بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৬৭/এবং কাফের-রা বলে:-১৭) [*তারা বলত, ‘মানুষই কি আমাদেরকে পথের সন্ধান দেবে? ’ অতঃপর তারা কুফরী করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল:- *কাফিররা ধারণা করে যে, তাদেরকে কখনো পুনরুত্থিত করা হবে না:-] www.motaher21.net সুরা: ৬৪ : হার-জিতের দিন। পারা:২৮ ১-১০ নং আয়তের ব্যাখ্যা:- ১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৬৭/এবং কাফের-রা বলে:-১৭)
[*তারা বলত, ‘মানুষই কি আমাদেরকে পথের সন্ধান দেবে? ’ অতঃপর তারা কুফরী করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল:-
*কাফিররা ধারণা করে যে, তাদেরকে কখনো পুনরুত্থিত করা হবে না:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৪ : হার-জিতের দিন।
পারা:২৮
১-১০ নং আয়তের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-১
یُسَبِّحُ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ۚ لَہُ الۡمُلۡکُ وَ لَہُ الۡحَمۡدُ ۫ وَ ہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۱﴾
আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে তার সবই আল্লাহর তাসবীহ করছে।‌ তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং সব প্রশংসাও তারই।
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-২
ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ فَمِنۡکُمۡ کَافِرٌ وَّ مِنۡکُمۡ مُّؤۡمِنٌ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۲﴾
তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ হয় কাফির এবং কেউ হয় মুমিন। আর তোমরা যে আমল কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-৩
خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ وَ صَوَّرَکُمۡ فَاَحۡسَنَ صُوَرَکُمۡ ۚ وَ اِلَیۡہِ الۡمَصِیۡرُ ﴿۳﴾
তিনি আসমান ও যমীনকে যথাযথরূপে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তোমাদেরকে আকার-আকৃতি দান করেছেন এবং অতি উত্তম আকার-আকৃতি দান করেছেন। অবশেষে তাঁর কাছেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে।
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-৪
یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ یَعۡلَمُ مَا تُسِرُّوۡنَ وَ مَا تُعۡلِنُوۡنَ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۴﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই তিনি জানেন। তিনি জানেন তোমরা যা গোপন কর ও তোমরা যা প্রকাশ কর এবং আল্লাহ অন্তর্যামী।
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-৫
اَلَمۡ یَاۡتِکُمۡ نَبَؤُا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ قَبۡلُ ۫ فَذَاقُوۡا وَبَالَ اَمۡرِہِمۡ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۵﴾
এরপূর্বে যেসব মানুষ কুফরী করেছে এবং নিজেদের অপকর্মের পরিণামও ভোগ করেছে তাদের খবর কি তোমাদের কাছে পৌঁছেনি? তাদের জন্য নির্দিষ্ট আছে অতীব কষ্টদায়ক শাস্তি।
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-৬
ذٰلِکَ بِاَنَّہٗ کَانَتۡ تَّاۡتِیۡہِمۡ رُسُلُہُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ فَقَالُوۡۤا اَبَشَرٌ یَّہۡدُوۡنَنَا ۫ فَکَفَرُوۡا وَ تَوَلَّوۡا وَّ اسۡتَغۡنَی اللّٰہُ ؕ وَ اللّٰہُ غَنِیٌّ حَمِیۡدٌ ﴿۶﴾
তা এজন্য যে, তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ আসত তখন তারা বলত, ‘মানুষই কি আমাদেরকে পথের সন্ধান দেবে? ’ অতঃপর তারা কুফরী করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল। আল্লাহও (তাদের ঈমানের ব্যাপারে) ক্ৰক্ষেপহীন হলেন; আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, সপ্রশংসিত।
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-৭
زَعَمَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَنۡ لَّنۡ یُّبۡعَثُوۡا ؕ قُلۡ بَلٰی وَ رَبِّیۡ لَتُبۡعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلۡتُمۡ ؕ وَ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ ﴿۷﴾
কাফিররা ধারণা করে যে, তাদেরকে কখনো পুনরুত্থিত করা হবে না। বলুন, ‘অবশ্যই হ্যাঁ, আমার রবের শপথ ! তোমাদেরকে অবশ্যই পুনরুত্থিত করা হবে। তারপর তোমরা যা করতে সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে অবশ্যই অবহিত করা হবে। আর এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-৮
فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ وَ النُّوۡرِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلۡنَا ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ ﴿۸﴾
তাই ঈমান আনো আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং সেই ‘নূর’ বা আলোর প্রতি যা আমি নাযিল করেছি। আর তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ‌ সে সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত।
সুরা: ৬৪ : সুরা: আত-তাগাবুন:-৯
یَوۡمَ یَجۡمَعُکُمۡ لِیَوۡمِ الۡجَمۡعِ ذٰلِکَ یَوۡمُ التَّغَابُنِ ؕ وَ مَنۡ یُّؤۡمِنۡۢ بِاللّٰہِ وَ یَعۡمَلۡ صَالِحًا یُّکَفِّرۡ عَنۡہُ سَیِّاٰتِہٖ وَ یُدۡخِلۡہُ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَاۤ اَبَدًا ؕ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ﴿۹﴾
যখন একত্র করার দিন তোমাদের সবাইকে তিনি একত্র করবেন।সেদিনটি হবে তোমাদের পরস্পরের হার-জিতের দিন। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করে আল্লাহ তা’আলা তার গোনাহ মুছে ফেলবেন আর তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে ঝরণা বইতে থাকবে। এসব লোক চিরস্থায়ীভাবে সেখানে থাকবে। এটাই বড় সফলতা।
সুরা: ৬৪ :আত-তাগাবুন:-১০
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿٪۱۰﴾
আর যারা কুফরী করেছে এবং আয়াতসমুহকে মিথ্যা বলেছে তারাই দোযখের বাসিন্দা হবে। তারা চিরস্থায়ীভাবে সেখানে থাকবে। তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান।

১-১০ নং আয়তের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে:-

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এই সূরাটি বিশেষত এর প্রথমাংশ মক্কী সূরার বিষয়বস্তুর সাথে গভীর সাদৃশ্যপূর্ণ, কেবলমাত্র শেষের কয়েকটি বাক্যে মদীনার পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা প্রতিফলিত হয়। ‘হে মুমিন ব্যক্তিরা’ বলে সম্বোধন করার পূর্ব পর্যন্ত সূরার প্রথম ১৩টি আয়াতে ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের বিবরণদান ও ইসলামী আদর্শকে অন্তরে বদ্ধমূল করার কাজটি অবিকল মােশরেক কাফেরদের লক্ষ্য করে নাযিল করা মক্কী সূরা গুলাের বর্ণনা ভংগি অনুসারেই করা হয়েছে। এতে প্রাকৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিদর্শনাবলী এবং অতীতের অবিশ্বাসীদের পরিণামও বর্ণনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি কেয়ামতের দৃশ্যাবলীও তুলে ধরা হয়েছে, যাতে মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হওয়া যে অকাট্য সত্য, তা প্রমাণিত হয়। এ সব বর্ণনাভংগি প্রমাণ করে যে, এ অংশটির লক্ষ্য হচ্ছে অবিশ্বাসী কাফেররা। সূরার শেষাংশে সম্বােধন করা হয়েছে মােমেনদেরকে। কেননা, এ অংশের বাকরীতি মদীনায় অবতীর্ণ সূরাগুলাের মতােই। এতে আল্লাহর পথে ধন সম্পদ ব্যয় করতে এবং সম্পদ ও সন্তান সন্ততির মাধ্যমে বান্দাদের যে পরীক্ষা করা হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক হতে বলা হয়েছে, মদীনায় যে ধরনের জীবন পদ্ধতি গড়ে ওঠেছিলাে, তার স্বাভাবিক দাবী অনুসারে মদীনায় অবতীর্ণ সূরাগুলােতে বারংবার এ জাতীয় সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। অনুরূপভাবে এতে মুসলমানদের ওপর আপতিত বিপদ আপদ ও দুঃখকষ্টে তাদের প্রবােধ দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর বা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করার আদেশ দেয়া হয়েছে। মাদানী সূরায় বিশেষত জিহাদের আদেশদান ও জিহাদ থেকে উদ্ভূত ত্যাগ তিতিক্ষা প্রসংগ এ সব বিষয় বার বার আলােচিত হয়ে থাকে। কিছু কিছু রেওয়ায়াতে এ সুরাটিকে মক্কী বলা হয়েছে। তবে অন্যান্য রেওয়ায়াতে একে মাদানী বলা হয়েছে এবং এই মতটিকেই অগ্রগণ্য বলা হয়েছে। সুরাটির পারিপার্শ্বিক ও প্রথমাংশের বর্ণনাভংগি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমিও একে প্রথম প্রথম মক্কী সূরা মনে করতাম। কিন্তু পরে চূড়ান্ত বিবেচনায় একে মাদানী বলেই গ্রহণ করেছি। সূরার প্রথম ভাগে কাফেরদের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তা মাদানী সূরায় থাকা একেবারে অসম্ভব নয়। হিজরতের পরেও মক্কার অথবা মদীনার পার্শ্ববর্তী কাফেরদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখা সম্ভব। তাছাড়া কোরআনের মাদানী অংশে যদি কখনাে কখনাে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস নিয়ে নতুন করে আলােচনা করা হয়, তবে তাতে কোনাে ক্ষতি নেই । আর তা করতে গিয়ে কোরআনের সর্বাধিক প্রচলিত রীতি, অর্থাৎ মক্কী সূরায় অনুসৃত রীতি অনুসরণ করাই যে স্বাভাবিক, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ফী জিলালিল কুরআন: সূরার প্রথমাংশে (প্রথম বারটি আয়াতে) মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্ব প্রকৃতির আনুগত্য, মহান স্রষ্টার সাথে সৃষ্টিজগতের সম্পর্ক এবং আল্লাহর কিছু কিছু গুণ, গুণবাচক নাম এবং প্রকৃতি ও মানব জীবনে তার প্রভাব আলােচিত হয়েছে।  *মানুষ ও বিশ্ব প্রকৃতির সাথে তাওহীদের সম্পর্ক : ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহর গুণকীর্তন করে থাকে…’ আকীদা বিশ্বাস ও আদর্শের ইতিহাসে এতাে প্রশস্ত, এতাে সূক্ষ্ম আর কোনাে আকীদা এবং আদর্শের সাথে মুসলমানদের কখনাে পরিচয় ঘটেনি, যতােটা প্রশস্ত ইসলামের এই বিশ্বজোড়া ধারণা। পৃথিবীতে আল্লাহর যতাে নবী ও রসূল এসেছেন, তাঁরা সকলেই এই মতবাদ প্রচার করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা এক, তিনিই বিশ্বজগতের ও প্রতিটি সৃষ্টির স্রষ্টা এবং বিশ্বজগতে যা কিছু আছে তিনি তার সব কিছুরই রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক। এ মতবাদে আমরা কোনাে সন্দেহ পােষণ করি না। কেননা, কোরআন এ মতবাদ সকল রসূলের পক্ষ থেকে উদ্ধৃত করেছে। কোরআন ছাড়া অন্যান্য বিকৃত, পরিবর্তিত ও মনগড়া গ্রন্থে যা কিছু বলা হয়েছে তা ধর্তব্য নয়। অনুরূপভাবে যারা সার্বিকভাবে অথবা আংশিকভাবে কোরআনে বিশ্বাস করে না, অথচ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে লেখে, তাদের কথাও গ্রহণযােগ্য নয়। মূল ইসলামী আকীদা বিশ্বাসে যা কিছু বিকৃতি ঘটেছে তা তার অনুসারীদেরই কারসাজি। এই কারসাজির কারণে মনে হয় যেন উক্ত আকীদায় নির্ভেজাল একতুবাদ কখনাে ছিলাে না, অথবা প্রতিটি সৃষ্টির সাথে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকা বা প্রতিটি সৃষ্টির ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য থাকার ধারণা গােড়াতেই ছিলো না। বস্তুত এই বিকৃতি ধর্মের আসল উপাদান নয়, এ হচ্ছে ধর্মের অভ্যন্তরে অনুপ্রবিষ্ট একটি বহিরাগত ধারণা। কেননা, প্রথম রসূল থেকে নিয়ে শেষ রসূল পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন বা ধর্ম একই ছিলাে এবং একই আছে। আল্লাহ তায়ালা তার দ্বীনের মূল আকীদার বিপরীত কোনাে ধর্ম পৃথিবীতে নাযিল করবেন এটা একেবারেই অসম্ভব। অথচ ধর্মের নামে প্রচলিত কিছু বিস্তৃত বা মনগড়া বই কেতাবে এরূপ দাবী করা ও এরূপ ধারণা ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। অবশ্য আল্লাহর দ্বীনের মূলনীতি আগাগোড়া একই রকম ছিলাে- এ কথা বলা দ্বারা এটা অস্বীকার করা হয় না যে, আল্লাহর সত্ত্বা, তার গুণাবলী এবং বিশ্বজগতে ও মানবজীবনে তাঁর প্রভাব সম্পর্কে ইসলামের (অর্থাৎ শেষ নবীর আনীত দ্বীনের) ধ্যানধারণা পূর্ববর্তী সকল নবীর আনীত আসমানী দ্বীনের ধ্যানধারণার চেয়ে অধিকতর প্রশস্ত, অধিকতর সূক্ষ্ম এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। শেষ নবীর নবুওতের প্রকৃতির সাথেও এ তত্ত্ব সামঞ্জস্যপূর্ণ, আর শেষ নবীর আনীত দ্বীন যে মানবীয় সুমতিকে সম্বােধন করে ও পথনির্দেশ দেয় এবং যার অভ্যন্তরে একত্ববাদের এই মতবাদ পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করে, সেই মানবীয় সুমতির সাথেও একটি গতিশীল। এই মতবাদ ও মতাদর্শের অন্যতম দাবী এই যে, মানুষের মন যেন সাধ্যমতাে আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করে আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও বিশ্ব প্রকৃতিতে তার দৃশ্যমান প্রভাব অনুভব করে, এর দৃশ্যমান নিদর্শনাবলীর সাহায্যে তা অন্তরের মধ্যেও উপলব্ধি করে, এই অসীম ক্ষমতা তার অনুভবযােগ্য নিদর্শনাবলীর মাঝে বেঁচে থাকে এবং আল্লাহর অসীম ক্ষমতাকে যেন বিশ্বজগতের প্রতিটি জিনিসের ওপর নিরংকুশভাবে কর্তৃত্বশীল ও প্রতিটি জিনিসের রক্ষক হিসাবে দেখতে পায়, চাই তা যতাে বড় বা ছােটো জিনিস হােক না কেন। এই তাওহীদী মতাদর্শের আরাে দাবী এই যে, মানুষের মন যেন সর্বক্ষণ সচেতন, আল্লাহর আযাবের ভয়ে ভীত এবং আল্লাহর পুরস্কারের আশায় আশান্বিত থাকে। জীবনের প্রতিটি কাজে সে যেন আল্লাহর ক্ষমতা, পরাক্রম, তদারকী ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং তার ওপর পুরােমাত্রায় নির্ভরশীল থাকে। তার দয়া ও অনুগ্রহ সম্পর্কে এবং তার নৈকট্য সম্পর্কে সচেতন থাকে। এর আরাে দাবী এই যে, মানুষ যেন অনুভব করে, গােটা সৃষ্টিজগত স্বীয় স্রষ্টার দিকে মনােযােগী রয়েছে, তার তাসবীহ করছে ও তার আদেশ নিষেধ মেনে চলছে। তাহলে সে নিজেও তাঁর দিকে মনােযােগী থাকবে, তার তাসবীহ করবে ও তার অনুগত থাকবে। এ কারণেই এবং এই অর্থেই তাওহীদী মতাদর্শ প্রকৃতপক্ষে একটি মহাজাগতিক মতাদর্শ। তা ছাড়া আরাে যে যে অর্থে একে মহাজাগতিক মতাদর্শ বলা হয়েছে, তার একটি সূরা হাশরের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহর তাসবীহ করে। কর্তৃত্ব তারই এবং প্রশংসাও তারই।’ অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছু আল্লাহর দিকেই মনোনিবিষ্ট হয়ে আছে এবং তাঁর প্রশংসার সাথে গুণকীর্তন করে। গােটা সৃষ্টিজগত তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে। তিনিই যে সব কিছুর মালিক, তা প্রতিটি জিনিসই অনুভব করে। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং প্রশংসিত এবং সমগ্র সৃষ্টিজগত থেকে নিরন্তর তাঁর পবিত্রতা ঘােষিত হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় মানুষ যদি এই বিশ্বজগত থেকে পৃথক ও ভিন্ন মত তথা কুফরীর পথ অবলম্বন করে শুনাহগার, অবাধ্য ও খােদাদ্রোহী হয় এবং আল্লাহর অনুগত না হয় ও প্রশংসা না করে, তা হলে সে একেবারেই কোণঠাসা ও একাকী হয়ে এ বিশ্বজগত থেকে সে বহিষ্কারযােগ্য হয়ে যাবে। ‘তিনি সর্ববিষয়ের ওপর শক্তিমান।’ বস্তুত এখানে আল্লাহর সীমাহীন অবাধ ক্ষমতার কথাই বলা হয়েছে। কোরআন এই সত্যটি মােমেনের হৃদয়ে বদ্ধমূল করতে চায়, যাতে সে আশস্ত হয় যে, সে যখন আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে, তখন এক সীমাহীন ক্ষমতাসম্পন্ন সত্ত্বার ওপর নির্ভর করে। সেই অসীম ক্ষমতাধর সত্ত্বা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, কোনাে বাধাবন্ধন মানেন না। আর আল্লাহর এই অসীম ক্ষমতা এবং সৃষ্টিজগতের প্রতিটি জিনিস কর্তৃক তাঁকে প্রশংসা ও তাঁর গুণকীর্তন করার বিষয়টি বিশ্বাস করা সেই বৃহত্তর ঈমান ও তাওহীদ মতাদর্শেরই অংশ বিশেষ। আল্লাহর প্রশংসা সহকারে গুণকীর্তনকারী বিশাল বিশ্বজগতের মাঝে যে মানুষ বাস করে, সে কিন্তু কখনাে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হয় আবার কখনাে হয় অবিশ্বাসী। মানুষ একাই এ ধরনের দ্বৈত ভূমিকা পালন করে থাকে। এ বিষয় নিয়েই পরবর্তী আয়াতে আলােচনা করা হয়েছে। বল হয়েছে, ‘তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি তােমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতপর তােমাদের কেউ হয় মােমেন, কেউ হয় কাফের…’ মানুষের আবির্ভাব, কাফের হওয়া অথবা মােমেন হওয়ার ব্যাপারে তার স্বাধীনতা, সমগ্র সৃষ্টি জগতের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই এই উভয় ধরনের ক্ষমতালাভ, আর এই ক্ষমতার কারণে তার ওপর ঈমান আনার দায়িত্ব অর্পণ- এই সবই আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতাবলে সংঘটিত হয়েছে। ঈমান আনার দায়িত্বটা যথার্থই একটি বিরাট দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্ব অর্পণের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা তার এই সৃষ্টিকে ভালাে ও মন্দের মধ্য থেকে একটি নির্বাচন করার ক্ষমতা দান করে সম্মানিত করেছেন। এরপর তাকে ভালাে ও মন্দ বাছাই করার এমন একটি মাপকাঠি দিয়েও সাহায্য করেছেন, যা দিয়ে সে নিজের কাজ ও চিন্তাধারাকে পরিমাপ করতে এবং তার কোনটি সঠিক ও কোনটি বেঠিক তা নির্ণয় করতে পারে। সেই মাপকাঠি হলাে আল্লাহর দ্বীন, যা তিনি স্বীয় নবী রসূলদের ওপর নাযিল করেছেন। এভাবে তিনি তাকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সাহায্য করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মানুষের ওপর মােটেই যুলুম করেননি। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘তােমরা যা করাে তার ওপর আল্লাহর দৃষ্টি রয়েছে।’ অর্থাৎ মানুষ যাই করে, যাই ভাবে বা চিন্তা করে, সব কিছু তার নখদর্পণে। সুতরাং তার সাবধান হওয়া উচিত এবং এই মহান ও সূক্ষ্ম দ্রষ্টার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে কাজ করা উচিত। মানুষের প্রকৃতি ও অবস্থান সংক্রান্ত এই মতাদর্শ ইসলামী চিন্তাধারার একটি উল্লেখযােগ্য। দিক। এই বিশ্বজগতের মানুষের অবস্থান কোথায়, তার ক্ষমতা ও যােগ্যতা কতােটুকু এবং বিশ্ব-স্রষ্টার কাছে তার দায়দায়িত্বই রয়েছে বা কী, সে সম্পর্কে এখানে সুস্পষ্ট ও দ্বার্থহীন পথনির্দেশ রয়েছে। তৃতীয় আয়াতে এক মহাসত্যের সন্ধান দেয়া হয়েছে, সে মহাসত্য বিশ্বজগতের প্রকৃতির অভ্যন্তরেই সুপ্ত রয়েছে। আকাশ ও পৃথিবী এই মহাসত্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মানব সৃষ্টি যে আল্লাহর কী অনুপম ও নিপূণ শিল্প এবং এই সৃষ্টিকেও যে একদিন আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে, সে কথাই বলা হয়েছে এ আয়াতটিতে, তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সত্যের ভিত্তিতেই সৃষ্টি করেছেন, তােমাদের আকৃতি প্রদান করেছেন এবং তােমাদের আকৃতিকে চমকপ্রদ বানিয়েছেন। তাঁর কাছেই তােমাদের ফিরে যেতে হবে। আয়াতের প্রথমাংশে ‘তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন’- এই উক্তিটির মাধ্যমে মােমেনের চেতনায় একথা বদ্ধমূল করা হচ্ছে যে, সত্য এই বিশ্বজগতের অস্তিত্বের মধ্যেই বিরাজ করছে। ওটা বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা কোনাে বস্তু নয় এবং কোনাে নিষ্প্রয়ােজন বস্তুও নয়। বরং সত্যের ওপরই গােটা সৃষ্টিজগতের ভিত্তি। যিনি এই সত্য বর্ণনা করছেন তিনি হচ্ছেন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এবং একমাত্র তিনিই জানেন, আকাশ ও পৃথিবীর ভিত্তি কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর মানুষ সত্যের ওপর অবিচল হবার প্রেরণা পায়, যার ওপর তার দ্বীন প্রতিষ্ঠিত এবং যার ওপর তার আশপাশের গােটা প্রকৃতি ও বিশ্ব নিখিল প্রতিষ্ঠিত। আর এই সত্য প্রকাশিত না হয়েই পারে না, চিরস্থায়ী না হয়েই পারে না এবং বাতিলের ফিৎনা অপসৃত হয়ে তা স্থিতিশীল হতে বাধ্য। এ আয়াতে দ্বিতীয় যে সত্য বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে, ‘তিনিই মানুষের আকৃতি দিয়েছেন এবং আকৃতিকে চমকপ্রদ বানিয়েছেন।’ এ উক্তি দ্বারা মানুষকে বুঝানাে হচ্ছে যে, আল্লাহর কাছে সে পরম সম্মানিত এবং তার আকৃতিকে সুন্দর বানিয়ে তিনি তার ওপর অনুগ্রহ করেছেন। শুধু যে দৈহিকভাবেই তাকে সুঠাম ও সুন্দর বানিয়েছেন তা নয়, বরং তাকে চেতনা ও বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়েও সুষম এবং সুন্দর বানিয়েছেন। এ জন্যই মানুষ দৈহিক গঠনে যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে পূর্ণাংগ প্রাণী, তেমনি চেতনা ও আত্মিক যােগ্যতার দিক দিয়েও সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর প্রাণী। আর এ জন্যে তাকেই পৃথিবীর খেলাফতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং এই সুপরিসর রাজ্যের ওপর কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে, যা কিনা তার নিজের তুলনায় অতীব বিশাল ও প্রকান্ড! মানুষের গােটা সত্ত্বা অথবা তার কোনাে একটি অংগের নির্মাণ কৌশলের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় যে, এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ও পূর্ণাংগ মানের সৌন্দর্য বজায় রাখা হয়েছে। যদিও এক এক আকৃতির সৌন্দর্য এক এক রকমের হয়ে থাকে, কিন্তু এর পরিকল্পনা অত্যন্ত চমৎকার ও পূর্ণাংগ । তাই মানুষ এদিক দিয়ে দুনিয়ার সকল প্রাণীর সেরা। ‘তার দিকেই সকলকে ফিরে যেতে হবে।’ অর্থাৎ সকল সৃষ্টিকেই ফিরে যেতে হবে। এমনকি স্বয়ং মানুষকেও এবং এই বিশ্বজগতকেও। এ বিশ্বজগত ও মানুষ আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারেই জন্ম লাভ করেছে আবার তার কাছেই ফিরে যাবে। বস্তুত তিনি অনাদি ও অনন্ত। প্রতিটি জিনিসের আদিতেও তিনি, অন্তেও তিনি। তিনি অনন্ত অসীম। এরপর চতুর্থ আয়াতে আল্লাহর সীমাহীন জ্ঞানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা প্রতিটি জিনিসের ওপর পরিব্যাপ্ত। মানুষের গোপন ও প্রকাশ্য সবই তিনি জানেন। বলা হচ্ছে, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে এবং তােমরা যা কিছু প্রকাশ করাে বা গােপন করাে, তা সবই তিনি জানেন। তিনি অন্তরের গোপন কথাও জানেন।’ এই সত্যটি মােমেনকে তার প্রভু সম্পর্কে পরিচিত হতে সাহায্য করে। সে জানতে পারে যে, আল্লাহর চোখ থেকে সে কিছুই লুকাতে পারে না। আল্লাহর কাছ থেকে কোনাে কিছুই সে গােপন করতে পারে না। এমন কি তার নিয়ত বা ইচ্ছা পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা জানেন ও দেখতে পান। এ ধরনের তিনটি আয়াতই মানুষের নিজের ও গােটা জগতের পরিচয়, আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক কি, তার সাথে কি রকম আচরণ করা উচিত এবং প্রতিটি কাজে তাকে কিভাবে ভয় করা উচিত তা উপলব্ধি করার জন্যে যথেষ্ট।

ফী জিলালিল কুরআন:   *মানুষকে নবী রাসূল হিসেবে পাঠানাের তাৎপর্য : সূরার দ্বিতীয় অংশে আল্লাহর রসূল ও কিতাবকে প্রত্যাখ্যানকারী এবং মানুষ কিভাবে রসূল হতে পারে এই প্রশ্ন উত্থাপনকারী অতীতের কাফেরদের প্রসংগ উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কার মােশরেকরাও প্রশ্ন তুলতাে যে, মানুষ কিভাবে রসূল হয়। আর এ প্রশ্ন তুলে আল্লাহর দ্বীনের যে দাওয়াত রসূল দিতেন, তা অস্বীকার করতাে। বলা হচ্ছে, ‘ইতিপূর্বে যারা কুফরী করেছে তাদের খবর কি তােমাদের কাছে আসেনি? তারা তাদের কর্মফল ভুগেছে। অধিকন্তু তাদের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে…’ এখানে তােমাদের সর্বনামটি দ্বারা খুব সম্ভবত মক্কার মােশরেকদের সম্বােধন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণতি সম্পর্কে তাদের সাবধান করা হয়েছে এবং অনুরূপ পরিণতি থেকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। উপরােক্ত আয়াতে প্রশ্নের মাধ্যমে প্রকারান্তরে এ কথাই বলা হয়েছে যে, অতীতের কাফেরদের কুফরীর শাস্তি ভােগ করার বৃত্তান্ত জানার পরও তােমাদের হুশ হয়নি। তাদের ইতিহাসের দিকে মক্কার মােশরেকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রশ্নের উদ্দেশ্য হতে পারে। কেননা তারা অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেসব কাফের জাতির কিছু কিছু কাহিনী জানতো এবং পরস্পরকে অবহিত করতাে। উত্তর ও দক্ষিণে ভ্রমণ কালে তাদের পরিত্যক্ত এলাকাগুলাে দিয়ে তাদের চলাচলও করতে হতাে। বিশেষত আদ, সামুদ ও লুতের জাতিগুলাের কথা তারা জানতাে এবং তাদের পরিত্যক্ত স্থানও তারা চিনতাে। কোরআন তাদের ইহকালীন পরিণতির সাথে আখেরাতের অবধারিত শাস্তির কথাও উল্লেখ করছে। সে বলছে, অধিকন্তু তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। অতপর যে কারণে তারা দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তির যােগ্য হয়েছে সেই কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর কারণ এই যে, যখনই তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে রসূল আসতাে, তখনই তারা বলতাে, কী ব্যাপার! একজন মানুষ আমাদের হেদায়াত করছে! মক্কার মােশরেকরাও অবিকল এই আপত্তিই রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে তুলে ধরতাে। নবুওত ও রেসালাতের প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতাবশতই এই আপত্তি তােলা হতাে। আসলে নবীরা যে বিধানের দিকে আহবান জানান, তা মানুষের জন্যে আল্লাহর রচিত বিধান। তাই এ বিধান বাস্তবে একজন মানুষের জীবনেই বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়ােজন, যাতে অন্যরা সাধ্যমত তার অনুকরণ করতে পারে। কিন্তু নবুওতের এই ভূমিকার কথা তারা জানে না বলেই উক্ত আপত্তি তুলে থাকে। নবী যদি মানুষ না হয়ে অন্য কিছু হতেন, তাহলে তিনি সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক থাকতেন। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে নবীর জীবন কোনাে বাস্তব অনুকরণযােগ্য আদর্শ হতে সক্ষম হতাে না, আর মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে সেই আদর্শের বাস্তবায়নও সম্ভব হতাে না। মানুষের মধ্য থেকে নবী প্রেরণে আপত্তি তােলার আরাে একটা কারণ হলাে, মানুষের জন্মগত শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে মােশরেকদের অজ্ঞতা। আকাশ থেকে পাওয়া বার্তাকে একজন মানুষ যতােটা অনায়াসে অন্য মানুষের কাছে পৌছাতে পারে, তাদের প্রস্তাব অনুসারে কোনাে ফেরেশতা নিযুক্ত হলে এ কাজটা অতাে সহজে করতে পারতাে না। তাকে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বার্তা ফেরি করে বেড়াতে হতাে। মানুষের ভেতরে আল্লাহর যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে, তার বদৌলতে সে আল্লাহর বার্তা গ্রহণ ও পূর্ণাংগভাবে তা অন্যের কাছে পৌছানাের এক কথায় রেসালাতের পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালনের যােগ্যতা অর্জন করে। এটা গােটা মানব জাতির জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি বিশেষ মর্যাদা। আল্লাহর কাছে মানুষের এই মর্যাদার কথা যে জানে না, কেবল সে-ই এ ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারে। বস্তুত রেসালাতের দায়িত্ব পালন করার সময়ে একজন মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বায় আল্লাহর রূহ ফুঁকে দেয়ার প্রকৃত মর্মই বাস্তব রূপ লাভ করে থাকে। মানুষের মধ্য থেকে নবীর আবির্ভাবে আপত্তি তােলার আরাে একটা কারণ হল; অহংকার বশত মানুষ রসূলের অনুসরণ করতে মােশরেকদের অসম্মতি। ভাবখানা এই যে, এতে যেন সেসব মূখ অহংকারীর সম্মানের হানি ঘটে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনা সৃষ্টি নবী হলে তার আনুগত্য করাতে যেন কোনাে সম্মান হানি হয় না। কেবল নিজেদের মধ্য থেকেই কেউ নবী বা রসূল হয়ে এলে তার আনুগত্য করায় যতাে সম্মান হানি হয়। এ কারণেই মােশরেকরা নবুওত অস্বীকার করলাে। অথচ তাদের কাছে এর পেছনে কোনাে সুস্পষ্ট যুক্তি ছিলাে না, ছিলাে কেবল অহংকার ও মূর্খতা। এই অহংকার ও মূর্খতার দরুনই তারা শিরক ও কুফরীর পথ বেছে নিলাে। আল্লাহ তায়ালা তাদের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। ‘আল্লাহ তায়ালা তাে চিরদিনই স্বয়ংসম্পূর্ণ, চিরপ্রশংসিত।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাদের ঈমান ও আনুগত্যের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তিনি তাে কখনােই তাদের কোনাে কিছুর মুখাপেক্ষী নন। এই হচ্ছে তাদের সংবাদ, যারা ইতিপূর্বে কুফরী করেছে, অতপর তাদের কর্মফল ভুগেছে। আর এই হচ্ছে তাদের ইহ-পরকালীন শাস্তি ভোগের কারণে সংবাদ জানার পর নতুন করে আবার কেন লােকেরা কুফরী করার ধৃষ্টতা দেখা যাচ্ছে? একই ধরনের পরিণাম ভোগ করার জন্যেই কি এ ধৃষ্টতা?

ফী জিলালিল কুরআন:   *কেয়ামত অস্বীকারকারীদের করুণ পরিণতি : এরপর শুরু হচ্ছে সূরার তৃতীয় অংশ। এটা আসলে দ্বিতীয় অংশেরই পরিপূরক। এখানে যারা আখেরাতে পুনরুথান অস্বীকার করেছে তাদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এটা সুবিদিত কথা যে, রসূল(স.)-এর আমলের মােশরেকরা এটা অস্বীকার করেছিলাে। এ অংশে রসূল(স.)-কে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তিনি যেন আখেরাতে পুনরুত্থানের বিষয়টি আবার জোর দিয়ে ঘোষণা করেন। এ অংশে কেয়ামতের দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে এবং কাফের ও মােমেনদের কী পরিণাম হবে তাও দেখানাে হয়েছে। সেই সাথে তাদের ঈমান ও আনুগত্যের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং জীবনে যা কিছুই ঘটুক, তা আল্লাহর ওপর সমর্পণ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কাফেররা ধারণা করেছে যে, তাদের কখনাে পুনরুজ্জীবিত করা হবে না। ‘তুমি বলাে, আল্লাহর কসম, অবশ্য অবশ্যই তােমরা পুনরুজ্জীবিত হবে… আল্লাহর ওপরই সকল নির্ভরকারীর নির্ভর করা উচিত।’ শুরুতেই কাফেরদের উক্তিকে ‘ধারণা’ বলে আখ্যায়িত করে প্রথম বিবরণেই তা মিথ্যা সাব্যস্ত করা হয়েছে। অতপর রসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তিনি যেন আল্লাহর কসম খেয়ে জোর দিয়ে বলেন, আখেরাত অকাট্য ও অবধারিত। বস্তুত আল্লাহর রসূল আল্লাহর নামে কসম খেয়ে যে কথা বলেন, তার চেয়ে অকাট্য সত্য আর কিছু হতে পারে না। বলা হয়েছে, ‘তুমি বলাে, হা আল্লাহর কসম, তােমরা অবশ্য অবশ্যই পুনরুজ্জীবিত হবে, অতপর তােমরা যা যা করেছো তা তােমাদের জানানাে হবে।’ কেননা, কোনাে কৃতকর্মই বৃথা ও নিস্ফল যাবে না। তার কিছু না কিছু ফলাফল থাকবেই, আর আল্লাহ তায়ালা তাদের চেয়েও তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে বেশী ওয়াকেফহাল। তাই কেয়ামতের দিন তিনি তাদের সেসব কৃতকর্ম অবহিত করবেন। ‘আর এ কাজ আল্লাহর কাছে সহজ।’ কেন সহজ হবে না, তিনি তাে আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় গােপন এবং প্রকাশ্য বিষয় জানেন, সকলের মনের কথাও জানেন। তিনি সর্বশক্তিমান। অতপর তাদের আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল ও রাসূলের কাছে নাযিলকরা আলাের প্রতি ঈমান আনার আহবান জানানাে হয়েছে। আলাে হচ্ছে এই কোরআন এবং কোরআনে আলােচিত মহান সত্য ধর্ম, কোরআন আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হওয়া গ্রন্থ বিধায় মূলতই একটি আলাের প্রদীপ আর আল্লাহ তায়ালা নিজেই আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি। কোরআন তার প্রভাবের দিক দিয়েও আলাের মশাল। কেননা, সে মানুষের হৃদয়কে আলােকিত করে। আর ঈমানের দাওয়াতের শেষে উপসংহারে তাদের এই বলে সতর্ক করেছে যে, তারা আল্লাহর কাছ থেকে কিছুই লুকাতে পারবে না। ‘আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সকল কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত।’ এই আহবানের পর পুনরায় কেয়ামতের দৃশ্য তুলে ধরে বলা হচ্ছে, ‘যেদিন তােমাদের সমবেত হওয়ার দিনের জন্যে একত্র করা হবে, সেই দিনই হবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার দিন।’ কেয়ামতের দিনকে সমবেত হবার দিন বলার কারণ এই যে, সকল যুগের সকল সৃষ্টিকে এই দিন একত্রিত করা হবে। সেদিন ফেরেশতারাও একত্রিত হবে। ফেরেশতাদের সংখ্যা যে কত, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে একটি হাদীস দ্বারা এ সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। আবু যর(রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূল(স.) বলেছেন, ‘আমি যতাে কিছু দেখতে পাই, তােমরা ততো কিছু দেখতে পাওনা। আমি যতাে কিছু শুনতে পাই তােমরা ততাে কিছু কিছু শুনতে পাও না। আকাশ বিলাপ করছে এবং তার বিলাপ করার কথাও বটে। সমগ্র আকাশের প্রতি চার আংগুল পরিমাণ জায়গায় একজন করে ফেরেশতা আল্লাহর সামনে সিজদারত রয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি যতাে কিছু জানি তা যদি তােমরা জানতে, তবে কম হাসতে ও বেশী কাঁদতে। এমনকি বিছানার ওপরে স্ত্রীদের সাথে তােমরা আমােদ ফুর্তি পর্যন্ত করতে না। তােমরা পাহাড় পর্বতে গিয়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে, বস্তুত আমার মন চায়, আমি যদি একটা গাছ হয়ে সবাইকে রক্ষা করতে পারতাম।'(তিরমিযী) যে আকাশের চার আংগুল পরিমাণ জায়গাও অন্তত একজন ফেরেশতা থেকে খালি নেই, তাও এত বিশাল ও প্রকান্ড যে, তার কোনাে সীমা পরিসীমা মানুষের জানা নেই। এই আকাশে আমাদের সূর্যের মতাে এক একটি সূর্য মহাশূন্যে উড়ন্ত এক একটি ধূলিকণার মতাে ক্ষুদ্র। এতে মানুষের কল্পনা ফেরেশতাদের প্রকৃত সংখ্যার কাছাকাছি যেতে পারে কিনা ভেবে দেখার বিষয়। এতদসত্তেও এই বিপুল সংখ্যক ফেরেশতা কেয়ামতের দিন আল্লাহর অগণিত সৃষ্টির যে সমাবেশ হবে, সে সমাবেশের একটি অংশ মাত্র হবে। এই সমাবেশেরই একটি দৃশ্যপটে ‘তাগাবুন’ সংঘটিত হবে। তাগাবুন এসেছে ‘গাবান’ ধাতু থেকে। গাবান অর্থ ক্ষয়ক্ষতি, তাগাবুন অর্থ হচ্ছে পরস্পরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ও নিজে লাভবান হওয়ার প্রতিযােগিতা। মােমনদের জান্নাতের অগাধ সম্পদ লাভ করা ও কাফেরদের তা থেকে বঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে যাওয়ার দৃশ্য এ শব্দ থেকে ফুটে ওঠেছে। বস্তুত এ হলাে দুটো পরস্পর বিরােধী পরিণতি। সেখানে প্রতিযােগিতা হবে এক দল কর্তৃক নিজে সব কিছু পাওয়ার এবং অপর দলকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করার। সেখানে মােমেনরা হবে সফলকাম আর কাফেররা হবে ব্যর্থ ও পরাজিত। সুতরাং এটা এই দৃশ্যমান ও চলমান অর্থে তাগাবুন তথা লাভবান ও ক্ষতিগ্রস্ত হবার প্রতিযােগিতা, পরবর্তী দুটি আয়াতে এর ব্যাখ্যা লক্ষণীয়, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার গুনাহগুলাে মাফ করে দেবেন…’ ঈমান আনয়নের আহবানকে পূর্ণতা দানের আগে তাকদীর বা অদৃষ্টের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভংগি কী ও হৃদয়ের হেদায়াত লাভে আল্লাহর প্রতি ঈমানের কার্যকারিতা কতটুকু, পরবর্তী আয়াতগুলােতে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

 

২) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
৩) তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
৪) তাফসীরে ইবনে কাছীর:-

Leave a Reply