Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬৩/হে মুমিনগণ!:-৮৫ ও ৮৬) [*‌‌  হে মুমিনগণ!আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দেবো:- *আসন্ন বিজয় ;মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন :- **হে মুমিনগণ!তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও:-] www.motaher21.net সূরা:৬১: আস্-সফ। পারা:২৮ ১০-১৪ নং আয়াত:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬৩/হে মুমিনগণ!:-৮৫ ও ৮৬)
[*‌‌  হে মুমিনগণ!আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দেবো:-
*আসন্ন বিজয় ;মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন :-
**হে মুমিনগণ!তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হও:-]
www.motaher21.net
সূরা:৬১: আস্-সফ।
পারা:২৮
১০-১৪ নং আয়াত:-

সূরা:৬১: আস্-সফ:-১০
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ہَلۡ اَدُلُّکُمۡ عَلٰی تِجَارَۃٍ تُنۡجِیۡکُمۡ مِّنۡ عَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۱۰﴾
*হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দেবো যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে?
সূরা:৬১: আস্-সফ:-১১
تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ تُجَاہِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ بِاَمۡوَالِکُمۡ وَ اَنۡفُسِکُمۡ ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾
তোমরা আল্লাহ‌ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ও জান-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করো এটাই তোমাদের জন্য অতীব কল্যাণকর যদি তোমরা তা জান।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-১২
یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ وَ یُدۡخِلۡکُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ وَ مَسٰکِنَ طَیِّبَۃً فِیۡ جَنّٰتِ عَدۡنٍ ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ﴿ۙ۱۲﴾
আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমনসব বাগানে প্রবেশ করাবেন যার নীচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে। আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন। এটাই বড় সফলতা।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-১৩
وَ اُخۡرٰی تُحِبُّوۡنَہَا ؕ نَصۡرٌ مِّنَ اللّٰہِ وَ فَتۡحٌ قَرِیۡبٌ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۳﴾
আর আরেক জিনিস যা তোমরা আকাংখা করো আল্লাহ‌ তাও তোমাদের দেবেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং অতি নিকটবর্তী সময়ে বিজয়। হে নবী! ঈমানদারদেরকে এর সুসংবাদ দান করো।
সূরা:৬১: আস্-সফ:-১৪
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡۤا اَنۡصَارَ اللّٰہِ کَمَا قَالَ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ لِلۡحَوَارِیّٖنَ مَنۡ اَنۡصَارِیۡۤ اِلَی اللّٰہِ ؕ قَالَ الۡحَوَارِیُّوۡنَ نَحۡنُ اَنۡصَارُ اللّٰہِ فَاٰمَنَتۡ طَّآئِفَۃٌ مِّنۡۢ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ وَ کَفَرَتۡ طَّآئِفَۃٌ ۚ فَاَیَّدۡنَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا عَلٰی عَدُوِّہِمۡ فَاَصۡبَحُوۡا ظٰہِرِیۡنَ ﴿٪۱۴﴾
**হে মুমিনগণ!তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। ঠিক তেমনি, যখন ঈসা ইবনে মারয়াম হাওয়ারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেনঃ আল্লাহর দিকে (আহবান করার ক্ষেত্রে) কে আমার সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীরা জবাব দিয়েছিলোঃ আমরা আছি আল্লাহর সাহায্যকারী। সেই সময় বনী ইসরাঈল জাতির একটি দল ঈমান আনয়ন করেছল এবং আরেকটি দল অস্বীকার করেছিল। অতঃপর আমি ঈমান আনয়নকারীদেরকে তাদের শত্রুদিগের বিরুদ্ধে শক্তি যোগালাম এবং তারাই বিজয়ী হয়ে গেল।

১০-১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:-

সূরার এটি হচ্ছে শেষ অংশ, শেষ আলোচনা ৷ এতে মুসলিম সমাজের সাথে অমুসলিম সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের অবশিষ্ট বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এ আলোচনা শুরু করা হয়েছে মুসলমানের সাথে তার মালিকের সম্পর্কের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে । এখানে ইসলামের সে মূল প্রকৃতি বর্ণিত হয়েছে যার ঘোষণা সূরার এ পর্যায়ে দেয়া হয়েছে। এখানে দ্বীনের হুকুম আহকামের বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। এর সাথে এই আন্দোলনের দিক ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনাও করা হয়েছে। ইসলামী জীবন বিধানে কোনো মানব সন্তানের প্রবেশ যেন একজন ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে সম্পাদিত কোনো চুক্তি। এখানে আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন ক্রেতা আর মোমেন হচ্ছে বিক্রেতা ৷ এটা হচ্ছে আল্লাহর সাথে মোমেনের সম্পাদিত একটি আনুগত্যের চুক্তিনামা- এ চুক্তিনামায় স্বাক্ষর দানের পর মোমেনের কোনো জিনিসই তার আর নিজের থাকে না, না তার মাল, না তার জান । এরপর সে তার জীবনকে আল্লাহ তায়ালা ও তার পথে জেহাদ করা থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। যার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর বিধান সমুন্নত হোক এবং জীবনের সব কয়টি দিক ও বিভাগ আল্লাহর দ্বীনের অনুগত হয়ে থাক । সূরার এ শেষ অংশে মোমেন তার জীবন ও তার সম্পদকে একটি সুনির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে আর সে নির্দিষ্ট মূল্যটি হচ্ছে জান্নাত । মূল্যের দিক থেকে তার জান আর মাল তো কোনো অবস্থায়ই জান্নাতের সমান হতে পারে না। আসলে এটাকে বিনিময় মূল্য হিসেবে নির্ধারণ করা মোমেনের ওপর আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ । যেমন এরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের কাছ থেকে……… (আয়াত ১১১) যে সব লোক এ ক্রয় বিক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তারা ছিলো সমাজের কতিপয় বাছাই করা আল্লাহর নেক বান্দাহ। তাদের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিলো, যা সাধারণত অন্য মানুষের মধ্যে পাওয়া যেতো না। এর কিছু গুণ বৈশিষ্ট্য ছিলো তাদের ব্যক্তি-চরিত্রের সাথে জড়িত, যা দিয়ে তারা আল্লাহর সাথে বেচাকেনার চুক্তি করেছে। এগুলোর কিছু তাদের দৈনন্দিন অভ্যাসের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলো। আবার তাদের এমন কিছু গুণও ছিলো যার সম্পর্ক ছিলো ব্যক্তিগত সীমারেখার বাইরে- এগুলোকেও তারা নিজেদের ওপর করণীয় করে নিয়েছিলো ৷ যেমন আল্লাহর অন্য বান্দাহকে নেক কাজের আদেশ দেয়া, তাদের অন্যায় কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখা । এই গুণটি দ্বারা আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করা এবং এর দ্বারা নিজেদের জীবনে ও অন্যান্য মানুষদের জীবনে আল্লাহর সীমারেখাকে যথাযথ কায়েম রাখা । এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, (যারা আল্লাহর দরবারে) তাওবা করে (নিষ্ঠার সাথে তার) এবাদাত করে …… (আয়াত ১১২) কোরআনের বর্ণনার গতি অনুযায়ী পরবর্তী আয়াতে যারা আল্লাহর সাথে এ বেচাকেনার চুক্তি সম্পাদন করেছে, আর যারা আল্লাহর সাথে এমন কোনো ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেনি- এ উভয় দলের সম্পর্ককে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এমনকি তারা যদি একান্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও আপনজনও হয়, তাহলেও এদের মধ্যে আর পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এর কারণ হচ্ছে, এদের উভয়ের লক্ষ্য হচ্ছে ভিন্নমুখী । উদ্দেশ্য ও মনযিল আলাদা আলাদা । যারা এই বন্ধনে একবার আল্লাহর সাথে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছে, তারা হচ্ছে জান্নাতের অধিবাসী। অপরদিকে যারা এখনো এ চুক্তি সম্পাদন করেনি, তারা হচ্ছে জাহান্নামী! এখন এ দু’দলের মাঝে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় সম্পর্ক, চলাফেরা শেষ হয়ে গেলো ৷ এ থেকে এ কথাটা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, রক্ত, বংশ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক কখনো জান্নাতীদের সাথে জাহান্নামী মানুষের সম্পর্কের সেতুবন্ধ হতে পারে না- এসব বৈষয়িক সম্পর্কের মাঝে এমন কোনো যোগ্যতাই নেই যে, এদের উভয়ের মিলাতে পারে। এ পর্যায়ে আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে, নবী ও তার ঈমানদার (সাথীদের) জন্যে এটা মানায় না…………….. (আয়াত ১১৩-১১৪) মোমেন আনুগত্যের এই চুক্তি শুধু আল্লাহর সাথে করেছে। তাই তার যাবতীয় বন্ধুত্ব শুধু আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট । তার সব সম্পর্ক এরই ওপর নির্ভর করে আল্লাহর পক্ষ থেকে একথাটার ঘোষণা- ঈমানদারদের যাবতীয় সন্দেহ যাবতীয় দ্বন্দ্ব থেকে বাচিয়ে দেয়। এই স্পষ্ট ঘোষণা তাদের সব ধরনের গোমরাহী থেকেও মাহফুয করে রাখে ৷ তাদের জন্যে আল্লাহর বন্ধুত্ব ও তার সাহায্যই যথেষ্ট। একবার এই বিষয়টি অর্জিত হয়ে গেলে তাদের সত্যিকার অর্থে আর কোনো জিনিসেরই দরকার হয় না। তিনিই হচ্ছেন আসমান যমীনের সর্বময় বাদশাহ । তিনি ছাড়া আর কারো কোনো কিছুর ক্ষমতাই নেই। আল্লাহ তায়ালা বলছেন-আল্লাহ তায়ালা এমন নন যে, কোনো জাতিকে একবার হেদায়াত দানের পর…….. (আয়াত ১১৫-১১৬) আল্লাহর সাথে চুক্তি ও আনুগত্যের এই যখন আসল প্রকৃতি, তখন একবার এই চুক্তি সম্পাদন করে নেয়ার পর আল্লাহর পথে জেহাদ করা থেকে দ্বিধা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া কিংবা এ পথ থেকে পিছু হটে যাওয়া অবশ্যই একটা বিরাট রকমের ব্যাপার । তারপরও যারা এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করেছে এবং জেহাদে না গিয়ে পেছনে থেকে গেছে, সে সব মোমেনকে আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দিয়েছেন কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদের নেক নিয়তের কথা জানতেন! তাদের নিষ্ঠার কথাও তিনি জানতেন । এটা ছিলো তাদের ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ । আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই…….(আয়াত ১১৬) এখান থেকে আল্লাহ তায়ালা মদীনার অধিবাসী ও এই শহরের পার্শ্ববর্তী লোকজনদের রসূলের প্রতি আনুগত্যের দায়িত্ব বর্ণনা করছেন। কেননা তারাই ছিলো রসূলের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি । তাদের সামষ্টিক কর্মকান্ডের ওপর ইসলামের ভিত্তি ছিলো নির্ভরশীল ৷ ইসলামী আন্দোলনেরও কেন্দ্রভুমি ছিলো এটি । জেহাদের ময়দানে তাই এদের পেছনে পড়ে থাকা ছিলো খুবই খারাপ ব্যাপার । তাদের প্রতিটি কদমে এখানে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করার কথার গুরুত্বও বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহর সাথে সম্পাদিত চুক্তির এটাও ছিলো একটি বিশেষ দাবী যে, তারা এ পথে নিজেদের অর্থ ব্যয় করবে। এরশাদ হচ্ছে, মদীনার (মূল) অধিবাসী ও তাদের আশপাশের বেদুইন আরবদের জন্যে ……(আয়াত ১২০-১২১) আল্লাহর পক্ষ থেকে জেহাদের সাধারণ ঘোষণা আসলে দেশের সব মানুষের ওপর জেহাদ ফরয হয়ে যায়। সে অবস্থায় কারো জন্যেই পেছনে পড়ে থাকা বৈধ নয়। তবে এ ধরনের অবস্থা না হলে জেহাদের জন্যে প্রতিটি বস্তি ও দল থেকে একটা গ্রুপ জেহাদের ময়দানে যাবে এবং দ্বীনের জ্ঞান শিখে নিজেদের লোকদের কাছে ফিরে আসবে । আর বাকী লোকেরা সমাজের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করবে, যেমন যমীনের উন্নতি করা, ফসলের উৎপাদন করা- পরিশেষে এ উভয় দলের কাজ একীভূত হয়ে উভয়ের উদ্দেশ্যে একটি প্রান্তে এসে মিশে যাবে৷ ঘোষণা হচ্ছে, মোমেনদের কখনো (কোনো অভিযানে) সবার……..(আয়াত ১২২) পরবর্তী আয়াতে জেহাদী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। এ সময় গোটা আরব উপদ্বীপ ইসলামের সমগ্র বুনিয়াদ ও তার অগ্রগামিতা রোধ করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছিলো । অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে উপনীত হয়ে পড়েছিলো যে, সবকটি কাফেরের সাথে যুদ্ধ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো- যেন কুফরী ফেতনা নিঃশেষ হয়ে যায় এবং দ্বীন সার্বিকভাবে আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত হয়ে যায়। একইভাবে সব আহলে কেতাবদের সাথেও যুদ্ধের আদেশ দেয়া হয়েছিলো- যাতে করে তারা তোমাদের সামনে নত হয়ে তোমাদের অধীনতার করো- তথা জিযিয়া দিতে বাধ্য হয়ে যায় । এরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদার লোকেরা, কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের …………… (আয়াত ১২৩) আল্লাহর সাথে আনুগত্যের চুক্তি সম্পাদন করা, তার দাবী তার আন্দোলনের প্রকৃতির বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার পর পরবর্তী আয়াত কটিতে কোরআনের প্রতি মোনাফেকদের আচরণ ও মোমেনদের আচরণ দেখানো হয়েছে। কেননা তাতে একদিকে মোমেনদের আকীদা বিশ্বাস তাদের ব্যবহারিক জীবনের আদেশ নিষেধ নিয়েই নাযিল হয়েছিলো । অপরদিকে এ কথাও বলা হচ্ছিলো যে, মোনাফেকদের জন্যে কোনো রকম দলীল প্রমাণ, ভীতি প্রদর্শন ও বিপদ মুসীবত নাযিল এর কোনেটাই কোনো কাজে আসে না । বলা হচ্ছে, যখনি কোনো (নতুন) সূরা নাযিল হয়, তখন ………… (আয়াত ১২৪-১২৬) শেষ যে দুটো আয়াত দিয়ে সূরার শেষ আলোচনার সমাপ্তি টানা হচ্ছে, তাহলো রসূলের প্রকৃতি ও তার মেযাজ বর্ণনা । মোমেনদের জন্যে তার আগ্রহ, তার দয়া ও স্নেহসুলভ মনোভাব । সর্বশেষ আয়াতটিতে রসূলকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তিনি সর্বাবস্থায় শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করেন এবং যারা আল্লাহর হেদায়াত গ্রহণ করেনি, তাদের সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেন । বলা হয়েছে, (হে মানুষরা শোনো) তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে…..(আয়াত ১২৮-১২৯) সূরার এই শেষ অংশের বর্ণনায় সম্ভবত এ কথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, দ্বীন ইসলামে জেহাদের মর্যাদা একটি কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আকীদা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইসলাম ও কুফরীর সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী। মোমেনরা জান মাল দিয়ে রসূলের সাথে যে জান্নাত পাবার চুক্তি করেছে তার পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে যে, তারা দ্বীনকে গোটা দুনিয়ার সামনে পেশ করার জন্যে জেহাদে অবতীর্ণ হয়েছে। তারা এর বিনিময় দুনিয়ায় নয়- আখেরাতে জান্নাতের মাধ্যমে পেতে চায়। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর সীমা সরহদকে সংরক্ষণ করা। আল্লাহর বান্দাদের সামনে তার সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা করা। যে ব্যক্তি ও দল এর বিরোধীতা করে সর্বশক্তি দিয়ে তাদের মোকাবেলা করবে । একই ভাবে এই আলোচনার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এ কথাও জানা যায় যে, বর্তমান সময়ে আল্লাহর আয়াত ও শরীয়তের ব্যাখ্যাতারা কি মানসিক দৈন্যের শিকার হয়ে আছে। তারা চেষ্টা করছে ইসলামী জেহাদের এই আদেশকে একটি সংকীর্ণ সময় ও সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিতে ৷ অথচ আল্লাহ তায়ালার কেতাব ঘোষণা করছে গোমরাহী ও জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে প্রতিটি যামানায় প্রতিটি ভূখন্ডে এই জেহাদ জারী রাখতে এবং এই কেতাব এই হুকুম দিচ্ছে আশেপাশের কাফেরদের সাথে একটি স্থায়ী যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে ৷ কোনো অবস্থায়ই এই স্থায়ী জেহাদ থেকে গাফেল হওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কঠোরতা সৃষ্টি করতে হবে৷ কেননা তাদের সাথে তোমাদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তোমরা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও একত্রে বিশ্বাস করো, তারা তা বিশ্বাস করে না। তারা গায়রুল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্ব শুধু তাদের নিজেদের ওপরেই নয়, তোমাদের ওপরও চাপিয়ে দিতে চায়। তারা বান্দাদের অন্য মানুষের গোলামীতে নিমজ্জিত করে দিতে চায়। অথচ সার্বভৌমত্ত্ব সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ তায়ালার জন্যে । এই হচ্ছে তাদের একটা বুনিয়াদী যুলুম ও বাড়াবাড়ির কারণে মুসলমানদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হবে। আমি এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এবার আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যায় অবতীর্ণ হবো। * ১১১ ও ১১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ১১২ নং আয়াতে পড়ুন।

ফী জিলালিল কুরআন:-

আল্লাহর সাথে মুমিনদের ক্রয় বিক্রয়ের চুক্তি : কোরআনের এই অংশটিকে আমি কোরআন হেফয করার সময় অসংখ্য বার পড়েছি এবং শুনেছি। তারপর গত সিকি শতক ধরে অসংখ্য বার আমি এ আয়াতের তেলাওয়াত করেছি, দরস দিয়েছি। কিন্তু তাফসীর ‘ফী যিলালিল কোরআনে’ যখন আমি এ আয়াত কয়টিকে দেখলাম, তখন মনে হলো আমি এ থেকে এখন এমন কিছু জিনিস অর্জন করছি, যা ইতিপূর্বেকার অসংখ্য তেলাওয়াত ও দরসে হাসিল করতে পারিনি। মূলত, এ হচ্ছে মহান কয়েকটি আয়াতের সমষ্টি- যাতে মোমেনের সাথে আল্লাহ তায়ালার সম্পর্ক পরিস্ফূট হয়ে ওঠে । মোমেন আল্লাহর সাথে আনুগত্যের যে চুক্তি সম্পাদন করেছে, তার প্রকৃতি বর্ণনা করে। অতএব একমাত্র সেই হচ্ছে সঠিক অর্থে মোমেন, যে ব্যক্তি এ সম্পাদিত চুক্তি মেনে চলে এবং তার জীবনে এই চুক্তির বাস্তব লক্ষণ ফুটে ওঠে । অন্যথায় এটি হচ্ছে নিছক একটি দাবী মাত্র- যার সত্যতা অবশ্যই প্রমাণের দাবী রাখে । এই আনুগত্যের দুক্তি- যাকে আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে পারস্পরিক বেচাকেনার চুক্তি নাম দিয়েছেন, তার মূল কথা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের জান ও মাল তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন । এখন থেকে তাদের কোনো জিনিসই আর তাদের নিজের রইলো না। তাদের কর্তব্য হচ্ছে এর কোনো কিছুই সে নিজের জন্যে বাচিয়ে রাখবে না। সব কিছুকেই আল্লাহর রাহে ব্যয় করে দেবে । এগুলোর কোনো কিছুর ওপরই তার আর নিজস্ব মালিকানা কিংবা অধিকার নেই । বেচাকেনার চুক্তি যেহেতু সম্পাদিত হয়ে গেছে- ক্রেতা যেভাবেই চাইবে, যখনই চাইবে তার কেনা মাল সে ব্যবহার করবে, এবং এই কেনা মালের ওপর সে যখন চাইবে তখন তাই কর্তব্য বলে আরোপ করবে। আবার সীমাবদ্ধ করতে চাইলেও তা সে করবে। আর বিক্রেতা- যে তার জিনিস বিক্রি করে দিয়েছে তাতে তার কোনো মালিকানা কিংবা অধিকার থাকবে না। এখন সেই বিক্রীত বস্তু ক্রেতার সম্পদে পরিণত হয়ে গেছে- বিক্রেতার অধিকার নেই যে, সে তার এই জান ও মালকে তার নিজস্ব মরযী মোতাবেক খরচ করবে, ক্রেতার মরযী মোতাবেক যখন তখন তাকে তার সামনে হাযির করতে হবে। তার এখতিয়ার বলতে শুধু এটুকু যে, ক্রেতার ইচ্ছানুযায়ী বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে তার মরযী মোতাবেক কাজে লাগানোর জন্যে তার আনুগত্য ও ফরমাবরদারী করবে । এই বিক্রয়ের বিনিময়ে সে অবশ্যই জান্নাত পাবে, যদি চুক্তি মেনে চলে ৷ সে জান্নাত পাবার পথ হচ্ছে আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও জেহাদে আত্মনিয়োগ করা, এর পরিণাম হয় শাহাদাত, না হয় বিজয় লাভ। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের বিনিময়ে মোমেনদের কাছ থেকে তাদের জানমালকে খরিদ করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করে। এই জেহাদে তারা অন্যদের হত্যা করে, আবার কখনো নিজেরাও নিহত হয়। মোমেন হচ্ছে সে ব্যক্তি- যে এই কেনাবেচার চুক্তি সম্পাদন করে এবং এই চুক্তি মোতাবেক চলে। সর্বোপরি আল্লাহর নির্ধারিত মূল্যে সন্তুষ্ট হয় । মোমেন সে ব্যক্তি যে জানে যে, ক্রেতা হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা আর সে হচ্ছে বিক্রেতা । জানমাল তো আল্লাহরই দেয়া, তিনিই এর একমাত্র মালিক । এটা মোমেনদের জন্যে আল্লাহর একান্ত মেহেরবানী যে, তবু তিনি এর একটা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন । অথচ তিনি মূল্য নির্ধারণ নাও করতে পারতেন । কারণ তিনিই আমাদের জানমালের চূড়ান্ত মালিক । এটা তার বিশেষ রহমত যে, তিনি মোমেনকে এর বিক্রেতা বলেছেন এবং এই বিক্রয় মুক্তি পালনকারী সাব্যস্ত করেছেন। এটাও তার বিশেষ দয়া যে, তিনি এর মূল্য হিসেবে নিজের ওয়াদা অংগীকারের কথা ঘোষণা করেছেন এবং এই চুক্তি পালন করাকে মানবতার চূড়ান্ত মাপকাঠি হিসেবে স্থির করেছেন। অপরদিকে এই চুক্তির লংঘনকে পশুত্বের মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন৷ তাও কোন স্তরের পশু। একান্ত নিম্নমানের পশু। আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট স্তরের জানোয়োর হচ্ছে- ‘যারা কাফের, যারা ঈমান আনে না। যাদের সাথে তুমি চুক্তি করেছো-অথচ তারা বারবার সে চুক্তির বরখেলাপ করে ।’ সর্বোপরি এরা আল্লাহকেও ভয় করে না। আল্লাহর দরবারে পুরস্কার কিংবা শান্তি সম্পূর্ণভাবে এই চুক্তি মেনে চলা কিংবা তা ভংগ করার ওপর নির্ভর করে। এই ঈমানের আনুগত্যের বন্ধন প্রতিটি মোমেনের ঘাড়ের ওপরই রয়েছে। সে এ বন্ধনের দায়িত্ব পালনের অবশ্যই ক্ষমতা রাখে । যতোক্ষণ পর্যন্ত তার ঘাড় থেকে ঈমান খসে পড়বে না, ততোক্ষণ পর্যন্ত তার ঘাড়ে এই আনুগত্যের বন্ধনও অব্যাহত থাকবে । এ কথা কয়টি যখন আমি এখানে লিখতে যাচ্ছি, তখন আমার নিজের প্রচন্ড ভয় হচ্ছে আল্লাহর এই ফরমান কতো মহান কতো ভীতিপ্রদ। আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের কাছ থেকে তাদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন । তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করে- জেহাদের ময়দানে অন্যদের যেমন তারা হত্যা করে, নিজেরাও নিহত হয়। হে মালিক! একান্তভাবে তোমারই সাহায্য চাই। কেননা এটা বড়ো কঠিন প্রতিশ্রুতি । আজ দুনিয়ার আনাচে কানাচে বসবাসকারী অসংখ্য মানুষ যারা নিজেদের মুসলমান মনে করে- এদের অবস্থা হচ্ছে, এরা সবাই ঘরের কোণে নিভৃতে বসে আছে। আল্লাহর সার্বভৌমত্তবকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার জন্যে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। মানুষরূপী যে ডাকাত ও বিদ্রোহীরা মানুষের জীবন থেকে আল্লাহর মালিকানার বন্ধন ছিনিয়ে নিয়েছে এরা তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলে না- এদের বিরুদ্ধে জেহাদ করে না, জেহাদের ময়দানে কাউকে হত্যা করে না- নিজেরাও নিহত হয় না। রসূলে করীমের মোবারক যুগে এই আয়াত ও এর বাক্যগুলো শানিত তরবারি ন্যায় মানুষের হৃদয়ে প্রচন্ড আঘাত হানতো । তারা সাথে সাথেই তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ মোমেন হয়ে যেতো । তাদের কানের কাছে এসব আয়াত কিছু শব্দ বিশিষ্ট কথা হিসেবে বিবেচিত হতো না কিংবা তাদের বিবেকের দুয়ারে এগুলো কিছু অনুভূতি হিসেবেই কাজ করতো না বরং তারা আল্লাহর কালামের এই বাক্যগুলোকে নিজেরা হযম করতো এবং নিজেদের জীবনে তা অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর করতে গিয়ে জেহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তো । তাদের জীবনের প্রতিটি কর্মতৎপরতায় এগুলো ছিলো কার্যকর । শুধু চিন্তা গবেষণার মাঝেই এরা সীমাবদ্ধ থাকতো না। এই বাক্য দ্বারা দ্বিতীয় আকাবার বায়য়াতের সময় আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা এই অর্থই বুঝেছিলেন। মোহাম্মদ বিন কাব আল কুরযী-এর বর্ণনা মতে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রসূলকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আপনার নিজের জন্যে ও আপনার মালিকের পক্ষে যে শর্তই আরোপ করতে চান- করতে পারেন । আল্লাহর নবী বললেন, আমি আমার মালিকের পক্ষ থেকে এই শর্তই আরোপ করতে চাই যে, তোমরা শুধু তারই দাসত্ব করবে, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না এবং আমি আমার পক্ষ থেকে এই শর্তই আরোপ করবো যে, তোমরা যেমনি করে নিজেদের জান মালের হেফাযত করো, তেমনিভাবে আমারও প্রতিরক্ষা করবে। আবদুল্লাহ বললেন, আমরা যদি এ শর্ত মেনে চলি, তাহলে আমরা কি পাবো । নবী বললেন, জান্নাত ৷ আবদুল্লাহ বললেন, এটা এক উত্তম ব্যবসা ৷ আমরা নিজেরাও এটা প্রত্যাখ্যান করবো না এবং আপনার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান না করার আবেদন জানাবো ৷ অতপর এ লোকেরা এই বেচাকেনার চুক্তিকে একটি পাকা পূর্ণাংগ ও লাভজনক ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এর থেকে পেছনে হটে যাওয়া । না এতে কোনো রকমের অধিকার খাটানোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে। জান্নাত এমন কোনো মূল্য নয় যে, যার শুধু ওয়াদাই করা হয়েছে। মূলত এটা ছিলো তাদের জন্যে নিশ্চিত পাওনা ৷ এটা কি আল্লাহর ওয়াদা ছিলো না- এখানে কি ক্রেতা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নন? দাম-দন্তুর কি তিনি ঠিক করে দেননি। এই প্রতিশ্রুতি তিনটি কেতাবের মাধ্যমেও পেশ করা হয়েছে। এটা তার পাকা ওয়াদা- যার প্রতিপালন তিনি অবশ্যই করবেন । একই ওয়াদা করা হয়েছে তাওরাতে, ইনজীলে ও কোরআনে ৷ আল্লাহর চাইতে কে বেশী ওয়াদা পালনকারী হতে পারে? হা আসলেই আল্লাহর চাইতে কে বেশী ওয়াদার পাবন্দ হতে পারে? জেহাদ ফী সাবীলিল্লাহ-র এ চুক্তি প্রতিটি মোমেনের ঘাড়েই একটি অনবদ্য বন্ধন হিসেবে হামেশাই কায়েম আছে। যেদিন থেকে মানব জাতির জন্যে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে এ দ্বীন তাদের দেয়া হয়েছে, যেদিন থেকে আল্লাহর নবী এ দুনিয়ায় এসেছেন, সেদিন থেকে এটা হচ্ছে আল্লাহর এক স্থায়ী সুন্নাত, একে বাদ দিয়ে এই যমীনে মানুষের জীবনের স্থায়িত্বকে চিন্তাই করা যায় না এবং তাকে বাদ দিলে জীবনের কখনো সংশোধনের সম্ভাবনা এগুতেই পারে না। ‘যদি আল্লাহ তায়ালা একদল লোককে আরেক দল লোক দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে না দিতেন, তাহলে এ যমীন সত্যিই বিপর্যয়ে ভরে উঠতো ।’ “যদি আল্লাহ তায়ালা একদল লোক দিয়ে আরেক দল লোককে ধ্বংস না করে দিতেন, তাহলে এ যমীনের গীর্জা, ধর্মীয় স্থান ও মসজিদসমূহ বিধ্বংস হয়ে যেতো- যেখানে আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করা হয় ।” ‘হক’ তার একান্ত দাবী হচ্ছে তা স্বীয় পথে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যাবে । আবার এ কথাও অপরিহার্য যে, ‘বাতিল’ ‘হকের’ পথ রুখে দাড়াবে এবং তার কাছ থেকে তার পথকে ছিনিয়ে নেবে । মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর দাসত্বের দিকে নিয়ে যাবার জন্যে দ্বীনকে এগিয়ে যেতেই হবে ৷ যাতে করে সে আল্লাহর গোলামীকে পূর্ণ মাত্রায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে । অপরদিকে “তাগুত ” শক্তির ক্ষেত্রে এটা অপরিহার্য যে তাগুত ‘হকের’ পথে বাধা হয়ে দাড়াবে এবং হকের কাছ থেকে তার পথকে ছিনিয়ে নিতে চাইবে । পক্ষান্তরে আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর এ যমীনে গোটা মানব সন্তানকে গোলামী থেকে মুক্ত করার জন্যে একান্ত আযাদীর সাথে এগিয়ে যেতে হবে। ‘হক’ যা, তার দায়িত্বই হচ্ছে তা এভাবে আপন গতিতে এগিয়ে যাবে এবং এ ব্যাপারে কখনো কোনো অবহেলা দেখাবে না। যতোক্ষণ পর্যন্ত যমীনে বাতিলের রাস্তা খোলা থাকবে, যতোক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর যমীনে কুফরী ব্যবস্থা চালু থাকবে যতোক্ষণ পর্যন্ত এ যমীনে বাতিল নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখবে- সর্বোপরি যতোক্ষণ পর্যন্ত এ যমীনে মানবীয় মান-মর্যাদাকে অমানবিকতায় রূপান্তরের জন্যে মানুষের ওপর মানুষের এ গোলামী অব্যাহত থাকবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত ‘জেহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’র এ কাজও অব্যাহত গতিতে চলতে থাকবে । একারণেই প্রতিটি মোমেনের ঘাড়ে এই বায়াতের যে চুক্তি বন্ধন রয়েছে তা তার কাছ থেকে পূরণ করার দাবী রাখে- নতুবা তার জন্যে ঈমানের দাবী অসার । প্রিয় নবীর হাদীসের ভাষায়, ‘যে ব্যক্তি জেহাদ করেনি, জেহাদের ইচ্ছাও মনে মনে পোষণ করেনি, সে যেন মোনাফেকীর কিছু অংশ নিয়েই মৃত্যুবরণ করলো ।’ (আহমদ, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ) । “অতএব তোমরা সন্তুষ্ট হয়ে যাও নিজেদের এ বেচাকেনার চুক্তিতে- যেটা তোমরা আল্লাহর সাথে সম্পাদন করেছো মূলত এ হচ্ছে এক মহান সাফল্য ।” তোমরা একারণে সন্তুষ্ট হয়ে যাও যে, তোমরা একান্ত নিষ্ঠার সাথে জানমাল আল্লাহর সমীপে পেশ করেছে৷ এবং এর বিনিময়ে তার কাছ থেকে তার প্রতিশ্রুতি মতে জান্নাত গ্রহণ করেছো । কি তোমরা হারিয়েছো? যে মোমেন নিজের জানমাল আল্লাহর সামনে হাযির করেছে, সে কি আসলে কিছু হারিয়েছে? আল্লাহর কসম, সে কিছুই হারায়নি! জান! তাকে তো একদিন শেষ হতেই হবে, আর মাল, তাকেও তো একদিন নিঃশেষ হতে হবে। এ দুটোকে তুমি আল্লাহর পথে খরচ করো কিংবা আল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যয় করো- উভয়টাই একদিন শেষ হয়ে যাবে । অপরদিকে জান্নাত এমন একটি অর্জনের নাম, যার সাথে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। তার কোনো বিনিময় বিকল্প নেই । অপরদিকে যে জিনিসের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত দিলেন তাতো শেষ হয়ে যাবেই, যেভাবেই খরচ করা হোক না কেন। মানুষ যখন আল্লাহর জন্যই বেঁচে থাকতে চায়, তখন তার মর্যাদা অনেক ওপরে উঠে যায়। যখন সে আল্লাহর কালেমাকে সমুননত করার জনোযে- দ্বীনের প্রতিষ্ঠার জন্যে, সর্বোপরি মানুষের জন্যে একান্ত অবমাননাকর কাজ মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করার জন্যে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য করবে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকেও তাকে নানারকম সাহায্য করা হবে। আবার যখন সে শহীদ হবে, তখন শহীদ হবে একান্ত ভাবে দ্বীনের জন্যে- যাতে করে সে একদিন এ কথার সাক্ষ্য দিতে পারে যে, তার জন্যে তার দ্বীন ছিলো তার জীবনের চাইতে বেশী প্রিয় এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এ অনুভুতি তার মধ্যে সদা জাগরূক থাকবে যে, সে যমীনের বহুবিধ বিধিবন্ধন থেকে অধিক অধিক শক্তিশালী- যমীনের ওপর সে কোনো বোঝা নয়- বরং তার মর্যাদা এখানে আরো অনেক ওপরে ৷ ঈমানের মাঝে দিয়ে যাবতীয় বিপদ-মুসীবতে তাকে সাহায্য করা হয়, আকীদা বিশ্বাস জীবনের ওপর প্রাধান্য লাভ করে। মূলত, কোনো রকম অর্জন থাকলে তাতো এই ৷ এমন এক মহান অর্জন, যা মানুষের মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা করে । আর এটা তখনই অর্জিত হতে পারে, যখন মানবতাকে ‘প্রয়োজনের’ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে দেয়া যাবে, ঈমানী পরীক্ষা নিরীক্ষা সে কামিয়াব হবে। আকীদা বিশ্বাস জীবনের ওপর সে প্রাধান্য বিস্তার করবে। যখন এসব কিছুর ওপর জান্নাতকে যোগ করা হয়, তখন তা এমন এক ব্যবসায়ে পরিণত হয় যাকে সত্যিই সুসংবাদ হিসেবেই গণ্য করতে হবে এবং সুসংবাদের দিকেই তার দাওয়াত দেয়া হয়। এটা হচ্ছে এমন এক মহা সাফল্য- যাতে কোনো সন্দেহ নেই- নেই কোনো রকমের বিতর্ক ৷ এরশাদ হচ্ছে, “অতপর তোমরা এমন এক বেচাকেনার সুসংবাদ গ্রহণ করো, যা তোমরা আল্লাহর সাথে সম্পাদন করেছো- জেনে রেখো, এ হচ্ছে এক মহা সাফল্য ।” চলুন, কিছুক্ষণের জন্যে আমরা আল্লাহ তায়ালার এ আয়াতের সামনে একটু দাড়াই । এই হচ্ছে আল্লাহর দায়িত্বে একটি সত্য ওয়াদা- এটা করা হয়েছে তাওরাতে, ইনজীলে ও কোরআনে ৷ কোরআনে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতির কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এতে কোনো রকম সন্দেহ নেই ৷ কোরআনের এই ওয়াদা হচ্ছে অতি পরিচিত একটি ঘটনা । ইসলামী শিক্ষা মোতাবেক জেহাদের এই প্রতিফল একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এটা সময় ও কালের সীমাবদ্ধতার বাইরের বিষয়। মানুষের প্রতিটি দেশে প্রতিটি যুগে নিজেদের বাস্তব জীবনের মধ্যে সর্ব সময়ই-এর প্রয়োজন থাকে। এর কারণ হচ্ছে জাহেলিয়াত মূলত নিছক একটি মতাদর্শই নয় যে, তার মোকাবেলা আরেকটি মতাদর্শ দিয়ে করা যাবে, বরং তা হচ্ছে একটি বস্তুবাদী আন্দোলন- যার সম্পর্ক হচ্ছে এই বস্তুতান্ত্রিক জীবনের সাথে ৷ এই জাহেলিয়াত এই বস্তুবাদী শক্তি নিয়েই আবির্ভূত হয় এবং একে নিয়েই সমাজে টিকে থাকার চেষ্টা করে । আর এভাবে যখন সে আল্লাহর দ্বীনের মোকাবেলা করে তখন তাকেও বস্তুবাদী শক্তি ও উপকরণ দিয়েই খতম করতে উদ্যত হয়। সে ইসলামের রাস্তা রুখে দাড়ায় । মানুষকে ইসলামের দাওয়াত শুনতে দেয় না। মানুষকে ইসলামের পাশে আসা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কেননা ইসলামই হচ্ছে এই বস্তুবাদী মতাদর্শের পথে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা । ইসলাম বস্তুবাদিতার মূলকথা মানুষকে আরেক মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে চায় এবস্তুবাদি এ কারণেই ইসলামকে টিকে থাকতে হলে তাকে জাহেলিয়াতের সাথে মোকাবেলা করতে হবে এবং তাকে সমাজ থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করতে হবে । নতুবা ইসলামের আসল শিক্ষা কখনো অর্জিত হবে না। ইসলাম এক আল্লাহর এবাদাত ও তার গোলামীর কথা বলে । অপরদিকে জাহেলিয়াত অসংখ্য মাবুদের আনুগত্য করে। যতোক্ষণ পর্যন্ত দেশ, রাষ্ট্র থেকে জাহেলিয়াতকে নিশ্চিহ্ন না করা হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত ইসলামের মূল উদ্দেশ্যই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । অতএব কোরআনের দৃষ্টিতে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী । আর এ পথে যারা বিপদ মুসীবত বরদাস্ত করছে, তাদের জন্যে বহু ধরনের সফলতার ওয়াদা করা হয়েছে । এবার তাওরাত ও ইনজীল আল্লাহর এই ওয়াদার প্রসংগ । আজ যে তাওরাত, ইনজীল ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের হাতে আছে, সে সম্পর্কে এ কথা বলা মুশকিল যে, এগুলোই সে মৌলিক কেতাব যা নবীদের ওপর নাযিল হয়েছিলো । স্বয়ং ইয়াহুদী খৃষ্টানরাও এ কথা স্বীকার করে যে, এই কেতাবগুলোর মূল পান্ডুলিপি তাদের কাছে নেই৷ বর্তমানে তাদের হাতে যা আছে, তা আসল কেতাব নাযিলের অনেক পরে লেখা হয়েছে- মূল কেতাব তখন সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তাই আজ তাদের হাতে তাওরাত ইনজীলের আকারে যা কিছু আছে তার মধ্যে আল্লাহর শিক্ষার সামান্য কিছু অংশই মাত্র মওজুদ রয়েছে । অপর কথায় আল্লাহর মূল কেতাবের যা কিছু তখন তাদের মনে ছিলো তাই তারা একজন আরেকজনের কাছে শুনে লিখে রেখেছে। এই কেতাবসমূহের মুখস্থ করারও বাকায়দা কোনো নিয়ম নীতি ছিলো না। যে ভাষায় এই কেতাব নাযিল হয়েছিলো তাও আজ বহুলাংশে বিলীন হয়ে গেছে। এতো কিছু সত্ত্বেও প্রাচীন কেতাবসমূহে জেহাদের দিকে ইংগিত দিয়ে কথাবার্তা মওজুদ আছে । ইয়াহুদীদের বলা হয়েছে তাদের মূর্তিপূজক দুশমনদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে- যাতে করে আল্লাহর সত্যিকারের দ্বীনকে তারা হেফাযত করতে পারে। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও মূল পান্ডুলিপিতে বিকৃতির কারণে ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ ও ‘তাওহীদের’ চেহারাই সেখানে পালটে গেছে। অপরদিকে ইনজীল যা আজ তাদের হাতে আছে, তাতে জেহাদ সম্পর্কিত কোনো ইশারা ইংগীতও নেই ৷ বর্তমানের ইনজীলসমূহ আসলেই এক একটা অর্থহীন কেতাব- যার কোনো বুনিয়াদই নেই, এদের মূল লেখকের নাম-পাত্তাও জানা নেই। অনেকাংশেই এগুলো হচ্ছে মূল কেতাবের কিছু কিছু অনুবাদ- যার মধ্যেও আবার কয়েক বছর পরপর পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়। বর্তমান খৃষ্টবাদ হচ্ছে এ ইনজীল সমূহেরই উৎপাদন । স্বয়ং খৃষ্টান গবেষকরাও স্বীকার করেন যে, এই ইনজীলে তা নয়- যা ঈসা মসীহর ওপর নাযিল করা হয়েছিলো (ইনজীল ছিলো একটি কেতাব আর এগুলোর সংখ্যা হচ্ছে ৪ যাতে আবার রয়েছে পারস্পরিক মতপার্থক্য । পঞ্চম ইনজীল যা সেন্ট বারনাবাস লিখেছিলেন, তা তুলনামূলকভাবে কিছু সততার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যাকে খৃষ্টান ধর্মযাজকরা বিনা কারণে প্রত্যাখ্যান করে রেখেছে) ৷ তাছাড়া আল্লাহর নিজস্ব সাক্ষ্য প্রমাণেও এটা জানা যায় যে, এই কেতাবে তারা বহুবিধ বিকৃতি ঘটিয়ে রেখেছে। আল্লাহ তায়ালা তার পবিত্র গ্রন্থ কোরআনে বলছেন, যারা আল্লাহর পথে জেহাদ করছে, যারা এই জেহাদ করতে গিয়ে অন্যদের হত্যা করছে, নিজেরা নিহত হচ্ছে, তাদের জন্যে জান্নাতের এই ওয়াদা রয়েছে। এর প্রমাণ রয়েছে তাওরাতে, ইনজীলে ও কোরআনে ৷ অতএব তাই হচ্ছে অকাট্য ও চুড়ান্ত কথা । বর্তমানে এই ইহুদী খৃষ্টানদের হাতে যে কেতাব আছে, তাতে এই জেহাদের বিষয় উল্লেখ না থাকাই এটা প্রমাণ করে যে, এগুলো আসলেই কোনো আসল গ্রন্থ নয়। আসল গ্রন্থকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বহু কিছুকে পরে তারা জুড়ে দিয়েছে। যেদিন থেকে দুনিয়ায় নবী আসা শুরু হয়েছে, যেদিন থেকে আল্লাহর দ্বীনের প্রবর্তন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই জেহাদের এই বিধান মোমেনদের ঘাড়ে একটা অপরিহার্য করণীয় হিসেবে অব্যাহত ছিলো।   সত্যিকার মুমিনের পরিচয়  :  কিন্তু ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ‘ শুধু ময়দানের সম্মুখ সমরের নামই নয়, তা হচ্ছে কতিপয় ঈমানী গুণাবলী, নৈতিক কর্মকান্ড ও ব্যবহারিক জীবনের কিছু গুণ বৈশিষ্ট্য । যারা আল্লাহর সাথে আনুগত্যের চুক্তি সম্পাদন করেছে, তারাই হচ্ছে মোমেন। যারা নিজেদের মাঝে ঈমানের এ গুণগুলোকে কার্যকর করেছে, তাদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে — তাওবাকারী, এবাদাতগুযার আল্লাহর প্রশংসাকারী, মোজাহেদ, রুকু আদায়কারী, সেজদা পালনকারী, নেকীর আদেশদাতা, অন্যায় থেকে প্রতিরোধকারী, আল্লাহর সীমা সমূহের সংরক্ষণকারী । তাওবাকারীরা হচ্ছে সেসব লোক যারা বিগত গুনাহসমূহ থেকে ফিরে আসে ক্ষমা চাইতে চাইতে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে । তাওবার মানে হচ্ছে অতীতের ওপর লজ্জিত হওয়া এবং ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা, সব রকমের না-ফরমানী থেকে ফিরে আসা । ভালো কাজ করা, খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা, যাতে করে এটা বুঝা যায় যে, আসলেই এ ব্যক্তিটি তাওবা করেছে। তাওবার অর্থ পাক পবিত্রতা, পবিত্র থাকা ও ভালোর দিকে মনোনিবেশ করা । এবাদাতকারী ব্যক্তিরা হচ্ছে যারা এক আল্লাহর দিকে গোলামী ও গোলামীসুলভ আচরণ নিয়ে মনোনিবেশ করে, তার পূর্ণাংগ মালিকানা স্বীকার করে। এই বিশ্বাস তাদের অন্তরে এমনভাবে জাগরূক থাকবে যেন সমস্ত অংগ প্রত্যংগ এর সাক্ষী দিচ্ছে। তাদের প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ ও প্রতিটি আনুগত্যে তা প্রমাণ দেবে। অতপর তাদের এই ঘোষণায় স্বীকৃতি দিতে হবে যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তাঁদের মাবুদ, তাদের মালিক । বাস্তব জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করতে না পারলে এই দাবীর কোনোই অর্থ নেই । আল্লাহর প্রশংসাকারী তারা- যাদের জন্য আল্লাহর অসীম নোয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করতে গিয়ে বিনায়বনত হয়। ভালো খারাপ উভয় অবস্থায়ই তাদের মুখ আল্লাহর প্রশংসায় থাকে পঞ্চমুখ, ভালো অবস্থায় আল্লাহর দানের শোকর আদায় করে, খারাপ অবস্থায় ধৈর্যধারণ করে। প্রশংসা শুধু ভালো সময়ের জন্যেই নয়, খারাপ সময় কিংবা বিপদ মুসীবত পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় ধৈর্যধারণ করে। মোমেন এ কথা ভালো করেই জানে যে, বিপদ মুসীবত, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আল্লাহর তরফ থেকেই আসে । এতে কোনো না কোনো মংগল অবশ্যই নিহিত আছে। হতে পারে আমি তা জানি না কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো জানেন । অতপর যে গুণটি (সায়েহুনা) বলা হয়েছে তার সম্পর্কে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে৷ কেউ বলেন, এর মানে হচ্ছে মোহাযের, কেউ বলেন মোজাহেদ, আবার কেউ বলেন- যারা দ্বীনী ইলমের সন্ধানে বের হয় তাদেরকে এ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কেউ আবার বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে রোযাদার। আমি মনে করি এর অর্থ হচ্ছে সে সব লোক, যারা আল্লাহর সৃষ্টি বৈচিত্র্য নিয়ে চিন্তা গবেষণা করে। যেমন কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “অবশ্যই এই আসমানসমূহ যমীনের সৃষ্টির মাঝে রাত ও দিনের বিবর্তনের সে সব জ্ঞানবান মানুষের জন্যে নিদর্শন রয়েছে- যারা দাড়িয়ে বসে পাশে শুয়ে আল্লাহকে স্বরণ করে, তারা আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি নিয়েও চিন্তা গবেষণা করে (এবং বলে) হে আমাদের মালিক, তুমি এর কোনোটাই অযথা সৃষ্টি করোনি ।” অতএব আল্লাহর এবাদাত, আল্লাহর প্রশংসা- আল্লাহর কাছে তাওবা করার বর্ণনার সাথে এই অর্থই এখানে বেশী মানানসই-কেননা এর পরই মোমেনদের আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের সুযোগ হয়। তার সৃষ্টির মাঝে সে তার মহান সৃষ্টি কুশল অনুভব করতে পারে, সে সত্য সম্পর্কেও সজাগ হতে পারে যার ওপর গোটা সৃষ্টি দাড়িয়ে আছে, এর অর্থ নিছক চিন্তা দর্শনের অনুভূতিই নয়, বরং এ হচ্ছে মানুষ গোটা জীবনভর আল্লাহর এই বিশাল সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবে এবং এরই বাস্তব কাঠামোর ওপর নিজের জীবনের ভিত্তিমূল দাড় করিয়ে নেবে। রুকুকারী সেজদা প্রদানকারী দ্বারা ওদের বুঝানো হয়েছে, যারা নামায কায়েম করে এবং নামাযের ওপর নিজেরাও কায়েম হয়ে যায়। অর্থাৎ এ যেন তাদের একটি প্রমাণিত গুণ, যেন রুকু-সেজদা তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য- যা তাদের অন্য মানুষদের থেকে আলাদা করে রেখেছে । ভালো কাজের আদেশ প্রদানকারী ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার লোক দ্বারা বুঝানো হয়েছে, যখন ইসলামী সমাজ আল্লাহর শরীয়তের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন এই সমাজ ও সমাজের লোকেরা শুধু আল্লাহরই ফরমা’বরদার হবে, অন্য কোনো তৃতীয় শক্তির মুখাপেক্ষী হবে না তখন। ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা এ সমাজের অংগে পরিণত হয়ে যাবে। তখন মোমেনদের কাজ হবে সমাজের অভ্যন্তরীণ ত্রুটি, বিকৃতি ও বিচ্যুতির সাথে সাথেই নিরাময় করতে থাকবে । কিন্তু যে সময় যমীনে কোনো ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে না অপর কথায় দুনিয়ার বুকে এমন কোনো জনসমন্টি কিংবা সমাজ প্রতিষ্ঠিত থাকবে না যাকে ইসলামী বলা যায়, যেখানে আল্লাহ্‌র শরীয়তের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব মওজুদ থাকবে৷ তেমন অবস্থায় ভালো কাজের আদেশ দেয়ার সব চাইতে বড়ো লক্ষ্য হবে সবচাইতে উৎকৃষ্ট কাজের প্রতি লক্ষ্য দেয়া অর্থাৎ প্রথমত আল্লাহর একক সার্বভৌমত্ব যমীনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারপর তার ওপর ভিত্তি করে একটি সঠিক ইসলামী সমাজ গড়ে তুলতে হবে। অপরদিকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার বিষয়টিকে সবচাইতে নিকৃষ্ট মন্দ কাজ- অর্থাৎ আল্লাহ বিদ্রোহী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। আল্লাহর শরীয়ত ছাড়া অন্য কোনো কিছুর আইন ও ফায়সালা মেনে মিয়ে মানুষদের অন্য কারো গোলামী থেকে বাচিয়ে রাখতে হবে। যারা মোহাম্মদ (স.)-এর ওপর ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে, জেহাদ করেছে এমন একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিস্থাপন করেছে। যেখানে আল্লাহর শরীয়ত ছিলো একমাত্র আইন । এমন একটি মুসলমান জনসমষ্টি স্থাপন করেছিলো, যেখানে আল্লাহর শরীয়তেরই বিধান চলতো । অতপর যখন একদিন তাদের এই উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেলো, তখন তারা সে সব শাখা-প্রশাখার ব্যাপারে- যার সম্পর্ক আনুগত্য ও গুনাহের কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো, ভালো কাজের আদেশ দিতো এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতো । যতোক্ষণ পর্যন্ত এই মৌলিক বিষয়টি, যার নাম আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা- কার্যকর না হয়েছে তারা শাখা-প্রশাখার দিকে মনোনিবেশ করেননি। তাছাড়া এটাও একান্ত জরুরী যে, ভালো কাজের আদেশ দেয়া ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার সত্যিকার অর্থ অবস্থার বাস্তবতা থেকে জানতে হবে। অতএব প্রথম দিকে শাখা প্রশাখার “ভালো কাজের আদেশ” দেয়া যাবে না। আবার শাখা প্রশাখার “মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা”ও যাবে না। যতোক্ষণ পর্যন্ত সমাজে ও রাষ্ট্রে আসল ‘ভালো কাজটির’ প্রতিষ্ঠা না হবে এবং আসল ‘মন্দ কাজ’টি নিশ্চিহ্ন না হবে। আর সে আসল কাজ হচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও আল্লাহ, বিরোধী শক্তির নির্মূল সাধন করা- এই আসল “ভালো মন্দের” প্রতিষ্ঠা ও নির্মূল না হলে ছোটখাটো ‘ভালো কাজ’ যেমন কোনো কাজে আসে না, তেমনি ছোটখাটো মন্দ কাজও সমাজকে বিধ্বংস করে দেয় না। মুসলমানদের প্রথম জনসমষ্টি তথা সমাজ গঠনের সময় এ নিয়মই সেখানে প্রচলিত ছিলো। আল্লাহর সীমারেখা তথা আল্লাহর আদেশ নিষেধসমূহের ওপর নিজেরাও আমল করতো, অন্যদের ওপরও এ বিধানসমূহ কার্যকর করতো যারা আল্লাহর এ সীমারেখাকে বিনষ্ট করতো, লংঘন করতো, তারা তাদেরও প্রতিরোধ করতো । কিন্তু আল্লাহর ‘এসব সীমারেখা’ ও ‘আমর বিল মারূফ ও নিহী আনিল মুনকার’ শুধু এমন একটি সমাজেই কায়েম করা যেতে পারে যেখানকার মানুষ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে একটি মুসলিম জনসমষ্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় । অতপর সে সমাজেই ‘আল্লাহর দণ্ডবিধি’ গুলো কায়েম করা যেতে পারে, যে সমাজে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর মালিকানা ও আল্লাহর আইন ও আল্লাহর শরীয়ত ছাড়া অন্যকিছুই চলতে পারে না। যে সমাজ আল্লাহ ও তার বিরোধী সব শক্তিকে নির্মূল করে তার ভিত্তিমূল আসল তাগুতকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সে সমাজেই এই ‘হুদুদুল্লাহ’ তথা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম হতে পারে । মুসলমানদের আদেশ দেয়া হয়েছে আগে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে একটা সমাজের ভিত্তি স্থাপন করার। তা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেই সেখানে আল্লাহর অন্যান্য আদেশ-নিষেধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এই হচ্ছে সেই মোমেনের দল যাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা আনুগত্যের চুক্তি সম্পাদন করেছেন। এই হচ্ছে তাদের কিছু স্বতন্ত্র্য গুণাবলী- খাঁটি তাওবা এটা বান্দাকে আল্লাহর সমীপে নিয়ে আসে, তাকে গুনাহ থেকে রক্ষা করে এবং নেক কাজের দিকে উৎসাহ দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এবাদাত- যা তাকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করে, যার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে স্বয়ং আল্লাহর সন্তুষ্টি ৷ ভালো খারাপ উভয় অবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা করে । আর এটা হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা, তার অনুগ্রহ ও দয়ার ওপর একান্তভাবে ভরসা করারই অপরিহার্য পরিণাম। আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের মাধ্যমে গোটা সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা পবেষণা করা, এমন সব নিদর্শন যা আল্লাহর সৃষ্টি রহস্যের সত্যতা সম্পর্কে প্রমাণ পেশ করে। নিজের জীবনে এবং অন্য মানুষদের জীবনে ভালো কাজের আদেশ দেয়া ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার এ নীতিমালাকে কার্যকর করা। আল্লাহর সীমারেখাসমূহের সংরক্ষণ করার দাবী হচ্ছে যারা এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে- যারাএকে বিনষ্ট করে তাদের এই বাড়াবাড়ির কাজ করা থেকে তারা বিরত রাখবে । অতএব এই হচ্ছে সেই মোমেনদের দল, যাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের এই চুক্তি করেছেন৷ তাদের কাছ থেকে তিনি জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জান মালকে কিনে নিয়েছেন যেদিন থেকে দুনিয়ার জীবন বিধান হিসেবে মানুষদের কাছে দ্বীন এসেছে যেদিন থেকে মানুষের কাছে নবী ও নবুয়ত আসতে শুরু করেছে। সেদিন থেকেই এই নিয়মও চলে আসছে যে, মোমেন আল্লাহর পথে আল্লাহর কালেমা সমুন্নত করার জন্যে জেহাদ করবে । যারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখাকে লংঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। হক ও বাতিলের, ইসলাম ও জাহেলিয়াতের এক দীর্ঘ দ্বন্দ্ব, আল্লাহর আইন ও আল্লাহর বিরোধী আইন, হেদায়াত ও গোমরাহীর এ সংঘর্ষে হামেশাই আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের কাছ থেকে তাদের জানমালকে জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নেয়ার এই চুক্তি সম্পাদন করে রেখেছেন । জীবন কোনো হাসি তামাশার বিষয় নয়, জন্তু-জানোয়ারের মতো জীবন কোনো উদরপূর্তির বিষয়ও নয়, নিতান্ত দায়িত্বহীনভাবে সময় কাটানো- অপমান ও লাঞ্ছনা নিয়ে নামকাওয়াস্তে একটা নিরাপত্তা লাভ করা, অবহেলা ও আরামে সময় কাটানোর নামও জীবন নয়। জীবন হচ্ছে তা, যা হামেশা অন্যায় অসত্যের মোকাবেলা করবে, আল্লাহর পথে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে, আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার প্রাণান্তকর যুদ্ধে শহীদ হয়ে যাবে, তারপর আসবে চুড়ান্ত সাফল্য জান্নাত ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। এই হচ্ছে সে জীবন যার দিকে আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের এই বলে ডাকছেন, “হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তোমাদের এমন এক বিষয়ের দিকে তিনি ডাক দেন, যাতে জীবনের উপকরণ রয়েছে ।”

ফী জিলালিল কুরআন:

এই ঐকান্তিক আকীদা-বিশ্বাসের আলোকে এবং আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পাদিত ওয়াদা অনুযায়ী সর্বশেষে প্রেরিত এই জীবন ব্যবস্থা কায়েম করার লক্ষ্যে কোরআনুল করীম মােমনদের উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাচ্ছে। আজকে যারা কোরআনুল করীমের আহ্বানের লক্ষ্য এবং কেয়ামত পর্যন্ত যারা যারাই এই মিশনে কাজ করার জন্য পাক কালামের লক্ষ্যে পরিণত হবে, তাদের সবাইকেই আল কোরআন দুনিয়া ও আখেরাতের এক লাভজনক ব্যবসার দিকে আহ্বান জানাচ্ছে। সে ব্যবসা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আল্লাহর পথে জিহাদ। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদার ব্যক্তিরা, বলবাে নাকি তােমাদের এমন একটি ব্যবসা সম্পর্কে, যা তােমাদের ভীষণ বেদনাদায়ক আযাব থেকে বাঁচাবে… মােমেনদের একথার সুসংবাদ দিয়ে দাও।’ আলােচ্য আয়াতটিতে যে বিচ্ছেদ ও মিলনের ভাব ফুটে ওঠেছে, প্রশ্ন ও তার যে উত্তর দেয়া হয়েছে, পূর্বাহ্নে ঘটবে ও পরে ঘটবে বলে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, কথার ভাষা ও ভংগিতে প্রথমে ইচ্ছা ব্যক্ত করা থেকে নিয়ে যে দৃঢ় সংকল্প ফুটে ওঠেছে এবং অন্তরের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার আহ্বানের যে সকল প্রভাব পড়েছে, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য।   *কোরআনের দৃষ্টিতে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা : আয়াতটি শুরু হয়েছে ঈমানের নাম নিয়ে আহ্বান জানিয়ে, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা’, তার সাথে সাথেই অত্যন্ত প্রভাবপূর্ণভাবে জিজ্ঞাসার সুর ধ্বনিত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিজেই জিজ্ঞেস করছেন এবং জওয়াব পাওয়ার জন্য তাদের উৎসাহিত করে তুলছেন, সৃষ্টি করছেন তাদের মধ্যে সঠিক উত্তর পাওয়ার দারুণ আগ্রহ। এরশাদ হচ্ছে, ‘বলবাে নাকি তােমাদের এমন একটি ব্যবসায়ের কথা, যা তােমাদের ভীষণ বেদনাদায়ক আযাব থেকে বাঁচাবে?’ কে আছে এমন যে জানতে চাইবে না সেই ব্যবসায়ের কথা, যা আল্লাহ পাক নিজেই জানাতে চাইছেন? এখানেই এই আয়াতটি শেষ হচ্ছে। দুটি আয়াতকে পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারণ করা হয়েছে যেন তাৎক্ষণিকভাবে এক মুহূর্তের মধ্যেই শ্রোতারা আগ্রহান্বিত হয়ে যায় এবং উত্তর পাওয়ার জন্য মন উন্মুখ হয়ে ওঠে। তারপর জওয়াব, যার জন্য মােমেনদের অন্তর ও কানগুলাে খাড়া হয়েছিলাে। এরশাদ হচ্ছে, ঈমান আনবে আল্লাহ ও রসূলের ওপর। তাদেরই ঈমান আনতে বলা হচ্ছে যারা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাসী। সুতরাং এই আহ্বানের তাৎপর্য জানার জন্য প্রতিটি কান উৎকর্ণ হয়ে ওঠেছে। উদ্বলিত হয়ে ওঠেছে অন্তরসমূহ, যখন তারা জওয়াবের একটি অংশমাত্র শুনতে পেয়েছে, এখন সুনির্দিষ্টভাবে তারা জানতে ব্যগ্র কথাটির মূল তাৎপর্য! তাই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কথার বাকি অংশে বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহর পথে তােমাদের মাল ও জান দ্বারা জিহাদ করবে।’ ঈমান আনার পর আল্লাহ তায়ালার পথে জিহাদ অবশ্যম্ভাবী। নচেৎ ঈমানের কোনাে মূল্য আল্লাহর কাছে থাকে না। এটিই হচ্ছে মূল বিষয়, যা এই সূরার মধ্যে বিশেষভাবে আলােচিত হয়েছে। জিহাদ ব্যতীত যে ঈমান তা বেদনাদায়ক আযাব থেকে বাঁচাতে পারবে না একথা জানিয়ে দিয়ে জিহাদের যে গুরুত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে এবং কথাটি বার বার বলা হয়েছে যেন পাঠকবর্গ যথাযথভাবে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে। আল্লাহ পাকই বেহতর জানেন, মানুষের নিকট কোনাে বিষয়কে গুরুত্ববহ করে তুলতে হলে এভাবে বার বার বলতে হয়, নানাভাবে, নানা প্রকার উৎসাহব্যঞ্জক কথায় তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হয়, যাতে করে তারা এই কঠিন দায়িত্ব পালন করতে পারে। আল্লাহ তায়ালার দেয়া জীবন ব্যবস্থা পৃথিবীর বুকে বাস্তবায়িত করতে হলে এই জিহাদ অপরিহার্য, যার থেকে দূরে সরে থাকার কোন সুযােগ ইসলামে নেই, আর এজন্য সদা-সর্বদা ইসলামের শত্রুদের তৎপরতা সম্পর্কে খবর রাখতে হবে এবং সূক্ষ্ম ও সুন্দরভাবে জিহাদ-রূপ এই ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে, তবেই এগিয়ে আসবে সেই কল্যাণ যার খবর আল্লাহ পাক রাখেন। তাই তিনি জানাচ্ছেন, ‘ঐটিই হবে তােমাদের জন্য কল্যাণকর, তােমরা তােমাদের জ্ঞানকে কাজে লাগালে তবেই বুঝতে পারবে।’ সুতরাং, সেই সত্যটি জানানাে হয়েছে, যা সে গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণের দিকে মানুষকে এগিয়ে নিতে পারে। এরপর পরবর্তী একটি পৃথক আয়াতে সে কল্যাণ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ এসেছে। কারণ, সংক্ষিপ্তভাবে কোন কিছু জানানাের পর সেই বিষয়টিকে অন্তরের কাছে গুরুত্ববহ করে তােলার জন্য অনেক সময় বিস্তারিত আলােচনার প্রয়ােজন হয়। তাই আল্লাহ পাক বলছেন, ‘তিনি তােমাদের গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন।’ জিহাদের গুরুত্ব বুঝানাের জন্য এই একটি কথাই যথেষ্ট। এ বিষয়ে এইভাবে চিন্তা করা দরকার যে, গুনাহ মাফ করার জামানত আল্লাহ ছাড়া আর কে দিতে পারে? আর তিনিই যদি এই দায়িত্ব নেন, তাহলে এরপর আর কোন জিনিসের প্রয়ােজন বা সফলতা লাভ করার জন্য আর কোন পুঁজির দরকার? বরং এটাই পরম ও চরম সত্য কথা যে, আল্লাহ পাকের মেহেরবানী হাসিল করাই আসল পুঁজি, যার লাভের কোন সীমা-পরিসীমা নেই। সেই জন্যই তিনি এ ব্যবসার চূড়ান্ত সাফলাের কথা জানাতে গিয়ে বলছেন, তিনি তােমাদের প্রবেশ করাবেন সেই সকল বাগ-বাগিচায়, যার নীচু ও পাশ দিয়ে এবং অভ্যন্তর ভাগে ছােট ছােট নদী প্রবাহিত হতে থাকবে। সেখানে সেই চিরস্থায়ী বাগিচায় থাকবে পাক-সাফ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে তকতকে বাসগৃহসমূহ। এটা বলা বাহুল্য, এক মােমেনের যিন্দেগীতে এর থেকে বড় লাভজনক ব্যবসা আর কি হতে পারে যে, এই ক্ষণস্থায়ী ও অতি অল্প দিনের মধ্যে জেহাদের বিনিময়ে চিরস্থায়ী জান্নাত লাভ করবে। এমন কি যখন এ জীবনের সব কিছু হারিয়ে যাবে, ফুরিয়ে যাবে সব কিছু চাওয়া-পাওয়ার অবকাশ, তখন তাকে দেয়া হবে ফুলে-ফলে ভরা বাগ-বাগিচাসমূহ এবং তার মধ্যে স্থায়ী নেয়ামত-ভরা সুশােভিত বাস-গৃহ। আর অবশ্য এটাই সত্য যে, সেটিই হচ্ছে মহা সাফল্য। লাভজনক ব্যবসায়ের হিসাব-নিকাশ যেন এখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এটা অতি বড় সাফল্য, যা পাওয়ার জন্য একজন মােমেন দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের বিনিময়ে বিলিয়ে দেবে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যদি এক দেরহাম বা এক টাকার পণ্যদ্রব্যে দশ টাকা লাভ করে, অবশ্যই তার সমব্যবসায়ী বাজারের অন্যান্য সবাই তাকে অভিনন্দন জানাবে। তাহলে যে ব্যক্তি ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার জীবনের বিনিময়ে আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবন খরিদ করে, তাকে কি মানুষ অভিনন্দিত করবে না? অবশ্যই করবে, কারণ দুনিয়ার জীবনের এ সুখ-সম্পদ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, আর এর বিনিময়ে সে উপার্জন করছে চিরন্তন এমন যিন্দেগী, যার সীমা-পরিসীমা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউই জানে না। সে সুখ-সম্পদ এমন চিরস্থায়ী যা কোন দিন কমও হবে না বা শেষও হয়ে যাবে না। আকাবার বাইয়াতের রাতে রসূলুল্লাহ(স.) ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা(রা.)-এর মধ্যে এই ধরনের ব্যবসায়ের লেনদেন হয়েছিল। তিনি রসূলুল্লাহ(স.)-কে বলেছিলেন, আপনার রবের জন্য এবং আপনার জন্য আপনি যা চান তাই দেয়ার জন্য আমি নিজেকে পেশ করছি। তখন রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, ‘আমি আমার রবের জন্য এই শর্তে তােমার দান গ্রহণ করছি যে, তােমরা একমাত্র তারই পূর্ণাংগ ও নিঃশর্ত আনুগত্য (এবাদাত) করবে এবং তার সাথে আর কাউকে শরীক করবে না। আর আমি আমার নিজের জন্য তােমার দানকে এই শর্তে গ্রহণ করছি যে, তােমরা সেসব বিষয় থেকে বিরত থাকবে, যা তােমাদের নিজের জন্য এবং তােমাদের সম্পদের জন্য খারাপ মনে কর। আবদুল্লাহ বললেন, যদি আমরা এসবগুলাের সকল কিছুই করতে থাকি তাহলে কি ফল পাব? রসূলুল্লাহ (স.) বললেন, জান্নাত। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে, চমৎকার এই ব্যবসায়ের লাভ, আমরা এর থেকে কমও দেব না আর কোন অংশে কম নেবও না! কিন্তু আল্লাহ পাকের মেহেরবানীই আসলে বড়, আর তিনি জানেন সে ব্যক্তিদের, যারা এই পৃথিবীর কিছু জিনিসের সাথে সম্পর্কিত রয়েছে। সীমাবদ্ধ এই পৃথিবীর সব কিছু মানুষের গঠন প্রণালীর উপযােগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি মানুষের ডাকে সাড়া দেন এবং তিনি তাদের সেসব জিনিসের সুসংবাদ দান করছেন, যা তিনি তাদের ভাগ্য লিখন হিসাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং তার গােপন জ্ঞানভান্ডারে লুকিয়ে রেখেছেন। আর তা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত ব্যবস্থা এক সময়ে পৃথিবীর বুকে বিজয়ী ব্যবস্থা হিসাবে চালু হয়ে যাবে এবং জীবনের সর্বত্র সকল ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। আর এটা হবে আল্লাহরই সাহায্যক্রমে, যে সম্পর্কে তিনি বলছেন, আর অন্য যে জিনিসটি তােমরা ভালবাস তা হচ্ছে, আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। আর সুসংবাদ দাও মােমেনদের। এখানে জানা গেলাে, যে ব্যবসায়ের কথা আল্লাহ তায়ালা বলছেন, তার লাভ হচ্ছে সর্বোচ্চ। যেহেতু স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই এই লাভ দান করবেন। আল্লাহ পাক তাে সেই মহান সত্ত্বা, যার সম্পদের কোন অন্ত নেই বা সে সম্পদ কোন দিন ফুরিয়েও যাবে না, তার রহমত কেউ ঠেকাতে পারবে না যে, তিনি দিতে চাইলে দিতে পারবেন না। তার করুণাপূর্ণ দানের মধ্যে রয়েছে মাগফিরাত (ক্ষমা), (পুরস্কারস্বরূপ) বাগ বাগিচা, পাক-পবিত্র বাসস্থান এবং পরকালীন জীবনে নেয়ামতভরা স্থায়ী আবাস। আরাে রয়েছে, সকল লাভজনক ব্যবসায়ের ওপরে সব উপার্জনের বড় উপার্জন আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। এমতাবস্থায় এমন কোন ব্যক্তি কি থাকতে পারে যাকে আল্লাহ পাক এ ব্যবসায়ের দিকে ডাকছেন, অথচ সে বিলম্ব করবে অথবা পিছিয়ে থাকবে? এসব কথা দ্বারা এখানে মানুষকে জিহাদের ব্যাপারে যেমন উৎসাহিত করা হচ্ছে, তেমনি তাদের মধ্যে জিহাদের মহব্বতও পয়দা করা হচ্ছে। একজন মােমেন ব্যক্তির মধ্যে সৃষ্টিজগত ও জীবনের সাফল্যের জন্য ঈমানী ধ্যান-ধারণার তাৎপর্যের অনুভূতি রয়েছে এবং আন্তরিকতার সাথে এ বিষয়ে সে চিন্তাও করে, তারপর ঈমানী জীবন যাপন করার ফল কত সুন্দর তাও খেয়াল করে। পাশাপাশি ঈমান বিহীন জীবনের অবস্থাও সে দেখে, খেয়াল করে সে জীবন কতাে সংকীর্ণ, কতাে সীমাবদ্ধ তার বিস্তৃতি, লক্ষ্য করে ঈমানবিহীন জীবনের পতন ও হাবুডুবু খাওয়া অবস্থা, আরও দেখে ঈমানবিহীন জীবনে সুখী সমৃদ্ধশালী হওয়ার কি হাস্যকর আকুতি ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা। যে হৃদয়টি এই তুলনামূলক পর্যালোচনা মাধ্যমে ঈমান বিহীন জীবনের অসারতা অনুধাবন করে, সে এক মুহূর্তের জন্যও ঈমানের মহাসম্পদ থেকে দূরে থাকতে পারে না বা এক মুহূর্তের জন্যও সে বাস্তব জীবনে ঈমানভিত্তিক মহান জীবন গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না; বরং তখন সে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ঈমানী যিন্দেগী যাপন করতে চায় এবং আশেপাশে অবস্থিত অপরকেও এই মধুর পথে এগিয়ে আনার জন্য তার সকল প্রচেষ্টাকে কাজে লাগায়। এই প্রচেষ্টার নামই জিহাদ। নিজের গরজেই সে জিহাদ করে। অর্থাৎ এই জিহাদের
বাস্তব ফল এই দুনিয়ার জীবনেই সে হাতেনাতে পাবে বলে দিব্যি চোখে দেখতে পায়। সে জন্যই হয়ত সে আখেরাতে কি পাবে না পাবে, সে চিন্তাও করে না। ঈমানের মজা সে অন্তরের গভীরে অনুভব করে বলেই তার মন খুশীতে ভরে যায়, আসে পরম নিশ্চিন্ত। তারপর সে আর কখনই ঈমানমুক্ত থাকতে পারে না, পারে না সে ইহজগতে ঈমানী যিন্দেগী প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে দূরে থাকতে। সে তখন জিহাদী জীবন যাপন করার জন্য নিজের থেকেই এগিয়ে যায় এবং অবলীলাক্রমে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি গ্রহণ করে নেয়। এতদসত্তেও মানুষের মন মাঝে মাঝে দুর্বল হয়ে যায়, অনেক সময় এ দুর্বলতা সে উপেক্ষাও করতে পারে না, প্রচেষ্টারত মন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, একটু নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ত জীবন যাপন অভিলাষ তাকে পেয়ে বসে। এই কারণেই প্রকৃতিগত এই দুর্বলতা তাকে বাস্তব পতনােন্মুখ অবস্থার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য করে। এই কারণেই আল কোরআন মানুষের মনের মধ্যে এই জেহাদী চেতনা দান করার চেষ্টা করছে এবং তার জন্য যত প্রকার উৎসাহব্যঞ্জক শব্দ ব্যবহার করা প্রয়ােজন তা সবই করছে। বিভিন্ন কায়দায়, নানা ভংগিমায়, সর্বপ্রকারের যুক্তির মাধ্যমে এবং অনেক প্ৰসংগ সামনে এনে তার ভিত্তিতে জেহাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাই দেখা যায়, এখানে মােমেনদের ডাক দিয়ে শুধু ঈমান আনার কথা বলে থেমে যাওয়া হয়নি; বরং ঈমানের সাথে অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে ওতপ্রােতভাবে জিহাদের কথা ঘােষণা করা হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন:

*দ্বীন প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা : অতপর এখানে নতুন আর একটি আহ্বান জানানাের মাধ্যমে সূরাটি শেষ করা হয়েছে। অবশ্য নতুন এ প্রসংগটিতে নবতর প্রেরণার খােরাক রয়েছে, যার কারণে সূরাটি পাঠ করার সাথে সাথে নবতর উদ্দীপনার… সৃষ্টি হয়। আল্লাহ পাকের আবেগমাখা আহ্বান, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, হয়ে যাও তােমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাহায্যকারী, যেমন করে ঈসা ইবনে মারইয়াম তার একনিষ্ঠ সাথীদের ডেকে বলেছিল, কে আছ তােমরা আল্লাহর দিকে যাওয়ার জন্য, আল্লাহর কাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমার সাহায্যকারী? সেই সাহাবীরা বলেছিলেন, “আমরা আছি আল্লাহর সাহায্যকারী।” অতপর বনী ইসরাঈলদের মধ্য থেকে একটি দল ঈমান আনল এবং কুফরী করল অপর একটি দল, আমি (সর্বশক্তিমান আল্লাহ) ঈমানদারদের তাদের শত্রুদের ওপর সাহায্য করলাম, ফলে তারা চুড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়ে গেলাে। এই হাওয়ারীরা ছিলেন ঈসা(আ.) এর শিষ্য। বলা হয়, এঁরা ছিলেন বার জন। এরা বনী ইসরাঈল জাতির অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ঈসা(আ.)-এর নিকট আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তার সংগে সর্বদা থাকার উদ্দেশ্যে অন্য সবার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। ঈসা(আ.)-কে আকাশে তুলে নেয়ার পর এঁরা তাঁর নির্দেশগুলাের হেফাযত করেছিলেন এবং তাঁর শিক্ষা বিস্তার করে চলেছিলেন। আলােচ্য আয়াতে ঈসা(আ.)-এর মূল কাজ সম্পর্কে ইংগিত দান করা হয়েছে, বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়নি। সুতরাং আমরাও সূরাটির আলােচনায় মূল যে উদ্দেশ্যে ঈসা(আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন সেই বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাক। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তােমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। এখানে সেই স্থানে আল্লাহর সাহায্যকারী হতে বলা হচ্ছে, যেখানে আল্লাহ পাক তাকে তুলে নিয়েছিলেন। তাহলে কি আল্লাহ পাক যে স্থান থেকে তাকে তুলে নিয়েছিলেন, সেখানে তিনি (আল্লাহর সেই বান্দা) আল্লাহ তায়ালার সাহায্যপ্রাপ্ত ছিলেন। এই যে তাঁকে শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে আকাশে তুলে নেয়া, এ এমন এক সম্মান যার মর্যাদা জান্নাত ও তার নেয়ামত থেকে কোন অংশে কম নয়, বরং অনেক গুণে বেশী। হয়ে যাও আল্লাহর সাহায্যকারী, যেমন মারইয়ামপুত্র ঈসা হাওয়ারীদের বলেছিল, কে আছ তােমরা আল্লাহর কাছে যাওয়ার ব্যাপারে আমার সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীরা বলেছিল, আমরা আছি আল্লাহর সাহায্যকারী।’ সুতরাং এ দায়িত্ব বহন করার জন্য তাদের নিকট প্রতিনিধি দল পাঠানাে হলাে এবং তারা এই বিরাট সম্মানের অধিকারী হয়ে গেলাে। ঈসা(আ.) তাে মুখ্যত এসেছিলেন নতুন নবী ও শেষ ‘দ্বীন’-এর আগমন সংবাদটুকু দিতে। সুতরাং ঈসা(আ.)-এর অনুসারীরা এই চিরস্থায়ী দায়িত্ব পালনের জন্য (সাময়িকভাবে) বেশী যোগ্য ছিলো না। এ প্রসংগে এই প্রতিনিধিত্বের কথাটাই স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর পরিণতি কি হয়েছিলাে। এর পরিণতিতে দেখা যায়, হাওয়ারীদের মধ্য থেকে একটি মাত্র দল ঈমান আনলাে এবং অন্য এক দল এ দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানালাে। সুতরাং ঈমান যারা আনল, তাদের আমি মহান আল্লাহ সাহায্য করলাম, ফলে তারা বিজয়ী হয়ে গেলাে। এই আয়াতটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুটি অর্থের যে কোন একটি গ্রহণ করা যেতে পারে। এক. যে সকল ব্যক্তি ঈসা(আ.)-এর রেসালাতের ওপর ঈমান এনেছিলাে, হয়ত তারা সবাই ছিলাে তার হাওয়ারী (শিষ্য)। এর মধ্যে যারা ঈমান আনার পর মযবুত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাে এবং যারা এ বিশ্বাস থেকে ফিরে গিয়েছিলাে, তাদের সবার ওপর হাওয়ারী কথাটি প্রযােজ্য, যেহেতু তারা সবাই ইহুদীদের ওপর বিজয়ী হয়েছিলাে, যারা ঈমান আনেনি এবং আল্লাহ পাক তাদের অবশ্যই ইহুদীদের ওপর বিজয় অর্জনে সাহায্য করেছিলেন, ইতিহাসও একথার সাক্ষ্য দেয়। অতপর দেখা যায়, যেসব ব্যক্তি ঈমান এনেছিলাে তারাই অবতার-বাদী {অবতারবাদী বলতে বুঝায় সেই সকল ব্যক্তিকে যারা ঈসা(আ.)-কে আল্লাহর অবতার মনে করে এবং তৃত্ববাদী বলতে তাদের বুঝায়, যারা বলে, God the father God the mother and God the son, অর্থাৎ পিতা, মাতা ও পুত্র মিলে তিন খােদায় এক আল্লাহ। মারইয়াম(আ.)-এর বিয়ে হয়নি এবং কোনাে পুরুষের স্পর্শ ব্যতীত ঈসা(আ.) তার গর্ভে (আল্লাহর একান্ত ইচ্ছায়) পয়দা হন। তৃত্ববাদীরা বুঝতে না পেরে এ কথা বলে} ও তত্ববাদীদের মােকাবেলায় তাওহীদের ওপর দৃঢ়তার সাথে টিকে ছিলাে, টিকে ছিলাে অন্য সব সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে যারা তাওহীদ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছিলাে। ‘প্রভাত করলাে বিজয়ী অবস্থায়’ একথার অর্থ হচ্ছে, যুক্তি-প্রমাণ সহকারে তারা বিভ্রান্ত লােকদের ওপর বিজয় অর্জন করলাে। অথবা অর্থ হবে, যে তাওহীদ (একত্ববাদ)-এর ওপর তারা দৃঢ়ভাবে টিকে ছিলাে সেই সকল শক্তি-ক্ষমতার মালিক এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাসের কারণেই আল্লাহ পাক তাদের কাছে ’শেষ দ্বীন’ প্রকাশ করে দিয়েছেন। একত্ববাদী এই জাতি সম্পর্কেই ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে। এই শেষের ব্যাখ্যাই এ প্রসংগে সঠিক অর্থের বেশী নিকটে এবং বেশী গ্রহণযোগ্য। এখানের এই ইংগিত এবং আহ্বান থেকে আমরা সেই উপদেশ ও সেই শিক্ষা পাই, যার দিকে আমরা ইতিপূর্বে ইংগিত করেছি; আর তা হচ্ছে, মােমেনদের হিম্মতকে নতুন দ্বীন গ্রহণ করার ব্যাপারে পুনরুজ্জীবিত করা। কারণ, তারাই তাে পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তায়ালার আইন-কানুন চালু করার ব্যাপারে দায়িত্বশীল! তারাই সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী এবং আল্লাহর রসূলদের ওয়ারিস! এই মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য তাদেরই বেছে নেয়া হয়েছে। তাদের সাহসকে নতুন বলে বলীয়ান করা হয়েছে যেন তারা আল্লাহকে ও তার দ্বীনকে সাহায্য করতে পারে। যেমন ঈসা ইবনে মারইয়াম তার শিষ্যদের বলেছিল, আল্লাহর কাছে পৌছে যাওয়ার ব্যাপারে বা আল্লাহর দিকে যাওয়ার ব্যাপারে কে হবে আমার সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীরা বলে ওঠেছিল, আমরা আছি আল্লাহর সাহায্যকারী। অবশেষে সাহায্য তাদেরই জন্য অবধারিত, মােমেনদের মধ্যে যারা আল্লাহর সাহায্যকারী। আলােচ্য সূরাতে এটিই শেষ কথা এবং এ প্রসংগে শেষ হৃদয়স্পর্শী বিষয় এটিই। এই কথাটিই নানা রংয়ে ও নানাভাবে আকর্ষণীয় করে তুলে সূরার মূল ভাবধারা ও প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে সংগতিসম্পন্ন করে তুলে ধরা হয়েছে। এর সাথে এটাও সত্য কথা যে, এ সূরার মধ্যে উপস্থাপিত এ রং ও স্বাদ সম্পূর্ণভাবে যেন নতুনভাবে তৈরী করা হয়েছে।

১০-১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

(هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلٰي تِجَارَةٍ)

এখানে আমল (ঈমান ও জিহাদ)-কে বাণিজ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এতেও ব্যবসা-বাণিজ্যের মত লাভ রয়েছে। সে লাভের কথা পরের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(إِنَّ اللّٰهَ اشْتَرٰي مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ط يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ فَيَقْتُلُوْنَ وَيُقْتَلُوْنَ)

“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের নিকট হতে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে তার বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে স্বসস্ত্র যুদ্ধ করে, হত্যা করে ও নিহত হয়।” (সূরা তাওবা ৯ : ১১১)

এটা হল আখেরাতের লাভ। আর দুনিয়াবী লাভ হল আল্লাহ তা‘আলা যুদ্ধক্ষেত্রসহ সর্বত্র সহযোগিতা করবেন এবং বিজয় দান করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ) ‏

“ওহে, যারা ঈমান এনেছে! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদমকে মযবুত করে দেবেন।” (সূরা মুহাম্মদ ৪৭ : ৭)

আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার বিজয়সমূহ নিকটতম তাই তাকে (فَتْحٌ قَرِيْبٌ) বলা হয়েছে।

(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا….)

আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদেরকে সর্বাবস্থায় কথায়, কাজে ও জান-মাল দ্বারা তাঁর সাহায্যকারী হওয়ার নির্দেশ প্রদান করছেন যেমন ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার পথে সাহায্য করেছিল।

حَوَارِيْ শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে উৎপত্তি। অর্থ দেওয়ালে চুনকাম করার জন্য ধবধবে সাদা চুন। পারিভাষিক অর্থে ঈসা (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হত। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেছেন তাদের সংখ্যা ছিল ১২জন। ঈসা (আঃ)্-এর অনুসারী ও সাহায্যকারীকে, সহচরদেরকে ‘হাওয়ারী’ বলা হয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসারী ও সহচরদেরকে ‘সাহাবী’ বলা হয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : প্রত্যেক নাবীর একজন বিশেষ সাহায্যকারী (হাওয়ারী) ছিল। আমার বিশেষ সাহায্যকারী হল যুবাইর (রাঃ)। (সহীহ বুখারী হা. ২৮৪৭, সহীহ মুসলিম হা. ২৪১৫)

ইমাম বাগাভী অত্র আয়াতের তাফসীরে ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পর খ্রিস্টান জাতি তিন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল তাকে ‘আল্লাহ তা‘আলা’ বলে। একদল তাকে ‘আল্লাহ তা‘আলার পুত্র’ বলে এবং একদল তাকে ‘আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল’ বলে। প্রত্যেক দলের অনুসারী দল ছিল। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ বাড়তে থাকে। অতঃপর শেষনাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমন ঘটে এবং তিনি মু’মিনদের দলকে সমর্থন দেন। ফলে তারাই দলীলের ভিত্তিতে জয়লাভ করে। এ সকল ঈসায়ীগণ সবাই ইসলাম কবূল করে।

(فَاٰمَنَتْ طَّآئِفَةٌ)

অর্থাৎ ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াতে একদল লোক তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল। আর একদল তাঁর দাওয়াত বর্জন করে কুফরী করল। এটা ছিল সেসব ইয়াহূদী যারা ঈসা (আঃ)-এর মায়ের প্রতি অপবাদ দিয়েছিল।

(فَأَيَّدْنَا الَّذِيْنَ)

অর্থাৎ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করে আল্লাহ তা‘আলা ঈসা (আঃ)-এর ওপর ঈমান আনয়নকারী দলকে অন্যান্য ভ্রষ্ট দলের ওপর শক্তিশালী করেছেন। তাই সঠিক আক্বীদার অধিকারী এ দলটি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপরও ঈমান আনল। আর এভাবে তিনি দলীল-প্রমাণের দিক দিয়েও সমস্ত কাফিরদের ওপর এদেরকে জয়যুক্ত করেছেন। এ জয়ের সর্বশেষ বিকাশ ঘটবে তখন যখন কিয়ামতের পূর্বকালে ঈসা (আঃ) পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন।

মু’মিনরা এভাবেই কিয়ামত অবধি কাফিরদের ওপর বিজয়ী থাকবে তবে শর্ত হল : তাদেরকে সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক ঈমান ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
জিহাদ করার ফযীলত জানলাম।
# আখেরাতের বিজয় সবচেয়ে বড় বিজয়।
# আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় সহযোগিতা করা মু’মিনের বৈশিষ্ট্য।
# আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে সহযোগিতা করেন।
# হকপন্থীরা সবর্দা জয়ী থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

১০-১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১০-১৩ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বর্ণিত হাদীস পূর্বে গত হয়েছে যে, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন আমল আল্লাহ তা’আলার নিকট সবচেয়ে প্রিয়?” তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ তা’আলা এই সূরাটি অবতীর্ণ করেন। এতে তিনি বলেনঃ এসো, আমি তোমাদেরকে এমন এক লাভজনক ব্যবসার কথা বলে দিই যাতে ক্ষতির কোনই সম্ভাবনা নেই। এতে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে এবং ভয়ের কোন কারণ থাকবে না। তা হচ্ছে এই যে, তোমরা আল্লাহর একত্বে ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এই ব্যবসা দুনিয়ার ব্যবসা হতে বহুগুণে উত্তম। যদি তোমরা এই ব্যবসায়ে হাত দাও তবে তোমাদের পদস্খলন ও পাপ-অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিবো। আর তোমাদেরকে দাখিল করবে এমন জান্নাতে যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত এবং তোমাদেরকে প্রবিষ্ট করবে স্থায়ী জান্নাতের উত্তম বাসগৃহে। বিশ্বাস রেখো যে, মহাসাফল্য এটাই।

আরো জেনে রেখো যে, তোমরা সদা তোমাদের শত্রুদের সাথে মুকাবিলা করে থাকো, এই মুকাবিলার সময় আমি তোমাদেরকে সাহায্য করতে থাকবো এবং তোমাদের ঈপ্সিত বিজয় দান করবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তবে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পাগুলো স্থির রাখবেন।” (৪৭:৭) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)

অর্থাৎ “অবশ্যই আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন যে তাঁকে সাহায্য করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমতাবান, মহাপরাক্রমশালী।” (২২:৪০) দুনিয়ার এই সাহায্য ও বিজয় এবং আখিরাতের ঐ জান্নাত ও নিয়ামত ঐ লোকদের জন্যে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যের কাজে সদা লেগে থাকে এবং জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর দ্বীনের খিদমত করে। তাই তো তিনি স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি আমার পক্ষ হতে মুমিনদেরকে এর সুসংবদি দাও।

১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
মহান আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন সদা-সর্বদা জান-মাল, ইজ্জত-আবরূ, কথা এবং কাজ দ্বারা আল্লাহকে সাহায্য করে, আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর ডাকে সাড়া দেয়, যেমন হাওয়ারীগণ হযরত ঈসা (আঃ)-এর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন যখন তিনি বলেছিলেনঃ আল্লাহর পথে কে আমাকে সাহায্যকারী হবে? অর্থাৎ আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার কাজে কে আমার সাহায্যকারী হবে? তখন হযরত ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী হাওয়ারীরা বলেছিলঃ আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। অর্থাৎ আল্লাহর এই দ্বীনের কাজে আমরাই আপনার সঙ্গী হিসেবে কাজ করবে, আপনাকে সাহায্য করবে ও আপনার অনুসারী হিসেবে থাকবো। তখন হযরত ঈসা (আঃ) তাদেরকে প্রচারক হিসেবে সিরিয়ার শহরগুলোতে পাঠিয়ে দেন।

হজ্বের মৌসুমে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-ও বলেছিলেনঃ “এমন কেউ আছে কি যে আমাকে জায়গা দিতে পারে যাতে আমি আল্লাহর রিসালাতকে জনগণের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারি? কুরায়েশরা তো আমাকে আমার প্রতিপালকের বাণী মানুষের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার কাজে বাধা প্রদান করেছে।” তখন মদীনার অধিবাসী আউস ও খাযরাজ গোত্রীয় লোকদেরকে মহান আল্লাহ এই সৌভাগ্যের অধিকারী করেন যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। তারা তাঁর কথা মেনে চলার অঙ্গীকার করেন। তাঁরা এই প্রতিজ্ঞা করেন যে, যদি রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের বাসভূমিতে চলে যান তবে কোনক্রমেই তাঁরা তাঁর কোন ক্ষতি সাধন হতে দিবেন না। তারা তার পক্ষ হতে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন এবং যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে তাকে রক্ষা করবেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন তাঁর সঙ্গীগণসহ হিজরত করে তাদের বাসভূমি মদীনা নগরীতে পৌঁছলেন তখন বাস্তবিকই তাঁরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন এবং তাদের কথাকে বাস্তবে রূপদান করলেন। এ কারণেই তারা ‘আনসার এই মহান উপাধিতে ভূষিত হন। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাঁদেরকে সন্তুষ্ট রাখুন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “অতঃপর বানী ইসরাঈলের একদল ঈমান আনলো এবং একদল কফরী করলো’ অর্থাৎ যখন ঈসা (আঃ) তাঁর অনুসারী হাওয়ারীদেরকে নিয়ে দ্বীনের তাবলীগ করতে শুরু করলেন তখন বানী ইসরাঈলের কিছু লোক সঠিক পথে এসে গেল, আর কিছু লোক এপথে আসলো না। এমনকি তারা। তাকে এবং তাঁর সতী-সাধ্বী মাতার প্রতি জঘন্যতম অপবাদ রচনা করলো। এই ইয়াহুদীদের উপর চিরতরে আল্লাহর গযব পতিত হলো। আবার যারা তাঁকে মেনে নিলো তাদের মধ্যে একটি দল মানার ব্যাপারে সীমালংঘন করলো এবং তাকে তার মর্যাদার চেয়েও বাড়িয়ে দিলো। এদের মধ্যেও আবার কয়েকটি দল হয়ে গেল। একটি দল বলতে লাগলো যে, হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ)। অন্য একটি দল বললো যে, হযরত ঈসা (আঃ) তিনজনের একজন অর্থাৎ পিতা, পুত্র ও রূহুল কুদস। আর একটি দল তো তাকে আল্লাহ বলেই স্বীকার করে নিলো। এসবের আলোচনা সূরায়ে নিসায় বিস্তারিতভাবে রয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ পরে আমি মুমিনদেরকে শক্তিশালী করলাম তাদের শত্রুদের মুকাবিলায়। অর্থাৎ আমি তাদেরকে তাদের শত্রু খৃষ্টানদের উপর বিজয়ী করলাম।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ যখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ হযরত ঈসা (আঃ)-কে আকাশে উঠিয়ে নেয়ার ইচ্ছা করলেন তখন হযরত ঈসা (আঃ) গোসল করে পাক সাফ হয়ে স্বীয় সহচরদের নিকট আসলেন। ঐ সময় তার মাথা হতে পানির ফোটা ঝরে পড়ছিল। তাঁর সহচরগণ ছিলেন বারোজন। তাঁরা একটি ঘরে অবস্থান করছিলেন। তিনি তাদের মধ্যে এসেই বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যে আমার উপর ঈমান এনেছে বটে কিন্তু পরে কুফরী করবে। একবার নয়, বরং বারো বার।” অতঃপর তিনি বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে যে এই ব্যাপারে প্রস্তুত হতে পারে যে, তাকে আমার চেহারার সাথে সাদৃশ্যযুক্ত করে দেয়া হবে এবং আমার পরিবর্তে তাকে হত্যা করে দেয়া হবে, অতঃপর সে জান্নাতে আমার সাথে আমার মর্যাদায় থাকবে?” তাঁর একথার জবাবে তাঁদের মধ্যে বয়সে যিনি সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি বললেনঃ “আমি এ জন্যে প্রস্তুত আছি।” হযরত ঈসা (আঃ) তাকে বললেনঃ “তুমি বসে পড়।” অতঃপর পুনরায় তিনি তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। এবারও ঐ যুবকটি দাড়িয়ে বললেনঃ “আমিই এজন্যে প্রস্তুত।” হযরত ঈসা (আঃ) এবারও তাঁকে বসে যেতে বললেন। তৃতীয়বার হযরত ঈসা (আঃ) ঐ কথাই বললেন এবং তৃতীয়বারও ঐ যুবকটিই দাঁড়িয়ে সম্মতি জানালেন। এবার তিনি বললেনঃ “আচ্ছা, বেশ!” তৎক্ষণাৎ তার আকৃতি সম্পূর্ণরূপে হযরত ঈসা (আঃ)-এর মত হয়ে গেল এবং হযরত ঈসা (আঃ)-কে ঐ ঘরের একটি ছিদ্র দিয়ে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হলো। হযরত ঈসা (আঃ)-কে অনুসন্ধানকারী ইয়াহূদীরা দৌড়িয়ে আসলো এবং ঐ যুবকটিকে ঈসা (আঃ) মনে করে গ্রেফতার করলো ও হত্যা করে শূলে চড়িয়ে দিলো। হযরত ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ঐ অবশিষ্ট এগারোজন লোকের মধ্য হতে কেউ কেউ বারো বার কুফরী করলো, অথচ ইতিপূর্বে তারা ঈমানদার ছিল।

অতঃপর হযরত ঈসা (আঃ)-কে মান্যকারী বানী ইসরাঈলের দলটি তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে গেল। একটি দল বললোঃ “স্বয়ং আল্লাহ হযরত (হযরত ঈসা আঃ-এর আকৃতিতে) যতদিন ইচ্ছা করেছিলেন আমাদের মধ্যে ছিলেন। অতঃপর তিনি আকাশে উঠে গেলেন।” এই দলটিকে ইয়াকুবিয়্যাহ বলা হয়। দ্বিতীয় দলটি বললোঃ “আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী আমাদের মাঝে ছিলেন, অতঃপর তিনি তাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিলেন।” এই দলটিকে বলা হয় নাসতুরিয়্যাহ। তৃতীয় দলটি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। তাদের আকীদাহ বা বিশ্বাস এই যে, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাদের মধ্যে ছিলেন, অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তাঁকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। এই দলটি হলো মুসলিম দল।

অতঃপর ঐ কাফির দল দুটির শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তারা ঐ মুসলিম দলটিকে মেরে পিটে হত্যা ও ধ্বংস করতে শুরু করে। অবশেষে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে প্রেরণ করেন। বানী ইসরাঈলের ঐ মুসলিম দলটি তাঁর উপরও ঈমান আনয়ন করে। সুতরাং এই ঈমানদার দলটিকে আল্লাহ তাআলা সাহায্য করেন এবং তাদেরকে তাদের শত্রুদের উপর জয়যুক্ত করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিজয়ী হওয়া এবং দ্বীন ইসলামের অন্যান্য দ্বীনগুলোকে পরাজিত করাই হলো তাদের বিজয়ী হওয়া ও তাদের শত্রুদের উপর জয়লাভ করা।” (এটা তাফসীরে ইবনে জারীরে ও সুনানে নাসাঈতে বর্ণিত হয়েছে)

সুতরাং এই উম্মত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে সদাসর্বদা বিজয়ীই থাকবে, শেষ পর্যন্ত কিয়ামত এসে যাবে এবং এই উম্মতের শেষের লোকগুলো হযরত ঈসা (আঃ)-এর সঙ্গী হয়ে মাসীহ দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, যেমন সহীহ হাদীসে বিদ্যমান রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

Leave a Reply