بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬২/এবং কাফের-রা বলে:-১৬) [*‌‌ সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে?:-  *কাফিররা অপছন্দ করে:- *আল্লাহ তা‘আলা ইসলামকে সারা জাহানে বিজয়ী করবেন, যতই কাফির-মুশরিকরা প্রতিহত করার চেষ্টা করুক:-] www.motaher21.net সূরা:৬১: আস্-সফ। পারা:২৮ ৭ – ৯ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬২/এবং কাফের-রা বলে:-১৬)
[*‌‌ সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে?:-
*কাফিররা অপছন্দ করে:-
*আল্লাহ তা‘আলা ইসলামকে সারা জাহানে বিজয়ী করবেন, যতই কাফির-মুশরিকরা প্রতিহত করার চেষ্টা করুক:-]
www.motaher21.net
সূরা:৬১: আস্-সফ।
পারা:২৮
৭ – ৯ নং আয়াত:-
সূরা:৬১: আস্-সফ:-৭
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ الۡکَذِبَ وَ ہُوَ یُدۡعٰۤی اِلَی الۡاِسۡلَامِ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۷﴾
সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে যে আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা বানিয়ে বলে। অথচ তাকে শুধু ইসলামের (আল্লাহর আনুগত্য করার) দিকে আহ্বান করা হচ্ছে। আল্লাহ এ রকম জালেমদের হিদায়াত দেন না।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-৮
یُرِیۡدُوۡنَ لِیُطۡفِـُٔوۡا نُوۡرَ اللّٰہِ بِاَفۡوَاہِہِمۡ وَ اللّٰہُ مُتِمُّ نُوۡرِہٖ وَ لَوۡ کَرِہَ الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿۸﴾
তারা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নেভাতে চায়, আর আল্লাহ্‌, তিনি তাঁর নূর পূর্ণতাদানকারী, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-৯
ہُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ رَسُوۡلَہٗ بِالۡہُدٰی وَ دِیۡنِ الۡحَقِّ لِیُظۡہِرَہٗ عَلَی الدِّیۡنِ کُلِّہٖ وَ لَوۡ کَرِہَ الۡمُشۡرِکُوۡنَ ٪﴿۹﴾
তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত এবং ‘দ্বীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দ্বীনকে অন্য সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।

৭-৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# আল্লাহর প্রেরিত নবীকে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার বলে অভিহিত করা এবং নবীর ওপর আল্লাহর যে বাণী নাযিল হচ্ছে তাকে নবীর নিজের তৈরী কথা বলে ধরে নেয়া।

# আল্লাহর এই সত্য নবীকে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার বলাটাই কোন ছোট খাট জুলুম নয়। কিন্তু সেটা আরো বড় জুলুম হয়ে দাঁড়ায় যখন তিনি আল্লাহর দাসত্ব আনুগত্যের প্রতি আহবান জানান আর জবাবে শ্রোতা তাঁকে গালি দিতে থাকে এবং তাঁর দাওয়াত ও আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য মিথ্যা কলঙ্ক লেপন ও অপবাদ আরোপের কৌশল অবলম্বন করে।
# স্মরণ রাখা দরকার যে, এ আয়াতটি ৩ হিজরী সনে ওহোদ যুদ্ধের পরে নাযিল হয়েছিল। সে সময় ইসলাম কেবল মদীনা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, মুসলমানদের সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশী ছিল না এবং গোটা আরবভূমি দ্বীন ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য পুরোপুরি সংকল্পবদ্ধ ছিল। ওহোদের যুদ্ধে মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছিল তার কারণে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন হয়েছিল এবং আশেপাশের গোত্রসমূহ তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসী হয়ে উঠেছিল। এরূপ পরিস্থিতিতে বলা হয়েছে, আল্লাহর এই ‘নূর’ কারো নিভিয়ে দেয়াতে নিভবে না, বরং পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হবে এবং সারা পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ক্ষান্ত হবে। এটা একটা স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী, যা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। ইসলামের ভবিষ্যত কি একমাত্র আল্লাহ‌ ছাড়া সেই সময় আর কে তা জানতো? মানুষ তো তখন দিব্যি দেখছিল, এটা একটা নিভু নিভু প্রদীপ যা নিভিয়ে ফেলার জন্য প্রচণ্ড ঝড়ে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে।

# মুশরিকদের জন্য অসহনীয় হলেও। অর্থাৎ যারা আল্লাহর দাসত্বের সাথে অন্যদের দাসত্বও করে থাকে এবং আল্লাহর দ্বীনের সাথে অন্য সব দ্বীন ও বিধানকে সংমিশ্রিত করে, শুধু এক আল্লাহর আনুগত্য ও হিদায়াতের ওপর গোটা জীবনব্যবস্থা কায়েম হোক তারা তা চায় না। যারা ইচ্ছামত যে কোন প্রভু ও উপাস্যের দাসত্ব করতে সংকল্পবদ্ধ এবং যে কোন দর্শন ও মতবাদের ওপর নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা এবং তাহযীব তামুদ্দুনের ভিত্তিস্থাপন করতে প্রস্তুত এমনসব লোকের বিরোধিতার মুখেও বলা হচ্ছে যে, তাদের সাথে আপোষ করার জন্য আল্লাহর রসূলকে পাঠানো হয়নি। বরং তাকে পাঠানো হয়েছে এ জন্য যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে হিদায়াত ও জীবনব্যবস্থা এনেছেন তাকে গোটা জীবনের সব দিক ও বিভাগের ওপর বিজয়ী করে দেবেন। অবস্থা যাই হোক না কেন, তাঁকে এ কাজ করতেই হবে। কাফের ও মুশরিকরা তা মেনে নিক আর না নিক এবং এ বিরোধিতায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও সর্বাবস্থায় রসূলের এ মিশন সফলকাম হবে এবং পূর্ণতা লাভ করবে। ইতিপূর্বে কুরআন মজীদের আরো দু’টি স্থানে এ ঘোষণা এসেছে এক, সূরা তাওবার ৩৩ আয়াতে । দুই, সূরা ফাতহের ২৮ আয়াতে । এ স্থানে তৃতীয়বারের মত এ ঘোষণার পুনরুক্তি করা হচ্ছে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন আত তাওবা টীকা, ৩২ ; সূরা আল ফাতহ টীকা ৫১ ।)

সুরা: আত-তওবা
আয়াত নং :-৩৩

هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰى وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَى الدِّیْنِ كُلِّهٖ١ۙ وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ

আল্লাহই তার রসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি একে সকল প্রকার দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, মুশরিকরা একে যতই অপছন্দ করুক না কেন।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# কুরআনের মূল আয়াতে “আদদ্বীন” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আমি এর অনুবাদে বলেছি, সকল প্রকার দ্বীন ইতিপূর্বে যেমন বলে এসেছি, এ দ্বীন শব্দটি আরবী ভাষায় এমন একটি জীবন ব্যবস্থা বা জীবন পদ্ধতি অর্থে ব্যবহৃত হয় যার প্রতিষ্ঠাতাকে সনদ ও অনুসরণযোগ্য বলে মেনে নিয়ে তার আনুগত্য করতে হয়। কাজেই এ আয়াতে রসূল পাঠাবার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে দ্বীন জাতীয় বা দ্বীনের শ্রেণীভুক্ত অন্য কথায় জীবন বিধান পদবাচ্য সমস্ত পদ্ধতি ও ব্যবস্থার ওপর জয়ী করবেন। অন্য কথায় রসূলের কখনো এ উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি যে, তিনি যে জীবন ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন তা অন্যান্য জীবন ব্যবস্থার কাছে পরাজিত হয়ে ও সেগুলোর পদানত থেকে তাদের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ ও সংকোচিত করে রাখবে। বরং তিনি আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতির প্রতিনিধি হয়ে আসেন এবং নিজের মনিবের সত্য ও ন্যায়ের ব্যবস্থাকে বিজয়ী দেখতে চান। দুনিয়ায় যদি অন্য কোন জীবন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাকে আল্লাহর ব্যবস্থার আওতাধীনেই তার দেয়া সুযোগ-সুবিধা হাতপেতে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। যেমন জিযিয়া আদায় করার মাধ্যমে যিম্মিরা নিজেদের অধীনতার জীবন মেনে নেয়। (দেখুন আয যুমার ৩ টীকা, আল মু’মিন ৪৩ টীকা, আশ শূরা ২০ টীকা)

সুরা: আল-ফাতাহ্
আয়াত নং :-২৮

هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰى وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَى الدِّیْنِ كُلِّهٖ١ؕ وَ كَفٰى بِاللّٰهِ شَهِیْدًاؕ

আল্লাহই তো সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন যেন তাকে সমস্ত দ্বীনের ওপর বিজয়ী করে দেন। আর এ বাস্তবতা সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষই যথেষ্ট।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে একথা বলার কারণ হলো যখন হুদাইবিয়াতে সন্ধিচুক্তি লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিলো সে সময় মক্কার কাফেররা নবীর ﷺ সম্মানিত নামের সাথে রসূলুল্লাহ কথাটি লিখতে আপত্তি জানিয়েছিলো, তাদের একগুঁয়েমির কারণে নবী (সা.) নিজে চুক্তিপত্র থেকে একথাটি মুছে ফেলেছিলেন। তাই আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছেন, আমার রসূলের রসূল হওয়া একটি অনিবার্য সত্য, কারোর মানা বা না মানাতে তাতে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না। কিছু লোক যদি তা না মানে না মানুক। তা সত্য হওয়ার জন্য আমার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। তাদের অস্বীকৃতির কারণে এ সত্য পরিবর্তিত হয়ে যাবে না। তাদের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও এ রসূল আমার পক্ষ থেকে যে হিদায়াত ও দ্বীন নিয়ে এসেছেন তা অন্য সব দ্বীনের ওপর বিজয় লাভ করবে। তা ঠেকিয়ে রাখার জন্য এসব অস্বীকারকারীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন।

‘সব দ্বীন’ বলতে বুঝানো হয়েছে সেসব ব্যবস্থাকে যা দ্বীন হিসেবে গণ্য। আমরা পূর্বেই তাফহীমুল কুরআন সূরা যুমারের ব্যাখ্যায় ৩ টীকায় এবং সূরা শূরার ২০ টীকায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে আল্লাহ‌ তা’আলা যে কথাটি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন তা হচ্ছে শুধু এ দ্বীনের প্রচার করাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল একে দ্বীন হিসেবে গণ্য সমস্ত জীবনাদর্শের ওপর বিজয়ী করে দেয়া। অন্য কথায় জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগের ওপর কোন বাতিল জীবনাদর্শ বিজয়ী হয়ে থাকবে আর বিজয়ী সে জীবনাদর্শ তার আধিপত্যাধীনে এ দ্বীনকে বেঁচে থাকার যতটুকু অধিকার দেবে এ দ্বীন সে চৌহদ্দির মধ্যেই হাত পা শুটিয়ে বসে থাকবে এ উদ্দেশ্যে নবী (সা.) এ দ্বীন নিয়ে আসেননি। বরং তিনি এ জন্য তা এনেছেন যে, এটাই হবে বিজয়ী জীবনাদর্শ। অন্য কোন জীবনাদর্শ বেঁচে থাকলেও এ জীবনাদর্শ যে সীমার মধ্যে তাকে বেঁচে থাকার অনুমতি দেবে সে সীমার মধ্যেই তা বেঁচে থাকবে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা যুমারের তাফসীর, টীকা ৪৮ )

 

৭-৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-

ফী জিলালিল কুরআন:-

এরশাদ হচ্ছে, “তারপর যখন তাদের কছে আল-কোরআনের সত্যতা ও সঠিকতা সম্পর্কে সকল প্রকার দলীল-প্রমাণ হাযির হয়ে গেল (এবং এর সম্মােহনী বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে লােক ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলাে), তখন তারা বলে ওঠলাে, এতাে স্পষ্ট এক জাদু। আর সে ব্যক্তি থেকে বড় যালেম আর কে হবে যে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলে, অথচ তাকে তাে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার দিকে ডাকা হচ্ছে এবং আল্লাহ তায়ালা যালেম জাতিকে সঠিক পথ দেখান না। ওরা তাে চায় আল্লাহর বাণীকে তাদের মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে, কিন্তু কাফেররা অপছন্দ করলেও আল্লাহ তায়ালা তার বাণীকে পূর্ণ করবেনই। তিনি তাে সেই মহান সত্তা, যিনি তাঁর রসূলকে সত্য পথের দিশা (আল-কোরআন) দিয়ে পাঠিয়েছেন, আরও দিয়েছেন তাঁর রসূল প্রদর্শিত সত্য-সঠিক জীবন ব্যবস্থা, যাতে তিনি এই জীবন ব্যবস্থাকে প্রচলিত মানব রচিত আইন-কানুন ও সকল জীবন ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করতে পারেন, যদিও মােশরেকরা এটা পছন্দ করে না।”  *মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে ইহুদি নাসারাদের অবিরাম চক্রান্ত : ইসলামের এই মােহিনী জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে বনী ইসরাঈল জাতি চরম শত্রুতা প্রদর্শন করেছে, নানা প্রকার চক্রান্তের জালে আবদ্ধ হয়েছে এবং নানা প্রকার বিভ্রান্তির পথ অবলম্বন করেছে। রসূল(স.)-এর যমানা থেকে নিয়ে তারা নানাভাবে, নানা উপায়ে ও পদ্ধতিতে এই দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে বহ্নিশিখা ছড়িয়ে দিয়েছে, তা আজও অবিকল সেই প্রথম দিনের মতই দাবানলের মতাে জ্বলছে। অনির্বাণ এই বহ্নিশিখাকে উদ্দীপিত রাখার জন্য নানারূপ মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, “যখন সে (নবী স.) তাদের নিকট স্পষ্ট দলীল, প্রমাণাদি সহকারে এলাে, তখন তারা বলে ওঠলাে, এতাে স্পষ্ট জাদু।” তারা সেইভাবে এই কথাগুলাে বলে ওঠলাে যেভাবে আসমানী কিতাবের জ্ঞান বিবর্জিত এবং এই দ্বীনের আগমন সম্পর্কে অজ্ঞ লােকেরা বলতাে। তারা যুদ্ধরত ইসলামী জনগণের মধ্যে ঢুকে সত্য-মিথ্যা বানিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলাে, মদীনার মধ্যে একত্রে বসবাসরত মােহাজের এবং তাদের দ্বীনী ভাই আনসারদের মধ্যে ঝগড়া বাধানোর জন্য তারা নানা প্রকার চক্রান্ত শুরু করলাে এবং আনসারদের আওস ও খাযরাজ গােত্রদ্বয়ের মধ্যেও ভুলবুঝাবুঝি সৃষ্টি করার কাজে ব্যাপৃত হল, কখনও মােনাফেকদের এবং কখনও মােশরেকদেরকে নেতৃত্বের নেশায় মাতিয়ে তুললাে। আবার কখনও তারা ইসলামের দুশমনদের একত্রিত করে মুসলমানদের একযােগে আক্রমণ করার কাজে লাগিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দিলাে, যেমন দেখা যায় আহযাবের যুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনীর তৎপরতার সময়। তাদের বিভিন্নমুখী ইসলাম বিধ্বংসী চক্রান্ত মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমেও চলেছে, যেমন তাদেরই প্ররােচনায় মােনাফেক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল মিথ্যা রটনার কাজে লেগে গিয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবনে সাবার কূট চক্রান্তে পড়ে ওসমান(রা.)-এর আমলে মদীনা ও আশেপাশের মুসলমানরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে জড়িয়ে পড়েছিলাে এইভাবে আরও বহু প্রকারের মিথ্যা ছড়িয়ে এবং ইসরাঈলীদের শ্রেষ্ঠ জাতি বানানাের ব্যর্থ ষড়যন্ত্রে এ ইহুদীচক্র বহু হাদীস জাল করে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে ফেলেছিলাে এবং সীরাত (রসূল স.-এর জীবনচরিত) ও তাফসীরের মধ্যে বহু ভুল হাদীস ঢুকিয়ে দেয়ার কাজ করেছিলাে। এ সকল নানা প্রকার চক্রান্ত ও তৎপরতায় তখনই তারা লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাে, যখন আল কোরআনের মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের ষড়যন্ত্রে তারা চরম ভাবে ব্যর্থ হয়। তারা কোনাে দিন এক মুহূর্তের জন্যও যুদ্ধের এই হাতিয়ার কোষবদ্ধ করেনি; বরং আজও নিরন্তর গতিতে ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র-চক্র সমভাবে সক্রিয় রয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক চরমপন্থী ইহুদীবাদ (যায়ােনিষ্ট) চক্র এবং আন্তর্জাতিক খৃষ্টান চক্র ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য নবতর উদ্যোগে মেতে ওঠেছে। এই উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের নীতিতে কিছু পরিবর্তন করে এমনভাবে একত্রিত হয়েছে যা ইতিপূর্বে অন্য সময়ে দেখা যায়নি। মুসলমানদের সাথে তারা কোন শান্তি চুক্তিতে আসতে এখন রাযি নয়, যদিও বাহ্যিকভাবে আলাপ-আলােচনার কথা বলে চলেছে। ইতিপূর্বে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যের আন্দালুসিয়ায় (স্পেনে) সম্মিলিতভাবে তারা ক্রুসেড যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে শেষ খলীফা পরিচালিত রাষ্ট্রে (তুরস্কে) এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছে এবং অবশেষে রাষ্ট্রটিকে ভেংগে কয়েকটি টুকরা বানিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিয়েছে। অবশিষ্ট যে অংশটুকু রয়ে গেছে পরে তা ইউরােপের ‘অসুস্থ ব্যক্তি’ বলে পরিচিত হয়েছে। এরপর ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানাের জন্য মুসলমানদের মধ্যে নানা প্রকার বিভেদ এমনভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, বর্তমানে মুসলমানরা মুসলমানদের কারাে ওপরই আস্থা রাখতে পারছে না। খেলাফতকে যখন তারা ধ্বংস করার মনস্থ করেছে এবং মুসলমানদের একের বিরুদ্ধে অপরকে লেলিয়ে দিতে চেয়েছে, তখন মুসলিম জনগণের চরিত্র ধ্বংস করার জন্য নানা প্রকার ব্যবস্থা নিয়েছে, তাদের মধ্যে পরস্পর ঘৃণা-বিদ্বেষের আগুন উদ্দীপিত করেছে এবং ভেীগােলিক জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন তুলে মুসলমান সমাজের রন্ধ্রএ রন্ধ্রে আঞ্চলিকতার বিষ ছড়ানাে হয়েছে, যার ফলে মুসলমানরা পরস্পরের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করে চলেছে। অথচ এর পূর্বে তাদের একের বিরুদ্ধে অপরকে আক্রমণ করাতে তারা বার বার ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে খেলাফতের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করাতে। আরবী ভাষা উচ্ছেদ করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে, মুসলমানদেরও নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এরপর যখন ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েমের কথা বাদ দিয়ে মুসলমানরা শুধু মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, এর ফলে অন্যান্য ফল যাইই হােক না কেন, দ্বীনের কোন স্বার্থ রক্ষিত হলাে না এবং অন্যান্য বিষয়ের উন্নতি হলেও দ্বীনের পতাকা কোথাও উড্ডীন হলাে না। এই অবস্থার সুযােগ নিয়ে আহলে কিতাবরা দ্বীনের বাতি নিভিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠলাে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা চায় তাদের মুখের ফুৎকারে দ্বীন ইসলামের বাতি নিভিয়ে দিতে, অথচ আল্লাহ তায়ালা তার বাতি পূর্ণ করবেনই, যদিও কাফেররা তা পছন্দ করে না। আল কোরআনের এই আয়াতটি বড় সত্য কথা তুলে ধরেছে যে, ক্রোধ উপশমের জন্য তারা ঠাট্টা, মঙ্কারি করতে আর এটা সত্য কথা যে, তারা মুখে বলতাে ‘এটা তাে স্পষ্ট জাদু এবং নতুন আগত এই জীবন ব্যবস্থাকে দাবিয়ে দেয়ার জন্য তারা নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করতে থাকলাে। এটা যে তাদের জন্য কতাে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে তা তারা জানতাে না, আর এ জন্যই তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর বাতি নিভিয়ে দিতে চাইছিলাে, অথচ তারা একথা জানে না, তারা কতাে দুর্বল, কতো অসহায়। তাই আল্লাহ পাকের ঘােষণা হচ্ছে, “আল্লাহ তায়ালা অবশ্য অবশ্যই তার বাতিকে পরিপূর্ণ করবেনই যদিও কাফেররা এটা পছন্দ করে না।” আল্লাহ পাক তার ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন। রাসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর নূরকে পূর্ণ করেছেন। অতপর তিনি ইসলামী জামায়াতকে আল্লাহ পাকের দেয়া আইন-কানুন চালু করার মাধ্যমে জীবন্ত রূপ দান করেছেন। এমন এক চমৎকার উপায়ে তিনি এই জীবন ব্যবস্থা চালু করেছেন, যা এক স্পষ্ট ও অতি স্মরণীয় ঘটনা হিসাবে আজও বর্তমান রয়েছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ আল্লাহ পাকের দ্বীনের এই বিজয়কে এমনভাবে স্মরণ করে চলেছে যে, তার কোনাে নযীর পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। এটা একটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ পাক তার নূর-কে পূর্ণ করেছেন এবং মুসলমানদের জন্য তাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। তাদেরকে যে নেয়ামত দিতে চেয়েছিলেন তা পূর্ণাংগভাবেই দান করেছেন। তারা এই দ্বীনকে মহব্বত করে বলে আল্লাহ তায়ালাও তাদের এই সত্য জীবন ব্যবস্থা দান করে সন্তুষ্ট হয়েছেন। মােমেনরা তাঁর পথে টিকে থাকার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রাম করে চলেছে। তাদের কেউ দোযখে নিক্ষিপ্ত হওয়া পছন্দ করে না এবং কিছুতেই কুফরীর দিকে ফিরে যেতে চায় না। সুতরাং দ্বীনের এই তাৎপর্য তাদের অন্তরের মধ্যেও সারা পৃথিবীতে সমানভাবে পূর্ণ করে দেয়া হলাে। যুগে যুগে ইসলামের এই দীপশিখা বার বার জ্বলে ওঠেছে। মুসলিম জাতির ধমনীতে ইসলামের রক্ত প্রবাহ আজও বিদ্যমান এবং এখনও মুসলমান অন্তরে আল্লাহ পাকের এই বিধানের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম রয়েছে, যদিও ইসলাম বিরােধী শক্তিগুলাে বরাবরই ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্র ও চরম আক্রমণের অভিযান চালিয়ে গেছে। ইসলামের বাতিকে শত চেষ্টা করেও এর দুশমনরা একেবারে নিভিয়ে দিতে পারেনি। কারণ এটা হচ্ছে আল্লাহর বাতি, যা মুখের ফুৎকারে কিছুতেই নিভানাে যায় না, না কোন বান্দার পক্ষ থেকে প্রয়ােগ করা কোন অগ্নিবাণ বা লৌহশলাকা আল্লাহ পাকের এই শক্তিকে দমন করতে পারে। দুনিয়ার শক্তিমান রাজা-বাদশাহরা, যালেম অধিপতিরা বার বার ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছে খৃষ্টানচক্র ক্রুসেড অভিযান চালিয়ে এবং ইহুদীরা নানা প্রকার ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে ইসলামের ধ্বংস সাধনে চেষ্টার কোন কসুর করেনি। অবশ্যই এই দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রয়েছে এবং বিজয়ী করার কর্মধারা নিরন্তর গতিতে এগিয়ে চলেছে। সুতরাং এই কাজ করার জন্য আল্লাহ পাক তার সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে বলছেন, তিনি সেই সত্ত্বা, যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর রসূলকে হেদায়াত ও সত্য জীবন ব্যবস্থা সহ, যাতে করে তিনি এই জীবন ব্যবস্থাকে মানব নির্মিত যাবতীয় আইন-কানুনের ওপর বিজয়ী করতে পারেন, যদিও মুশরিকরা এটা পছন্দ করে না। এই দ্বীনের পক্ষে আল্লাহ পাকের সাক্ষ্য ও সাহায্য এই জন্য রয়েছে যে, এটিই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে সঠিক দিক-নির্দেশনা এবং এটিই প্রকৃত সত্য জীবন ব্যবস্থা, যা মানুষের জীবনে সর্বদিক দিয়ে শান্তি আনতে পারে, এরই সাক্ষ্য আল্লাহ পাক দিচ্ছেন আলােচ্য এই আয়াতে। এটিই চূড়ান্ত ও সিদ্ধান্তকর কথা, যার বাইরে বা যার থেকে উত্তম আর কোনাে কথা হতে পারে না। আর আল্লাহ তায়ালার চূড়ান্ত ইচ্ছা সমাপ্ত হয়েছে এবং এই দ্বীন বিজয়ীও হয়েছে অন্যান্য সকল জীবন বিধানের ওপর। আল্লাহ তায়ালার আইন অবশ্যই বিজয়ী হয়েছে। সুতরাং অন্য কোন দ্বীন বা আইন-কানুন (চিরদিনের জন্য) কিছুতেই বিজয়ী হবে না। এক্ষেত্রে পৌত্তলিক ধর্ম রাষ্ট্র পরিচালনা বা মানুষকে জীবন ব্যবস্থা দেয়ার কোন ক্ষমতা রাখে না। আহলে কিতাবদের প্রাধান্য-কর্তৃত্বও সমাপ্ত হয়েছে, আর যে উদ্দেশ্যে ইতিপূর্বে কিতাবসমূহ অবতীর্ণ হয়েছিলাে, তার পরিপূর্ণতা দান করার জন্য আগত ইসলাম আজ ষােলকলায় পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে বিশ্ব-দরবারে হাযির এবং এর কর্তৃত্ব চলতে থাকবে পৃথিবীর শেষ যমানা অবধি। ইতিপূর্বে যেসব ধর্ম এসেছে তার আসল রূপ পরিবর্তিত হয়ে মূল শিক্ষা থেকে সেগুলাে বহু দূরে চলে যাওয়ার কারণে এখন সেগুলাে ভেংগে খানখান হয়ে গেছে। সেগুলাের মধ্যে মানব নির্মিত অনেক মতবাদ প্রবেশ করেছে। সেগুলাের বহু শিক্ষাকে কাট-ছাঁট করে ফেলা হয়েছে। যার ফলে সেগুলাে আর মানুষের জীবনের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য যথেষ্ট থাকেনি। আর যদি সেগুলাে অপরিবর্তিত অবস্থাতেও থাকত, তবু সেগুলাে পরিবর্তিত অবস্থার প্রয়ােজন মেটানাের জন্য যথেষ্ট হত না। কারণ, সেগুলাে বিশেষ এক সময়ের প্রয়ােজন মেটানাের জন্য প্রেরিত হয়েছিলাে। সুতরাং এটাই হচ্ছে দ্বীন ইসলামের তাৎপর্য ও প্রকৃতি। মানব জীবনের বাস্তব প্রয়ােজন মেটানাের জন্য যে জীবন বিধান দেয়ার ওয়াদা আল্লাহ পাক করেছিলেন তা পরিপূর্ণ শক্তি, সৌন্দর্য ও যাবতীয় প্রয়ােজন মেটানাের বাস্তব ব্যবহার প্রণালী এবং মানব জীবনের ব্যবহারােপযােগী সর্বোত্তম ব্যবস্থা রূপে আজ সমাগত। শাসন ব্যবস্থা হিসাবে এ দ্বীন অন্যান্য মানব নির্মিত সকল শাসন ব্যবস্থা থেকে উত্তম। সর্বযুগে এবং সকল দেশে এ ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা ধীরে ধীরে চালু হয়েছে। তারপর যারাই পূর্বের মতাে জিহাদী মনােবৃত্তি নিয়ে সংগ্রাম করেছে, প্রাণান্ত চেষ্টা করেছে এবং পরিপূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করে গেছে, তাদের দাওয়াত পূর্ব থেকে পাঁচ শুণ বেশী ফলপ্রসূ হয়েছে এবং একটি রাষ্ট্র থেকে আশেপাশের অপর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এ দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চরমপন্থী আন্তর্জাতিক ইহুদীবাদ ও আন্তর্জাতিক খৃষ্টবাদ একত্রিত হয়ে তুরস্কের ওপর আক্রমণ করার পর এবং পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ ও চক্রান্তের আগুন ছড়িয়ে দেয়া সত্তেও ইসলামের দাওয়াত অনিরুদ্ধ গতিতে এগিয়েই চলেছে। সকল ইসলামী দেশে আন্তর্জাতিক ইহুদীবাদ ও খৃষ্টানচক্র সর্বপ্রকার ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা চালানাে সত্তেও ইসলামের প্রচার প্রসার থেমে যায়নি। মানবেতিহাসের সর্বযুগে আল্লাহ পাকের ওয়াদা-অনুসারে, তার দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে এর প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম হয়ে এসেছে এবং কারাে কোনাে উপহাস বিদ্রুপে কোনােকালে এ চেষ্টা থেমে যায়নি বা কোন শক্তির দাপট, ষড়যন্ত্রের তীব্রতা এবং বিভ্রান্তিকর প্রচেষ্টা ইসলামের গতি থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। ইহুদী ও নাসারাদের পরিচালনার দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মােমেনদের দ্বীন ইসলামের এই আমানত বহন করার দায়িত্ব দিয়েছেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এই দায়িত্ব পালনের কথা অপরের নিকট পৌছে দেয়ার জন্য এই আয়াতগুলাের মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন। আল্লাহ পাক তার যে দ্বীনকে বিজয়ী করতে চেয়েছেন এবং এ উদ্দেশ্যে তারা যে পদ্ধতিতে কাজ করে যাচ্ছে, তাতে তাদের অন্তরের মধ্যে প্রশান্তি বিরাজ করছে। দ্বীনকে বিজয়ী করার মালিক তাে আল্লাহ পাক নিজেই, তারা তাে নিছক যন্ত্রমাত্র। তারা তাদের রবের সাথে করা এ ওয়াদা পূরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে এবং আল্লাহর হুকুমে বাস্তব জীবনের সর্বত্র অনাগত কালের সকল সময়ে এ ওয়াদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে তীব্র অনুভূতি নিয়ে কাজ করে যাবে।

ফী জিলালিল কুরআন:-
এরপর আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ ওয়াদাও বাস্তবায়িত হয়। সে ওয়াদাটা হলাে এই, “তিনিই তার রসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত জীবন বিধানের ওপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠাতারূপে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট।'(আয়াত ২৮) আল্লাহ তায়ালার এই ওয়াদা পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে। সত্য দ্বীনের জয় হয়েছে। এই বিজয় কেবল আরব উপদ্বীপ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের মধ্যেই গােটা পৃথিবীতে এর বিস্তার ঘটে। গােটা পারস্য সম্রাজ্যে এর বিস্তার ঘটে, রােমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ এলাকায় এর বিস্তার ঘটে । এমনকি ভারত ও চীনসহ দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপ (ইন্দোনেশিয়া) পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ ও গােটা ষষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীতে এসব এলাকাতেই আবাদ ছিলাে। আল্লাহ তায়ালার এই সত্য বিধানের বিজয় এখনও অব্যাহত রয়েছে। এমনকি এর বিজিত অধিকাংশ এলাকায় বিশেষ করে ইউরােপ ও ভূমধ্যসাগরের দ্বীপগুলােতে এর রাজনৈতিক পতনের পরও এবং গােটা বিশ্বে অন্যান্য জাতির তুলনায় মুসলিম জাতির প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পাওয়া সত্তেও ইসলামের প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে। এটা মানতেই হবে যে, জীবন বিধান হিসেবে পৃথিবীর বুকে অন্যসব মতাদর্শের তুলনায় ইসলামের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্য এখনও অল্লান রয়ে গেছে। কারণ, মূল হিসেবে এটা একটা শক্তিশালী ব্যবস্থা এবং প্রকৃতির দিক থেকেও এটা একটা শক্তিশালী বিধান। এই বিধান তলােয়ার বা কামানের জোরে চলে না। বরং চলে এর অন্তর্নিহিত শক্তি, বৈশিষ্ট ও স্বভাবমুখীতার গুণে। এই বিধানের মাঝে দেহ ও আত্মার প্রয়ােজন মেটানাের মতাে যােগ্যতা রয়েছে। এর মাঝে জাগতিক উন্নতি ও অগ্রগতির প্রয়ােজন মেটানাের মতাে যােগ্যতা রয়েছে এবং সকল পরিবেশ ও সকল শ্রেণীর মানুষের প্রয়ােজন মেটানাের মত যােগ্যতাও রয়েছে। এই বিধানে কুঁড়েঘরে বসবাসকারী একজন দরিদ্র মানুষের চাহিদা মেটানাের উপাদান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকায় বসবাসকারী একজন বিত্তশালীর চাহিদাও। কোনো বিধর্মী বিদ্বেষমুক্ত হয়ে এটাকে জানার চেষ্টা করে তাহলে সে এর যথার্থতা, এর অন্তর্নিহিত শক্তি, এর দিকদর্শনের ক্ষমতা এবং মানুষের বহুবিধ ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানাের যােগ্যতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। তাই বলা হয়েছে, ‘এসব বিষয়ের স্বাক্ষী হিসেবে আল্লাহ তায়ালাই যথেষ্ট’ আল্লাহ তায়ালার এই ওয়াদা বাহ্যিক রাজনৈতিক রূপে প্রকাশ পেয়েছে রসুলুল্লাহ(স.)-এর নবুওত লাভের পর থেকে এক শতাব্দী পূর্ণ হওয়ার আগেই। তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালার এই ওয়াদা এখনও বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং সেটা হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক রূপে। অন্যান্য ধর্মের ওপর এই সত্য ধর্মের প্রাধান্য এখনও অব্যাহত আছে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ইসলামই একমাত্র শ্বাশ্বত জীবন বিধান যা সব ধরনের পরিস্থিতিতে কাজ করতে এবং নেতৃত্বদানে সক্ষম। আমার মনে হয় ইসলামের এই বাস্তব গুণটি আজ যারা অনুধাবন করতে পারছে না তারা স্বয়ং এই দ্বীনের অনুসারীরা। অন্যথায় বিধর্মীরা এটা ঠিকই অনুধাবন করতে পারে, ইসলামকে তারা ভয়ও করে এবং সে কারণেই তাদের প্রতিটি পলিসি ও নীতি নির্ধারণের সময় ব্যাপারটি বিবেচনায় রাখে।

ফী জিলালিল কুরআন:-

কাফেরদের ষড়যন্ত্র ও দ্বীনুল হকের প্রতি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি : অতপর কোরআন মোমেনদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে আরো একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আয়াত নং ৩২ ও ৩৩ এর মধ্যে এই পদক্ষেপটি প্রতিফলিত হয়েছে। ‘তারা আল্লাহর প্রদীপকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলতে চায় ।………… ‘ অর্থাৎ এ সব আহলে কেতাব শুধুমাত্র সত্য ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে, আল্লাহর বিকল্প প্রভুদের কাছ থেকে আইন ও বিধান গ্রহণ করে এবং আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর যথোচিতভাবে ঈমান না এনেই ক্ষান্ত থাকতে চায় না, বরঞ্চ তারা আল্লাহর সত্য দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করে, এই দ্বীনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর যে প্রদীপ আলো বিকিরণ করছে তাকে নিভিয়েও ফেলতে চায় এবং বিশ্বময় আল্লাহর আইন চালু করার দাওয়াতের মধ্য দিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে আলো জ্বালানোর যে প্রচেষ্টা চলছে, সেই মহত প্রচেষ্টাকে তারা স্তব্ধ ও নস্যাত করে দিতে চায়। ‘তারা আল্লাহর আলোকে নিভিয়ে ফেলতে চায়। …………. ’ অর্থাৎ তারা আল্লাহর আলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ও আগ্রাসনরত ৷ এই যুদ্ধ ও আগ্রাসন তারা চালায় কখনো অপপ্রচার, মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা রটনার মাধ্যমে । কখনো প্রতারণা, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে । কখনো এমন যুলুম নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে, যাতে মুসলমানরা নিজেদের ঈমান, চরিত্র ও সততা, অথবা জীবন ও সহায় সম্পদ অথবা সব কিছুই হারাতে বাধ্য হয়। কখনো তাদের বশংবদদের ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ চালানোর জন্যে উস্কে ও লেলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে । কখনো তাদেরকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্ররোচিত করার মাধ্যমে ৷ কোরআন নাযিল হবার সময়ে ও তার পরবর্তীকালে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে এরূপ পরিস্থিতিই বিরাজ করছিলো এবং উল্লিখিত সব ক’টা পন্থা পর্যায়ক্রমে অবলম্বন করা হয়েছিলো । এ বিবরণ দ্বারা এক দিকে যেমন কাংখিত ছিলো তৎকালীন মুসলমানদের মনে জাগরণ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করা, অপরদিকে তেমনি আল্লাহর সত্য ধর্মের বিরুদ্ধে আহলে কেতাবের চিরন্তন শত্রুসুলভ ভূমিকার মুখোশ খুলে দেয়াও এর উদ্দেশ্য ছিলো। “কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত না করে কিছুতেই ক্ষান্ত হবেন না। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে ।” এ হচ্ছে আল্লাহর শাশ্বত, অকাট্য ও নির্ভুল প্রতিশ্রুতি । এ প্রতিশ্রুতি আল্লাহর এ অপরিবর্তনীয় নীতির প্রতীক যে, তিনি কাফেরদের কাছে ঘোরতর অপ্রীতিকর হওয়া সত্ত্বেও তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করে তার আলোকে ছড়িয়ে দেবেন ও পূর্ণতা দান করবেন। এই প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করেই মোমেনদের মন প্রশান্ত, পরিতৃপ্ত ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে,অতপর তা তাদেরকে পথের যাবতীয় বাধাবিপত্তি, বক্রতা ও বিড়ম্বনা এবং কাফেরদের (অর্থাৎ এখানে আহলে কেতাবের) সমস্ত ভ্রকুটি ও কুটিল চক্রান্তকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। আনুষংগিকভাবে এই প্রতিশ্রুতির মধ্যে এই সব আল্লাহদ্রোহী ও তাদের তল্পিবাহকদের জন্যে কঠোর হুমকি ও সতর্কবাণীও রয়েছে, যা যুগযুগান্তর বলবত থাকবে। মোমেনদের প্রতি ওই প্রতিশ্রুতি এবং ইসলামের শত্রুদের প্রতি এই হুমকিকে আরো ধারালো, শানিত ও জোরদার করা হয়েছে ৩৩ নং আয়াতে, “তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি স্বীয় রসূলকে হেদায়াত ও সত্য ধর্ম সহকারে পাঠিয়েছেন…..” এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‘সত্য ও দ্বীনুল হক’ কথাটা দ্বারা ইতিপূর্বে ২৯ নং আয়াতেও আল্লাহর শেষ নবী মোহাম্মদ (স.)-এর মাধ্যমে প্রেরিত ইসলামকেই বুঝানো হয়েছে এবং যারা এই ইসলামকে গ্রহণ করে না, তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আয়াতের ব্যাখ্যা যেভাবেই করা হোক না কেন, এ বক্তব্য সম্পূর্ণ শুদ্ধ । “দ্বীনূল হক’ বা সত্য ধর্ম দ্বারা মোটামুটিভাবে এ কথাই বুঝানো হয় যে, আকীদা বিশ্বাসে, আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় কর্মকান্ডে ও আইন কানুনে একমাত্র আল্লাহরই আনুগত্য করা চাই। আল্লাহর সত্য দ্বীন যে যুগে যে নবীর মাধ্যমে ও যে কেতাবের আকারেই আসুক না কেন, তার মূল কথা সব সময় এটাই ৷ সর্বশেষে মোহাম্মদ (স.) যে ধর্ম বা দ্বীন নিয়ে এসেছেন, তারও এটাই মূল কথা । সুতরাং যে কোনো ব্যক্তি বা জাতি নিজের আকীদা বিশ্বাসে, আনুষ্ঠানিক এবাদাত উপাসনায় ও আইন কানুনে সর্বতোভাবে একমাত্র আল্লাহর বিধান অনুসরণ করবে না, তার বা তাদের ওপর এ বক্তব্যই প্রযোজ্য হবে যে, তারা সত্য ধর্মের অনুসারী নয় এবং ২৯ নং আয়াতে যে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত । তবে আগেও বহুবার বলেছি এবং পুনরায় বলছি যে, এই আদেশের বাস্তবায়নে ইসলামের পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবের প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং তার নিত্যনতুন কর্মপন্থা ও কর্মকৌশলের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। বস্তুত ৩৩নং আয়াতে ইসলামকে অন্য সকল জীবন ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করার যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো, তা দ্বারা ৩২ নং আয়াতের “আল্লাহ তার আলোকে পরিপূর্ণ রূপে বিকশিত না করে ক্ষান্ত হবেন না ” এই প্রতিশ্রুতিকেই অধিকতর শানিত ও জোরদার করা হয়েছে। তবে সেটা করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট আকারে । পূর্বোক্ত আয়াতে ‘আল্লাহর আলোকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করা’ কথাটা অস্পষ্ট ছিলো । এ আয়াতে তাকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর সেই আলো হচ্ছে ইসলাম, যা শেষ নবীর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। আর তাকে অন্য সকল জীবন ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করেই পূর্ণরূপে বিকশিত করা হবে। আগেই বলেছি যে, সত্য ধর্ম বা দ্বীনুল হক হচ্ছে আকীদা বিশ্বাসে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এবং আইন কানুনে সর্বত্র আল্লাহর সর্বাত্মক ও পরিপূর্ণ আনুগত্যের নাম। সর্বকালের সকল নবীর মাধ্যমে আগত ঐশী ধর্মেই আল্লাহর এই সর্বাত্মক আনুগত্যের নির্দেশ ছিলো । আজকের ইহুদী খৃষ্টানদের অনুসৃত বিকৃত ও পৌত্তলিকতা মিশ্রিত আকীদা বিশ্বাসে পরিপূর্ণ ধর্ম এবং ইসলামের লেবেল আঁটা সেই সব মানব রচিত মতবাদ, মতাদর্শ, আইন, বিধান ও রকমারি বিধি ব্যবস্থা স্বভাবতই ইসলামের আওতাভুক্ত নয়, যা পৃথিবীতে আল্লাহর দাসত্ব ও আল্লাহর আইনের আনুগত্যের পরিবর্তে মানুষের দাসত্ত্ব ও মানুষের রচিত আইন ও বিধানের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করে। আল্লাহ তায়ালা তার ‘দ্বীন’ কে বিজয়ী করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতে ‘দ্বীন’ শব্দের সেই সর্বব্যাপী ও সুদূর প্রসারী তাৎপর্য আমাদের বুঝতে হবে, যা আমি ইতিপূর্বে বর্ণনা করেছি। আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতির ব্যাপকতা ও পরিধি যাতে আমরা উপলব্ধি করতে পারি সে জন্যেই এর প্রয়োজন। শাব্দিক অর্থে ‘দ্বীন’-অর্থ আনুগত্য । কাজেই মানুষের অনুকরণ, অনুসরণ ও আনুগত্য করে, এমন প্রত্যেক ধর্ম, মত বা বিধান সমূহ এর আওতাভুক্ত হয়ে যায়৷ কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যে কোনো ‘দ্বীন’ কে বিজয়ী করার প্রতিশ্রুতি দেননি, বরং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দ্বীনুল হক বা ‘সত্য দ্বীন’কে বিজয়ী করার, যাকে তার নবীর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। এতে করে সমস্ত আনুগত্য শুধু আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যাবে, আর যে বিধান একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যকে প্রতিফলিত করে, সেই বিধানেরই বিজয় হবে। এই বিজয় একবার বাস্তবায়িত হয়েছে রসূল (স.), তার খলীফারা ও তাঁদের পরবর্তী মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে, যারা দীর্ঘকাল যাবত আল্লাহর বিধান অনুসারে শাসন পরিচালনা করেছেন । সত্য ধর্ম ইসলামই ছিলো তখন বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা । যে সব বিধানে আল্লাহর আনুগত্যের ব্যবস্থা ছিলো না, সেগুলো ভীত সন্ত্রস্ত ও কম্পমান থাকতো। এরপর সত্য ধর্মের অনুসারীরা ক্রমান্বয়ে পিছু হটতে ও সত্য ধর্মের অনুসরণ থেকে দূরে সরতে লাগলো । এর জন্যে অনেকগুলো কার্যকারণ দায়ী ছিলো ৷ একদিকে দায়ী ছিলো মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা, অপরদিকে তাদের শত্রু পৌত্তলিক ও আহলে কেতাবের পক্ষ থেকে পরিচালিত দীর্ঘ ও বহুমুখী যুদ্ধ । কিন্তু তাদের ওই পতন ও বিচ্যুতিই শেষ কথা নয়। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি এখনো বলবৎ রয়েছে এবং এমন একটা মুসলিম দলের অপেক্ষায় রয়েছে, যারা ইসলামের পতাকা বহন করে এগিয়ে যাবে, যারা আবার রসূল (স.) যেখান থেকে কাজ শুরু করেছিলেন সেখান থেকে শুরু করবে এবং আল্লাহর সত্য দ্বীনকে বাস্তবায়িত করতে আল্লাহর আলো জ্বালিয়ে পথ চলবে ।

৭-৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰي…. وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِیْنَﭜ)

অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয় যেমন বলে : আল্লাহ তা‘আলা সন্তান গ্রহণ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলার স্ত্রী আছে ইত্যাদি; তাদের চেয়ে বড় যালেম আর কেউ নেই। অথচ তাকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করা হয়।

(نُوْرَ اللّٰهِ) আল্লাহ তা‘আলার নূর অর্থ : কুরআন, ইসলাম, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিংবা দলীল প্রমাণাদি। মুখ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়ার অর্থ হল : তাদের সে সব কটুক্তি ও নিন্দনীয় কথাবার্তা যা তাদের মুখ থেকে বের হয় তা দিয়ে তারা ঐ জ্যোতিকে প্রতিহত করতে চায়।

(وَاللّٰهُ مُتِمُّ نُوْرِه)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সারা জাহানে তার প্রসার ঘটাবেন এবং অন্য সমস্ত ধর্মের ওপর তাকে জয়যুক্ত করবেন।

৭-৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

মহান আল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে এবং তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করে তার চেয়ে অধিক যালিম আর কেউই হতে পারে না। সে যদি বে-খবর হতো তবে তো একটা কথা ছিল, কিন্তু তার তো অবস্থা এই যে, তাকে তাওহীদ ও ইখলাসের দিকে সদা-সর্বদা আহ্বান করা হচ্ছে, সুতরাং যে ব্যক্তি এ ধরনের যালিম তার ভাগ্যে হিদায়াত আসবে কোথা হতে? তাদের চাহিদা এই যে, তারা সত্যকে মিথ্যা দ্বারা হারিয়ে ফেলবে। তাদের দৃষ্টান্ত ঠিক ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত যে ব্যক্তি সূর্যের রশ্মিকে মুখের ফু দ্বারা নিভিয়ে দিতে চায়। এটা যেমন অসম্ভব যে, তাদের মুখের ফু দ্বারা সূর্যের আলো নিভে যাবে ঠিক তদ্রুপ এটাও অসম্ভব যে, এই কাফিরদের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন দুনিয়ার বুক হতে মুছে যাবে।

কিন্তু আল্লাহ এই ফায়সালা করেছেন যে, তিনি তাঁর নূরকে উদ্ভাসিত করবেন যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। আর তিনিই তাঁর রাসূল (সঃ)-কে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর ওকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করার জন্যে, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।

এই দুটি আয়াতের পূর্ণ তাফসীর সূরায়ে বারাআতে গত হয়েছে। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে এবং আমরা তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ।

Leave a Reply