Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬১/মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৮) [*‌‌ হে মু’মিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা নিজেরা করো না?:- *আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না:-] www.motaher21.net সূরা:৬১: আস্-সফ। পারা:২৮ ১-৬ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬১/মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৮)
[*‌‌ হে মু’মিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা নিজেরা করো না?:-
*আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না:-]
www.motaher21.net
সূরা:৬১: আস্-সফ।
পারা:২৮
১-৬ নং আয়াত:-

সূরা:৬১: আস্-সফ:-১
سَبَّحَ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ۚ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۱﴾
আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর তাসবীহ করেছে। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-২
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِمَ تَقُوۡلُوۡنَ مَا لَا تَفۡعَلُوۡنَ ﴿۲﴾
হে মু’মিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল যা নিজেরা করো না?
সূরা:৬১: আস্-সফ:-৩
کَبُرَ مَقۡتًا عِنۡدَ اللّٰہِ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا مَا لَا تَفۡعَلُوۡنَ ﴿۳﴾
আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-৪
اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الَّذِیۡنَ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِہٖ صَفًّا کَاَنَّہُمۡ بُنۡیَانٌ مَّرۡصُوۡصٌ ﴿۴﴾
আল্লাহ সেই সব লোকদের ভালবাসেন যারা তাঁর পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সীসা গলিয়ে ঢালাই করা এক মজবুত দেয়াল।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-৫
وَ اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِقَوۡمِہٖ یٰقَوۡمِ لِمَ تُؤۡذُوۡنَنِیۡ وَ قَدۡ تَّعۡلَمُوۡنَ اَنِّیۡ رَسُوۡلُ اللّٰہِ اِلَیۡکُمۡ ؕ فَلَمَّا زَاغُوۡۤا اَزَاغَ اللّٰہُ قُلُوۡبَہُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿۵﴾
তোমরা মূসার সেই কথাটি স্মরণ করো যা তিনি তাঁর কওমকে বলেছিলেন। “হে আমার কাওমের লোক, তোমরা কেন আমাকে কষ্ট দাও? অথচ তোমরা ভাল করেই জানো যে, আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত রসূল। এরপর যেই তারা বাঁকা পথ ধরলো অমনি আল্লাহও তাদের দিল বাঁকা করে দিলেন। আল্লাহ‌ কাফেকদের হিদায়াত দান করেন না।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-৬
وَ اِذۡ قَالَ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ یٰبَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اِنِّیۡ رَسُوۡلُ اللّٰہِ اِلَیۡکُمۡ مُّصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیَّ مِنَ التَّوۡرٰىۃِ وَ مُبَشِّرًۢا بِرَسُوۡلٍ یَّاۡتِیۡ مِنۡۢ بَعۡدِی اسۡمُہٗۤ اَحۡمَدُ ؕ فَلَمَّا جَآءَہُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ قَالُوۡا ہٰذَا سِحۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۶﴾
আর স্মরণ করো ঈসা ইবনে মারয়ামের সেই কথা যা তিনি বলেছিলেনঃ হে বনী ইসরাঈল, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল। আমি সেই তাওরাতের সত্যতা প্রতিপাদনকারী যা আমার পূর্বে এসেছে৭ এবং একজন রসূলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন, যার নাম আহমাদ। কিন্তু যখন তিনি তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেশ করলেন তখন তারা বললঃ এটা তো স্পষ্ট প্রতারণা।

১-৬ আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৬১-সফ) : নামকরণ:

সূরার চতুর্থ আয়াতের يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا আয়াতাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ এটি সেই সূরা যাতে ‘সফ’ শব্দটি আছে।
(৬১-সফ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে এর নাযিল হওয়ার সময়-কাল জানা যায় না। কিন্তু এর বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে অনুমান করা যায় যে, সূরাটি সম্ভবত ওহোদ যুদ্ধের সমসাময়িককালে নাযিল হয়ে থাকবে। কারণ এর মধ্যে যেসব পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তা সেই সময়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট।
(৬১-সফ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এ সূরার বিষয়বস্তু হলো ঈমানের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে নিষ্ঠা ঐকান্তিকতা অবলম্বন এবং আল্লাহর পথে জীবন কুরবানী করতে উদ্ধুদ্ধ করা। এতে দুর্বল ঈমানের মুসলমানদেরও সম্বোধন করা হয়েছে। যারা ঈমানের মিথ্যা দাবি করে ইসলামে প্রবেশ করেছিল তাদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছে আবার যারা ঈমানের ব্যাপারে একনিষ্ঠ ছিল তাদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছে। কোন কোন আয়াতে শুধু প্রথম দুটি শ্রেণীকে সম্বোধন করা হয়েছে। কোন কোন আয়াতে শুধু মুনাফিকদের সম্বোধন করা হয়েছে। আবার কোন কোন আয়াতে নিষ্ঠাবান মু’মিনদের প্রতি লক্ষ্য করে কথা বলা হয়েছে। কোন স্থানে কাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে তা বক্তব্যের ধরণ থেকেই বুঝা যায়।

শুরুতে সমস্ত ঈমানদারদের এই মর্মে সাবধান করা হয়েছে যে, যারা বলে এক কথা কিন্তু করে অন্য রকম কাজ, তারা আল্লাহ তা’আলার দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণিত। আর যারা ন্যায়ের পথে লড়াই করার জন্য মজবুত প্রাচীরের মত দুর্ভেদ্য হয়ে দাঁড়ায় আল্লাহ তা’আলার নিকট তারা অত্যন্ত প্রিয়।

৫ থেকে ৭ আয়াতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের লোকদেরকে সাবধান করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে বনী ইসরাঈল জাতি মূসা (আ) এবং ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে যে আচরণ করেছে তোমাদের রসূল এবং তোমাদের দ্বীনের সাথে তোমাদের আচরণ সেই রকম হওয়া উচিত নয়। হযরত মুসা(আ) আল্লাহর রসূল একথা জানা সত্ত্বেও তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তারা তাঁকে কষ্ট-যন্ত্রণা দিয়েছে এবং হযরত ঈসার (আ) কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনাবলী দেখতে পাওয়ার পরও তাকে অস্বীকার করা থেকে বিরত হয়নি। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, ঐ জাতির লোকদের মেজাজের ধরন-প্রকৃতিই বাঁকা হয়ে গিয়েছে এবং হিদায়াত লাভের তাওফিক বা শুভবুদ্ধি থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। এটা এমন কোন বাঞ্ছনীয় বা ঈর্ষনীয় অবস্থা নয় যে, অন্য কোন জাতি তা লাভের জন্য উদগ্রীব হবে।

এরপর ৮ ও ৯ আয়াতে চ্যালেঞ্জ করে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ইহুদী ও খৃস্টান এবং তাদের সাথে ষড়যন্ত্রকারী মুনাফিকরা আল্লাহর এই নূরকে নিভিয়ে দেয়ার যতই চেষ্টা-সাধনা করুক না কেন তা পুরা শানশওকতের সাথে গোটা পৃথিবীতে অবশ্যই বিস্তার লাভ করবে। মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন আল্লাহর মহান রসূলের আনীত দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা অন্য সব জীবনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবশ্যই বিজয়ী হবে।

অতপর ১০ থেকে ১৩ পর্যন্ত আয়াতে ঈমানদারদের বলা হয়েছে যে, দুনিয়া এবং আখেরাতে সফলতা লাভের পথ মাত্র একটি। তা হলো খাঁটি ও সরল মনে আল্লাহ তার রসূলের ওপর ঈমান আনো এবং জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করো। এর ফল হিসেবে আখেরাতে পাবে আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি, গোনাহসমূহের মাগফিরাত এবং চিরদিনের জন্য জান্নাত। আর দুনিয়াতে পুরষ্কার হিসেবে পাবে আল্লাহর সাহায্য সহযোগিতা এবং বিজয় ও সফলতা।

সূরার শেষে ঈমানদারদের বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে তাঁর হাওয়ারী বা সাহায্যকারীরা আল্লাহর পথে যেভাবে সহযোগিতা করেছে তারাও যেন অনুরূপভাবে ‘আনসারুল্লাহ’ বা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে দাঁড়ায় যাতে ইতিপূর্বে ঈমান আনয়নকারি গণ যেভাবে আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করেছিলেন তারাও কাফেরদের বিরুদ্ধে তেমনি সাহায্য সহযোগিতা লাভ করতে পারে।
এটা এই ভাষণের সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, সূরা হাদীদের তাফসীর, টীকা ১ ও ২ । এ ধরনের ভূমিকা দিয়ে বক্তব্য শুরু করার কারণ হলো, পরে যা বলা হবে তা শোনা বা পড়ার আগে মানুষ যাতে একথা ভালভাবে বুঝে নেয়, যে আল্লাহ‌ তা’আলা অভাবহীন এবং অমুখাপেক্ষী। তাঁর প্রতি কারো ঈমান আনা, সাহায্য করা এবং ত্যাগ ও কুরবানী করার ওপর তাঁর কর্তৃত্ব নির্ভরশীল নয়। তিনি এর অনেক ঊর্ধ্বে। তিনি যখন ঈমান গ্রহণকারীদের ঈমানের ব্যাপারে একনিষ্ঠ হওয়ার শিক্ষা দেন এবং বলেন সত্যকে উন্নতির করা জন্য জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করো তখন এ সব তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই বলেন। তাঁর ইচ্ছা তাঁর নিজের শক্তি ও ব্যবস্থাপনার সাহায্যেই বাস্তব রূপ লাভ করে। কোন বান্দা তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নের সামান্যতম তৎপরতাও যদি না চালায় বরং গোটা পৃথিবী সে পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে বদ্ধপরিকরও হয় তবুও তার নিজের শক্তি ও ব্যবস্থাপনা দ্বারা তা বাস্তবরূপ লাভ করে।
একথাটির একটি সাধারণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে যা এর শব্দসমূহ থেকেই প্রতিভাত হচ্ছে। এছাড়া একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যও আছে যা পরবর্তী আয়াতের সাথে এটিকে মিলিয়ে পড়লে বুঝা যায়। প্রথম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো, একজন খাঁটি মুসলমানের কথা ও কাজে মিল থাকা উচিত। সে যা বলবে তা করে দেখাবে। আর করার নিয়ত কিংবা সৎ সাহস না থাকলে তা মুখেও আনবে না। এক রকম কথা বলা ও অন্য রকম কাজ করা মানুষের এমন একটি জঘন্য দোষ যা আল্লাহ‌ তা’আলার দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণিত। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করার দাবী করে তার পক্ষে এমন নৈতিক দোষ ও বদ স্বভাবে লিপ্ত হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। নবী (সা.) ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ কোন ব্যক্তির মধ্যে এরূপ স্বভাব থাকা প্রমাণ করে যে, সে মু’মিন নয় বরং মুনাফিক। কারণ তার এই স্বভাব মুনাফিকির একটি আলামত। একটি হাদীসে নবী (সা.) বলেছেনঃ

آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ (زَادَ الْمُسْلِمَ وَاَنْ صَامَ وَصَلَّى وَزَعَمَ اَنَّهُ مُسْلِمٌ) إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ(البخارى ، ومسلم)

“মুনাফিকের পরিচয় বা চিহ্ন তিনটি (যদিও সে নামায পড়ে এবং মুসলমান হওয়ার দাবী করে)। তাহলো, সে কথা বললে মিথ্যা বলে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং তার কাছে কোন আমানত রাখলে তা খিয়ানত করে। “(বুখারী ও মুসলিম)।

তিনি অন্য একটি হাদীসে বলেছেনঃ

أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا ، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ(البخارى ، ومسلم)

“চারটি স্বভাব এমন যা কোন ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া গেলে সে হবে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এর কোন একটি স্বভাব পাওয়া যাবে তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকীর একটি স্বভাব বিদ্যমান। স্বভাবগুলো হলো, তার কাছে আমানত রাখা হলে সে খিয়ানত করে, কথা বললে মিথ্যা বলে ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ করলে নৈতিকতা ও দ্বীনদারীর সীমালঙ্ঘন করে। “(বুখারী ও মুসলিম)

ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ এ বিষয়ে মোটামুটি একমত যে, কোন ব্যক্তি আল্লাহ‌ তা’আলার সাথে যদি কোন ওয়াদা করে (যেমন কোন জিনিসের মানত করল) কিংবা মানুষের সাথে কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় অথবা কারো সাথে কোন বিষয়ে ওয়াদা করে আর তা যদি গোনাহের কাজের কোন প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা না হয় তাহলে পালন করে অবশ্য কর্তব্য। তবে যে কাজের প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা করা হয়েছে তা গোনাহর কাজ হলে সে কাজ করবে না ঠিকই কিন্তু তার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কসমের কাফফারা আদায় করতে হবে। সূরা মায়েদার ৮৯ আয়াতে একথাটিই বলা হয়েছে। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস ও ইবনে আরাবী)।

এটা হলো এ আয়াতগুলোর সাধারণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এরপর থাকে এর সেই বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যে জন্য এক্ষেত্রে আয়াত কয়টি পেশ করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতটিকে এর সাথে মিলিয়ে পড়লেই সেই বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জানা যায়। যারা ইসলামের জন্য জীবনপাত করার লম্বা লম্বা ওয়াদা করতো কিন্তু চরম পরীক্ষার সময় আসলে জান নিয়ে পালাতো সেই সব বাক্যবাগীশদের তিরষ্কার করাই এর উদ্দেশ্য। দুর্বল ঈমানের লোকদের এই দুর্বলতার জন্য কুরআন মজীদের কয়েকটি স্থানে তাদের সমালোচনা করা হয়েছে। যেসন সূরা নিসার ৭৭ আয়াতে আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছেনঃ তোমরা সেই সব লোকদের প্রতি কি লক্ষ্য করেছ যাদের বলা হয়েছিল, নিজেদের হাতকে সংযত রাখ, নামায কায়েম কর এবং যাকাত দাও। এখন যেই তাদেরকে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে অমনি তাদের একটি দল মানুষকে এমন ভয় করতে আরম্ভ করেছে যা আল্লাহকে করা উচিত, কিংবা তার চেয়েও অধিক। তারা বলেঃ হে আল্লাহ, আমাদের জন্য লড়াইয়ের নির্দেশ কেন লিপিবদ্ধ করে দিলে? আমাদেরকে আরো কিছুদিনের জন্য অবকাশ দিলে না কেন? সূরা মুহাম্মাদের ২০ আয়াতে বলেছেনঃ যারা ঈমান এনেছে তারা বলেছিল, এমন কোন সূরা কেন নাযিল হচ্ছে না (যার মধ্যে হুকুম থাকবে), কিন্তু যখন একটি সুস্পষ্ট অর্থবোধক সূরা নাযিল করা হলো যাতে যুদ্ধের উল্লেখ ছিল তখন তোমরা দেখলে যাদের মনে রোগ ছিল তারা তোমাদের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কাউকে মৃত্যু আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিশেষ করে ওহোদ যুদ্ধের সময় এসব দুর্বলতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। সূরা আলে ইমরানের ১৩ থেকে ১৭ রুকূ’ পর্যন্ত একাধারে এ বিষয়ের প্রতিই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

এ আয়াতগুলোতে যেসব দুর্বলতার সমালোচনা করা হয়েছে আয়াতগুলোর শানে নুযূল বর্ণনা প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণ তার বিভিন্ন ধরন ও প্রকৃতি বর্ণনা করেছেন। ইবনে আব্বাস বলেনঃ মুলমানদের মধ্যে কিছু লোক ছিল যারা জিহাদ ফরয হওয়ার পূর্বে বলতঃ হায়! আল্লাহ‌ তা’আলার কাছে যে কাজটি সবচেয়ে বেশী প্রিয় তা যদি আমরা জানতাম তাহলে তাই করতাম। কিন্তু যখন বলে দেয়া হলো, যে সেই কাজটি হলো জিহাদ, তখন নিজেদের কথা রক্ষা করা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ল। মুকাতিল ইবনে হাইয়ান বলেনঃ ওহোদের যুদ্ধে এসব লোক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হলে তারা নবীকে(সা.) ফেলে রেখে জান নিয়ে পালিয়েছিল। ইবনে যায়েদ বলেনঃ বহু লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই মর্মে আশ্বাস দিত যে, আপনাকে যদি শত্রুর মুখোমুখি হতে হয় তাহলে আমরা আপনার সাথে থাকব। কিন্তু শত্রুর সাথে মুখোমুখি হওয়ার সময় আসলে তাদের ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি মিথ্যা প্রমাণিত হত। কাতাদা এবং দাহহাক বলেনঃ কোন কোন লোক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত ঠিকই, কিন্তু তারা কোন কাজই করত না। কিন্তু যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বড় গলায় বলতঃ আমি এভাবে লড়াই করেছি, আমি এভাবে হত্যা করেছি। এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ‌ তা’আলা এই প্রকৃতির লোকদের তিরষ্কার করেছেন।
# এর দ্বারা প্রথমত জানা গেল যে, কেবল সেই ঈমানদারই আল্লাহ‌ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনে সফল হয় যারা তাঁর পথে মরণপণ করে কাজ করতে এবং বিপদ আপদ মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত থাকে। দ্বিতীয়ত, জানা গেল যে, আল্লাহ‌ যে সেনাদলকে পছন্দ করেন তার মধ্যে তিনটি গুণ থাকা আবশ্যক। এক, তারা বুঝে শুনে ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে আল্লাহর পথে লড়াই করবে এবং এমন কোন পথে লড়াই করবে না যা ফী সাবীলিল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহর পথের সংজ্ঞায় পড়ে না। দুই, তারা বিচ্ছিন্নতা ও শৃঙ্খলাহীনতার শিকার হবে না, বরং মজবুত সংগঠন সুসংহত অবস্থায় কাতারবন্দী বা সুশৃঙ্খল হয়ে লড়াই করবে। তিন, শত্রুর বিরুদ্ধে তার অবস্থা হবে, “সুদৃঢ় দেয়ালের”মত। এই শেষ গুণটি আবার অর্থের দিক থেকে অত্যন্ত ব্যাপক। যুদ্ধের ময়দানে কোন সেনাবাহিনীই ততক্ষণ পর্যন্ত সুদৃঢ় দেয়ালের মত দুর্ভেদ্য হয়ে দাঁড়াতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে নিম্নবর্ণিত গুণাবলী সৃষ্টি না হবেঃ

-আকীদা-বিশ্বাস এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মধ্যে পূর্ণ ঐক্য। এ গুণটিই কোন সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিক অফিসারকে পূর্ণরূপে ঐক্যবদ্ধ করে।

-পরস্পরের নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার ওপর আস্থা। প্রকৃতপক্ষে সবাই নিজ নিজ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে নিষ্ঠাবান এবং অসদুদ্দেশ্য থেকে মুক্ত না হলে এ গুণ সৃষ্টি হতে পারে না। আর এ গুণটি যদি সৃষ্টি না হয় তাহলে যুদ্ধের মত কঠিন পরীক্ষা কারো কোন দোষ-ত্রুটি গোপন থাকতে দেয় না। আর আস্থা নষ্ট হয়ে গেলে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য পরস্পরের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে একে অপরকে সন্দেহ করতে শুরু করে।

-নৈতিক চরিত্রের একটি উন্নত মান থাকতে হবে। সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সাধারণ সৈনিক যদি সেই মানের নীচে চলে যায় তাহলে তাদের মনে পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ও সম্মানবোধ সৃষ্টি হতে পারে না। তারা পারস্পরিক কোন্দল ও দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ থেকেও রক্ষা পেতে পারে না।

-উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি এমন অনুরাগ ও ভালবাসা এবং তা অর্জনের জন্য এমন দৃঢ় সংকল্প থাকা চাই যা গোটা বাহিনীর মধ্যে জীবনপাত করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে দেবে আর যুদ্ধের ময়দানে তা প্রকৃতই মজবুত দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে থাকবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বের যে শক্তিশালী সামরিক সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল, যার সাথে সংঘর্ষে বড় বড় শক্তি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী কোন শক্তি যার মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারেনি এ সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য ছিল তার ভিত্তি।

# যেসব মানুষ ইচ্ছা করে বাঁকা পথে চলতে চায় অথবা তাদেরকে সোজা পথে চালান এবং যারা আল্লাহর নাফরমানী করার জন্য বদ্ধপরিকর তাদেরকে জোর করে হিদায়াত দান করা আল্লাহর নিয়ম বা রীতি নয়। এর দ্বারা একথা আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন ব্যক্তি বা জাতির গোমরাহীর সূচনা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয় না বরং স্বয়ং সেই ব্যক্তি বা জাতির পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে আল্লাহর নিয়ম বা বিধান হলো, যারা গোমরাহীকে গ্রহণ করে তিনি তাদের জন্য সঠিক পথে চলার উপায়-উপকরণ নয়, বরং গোমরাহীর উপায়-উপকরণেই সরবরাহ করেন যাতে যেসব পথে তারা নিজেদেরকে নিয়ে যেতে চায় সেসব পথে যেন অবাধে যেতে পারে। আল্লাহ‌ তো মানুষকে বাছাই করে নেয়ার স্বাধীনতা (Freeom of choice) দিয়েছেন। এরপর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রতিটি মানুষের বা মানুষের দলও গোষ্ঠীর নিজের কাজ যে, তারা তাদের রবের আনুগত্য করবে কি করবে না এবং সঠিক পথ গ্রহণ করবে না বাঁকা পথের কোন একটিতে চলবে। এই বাছাই ও গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহ‌ তা’আলার পক্ষ থেকে কোন জবরদস্তি নেই। কেউ যদি আনুগত্য ও হিদায়াতের পথ বেছে নেয় তাহলে আল্লাহ‌ তা’আলা তাকে জোর করে গোমরাহী ও নাফরমানীর পথে ঠেলে দেন না। আর কেউ যদি নাফরমানী করা এবং সঠিক পথ অনুসরণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে তাকে জোর করে আনুগত্য ও হিদায়াতের পথে নিয়ে আসাও আল্লাহর নিয়ম নয়। কিন্তু এটাও একটি বাস্তব ব্যাপার যে, কেউ নিজের জন্য যে পথই বেছে নিক না কেন সে পথে চলার জন্য উপায়-উপকরণ আল্লাহ‌ তা’আলা যতক্ষণ সরবরাহ না করেন এবং অনুকূল অবস্থা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি না করেন ততক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ পথে কার্যত এক পাও অগ্রসর হতে পারে না। এটাই হলো আল্লাহর দেয়া তাওফীক বা আনুকূল্য যার ওপর মানুষের প্রতিটি চেষ্টা-সাধনা ফলপ্রসূ হওয়া নির্ভর করে। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি ভাল কাজের তাওফীক আদৌ না চায় বরং উল্টা মন্দ ও পাপ কাজের তাওফীক চায় তাহলে সে তাই লাভ করবে। আর যখন সে মন্দ ও পাপ কাজের তাওফীক লাভ করে তখন তার মন-মানসিকতার গোটা ছাঁচ এবং চেষ্টা-সাধনা ও কাজকর্মের পথও বাঁকা হয়ে যেতে থাকে। এমন কি ভাল ও কল্যাণকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা ধীরে ধীরে তার মধ্যে থেকে নিঃশেষ হয়ে যায়। “তারা বাঁকা পথ ধরলে আল্লাহও তাদের দিল বাঁকা করে দিলেন” কথাটির অর্থ এটাই। এ অবস্থায় যে ব্যক্তি নিজে গোমরাহী কামনা করে গোমরাহীর জন্য তৎপর থাকে এবং গোমরাহীতে নিমজ্জিত থেকে অধিকতর গোমরাহীর দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ও চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করে তাকে জোর করে হিদায়াতের দিকে ফিরিয়ে দেয়া আল্লাহর আইন ও নিয়ম-নীতির পরিপন্থী ব্যাপার। কারণ যে পরীক্ষার জন্য মানুষকে দুনিয়ায় বাছাইয়ের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এরূপ কাজ সেই উদ্দেশ্য লক্ষ্যকেই নস্যাত করে দেবে। আর এভাবে হিদায়াত লাভ করে মানুষ সঠিক পথে চললেও সেজন্য তার কোন প্রকার বিনিময় বা উত্তম প্রতিদান লাভের উপযুক্ত বিবেচিত হওয়ারও যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই। এক্ষেত্রে তো বরং যে ব্যক্তি বাধ্যতামূলক হিদায়াত লাভ করেনি এবং গোমরাহীর মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে তারাও কোন প্রকার শাস্তি লাভ না করা উচিত। কারণ এমতাবস্থায় তার গোমরাহীর মধ্য থেকে যাওয়ার সমস্ত দায়-দায়িত্ব আল্লাহর উপরই বর্তায়। সে বরং আখেরাতে জবাবদিহির সময় এ যুক্তি পেশ করতে পারে যে, আপনার কাছে বাধ্যতামূলকভাবে হিদায়াত দান করার ব্যবস্থা যখন ছিল তখন আপনি আমাকে এই কৃপা থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন কেন? ’আল্লাহ তা’আলা ফাসেকদের হিদায়াত দান করেন না’ বাণীটির তাৎপর্য এটাই। অর্থাৎ যেসব মানুষ নিজেরাই তাদের জন্য গোনাহ ও নাফরমানীর পথ বেছে নিয়েছি তিনি তাদেরকে আনুগত্যের পথে চলার ‘তাওফীক’ দেন না।
# এটা বনী ইসরাঈল জাতির দ্বিতীয়বারের নাফরমানীর কথা। তারা একটি নাফরমানী করেছিল তাদের উত্থান যুগের শুরুতে। আর এটি হলো তাদের দ্বিতীয় নাফরমানী যা তারা এই যুগেরই শেষ দিকে, সর্বশেষ পর্যায়ে করেছিলেন। এরপর চিরদিনের জন্য তাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হলো। এ দু’টি ঘটনা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদেরকে আল্লাহর রসূলের সাথে বনী ইসরাঈলের মত আচরণ করার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া।

# এই আয়াতাংশের তিনটি অর্থ। আর এ তিনটি অর্থই যথাযথ ও সঠিক। এর একটি অর্থ হলো, আমি কোন স্বতন্ত্র এবং অভিনব দ্বীন বা জীবন বিধান নিয়ে আসিনি। বরং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যে দ্বীন এনেছিলেন আমিও সেই দ্বীন এনেছি। আমি তাওরাতকে রহিত বা বাতিল করতে আসিনি বরং তার সত্যতা প্রতিপাদনকারী হিসেবে এসেছি। আল্লাহর রসূলগণ যেমন চিরদিনই তাদের পূর্বের নবী-রসূলদের সত্য হওয়ার কথা ঘোষণা করে এসেছেন আমিও তেমনি পূর্ববর্তী নবী-রসূলদের সত্যতা ঘোষণা করছি। তাই আমার রিসালাত মেনে নিতে দ্বিধা-সংকোচ করার কোন কারণ তোমাদের জন্য নেই।

দ্বিতীয় অর্থ হলো, আমার আগমণ সম্পর্কে তাওরাতে যেসব সুসংবাদ বিদ্যমান আমি তার বাস্তব রূপ। তাই তোমাদের কর্তব্য আমার বিরোধিতা না করে এই ভেবে স্বাগত জানান যে, পূর্ববর্তী নবীগণ যার আগমনের সুসংবাদ আগে দিয়েছিলেন তিনি এখন এসে গিয়েছেন।

আর এই আয়াতাংশই পরবর্তী আয়াতাংশের সাথে মিলিয়ে পড়লে তৃতীয় আরেকটি অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তাওরাতে আল্লাহর রসূল আহমাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আগমনের সুসংবাদ দিচ্ছি। এই তৃতীয় অর্থ অনুসারে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের এই বাণী রসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের দেয়া সেই সুসংবাদের প্রতি ইঙ্গিত যা তিনি তাঁর কওমের সামনে ভাষণ দেয়ার সময় বলেছিলেন। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেনঃ

“তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমার মধ্য হইতে, তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে হইতে, তোমার জন্য আমার সদৃশ এক ভাববাদী উৎপন্ন করিবেন। তাঁহারই কথায় তোমার কর্ণপাত করিবে। কেননা হোরেবে সমাজের (সমাবেশ) দিবসে তুমি আপন ঈশ্বর সদাপ্রভুর কাছে এই প্রার্থনাই তো করিয়াছিলে, যথা আমি যেন আপন ইশ্বর সদাপ্রভুর রব পুনর্ব্বার শুনিতে ও এই মহাগ্নি আর দেখিতে না পাই, পাছে আমি মারা পড়ি। তখন সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, উহারা ভালই বলিয়াছে। আমি উহাদের জন্য উহাদের ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে তোমার সদৃশ এক ভাববাদী উৎপন্ন করিব ও তাহার মুখে আমার বাক্য দিব; আর আমি তাহাকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিব, তাহা তিনি উহাদিগকে বলিবেন। আর আমার নামে তিনি আমার যে সকল বাক্য বলিবেন, তাহাতে যে কেহ কর্ণপাত না করিবে, তাহার কাছে আমি পরিশোধ লইব। “( দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮: শ্লোক-১৫ থেকে ১৯ )

এটা তাওরাতের এমন একটি স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী যা মুহাম্মাদ ﷺ ছাড়া আর কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। এ ভাষণে হযরত মূসা (আ) তাঁর কওমকে আল্লাহ‌ তা’আলার এ বাণী শুনাচ্ছেন যে, আমি তোমার জন্য তোমার ভাইদের মধ্য থেকে একজনকে নবী করে পাঠাবো। একথা সবার কাছেই স্পষ্ট যে, কোন কওমের ‘ভাই’ কথার অর্থ ঐ কওমেরই কোন গোত্র বা খান্দান হতে পারে না। বরং তার অর্থ কেবল এমন কোন জাতিই হতে পারে যার সাথে তার বংশগত নিকট সম্পর্ক বিদ্যমান। এর অর্থ যদি খোদ বনী ইসরাঈলের মধ্য থেকেই কোন নবীর আগমণ হতো তাহলে তার ভাষা হতো, আমি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একজনকে নবী করে পাঠাব। অতএব বনী ইসরাঈলের ভাই অর্থ অনিবার্যভাবে হযরত ইসমাঈলের বংশধরগণই হতে পারে। আর হযরত ইবরাহীমের সন্তান হওয়ার কারণে হযরত ইসমাঈল ও তাঁর বংশধরগণ তাদের বংশগত আত্মীয় হিসেবে গণ্য। তাছাড়া বনী ইসরাঈলের কোন নবী এই ভবিষ্যদ্বানীর বাস্তব রূপ হতে পারেন না। এর আরো একটি কারণ এই যে, হযরত মুসার পরে বনী ইসরাঈলের মধ্য কোন একজন নবী নয় বরং বহু সংখ্যক নবী এসেছেন বাইবেলে যার ভুরি ভুরি বর্ণনা রয়েছে।

এই ভবিষ্যদ্বানীতে দ্বিতীয় যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো, যাকে নবী বানিয়ে পাঠান হবে তিনি হবেন হযরত মূসার মত। এ কথাই স্পষ্ট যে, এর অর্থ আকার-আকৃতি এবং জীবনের ঘটনাবলীর সাথে সাদৃশ্য মোটেই নয়। কারণ এ দিক দিয়ে বিচার করলে কোন ব্যক্তিই অপর কোন ব্যক্তির মত হয়না। আবার এর দ্বারা শুধু নবুওয়াতের গুণাবলীর দিক দিয়ে সাদৃশ্য বুঝায় না। কারণ হযরত মুসার পরে যত নবীর আগমণ ঘটেছে তাদের সবারই নবীসুলভ গুণাবলী ছিল এক অভিন্ন। তাই কোন একজন নবীর এরূপ বৈশিষ্ট্য হতে পারে না যে, তিনি এই গুণের ক্ষেত্রে তার অনুরূপ হবেন। তাই এ দু’টি দিক দিয়ে সাদৃশ্য বাদ পড়ার পর অপর কোন সাদৃশ্য দ্বারা যদি আগমণকারী নবীকে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করা বোধগম্য হতে পারে তবে সেই সাদৃশ্য এছাড়া আর কিছুই হতে পারে না যে, আগমনকারী নবী একটি স্বতন্ত্র শরীয়াত নিয়ে আসবেন। একমাত্র এদিক দিয়েই তিনি হতে পারেন হযরত মূসার অনুরূপ। আর এ বৈশিষ্ট্য হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ছাড়া তিনি অন্য কোন নবীর মধ্যে নেই। কারণ তাঁর আগে বনী ইসরাঈলের মধ্যে যত নবীই এসছেন তাঁরা ছিলেন হযরত মুসার শরীয়াতের অনুসারী। তাদের কেউ-ই স্বতন্ত্র কোন শরীয়াত নিয়ে আসেননি। ভবিষ্যদ্বানী নিম্নবর্ণিত বক্তব্য দ্বারা এ ব্যাখ্যা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠেঃ

“এটা তোমার (অর্থাৎ বনী ইসরাঈলের) সেই প্রার্থনা অনুসারে হবে যা তুমি আপন ঈশ্ব সদাপ্রভুর কাছে সমাবেশের দিন হোরেবে করেছিলে, যেন আমি আপন ঈশ্বর সদাপ্রভুর রব পুনর্বার শুনিতে এবং এই মহাগ্নি আর দেখতে না পাই আমি মারা পড়ি। তখন সদাপ্রভু আমাকে বললেন, তারা ভালই বলেছে। আমি তাদের জন্য তাদের ভ্রাতৃগনের মধ্যে থেকে তোমার সদৃশ এক ভাববাদী উৎপন্ন করবো ও তার মুখে আমার বাক্য দিব।” ( দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮: শ্লোক-১৫ থেকে ১৯ )

এই বাক্যটির মধ্যে উল্লেখিত হোরেব অর্থ সেই পাহাড় হযরত মূসাকে প্রথমবার যেখানে শরীয়াতের আহকাম বা বিধিবিধান দেয়া হয়েছিল। আর এর মধ্যে বনী ইসরাঈলদের যে প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হলো, ভবিষ্যতে যদি আমাদেরকে কোন শরীয়াত দেয়া হয় তাহলে যেন সেই ভীতিকর অবস্থার মধ্যে না দেয়া হয়, যা শরীয়াত দেয়ার সময় হোরেব পাহাড়ের পাদদেশে সৃষ্টি করা হয়েছিল। কুরআন মজীদ ও বাইবেল উভয় গ্রন্থে সেই সব অবস্থার উল্লেখ বিদ্যমান। (দেখুন, সূরা আল বাকারাহ, আয়াত ৫৫, ৫৬ , ৬৩ ; আল আরাফ, আয়াত ১৫৫ , ১৭১ ; বাইবেল যাত্রাপুস্তক ১৯: ১৭, ১৮; ) এর জবাবে হযরত মুসা বনী ইসরাঈলকে বলেছেনঃ আল্লাহ‌ তোমাদের এ প্রার্থনা কবুল করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আমি তাদের জন্য এমন একজন নবী পাঠাবো, যার মুখে আমার কথা দিব। অর্থাৎ হোরেব পাহাড়ের পাদদেশে যে ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল পরবর্তী শরীয়াত দেয়ার সময় সেই অবস্থার সৃষ্টি করা হবে না। বরং এর পরে যে নবীকে এই পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করা হবে তার মুখে আল্লাহর বাণী দিয়ে দেয়া হবে এবং তিনি আল্লাহর বান্দাদের তা শুনিয়ে দেবেন। এই স্পষ্ট কথাগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচানার পর এ ব্যাপারে কি কোন সন্দেহ থাকে যে, এ বাণীর বাস্তব রূপ হযরত মুহাম্মাদ ﷺ ছাড়া অন্য কেউ নয়? হযরত মূসার পরে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ শরীয়াত কেবল তাকেই দেয়া হয়েছে। হোরেব পাহাড়ের পাদদেশে বনী ইসরাঈলের যেমন সমাবেশ হয়েছিল তাকে শরীয়াত দেয়ার সময় এমন কোন সমাবেশ হয়নি এবং শরিয়াতের বিধিবিধান দেয়ার সময় কোন ক্ষেত্রেই সেইরূপ অবস্থার সৃষ্টি করা হয়নি যা সেখানে করা হয়েছিল।

# এটি কুরআন মজীদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। ইসলাম বিরোধীরা এ আয়াত নিয়ে যেমন অনেক অপপ্রচার চালিয়েছে তেমনি জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধও করেছে। কারণ এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম স্পষ্টভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উল্লেখ করে তাঁর আগমণের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তাই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা আবশ্যক।

একঃ এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নাম বলা হয়েছে ‘আহমাদ’। আহমাদ শব্দের দু’টি অর্থ। এক, আল্লাহর সর্বাধিক প্রশংসাকারী। দুই, সবচেয়ে বেশী প্রশংসিত অথবা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী প্রশংসার যোগ্য। সহীহ হাদীসসমূহ থেকে প্রমাণিত যে এটি ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি নাম। মুসলিম ও আবু দাউদ তায়ালিসীতে হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْحَاشِرُ ”আমি মুহাম্মাদ, আমি আহমাদ এবং আমি সমবেতকারী………………. হযরত যুবাইর ইবনে মুতয়িম থেকে ইমাম মালেক, বুখারী, মুসলিম, দরেমী, তিরমিযী এবং নাসায়ী একই বক্তব্য সম্বলিত অনেকগুলো হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই নামটি সাহাবীদের মধ্যেও পরিচিত ছিল। হযরত হাসসান ইবনে সাবেতের কবিতার একটি ছত্রে বলা হয়েছেঃ صَلَّى الْاِلَهُ وِمَنْ نَحِفُّ بِعَرْشِهِ , وَالطَّيِبُوْنَ عَلَى الْمُبَارَكِ اَحْمَدُ

“মহান আল্লাহ, তাঁর আরশের চারপাশে সমবেত ফেরেশতারা এবং সব পবিত্র সত্তা বরকত ও কল্যাণময় আহমাদের ওপর দরুদ পাঠিয়েছেন।”

এ বিষয়টি ইতিহাস থেকে প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম শুধু মুহাম্মাদ ছিল না বরং আহমাদও ছিল। আরবদের গোটা সাহিত্যে কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই, নবীর(সা.) পূর্বে কারো নাম আহমাদ রাখা হয়েছিল। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে এত অধিক সংখ্যক লোকের নাম আহমাদ ও গোলাম আহমাদ রাখা হয়েছে যে, তা হিসেব করাও অসম্ভব। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, নবুওয়াতের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র উম্মাতের মধ্যে তাঁর এই পবিত্র নামটি সুপরিচিত ও সুবিদিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম যদি আহমাদ না হয়ে থাকে তাহলে যারা তাদের ছেলেদের নাম গোলাম আহমাদ রেখেছে তারা তাদের ছেলেদেরকে কোন আহমাদের গোলাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল?

দুইঃ যোহন লিখিত সুসমাচারে সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত ঈসা মাসীহর আগমনের সময় বনী ইসরাঈল জাতি তিনজন মহাব্যক্তিত্বের আগমনের অপেক্ষায় ছিল। এক, মাসীহ, দুই, এলিয় (অর্থাৎ হযরত ইলিয়াসের পুনরায় আগমন) এবং তিন, “সেই নবী।” যোহনের সুসমাচারের ভাষা হলোঃ

“আর যোহনের (ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম) সাক্ষ্য এই,-যখন যিহুদিগণ কয়েকজন যাজক লেবীয়কে দিয়া যিরূশালেম হইতে তাঁহার কাছে এই কথা জিজ্ঞেস করিয়া পাঠাইল, ‘আপনি কে? ’তখন তিনি স্বীকার করিলেন, অস্বীকার করিলেন, না; তিনি স্বীকার করিলেন যে, আমি সেই খ্রীষ্ট নই। তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞেস করিল, তবে কি? আপনি কি এলিয়? তিনি বললেন আমি নই। আপনি কি সেই ভাববাদী? তিনি উত্তর করিলেন না। তখন তাহারা তাহাকে কহিল, আপনি কে? যাহারা আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন, তাহাদিগকে যেন উত্তর দিতে পারি। আপনার বিষয়ে আপনি কি বলেন? তিনি কহিলেন, আমি “প্রান্তরে এক জনের রব, যে ঘোষণা করিতেছে, তোমরা প্রভুর পথ সরল কর” …………………তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞেস করিল, আপনি যদি সেই খ্রীষ্ট নহেন, এলিয়ও নহেন, সেই ভাববাদীও নহেন তবে বাপ্তাইজ করিতেছেন কেন? ( অধ্যায়-১, পদ ১৯ থেকে ২৫ )

এসব কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বনী ইসরাঈল হযরত ঈসা মাসীহ এবং হযরত ইলিয়াস ছাড়াও আরো একজন নবীর আগমণের প্রতীক্ষায় ছিল। হযরত ইয়াহইয়া সেই নবী ছিলেন না। সেই নবীর আগমণ সম্পর্কে আকীদা-বিশ্বাস বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে এতটা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত ছিল যে, তাঁকে বুঝানোর জন্য সেই নবী কথাটা বলাই যেন যথেষ্ট ছিল। পুনরায় একথা বলার আর প্রয়োজনই হতো না যে, তাওরাতের যার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এসব কথা থেকে এও জানা গেল যে, তিনি যে নবীর প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তাঁর আগমনের বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত ছিল। কেননা, হযরত ইয়াইহিয়াকে যখন বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করা হলো, তখন তিনি একথা বলেননি যে, তোমরা কোন নবী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ, আর কোন নবী তো আসবেন না?

তিনঃ এবার সেই সব ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি একটু লক্ষ্য করুন যা যোহনের সুসমাচারের ১৪ থেকে ১৬ পর্যন্ত অধ্যায়ে একাধারে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

“আর আমি পিতার নিকট নিবেদন করিব এবং তিনি আর এক সহায় তোমাদিগকে দিবেন, যেন তিনি চিরকাল তোমাদের সঙ্গে থাকেন; তিনি সত্যের আত্মা; জগত তাঁহাকে গ্রহণ করিতে পারে না; কেননা সে তাঁহাকে দেখেনা, তাঁহাকে জানেও না; তোমরা তাঁহাকে জান, কারণ তিনি তোমাদের নিকটে অবস্থিতি করেন ও তোমাদের অন্তরে থাকিবেন” (১৪: ১৬, ১৭)

“তোমাদের নিকটে থাকিতে থাকিতেই আমি এইসকল কথা কহিলাম। কিন্তু সেই সহায়, পবিত্র আত্মা, যাঁহাকে পিতা আমার নামে পাঠাইয়া দিবেন, তিনি সকল বিষয়ে তোমাদিগকে শিক্ষা দিবেন এবং আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা বলিয়াছি, সে সকল স্মরণ করাইয়া দিবেন।” (১৪: ২৫, ২৬)।

“এর পর আমি তোমাদের সহিত আর অধিক করা বলিব না; করণ জগতের অধিপতি আসিতেছে, আর আমাতে তাহার কিছুই নাই। “( ১৪: ৩০ )

“যাঁহাকে আমি পিতার নিকট হইতে তোমাদের কাছে পাঠাইয়া দিব, সত্যের সেই আত্মা, যিনি পিতার নিকট হইতে বাহির হইয়া আইসেন-যখন সেই সহায় আসিবেন-তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন। “(১৫: ২৬)।

“তথাপি আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল, কারণ আমি না গেলে সেই সহায় তোমাদের নিকটে আসিবেন না। কিন্তু আমি যদি যাই, তবে তোমাদের নিকটে তাঁহাকে পাঠাইয়া দিব। “(১৬: ৭)।

“তোমাদিগকে বলিবার আমার আরও অনেক কথা আছে, কিন্তু তোমরা এখন সে সকল সহ্য করিতে পার না। পরন্তু তিনি, সত্যের আত্মা, যখন আসিবেন তখন পথ দেখাইয়া তোমাদিগকে সমস্ত সত্যে লইয়া যাইবেন; কারণ তিনি আপনা হইতে কিছু বলিবেন না কিন্তু যাহা শুনেন, তাহাই বলিবেন এবং আগামী ঘটনাও তোমাদিগকে জানাইবেন। তিনি আমাকে মহিমান্বিত করিবেন; কেননা যাহা আমার, তাহাই লইয়া তোমাদিগকে জানাইবেন। পিতার যাহা যাহা আছে সকলই আমার; এই জন্য বলিলাম, যাহা আমার, তিনি তাহাই লইয়া থাকেন ও তোমাদিগকে জানাবেইন। “( ১৬: ১২-১৫ )।

চারঃ বাইবেলের এসব উদ্বৃতির সঠিক অর্থ নিরূপণের জন্য সর্বপ্রথম জানা দরকার যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর সমকালীন ফিলিস্তিনবাসীদের ভাষা ছিল আরামীয় ভাষায় সেই কথ্য রূপ যাকে সুরিয়ানী (প্রাচীন সিরীয় ভাষা) বলা হয়। ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের দুই আড়াই শত বছর পূর্বেই সালুকী (Seleucie) শাসন আমলে এ অঞ্চল থেকে ইব্রিয় বা হিব্রু ভাষা বিদায় নিয়েছিল এবং সুরিয়ানী ভাষা তার স্থান দখল করেছিল। যদিও প্রথমে সালুকী এবং পরে রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবে গ্রীক ভাষাও এ অঞ্চলে পৌঁছেছিল কিন্তু যে শ্রেণীটি সরকার ও রাজদরবারে স্থান করে নিয়েছিল কিংবা স্থান করে নেয়ার জন্য গ্রীক ভাবধারা পন্থী হয়ে গিয়েছিল কেবল তাদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ সুরিয়ানী ভাষার একটি বিশেষ কথ্য রূপ (dialect) ব্যবহার করত, যার ধ্বনি, কথনভঙ্গি, উচ্চারণরীতি এবং বাকধারা দামেশক অঞ্চলে প্রচলিত সুরিয়ানী ভাষারূপ থেকে ভিন্ন ছিল এবং এ দেশের সাধারণ মানুষ গ্রীক ভাষার সাথে এতটা অপরিচিত ছিল যে, ৭০ খৃস্টাব্দে যিরুশালেম দখলের পর রোমান জেনারেল টিটুস (Titus) যিরুশালেমের অধিবাসীদের সামনে গ্রীক ভাষায় বক্তৃতা করলে তা সুরিয়ানী ভাষায় অনুবাদ করতে হয়েছিল। এ থেকে আপনা আপনি প্রমাণিত হয় যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর শাগরিদদের যা বলেছিলের তা অবশ্যই সুরিয়ানী ভাষায় হবে।

দ্বিতীয় যে, বিষয়টি জানা জরুরী তা এই যে, বাইবেলের চারটি পুস্তক বা সুসমাচারই সেই সব গ্রীক ভাষাভাষী খৃস্টানদের লেখা যারা হযরত ঈসার পর এ ধর্ম গ্রহণ করেছিল। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বাণী ও কাজকর্মের বিস্তারিত বিবরণ তাদের কাছে সুরিয়ানী ভাষী কোন খৃস্টানদের মাধ্যমে লিখিত আকারে নয় বরং মৌখিক বর্ণনার আকারে পৌঁছেছিল এবং সুরিয়ানী ভাষার এই বর্ণনাসমূহকে তারা নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে লিপিবদ্ধ করেছিল। এসব পুস্তক বা সুসমাচারের কোনটিই ৭০ খৃস্টাব্দের পূর্বে লিখিত নয়। আর যোহন লিখিত সুসমাচার তো হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের একশত বছর পরে সম্ভবত এশিয়া মাইনরের এফসুস শহরে বসে লেখা। তাছাড়াও গ্রীক ভাষায় সর্বপ্রথম লিখিত সুসমাচারের মূল কোন কপিও সংরক্ষিত নাই। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে গ্রীক ভাষায় লিখিত যেসব পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে এনে একত্রিত করা হয়েছিল তার কোনটিই চতুর্থ শতাব্দির পূর্বের নয়। তাই তিন শতাব্দীকাল সময়ে এসবের মধ্যে কি কি রদবদল এবং পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে তা বলা মুশকিল। যে জিনিস এ বিষয়টিকে বিশেষভাবে সন্দেহজনক করে তোলে তা হলো, খৃস্টানরা তাদের পছন্দ মাফিক জেনে বুঝে তাদের সুসমাচারের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনকে বৈধ মনে করে এসেছে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা (১৯৪৬ সনের সংস্করণে) এর বাইবেল শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবন্ধের রচয়িতা লিখছেনঃ “বাইবেলের সুসমাচারসমূহে অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বাক্য যা পদকেই অন্য কোন সূত্র থেকে এনে গ্রন্থের মধ্যে শামিল করার মত সুস্পষ্ট পরিবর্তন করা হয়েছে জেনে শুনে…………………. স্পষ্টত উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। তা করেছে এমন সব লোক যারা মূল গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কোন জায়গা থেকে কিছু তথ্য লাভ করেছে এবং গ্রন্থকে উন্নত ও অধিক কল্যাণকর বানানোর জন্য নিজের পক্ষ থেকে তার মধ্যে সেই সব তথ্য শামিল করার অধিকারী বলে নিজেদেরকে মনে করেছে…………………এরূপ বহুসংখ্যক সংযোজন দ্বিতীয় শতকেই হয়েছিল। কিন্তু তার উৎস সম্পর্কে জানা যায়নি। “

বর্তমানে বাইবেলের সুসমাচারসমূহে আমরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যেসব বাণী দেখতে পাই তা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিকভাবে উদ্ধৃত হয়েছে এবং তাতে কোন রদবদল ও পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধিত হয়নি এমন কথা বলা উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত কঠিন।

তৃতীয় এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলমানদের বিজয়ের পরেও প্রায় তিন শতাব্দীকাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের খৃস্টান অধিবাসীদের ভাষা ছিল সুরিয়ানী এবং খৃস্টীয় নবম শতকে গিয়ে আরবী ভাষা সে স্থান দখল করে। সুরিয়ানী ভাষাভাষী ফিলিস্তিনবাসীদের মাধ্যমে খৃস্টীয় ঐতিহ্য বা ধর্মাচারণ, আচার-অনুষ্ঠান ও ইতিহাস সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলিম মনীষীগণ লাভ করেছিলেন তা সেই সব লোকদের লব্ধ তথ্যের তুলনায় অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য হওয়া উচিত যা তাদের কাছে সুরিয়ানী থেকে গ্রীক এবং গ্রীক থেকে ল্যাটিক ভাষায় অনুবাদের পর অনুবাদ হয়ে পৌঁছেছিল। কেননা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মুখ থেকে উচ্চারিত মূল সুরিয়ানী শব্দসমূহ মুসলিম মনীষীদের কাছে সংরক্ষিত থাকার সম্ভাবনাই বেশী ছিল।

পাঁচঃ অনস্বীকার্য এসব ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি লক্ষ্য করে দেখুন ওপরে উদ্ধৃত যোহন লিখিত সুসমাচারের পদগুলোতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এমন একজন আগমনকারীর আগমনের সুসংবাদ দিচ্ছেন যিনি তাঁর পরে আসবেন। তিনি তাঁর সম্পর্কে বলেছেনঃ তিনি হবেন গোটা বিশ্বের নেতা (সরওয়ারে আলম), চিরকাল থাকবেন, সত্যের সবগুলো পথ দেখাবেন এবং নিজে তাঁর (হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। যোহন লিখিত সুসমাচারের এসব বাক্যের মধ্যে “পবিত্র আত্মা”এবং “সত্যের আত্মা” ইত্যাদি কথাগুলো অন্তর্ভুক্ত করে মূল বিষয় ও বক্তব্যকে বিকৃত করার পুরোপুরি চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গভীর মনোযোগ সহকারে বাক্যগুলো পড়লে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যে আগমনকারীর আগমনের কথা বলা হয়েছে তিনি কোন আত্মা নন বরং মানুষ। তিনি এমন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাঁর শিক্ষা হবে বিশ্বজনীন, সর্বব্যাপী এবং কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী সেই বিশেষ ব্যক্তিকে বুঝানোর জন্য বাইবেলের বাংলা অনুবাদের ‘সহায়’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং যোহন লিখিত মূল সুসমাচারের গ্রীক ভাষার যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল সে ব্যাপারে খৃস্টানদের অনড় দাবী হচ্ছে, যে শব্দটি ছিল Paracletis কিন্তু শব্দটির অর্থ নিরূপণ খোদ খৃস্টান পণ্ডিতগণকে যথেষ্ট জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মূল গ্রীক ভাষায় Paraclet শব্দটির কয়েকটি অর্থ হয়। কোন স্থানের দিকে ডাকা, সাহায্যের জন্য ডাকা, ভীতি প্রদর্শন করা, সাবধান করা, উৎসাহিত করা, প্ররোচিত করা, আশ্রয় প্রার্থনা করা বা আবেদন নিবেদন করা এবং দোয়া করা। তাছাড়াও গ্রীক বাগবিধি অনুসারে শব্দটির অর্থ হয় সান্ত্বনা দেয়া, পরিতৃপ্ত করা, সাহস যোগানো। বাইবেলের যেসব জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেসব জায়গায় এর কোন একটি অর্থও খাপ খায় না। ওরাইজেন( Origen ) কোথাও এর অনুবাদ করেছেন Consolator আবার কোথাও অনুবাদ করেছেন deprecator । কিন্তু অন্যান্য ব্যাখ্যাকারগণ এ দু’টি অনুবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেননা প্রথমত গ্রীক ভাষার ব্যাকারণ অনুসারে এটি শুদ্ধ নয়।

দ্বিতীয়ত, সবগুলো বাক্যের যেখানে যেখানে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে এই অর্থ খাপ খায় না। আরো কিছু সংখ্যক অনুবাদক এর অনুবাদ করেছেন Teacher . কিন্তু গ্রীক ভাষার ব্যবহার রীতি অনুসারে এ অর্থও গ্রহণ করা যেতে পারে না। এর অনুবাদে তার তুলিয়ান এবং অগাষ্টাইন Advocate শব্দটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আরো কিছু সংখ্যক লোক Assistant , Comforter এবং Consoler ইত্যাদি শব্দ গ্রহণ করেছেন। (দেখুন ইনসাইক্লোপেডিয়া অব বাইবেলিক্যাল লিটারেচার, শব্দ-প্যারাক্লিটাস)। এখন মজার ব্যাপার হলো, গ্রীক ভাষাতেই অন্য একটি শব্দ আছে Perilytos যার অর্থ প্রশংসিত। এ শব্দটি সম্পূর্ণরূপে মুহাম্মাদ محمد শব্দের সামার্থক। উচ্চারণের ক্ষেত্রেও Periclytos এবং Periclytos এর মধ্যে বেশ মিল আছে। অসম্ভব নয় যে, যেসব খৃস্টান মহাত্মনরা তাদের ধর্মগ্রন্থসমূহে নিজেদের মর্জি ও পছন্দ মাফিক নির্দ্বিধায় পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে অভ্যস্ত ছিলেন তারা যোহন কর্তৃক বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর এই শব্দটিকে নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী দেখতে পেয়ে তা লিপিবদ্ধ করার সময় কিছুটা রদবদল করে দিয়েছে। এ বিষয়টি যাঁচাই করার জন্য যোহন কর্তৃক লিখিত আদি গ্রীক ভাষায় সুসমাচার গ্রন্থ কোথাও বর্তমান নেই। তাই দু’টি শব্দের মধ্যে মূলত কোনটি ব্যবহার করা হয়েছিল তা অনুসন্ধান করে দেখার সুযোগ নেই।

ছয়ঃ কিন্তু যোহন কোন গ্রীক শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তার ওপরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা নির্ভর করে না। কেননা তাও অনুবাদ। পূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে, ফিলিস্তিনের সুরিয়ানী ভাষা ছিল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষা। তাই তিনি তাঁর সুসংবাদ বাণীতে যে শব্দ ব্যবহার করে থাকবেন তা অবশ্যই সুরিয়ানী ভাষারই কোন শব্দ হবে। সৌভাগ্যবশত আমরা সুরিয়ানী ভাষার সেই মূল শব্দটি পাচ্ছি ইবনে হিশামের সীরাত গ্রন্থে এবং তার সমার্থক গ্রীক শব্দটি কি তাও সাথে সাথে ঐ একই গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বরাত দিয়ে ইবনে হিশাম ইউহান্নাস (যোহন)-এর সুসমাচারের ১৫ অধ্যায়ের ২৩ থেকে ২৭ পদ এবং ১৬ অধ্যায়ের পুরো অংশের অনুবাদ উদ্ধৃত করেছেন এবং তাতে গ্রিক ভাষার فارقليط শব্দের জায়গায় সুরিয়ানী ভাষায় منحمنا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অতঃপর ইবনে ইসহাক অথবা ইবনে হিশাম এভাবে তার ব্যাখ্যা করেছেন যে, (منحمنا) (برقليطس) হয়। (ইবনে হিশাম, ১ ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮)।

এখন দেখুন, ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণিত যে, খৃস্টীয় নবম শতক পর্যন্ত ফিলিস্তিনের খৃস্টান জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল সুরিয়ানী। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকেই এ অঞ্চল ইসলামবিজিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইবনে ইসহাক ৭৬৮ খৃস্টাব্দে এবং ইবনে হিশাম ৮২৮ খৃস্টাব্দে ইনতিকাল করেন। এর অর্থ হলো, তাঁদের উভয়ের যুগেই ফিলিস্তিনের খৃস্টানরা সুরিয়ানী ভাষায় কথা বলত। আর ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের জন্য তাদের নিজ দেশের খৃস্টান নাগরিকদের সাথে যোগাযোগ বা সম্পর্ক স্থাপন মোটেই কোন কঠিন বিষয় ছিল না। তা ছাড়াও সে সময় লক্ষ লক্ষ গ্রীক ভাষা খৃস্টান ইসলামী ভূখণ্ডে বসবাস করত। তাই সুরিয়ানী ভাষার কোন শব্দ গ্রীক ভাষার কোন শব্দের সমর্থক তা চেনে নেয়াও তাদের জন্য কঠিন ছিল না। এখন কথা হলো ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃত অনুবাদের যদি সুরিয়ানী শব্দ منحمنا মুনহামান্না ব্যবহৃত হয়ে থাকে আর ইবনে ইসহাক বা ইবনে হিশাম যদি তার ব্যাখ্যা এই করে থাকেন যে, আরবী ভাষায় তার সমার্থক শব্দ “মুহাম্মাদ” এবং গ্রীক ভাষায় “বারকালীতুস” তাহলে এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশই আর থাকে না যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের পবিত্র নাম নিয়েই তার আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। সাথে সাথে একথাও জানা যায় যে, যোহন কর্তৃক গ্রিক ভাষায় লিখিত সুসমাচারে মূলত Periclytos শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছিল যা পরবর্তীকালে কোন এক সময়ে খৃস্টানরা পরিবর্তন করে Paracletus বানিয়ে দিয়েছে। সাতঃ এর চেয়েও প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রমাণ হলো হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ একটি বর্ণনা। তাতে তিনি বলেছেন, নাজ্জাশী যখন তাঁর দেশ হাবশায় হিজরাতকারী মুহাজিরদের তাঁর দরবারে ডেকে পাঠালেন এবং হযরত জা’ফর ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুখে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের শিক্ষাসমূহ সম্পর্কে শুনলেন তখন তিনি বলে উঠলেনঃ

مَرْحَباًرَسُولُ اللَّهِ وإِنَّهُ الَّذِى نَجِدُ فِى الإِنْجِيلِ وَإِنَّهُ الَّذِى بَشَّرَ بِهِ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ (مسند احمد)

“স্বাগত জানাই তোমাদেরকে আর স্বাগত জানাই তাঁকেও যার নিকট থেকে তোমরা এসেছ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি আল্লাহর রসূল। আর তিনিই সেই সত্তা যাঁর উল্লেখ আমরা ইনজীলে দেখতে পাই এবং তিনিই সেই সত্তা যার সুসংবাদ ঈসা ইবনে মারয়াম দিয়েছিলেন। “

বিভিন্ন হাদীসে এ কাহিনী খোদ হযরত জা’ফর (রা.) এবং হযরত উম্মে সালমা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে শুধু এ কথাই প্রমাণিত হয় না যে, সপ্তম শতাব্দির শুরুতে নাজ্জাশী জানতেন, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম একজন নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বরং একথাও প্রমাণিত হয় যে, বাইবেলের সুসমাচারে সেই নবীর এমন সব সুস্পষ্ট লক্ষণাদিরও উল্লেখ ছিল যার ভিত্তিতে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই যে সেই নবী সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নাজ্জাসী একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। তবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের এ সুসংবাদ সম্পর্কে নাজ্জাশীর জ্ঞানের সুত্র ও উৎস যোহন লিখিত এই সুসমাচার ছিল, না অন্য আর কোন উৎস ও সুত্র সে সময় বর্তমান ছিল, এ বর্ণনা থেকে তা জানা যায় না। আটঃ সত্য কথা হলো, খৃস্টান গীর্জাসমূহ কর্তৃক নির্ভরযোগ্য ও সর্বসমর্থিত ( CanonicalGospels ) বলে ঘোষিত চারখানি সুসমাচার যে কেবল রসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কেই হযরত ঈসা (আ) ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ জানার নির্ভরযোগ্য উৎস হতে পারে না, তাই নয় বরং তা খোদ হযরত ঈসা (আ) নিজের সঠিক জীবন বৃত্তান্ত ও শিক্ষাসমূহ সম্পর্কে অবগত হওয়ারও নির্ভরযোগ্য উৎস নয়। বরং তা জানার অধিক নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে বার্নাবাসের সেই সুসমাচার যাকে গীর্জাসমূহ বেআইনী ও অনিভরযোগ্য ( Apocryphal ) বলে উড়িয়ে দিয়ে থাকে। খৃস্টানরা তা গোপন করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। শত শত বছর পর্যন্ত তা লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন করে রাখা হয়েছিল। ইটালিয় ভাষায় অনূদিত এর একটি মাত্র কপি ষোড়শ শতাব্দিতে পোপ সিক্সটাসের ( Sixtus ) লাইব্রেরীতে পাওয়া যেত। কিন্তু তা পড়ার অনুমতি কারো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে তা জন টোলেন্ড নামক এক ব্যক্তির হাতে আসে। অতঃপর বিভিন্ন হাত ঘুরে ১৭৩৮ খৃস্টাব্দে তা ভিয়েনার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীতে পৌঁছে। ১৯০৭ খৃস্টাব্দে এ গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ অক্সফোর্ডের ক্লোরিন্ডন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার পর পরই সম্ভবত খৃস্টান জগত আঁচ করতে পারে যে, যে ধর্মকে হযরত ঈসার নামে নামকরণ করা হয় এ গ্রন্থ তারই মূলোৎপাটন করছে। তাই এর মুদ্রিত কপিসমূহ বিশেষ কোন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উধাও করে দেয়া হয়। এরপর তা আর কখনো প্রকাশিত হতে পারেনি। এ গ্রন্থেরই ইটালিয়ান ভাষার অনুবাদ থেকে স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত আরেকটি কপি অষ্টাদশ শতাব্দিতে পাওয়া যেত। জর্জ সেল তাঁর কুরআনের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকায় এ গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেটাও কোথাও গায়েব করে দেয়া হয়েছিল এবং বর্তমানে কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায় না। অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজী অনুবাদের একটি ফটোষ্ট্যাট কপি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি এর প্রতিটি শব্দ পড়েছি। আমার মনে হয়, এটা অতি বড় একটা নিয়ামত। খৃস্টানরা কেবল হিংসা-বিদ্বেষ ও হঠকারিতার কারণে এর থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছে।

খৃস্টীয় সাহিত্যে যেখানেই এই ইনজিল বা সুসমাচারের উল্লেখ দেখা যায়, সেখানেই একথা বলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যে, এটা কোন মুসলমানের রচিত নকল সুসমাচার যা বার্নাবাসের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা একটা নির্জলা মিথ্যা কথা। এত বড় একটা মিথ্যা বলার কারণ এই যে, এ গ্রন্থে বিভিন্নস্থানে স্পষ্টভাবে নবী ﷺ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী আছে। প্রথমত এই সুসমাচার গ্রন্থখানি পড়লে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এ গ্রন্থ কোন মুসলমানদের রচনা হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, এ গ্রন্থ যদি কোন মুসলমানের রচিত হতো তাহলে মুসলমানদের মধ্যে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ত এবং মুসলিম মনীষী ও পন্ডিতদের রচনায় ব্যাপকভাবে এর উল্লেখ থাকত। কিন্তু এক্ষেত্রে অবস্থা হলো জর্জ সেলের কোরআনের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকার পূর্বে এর অস্তিত্ব সম্পর্কেই মুসলমানদের আদৌ জানা ছিল না। তাবারয়ী, ইয়া’কূবী, মাস’উদী, আল বিরুনী ও ইবনে হাযম এবং অন্যান্য গ্রন্থকারগণ ছিলেন খৃস্টীয় সাহিত্য সম্পর্কে গভীর পান্ডত্যের অধিকারী মুসলিম মনীষী। তাদের কারো রচনাতেই খৃস্টান ধর্ম সম্পর্কিত আলোচনায় বার্নাবাসের সুসমাচারের আভাস-ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ইসলামী বিশ্বের গ্রন্থাগারসমূহে যেসব গ্রন্থরাজী ছিল ইবনে নাদীম রচিত “আল ফিহরিস্ত” এবং হাজী খলীফা রচিত “কাশফুয যুনুন” গ্রন্থেই তার ব্যাপক ও সর্বোত্তম তালিকা গ্রন্থ। এ দু’টি গ্রন্থেও তার কোন উল্লেখ নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে কোন মুসলমান পণ্ডিতই বার্নাবাসের সুসমাচারের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। একথাটি মিথ্যা হওয়ার তৃতীয় এবং সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মেরও ৭৫ বছর আগে পোপ গ্লাসিয়াসের ( Gelasius ) যুগে খারাপ আকীদা ও বিভ্রান্তিকর ( Heretical ) গ্রন্থরাজির যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং পোপের দেয়া একটি ফতোয়ার জোরে যা পড়তে নিষেধ করা হয়েছিল তার মধ্যে বার্নাবাসের সুসমাচার (Evangelium Barnabes) গ্রন্থখানিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রশ্ন হলো, তখন মুসলমান এসেছিল কোথা থেকে যে এই নকল ইনজীল বা সুসমাচার রচনা করেছিল? খোদ খৃস্টান পন্ডিত পুরোহিতগণও একথা স্বীকার করেছেন যে, সিরিয়া স্পেন, মিসর, প্রভুতি দেশে প্রাথমিক যুগের খৃস্টান গীর্জাসমূহে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বার্নাবাসের সুসমাচার প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ শতাব্দীতে এসে তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ( উল্লেখ্য যে, বার্নাবাসের সুসমাচার বইখানা গুগলে সার্চ দিয়ে আমি পেয়ে যাই। আলহামদুলিল্লাহ। বইটির পিডিএফ ফরমেট ডাউনলোড করতে পারবেন এখান থেকে – Evangelium Barnabes – The Gospel of Barnabas ( এ্যাপ নির্মাতা মোহাম্মদ নুর হোসেন, 29/10/2018 ))

নয়ঃ এই সুসমাচার থেকে নবী ﷺ সম্পর্কে হযরত ঈসার সুসংবাদসমূহ উদ্ধৃত করার আগে গ্রন্থখানির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা প্রয়োজন যাতে তার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায় এবং একথাও জানা যায় যে, খৃস্টানরা এর প্রতি এত মারমুখী কেন?

যে চারখানি সুসমাচারকে আইনসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য বলে গ্রহণ করে বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার কোনটিরই লেখক হযরত ঈসা (আ) এর সাহাবী ছিলেন না। তাঁরা কেউ একথা দাবীও করেননি যে, তিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাহাবীদের নিকট থেকে তথ্য নিয়ে তাঁর সুসমাচারে লিপিবদ্ধ করেছেন। যেসব উৎস থেকে তাঁরা তথ্য গ্রহণ করেছেন তার কোন বরাতও তারা উল্লেখ করেননি। যদি তাঁরা বরাত উল্লেখ করতেন তাহলে তা থেকে জানা যেতো যে, বর্ণনাকারী যেসব ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং যেসব বাণী উদ্ধৃত করেছেন তা তিনি নিজে দেখেছেন এবং শুনেছেন না একজন বা কয়েকজনের মাধ্যমে তা তাঁর কাছে পৌঁছেছে? পক্ষান্তরে বার্নাবাসের সুসমাচারের লেখক বলেছেন আমি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রথম বারজন হাওয়ারীর একজন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমি হযরত ঈসা মাসীহর সাথে ছিলাম এবং নিজের চোখে দেখা ঘটনা এবং নিজের কানে শোনা বাণী এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছি। শুধু এতটুকুই নয়, বরং গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছেন, পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় হযরত মাসীহ আমাকে বলেছিলেনঃ আমার ব্যাপারে যেসব ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তা বিদূরিত করা এবং দুনিয়ার সামনে সঠিক অবস্থা তুলে ধরা তোমার দায়িত্ব।

কে ছিলেন এই বার্নাবাস? বাইবেলের “প্রেরিতদের কার্য” পুস্তকে এই নামের এক ব্যক্তির উল্লেখ বার বার এসেছে। এ ব্যক্তি ছিল সাইপ্রাসের এক ইহুদী পরিবারের লোক। খৃস্টান ধর্মের প্রচার এবং ঈসা মাসীহর অনুসারীদের সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে তার সেবা ও অবদানের অনেক প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু কখন সে মাসীহর ধর্ম গ্রহণ করেছিল তা কোথাও বলা হয়নি এবং প্রাথমিক যুগের বারজন হাওয়ারীর যে তালিকা তিনটি সুসমাচারে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে কোথাও তার নামের উল্লেখ নেই। তাই উক্ত সুসমাচারের লেখক সেই বার্নাবাস নিজে না অন্য কেউ তা বলা কঠিন। মথি এবং মার্ক হাওয়ারীদের ( Apostles ) নামের যে তালিকা দিয়েছেন বার্নাবাসের দেয়া তালিকা শুধু দু’টি নামের ক্ষেত্রে তাদের থেকে ভিন্ন। ঐ দু’টি নামের একটি হলো ‘তূমা’। এ নামটির পরিবর্তে বার্নাবাস নিজের নাম উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়টি হলো, ‘শামউন কানানী’। এ নামটির পরিবর্তে তিনি ইয়াহুদা ইবনে ইয়া’কূবের নাম উল্লেখ করেছেন। লুক লিখিত সুসমাচারে এই দ্বিতীয় নামটিরও উল্লেখ আছে। তাই এরূপ ধারণা করা যুক্তিসঙ্গত যে, পরবর্তীকালে কোন এক সময় শুধু বার্নাবাসকে হাওয়ারীদের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য তূমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাতে তার সুসমাচার গ্রন্থের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর নিজেদের ধর্মগ্রন্থসমূহে এ ধরনের রদবদল ও পরিবর্তন পরিবর্ধন করে নেয়া ঐ সব মহাত্মনদের দৃষ্টিতে কোন অন্যায় ও অবৈধ কাজ ছিল না।

কেউ যদি বার্নাবাসের এই ইনজীল বা সুসমাচার গ্রন্থখানি পক্ষপাত শূন্য ও বিদ্বেষমুক্ত মনে চোখ খুলে পড়ে এবং বাইবেল নতুন নিয়মের চারখানি সুসমারের সাথে তার তুলনা করে তাহলে সে একথা উপলব্ধি না করে পারবে না যে, এই গ্রন্থখানি উক্ত চারখানি গ্রন্থের চেয়ে অনেক উন্নত মানের। এতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনের ঘটনাবলী অধিক বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যেন কেউ প্রকৃতপক্ষে সেখানকার সবকিছু দেখছিল এবং নিজেও তাতে শরীক ছিল। চারখানি সুসমাচারের অসংবদ্ধ ও খাপ ছাড়া কাহিনীসমূহের তুলনায় এর ঐতিহাসিক বর্ণনা অধিক সুসংহত এবং ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতারও আরো ভালভাবে বোধগম্য। এতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষাসমূহ বাইবেলের চারখানি সুসমাচারের তুলনায় অধিক স্পষ্ট, বিস্তারিত এবং মর্মস্পর্শীরূপে বর্ণিত হয়েছে। এতে তাওহীদের শিক্ষা, শিরক খণ্ডন, আল্লাহ‌ তা’আলার গুণাবলী, ইবাদতের প্রাণসত্তা এবং উত্তম ও উন্নত চরিত্রের বিষয়াবলী অত্যান্ত জোরালো ভাবে যুক্তি ও প্রমাণসহ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। যেসব শিক্ষানীয় উপমা ও উদাহরণের মাধ্যমে মাসীহ আলাইহিস সালাম যেসব বিষয় বর্ণনা করেছেন, চারখানি সুসমাচারে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। তিনি কি ধরনের বিজ্ঞোচিত পন্থায় তাঁর শাগরিদদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতেন এ গ্রন্থ থেকে সে বিষয়টিও অধিক বিস্তারিতভাবে জানা যায়। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষা, বাচনভঙ্গি এবং মেজাজ প্রকৃতি সম্পর্কে যার সামান্য পরিমাণও জ্ঞান আছে সে এই সুমাচার গ্রন্থখানি পাঠ করলে একথা স্বীকার না করে পারবে না যে, এটা পরবর্তীকালে কারো রচিত কোন নকল কাহিনী নয়। বরং চারখানি সুসমাচারের তুলনায় এতে হযরত ঈসা তার প্রকৃত মর্যাদায় অধিকতর স্পষ্ট হয়ে আমাদের সামনে ফুটে ওঠেন। তাছাড়া সুসমাচার চতুষ্টয়ে তাঁর বিভিন্ন বানীর মধ্যে যে বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় এ গ্রন্থে তার নামগন্ধ পর্যন্ত নেই।

হযরত ঈসার জীবন ও শিক্ষা হিসেবে এ গ্রন্থে যা বর্ণিত হয়েছে তা সঠিক অর্থে একজন নবীর জীবন ও শিক্ষা বলেই মনে হয়। এতে তিনি নিজেকে একজন নবী হিসেবেই পেশ করেছেন। পূর্ববর্তী সমস্ত নবী এবং আসমানী কিতাবসমূহকে সত্য বলে ঘোষণা করেছেন। এতে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, নবী-রাসূলের (আলাইহিমুস সালাম) শিক্ষা ছাড়া সত্যকে জানার জন্য কোন মাধ্যম নেই। যারা নবী-রাসূলের পরিত্যাগ করে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকেই পরিত্যাগ করে। সমস্ত নবী-রাসূল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের যে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি হুবহু সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। এ গ্রন্থে তিনি নামায, রোযা এবং যাকাতের শিক্ষা দিচ্ছেন। এ গ্রন্থে বার্নাবাস বহুস্থানে তাদের নামাযের যে উল্লেখ করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, এই ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও তাহাজ্জুদের সময়ই তারা নামায পড়তেন এবং সর্বদা নামাযের আগে অযু করতেন। নবী-রাসূলের মধ্যে থেকে হযরত দাউদ ও সুলায়মানকেও তিনি নবী বলে স্বীকৃতি দিতেন। অথচ ইহুদী ও খৃস্টানরা তাঁদেরকে নবীদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে রেখেছে। তিনি হযরত ইসমাঈলকেই ‘যাবীহ’ (যাঁকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে যবেহ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন-অনুবাদক) বলে ঘোষণা করেন, একজন ইহুদী আলেমকে তিনি স্বীকার করান যে, প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল ছিলেন ‘যাবীহ’ কিন্তু বনী ইসরাঈলরা জোড়াতালি দিয়ে জোর করে হযরত ইসহাককে যাবীহ বানিয়ে রেখেছে। কুরআন মজীদে আখেরাত, কিয়ামাত, জান্নাত ও দোযখ সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তাঁর শিক্ষাও প্রায় তার কাছাকাছি।

দশঃ বার্নাবাসের সুসমাচারে বিভিন্ন স্থানে রসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে স্পষ্ট সুসংবাদের উল্লেখ থাকার কারণে যে খৃস্টানরা এর বিরোধী তা নয়। কারণ নবীর ﷺ জন্মেরও বহু আগে তারা এ গ্রন্থকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের উষ্মা ও অসন্তুষ্টির প্রকৃত কারণ উপলব্ধি করতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রথম যুগের অনুসারীগণ তাঁকে কেবল একজন নবী হিসেবে স্বীকার করতেন, হযরত মূসার শরীয়াতের অনুসরণ করতেন, আকীদা-বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম ও ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে নিজেদেরকে বনী ইসরাঈল জাতির অন্য সবার থেকে মোটেই আলাদা কিছু মনে করতেন না এবং ইহুদীদের সাথে তাদের বিরোধ ছিল শুধু এতটুকু যে, তাঁরা হযরত ঈসাকে ‘মাসীহ’ হিসেবে মেনে নিয়ে তার প্রতি ঈমান এনেছিলেন, কিন্তু ইহুদীরা তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাতো। পরবর্তীকালে সেন্টপল এই দলে শামিল হলে সে রোমান, গ্রীক এবং অন্যন্য অ-ইহুদী ও অ-ইসরাঈল লোকদের মধ্যেও এ ধর্মের তাবলিগ ও প্রচার শুরু করে দেয় । এ উদ্দেশ্যে সে একে এমন একটি নতুন ধর্ম বানিয়ে ফেলে যার আকীদা-বিশ্বাস , মূলনীতি এবং হুকুম-আহকাম হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পেশকৃত ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ছিল । এই ব্যক্তি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাহচর্য আদৌ পায়নি । বরং তাঁর জীবদ্দশায় সে ছিল চরম বিরোধী এবং তাঁর পরেও কয়েক বছর পর্যন্ত সে তার ধর্ম অনুসারীদের চরম শত্রু ছিল । পরবর্তী সময়ে এই দলে শামিল হয়ে যখন সে একটি নতুন ধর্ম তৈরী করতে শুরু করে তখনও সে তার এ কাজের সামর্থনের হযরত ঈসার দেয়া কোন সনদ পেশ করেননি বরং নিজের ‘কাশফ’ ও ‘ইলহাম’ বা মনের স্বতষ্ফূর্ত সৎপ্রেরণার ভিত্তিতেই তা করেছে । নতুন এই ধর্ম রচনার ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল , ধর্ম হবে এমন যা দুনিয়ার সমস্ত অ-ইহুদী( Gentile ) গ্রহণ করবে । সে ঘোষণা করলো, খৃস্টানরা ইহুদীদের শরীয়াতের সমস্ত বিধি-নিষেধ ও বাধ্য বাধকতা থেকে মুক্ত । সে পানাহারের ব্যাপারে হালাল ও হারামের সব বিধি-নিষেধ তুলে দিলো । সে খাতনার নির্দেশও বাতিল করে দিল অ-ইহুদীদের কাছে যা বিশেষভাবে অপছন্দনীয় ছিল॥ এমন কি সে মাসীহর” খোদায়ী, খোদার বেটা হওয়া এবং সমস্ত আদম সন্তানের জন্মগত পাপের কাফ্ফারা বা প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য শূলিবিদ্ধ হয়ে জীবন দেয়ার আকীদ-বিশ্বাসও গড়ে নিল । কারণ তা সাধারণভাবে সমস্ত মুশরিকের মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল । হযরত ঈসার(আ) প্রথম যুগের অনুসারীগণ এসব বিদ’আতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন কিন্তু সেন্টপল যে দরজা খুলে দিয়েছিল তা দিয়ে অ-ইহুদী খৃস্টানদের এক বিরাট সয়লাব এ ধর্মে ঢুকে পড়লো যার মোকিবিলায় ঐ নগণ্য সংখ্যক লোকগুলো কোনক্রমেই টিকে থাকতে পারলেন না । তা সত্ত্বেও তৃতীয় খৃস্টাব্দের শেষ ভাগ পর্যন্তও এমন বহুলোক ছিলো যারা হযরত ঈসার খোদা হওয়ার আকীদা-অস্বীকার করতো । কিন্তু চতুর্থ খৃস্টাব্দের প্রারম্ভে (৩২৫ খৃঃ) নিকিয়ার ( Nicaea ) কাউন্সিল পল প্রবর্তিত আকীদা-বিশ্বাসকে খৃস্টানদের সর্বসম্মত ধর্ম হিসেবে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করে । অতপর রোমান সাম্রাজ্য খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে এবং কাইজার থিওডোসিয়াসের সময় খৃস্ট ধর্মই সাম্রাজ্যের সরকারী ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হয় । এরপর এটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার যে , যেসব গ্রন্থ এ আকীদার পরিপন্থী তা পরিত্যক্ত ঘোষিত হবে এবং কেবল সেই সব গ্রন্থরাজী নির্ভরযোগ্য বলে গৃহীত হবে যা এই আকীদার সাথে সংগতিপূর্ণ । ৩৬৭ খৃস্টাব্দে এথানাসিয়াসের ( Athanasius ) এক পত্রের দ্বারা প্রথমবারের মত স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থরাজির একটি ঘোষনা দেয়া হয় । পরে ৩৮২ খৃস্টাব্দে পোপ ডেমাসিয়াসের ( damasius ) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন তা অনুমোদন করে এবং পঞ্চম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে পোপ গেলাসিয়াস (Gelasius) এই গ্রন্থসমষ্টিকে স্বীকৃতি দেয়ার সাথে সাথে প্রত্যাখ্যাত গ্রন্থরাজীর একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন । অথচ পল প্রবর্তিত যেসব আকীদা-বিশ্বাসকে ভিত্তি করে ধর্মীয় গ্রন্থসমূহের নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেসব আকীদা-বিশ্বাসের কোন একটিও হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজে শিক্ষা দিয়েছিলেন বলে খৃস্টান পাদরী-পুরোহিতদের কেউ কখনো দাবী করতে পারেননি । বরং যে সুসমাচারগুলো নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহের অন্তর্ভুক্ত তার মধ্যেও হযরত ঈসার (আ) কোন বাণী থেকে ঐ সব আকায়েদের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ।

এসব অগ্রহণযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে বার্নাবাসের সুসমাচারকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হলো তা সরকারীভাবে গৃহীত খৃস্টাবাদের আকীদা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল । এ গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ সম্পর্কে এর রচয়িতা গ্রন্থের শুরুতে বলছেনঃ যেসব লোক শয়তানের প্রতারণায় পড়ে ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলে । খাতনা করা অপ্রয়োজনীয় মনে করে এবং হারাম খাদ্যকে হালাল করে দেয়া তাদের ধ্যান-ধারণা সংশোধনের উদ্দেশ্যে পলও এসব প্রতারিতদের একজন । তিনি বলেছেনঃ হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম যখন পৃথিবীতে ছিলেন তখন তাঁর মু’জিযাসমূহ দেখে মুশরিক রোমার সৈন্যরা সর্বপ্রথম তাঁকে খোদা এবং কেউ কেউ খোদার পুত্র বলতে শুরু করে । অতপর বনী ইসরাঈলদের সর্বসাধারণের মধ্যেও এই ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ে । এতে হযরত ঈসা (আ) অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েলিন । তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এই ভ্রান্ত আকীদা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যারা তাঁর সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলতো তাদেরকে অভিশাপ দিলেন । অতপর এই আকীদার প্রতিবাদের জন্য তিনি তাঁর শাগরেদদের সমগ্র ইয়াহুদিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন এবং যার থেকে এসব মু’জিযা প্রকাশ পাচ্ছে তাকে খোদা অথবা খোদার পুত্র ‘মনে করার ভ্রান্ত ও উদ্ভট ধারণা থেকে মানুষ যাতে বিরত থাকে সে জন্য যেসব মু’জিযা তাঁর নিজের থেকে প্রকাশ পেতো তাঁর দোয়ায় শাগরেদদের থেকেও সেসব মু’জিযা প্রকাশ করা হলো । এ ব্যাপারে তিনি হযরত ঈসার (আ) বক্তৃতাসমূহ বিস্তারিত উদ্ধৃতি করেছেন যাতে তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এসব ভ্রান্ত আকীদার প্রতিবাদ করেছিলেন । আর এই গোমরাহী প্রসার লাভ করায় হযরত ঈসা (আ) কতটা বিচলিত ছিলেন, তাও তিনি এ গ্রন্থের স্থানে স্থানে বর্ণনা করেছেন । তাছাড়া বার্নাবাস পলের গড়া এ আকীদাও খন্ডন করেছেন যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ক্রুশে জীবন দিয়েছিলেন । তিনি নিজ চোখে দেখা যে অবস্থা বর্ণনা করেছেন তাহলো, যে সময় ইয়াহুদা ইহুদী পুরোহিতদের নেতার নিকট থেকে ঘুষ গ্রহণ করে হযরত ঈসাকে গ্রেফতার করানোর জন্য সৈন্যদের নিয়ে আসলো তখন আল্লাহ তা’আলার হুকুমে চারজন ফেরেশতা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন এবং ইয়াহুদা ইসকার ইউতির আকৃতি ও কণ্ঠ অবিকল হযরত ঈসার আকৃতি ও কণ্ঠের মত করে দেয়া হলো । তাকেই শূলি বিদ্ধ করা হয়েছে, হযরত ঈসাকে (আ) নয় । এভাবে এই সুসমাচার গ্রন্থখানি পলের গড়াখৃস্টান ধর্মের মূল উটপাটিত করে ফেলেছে এবং কুরআনের বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে । অথচ এসব বক্তব্যের কারণেই কুরআন নাযিলের ১১৫ বছর আগে খৃস্টান পাদরীগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ।

এগারঃ এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বার্নাবাসের ইনজিল বা সুসমাচার প্রকৃতপক্ষে বাইবেলের চারটি সুমাচার থেকে অধিক নির্ভরযোগ্য সুসমাচার । এ গ্রন্থ হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা, জীবন-চরিত, এবং বাণীসমূহ সঠিকভাবে তুলে ধরে । এটা খৃস্টানদের দুর্ভাগ্য যে, এ গ্রন্থের সাহায্যে নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস শুধরে নেয়া এবং হযরত ঈসার (আ) মূল শিক্ষাসমূহ জানার যে সুযোগ তারা লাভ করেছিল শুধু জিদ ও হঠকারিতার কারণে তা থেকে তারা বঞ্চিত থেকে গেল । বার্নাবাস হযরত ঈসা (আ) থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যেসব সুসংবাদ বর্ণনা করেছেন এখন তা আমরা দ্বিধাহীনভাবে এখানে উদ্ধৃত করতে পারি । এসব সুসংবাদের কোনটিতে হযরত ঈসা (আ) নবীর (সা) নাম উল্লেখ করেছেন, কোনটিতে ‘রসূলুল্লাহ’ বলেছেন, কোনটিতে তাঁর জন্য ‘মাসীহ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, কোনটিতে ‘প্রশংসার যোগ্য’( Admirable ) বলছেন আবার কোনটিতে স্পষ্টভাবে এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা হুবহু لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ محمد رَسُولُ اللَّهِ এর সমার্থক । এখানে সবগুলো সুসংবাদবাণী উদ্ধৃত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় । কারণ তা এত অধিক সংখ্যক এবং বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভঙ্গিতে পূর্বাপর প্রসংগে এসেছে যে তার সমন্বয়ে একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থই তৈরী হতে পারে । আমরা তার মধ্য থেকে নমুনা হিসেবে এখানে কয়েকটি বাণী উদ্ধৃত করেছিঃ

“সমস্ত নবী-যাঁদেরকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, যাঁদের সংখ্যা এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার-অস্পষ্ট ভঙ্গীতে কথা বলেছেন । কিন্তু আমার পরে সমস্ত নবী এবং পবিত্র সত্তাসমূহের জ্যোতি আসবেন যিনি নবীদের বলা কথার অন্ধকার দিকের ওপর আলোকপাত করবেন । কারণ তিনি খোদার রসূল । “(অধ্যায়-১৭)

“ফারিশী এবং লাবীরা বললোঃ যদি তুমি মাসীহও না হয়ে থাকো , ইলিয়াসও না হয়ে থাকো কিংবা অন্য কোন নবীও না থাকো তাহলে তুমি নতুন শিক্ষা দিচ্ছ কেন এবং নিজেকে মাসীহর চেয়ে বড় করেই বা পেশ করছো কেন? জবাবে ঈসা বললেনঃ আমার দ্বারা আল্লাহ যেসব মুজিযা দেখান তা প্রকাশ করে যে, আমি তাই বলি যা খোদা চান । অন্যথায় তোমারা যার কথা বলে থকো, প্রকৃতপক্ষে আমি নিজেকে তার সেই (মাসীহ) চেয়ে বড় করে পেশ করার যোগ্য নই । যাকে তোমরা মাসীহ বলে থাকো আমি তো খোদার সেই রসূলের মোজার গিরা বা তাঁর জুতার ফিতা খোলারও উপযুক্ত নই, যাঁকে আমার আগে সৃষ্টি করা হয়েছিলো, আমার পরে আসবেন এবং সত্যের বাণী নিয়ে আসবেন , যাতে তাঁর দীনের কোন সীমাবদ্ধতা না থাকে । “(অধ্যায়-৪২)

“আমি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে তোমাদের বলেছি যেসব নবী এসেছেন তাঁরা সকলেই কেবল একটি মাত্র কওমের জন্য খোদার নির্দশন হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিলেন । তাই যেসব লোকের জন্য তাঁদের পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছাড়া সেই সব নবীর বাণী আর কোথাও প্রচারিত হয়নি । কিন্তু আল্লাহর রসূল যখন আসবেন খোদা হয়তো তাঁকে নিজের হাতের মোহর দিয়ে পাঠাবেন এমনকি দুনিয়ার যেসব কওম তাঁর শিক্ষা লাভ করবে তাদেরকেই তিনি মুক্তি ও রহমত পৌঁছিয়ে দেবেন । তিনি খোদাহীন লোকদের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে আসবেন এবং এমনভাবে মুর্তি পূজার মুলোৎপাটন করবেন যে, শয়তান অস্থির হয়ে উঠবে । “

“এরপর শাগরেদদের সাথে দীর্ঘ কথাবার্তার সময় হযরত ঈসা (আ) স্পষ্ট করে একথা বলেন যে, সেই নবী হবেন বনী ইসমাঈল বংশের লোক”(অধ্যায়-৪৩)

“এ জন্য আমি তোমাদের বলি যে, খোদার রসূল এমন এক দীপ্তি ও সৌন্দর্য যার দ্বারা খোদা তা’আলার সৃষ্ট প্রায় সব বস্তুই আনন্দিত হবে । কেননা, তিনি উপলদ্ধি ও উপদেশ, বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি , ভয় ও ভালবাসা এবং দূরদর্শিতা ও পরহেযগারীর প্রাণসত্তায় উজ্জীবিত । তিনি বদান্যতা ও দয়ামায়া , ন্যায় নিষ্ঠাতা ও তাকওয়া এবং শিষ্টাচার ও ধৈর্যের প্রাণসত্তা দ্বারা গুণান্বিত । আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাদের এই প্রাণসত্তা দান করেছেন তিনি তাদের তুলনায় তা তিনগুণ লাভ করেছেন । যে সময় তিনি দুনিয়ায় আসবেন সে সময়টা কত বরকতপূর্ণ ও কল্যাণময় হবে । নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করো, যেমনটি প্রত্যেক নবী তাঁকে দেখেছেন তেমনি আমিও তাঁকে দেখেছি এবং সম্মান দেখিয়েছি । তাঁর রূহকে দেখেই আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দিয়েছেন । আর আমি যখন তাঁকে দেখলাম তখন আমার প্রাণ একথা বলতে গিয়ে পরম প্রশান্তিতে ভরে উঠলো যে, হে মুহাম্মাদ , খোদা তোমাদের সাথে থাকুন এবং তিনি যেন আমাকে তোমার জুতার ফিতা বেঁধে দেয়ার যোগ্য বানিয়ে দেন । কারণ, এই মর্যাদাটুকু পেলেও আমি একজন বড় নবী এবং খোদার এক পবিত্র সত্তা হিসেবে পরিগণিত হবো” । (অধ্যায়-৪৪)

“(আমার চলে যাওয়ার কারণে) তোমাদের মন যেন বিচলিত না হয় এবং তোমরা ভয় না পাও । কারণ , আমি তোমাদের সৃষ্টি করি নাই । বরং আল্লাহ তা’আলা আমাদের স্রষ্টা , তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তোমাদেরকে রক্ষা করবেন । বাকী রইল আমার কথা । আমি এ সময় দুনিয়ায় এসেছি আল্লাহর সেই রাসূলের জন্য পথ পরিষ্কার করতে যিনি দুনিয়ার জন্য মুক্তি নিয়ে আসবেন…………. ইন্দিরিয়াস বললোঃ হে মহান শিক্ষাক, আমারা যাতে তাঁকে চিনতে পারি সে জন্য আপনি তাঁর কিছু নিদর্শন বলে দিন । ঈসা জবাব দিলেনঃ তিনি তোমাদের যুগে আসবেন না । বরং তোমাদের বহু বছর পরে আসবেন যখন আমার ‘ইনযিল’ এতটা বিকৃত হয়ে যাবে যে, বড় জোর ত্রিশজন ঈমানাদার অবশিষ্ট থাকবে । তখন আল্লাহ দুনিয়ার ওপরে অনুগ্রহ করবেন এবং তাঁর রাসূলকে পাঠাবেন । তাঁর মাথার ওপর সাদা মেঘ ছায়া দান করবে । তিনি যে, আল্লাহর মনোনিত তা এভাবে জানা যাবে এবং তাঁর দ্বারা দুনিয়া খোদার পরিচয় জানাতে পারবে । খোদাহীনদের বিরুদ্ধে তিনি বিরাট শক্তি নিয়ে আসবেন এবং পৃথিবী থেকে মুর্তিপূজা উচ্ছেদ করেবেন । তাঁর জন্য আমি খুবই আনন্দিত । কারণ তাঁর মাধ্যমে আমাদের খোদাকে চেনা যাবে, তাঁর পবিত্রতা প্রমাণিত হবে এবং সারা দুনিযা আমার সত্যতা জানতে পারবে । আর তিনি তাদের থেকে প্রতিশোধ নেবেন যারা আমাকে মানুষের চেয়ে বড় কিছু সাব্যস্ত করবে…………তিনি এমন একটি সত্য নিয়ে আসবেন যা সমস্ত নবী কর্তৃক আনীত সত্যের চেয়ে অধিক স্পষ্ট হবে । “(অধ্যায়-৭২)

“খোদার প্রতিশ্রুতি এসেছিল , যেরুশালেমে সুলায়ামানের উপাশনালয়ের মধ্যে অন্য কথাও নয় । কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করো, এমন এক সময় আসবে, যখন খোদা অন্য এক শহরে তাঁর রহমত নাযিল করবেন । অতপর সব জায়গায় সঠিকভাবে তাঁর ইবাদত বন্দেগী হতে পারবে । আর আল্লাহ তাঁর রহমতে সব জায়গায় সঠিক ও সত্যিকার নামায কবুল করবেন…………আমি প্রকৃতপক্ষে ইসরাঈলের পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণকারী নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি । কিন্তু আমার পরে সারা দুনিয়ার জন্য খোদার প্রেরিত সেই মাসীহ আসবেন যার জন্য আল্লাহ সারা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন । তখন সারা দুনিয়ায় আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী হবে এবং তাঁর রহমত নাযিল হবে । “ (অধ্যায়-৮৩)

“(ঈসা পুরোহিত সর্দারকে বললেনঃ) জীবন্ত সেই খোদার শপথ, যাঁর জন্য আমার প্রাণ নিবেদিত । সারা বিশ্বের জাতিসমূহ যে মাসীহর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে, আমাদের পিতা ইবরাহীমকে (আ) আল্লাহ যাঁর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই বলে যে, তোমার বংশের মাধ্যমে পৃথিবীর সব জাতি আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবে সে মাসীহ তো আমি নই । “ (আদিপুস্তকঃ অধ্যায়ঃ ২২ পদ-১৮)

“কিন্তু খোদা যখন আমাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবেন তখন শয়তান পুনরায় এভাবে বিদ্রোহ ছড়াবে যাতে খোদাকে যারা ভয় করে না তারা আমাকে খোদা এবং খোদার বেটা হিসেবে মেনে নেয় । তার কারণে আমার বাণী এবং শিক্ষা বিকৃত করে ফেলা হবে, এমনকি বড়জোর ত্রিশ জন ঈমানদার লোক অবশিষ্ট থাকবে । সেই সময় খোদা দুনিয়ার প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং তাঁর সেই রসূলকে পাঠাবেন যাঁর জন্য তিনি দুনিয়ার এই সব জিনিস সৃষ্টি করছেন । যিনি শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দক্ষিণ থেকে আসবেন এবং মূর্তিসমূহকে মূর্তির পূজারীদের সহ ধ্বংস করে ফেলবেন । শয়তান মানুষের ওপর যে কর্তৃত্ব লাভ করেছে তিনি তার থেকে সে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবেন । যারা তাঁর ওপর ঈমান আনবে তাদের মুক্তির জন্য তিনি খোদার রহমত নিয়ে আসবেন । আর বড়ই সৌভাগ্যের অধিকারী তারা যারা তাঁর কাথা মানবে । “ (অধ্যায় ৯৬)

“পুরোহিত সদার জিজ্ঞেস করলোঃ খোদার সেই রাসূলের পরে অন্য কোন নবী কি আসবেন? ঈসা জবাব দিলেনঃ তাঁর পরে প্রেরিত আর কোন সত্যনবী আসবেন না । কিন্তু অনেক মিথ্যা নবী আসবে যে কারণে আমি দুঃখিত ও মনক্ষুণ্ন । কেননি খোদার ইসাফপূর্ণ ফায়সালার কারণে শয়তান তাদের আবির্ভাব ঘটাবে । তারা আমার এই ইনযীলের আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখবে”(অধ্যায়-৯৭)

 

পুরোহিত সরদার জিজ্ঞেস করলোঃ সে মাসীহকে কোন নামে ডাকা হবে এবং কি কি নিদর্শন তাঁর আগমনকে প্রকাশ করবে? ঈসা জবাব দিলেনঃ সেই মাসীহর নাম ‘প্রশংসা যোগ্য’ । কেননা, আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর রূহ সৃষ্টি করেছিলেন , তখন নিজেই তার এ নাম রেখেছিলেন এবং সেখানে তাঁর ফেরেস্তাদের মত মর্যাদায় রাখা হয়েছিলো । খোদা বললেনঃ হে মুহাম্মাদ , অপেক্ষা কর । কেননা তোমার কারণেই আমি জান্নাত, পৃথিবী এবং আরো অনেক ‘মাখলুক’ সৃষ্টি করেবো । আর তা সব উপহার হিসেবে তোমাকে দেব । এমন কি যে তোমাকে মোবারকবাদ দেবে, তাকেও কল্যাণ দান করা হবে এবং যে তোমাকে অভিসম্পাত করবে তাকে অভিসম্পাত দেয়া হবে । যে সময় আমি তোমাকে দুনিয়ায় পাঠাবো তখন মুক্তির সংবাদ বাহক হিসেবে পাঠাবো । তোমার কথা হবে সত্য । আসমান ও যমীন স্থানচ্যুত হবে কিন্তু তোমার দীন টলবে না । তাই তাঁর পবিত্র ও কল্যাণময় নাম ‘মুহাম্মাদ’(সা) “(অধ্যায়-৯৭)

বার্নাবাস লিখছেনঃ এক সময়ে হযরত ঈসা (আ) তাঁর শাগরিদদের সামনে বললেনঃ আমার শাগরিদদেরই একজন (পরবর্তী সময়ে দেখা গেল ইয়াহুদী ইসকার ইউতি সেই শাগরিদ) ৩০ টি মুদ্রার বিনিময়ে আমাকে শত্রুদের কাছে বিক্রি করে দেবে । তারপরে বললেনঃ “আমার দৃঢ় বিশ্বাস , যে আমাকে বিক্রি করবে এরপর সে-ই আমার নামে মারা যাবে । কেননা, খোদা আমাকে পৃথিবী থেকে উপরে উঠিয়ে নেবেন এবং সেই বিশ্বাসঘাতকের চেহারা এমনভাবে পরিবর্তিত করে দেবেন যে, সবাই মনে করবে সে-ই আমি । তথাপি সে যখন জঘন্য মৃত্যুবরণ করবে তখন একটা সময়-কাল পর্যন্ত লাঞ্ছন আমারই হতে থাকবে । কিন্তু খোদার পবিত্র রাসূল মুহাম্মাদ যখন আসবে তখন সেই বদনাম দূর করে দেয়া হবে । আল্লাহ তা’আলা তা এ জন্য করবেন যে, আমি সেই মাসীহর সত্যতা স্বীকার করেছি । সেজন্য তিনি আমাকে এই পুরস্কার দেবেন । লোকে জানতে পারবে আমি বেঁচে আছি এবং সেই লাঞ্ছনাকর মৃত্যুর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই । “ (অধ্যায়-১১৩)

“(হযরত ঈসা শাগরিদদের বললেনঃ) আমি সন্দেহাতীতভাবে তোমাদের বলছি , যদি মূসার গ্রন্থের সত্যতা বিকৃত না হতো তাহলে খোদা আমাদের পিতা দাউদকে অন্য একখানি গ্রন্থ দিতেন না । আর দাউদের গ্রন্থের মধ্যে যদি বিকৃতি ঘটানো না হতো তাহলে খোদা আমাকে ইনযিল দিতেন না । কারণ, মহাপ্রভু, আমাদের খোদা পরিবর্তিত হওয়ার নন । আর তিনি সব মানুষকে একই বাণী দিয়েছেন । তাই যখন আল্লাহর রাসূল আসবেন এ সব জিনিসকে পরিষ্কার করে দেয়ার জন্যই আসবেন যা দিয়ে খোদাহীন লোকেরা আমার কিতাবকে কলুষিত করে ফেলেছে । “(অধ্যায়-১২৪)

এসব সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত ভবিষ্যদ্বাণীতে শুধু তিনিটি বিষয় এমন দেখা যায় আপাতঃ দৃষ্টিতে খটকা লাগায় । এক, এসব ভবিষ্যদ্বাণীতে এবং বার্নাবাসের ইনজীলের আরো কিছু বাক্যে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজের মাসীহ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন । দুই, শুধু ওপরে উদ্ধৃত বাক্যসমূহে নয় বরং এ সুসমাচারের বহুস্থানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল আরবী নাম ‘মুহাম্মাদ’ লেখা হয়েছে । অথচ পরবর্তীকালে আসবেন এমন কোন পবিত্র ব্যক্তি ও সত্তার মূল নাম উল্লেখ করা নবীদের ভবিষ্যদ্বাণীর সাধারণ নিয়ম বা রীতি নয় । তিন, এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘মাসীহ’ বলা হয়েছে ।

প্রথম সন্দেহের জবাব হলো, শুধু বার্নাবাসের সুসমাচারেই নয়, বরং লূক লিখিত সুসমাচারেও এ বিষয়ের উল্লেখ আছে যে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁকে ‘মাসীহ’ বলতে তাঁর শাগরিদদের নিষেধ করেছিলেন । লূকের ভাষা হলোঃ “তিনি তাহাদিগকে কহিলেন , কিন্তু তোমরা কি বল, আমি কে? পিতার উত্তর করিয়া কহিলেন, ঈশ্বরের সেই খ্রীষ্ট । তখন তিনি তাহাদিগকে দৃঢ়রূপে বলিয়া দিলেন ও আদেশ করিলেন , একথা কাহাকেও বলিও না । (অধ্যায়-৯ পদ ও ২২) সম্ভবত এর কারণ ছিল এই যে, বনী ইসরাঈল জাতি যে মাসীহর আগমনের অপেক্ষায় ছিল তাঁর সম্পর্কি তাদের ধারণা ছিল তিনি তরবারির জোরে ন্যায় ও সত্যের দুশমনের পরাচিত করবেন । তাই হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন, আমি সেই ‘মাসীহ’ নই । তিনি আমার পরে আসবেন ।

দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব হলো, বার্নাবাসের সুসমাচারের যে ইটালিয়ান অনুবাদ বর্তমানে পাওয়া যায় তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম ‘মুহাম্মাদ’ লিখিত আছে । কিন্তু একথা কেউ-ই জানে না যে, এ গ্রন্থ কোন কোন ভাষায় অনুবাদের অনুবাদ হয়ে অবশেষে ইটালিয়ান ভাষায় পৌঁছেছে । একথা সুস্পষ্ট যে, বার্নাবাসের মূল সুসমাচারের গ্রন্থখানা সুরিয়ানী ভাষারই হওয়ার কথা । কারণ হযরত ঈসা (আ) এবং তার অনুসারীদের ভাষা ছিল সুরিয়ানী । সেই মূল গ্রন্থখানা পাওয়া গেলে জানা যেতো, তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নাম কি লেখা হয়েছিলো । এখন যতটুকু অনুমান করা যায় তা হলো হযরত ঈসা আলাইহিস ওয়া সাল্লাম হয়তো মূল শব্দ ব্যবহার করেছিলেন مُنْحَمَنَّا (মুনহামান্না) যোহন লিখিত সুসমাচারের বরাত দিয়ে ইবনে ইসহাক যা বর্ণনা করেছেন । অতপর অনুবাদকারীরা হয়তো নিজ নিজ ভাষায় তার অনুবাদ করেছেন । এরপর কোন অনুবাদক হয়তো মনে করেছেন, ভবিষ্যদ্বাণীতে আগমনকারীর যে নাম বলা হয়েছে তা পুরোপুরি ‘মুহাম্মাদ’ শব্দের সমার্থক । তাই তিনি নবীর (সা) পবিত্র এই নামটিই লিখে দিয়েছেন । অতএব এ নামটির স্পষ্ট উল্লেখ থাকাই এরূপ সন্দেহ পোষনের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয় যে, বার্নাবাসের গোটা সুসমাচারটাই কোন মুসলমানের নকল রচনা ।

তৃতীয় সন্দেহের জবাব হলো, ‘মাসীহ’শব্দটি মূলত একটি ইসরাঈলী পরিভাষা । কুরআন মজীদে কেবল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্য এই পরিভাষাটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে । কারণ, ইহুদীরা তাঁর ‘মাসীহ’ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করতো । মূলত এটি কুরআন মজীদের কোন পরিভাষা নয় । আর কোরআন মজীদের কথাও এটিকে ইসরাঈলীদের পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়নি । তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে হযরত ঈসা আলইহিস সালাম যদি ‘মাসীহ’শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, আর কুরআনে তাঁর জন্য এ শব্দটি ব্যবহার না করা হয়ে থাকে তাহলে তার অর্থ এই নয় যে, বার্নাবাসের সুসমাচার তাঁর সাথে এমন কিছু সম্পর্কিত করছে যা কুরআন অস্বীকার করে । আসলে বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে প্রাচীন কাল থেকে একটা প্রথা চলে আসছিলো । প্রথমটি হলো, কোন বস্তু কিংবা ব্যক্তিকে যখন কোন পবিত্র উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করা হতো তখন সেই বন্তু বা ব্যক্তির মাথার ওপর তেল মেখে দিয়ে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই উদ্দেশ্যে নিবেদিত করা হতো । ইবরানী (ইব্রিয়) ভাষায় তেল মাখার এই কাজকে ‘মাসহ”বলা হতো । আর যে বস্তু বা ব্যক্তির ওপর তো মেখে দেয়া হতো তাকে ‘মাসীহ’ বলা হতো । উপাসনালয়ের পাত্রসমূহ এভাবে মুছে বা মর্দন করে উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট করা হতো । যাজক ও পুরোহিতদের পৌরহিত্যের ( Priesthood ) আসনে সমাসীন করার সময়ও ‘মাসহ’ করা হতো । বাদশাহ এবং নবীকেও যখন খোদার তরফ থেকে বাদশাহী বা নবুওয়াতের জন্য নিয়োগ করা হতো তখন ‘মাসহ’ করা হতো । সুতরাং বাইবেলের বর্ণনা মতে বনী ইসরাঈল জাতির ইতিহাসে বহু ‘মাসীহ’র সন্ধান পাওয়া যায় । পুরোহিত হিসেবে হযরত হারুন ‘মাসীহ’ ছিলেন । হযরত মূসা যাজক এবং নবী হিসেবে , তালূত বাদশাহ হিসেবে , হযরত দাউদ বাদশাহ এবং নবী হিসেবে, মালেক সাদক বাদশাহ এবং যাজক হিসেবে এবং হযরত “আল-ইয়াসা” নবী হিসেবে “মাসীহ” ছিলেন । পরবর্তীকালে কাউকে তেল মেখে দিয়ে নিবেদিত করার প্রয়োজনও ছিল না । বরং আল্লাহর তরফ থেকে কারো আদিষ্ট হওয়াই ‘মাসীহ’ হওয়ার সমার্থক হয়ে গিয়েছিল । উদাহরণ হিসেবে রাজলী-১ এর ১৯ অধ্যায় দেখুন । এতে বলা হয়েছে যে, খোদা হযরত ইলিয়াসকে (এলিয়) আদেশ করলেন, তুমি, ইসরায়েলকে ‘মাসহ’ কর, সে আরামের (দামেশক) বাদশাহ হিসেবে অভিষিক্ত হোক এবং নিমশির পুত্র যেহুকে ইসরাঈলের উপরে রাজপদে অভিষেক কর । আর আমার স্থলাভিষিক্ত নবী হওয়ার জন্য ইলীশায়কে (আল ইয়াসা) অভিষেক কর । তাদের কারো মাথায়ই তেল মর্দন করা হয়নি । খোদার পক্ষ থেকে তাঁর আদিষ্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেয়াই যেন তাকে ‘মাসীহ’ বা অভিষেক করার শালিম ছিল । অতএব ইসরাঈলী ধ্যান-ধারণা অনুসারে ‘মাসীহ’ শব্দটি মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হওয়ার সমার্থক ছিল । হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে শব্দটিকে এ অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন । (ইসরাঈলীদের দৃষ্টিতে “মাসীহ” শব্দটির অর্থ কি তার বুঝার জন্য দেখুনঃ সাইক্লোপেডিয়া অব বাইবেলিক্যাল লিটারেচার, শব্দ “মিস্ইয়াহ”) ।
[8/13, 9:10 PM] Engr Motaher: তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# মূল আয়াতে سحر শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে سحر শব্দটি যাদু অর্থে নয়, বরং ধোঁকা ও প্রতারণা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় যাদু অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার যেমন পরিচিত তেমনি ধোঁকা ও প্রতারণা অর্থে ব্যবহারও পরিচিতি। যেমনঃ আরবীতে বলা হয় سحره اى حدعه সে অমুক ব্যক্তিকে যাদু করেছে অর্থাৎ ধোঁকা দিয়েছে। যে দৃষ্টি ও চাহনি মন কেড়ে নেয় তাকে বলা হয় عين ساحرة যাদুমীয় চোখ। যে প্রান্তরে চারদিকে কেবল মরীচিকা আর মরীচিকাই চোখে পড়ে তাকে ارض ساحرة যাদুর প্রান্তর বলে। রৌপ্যকে পালিশ করে স্বর্ণের মত উজ্জ্বল করা হলে তাকে বলা হয় سحرت الفضة । সুতরাং আয়াতের অর্থ হলো, যখন সেই নবী, যার আগমনের সুসংবাদ হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম দিয়েছিলেন স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে আস বলেন তখন নবী ইসরাঈল এবং হযরত ঈসার উম্মাতগণ তাঁর নবুওয়াতের দাবীকে খোলাখুলি প্রতারণা ও জালিয়াতি বলে ঘোষণা করল।

১-৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আলােচ্য এ সূরাটিতে দুটি মৌলিক বিষয়ের ওপর আলােকপাত করা হয়েছে, যা এর বর্ণনাধারার মধ্যে অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে ফুটে ওঠেছে, এ মৌলিক বিষয় দুটি বুঝানাের জন্যে বারবার ইশারা-ইংগিতের পন্থাও অবলম্বন করা হয়েছে। আলােচনার প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক মুসলমানের মনের মধ্যে একথা দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করে দেয়া যে, মানুষের জন্যে যে জীবন ব্যবস্থা প্রেরণ করা হয়েছে তা হচ্ছে তার শেষ অবস্থা সামনে রেখে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর বিধান কায়েম করা। মানবেতিহাসে ইতিপূর্বে মানুষের পরিবর্তনশীল অবস্থার প্রেক্ষিতে এই জীবন বিধানই বার বার এসেছে। এসেছে বহু রসূলের জীবনে এবং তাদের অনুসরণে বহু মানব গােষ্ঠীর মধ্যে এ জীবন ব্যবস্থা চালু করার অভিজ্ঞতা মানুষ লাভ করেছে, যার পরিসমাপ্তি ঘটেছে শেষ নবীর জীবনে এসে। তাকে তিনি সমাপ্তকারী রসূল বানাতে চেয়েছিলেন এবং তার মাধ্যমে তিনি মানব নির্মিত সকল জীবন ব্যবস্থার ওপর তার প্রদত্ত এই জীবন ব্যবস্থাকে বিজয়ী করতে চেয়েছিলেন। এই প্রসংগে মূসা(আ.)-এর রেসালাতের কথা উল্লেখিত হয়েছে যাতে একথা স্থিরভাবে জানিয়ে দেয়া যায় যে, যে জাতির কাছে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন, তারা তাকে মারাত্মক কষ্ট দিয়েছিলাে এবং এর ফলে তারা গােমরাহ হয়েছিলাে। অতপর তারা আর পৃথিবীর বুকে এই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়নি। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন মূসা(আ.) তার জাতিকে ডেকে বললাে, হে আমার জাতি, কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছো, অথচ তােমরা তাে জানাে, আমি তােমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল হয়ে এসেছি। এরপর যখন তারা (সােজা পথ ছেড়ে দিয়ে) বাঁকা পথ ধরে তখন আল্লাহ তায়ালাও তাদের অন্তরগুলােকে বাঁকা করে দিলেন এবং আল্লাহ তায়ালা এমন কোনাে অপরাধী জাতিকে হেদায়াত করেন না (যারা উপর্যুপরি অপরাধ করে চলে এবং কখনাে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় না)। এরপর আল্লাহর যমীনে তার দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে মূসা(আ.)-এর জাতির নেতৃত্বের অবসান হয়ে গেলাে। তারপর তারা আর কখনও আল্লাহর অনুগত হতে পারেনি। যেহেতু তারা সঠিক পথ পরিত্যাগ করে বাঁকা পথ অবলম্বন করেছিলাে। ফলে আল্লাহ তায়ালাও তাদের বাঁকা পথে চালিয়ে দিয়েছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে তারা ভুল পথ বেছে নিয়েছিল। এজন্যে আল্লাহ তায়ালাও তাদের জন্যে ভুল পথে চলা সহজ করে দিয়েছিলেন। আর আল্লাহ তায়ালা অপরাধী জাতিকে হেদায়াত করেন না। এরপর ঈসা(আ.)-এর রেসালতের কথা এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে যেন একথা জানানাে যায়, তিনি মূসা(আ.)-এর সাহায্যের জন্যেই প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি তার সামনে যে তাওরাত কিতাব বর্তমান ছিল তার সত্যতা প্রমাণ করার জন্যে এবং সর্বশেষ রসূল(স.)-এর পূর্বাভাস ও সুসংবাদ দান করার জন্যেও প্রেরিত হয়েছিলেন। তার পূর্ববতী আহলে কিতাব এবং পরবর্তী আহলে কিতাব ব্যক্তিগণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্যেও প্রেরিত হয়েছিলেন। এরশাদ হচ্ছে, স্মরণ কারাে সে সময়ের কথা, যখন মারইয়াম পুত্র ঈসা বললাে, হে বনী ইসরাঈল জাতি, অবশ্যই আমি তােমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছি। আমি সত্যায়নকারী তাওরাত কিতাবের, যা আমার সামনে রয়েছে এবং সুসংবাদদানকারী সেই (অনাগত) রসূলের, যিনি আমার পরে আসবেন, যার নাম হবে আহমাদ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মূসা(আ.)-এর পর আল্লাহর কাছ থেকে তিনি দ্বীন ইসলামের যে আমানত পেয়েছিলেন তাই তিনি পরবর্তী সেই রসূলের কাছে হস্তান্তর করতে এসেছিলেন যার সুসংবাদ তিনি দিচ্ছিলেন। আর আল্লাহর জ্ঞানভান্ডারে একথা মওজুদ ছিলাে এবং স্থির করা ছিল যে, তার দ্বীনকে শেষ বারের মতাে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করা হবে এবং শেষ রসূলের হাতে আল্লাহর যমীনে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবে, যদিও মােশরেকরা এটা পছন্দ করে না। এ সূরার মধ্যে আলােচিত প্রথম স্পষ্ট লক্ষ্যের ওপর স্থাপিত হয়েছে দ্বিতীয় লক্ষ্য। অতএব মুসলমানদের চেতনার মধ্যে একথা দৃঢ়তার সাথে স্থাপন করা হচ্ছে এবং তাদের ভালাে করে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, যে আকীদা বিশ্বাস তারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছে তারই ওপর ভিত্তি করে। গড়ে ওঠবে তাদের জীবন ব্যবস্থা, সেই জীবন ব্যবস্থাকে পৃথিবীর বুকে চালু করাই তাদের আসল দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়ােজন চূড়ান্ত সংগ্রামের এবং মানব নির্মিত সকল জীবন ব্যবস্থার ওপর ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হবে তাদের এই জিহাদ। এই চূড়ান্ত প্রচেষ্টাই আল্লাহর কাম্য। তিনি চান মুসলমানদের কথা ও কাজের মধ্যে কোনাে বৈপরীত্য না থাকুক। তিনি চান না এই ওয়াদা পালনে তারা কোনাে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করুক। তিনি চান তারা ঈমান আনার দাবী করে যে ওয়াদায় আবদ্ধ হয়েছে এই জিহাদের মাধ্যমেই তা পূরণ করুক। তিনি কিছুতেই পছন্দ করেন না যে, মােমেনরা জিহাদ করার আগ্রহ প্রকাশ করবে এবং তারপর বাস্তব জিহাদ যখন হাযির হবে, তখন তারা পেছন দিকে ফিরে দাঁড়াবে, যেমনটি অতীতে ঘটেছিলাে মুসলমানদের একটি দলের পক্ষ থেকে, যা বেশ কিছু রেওয়ায়াতের মাধ্যমে জানা যায়। আর এভাবেই সূরার শুরুতে সৃষ্টির সব কিছু যে আল্লাহর প্রশংসায় রত একথা ঘােষণার পর নাযিল হচ্ছে, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, কেন বলছাে এমন সব কথা যা তােমরা করাে না? আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণার বস্তু সেই কথা বলা যা তােমরা করাে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের পছন্দ করেন যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে সারিবদ্ধ হয়ে লড়াই করে যেন তারা এক সীসাঢালা প্রাচীর । এরপর সূরাটির মধ্যভাগে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে সব থেকে লাভজনক ব্যবসার দিকে আল্লাহ তায়ালা তাদের ডাকছেন। বলছেন, ‘হে ঈমানদাররা, আমি কি তােমাদের বলবাে এমন… আল্লাহর সাহায্য এবং আসন্ন বিজয়। সুতরাং সুসংবাদ দাও মােমেনদের।’ তারপর মােমেনদের প্রতি শেষ আহবান রেখে সূরাটি শেষ করা হচ্ছে। যেন তারা সেইভাবে আল্লাহর সাহায্যকারী দলে পরিণত হয়ে যায়, যেমন ঈসা(আ.)-এর একদল সাহায্যকারী ছিলাে, আল্লাহর দিকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করত। বনী ইসরাঈল জাতির বিরােধিতা ও চরম শত্রুতার মুখােমুখি দাড়িয়ে এই দলটি তাকে সাহায্য করত। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদাররা, তােমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও, যেমন করে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরকে তিনি বলেছিলেন ফলে তারা চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হলো।’ এ সূরার মধ্যে শেষের এ দুটি লাইন অত্যন্ত স্পষ্ট। এখানে আল্লাহর প্রায় সব কথাই এসে গেছে। শুধু শেষ রাসূল(স.)-কে অস্বীকারকারীদের কঠোর সমালোচনার কথাটাই বাকি রয়ে গেছে। এই হচ্ছে সুরাটির কাহিনী ও বক্তব্যের লক্ষ্য এবং হঠকারী কাফেরদের সমালােচনার কথা এই মৌলিক আয়াত দুটির মধ্যে পরােক্ষভাবে অবশ্যই এসে গেছে, তাই একটু খেয়াল করলে বুঝা যায়। রসূলুল্লাহ(স.)-এর সুসংবাদ দিতে গিয়ে ঈসা(আ.)-এর উক্তি আল্লাহর বাণীতে কি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠেছে। তারপর যখন তাদের কাছে স্পষ্ট দলীল প্রমাণ নিয়ে সে এসে গেলাে, তখন তারা বলে ওঠলাে, এটা তাে স্পষ্ট জাদু… অথচ অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তার নূরকে পূর্ণত্ব দানকারী, যদিও কাফেররা এটা পছন্দ করে না। এখানে একজন মুসলিম ব্যক্তির অন্তরে একথা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠছে যে, আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থাই তার জন্যে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা, যা শেষ রসূলের আমলে সমাপ্ত হয়েছে এবং সমগ্র পৃথিবীর বুকে পরিচিত হয়েছে। গােটা মানব জাতির কাছে এ ব্যবস্থা পৌঁছে দেয়া তার দায়িত্ব। তিনি জানেন, তাকে অবশ্যই আল্লাহর পথে জিহাদ করতে হবে (অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী ব্যবস্থা হিসাবে চালু করার জন্যে মাল ও জানের কোরবানী নিয়ে চূড়ান্ত সংগ্রামে নামতে হবে)। যেহেতু এটাই আল্লাহর পছন্দ। এভাবে এ চূড়ান্ত প্রচেষ্টার পদ্ধতি স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং তার ধারণায় আর কোনাে অস্পষ্টতা থাকার অবকাশ নেই, বা কাজ করতে গিয়ে তার জীবনে এমন কোনাে ভয় ভীতি নেই যাতে তার স্বর বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে, অথবা তিনি দুর্বিষহ দুঃখভারে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। নেই তার সংকল্পের মধ্যে দৃঢ়তার অভাব বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করার ব্যাপারে কোন জড়তা। আল্লাহ পাকের দেয়া জ্ঞান ও তার নির্ধারিত পরিণাম বিলম্বে হলেও যে আসবেই, এ বিষয় মনে কোনাে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। এই স্পষ্ট লক্ষ্যের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে মুসলমানদের তাদের সৃষ্টি সম্পর্কে। চিন্তা করতে আহবান জানানাে হচ্ছে, তার মননশীলতার প্রকৃতি সম্পর্কে তাদের চিন্তা করতে বলা হচ্ছে। সুতরাং এমন কথা একজন মুসলমান বলবে না যা সে করে না, প্রকাশ্যে গােপনে, একাকিত্বে, সর্বসমক্ষে সর্বাবস্থায় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সে কথা বলবে, কথা বলবে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে। তার কথা ও কাজের মধ্যে থাকবে স্বচ্ছতা, তার প্রতিটি পদক্ষেপে সে হবে দৃঢ়, সে তার ভাইদের সাথে মেলামেশার ব্যাপারে হবে আবেগময়, এইভাবে তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠবে তা হবে শীসাঢালা প্রাচীরের মতােই মযবুত।

ফী জিলালিল কুরআন:

‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর প্রশংসায় রত এবং তিনি মহাশক্তিমান মহাজ্ঞানী।’ গােটা সৃষ্টির সব কিছু থেকে আল্লাহর এই প্রশংসা নিশিদিন উত্থিত হয়ে চলেছে (নিরন্তর আনুগত্য করার মাধ্যমে)। তারা জানাচ্ছে যে, তিনি মহাশক্তিমান, মহাজ্ঞানী। সূরার শুরুতে মুসলমানদের জানানাে হয়েছে যে, আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের মধ্যে তাদের কাছে আগত জীবন পদ্ধতিই হচ্ছে শেষ সংস্করণ। আল্লাহ তায়ালার একত্ব প্রতিষ্ঠায় তারাই শেষ দায়িত্বশীল। তাদেরই দায়িত্ব, কাফের-মােশরেকদের কুফরী কাজ ও যাবতীয় শিরকী আচরণ প্রতিহত করা। তিনি (মহান আল্লাহ) তাদের জেহাদ করার জন্যে, তার সাহায্যের জন্যে আহবান জানিয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা নিজেই নিশ্চিতভাবে স্থির করে দিয়েছেন যে, তিনি অন্যান্য জীবন ব্যবস্থার ওপর এই জীবন ব্যবস্থাকে বিজয়ী করে দেবেন, যদিও মােশরেকরা এটা পছন্দ করে না। আর যে বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা জেহাদ করবে সেই একই আকীদা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে বিরাজ করছে। আর অন্যান্য জীবন প্রণালীর ওপর এই জীবন প্রণালীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী, যেহেতু এই জীবন ব্যবস্থাই সৃষ্টির সব কিছুর সাথে সংগতিপূর্ণ এবং সবাই সেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই কাজ করে চলেছে যিনি মহাশক্তিমান ও মহাজ্ঞানী।

ফী জিলালিল কুরআন:

*কথায় কাজে অমিল আল্লাহর ক্রোধ জাগায় : আল্লাহ তায়ালা এখানে অত্যন্ত কঠোরভাবে ঈমানদারদেরকে তিরস্কার করছেন এমন একটি বিষয়ের ওপর, যা তাদের মধ্য থেকে একটি দলের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিলাে। বিষয়টি এমন কঠিন যা আল্লাহ তায়ালা ভীষণভাবে অপছন্দ করেন এবং তাকে সব থেকে বেশী ঘৃণা করেন। এমন আচরণ বিশেষ করে মােমেনদের জন্যে ভয়ানক অপরাধ বলে গণ্য। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, কেন বলছো এমন কথা যা তােমরা করো না? আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণার বিষয় হবে যদি এমন কথা বলো যা তােমরা পালন করাে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের পছন্দ করেন যারা তার রাস্তায় এমন সারিবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে যেন তারা শীসাঢালা একটি প্রাচীর।’ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা.)-এর বরাত দিয়ে আলী ইবনে তালহা বলেন, জিহাদ ফরয হওয়ার পূর্বে মােমেনদের একটি দল বলতাে, আল্লাহর কাছে কোন্ কাজটি সব থেকে প্রিয় তা যদি তিনি আমাদের জানিয়ে দিতেন, তাহলে তা আমাদের কাছে কতই না ভালাে লাগতাে! তাহলে তা আমরা পালন করতাম। এরপর আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর ওপর ঈমান আনা এবং যারা একথা মানে না ও বিরােধিতা করে সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা নিসন্দেহে সব থেকে ভালাে কাজ, কিন্তু যখন জিহাদের আয়াত নাযিল হলাে, তখন মােমেনদের একটি দল তা আর পছন্দ করলাে না, বরং এ নির্দেশ তাদের নিকট বড়ই কঠিন লাগলাে। কাজেই আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা তখন এরশাদ করলেন, ‘হে ঈমানদার, কেন বলছাে তােমরা এমন কথা যা তােমরা পালন করো না? আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণার বিষয় হবে (ওই আচরণ) যদি তােমরা বলাে এমন কথা যা বাস্তবে পালন করাে না।’ ইবনে জারীর তাঁর তাফসীরে এ কথাটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইবনে কাসীরও তাঁর তাফসীরে বলেছেন, ওলামায়ে কেরামের অধিকাংশ এ আয়াতটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, আয়াতটি তখনই নাযিল হয়েছে যখন তারা তাদের ওপর জিহাদ ফরয হওয়া কামনা করছিল, কিন্তু যখন জিহাদ তাদের ওপর ফরয করে দেয়া হলাে, তখন তাদের কেউ কেউ এ হুকুম এড়িয়ে গেলাে। যেমন আল্লাহর এরশাদে জানা যায়, তুমি কি দেখনি। সেসব ব্যক্তির দিকে যাদের বলা হয়েছে, তােমাদের হাতকে যুদ্ধ থেকে থামিয়ে দাও, নামায কায়েম করাে এবং যাকাত আদায় করাে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন তাদের জিহাদ করার জন্যে দেয়া হলাে, তখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল মানুষকে এতাে ভয় করতে লাগলাে যেমন আল্লাহকে ভয় করা দরকার। অথবা আল্লাহ তায়ালা থেকে তারা সেসব বিরােধী মানুষকে বেশী ভয় করতে শুরু করলাে এবং তারা বলতে লাগলাে, ‘হে আমাদের রব, আমাদের ওপর কেন জেহাদ ফরয করে দিলেন? হায়, আমাদের নিকটবর্তী একটি সময় পর্যন্ত যদি জিহাদে যাওয়া থেকে রেহাই দিতেন তা হলে কতই না ভালাে হতাে! বলাে (হে নবী), দুনিয়ার সুখ-সম্পদ অতি তুচ্ছ এবং আল্লাহকে যারা ভয় করে এবং অন্তরে আল্লাহর ভয় রেখে যারা জীবন যাপন করে, তাদের জন্যে আখেরাতই উত্তম (স্থান) এবং তাদের প্রতি একটি সুতা পরিমাণও যুলুম করা হবে না। তােমরা যেখানেই থাকো না কেন, মৃত্যু তােমাদের স্পর্শ করবেই। যদি তােমরা অত্যন্ত মত কেল্লার মধ্যে লুকিয়ে থাকো, সেখানেই মৃত্যু তােমাদের পাকড়াও করবে। কাতাদা ও দাহহাক বলেন, এ আয়াতটি সেই জাতিকে ধমক দিতে গিয়ে নাযিল হয়েছে যারা বলে, আমরা হত্যা করেছি, মারপিট করেছি, নানা প্রকার দোষারােপ করেছি এবং আরও কত কি করেছি; কিন্তু কই তারা তো কিছুই করতে পারলাে না। কিন্তু আয়াতগুলাের বর্ণনাভংগিতে এবং যুদ্ধ সম্পর্কে কথা থাকায় বুঝা যায়, নাযিল হওয়ার প্রসংগ তাই যা ইবনে জারীর বলেছেন এবং অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামও এই কথাই মনে করেন। তবে এটা মনে রাখতে হবে, কোরআন করীমের বর্ণনা কোনাে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হলেও আরও বহু বিষয়ের ওপর তা প্রযােজ্য, যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তা নাযিল হয়েছে সেটি ছাড়াও আরও বহু অবস্থার ওপর তার থেকে দলীল গ্রহণ করা যায়। আর এ কারণেই আমরা এই ঘটনাগুলাে সামনে রেখে এর থেকে আরও বহু বিষয়ের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করি। সুরাটি একটি বিশেষ ঘটনা বা ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে তিরস্কার করতে গিয়ে নাযিল হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তি, কেন তােমরা বলাে এমন কথা যা তােমরা করাে না?’ জিজ্ঞাসার সুরে এ কথা জিজ্ঞেস করে যে আচরণের ওপর কথাটি বলা হয়েছে তার ঘােরতর আপত্তিকর হওয়ার কথা জানানাে হয়েছে। তাই বলা হয়েছে, ‘এটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত ঘৃণার বিষয় যে, তােমরা বলবে এমন কথা যা বাস্তবে করবে না।’ যে ঘৃণার বিষয়টি আল্লাহর কাছে সব থেকে বড়, আসলেই তা সব থেকে বড় ঘৃণার বিষয় এবং যে প্রকার অপ্রিয় জিনিস থাকতে পারে সেসব কিছু থেকে বেশী অপ্রিয়। এ বিষয় এবং কোনাে কাজের জন্যে এই অভ্যাস চরম ভয়ানক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, বিশেষ করে একজন সেই মােমেনের জন্যে এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যার ঈমানের সৌন্দর্যের কারণেই তার দিকে মানুষকে ডাকা হয় এবং যিনি ডাকছেন তিনি হচ্ছেন তার প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা, যার প্রতি সে নিজে ঈমান এনেছে। তৃতীয় আয়াতটিতে সরাসরি সেই বিষয়টির প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যা তারা বলেছে, কিন্তু করেনি, অর্থাৎ তা হচ্ছে জিহাদ। আর এটা সাফ সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই জিহাদই আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন এবং এই কাজই তিনি সন্তুষ্ট হন।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মুসলিম সমাজের সামষ্টিক বৈশিষ্ট্য : ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তাদের পছন্দ করেন যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে, যেন তারা শীশাঢালা এক প্রাচীর।’ এতে বুঝা গেলাে, এ কাজ শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ নয়, বরং এটি আল্লাহর পথে যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধ করার মধ্যে মুসলমানদের সাথে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দৃঢ়ভাবে যুদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে, এমন সারিবদ্ধভাবে যেন তারা শীশাঢালা এক প্রাচীর। আলােচ্য এই পারার মধ্যে বিভিন্ন প্রসংগে বার বার এ কথা বলা হয়েছে যে, কোরআনে করীম নাযিল হয়েছিলাে এক বিশিষ্ট জাতি গড়ে তােলার লক্ষ্যে। পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার আমানত বহন করার জন্যেই এই জাতিকে গড়ে তুলেছিলেন। এ জাতির জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর দেয়া এই জীবন ব্যবস্থা যেমন চালু করতে হবে, তেমনি গােটা মানবমন্ডলীর মধ্যে এ ব্যবস্থা চালু করার জন্যে নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হবে, আর এই লক্ষ্যে প্রতিটি ব্যক্তিকে যেমন এ আমানত বহন করার উপযােগী করে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি গঠন করতে হবে এমন একটি দল, যারা বাস্তব কর্মকান্ডের মাধ্যমে এর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। এসব কাজ একই সময়ে চলতে থাকবে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, দলীয় জীবনের মধ্যে মানুষ হওয়া ব্যতীত একজন ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ মুসলমানরূপে গড়ে তােলা সম্ভব নয় এবং একটি সুসংগঠিত দলের মধ্যে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা গড়ে তােলা ছাড়া অন্য কোনােভাবে এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা কল্পনাই করা যায় না। এ জাতির গঠন পদ্ধতি হবে সুনির্দিষ্ট এবং সামষ্টিক জীবনের কল্যাণই হবে এর লক্ষ্য, কিন্তু সাথে সাথে প্রত্যেক ব্যক্তি যেন সে কল্যাণের অধিকারী হতে পারে সেদিকেও সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর দেয়া এই জীবন বিধান যেমন হবে বিবেক বুদ্ধির কাছে গ্রহণযােগ্য, তেমনি পৃথিবীর বুকে বাস্তব কর্মের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অবশ্যই একথা সত্য যে, যে সমাজে মুসলমানরা বাস করবে, নড়াচড়া করবে ও কাজ করবে, সেই সমাজেই আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কাজ করার কারণে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ফল পাওয়া যাবে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রত্যেক ব্যক্তির বিবেকে তীব্রভাবে সাড়া জাগাবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি সাগ্রহে তা অনুসরণ করতে পারবে। এ ব্যবস্থা সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের কোনাে আনুষ্ঠানিক উপাসনা নয় যে, তারা নিজ নিজ উপাসনালয়ে তা পালন করবে। কোনাে মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত কাজ হিসাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে না, বা জীবনের বিশেষ কোনাে অবস্থার সাথে এ ব্যবস্থাকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে তাও নয়। অথবা এও সত্য নয় যে, জীবনের সকল স্বাভাবিক অবস্থা থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্যে ইসলাম এসেছে; বরং ইসলাম এসেছে মানব জীবনকে পরিচ্ছন্নভাবে পরিচালনা করতে এবং সকল দিক ও বিভাগে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে তার যােগ্যতার স্ফুরণ ঘটাতে। মানুষের জীবন একাকী অবস্থায় চলতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা তাকে সৃষ্টিই করেছেন সামাজিক জীব হিসাবে, এজন্য তারা সমাজবদ্ধভাবে বা জাতি হিসাবে একত্রে বাস করে। তাই এই সমাজের মধ্যে থেকে পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে চলার শিক্ষাই ইসলাম মানুষকে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই ইসলাম তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে আর এই কারণেই তার নিয়ম শৃংখলা, আইন কানুন এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা এ মূল লক্ষ্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। যখন কোনাে ব্যক্তির বিৱেকে এই বিষয়ের ওপর চিন্তা ভাবনা আসে, তখন সে নিজেকে একজন সামাজিক জীব হিসাবেই চিন্তা ভাবনা করে। তবে, মুসলমান হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে ও সামাজিক জীবন যাপন করা কালে সর্বদাই সে আল্লাহমুখী হয়ে থাকে। মুসলমানরা ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে তাদের জীবনের আইন কানুন গড়ে তােলে এবং অন্য মানুষকে পরিচালনা করে। ইসলামী দাওয়াতের সূচনা থেকেই ইসলামী সমাজ গড়ে ওঠেছে অথবা বলা যায় গড়ে ওঠেছে মুসলমানদের একটি এমন মজবুত দল, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন খোদ রসূলুল্লাহ(স.)-এর অনুগত ব্যক্তিবর্গ। তারা এই দলের ব্যক্তিদের মধ্যে দলীয় জীবন যাপন করার বৈশিষ্ট্য বরাবর কায়েম করে রেখেছিলেন এবং এই দলের মধ্যে এমন ক্ষমতা ছিলো, যা তাকে আশেপাশের সকল দল থেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে তুলেছিলাে। এমন আদব শৃংখলা এ দলে বিরাজ করতাে যা দলের সকল সদস্যের হৃদয়কে সদা সর্বদা আকর্ষণ করেছিলো। এই গুণাবলীর ওপর নির্ভর করে ইসলামী দলের স্থায়িত্ব। আর মুসলিম জামায়াতের মধ্যে এসব দলীয় বৈশিষ্ট্য মদীনায় মুসলমানদের রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছিলাে, বরং সত্য বলতে কি, এই গুণাবলীর ওসীলাতেই মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিলাে। এই তিনটি আয়াতের দিকে তাকাতেই আমরা দেখতে পাই, এর মধ্যে অতি চমৎকারভাবে দলীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যের সাথে সাথে ব্যক্তিগত জীবনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছে। আয়াতগুলােতে আরও ফুটে ওঠেছে যে, এসব গুণ লালিত হয়েছে দ্বীনী আকীদা বিশ্বাসের ছায়াতলে। এই আকীদার প্রকৃত দাবীই হচ্ছে, সারা জগতের সকল মানুষের মধ্যে সুশৃংখল ও ভারসাম্যপূর্ণ এক জীবন ব্যবস্থা গড়ে তােলা এবং এই জীবন ব্যবস্থা যাতে টিকে থাকে তার জন্যে এর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং এর জন্যে সদা সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রথম দুটি আয়াতে সেই সকল মােমেনের প্রতি তিরস্কার ও ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছে, যারা এমন কথা বলে যা বাস্তবে তারা পালন করে না। প্রকারান্তরে এ আয়াত দুটিতে বলা হয়েছে, একজন মুসলিম ব্যক্তির চরিত্রে সত্যবাদিতা ও সত্য পথে দৃঢ়তা অবলম্বনের শুণ অবশ্যই থাকতে হবে, তাদের প্রকাশ্য ও গোপন এক হতে হবে এবং সকল কথায় কাজে মিল থাকতে হবে। আলােচ্য আয়াত তিনটির শেষােক্ত আয়াতে যুদ্ধ বিগ্রহ সম্পর্কিত কথা উচ্চারিত হয়েছে। প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের মধ্যে সংগ্রামের এই মনােভাব থাকতেই হবে যার উল্লেখ আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসেও বহু জায়গায় এর বর্ণনা পাওয়া যায়। আল কোরআনে ইহুদী সম্প্রদায়কে ডেকে বলা হয়েছে, তােমরা কি মানুষকে ভালাে কাজের নির্দেশ দাও, আর নিজেদের ভুলে যাও, অথচ তােমরাও তাে (তােমাদের প্রতি অবতীর্ণ) কিতাব তেলাওয়াত করাে, তোমরা কি কিছুই বুঝো না। আবার মােনাফেকদের সম্বােধন করে বলা হয়েছে, ‘ওরা বলে (হা আমরা) আনুগত্য (করছি)। তারপর তােমার কাছ থেকে সরে গিয়ে তােমার সম্পর্কে এমন কথা বানিয়ে বানিয়ে বলে যা তুমি বলােনি। এই কারণে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আর মানুষের মধ্যে এমন কোনাে কোনাে ব্যক্তিকে দেখতে পাবে, দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে তার কথা তােমাকে মুগ্ধ করে ফেলবে, কিন্তু তার অন্তরে যা কিছু আছে তা অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা দেখছেন। তাই তিনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন, সে নিকৃষ্টতম দুশমন। এহেন ব্যক্তি যখন তােমার থেকে মুখ ফিরিয়ে সরে যায়, তখন সে পৃথিবীর বুকে নানা প্রকার অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে এবং মানুষের ফসল ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতিতে লিপ্ত হয়ে যায়, আর আল্লাহ তায়ালা অশান্তি মােটেই পছন্দ করেন না। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ(স.) এরশাদ করেছেন, মুনাফিকের লক্ষণ ৩টি, (১) কথা বলার সময় মিথ্যা কথা বলা, (২) কোনাে ওয়াদা করলে তা খেলাপ করা, (৩) আর কখনও তার কাছে কোনাে আমানত রাখলে তার খেয়ানত করা। (আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী ও নাসায়ী) এই অর্থে আরও বহু হাদীস পাওয়া গেছে এবং এখন যে হাদীসটি আমরা উল্লেখ করবাে, তা এ প্রসংগে বর্ণিত সব থেকে সূক্ষ্ম এবং অর্থবহ হাদীস বলে আমরা মনে করি, যেহেতু তা নবী জীবনের সব থেকে মহান দিক তুলে ধরেছেন। ইমাম আহমাদ এবং আবু দাউদ আবদুল্লাহ(র.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘একদিন নবী করীম(স.) আমাদের বাড়ীতে এলেন, তখন আমি ছােট বালক। খেলতে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। আম্মা ডাক দিয়ে বললেন, আবদুল্লাহ, শােনো, আমি তােমাকে দিচ্ছি। তখন রসূলুল্লাহ(স.) তাকে বললেন, ওকে কি দিতে চাইলে? আম্মা বললেন, কিছু খেজুর। তখন রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, দেখাে, যা দিতে চেয়েছো, তা যদি না দাও, তাহলে তােমার আমলনামায় কিন্তু একটি মিথ্যা বলার গুনাহ লিখিত হয়ে যাবে। সম্ভবত নবী(স.)-এর শিক্ষার এই ঝর্ণাধারা থেকে গভীরভাবে পান করতে পেরেছিলেন বলেই আহমাদ ইবনে হাম্বল(র.) সেই ব্যক্তি থেকে হাদীস গ্রহণ করেননি যে তার খচ্চরকে পাথরের পাত্র দেখিয়ে খাবারের লােভ দিয়ে কাছে ডেকেছিলাে, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছেন পাত্রটি শূন্য। এই অবস্থা দেখে এতাে দূর থেকে হাদীস সংগ্রহের জন্যে তার কাছে পৌছেও তিনি তার থেকে কোনাে হাদীস গ্রহণ করেননি, তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে চলে এসেছেন, কারণ সে তার খচ্চরের সাথে প্রতারণা করেছে। এই ছিলাে সেই সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ আখলাকী বুনিয়াদ, যা একজন মুসলমানের বিবেক ও ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্যে সহায়ক হয়েছে এবং উপযােগী ভূমিকা পালন করেছে, যেহেতু পৃথিবীতে সে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে দায়িত্বশীল হিসেবে কাজ করছে। আর এই কথাই বক্ষ্যমাণ সূরাটি বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছে। আর এই শিক্ষাই সেই সকল মৌলিক শিক্ষার অন্যতম, যা মুসলিম জামায়াতকে দুনিয়ার বুকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করার উপযােগী বানিয়েছে।   *আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা সর্বোচ্চ এবাদাত : এখন আমরা সরাসরি সেই বিষয়টি আলােচনার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যার কথা কোরআন করীমের অবতরণকালের শুরুতেই প্রকাশ করা হয়েছিল। আর তা হচ্ছে, আল্লাহর রাজ্যে তার প্রভুত্ব কায়েম করার লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রাম তথা জিহাদ। সুতরাং আসুন হাদীসটির বর্ণিত বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আমরা একটু দৃষ্টিপাত করি এবং এর থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করি। প্রথমেই আমরা মানব জীবনের স্বাভাবিক দুর্বলতার দিকে একটু খেয়াল করবাে। যে দুর্বলতা থেকে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এবং নিরন্তর তার উপদেশ স্মরণ করা ব্যতীত কিছুতেই রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্যে সার্বক্ষণিক খেয়াল এবং নিরন্তর প্রশিক্ষণ গ্রহণ প্রয়ােজন। সুতরাং, কোনাে কোনাে রেওয়ায়াত বলা হয়েছে যে, এই হচ্ছে সেই মুসলিম জামায়াত- এ কথা দ্বারা ইংগিত করা হচ্ছে, মক্কা থেকে আগত সেই মুসলিম জামায়াতের দিকে, যারা অতি উৎসাহ ও স্বভাবের কারণে আকাংখা করছিলাে যে, তাদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হােক। অথচ তখন তাদের প্রতি যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে রাখার, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার নির্দেশ ছিলাে। কিন্তু মাদানী যিন্দেগীতে আল্লাহর নির্ধারিত সঠিক সময়ে যখন তাদের প্রতি যুদ্ধ করার নির্দেশ প্রদান করা হলাে, তখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল মানুষকে এমনভাবে ভয় করতে শুরু করলাে যেমন আল্লাহকে ভয় করা দরকার, বরং বলতে কি, তারা আল্লাহর থেকেও বেশী মানুষকে ভয় করতে শুরু করলাে। তারা বলে ওঠলাে, হে আমাদের রব, কেন আমাদের প্রতি যুদ্ধ ফরয করে দিলে। আমাদের নিকটবর্তী এক সময় পর্যন্ত বিলম্ব করার অবসর দিলে না কেন? অথবা এরা ছিলাে মদীনার মুসলমানদের একটি দল, যারা বার বার জিজ্ঞেস করে জানতে চাচ্ছিলাে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ কোটি, যাতে করে তারা তা করতে পারে, কিন্তু এ সর্বাধিক প্রিয় কাজ ছিলাে জিহাদ। এর নির্দেশ যখন তাদের দেয়া হলাে, তখন মােটেই তাদের আর তা ভালাে লাগলো না! জিহাদ সম্পর্কে এই স্বচ্ছ দৃষ্টিভংগির কারণে আমাদের বুঝা সহজ হবে এবং এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের চোখ খুলে যাবে যে, মানুষে মানুষে হৃদ্যতা ও ভালােবাসার সম্পর্ক গড়ে তােলাই আমাদের আসল কাজ। আমাদের এই দৃষ্টিভংগি জোরদার করতে হবে, এর ওপর দৃঢ়তা অবলম্বন করতে হবে এবং এ বিষয়ে পুরােপুরি মনােনিবেশ করতে হবে, যদিও এটা কোনাে সহজ কাজ নয়, এ পথে দৃঢ় থাকা ও এ পথে মযবুতীর সাথে চলতে পারাটা অবশ্যই অত্যন্ত কঠিন কাজ, এর জন্যে অনেক দুর্বল মুহূর্তকে জয় করতে হবে এবং দৃষ্টিকে সুদূর দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত করতে হবে। আল্লাহর রহমতে এবং রসূল(স.)-এর শিক্ষার আলােকে আমরা যে জ্ঞান লাভ করেছি তাতে বুঝতে পেরেছি, যখন কোন কঠিন কাজের জন্য দায়িত্ব দেয়া না হয়, তখন সে কঠিন কাজ করতে চাওয়া বা তার জন্যে কোনাে আকাংখা প্রকাশ করা আমাদের জন্য উচিত নয়। কিন্তু সে গুরুদায়িত্ব বহন করার জন্যে যখন আমাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হবে, তখন নিজের মত প্রকাশ করার অধিকার বা কোনাে পরামর্শ দেয়ার অধিকার আমাদের থাকবে না। প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্য থেকে একটি দল এই দুর্বলতা দেখিয়েছিলাে এবং এমন সব কথা বলেছিলাে যা তারা নিজেরা পালন করেনি। শেষ পর্যন্ত আলােচ্য আয়াতের ভাষায় অত্যন্ত কঠোরভাবে আল্লাহ তায়ালা তাদের তিরস্কার করেছেন এবং যাদের কথা ও কাজে মিল নেই, তাদের জন্যে অত্যন্ত ভয়াবহভাবে আল্লাহ তায়ালা তার আক্রোশের কথা ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লাহর ঘােষণা, তাদের জন্যে রয়েছে আল্লাহর মহব্বত, যারা শীশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সারিবদ্ধভাবে আল্লাহর পথে লড়াই করে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আল্লাহ তায়ালা কি কঠিনভাবে তার পথে যুদ্ধ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছেন। এই পর্যায়ে প্রথম যে জিনিসটি প্রকাশ পেয়েছে তা হচ্ছে, ময়দানে শত্রুর মুখােমুখি হওয়ার ব্যাপারে তাদের অনীহা প্রকাশ পেয়েছে, যুদ্ধের ডাকে সাড়া দিতে বিনা কারণে বিলম্ব করা হয়েছে, এর প্রয়ােজন সম্পর্কে মতভেদ করা হয়েছে এবং যুদ্ধকে ঘৃণা করা হয়েছে। তবে এটাও সত্য, এই অদ্ভুত মনােভাব সবার ছিলাে না, সব সময় ছিলাে না এবং এ আশ্চর্য মনােভাবের কারণে নিষ্ঠাপূর্ণ সাধারণ মুসলমানের মনে তেমন কোনাে ভাবান্তর দেখা দেয়নি, যেহেতু এর পেছনে স্থায়ী এক বুদ্ধিমত্তা সক্রিয় ছিলাে, যার কারণে খাঁটি ঈমানদার ব্যক্তিরা কর্তব্যচ্যুত হয়নি। ইসলাম অবশ্যই যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করে না বা যুদ্ধ-বিগ্রহ কেউ ভালবাসুক তাও চায় না, তবু বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায় বলে কোন কোন সময়ে একে ইসলাম ফরয ঘােষণা করেছে। যেহেতু এর পেছনে যে লক্ষ্য রয়েছে তা অতি বৃহৎ। এ জন্য আল্লাহ তায়ালার আইন প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনে ইসলাম সর্বশেষ অবস্থার কাজ, অর্থাৎ অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ। পরিস্থিতির মােকাবেলা করে। যুদ্ধের এ আইন সম্পূর্ণ প্রকৃতিগত হওয়া সত্তেও এটা মানুষের জন্য কিছু কষ্টদায়ক, তবু তা সুমহান লক্ষ্যের কারণে অনেক সময়ে অনিবার্য হয়ে যায় । মানুষের মংগলার্থে ইসলামী ব্যবস্থা চালু হওয়া জরুরী হওয়া সত্তেও পৃথিবীর বহু শক্তি এর বাস্তবায়ন পছন্দ করে না। কারণ তাতে তাদের বিশেষ বিশেষ সুবিধা ভােগের পথ বন্ধ হয়ে যাবে বলে তারা মনে করে। তারা স্পষ্ট দেখতে পায়, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের বিলাসিতার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। এ জন্যই এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা লড়াই করে এবং মানুষের জীবনে এর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে এর বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়ায়। এই শক্তিগুলাে মানুষের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে তাদের ঈমান ছিনিয়ে নিতে চায়, থামিয়ে দিতে চায় তাদের ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কার্যক্রম, এমনকি তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত তারা বিলুপ্ত করে দিতে চায়। কোন কোন সময়ে তারা মানুষের বুদ্ধিহীনতার সুযােগ নেয় এবং এই আইনের বিরােধিতা করে বিভিন্ন পরিবারের অসহায় ওয়ারিসদের কাছ থেকে স্বার্থ বাগানাের উদ্দেশ্যে এ আইন প্রতিষ্ঠার পথে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায় । এই সীমাহীন অন্যায় সর্বত্র এবং সর্বযুগে বিরাজ করে। নির্লজ্জ মিথ্যার দাপটে পৃথিবীর বাসিন্দারা পেরেশান থাকে এবং শয়তান হচ্ছে তাদের সামনে মূর্তিমান ধোকা। আর এই কারণে ঈমানের ওপর হামলাকারীকে প্রতিরোধ করা মােমেনের দায়িত্ব হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে এবং অন্যায়কারী ও শয়তানের দোসরদের ওপর মােমেনদের বিজয়ী করার লক্ষ্যে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করাই তার প্রধান কাজ হিসাবে স্থির করা হয়েছে। এই লক্ষ্যেই মযবুত করা হয়েছে মুমিনের চরিত্রকে এবং তাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের যােগ্য বানানাে হয়েছে। মানব নির্মিত আইন পর্যদস্ত করে নবীর মাধ্যমে আগত এই নতুন ব্যবস্থার দিকে দাওয়াত দানের পথ নিষ্কন্টক করার জন্য সঠিক আকীদার প্রচার প্রসারের আযাদীলাভ এবং ইসলামের বিধিমতে কর্মের স্বাধীনতা বহাল করা ও রাখার জন্য যুদ্ধ করাকে বাধ্যতামূলক বলে ঘােষণা করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, উপরােক্ত উদ্দেশ্যে কাজ করার কারণে শত্ৰুপক্ষ থেকে যুদ্ধ যদি বাধানাে হয়, তবেই যুদ্ধ করা যাবে। পার্থিব কোন স্বার্থের জন্য যুদ্ধ বাধানাে বা কাউকে আক্রমণ করা যাবে না। তাই বলা হচ্ছে তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে (তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে)’, তাদের ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ বা দেশ, বর্ণ, গােত্র, বংশ বা ঘর অথবা অন্য কোন আভিজাত্যবােধের কারণে যুদ্ধ করা যাবে না। একমাত্র আল্লাহর পথে, অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব তারই যমীনে কায়েমের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করার অনুমতি রয়েছে। এ বিষয়ে রসূলুল্লাহ(সঃ) এরশাদ করেন, যে যুদ্ধ করে শুধুমাত্র এই জন্য যে, আল্লাহ্ তায়ালার কথাই বুলন্দ হবে, সে ব্যক্তিই আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, অর্থাৎ আল্লাহর কথা সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে যে যুদ্ধ করে, সে-ই প্রকৃতপক্ষ আল্লাহর পথে রয়েছে।(সহীহ পাঁচটি হাদীসের কিতাবেই এ হাদীস উল্লিখিত হয়েছে) আর আল্লাহর ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে আল্লাহর কথার বাস্তবায়ন, যেহেতু এ কথাগুলোর মাধ্যমে তার ইচ্ছা আমাদের কাছে প্রকাশ পায়। আমরা মানুষ, আল্লাহর একথাগুলােই আমাদেরকে সেই খবর দেয় যার ওপর সৃষ্টির সকল কিছু কাজ করে যাচ্ছে। এই সৃষ্টির প্রতিটি জিনিস আল্লাহ পাকের ইচ্ছা অনুযায়ী চলার মাধ্যমে তার প্রতিপালকের প্রশংসাগীতি গেয়ে চলেছে এবং ইসলামী জীবন পদ্ধতির সর্বশেষে আগত রূপই হচ্ছে আল্লাহর সেই বিধান কায়েমের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে ইসলামের আগমন ঘটেছে। এই বিধান কায়েমের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টিমল্লিকার এই বিপুল সমারােহ, আর তার মধ্যে থেকেই মানুষ আল্লাহর আইন অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে শান্তি পায়। নিজেদের মনগড়া কোন ব্যবস্থার মাধ্যমে শান্তি পাওয়া বা শান্তি দেয়া কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাতিল শক্তির মােকাবেলা করা কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাজ নয়; বরং এ দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের। কারণ, বিরােধী রাষ্ট্রসমূহের মােকাবেলায় শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সর্বাত্মকভাবে ইসলামী কার্যক্রম চলতে পারে না। এখানে মনে রাখতে হবে, ইসলামের কিছু কিছু নিয়ম পদ্ধতি চালু করার জন্যই ইসলামের আগমন ঘটেনি, আর এই ধরনের আংশিক কাজে সহায়তা করার জন্যও মুসলমানদের প্রতি জিহাদ ফরয করা হয়নি; বরং ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে, গােটা বিশ্বে আল্লাহ পাকের বিধান পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। এই কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের পছন্দ করেছেন, যারা শীশাঢালা প্রাচীরের মত সারিবদ্ধভাবে আল্লাহ তায়ালার পথে যুদ্ধ করে। (দেখুন ‘আস-সালামুল আলামিয়্যে অল ইসলাম’, অধ্যায় ‘সালামুল আলম) তৃতীয়ত, আমরা দেখি, সেই মুজাহিদদের অবস্থার দিকে, যাদের আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধ করার কারণে পছন্দ করছেন, ‘(যুদ্ধ করছে তারা) শীশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় সারিবদ্ধভাবে।’ যুদ্ধ করার জন্য যদিও প্রত্যেক মুসলমান ব্যক্তিগতভাবে দায়ী, কিন্তু একটু খেয়াল করলে বুঝা যাবে, আসলে একাজ দলীয়ভাবে করতে হয়। এমন এক দলের সদস্য হিসেবে এ কাজ করতে হয় যার মধ্যে রয়েছে পরিপূর্ণ নিয়ম-শৃঙ্খলা। যারা ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে বলে মনস্থ করেছে তাদের মধ্যে অবশ্যই এই দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলা সহজ। তারা সবাই মিলে এক সাথে একত্রিত হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, ইসলামী বাহিনীকে শক্রর বিরুদ্ধে অবশ্যই সারিবদ্ধভাবে পর্বতসম দৃঢ়তা নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে (আর এটা নিশ্চিত, একই সময়ে সবাই একত্রিত না হলে এই সারিবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানাে সম্ভব নয়)। এই সারি হবে সুশৃঙ্খল এবং একদম সােজা, সুদৃঢ়, অনমনীয় এবং লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের সংকল্প দ্বারা তারা প্রমাণ করবে যে, তারা দলীয় শৃঙ্খলা মানে এবং দলের নিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করে না। এটাও তারা প্রমাণ করবে যে, তারা সুদৃঢ় দলের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সুসামঞ্জস্য ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী। সুতরাং সে ব্যক্তি যে একাকী থাকতে চায়, একাকীই আল্লাহর আনুগত্য করা পছন্দ করে, এককভাবেই যুদ্ধ-জিহাদ করায় বিশ্বাসী এবং একাকী নিরিবিলি জীবন যাপন করার পক্ষপাতী, সে প্রকৃতপক্ষে এই দ্বীনের মেযাজ ও জিহাদকালীন অবস্থার দাবী থেকে অনেক দূরে এবং ইসলামের নিশানবরদারদের যে নেতৃত্বের আসনে বসানাের জন্য আল্লাহর রসূল(স.) চেয়েছিলেন তার ধারে-কাছেও সে নেই। সংঘবদ্ধভাবে দ্বীন ইসলাম কায়েম করার জন্য সংগ্রামী মােমেনের দলকেই আল্লাহ পাক ভালােবাসেন এবং আলােচ্য সূরাতে তাদের চলার পথ তিনি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। এ প্রসংগে তাদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে আল কোরআন জানাচ্ছে, ‘(তারা লড়াই করে) সারিবদ্ধভাবে যেন তারা সিমেন্ট নির্মিত এক মযবুত ইমারত। এমন ইমারত যার ইটগুলাে একে অপরকে সাহায্য করে, একটির সাথে অপরটি মিশে থাকে এবং একে অপরকে আঁকড়ে রাখে। প্রত্যেকটি ইটের মাঝের ফাকগুলাে সিমেন্ট দ্বারা পূরণ করে দেয়ার ফলে গাথুনিগুলাে শীশার মত মযবুত হয়ে যায় । এই ফাকগুলাে সিমেন্ট দ্বারা বন্ধ না করলে যে ফাঁক হয়ে থাকে, অথবা কোন ইট যদি সরে যায় তাহলে তা তলাবিহীন গর্তের ওপরে অবস্থিত ইমারতের মত হয়ে যায় এবং আজ অথবা কাল তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে বাধ্য। এখন এই ইট সামনে, পেছনে বা পাশে যেখান থেকেই সরে যাক না কেন, বিল্ডিংটি যে দুর্বল হবেই, তার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। এটা কোন বাহ্যিক সাদৃশ্য বা তুলনা নয়। মুসলিম জামায়াতের মধ্যে ফাটল ধরার কারণে যে অবস্থা সৃষ্টি হয় এই তুলনা দ্বারা তা ছবির মত স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে, ফুটে ওঠেছে দলীয় জীবনের প্রকৃতি এবং দলের মধ্যে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, মুসলমানদের মধ্যে যে নিগূঢ় বন্ধন গড়ে ওঠে এবং একই লক্ষ্যে কাজ করার জন্য আদর্শবাদী এ দলের মধ্যে পারস্পরিক যে সহযােগিতা সৃষ্টি হয়, তা এ প্রসংগে মূর্ত হয়ে ওঠেছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*ইহুদী নাসারাদের ঘৃণ্য স্বভাবের কিছু নমুনা : এরপর আল্লাহ পাকের এ আইনের উপলক্ষ এবং ইসলাম-পূর্ব যুগে যাদের রসূল হিসাবে পাঠানাে হয়েছিল তাদের বর্ণনা এবং সেই সময়কার অবস্থার বিবরণ দেয়া হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করাে সে সময়কার অবস্থা, যখন মূসা তার জাতিকে ডেকে বললাে, হে আমার জাতি, কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, অথচ তােমরা জান যে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তােমাদের নিকটে রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি… তার আগমনের সুসংবাদ দানকারী।’ মূসা(আ.)-এর প্রতি বনী ইসরাঈলের দুর্ব্যবহার ও কষ্টদানের অবস্থাও লক্ষণীয়। অথচ তিনি তাে ছিলেন তাদের ফেরাউন ও তার আমলাদের দৌরাত্ম থেকে উদ্ধারকারী রসূল, নেতা ও শিক্ষক। তবু দীর্ঘ বহু বছর ধরে বিভিন্নভাবে তাকে তারা কষ্ট দিয়েছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে নিরন্তরভাবে তারা বাঁকা পথে চলেছে। তাই আল কোরআন বহুভাবে তাদের এই নিগ্রহের কাহিনী তুলে ধরেছে। তিনি যখন ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সেই একই সময়ে তারা মূসাকে কষ্ট দেয়ার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছিলাে, তাঁকে বিপদগ্রস্ত করার চেষ্টা করছিলাে এবং নানাভাবে তার ওপর চড়াও হয়ে চলেছিলাে। তাকে অপমাণিত করে তারা নিজেরা নিরাপদ হতে চেয়েছিলাে। তাই তারা তাকে দোষারােপ করার ও ইচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে বলত, তুমি আমাদের কাছে আগমন করার পূর্বেও যেমন আমাদের কষ্ট দেয়া হয়েছে, তােমার আগমনের পরেও তেমনি কষ্ট দেয়া হচ্ছে। ভাবখানা এই, তারা বলতে চাইছিল যে, রসূল আসায় তাদের আদৌ কোন উপকার হয়নি; বরং একেবারে শেষে যে কষ্টটা তারা পেল তার জন্যও সেই (মুসাই) দায়ী। অথচ তারা তাে স্পষ্টভাবে দেখে নিয়েছিল, ফেরাউনের অপমান ও যুলুম থেকে তিনিই এক আল্লাহর নামে তাদের উদ্ধার করে মিসর থেকে নিয়ে গেলেন, আর আল্লাহ পাক তাদের চোখের সামনে ফেরাউনকে ডুবিয়ে মারলেন। এই উদ্ধার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরেও তারা ফেরাউন ও তার জাতির গােলামী করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাে। এরশাদ হচ্ছে, “অবশেষে তারা এমন এক জাতির নিকট পৌছুলাে, যারা তাদের তৈরী মূর্তির সামনে মাথা ভুলুষ্ঠিত করছে।” তাদের এই মূর্তিপূজা করতে দেখে এ বনী ইসরাঈলরা বলে ওঠলাে, “আমাদের জন্যও তাদের মতাে কিছু সংখ্যক দেব-মূর্তি বানিয়ে দাও। আর যখন তিনি তার প্রতিপালকের নির্দেশে, নির্দষ্ট সময়ে তার পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে প্রেরিত ফলক গ্রহণ করার জন্য গেলেন, তখন তাদের সামেরী নামক এক ব্যক্তি পথভ্রষ্ট করল। সে তাদের জন্য এমন একটি গাে-শাবকের দেহমূর্তি তৈরী করে আনল, যার থেকে হাম্বা হাস্বা রবের ন্যায় এক প্রকার শব্দ বের হচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে উপস্থিত ব্যক্তিরা বলে ওঠল, এই তাে তােমাদের মাবুদ ও মূসার মাবুদ (উপাস্য), তারপর সে (তার) প্রকৃত রবকে ভুলে গেল।” এরপর নীল নদ পার হয়ে সিনাই মরুভূমিতে পৌছে গিয়ে বিচরণরত অবস্থায় ‘মান্না ও সালওয়া’ নামক যে খাদ্য পাচ্ছিল তার কারণে তারা রাগান্বিত হয়ে বলতে থাকল, ‘ও মূসা, আমরা কিছুতেই এই একটি মাত্র খাদ্য খেয়ে থাকতে পারবাে না। তােমার রবের কাছে দোয়া করাে না, যেন তিনি আমাদের জন্য এই যমীন থেকে শাক-সজি, শসা, গম, মসুরের ডাল এবং পেঁয়াজ উৎপাদন করে দেন!’ আলােচ্য সূরাতে গাভীর ঘটনায় তাদের গাভী যবাই করার নির্দেশ দেয়া হল, এতে তারা নানা প্রকার বিতর্ক তুলল। তারা এর কারণ জিজ্ঞেস করতে লাগল এবং তাদের নবীর সাথে বেয়াদবী করতে থাকল আর বলল, তােমার রবকে ডেকে বলাে না আমাদের বলে দিক এর রং কি হবে, বলাে না আমাদের বলে দিক এই গরুটা আমাদের কোন গরুর মতাে দেখতে হবে। এসবের জওয়াব দেয়া হলে তারা ঐ গরু সংগ্রহ করে যবাই করল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছুতেই তারা যবাই করতে চাচ্ছিল না। এরপর তারা একটি ছুটির দিন চাইলাে এবং সে দিনটিকে পবিত্র দিন হিসাবে মানতে থাকবে বলে জানালাে, কিন্তু যখন শনিবারকে তাদের জন্য পবিত্র দিন বলে ঘোষণা করা হলাে, তখন তারা সীমালংঘন করে সে দিনের পবিত্রতা নষ্ট করলাে। যে এলাকায় তারা প্রবেশ করবে বলে আল্লাহ পাক সুসংবাদ দিয়েছিলেন তার সামনে তারা অসহায় অবস্থায় মুখ বাঁকা করে দাড়িয়ে অস্থিরভাবে কোরআনের ভাষায় মূসা(আ.)-কে বলছিল, এরশাদ হচ্ছে, তারা বলল, ওখানে তাে এক ভীষণ শক্তিশালী জাতি বাস করছে। ওখান থেকে তারা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই আমরা ওখানে প্রবেশ করবাে না। তারা বেরিয়ে গেলে তবেই আমরা প্রবেশ করবে। এরপর তাদের বার বার সেই শহরে প্রবেশ করার জন্য উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করা হলে তারা সেখানে ঢুকতে অস্বীকার করে বসলাে ও অহংকারভরে চিৎকার করে ওঠে বললাে, “হে মূসা, শােনাে যতদিন তারা ওখানে আছে ততদিন আমরা কিছুতেই (ওখানে) প্রবেশ করবো না। সুতরাং যাও তুমি ও তােমার প্রতিপালক, (তােমরা দুজনে) গিয়ে ওদের সাথে যুদ্ধ করাে, আমরা এখানেই বসে থাকলাম।” এইভাবে তারা কষ্টদায়ক ব্যবহার করে নানা প্রকার প্রশ্ন করে, নাফরমানী করে ও অহংকার দেখিয়ে মূসা(আ.)-কে ক্লান্ত করে ফেলেছিলাে এবং কোনাে কোনাে হাদীসে বলা হয়েছে, তারা মূসা(আ.)-কে ব্যক্তিগতভাবে মিথ্যা দোষারােপ করেছিলাে, অর্থাৎ তার প্রতি নানা প্রকার মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলাে এবং তারা দাবী করেছিলাে যে, তাদের দুর্দশার জন্য মূলত মূসা(আঃ)-ই দায়ী। এজন্য আলােচ্য আয়াতে মূসা(আ.)-এর তিরস্কার ও আদরের সাথে তাদের দোষগুলাে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘হে আমার জাতি, কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, অথচ তােমরা তাে জান যে, তােমাদের কাছে আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ একথার ভংগি ও ভাষায় তারা নিশ্চিতভাবে বুঝেছিলো, মূসা(আ.) উপদেশ দিতে গিয়েই তাদের এইভাবে তিরস্কার করছিলেন। এ প্রসংগ শেষ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তাদের সত্য পথে দৃঢ়ভাবে টিকে থাকার জন্য শত প্রকার প্রচেষ্টা চালানাে সত্তেও তারা বাঁকা পথই অবলম্বন করলাে, যার ফলে আল্লাহ পাকও তাদের বাঁকা পথে চলার দিকে এগিয়ে দিলেন। তাদের অন্তরগুলােকে বাঁকা করে দিলেন, যার কারণে কোন ভালাে কথা তাদের কানে প্রবেশ করলাে না এবং তারা কিছুতেই ভালাে পথ ধরলাে না। তারা নিজেরা ভুল পথ গ্রহণ করলাে যার কারণে চিরদিনের জন্য ভুল পথে চলাই তাদের জন্য নির্ধারণ করে দিলেন এবং আল্লাহ পাক কোন অপরাধী (ও অপরাধপ্রবণ) জাতিকে সঠিক পথ দেখান না। এইভাবেই আল্লাহ প্রেরিত জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের যে দায়িত্ব ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা কেড়ে নিলেন, আর এরই ফলে চিরদিনের জন্য পৃথিবীর বুকে তাদের নেতৃত্বের অবসান হলাে। এরপর কোন দিন এর সংশােধন আসবে না এবং সর্বদা বাকা ও ভুল পথ অবলম্বনের স্বভাবের কারণে তারা চিরদিন বক্র পথ ও গােমরাহীর মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকবে। তারপর এলেন মারইয়াম-পুত্র ঈসা(আ.)। তিনি আবির্ভূত হয়ে বনী ইসরাঈল জাতিকে ডেকে বললেন, ‘হে বনী ইসরাঈল জাতি, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তােমাদের নিকট রসূল হয়ে এসেছি।’ খেয়াল করুন, তিনি এ কথা বলেননি যে, তিনিই আল্লাহ, একথাও বলেননি যে, তিনি আল্লাহর ছেলে বা আল্লাহর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কোন আত্মীয়। তাঁর পরিচয় পেশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তার সামনে অবস্থিত তাওরাত কিতাবের সত্যতার সাক্ষ্যদানকারী এবং সুসংবাদদানকারী তার পরবর্তীতে আগমনকারী এক রসূলের, যার নাম হবে আহমদ’। এই বর্ণনাভংগিতে রসূলদের পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও তাদের দীর্ঘ আগমন পরম্পরার কথা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেছে। তারা সবাই সত্য পথের পথিক, সত্যের ধারক বাহক এবং তাদের সবার লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ আকাশ থেকে আগত বার্তা দুনিয়ার মানুষের কাছে পৌছানােই ছিল তাদের সাধারণ লক্ষ্য। রেসালাতের এই দীর্ঘ শিকলের প্রত্যেকটি কড়ি পরস্পর ওতপ্রােতভাবে জড়িত। এটিই হচ্ছে আল্লাহর কাজ ও লক্ষ্যের বাস্তব চেহারা। মূলত সকলের পথ একই, যদিও বাহ্যিক চেহারায় মনে হয় ভিন্ন। তাদের কর্মধারার মধ্যে কোনাে কোনাে ব্যাপারে যে সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে, সেগুলাের দিকে তাকালে দেখা যায়, তার মূল কারণ হচ্ছে, যাদের নিকট রসূলদের দাওয়াত পৌছানাে হয়েছে তাদের যােগ্যতা, প্রয়ােজন ও গ্রহণশক্তির বিভিন্নতা। আরও কারণ হচ্ছে বিভিন্ন জাতির ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান, সত্য সন্দর্শনের শক্তি ও অভিজ্ঞতার তারতম্য, যার কারণে যুক্তি-বুদ্ধি দ্বারা কেউ সত্যকে তাড়াতাড়ি চিনতে পেরেছে ও গ্রহণ করতে পেরেছে, কেউ চিনতে বিলম্ব করেছে বা গ্রহণ করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছে। রেসালাতের শিকলের শেষ কড়িটি হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ, সুদৃঢ়, পেছনের সকল অভিজ্ঞতার আলােকে যুক্তি-বুদ্ধি আকর্ষণকারী। এই যুক্তি-বুদ্ধি সত্য গ্রহণ করেই ক্ষান্ত নয়; বরং নিজ সীমার মধ্যে থেকে এ বুদ্ধি সত্যকে বাস্তবে প্রয়োগকারী। গােটা মানবমন্ডলীর জীবনের সর্বক্ষেত্রে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং সংঘবদ্ধভাবে এ সত্যের অনুসারীদের সকল শক্তি ও যােগ্যতাকে কাজে লাগানােই এই যুক্তি-বুদ্ধির লক্ষ্য। ঈসা(আ.) কর্তৃক আহমাদ(স.)-এর আগমনবার্তা আল কোরআনের ভাষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। ইনজীল কিতাবের নানা সংস্করণের মধ্যে এ সম্পর্কে উল্লেখ থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু আসে-যায় না। কারণ, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, যে পদ্ধতিতে ইনজীলের এই পুস্তকগুলাে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং যারা এগুলাে রচনা করেছে, তাদের বিশ্বস্ততা প্রশ্নের উর্ধে না থাকায় আল-কোরআনের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য এসব পুস্তকের দিকে তাকানাে চলে না। আল-কোরআনের সুমধুর বাণী আরব উপদ্বীপের ইহুদী-নাসারাদের পড়ে শােনানাে হয়েছে, সেখানে আহমাদ-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তিনি নিরক্ষর নবী, যার বিবরণ ওরা (ইহুদী-নাসারারা) তাদের নিকট অবস্থিত তাওরাত ও ইনজীল কিতাবদ্বয়ে লিপিবদ্ধ পায়। কতিপয় আহলে কিতাব আলেম, যেমন আবদুল্লাহ ইবন সালাম ইসলাম গ্রহণ করার পর একথার সত্যতা (অর্থাৎ তাওরাত ও ইনজীল কিতাবে নবী আহমাদ-এর আগমনবার্তার কথা) স্বীকার করেছেন। তিনি এও স্বীকার করেছেন যে, তারা একথাগুলাে গোপন রাখার জন্য একে অপরকে বিশেষভাবে উপদেশ দিতাে ও অনুরােধ করতাে! এইভাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা যায়, ইহুদীরা দীর্ঘ দিন থেকে একজন নবীর আগমন প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল। একইভাবে আরব-উপদ্বীপের কতিপয় একত্ববাদী নাসারা আলেমও একজন নবীর আগমনের কথা বলতাে, কিন্তু ইহুদীরা চাইতাে, এই নবীর আগমন তাদের মধ্যে ঘটুক। তারপর যখন আল্লাহ পাক চাইলেন যে, ইবরাহীম(আ.)-এর দুই শাখার মধ্যে দ্বিতীয় শাখায় শেষ নবীর আগমন হােক, তখন ওদের কাছে এটা খারাপ লাগলাে এবং তারা নবী (স.)-এর সাথে নানা প্রকার কূটতর্ক শুরু করে দিলাে। অবস্থা যাই হােক না কেন, অন্যান্য উপায়ে প্রাপ্ত সংবাদের সাথে প্রমাণের জন্য এ সম্পর্কিত আল-কোরআনের সিদ্ধান্তকারী আয়াতই যথেষ্ট এবং এ প্রসংগে এই শেষের কথাটিই চূড়ান্ত প্রমাণ। আলােচ্য সূরার মধ্যে নিম্নে বর্ণিত অধিকাংশ আয়াতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানা যায়, বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে ইহুদী ও নাসারাদের বিরােধিতার মােকাবেলায় আয়াতে উল্লিখিত এ কথাগুলাে বলা হয়েছে। কারণ তাদের নিকট অবস্থিত কিতাবগুলাে অবশ্যই তার (নবীর) আগমন সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়েছে, যা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে গােপন করে রাখছিলাে। নবাগত এই যে দ্বীন (ইসলামী জীবন ব্যবস্থা), যাকে আল্লাহ পাক মানব নির্মিত যাবতীয় জীবন ব্যবস্থা ও আইন-কানুনের ওপরে প্রতিষ্ঠিত ও পরিপূর্ণভাবে বিজয়ী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং স্থির করেছিলেন যে, শেষবারের মতাে প্রেরিত এই ব্যবস্থাই হবে সমাপ্তকারী ও চূড়ান্ত। সেই জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই ইহুদী-খৃষ্টানরা নানা প্রকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলো যা এখনও চালু আছে।

Leave a Reply