Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৫৯/হে মুমিনগণ!:-৮০)
[* প্রত্যেকেই যেন লক্ষ রাখে, সে আগামীকালের (কিয়ামতের) জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে?:-
*তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে:-
**আল কোরআনের প্রভাব :-]
www.motaher21.net
সূরা:৫৯: আল্-হাশর।
পারা:২৮
১৮-২৪ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
২) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১৮
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ وَ لۡتَنۡظُرۡ نَفۡسٌ مَّا قَدَّمَتۡ لِغَدٍ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۸﴾
হে ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় করো। আর প্রত্যেকেই যেন লক্ষ রাখে, সে আগামীকালের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই তোমাদের সেই সব কাজ সম্পর্কে অবহিত যা তোমরা করে থাক।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-১৯
وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ نَسُوا اللّٰہَ فَاَنۡسٰہُمۡ اَنۡفُسَہُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿۱۹﴾
তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন। তারাই ফাসেক।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-২০
لَا یَسۡتَوِیۡۤ اَصۡحٰبُ النَّارِ وَ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ؕ اَصۡحٰبُ الۡجَنَّۃِ ہُمُ الۡفَآئِزُوۡنَ ﴿۲۰﴾
যারা দোজখে যাবে এবং যারা জান্নাতে যাবে তারা পরস্পর সমান হতে পারে না। যারা জান্নাতে যাবে তারাই সফলকাম।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-২১
لَوۡ اَنۡزَلۡنَا ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ عَلٰی جَبَلٍ لَّرَاَیۡتَہٗ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنۡ خَشۡیَۃِ اللّٰہِ ؕ وَ تِلۡکَ الۡاَمۡثَالُ نَضۡرِبُہَا لِلنَّاسِ لَعَلَّہُمۡ یَتَفَکَّرُوۡنَ ﴿۲۱﴾
আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে পেতে তা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা (নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে) ভেবে দেখে।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-২২
ہُوَ اللّٰہُ الَّذِیۡ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۚ عٰلِمُ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ ۚ ہُوَ الرَّحۡمٰنُ الرَّحِیۡمُ ﴿۲۲﴾
আল্লাহই সেই মহান সত্তা যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। অদৃশ্য ও প্রকাশ্য সবকিছুই তিনি জানেন। তিনিই রহমান ও রহীম।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-২৩
ہُوَ اللّٰہُ الَّذِیۡ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۚ اَلۡمَلِکُ الۡقُدُّوۡسُ السَّلٰمُ الۡمُؤۡمِنُ الۡمُہَیۡمِنُ الۡعَزِیۡزُ الۡجَبَّارُ الۡمُتَکَبِّرُ ؕ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۲۳﴾
আল্লাহ-ই সেই মহান সত্তা যিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। তিনি বাদশাহ, অতীব পবিত্র, পূর্ণাঙ্গ শান্তি, নিরাপত্তাদানকারী, হিফাযতকারী, সবার ওপর বিজয়ী, শক্তি বলে নিজের নির্দেশ কার্যকরী করতে সক্ষম। এবং সবার চেয়ে বড় হয়েই বিরাজমান থাকতে সক্ষম। আল্লাহ সেই সব শিরক থেকে পবিত্র যা লোকেরা করে থাকে।
সূরা:৫৯: আল্-হাশর:-২৪
ہُوَ اللّٰہُ الۡخَالِقُ الۡبَارِئُ الۡمُصَوِّرُ لَہُ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی ؕ یُسَبِّحُ لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿٪۲۴﴾
সেই পরম সত্তা তো আল্লাহ-ই যিনি সৃষ্টির পরিকল্পনাকারী, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের র্নিদেশ দানকারী এবং সেই অনুপাতে রূপদানকারী। উত্তম নামসমূহ তাঁর-ই। আসমান ও যমীনের সবকিছু তাঁর তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করে চলেছে। তিনি পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।
১৮-২৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:
ঘটনার বর্ণনা, তার পর্যালােচনা ও মন্তব্য এবং সুদূরপ্রসারী তত্ত্বসমূহের সাথে তার সংযােগ সাধনের এই পর্যায়ে সূরাটি মােমেনদের সম্বােধন করছে। ঈমানের দোহাই দিয়ে তাদের মনােযােগ সাথে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করে এবং তার আদেশ পালন সহজতর করে তােলে। সে গুণটি হলাে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। তাদের তাকওয়া অবলম্বন, আখেরাতের সম্বল সংগ্রহ, সার্বক্ষণিক সচেতনতা, আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে না যাওয়ার আহবান জানিয়ে বলা হচ্ছে, ‘হে মােমেনরা, আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করাে এবং প্রত্যেকের নযর দেয়া উচিত, সে আগামী কালের জন্যে কী পাঠিয়েছে…'(আয়াত ১৮-২০) তাকওয়া মনের একটা অবস্থার নাম, যার দিকে এই শব্দটি ইংগিত করে মাত্র, কিন্তু তার প্রকৃত ও পূর্ণ রূপ এর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে না। এটি এমন এক অবস্থার নাম, যা প্রতি মুহূর্তে মনকে আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন, সংবেদনশীল, সদাজাগ্রত ও সদাসতর্ক রাখে। তাকে সর্বদা এই মর্মে ভীতসন্ত্র ও লজ্জাশীল রাখে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন অবস্থায় যেন না দেখেন, যা তিনি অপছন্দ করেন। প্রত্যেক হৃদয়ের ওপরই প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর দৃষ্টি রয়েছে। কাজেই কতক্ষণ তার দৃষ্টির আড়ালে থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব? *সময় থাকতে নিজের হিসাব নেয়া : প্রত্যেকের নজর দেয়া উচিত সে আগামীকালের জন্যে কি পাঠিয়েছে? এখানে শব্দের চেয়ে মর্ম আরাে প্রশস্ত, আরাে ব্যাপক ও আরাে সুদূরপ্রসারী। হৃদয়ের ওপর সতর্ক তদারকি দৃষ্টি রাখলে মােমেনের চোখের সামনে তার আমলনামাই শুধু নয়, তার গােটা জীবনের হিসাব নিকাশই উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই আমলনামার প্রতিটি লাইন সে পড়ে দেখতে পারে এবং প্রতিটি খুঁটিনাটি থেকে বিস্তারিত বিষয় নিয়ে সে ভেবেও দেখতে পারে। এই আমলনামায় সে সহজেই দেখতে পারে আগামীকালের জন্য কী জিনিস পাঠিয়েছে। এই চিন্তা-ভাবনা তার দুর্বলতা, ঘাটতি ও ভুলক্রটির জায়গাগুলাে সম্পর্কে তাকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। সে যদি অনেক ভালাে কাজও করে থাকে, তথাপি এরূপ চিন্তা-ভাবনার অভ্যাস তাকে তার অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে, আর যার সৎকাজের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে, তার সম্পর্কে তাে কথাই নেই। বস্তুত এটা এমন এক কাজ যা করার পর অন্তর আর কখনাে শিথিল ও উদাসীন হবে না এবং কখনাে নিজের কাজকর্মের হিসাব গ্রহণে অলসতা দেখাবে না। আয়াতটি এভাবে অনুভূতি ও চেতনার মাঝে সাড়া জাগানাের পর ঈমানদারদের হৃদয়ে আবারাে এই বলে করাঘাত করছে, ‘তােমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের তৎপরতা সম্পর্কে জ্ঞাত।’ এ বাক্য দুটো মানুষের হৃদয়কে আবাে সচেতন, সতর্ক, লজ্জাশীল ও আরাে আল্লাহভীরু করে তােলে। এ আয়াতে যে সচেতনতা সতর্কতার আহবান জানানাে হয়েছে, তারই প্রসংগ ধরে পরবর্তী আয়াতে সাবধান করা হয়েছে যেন তারা সেই লােকদের মতাে না হয়, ‘যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদের আত্মভােলা বানিয়ে দিয়েছেন।’ এটা এক বিস্ময়কর অবস্থা হলেও সম্পূর্ণ বাস্তব। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভুলে যায়, সে দুনিয়ার জীবন নিয়ে এতাে মগ্ন হয়ে যায় যে, উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠতর জীবনের সাথে তার আর কোনাে সংযােগ থাকে না এবং তার জীবনের এমন কোনো মহত্তর লক্ষ্য থাকে না, যা তাকে ইতর প্রাণীর চেয়ে উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠতর প্রাণী বানাতে পারে। এতে করে সে ভুলেই যায় যে সে মানুষ। এই সত্য থেকে আর একটা সত্যেরও উদ্ভব ঘটে। সেটি এই যে, নিজেকে ভুলে যাওয়ার কারণে সে তার পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনের জন্যে কোনাে পাথেয় সংগ্রহ করে না এবং সে পাথেয় সংগ্রহ করার কথা ভাবেও না। ‘তারাই ফাসেক।’ অর্থাৎ তারা বিপথগামী। পরবর্তী আয়াতে ঘােষণা করা হয়েছে যে, তারা দোযখবাসী। মােমেনদের বলা হচ্ছে, তারা যেন জাহান্নামবাসীর পথ ছেড়ে দিয়ে জান্নাতবাসীর পথ অবলম্বন করে। জান্নাতবাসীর পথ জাহান্নামবাসীর পথ থেকে ভিন্ন। ‘দোযখবাসী ও বেহেশতবাসী সমান নয়, বেহেশতবাসীরাই সফলকাম।’ অর্থাৎ তাদের স্বভাব চরিত্র, চাল চলন, মত পথ ও পরিণতি সবই পরস্পরের বিপরীত। কোনােটাই এক রকম নয়। দুটো পথ এমনভাবে ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে গেছে যে, কোথাও তা একত্রে মিলিত হয় না। আকার আকৃতিতেও নয়, প্রকৃতি এবং নীতিতেও নয়। দুনিয়া ও আখেরাতের কোথাও তা এক কাতারে মিলিত হয় না। ‘জান্নাতবাসীরাই সফলকাম।’ এখানে কেবল জান্নাতবাসীর ফলাফল সম্পর্কেই বলা হয়েছে এবং জাহান্নামের অধিবাসীদের সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। ভাবখানা এই যে, ওটা তাে একটা ব্যর্থ ও ভ্রান্ত পথ, ওটা নিয়ে আবার আলােচনার কী আছে?
ফী জিলালিল কুরআন:
*আল কোরআনের প্রভাব : এরপর এমন একটা বক্তব্য আসছে যা সরাসরি হৃদয়ের অভ্যন্তরে ঢুকে যায় এবং তাতে তীব্র এক ঝাকুনির সৃষ্টি করে। এতে দেখানাে হয়েছে, কোরআন জমাট পাথরের ওপর নাযিল হলে তাকেও প্রভাবিত করবে, ‘যদি আমি পাহাড়ের ওপর এই কোরআন নাযিল করতাম, তবে তুমি সেই পাহাড়কেও আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে যেতে দেখতে।’ এটা একটা কাল্পনিক দৃশ্য হলেও বাস্তবতাকে মােটামুটি প্রতিফলিত করছে। কেননা কোরআনের এমন একটা ভারিত্ব, শক্তি ও প্রভাব রয়েছে, যা অন্য জিনিসকে প্রকম্পিত করে এবং যে একে এর প্রকৃত মর্ম সহকারে গ্রহণ করে, সে স্থির থাকতে পারে না। একবার হযরত ওমর(রা.) যখন এক ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত আয়াতগুলাে পড়তে শুনলেন, তখন তার ভেতরে এমন প্রতিক্রিয়া হলাে যে, তিনি দেয়ালের ওপরে হেলে পড়লেন এবং কিছুক্ষণ পর তিনি বাড়ীতে ফিরে গেলেন। এক মাস পর্যন্ত তার অসুস্থ ছিলেন এবং লােকজন তাকে দেখতে গিয়েছিলাে। সে আয়াতগুলাে ছিলাে এই, ‘তুর পাহাড়ের শপথ, লিপিবদ্ধ পুস্তকের শপথ, উন্মুক্ত পত্রের শপথ, বায়তুল মা’মুরের শপথ, সুউচ্চ আসমানের শপথ, উত্তাল সমুদ্রের শপথ, তােমার প্রভুর শপথ, নিশ্চয় তােমার প্রভুর শাস্তি অবধারিত, কেউ তা ঠেকাতে পারবে না…’ কিছু কিছু মুহূর্ত এমন আছে, যখন মানবসত্তা কোরআনের কিছু নির্যাস গ্রহণ করার জন্যে উন্মুক্ত ও উন্মত্ত হয়ে থাকে। কোরআন শােনার পর মানবসত্তা আপন মনে এমন কল্পনা ও ঝাঁকুনি অনুভব করে এবং তার ভেতরে এমন কিছু পরিবর্তন সংঘটিত হয়, যা বস্তুজগতে বিদ্যুৎ ও চুম্বকের ন্যায় কাজ করে বা তার চেয়েও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালা পাহাড়েরও সৃষ্টিকর্তা, কোরআনেরও নাযিলকারী। তিনিই বলেছেন, ‘যদি আমি পাহাড়ের ওপর এই কোরআন নাযিল করতাম…’ যারা তাদের সত্তায় কোরআনের পরশ অনুভব করেছে, তারা এই সত্যটা এমনভাবে উপভােগ ও উপলব্ধি করে, যাকে এই আয়াতের ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব। ‘এ হচ্ছে এমন সব উদাহরণ, যা আমি মানুষের জন্যে পেশ করে থাকি যাতে তারা চিন্তা করে।’ অর্থাৎ এগুলাে মানুষের মনে চিন্তার প্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টির যােগ্যতাসম্পন্ন আয়াত।
ফী জিলালিল কুরআন:
*আসমাউল হুসনা : সবার শেষে আসছে মহান আল্লাহর সুন্দরতম নামসমূহযুক্ত তাসবীহগুলাে। এ তাসবীহগুলাে যেন সমগ্র বিশ্বজগতের অস্তিত্বমূলে এবং তার যাবতীয় তৎপরতায় ও গুণবৈশিষ্ট্যে সুস্পষ্টভাবে বিরাজমান রয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতি শুধু আল্লাহর প্রশংসাই করে না; বরং সেই সাথে তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে দিয়ে তার স্বাক্ষরও দেয়, “তিনি সেই মহান আল্লাহ, যিনি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই। তিনি গােপন ও প্রকাশ্য যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত। তিনি পরম দাতা ও দয়ালু। তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা, যিনি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই। তিনি মহা সম্রাট, পবিত্র, পরম শান্তিময়, নিরাপত্তাদাতা, আধিপত্যশীল, মহাপরাক্রমশালী, একনায়ক, অহংকারী এবং যাবতীয় শিরক থেকে তিনি পবিত্র। তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা, যিনি সৃষ্টিকর্তা, আদি স্রষ্টা ও পরিকল্পনাকারী। সুন্দরতম নামগুলাে শুধু তারই। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তার গুণকীর্তন ও মহিমা ঘােষণা করে; তিনি মহা পরাক্রমশালী ও মহা প্রজ্ঞাময়।” এ হচ্ছে পবিত্রতম গুণাবলী সম্বলিত এক বিস্তারিত প্রশংসা। এ প্রশংসা তিন পর্বে সম্পন্ন। প্রতিটি পর্বই তাওহীদের বক্তব্য দ্বারা সজ্জিত। যথা ‘তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই।’ এই সুন্দরতম নামগুলাের মধ্য থেকে প্রতিটি নামের প্রভাবই এ বিশ্বজগতে দৃশ্যমান এবং মানব জীবনেই অনুভূত। এই নাম ও গুণাবলী মানুষের হৃদয়কে তার কার্যকারিতা সম্পর্কে অবহিত করে। মানবজগত ও জীবজগতের ওপর তার ইতিবাচক কার্যকারিতা বিস্তৃত হয়। এ গুণবাচক নামগুলো নেতিবাচক নয়, বিশ্বজগত থেকে বিচ্ছিন্নও নয়। বিশ্বজগতের সহজাত ও অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য এবং অবস্থা থেকে তা সংস্রবহীনও নয়। ‘তিনিই সেই মহান আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই।’ উক্তিটি দ্বারা মানুষের বিবেককে আকীদাগত একত্ব, এবাদাতের একত্ব এবং সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্বের একত্ব ও একাধিপতিত্বের ধারণা দেয়া হয়েছে, আর এই একত্ব থেকে তাদের চিন্তা, চেতনা, কর্ম, আচরণ, বিশ্ব প্রকৃতি ও যাবতীয় প্রাণীর মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং সংযােগ সাধিত হয়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্বের ভিত্তিতে একটা পূর্ণাংগ বিধান রচিত হয়। গােপন ও প্রকাশ্য যাবতীয় বিষয়ে তিনি অবহিত- এ কথা দ্বারা মন মগযে এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, গােপন ও প্রকাশ্য সকল বিষয়ে আল্লাহর জ্ঞান সর্বাত্মক। এ কারণে মন মগয গোপন ও প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহ সম্পর্কে সাবধান হয়ে যায়। মানুষ সেই কাজই করে যা একমাত্র সর্বক্ষণ আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে সচেতন থাকলেই করা যায়। মানুষ একাকী অবস্থান করলেও সে একা নয়- এ চেতনা তার মনে বদ্ধমূল থাকে। আর এই চেতনার আলােকেই তার যাবতীয় আচরণ গঠিত হয়। এরপর তার মন কিছুতেই অসচেতন ও উদাসীন হয় না। তিনি পরম দাতা ও দয়ালু।’ এ উক্তি দ্বারা আল্লাহর করুণা ও বদান্যতার ব্যাপারে এক দৃঢ় আস্থা তার অন্তরে বদ্ধমূল হয় এবং ভীতি ও আশা, উদ্বেগ ও নিশ্চিন্ততার মাঝে একটা ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। মােমেনের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এরূপ ধারণা বদ্ধমূল থাকে যে, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের কখনাে তাড়িয়ে দেন না, তাকে তিনি সতর্ক করেন আর তার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও তদারক করেন। তাদের সৎপথে চলা তিনি পছন্দ করেন। তাদের অকল্যাণ, ক্ষতি ও অসৎ কাজে লিপ্ত হওয়া তিনি পছন্দ করেন না। তারা যখন অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন তাদের তিনি অসহায়ভাবে ছেড়ে দেন না। দ্বিতীয় আয়াতেও এ কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তিনিই সেই আল্লাহ যিনি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই। আসলে এই মূলনীতির ওপরই তার যাবতীয় গুণাবলী প্রতিষ্ঠিত। ‘আল মালিক’ বা সম্রাট, এ দ্বারা অন্তরে এই ধারণা জন্মে যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনাে মাবুদ যেমন নেই, তেমনি কোনাে রাজাও নেই। তিনি যখন একাই রাজা ও একাই সম্রাট, তখন তিনি প্রজাদের একমাত্র প্রভুও। সবাই একমাত্র সেই প্রভুর অনুগত হবে, সেই প্রভুর সেবা করবে এটাই স্বাভাবিক। কোনাে মানুষ একই সময়ে একাধিক প্রভুর সেবা বা দাসত্ব করতে পারে না। ‘আল্লাহ তায়ালা কোনাে মানুষের অভ্যন্তরে দুটো হৃদয় সৃষ্টি করেননি।'(সূরা আহযাব) ‘আল কুদ্দুস’ বা মহাপবিত্র। এই গুণবাচক নামটি মানুষের মনে সর্বত্রই ও সর্বাত্মক পরিচ্ছন্নতার ধারণা জন্ম দেয়। এ দ্বারা মানুষের মন পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়, যাতে তা মহাপবিত্র সম্রাট আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ লাভের যােগ্য হয়। ‘আস সালাম’ বা শান্তিময়। এ নামটিও বিশ্ব জগতে শান্তি, নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততার বিস্তার ঘটায়। মােমেনের অন্তরে তার প্রভু সম্পর্কে শাস্তি এনে দেয়। তাই সে তার চারপাশের সকল বস্তু, প্রাণী ও মানুষের প্রতি শান্তিময় ও কল্যাণময় হয়ে যায়। এই নাম থেকে মানুষের মন লাভ করে পরম শান্তি, পরিতৃপ্তি ও নিরাপত্তা। তার প্রবৃত্তি এতে শান্ত হয়, তার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূরীভূত হয় এবং তার সকল অতৃপ্তির নিরসন ঘটে। ‘আল মু’মিন’ অর্থাৎ নিরাপত্তাদাতা ও ঈমানদাতা। এই নামটি উচ্চারণ করা মাত্রই হৃদয়ে ঈমানের গুরুত্ব অনুভূত হয়। কেননা এই নামটিতে সে আল্লাহর সাথে মিলিত হয় এবং আল্লাহর একটি গুণ ‘মু’মিন’ দ্বারা নিজেও গুণান্বিত হয়। তাই সে ঈমান যারা মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছে যায়। ‘আল মুহাইমিন’- এ শব্দটি দ্বারা আল্লাহর গুণাবলীর আর একটা অধ্যায় সূচিত হয়। ইতিপূর্বে যে গুণগুলাে শুধু আল্লাহর ব্যক্তিগত গুণ ছিলাে, কিন্তু আল্লাহর এ গুণটি বিশ্ব প্রকৃতির সাথে ও মানব জাতির সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি গুণ। এগুলাে বিশ্বময় কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। অনুরূপভাবে ‘আল আযীয’, ‘আল জাব্বার’ ও ‘আল মুতাকাব্বির’ অর্থাৎ যথাক্রমে মহাপরাক্রমশালী, একনায়ক ও অহংকারী। বস্তুত এগুলাে আল্লাহর প্রতাপ, পরাক্রম, শ্রেষ্ঠত্ব, কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও একনায়কত্বের ধারণা দেয়। তিনি ছাড়া আর কেউ প্রতাপশালী নেই, কেউ একনায়ক নেই, আর কেউ অহংকারী নেই। তার এই গুণাবলীতে কেউ তার সাথে অংশীদার নেই। তিনি ছাড়া আর কেউ এসব শুণে গুণান্বিত নয়। তিনি এককভাবে এসব গুণের অধিকারী। তাই আয়াতের শেষ ভাগে বলা হয়েছে, তাদের শিরক থেকে আল্লাহ পবিত্র তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা, অর্থাৎ তিনি একক মাবুদ। তিনি ছাড়া আর কেউ মাবুদ নেই। ‘আল খালেক’ অর্থাৎ স্রষ্টা। সৃষ্টির পরিকল্পনা ও ভাগ্য নির্ধারণ এর অন্তর্ভুক্ত। আর ‘আল বারিউ’ অর্থে ভাগ্য নির্ধারণ বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত। আর ‘আল বারিউ’ শব্দের অর্থও স্রষ্টা। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকটা এতে বেশী প্রাধান্য পায়। এই দুটো গুণ অত্যন্ত কাছাকাছি এবং এ দুটোর পার্থক্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম। ‘আল মুসাওয়িরু’-এর অর্থও পরিকল্পক, অর্থাৎ প্রত্যেক জিনিসকে তার যথাযথ বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শনাদি দিয়ে স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তাদানকারী। এই সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্বলিত, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত গুণাবলী মানুষের মন মগযকে, মানবীয় চিন্তাধারা অনুযায়ী তার মনকে সৃষ্টি ও সৃষ্টির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম ধাপে ধাপে পর্যবেক্ষণ করার প্রেরণা যােগায়, কিন্তু বাস্তব জগতে এসব পর্যায়ক্রমিকতা নেই। আমরা এই গুণবাচক নামগুলাে থেকে শাব্দিকভাবে যা বুঝতে পারি, সেটাই তার প্রকৃত ও সর্বাত্মক রূপ নয়। প্রকৃত রূপ একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। আমরা কেবল আমাদের সীমিত বােধশক্তির আওতায় তার কিছুটা নিদর্শন জানতে ও বুঝতে পারি মাত্র। ‘সর্বোত্তম ও সুন্দরতম নামগুলাে শুধু তার।’ অর্থাৎ নামগুলাে প্রকৃতপক্ষে সুন্দরতম, কেউ তাকে সুন্দরতম বলে স্বীকার করুক বা না করুক, তাতে কিছু এসে যায় না। সুন্দরতম তাকেই বলা হয়, যা অন্তরকে সর্বোত্তম সৌন্দর্যের ধারণা দেয় ও সৌন্দর্য দিয়ে মনকে ভরে দেয়। এই নামগুলাে নিয়ে মােমেনের চিন্তা ভাবনা করা উচিত। যাতে এর প্রেরণা ও চেতনার আলােকে নিজেকে তারা গড়ে তুলতে পারে। কেননা সে এ দ্বারা জানতে পারে, আল্লাহ তায়ালা এ সব গুণ দ্বারা বান্দার গুণান্বিত হওয়া পছন্দ করেন। এ থেকে তার নিজেকে উন্নতি ও উৎকর্ষের দিকে ধাবিত করা উচিত। সুন্দরতম নামগুলাের তাসবীহ বা প্রশংসা শেষ হলাে। সূরার শেষাংশে এসে সমগ্র বিশ্বজগতকে আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহে মুখরিত দেখানাে হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সকলেই তাঁর গুণগান ও প্রশংসা করে এবং তিনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ বস্তুত এই গুণাবলীর উল্লেখের পরে স্বভাবতই প্রত্যেকের মনে এই দৃশ্যই প্রত্যাশিত হয়ে ওঠে এবং সকল জড় ও জীবের সাথে সে নিজেও এখানে অংশ গ্রহণ করে। আর এই একই বক্তব্য দিয়ে সূরা শুরু এবং শেষ হওয়ায় এর সমন্বয়েও পূর্ণতা লাভ করেছে।
১৮-২৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# কুরআন মজীদের নিয়ম হলো, যখনই মুনাফিক মুসলমানদের মুনাফিকসুলভ আচরণের সমালোচনা করা হয় তখনই তাদেরকে নসীহতও করা হয়। যাতে তাদের যার যার মধ্যে এখনো কিছুটা বিবেক অবশিষ্ট আছে সে যেন তার এই আচরণে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহকে ভয় করে ধ্বংসের সেই গহবর থেকে উঠে আসার চিন্তা করে যার মধ্যে সে প্রকৃতির দাসত্বের কারণে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ রুকূ’ পুরোটাই এ ধরনের নসীহতে পরিপূর্ণ।
# আগামীকাল অর্থ আখেরাত। দুনিয়ার এই গোটা জীবনকাল হলো, ‘আজ’ এবং কিয়ামতের দিন হলো আগামীকাল যার আগমণ ঘটবে আজকের এই দিনটির পরে। এ ধরনের বাচনভঙ্গির মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা অত্যন্ত বিজ্ঞোচিতভাবে মানুষকে বুঝিয়েছেন যে, ক্ষণস্থায়ী আনন্দ উপভোগ করার জন্য যে ব্যক্তি তার সবকিছু ব্যয় করে ফেলে এবং কাল তার কাছে ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্য আর মাথা গুঁজবার ঠাই থাকবে কিনা সে কথা চিন্তা করে না সেই ব্যক্তি এ পৃথিবীতে বড় নির্বোধ। ঠিক তেমনি ঐ ব্যক্তিও নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করছে যে তার পার্থিব জীবন নির্মাণের চিন্তায় এতই বিভোর যে আখেরাত সম্পর্কে একেবারেই গাফেল হয়ে গিয়েছে। অথচ আজকের দিনটির পরে কালকের দিনটি যেমন অবশ্যই আসবে তেমনি আখেরাতও আসবে। আর দুনিয়ার বর্তমান জীবনে যদি সে সেখানকার জন্য অগ্রিম কোন ব্যবস্থা না করে তাহলে সেখানে কিছুই পাবে না। এর সাথে দ্বিতীয় জ্ঞানগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এ আয়াতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের হিসেব পরীক্ষক বানানো হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তির মধ্যে ভাল এবং মন্দের পার্থক্যবোধ সৃষ্টি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আদৌ সে অনুভব করতে পারে না যে, সে যা কিছু করছে তা তার আখেরাতের জীবনকে সুন্দর ও সুসজ্জিত করছে, না ধ্বংস করছে। তার মধ্যে এই অনুভূতি যখন সজাগ ও সচেতন হয়ে ওঠে তখন তার নিজেকেই হিসেব-নিকেশ করে দেখতে হবে, সে তার সময়, সম্পদ, শ্রম, যোগ্যতা এবং প্রচেষ্টা যে পথে ব্যয় করছে তা তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করা তার নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন। অন্যথায় সে নিজের ভবিষ্যত নিজেই ধ্বংস করবে।
# আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার অনিবার্য ফল হলো নিজেকে ভুলে যাওয়া, সে কার বান্দা সে কথা যখন কেউ ভুলে যায়, তখন অনিবার্যরূপে সে দুনিয়ায় তার একটা ভুল অবস্থান ঠিক করে নেয়। এই মৌলিক ভ্রান্তির কারণে তার গোটা জীবনই ভ্রান্তিতে পর্যবসতি হয়। অনুরূপভাবে সে যখন একথা ভুলে যায় যে সে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো বান্দা নয় তখন আর সে শুধু সেই এদের বন্দেগী করে না। এমতাবস্থায় সে প্রকৃতই যার বান্দা তাকে বাদ দিয়ে যাদের সে বান্দা নয় এমন অনেকের বন্দেগী করতে থাকে। এটা আর একটি মারাত্মক ও সর্বাত্মক ভুল যা তার গোটা জীবনকেই ভুলে পরিণত করে। পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান হলো সে বান্দা বা দাস, স্বাধীন বা মুক্ত নয়। সে কেবল এক আল্লাহর বান্দা, তার ছাড়া আর কারো বান্দা সে নয়। একথাটি যে ব্যক্তি জানে না প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই নিজেকে জানে না। আর যে ব্যক্তি একথাটি জেনেও এক মুহূর্তের জন্যও তা ভুলে যায় সেই মুহূর্তে সে এমন কোন কাজ করে বসতে পারে যা কোন আল্লাহদ্রোহী বা মুশরিক অর্থাৎ আত্মবিস্মৃত মানুষই করতে পারে। সঠিক পথের ওপর মানুষের টিকে থাকা পুরোপুরি নির্ভর করে আল্লাহকে স্মরণ করার ওপর। আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে গাফেল হওয়া মাত্রই সে নিজের সম্পর্কেও গাফেল হয়ে যায় আর এই গাফলতিই তাকে ফাসেক বানিয়ে দেয়।
# এই উপমার তাৎপর্য হলো, কুরআন যেভাবে আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য এবং তাঁর কাছে বান্দার দায়িত্ব ও জবাবদিহির বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে পাহাড়ের মত বিশাল সৃষ্টিও যদি তার উপলব্ধি লাভ করতে পরতো এবং কেমন পরাক্রমশালী ও সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী প্রভুর সামনে নিজের সব কাজকর্মের জবাবদিহি করতে হবে তা যদি জানতো তাহলে সেও ভয়ে কেঁপে উঠতো। কিন্তু সে মানুষ কুরআনকে বুঝতে পারে এবং কুরআনের সাহায্যে সবকিছুর তাৎপর্য ও বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছে, কিন্তু এরপরও তার মনে কোন ভয়-ভীতি সৃষ্টি হয় না কিংবা যে কঠিন দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হয়েছে সে সম্পর্কে তার আল্লাহকে কি জবাব দেবে সে বিষয়ে আদৌ কোন চিন্তা তার মনে জাগে না। বরং কোরআন পড়ার বা শোনার পরও সে এমন নির্লিপ্তি ও নিষ্ক্রীয় থাকে যেন একটি নিষ্প্রাণ ও অনুভূতিহীন পাথর। শোনা, দেখা ও উলপব্দি করা আদৌ তার কাজ নয়। মানুষের এই চেতানাহীনতা ও নিরুদ্বিগ্নতা বিষ্মরকর বৈকি। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আহযাব, টীকা ১২০)।
# এ আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার কাছে এই কুরআন পাঠানো হয়েছে যিনি তোমার ওপর এসব দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এবং যাঁর কাছে অবশেষে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে সেই আল্লাহ কেমন এবং তাঁর গুণাবলী কি? উপরোল্লেখিত বিষয়টি বর্ণনার পর পরই আল্লাহর গুণাবলীর বর্ণনা আপনা থেকেই মানুষের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি করে যে, তার লেনদেন ও বুঝা পড়া কোন সাধারণ সত্তার সাথে নয়, বরং এমন এক জবরদস্ত সত্তার সাথে যিনি এসব গুণাবলীর অধিকারী। এখানে এ বিষয়টি জেনে নেয়া দরকার যে, যদিও কোরআন মজীদে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর গুণাবলী এমন অনুপম ভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে যা থেকে আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণালাভ করা যায়। কিন্তু দু’টি স্থান বিশেষভাবে এমন যেখানে আল্লাহ তা’আলার গুণাবলীর ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক বর্ণনা পাওয়া যায়। এর একটি হলো, সূরা বাকারার আয়াতুল কুরসী ( ২৫৫ আয়াত) অপরটি হলো সূরা হাশরের এই আয়াতগুলো।
# যিনি ছাড়া আর কারোই ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অবস্থান এমন নয় যে, তার বন্দেগী ও আরাধনা করা যেতে পারে। যিনি ছাড়া আর কেউ আল্লাহর গুণাবলী ও ক্ষমতার মালিকই নয় যে, সে উপাস্য হওয়ার অধিকার লাভ করতে পারে।
# সৃষ্টির কাছে যা গোপন ও অজানা তিনি তাও জানেন আর যা তাদের কাছে প্রকাশ্য ও জানা তাও তিনি জানেন। এই বিশ্ব-জাহানের কোন বস্তুই তার জ্ঞানের বাইরে নয়। যা অতীত হয়ে গিয়েছে, যা বর্তমানে আছে যা ভবিষ্যতে হবে তার সবকিছুই তিনি সরাসরি জানেন। এসব জানার জন্য তিনি কোন মাধ্যমের মুখাপেক্ষী নন।
# একমাত্র তিনিই এমন এক সত্তা যার রহমত অসীম ও অফুরন্ত সমগ্র বিশ্ব চরাচরব্যাপী পরিব্যাপ্ত এবং বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসই তার বদান্যতা ও অনুগ্রহই লাভ করে থাকে। গোটা বিশ্ব-জাহানে আর একজনও এই সর্বাত্মক ও অফুরন্ত রহমতের অধিকারী নেই। আর যেসব সত্তার মধ্যে দয়ামায়ার এই গুণটি দেখা যায় তা আংশিক ও সীমিত। তাও আবার তার নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। বরং স্রষ্টা কোন উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন সামনে রেখে তা তাকে দান করেছেন। তিনি কোন সৃষ্টির মধ্যে দয়ামায়ার আবেগ অনুভূতি সৃষ্টি করে থাকলে তা এ জন্য করেছেন যে, তিনি একটি সৃষ্টিকে দিয়ে আরেকটি সৃষ্টির প্রতিপালন ও সুখ-স্বচ্ছন্দের ব্যবস্থা করতে চান। এটাও তারই রহমতের প্রমাণ।
# মূল আয়াতে الملك শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ প্রকৃত বাদশাহ তিনিই। তাছাড়া শুধু الملك শব্দ ব্যবহার করায় তার অর্থ দাঁড়ায় তিনি কোন বিশেষ এলাকা বা নির্দিষ্ট কোন রাজ্যের বাদশাহ নন, বরং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ। তার ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্ব সমস্ত সৃষ্টিজগত জুড়ে পরিব্যাপ্ত। প্রতিটি বস্তুর তিনিই মালিক। প্রতিটি বস্তু তার ইখতিয়ার ক্ষমতা এবং হুকুমের অধীন। তার কর্তৃত্ব তথা সার্বভৌম ক্ষমতাকে (Sovereignty) সীমিত করার মত কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তা’আলার বাদশাহীর এ দিকগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছেঃ
وَلَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَهُ قَانِتُونَ (الروم : 26)
“আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তা সব তারই মালিকানাধীন। সবাই তার নির্দেরশের অনুগত।”( আর রুম-২৬ )
يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ (السجدة : 5) “আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সব কাজের ব্যবস্থাপনা তিনিই পরিচালনা করে থাকেন।”
لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ (الحديد : 5)
“আসমান ও যমীনের বাদশাহী তাঁরই। সব বিষয় আল্লাহর দিকেই রুজু করা হবে।” وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ (الفرقان : 2) “বাদশাহী ও সার্বভৌমত্বে কেউ তাঁর অংশীদার নয়।”
بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ (يس : 82)
“সবকিছুর কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা তাঁরই হাতে।” (ইয়াসীন- ৮২ )
فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ- (البروج : 16)
“যা ইচ্ছা তাই করতে সক্ষম”(আল বুরুজ- ১৬ )
لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ- (الانبياء : 23)
“তিনি যা করেন তার জন্য তাকে কারো জবাবদিহি করতে হয় না। তবে অন্য সবাইকে জবাবদিহি করতে হয়।”
اللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ- (الرعد : 41)
“আল্লাহ ফয়সালা করেন। তাঁর ফয়সালা পুনর্বিবেচনাকারী কেউ নেই।”
وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ (المؤمنون : 88)
“তিনিই আশ্রয় দান করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ আশ্রয় দিতে পারে না। (আল মু’মিনূন, ৮৮ )
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (ال عمران : 26)
“বলো, হে আল্লাহ, বিশ্ব-জাহানের মালিক! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর এবং যার নিকট থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও। তুমি যাকে ইচ্ছা মর্যাদা দান করো আবার যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত কর। সমস্ত কল্যাণ তোমার আয়ত্বে। নিঃসন্দেহে তুমি সব বিষয়ে শক্তিমান।”(আলে ইমরান, ২৬ )
এসব স্পষ্ট ঘোষণা থেকে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহ তা’আলার বাদশাহী সার্বভৌমত্ব কোন সীমিত বা রূপক অর্থের বাদশাহী নয়, সত্যিকার বাদশাহী যা সার্বভৌমত্বের পূর্ণাংগ অর্থ ও পূর্ণাংগ ধারণার মূর্তপ্রতীক। সার্বভৌম ক্ষমতা বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বুঝায় তার অস্তিত্ব তার বাস্তবে কোথাও থাকলে কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলার বাদশাহীতেই আছে। তাঁকে ছাড়া আর যেখানেই সার্বভৌম ক্ষমতা থাকার দাবী করা হয় তা কোন বাদশাহী বা ডিক্টেটরের ব্যক্তিসত্তা, কিংবা কোন শ্রেণী বা গোষ্ঠী অথবা কোন বংশ বা জাতি যাই হোক না কেন প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়। কেননা যে ক্ষমতা অন্য কারো দান, যা কোন সময় পাওয়া যায় এবং আবার এক সময় হাতছাড়া হয়ে যায়, অন্য কোন শক্তির পক্ষ থেকে যা বিপদেরআশঙ্কা করে, যার প্রতিষ্ঠা ও টিকে থাকা সাময়িক এবং অন্য বহু প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের গণ্ডি সীমিত করে দেয় এমন সরকার বা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে আদৌ সার্বভৌম ক্ষমতা বলা হয় না। কিন্তু কুরআন মজীদ শুধু একথা বলেই ক্ষান্ত হয় না যে, আল্লাহ তা’আলা গোটা বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ। এর সাথে পরবর্তী আয়াতাংশগুলোতে স্পষ্ট করে বলেছে, তিনি এমন বাদশাহ যিনি, ’কুদ্দুস’, ’সালাম’, ‘মু’মিন’, ’মুহাইমিন’, ’আযীয’, ‘জাব্বার’, ‘মুতাকাব্বির’, ‘খালেক’, ‘বারী’এবং ‘মুছাওবির’।
# মূল ইবারতে قدوس শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা আধিক্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এর মূল ধাতু قدس । قدس অর্থ সবরকম মন্দ বৈশিষ্ট্য মুক্ত ও পবিত্র হওয়া। قدوس অর্থ হলো, আল্লাহ তা’আলার পবিত্র সত্তা কোন প্রকার দোষ-ত্রুটি অথবা অপূর্ণতা কিংবা কোন মন্দ বৈশিষ্ট্যের অনেক উর্ধ্বে। বরং তা এক অতি পবিত্র সত্তা যার মন্দ হওয়ার ধারণাও করা যায় না। এখানে একথাটি ভালভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, চরম পবিত্রতা প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্বের প্রাথমিক অপরিহার্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত যে সত্তা দুষ্ট, দুশ্চরিত্র এবং বদনিয়াত পোষণকারী, যার মধ্যে মানব চরিত্রের মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান এবং যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের অধিনস্তরা কল্যাণ লাভের প্রত্যাশী হওয়ার পরিবর্তে অকল্যাণের ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে এমন সত্তা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে এটা মানুষের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি ও স্বাভাব-প্রকৃতি মেনে নিতে অস্বীকার করে। এ কারণে মানুষ যাকেই সার্বভৌম ক্ষমতার আধার বলে স্বীকৃতি দেয় তার মধ্যে পবিত্রতা না থাকলেও তা আছে বলে ধরে নেয়। কারণ পবিত্রতা ছাড়া নিরংকুশ ক্ষমতা অকল্পনীয়। কিন্তু এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, আল্লাহ ছাড়া কোন চূড়ান্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি পবিত্র নয় এবং তা হতেও পারে না। ব্যক্তিগত বাদশাহী, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি, অন্য কোন পদ্ধতির মানবীয় সরকার যাই হোক না কেন কোন অবস্থায়ই তার সম্পর্কে চরম পবিত্রতার ধারণা করা যেতে পারে না।
# মূল আয়াতে السلام শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ শান্তি। কাউকে ‘সুস্থ’ও ‘নিরাপদ’না বলে ‘নিরাপত্তা’বললে আপনা থেকেই তার মধ্যে আধিক্য অর্থ সৃষ্টি হয়ে যায়। যেমন কাউকে সুন্দর না বলে যদি সৌন্দর্য বলা হয় তাহলে তার অর্থ হবে সে আপাদমস্তক সৌন্দর্যমণ্ডিত। সুতরাং আল্লাহ তা’আলাকে السلام বলার অর্থ তার গোটা সত্তাই পুরোপুরি শান্তি। কোন বিপদ, কোন দুর্বলতা কিংবা অপূর্ণতা স্পর্শ করা অথবা তাঁর পূর্ণতায় কোন সময় ভাটা পড়া থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।
# মূল আয়াতে المؤمن শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটির মূল ধাতু হলো امن । امن অর্থ ভয়ভীতি থেকে নিরাপদ হওয়া। তিনিই মু’মিন যিনি অন্যকে নিরাপত্তা দান করেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টিকে নিরাপত্তা দান করেন তাই তাঁকে মু’মিন বলা হয়েছে। তিনি কোন সময় তাঁর সৃষ্টির ওপর জুলুম করবেন, কিংবা তার অধিকার নাস্যাত করবেন কিংবা তার পুরস্কার নষ্ট করবেন অথবা তার কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করবেন এ ভয় থেকে তার সৃষ্টি পুরোপুরি নিরাপদ। আর কর্তার কোন কর্ম অর্থাৎ তিনি কাকে নিরাপত্তা দেবেন তা যেহেতু উল্লেখিত হয়নি বরং শুধু المؤمن বা নিরাপত্তা দানকারী বলা হয়েছে তাই আপনা থেকে এর অর্থ দাঁড়ায় গোটা বিশ্ব-জাহান ও তার সমস্ত জিনিসের জন্য তাঁর নিরাপত্তা।
# মূল আয়াতে اَلْمُهَيْمِنَ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটির তিনটি অর্থ হয়। এক, তত্ত্বাবধান ও হিফাজতকারী। দুই, পর্যবেক্ষণকারী, কে কি করছে তা যিনি দেখছেন। তিন, সৃষ্টির যাবতীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপক, যিনি মানুষের সমস্ত প্রয়োজন ও অভাব পূরণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এখানেও যেহেতু শুধু المهيمن শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই কর্তার কোন কর্ম নির্দেশ করা হয়নি। অর্থাৎ তিনি কার তত্বাবধানকারী ও সংরক্ষক, কার পর্যবেক্ষক এবং কার দেখা শোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তা বলা হয়নি। তাই শব্দের এ ধরনের প্রয়োগ থেকে স্বতঃই যা অর্থ দাঁড়ায় তা হলো তিনি সমস্ত সৃষ্টির তত্বাবধান ও সংরক্ষণ করছেন, সবার কাজকর্ম দেখছেন এবং বিশ্ব-জাহানের সমন্ত সৃষ্টির দেখাশোনা, লালন-পালন এবং অভাব ও প্রয়োজন পুরণের দায়িত্ব গ্রহণ করছেন।
# মূল ইবারতে العزيز শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ এমন এক পরাক্রমশালী সত্তা যার মোকাবিলায় অন্য কেউ মাথা তুলতে পারে না, যার সিদ্ধান্তসমূহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সাধ্য করো নেই এবং যার মোকাবিলায় সবাই অসহায় ও শক্তিহীন।
# মূল আয়াতে الجبار শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর শব্দমূল বা ধাতু হলো جبر । جبر শব্দের অর্থ কোন বস্তুকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঠিক করা, কোন জিনিসকে শক্তি দ্বারা সংশোধন করা। যদিও আরবী ভাষায় جبر শব্দটির কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু সংশোধন অর্থে এবং কোন কোন সময় শুধু জবরদস্তি বা বল প্রয়োগ অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ হলো, সংস্কার ও সংশোধনের জন্য শক্তি প্রয়োগ করা। সুতরাং আল্লাহ তা’আলাকে جبار বলার অর্থ হলো বল প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি সৃষ্ট বিশ্ব-জাহানের শৃংখলা রক্ষাকারী এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নকারী, যদিও তাঁর ইচ্ছা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান ও যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়াও جبار শব্দটির মধ্যে বড়ত্ব ও মহত্ববোধক অর্থও বিদ্যমান। খেজুরের যে গাছ অত্যন্ত উঁচু হওয়ার কারণে তার ফল সংগ্রহ করা কারো জন্য সহজসাধ্য নয় আরবী ভাষায় তাকে জাব্বার বলে। অনুরূপ যে কাজ অত্যন্ত গুরুত্ব বা জাকজমকপূর্ণ তাকে জাব্বার বা অতি বড় কাজ বলা হয়।
# মূল আয়াতে اَلْمُتَكَبِّرُ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটির দু’টি অর্থ। এক, যে প্রকৃতপক্ষে বড় নয়, কিন্তু খামাখা বড়ত্ব জাহির করে। দুই, যে প্রকৃতপক্ষেই বড় এবং বড় হয়েই থাকে। মানুষ হোক, শয়তান হোক, বা অন্য কোন মাখলুক হোক, যেহেতু প্রকৃতপক্ষে তার কোন বড়ত্ব মহত্ব নেই, তাই নিজেকে নিজে বড় মনে করা এবং অন্যদের কাছে নিজের বড়ত্ব ও মহত্ব জাহির করা একটা মিথ্যা দাবী ও জঘন্য দোষ। অপর দিকে আল্লাহ তা’আলা প্রকৃতই বড়, বড়ত্ব বাস্তবে তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট এবং বিশ্ব-জাহানের সব বস্তু তাঁর সামনে ক্ষুদ্র ও নগণ্য। তাই তাঁর বড় হওয়ার এবং বড় হয়ে থাকা নিছক কোন দাবী বা ভান নয়। বরং একটি বাস্তবতা। এটি কোন খারাপ বা মন্দ বৈশিষ্ট্য নয়, বরং একটি গুণ ও সৌন্দর্য যা তাঁর ছাড়া আর কারো মধ্যে নেই।
# যারাই তাঁর ক্ষমতা, ইখতিয়ার ও গুণাবলীতে কিংবা তাঁর সত্তায় অন্য কোন সৃষ্টিকে অংশীদার বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তারা অতিবড় এক মিথ্যা বলেছে। কোন অর্থেই কেউ আল্লাহ তা’আলার শরীক বা অংশীদার নয়। তিনি তা থেকে পবিত্র।
# সারা দুনিয়ার এবং দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু সৃষ্টির প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তার নির্দিষ্ট আকার আকৃতিতে অস্তিত্ব লাভ করা পর্যন্ত পুরোপুরি তাঁরই তৈরী ও লালিতপালিত। কোন কিছুই আপনা থেকে অস্তিত্ব লাভ করেনি কিংবা আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়ে যায়নি অথবা তার নির্মাণ ও পরিপাটি করণে অন্য কারো সামান্যতম অবদান ও নেই। এখানে আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিকর্মকে তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায় বা স্তরে বর্ণনা করা হয়েছে। যা ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়টি হলো সৃষ্টি অর্থাৎ পরিকল্পনা করা। এর উদাহরণ হলো, কোন ইঞ্জিনিয়ার কোন ইমারত নির্মাণের পূর্বে যেমন মনে মনে স্থির করে যে, অমুক বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে এরূপ ও এরূপ একটি ইমরাত নির্মাণ করতে হবে। সে তখন মনে মনে তার নমুনা বা ডিজাইন চিন্তা করতে থাকে। এ উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত ইমারতের বিস্তারিত ও সামগ্রিক কাঠামো কি হবে এ পর্যায়ে সে তা ঠিক করে নেয়। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, برء । এ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো, পৃথক করা চিরে ফেলা, ফেড়ে ফেলা আলাদা করা। স্রষ্টার জন্য ‘বারী’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা হচ্ছে, তিনি তার পরিকল্পিত কাঠামোকে বাস্তবে রূপ দেন। অর্থাৎ যে নকশা তিনি নিজে চিন্তা করে রেখেছেন তাকে কল্পনা বা অস্তিত্বহীনতার জগত থেকে এনে অস্তিত্ব দান করেন। এর উদাহরণ হলো, ইঞ্জিনায়ার ইমারতের যে কাঠামো ও আকৃতি তাঁর চিন্তার জগতে অংকন করেছিলেন সে অনুযায়ী ঠিকমত মাপজোঁক করে মাটিতে দাগ টানেন, ভিত খনন করেন, প্রাচীর গেঁথে তোলেন এবং নির্মাণের সকল বাস্তব স্তর অতিক্রম করেন। তৃতীয় পর্যায় হলো, ’তাসবীর’এর অর্থ রূপদান করা। এখানে এর অর্থ হলো, কোন বস্তুকে চূড়ান্ত, পূর্ণাঙ্গ আকৃতি ও রূপ দান করা। এখানে এর অর্থ হলো, কোন বস্তুকে চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ আকৃতি ও রূপ দান করা। এই তিনটি পর্যায়ে আল্লাহ তা’আলার কাজ ও মানুষের কাজের মধ্যে আদৌ কোন মিল বা তুলনা হয় না। মানুষের কোন পরিকল্পনাই এমন নয় যা পূর্বের কোন নমুনা থেকে গৃহীত নয়। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার প্রতিটি পরিকল্পনাই অনুপম এবং তাঁর নিজের আবিষ্কার। মানুষ যা তৈরী করে তা আল্লাহ তা’আলার সৃষ্ট উপাদানসমূহের একটিকে আরেকটির সাথে জুড়ে করে। অস্তিত্ব নেই এমন কোন জিনিসকে সে অস্তিত্ব দান করে না, বরং যা আছে তাকেই বিভিন্ন পন্থায় জোড়া দেয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা’আলা সমস্ত বস্তুকে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন এবং যে উপাদান দিয়ে তিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সে উপাদানও তাঁর নিজের সৃষ্টি। অনুরূপ আকার-আকৃতি দানের ব্যাপারেও মানুষ আবিষ্কর্তা নয়, বরং প্রকৃত আকার-আকৃতি দানকারী ও চিত্র অংকনকারী মহান আল্লাহ। তিনি প্রতিটি জাতি, প্রজাতি এবং প্রতিটি ব্যক্তির অনুপম ও নজীরহীন আকার-আকৃতি বানিয়েছেন এবং কোন সময় একই আকার-আকৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটাননি।
# নামসমূহ অর্থ গুণবাচক নাম। তাঁর উত্তম নাম থাকার অর্থ হলো, যেমন গুণবাচাক নাম দ্বারা তার কোন প্রকার অপূর্ণতা প্রকাশ পায় যেসব গুণবাচক নাম তাঁর উপযুক্ত নয়। যেসব নাম তাঁর পূর্ণাংগ গুণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে সেই সব নামে তাকে স্মরণ করা উচিত। কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ তা’আলার এসব উত্তম নামের উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসে তাঁর পবিত্র সত্তার ৯৯টি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে তিরমিযী ও ইবনে মাজা এসব নাম বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। কেউ যদি কুরআন ও হাদীস থেকে এসব নাম গভীর মনোনিবেশ সহকারে পড়ে তাহলে সে অতি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে যে, পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় যদি আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করতে হয় তাহলে সেজন্য কি ধরনের শব্দ উপযুক্ত হবে।
# মুখের ভাষায় ও অবস্থার ভাষায় বর্ণনা করছে যে, তারা স্রষ্টা সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি, অপূর্ণতা, দুর্বলতা এবং ভুল-ভ্রান্তি থেকে পবিত্র।
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন সূরা হাদীদের ২নং টীকা।
১৮-২৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
১৮-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদেরকে তাঁর ভয় করার নির্দেশ দিচ্ছেন। তারপরেই কিয়ামত দিবসে আত্মরক্ষার্থে কী সৎ আমল প্রস্তুত করে রেখেছে তা হিসাব করে দেখার নির্দেশ প্রদান করেছেন। কারণ মানুষ যখন কিয়ামতের ভয়াবহতা স্মরণ করবে, সেদিনে নিজের অসহায়ত্ব খেয়াল করবে তখন নিজের মাঝে তাক্বওয়া চলে আসবে। আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে সকল অবাধ্য কাজ বর্জন করবে এবং তাঁর নির্দেশমূলক কাজ পালনে সচেষ্ট হবে। এখানে কিয়ামত দিবসকে আগামী কাল বলে উল্লেখ করার কারণ হল : এর সংঘটন কাল বেশি দূরে নয় বরং অতি নিকটে।
প্রত্যেক নাবীরা যেমন এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন তেমনই তাক্বওয়ার দিকে আহ্বান করেছেন। সূরা শুআরার ১০৫-১০৮, ১২৩-১২৬, ১৬০-১৬৩ ও ১৭৬-১৭৯ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। তাক্বওয়ার ফলাফল সম্পর্কে সূরা বাক্বারায় আলোচনা করা হয়েছে।
(وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوا اللّٰهَ)
অর্থাৎ যারা (আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত, নির্দেশ পালন ও নিষেধ বর্জন না করার মাধ্যমে) আল্লাহ তা‘আলার স্মরণকে বর্জন করেছে ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সৎআমলের কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন যা আখিরাতে তাদের উপকারে আসতো। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে এমন সব মানুষের মত হতে নিষেধ করেছেন যারা আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে তারাই তাঁর আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাবে, নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْھِکُمْ اَمْوَالُکُمْ وَلَآ اَوْلَادُکُمْ عَنْ ذِکْرِ اللہِﺆ وَمَنْ یَّفْعَلْ ذٰلِکَ فَاُولٰ۬ئِکَ ھُمُ الْخٰسِرُوْنَ)
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন না করে-যারা এমন করবে (উদাসীন হবে) তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা মুনাফিকূন ৬৩ : ৯)
النسي এর প্রকৃত অর্থ অনিচ্ছাকৃত ভুলে যাওয়া। যেমন সূরা বাক্বারায় বলা হয়েছে :
( رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَآ اِنْ نَّسِیْنَآ اَوْ اَخْطَاْنَا)
‘হে আমাদের রব! আমরা ভুলে গেলে অথবা ভুল করলে পাকড়াও করবেন না।’ অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য উম্মাতে মুহাম্মাদিকে পাকড়াও করা হবে না, এ উম্মতকে তা ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কিন্তু এখানে অর্থ হল : স্বেচ্ছায় বর্জন করা। শব্দটি এ অর্থে কুরআনের সূরা ত্ব-হার ১১৫, ১২৬ ও সূরা আ‘রাফের ৫১ ও সূরা সাজদাহর ১৪ নম্বর আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে।
(لَا یَسْتَوِیْٓ اَصْحٰبُ النَّارِ . . . . )
‘জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়।’ এরূপ পার্থক্য করে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন :
(أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ اجْتَرَحُوا السَّيِّاٰتِ أَنْ نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لا سَوَا۬ءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ ط سَا۬ءَ مَا يَحْكُمُوْنَ)
“দুস্কৃতিকারীরা কি মনে করে যে, আমি জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়ে তাদেরকে তাদের সমান গণ্য করবো যারা ঈমান আনে ও আমল করে? তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ।” (সূরা জাসিয়া ৪৫ : ২১)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَمْ نَجْعَلُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ كَالْمُفْسِدِيْنَ فِي الْأَرْضِ ز أَمْ نَجْعَلُ الْمُتَّقِيْنَ كَالْفُجَّارِ)
“যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে আমি কি তাদেরকে ঐসব লোকের সমান করে দেব, যারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়? অথবা আমি কি মুত্তাক্বীদেরকে গুনাহগারদের সমান করে দেব?” (সূরা সোয়াদ ৩৮ : ২৮)
অতএব জান্নাতী ও জাহান্নামী কখনো সমান নয়, বরং তাদের উভয় শ্রেণির মাঝে আকাশ-জমিন তফাত। সুতরাং প্রত্যেক মু’মিনের কামনা-বাসনা থাকবে সে কিভাবে জান্নাতী হতে পারবে। কারণ যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেল আর জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল সে ব্যক্তিই সফলকাম।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সৎকাজ করার মাধ্যমে ও অসৎকাজ বর্জন করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা ওয়াজিব।
২. আখিরাতের মুক্তির জন্য পাথেয় গ্রহণ করা উচিত।
৩. জান্নাতবাসী ও জাহান্নামী কখনো সমান নয়।
২১-২৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের মহত্ত্ব ও বড়ত্বের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, এ পবিত্র কুরআন উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কিতাব। এর সামনে অন্তর ঝুঁকে পড়ে, লোম খাড়া হয়ে যায়, কলিজা কেঁপে উঠে। মহান আল্লাহ বলেন : যদি আমি এ কুরআন পাহাড়ের ওপর অবতীর্ণ করতাম তবে পাহাড় আমার ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ হয়ে যেত। অর্থাৎ পাহাড় এত কঠিন ও দৃঢ় হওয়া সত্ত্বেও যদি কুরআন বুঝতে পারত এবং তাতে যা রয়েছে তা অনুধাবন করতে পারত, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে প্রকম্পিত ও বিদীর্ণ হয়ে যেত। তাহলে মানুষের কিভাবে শোভা পায় যে, আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে তাদের অন্তর নরম, প্রকম্পিত ও বিনীত হবে না? অথচ তারা আল্লাহ তা‘আলার বিধান উপলব্ধি করতে পারে, আল্লাহ তা‘আলার কিতাব বুঝতে পারে। এ জন্য মহান আল্লাহ বলেছেন : আমি এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করি মানুষের জন্য যাতে তারা চিন্তা করে।
হাদীসে এসেছে : মিম্বার নির্মিত হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি খেজুর গাছের গুড়ির ওপর দাঁড়িয়ে খুতবাহ প্রদান করতেন। অতঃপর যখন মিম্বার তৈরি করা হল তখন তিনি তার ওপর দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিতে লাগলেন এবং ঐ গুড়িটিকে সরিয়ে দেওয়া হল। ঐ সময় গুড়ি হতে কান্নার শব্দ আসতে লাগল। শিশুর মত ওটা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকল। কারণ তাকে আল্লাহ তা‘আলার যিকির ও ওয়াহী কিছু দূর থেকে শুনতে হচ্ছে। (সহীহ বুখারী হা. ১৪১)
সুতরাং কিছু মানুষ রয়েছে যাদের অন্তরে কুরআন কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ, তাদের অন্তর পাথরের চেয়েও কঠিন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এমন রূঢ় অন্তর থেকে মুক্ত করে তাঁর বিধানের প্রতি নরম করে দিন। আমীন!
পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর সুন্দর কয়েকটি নামের বিবরণ এসেছে। হাদীসে এসেছে আল্লাহ তা‘আলার নিরানববইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি তা গণনা করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে নিরানব্বইটি নাম হল :
اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ المَلِكُ القُدُّوسُ السَّلَامُ المُؤْمِنُ المُهَيْمِنُ العَزِيزُ الجَبَّارُ المُتَكَبِّرُ الخَالِقُ البَارِئُ المُصَوِّرُ الغَفَّارُ القَهَّارُ الوَهَّابُ الرَّزَّاقُ الفَتَّاحُ العَلِيمُ القَابِضُ البَاسِطُ الخَافِضُ الرَّافِعُ المُعِزُّ المُذِلُّ السَّمِيعُ البَصِيرُ الحَكَمُ العَدْلُ اللَّطِيفُ الخَبِيرُ الحَلِيمُ العَظِيمُ الغَفُورُ الشَّكُورُ العَلِيُّ الكَبِيرُ الحَفِيظُ المُقِيتُ الحَسِيبُ الجَلِيلُ الكَرِيمُ الرَّقِيبُ المُجِيبُ الوَاسِعُ الحَكِيمُ الوَدُودُ المَجِيدُ البَاعِثُ الشَّهِيدُ الحَقُّ الوَكِيلُ القَوِيُّ المَتِينُ الوَلِيُّ الحَمِيدُ المُحْصِي المُبْدِئُ المُعِيدُ المُحْيِي المُمِيتُ الحَيُّ القَيُّومُ الوَاجِدُ المَاجِدُ الوَاحِدُ الصَّمَدُ القَادِرُ المُقْتَدِرُ المُقَدِّمُ المُؤَخِّرُ الأَوَّلُ الآخِرُ الظَّاهِرُ البَاطِنُ الوَالِيَ المُتَعَالِي البَرُّ التَّوَّابُ المُنْتَقِمُ العَفُوُّ الرَّءُوفُ مَالِكُ المُلْكِ ذُو الجَلَالِ وَالإِكْرَامِ، ا لمُقْسِطُ الجَامِعُ الغَنِيُّ المُغْنِي المَانِعُ الضَّارُّ النَّافِعُ النُّورُ الهَادِي البَدِيعُ البَاقِي الوَارِثُ الرَّشِيدُ الصَّبُورُ
(তিরমিযী হা. ৩৫০৭, সহীহ) তবে এ নিরানব্বই এর মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বরং তাঁর নাম অগণিত। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ১৮০ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
اَلْمَلِكُ অর্থাৎ কোন প্রতিবন্ধক ও প্রতিরোধ ছাড়াই সব কিছুর মালিক।
الْقُدُّوْسُ ওহাব বিন মুনাব্বিহ বলেন : এর অর্থ হল পবিত্র, মুজাহিদ বলেন : বরকতময়। السَّلٰمُ সকল ত্রুটি ও অপূর্ণাঙ্গতা থেকে মুক্ত, তিনি সত্তায়, গুণ ও কাজে পরিপূর্ণতার কারণে। الْمُؤْمِنُ ইবনু আব্বাস বলেন : তাঁর সৃষ্টি এ ব্যাপারে নিরাপদ যে, তিনি তাদের ওপর জুলুম করবেন না। الْمُهَيْمِنُ ইবনু আব্বাসসহ প্রমুখ বলেন : সৃষ্টিজীবের কাজের প্রত্যক্ষদর্শী। الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّر অর্থাৎ যে অহংকার ও বড়ত্ব তিনি ছাড়া অন্য কারো শানে শোভা পায় না। অহংকার আল্লাহ তা‘আলার জন্য প্রশংসনীয় কিন্তু বান্দার জন্য নিন্দনীয়।
হাদীসে এসেছে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي، وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي، فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا، قَذَفْتُهُ فِي النَّار
অহংকার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার লুঙ্গী। যদি কেউ তা হতে কোন একটি ছিনিয়ে নিতে চায় তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। (আবূ দাঊদ হা. ৪০৯০, ইবনু মাযাহ হা. ৪১৭৪, সহীহ)
সুতরাং অহংকার ও বড়ত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার শানেই শোভা পায়, কোন ব্যক্তির জন্য অহংকার করা ও বড়ত্ব প্রকাশ করা শোভনীয় নয়। বরং কোন ব্যক্তি অহংকার করলে তার সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যায়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআনের মহত্ব ও বড়ত্ব সম্পর্কে জানলাম। যদি তা পাহাড়ের ওপর অবতীর্ণ করা হতো তাহলে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে তা বিদীর্ণ হয়ে যেত।
২. শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য উদাহরণ পেশ করা যায়।
৩. আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর সুন্দর নামের বিবরণ জানলাম। আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর সুন্দর নামের সংখ্যা তিনিই ভাল জানেন।
১৮-২৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১৮-২০ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত জারীর (রাঃ) বলেনঃ “একদা সূর্য কিছু উপরে উঠার সময় আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট ছিলাম। এমন সময় উলঙ্গ দেহ ও নগ্ন পদ বিশিষ্ট কতকগুলো তোক সেখানে আগমন করলো। তারা শুধু ই’বা (আরব দেশীয় পোশাক) দ্বারা নিজেদের দেহ আবৃত করেছিল। তাদের কাঁধে তরবারী লটকানো ছিল। তাদের অধিকাংশই বরং সবাই ছিল মুযার গোত্রীয় লোক। তাদের দারিদ্র্য ও দুরবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলেন এবং আবার বেরিয়ে আসলেন। অতঃপর তিনি হযরত বিলাল (রাঃ)-কে আযান দেয়ার নির্দেশ দিলেন। আযান হলো, ইকামত হলো এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) নামায পড়ালেন। তারপর তিনি খুবাহ্ শুরু, করলেন। তিনি বললেনঃ … (আরবী) অর্থাৎ “হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন …।” তারপর তিনি সূরায়ে হাশরের (আরবী)-এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। অতঃপর তিনি দান-খয়রাতের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেন। তখন জনগণ দান-খয়রাত করতে শুরু করেন। বহু দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা), দীনার (স্বর্ণমুদ্রা), কাপড়-চোপড়, গম, খেজুর ইত্যাদি আসতে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ভাষণ দিতেই থাকেন। এমন কি শেষ পর্যন্ত তিনি বলেনঃ “তোমরা অর্ধেক খেজুর হলেও তা নিয়ে এসো।” একজন আনসারী (রাঃ) অর্থ বোঝাই ভারী একটি থলে কষ্ট করে উঠিয়ে দিয়ে আসলেন। তারপর তো লোকদের দানের পর দান আসতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক জিনিসের এক একটি স্কুপ হয়ে যায়। এর ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বিবর্ণ চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং সোনার মত ঝলমল করতে থাকে। তিনি বলেনঃ “যে কেউ ইসলামের কোন ভাল কাজ শুরু করবে তাকে তার নিজের কাজের প্রতিদান তো দেয়া হবেই, এমনকি তার পরে। যে কেউই ঐ কাজটি করবে, প্রত্যেকের সমপরিমাণ প্রতিদান তাকে দেয়া হবে। এবং তাদের প্রতিদানের কিছুই কম করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ শুরু করবে, তার নিজের এ কাজের গুনাহ্ তো হবেই, এমনকি তার পরে যে কেউই ঐ কাজ করবে, প্রত্যেকেরই গুনাহ তার উপর পড়বে এবং তাদের গুনাহ্ কিছুই কম করা হবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)
আয়াতে প্রথমে নির্দেশ হচ্ছেঃ আল্লাহর আযাব হতে বাঁচার ব্যবস্থা কর অর্থাৎ তাঁর হুকুম পালন করে এবং তাঁর নাফরমানী হতে দূরে থেকে তার শাস্তি হতে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা কর।
এরপর আল্লাহ্ পাক বলেনঃ সময়ের পূর্বেই নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ কর। চিন্তা করে দেখতে থাকে যে, কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর সামনে হাযির হবে তখন কাজে লাগার মত কতটা সঞ্চিত আমল তোমাদের কাছে রয়েছে!
আবার তাগীদের সাথে বলা হচ্ছেঃ আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে থাকো এবং জেনে রেখো যে, তোমাদের আমল ও অবস্থা সম্বন্ধে তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। না কোন ছোট কাজ তাঁর কাছে গোপন আছে, না কোন বড় কাজ তাঁর অগোচরে আছে। কোন গোপনীয় এবং কোন প্রকাশ্য কাজ তাঁর অজানা নেই।
অতঃপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা বিস্মৃত হয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করেছেন। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর যিকিরকে ভুলে বসো না, অন্যথায় তিনি তোমাদেরকে তোমাদের ঐ সকার্যাবলী ভুলিয়ে দিবেন যেগুলো আখিরাতে কাজে লাগবে। কেননা, প্রত্যেক আমলের প্রতিদান ঐ শ্রেণীরই হয়ে থাকে। এ জন্যেই তিনি বলেনঃ তারাই তো পাপাচারী। যেমন অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে, যারা উদাসীন হবে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (৬৩:৯)
হযরত নাঈম ইবনে নামহাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাঁর এক ভাষণে বলেনঃ “তোমরা কি জান না যে, তোমরা সকাল-সন্ধ্যায় তোমাদের নির্দিষ্ট সময়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছ? সুতরাং তোমাদের উচিত যে, তোমরা তোমাদের জীবনের সময়গুলো আল্লাহর আনুগত্যের কাজে কাটিয়ে দিবে। আর এটা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া শুধু নিজের ক্ষমতার মাধ্যমে লাভ করা যায় না। যারা আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির কাজ ছাড়া অন্য কাজে লেগে যাবে তোমরা তাদের মত হয়ো না। আল্লাহ তোমাদেরকে এটা হতে নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ “তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে বিস্মৃত হয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করেছেন।” তোমাদের পরিচিত ভাইয়েরা আজ কোথায়? তারা তাদের অতীত জীবনে যেসব আমল করেছিল তার প্রতিফল নেয়ার অথবা তার শাস্তি ভোগ করার জন্যে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে গেছে। সেখানে তারা সৌভাগ্য লাভ করেছে অথবা হতভাগ্য হয়েছে। যেসব উদ্ধত লোক আঁকজমক পূর্ণ শহর বসিয়েছিল তারা আজ কোথায়? তারা ঐ শহরে মযবুত দূর্গসমূহ নির্মাণ করেছিল। আজ তারা কবরের গর্তে পাথরের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে। এটা হলো আল্লাহর কিতাব কুরআন কারীম। তোমরা এর নূর হতে আলো নিয়ে নাও। এটা কিয়ামতের দিনের অন্ধকারে তোমাদের কাজে আসবে। এর সুন্দর বর্ণনা হতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর এবং সুন্দর হয়ে যাও। দেখো, আল্লাহ্ তা’আলা হযরত যাকারিয়া (আঃ) ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “নিশ্চয়ই তারা সৎকার্যে অগ্রগামী ছিল এবং বড় লোভ ও ভয়ের সাথে আমার কাছে প্রার্থনা করতো এবং আমার সামনে ঝুঁকে পড়তো।” (২১:৯০) জেনে রেখো যে, ঐ কথা কল্যাণশূন্য যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য না হয়। ঐ মাল কল্যাণ ও বরকতপূর্ণ নয় যা আল্লাহর পথে খরচ করা হয় না। ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্য হতে দূরে রয়েছে যার মূর্খতা সহনশীলতার উপর বিজয়ী হয়েছে। অনুরূপভাবে ঐ ব্যক্তিও পুণ্যলাভে বঞ্চিত হয়েছে যে আল্লাহর আহকাম পালনের ক্ষেত্রে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় করেছে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম তিরবানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ খুবই উত্তম এবং এর বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। যদিও এর একজন বর্ণনাকারী নাঈম ইবনে নামহাহ নামক ব্যক্তি সুপরিচিত নন, কিন্তু ইমাম আবু দাউদ সিজিস্তানী (রঃ)-এর এই ফায়সালাই যথেষ্ট যে, জারীর ইবনে উসমান (রঃ)-এর সমস্ত উস্তাদই বিশ্বাসযোগ্য এবং ইনিও তার একজন উস্তাদ)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ জাহান্নামের অধিবাসী ও জান্নাতের অধিবাসী সমান নয়। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন জাহান্নামী ও জান্নাতীরা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সমান হবে না। যেমন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা পাপকার্যে লিপ্ত রয়েছে তারা কি ধারণা করেছে যে, আমি তাদেরকে ঈমান আনয়নকারী ও সৎ আমলকারীদের মত করবে? তাদের জীবিত ও মৃত কি সমান? তারা যা ফায়সালা করছে তা কতই না নিকৃষ্ট।” (৪৫:২১) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “অন্ধ ও চক্ষুষ্মন সমান নয় এবং মুমিন ও সৎ আমলকারী এবং দুষ্কার্যকারী সমান নয়, তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো।” (৪০:৫৮) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “যারা ঈমান এনেছে ও ভাল কাজ করেছে তাদেরকে কি আমি ভূ-পৃষ্ঠে বিপর্যয় সষ্টিকারীদের মত করবে অথবা আমি কি মুত্তাকীদেরকে পাপীদের মত করবে?” (৩৮:২৮) এসব আয়াত এটাই প্রমাণ করে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা পুণ্যবানদেরকে সম্মানিত করেন এবং পাপীদেরকে লাঞ্ছিত করেন। এ জন্যেই এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ জান্নাতবাসীরাই সফলকাম। অর্থাৎ মুসলমানরা আল্লাহ তা’আলার আযাব হতে পরিত্রাণ লাভকারী।
২১-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন কারীমের বুযুর্গী ও মাহাত্মের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, এই পবিত্র কুরআন প্রকৃতপক্ষে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব। এর সামনে অন্তর ঝুঁকে পড়ে, লোম খাড়া হয়ে যায়, কলিজা কেঁপে ওঠে। এর সত্য ওয়াদা ও ভীতি প্রদর্শন প্রত্যেককে কাঁপিয়ে তোলে এবং আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত করে।
মহান আল্লাহ বলেন যদি আমি এই কুরআন পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতাম তবে অবশ্যই দেখা যেতো যে, ওটা আল্লাহর ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ যদি মহামহিমান্বিত আল্লাহ এই কুরআনকে কোন কঠিন ও উঁচু পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতেন এবং ওকে চিন্তা ও অনুভূতি শক্তি দান করতেন তবে ওটাও তাঁর ভয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো। তাহলে মানুষের অন্তরে তো এটা আরো অধিক ক্রিয়াশীল হওয়া উচিত। কেননা, পর্বতের তুলনায় মানুষের অন্তর বহুগুণে নরম ও ক্ষুদ্র এবং তাতে পূর্ণমাত্রায় বোধ ও অনুভূতি শক্তি রয়েছে। মানুষ যেন চিন্তা-গবেষণা করে এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা মানুষের সামনে এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা ও বিনীত হওয়া।
মুতাওয়াতির হাদীসে রয়েছে যে, মিম্বর নির্মিত হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে খুত্ব দিতেন। অতঃপর যখন মিম্বর তৈরী হয়ে গেল ও বিছিয়ে দেয়া হলো তখন তিনি তার উপর দাঁড়িয়েই খুবাহ দিতে লাগলেন এবং ঐ খুঁড়িটিকে সরিয়ে দেয়া হলো। ঐ সময় ঐ গুঁড়ি হতে কান্নার শব্দ আসতে লাগলো। শিশুর মত ওটা ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। কারণ এই যে, ওকে আল্লাহর যিকির ও অহী কিছু দূর থেকে শুনতে হচ্ছে।
হযরত ইমাম বসরী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলতেনঃ “হে লোক সকল! খেজুর গাছের একটি গুড়ি যদি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর প্রতি এতো আসক্ত হতে পারে তবে তো তোমাদের তার প্রতি ওর চেয়ে বহুগুণ বেশী আসক্তি থাকা উচিত। অনুরূপভাবে এই আয়াতটি যে, যদি একটি পাহাড়ের এই অবস্থা হয় তবে এই অবস্থায় তোমাদের এর চেয়ে অগ্রগামী হওয়া উচিত। কারণ তোমরা তো শুনছো ও বুঝছো?” অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “যদি কোন কুরআন এরূপ হতো যে, ওর কারণে পর্বতরাজিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অথবা যমীনকে কেটে দেয়া হবে কিংবা মৃতকে কথা বলানো হবে (তবে এর যোগ্য একমাত্র এই কুরআনই ছিল, আর তখনো কিন্তু এই কাফিররা ঈমান আনয়নের সৌভাগ্য লাভ করতো না)।” (১৩:৩১) অন্য এক জায়গায় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “পাথরও কতক এমন যে, ওটা হতে নদী-নালা প্রবাহিত হয় এবং কতক এই রূপ যে, বিদীর্ণ হওয়ার পর ওটা হতে পানি নির্গত হয়, আবার কতক এমন যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।” (২:৭৪)
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ আল্লাহ্ ছাড়া না কোন পালনকর্তা রয়েছে, না তার সত্তা ছাড়া এমন কোন সত্তা রয়েছে যে, কেউ তার কোন প্রকারের ইবাদত করতে পারে। আল্লাহ্ ছাড়া মানুষ যাদের ইবাদত করে সেগুলো সবই বাতিল। তিনি সারা বিশ্বের দৃশ্যের ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কিছুই তাঁর কাছে পূর্ণভাবে প্রকাশমান। তিনি এমন বড় ও প্রশস্ত রহমতের অধিকারী যে, তাঁর রহমত সমস্ত মাখলুকের উপর পূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে রহমানও বটে এবং রাহীমও বটে। আমাদের তাফসীরের শুরুতে এ দু’টি নামের পুরো তাফসীর গত হয়েছে। কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “আমার রহমত সমস্ত জিনিসকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে।” (৭:১৫৬) অন্য জায়গায় আছেঃ
(আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রতিপালক তাঁর নিজের উপর রহমত লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।” (৬:৫৪) আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণার প্রতিই তাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত, তাদের জমাকৃত জিনিস হতে এটাই উত্তম।” (১০:৫৮)
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ তিনিই আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। সমস্ত জিনিসের একক মালিক তিনিই। তিনিই সবকিছুকে হেরফেরকারী। সব কিছুরই অধিকর্তা ও অধিপতি তিনিই। তিনিই সব কিছুরই ব্যবস্থাপক। কেউই এমন নেই যে তাঁর কাজে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বা তাঁকে তাঁর কার্যসম্পাদন করা হতে বিরত রাখতে পারে। তিনিই পবিত্র। অর্থাৎ তিনিই প্রকাশমান ও কল্যাণময়। সত্তাগত ও গুণগত ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। সমস্ত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতা এবং অন্যান্য সবই তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণায় সর্বদা রত। তিনিই অতীব মহিমান্বিত। তার কোন কাজ হিকমতশূন্য নয়। তাঁর সমুদয় কাজকর্মেও তিনি সর্বপ্রকারের দোষ-ত্রুটি হতে পবিত্র। তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক। অর্থাৎ তিনি সমস্ত মাখলুককে এ ব্যাপারে নিরাপত্তা দান করেছেন যে, তাদের উপর তার পক্ষ হতে কখনো কোন প্রকারের অত্যাচার হবে না। তিনি যে সত্য কথা বলেছেন, এ কথা বলে তিনি সকলকে নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছেন। তিনি তাঁর মুমিন বান্দাদের ঈমানের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
তিনিই রক্ষক অর্থাৎ তিনি তাঁর সমস্ত মাখলকের সমস্ত আমল সদা প্রত্যক্ষ ও রক্ষাকারী। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে রক্ষক।” (৮৫:৯) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ তাদের সমস্ত আমলের উপর সাক্ষী।” (১০:৪৬) মহান আল্লাহ্ আরো বলেনঃ .. (আরবী) ভাবার্থ এই যে, ওরা প্রত্যেকেই কি মাথার উপর স্ব-স্ব কৃতকম নিয়ে দণ্ডায়মান নয়? (১৩:৩৩)
তিনিই পরাক্রমশালী। প্রত্যেক জিনিস তাঁর আদেশ পালনে বাধ্য। প্রত্যেক মাখলুকের উপর তিনি বিজয়ী। সুতরাং তার মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তিমত্তা এবং বড়ত্ব দেখে কেউই তাঁর মুকাবিলা করতে পারে না। তিনিই প্রবল এবং তিনিই মহিমান্বিত। শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব প্রকাশ করা শুধু তাঁরই জন্যে শোভনীয়। অহংকার করা শুধু তারই সাজে। যেমন সহীহ্ হাদীসে এসেছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ “বড়াই করা আমার ইযার এবং অহংকার করা আমার চাদর। সুতরাং যে ব্যক্তি এ দু’টোর যে কোন একটি নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে, আমি তাকে শাস্তি প্রদান করবে।” সমস্ত কাজের সংস্কার ও সংশোধন তারই হাতে। তিনি প্রত্যেক কুকর্মকে ঘৃণাকারী। যারা নির্বুদ্ধিতার কারণে অন্যদেরকে আল্লাহর শরীক স্থাপন করে, আল্লাহ তা হতে পবিত্র ও মহান। তিনিই আল্লাহ সৃজনকর্তা, তিনিই উদ্ভাবনকর্তা। অর্থাৎ তিনিই ভাগ্য নির্ধারণকারী এবং তিনিই ওটাকে জারী ও প্রকাশকারী। তিনি যা চান তাই নির্ধারণ করেন। কেউই এমন নেই যে, ভাগ্য নির্ধারণ ও ওটাকে চালু এ দু’টোই করতে পারে। তিনি নিজের ইচ্ছামত ভাগ্য নির্ধারণ করেন, অতঃপর ওটা অনুযায়ী ওকে চালিয়েও থাকেন। কখনো তিনি এতে পার্থক্য সৃষ্টি হতে দেন না। বহু পরিমাণ ও পরিমাপকারী এবং বিন্যাসকারী রয়েছে যারা পরিমাণ ও পরিমাপ করার পর ওটাকে জারী করতে এবং ওটা অনুযায়ী চালু করতে সক্ষম নয়। পরিমাণ ও পরিমাপ করার সাথে সাথে তফীযের উপরও যিনি ক্ষমতা রাখেন তিনিই আল্লাহ্। সুতরাং (আরবী) দ্বারা (আরবী) এবং (আরবী) দ্বারা (আরবী) উদ্দেশ্য। আরবে এই শব্দগুলো এই অর্থে বরাবরই দৃষ্টান্ত স্বরূপ পেশ করার প্রচলন রয়েছে।
আল্লাহ্ তা’আলার শান বা মাহাত্ম্য এই যে, যে জিনিসকে তিনি যখন যেভাবে করার ইচ্ছা করেন তখন শুধু ‘হও’ বলে দেন, আর তখনই তা ঐ ভাবেই এবং ঐ আকারেই হয়ে যায়। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অথাৎ “যেই আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।” (৮২:৮) এজন্যেই এখানে বলেনঃ তিনি রূপদাতা। অর্থাৎ যাকে তিনি যেভাবে গঠন করার ইচ্ছা করেন সেভাবেই করে থাকেন।
সকল উত্তম নাম তারই। সূরায়ে আ’রাফে এই বাক্যটির তাফসীর গত হয়েছে। তাছাড়া ঐ হাদীসটিও বর্ণিত হয়েছে যেটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তা এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলার নিরানব্বইটি অর্থাৎ এক কম একশ’টি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি ওগুলো গণনা করবে ও স্মরণ রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি (আল্লাহ) বে-জোড় অর্থাৎ তিনি একক এবং বে-জোড়কে অর্থাৎ একাকীকে ভালবাসেন।” জামেউত তিরমিযীতে নামগুলো স্পষ্টভাবে এসেছে। নামগুলো হলোঃ আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই, তিনিই (১) রহমান, (২) রাহীম, (৩) মালিক, (৪) কুদুস, (৫) সালাম, (৬) মুমিন, (৭) মুহাইমিন, (৮) আযীয, (৯) জাব্বার, (১০) মুতাকাব্বির, (১১) খালিক, (১২) বারী, (১৩) মুসাব্বির, (১৪) গাফফার, (১৫) অহ্হাব, (১৬) রাযযাক, (১৭) কাহহার, (১৮) ফাত্তাহ্, (১৯) আলীম, (২০) কাবি, (২১) বাসিত, (২২) খাফি, (২৩) রাফি’, (২৪) মুইয্য, (২৫) মুযিল্ল, (২৬) সামী’, (২৭) বাসীর, (২৮) হাকীম, (২৯) আদৃল, (৩০) লাতীফ, (৩১) খাবীর, (৩২) হালীম, (৩৩) আযীম, (৩৪) গাফুর, (৩৫) শাকূর, (৩৬) আলী, (৩৭) কাবীর, (৩৮) হাফী, (৩৯) মুকীত, (৪০) হাসীব, (৪১) জালীল, (৪২) কারীম, (৪৩) রাকীব, (৪৪) মুজীব, (৪৫) ওয়াসি, (৪৬) হাকীম, (৪৭) অদূদ, (৪৮) মাজীদ, (৪৯) বাই’স (৫০) শাহীদ, (৫১) হাক্ক, (৫২) অকীল, (৫৩) কাবী, (৫৪) মাতীন, (৫৫) ওয়ালী, (৫৬) হামীদ, (৫৭) মুহসী, (৫৮) মুবদী, (৫৯) মুঈদ, (৬০) মুহঈ, (৬১) মুমীত, (৬২) হাই, (৬৩) কাইয়ুম, (৬৪) ওয়াজিদ, (৬৫) মাজিদ, (৬৬) ওয়াহিদ, (৬৭) সামাদ, (৬৮) কাদির, (৬৯) মুকতাদির, (৭০) মুকাদিম, (৭১) মুআখির, (৭২) আওয়াল, (৭৩) আখির, (৭৪) যাহির, (৭৫) বাতিন, (৭৬) ওয়ালী, (৭৭) মুতাআলী, (৭৮) বারর, (৭৯) তাওয়াব, (৮০) মুনতাকিম, (৮১) আফু, (৮২) রাউফ, (৮৩) মালিকুল মুলক, (৮৪) যুলজালালি ওয়াল ইকরাম, (৮৫) মুকসিত, (৮৬) জামি, (৮৭) গানী, (৮৮) মুগনী, (৮৯) মুতী, (৯০) মানি, (৯১) যারর, (৯২) নাফি, (৯৩) নূর, (৯৪) হাদী, (৯৫) বাদী, (৯৬) বাকী, (৯৭) ওয়ারিস, (৯৮) রাশীদ (৯৯) সাবূর।
সুনানে ইবনে মাজাহতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এবং তাতে কিছু আগা-পিছা এবং কম-বেশীও রয়েছে। মোটকথা, এসব হাদীস ইত্যাদির বর্ণনা পূর্ণরূপে সূরায়ে আ’রাফের তাফসীরে গত হয়েছে। সুতরাং এখানে শুধু এটুকু লিখাই যথেষ্ট। বাকী সবগুলোর পুণরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু ওদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” (১৭:৪৪)
তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ তিনি তাঁর শরীয়তের আহকামের ব্যাপারে অতীব জ্ঞানী ও বিজ্ঞানময়।
হযরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি সকালে (আরবী) পড়ার পর সূরায়ে হাশরের শেষ তিনটি আয়াত পাঠ করে, তার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলা সত্তর হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেন যারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার উপর রহমত বর্ষণ করতে থাকেন। যদি ঐ দিনে তার মৃত্যু হয়ে যায় তবে তাকে শহীদের মর্যাদা দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এগুলো পাঠ করে সেও অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। জামি তিরমিযীতেও এ হাদীসটি রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে গারীব বলেছেন)।