بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬৫/ মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৯) [* যখন মুনাফিকরা আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে:- *তারা ঈমান আনার পর আবার কুফরী করেছে:- *তারা যেন দেওয়ালে ঠেকানো কাঠের খুঁটি,ষ:- *মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেনা:- *আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না:- *তারা বলে, আল্লাহর রসূলের সাথীদের জন্য খরচ করা বন্ধ করে দাও:- *সম্মান ও মর্যাদা তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মু’মিনদের জন্য:-] www.motaher21.net সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন। পারা:২৮ ১- ৮ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬৫/ মুনাফিক কী? কেন ও কীভাবে?:-৪৯)
[* যখন মুনাফিকরা আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে:-
*তারা ঈমান আনার পর আবার কুফরী করেছে:-
*তারা যেন দেওয়ালে ঠেকানো কাঠের খুঁটি,ষ:-
*মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেনা:-
*আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না:-
*তারা বলে, আল্লাহর রসূলের সাথীদের জন্য খরচ করা বন্ধ করে দাও:-
*সম্মান ও মর্যাদা তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মু’মিনদের জন্য:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন।
পারা:২৮
১- ৮ নং আয়াত:-

সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-১
اِذَا جَآءَکَ الۡمُنٰفِقُوۡنَ قَالُوۡا نَشۡہَدُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُ اللّٰہِ ۘ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُہٗ ؕ وَ اللّٰہُ یَشۡہَدُ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَکٰذِبُوۡنَ ۚ﴿۱﴾
যখন মুনাফিকরা আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল।’ আর আল্লাহ জানেন যে, আপনি নিশ্চয় তাঁর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-২
اِتَّخَذُوۡۤا اَیۡمَانَہُمۡ جُنَّۃً فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ اِنَّہُمۡ سَآءَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲﴾
তারা নিজেদের শপথসমূহকে ঢাল বানিয়ে রেখেছে। এভাবে তারা নিজেরা আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকছে এবং অন্যদেরকেও বিরত রাখছে। এরা যা করছে তা কত মন্দ কাজ!
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-৩
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ اٰمَنُوۡا ثُمَّ کَفَرُوۡا فَطُبِعَ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ فَہُمۡ لَا یَفۡقَہُوۡنَ ﴿۳﴾
এ সবের কারণ এই যে, তারা ঈমান আনার পর আবার কুফরী করেছে। তাই তাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। এখন তারা কিছুই বুঝে না।
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-৪
وَ اِذَا رَاَیۡتَہُمۡ تُعۡجِبُکَ اَجۡسَامُہُمۡ ؕ وَ اِنۡ یَّقُوۡلُوۡا تَسۡمَعۡ لِقَوۡلِہِمۡ ؕ کَاَنَّہُمۡ خُشُبٌ مُّسَنَّدَۃٌ ؕ یَحۡسَبُوۡنَ کُلَّ صَیۡحَۃٍ عَلَیۡہِمۡ ؕ ہُمُ الۡعَدُوُّ فَاحۡذَرۡہُمۡ ؕ قٰتَلَہُمُ اللّٰہُ ۫ اَنّٰی یُؤۡفَکُوۡنَ ﴿۴﴾
তুমি যখন তাদের দিকে তাকাও, তখন তাদের দেহাকৃতি তোমাকে মুগ্ধ করে এবং তারা যখন কথা বলে, তখন তুমি সাগ্রহে তা শ্রবণ কর; তারা যেন দেওয়ালে ঠেকানো কাঠের খুঁটি, তারা যে কোন শোরগোলকে মনে করে তাদেরই বিরুদ্ধে। তারাই শত্রু অতএব তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও, আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! বিভ্রান্ত হয়ে তারা কোথায় চলেছে?
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-৫
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمۡ تَعَالَوۡا یَسۡتَغۡفِرۡ لَکُمۡ رَسُوۡلُ اللّٰہِ لَوَّوۡا رُءُوۡسَہُمۡ وَ رَاَیۡتَہُمۡ یَصُدُّوۡنَ وَ ہُمۡ مُّسۡتَکۡبِرُوۡنَ ﴿۵﴾
যখন তাদের বলা হয়, এসো আল্লাহর রসূল যাতে তোমাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন তখন তারা মাথা ঝাঁকুনি দেয় আর তুমি দেখবে যে, তারা অহমিকা ভরে আসতে বিরত থাকে।
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-৬
سَوَآءٌ عَلَیۡہِمۡ اَسۡتَغۡفَرۡتَ لَہُمۡ اَمۡ لَمۡ تَسۡتَغۡفِرۡ لَہُمۡ ؕ لَنۡ یَّغۡفِرَ اللّٰہُ لَہُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿۶﴾
আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন বা না করুন, উভয়ই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসিক সম্পপ্রদায়কে হেদায়াত দেন না।
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-৭
ہُمُ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ لَا تُنۡفِقُوۡا عَلٰی مَنۡ عِنۡدَ رَسُوۡلِ اللّٰہِ حَتّٰی یَنۡفَضُّوۡا ؕ وَ لِلّٰہِ خَزَآئِنُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَا یَفۡقَہُوۡنَ ﴿۷﴾
এরাই তো সেই সব লোক যারা বলে, আল্লাহর রসূলের সাথীদের জন্য খরচ করা বন্ধ করে দাও যাতে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। অথচ আসমান ও যমীনের সমস্ত ধন ভাণ্ডারের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। কিন্তু এই মুনাফিকরা তা বুঝে না।
সুরা: ৬৩ : মুনাফিকুন:-৮
یَقُوۡلُوۡنَ لَئِنۡ رَّجَعۡنَاۤ اِلَی الۡمَدِیۡنَۃِ لَیُخۡرِجَنَّ الۡاَعَزُّ مِنۡہَا الۡاَذَلَّ ؕ وَ لِلّٰہِ الۡعِزَّۃُ وَ لِرَسُوۡلِہٖ وَ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ لٰکِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ٪﴿۸﴾
এরা বলে, আমরা মদীনায় ফিরে যেতে পারলে যে সম্মানিত সে হীন ও নীচদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে। অথচ সম্মান ও মর্যাদা তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মু’মিনদের জন্য। কিন্তু এসব মুনাফিক তা জানে না।

১-৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটির নাম আল মুনাফিকুন। এই নাম দ্বারাই এর আলােচ্য বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে মুনাফিকদের আলােচনা এবং তাদের স্বভাব চরিত্র ও চক্রান্তের বিবরণ শুধু যে এই সূরাতেই এসেছে তা নয়; বরং বলতে গেলে মদীনায় নাযিল হওয়া কোনাে সূরাতেই মুনাফিকদের প্রসঙ্গ বাদ যায়নি। তা প্রত্যক্ষভাবেই হােক বা পরােক্ষভাবেই হােক। কিন্তু এই সূরা মুনাফিকদের এবং তাদের কথিত কিছু কথাবার্তা ও তাদের দ্বারা সংঘটিত কিছু ঘটনার আলােচনায় সীমাবদ্ধ। তাছাড়া মুনাফিকের চরিত্র, মিথ্যাচার, জালিয়াতি, ষড়যন্ত্র, তাদের অন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সঞ্চিত আক্রোশ, চক্রান্ত, নীচাশয়তা, কাপুরুষতা এবং চোখ ও মনের অন্ধত্ব সম্পর্কেও এই সূরায় তীব্র সমালােচনা করা হয়েছে। এছাড়া এ সূরায় অন্য কোনাে প্রসংগ আলােচিত হয়নি বললেই চলে। কেবল শেষের দিকে মােমেনদের অতি সংক্ষেপে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা যেন মুনাফিকদের সামান্যতম দোষেও দুষ্ট না হয়। এই সাথে কয়েকটি জিনিসকে মুনাফিকদের ন্যূনতম চারিত্রিক দোষ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহর জন্যে সর্বতােভাবে আত্মনিবেদিত না হওয়া, ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকার কারণে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কার্পণ্য প্রদর্শন করতে থাকা, যতােক্ষণ না মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসে- যেদিন কোনাে দানশীলতাই কাজে আসবে না। মুনাফিকী নামক রােগটা মুসলমানদের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে মদীনায় ইসলামের আগমনের সাথে সাথেই। রসূল(স.)-এর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে এবং বলতে গেলে কোনাে সময়ে তা পুরােপুরি নির্মূল হয়নি। অবশ্য সময়ে সময়ে তার বৈশিষ্ট্য, নিদর্শনাবলী ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। রসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় ইসলামের যে ঐতিহাসিক যুগটা অতিবাহিত হয়েছে, তার বিভিন্ন ঘটনাবলীতে এই রােগটার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মুসলমানদের চেষ্টা-সাধনা, সময় ও শক্তির এক বিরাট অংশ এই রােগের কবলে পড়ে নষ্ট হয়েছে। কোরআন ও হাদীসে এ রােগ সম্পর্কে এতােবার আলােচনা করা হয়েছে যে, তা দ্বারা বুঝা যায়, এ রােগটি কতাে সাংঘাতিক এবং তৎকালীন ইসলামী আন্দোলনের ওপর এর প্রভাব কতাে বেশী ছিলাে। অধ্যাপক মােহাম্মদ ইযযত দারুয়া লিখিত ‘সীরাতুর রাসূল, সুয়ারুম মুকতাবাসাতুম মিনাল কোরআনিল কারীম (কোরআনে রাসূল জীবনের কয়েকটি চিত্র) নামক গ্রন্থে মুনাফিকী সম্পর্কে একটি চমৎকার অধ্যায় রয়েছে। নিম্নে সেই অধ্যায় থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি… মদীনায় এই ব্যাধিটি ছড়িয়ে পড়ার কারণ সুবিদিত। রসূল(স.) ও প্রথম যুগের মুসলমানরা মক্কায় থাকাকালে এমন শক্তি সামর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন না যে, তাদের ভয়ে বা তাদের কাছ থেকে সুবিধা লাভের আশায় কেউ প্রকাশ্যে তাদের চাটুকারিতায় লিপ্ত হবে ও তাদের সাথে মিতালী পাবে, আর গােপনে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবে, ফন্দিফিকির আঁটবে ও ধােকাবাজি করবে, যেমনটি ছিলাে মুনাফিকদের সাধারণ স্বভাব। মক্কাবাসীরা ও বিশেষত তাদের নেতারা রাসূল(স.)-এর বিরােধিতা প্রকাশ্যেই করতাে, মুসলমানদের মধ্যে যাকে যতােটা পারতাে কঠোর নির্যাতন করতাে এবং কোনাে রকম রাখঢাক না করেই ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরােধ করতাে। শক্তি সামর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তি যা কিছু ছিলাে মক্কাবাসী কাফেরদেরই ছিলাে। শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা নিজেদের প্রাণ ও ঈমান বাঁচানাের জন্যে প্রথমে আবিসিনিয়ায় ও পরে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়। কেউবা কাফেরদের নৃশংসতা ও বল প্রয়ােগের কারণে, কেউবা প্রলােভন ও সন্ত্রাসের দরুন ইসলাম পরিত্যাগে বাধ্য হয়েছে, কেউবা পদদলিত হয়েছে, কেউবা দ্বার্থবােধক শব্দ উচ্চারণ করতে ও মােশরেকদের সাথে কপটতার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি কেউ কেউ ইসলামকে অবিচলভাবে আঁকড়ে ধরার ফলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করেছে। কিন্তু মদীনার পরিস্থিতি ছিলাে একেবারেই ভিন্ন রকমের । রাসূল(স.) মদীনায় হিজরত করার আগেই আওস এবং খাযরাজ গােত্রদ্বয় থেকে বেশ কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী ও জোরালাে সমর্থক লােক পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। মদীনায় নিজের অবস্থান সুসংহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং প্রায় প্রতিটি পরিবারে ইসলাম প্রবেশ না করা পর্যন্ত তিনি হিজরত করেননি। এরূপ পরিবেশে ইসলাম গ্রহণ করেনি এমন লােকদের পক্ষে এটা মােটেই সহজ ছিলাে না যে, তারা রাসূল(স.), মদীনার আদি অধিবাসী মুসলমান (আনসার) ও হিজরত করে আসা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরােধিতা ও শত্রুতামূলক অবস্থান গ্রহণ করবে, চাই তাদের ইসলাম গ্রহণ না করার কারণ অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা হােক অথবা ইচ্ছাকৃত হঠকারিতা, গােয়ার্তুমি, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষই হােক। সম্ভাব্য এই হঠকারিতা ও বিদ্বেষের কারণ এই যে, রসূল(স.)-এর আগমনে তাদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হওয়া যে অবধারিত তা তার আঁচ করতে পেরেছিলাে। প্রকাশ্য শত্রুতা করতে না পারার আরাে একটা কারণ এই যে, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে মদীনাবাসীর এক ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্কও সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলাে। কেননা, আওস ও খাযরাজের বেশীর ভাগ মানুষ মুসলমান হয়ে গিয়েছিলাে এবং তাকে সাহায্য করা ও সংরক্ষণ করার অংগীকারে আবদ্ধ ছিলাে। শুধু তাই নয়, তাদের অধিকাংশ ইসলামের প্রতি এত আন্তরিক ও একনিষ্ঠ ছিলাে যে, রাসূল(স.)-কে তারা শুধু আল্লাহর রসূলই মনে করতাে না, বরং নিজেদের সর্বোচ্চ নেতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শকও মনে করতাে এবং তাঁর আনুগত্য অনুসরণ অপরিহার্য বলে বিবেচনা করতাে। তাই যারা তখনাে শিরকের প্রতি অধিকতর ঝোঁক ও অনুরাগ পােষণ করতাে, অহংকার ও হিংসার ন্যায় মানসিক ব্যাধি তাদের মনের ওপর প্রবলতর প্রভাব বিস্তার করে রাখতে এবং এই ব্যাধি তাদের রসূল(স.), তার আন্দোলন ও তার প্রভাব প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে প্ররােচিত করতো, তাদের পক্ষে তাদের উক্ত ঝোঁক ও বিরােধিতার মনােভাব খােলাখুলিভাবে প্রকাশ করা সম্ভব ছিলাে না। ইসলামের প্রতি আনুগত্য লােক দেখানাে ভাবে হলেও জাহির না করে তাদের উপায় ছিলাে না। ইসলামের মৌলিক এবাদাতসমূহ পালন এবং তাদেরই স্বগােত্রীয় মুসলমানদের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিলাে না। আর তাদের ধােকা, শঠতা ও ষড়যন্ত্রগুলাে চরম জালিয়াতির মাধ্যমে ভিন্ন মােড়কে পেশ করতে তারা বাধ্য ছিলাে। কদাচিত তারা কোনাে প্রকাশ্য মুনাফিকী ও ভন্ডামিপূর্ণ আচরণ এবং ধােকা ও প্রবঞ্চনাপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করতাে বটে, তবে সেটা করতাে শুধুমাত্র কতিপয় সংকটজনক অবস্থাতেই যা রসূল(স.) ও মুসলমানদের ওপর সময় সময় আপতিত হতাে। আর এসব সংকটজনক পরিস্থিতিকে তারা তাদের আচরণের অজুহাত হিসাবে দাড় করাতাে। কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই তারা তাদের কুফরী বা মােনাফেকীর কথা স্বীকার করতাে না। তথাপি তাদের কুফরী, মুনাফি ও চক্রান্ত রসূল(স.) ও তার নিবেদিতপ্রাণ সাহাবীদের কাছে গােপন থাকতাে না। আর এই সংকটজনক অবস্থা তাদের প্রকাশ্য ইসলাম বিরােধী ভূমিকা ও আচরণ, তাদের কুফরী ও মুনাফিকের আরাে অপমানজনক এবং নিন্দনীয়ভাবে প্রকাশ করে দিতে। কোরআনের আয়াত ও তাদের নিন্দা ভৎর্সনা সহকারে বারংবার নাযিল হতাে এবং রসূল(স.) ও মুসলমানদের তাদের সম্পর্কে সাবধান করে দিতাে। মুনাফিকের আচরণ ও চক্রান্তের প্রভাব যে খুবই সুদূরপ্রসারী ছিলাে, সে কথা কোরআনের মদীনায় নাযিল হওয়া অংশ থেকে বুঝা যায়। এ অংশটি এমন একটি দুরন্ত সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে, যা রসূল(স.) ও মক্কার নেতাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সংঘাত স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশ্য মক্কার দুই পক্ষের ভূমিকা ও তার ফলাফল মদীনায় দুই পক্ষের ভূমিকা ও ফলাফল থেকে ভিন্নতর ছিল। কেননা, মদীনায় রাসূল(স.)-এর কেন্দ্র ক্রমেই শক্তিশালী, তার ক্ষমতা ক্রমেই সংহত এবং ইসলাম ক্রমেই প্রসার ও বিস্তার লাভ করতে থাকে। এখানে তিনি ছিলেন ক্ষমতাসীন ও পরাক্রান্ত শাসক, আর মুনাফিকদের না ছিলাে কোনাে সুসংগঠিত দল, না ছিলাে কোনাে খ্যাতিমান বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। উপরন্তু রসূল(স.)-এর পর্যায়ক্রমিক শক্তি বৃদ্ধি, ইসলামের বিকাশ ও বিস্তার এবং তার শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রসারের সাথে সাথে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিলাে তাদের দুর্বলতা, কমে যাচ্ছিলাে তাদের জনশক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তি। মুনাফিকদের ভূমিকা, বিশেষত সেই প্রাথমিক যুগের পটভূমিতে কতাে মারাত্মক ও ক্ষতিকর ছিলাে, তা বুঝার জন্যে এটুকু জানাই যথেষ্ট যে, (১) মুনাফিকদের যা কিছু শক্তি ও প্রতিপত্তি ছিলাে, তার প্রধান উৎস ছিলাে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক তাদের গোত্রসমূহের জনগণের মনে তখনাে অত্যন্ত শক্তভাবে বিরাজ করছিলাে। (২) তারা তখনাে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে পুরােপুরিভাবে চিহ্নিত ও কলংকিত হয়নি। (৩) মদীনার গােত্রসমূহের সাধারণ জনতার মনে ইসলাম তখনাে যথেষ্ট শক্তি নিয়ে বন্ধমূল হয়নি। (৪) রসূল(স.) চারদিক থেকে ইসলামের ঘােরতর শত্রু মােশরেকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। (৫) বিশেষত মক্কাবাসী তখনাে তাঁর কট্টরতম শত্রু ছিলাে। আরব দেশের কেন্দ্রভূমিতে তাদের অবস্থান ছিলাে। প্রতি মুহূর্তে তারা তার ক্ষতি সাধনে এবং সাধ্যে কুলালে তাকে সমূলে ধ্বংস করার সুযােগ সন্ধানে তৎপর ছিলাে। (৬) মদীনায় ও তার আশেপাশে ইহুদীরা শুরু থেকেই তাকে অস্বীকার এবং নিজেদের জন্যে অশুভ এবং অকল্যাণকর মনে করে আসছিলাে। এক পর্যায়ে তারা প্রকাশ্যভাবেই তাঁর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এবং শত্রুতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করতে আরম্ভ করে। (৭) এই পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে ও মুনাফিকদের মধ্যে ইসলামের বিরােধিতা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানাের ব্যাপারে একাত্মতা, চেষ্টার ঐক্য এবং স্বাভাবিক মৈত্রী গড়ে ওঠে। এক কথায় বলা চলে, ইহুদীদের পক্ষ থেকে সহযােগিতা, সমর্থন ও শক্তি অর্জন করা ছাড়া মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে এতােটা শক্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারতাে না, এতােটা মারাত্মক নির্যাতনকারী বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকের ভূমিকা পালন করতে পারতাে না, যেটা কার্যত করতে পেরেছিলাে। আর রসূল(স.)-কে আল্লাহ তায়ালা পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও প্রতাপ দান করে তাদের ওপর বিজয়ী করা এবং তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার পূর্ব পর্যন্ত তাদের শক্তি কিছুমাত্র স্তিমিত হয়নি, তাদের দিক থেকে ভয় ভীতি মোটেই হ্রাস পায়নি।(মুহাম্মাদ ইজ্জত দারুশার উক্ত গ্রন্থের ১৭৬ থেকে ২১৬ পৃঃ দ্রষ্টব্য)
ফী জিলালিল কুরআন:

সূরার শুরুতেই বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে মুনাফিকরা তাদের অন্তরে কুফরী পুষে রাখতাে, মুখে ইসলামের ঘােষণা দিত এবং রসূল(স.)-কে আল্লাহর রাসূল বলে মিথ্যামিথ্যি কসম খেয়ে স্বীকৃতি দিতাে, যাতে মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস করে। এভাবে তারা তাদের এই কসম খাওয়াকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতাে এবং এর আড়ালে তাদের প্রকৃত অবস্থা লুকিয়ে মুসলমানদের ধােকা দিত।  *মুনাফিকী চরিত্রের বিশ্লেষণ : ‘যখন মুনাফিকরা তােমার কাছে আসে তখন বলে, আমরা আপনাকে আল্লাহর রসূল বলে সাক্ষ্য দিচ্ছি। অথচ আপনি যে আল্লাহর রসূল সে কথা তাে আল্লাহ জানেনই। আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথকে ঢাল হিসাবে গ্রহণ করছে এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তারা যে কাজ করে থাকে, তা কতাে জঘন্য। তারা রসূল(স.)-এর কাছে আসতাে এবং তার সামনে তার রেসালাতের পক্ষে মৌখিক সাক্ষ্য দিতাে। এ দ্বারা সত্যের প্রতি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা প্রকাশ করা তাদের কাম্য ছিলাে না। কেবল চলমান সমাজের ঘৃণা ও গণরােষ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই তারা এরূপ করতাে। মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের প্রকৃত মনােভাব গােপন করাই ছিলাে তাদের আসল উদ্দেশ্য। তারা রাসূল(স.)-এর রেসালাতের সাক্ষ্য দিতে এসেছে বলে যে উক্তি করতাে, তা ছিলাে তাদের নির্জলা মিথ্যাচার। আসলে তারা এসেছিলাে মুসলমানদের ধােকা দিতে এবং নিজেদের মনকে সান্তনা দিতে। এজন্যে আল্লাহর রসূলের রেসালাত যে অকাট্য ও চরম সত্য, তা প্রথমে ঘােষণা করে আল্লাহ তায়ালা তাদের সাক্ষ্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।’ এখানে এমন সূক্ষ্ম ও সতর্ক ভাষা প্রয়ােগ করা হয়েছে, যা মুনাফিকদের বক্তব্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করার আগে রেসালাতকে সত্য প্রমাণ করা হয়েছে। অন্যথায় বাহ্যত প্রতীয়মান হতাে যে, মুনাফিকরা যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে সেটাই মিথ্যা। অথচ সেটা বলা উদ্দেশ্য নয়। যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা এই যে, রেসালাতের প্রতি ঈমান আনা সংক্রান্ত তাদের ঘোষণাটা মিথ্যা। তারা আন্তরিকভাবে এ ঘােষণা দেয় না এবং প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মদ(স.)-কে রাসূল বলে মানে না। তারা তাদের শপথকে ঢাল বানিয়ে নিয়েছে। এ বাক্য দ্বারা বুঝা যায়, যখনই তাদের প্রকৃত মনােভাব ফাঁস হয়ে যেতাে, তাদের কোনাে চক্রান্ত বা দুরভিসন্ধি জানাজানি হয়ে যেতাে এবং মুসলমানদের মধ্যে তাদের সম্পর্কে কোনাে খারাপ খবর প্রচারিত হতাে, তখনই তারা কসম খেয়ে খেয়ে তা অস্বীকার করতাে, যাতে সেসব গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার কুফল থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। এভাবে তারা তাদের শপথ বা কসমকে ঢাল বানিয়ে তার আড়ালে লুকাত, যাতে মুসলমান সমাজের সাথে প্রতারণা অব্যাহত রাখা যায়। ‘অতপর তারা আল্লাহর পথ থেকে ফেরাতাে।’ অর্থাৎ এই মিথ্যা শপথের সাহায্যে নিজেদেরও ফেরাতাে, অন্যদেরও ফেরাতাে। নিশ্চয় তারা খুবই জঘন্য কাজ করতাে। বস্তুত মিথ্যাচার, ধােকাবাজি ও জালিয়াতির মতাে জঘন্য কাজ আর কী হতে পারে? পরবর্তী আয়াতে মুনাফিকদের এই অবস্থার অর্থাৎ মিথ্যা সাক্ষ্যদান, মিথ্যা ও শঠতাপূর্ণ কসম খাওয়া, আল্লাহর পথ থেকে ফেরানাে ও জঘন্য কার্যকলাপের কারণ দর্শানাে হয়েছে। সে কারণ এই যে, তারা ঈমান আনার পর এবং ইসলামকে জানা ও বুঝার পর কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে। ‘এর কারণ এই যে, তারা প্রথমে ঈমান এনেছিলাে, তারপর কাফের হয়েছে। ফলে তাদের হৃদয়ে সিল মেরে দেয়া হয়েছে। তাই এখন তারা আর বুঝতে পারে না।'(আয়াত-৩) অর্থাৎ তারা ঈমান কী জিনিস তা জানতাে, কিন্তু তা সত্তেও তারা ঈমান ছেড়ে কুফরীতে প্রত্যাবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাে। ঈমান কী জিনিস তা জানা এবং জানার পর কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন এমন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব, যার হৃদয়ে কিছুমাত্র উপলব্ধি, অনুভূতি অথবা জীবনীশক্তি আছে। জগত ও জীবন সম্পর্কে যার ইসলামী ধারণা বিশ্বাস, ইসলামী চেতনা-অনুভূতি আছে, যে ইসলামের আলােকোজ্জ্বল ও শীতল পরিবেশে জীবন ধারণ করেছে, সে কিভাবে কুফরীর কালাে ও অশুভ পরিবেশে ফিরে যেতে পারে? এটা একমাত্র সে ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যার জ্ঞানবুদ্ধি ও চেতনা বিকৃত হয়ে গেছে, ফলে সে সত্য উপলব্ধি করতে পারে না এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে তা দেখতে পায় না। আয়াতে ‘সিল মারা’ বলতে চেতনা, রুচি ও বােধশক্তির এই বিকৃতিকেই বুঝানাে হয়েছে, যার দরুন সত্যকে আর চেনা ও বুঝা সম্ভব হয় না। ৪ নং আয়াতে এই বিকৃত রুচি ও চেতনাসম্পন্ন মানুষের এক বিস্ময়কর এবং হাস্যকর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ‘তুমি যখন তাদের দেখবে, তখন তাদের দেহ দেখে তুমি বিস্মিত হবে…’ অর্থাৎ তাদের দেখে মনে হবে, তাদের যেন নিশ্চল নিথর দেহখানাই একমাত্র সম্বল, প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এমন কোনাে সচেতন মানবীয় সত্ত্বা যেন তাদের নেই। যতােক্ষণ তারা চুপ থাকে ততােক্ষণ দর্শকদের চোখে তাদের নাদুস নুদুস দেহ বেশ চিত্তাকর্ষক লাগে। কিন্তু যখনই তারা কথা বলে অমনি মনে হয়, তারা একেবারেই তাৎপর্যহীন, চেতনাহীন ও বােধশক্তিহীন। তাদের কথা শুনে তােমার মনে হবে যেন তারা নিশ্চল, নিথর ও দেয়ালে হেলিয়ে রাখা কাঠ মাত্র। এই নিথর নিস্তব্ধ জড়তা একদিকে তাদের আত্মােপলব্ধির ইংগিতবহ যদি আগে তাদের কোনাে আত্মা থেকে থাকে! অপরদিকে এক ধরনের সার্বক্ষণিক সতর্কতা এবং আতংকেরও ইংগিতবহ, যে আয়াতের নিম্নোক্ত বাক্য দ্বারা বুঝানাে হয়েছে, ‘তারা প্রতিটি ধ্বনিকে নিজেদের জন্যে বিপজ্জনক মনে করে।’ অর্থাৎ যেহেতু নিজেদের সম্পর্কে তাদের এতােটুকু জানা আছে যে, তারা বর্ণচোরা মুনাফিক এবং মিথ্যে শপথ ও লােক দেখানাের পাতলা আবরণের আড়ালে আত্মগােপনকারী। তাই প্রতি মুহূর্তে তারা শংকিত থাকে যে, এই বুঝি তাদের সমস্ত গুপ্তভেদ ফাঁস হয়ে গেলাে, এই বুঝি তাদের ভন্ডামির রহস্য উদঘাটিত হয়ে গেলাে! আয়াতের উল্লিখিত বাক্যটির বর্ণনাভংগি থেকে মুনাফিকদের এরূপ একটি চিত্র ফুটে ওঠেছে যে, তারা যেন ভীত সন্ত্রস্ত মনে অনবরত চারপাশে তাকাতে থাকে এবং প্রতিটি শব্দ থেকেই তাদের মনে হতে থাকে, তাদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে কেউ বুঝি তাদের পাকড়াও করার জন্যে খোঁজাখুঁজি করছে। নিজেদের পাপ ও অপরাধপ্রবণ মানসিকতার উপলব্ধি থেকে যখন তারা কাষ্ঠের মতাে জড়তা ও স্থবিরতায় ভােগে, আর নিজেদের জান ও মালের ভয়ে যখন তারা বায়ুপ্রবাহে দোদুল্যমান বাঁশের মতাে দুলতে থাকে, উভয় অবস্থাতেই তারা রসূল(স.) ও মুসলমানদের এক নম্বর দুশমন হিসাবে বিরাজ করে। এ কথাই বলা হয়েছে পরবর্তী বাক্যটিতে- ‘তারা দুশমন, সুতরাং তাদের থেকে সাবধান হও।’ অর্থাৎ তারা আসল শক্র। তারা গৃহ শক্র বিভীষণ। প্রকাশ্যভাবে বিরাজমান বহিঃশত্রুর চেয়েও তারা মারাত্মক। লক্ষণীয় যে, এখানে তাদের থেকে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। রসূল(স.)-কে বলা হয়নি যে তাদের হত্যা করাে। বরঞ্চ একটি ভিন্নতর পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের সাথে আচরণ করা হয়েছে, যা উদারতা, বিচক্ষণতা ও তাদের চক্রান্ত থেকে মুক্তির পথনির্দেশক (শীঘ্রই এ ধরনের আচরণের একটি নমুনা তুলে ধরা হবে)। আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন তারা যেখানেই থাক না কেন বস্তুত আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন, তারা যেখানে যে অবস্থায়ই অবস্থান করুক না কেন। আল্লাহর পক্ষ থেকেই যুদ্ধ করুন বলে যখন দোয়া করা হয়েছে, তখন বুঝতে হবে, যুদ্ধ পরিচালনার ফয়সালা হয়ে গেছে এবং সে ফয়সালা আর কেউ রুখতে বা বদলাতে পারবে না। কার্যত এটাই হয়েছিলাে তাদের চূড়ান্ত পরিণতি।

ফী জিলালিল কুরআন:

*মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ বিন উবাই : এই চারটি আয়াতে মুনাফিকদের এই দ্বিমুখী মানসিকতা, রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে। চক্রান্ত আঁটা এবং সামনাসামনি মিথ্যা বলার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এগুলাে মুনাফিকদের সুপ্রসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। যখন তাদের বলা হয়, ‘এসাে, রাসূল তােমাদের জন্যে ক্ষমা চাইবেন…’ একাধিক প্রাচীন তাফসীরকার বলেছেন, এ আয়াতগুলাে সবই নাযিল হয়েছে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল প্রসংগে। ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক বনুল মুসতালিক যুদ্ধের বিবরণ দিতে গিয়ে নাযিল হওয়ার সেই পটভূমি বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ৬ষ্ঠ হিজরীতে বনুল মুসতালিকের একটি জলাশয়ের কাছে এই ঘটনা ঘটে। যুদ্ধ শেষে রসূল(স.) যখন উক্ত জলাশয়ের পাশে অবস্থান করছেন, তখন মুসলমানদের একটি দল সে জলাশয়ে পানি আনতে গেলাে। হযরত ওমরের সংগে ছিলো তাঁর একজন বেতনভুক্ত ভৃত্য- বনু গিফার গােত্রের জাহজাহ ইবনে মাসউদ। সে তার ঘােড়া নিয়ে জলাশয়ে গেলাে। সেখানে সিনান ইবনে ওয়াবার জুহানীর সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়। অতপর তারা উভয়ে লড়াই বাধিয়ে বসে। সিনান ছিলাে আনসারী অর্থাৎ মদীনার স্থানীয় অধিবাসী, আর জাহজাহ মক্কা থেকে আগত মোহাজের। প্রথমে সিনান চিৎকার করে ওঠলাে, ‘ওহে আনসারীরা, কে কোথায় আছে, আমাকে বাচাও। অতপর জাহজাহ চিতকার করলাে, ওহে মােহাজেররা, কে কোথায় আছে, আমাকে রক্ষা করাে।’ মুনাফিকদের নেতা হিসাবে পরিচিত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল এতে মদীনার স্থানীয়দের পক্ষ নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলাে। তার সাথে তার স্বগােত্রীয় কয়েকজন ছিলাে। তাদের মধ্যে যায়দ ইবনে আরকাম নামক একজন নবীন যুবক ছিলাে। তাদের লক্ষ্য করে আবদুল্লাহ বললাে, ওরা (মােহাজেররা) এ কান্ডটা ঘটিয়েই ছাড়লাে? ওরা আমাদের দেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এখন তাে সংখ্যায়ও ওরা বিরাট এক গােষ্ঠী। আল্লাহর কসম, এই প্রবাসী কোরায়শদের ও আমাদের অবস্থা সেই প্রবাদ বাক্যের মতােই হতে যাচ্ছে, তা আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। প্রবাদে আছে, তােমার কুকুরটাকে খাইয়ে-দাইয়ে মােটাতাজা বানাও, যেন সে একদিন তােমাকেই খেয়ে সাবাড় করে। আল্লাহর কসম করে বলছি, এবার মদীনায় ফিরে গেলে সবলেরা দুর্বলদের সেখান থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবে। তারপর সে তার আশপাশে জড়াে হওয়া স্বগােত্রীয়দের দিকে তাকিয়ে বললাে, ‘এ সব তােমাদেরই কর্মফল। তোমরা এদের তোমাদের এলাকায় থাকতে দিয়েছ। তাদের তােমাদের জমিজমা, সহায় সম্পদ ভাগ করে দিয়েছে। আল্লাহর কসম, তােমরা যদি তাদের সহায়তা না করতে এবং আশ্রয় না দিতে, তাহলে তারা অন্যত্র চলে যেতাে। যায়দ ইবনে আরকাম তার এ কথাগুলাে শুনে রাসূল(স.)-কে গিয়ে জানালো। তখন রসূল(স.) শত্রুদের সাথে বােঝাপড়া শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তার কাছে ওমর ইবনুল খাত্তাবও ছিলেন। ওমর(রা.) বললেন, ‘হে রসূল, উব্বাদ বিন বিশরকে আদেশ দিন ওকে (আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে) হত্যা করে ফেলুক। রসূল(স.) বললেন, ওহে ওমর! লােকেরা যখন বলবে মােহাম্মদ নিজের সহচরদের হত্যা করে, তখন কেমন হবে? এটা করা যাবে না। তুমি বরং লােকদের জানিয়ে দাও, অবিলম্বে এখান থেকে প্রস্থান করা হােক। অথচ রসূল(স.) সচরাচর এ রকম সময়ে কোথাও রওনা হতেন না। অগত্যা লােকেরা রওনা হলাে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখন জানতে পারলাে, যায়দ বিন আরকাম তার কথাগুলাে রসূল(স.)-কে জানিয়ে দিয়েছে। তখন সে রসূল(স.)-এর কাছে ছুটে গেলাে এবং কসম খেয়ে বলতে লাগলাে, যায়দ যা বলেছে তা ঠিক নয়। আমি ওসব কথা বলিনি। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিজ গােত্রে একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি ছিলাে। উপস্থিত আনসারী সাহাবীরা বললেন, ‘হে রসূলুল্লাহ যায়দ হয়তাে বা ভুল শুনেছে। হয়তাে বা এই ব্যক্তি যা বলেছে তা হুবহু মনে রাখতে পারেনি।’ এভাবে তারা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ করলেন ও তাকে রক্ষা করলেন। ইবনে ইসহাক বলেন, অতপর যখন রসূল(স.) রওনা হলেন, তখন ওসায়দ বিন হুযায়র নামক জনৈক আনসারী সাহাবী তাঁর সাথে সাক্ষাত করে বললেন, ‘হে রসূল! আপনি খুবই অসময়ে রওনা দিয়েছেন। ইতিপূর্বে আপনি কখনাে এমন সময়ে কোথাও যাত্রা করতেন না।’ রসূল(স.) বললেন, তােমাদের সংগী কী বলেছে শোননি? ওসায়েদ : কোন সংগী হে রাসূল। রসূল(স.) : আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। উসায়দ, সে কী বলছে? রাসূল (স.) : সে বলেছে, মদীনায় গেলে সবলরা দুর্বলদের সেখান থেকে বের করে দেবে। ওসায়দ : হে রসূল, আল্লাহর কসম, আপনি ইচ্ছা করলে এ ব্যাটাকে মদীনা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। কেননা, আপনি সবল আর সে দুর্বল। তবে হে রসূল, আপনি ওর প্রতি একটু উদারতা প্রদর্শন করুন। আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের কাছে আপনাকে এমন সময়ে এনে দিয়েছেন, যখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর গােত্র তাকে মুকুট পরিয়ে রাজা হিসাবে বরণ করে নেয়ার জন্যে উৎসবের আয়ােজন করছিলাে। এ জন্যে সে মনে করে আপনি তার রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। এরপর রসূল(স.) সদলবলে সন্ধ্যা পর্যন্ত আবার সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত এবং সকাল থেকে সূর্যের কিরণ প্রখর হওয়া পর্যন্ত এক টানা পথ চললেন। অতপর এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলেন। প্রচন্ড ক্লান্তির কারণে তারা সেখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন। রসূল(স.)-এর এই অসময়ের যাত্রার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলাে এই যে, তার সফর সংগীদের মনে আগের দিন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর কথা শুনে যে ক্ষোভ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়েছিলো, তা যেন তারা ভুলে যায় এবং তাদের মন অন্য বিষয়ে ব্যস্ত হয়। ইবনে ইসহাক বলেন, যে সূরাটিতে আল্লাহ তায়ালা মােনাফেকদের বিষয়ে আলােচনা করেছেন, তা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সমতুল্য লােকদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। সূরাটি নাযিল হবার পর রাসূল(স.) যায়দ ইবনে আরকামের কান ধরে (আদর করে) বললেন, এই হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে নিজের কান দিয়ে আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে।’ ইতিমধ্যে আবদুল্লাহ বিন উবাইর ছেলে আবদুল্লাহর কাছেও তার পিতার দুষ্কর্মের খবর পৌঁছে গেলো। ইবনে ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর ছেলে আবদুল্লাহ রসূল(স.)-এর কাছে এসে বললাে, ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি শুনেছি, আপনি আমার পিতা আবদুল্লাহ সম্পর্কে যা জানতে পেরেছেন তার জন্যে তাকে হত্যা করতে চান। এটা যদি আপনি করতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকেন, তাহলে আমাকেই আদেশ করুন। আমি তার মাথা আপনার কাছে নিয়ে আসি। আল্লাহর কসম, খাযরাজ গোত্র জানে, এ গোত্রে আমার চেয়ে অধিক পিতৃভক্ত কোনাে লােক নেই । তথাপি আপনি আদেশ দিলে এ কাজ আমাকেই করতে হবে। কেননা, আমার আশংকা, আপনি যদি আমাকে ছাড়া আর কাউকে আদেশ দিয়ে এ কাজ করান, তাহলে আমি আমার পিতার হত্যাকারীকে চোখের সামনে ঘােরাঘুরি করতে দেখে একদিন হয়তাে হত্যা করে বসবাে এবং একজন কাফেরের বদলায় মােমেনকে হত্যা করে জাহান্নামের কাঠ হবো। রসূল(স.) বললেন, ‘না, ওসবের দরকার নেই। আমরা বরঞ্চ তার প্রতি উদারতা দেখাতে থাকি এবং যতােদিন সে আমাদের সাথে থাকে ততােদিন তার সাথে ভালাে আচরণ করে যেতে থাকবাে।’ এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখনই কোনাে অপকীর্তি ঘটাতাে, অমনি তার গােত্রের লােকেরাই তাকে পাকড়াও করতাে ও তিরস্কার করতাে। তখন রাসূল(স.) ওমর ইবনুল খাত্তাবকে ডেকে বলতেন, ‘কেমন দেখছাে ওমর! আল্লাহর কসম, যেদিন তুমি ওকে হত্যা করতে চেয়েছিলে, সেদিন যদি হত্যা করতে, তবে ওর জন্যে পাহাড়ের চূড়াগুলাে পর্যন্ত শিউরে ওঠতাে, কিন্তু আজ আমি যদি সেসব পাহাড়ের চূড়াকে আদেশ দেই, তবে তারাই ওকে হত্যা করবে।’ এরপর যখন রাসূল(স.)-এর সহযাত্রী মােজাহেদরা মদীনায় প্রবেশ করতে লাগলাে, তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর ছেলে আবদুল্লাহ মদীনার দ্বারপ্রান্তে নগ্ন তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। লােকজন তার সামনে দিয়ে যেতে লাগলাে। যখন তার পিতা আসলাে, অমনি পুত্র বলে ওঠলাে, থামুন! সে বললো, কী হয়েছে। পুত্র বললাে, যতােক্ষণ রসূলুল্লাহ(স.) আপনাকে মদীনায় প্রবেশের অনুমতি না দেবেন, ততােক্ষণ আপনি প্রবেশ করতে পারবেন না। কেননা, তিনি সবল, আপনি দুর্বল। এই সময়ে রসূল(স.) পশ্চাদবর্তী বাহিনীর সাথে ছিলেন এবং কেউ পেছনে পড়ে রইলাে কিনা, নিখোঁজ হলো কিনা, বা কারাে কোনাে সাহায্যের দরকার আছে কিনা, তার খোঁজখবর নিতে নিতে এখানে এসে পড়লেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার কাছে স্বীয় পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযােগ করলাে। তার পুত্র আবদুল্লাহ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তিনি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবেন না। রসূল(স.) তাকে অনুমতি দিলেন। তখন আবদুল্লাহ বললেন, ঠিক আছে। রসূল(স.) যখন আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন, তখন যেতে পারেন।'{উল্লেখ্য যে, এই যুদ্ধ থেকে ফেরার পরই হযরত আয়শার বিরুদ্ধে অপবাদ রচনার সেই কুখ্যাত ঘটনাটা ঘটে এবং তার প্রধান হােতা ছিলাে এই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-গ্রন্থকার} এখানে আমরা একবার সে সময়কার ঘটনাবলীর দিকে, একবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দিকে এবং এর কোরআনের বক্তব্যের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা রসূল(স.)-এর জীবনাদর্শ, আল্লাহর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং বিশ্ব পরিচালনায় আল্লাহর বিস্ময়কর পরিকল্পনার সাক্ষাত পাই। অপরদিকে দেখতে পাই, মুসলিম সমাজে কিভাবে মুনাফিকরা অনুপ্রবেশ করে, কিভাবে তারা স্বয়ং রাসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় মুসলিম সমাজে প্রায় দশ বছর যাবত অবস্থান করে, অথচ তিনিও তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করেন না, আল্লাহও তাদের মৃত্যুর সামান্য আগে ছাড়া তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করেন না। যদিও রসূল(স.) তাদের কথার সুর শুনে, চালচলন, হাবভাব, গতিবিধি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি দেখেই তাদের চিনতেন। এর কারণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা চান না মানুষেরা নিজেরাই একে অপরের মনের ওপর খবরদারী করুক। কেননা, মানুষের মনের উপর আল্লাহর একচ্ছত্র ও নিরংকুশ আধিপত্য অধিকার বিদ্যমান। তিনিই জানেন কার মনে কী আছে এবং তিনিই তার হিসাব নিকাশ নেবেন। মানুষের কর্তব্য হলাে, অন্য মানুষের কেবল বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনায় আনা, আভ্যন্তরীণ অবস্থা নয়। মানুষ অন্য মানুষের ওপর নিজের ধারণা অনুযায়ী কোনাে অভিযােগ আরােপ বা বিচার ফয়সালা করার অধিকারী নয়। এমনকি আমরা এও দেখতে পাই, আল্লাহ তায়ালা যখন রসূল(স.)-কে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুনাফিক সুলভ আচরণকারী লােকগুলাের পরিচয় জানিয়ে দিয়েছেন, তখনও তিনি তাদের বাহ্যিক ইসলামী চালচলন ও ইসলামের ফরযসমূহ পালনরত থাকা অবধি তাদের মুসলিম সমাজ থেকে বহিষ্কার করেননি। এই সকল মুনাফিককে শুধু রসূল(স.) চিনতেন এবং তিনি মাত্র একজন সাহাবীকে তাদের পরিচয় জানিয়েছেন। এই সাহাবী ছিলেন হােযায়ফা ইবনুল ইয়ামান(রা.)। সাধারণ মুসলমানদের কাছে এটা প্রকাশ করেননি। এমনকি হযরত ওমর(রা.) পর্যন্ত হােযায়ফার কাছে এসে নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন, রাসূল(স.) তাকে মুনাফিক হিসাবে চিহ্নিত করেননি তাে! হােযায়ফা শুধু বলতেন, ‘হে ওমর! আপনি তাদের অন্তর্ভুক্ত নন। এর বেশী একটি কথাও বলতেন না। রাসুল(স.)-কে কোনাে মুনাফিকের জানাযার নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছিলাে। যখন রসুল(স.) কারাে জানাযার নামায পড়া থেকে বিরত থাকতেন, কেবল তখনই মুসলমানরা একজন মুনাফিককে চিনতে পারতেন। রাসূল(স.)-এর ইন্তেকালের পর হােযায়ফা যাকে যাকে মুনাফিক বলে জানতেন তাদের জানাযা পড়তেন না। আর হযরত ওমর(রা.) যতােক্ষণ পর্যন্ত কোনাে জানাযার নামাযে হােযায়ফা(রা)-কে উপস্থিত না দেখতেন, ততােক্ষণ তিনিও সেই জানাযা পড়তেন না। হােযায়ফাকে দেখলেই নিশ্চিত হতেন, মৃত ব্যক্তি মুনাফিক গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। তাকে না দেখলে সেখান থেকে নীরবে কেটে পড়তেন। মুসলিম সমাজের চরিত্র গঠন এবং তাদের সুষ্ঠু ইসলামী আচরণ ও নীতিমালা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তায়ালা সুপরিকল্পিতভাবে এই রীতির প্রচলন করেছিলেন।  *দ্বীনের কারণে পিতৃহত্যাও সহজ হয়ে যায় : আলােচ্য আয়াতগুলাে নাযিল হওয়ার উপলক্ষ এই ঘটনাটিতে প্রচুর শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল রসূল(স.)-এর একেবারে কাছাকাছিই অবস্থান করত এবং মুসলমানদের মধ্যেই থাকতাে। ইসলামের সত্যতা ও রাসূল(স.)-এর রেসালাতের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তার সামনে অগণিত অকাট্য সাক্ষ্য প্রমাণ নিরন্তর উপস্থিত হতাে। কিন্তু আল্লাহ তার হৃদয়কে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করলেন না। কেননা, এই মহান নেয়ামত আল্লাহ তার জন্যে বরাদ্দ করেননি। তার এই অমূল্য সম্পদ লাভের পথে একমাত্র অন্তরায় ছিলাে তার মনের এই আক্ষেপ, রাসূল(স.) মদীনায় আগমন করায় তার আওস ও খাযরাজের রাজা হওয়ার সাধ ধুলায় মিশে গেলে। মদীনায় ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটছিলাে, অথচ সে ইসলামের আলাে থেকে বঞ্চিত থেকে গেলাে। পক্ষান্তরে তার ছেলে আবদুল্লাহ নিষ্ঠাবান ও অনুগত মুসলমানের এক মহিমান্বিত ও উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। নিজের পিতার কার্যকলাপ ও আচরণে তিনি দুঃখিত, লজ্জিত ও বিব্রত। তা সত্তেও একজন পিতৃভক্ত পুত্রের ন্যায় তার অন্তরে পিতার প্রতি ভালােবাসা সুপ্ত থাকে। যখন শুনলেন, তার পিতাকে রাসূল(স.) হত্যা করতে চান, তখন তার মন পরস্পর বিরােধী আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ও দৃঢ়তার সাথে এই উভয় সংকট নিরসন করেন। তিনি ইসলামকে ভালােবাসেন, রসূলের আনুগত্য পছন্দ করেন এবং তাঁর আদেশ যদি তার পিতার বিরুদ্ধেও যায় তথাপি কামনা করেন, তা কার্যকর হােক। তবে অন্য কেউ উদ্যোগী হয়ে তার পিতাকে হত্যা করুক এবং তারপর তার সামনে দিয়ে বহাল তবিয়তে বিচরণ করতে থাকুক এটা তিনি বরদাশত করতে অক্ষম। তিনি আশংকা করেন, তেমনটি ঘটলে তার প্রবৃত্তি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসতে পারে এবং তিনি বংশীয় কৌলীন্য ও জিঘাংসার শয়তানের কাছে পরাভূত হতে পারেন। তাই তিনি তার মনের এই দ্বিমুখী টানাপড়েন থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে স্বীয় রাসূল ও নেতার সাহায্য কামনা করেন। তিনি তাকে অনুরােধ করেন, যদি কাজটা তার করতেই হয় তবে তিনি যেন তাকেই তার (পিতার হত্যার) আদেশ দেন। তিনি রসূল(স.)-কে আশ্বাস দেন, তিনি তার আদেশ সর্বতােভাবে পালন করবেন এবং তার মাথা রসূল(স.)-এর দরবারে হাযির করবেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলাে অন্য কেউ যেন এ কাজ না করে এবং তিনি তার পিতৃহন্তাকে ঘােরাফেরা করতে দেখে হত্যা করে জাহান্নামী হতে বাধ্য না হন। মানুষের মনে যে কি বিস্ময়কর ঈমান থাকতে পারে, এ ঘটনা থেকে তাও পরিষ্কারভাবে জানা যায়। এই তরুণ সাহাবী রসূল(স.)-এর সাথে সাক্ষাত করে পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দাবী জানান, যে কাজটি তার জন্যে সবচেয়ে কষ্টকর, তা অর্থাৎ তার পিতাকে হত্যা করার কাজ তাকেই অর্পণ করা হােক। কেননা, এ দ্বারা তিনি এর চেয়েও কষ্টকর ও মারাত্মক পরিণতি থেকে নিষ্কৃতি পেতে চান। সেই পরিণতি হলাে, মানবীয় দুর্বলতা ও ঝোঁকের বশে একজন কাফেরের বদলায় একজন মােমেনকে হত্যা করে অবধারিতভাবে জাহান্নামে যাওয়া। আপন পিতার প্রতি মানবীয় দুর্বলতা ও অনুরাগের মােকাবেলা করতে যেয়ে তিনি বিস্ময়কর সত্যবাদিতা ও স্পষ্টভাষিতার পরিচয় দেন। তিনি বলেন, ‘আমার চেয়ে পিতৃভক্ত ছেলে যে খাযরাজ গোত্রে নেই, তা গােটা খাযরাজ গোত্রের কাছে সুবিদিত।’ অতপর তিনি স্বীয় নবী ও নেতার কাছে এই মর্মে সাহায্য চান যেন তিনি তাকে এই উভয় সংকট থেকে উদ্ধার করেন। অথচ ঘূর্ণাক্ষরেও এ দাবী জানান না যে, তার পিতার হত্যার আদেশ প্রত্যাহার বা পরিবর্তন করা হােক; বরং আদেশকে তিনি শিরােধার্য মেনে নিয়েছেন বরং তা কার্যকর হতেই হবে বলে দ্ব্যর্থহীন মত দিয়েছেন। যে বিষয়টা তিনি চেয়েছেন তা হচ্ছে, আদেশটি কার্যকর করার দায়িত্ব তাকেই দেয়া হােক এবং তিনি নিজেই তার মাথা কেটে আনবেন। অন্যদিকে দয়া ও মহানুভবতার মূর্ত প্রতীক রসূল(স.) ঈমানী তেজোদ্দীপ্ত এই যুবকের উভয় সংকট উপলব্ধি করে তাকে পরম উদারতা ও সহনশীলতা সহকারে জানান, আমরা বরং তার সাথে উদার আচরণ করবাে এবং যতদিন সে আমাদের সাথে থাকে, ততােদিন তার সাথে ভালাে ব্যবহার করবো। ইতিপূর্বে তিনি ওমর ইবনুল খাত্তাব(রা.)-কে এই বলে হত্যা থেকে বিরত রাখেন যে, হে ওমর! লােকেরা যখন বলাবলি করবে, মােহাম্মদ(স.) নিজের সহচরদের হত্যা করে, তখন কেমন হবে? এরপর রসূল(স.) অসময়ে যাত্রা করা এবং ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত সফর অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে একদিকে যেমন গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন, অপরদিকে তেমনি আল্লাহর ইংগিতও কার্যকর করেন। এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিলাে মুসলিম বাহিনীর মনােযােগ আঞ্চলিক ও গােষ্ঠীগত বিদ্বেষের নােংরামি থেকে ভিন্ন দিকে ফেরানাে। একজন আনসার যখন ‘হে আনসাররা আমাকে বাঁচাও’ এবং একজন মােহাজের ‘হে মােহাজেররা আমাকে বাঁচাও’ বলে চিৎকার দিয়েছিলাে তখনই এই নােংরা আঞ্চলিক ও গােষ্ঠী বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছিলাে। মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল আনসার ও মােহাজেরদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার যে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিলাে, তা নস্যাৎ করে দেয়াও উক্ত পদক্ষেপের অন্যতম লক্ষ্য ছিলাে। বস্তুত এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিলাে গােটা মানব জাতির ইতিহাসে এবং আদর্শগত আন্দোলনের ইতিহাসে নযীরবিহীন। এ ঘটনার মধ্যে রসূল(স.) ও ওসায়দ ইবনে হােযায়র(রা.)-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত কথাবার্তাও খুবই শিক্ষাপ্রদ। এই সংক্ষিপ্ত কথােপকথনের মধ্যে একদিকে যেমন সে ষড়যন্ত্র প্রতিরােধের মানসিক প্রস্তুতি নিহিত ছিলাে, তেমনি এই ষড়যন্ত্রের হােতাকে প্রতিহত করার উদ্যোগ ও ছিল। অথচ এ কাজটি সহজ ছিলাে না। কেননা, ষড়যন্ত্রের হােতা নিজ গােত্রের ইসলাম গ্রহণ করার পরও তাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলাে। সর্বশেষে আরাে একটি বিস্ময়কর দৃশ্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তা হচ্ছে, মােনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-র ঈমানদার ছেলে আবদুল্লাহর দৃঢ়তা। আবদুল্লাহ নিজের তরবারি হাতে নিয়ে পিতাকে শহরে ঢুকতে না দেয়ার অভিপ্রায়ে মদীনার প্রবেশদ্বারে দাড়িয়ে গেলেন। কেননা, তার পিতা বলেছিলাে, ‘সবল দুর্বলকে মদীনা থেকে বের করে দেবে। আবদুল্লাহ তার পিতার এই উক্তিকেই সত্য প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, যাতে সে নিশ্চিত হতে পারে যে, রসূলুল্লাহ(স.) যথার্থই সবল এবং আবদুল্লাহ ইবনে উবাই দুর্বল। তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন, রসূল(স.) মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে তার পিতাকে শহরে প্রবেশের অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত তিনি প্রবেশ করতে দেবেন না। তিনি অনুমতি দেবেন, তবেই সে প্রবেশ করবে। এভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হবে কে সবল এবং কে দুর্বল। বস্তুত এ হচ্ছে সেই সর্বোচ্চ মান, যেখানে এই ব্যক্তিরা ঈমানের বলেই উন্নীত হয়েছিলেন। এই সর্বোচ্চ মানে উন্নীত হওয়ার পরও তারা মানুষই ছিলেন এবং তাদের মধ্যে মানবীয় দুর্বলতা মানবীয় ভাবাবেগ— সবই ছিলাে। বস্তুত মানুষ যখন ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করে এবং পৃথিবীতে ইসলামের মানবরূপী চলমান প্রতীক হয়ে বিচরণ করে ও পানাহার ইত্যাদি করে, তখন ইসলামের সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে বাস্তব রূপটিই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।   *মুনাফিকের আরো কিছু ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্য : এবারে আমরা দৃষ্টি দেবাে উল্লিখিত ঘটনাবলীর বিবরণ সম্বলিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে। এই সূরার ৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন তাদের বলা হয়, এসাে, আল্লাহর রাসূল তােমাদের জন্যে ক্ষমা চাইবেন, তখন তারা মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং তুমি তাদের দেখবে দাম্ভিকতার সাথে বিরােধিতায় লিপ্ত। বস্তুত তারা তাদের মুনাফিকসুলভ অপতৎপরতা ও খারাপ কথাবার্তা যথারীতি চালিয়ে যায়, কিন্তু যখনই জানতে পারে, রসূল(স.)-এর কাছে তা ফাঁস হয়ে গেছে, তখন কাপুরুষতা প্রদর্শন করে, লজ্জা পেয়েএবং কসম খেয়ে খেয়ে বলতে থাকে, আমি ওসব কথা বলিনি। এভাবে কসম ঢাল হয়ে তাদের রসূল(স.) ও মুসলমানদের রােষ থেকে রক্ষা করে। অতপর যখন কেউ বলে, ‘এসো, আল্লাহর রসূল তােমাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, অথচ তখনাে তারা রসূলের সম্মুখীন হওয়া থেকে নিরাপদ ছিলাে, তখন তারা দাম্ভিকতার সাথে মাথা ঘুরিয়ে নেয়।’ একদিকে উপরােক্ত কাপুরুষতা ও লজ্জা, অপরদিকে এই দাম্ভিকতা ও মাথা ঘুরিয়ে নেয়া এই দুটো হচ্ছে মােনাফেকদের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের আচরণ যদিও সচরাচর প্রভাবশালী ও গণ্যমান্য শ্রেণীর লােকদের মধ্যেই দৃষ্টিগােচর হয়ে থাকে, কিন্তু এই শ্রেণীর লােকেরা স্বভাবগতভাবে কিছুটা ভীরু এবং কাপুরুষও হয়ে থাকে। তারা মুসলমানদের ও তাদের নেতার মুখােমুখি হতে ভয় পায়। যতোক্ষণ মুখােমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকে ততােক্ষণ তারা অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করতে থাকে, আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফেরাতে থাকে এবং মাথা ঘুরিয়ে অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে থাকে। কিন্তু যখনই তাদের নেতার মুখােমুখি হতে হয় অমনি কাপুরুষতা, লজ্জা ও কসম খাওয়া শুরু করে দেয়। এ কারণে তাদের সম্পর্কে আল্লাহর চুড়ান্ত ফয়সালা এবং এই ফয়সালার পর তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে যে কোনাে লাভ নেই, সে কথা পরবর্তী আয়াতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ‘তাদের জন্যে তুমি ক্ষমা চাও আর না চাও উভয়ই সমান, আল্লাহ তায়ালা তাদের কখনাে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তায়ালা ফাসেকদের সুপথ দেখান না।’ অতপর যে ফাসেকীর কারণে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর এই চূড়ান্ত ফয়সালা কার্যকর হয়েছে। সেই ফাসেকীর একটি দিক তুলে ধরা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে। ‘তারা হচ্ছে সেসব লােক, যারা জনগণকে বলে, আল্লাহর রাসূলের কাছে অবস্থানকারীদের জন্যে অর্থ ব্যয় করাে না, যতক্ষণ না তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে চলে যায়…’ বস্তুত মুনাফিকরা যে কাল ও যে স্থানেরই অধিবাসী হােক না কেন, এ ধরনের কথা বলা তাদের চিরন্তন রীতি। এ ধরনের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তাদের মজ্জাগত নােংরা স্বভাবই পরিস্ফুট হয়ে থাকে। সত্য ও ঈমানের শত্রুরা চিরকাল ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই চালানাের জন্যে মােমেনদের অনাহারে মারার অপকৌশল অবলম্বন করে। যেহেতু তারা নিজেদের ইতর সুলভ মানসিকতার কারণে খাদ্য ও জীবন যাপনের উপকরণকেই জীবনের সব কিছু মনে করে, সেহেতু এই উপকরণটির সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েই তারা মােমেনদের বিরুদ্ধে লড়াই করে থাকে। এই অস্ত্রটি দিয়েই কোরায়শ বনু হাশেমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো। পর্বতের উপত্যকার মধ্যে তাদের বন্দী করে ও বয়কট করে চাপ প্রয়ােগ করেছিলাে, যাতে তারা (বনু হাশেম) রসূল(স.)-এর সাহায্য করা থেকে বিরত হয় এবং তাঁকে মোশরেকদের কাছে হস্তান্তর করে। আলোচ্য আয়াত থেকে জানা যাচ্ছে যে, রাসূল(স.)-এর সাহাবীরা যাতে ক্ষুধা ও অনাহারের চাপে পড়ে তাকে ছেড়ে চলে যায়, সে জন্যে মুনাফিকরাও তাদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র প্রয়ােগ করতাে। তারা যাতে অনাহারে কষ্ট পায়, সেজন্যে তাদের দান করা থেকে জনগণকে বিরত রাখতে চেষ্টা করতাে। এই অস্ত্র কমিউনিষ্টরাও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করে থাকে। খাদ্য সরবরাহের জন্যে প্রচলিত রেশনকার্ড থেকে তাদের বঞ্চিত রাখে, যাতে তারা ক্ষুধায় মরে তাে মরুক, নচেত আল্লাহকে অস্বীকার ও নামায ত্যাগ করুক। তথাকথিত নামধারী মুসলিম দেশগুলােতেও এই অস্ত্রের প্রয়ােগ চলছে। আল্লাহর দিকে আহবান ও ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে যারা ঠেকাতে চায়, তারা অকমিউনিষ্ট হলেও অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরােপ, অনাহার চাপিয়ে দেয়া এবং কর্মসংস্থানে ও জীবিকা উপার্জনে বাধাদানের অপকৌশল অবলম্বন তারা করেই চলেছে। এভাবে আবহমানকাল ধরে ইসলামের শত্রুরা এই ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে চলেছে। অথচ তারা অত্র আয়াতের শেষ অংশে বর্ণিত সত্যটি জানে না যে আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সহায়-সম্পদ আল্লাহর, কিন্তু মুনাফিকরা তা বােঝে না।’ মুসলমানদের জীবিকা নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট এসব মুসলিম নামধারী মুনাফিকরাও আকাশ ও পৃথিবীতে বিরাজমান আল্লাহর সৃষ্ট জীবিকার অবারিত উৎস থেকেই নিজেদের জীবিকা উপার্জন করে থাকে। তারা নিজেরা নিজেদের জীবিকার স্রষ্টা নয়। অথচ তারাই কিনা অন্যের জীবিকা বন্ধ করতে সচেষ্ট । কতাে মূর্খ কতো নির্বোধ তারা! আকাশ ও পৃথিবীতে বিরাজমান জীবিকার উৎসগুলাে যে আল্লাহর শত্রু ও বন্ধু নির্বিশেষে সকলেরই জীবিকার উৎস, সে কথা বলে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের প্রবোধ দিচ্ছেন এবং আল্লাহর শত্রুদের গৃহীত পাশবিক ও হীন কর্মপন্থার মােকাবেলায় টিকে থাকার জন্যে মােমেনদের মনােবল বৃদ্ধি করছেন। যে আল্লাহ তায়ালা তার দুশমনদের পর্যন্ত জীবিকা দিতে ভােলেন না, তিনি তার বন্ধুদের ভুলতে পারেন না। তিনি এত দয়ালু যে, তার শত্রুদের পর্যন্ত জীবিকা থেকে বঞ্চিত করেন না ও না খাইয়ে রাখেন না। অথচ তিনি জানেন যে, তিনি যদি তার বান্দাদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত করেন, তবে তারা নিজেদের জন্যে জীবিকা সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ তায়ালা এতােটা উদার যে, তার শত্রুদের পর্যন্ত যে কাজে তারা সক্ষম নয়, সে কাজে বাধ্য করেন না। বস্তুত ভাতে পানিতে মারার কৌশলটি এমন অপকৌশল, যার কথা জঘন্যতম ইতর ও পাষন্ডতম লোক ছাড়া আর কেউ চিন্তা করে না। পরবর্তী আয়াতে মুনাফিকদের অপর একটি নিকৃষ্ট উক্তি তুলে ধরে তার সমালােচনা করা হয়েছে। ‘তারা বলে, আমরা যদি মদীনায় ফিরে যাই তাহলে সবল সেখান থেকে দুর্বলকে তাড়িয়ে দেবো।’ ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি কিভাবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই-র ছেলে আবদুল্লাহ এ কথাটা বাস্তবায়িত করেছেন এবং কিভাবে মদীনায় সবলের অনুমতি ছাড়া দুর্বল প্রবেশ করতে পারেনি। বস্তুত সমস্ত প্রতাপ ও সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহর, তাঁর রসূলের ও মােমেনদের। অথচ মুনাফিকরা তা জানে না। এখানে আল্লাহ তায়ালা নিজের পাশাপাশি তাঁর রসূল ও মােমেনদের কথা উল্লেখ করেছেন। এটা রসূল ও মােমেনদের জন্যে এক দুর্লভ সম্মানের প্রতীক। তিনি যেন বলছেন, এই তাে আমরা, এ হচ্ছে সবল ও সম্মানিতদের পতাকা, এই হচ্ছে প্রতাপশালীদের সারি। বস্তুত রসূল(স.) ও মােমেনদের নিজের পার্শ্বে রেখে তিনি মহাপ্রতাপান্বিত একটি শিবির স্থাপন করেছেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা সত্য কথাই বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা সকল সম্মান, শক্তি ও প্রতাপের উৎস হিসাবে মােমেনের হৃদয়ে বিদ্যমান ঈমানকেই চিহ্নিত করেছেন। এই সম্মান প্রতিপত্তি আল্লাহর সম্মান প্রতিপত্তি থেকেই উদ্ভূত। এ সম্মান ও প্রতিপত্তি কখনাে কাউকে দুর্বল করে না, নিজেও দুর্বল হয় না। মােমেনের হৃদয় থেকে তা চরম সংকটজনক মুহূর্তেও দূরে সরে যায় না। কেবল দুর্বল ও দোদুল্যমান হতে পারে। এই দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতা কাটিয়ে ওঠলে মােমেনের সম্মান, শক্তি, প্রতিপত্তি অটল ও স্থিতিশীল হয়ে যায়। ‘অথচ মােনাফেকরা তা জানে না। তারা যখন এই সম্মান প্রতিপত্তির স্বাদ পায়নি এবং এর মূল উৎসের সাথে তাদের যােগাযােগ নেই, তখন তারা কেমন করেই বা তার কথা জানবে।

১-৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
২) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# (৬৩-মুনাফিকুন) : নামকরণ:

প্রথম আয়াতের إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ অংশ থেকে এ সূরার নাম গ্রহণ করা হয়েছে। এটি এ সূরার নাম এবং বিষয়বস্তু শিরোনামও। কারণ এ সূরায় মুনাফিকদের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করা হয়েছে।
(৬৩-মুনাফিকুন) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

বনী মুসতালিক যুদ্ধভিযান থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে অথবা মদীনায় পৌছার অব্যবহিত পরে এ সূরা নাযিল হয়েছিল। ৬ হিজরীর শা’বান মাসে বনী মুসতালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল একথা আমরা সূরা নূরের ভূমিকায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বর্ণনা করেছি। এভাবে এর নাযিল হওয়ার সময় সঠিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে আমরা পরে আরো আলোচনা করব।
(৬৩-মুনাফিকুন) : ঐতিহাসিক পটভূমি :

যে বিশেষ ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে এ সূরা নাযিল হয়েছিল তা আলোচনার পূর্বে মদীনার মুনাফিকদের ইতিহাসের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। কারণ ঐ সময়ে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তা আদৌ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ছিল না। বরং তার পেছনে ছিল একটি পুরো ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ যা পরিশেষে এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

পবিত্র মদীনা নগরীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বে আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটি পারস্পরিক গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। তারা যথারীতি তাকে বাদশাহ বানিয়ে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। এমন কি তার জন্য রাজ মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল। এ ব্যক্তি ছিল খাযরাজ গোত্রের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খাযরাজ গোত্রে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বসম্মত এবং আওস ও খাযরাজ ইতিপূর্বে আর কখনো একযাগে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। (ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৪, ।

এই পরিস্থিতিতে ইসলামের বাণী মদীনায় পৌঁছে এবং এই দুটি গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। হিজরতের আগে আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদলা (রা.) আনসারী এ আহবান জানাতে শুধু এ কারণে দেরী করতে চাচ্ছিলেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও বাইয়াত ও দাওয়াতে শামিল হয় এবং এভাবে মদীনা যেন সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু যে প্রতিনিধি দল বাইয়াতের জন্য হাজির হয়েছিল তারা এই যুক্তি ও কৌশলকে কোন গুরুত্বই দিলেন না এবং এতে অংশগ্রহণকারী দুই গোত্রের ৭৫ ব্যক্তি সব রকম বিপদ মাথা পেতে নিয়ে নবী (সা.) কে দাওয়াত দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল। (ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৯) আমরা সূরা আনফালের ভূমিকায় এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছি।

এরপর নবী (সা.) যখন মদীনায় পৌছলেন তখন আনসারদের ঘরে ঘরে ইসলাম এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিরূপায় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য তার নিজের জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই সে তার বহু সংখ্যক সহযোগী ও সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উভয় গোত্রের প্রবীণ ও নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকেরা। অথচ তাদের সবার অন্তর জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অন্তর্জ্বালা ও দু:খ ছিল অত্যন্ত তীব্র। কারণ সে মনে করতো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রাজত্ব ও বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার এই মুনাফেকীপূর্ণ ঈমান এবং নেতৃত্ব হারানোর দু:খ কয়েক বছর ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে থাকল। একদিকে তার অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বরে উঠে বসতেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উঠে বলতো, “ভাইসব, আল্লাহর রসূল আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। তাই আপনারা সবাই তাঁকে সাহায্য, সহযোগিতা করুন। এবং তিনি যা বলেন গভীর মনযোগ সহকারে শুনুন এবং তার আনুগত্য করুন। “(ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা, ১১১, । অপরদিকে অবস্থা ছিল এই যে, প্রতিদিনই তার মুনাফেকীর মুখোশ খুলে পড়ছিল এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইসলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা পোষণ করে।

একবার নবী (সা.) কোন এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় পথে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর সাথে অভদ্র আচরণ করে। তিনি হযরত সা’দ ইবনে উবাদাকে বিষয়টি জানালে সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, আপনি এ ব্যক্তির প্রতি একটু নম্রতা দেখান। আপনার আগমনের পূর্বে আমরা তার জন্য রাজমুকুট তৈরী করেছিলাম। এখন সে মনে করে, আপনি তার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। “(ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৩৭, ২৩৮, ।

বদর যুদ্ধের পর বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অকারণে বিদ্রোহ করলে রসূলুল্লাহ (সা.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তখন এই ব্যক্তি তাদের সমর্থনে কোমর বেঁধে কাজ শুরু করে। সে নবীর (সা.) বর্ম ধরে বলতে লাগলো, এই গোত্রটির সাতশত বীরপুরুষ যোদ্ধা শত্রুর মোকাবেলায় সবসময় আমাকে সাহায্য করেছে, আজ একদিনেই আপনি তাদের হত্যা করতে যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ, আপনি যতক্ষণ আমার এই মিত্রদের ক্ষমা না করবেন আমি ততক্ষণ আপনাকে ছাড়বো না। (ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১-৫২, ।

উহুদ যুদ্ধের সময় এই ব্যক্তি খোলাখুলি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে সে তার তিনশত সঙ্গী-সাথীকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসেছে। কি সাংঘাতিক নাজুক মুহূর্তে সে এই আচরণ করেছে তা এই একটি বিষয় থেকেই অনুমান করা যায় যে, কুরাইশরা তিন হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে মদীনার ওপরে চড়াও হয়েছিল আর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র এক হাজার লোক নিয়ে তাদের মোকাবিলা ও প্রতিরোধের জন্য বেরিয়েছিলেন। এক হাজার লোকের মধ্যে থেকেও এই মুনাফিক তিনশত লোককে আলাদা করে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল এবং নবী (সা.) কে শুধু সাতশত লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তিন হাজার শত্রুর মোকাবিলা করতে হলো।

এ ঘটনার পর মদীনার সব মুসলমান নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলো যে, এ লোকটি কট্টর মুনাফিক। তার যেসব সংগীসাথী এই মুনাফিকীতে তার সাথে শরীক ছিল তাদেরকেও তারা চিনে নিল। এ কারণে উহুদ যুদ্ধের পর প্রথম জুম’আর দিনে নবীর (সা.) খোতবা দেয়ার পূর্বে এ ব্যক্তি যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়ালো তখন লোকজন তার জামা টেনে ধরে বলল: “তুমি বসো, তুমি একথা বলার উপযুক্ত নও।” মদীনাতে এই প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে এ ব্যক্তিকে অপমানিত করা হলো। এতে সে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলো এবং মানুষের ঘাড় ও মাথার উপর দিয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। মসজিদের দরজার কাছে কিছু সংখ্যক আনসার তাকে বললেন, “তুমি একি আচরণ করছো? ফিরে চলো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করো।” এতে সে ক্রোধে ফেটে পড়লো এবং বললো! “তাকে দিয়ে আমি কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করাতে চাই না”। (ইবনে হিশাম, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১১, ।

হিজরী ৪ সনে বনু নাযীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় এই ব্যক্তি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আরো খোলাখুলিভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের সাহায্য সহযোগিতা দান করে। একদিনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর জান কবুল সাহাবীগণ এসব ইহুদী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অপরদিকে এই মুনাফিকরা গোপনে গোপনে ইহুদীদের কাছে খবর পাঠাচ্ছিল যে, তোমরা রুখে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের সাথে আছি। তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করা হলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব। আল্লাহ তা’আলা তাদের এই গোপন গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টি প্রকাশ করে দিলেন। সূরা হাশরের দ্বিতীয় রুকূ’তে এ বিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে।

কিন্তু তার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মুখোশ খুলে পড়ার পরও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কার্যকলাপ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ মুনাফিকদের একটা বড় দল তার সহযোগী ছিল। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের বহু সংখ্যক নেতা তার সাহায্যকারী ছিল। কম করে হলেও মদীনার গোটা জনবসতির এক তৃতীয়াংশ ছিল তার সাঙ্গপাঙ্গ। উহুদ যুদ্ধের সময় এ বিষয়টিই প্রকাশ পেয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ শত্রুর সাথেও যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়া কোন অবস্থায়ই সমীচীন ছিল না। এ কারণে তাদের মুনাফিকী সম্পর্কের অবহিত থাকা সত্ত্বেও নবী (সা.) দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে ঈমানের দাবি অনুসারেই তাদের সাথে আচরণ করেছেন। অপরদিকে এসব লোকেরও এতটা শক্তি ও সাহস ছিল না যে, তারা প্রকাশ্যে কাফের হয়ে ঈমানদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করত অথবা খোলাখুলি কোন হামলাকারী শত্রুর সাথে মিলিত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতো। বাহ্যত তারা নিজেদের একটা মজবুত গোষ্ঠী তৈরী করে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বহু দুর্বলতা ছিল। সূরা হাশরের ১২ থেকে ১৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে সেইসব দুর্বলতার কথাই তুলে ধরেছেন। তাই তারা মনে করতো মুসলমান সেজে থাকার মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। তারা মসজিদে আসত, নামায পড়তো এবং যাকাতও দিতো। তাছাড়া মুখে ঈমানের লম্বা চওড়া দাবি করতো, সত্যিকার মুসলমানদের যা করার আদৌ কোন প্রয়োজন পড়তো না। নিজেদের প্রতিটি মুনাফিকী আচরণের পক্ষে হাজারটা মিথ্যা যুক্তি তাদের কাছে ছিল। এসব কাজ দ্বারা তারা নিজেদের স্বগোত্রীয় আনসারদেরকে এই মর্মে মিথ্যা আশ্বাস দিত যে, আমরা তোমাদের সাথেই আছি। আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের অনেক ক্ষতি হতো। এসব কৌশল অবলম্বন করে তারা যেসব ক্ষতি থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিল। তাছাড়া তাদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মুসলমানদের ভেতরে কলহ কোন্দল ও ফ্যাসাদ সৃষ্টির এমন সব সুযোগও তারা কাজে লাগাচ্ছিল যা অন্য কোন জায়গায় থেকে লাভ করতে পারত না।

এসব কারণে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বনী মুসতালিক যুদ্ধাভিযানে শরীক হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল এবং এই সুযোগে একই সাথে এমন দুটি মহাফিতনা সৃষ্টি করেছিল যা মুসলমানদের সংহতি ও ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারত। কিন্তু পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সাহচর্য থেকে ঈমানদাগণ যে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তার কল্যাণে যথা সময়ে এ ফিতনার মুলোৎপাটন হয়ে যায় এবং এসব মুনাফিক নিজেরাই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। এ দুটি ফিতনার মধ্যে একটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নূরে। আর অপর ফিতনাটির উল্লেখ করা হয়েছে আলোচ্য এই সূরাটিতে।

বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, নাসায়ী, তিরমিযী, বায়হাকী, তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া, আবদুর রাযযাক, ইবনে জারীর, তাবারী, ইবনে সা’দ এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বহু সংখ্যক সনদসূত্রে এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। যে অভিযানের সময় এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল কিছু সংখ্যক রেওয়ায়াতে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। আবার কোন কোন রেওয়ায়াতে তাবুক যুদ্ধের সময়কার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু মাগাযী (যুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাস) ও সীরাত (নবী জীবন) বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে একমত যে, এ ঘটনা বনী মুসতালিক যুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়েছিল। বিভিন্ন রেওয়ায়াত একত্রিত করলে ঘটনার যে বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় তা হচ্ছে:

বনী মুসতালিক গোত্রকে পরাস্ত করার পর ইসলামী সেনাবাহিনী তখনও মুরাইসী নামক কূপের আশেপাশের জনবসতিতে অবস্থান করেছিল। ইতিমধ্যে হঠাৎ পানি নিয়ে দুই ব্যক্তির মধ্যে বচসা হয়। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জাহ্জাহ্ ইবনে মাসউদ, গিফারী। তিনি ছিলেন হযরত উমরের (রা.) কর্মচারী। তিনি তাঁর ঘোড়ার দেখাশোনা ও তত্বাবধান করতেন। অন্যজন ছিলেন সিনান ইবনে ওয়াবার ইল জুহানী। ১ তাঁর গোত্র খাযরাজ গোতের মিত্র ছিল। মৌখিক বাদানুবাদ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে পরিণত হয় এবং জাহজাহ সিনানকে একটি লাথি মারে। প্রাচীন ইয়ামানী ঐতিহ্য অনুসারে আনসারগণ এ ধরনের আচরণকে অত্যন্ত অপমানজনক ও লাঞ্ছনাকর মনে করতেন। এতে সিনান সাহায্যের জন্য আনসারদেরকে আহবান জানায় এবং জাহজাহও মুহাজিরদের আহবান জানায়। এই ঝগড়ার খবর শোনামাত্র আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের উত্তেজিত করতে শুরু করে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে দ্রুত এসো, নিজের মিত্রদের সাহায্য করো। অপরদিকে থেকে কিছু সংখ্যক মুহাজিরও এগিয়ে আসেন। বিষয়টি আরো অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো। ফলে আনসার ও মুহাজিরগণ সম্মিলিতভাবে সবেমাত্র যে স্থানটিতে এক দুশমন গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের পরাজিত করেছিলেন এবং তখনও তাদের এলাকাতেই অবস্থান করেছিলেন সে স্থানটিতেই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লিপ্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু শোরগোল শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগিয়ে গেলেন এবং বললেন:

“কি ব্যাপার! জাহেলিয়াতের আহবান শুনতে পাচ্ছি কেন? জাহেলিয়াতের আহবানের সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? এসব ছেড়ে দাও, এগুলো দুর্গন্ধময় নোংরা জিনিস। ২ এতে উভয়পক্ষের সৎ ও নেককার লোকজন অগ্রসর হয়ে ব্যাপারটি মিটমাট করে দিলেন এবং সিনান জাহজাহকে মাফ করে আপোষ করে নিলেন।

১. বিভিন্ন রেওয়ায়াতে উভয়ের বিভিন্ন নাম বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা ইবনে হিশামের বর্ণনা থেকে এ নাম গ্রহণ করেছি।

২. এই সময় নবীর (সা.) বলা একথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের সঠিক মর্মবাণীকে বুঝতে হলে একথাটি যথাযথভাবে বুঝে নেয়ার প্রয়োজন। ইসলামের নীতি হচ্ছে, দুই ব্যক্তি যদি তাদের বিবাদের ব্যাপারে সাহায্যের জন্য মানুষকে আহবান জানাতে চায় তাহলে সে বলবে, মুসলমান ভাইয়েরা, এগিয়ে এসো, আমাদের সাহায্য করো। অথবা বলবে, হে লোকেরা, আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আস। কিন্তু তাদের প্রত্যেকে যদি নিজ গোত্র, স্বজন, বংশ ও বর্ণ অথবা অঞ্চলের নাম নিয়ে আহবান জানায় তাহলে তা জাহেলিয়াতের আহবান হয়ে দাঁড়ায়। এ আহবানের সাড়া দিয়ে আগমনকারী যদি কে অত্যাচারী আর কে অত্যাচারিত তা না দেখে এবং হক ও ইনসাফের ভিত্তিতে অত্যাচারিতকে সাহায্যে করার পরিবর্তে নিজ নিজ গোষ্ঠীর লোককে সাহায্য করার জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাহলে তা একটি জাহেলিয়াতপূর্ণ কাজ। এ ধরনের কাজ দ্বারা দুনিয়াতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একে নোংরা ও ঘৃণিত জিনিস বলে আখ্যায়িত করে মুসলমানদের বলেছেন যে, এরূপ জাহেলিয়াতের আহবানের সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? তোমরা ইসলামের ভিত্তিতে একটি জাতি হয়েছিলে। এখন আনসার ও মুহাজিরদের নাম দিয়ে তোমাদের কি করে আহবান জানানো হচ্ছে, আর সেই আহবান শুনে তোমরা কোথায় ছুটে যাচ্ছে? আল্লামা সুহাইলী “রাওদুল উনুফ” গ্রন্থে লিখেছেন: কোন ঝগড়া-বিবাদ বা মতানৈক্যের ক্ষেত্রে জাহেলিয়াপূর্ণ আহবান জানানোকে ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদগণ রীতিমত ফৌজদারী অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছেন। একদল আইনবিদের মতে এর শাস্তি পঞ্চাশটি বেত্রাঘাত এবং আরেক দলের মতে দশটি। তৃতীয় আরেক দলের মতে, তাকে অবস্থার আলোকে শাস্তি দেয়া দরকার। কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু তিরস্কার ও শাসনই যথেষ্ট। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের আহবান উচ্চারণকারীকে বন্দী করা উচিত। সে যদি বেশী দুষ্কর্মশীল হয় তাহলে তাকে বেত্রাঘাত করতে হবে।

কিন্তু যাদের অন্তরে মুনাফিকী ছিল তারা সবাই এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে সমবেত হয়ে তাকে বললো: “এতদিন আমরা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তুমি প্রতিরোধও করে আসছিলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তুমি আমাদের বিরুদ্ধে এসব কাঙাল ও নি:স্বদের ১ সাহায্যকারী হয়ে গিয়েছো। “আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আগে থেকেই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। একথা শুনে সে আরো জ্বলে উঠল। সে বলতে শুরু করল: এসব তোমাদের নিজেদেরই কাজের ফল। তোমরা এসব লোককে নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছো, নিজেদের অর্থ-সম্পদ তাদের বন্টন করে দিয়েছো। এখন তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং আমাদেরই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এবং কুরাইশদের এই কাঙালদের বা মুহাম্মাদের (সা.) (সঙ্গীসাথীদের) অবস্থা বুঝাতে একটি উপমা হুবহু প্রযোজ্য। উপমাটি হলো, তুমি নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা করো, যাতে তা একদিন তোমাকেই ছিঁড়ে ফেড়ে খেতে পারে। তোমরা যদি তাদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নাও তাহলে তারা কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আল্লাহর শপথ, মদীনা ফিরে গিয়ে আমাদের মধ্যে যারা মর্যাদাবান লোক তারা হীন ও লাঞ্ছিত লোকদের বের করে দেবে। “

এ বৈঠকে ঘটনাক্রমে হযরত যায়েদ ইবনে আরকমাও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি একজন কমবয়স্ক বালক ছিলেন। এসব কথা শোনার পর তিনি তাঁর চাচার কাছে তা বলে দেন। তাঁর চাচা ছিলেন আনসারদের একজন নেতা। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে সব বলে দেন। নবী (সা.) যায়েদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি যা শুনেছিলেন আদ্যপান্ত খুলে বললেন। ২নবী (সা.) বললেন: তুমি বোধ হয় ইবনে উবাইয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। সম্ভবত তোমার শুনতে ভুল হয়েছে। ইবনে উবাই একথা বলছে বলে হয়তো তোমার সন্দেহ হয়েছে। কিন্তু যায়েদ বললেন, হে আল্লাহর রসূল, তা নয়। আল্লাহর শপথ আমি নিজে তাকে এসব কথা বলতে শুনেছি। অতপর নবী (সা.) ইবনে উবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে সরাসরি অস্বীকার করলো। সে বারবারের শপথ করে বলতে লাগলো আমি একথা কখনো বলি নাই। আনসারদের লোকজনও বললেন: হে আল্লাহর নবী, এতো একজন ছেলে মানুষের কথা, হয়তো তার ভুল হয়েছে।

তিনি আমাদের নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার কথার চেয়ে একজন বালকের কথার প্রতি বেশী আস্থাশীল হবেন না। বিভিন্ন গোত্রের প্রবীণ ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরাও যায়েদকে তিরস্কার করলো। বেচারা যায়েদ এতে দু:খিত ও মন:ক্ষুণ্ন হয়ে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকলেন। কিন্তু নবী (সা.) যায়দে ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উভয়কেই জানতেন। তাই প্রকৃত ব্যাপার কি তা তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারলেন।

১. যারা ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় চলে আসছিল মদীনার মুনাফিকরা তাদের সবাইকে () বলে আখ্যায়িত করতো। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কম্বল বা মোটা বস্ত্র পরিধানকারী। কিন্তু গরীব মুহাজিরদেরকে হেয় ও অবজ্ঞা করার জন্যই তারা এ শব্দটি ব্যবহার করতো। যে অর্থ বুঝাতে তারা শব্দটি বলত, ‘কাঙাল’ শব্দ দ্বারা তা অধিকতর বিশুদ্ধভাবে ব্যক্ত হয়।

২. এ ঘটনা থেকে ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, ধর্মীয়, নৈতিক ও জাতীয় স্বার্থের খাতিরে কেউ যদি কারো ক্ষতিকর কথা অন্য করো কাছে বলে তা হলে চোগলখুরীর পর্যায়ে পড়ে না। ফিতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে যে চোগলখুরী করা হয় সেই চোখলখুরীকে ইসলামী শরীয়াত হারাম ঘোষণা করেছে।

হযরত ‘উমর এ বিষয়টি জানতে পেরে নবীর (সা.) কাছে এসে বললেন: “আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। অথবা এরূপ অনুমতি দেয়া যদি সমীচীন মনে না করেন তাহলে আনসারদের নিজেদের মধ্যে থেকে মুআয ইবনে জাবাল অথবা আববাদ ইবনে বিশর, অথবা সা’দ ইবনে মু’আয অথবা মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাকে নির্দেশ দিন ১ সে তাকে হত্যা করুক। “কিন্তু নবী (সা.) বললেন: “এ কাজ করো না। লোকে বলবে, মুহাম্মাদ (সা.) নিজের সংগী-সাথীদেরকেই হত্যা করেছে”। এরপর নবী(সা.) তৎক্ষনাৎ যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিয়ে দিলেন। অথবা নবী (সা.) এর স্বাভাবিক রীতি ও অভ্যাস অনুসারে তা যাত্রার সময় ছিল না। ক্রমাগত ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত থাকলো। এমন কি লোকজন ক্লান্তিতে নিস্তেজ ও দুর্বল হয়ে পড়লো। তখন তিনি একস্থানে তাবু করে অবস্থান করলেন। ক্লান্ত শ্রান্ত লোকজন মাটিতে পিঠ ঠেকানো মাত্র সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এ কাজ তিনি এ জন্য করলেন যাতে, মুরইসী কূপের পাশে যে ঘটনা ঘটেছিল মানুষের মন-মগজ থেকে তা মুছে যায়। পথিমধ্যে আনসারদের একজন নেতা হযরত উসাইদ ইবনে হুদায়ের তাঁর কাছে গিয়ে বললেন: “হে আল্লাহর রসূল, আজ আপনি এমন সময় যাত্রার নির্দেশ দিয়েছেন যা সফরের জন্য উপযুক্ত নয়। আপনি তো এ রকম সময়ে কখনো সফর শুরু করতেন না?”নবী (সা.) বললেন: তোমাদের সেই লোকটি কি কথা প্রচার করেছে তা কি তুমি শোন নাই? তিনি জিজ্ঞেস করলেন: কোন লোকটি? তিনি বললেন: আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। উসাইদ জিজ্ঞেস করলেন, সে কি বলেছে? তিনি বললেন: “সে বলেছে মদীনায় পৌছার পর সম্মানী লোকেরা হীন ও নীচ লোকদের বহিষ্কার করবে। তিনি আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল। সম্মানিত ও মর্যাদাবান তো আপনি। আর হীন ও নীচ তো সে নিজে। আপনি যখন ইচ্ছা তাকে বহিষ্কার করতে পারেন”।

১. বিভিন্ন রেওয়াওয়াতে আনসারদের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম উল্লেখিত হয়েছে। হযরত উমর (রা.) নবীর (সা.) কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন “আমি মুহাজির হওয়ার কারণে আমার হাতে সে নিহত হলে ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকলে এসব লোকদের মধ্য থেকে কোন একজনকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিন”।

কথাটা আস্তে আস্তে আনসারদের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এবং ইবনে উবাইয়ের বিরুদ্ধে তাদের মনে ভীষণ ক্রোধের সৃষ্টি হলো। লোকজন ইবনে উবাইকে বললো, তুমি গিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের কাছে ক্ষমা চাও। কিন্তু সে ক্রদ্ধ স্বরে জবাব দিল: তোমরা বললে তার প্রতি ঈমান আন। আমি ঈমান আনলাম। তোমরা বললে, অর্থ-সম্পদের যাকাত দাও। আমি যাকাতও দিয়ে দিলাম। এখন তো শুধু মুহাম্মাদকে আমার সিজদা করা বাকী আছে। এসব কথা শুনে তার প্রতি ঈমানদার আনসারদের অসন্তুষ্টি আরো বৃদ্ধি পেল এবং চারদিক থেকে তার প্রতি ধিক্কার ও তিরস্কার বর্ষিত হতে থাকলো। যে সময় এ কাফেলা মদীনায় প্রবেশ করছিল তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র (তার নামও) আবদুল্লাহ খোলা তরবারি হাতে পিতার সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন: “আপনিই তো বলেছেন, মদীনায় ফিরে গিয়ে সম্মানিত ব্যক্তিরা হীন ও নীচ লোকদের সেখান থেকে বহিষ্কার করবে। এখন আপনি জানতে পারবেন সম্মান আপনার, না আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের। আল্লাহর কসম! যতক্ষণ পর্যন্ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি না দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবেন না”। এতে ইবনে উবাই চিৎকার করে বলে উঠল “হে খাযরাজ গোত্রের লোকজন, দেখো, আমার নিজের ছেলেই আমাকে মদীনায় প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে”। লোকজন গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ খবর দিলে তিনি বললেন: “আবদুল্লাহকে গিয়ে বলো তার পিতাকে যেন নিজের বাড়ীতে প্রবেশ করতে দেয়”। তখন আবদুল্লাহ বললেন: “নবী (সা.) অনুমতি দিয়েছেন তাই এখন আপনি প্রবেশ করতে পারেন”। এই সময় নবী (সা.) হযরত উমরকে (রা.) বললেন: “হে উমর, এখন তোমার মতামত কি? যে সময় তুমি বলেছিলে, আমাকে তাকে হত্যা করার অনুমতি দিন, সে সময় তুমি যদি তাকে হত্যা করতে তাহলে অনেকেই নাক সিটকাতো এবং নানা রকম কথা বলতো। কিন্তু আজ যদি আমি তার হত্যার আদেশ দেই তাহলে তাকে হত্যা পর্যন্ত করা যেতে পারে”। হযরত উমর বললেন: “আল্লাহর শপথ, এখন আমি বুঝতে পেরেছি আল্লাহর রসূলের কথা আমার কথার চেয়ে অধিক যুক্তিসঙ্গত ছিল”। ১ এই পরিস্থিতি ও পটভূমিতে অভিযান শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় পৌছার পর এ সূরাটি নাযিল হয়।

১. এ থেকে শরীয়াতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাসায়ালা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায়। এক, ইবনে উবাই যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছিল এবং যে ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত থেকে কেউ যদি এ ধরনের আচরণ করে তাহলে সে হত্যাযোগ্য অপরাধী। দুই, শুধু আইনের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি হত্যার উপযুক্ত হলেই যে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে তা জরুরী নয়। এরূপ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দেখতে হবে, তাকে হত্যা করার ফলে কোন বড় ধরনের ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কিনা। পরিবেশ-পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে অন্ধভাবে আইনের প্রয়োগ কোন কোন সময় আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী ফলাফল নিয়ে আসে। যদি একজন মুনাফিক ও ফিতনাবাজের পেছনে কোন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি থাকে তাহলে তাকে শাস্তি দিয়ে আরো বেশী ফিতনাকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ দেয়ার চেয়ে উত্তম হচ্ছে, যে রাজনৈতিক শক্তির জোরে সে দুষ্কর্ম করছে কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তার মূলোৎপটন করা। এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যেই নবী (সা.) তখনো আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে শাস্তি দেননি যখন তিনি তাকে শাস্তি দিতে সক্ষম ছিলেন। বরং তার সাথে সবসময় নম্র আচরণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত দুই তিন বছরের মধ্যেই মদীনায় মুনাফিকদের শক্তি চিরদিনের জন্য নির্মূল হয়ে গেল।
# যে কথা তারা মুখে বলেছে তা আসলে সত্য। কিন্তু তারা মুখে যা প্রকাশ করছে নিজেরা যেহেতু তা বিশ্বাস করে না, তাই তাঁর রসূল হওয়ার যে সাক্ষ্য তারা দেয় সে ব্যাপারে তারা মিথ্যাবাদী। এখানে একথাটি ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, দু’টি জিনিসের সমন্বয়ের নাম সাক্ষ্য। এক, যে মূল বিষয়টির সাক্ষ্য দেয়া হয় সেটি। দুই, সেই বিষয়টি সম্পর্কে সাক্ষ্যদানকারীর বিশ্বাস। এখন বিষয়টি যদি আসলে সত্য হয় এবং সাক্ষ্য দানকারী মুখে যা বলছে তার বিশ্বাসও যদি তাই হয়, তাহলে সে সবদিক দিয়েই সত্যবাদী হবে। আর বিষয়টি যদি মিথ্যা হয়, কিন্তু সাক্ষ্যদাতা সেটিতে সত্য বলে বিশ্বাস করে তাহলে একদিক দিয়ে আমরা তাকে সত্যবাদী বলবো। কেননা সে তার বিশ্বাসকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সত্যবাদী। কিন্তু আরেক দিক দিয়ে তাকে মিথ্যাবাদী বলব। কেননা, সে যে বিষয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে ভুল। অপরদিকে বিষয়টি যদি সত্য হয় কিন্তু সাক্ষ্যদাতার বিশ্বাস তার পরিপন্থী হয় তাহলে সঠিক বিষয়টির সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আমরা তাকে সত্যবাদী বলব। কিন্তু সে মুখে যা প্রকাশ করছে তার বিশ্বাস না হওয়ার কারণে আমরা তাকে মিথ্যাবাদী বলব। যেমন কোন ঈমানদার ব্যক্তি যদি ইসলামকে সত্য বলে তাহলে সে সবদিক দিয়ে সত্যবাদী। কিন্তু একজন ইহুদী যদি ইহুদী ধর্মের ওপর বিশ্বাসী থেকে ইসলামকে সত্য বলে তাহলে তার কথা সত্য কিন্তু তার সাক্ষ্য মিথ্যা বলে গণ্য করা হবে। কেননা, সে তার বিশ্বাসের পরিপন্থী সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর সে যদি ইসলামকে বাতিল বা মিথ্যা বলে তাহলে আমরা তার একথা মিথ্যা বলবো। কিন্তু সে যে সাক্ষ্য দিচ্ছে তা তার নিজের বিশ্বাস অনুসারে সত্য।
# নিজেরা মুসলমান ও ঈমানদার এ কথা বিশ্বাস করানোর জন্য তারা যেসব শপথ করে সেগুলোকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যাতে মুসলমানদের ক্রোধ থেকে রক্ষা পায় এবং প্রকাশ্য শত্রুর সাথে মুসলমানগণ যে আচরণ করে থাকে তাদের সাথে তা করতে না পারে।

এসব শপথ দ্বারা ঐ সব শপথও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে যা সাধারণত তারা নিজেদের ঈমানের বিষয়টি বিশ্বাস করানোর করতো। তাদের মুনাফিকী আচরণ ধরা পড়ার পর যেসব শপথ করে তারা মুসলমানদের বুঝাতে চাইতো যে, তা তারা মুনাফিকীর কারণে করেনি সেসব শপথও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। আবার যায়েদ ইবনে আরকামের দেয়া খবর মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যে শপথ করেছিল তাও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। এসব সম্ভাবনার সাথে আরো একটি সম্ভাবনা আছে। তা হলো, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল” তাদের একথাটিকে আল্লাহ‌ তা’আলা শপথ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই সম্ভাবনার ভিত্তিতে ফিকাহবিদদের মধ্যে একটি বিষয়ে বিতর্কের সুত্রপাত হয়েছে। বিষয়টি হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যদি “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি” বলে কোন কথা বর্ণনা করে তাহলে তা শপথ বা হলফ(Oath) বলে বিবেচিত হবে কিনা। ইমাম আবু হানিফা (র) ও তাঁর সাথীগণ (ইমাম যুফার ছাড়া) এবং ইমাম সুফিয়ান সাওরী ও ইমাম আওযায়ী একে শপথ (শরীয়াতের পরিভাষা ইয়ামীন) বলে মনে করেন। ইমাম যুফার বলেনঃ এটা শপথ নয়। ইমাম মালেক থেকে দু’টি মত বর্ণিত হয়েছে, একটি হচ্ছে, এটা নিছক শপথ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, “সাক্ষ্য দিচ্ছি” বলার সময় সে যদি এরূপ নিয়ত করে যে, “আল্লাহর শপথ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি” অথবা “আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি” তাহলে সে ক্ষেত্রে এটা শপথমূলক বর্ণনা হবে। অন্যথায় হবে না। ইমাম শাফেয়ী (র) বলেন, বক্তব্য পেশকারী ব্যক্তি যদি এ কথাও বলে যে, “আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে সাক্ষ্য দিচ্ছি” তবুও তা তার শপথমূলক বক্তব্য বলে গণ্য হবে না। কিন্তু সে যদি এরূপ কথা শপথের নিয়তেই বলে থাকে তাহলে তা শপথ বলে গণ্য হবে। (আহকামূল কুরআন-জাসসাস, আহকামুল কুরআন-ইবনুল আরাবী)।

# আরবী ভাষায় صَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ শব্দটি সকর্মক এবং অকর্মক এই উভয় প্রকার ক্রিয়া হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। এ কারণে صد আয়াতাংশের অর্থ “তারা নিজেরা আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকে” যেমন হয়, তেমনি “তারা অন্যদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে”ও হয়। তাই অনুবাদে আমরা দু’টি অর্থই উল্লেখ করেছি। প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে আয়াতাংশের অর্থ হবে এসব শপথের মাধ্যমে তারা মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করে নেয়ার পর ঈমানের দাবী পূরণ না করার এবং আল্লাহ‌ ও রসূলের আনুগত্য থেকে পাশ কাটিয়ে চলার ব্যাপারে সুযোগ সৃষ্টি করে নেয়। দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করলে আয়াতাংশের অর্থ হবে, এসব মিথ্যা শপথের আড়ালে তারা শিকারের সন্ধানে থাকে, মুসলমান সেজে থেকে ভিতর থেকেই মুসলমানদের জামায়াতের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে। মুসলমানদের গোপনীয় বিষয়সমূহ জেনে নিয়ে তা শত্রুদের জানিয়ে দেয়, ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের মধ্যে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করতে এবং সহজ-সরল মুসলমানদের মনে সন্দেহ-সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে তারা এমন সব কৌশল অবলম্বন করে যা কেবল মুসলমান সেজে থাকা একজন মুনাফিকের পক্ষেই সম্ভব। ইসলামের প্রকাশ্য শত্রুরা ঐ সব কৌশল কাজে লাগাতে পারে না।

# এ আয়াতে ঈমান আনার অর্থ বুঝানো হয়েছে ঈমানের স্বীকৃতি দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে শামিল হওয়াকে আর কুফরের অর্থ বুঝানো হয়েছে আন্তরিকভাবে ঈমান না আনা এবং মৌখিকভাবে ঈমান আনার পূর্বে যে কুফরের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই কুফরের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকাকে। কথাটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, তারা যখন খুব ভালভাবে বুঝে শুনে সোজাসুজি ঈমানের পথ অবলম্বন অথবা পরিষ্কাভাবে কুফরের পথ গ্রহণের পরিবর্তে মুনাফিকীর এই নীতি ও পন্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল তখন আল্লাহ‌ তা’আলার পক্ষ থেকে তাদের অন্তরের ওপর মোহর মেরে দেয়া হলো এবং একজন সত্যবাদী, নিষ্কলুষ, সৎ ও ভদ্র মানুষের মত নীতি ও পন্থা অবলম্বন করার সামর্থ্য ও শুভবুদ্ধিই আল্লাহ‌ তা’আলা তাদের থেকে ছিনিয়ে নিলেন। এখন তাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির যোগ্যতাই হারিয়ে গিয়েছে এবং নৈতিক অনুভূতির মৃত্যু ঘটেছে। রাতদিনের এই মিথ্যা প্রতি মূহূর্তের এই প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি এবং কথা এবং কাজের এ স্থায়ী বৈপরীত্য-যার মধ্যে তারা নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছে-তা যে কত হীন ও লাঞ্ছনাকর অবস্থা, সে উপলব্ধিটুকু পর্যন্ত এখন তাদের আসে না।

আল্লাহর পক্ষ থেকে কারো অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার অর্থ কুরআন মজীদের যেসব আয়াতে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে আলোচ্য আয়াতটি তার একটি। এসব মুনাফিকের অন্তরে আল্লাহ‌ তা’আলা মোহর মেরে দেয়ার কারণে ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি এবং তারা বাধা হয়ে মুনাফিক রয়ে গিয়েছে-ব্যাপারটি তা নয়। বরং বাহ্যিকভাবে ঈমান প্রকাশ করা সত্ত্বেও যখন তারা কুফরির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন আল্লাহ‌ তা’আলা তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। এ সময়ই তাদের থেকে নির্ভেজাল ঈমান ও তা থেকে জন্মলাভকারী নৈতিক আচরণ করার সামর্থ্য ও শুভবুদ্ধি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তারা নিজেদের জন্য যে মুনাফিকী ও মুনাফিকী চরিত্র পছন্দ করেছিল তার সামর্থ্য ও বুদ্ধিই তাদের দান করা হয়েছে।

# হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অত্যন্ত সুঠামদেহী, সুস্থ, সুদর্শন ও বাকপটু ব্যক্তি ছিল। তার সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকও তাই ছিল। এরা সবাই ছিল মাদীনার নেতৃস্থানীয় লোক। তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে যখন আসতো তখন দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসতো এবং রসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা বলতো। তাদের দেহাবয়ব ও চেহারা-আকৃতি দেখে আর কথাবার্তা শুনে কেউ কল্পনাও করতে পারতো না যে, সমাজের এসব সম্মানিত লোকেরা চরিত্রের দিক দিয়ে এত নীচ ও জঘন্য হতে পারে।

৪-৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# এরা যারা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে তারা মানুষ নয়, বরং কাঠের গুড়ি। তাদেরকে কাষ্ঠখণ্ডের সাথে তুলনা করে বুঝানো হয়ে ছে যে, নৈতিক চরিত্র মানুষের মূল প্রাণসত্তা, সেই প্রাণসত্তাই তাদের মধ্যে নেই। তারপর তাদেরকে দেয়ালগাত্রে হেলান দিয়ে খাড়া করা কাষ্ঠখন্ডের সাথে তুলনা করে এ কথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, তা একেবারেই অকেজো, অপদার্থ। কেননা, কাঠ কেবল তখনই উপকারে আসে যদি তা ছাদে অথবা দরজায় বা আসবাব তৈরীর কাজে ব্যবহার করা হয়। দেয়াল গাত্রে হেলান দিয়ে রাখা কাষ্ঠখন্ড কোন উপকারেই আসে না।

# ছোট্ট এই আয়াতাংশে তাদের অপরাধী বিবেকের চিত্র অংকন করা হয়েছে। ঈমানের বাহ্যিক পর্দার আড়ালে মুনাফিকীর যে খেলা তারা খেলছিল তা নিজেরা যেহেতু ভাল করেই জানতো, তাই সবসময় তারা ভীতসন্ত্রস্ত থাকতো যে কখনো যেন তাদের অপরাধের গোপনীয়তা প্রকাশ পেয়ে যায়, অথবা তাদের আচরণের ব্যাপারে ঈমানদারদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় এবং তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়। জনপদের কোন স্থান থেকে কোন বড় আওয়াজ শোনা গেলে অথবা কোথাও কোন শোরগোল উত্থিত হলে তারা ভয়ে জড়সড় হয়ে যেত এবং মনে করত, আমার দুর্ভাগ্য বোধ হয় এসেই পড়ল।

#.অন্য কথায় প্রকাশ্য দুশমন তুলনায় ছদ্মবেশী এসব দুশমন অনেক বেশী ভয়ংকর।

# তাদের বাহ্যিক চালচলন ও আচার আচরণ দেখে প্রতারিত হয়ো না। এ ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকো যে, এরা যে কোন সময় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।

# এটা বদদোয়া নয়, বরং তারা যে আল্লাহর গযবের উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং সে গযব যে অবশ্যই নাযিল হবে-এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তারই ঘোষণা। এও হতে পারে যে, আল্লাহ‌ তা’আলা এ বাকাংশটি আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করেননি এবং আরবী বাকরীতি অনুসারে, অভিশাপ ও তিরস্কার অর্থে ব্যবহার করেছেন। আমাদের নিজস্ব ভাষায় আমরা যেমন বলিঃ ওর সর্বনাশ হোক, কি জঘন্য মানুষ সে। এখানে “সর্বনাশ” শব্দটি দ্বারা তার জঘন্যতার তীব্রতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, বদদোয়া করা নয়।

# তাদেরকে ঈমানের পথ থেকে মুনাফিকীর পথে কে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা বলা হয়নি। একথাটি স্পষ্ট করে না বলার কারণে আপনা থেকেই যে অর্থ প্রকাশ পায় তা হলো, তাদের এই এলোপাতাড়ি ও অস্বাভাবিক আচরণের চালিকাশক্তি একটি নয়, বরং বহু সংখ্যক চালিকাশক্তি এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে। তাদের পেছনে এই চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে শয়তান, অসৎ বন্ধু-বান্ধব এবং তাদের কুপ্রবৃত্তির আকাংখাসমূহ। কারো স্ত্রী, কারো সন্তান-সন্তুতি, কারো নিজ গোত্র ও গোষ্ঠীর অসৎলোকজন তাকে এ পথে চলতে বাধ্য করছে। আবার কাউকে তার হিংসা, বিদ্বেষ ও অহমিকা এ পথে তাড়িত করেছে।
# তারা ইসতিগফারের জন্য রসূলের কাছে আসে না শুধু তাই নয়, বরং এ কথা শুনে অহংকার ও গর্ব মাথা ঝাঁকুনি দেয়। রসূলের কাছে আসা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করাকে নিজেদের জন্য অপমানজনক ও মর্যাদাহানিকর মনে করে আপন অবস্থানে অনড় থাকে। তারা যে ঈমানদার নয় এটা তার স্পষ্ট প্রমাণ।
# হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম বলেনঃ আমি যখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের এ কথা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম এবং সে এসে শপথ করে পরিষ্কার ভাষায় তা অস্বীকার করলো তখন আনসারদের প্রবীণ ও বয়োবৃদ্ধ লোকজন এবং আমার আপন চাচা আমাকে অনেক তিরস্কার করলেন। এমনকি আমার মনে হলো নবীও ﷺ আমাকে মিথ্যাবাদী এবং আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে সত্যবাদী মনে করেছেন। এতে আমার এত দুঃখ ও মনঃকষ্ট হলো যা সারা জীবনে কখনো হয়নি। আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিজের জায়গায় বসে পড়লাম। পরে এ আয়াতগুলো নাযিল হলে রসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে ডেকে হাসতে হাসতে আমার কান ধরে বললেনঃ ছোকরাটার কান ঠিকই শুনেছিল। আল্লাহ‌ নিজে তা সত্য বলে ঘোষণা করেছেন। (ইবনে জারীর। এ বর্ণনা অনুরূপ বর্ণনা তিরমিযীতেও আছে)।

# সম্মান ও মর্যাদা মূলত আল্লাহর সত্তার জন্য নির্দিষ্ট আর রসূলের মর্যাদা রিসালাতের কারণে এবং ঈমানদারদের মর্যাদা তাদের ঈমানের কারণে। এরপর থাকে কাফের, ফাসেক ও মুনাফিকদের মর্যাদার ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদায় তাদের কোন অংশ নেই।

১-৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ :

الْمُنٰفِقُوْنَ শব্দটি المنافق শব্দের বহুবচন। অর্থ হল : যারা দ্বিমুখীতা অবলম্বন করে, যারা মুখে বলে ঈমানের কথা কিন্তু অন্তরে কুফরী, কপটতা। সূরার প্রথম আয়াতের মুনাফিকুন শব্দ থেকে উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর সালাতের প্রথম রাকআতে সূরা জুমু‘আহ পড়তেন আর এর দ্বারা মু’মিনদের উৎসাহিত করতেন। আর দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকুন পড়তেন, আর এর দ্বারা মুনাফিকদের তিরস্কার করতেন। (মাযমাউয যাওয়ায়েদ ২/১৯১, সনদ হাসান)। সূরায় মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সাথীদের মুনাফিকী কর্মকাণ্ড ও মুসলিমদের সাথে তাদের আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। তারা নিজেদেরকে সম্মানিত মনে করে আর আল্লাহর রাসূল ও মু’মিনদেরকে অসম্মানিত মনে করে থাকে। তাদের এসব ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা হয়েছে। সবশেষে মু’মিনদেরকে সম্পদ ও সন্তান সম্পর্কে সতর্ক করছেন যেন কিছুতেই তারা আল্লাহ তা‘আলা থেকে বিমুখ না হয়।

শানে নুযূল :

জায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) বলেন : একদা আমি কোন এক যুদ্ধে ছিলাম। অন্য বর্ণনাতে বলা হয়েছে তাবুক যুদ্ধে (সহীহ বুখারী হা. ৩৫১৮) শুনতে পেলাম আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলছে; যদি আমরা মদীনাতে ফিরে যাই তাহলে সম্মানিতরা অসম্মানিতদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেব। সাহাবী জায়েদ বলেন : এ কথাটা আমি আমার চাচা অথবা উমার (রাঃ)-এর কাছে বললাম। তিনি এটা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উল্লেখ করলেন। জায়েদ (রাঃ) বলছেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডাকলেন, আমি গেলাম এবং এ ঘটনা বললাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গীদের নিকট ডেকে লোক পাঠালেন। তারা এসে শপথ করে বলল : আমরা এরূপ কথা বলিনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করলেন আর তাদের কথা বিশ্বাস করে নিলেন। ফলে আমাকে এমন চিন্তা আক্রান্ত করল যা ইতোপূর্বে কখনো করেনি। আমি (মনের দুঃখে) ঘরে বসে গেলাম। আমার চাচা আমাকে বললেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছেন এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে তোমার মন খারাপ? এ প্রসঙ্গে এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। পরে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছে লোক প্রেরণ করলেন এবং এ সূরাটি পাঠ করে শুনালেন আর বললেন আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্য বলে উল্লেখ করেছেন হে জায়েদ। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০০, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৭২)

১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র সূরাতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। যার অধিকাংশগুলো সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর মানুষ প্রতিনিয়ত ইসলামে দিক্ষিত হতে লাগল। এমনকি যখন আওস ও খাজরায গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করল তখন এক শ্রেণির লোক বাহ্যিক ঈমানের কথা প্রকাশ করল আর অন্তরে কুফরী গোপন রাখল যাতে সমাজে তাদের সম্মান, রক্ত ও সম্পদ হেফাযতে থেকে যায়। এরাই হল মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা এদের গুণাবলী উল্লেখ করে দিয়েছেন যাতে মু’মিনরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারে।

(إِذَا جَا۬ءَكَ الْمُنٰفِقُوْنَ)

‘যখন মুনাফিকরা তোমার নিকট আসে’ এখানে মুনাফিক বলতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সহচর মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। এরা নিজেদের কপটতা গোপন রাখার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে এসে বলে, আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আপনি আল্লাহর রাসূল।

(وَاللّٰهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُه۫)

‘আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল’ এ বাক্যটি পূর্বের বাক্য থেকে আলাদা একটি বাক্য, যা পূর্বের বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করেছে এবং যার প্রকাশ মুনাফিকরা মুনাফিক হিসাবে করত। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : মুনাফিকদের এটা শুধু মুখের কথা, অন্তরে এর বিশ্বাস নেই। তবে আমি জানি যে, তুমি সত্যিই আমার রাসূল।

(إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَكَاذِبُوْنَ)

অর্থাৎ মুনাফিকরা কথায় ও দাবীতে মিথ্যেবাদী।

(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً)

‘তারা তাদের শপথগুলোকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে’ অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের মিথ্যা শপথসমূহকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে। কারণ যারা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানেনা তারা তাদেরকে মুসলিম মনে করবে। ফলে তাদেরকে মুরতাদ হিসাবে হত্যা করা হবে না। এভাবে তারা বেঁচে যাবে। তাদের এরূপ কার্যকলাপে মুসলিমদের অনেক ক্ষতি হয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদেরকে নিজেদের মত মুসলিম মনে করে তাদের কথা ও কাজের অনুসরণ করে। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :

(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ط إِنَّهُمْ سَا۬ءَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْن)‏

“তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে। তারা যা করছে তা কতই না মন্দ।”
মুনাফিকদের এসব কার্যকলাপের কারণ হল তারা তাদের কর্মের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরকে কুফরীর ওপর বদ্ধমূল করে দিয়েছেন।

(ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ اٰمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا)

‘এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে’ এখানে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা কাফির। তারা মুখে ঈমানের কথা স্বীকার করেছে তারপর অন্তর দ্বারা অস্বীকার করেছে। তাই দুনিয়াতে তাদের ওপর কাফিরদের বিধান কার্যকর না হলেও আখিরাতে কাফিরদের কাতারে থাকবে।

(وَإِذَا رَأَيْتَهُمْ تُعْجِبُكَ)

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলছেন : তুমি তাদের দৈহিক কাঠামো, সৌন্দর্য ও সজীবতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে। আর তাদের ভাষার যে বিশুদ্ধতা ও তারা যে বাকপটু তাতে তুমি তাদের কথা সাগ্রহে শুনবে। কিন্তু তারা হিদায়াত থেকে বিমুখ। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :

(كَأَنَّهُمْ خُشُبٌ مُّسَنَّدَةٌ)

অর্থাৎ দেওয়ালে ঠেকানো কাঠ দেখতে ভাল কিন্তু কোন উপকারে আসে না, এ সকল মুনাফিকরাও প্রাচীরে ঠেকানো কাঠের মত, এরা হিদায়াতের কথা শোনার মত নয়।

(يَحْسَبُوْنَ كُلَّ صَيْحَةٍ)

অর্থাৎ এ সকল মুনাফিকদের অন্তরে সন্দেহ, দুর্বলতা, ভীরুতা ও ভয় থাকার কারণে যে কোন ভীতিকর অবস্থা বা হট্টগোল শুনলেই তারা মনে করে হয়তো কোন বিপদ আমাদের ওপর আপতিত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ ج فَإِذَا جَا۬ءَ الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنْظُرُوْنَ إِلَيْكَ تَدُوْرُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِيْ يُغْشٰي عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ ج فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوْكُمْ بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَي الْخَيْرِ ط أُولٰ۬ئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوْا فَأَحْبَطَ اللّٰهُ أَعْمَالَهُمْ ط وَكَانَ ذٰلِكَ عَلَي اللّٰهِ يَسِيْرًا)‏

“তোমাদের প্রতি কার্পণ্য করে আর যখন কোন ভয়ের কারণ সামনে আসে, তখন আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা মৃত্যুভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। অতঃপর যখন সেই ভয় চলে যায়, তখন তারা ধন-সম্পদের লোভে তীব্র ভাষায় তোমাদেরকে আক্রমণ করে। তারা ঈমান আনেনি। অতএব আল্লাহ তাদের কার্যসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এরূপ করা আল্লাহ্র জন্য খুবই সহজ।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ১৯)

মুনাফিকী একটি মারাত্মক ব্যাধি যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। মুনাফিকরা মুসলিমদের জন্য কাফিরদের চেয়ে ভয়ংকর। সুতরাং নিজেরা মুনাফিকী চরিত্র থেকে বেঁচে থাকব এবং মুসলিম সমাজকে এ সম্পর্কে সতর্ক করব।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মুনাফিকরা কাফিরদের চেয়েও মুসলিমদের জন্য বেশি ক্ষতিকর।
২. মুনাফিকরা ফেতনা-ফাসাদ ও অরাজকতা সৃষ্টি করে বেড়ায়।
৩. মুনাফিকরা নিজেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বেশি বেশি শপথ করবে।
৪. মুনাফিকরা ঈমানদারদের সামনে খুব চমকপ্রদভাবে নিজেদের কথা উত্থাপন করে থাকে যাতে তারা তাদের অন্তরের খবর বুঝতে না পারে।
৫. মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলিমদের চরম শত্রু।
৫-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে তুলে ধরে বলছেন। এদেরকে যদি বলা হয়, তোমরা তোমাদের কৃত অপরাধ ও কুফরীর জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট যাও, তিনি তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইবেন। অথচ তারা ক্ষমা না চেয়ে উদ্ধত্য ও বড়ত্ব প্রকাশ করে মাথা ফিরিয়ে নিবে। তারা কখনো ক্ষমা চাইবে না। কারণ তারা ক্ষমা চাইলেই নিজেদেরকে অপমানিত মনে করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্ষমা চান আর না চান তিনি ক্ষমা করবে না।

(هُمُ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ لَا تُنْفِقُوْا عَلٰي مَنْ عِنْدَ رَسُوْلِ اللّٰهِ) শানে নুযূল :

জায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) বলছেন : যখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলল : আল্লাহ তা‘আলার রাসূলের নিকট যারা আছে (অর্থাৎ সাহাবীরা) তাদের জন্য কিছুই ব্যয় করো না। এবং আরো বলল : যদি আমরা মদীনায় ফিরে যাই তাহলে সম্মানিত ব্যক্তিরা অসম্মানিতদেরকে বের করে দেব। আমি এ কথা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালাম (এ কথা শুনে) আনসারীরা আমাকে তিরস্কার করতে লাগলে। আব্দুল্লাহ বিন উবাই শপথ করে বলল : সে এসব কথা বলেনি। আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম এবং ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডাকলেন আমি তাঁর কাছে আসলাম। তিনি বললেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্য বলে উল্লেখ করেছেন এবং

(هُمُ الَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ لَا تُنْفِقُوْا)

আয়াত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০২, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৭২)

জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমরা কোন এক যুদ্ধে ছিলাম। (যাকে ঐতিহাসিকগণ মুরাইসী অথবা বানী মুসতালিক বলেছেন)। জনৈক মুহাজির আনসারীদের এক ব্যক্তিকে নিতম্বে আঘাত করলেন। তখন আনসারী সাহাবী “মুহাজির ভাইগণ” বলে ডাক দিলেন। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলের কানে এ কথা পৌঁছে দিলেন। তিনি বললেন : এটা কেমন ডাকাডাকি। অন্য বর্ণনায় রয়েছে : তোমাদের কী হল যে, জাহিলিয়া যুগের প্রথা ডেকে নিয়ে আসছো। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০৫) উপস্থিত লোকেরা বললেন : জনৈক মুহাজির ব্যক্তি এক আনসারী ব্যক্তির নিতম্বে আঘাত করেছে। আনসারী ব্যক্তি হে আনসারী ভাইগণ বলে আর মুহাজির ব্যক্তি হে মুহাজির ভাইগণ বলে নিজ নিজ গোত্রকে ডাক দিলেন। এ কথা শুনে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : এ রকম ডাকাডাকি ত্যাগ কর, এগুলো অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত কথা। জাবের (রাঃ) বলছেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় হিজরত করে আসেন তখন আনসারী সাহাবীদের সংখ্যা বেশি ছিল। পরে মুহাজিরদের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। এ কথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলল : সত্যিই তারা কি এমন করেছে? আল্লাহ তা‘আলার শপথ আমরা মদীনায় ফিরে গেলে সম্মানিত ব্যক্তিরা অসম্মানিত ব্যক্তিদের বের করে দেব। উমার (রাঃ) বলছেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ছেড়ে দিন, আমি এ মুনাফিকদের গর্দান উড়িয়ে দিই। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : উমার (রাঃ) তাকে ছেড়ে দাও যাতে লোকেরা এমন কথা বলতে না পারে মুহাম্মাদ তাঁর সাথীদের হত্যা করে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০৭, সহীহ মুসলিম হা. ২৫৮৪)

আব্দুল্লাহ বিন উবাই সম্মানিত বলতে নিজের দলবলের লোকদের বুঝাতো আর অসম্মানিত বলতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদেরকে বুুঝাতো। মূলত সম্মান তো কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল ও মু’মিনদের জন্য।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মু’মিনদের সাথে মুনাফিকদের চরম শত্রুতার কথা জানতে পারলাম।
২. মুনাফিকদের জন্য দু‘আ প্রার্থনা উপকারে আসবে না।
৩. রিযিক ও মান সম্মানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন।
৪. মুনাফিকরা মু’মিনদের বিপদ-আপদের সুযোগ খুঁজে।

১-৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা মুনাফিকদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেন যে, যখন তারা নবী (সঃ)-এর নিকট আসে তখন শপথ করে করে ইসলাম প্রকাশ করে এবং তাঁর রিসালাত স্বীকার করে। কিন্তু প্রকতপক্ষে তাদের অন্তর ইসলাম হতে বহু দূরে রয়েছে। নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর নবী এবং মুনাফিকদের উক্তিও এটাই। কিন্তু তাদের অন্তরে এর কোন ক্রিয়া নেই। সুতরাং তারা মিথ্যাবাদী।

মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ এই মুনাফিকরা তোমার কাছে এসে কসম খেয়ে খেয়ে তোমার রিসালাতের স্বীকারোক্তি করে। কিন্তু তুমি বিশ্বাস রেখো যে, তাদের এই কসমের কোনই মূল্য নেই। এটা তাদের মিথ্যাকে সত্য বানাবার একটা মাধ্যম মাত্র।

এর দ্বারা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো এই যে, মুমিনগণ যেন তাদের হতে সতর্ক থাকে। তারা যেন এই মুনাফিকদেরকে খাঁটি মুমিন মনে করে তাদের কোন কাজে তাদের অনুসরণ না করে। কেননা, তারা ইসলামের নামে কুফরী করিয়ে ফেলবে। তারা আল্লাহর পথ হতে বহু দূরে রয়েছে এবং তাদের আমল অতি জঘন্য।

যহহাক (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবি) অর্থাৎ (আরবি) তে যের দিয়ে রয়েছে। তখন ভাবার্থ হবেঃ তারা তাদের বাহ্যিক স্বীকারোক্তিকে নিজেদের জীবন রক্ষার মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে যে, তারা হত্যা ও কুফরীর হুকুম হতে দুনিয়ায় বেঁচে যাবে। তাদের অন্তরে নিফাক স্থান করে নিয়েছে। তাই তারা ঈমান হতে ফিরে গিয়ে কুফরীর দিকে এবং হিদায়াত হতে সরে গিয়ে গুমরাহীর দিকে চলে এসেছে। এখন তাদের হৃদয় মোহর করে দেয়া হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে যে বোধশক্তি ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। বাহ্যতঃ তো তারা মুখে মিষ্টি কথা বলে এবং তারা বেশ বাকপটু। কিন্তু তাদের অন্তর কালিমাময়।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তারা যে কোন শোরগোলকে মনে করে তাদেরই বিরুদ্ধে।’ অর্থাৎ যখনই কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তখন তারা ধারণা করে নেয় যে, তাদের উপর হয়তো তা আপতিত হচ্ছে। তাই তারা মৃত্যুর ভয়ে হা-হুতাশ করে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমাদের ব্যাপারে কৃপণতা বশতঃ (যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করার ব্যাপারে মুনাফিকরা কৃপণতা প্রকাশ করেছিল), যখন বিপদ আসে তখন তুমি দেখবে, মৃত্যু ভয়ে মূৰ্ছাতুর ব্যক্তির মত চক্ষু উলটিয়ে তারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ চলে যায় তখন তারা ধনের লালসায় তোমাদেরকে তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। তারা ঈমান আনেনি, এই জন্যে আল্লাহ তাদের কার্যাবলী নিষ্ফল করেছেন, আর আল্লাহর পক্ষে এটা সহজ।” (৩৩:১৯)

এ জন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তারাই শত্রু, অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক হও, আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! বিভ্রান্ত হয়ে তারা কোথায় চলেছে?

হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মুনাফিকদের বহু নিদর্শন রয়েছে যেগুলো দ্বারা তাদেরকে চেনা যায়। তাদের সালাম হলো লা’নত, তাদের খাদ্য হলো লুঠতরাজ, তাদের গানীমাত হলো হারাম ও খিয়ানত, তারা মসজিদের নিকটবর্তী হওয়াকে অপছন্দ করে, নামাযের জন্যে তারা শেষ সময়ে এসে থাকে, তারা অহংকারী ও আত্মগর্বী হয় এবং তারা নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ হতে বঞ্চিত থাকে। তারা নিজেরাও ভাল কাজ করে না এবং অন্যদেরকেও ভাল কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে না। তারা রাত্রে খড়ি এবং দিনে শোরগোলকারী।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত রয়েছে) অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, তারা দিনে খুবই পানাহারকারী হয় এবং রাত্রে শুষ্ক কাঠের মত তারা পড়ে থাকে।

৫-৮ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা অভিশপ্ত মুনাফিকদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেনঃ তাদের কৃত পাপের ব্যাপারে খাঁটি মুসলমানরা যখন তাদেরকে বলেঃ এসো, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তোমাদের পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা গর্বভরে মাথা দুলিয়ে থাকে। এভাবে তারা বিমুখ হয়ে যায়। এর প্রতিফল হলো এই যে, তাদের জন্যে ক্ষমার দর বন্ধ। তাদের জন্যে নবী (সঃ)-এর ক্ষমা প্রার্থনা তাদের কোনই উপকারে আসবে না। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। সূরায়ে বারাআতে এই বিষয়েই আয়াত গত হয়েছে এবং সেখানে এর তাফসীর এবং সাথে সাথে এই সম্পর্কীয় হাদীসসমূহও বর্ণিত হয়েছে।

মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে যে, মুনাফিক সুফইয়ান তার মুখখানা ডান দিকে ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং ক্রোধ ও গর্বের সাথে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল। ওরই বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে। এগুলো সবই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল সম্পর্কে বর্ণনা, এরূপ মন্তব্য করেছেন পূর্বযুগীয় অধিকাংশ গুরুজন। যেমন এটা সত্বরই আসছে ইনশাআল্লাহ।

সীরাতে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের মধ্যে রয়েছে যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল তার কওমের মধ্যে এক বড় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিল। জুমআ’র দিন নবী (সঃ) যখন খুৎবাহ দেয়ার জন্যে দাঁড়াতেন তখন সে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলতোঃ “হে জনমণ্ডলী! ইনি হলেন আল্লাহর রাসূল (সঃ)। ইনি তোমাদের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছেন। এরই কারণে আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে মর্যাদা দান করেছেন। সুতরাং তাঁকে সাহায্য করা এখন তোমাদের অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা তাঁকে সম্মান করবে ও মর্যাদা দিবে এবং তিনি যা কিছু বলবেন সবই মেনে চলবে।” এ কথা বলে সে বসে পড়তো। উহুদের যুদ্ধে তার কপটতা প্রকাশ পেয়ে যায়। সেখান হতে সে প্রকাশ্যভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অবাধ্যাচরণ করে এক তৃতীয়াংশ সৈন্য নিয়ে মদীনায় ফিরে আসে। যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন মদীনায় ফিরে আসেন এবং জুমআ’র দিনে মিম্বরের উপর উপবিষ্ট হন তখন অভ্যাসমত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সেদিনও দাঁড়িয়ে যায় এবং সে কথা বলতে যাবে এমতাবস্থায় কয়েক জন সাহাবী এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে যান এবং তার কাপড় ধরে নিয়ে বলে ওঠেনঃ “ওরে আল্লাহর দুশমন! তুই বসে যা। এখন তোর কথা বলার মুখ নেই। তুই যা কিছু করেছিস তা আর কারো কাছে গোপন নেই। তোর আর ঐ যোগ্যতা নেই যে, মন যা চাইবে তাই বলবি।” সে তখন অসন্তুষ্ট হয়ে জনগণের ঘাড়ের উপর দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। সে বলতে বলতে গেলঃ “আমি কি কোন মন্দ কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম? আমি তো তাঁর কাজ মযবুত করার উদ্দেশ্যেই দাঁড়িয়েছিলাম।” মসজিদের দরজার উপর কয়েক জন আনসারীর সাথে তার সাক্ষাৎ হলো। তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ব্যাপার কি?” উত্তরে সে বললঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাজকে দৃঢ় করার উদ্দেশ্যেই দাঁড়িয়েছিলাম এমন সময় কয়েকজন সাহাবী আমার উপর লাফিয়ে পড়ে আমাকে টানা-হেঁচড়া করতে শুরু করে এবং আমাকে ধমকাতে থাকে। তাদের ধারণায় আমি যেন কোন মন্দ কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম। অথচ আমার উদ্দেশ্য শুধু এই ছিল যে, আমি তাঁর কথা ও কাজেরই পৃষ্টপোষকতা করবো।” একথা শুনে ঐ আনসারীগণ বললেনঃ “ভাল কথা, তুমি ফিরে চল। আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট আবেদন জানাবো যে, তিনি যেন তোমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সে তখন বললোঃ “আমার এর কোন প্রয়োজন নেই।”

হযরত কাতাদাহ (রঃ) ও হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ঘটনাটি ছিল এই যে, তারই কওমের একজন যুবক মুসলমান তার এ ধরনের কার্যকলাপের কথা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ডাকিয়ে নেন। সে সরাসরি অস্বীকার করে। সে মিথ্যা শপথও করে। তখন আনসারীগণ ঐ সাহাবীকে তিরস্কার এবং শাসন-গর্জন করেন ও মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেন। ঐ সময় এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। এতে আল্লাহ্ তা’আলা মুনাফিকের মিথ্যা শপথের এবং যুবক সাহাবীটির সত্যবাদীতার বর্ণনা দিয়েছেন। অতঃপর ঐ মুনাফিককে বলা হয়ঃ “চলো, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর মাধ্যমে তোমার পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে নাও।” তখন সে অস্বীকার করে এবং মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যায়।

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কোন মনযিলে অবতরণ করলে সেখানে নামায না পড়া পর্যন্ত যাত্রা শুরু করতেন না। তাবূকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) খবর পেলেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বলছেঃ “আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথা হতে প্রবল ও সম্মানীরা দুর্বল ও লাঞ্ছিতদেরকে বহিষ্কার করবেই।” অর্থাৎ আমরা এই দুর্বল ও মর্যাদাহীন মুহাজিরদেরকে আমাদের শহর মদীনা হতে বের করে দিবো। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দিনের শেষ ভাগে অবতরণের পূর্বেই যাত্রা শুরু করে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে বলা হয়ঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে তোমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর।” তখন আল্লাহ্ তা’আলা (আরবি) হতে (আরবি) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ ইবনে সীরীন পর্যন্ত তো সঠিক বটে, কিন্তু এটা তাবূকের ঘটনা একথা বলার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে, এমনকি এটা সঠিক কথাই নয়। কেননা, তাবূকের যুদ্ধে তো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই হাযিরই ছিল না, বরং সে তার একটি দল নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। কুতুবে। মাগাযী ও সিয়ারের লেখকগণ এ মন্তব্য করেছেন যে, এ মুরীসী যুদ্ধের ঘটনা এবং ???)

এই ঘটনায় হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে হিব্বান (রঃ), হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আবি বকর (রঃ) এবং হযরত আসিম ইবনে উমার ইবনে কাতাদাহ্ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এই যুদ্ধস্থলে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এক জায়গায় অবস্থান করছিলেন। তথায় পানির জায়গার উপর যে জনসমাবেশ ছিল ওর মধ্যে হযরত জাহজাহ ইবনে সাঈদ গিফারী (রঃ) ও হযরত সিনান ইবনে ইয়াযীদ (রাঃ)-এর মাঝে কিছু ঝগড়া হয়ে যায়। হযরত জাহজাহ (রাঃ) হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর একজন কর্মচারী ছিলেন। ঝগড়া চরম আকার ধারণ করে। হযরত সিনান (রাঃ) সাহায্যের জন্যে আনসারদেরকে আহবান করেন এবং হযরত জাহজাহ্ (রাঃ) আহ্বান করেন মুহাজিরদেরকে। ঐ সময় হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) প্রমুখ আনসারদের একটি দল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর পাশে উববিষ্ট ছিলেন। এই ফরিয়াদ শুনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই বলতে শুরু করেঃ “আমাদের শহরেই এ লোকগুলো আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করে দিলো? আমাদের ও এই কুরায়েশদের দৃষ্টান্ত ওটাই যাকে একজন বলেছে- ‘স্বীয় কুকুরকে তুমি মোটা-তাজা কর যাতে সে তোমাকেই কামড় দেয়। আল্লাহর শপথ! আমরা মদীনায় ফিরে গেলে তথা হতে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কার করবেই।” অতঃপর সে তার পাশে উপবিষ্ট লোকদেরকে সম্বোধন করে বলতে শুরু করলোঃ “সব বিপদ তোমরা নিজেরাই নিজেদের হাতে টেনে এনেছো। তোমরা এই মুহাজিরদেরকে তোমাদের শহরে জায়গা দিয়েছে এবং নিজেদের সম্পদের অর্ধাংশ দান করেছে। এখনো যদি তোমরা তাদেরকে আর্থিক সাহায্য না কর তবে তারা সংকটে পড়ে মদীনা হতে বেরিয়ে যাবে।” হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) এসব কথাই শুনলেন। ঐ সময় তিনি অল্প বয়স্ক ছিলেন। তিনি সরাসরি নবী (সাঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন। ঐ সময় তাঁর নিকট হযরত উমার ইবনে খাত্তাবও (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন। রাগান্বিত হয়ে তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (রঃ)! আমাকে নির্দেশ দিন, আমি তার গদান উড়িয়ে দিই।” তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ “এ কাজ করলে এটা প্রচারিত হয়ে পড়বে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজের সঙ্গী-সাথীদেরকেও হত্যা করে থাকেন। এটা ঠিক হবে না। যাও, লোকদেরকে যাত্রা শুরু করার হুকুম দিয়ে দাও।” আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যখন এ খবর পেলো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তার কথা জেনে ফেলেছেন তখন সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো এবং তাঁর দরবারে হাযির হয়ে ওযর-আপত্তি, হীলা-বাহানা করতে লাগলো এবং কথা পাল্টাতে শুরু করলো। আর শপথ করে বলতে লাগলো যে, সে এরূপ কথা কখনো বলেনি। এই লোকটি তার সম্প্রদায়ের মধ্যে খুবই মর্যাদাবান ও প্রভাবশালী ছিল। তাছাড়া লোকেরাও বলতে লাগলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! সম্ভবতঃ এই বালকটিই ভুল বলেছে। সে হয়তো ধারণা করেছে, প্রকৃত ঘটনা হয়তো এটা নয়।” রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সময়ের পূর্বেই এখান হতে তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিলেন। পথে হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়ের (রাঃ) তাঁর সাথে মিলিত হন এবং তাঁর নবুওয়াতের যথাযোগ্য আদবের সাথে তাঁকে সালাম করেন। অতঃপর আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আজ যে সময়ের পূর্বেই যাত্রা শুরু করেছেন, ব্যাপার কি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে বলেনঃ “তোমার কি জানা নেই যে, তোমাদের সঙ্গী আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই বলেছেঃ “মদীনায় পৌঁছে আমরা সম্মানিত ব্যক্তিরা লাঞ্ছিত ব্যক্তিদেরকে অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে বহিষ্কার করে দিবো?” তখন হযরত উসায়েদ (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! সম্মানিত তো আপনিই, আর লাঞ্ছিত হলো তো সেই। আপনি তার কথাকে মোটেই পরোয়া করবেন না। আসলে মদীনায় আপনার আগমনে সে ক্রোধে ও হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছে। মদীনাবাসীরা তাকে নেতা নির্বাচন করার উপর ঐকমত্যে পৌঁছেছিল এবং তার মাথার মুকুটও তৈরী হচ্ছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন আপনাকে এখানে আনিয়েছেন এবং রাজত্ব তার হাত হতে ছুটে গেছে। কাজেই আপনার উপর সে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে। হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! চলতে থাকুন।” তাঁরা দুপুরেই যাত্রা শুরু করেছিলেন। সন্ধ্যা হলো, রাত্রি হলো, সকাল হলো, এমনকি রৌদ্রের প্রখরতা এসে গেলে তিনি শিবির স্থাপন করলেন, যাতে জনগণ আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই-এর ঐ কথায় মুষড়ে না পড়ে। জনগণের ক্লান্তি ও রাত্রি জাগরণ ছিল বলে অবতরণ করা মাত্রই সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। আর এদিকে এই সূরায়ে মুনাফিকূন অবতীর্ণ হয়ে গেল। (এটা সীরাতে ইসহাক নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলাম। একজন মুহাজির একজন আনসারকে পাথর মেরে দেন। এটাকে কেন্দ্র করে কথা বেড়ে চলে এবং উভয়েই নিজ নিজ দলের নিকট ফরিয়াদ জানান এবং তাঁদেরকে আহ্বান করেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং বলেনঃ “একি অজ্ঞতার যুগের কাজ-কারবার শুরু করলে তোমরা? এই বেদুঈনী অভ্যাস পরিত্যাগ কর।” আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল বলতে লাগলোঃ “এখন মুহাজিরগণ এরূপ করতে শুরু করলো? আল্লাহর কসম! মদীনায় পৌঁছেই আমরা সম্মানীরা এই লাঞ্ছিতদেরকে মদীনা হতে বের করে দিবো।” ঐ সময় মদীনায় আনসারদের সংখ্যা মুহাজিরদের অপেক্ষা বহু গুণে বেশী ছিল। তবে পরবর্তীতে মুহাজিরদের সংখ্যা অনেক হয়ে যায়। হযরত উমার (রাঃ) যখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর এ কথা শুনতে পেলেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে এ কাজ হতে বিরত রাখলেন।” (এ হাদীসটি হাফিয আবূ বকর বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বলেনঃ “আমি তাবূকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বললোঃ “আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথা হতে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কার করবেই।” আমি তার এ কথা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বর্ণনা করলাম। কিন্তু সে এসে অস্বীকার করে বসলো ও শপথ করলো। ঐ সময় আমার সম্প্রদায় আমাকে বহু কিছু গাল মন্দ দিলো এবং নানা প্রকারে তিরস্কার করলো যে, আমি এরূপ কেন করলাম? আমি দুঃখিত মনে সেখান হতে চলে আসলাম। আমার দুঃখের কোন সীমা থাকলো না। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলা তোমার ওযর ও সত্যবাদিতা (সম্পৰ্কীয় আয়াত) অবতীর্ণ করেছেন। ঐ সময় … (আরবি)-এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)

মুসনাদে আহমাদে এটা এভাবেও বর্ণিত আছে যে, হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) বলেনঃ “আমি আমার চাচার সাথে এক যুদ্ধে ছিলাম। আমি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে এ দু’টি কথা বলতে শুনলামঃ “আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর সহচরদের জন্যে ব্যয় করো না” এবং “তারা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথা হতে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কার করবেই।” আমি এটা আমার চাচার নিকট বর্ণনা করি এবং আমার চাচা তা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে ডেকে পাঠালে সে সম্পূর্ণরূপে কথাগুলো অস্বীকার করে এবং শপথও করে নেয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার কথা সত্য ও আমার কথা মিথ্যা বলে মেনে নেন। আমার চাচাও আমাকে বহু তিরস্কার করেন। আমি এতে এতো বেশী দুঃখিত ও লজ্জিত হই যে, বাড়ী হতে বের হওয়া পরিত্যাগ করি। শেষ পর্যন্ত এই সূরাটি অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার সত্যতা স্বীকার করেন এবং সূরাটি আমাকে পড়ে শুনিয়ে দেন।

মুসনাদে আহমাদের অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, এক সফরে সাহাবীগণ সংকটময় অবস্থায় পতিত হলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উপরোক্ত কথা দু’টি বলে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে ডেকে পাঠিয়ে একথা জিজ্ঞেস করলে সে তা অস্বীকার করে এবং শপথ করে বলে যে, সে এরূপ কথা কখনো বলেনি। তখন জনগণ যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-কে মিথ্যাবাদী রূপে সাব্যস্ত করেন। এতে হযরত যায়েদ (রাঃ) খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত হন। ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা এ সূরাটি অবতীর্ণ করেন। আল্লাহর রাসূল (সঃ) তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তাদেরকে (মুনাফিকদেরকে) ডাকলে তারা মাথা ফিরিয়ে নেয়।

আল্লাহ তা’আলা মুনাফিকদেরকে দেয়ালে ঠেকানো কাঠের স্তম্ভ সদৃশ এই কারণে বলেছেন যে, তারা দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে সুন্দর ছিল।

জামে তিরমিযীতে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “আমরা এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে বের হই। কিছু বেদুঈনও আমাদের সাথে ছিল। পানির জায়গায় তারা প্রথমেই পৌঁছতে চাইতো। অনুরূপভাবে আমরাও ঐ চেষ্টাতেই থাকতাম। একদা একজন বেদুঈন গিয়ে পানি দখল করে নেয় এবং হাউয পূর্ণ করে হাউযের চতুর্দিকে সে পাথর রেখে দেয় এবং উপর হতে চামড়া ছড়িয়ে দেয়। একজন আনসারী এসে ঐ হাউযের মধ্য হতে নিজের উটকে পানি পান করাবার ইচ্ছা করে। বেদুঈন তাকে বাধা দেয়। আনসারী জোরপূর্বক পানি পান করাতে গেলে ঐ বেদুঈন লাঠি দ্বারা আনসারীর মাথায় আঘাত করে। ফলে আনসারীর মাথা জখম হয়। আনসারী আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর লোক ছিল বলে সরাসরি তার কাছে চলে যায় এবং ঘটনাটি বর্ণনা করে। এতে সে ভীষণ রাগান্বিত হয় এবং বলেঃ “এই বেদুঈনদেরকে কিছুই দিয়ো না, তাহলে তারা আপনা আপনি ক্ষুধার জ্বালায় পালিয়ে যাবে। এই বেদুঈনরা আহারের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আসতো এবং খেয়ে নিতো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার সঙ্গীদেরকে বললোঃ “তোমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খাদ্য নিয়ে এমন সময় যাবে যখন এই বেদুঈনরা থাকবে না। তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে খাদ্য খেয়ে নিবেন এবং এরা খেতে পাবে না। তখন এরা না খেয়ে খেয়ে আপনা আপনি পালিয়ে যাবে। আর আমরা মদীনায় গিয়ে এ হীন ও ছোট লোকদেরকে মদীনা হতে বের করে দিবো।” আমি আমার চাচার পিছনে বসতাম। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যা কিছু বললো আমি তার সবই শুনলাম এবং আমার চাচার নিকট বর্ণনা করলাম। আমার চাচা তা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে ডাকিয়ে নিলেন। সে সবকিছুই অস্বীকার করলো এবং শপথও করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে সত্যবাদী মনে করলেন এবং আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলেন। আমার চাচা আমার কাছে এসে আমাকে বললেনঃ “তুমি এটা করলে? রাসূলুল্লাহ (সঃ) তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছেন। অন্যান্য মুসলমানরাও তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছে।’ এ কথা শুনে তো আমার উপর দুঃখের পাহাড় ভেঙ্গে পড়লো। আমি অত্যন্ত দুঃখিত অবস্থায় মাথা নীচু করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে চলছিলাম। অল্পক্ষণ পরেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট আসলেন এবং আমার কান ধরলেন। আমি ফিরে তাকিয়ে দেখি যে, তিনি মুচকি হাসছেন। আল্লাহর শপথ! ঐ সময় আমি এতো বেশী খুশী হয়েছিলাম যে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। যদি আমি দুনিয়ার চিরস্থায়ী জীবন লাভ করতাম তবুও এতো খুশী হতে পারতাম না। অতঃপর হযরত আবূ বকর (রাঃ) আমার কাছে এসে আমাকে বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) তোমাকে কি বললেন?” আমি উত্তরে বললাম, তিনি কিছুই আমাকে বলেনি, শুধু মুচকি হেসে চলে গেলেন। তখন তিনি বললেনঃ “ঠিক আছে, তুমি খুশী হও।” তাঁর চলে যাওয়ার পরেই হযরত উমার (রাঃ) আমার কাছে আসলেন এবং ঐ প্রশ্নই আমাকে করলেন। আমিও ঐ একই জবাব দিলাম। সকালে সূরায়ে মুনাফিকূন অবতীর্ণ হলো।” অন্য রিওয়াইয়াতে সূরাটি (আরবি) পর্যন্ত পড়াও বর্ণিত আছে।

আবদুল্লাহ ইবনে লাহীআহ (রঃ) এবং মূসা ইবনে উকবাও (রঃ) এই হাদীসটি মাগাযীর মধ্যে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এ দু’জনের বর্ণনায় সংবাদদাতার নাম আউস ইবনে আকরাম রয়েছে, যে বানু হারেস ইবনে খাযরাজ গোত্রভুক্ত ছিল। তাহলে সম্ভবতঃ হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) ও খবর পৌঁছিয়েছিলেন এবং হযরত আউসও (রাঃ) পৌঁছিয়েছিলেন। আবার এও হতে পারে যে, বর্ণনাকারী নামে ভুল করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রাঃ) এবং হযরত আমর ইবনে সাবিত আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এটা গাযওয়ায়ে মুরীসীর ঘটনা। এটা ঐ যুদ্ধ যাতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত খালেদ (রাঃ)-কে প্রেরণ করে ‘মানাত’ প্রতিমাকে ভাঙ্গিয়েছিলেন যা কিফা মুশাললাল ও সমুদ্রের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল। এই যুদ্ধেই দুই জন লোকের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। একজন ছিলেন মুহাজির এবং অন্যজন ছিলেন বাহায় গোত্রের লোক। বাহায গোত্র আনসারদের মিত্র ছিল। বাহযী আনসারদেরকে এবং মুহাজির মুহাজিরদেরকে আহ্বান করে। উভয়পক্ষের কিছু লোক দাঁড়িয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়া শেষ হলে মুনাফিক ও রোগা অন্তরের লোকেরা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর নিকট একত্রিত হয় এবং তাকে বলেঃ “আপনার কাছে তো আমরা বহু কিছু আশা করেছিলাম। আমাদের শত্রুদের ব্যাপারে আপনি ছিলেন আমাদের রক্ষক। এখন তো আপনি একেবারে অকেজো ও কর্ম বিমুখ হয়ে পড়েছেন। এখন না আছে আপনার কোন উপকারের চিন্তা, না ক্ষতির চিন্তা। আপনিই তো এই মুহাজিরদেরকে এতোটা উপরে উঠিয়ে দিয়েছেন? কথায় কথায় তারা আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। নতুন মুহাজিরদেরকে তারা জালাবীব বলতো। আল্লাহর ঐ শত্রু জবাবে বললোঃ “আল্লাহর কসম! আমরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে অবশ্যই প্রবলরা দুর্বলদেরকে বহিষ্কার করবে।” মুনাফিক মালিক ইবনে দাখশান বললোঃ “আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি যে, এদের সঙ্গে সুসম্পর্ক পরিত্যাগ করা হোক, তাহলে তারা আপনা আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে?” হযরত উমার (রাঃ) এসব কথা শুনে নেন। তিনি নবী পাক (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করেনঃ লোকদের মধ্যে হাঙ্গামার গোড়া পত্তনকারী এই লোকটির ব্যাপারে আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিই।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “আমি যদি তোমাকে অনুমতি দিই তবে কি তুমি তাকে হত্যা করে ফেলবে?” জবাবে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আল্লাহর কসম! এখনই আমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করে ফেলবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আচ্ছা, বসে পড়।” ইতিমধ্যে হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়েরও (রাঃ) ঐ কথা বলতে বলতে আসলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকেও ঐ একই প্রশ্ন করলেন এবং তিনিও ঐ একই উত্তর দিলেন। তাঁকেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) বসে যেতে বললেন। এরপর কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলে তিনি সকলকে তথা হতে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিলেন এবং সময়ের পূর্বেই তারা সেখান হতে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তারা ঐ দিন-রাত এবং পরবর্তী দিনের সকাল পর্যন্ত বরাবর চলতেই থাকলেন। যখন রৌদ্র প্রখর হয়ে উঠলো তখন অবতরণের হুকুম করলেন। দ্বিপ্রহর ঢলে পড়ার সাথে সাথেই পুনরায় তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিলেন। এভাবে চলতে চলতে তৃতীয় দিনের সকাল বেলায় কিফা মুশাললাল হতে মদীনা শরীফে পৌছে গেলেন। হযরত উমার (রাঃ)-কে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যা করার আমি নির্দেশ দিলে সত্যিই কি তুমি তাকে হত্যা করে ফেলতে?” জবাবে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “নিশ্চয়ই আমি তার মাথা দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতাম।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যদি তুমি সেই দিন তাকে হত্যা করে ফেলতে তবে বহু লোকের নাক ধূলো-মলিন হয়ে যেতো। কেননা, যদি আমি তাদেরকে বলতাম তবে তারাও তাকে হত্যা করতে মোটেই দ্বিধাবোধ করতো না। তখন লোকদের একথা বলার সুযোগ হয়ে যেতো যে, মুহাম্মাদ (সঃ) স্বীয় সহচরদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে থাকেন। এই ঘটনারই বর্ণনা এই আয়াতগুলোতে রয়েছে।” (এ বর্ণনাটি খুবই গরীব। এতে এমন কতকগুলো চমকপ্রদ কথা রয়েছে, যেগুলোর অন্যান্য রিওয়াইয়াতে নেই)

সীরাতে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকে রয়েছে যে, মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ), যিনি একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন, এই ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি শুনেছি যে, আমার পিতা যে উক্তি করেছে তার প্রতিশোধ হিসেবে আপনি তাকে হত্যা করতে চান। যদি এটা সত্য হয়, তবে তাকে হত্যা করার আদেশ আপনি অন্য কাউকেও দিবেন না। আমিই যাচ্ছি এবং তার কর্তিত মস্তক এনে আপনার পদতলে নিক্ষেপ করছি। আল্লাহর কসম! খাযরাজ গোত্রের প্রত্যেকেই জানে যে, কোন ছেলে তার পিতাকে আমার চেয়ে বেশী শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনকারী নেই। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশক্রমে আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় পিতাকেও হত্যা করতে প্রস্তুত আছি। যদি আপনি অন্য কাউকেও নির্দেশ দেন এবং সে আমার পিতাকে হত্যা করে তবে আমার ভয় হচ্ছে যে, না জানি হয়তো প্রতিশোধ গ্রহণের নেশায় উন্মত্ত হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলবো। আর যদি আমার দ্বারা এ কাজই হয়ে যায় তবে একজন কাফিরের বিনিময়ে একজন মুসলমানকে হত্যা করার অপরাধে আমি জাহান্নামী হয়ে যাবো। সুতরাং এখন আপনি আমার পিতাকে হত্যা করার আদেশ আমাকেই করুন।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “না, না। আমি তাকে হত্যা করতে চাই না। আমি তো তার সাথে আরো উত্তম ও নম্র ব্যবহার করতে চাই যতক্ষণ সে আমাদের সাথে রয়েছে।”

হযরত ইকরামা (রঃ) ও হযরত ইবনে যায়েদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, সেনাবাহিনীসহ রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন মদীনায় পৌঁছেন তখন ঐ মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) মদীনা শরীফের দরবার উপর দাঁড়িয়ে যান ও তরবারী তুলে ধরেন। জনগণ মদীনায় প্রবেশ করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তার পিতা এসে পড়ে। তিনি স্বীয় পিতাকে সম্বোধন করে বলেনঃ “দাঁড়িয়ে যাও, মদীনায় প্রবেশ করো না।” সে বললোঃ “ব্যাপার কি? আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন?” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “তুমি মদীনায় প্রবেশ করতে পার না যে পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ (সঃ) অনুমতি দেন। সম্মানিত তিনিই এবং লাঞ্ছিত তুমিই।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আসলেনঃ তার অভ্যাস ছিল এই যে, তিনি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ অংশে থাকতেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেখে ঐ মুনাফিক তাঁর কাছে স্বীয় পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার পিতাকে আটক করে রেখেছো কেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আল্লাহর কসম! আপনি অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত আমার পিতাকে আমি মদীনায় প্রবেশ করতে দিবো না।” অতঃপর নবী (সঃ)-এর অনুমতিক্রমে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তাঁর পিতাকে মদীনায় প্রবেশ করতে দিলেন।

মুসনাদে হুমাইদীতে রয়ছে যে, হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তাঁর পিতাকে বলেনঃ “যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি নিজের মুখে একথা না বলবে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হলেন সম্মানিত এবং তুমি লাঞ্ছিত, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে আমি মদীনায় প্রবেশ করতে দিবো না। এর পূর্বে তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করেছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার পিতার অত্যধিক গাম্ভীর্য ও প্রভাবের কারণে আজ পর্যন্ত আমি তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিনি, কিন্তু আপনি যদি তার উপর অসন্তুষ্ট থাকেন তবে আমাকে নির্দেশ দিন, আমি তার মাথা কেটে নিয়ে আপনার নিকট হাযির করছি। অন্য কাউকেও তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিবেন না। এমনও হতে পারে যে, আমার পিতৃহন্তাকে আমি চলাফেরা অবস্থায় দেখতে পারবো না।”

Leave a Reply