Engr Motaher: أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৭২/ এবং কাফের-রা বলে:-১৯) [* কে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন:- **হেদায়াত ও গােমরাহীর উদাহরণ :- **দায়ীর কাজ শুধু সতর্ক করে যাওয়া :- *  *কাফেরদের ভ্রান্ত চিন্তা :-] www.motaher21.net সুরা: ৬৭: আল্-মুলক। পারা:২৮ ১- ৩০ নং আয়াত:-

Engr Motaher: أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৭২/ এবং কাফের-রা বলে:-১৯)
[* কে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন:-
**হেদায়াত ও গােমরাহীর উদাহরণ :-
**দায়ীর কাজ শুধু সতর্ক করে যাওয়া :-
*  *কাফেরদের ভ্রান্ত চিন্তা :-]
www.motaher21.net
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক।
পারা:২৮
১- ৩০ নং আয়াত:-
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১
تَبٰرَکَ الَّذِیۡ بِیَدِہِ الۡمُلۡکُ ۫ وَ ہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرُۨ ۙ﴿۱﴾
অতি মহান ও শ্রেষ্ঠ তিনি যাঁর হাতে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের কর্তৃত্ব। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতা রাখেন।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২
الَّذِیۡ خَلَقَ الۡمَوۡتَ وَ الۡحَیٰوۃَ لِیَبۡلُوَکُمۡ اَیُّکُمۡ اَحۡسَنُ عَمَلًا ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡغَفُوۡرُ ۙ﴿۲﴾
যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করবার জন্য; কে তোমাদের মধ্যে কর্মে সর্বোত্তম? আর তিনি পরাক্রমশালী, বড় ক্ষমাশীল।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৩
الَّذِیۡ خَلَقَ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا ؕ مَا تَرٰی فِیۡ خَلۡقِ الرَّحۡمٰنِ مِنۡ تَفٰوُتٍ ؕ فَارۡجِعِ الۡبَصَرَ ۙ ہَلۡ تَرٰی مِنۡ فُطُوۡرٍ ﴿۳﴾
তিনিই স্তরে স্তরে সাজিয়ে সাতটি আসমান তৈরী করেছেন। তুমি রহমানের সৃষ্টকর্মে কোন প্রকার অসঙ্গতি দেখতে পাবে না। আবার চোখ ফিরিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি৮ দেখতে পাচ্ছ কি?
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৪
ثُمَّ ارۡجِعِ الۡبَصَرَ کَرَّتَیۡنِ یَنۡقَلِبۡ اِلَیۡکَ الۡبَصَرُ خَاسِئًا وَّ ہُوَ حَسِیۡرٌ ﴿۴﴾
তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ক্লান্ত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৫
وَ لَقَدۡ زَیَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنۡیَا بِمَصَابِیۡحَ وَ جَعَلۡنٰہَا رُجُوۡمًا لِّلشَّیٰطِیۡنِ وَ اَعۡتَدۡنَا لَہُمۡ عَذَابَ السَّعِیۡرِ ﴿۵﴾
আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুশোভিত করেছি এবং ওগুলোকে করেছি শয়তানদের প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র স্বরূপ এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৬
وَ لِلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِرَبِّہِمۡ عَذَابُ جَہَنَّمَ ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿۶﴾
আর যারা তাদের রবের কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি ; এবং তা কত মন্দ ফিরে যাওয়ার স্থান!
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৭
اِذَاۤ اُلۡقُوۡا فِیۡہَا سَمِعُوۡا لَہَا شَہِیۡقًا وَّ ہِیَ تَفُوۡرُ ۙ﴿۷﴾
তাদেরকে যখন সেখানে নিক্ষেপ করা হবে তখন তারা তার ভয়ানক গর্জনের শব্দ শুনতে পাবে‌ এবং তা টগবগ করে ফুটতে থাকবে।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৮
تَکَادُ تَمَیَّزُ مِنَ الۡغَیۡظِ ؕ کُلَّمَاۤ اُلۡقِیَ فِیۡہَا فَوۡجٌ سَاَلَہُمۡ خَزَنَتُہَاۤ اَلَمۡ یَاۡتِکُمۡ نَذِیۡرٌ ﴿۸﴾
অত্যধিক রোষে তা ফেটে পড়ার উপক্রম হবে। যখনই তার মধ্যে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে তখনই তার ব্যবস্থাপকরা জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের কাছে কি কোন সাবধানকারী আসেনি?
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৯
قَالُوۡا بَلٰی قَدۡ جَآءَنَا نَذِیۡرٌ ۬ۙ فَکَذَّبۡنَا وَ قُلۡنَا مَا نَزَّلَ اللّٰہُ مِنۡ شَیۡءٍ ۚۖ اِنۡ اَنۡتُمۡ اِلَّا فِیۡ ضَلٰلٍ کَبِیۡرٍ ﴿۹﴾
তারা জবাব দেবে, হ্যাঁ, আমাদের কাছে সাবধানকারী এসেছিলো। কিন্তু আমরা তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিলাম এবং বলেছিলাম আল্লাহ‌ কিছুই নাযিল করেননি। তোমরাই বরং বিরাট ভুলের মধ্যে পড়ে আছো।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১০
وَ قَالُوۡا لَوۡ کُنَّا نَسۡمَعُ اَوۡ نَعۡقِلُ مَا کُنَّا فِیۡۤ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ ﴿۱۰﴾
তারা আরো বলবেঃ আহা! আমরা যদি শুনতাম এবং বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে বুঝতাম, তাহলে আজ এ জ্বলন্ত আগুনে সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে গণ্য হতাম না।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১১
فَاعۡتَرَفُوۡا بِذَنۡۢبِہِمۡ ۚ فَسُحۡقًا لِّاَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ ﴿۱۱﴾
তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে। সুতরাং জাহান্নামীরা (আল্লাহর রহমত হতে) দূর হোক!
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১২
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّہُمۡ بِالۡغَیۡبِ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ اَجۡرٌ کَبِیۡرٌ ﴿۱۲﴾
যারা না দেখেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১৩
وَ اَسِرُّوۡا قَوۡلَکُمۡ اَوِ اجۡہَرُوۡا بِہٖ ؕ اِنَّہٗ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۱۳﴾
তোমরা নীচু স্বরে চুপে চুপে কথা বলো কিংবা উচ্চস্বরে কথা বলো (আল্লাহর কাছে দু’টোই সমান) তিনি তো মনের অবস্থা পর্যন্ত জানেন।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১৪
اَلَا یَعۡلَمُ مَنۡ خَلَقَ ؕ وَ ہُوَ اللَّطِیۡفُ الۡخَبِیۡرُ ﴿٪۱۴﴾
যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই কি জানবেন না? অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সব বিষয় ভালভাবে অবগত।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১৫
ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ ذَلُوۡلًا فَامۡشُوۡا فِیۡ مَنَاکِبِہَا وَ کُلُوۡا مِنۡ رِّزۡقِہٖ ؕ وَ اِلَیۡہِ النُّشُوۡرُ ﴿۱۵﴾
তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন ; অতএব তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া রিযিক থেকে তোমরা আহার কর ; আর পুনরুত্থান তো তাঁরই কাছে।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১৬
ءَاَمِنۡتُمۡ مَّنۡ فِی السَّمَآءِ اَنۡ یَّخۡسِفَ بِکُمُ الۡاَرۡضَ فَاِذَا ہِیَ تَمُوۡرُ ﴿ۙ۱۶﴾
তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন, তিনি তোমাদেরকে সহ ভূমিকে ধসিয়ে দেবেন না? আর ওটা আকস্মিকভাবে কেঁপে উঠবে।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১৭
اَمۡ اَمِنۡتُمۡ مَّنۡ فِی السَّمَآءِ اَنۡ یُّرۡسِلَ عَلَیۡکُمۡ حَاصِبًا ؕ فَسَتَعۡلَمُوۡنَ کَیۡفَ نَذِیۡرِ ﴿۱۷﴾
অথবা তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন, তিনি তোমাদের উপর পাথর বর্ষণকারী ঝড় প্রেরণ করবেন না? তখন তোমরা জানতে পারবে, কিরূপ ছিল আমার সতর্কবাণী!
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১৮
وَ لَقَدۡ کَذَّبَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ فَکَیۡفَ کَانَ نَکِیۡرِ ﴿۱۸﴾
তাদের পূর্বের লোকেরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল। ফলে দেখো, আমার পাকড়াও কত কঠিন হয়েছিল।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-১৯
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اِلَی الطَّیۡرِ فَوۡقَہُمۡ صٰٓفّٰتٍ وَّ یَقۡبِضۡنَ ؔۘؕ مَا یُمۡسِکُہُنَّ اِلَّا الرَّحۡمٰنُ ؕ اِنَّہٗ بِکُلِّ شَیۡءٍۭ بَصِیۡرٌ ﴿۱۹﴾
তারা কি মাথার ওপর উড়ন্ত পাখীগুলোকে ডানা মেলতে ও গুটিয়ে নিতে দেখে না? রহমান ছাড়া আর কেউ নেই যিনি তাদেরকে ধরে রাখেন। তিনিই সবকিছুর রক্ষক।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২০
اَمَّنۡ ہٰذَا الَّذِیۡ ہُوَ جُنۡدٌ لَّکُمۡ یَنۡصُرُکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ الرَّحۡمٰنِ ؕ اِنِ الۡکٰفِرُوۡنَ اِلَّا فِیۡ غُرُوۡرٍ ﴿ۚ۲۰﴾
দয়াময় আল্লাহ ছাড়া তোমাদের এমন কোন সৈন্যবাহিনী আছে কি, যারা তোমাদেরকে সাহায্য করবে? কাফিররা তো রয়েছে প্ৰবঞ্চনার মধ্যে।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২১
اَمَّنۡ ہٰذَا الَّذِیۡ یَرۡزُقُکُمۡ اِنۡ اَمۡسَکَ رِزۡقَہٗ ۚ بَلۡ لَّجُّوۡا فِیۡ عُتُوٍّ وَّ نُفُوۡرٍ ﴿۲۱﴾
বলো, রহমান যদি তোমাদের রিযিক বন্ধ করে দেন তাহলে এমন কেউ আছে, যে তোমাদের রিযিক দিতে পারে? প্রকৃতপক্ষে এসব লোক বিদ্রোহ ও সত্য বিমুখতায় বদ্ধপরিকর।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২২
اَفَمَنۡ یَّمۡشِیۡ مُکِبًّا عَلٰی وَجۡہِہٖۤ اَہۡدٰۤی اَمَّنۡ یَّمۡشِیۡ سَوِیًّا عَلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۲۲﴾
ভেবে দেখো, যে ব্যক্তি মুখ নিচু করে পথ চলছে৩২ সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত, না যে ব্যক্তি মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে সমতল পথে হাঁটছে সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত?
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২৩
قُلۡ ہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡشَاَکُمۡ وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۲۳﴾
এদেরকে বলো, আল্লাহই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তোমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২৪
قُلۡ ہُوَ الَّذِیۡ ذَرَاَکُمۡ فِی الۡاَرۡضِ وَ اِلَیۡہِ تُحۡشَرُوۡنَ ﴿۲۴﴾
বলুন, ‘তিনিই যমীনে তোমাদেরকে সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাঁরই কাছে তোমাদেরকে সমবেত করা হবে।’
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২৫
وَ یَقُوۡلُوۡنَ مَتٰی ہٰذَا الۡوَعۡدُ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۲۵﴾
তারা বলে, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে বল, এই প্রতিশ্রুতি কখন বাস্তবায়িত হবে?’
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২৬
قُلۡ اِنَّمَا الۡعِلۡمُ عِنۡدَ اللّٰہِ ۪ وَ اِنَّمَاۤ اَنَا نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۲۶﴾
বলুন, ‘এর জ্ঞান শুধু আল্লাহ্‌রই কাছে আছে, আর আমি তো স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।’
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২৭
فَلَمَّا رَاَوۡہُ زُلۡفَۃً سِیۡٓـَٔتۡ وُجُوۡہُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ قِیۡلَ ہٰذَا الَّذِیۡ کُنۡتُمۡ بِہٖ تَدَّعُوۡنَ ﴿۲۷﴾
অতঃপর তারা যখন তা আসন্ন দেখবে তখন কাফিরদের চেহারা ম্লান হয়ে পড়বে এবং বলা হবে, ‘এটাই হল তা, যা তোমরা দাবী করেছিলে।’
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২৮
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ اَہۡلَکَنِیَ اللّٰہُ وَ مَنۡ مَّعِیَ اَوۡ رَحِمَنَا ۙ فَمَنۡ یُّجِیۡرُ الۡکٰفِرِیۡنَ مِنۡ عَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿۲۸﴾
বলুন, ‘তোমরা আমাকে জানাও— যদি আল্লাহ আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে ধ্বংস করেন অথবা আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন, তবে কাফিরদেরকে কে রক্ষা করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে?
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-২৯
قُلۡ ہُوَ الرَّحۡمٰنُ اٰمَنَّا بِہٖ وَ عَلَیۡہِ تَوَکَّلۡنَا ۚ فَسَتَعۡلَمُوۡنَ مَنۡ ہُوَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۲۹﴾
বলুন, ‘তিনিই রহমান, আমরা তাঁর উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁরই উপর তাওয়াক্কুল করেছি। অতঃপর অচিরেই তোমারা জানতে পারবে কে স্পষ্ট বিভ্ৰান্তিতে রয়েছে।’
সুরা: ৬৭: আল্-মুলক:-৩০
قُلۡ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ اَصۡبَحَ مَآؤُکُمۡ غَوۡرًا فَمَنۡ یَّاۡتِیۡکُمۡ بِمَآءٍ مَّعِیۡنٍ ﴿٪۳۰﴾
বলুন, ‘তোমরা আমাকে জানাও, যদি পানি ভূগর্ভে তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন কে তোমাদেরকে এনে দেবে প্ৰবাহমান পানি?’

আয়তের ব্যাখ্যা:-
১-৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
১) তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: আল-মুলক

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৬৭

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আলােচ্য পারাটির সব কয়টি সূরাই মক্কায় অবতীর্ণ। ঠিক এর বিপরীত, পূর্ববর্তী ২৮ নং পারার সব কয়টি সূরাই ছিলাে মদীনায় অবতীর্ণ। মক্কী হােক বা মাদানী হােক, প্রত্যেক সূরারই থাকে স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও বিশিষ্ট স্বাদ। এই পারার কোনাে কোনাে সূরার প্রথমাংশ পবিত্র কোরআনের সূচনাকালীন ওহীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন সূরা আল মুদ্দাসসির ও সূরা আল মুযযাম্মিলের প্রথমাংশ। আবার এই পারায় এমন কিছু সূরাও রয়েছে যা সম্ভবত নবুয়ত লাভের প্রায় তিন বছর পর নাযিল হয়েছে, যেমন সূরা আল কালাম, আবার কোনােটা নাযিল হয়েছে নবুয়ত লাভের প্রায় দশ বছর পর যেমন সূরা আল জ্বিন। বর্ণিত আছে, বনু সাকীফ গােত্রের নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রাসূল(স.) যখন তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন পথিমধ্যে সূরা জ্বিন নাযিল হয়। সূরা জ্বিনের ঘটনার বিবরণ এভাবে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা রসূল(স.)-এর কাছে একদল জ্বিনকে পাঠিয়ে দিলেন। তারা যখন রাসূল(স.)-এর কাছে পৌঁছলাে, তখন তিনি কোরআন পড়ছিলেন। জ্বীনেরা তাঁর কোরআন পাঠ শুনতে লাগলাে। তায়েফের এই সফর সংঘটিত হয়েছিলাে খাদিজা(রা.) ও আবু তালেবের ইন্তেকালের পর হিজরতের এক বছর বা দু’বছর আগে। অবশ্য অপর একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, সূরা জ্বিন নবুওতের প্রথম দিকেই নাযিল হয়েছিলাে। এই শেষােক্ত রেওয়ায়াতটিই অধিকতর নির্ভরযােগ্য। পবিত্র কোরআনের মক্কায় নাযিল হওয়া অংশ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যে বিষয় নিয়ে আলােচনা করে তা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা, ওহী ও আখেরাত সংক্রান্ত আকীদা এবং এই আকীদা থেকে বিশ্বজগত ও তার স্রষ্টার সাথে বিশ্বজগতের সম্পর্ক সম্বন্ধে যে ধারণা জন্মে, তা। সেই সাথে স্রষ্টার পরিচয়ও এই সূরাগুলােতে এমনভাবে তুলে ধরা হয় যে, স্রষ্টার সম্পর্কে মানব হৃদয়ে এক জীবন্ত চেতনার উন্মেষ ঘটে। সেই চেতনা অত্যন্ত কার্যকর, সঠিক দিক-নির্দেশক এবং আপন মনিবের অনুগত বান্দার যেরূপ অনুভূতি ও মানসিকতা থাকা উচিত, সেরূপ মানসিকতারই উদ্দীপক, বান্দার মধ্যে আপন প্রভুর উপযুক্ত আদব ও ভক্তির উদ্গাতা এবং বিভিন্ন ব্যক্তি, বস্তু ও ঘটনাবলীর মূল্যায়ন ও মান নির্ণয়ে একজন মুসলমানের যে দৃষ্টিভংগী ও মূল্যবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়, তারই উজ্জীবক। পূর্ববর্তী মক্কী সূরাগুলােতে আমরা এই বক্তব্যের নমুনা দেখেছি। বর্তমান পারায় আমরা তার আরাে নমুনা দেখতে পাব। পক্ষান্তরে মাদানী সূরা ও আয়াতগুলাে প্রধানত উপরােক্ত আকীদা এবং ধারণা ও মূল্যমানকে বাস্তব জীবনে কার্যকর রূপদান সম্পর্কে সােচ্চার থাকে। সেই সাথে মানুষের মনকে জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ও শরীয়তী বিধান বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ ব্যাপারে মানুষকে মানসিক ও বাহ্যিক উভয়ভাবে প্রস্তুত করে । পূর্বোক্ত মাদানী সূরাগুলােতে যেমন আমরা এর নযির দেখেছি, চলতি পারার সূরাগুলােতেও তেমনি দেখতে পাব। ‘সূরা তাবারাকা’ বা সূরা আল মুলক এ পারার প্রথম সূরা। সৃষ্টিজগত ও তার স্রষ্টার মধ্যকার সম্পর্ক সম্বন্ধে একটা নতুন ধারণা গড়ে তােলার চেষ্টা এ সূরায় পরিলক্ষিত হয়েছে। ধারণাটা এতাে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী যে, তা সংকীর্ণ ও সীমিত পার্থিব পরিন্ডলকে অতিক্রম করে মহাকাশের বিভিন্ন জগত, আখেরাতের জীবন, পার্থিব জগতের মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টি তথা জ্বিন, পাখি, আখেরাতের জাহান্নাম ও তার রক্ষীরা এবং অদৃশ্য জগতের এমন আরাে বহু জিনিস পর্যন্ত বিস্তৃত, যার সাথে মানুষের মন ও আবেগ জড়িত, তাই এর আলােচ্য বিষয় শুধু দৃশ্যমান পার্থিব জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উপরন্তু তা মানুষের চোখের সামনে, বাস্তব জীবনে ও আপন সত্তার মধ্যে বিরাজমান এমন বহু জিনিস সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করে, যাকে সচরাচর উপেক্ষা করে চলতেই সে অভ্যস্ত। এই সূরা মানুষের মনমানসে পুঞ্জীভূত যাবতীয় স্থবির ও পশ্চাদমুখী জাহেলী ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাধারাকে নাড়া দিয়ে ঝেড়ে ফেলে, চেতনার স্থানে স্থানে সংযােগের জানালা খুলে দেয়। সেখান থেকে জড়তার ধুলাবালি মুছে ফেলে এবং বিবেক, চেতনা ও অন্তর্দৃষ্টিকে স্বাধীন করে দিয়ে বিশ্ব প্রকৃতির মুক্ত দিগন্তে, আপন সত্ত্বার গভীরতম প্রকোষ্ঠে, মহাশূণ্যের দূর নিলীমায়, মহা সমুদ্রের অথৈ জলরাশিতে এবং অদৃশ্য জগতের সকল গােপন ঘাঁটিতে বিচরণ ও পর্যবেক্ষণে উদ্দীপিত করে। এই বিচরণের মধ্য দিয়ে সে সর্বত্র আল্লাহর হাতকেই দেখতে পায় সৃজনশীল, অনুভব করে আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও নৈপুণ্যে পরিচালিত সৃষ্টিজগতের তৎপরতা, তারপর এই বিশাল সৃষ্টি জগতকে স্বীয় উপলব্ধির উর্ধে বিবেচনা করে তার পর্যবেক্ষণ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে তার মন-মগয। সে বুঝতে পারে যে, এ মহাবিশ্বের পরিধি তার কল্পনার চেয়েও বিশালতর। ফলে সে পৃথিবীর প্রশস্ততাকে অতিক্রম করে চলে যায় আকাশে, দৃশ্যমান জগত থেকে তা গিয়ে উপনীত হয় প্রকৃত জগতে, স্থবিরতা থেকে সচলতায় অদৃষ্ট, জীবন ও জগতে জীবসুলভ এক চঞ্চলতায়। জীবন ও মৃত্যু একটি সুপরিচিত ও বারংবার সংঘটিত ব্যাপার। কিন্তু এই সূরা মানুষের চিন্তাধারাকে জীবন ও মৃত্যুর অপর পারে সঞ্চালিত করে। আল্লাহর নির্ধারিত অদৃষ্ট, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং তার প্রজ্ঞা ও কৌশল নিয়ে ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে। সূরার একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যিনি জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তােমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তােমাদের মধ্যে কে বেশী সৎকর্মশীল। তিনি মহাপরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ আকাশ হচ্ছে অজ্ঞ মানুষের চোখের সামনে বিরাজিত স্থির নিশ্চল এক সৃষ্টি। এ সৃষ্টির পশ্চাতে তার সৃজনকারী হাতকে সে দেখতে পায় না। এতে কি পূর্ণতা ও চমৎকারিত্ব বিদ্যমান তাও তার চোখে পড়ে না। কিন্তু আলােচ্য সূরা তার চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ শক্তিকে এর অপরূপ সৌন্দর্য ও পূর্ণতা এবং তার পশ্চাতে যে তৎপরতা ও অভিলাষ নিহিত রয়েছে তা নিয়ে ভাবতে শিখায় এবং তা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই উপরােক্ত আয়াতের পরবর্তী আয়াতের বক্তব্য হলাে, ‘যিনি সাতটি আকাশকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। দয়াময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোনাে অসামঞ্জস্য দেখতে পাবে না। আচ্ছা, দৃষ্টি ফেরাও তাে। কোনাে অসম্পূর্ণতা দেখতে পাও কি? পুনরায় দৃষ্টি ফেরাও তােমার দৃষ্টি তােমার কাছেই ক্লান্ত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে। আর আমি নিম্নতম আকাশকে কতকগুলাে প্রদীপ দ্বারা সুসজ্জিত করেছি এবং শয়তানগুলােকে মেরে তাড়ানাের জন্যে এগুলােকে হাতিয়ার বানিয়েছি। জাহেলিয়াতের দৃষ্টিতে পার্থিব জীবনই হচ্ছে জীব-জীবনের চূড়ন্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কিন্তু আলােচ্য সুরা আরেকটি জগত উদ্ঘাটিত করেছে। নতুন করে সৃজিত সেই জগতটি শয়তানদের ও কাফেরদের জন্যে প্রস্তুত রয়েছে। সে জগত চঞ্চলতা, চমক ও প্রতীক্ষায় পরিপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তাদের জন্যে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড প্রস্তুত করে রেখেছি। আর যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছে তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। ‘আর জাহান্নাম খুবই নিকৃষ্ট ঠিকানা… জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডবাসীর ওপর অভিশাপ।’ জাহেলিয়াত মুখী মন-মগজ জীবন যাপনের এই প্রকাশ্য পরিমন্ডলের বাইরের আর কিছুর অস্তিত্ব মানে না। অদৃশ্য জগত ও তার অন্তর্নিহিত সত্যগুলাে নিয়ে চিন্তাও করে না। তার সমস্ত চিন্তাভাবনা শুধুমাত্র পার্থিব জীবনকে নিয়েই কেন্দ্রীভূত এবং দৃশ্যমান। পৃথিবীর বদ্ধ খাচায় সে আবদ্ধ। তাই এ সূরা মানুষের মনকে ও দৃষ্টিকে অদৃশ্য জগত, আকাশ ও সেই সীমাহীন ক্ষমতার প্রতি নিবন্ধ করে, যা চোখের অগােচরে থাকলেও যা ইচ্ছা যখন ইচ্ছা ও যেখানে ইচ্ছা তা করতে সক্ষম। যে ইহকালীন জগত নিয়ে তারা ডুবে আছে এবং যার প্রতি তারা পরম আস্থাশীল রয়েছে, সেই ইহকালীন জগতের প্রতি তাদের আস্থা নাড়িয়ে দেয়। সূরার একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা তাদের অদৃশ্য প্রভুকে ভয় পায়, তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও বিরাট প্রতিদান। যিনি আকাশে রয়েছেন তিনি যে তােমাদেরকে মাটির নিচেও পুঁতে ফেলতে পারেন, সে ব্যাপারে কি তােমরা নিশ্চিন্ত?…’ পাখি এমন এক সৃষ্টি যাকে মানুষ প্রতিনিয়তই দেখতে পায়, অথচ তার অলৌকিকত্ব নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা করে না। কিন্তু এই সূরা মানুষের চোখকে পাখির দিকে তাকাতে এবং তার মনকে পাখি নিয়ে ভাবতে শেখায়। আল্লাহর যে সীমাহীন ক্ষমতা এই বিচিত্র সৃষ্টিকে সৃজন ও তার পরিকল্পনা করেছে, সে সম্পর্কে তাকে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে। ‘তারা কি পাখিদের দিকে তাকায় না, কিভাবে তারা মানুষের মাথার ওপর পাখা মেলে ও গুটিয়ে নেয়? দয়াময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তাদেরকে তাে আর কেউ থামাতে পারে না। তিনি সকল জনিসের দর্শক।’ মানুষ যখন নিজ বাসস্থানে আল্লাহর ক্ষমতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে অবস্থান করে, সেই সময়ে এই সূরা তাকে ঝাকুনি দিয়ে এক মানসিক উদাসীনতা থেকে মুক্ত করে দেয়। অবশ্য সে চিন্তা ভাবনা করলে বুঝতাে, যে তার পায়ের তলা থেকে পৃথিবী এবং চারপাশ থেকে গােটা প্রকৃতি ইতিপূর্বেই তাকে আল্লাহর পরাক্রম ও প্রতাপ সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিয়েছে, অথচ এটাকে সে হিসাবেই ধরেনি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তােমাদের কাছে কি এমন কোনাে বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে, যারা রহমানের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারে! আসল কথা হলাে, অমান্যকারীরা প্রতারণার শিকার।’ মানুষ যে জীবিকা উপার্জন করে, তা তার ধারণায় উপায় উপকরণের নাগালের কাছাকাছি এবং সহজেই তা উপার্জন করা সম্ভব। আর এই উপায়-উকরণ হচ্ছে তাদের পারস্পরিক প্রতিযােগিতা। কিন্তু আলােচ্য সুরা তাদের দৃষ্টিতে অনেক দূরে আকাশের ওপরে পর্যন্ত প্রসারিত করে। তাদের ধারণা অনুসারে তাদের সুপরিচিত উপায়-উপকরণের উর্ধে টেনে নিয়ে যায়। এ সম্পর্কে একটি আয়াতের বক্তব্য দেখুন! ‘যে তােমাদেরকে জীবিকা সরবরাহ করে থাকে, তার জীবিকা যদি আল্লাহ তায়ালা বন্ধ করে দেন, তাহলে কি হবে ভেবে দেখতাে। আসলে তারা আল্লাহদ্রোহিতা ও সত্য পরিত্যাগের ওপর জেদ ধরে রয়েছে।’ মানুষ যখন তার বিভ্রান্তিতে অনড় হয়ে বসে থাকে আর ভাবে যে, আমি সঠিক পথে আছি, তখন এই সূরা তার কাছে তার প্রকৃত অবস্থা এবং প্রকৃত সত্য পথচারীদের অবস্থা ও গুণাগুণ বর্ণনা করে এক চলন্ত, জীবন্ত ও উদ্বুদ্ধকারী ভংগীতে। ভেবে দেখ তাে, যে লােক উল্টোদিকে মুখ করে বলছে, সে সঠিক সত্য পথপ্রাপ্ত, না যে লোক মাথা উঁচু করে সােজাসুজি একটি সমতল সড়কের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে সে হেদায়াতপ্রাপ্ত। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা তার সত্তায় যেসব যােগ্যতা, ক্ষমতা ও প্রতিভা দিয়েছেন, তাকে সাধারণত সে কাজে লাগায় না। তার স্নায়ু ও পঞ্চইন্দ্রিয় যা অনুভব করে তাকে অতিক্রম করে এই ইহজগতের উর্ধের কোনাে কিছুতে সে ভ্রুক্ষেপ করে না। এ জন্যে আলােচ্য সূরা তাকে দেয়া আল্লাহর নেয়ামতগুলােকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর এই নেয়ামতগুলােকে দৃশ্যমান বর্তমানের বহির্ভূত অজানা ভবিষ্যতের পথকে আলােকিত করে দেয় এবং এই সূচনা থেকে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌছার দিক নির্দেশনা দেয়। ‘তুমি বলাে! তিনিই সেই মহান আল্লাহ তায়ালা, যিনি তােমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তােমাদের চোখ, কান ও অন্তর দিয়েছেন। তােমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো। বলো, তিনিই পৃথিবীতে তােমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তােমরা তার কাছেই ফিরে যাবে।’ কাফেররা পরকালীন জীবনে পুনরুজ্জীবন ও কেয়ামতকে অস্বীকার করে থাকে এবং তার নির্দিষ্ট সময়কাল জানতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে আলােচ্য সূরা তার সামনে কেয়ামতকে একটা অবধারিত আকস্মিক ঘটনা হিসাবে তুলে ধরে এবং সে ঘটনা যখন ঘটবে তখন তা তাদের জন্যে অবশ্যই বিব্রতকর হবে। ‘তারা বলে, তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে বলতাে এই ঘটনা কবে ঘটবে? বলাে, প্রকৃত জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছেই রয়েছে আর আমি তাে শুধু খােলাখুলি সতর্ককারী। পরে তারা যখন এই জিনিসকে অর্থাৎ কেয়ামতকে একান্ত কাছে উপস্থিত দেখবে, তখন এই অস্বীকারকারীদের মুখ বিকৃত হয়ে যাবে এবং তাদেরকে বলা হবে, এই হচ্ছে সেই বিষয়, যার জন্যে তােমরা তাগাদা দিচ্ছিলে।’ কাফেররা ভাবতাে যে, রসূল(স.) ও তার সংগীরা মারা গেলে খুবই ভালাে হতাে এবং তারা হেদায়াতের এই বিরক্তিকর আওয়ায শােনার হাত থেকে রেহাই পেতাে। যে আওয়ায প্রতিনিয়ত তাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, সতর্ক করে এবং তাদের আয়েশী ঘুম ভেংগে দেয়, তার হাত থেকে নিস্তার পেতাে। কিন্তু আলােচ্য সূরা তাদেরকে বলে যে, মােমেন জনগােষ্ঠীর মরা বা বাঁচাতে কিছু এসে যায় না। রসূল(স.)-কে অস্বীকার করার কারণে আল্লাহর যে আযাব তাদের জন্যে অবধারিত হয়ে আছে, তা থেকে তাদের রেহাই নেই। কাজেই সেই ভয়াবহ দিন ঘনিয়ে আসার আগে তাদের নিজ নিজ অবস্থা ও করণীয় বিবেচনা করা উত্তম। ‘তুমি বলাে! আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে ও আমার সংগীদেরকে ধ্বংস করে দেন অথবা আমাদের ওপর দয়া করেন, তাহলে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে কাফেরদেকে কে রক্ষা করবে? তুমি বলাে, তিনি দয়াময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ নন। আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং তারই ওপর নির্ভরশীল আছি। প্রকৃত গােমরাহ কে, তা তােমরা অচিরেই জানতে পারবে।’ সর্বশেষে এই সূরা আরবদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংগ পানি যে কোনাে মুহূর্তে চলে যেতে পারে এ আশংকা ব্যক্ত করে সাবধান করেছে। সে বলছে যে, আল্লাহ তায়ালাই এই পানি সরবরাহ করেন। অথচ তাকেই তারা অগ্রাহ্য করছে, ‘বলাে, তোমরা কি ভেবে দেখেছাে যে, তােমাদের পানি যদি উধাও হয়ে যায়, তাহলে কে তােমাদেরকে বহমান পানি এনে দেবে?’ এ সব বক্তব্য বিবেচনা করলে মনে হয় সূরাটি আগাগোড়াই একটি আন্দোলন, অনুভূতিতে একটি শিহরণ এবং চিন্তায় ও চেতনায় একটি অভ্যুত্থান, আর গােটা সূরার মূল ও প্রধান বক্তব্য হলাে তার সূচনা বাক্য, ‘পরম কল্যাণময় তিনি, যার হাতে রয়েছে সাম্রাজ্য এবং তিনিই সর্ববিষয়ে শক্তিমান।’ আর এই সাম্রাজ্য ও তাতে সর্বশক্তিমান হওয়ার তত্ত্ব থেকেই এই সূরায় নিবেদিত সকল দৃশ্য এবং সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য তৎপরতার উৎপত্তি।

ফী জিলালিল কুরআন: বস্তুত জীবন ও মৃত্যুর সৃষ্টি এবং তা দিয়ে কে অধিক সৎকর্মশীল তা পরীক্ষা করা, আকাশসমূহের সৃষ্টি, আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সজ্জিত করা ও সেগুলাে দিয়ে শয়তানকে বিতাড়িত করা, জাহান্নামকে তার নির্দিষ্ট আকৃতি, গুণাগুণ ও রক্ষক সহকারে প্রস্তুত করা, গোপন ও প্রকাশ্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, পৃথিবীকে মানুষের জন্যে বশীভূত করা, অতীতকালের অবিশ্বাসীদের ওপর আকস্মিক বিপদাপদ অবতরণ করা, আকাশে পাখিদের টিকে থাকার ব্যবস্থা করা, আধিপত্য ও পরাক্রম, যাকে যতাে ইচ্ছা রিযিক দান করা, মানুষকে সৃষ্টি করা ও তাকে চোখ কান ও হৃদয় দান করা, পৃথিবীতে ও কেয়ামতের দিন সৃজন ও পুনরুজ্জীবন, আখেরাতের জ্ঞান, কাফেরদের আযাব এবং জীবন রক্ষাকারী পানি সরবরাহ করা ও যখন ইচ্ছা তা উধাও করে দেয়া এ সবই আল্লাহর সর্বশক্তিমান ও সার্বভৌমত্বের আধিপত্য থেকে উৎসারিত। তাই সূরার সকল তত্ত্ব ও বক্তব্য এবং এর সকল দৃশ্য ও শিক্ষা সূরার সেই সূচনা বাণী ও তার সুদ্রপ্রসারী তাৎপর্য থেকে উৎসারিত।  *যাবতীয় সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর শক্তিমান : ‘পরম কল্যাণময় তিনি, যার হাতে সমগ্র বিশ্বের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব এবং তিনি সর্ববিষয়ে শক্তিমান। সূরার সকল তত্ত্ব, তথ্য ও শিক্ষা ধারাবাহিকভাবে ও বিরতিহীনভাবে বিবৃত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সুরার সেই সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যবহ সূচনাবাণীর ব্যাখ্যা বিবৃত হয়েছে। এ জন্যে এ সূরাকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা কঠিন। সূরাটির বক্তব্যগুলােকে কিভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়ােজন, ‘পরম কল্যাণময় সেই মহান সত্তা, যার হাতে বিশ্বের কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও সাম্রাজ্য এবং তিনি সকল জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান।’ সূরার শুরুতে এই গুণ বর্ণনা আল্লাহর বরকত ও কল্যাণকে বহুগুণে বৃদ্ধির আশ্বাস প্রদান করে, আর তার পাশাপাশি রাজত্ব ও সাম্রাজ্যের উল্লেখ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, এই রাজ্য ও বরকতময় এবং এই বরকত শুধু আল্লাহর সত্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং গােটা সৃষ্টিতে বিস্তৃত। এই সত্যের সপক্ষে প্রত্যেক সৃষ্টির মাঝে ঐকতান রয়েছে। এই ঐকতান কোরআন থেকে শুরু হয়ে গােটা সৃষ্টিজগত জুড়ে পরিব্যাপ্ত রয়েছে। ‘বরকতময় ও কল্যাণময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব ও কর্তৃত্ব।’ সুতরাং তিনি গােটা বিশ্ব সাম্রাজ্যের অধিপতি, তার ওপর পরাক্রান্ত, তার ওপর সঠিক ক্ষমতার অধিকারী। এটি এমন একটি সত্য যে, এটি যখন কারাে বিবেকে অবস্থান করে তখন তার দিক ও পরিণতি নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং তাকে একমাত্র এই রাজ্যের একক অধিপতির কাছে প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর সেই একক ও সার্বভৌম অধিপতির দাসত্ব ও আনুগত্যে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার প্রেরণা যােগায়। তিনি সকল জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান। সুতরাং তাঁকে কোনাে কিছুই অক্ষম ও উপায়হীন করে দেয় না। তার উর্ধে কেউ উঠতে পারে না, তার ইচ্ছাকে কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারে না বা সীমাবদ্ধও করতে পারে না; তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যা চান তাই করেন। তিনি যা চান তা করতে সক্ষম, নিজের কাজের ওপর তার কর্তৃত্ব সর্বোচ্চ ও সর্বজয়ী । তার ইচ্ছার সাথে কোনাে শর্ত ও বিধি-নিষেধ আরােপিত হয়নি। তাই এমন একটি সত্য, যা মানুষের বিবেকে অবস্থান গ্রহণ করলে আল্লাহর ইচ্ছা ও কাজ সম্পর্কে তার ধারণাকে সর্বপ্রকারের শর্ত ও বাধা থেকে মুক্ত করে। যার জ্ঞান বুদ্ধি ও অনুভূতি পরিচিত বলয়ে কেন্দ্রীভূত, তার দিক থেকে আগত সকল বিধি-নিষেধ থেকে মুক্ত করে। সুতরাং আল্লাহর ক্ষমতা মানুষের মনে আগত যাবতীয় ধারণা-কল্পনার উর্ধে। আর মানুষের জন্মগত সীমাবদ্ধতার কারণে তার ধ্যান-ধারণায় যে সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা আরােপিত হয়, তা তাকে তার প্রিয় বস্তুর বন্দী বানিয়ে দেয়। চলমান মুহুর্ত ও সীমিত বাস্তবতার বাইরে প্রত্যাশিত রদবদলের মূল্যায়নে তাকে নিজের প্রিয় বস্তুর দাসানুদাস বানিয়ে ছাড়ে। আলােচ্য সূরার এই তত্ত্ব ও তথ্য তার অনুভূতিকে এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে। সুতরাং আল্লাহর ক্ষমতায় সকল অসাধ্য সাধন সম্ভব বলে বিশ্বাস করে এবং নির্বিশেষে সকল জিনিসকে আল্লাহর ক্ষমতার কাছে সমর্পণ করে দেয়। এভাবে সে চলমান সময় ও নির্দিষ্ট সীমিত বাস্তবতার গােলামী থেকে মুক্তি লাভ করে।

ফী জিলালিল কুরআন: ‘যিনি জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তােমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তােমাদের মধ্যে কে বেশী সৎকর্মশীল…’ বিশ্ব সাম্রাজ্যের ওপর তার যে সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বিরাজমান, সব কিছুর ওপর যে তার সীমাহীন অধিকার ও ক্ষমতা এবং তার ইচ্ছা যে বাধা-বন্ধনহীন, তার প্রমাণ এই যে, তিনি জীবন ও মৃত্যুর স্রষ্টা। মৃত্যু দ্বারা জীবনের পূর্ববর্তী নির্জীব অবস্থা ও তার পরবর্তী মৃত্যু দুটোকেই বুঝায়। আর জীবন বলতে ইহকালের জীবন ও পরকালের জীবন উভয়টাকেই বুঝায়। আয়াতে বলা হচ্ছে যে, এর সবটাই আল্লাহর সৃষ্টি।’ এ আয়াত মানুষের চিন্তা ও কল্পনায় এই তথ্য সংগ্রহ করে দিচ্ছে এবং তার পাশাপাশি জাগ্রত চেতনার সৃষ্টি করছে। এই জাগৃতির পশ্চাতে রয়েছে ইচ্ছা ও পরীক্ষা। বস্তুত ব্যাপারটা বিনা চেষ্টায় কিছু অর্জন এবং বিনা উদ্দেশ্যে কোনাে আয়ােজন নয়। এ হচ্ছে শুধুমাত্র আল্লাহর জানা ও অন্যদের অজানা তথ্য প্রকাশ করা, মানুষ পৃথিবীতে কি আচরণ করে এবং তারা কি প্রতিদান পায় সে সম্পর্কে। যাতে তিনি তােমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তােমাদের মধ্যে কে বেশী সৎকর্মশীল। গুনাহ সম্পর্কে সাবধান হয় এবং মনের গােপন ইচ্ছা ও প্রকাশ্য কাজ কর্ম সম্পর্কে হুশিয়ার হয়। এটা তার ভেতরে কোনাে শৈথিল্য উদাসীনতা যেমন থাকতে দেয় না, তেমনি তাকে নিশ্চিত মনে বসেও থাকতে দেয় না। এ জন্যেই বলা হয়েছে, মন মগযে এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ সদা সতর্ক থাকে, সচেতন ও ছােট বড় যাবতীয়। ‘তিনি মহাপরাক্রান্ত, ক্ষমাশীল।’ যে ব্যক্তির মন আল্লাহর ভয়ে সন্ত্রস্ত এবং আল্লাহর সম্মানে সচেতন, তার হৃদয়ে এ আয়াতংশ নিশ্চিন্ততা এনে দেয়। কেননা আল্লাহ তায়ালা পরাক্রান্ত ও বিজয়ী । সেই সাথে তিনি ক্ষমাশীল এবং দয়াশীলও। মন যখন সচেতনভাবে একথা বুঝবে যে, সে এই জগতে কেবল পরীক্ষা দিতেই এসেছে, তখন সে সতর্কও সংযত হবে। তখন সে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া আশা করতে পারে এবং নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারে। ইসলাম মানুষের মনে যে সত্য ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে তা এই যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দূরে তাড়িয়ে দেন না, ব্যক্তির আযাব হােক তাও তিনি চাননা বরং শুধু এটুকু চান যে, তার জীবনের উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে অন্তত সে সজাগ ও সচেষ্ট হােক এবং তার বাস্তবতার পর্যায় পর্যন্ত উন্নীত হােক এবং আল্লাহ তায়ালা যে উদ্দেশ্যে তাকে রূহ দিয়ে অন্যান্য সৃষ্টির ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে সম্মানিত করেছেন তা সে বাস্তবায়িত করুক। এটুকু লক্ষ্য অর্জিত হলে আর তেমন সমস্যা থাকে না। কারণ এর পরে অঢেল অনুগ্রহ, অনুকম্পা, বিপুল মহানুভবতা এবং প্রচুর ক্ষমার ব্যবস্থা রয়েছে। অতপর এই সত্যকে যে সমগ্র বিশ্ব জগতের সাথে সম্পৃক্ত করে সেই সাথে আখেরাতের প্রতিদানকেও তার সাথে সম্পৃক্ত করে। জীবন ও মৃত্যু দ্বারা পরীক্ষিত হবার পরই সে এ কাজ করে।
সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-৪

ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَیْنِ یَنْقَلِبْ اِلَیْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَّ هُوَ حَسِیْرٌ

তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখ, তোমার দৃষ্টি ক্লান্ত ও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*বিস্ময়কর এ সাত আসমান : ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশকে স্তরে স্তরে…’ এই আয়াতসমূহের বক্তব্য হুবহু প্রথম আয়াতেরই ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং সার্বভৌমত্ব, নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও রাজত্বেরই বৈশিষ্ট্য। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় আয়াতে পরীক্ষার জন্যে ও প্রতিদানের জন্যে জীবন ও মৃত্যুর সৃষ্টি সম্পর্কে যে বক্তব্য রয়েছে, এ আয়াতগুলাে তার প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করে। এ আয়াতে যে সাত স্তর আকাশসমূহের কথা বলা হয়েছে, তা কি জিনিস নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। আকাশ বা মহাশূন্য সংক্রান্ত মতবাদসমূহের ওপর নির্ভর করে এ সম্পর্কে কিছু বলা চলে না। কারণ এসব মতবাদ সবসময় পরিবর্তনশীল ও সংশােধন সাপেক্ষ। তাছাড়া মহাশূন্য সংক্রান্ত তথ্যান্বেষণের উপায়-উপকরণও নতুন নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। তাই এসব সংশোধনযোগ্য ও রদবদল যােগ্য তথ্যের সাথে আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যাকে সংশ্নিষ্ট করা যায় না। আমাদের শুধু এতটুকু জানাই যথেষ্ট হবে যে, সাতটি আকাশ আছে এবং সেগুলাে স্তরে স্তরে সাজানাে অর্থাৎ পরস্পর থেকে দূরত্বে অবস্থিত স্তরে বা তালায় তালায় সজ্জিত। কোরআন মানুষের দৃষ্টিকে আল্লাহর সৃষ্টির দিকে আকৃষ্ট করে। আকাশের দিকে বিশেষভাবে এবং যাবতীয় সৃষ্টির দিকে সাধারণভাবে। আল্লাহর সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় সে এই সৃষ্টির শৈল্পিক পূর্ণতা ও চমৎকারিত্ব সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। সৃষ্টির এই পূর্ণতা ও চমৎকারিত্ব চক্ষুকে করে বিষ্ময়ে বিস্ফোরিত অভিভূত ও হতভম্ব। ‘দয়াময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোনাে খুঁত দেখতে পাবে না।’ বস্তুত তাতে আসলেই কোনাে খুঁত নেই, ত্রুটি নেই, নেই কোনাে অসম্পূর্ণতা। ‘আচ্ছা, পুনরায় দৃষ্টি দাও তাে! কোনা ত্রুটি কি দেখতে পাচ্ছে?’ অর্থাৎ এর কোথায়ও কোনাে কাটা, ফাটা, ছেড়া, কিংবা বৈকল্য তােমার নযরে পড়ছে কি? ‘দৃষ্টি ফেরাও তাে দ্বিতীয়বার। হয়তাে তােমরা প্রথম বারের দৃষ্টিতে কোনাে কিছু বাদ পড়ে গেছে, যা তুমি দেখােনি।’ কাজেই আবার তাকাও। ‘তােমার দৃষ্টি তােমার কাছেই শ্রান্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে ফিরে আসবে।’ এখানে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে গিয়ে যে বর্ণনাভংগী অবলম্বন করা হয়েছে, তার ভেতরে আকাশ ও সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রতি গুরুত্বের সাথে অনুসন্ধিৎসা সহকারে দৃষ্টি দেয়ার অনুপ্রেরণা বিদ্যমান রয়েছে। এই তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানমূলক ও চিন্তা গবেষণাধর্মী দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণে উদ্বুদ্ধ করাই হচ্ছে কোরআনের লক্ষ্য। এই অপরূপ সুন্দর সূক্ষ্ম ও বিশ্ময়কর প্রকৃতির দিকে তাকালে মানুষের সরল ও স্থূল দৃষ্টি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরিণত হয়। চক্ষু এই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে কোনােক্রমেই তৃপ্ত হয় না, বরং যতাে দেখে, ততােই আরাে দেখতে চায়। হৃদয় এর সৃক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শিক্ষা ও আভাস ইংগিত যতােই পায়, ততােই তার আরাে পাওয়ার বাসনা জাগে। বিশ্ব প্রকৃতির সুশৃংখল পরিচালনা ও সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা নিয়ে হৃদয় যতােই চিন্তা গবেষণা করে, তৃপ্তি পায় না বরং আরো চিন্তা গবেষণায় মগ্ন হতে চায়। আর যে ব্যক্তি এই জগতের অধিবাসী হয়ে আল্লাহর এই বিচিত্র ও অপরূপ সৃষ্টির মেলাকে নিরন্তর নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করে, তারও পর্যবেক্ষণে কোনােক্রমেই তৃপ্তি আসতে চায় না। কারণ এটা এমন এক জগত, যা কখনাে প্রাচীন হয় না, চোখ, মন ও বিবেক বুদ্ধির জন্যে এ জগত প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সাজে সজ্জিত হয়।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-৬

وَ لِلَّذِیْنَ كَفَرُوْا بِرَبِّهِمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ١ؕ وَ بِئْسَ الْمَصِیْرُ

যেসব লোক তাদের রবকে অস্বীকার করেছে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি। সেটি অত্যন্ত খারাপ জায়গা।

ফী জিলালিল কুরআন:

*প্রকৃতির এ এক মহা বিস্ময় : যে ব্যক্তি এই বিশ্বজগত এবং তার নিয়ম-নীতি ও স্বভাব প্রকৃতি সম্পর্কে ন্যূনতম তথ্যও জানে-যেমনটি আধুনিক বিজ্ঞান কিছু কিছু তথ্য উদঘাটন করেছে, সে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে বিস্ময়ে স্তম্ভিত ও হতবাক না হয়ে পারে না। তবে প্রকৃতির বিষ্ময় ও চমকের জন্যে বিজ্ঞানের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। মানুষের ওপর আল্লাহর এ এক অতুলনীয় অনুগ্রহ যে, বিশ্ব প্রকৃতির আর একটি সাধারণ দৃষ্টি বুলানাে এবং সামান্যতম মনােযােগ দেয়া মাত্রই তার সাথে পরিপূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে এই ক্ষমতা তাকে তিনি দিয়েছেন। তাই মানুষের মন এই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্ব নিখিলের পক্ষ থেকে প্রদত্ত শিক্ষাকে সংগে সংগেই লুফে নেয় ও তাকে আত্মস্থ করে। এই শিক্ষাকে সে সরাসরিভাবেই গ্রহণ করে, যখন সে তার পরিচয় লাভ করে। অতপর সে এসব শিক্ষার ব্যাপারে পরিপূর্ণ একাত্মতা ব্যক্ত করে, জীবের সাথে জীবের যে রূপ ঐকতান হওয়া উচিত এটি ঠিক সেরূপ ঐকতান। এই বিষ্ময়কর সৃষ্টি সম্পর্কে কোনাে তথ্য অবগত হওয়া এবং কোনাে চিন্তা-ভাবনা করার আগেই তার মধ্যে এই ঐকতান গড়ে ওঠে।  *সৃষ্টি দেখে তার স্রষ্টাকে জানাে : এ জন্যেই কোরআন মানুষকে এই বিশ্ব প্রকৃতি ও তার বিস্ময়কর উপাদানগুলো পর্যবেক্ষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ কোরআন সর্বকালের সমগ্র মানব জাতিকেই সম্বােধন করে। সে কথা বলে অরণ্যবাসীর সাথে, মরুচারীর সাথে, নগরবাসী ও সমুদ্র অভিযাত্রীর সাথে। সে কথা বলে। সেই নিরক্ষর মানুষের সাথেও যে একটি অক্ষরও কখনাে লেখেনি বা পড়েনি। একইভাবে সে সম্বােধন করে মহাশূন্য বিজ্ঞানী, প্রকৃতি বিজ্ঞানী ও দার্শনিককে, আর পবিত্র কোরআন থেকে এরা সবাই প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্টতর সংযােগ স্থাপনের উপকরণ এবং প্রকৃতি নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করার প্রেরণা লাভ করে। বিশ্বজগতের সৃষ্টিতে পূর্ণতা যেমন কাম্য, তেমনি কাম্য সৌন্দর্যও। বরঞ্চ এই দুটো আসলে একই জিনিসের এপিঠ ওপিঠ মাত্র। কেননা পূর্ণতা যখন শেষ সীমায় উপনীত হয়, তখন তা সৌন্দর্যে পরিণত হয়। এ কারণেই কোরআন মানুষের দৃষ্টিকে আকাশের পূর্ণতার দিকে আকৃষ্ট করার পর তার সৌন্দর্যের দিকে আকৃষ্ট করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি সর্বনিম্ন আকাশকে সাজিয়ে রেখেছি বহুসংখ্যক প্রদীপ দ্বারা।’ এই সর্বনিম্ন আকাশটা কি? সম্ভবত এটিই পৃথিবী ও পৃথিবীর অধিবাসীর নিকটতম এবং কোরআনের শ্রোতাদের কাছাকাছি। আর এখানে যে প্রদীপমালার কথা বলা হয়েছে, সেগুলাে সম্ভবত খালি চোখে আকাশের দিকে তাকালেই যে গ্রহ নক্ষত্র-পুঞ্জের দেখা যায় সেগুলাে। শ্রোতাদেরকে আকাশের দিকে তাকাতে বলার সাথে এই ব্যাখ্যাই অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা সে যুগের শ্রোতাদের কাছে তাদের খালি চোখ ছাড়া এবং আকাশে ঝিকমিক করা যে জ্যোতিষ্কগুলােকে খালি চোখে দেখা যায় সেই জ্যোতিষ্কগুলাে ছাড়া পর্যবেক্ষণের আর কোনাে সরঞ্জাম ছিল না। আকাশে নক্ষত্রমন্ডলীর দৃশ্য যে হৃদয়ে দাগ কাটার মত সৌন্দর্যমন্ডিত, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। সে সৌন্দর্য বিচিত্র। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার রংও পাল্টে যায়। সকালে বিকালে ও উদয়ান্তে বিচিত্র বর্ণে তার আত্মপ্রকাশ। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে, জ্যোৎস্না রাতে, নির্মল আকাশে এবং কুয়াশাচ্ছন্ন ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তার রকমারি শােভা। সত্যি বলতে গেলে প্রতি ঘন্টায়, আকাশের প্রতি কোণ থেকে এবং প্রত্যেক মানমন্দির থেকে তার ভিন্ন দৃশ্য দেখা যায়। এর প্রতিটি দৃশ্যই মনােরম। প্রতিটি দৃশ্যই অন্তরে দাগ কাটে। ওই সে যে আকাশের এক প্রান্তে একটি নক্ষত্রকে একাকী উকিঝুকি মারতে দেখা যাচ্ছে, মনে হয় ওটা নক্ষত্র তাে নয়, যেন একটা চোখ। মায়াভরা চাহনি নিয়ে তা যেন ডাকছে মিটমিট করে। আবার ওধারে দেখা যাচ্ছে দুটো নক্ষত্র, ভিড় থেকে মুক্ত হয়ে তারা যেন গােপন আলাপচারিতায় লিপ্ত। আর এখানে ওখানে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু ছােট বড় নক্ষত্রপুঞ্জ। আকাশের বিশাল আলাের মেলায় ওগুলাে যেন এক একটা উজ্জ্বল সমাবেশ। মেলায় ওরা যেন এ রাতের সহচর। একবার মিলিত হয় আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চাঁদ ও তার পরিক্রমার পথও বিচিত্র  ধরনের। মাসের শুরুতে এক রাতে তার জন্ম ও উদয়, তারপর ক্রমে তার বৃদ্ধি, আবার ক্রমে ক্ষয়প্রাপ্তি, অবশেষ এক রাতে বিলীন হয়ে যাওয়া। বিশাল মহাশূন্যকেই দেখুন না! যতােদূর চোখ যায় তার কোনাে কুলকিনারা নেই। বিচিত্র সৌরজগতের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভােগ করার ক্ষমতাই শুধু মানুষের আছে, কিন্তু সে সৌন্দর্যকে বর্ণনা ও ব্যক্ত করার ভাষা তার নেই।  *আকাশ ও বিশ্বের অপরূপ সৌন্দর্য : কোরআন মহাকাশ ও গােটা বিশ্বের এই অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে মানুষের মনােযােগ আকর্ষণ করে। কেননা সৃষ্টির সৌন্দর্য উপলব্ধি হচ্ছে স্রষ্টার সৌন্দর্যোপলব্ধির নিকটতম ও অব্যর্থ উপায়। এই উপলব্ধি মানুষকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করে। কেননা স্রষ্টার সৌন্দর্য উপলদ্ধি করা মাত্রই সে উৎকর্ষের সেই উচ্চতম শিখরে আরােহণ করে, যেখান থেকে সে মুক্ত স্বাধীন, মনােরম ও পার্থিব জীবনের ক্লেদমুক্ত এক জগতে প্রবেশ করে চিরস্থায়ী জীবন যাপনের প্রস্তুতি নিতে পারে। আর মানব মনের সবচেয়ে সুখময় মুহূর্তটি আসে তখনি, যখন সে বিশ্বজগতে বিরাজিত আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য সুষমাকে উপভােগ ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। কেননা ওটাই সেই দুর্লভ ও বিরল মুহূর্ত, যখন তার ভেতরে স্বয়ং আল্লাহর সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা ও প্রস্তুতি জন্মে। এখানে পবিত্র কোরআনের অকাট্য উক্তি থেকে জানা যাচ্ছে যে, যে প্রদীপমালা দ্বারা আল্লাহ তায়ালা সর্বনিম্ন আকাশকে সুসজ্জিত করেছেন, সে সব প্রদীপমালার তথা নক্ষত্রমালার আরাে একটা দায়িত্ব আছে। সেটি হচ্ছে, ‘এগুলো আমি শয়তানদের বিতাড়নের হাতিয়ার বানিয়ে।’ আমি এই তাফসীর গ্রন্থে একটি নীতি অবলম্বন করে এসেছি যে, আল্লাহ তায়ালা যেসব অদৃশ্য বিষয়ের আংশিক তথ্য আমাদের কাছে ব্যক্ত করে থাকেন, তার অতিরিক্ত কিছুই বলার আমি চেষ্টা করবাে না এবং কোরআন তার সুস্পষ্ট বক্তব্যে যতােটুকু বলে, আমরা ঠিক ততটুকু নিয়েই ক্ষান্ত থাকবাে, তার চেয়ে একবিন্দুও সামনে এগুবাে না। কেননা কোরআনের বক্তব্য বিষয় প্রমাণিত করতে আসলে সেটুকুই যথেষ্ট। অতিরিক্ত কিছুর কোনাে প্রয়ােজন নেই। যেমন ধরুন, শয়তান নামে আল্লাহর একশ্রেণীর সৃষ্টি যে আছে সে কথা আমরা বিশ্বাস করি। কোরআনে শয়তানের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। আমার এই তাফসীরেও ইতিপূর্বে সে সম্পর্কে কিছু বিবরণ দিয়েছি। আমরা তার চেয়ে বেশী কোনাে তথ্য দেবাে না। আমরা এ কথায়ও বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তায়ালা এই নক্ষত্র মন্ডলী দ্বারা আকাশকে সুশােভিত করা ছাড়াও শয়তানকে তাড়ানাের কাজও সম্পন্ন করে থাকেন। অন্য সূরায় বর্ণিত হয়েছে যে, উল্কাপিডের আকারে নক্ষত্রগুলাের অংশ বিশেষ দ্বারা এই কাজটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। ‘প্রত্যেক দুর্বৃত্ত শয়তানের কবল থেকে রক্ষার জন্যে। তবে যে কেউ পশ্চাদ্ধাবন করবে, একটি জ্বলন্ত উল্কা তার পিছু নেবে।’  *তারকাপুঞ্জের কাজ : বাকী রইলাে কিভাবে ও কেমন আকৃতি নিয়ে এই নক্ষত্র শয়তানকে তাড়া করে-সে কথা, এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কিছুই জানাননি। আর এটা জানবার জন্যে আমাদের কাছে অন্য কোনো উৎসও নেই। সুতরাং আমাদের শুধু এটুকু জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং এর বাস্তবতায় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। আমাদের কাছ থেকে আল্লাহর কাম্যও এটাই। আল্লাহ তায়ালা যদি বুঝতেন যে, আরাে সঠিক তথ্য জানায় উপকারিতা আছে, তাহলে তিনি তা অবশ্যই আমাদের জানাতেন। আল্লাহ তায়ালা যা জানানাে ভালাে মনে করেননি, তা আমাদের জানতে চেষ্টা করার কি দরকার? বস্তুত শয়তানকে বিতাড়নের আদেশটিও তিনি দিয়েছেন এ ধরনের নিষ্প্রয়ােজন তথ্য সংগ্রহ থেকে নিবৃত্ত রাখার জন্যে। এরপর শয়তানদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা আর কি কি শান্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন তার বিবরণ দিচ্ছেন, আমি তাদের জন্যে জুলন্ত আগুনের শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। অতএব এই শয়তানদের জন্যে পৃথিবীতে নক্ষত্র ছুড়ে মেরে বিতাড়ন এবং আখেরাতে আগুনে দদ্ধ হওয়ার শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা শয়তানদের জন্যে দুনিয়া ও আখেরাতে যে শাস্তি নির্ধারিত রেখেছেন, তার উল্লেখের প্রাসংগিকতা কি, এ প্রশ্ন এখানে স্বভাবতই ওঠে। এর প্রাসংগিকতা প্রথমত এই যে, আকাশেই প্রদীপমালার উল্লেখ প্রসংগে শয়তানের উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পরবর্তীতে যে কাফেরদের উল্লেখ রয়েছে, সে প্রসংগেও শয়তানের উল্লেখ করা হয়েছে । শয়তান ও কাফেরদের সম্পর্ক যে কত ঘনিষ্ঠ তা সুবিদিত। আকাশের প্রদীপমালার উল্লেখ প্রসংগে সেগুলােকে শয়তান বিতাড়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের উল্লেখ করা হয়েছে । আর শয়তানদের জন্যে জ্বলন্ত আগুনের শাস্তির উল্লেখ প্রসংগে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা শয়তানের অনুসরণের কারণে কাফেরদের জন্যে নির্ধারিত করেছেন জাহান্নামের আযাব, যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছে, তাদের জন্যে জাহান্নামের আযাব নির্ধারিত রয়েছে। বস্তুত জাহান্নাম বড়ই নিকৃষ্ট ঠিকানা।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-৭

اِذَاۤ اُلْقُوْا فِیْهَا سَمِعُوْا لَهَا شَهِیْقًا وَّ هِیَ تَفُوْرُۙ

তাদেরকে যখন সেখানে নিক্ষেপ করা হবে তখন তারা তার ভয়ানক গর্জনের শব্দ শুনতে পাবে এবং তা টগবগ করে ফুটতে থাকবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তির বর্ণনা : অতপর এই জাহান্নামের একটি দৃশ্য অংকন করা হয়েছে এই বলে, যখন অবিশ্বাসীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা সেখানে গাধার ডাক শুনবে, জাহান্নাম তখন উদ্বেলিত হবে এবং ক্রোধে যেন ফেটে পড়ার উপক্রম হবে। বস্তুত জাহান্নামকে এখানে একটা জীবন্ত সৃষ্টিরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। সে যেন নিজের প্রচন্ড ক্রোধ দমন করছে। ফলে তার ভেতর থেকে গাধার ডাকের মত আওয়াযের সৃষ্টি হচ্ছে। দমিত আক্রোশে সে যেন ফেটে পড়তে চাইবে। কাফেরদের ওপর তার ক্রোধ ও আক্রোশ চরম পর্যায়ে। উপনীত হবে। এখানে দোযখের অবস্থা বাহ্যত রূপকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু আসলে তা রূপক নয় বরং বাস্তব। কেননা আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিই এই অর্থে প্রাণী যে, তার নিজস্ব এক ধরনের আত্মা আছে এবং প্রত্যেক সৃষ্টি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করে থাকে। মানুষকে তার স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখে প্রত্যেক সৃষ্টি দুঃখিত, স্তম্ভিত, ক্রুদ্ধ হয়। কেননা স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টি মাত্রেরই সহজাত বিরাগ বিদ্বেষ ও ক্রোধ জন্মে। তার স্বভাব অন্য এক সৃষ্টির কুফরী আচরণকে ও অবাধ্যতাকে ঘৃনা সুপ্ত রয়েছে। বস্তুত কোরআনে এ সত্যটি একাধিক জায়গায় বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তার গুণগানের প্রবণতা আর তার অবাধ্যদের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা সুপ্ত রয়েছে। কোরআনের দ্ব্যর্থহীন উক্তি হচ্ছে, ‘সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যবর্তী সব কিছু আল্লাহর গুণগান করাে। আল্লাহর গুণগান করে না এমন কিছুরই অস্তিত্ব নেই, তবে তােমরা তাদের গুণগান বুঝতে পারো না।’ আরাে বলা হয়েছে, ‘হে পর্বতমালা এবং হে পাখিরা, দাউদের সাথে সাথে তােমরাও আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করো।’ এ সব উক্তি এতাে অকাট্য এতাে সুস্পষ্ট যে, এর ভেতরে অন্য কোনােরকম ব্যাখ্যা দেয়ার অবকাশ নেই। আরাে বলা হয়েছে, ‘অতপর আল্লাহ তায়ালা আকাশের দিকে মনােযােগ দিলেন, তখনও তা ছিলাে ধুয়ার আকারে।’ তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, ‘তােমরা উভয়ে ইচ্ছায় হােক বা অনিচ্ছায় হােক চলে এসাে। আকাশ ও পৃথিবী জবাব দিলাে, ‘আমরা স্বেচ্ছায় এলাম।’ এখানে এরূপ ব্যাখ্যা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে যে, এটা আসলে রূপক অর্থে আল্লাহর আদেশের সামনে আকাশ ও পৃথিবীর আনুগত্য বুঝাচ্ছে। কিন্তু আসলে এই ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়ােজন। বরঞ্চ প্রত্যক্ষ অর্থ থেকে এটা আরাে বেশী দূরবর্তী। আলােচ্য আয়াতে দোযখের একটি প্রতিক্রিয়া ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন অপর এক জায়গায় আল্লাহর সাথে শরীক করার কাজটির প্রতি প্রকৃতির তীব্র অসন্তোষ প্রকাশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তােমরা এমন একটা উদ্ভট বিষয় নিয়ে এসেছে যে, তার প্রভাবে আকাশ বিদীর্ণ, পৃথিবী খন্ড বিখন্ড এবং পাহাড় পর্বতসমূহ বিধবস্ত হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। কারণ লােকেরা দয়াময় আল্লাহর পুত্র আছে বলে দাবী করেছে। অথচ দয়াময় আল্লাহর পক্ষে এটা আদৌ সমীচীন নয় যে, কাউকে পুত্র বানিয়ে নেন।’ পবিত্র কোরআনের এ সব অকাট্য ও দ্বার্থহীন উক্তি যে সত্যের সন্ধান দিচ্ছে, সে সত্যটি এই যে, সমগ্র সৃষ্টিজগত তার স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসী এবং তার প্রশংসা ও গুণগানে নিয়ােজিত। মানুষ যখন তার স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তার অবাধ্য হয়, তখন সমগ্র সৃষ্টিজগত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহদ্রোহী মানুষ গােটা সৃষ্টিজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সৃষ্টিজগত তার ওপর ক্রোধে ও আক্রোশে ফেটে পড়তে চায়। ঠিক যেমন কোনাে সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্য ব্যক্তিকে কেউ অপদস্থ ও ভৎর্সনা করলে জনতা সেই ভৎর্সনাকারীর ওপর ক্ষিপ্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। দোযখের অবস্থাও তদ্রুপ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে অবস্থা এই যে, ‘দোযখ উদ্বেলিত হবে এবং ক্রোধে ফেটে পড়ার উপক্রম হবে।’

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-১১

فَاعْتَرَفُوْا بِذَنْۢبِهِمْ١ۚ فَسُحْقًا لِّاَصْحٰبِ السَّعِیْرِ

এভাবে তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করবে। এ দোযখবাসীদের ওপর আল্লাহর লানত।

ফী জিলালিল কুরআন:

*জাহান্নামের প্রহরীর জিজ্ঞাসা : আল্লাহর অবাধ্য বান্দাদের ওপর দোযখের এই সর্বব্যাপী ক্ষোভ ও অসন্তোষ দোযখের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকেও প্রভাবিত করবে। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখনই একটি দলকে তার ভেতরে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তার প্রহরীরা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘তােমাদের কাছে কি কোনাে সতর্ককারী (রসূল) আসেনি?’ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ অবস্থায় এই প্রশ্ন নিছক তাচ্ছিল্য ও অবমাননার উদ্দেশ্যেই করা হবে। কেননা দোযখের প্রহরীরাও তাদের ওপর দোযখের মতােই ক্ষিপ্ত ও রাগান্বিত হবে এবং তারা তাদেরকে শাস্তি দেয়ার কাজে তৎপর হবে। কোনাে শাস্তিযােগ্য অপরাধীর অবমাননা ও লাঞ্ছনার জন্যে যখন এ ধরনের কথা বলা হয়, তখন এর চেয়ে হৃদয়বিদারক কটু কথা ও কষ্টদায়ক কথা আর কিছুই হতে পারে না। এর জবাবে স্বভাবতই চরম হতাশা, অনুশােচনা ও আপন নির্বুদ্ধিতা ও উদাসীনতার স্বীকৃতি প্রতিফলিত হবে এবং দুনিয়ার জীবনে নিজেদের হঠকারিতা অস্বীকৃতি ও নবীদের গােমরাহীতে লিপ্ত থাকার অপবাদ দানের স্মৃতিচারণ করা হবে। তারা বলবে, ‘অবশ্যই আমাদের কাছে সতর্ককারী এসেছিলে। কিন্তু আমরা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছিলাম আর বলেছিলাম যে, আল্লাহ তায়ালা তাে কিছুই নাযিল করেননি। তােমরা নিশ্চয়ই মারাত্মক গােমরাহীতে লিপ্ত আছাে তারা আরাে বলবে, আমরা যদি শুনতাম এবং বুঝতাম তাহলে আজ দোযখের অধিবাসী হতাম না।’ বস্তুত যে ব্যক্তি শ্রবণ করে অথবা হৃদয়ংগম করে, সে নিজেকে এমন ভয়ংকর পরিণতির। সম্মুখীন করে না, সেসব হঠকারী লােকের মত অস্বীকার করে না, অস্বীকৃতির কোনাে যুক্তি না থাকা সত্ত্বেও এমন ধৃষ্টতার সাথে এতাে তাড়াহুড়া করে রসূলদেরকে গােমরাহ ঠাওরায় না এবং অস্বীকার করার পর পরম সত্যবাদী রসূলদের ওপর এরূপ পাল্টা দোষারােপ করে না যে, আল্লাহ কিছুই নাযিল করেননি, তােমরা নিছক গোমরাহীতেই লিপ্ত রয়েছো। ‘বস্তুত তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে কাজেই এ সব দোযখবাসীর ওপর অভিসম্পাত!’ ‘সুহক’ শব্দের শাব্দিক অর্থ দূরত্ব, তাওহীদের প্রতি ঈমান না আনা এবং কেয়ামত সত্যই ঘটবে বলে বিশ্বাস না করার অপরাধ স্বীকার করার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে এই অভিসম্পাত উচ্চারিত হবে। আল্লাহর অভিসম্পাতের অর্থই হলাে এই মর্মে আল্লাহর সিদ্ধান্ত আসা যে, তারা তার রহমত থেকে বঞ্চিত, তাদের ক্ষমা লাভের কোনাে অবকাশ নেই এবং আযাব থেকে পরিত্রাণ নেই। তারা চিরদিনের জন্যে দোযখবাসী। এমন জঘন্য ও নিকৃষ্ট অধিবাস ও বাসস্থান আর কি হতে পারে। এমন বিক্ষুব্ধ ক্ষিপ্ত ও উদ্বেলিত দোযখের আযাব অত্যন্ত ভয়াবহ আযাব। এ আযাব দেয়া আল্লাহর যুলুম নয়। তিনি কাউকে যুলুম করেন না। আমরা মনে করি যে, মানুষের স্বভাব প্রকৃতিতে ঈমানের সত্যতা ও তার যৌক্তিকতায় বিশ্বাস স্থাপনের প্রবণতা সংরক্ষিত করার পরও যে ব্যক্তি আল্লাহকে অস্বীকার করে, তার বিবেক সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই। সে ব্যক্তির ভেতরে এমন গুণপনারও আর অস্তিত্ব নেই- যা তাকে গােটা সৃষ্টির ভেতরে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেবে। সুতরাং তার পরিণতি হলাে তাকে দোযখে রাখা হবে এবং সেখান থেকে তার উদ্ধার পাওয়া বা পালাবার কোনাে অবকাশ থাকবে না।  *আল্লাহ তায়ালার সাথে বিদ্রোহের চরম পরিণতি : যে মানবাত্মা পৃথিবীতে আল্লাহকে অমান্য করে, সে পার্থিব জীবনে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হতে থাকে, অবশেষে তা চরমভাবে বিকৃত, ধিকৃত, ঘৃণিত ও দোযখের উপযুক্ত রূপ ধারণ করে। বিশ্বজগতের কোনাে জিনিসই তার মত বিকৃত ও নিকৃষ্ট হয় না। কেননা প্রকৃতির প্রতিটি বস্তু মােমেন। প্রতিটি বস্তুই আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করে। এসব আল্লাহদ্রোহী, বিকৃত অবিশ্বাসী পাপিষ্ঠ মানবাত্মা ছাড়া বিশ্বজগতের সকল বস্তু আল্লাহর অনুগত ও ফরমাবরদার । ফলে এই পাপিষ্ঠ মানবাত্মাগুলাে বিশ্ব প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ধিকৃত ও বিকৃত হয়ে নিকৃষ্টতম স্তরে পৌছে যায়। আর তাদের পারলৌকিক পরিণতি দাঁড়ায় এই যে, তারা সে ভয়ংকর ক্ষিপ্ত রুদ্রমুর্তিধারী জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড দোযখে নিক্ষিপ্ত হয় এবং সকল মান-মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পবিত্র কোরআনের রীতি এই যে, কেয়ামাতের দৃশ্য বর্ণনাকালে দুই পরস্পর বিরােধী পরিণামকে পাশাপাশি রেখে দেখিয়ে দেয়। এক পাশে মােমেনের আর এক পাশে কাফেরের পরিণামের বর্ণনা দেয়। এভাবে সে সূরা ‘মুলক’-এর দ্বিতীয় আয়াতের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত করে। ‘যাতে তােমরা কে অধিকতর সৎকর্মশীল তার পরীক্ষা হয়।’

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-১৪

اَلَا یَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ١ؕ وَ هُوَ اللَّطِیْفُ الْخَبِیْرُ۠

যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই কি জানবেন না? অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সব বিষয় ভালভাবে অবগত।

 

ফী জিলালিল কুরআন:

পরীক্ষার কথা উল্লেখের পর এখন আল্লাহ তায়ালা কর্মফলের বিবরণ দিচ্ছেন, ‘নিশ্চয় যারা তাদের প্রতিপালককে না দেখেও ভয় করে তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার।’ আয়াতে উল্লেখিত ‘গায়ব’ শব্দটিতে দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রথমত, বান্দাদের চোখের আড়ালে থাকা মনিবকে যারা ভয় করে। দ্বিতীয়ত, যে বান্দারা একে অপরের দৃষ্টির আড়ালে থাকা অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে।  *আল্লাহ তায়ালার বিপুল জ্ঞান ভান্ডার : এই দুটোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মূলাবান, মর্যাদাপূর্ণ ও পবিত্র অবস্থা। আয়াতের শেষাংশে যে মহান প্রতিদানের তথা ক্ষমা, গুনাহ থেকে অব্যাহতি ও বিরাট পুরস্কারের উল্লেখ করা হয়েছে, উক্ত উভয় প্রকারের ভীতিই মানুষকে তার উপযুক্ত করে তােলে। অর্থাৎ আল্লাহকে না দেখেও ভয় করা এবং লােকেরা না দেখুক, না জানুক এমন অবস্থায়ও আল্লাহকে ভয় করা। বস্তুত গােপন ও প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাথে হৃদয়ের যােগাযােগ অক্ষুন্ন থাকা, কেউ না দেখা ও না জানা সত্ত্বেও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ রাখা হচ্ছে মানব মনে চেতনা ও অনুভূতি অটুট থাকার মানদন্ড এবং বিবেকের সজীবতার গ্যারান্টি। হাফেজ আবু বকর আল বাযযায স্বীয় মােসনাদে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত আনাস বর্ণনা করেন, সাহাবীরা রসূল(স.)-কে বললেন, আমরা যখন আপনার কাছে থাকি, তখন এক অবস্থায় থাকি এবং আপনার কাছ থেকে দূরে গেলেই আমাদের অবস্থা অন্যরকম হয়ে যায়। রাসূল(স.) বললেন, ‘আল্লাহর সাথে তােমাদের সম্পর্ক কেমন থাকে? তারা বললেন, আল্লাহ তায়ালা তাে গােপন ও প্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আমাদের প্রতিপালক। রাসূল(স.) বললেন, তাহলে তােমাদের সে অবস্থার পরিবর্তন মােনাফেকী নয়। বস্তুত, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ও সংযােগই হলাে মূল কথা। এটা যতােক্ষণ কারাে মনে অক্ষুন্ন থাকবে, ততক্ষণ সে যথার্থ আল্লাহ ভক্ত মােমেন থাকবে। এ আয়াতটি তার পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে পরবর্তী আয়াতের সংযোগ ঘটাচ্ছে। যেহেতু মানুষের গােপন ও প্রকাশ্য সবই আল্লাহ জানেন, তিনি মানুষের মন ও আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের অবস্থান স্থল সম্পর্কে অবগত আছেন, তাই তিনি তাদেরকে এ আয়াতে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন, ‘তােমরা তােমাদের কথা গোপনে বলো বা প্রকাশ্যে বলাে, তিনি মানুষের মনের কথা জানেন । যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি জানবেন না এও কি সম্ভব? তিনি তাে অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ।’ অর্থাৎ গােপন করাে বা প্রকাশ করাে, আল্লাহর জ্ঞানের কাছে তা সমানভাবে পরিজ্ঞাত। এমনকি গােপন ও প্রকাশ্য কথার চেয়েও যা গোপনীয়, যা এখনাে কথায় পরিণতই হয়নি বরং হৃদয়ে চিন্তা ও কল্পনার আকারে লুকিয়ে আছে, তাও জানেন। নিশ্চয়ই তিনি মনের অবস্থাও জানেন, তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ। যিনি সৃষ্টি করেন তিনি কি নিজের সৃষ্টিকে জানবেন না? তিনি তাে সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ। ফলে তার জ্ঞান সূক্ষ্মতম ও গুপ্ততম জিনিস পর্যন্ত পৌছে। মানুষ যখন নিজের কোনাে তৎপরতাকে বা মনের কোনাে চিন্তাভাবনাকে আল্লাহর কাছ থেকে লুকাতে চেষ্টা করে, তখন সে বড়ই হাস্যকর চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। কেননা যে মনের মধ্যে সে নিজের চিন্তাভাবনাকে লুকায় সে মনটা তাে আল্লাহরই সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা তার এই সৃষ্টির গোপন ও প্রকাশ্য অবস্থা সবই জানেন। আর যে চিন্তাভাবনা, ধ্যান ধারণা বা উদ্দেশ্যকে সে লুকায় তাও আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি এটাও জানেন, কোথায় তা থাকে তাও জানেন। তাহলে মানুষ কি লুকাবে এবং কোথায় লুকাবে? কোরআন এই সত্যটিকেই মানুষের হৃদয়ে বদ্ধমূল করতে চায়। কেননা এ সত্য যার হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়, তার সব জিনিসের ব্যাপারেই সঠিক বুঝ অর্জিত হয়। তার জাগৃতি, চেতনা ও আল্লাহভীতি সবই যথাযথভাবে অর্জিত হয়। এগুলাে যথাযথভাবে অর্জিত হওয়ার কারণে পৃথিবীতে সত্যিকার মােমেন হিসাবে তার দায়িত্ব পালনও তার পক্ষে সম্ভবপর হয়। আকিদা ও ন্যায়নীতি এবং নিয়ত ও আমলে সে আল্লাহর একক আনুগত্য অবলম্বন করে। আর এটা কেবল তখনই সম্ভব হয় যখন তার এই বিশ্বাস জন্মে যে, তার মন এবং মননে যা কিছু লুকানাে থাকে সবই আল্লাহর সৃষ্টি এবং আল্লাহর কাছে তার অবস্থা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত। কেননা তিনি সুক্ষ্মতম জ্ঞানী ও সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ। এ বিশ্বাস অর্জিত হওয়ার পরই মােমেন তার গুপ্ত উদ্দেশ্য এবং প্রকাশ্য কাজ ও শব্দ থেকে সংযত ও সাবধান হয়। কেননা সে জানে, তার আচরণ ও লেনদেন যা কিছু হচ্ছে, গোপন ও প্রকাশ্য সব তিনি হৃদয়ের ভেতরে কি আছে তা অবশ্যই জানেন।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-১৫

هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ ذَلُوْلًا فَامْشُوْا فِیْ مَنَاكِبِهَا وَ كُلُوْا مِنْ رِّزْقِهٖ١ؕ وَ اِلَیْهِ النُّشُوْرُ

তিনিই তো সেই মহান সত্তা যিনি ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন। তোমরা এর বুকের ওপর চলাফেরা করো এবং আল্লাহর দেয়া রিযিক খাও।আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*বসবাসযােগ্য গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী : এ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা মানুষের নিজ সত্তা নিয়ে আলােচনা করলেন। অতপর যে পৃথিবীকে তিনি মানুষের জন্যে সৃষ্টি করেছেন, যে পৃথিবীকে মানুষের অনুগত করেছেন এবং যে পৃথিবীর উদরে মানুষের যাবতীয় জীবনােপকরণ নিহিত রেখেছেন, তার সম্পর্কে আলােচনা করছেন। তিনি বলেন, ‘তিনি সেই আল্লাহ তায়ালা, যিনি তােমাদের জন্যে পৃথিবীকে বশীভূত ও বিনীত করেছেন। অতএব তােমরা তার সকল প্রান্তে চলাফেরা করাে এবং তার জীবিকা আহরণ করাে। তােমাদেরকে তার কাছেই সমবেত হতে হবে।’ মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে পৃথিবী পৃষ্ঠে বসবাস করে আসছে। অনায়াসে ও অবাধে তার ওপর জীবন যাপন ও চলাফেরা করছে। তার পানি, মাটি, বাতাস, খনিজ দ্রব্য, রকমারি শক্তি ও জীবিকা উপভােগ করছে। এই গতানুগতিক জীবন ধারায় মানুষ আল্লাহর এই অনুগ্রহের কথা বেমালুম ভুলে যায় যে, তিনিই পৃথিবীকে এমন বিনীত, অনুগত ও বাসযােগ্য করে দিয়েছেন। কোরআন এ অভাবনীয় নেয়ামতটির কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ সম্পর্কে তার ভেতরে গভীর অন্তর্দষ্টি ও সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং তা এমন ভাষায় করে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রত্যেক প্রজন্ম এই অনুগত পৃথিবী সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। আর কোরআনে কথিত অনুগত পৃথিবী বলতে কোরআনের তৎকালীন শ্রোতারা বুঝতো এই ভূমন্ডল যে, যার ওপর পায়ে হেঁটে, জন্তু জানােয়ারের পিঠে সওয়ার হয়ে, সমুদ্র বিহারী নৌকা ও জাহাজে আরােহণ করে যথেচ্ছা চলাচল ও যাতায়াত করা যায়। যার ওপর কৃষিকার্য করা, ফসলের বীজ বােনা ও ফসল কাটা যায়। আর বৃক্ষলতা ও ফসল উৎপাদনের যােগ্য পানি, মাটি ও বাতাসে সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা যায়। পৃথিবী সংক্রান্ত এই সংক্ষিপ্ত ধ্যান-ধারণার যে বিশদ ব্যাখ্যা আধুনিক বিজ্ঞান দিয়ে থাকে তা কোরআনের বক্তব্যেরই যুক্তিসংগত সম্প্রসারিত রূপ। পবিত্র কোরআনে পৃথিবীকে ‘যালুল’ (অনুগত বা বশীভূত) শব্দ দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে। আনুগত্য বা বশীভূত হওয়া বা পোষ মানার এই গুণটি সাধারণত জন্তু জানােয়ারের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। এই গুণটি স্বয়ং পৃথিবীর ওপরও প্রযােজ্য। আমরা যে পৃথিবীকে দেখি, একই জায়গায় স্থির ও নিস্তব্ধ হয়ে আছে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আসলে তা একটা চলমান, শুধু চলমান নয় সবেগে ধাবমান এক জন্তু। আবার একই সাথে সে বিনয়াবনত এবং অনুগতও। সে তার আরােহীকে পিঠ থেকে নাড়া দিয়ে ফেলে দেয়না বা পােষমানা জন্তুর মত অস্থির করে তােলে না। আরােহীরা পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তার পিঠে চড়ে ভ্রমণ করতে থাকে। এই জন্তুটি শুধু অনুগতই নয় বরং দুধেলও। তার পেট থেকে আমরা যাবতীয় খাদ্য সম্ভার লাভ করে থাকি। এই যানবাহনটি, যার ওপর দিয়ে আমরা ভ্রমণ করি, নিজের চার পাশেই ঘন্টায় এক হাজার মাইল বেগে ঘুরছে। তাছাড়া সূর্যের চারপাশেও সে প্রায় ৬৫ হাজার মাইল বেগে চক্কর দিচ্ছে। তারপর পৃথিবী, সূর্য ও গােটা সৌরজগত একত্রে ২০ হাজার মাইল বেগে ছুটে চলেছে। এতসব ঘােরাঘুরি ও ছুটোছুটির ভেতরে মানুষ তার পিঠের ওপর নিরাপদে, নিশ্চিন্তে নিরুপদ্রবে বসে আছে। কোথাও ছিটকে পড়ছে না, তার হাড়গােড় মাথা মগয কিছুই ভাংছে না।   *পৃথিবীর গতির প্রভাব : পৃথিবীতে যে তিনটি গতির কথা উল্লেখ করলাম, তার গভীর উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা রয়েছে। মানুষের জীবনে এর দুটো গতির প্রভাব আমরা জানতে পেরেছি। শুধু মানুষের জীবনে নয় বরং ভূপৃষ্ঠে যতাে প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে তাদের জীবনেও এ গতিদ্বয়ের প্রভাব সুস্পষ্ট। পৃথিবীর নিজের চারপাশে যে গতি (আহ্নিক গতি) তার প্রভাবে রাত ও দিন হয়। পৃথিবীতে যদি শুধু রাতই চিরস্থায়ী হতাে, তাহলে গােটা জীব জগত বরফে জমে যেত। আর যদি শুধু দিনই চিরস্থায়ী হতাে তাহলে উত্তাপে গােটা জীবজগত জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। আর সূর্যের চারপাশে তার যে আবর্তন, (বার্ষিক গতি) তার প্রভাবে ঋতুর পরিবর্তন ঘটে। শুধু একটা ঋতুই যদি চিরস্থায়ী হতাে তাহলে আল্লাহর ঈপ্সিত বর্তমানরূপে জীবজগত টিকে থাকতে পারতাে না। তৃতীয় যে আবর্তনটার উল্লেখ করেছি, (অর্থাৎ সমগ্র সৌরজগতের একত্রে আবর্তন) তার অজানা রহস্য এখনাে উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মহাজাগতিক ভারসাম্য রক্ষার সাথে সে গতিটার একটা সংযােগ এবং মহাজাগতিক এই সময় বিধানে তারও একটা ভূমিকা অবশ্য আছে। এই সব কয়টি গতিতে একই সাথে আবর্তনরত, এই একান্ত অনুগত জন্তুটি বা যানবাহনটি আপন কক্ষপথে পরিভ্রমণকালে একই অবস্থায় স্থির থাকে। কেবল ০২৩.৫ ডিগ্রী পরিমাণ হেলানাে থাকে। কেননা এই হেলানাে অবস্থায় পৃথিবীর সূর্যের কক্ষপথে পরিভ্রমণ থেকেই ঋতু বৈচিত্রের উদ্ভব হয়ে থাকে। পরিভ্রমণকালে যদি এই অবস্থান কিছুমাত্র বিক্ষত হতাে, তাহলে ঋতু বৈচিত্রের উৎপত্তিও বাধাগ্রস্ত হতাে এবং শুধু উদ্ভিদ জীবনই নয়, ভূপৃষ্ঠের গােটা জীব ও জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়তাে। আল্লাহ তায়ালা যে পৃথিবীকে মানুষের অনুগত ও মানানসই করে রেখেছেন তার একটা অর্থ এই যে, তিনি তার ভেতরে মধ্যাকর্ষণ শক্তি সৃষ্টি করেছেন। যা পৃথিবীর আবর্তনকালে তার অধিবাসীদেরকে তার সাথে চিমটে ধরে রাখে। তাছাড়া তাকে একটা বায়ুমন্ডলীয় চাপের আওতায় রেখেছেন, যাতে তার ওপর দিয়ে সহজে চলাচল করা যায়। বায়ুমন্ডলীয় চাপটা যদি বর্তমানে যেমন আছে তার চেয়ে বেশী ভারী হতো, তাহলে সেই বায়ুমন্ডলীয় চাপ যে পরিমাণে ভারী হতাে ঠিক সেই পরিমাণ মানুষের যাতায়াত ও মালামাল পরিবহন কষ্টকর হতাে অথবা একেবারেই অসাধ্য হতাে। মানুষ হয় ধ্বংস হয়ে যেত, নতুবা অচল ও পংগু হয়ে যেত। আর যদি বায়ুমন্ডলীয় চাপ এখনকার চেয়ে হালকা হত, তাহলে মানুষের পদচারণা হত এলােমেলাে ও এবড়ােথেবড়াে, তার চার পাশের বায়ুমন্ডলের ওপর তার নিজ দেহের চাপ বেশী হওয়ায় তার দেহের কোটর বিশিষ্ট অংগসমূহ ফেটে যেত, যেমন উপযুক্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া মহাশূণ্যের উচ্চতর স্তরসমূহে উন্নয়নকারীদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। আল্লাহ তায়ালা যে পৃথিবীকে অনুগত করে দিয়েছেন, তার একটা দিক এও যে, তিনি পৃথিবীর উপরিভাগকে প্রসারিত করে দিয়েছেন এবং ভূপৃষ্ঠের মাটিকে নরম বানিয়ে দিয়েছেন। যদি তা কঠিন প্রান্তরের আকারে থাকতাে যেমন বিজ্ঞান বলে থাকে যে, পৃথিবীর উপরিভাগ ঠান্ডায় জমে গেলে তা পাথরে পরিণত হতাে তাহলে এর ওপর দিয়ে চলাফেরা করা অসম্ভব হয়ে পড়ত এবং উদ্ভিদ জন্মানােও অসাধ্য হয়ে পড়তো। কিন্তু বাতাস ও বৃষ্টি ইত্যাকার পরিবেশগত উপাদানগুলাে এসব পাথরকে চূর্ণ করে দেয়। সেই পাথরচূর্ণ দিয়েই আল্লাহ তায়ালা জীবন ধারণের উপযােগী এই উর্বর মাটি তৈরী করেন আর এই উর্বর মাটি থেকেই সৃষ্টি করেন পৃথিবীর অধিবাসীদের প্রয়ােজনীয় জীবিকা ও উদ্ভিদ।  *মানব জীবনের জরুরী উপাদানসমূহ : আল্লাহ তায়ালা এভাবেও পৃথিবীকে মানুষের অনুগত ও বশীভূত করে দিয়েছেন যে, তার চারপাশের বিরাজমান বায়ুমন্ডলকে জীবনের জন্যে অপরিহার্য উপাদানসমূহ দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছেন। আর এই উপাদানগুলােকে এমন নিখুঁত ও সুক্ষ্ম আনুপাতিক হারে স্থাপন করেছেন যে, তাতে বিন্দুমাত্রও কম বেশী হলে কোনাে প্রাণী বেঁচে থাকতে পারতাে না। এতে শতকরা ১৯ ভাগ অক্সিজেন, ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন আর অবশিষ্ট অংশ কার্বনডাই অক্সাইড ও অন্যান্য উপাদান রয়েছে ৩ ভাগ অনুপাতে। এ অনুপাত পৃথিবীতে জীবন সংরক্ষণের জন্যে অপরিহার্য। এ না হলে জীবন এখানে টিকে থাকতে পারবে না। উল্লেখিত অপরিহার্য উপাদানগুলাে ছাড়াও আরাে হাজারাে রকমের মানানসই উপাদান দিয়ে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীকে মানব জীবনের উপযােগী বানিয়ে দিয়েছেন। এসব উপাদান জীবন রক্ষার জন্যে অত্যন্ত জরুরী। উদাহরণ স্বরূপ পৃথিবীর আকৃতি, সূর্য ও চাদের আকৃতি, চাঁদ ও সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব, সূর্যের তাপমাত্রা, পৃথিবীর উপরিভাগের ব্যাস, পৃথিবীর গতিবেগ, পৃথিবীর অক্ষরেখার হেলানাে ভাব, পৃথিবীতে জল ও স্থলের আনুপাতিক তারতম্য এবং পৃথিবীর চারপাশের বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সকল অনুকূল উপাদানের একত্র সমাবেশ পৃথিবীকে বাসযােগ্য করেছে। এগুলােই পৃথিবীতে জীবিকা উৎপাদনে এবং প্রাণীকুলের ও বিশেষত মানুষের জীবন ধারণে সহায়ক হয়েছে। পবিত্র কোরআন এসব সত্যকে তুলে ধরছে, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি ও প্রত্যেক প্রজন্ম এগুলােকে সাধ্যমত ও নিজ নিজ জ্ঞান মােতাবেক হৃদয়ংগম করে। এতে সে সমগ্র বিশ্ব জাহানের সম্রাট আল্লাহর শক্তি ও প্রতাপ অনুভব করবে কেননা তার এবং চারপাশের সকল জিনিসের ওপর মহান আল্লাহরই আধিপত্য ও কর্তৃত্ব বিরাজিত। তিনিই পৃথিবীকে মানুষের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন এবং তিনিই মানুষ ও পৃথিবীর সংরক্ষক। তিনি যদি এক মুহূর্তও এ কাজে উদাসীনতা দেখান তবে সমগ্র বিশ্বজগত বিশৃংখলার শিকার হবে এবং বিশ্বজগতে যতাে বস্তু ও প্রাণী আছে, সকলকে নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তার বিবেক যখন এই অকাট্য সত্যকে গ্রহণ করে নেয়, তখন পরম দাতা ও দয়ালু স্রষ্টা তাকে পৃথিবীর প্রান্তরে চলাফেরা করা ও তার ফলানাে জীবিকা খাওয়ার অনুমতি দেন। ‘পৃথিবীর সকল প্রান্তরে চলাফেরা করাে এবং তার রিযিক খাও।’ মূল আয়াতে যে, ‘মানকিব’ শব্দটি রয়েছে তার অর্থ হলাে উচ্চ প্রান্ত সমূহ বা কিনারসমূহ। এটা সংগতভাবেই ধরে নেয়া যায় যে, তিনি উচ্চ প্রান্তর বা কিনারসমূহে চলাফেরা ও খাদ্য আহরণের অনুমতি যখন দিয়েছেন, তখন নিম্ন সমতল ভূমি এবং উপত্যকা অঞ্চলেও এ অনুমতি অবশ্যই দিয়েছেন। আর যে জীবিকা পৃথিবীতে উৎপন্ন হয় তার সবই আল্লাহর সৃষ্টি এবং আল্লাহর মালিকানাভুক্ত। তাই ‘তার জীবিকা’ কথাটা স্রেফ জীবিকা বললে যা বুঝা যায় তা তার চেয়ে ব্যাপক অর্থবােধক। কেননা এ দ্বারা কোনাে মানুষের হাতে বিদ্যমান সেই অর্থ সম্পদকে বুঝায়-যা দ্বারা সে নিজের প্রয়ােজনীয় জিনিস ও আসবাবপত্র সংগ্রহ করতে পারে। বরঞ্চ এ দ্বারা বুঝানাে হয় আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে জীবিকার যতাে উপায়-উপকরণ গচ্ছিত রেখেছেন তার সব কিছু। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীকে এমন সব উপাদান থেকে তৈরী করেছেন। সেসব উপাদানকে এমন আনুপাতিক হারে বন্টন করেছেন যে তা দ্বারা এখানকার যাবতীয় উদ্ভিদ এবং মানুষসহ সকল প্রাণীর জন্ম ও বিকাশ লাভ সম্ভব হয়েছে। অতপর প্রাণী ও উদ্ভিদকে আল্লাহই এসব উপকরণ দ্বারা উপকৃত হওয়ার ক্ষমতা দান করেছেন। এই ব্যাপক অর্থের আলােকে জীবিকার প্রকৃত তাৎপর্য কি সে সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে কিছু আলােকপাত করছি।  *রিযক-ই-ইলাহীর তাৎপর্য কি? : প্রখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী মাহমুদ সালেহ তার গ্রন্থ ‘আধুনিক বিজ্ঞান ঈমানের দিকে আহবান জানায়’ নামক গ্রন্থের ৭০-৭১ পৃষ্ঠায় বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের কাছে এটা সুবিদিত ব্যাপার যে, প্রত্যেকটা উদ্ভিদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে কার্বন অক্সাইডের সেই ন্যূনতম মাত্রার ওপর যা বায়ুমন্ডলেই বিদ্যমান এবং যা উদ্ভিদ নিজেই শুষে নিয়ে থাকে বলে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু আলাের সংযুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট এই রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে আমরা সংক্ষেপে এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। উদ্ভিদ পাতা হচ্ছে ফুসফুস এবং তা কার্বনঅক্সাইডের ন্যায় শক্ত জিনিসকে সূর্যের কিরণের সাহায্যে বিভক্ত করে কার্বন ও অক্সিজেনে পরিণত করতে সক্ষম। অন্য কথায় বলা যায়, এই পাতা অক্সিজেনকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং হাইড্রোজেন মিশ্রিত কার্বনকে সংরক্ষণ করে। এই হাইড্রোজেন হচ্ছে উদ্ভিদ কর্তৃক নিজের শিকড়ের সাহায্যে সংগৃহীত পানি। এই পানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত হয়ে যায় এবং প্রকৃতি এ বিস্ময়কর রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এই সকল উপাদান থেকে চিনি, উদ্ভিদের প্রধান উপাদান সেলিলােজ ও আরাে কয়েক রকমের রাসায়নিক উপাদান প্রস্তুত করে। অতপর এই সমস্ত উপাদানের কিয়দংশ ফল ও ফুলের আকার ধারণ করে। আর বাদবাকী অংশকে উদ্ভিদ নিজের খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে এবং আরো খানিকটা উৎপন্ন উপাদান উদ্বৃত্ত থেকে যায়, যা পরবর্তীতে ভূপৃষ্ঠের সকল প্রাণীর জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ করে। একই সময় উদ্ভিদ তার শােষিত অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। এই অক্সিজেন না হলে কোনাে প্রাণী ৫ মিনিটের বেশী বাঁচে না।’ এভাবে আমরা জানতে পারি যে, যাবতীয় উদ্ভিদ, গাছপালা, ঘাস, শেওলার প্রতিটা অংশ এবং কৃষি ক্ষেতের পানির সাথে সংযুক্ত যে কোনাে উদ্ভিদের জন্ম কার্বন এবং বিশেষভাবে পানির ওপর নির্ভরশীল। প্রাণী কার্বন অক্সাইড-২ ত্যাগ করে। আর উদ্ভিদ ত্যাগ করে অক্সিজেন। এই আদান প্রদান চালু না থাকলে উদ্ভিদ ও প্রাণী সকল অক্সিজেন অথবা প্রায় সকল কার্বন অক্সাইড-২ খেয়ে ফেলতাে। এভাবে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে হয় উদ্ভিদ পচে যেত, নচেৎ মানুষ মারা যেত। আর একটার মৃত্যুর সাথে অপরটিও তার সাথে মিলিত হতাে। সাম্প্রতিক কালে এ তথ্যও আবিস্কৃত হয়েছে যে, বেশীরভাগ প্রাণীর জীবনের জন্যেও স্বল্পমাত্রায় কার্বন অক্সাইড-২ প্রয়ােজনীয়। আবার এও জানা গেছে যে, উদ্ভিদ ও সামান্য কিছু অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। হাইড্রোজেনও একটা প্রয়ােজনীয় জিনিস। আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ না করলেও হাইড্রোজেন ছাড়া পানির অস্তিত্ব অসম্ভব। আর প্রাণী কিংবা উদ্ভিদের জন্যে যে অনুপাতে পানির প্রয়োজন তার মাত্রা বিস্ময়করভাবে বিপুল। এক কথায় বলা যায়, পানির কোনাে বিকল্প নেই এবং পানি ছাড়া জীবন একদম অচল। পৃথিবীর জীবিকা উৎপাদনে নাইট্রোজেনের অবদানও কম নয়। একই বিজ্ঞানী তার গ্রন্থের ২৬-২৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, কোনো না কোনােভাবে নাইট্রোজেনের উপস্থিতি ছাড়া খাদ্য জাতীয় উদ্ভিদের উৎপাদন ও বিকাশ অসম্ভব। কৃষি জমিতে নাইট্রোজেন প্রবেশের দুটো উপায় আছে। একটা হলাে, এক ধরনের রোগ জীবাণুর উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ । এসব জীবাণু সবজি ও তরিতরকারীর গাছের বীজে পাওয়া যায়। এসব সবজী ও তরকারী হলাে লবংগ, বুট, মােটর ইত্যাদি। এ সব জীবাণু বাতাস থেকে নাইট্রোজেন গ্ৰহণ করে তাকে মিশ্র নাইট্রোজেনে পরিণত করে। যাকে উদ্ভিদ চুষে নিতে পারে আর উদ্ভিদ মারা গেলে এই মিশ্র নাইট্রোজেনের কিছু অংশ ভূপৃষ্ঠে থেকে যায়। মাটিতে নাইট্রোজেন প্রবেশের অপর মাধ্যমটি হলাে মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎ চমকানাে। প্রবল বৃষ্টি এটাকে মিশ্র নাইট্রোজেনের আকারে পৃথিবীতে নামায়।(অর্থাৎ উদ্ভিদ যাতে তাকে চুষে নিতে পারে। কেননা উদ্ভিদ নির্ভেজাল নাইট্রোজেনকে বায়ুমন্ডল থেকে চুষে নিতে অক্ষম। সেখানে মেঘের গর্জন হলে ও বিদ্যুৎ চমকালে নাইট্রোজেন ও স্বল্প মাত্রায় অক্সিজেন মিশ্রিত হয়। (নির্ভেজাল নাইট্রোজেনের মাত্রা শতকরা ৮৭ ভাগ সে কথা আগেই বলেছি।) এ ছাড়া ভূগর্ভে তরল ও কঠিন খনিজ পদার্থের আকারে অনেক গুপ্ত জীবিকা রয়েছে। এসব কিছু দ্বারা পৃথিবী ও তার সংশ্লিষ্ট অবস্থার উন্নয়ন ও পুনর্গঠন সম্পন্ন হতে পারে। আমরা এর দীর্ঘ বিশ্লেষণে যাবাে না। তবে উল্লেখিত বিবরণসমূহের আলােকে বিষয় বা জীবিকার তাৎপর্য এর প্রচলিত অর্থের চেয়ে ব্যাপকতর। পৃথিবী পুনর্নিমাণে এবং গােটা বিশ্বের সংহতকরণে এর উপায়-উপকরণ অত্যন্ত গভীর ও কার্যকর। আর আল্লাহ তায়ালা যখন ‘খাও’ বলে এই জীবিকা আহরণের অনুমতি দেন তখন তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তিনি এই জীবিকা মানুষের আয়ত্তাধীন ও সহজলভ্য করে দিয়েছেন এবং তা দ্বারা উপকৃত হওয়া ও তা খাওয়ার ক্ষমতাও তাকে দিয়েছেন। তাই তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে বিচরণ ও পরিভ্রমণ করাে এবং আল্লাহর দেয়া জীবিকা আহার করাে।’ কিন্তু এই জীবিকা আহরণের সময় নির্ধারিত ও সীমিত। সে সময় নির্ধারিত হয় আল্লাহরই জ্ঞান পরিকল্পনা ও কর্তৃত্বাধীনে। এই নির্ধারিত মেয়াদটি আবার জীবন মৃত্যু এবং অন্য যে যে জিনিসে পার্থিব জীবনে আল্লাহ তায়ালা মানুষের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন তার দ্বারা পরীক্ষা পরিপূর্ণ। এই পরীক্ষার মেয়াদ শেষ হলেই আসবে মৃত্যু এবং মৃতের পরে পুনরুজ্জীবন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তারই কাছে পুনরুজ্জীবন।’ বস্তুত সমগ্র বিশ্ব সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র মালিকানা ও কর্তৃত্ব যখন তারই হাতে, তিনিই যখন সৃষ্টিজগতের আশ্রয়স্থল এবং তিনিই যখন সর্বশক্তিমান তখন তিনি ব্যতীত আর কার কাছেই বা মানুষের পুনরুজ্জীবন হবে? আর এখন যখন মানুষ পরম শক্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে এই নিরুপদ্রব বিশ্বে জীবন যাপন করছে আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে এই প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধিতে কাল কাটাচ্ছে, তখন সহসা আল্লাহ তার পায়ের নিচের মাটি কাঁপিয়ে দিচ্ছেন এবং আন্দোলিত ও আলােড়িত করছেন চার পাশের পরিবেশ ও বায়ুমন্ডলকে। এমনভাবে উদ্বেলিত করছেন যে, একটা আগুনের শিখা যেন এসে তার মুখ ও বুকে আঘাত করছে। মানুষের স্নায়ুতে এই ভূকম্পন ঘটাচ্ছেন এবং তাদের কল্পনার জগতে আগুনের শিখা বইয়ে দিচ্ছেন যাতে তারা স্বস্তি ও স্থিতিজনিত উদাসীনতা থেকে নিবৃত্ত হয়। তার দৃষ্টি আকাশ ও অদৃশ্য জগতের দিকে প্রসারিত করে এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কাছে নিজেদের মনকে নিবেদিত করে।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-১৮

وَ لَقَدْ كَذَّبَ الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَكَیْفَ كَانَ نَكِیْرِ

তাদের পূর্বের লোকেরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল। ফলে দেখো, আমার পাকড়াও কত কঠিন হয়েছিল।

 

 

 

ফী জিলালিল কুরআন:

*কোন দূরাচার আল্লাহকে ভয় করবে না? : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা কি আকাশের অধিপতির পক্ষ থেকে এমন কর্মকান্ডের আশংকা বােধ করাে না যে, তিনি তােমাদেরকে মাটির অভ্যন্তরে ধ্বসিয়ে দিতে পারেন এবং পৃথিবী তােমাদেরকে নিয়ে অবনমিত হয়ে যেতে পারে। তােমরা কি এ আশংকাও বােধ করাে না যে আকাশের অধিপতি তােমাদের দিকে একটা অগ্নিশিখা পাঠিয়ে দিতে পারেন? তখন তােমরা বুঝতে পারবে যে আমার ভীতি প্রদর্শন কেমন (সাংঘাতিক) হয়। পূর্ববর্তী লোকেরাও আল্লাহর বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলাে। তখন আমার শাস্তি কেমন ছিলাে?’ অর্থাৎ পরম অনুগত জন্তু সদৃশ যে পৃথিবীটার ওপর মানুষ জীবন যাপন করছে এবং তাকে দোহন করে তা থেকে আল্লাহর নির্দিষ্ট পরিমাণ জীবিকা আহরণ করছে, সেই নিরীহ গােবেচারা পৃথিবী যে সময়ে সময়ে কি সাংঘাতিক রকমের অনমনীয় ও অবাধ্য হয়ে ওঠে তা সে যথাসময়েই জানতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা যখনই নির্দেশ দেন সামান্য একটু হেলে দুলে উঠতে অমনি তার পিঠের সব কিছু এলােমেলাে অথবা বিধ্বস্ত হয়ে যায় অথবা আন্দোলিত ও তছনছ হয়ে যায়। কোনাে ফন্দি বা শক্তি খাটিয়ে তাকে রক্ষা করা যায় না । ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় এ ধরনের প্রলয়ংকরী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তখন এই গােবেচারা পৃথিবীর অভ্যন্তরে কি সাংঘাতিক হিংস্র প্রাণীর চরিত্র লুকিয়ে ছিলাে তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এ হিংস্র প্রাণীটাকে আল্লাহ তায়ালা লাগাম দিয়ে সামাল দিয়ে রাখেন বলে তা সীমিত পর্যায়ের উচ্ছৃংখলতা দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডব্যাপী ভূমিকম্পের হিংস্রতা ভূপৃষ্ঠে মানবজাতির নির্মিত হাজার হাজার বছরের সভ্যতা সংস্কৃতি ও সুরম্য প্রাসাদকে ধূলিসাৎ করে দেয়। যখন অবাধ্য পৃথিবীর কোনাে আগ্নেয়গিরির পেট থেকে কোনাে মুখ ফুটে বের হয় তখন তা পৃথিবীর একটা অংশকে আস্ত গ্রাস করে ফেলতে পারে। মানুষ এই ধ্বংসলীলার সামনে সম্পূর্ণ অক্ষম ও অসহায় হয়ে পড়ে। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ও ভূমিধসের ধ্বংসলীলায় মানুষ ভয়ে ত্রাসে খাঁচার আবদ্ধ ইঁদুরের মতাে পড়ে থাকে। অথচ একটু আগেই হয়তাে তারা পরম শান্তিতে ও মহা উল্লাসে খেলায় মত্ত ছিলাে। এক সর্বশক্তিমান সত্তার হাতে যে তাদের সর্বময় কর্তৃত্বের লাগাম ধরা রয়েছে সে সম্পর্কে ছিলাে একেবারেই উদাসীন। মানুষ এভাবেই অনেক ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটনকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি প্রত্যক্ষ করে থাকে। সে সব বিনাশী অভিযানের সামনে তারা তাদের সমস্ত জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি ও তৎপরতা সত্ত্বেও নিরুপায় ও অসহায় দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়। যতােক্ষণ আল্লাহর হস্তক্ষেপে সেই দুর্যোগ প্রশমিত না হয় ততক্ষণে জলে স্থলে ও অন্তরীক্ষে তা তার সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা অবাধে চালিয়ে যেতে থাকে। মানুষ তার সামনে নিতান্তই তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, দুর্বল জীব প্রতীয়মান হয়। পৃথিবীর নিরুপদ্রব শান্তি ও নিরাপত্তা মানুষকে প্রতারিত করে, তাকে তার স্রষ্টা ও পালনকর্তার কথা ভুলিয়ে দেয়। সে জন্যেই কোরআন তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর ইচ্ছায় যে কোনাে মুহূর্তে তাদের এই সুখ স্বপ্ন ভেংগে যেতে পারে। যে কোন সময় তাদের ঘাড়ে নেমে আসতে পারে এসব সর্বনাশা দুর্যোগ। তাদের পায়ের নিচের শান্ত পৃথিবী হঠাৎ দুলে উঠতে পারে। সংহারীরূপ ধারণ করে ফুসে উঠতে ও মানুষকে খড়-কুটোর মতাে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। চারপাশের মৃদুমন্দ বাতাস সহসা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। কোনাে শক্তিই তা রোধ করতে পারে না। মানুষ তার সামনে হয়ে পড়ে অসহায়। কোরআন সেই সম্ভাব্য অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে সাবধান করে। তার স্নায়ুতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে তাকে হুশিয়ারী দেয়, ‘শীঘ্রই তােমরা জানতে পারবে আমার হুঁশিয়ারী কেমন।’  *আল্লাহর প্রতিশ্রুত আযাব : কোরআন এই সাথে অতীত ইতিহাস থেকে ইসলামী দাওয়াতকে অস্বীকারকারীদের শােচনীয় পরিণামের দৃষ্টান্ত পেশ করে এই বলে, ‘তাদের পূর্ববর্তীরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাে, সে জন্যে আমার শাস্তিটা কেমন হয়েছিলাে?’ আয়াতে যে নাকীর শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে তার অর্থ হলাে প্রত্যাখ্যান ও তার পরিণতি। যারা অতীতে আল্লাহর দাওয়াত অস্বীকার করেছিলাে আল্লাহ তায়ালা তাদের অস্বীকৃতিকে প্রত্যাখ্যান করছেন এই জিজ্ঞাসার মাধ্যম যে আমার শাস্তি কেমন ছিলাে?’ অথচ আল্লাহ নিজেই জানেন তা কেমন ছিলাে। সে সময়কার ধ্বংস চিহ্নগুলাে এখনাে বহাল রয়েছে। সে গুলাে মক্কার কাফেরদের সামনে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে সে ধ্বংসলীলা কেমন ভয়াবহ ছিলাে। যে শান্তি ও নিরাপত্তা মানুষকে আল্লাহর কথা, তার সীমাহীন শক্তি ও পরিকল্পনার কথা ভুলিয়ে দেয়- সেই শান্তির প্রতি আল্লাহ তায়ালা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এ আয়াতের মাধ্যমে। আল্লাহর রহমত তার প্রহরা ও তদারকীর ওপর নির্ভর করে মােমেনরা যে প্রশান্তি লাভ করে তার প্রতি নয়। এই দুটো প্রশান্তি এক রকমের নয়। কেননা মােমেন আল্লাহর ওপর নির্ভর করে শান্তি পায়। তার করুণা ও অনুগ্রহের প্রত্যাশী থাকে। কিন্তু তা তাকে উদাসীন করে দেয়না। দুনিয়ার প্রাচুর্য তাকে মত্ত করে রাখে না। বরং তাকে সর্বক্ষণ আল্লাহর প্রত্যাশী, তার ব্যাপারে লজ্জাশীল, তার ক্রোধ সম্পর্কে সতর্ক, তার অজানা পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন এবং তার প্রতি সদা অনুগত ও সদা প্রশান্ত রাখে। ইমাম আহমদ হযরত আয়েশা(রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, রসুলকে আমি কখনাে দাঁত বের করে হাঁসতে দেখিনি। তিনি কেবল মুচকি হাঁসতেন আর যখনই তিনি কোনাে মেঘ বা বাতাস দেখতেন তখন তার মুখে ভয়ার্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতাে। তিনি বললেন, হে রসুল, মেঘ দেখলে বৃষ্টির আশায় লোকেরা আনন্দিত হয়। কিন্তু আপনার মুখে অসন্তোষের চিত্র দেখতে পাই। রাসূল(স.) বললেন, হে আয়েশা, ওই মেঘ থেকে বৃষ্টির বদলে আযাব আসবে কিনা সেই আশংকায় আমাকে পেয়ে বসে। একটি জাতি এই বাতাস থেকেই আযাব ভােগ করেছিলাে। আর একটি জাতি বলেছিলাে যে, ঐ তাে মেঘ আসবে, আমাদের বৃষ্টি দেবে। কিন্তু পরে তারা তা থেকে আযাবে ভুগেছিলাে। আল্লাহর প্রতি মুমিনের সর্বক্ষণ এই চেতনা ও অনুভূতি জাগরক থাকা চাই। কুরআন যে ইতিহাস বর্ণনা করেছে তাও এই চেতনা জাগরূক করার উদ্দেশেই করেছে। তবে আল্লাহর করুণা ও অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীলতার জন্যে যে প্রশান্তি জন্মে তা সে চেতনার পরিপন্থী নয়।  *একজন মােমেনের কর্তব্য : এরপর মােমেনের কর্তব্য হলাে যাবতীয় বাহ্যিক কারণের মূল কারণ যে আল্লাহ তায়ালা তা বিশ্বাস করা। প্রত্যেক বিষয়কে সর্বতােভাবে সর্বশক্তিমান বিশ্ব অধিপতির নিরংকুশ কর্তৃত্বের আওতাভুক্ত মনে করতে হবে। কি ভুমিকম্প, কি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, কি ঝড় ঝঞ্ঝা, কি ভূমিধস কিংবা আগুনের হলকা যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসুক না কেন তার ব্যাপারে মানুষের কিছুই করার থাকে না। এ সব ব্যাপারে আল্লাহর হাতেই নিরংকুশ ক্ষমতা নিবদ্ধ। এ সব ঘটনা সম্পর্কে মানুষ যা কিছুই বলে তা দ্বারা কেবল তা কেন ও কিভাবে ঘটলাে তার ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে মাত্র। কিন্তু সে ঘটনা ঘটা বা না ঘটার ব্যাপারে তার কোনােই হাত থাকে না এবং তা থেকে আত্মরক্ষারও কোনাে কার্যকর শক্তি তাদের নেই। পৃথিবীতে মানব জাতি যতাে সুরম্য ইমারত নির্মাণ করুক না কেন, পৃথিবীর একটিমাত্র ঝাকুনি কিংবা একটামাত্র ঝড় তাকে তাসের ঘরের মতাে নিশ্চিন্ন করে দেয়। সুতরাং এসব ব্যাপারে একমাত্র এই বিশ্বনিখিলের সৃষ্টিকর্তার দিকে মুখ ফেরানােই মানুষের কর্তব্য। কেননা তিনিই এ সবের ওপর একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে অপরাজেয় শক্তির কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। সে শক্তির চাবিকাঠি একমাত্র তার হাতেই নিবদ্ধ। এসব দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষের আত্মনিবেদন করা উচিত একমাত্র বিশ্বজগতের সার্বভৌম অধিপতি সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে।  *মানবীয় জ্ঞান ও আল্লাহর কুদরত : আল্লাহ তায়ালা যতােটুকু শক্তি ও জ্ঞান মানুষকে বরাদ্দ করেছেন মানুষ ততটুকুই শক্তি ও জ্ঞানের মালিক। কিন্তু গােটা সৃষ্টিজগতের নিয়ন্ত্রণ এর স্রষ্টার হাতেই নিবদ্ধ। এর নিয়ামক বিধিমালা তারই সৃষ্টি এবং এর ভেতরে নিহিত যাবতীয় শক্তি তারই সরবরাহ করা। এই সকল শক্তি আল্লাহরই প্রাকৃতিক বিধানের বলে আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে চলে। এ শক্তি থেকে আল্লাহর বরাদ্দ করা অংশই মানুষ পেয়ে থাকে এবং এ সংক্রান্ত জ্ঞানেরও কেবল বরাদ্দকৃত অংশই তার হস্তগত হয়ে থাকে। আর যেসব ঘটনা সংঘটিত হয় অথবা মানুষ তার সামনে নিস্ক্রিয় দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারে না, সে সম্পর্কে তাকে সেসব ঘটার স্রষ্টা নিয়ন্তা ও সংগঠক আল্লাহর কাছেই যা কিছু বলার থাকে তাঁকেই বলতে হবে। সেগুলোর মােকাবেলা করার জন্যে সাহায্য চাইতে হবে এবং যতােদুর তার সাধ্যে কুলায় মােকাবেলা করে ওগুলােকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ সত্যকে যখন মানুষ ভুলে যায় এবং সৃষ্টিজগতের কিছু শক্তিকে পদানত করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে, তখন সে একটা বিকৃত ও ভ্রষ্ট মানুষে পরিণত হয়। সেই নির্ভুল জ্ঞানের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় যা আত্মাকে উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে আরােহণ করায় এবং সে সৃষ্টির জীবনী শক্তি থেকে সম্পর্কচ্যুত হয়ে মাটির কাছে ঘনিষ্ঠ হয়। অথচ সত্য জ্ঞানের অধিকারী মােমেন আল্লাহর অনুগত গােটা সৃষ্টিজগতের সাথে একাত্ম হয়ে এক নয়নাভিরাম সমাবেশে মহান স্রষ্টার সামনে রুকু সেজদায় লিপ্ত হয়। এটা যে কি অমূল্য নেয়ামত তা শুধু সেই ব্যক্তিই জানে যে এর স্বাদ পেয়েছে এবং এর স্বাদ আল্লাহ যার বরাতে রেখেছেন। কিন্তু এ স্বাদ ও সৌভাগ্য মানুষের অর্জিত হােক বা না হােক প্রকৃতির ত্রাসসঞ্চারী শক্তিগুলাে তাকে অসহায়ত্ব ও অক্ষমতার শেষ প্রান্তে না নিয়ে এবং আত্মা সম্পর্কে বাধ্য না করে ছাড়ে না। সে টুকটাক কিছু আবিস্কার ও উদ্ভাবন করে এবং বেশ খনিকটা শক্তিও অর্জন করে। কিন্তু এসত্বেও প্রাকৃতিক শক্তিগুলাের মােকাবেলায় সে অক্ষম মানুষের চেয়ে বেশী কোনাে মর্যাদা রাখেনা। হয়তাে বা সময় সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুর্যোগগুলাে যথারীতি ঘটতেই থাকে, মানুষ তার আত্মরক্ষা করতে পারেনা। সে বড়জোর দুর্যোগের আগাম সংবাদ জানিয়ে পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, তাও সব সময় নয়। কিন্তু কখনাে তার পক্ষে দুর্যোগকে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কখনাে কখনাে তাে দুর্যোগ তাকে হত্যা করেই ছাড়ে। তার দেয়াল ও ভবন ধসিয়ে দিয়ে তার নিচে তাকে পিষে মারে। সমুদ্র ঝড় তুফান তাকে ডুবিয়ে মারে আর বড় বড় জাহাজকে এমনভাবে প্রবল বাতাসের মধ্যে উল্ট দেয় কোনাে শিশু যেমন তার খেলনাকে উলট পালট করে। ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির তাে ব্যাপারই আলাদা। সৃষ্টির আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তা যেমন ছিলাে তেমনই রয়েছে। মানুষ তার নাগালই পায়নি। কাজেই মানুষ এই প্রাকৃতিক জগতে একাই দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম কিংবা সে এর নিয়ন্তা এ কথা যে বলে সে অন্ধ ছাড়া কিছুই নয়। তার এ উক্তি জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক সত্যের পরিপন্থী। বস্তুত মানুষ আসলে এ পৃথিবীতে আল্লাহর মনোনীত প্রতিনিধি। এই দায়িত্ব পালনের জন্যে তার যতােটুকু শক্তি ক্ষমতা ও জ্ঞান দরকার তাই তিনি তাকে দিয়েছেন। তিনি তার তত্ত্বাবধায়ক অভিভাবক ও রক্ষক। জীবিকা ও অন্য যাবতীয় প্রয়ােজনীয় জিনিস তিনিই তাকে দিয়েছেন। তার রক্ষাকারী হাত যদি মানুষের ওপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে যায় তাহলে যে শক্তিগুলােকে তার অধীনে ও অনুগত করে দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল শক্তিও তাকে খতম করে দিতে সক্ষম। মশা, মাছি বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র সৃষ্ট তাকে খেয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা, আদেশ ও অনুগ্রহে তাকে রক্ষা করা হয়। এজন্যেই সে টিকে আছে, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে আছে। তার এই সম্মান ও মর্যাদা কোথা থেকে এলাে তা তার জানা ও ভাবা উচিত।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২০

اَمَّنْ هٰذَا الَّذِیْ هُوَ جُنْدٌ لَّكُمْ یَنْصُرُكُمْ مِّنْ دُوْنِ الرَّحْمٰنِ١ؕ اِنِ الْكٰفِرُوْنَ اِلَّا فِیْ غُرُوْرٍۚ

বলো তো, তোমাদের কাছে কি এমন কোন বাহিনী আছে যা রহমানের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারে? বাস্তব অবস্থা হলো, এসব কাফেররা ধোঁকায় পড়ে আছে মাত্র।

ফী জিলালিল কুরআন:

*বিবেকের কাছে আহবান : সতর্কীকরণ ও ভীতি প্রদর্শনের পর্যায় অতিক্রম করে এবার কোরআন মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে চিন্তা গবেষণার স্তরে। সে তাকে এমন একটা অংগনে নিয়ে যাচ্ছে যাকে মানুষ হরহামেশাই দেখতে পায়। কিন্তু তা নিয়ে খুব কমই চিন্তা ভাবনা করে। এ অংগনটি আল্লাহর ক্ষমতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন এবং তার সূক্ষ্ম ও নিপুণ রাজ্য পরিচালনার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। কোরআন বলছে, ‘তারা কি পাখিকুলকে দেখে না যখন তা পাখা মেলে ও বন্ধ করে? করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ তাে তাদেরকে মহাশূন্যে ধরে রাখতে পারে না। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুই দেখেন।’ প্রতিনিয়ত সংঘটিত এই অলৌকিক ঘটনা আমরা দেখেও দেখি না। বার বার সংঘটিত হওয়ার কারণে এর ভেতরে যে অসীম ক্ষমতা ও মহত্বের নিদর্শন নিহিত রয়েছে তা যেন ভুলে বসে আছি। পাখিকে নিয়ে একটু ভাবুন তাে। সে তার ডানা মেলে ও বন্ধ করে। এই উভয় অবস্থায় সে বায়ুমন্ডলে অনায়াসে ভেসে বেড়ায়, নিচে পড়ে যায় না। তার তৎপরতা দেখে সময় সময় মনে হয় যে এগুলাে নিছক বৃত্তাকারে ওঠানামার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। এ দৃশ্যটা নিয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করুন ও ভাবুন। যতাে দেখবেন ততােই চোখ জুড়াবে এবং মনে আনন্দের হিল্লোল বইবে। এসব দেখে আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টির অনুভূতি জাগে এবং অনুরূপ এই দৃশ্য দেখিয়ে বলে, ‘তারা কি দেখেনি তাদের মাথার ওপর পাখিরা ডানা মেলে ও বন্ধ করে?’ এর পর এর নেপথ্য পরিকল্পনা ও পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে তার দিকে ইংগিত করছে এই বলে, ‘দয়াময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তাদেরকে আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না।’ দয়াময় আল্লাহ সৃষ্টিজগত পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশাবলী দ্বারা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সেই নির্দেশাবলীতে বিস্ময়কর সময় বিদ্যমান। প্রতিটি ছােট বড় সৃষ্টি এমনকি প্রতিটি অণু পরমাণু ও কোষ পর্যন্ত সময়ের আওতাভুক্ত। আল্লাহর এসব নির্দেশ তথা প্রাকৃতিক নিয়ম বিধির আলােকে ভূমন্ডলে ও নভােমন্ডলে বিরাজমান হাজারাে অনুকূল উপাদান সৃষ্টি ও পাখিকুলের বিচিত্র গঠন সুসম্পন্ন হয়ে থাকে আর এরই বদৌলতে নিরন্তর সংঘটিত হতে থাকে প্রাকৃতিক জগতের যাবতীয় অলৌকিক ঘটনাবলী। দয়াময় স্রষ্টা এই পাখিকুলকে নিজের দূরন্ত ক্ষমতা বলে নিয়ন্ত্রণ করেন। সব কিছুর ওপর তার সার্বক্ষণিক নিরলস পর্যবেক্ষণ ও তদারকী বিদ্যমান। এ জন্যেই প্রাকৃতিক বিধান চিরদিন নিখুঁত, সুশৃংখল ভারসাম্যপূর্ণ সুসমন্বিত । আল্লাহর ইচ্ছাকৃত ব্যতিক্রম ছাড়া তার প্রাকৃতিক বিধানে কোনাে গরমিল, কোনাে ওলট পালট এবং কোনাে ব্যতিক্রম একমুহূর্তের জন্যে ঘটে না। দয়াময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এই পাখিকুলকে আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। এই সুস্পষ্ট উক্তিতে মহান দয়াময় আল্লাহর পরিপূর্ণ কৃতিত্ব ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়েছে প্রতিটি পাখির প্রতিটি ডানার নিয়ন্ত্রণের, চাই সে পাখি আকাশে ডানা ঝাপটে উড়ন্ত অবস্থায় থাকুক কিংবা ডানা বন্ধ করে ঝুলন্ত থাকুক। ‘নিশ্চয়ই তিনি প্রতিটি জিনিসের দর্শক।’ অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে পাখিকে দেখেন, তাকে অবহিত করেন, আর এভাবে সমন্বয় সাধন করেন। সব কিছুকে প্রস্তুত করেন, শক্তি দেন, এবং সর্বস্রষ্টা ও সর্ব প্রভুর পক্ষে যেমনটি উপযুক্ত, তেমনভাবে তত্ত্বাবধান করেন। এ কথা সত্য যে, আকাশে পাখিকুলকে নিয়ন্ত্রণ করা আর ভূপৃষ্ঠে জীব জন্তুকে নিয়ন্ত্রণ করা একইরকম ব্যাপার। এ দুইয়ে তেমন কোনাে পার্থক্য নেই। কেননা পৃথিবী তাে তার পিঠের যাবতীয় বােঝা নিয়ে মহাশূন্যে উড়ছেই। সেই মহাশুণ্যের সকল গ্রহ নক্ষত্রকে যেমন আল্লাহ তায়ালা যথাস্থানে স্থির রেখেছেন, পৃথিবীকে সেইভাবে এবং পাখিকেও সেইভাবেই স্থির রেখেছেন। কিন্তু কোরআন মানুষের চোখ ও মনকে প্রতিটি দর্শনযোগ্য ও প্রতিটি অনুধাবনযােগ্য দৃশ্যের কাছে নিয়ে যায় এবং সেই দৃশ্যটিতে কি কি শিক্ষণীয় জিনিস আছে তা জানিয়ে দেয়। এ কারণেই পাখির দৃশ্যটিকে অবলােকন করায়। নচেৎ আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিই অলৌকিক ও অকল্পনীয় উদ্ভাবন। সব কিছুতেই রয়েছে শিক্ষা এবং মনে দাগ কাটার মতাে বিষয়। প্রতিটি মানুষ এর প্রতিটি প্রজন্ম থেকে সাধ্যমত এবং আল্লাহর দেয়া শক্তি ও প্রেরণা অনুসারে শিক্ষা গ্রহণ করে। আকাশে সাঁতাররত পাখির দৃশ্য অবলােকনের পর কোরআন পরবর্তী আয়াতে মানুষের মনকে পুনরায় নিয়ে যায় দুর্যোগ সংকুল দৃশ্যের কাছে। যেখানে ভূমিধস, আগুনের হলকাবাহী ঝড় ইত্যাদির উপদ্রব বিদ্যমান। সেখানে তার চেতনায় রকমারি অনুভূতির পুনরাবৃত্তি করে। কেননা এ ধরনের বিচিত্র অনুভূতির পুনরাবৃত্তিতে আল্লাহর বান্দাদের হৃদয়ে কি ভাবান্তর ঘটাতে পারে, তা আল্লাহর জানা আছে। তাই কোরআন পরবর্তী আয়াতে বলছে, ‘তােমাদের এই যে বাহিনী রয়েছে, সে কি তােমাদেরকে আল্লাহর মােকাবিলায় সাহায্য করতে পারে? কাফেররা তাে কেবল প্রতারণার শিকার হয়ে রয়েছে।’ বস্তুত স্রষ্টার গযব থেকে সৃষ্টিকে ক্ষমা করার ক্ষমতা একমাত্র স্রষ্টারই আছে, অন্য কারাে নেই। ইতিপূর্বে মানুষকে ঝড়ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বংস ইত্যাকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে এবং আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তোষের শিকার ধ্বংসপ্রাপ্ত অতীত জাতিসমূহের শােচনীয় পরিণতির কথা স্মরণ করানাে হয়েছে। এক্ষণে পুনরায় মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কে আছে মানুষকে আল্লাহর নাযিল করা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে পারে? ‘কাফেররা তার প্রতারণার শিকার হয়ে রয়েছে।’ অর্থাৎ এমন একটা বিভ্রান্তিকর ধারণার মধ্যে তারা রয়েছে যে, তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। কেউ তাদের পশমও স্পর্শ করতে পারে না। অথচ তারা আল্লাহর গযবের উপযুক্ত ও তার আযাবের সম্মুখীন হয়ে রয়েছে। একমাত্র যে জিনিস আল্লাহর রহমত ও দয়ার উদ্রেক এবং গযবকে রােধ করতে পারে সেই ঈমান ও সৎ কাজও তাদের নেই যে, তা দ্বারা আল্লাহর দয়া ও করুণার আশা করতে পারে।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২১

اَمَّنْ هٰذَا الَّذِیْ یَرْزُقُكُمْ اِنْ اَمْسَكَ رِزْقَهٗ١ۚ بَلْ لَّجُّوْا فِیْ عُتُوٍّ وَّ نُفُوْرٍ

অথবা বলো, রহমান যদি তোমাদের রিযিক বন্ধ করে দেন তাহলে এমন কেউ আছে, যে তোমাদের রিযিক দিতে পারে? প্রকৃতপক্ষে এসব লোক বিদ্রোহ ও সত্য বিমুখতায় বদ্ধপরিকর।

ফী জিলালিল কুরআন:

*অব্যাহত জীবিকা সরবরাহ : এরপর আর একটি প্রশ্ন তুলে ধরা হচ্ছে মানুষের সামনে তার জীবিকার ব্যাপারে। এই জীবিকা সে প্রতিনিয়ত উপভােগ করে। অথচ তা কোথা থেকে এলাে, তা ভুলে যায় এবং কখনাে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিনা, সে কথা ভেবেও দেখে না। এ জন্যে অহংকার ও অস্বীকৃতির আবরণে তারা অনড় ও অবিচল থাকে। ‘আচ্ছা, যিনি তােমাদেরকে জীবিকা সরবরাহ করেন, তিনি যদি জীবিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেন, তাহলে তােমাদের কী হবে? তথাপি তারা বিদ্রোহী ও বিদ্বেষী ভূমিকায় অবিচল রয়েছে।’ এ কথা আমরা আগেই বলেছি যে, সকল মানুষের জীবিকা প্রাথমিকভাবে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির অবকাঠামােতে এবং পৃথিবী ও বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন উপাদানে (মাটি, আলাে, বাতাস, বৃষ্টি, তাপ ও ঋতু বৈচিত্রের আকারে) জীবিকা উৎপাদনের যেসব উপকরণ বিরাজ করছে, তার সবই নিরংকুশভাবে আল্লাহর হাতে। মানুষের হাতে তার কিছুই নেই এবং মানুষের কর্মকান্ডের সাথে তার আদৌ কোনাে সম্পর্কও নেই। কেননা সে সকল উপায় উপকরণ মানুষের অনেক আগে জন্মেছে, মানুষের চেয়ে ওগুলাে অনেক বেশী শক্তিশালী। আর আল্লাহ তায়ালা যখন জীবনের নির্দশনাবলীকে খতম করতে চান, তখন সেসব প্রাকৃতিক উপাদান সেগুলােকে ধ্বংস করার কাজে স্বয়ং মানুষের চেয়েও অনেক বেশী সক্ষম। অতএব আল্লাহ তায়ালা যদি পানি না দেন, বাতাস না দেন, কিংবা জিনিসপত্রের সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদানগুলাের সরবরাহ বন্ধ করে দেন, তাহলে মানুষকে জীবিকা কে দেবে? কোথা থেকে আসবে তার খাদ্য, পানীয় ও জীবন ধারণের অন্যান্য মৌলিক উপকরণ? রিযিক বা জীবিকা বলতে আমরা প্রাথমিকভাবে যা বুঝি, তার চেয়ে তার প্রকৃত মর্মার্থ অনেক বেশী ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। জীবিকার পর্যায়ে পড়ে এমন যে কোনাে জিনিস যতাে ছােট বা বড় হােক না কেন, তা আল্লাহর ক্ষমতা, পরিকল্পনা এবং আল্লাহ তায়ালা তার উপকরণাদি সরবরাহ করবেন না বন্ধ করবেন তার ওপর পুরােপুরিভাবে নির্ভরশীল। উক্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী অর্থের আওতাভুক্ত রয়েছে রিযিক বা জীবিকা শব্দের অর্থের অতি নিকটবর্তী কিছু জিনিস, যাকে মানুষ নিজের উপার্জন এবং নিজের শক্তি সামর্থের নাগালের ভেতরের জিনিস বলে মনে করে। যেমন, শ্রম, উৎপাদন ও আবিষ্কার-উদ্ভাবন। এই তিনটি জিনিস এবং অনুরূপ আর যে যে জিনিস থাকা সম্ভব তার সবই একদিকে যেমন প্রাথমিক উপায় উপকরণের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল, অপরদিকে তেমনি আল্লাহ তায়ালা কোনাে ব্যক্তি বা জাতিকে কি পরিমাণে তা দান করেন বা আদৌ দান করেন কিনা তার ওপর নির্ভরশীল। একজন শ্রমিকের প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাস ও প্রতিটি তৎপরতা আল্লাহর সৃষ্টি করা জীবিকার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালাই তাকে শ্রমের উপযুক্ত শক্তি ও ক্ষমতা দান করেন। তার প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাস সৃষ্টি করেন এবং যে উপকরণটি তার শরীরে ব্যয়িত হয়ে শক্তির যােগান দেয়, তাও আল্লাহ তায়ালাই দান করেন। একজন আবিষ্কারক যে বুদ্ধিবৃত্তিক চেষ্টা সাধনা ও গবেষণা চালান, তাও তাে আল্লাহরই দেয়া জীবিকার ফল। কেননা আল্লাহ তায়ালাই তাকে চিন্তা-গবেষণা ও আবিষ্কারের ক্ষমতা দান করেন।কোনাে শ্রমিক বা আবিষ্কারক যাই উৎপাদন করুন না কেন, তা প্রাথমিকভাবে আল্লাহর সৃষ্টি করা কোনাে বস্তু বা পদার্থ থেকেই উৎপাদন করেন। এমন কোনাে প্রাকৃতিক বা মানবীয় উপায় উপকরণের সাহায্যে করেন, যা মূলত আল্লাহরই প্রদত্ত জীবিকা ছাড়া আর কিছু নয়। এই পটভূমিতে কোরআনের এ প্রশ্ন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও স্বার্থক যে, যিনি তােমাদেরকে জীবিকা দেন তিনি যদি তার জীবিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেন তাহলে কি হবে! কিন্তু তবুও তারা তাদের অস্বীকৃতি ও বিদ্রোহী আবরণে অনড়।’ আয়াতটির ভাষা থেকে একটি ভ্রু কুঞ্চিত ও স্পর্ধিত মুখমন্ডলের ছবি ভেসে ওঠে। ইতিপূর্বে জীবিকার তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে এবং মানুষ যে জীবিকার ব্যাপারে পুরােমাত্রায় আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল, তাও বলা হয়েছে। এমন একটা পরনির্ভরশীল ও পরমুখাপেক্ষী জীব যদি তার জীবিকা তথা খাদ্য বস্ত্র ইত্যাদি সরবরাহকারীর সাথে বিদ্রোহাত্মক, বিদ্বেষপূর্ণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে তবে তার চেয়ে কুৎসিত ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। আয়াতটি এমন এক শ্রেণীর মানুষের ছবি অংকন করেছে, যারা চরম হঠকারিতার সাথে ও ঘৃণাভরে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াতকে উপেক্ষা করেছে। তারা এ কথা ভুলে যায় যে, তারা একমাত্র আল্লাহরই অনুগ্রহের ওপর বেঁচে রয়েছে এবং নিজেদের জীবন, জীবিকা ও আয়ুঙ্কালের ওপর তাদের একেবারেই কোনাে হাত নেই।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২২

اَفَمَنْ یَّمْشِیْ مُكِبًّا عَلٰى وَجْهِهٖۤ اَهْدٰۤى اَمَّنْ یَّمْشِیْ سَوِیًّا عَلٰى صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ

ভেবে দেখো, যে ব্যক্তি মুখ নিচু করে পথ চলছে সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত, না যে ব্যক্তি মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে সমতল পথে হাঁটছে সে-ই সঠিক পথপ্রাপ্ত?

ফী জিলালিল কুরআন:

*হেদায়াত ও গােমরাহীর উদাহরণ : এহেন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ সত্ত্বেও তারা রসূল(স.) ও তাঁর সাহাবীদেরকে গােমরাহ বা বিপদগামী এবং নিজেদেরকে সবচেয়ে নির্ভুল পথের যাত্রী ভাবতাে। তাদের সমগোত্রীয়রা প্রত্যেক যুগে আল্লাহর পথে আহবানকারীদের সাথে অনুরূপ আচরণই করে থাকে। এ জন্যে তাদের ও মােমেনদের প্রকৃত অবস্থা পরবর্তী আয়াতে নিম্নরূপ চিত্রিত করা হয়েছে। ‘সুতরাং যে ব্যক্তি মাথা নিচের দিকে রেখে চলে, সে সঠিক পথের যাত্রী, না যে ব্যক্তি সােজা পথ ধরে স্বাভাবিকভাবে চলে সে?’ ‘যে ব্যক্তি মাথা নিচের দিকে রেখে চলে’ এ কথার দু’রকম অর্থ হতে পারে। প্রথমত, এমন ব্যক্তি যে সত্যিই আল্লাহর দেয়া পায়ের ওপর সােজা হয়ে চলতে পারে না বরং উপুড় হয়ে চলে। দ্বিতীয়ত, রূপক অর্থে এমন ব্যক্তিকে বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে, যে পথ চলতে গিয়ে ঠোকর খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। তারপর আবার ওঠে, অতপর আবার উপুড় হয়ে পড়ে। এ ধরনের মানুষ যে কখনাে গন্তব্যস্থলে পৌছতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। যে ব্যক্তি এভাবে পথে ক্রমাগত ঠোকর খেয়ে থাকে এবং দুস্তর বাধার সম্মুখীন হতে থাকে, সে কোনাে হেদায়াত বা কল্যাণ লাভ করতে পারে না। এই ব্যক্তির সাথে সেই ব্যক্তির তুলনা কিভাবে হতে পারে যে, বাধাবন্ধনহীন সােজাপথে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে চলে এবং যার গন্তব্য সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। প্রথমােক্ত অবস্থাটা হেদায়াত থেকে বঞ্চিত ও আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হতভাগা মানুষের অবস্থা। অনবরত আল্লাহর সৃষ্টি ও আল্লাহর নির্দেশাবলীর সাথে তার টক্কর লাগে। কেননা সে এগুলাের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তার পথ আল্লাহর যাবতীয় সৃষ্টির পথ থেকে ভিন্ন হয়ে যায়। তাই সে সব সময় ঠোকর খায়, সব সময় কষ্টের মধ্যে থাকে এবং সব সময় গােমরাহীর মধ্যে থাকে। দ্বিতীয় অবস্থাটা হলাে আল্লাহর সঠিক পথের সন্ধানপ্রাপ্ত ও সঠিক পথের যাত্রীর অবস্থা। সে আল্লাহর নির্দেশ মােতাবেক সঠিক ও সােজা পথে চলে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও আল্লাহর গুণগানে সদামুখরিত জীব জন্তু নির্বিশেষে গােটা সৃষ্টিজগতের কাফেলা এই পথেই ধাবমান। বস্তুত ঈমানী জীবন সরল, সহজ, স্বচ্ছ সাবলীল, বাধাবন্ধন মুক্ত ও প্রত্যয়দীপ্ত। আর কুফরী জীবন কঠিন, পদে পদে ঠোকর খাওয়া এবং পথভ্রষ্ট। এ দুটো পথ এবং এ দুটো জীবনের কোনটা ভালাে ও সঠিক? এ প্রশ্ন কি কোন জবাবের অপেক্ষা রাখে, না এ প্রশ্নের ভেতরেই রয়েছে এর ইতিবাচক জবাব। বস্তুত প্রশ্নের জবাবটি স্পষ্ট ভাষায় না দেয়ার উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ যেন হৃদয়ের চোখ দিয়ে এই জীবন্ত ও চলন্ত দৃশ্য দেখতে পায়। এ দৃশ্যে একদিকে রয়েছে উপুড় হয়ে চলা একটি দলের ছবি, যাদের কোনাে পথও নেই, গন্তব্যও নেই। অপরদিকে রয়েছে ঘাড় সােজা ও বুক টান করে চলা একটি দৃঢ় প্রত্যয়ী কাফেলার ছবি, যারা সঠিক পথে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে অপ্রতিহতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এটি কোরআনের একটি বিশেষ বর্ণনাভংগী। তত্ত্বকে বাস্তব রূপ দান এবং জীবনকে ছবির মত একে পেশ করা এই বর্ণনাভংগীর বৈশিষ্ট্য।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২৩

قُلْ هُوَ الَّذِیْۤ اَنْشَاَكُمْ وَ جَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَ الْاَبْصَارَ وَ الْاَفْئِدَةَ١ؕ قَلِیْلًا مَّا تَشْكُرُوْنَ

এদেরকে বলো, আল্লাহই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তোমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।

ফী জিলালিল কুরআন:

*হেদায়াত ও সত্যোপলব্ধির উপকরণ : হেদায়াত ও গােমরাহীর উল্লেখের পাশাপাশি আল্লাহ মানুষকে হেদায়াত ও সত্যোপলব্ধির যে সব উপকরণ দিয়েছেন, অথচ মানুষ তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে সত্যের পথ চিনে নেয়নি। এবং কৃতজ্ঞতার আচরণ করেনি, সেই উপকরণগুলাের কথা স্মরণ করানাে হয়েছে পরবর্তী আয়াতে, ‘হে নবী, তুমি বলাে, তিনিই তাে সেই মহান প্রতিপালক, যিনি তােমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তােমাদেরকে চোখ, কান ও হৃদয় দিয়েছেন। অথচ তােমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো।’ মানুষকে আল্লাহ তায়ালাই তৈরী করেছেন। এটি এমন একটি অকাট্য সত্য, যা মেনে নেয়ার জন্যে মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে ক্রমাগত উদ্বুদ্ধ করে এবং নিজেকে এমন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত করে যে, অস্বীকার করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ কথা কে না জানে, মানুষ জ্ঞানে, শক্তিতে ও মর্যাদায় সকল সৃষ্টির সেরা। এ কথাও অনস্বীকার্য যে, মানুষ নিজেকে কখনাে নিজেই সৃষ্টি করেনি বরং কারাে না কারাে দ্বারা সে সৃজিত। সুতরাং তার চেয়ে বেশী জ্ঞানী, বেশী শক্তিশালী এবং বেশী মর্যাদাবান কেউ না থেকে পারে না যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। এভাবে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব না মেনে উপায় থাকে না। কেননা খোদ মানুষের নিজের অস্তিত্বই তাকে এই সত্যের মুখােমুখী দাড় করিয়ে দেয়। এ সত্য নিয়ে বিবাদ ও বিতর্ক তােলা এক ধরনের বােকামি ছাড়া কিছু নয় এবং তা কোনােরূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শনেরও যােগ্য নয়। এখানে আল্লাহর এ তথ্যটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের জ্ঞান অর্জনের হাতিয়ার ও উপকরণগুলাে সম্পর্কে তাকে অবহিত করতে চান, অর্থাৎ ‘তােমাদের জন্যে তিনি কান, চোখ ও হৃদয় সৃষ্টি করেছেন।’ আল্লাহ এ কথাও বলতে চান যে, অধিকাংশ মানুষ এসব নেয়ামতের শােকর আদায় করে না। চোখ ও কান মানবদেহের অসাধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন দুটো অংগ। এ দুটো অংগের গুণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বহু বিস্ময়কর তথ্য জানা গেছে। চোখ ও কানের চেয়েও বিস্ময়কর অংগ হচ্ছে হৃদয়। মানুষের বুঝা ও জানার ক্ষমতাকেই কোরআন ‘ফুয়াদ’ বা হৃদয় নামে অভিহিত করে থাকে। এই হৃদয় সম্পর্কে এ যাবত খুব কম তথ্যই জানা গেছে। আসলে হৃদয় হচ্ছে আল্লাহর এ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের দেহে আল্লাহর পক্ষ থেকে সংরক্ষিত এক অজানা রহস্য। আধুনিক বিজ্ঞান চোখ ও কানের বিস্ময়কর তথ্য সংগ্রহে অনেক চেষ্টা চালিয়েছে। সংগৃহীত তথ্যের সামান্য কিছু এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক নাওফেল তার ‘আল্লাহ ও আধুনিক বিজ্ঞান” নামক গ্রন্থের ৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, শােনার কাজ বাইরের কান থেকে শুরু হয়। কিন্তু কোথায় গিয়ে শেষ হয় তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। বিজ্ঞানের বক্তব্য হলাে, শব্দ হওয়া মাত্র বাতাসে যে তরংগের সৃষ্টি হয়, সেটা কানে গিয়ে লাগে। এরপর কান শব্দটিকে ভেতরে ঢোকানের ব্যবস্থা করে যাতে তা কানের পর্দায় গিয়ে লাগে । অতপর তা তাকে ভেতরে শূন্যস্থানে নিয়ে যায়। এই আভ্যন্তরীণ শূন্য জাগয়গাটি কয়েক প্রকারের নালায় পরিপূর্ণ। ওসব নালায় কতক গােলাকার এবং কতক আধা গােলাকার। শুধুমাত্র গােলাকার নালাগুলাের ভেতরে ৪ হাজার ছােট ছােট ধনুক রয়েছে। এগুলাে সবই কানের রগসমূহের মাধ্যমে মাথার ভেতরে সংযুক্ত রয়েছে। এই ধনুকগুলাের দৈর্ঘ্য এবং আয়তন কত তা কেউ জানে না। সংখ্যায় কয়েক হাজারে উন্নীত এ সব ধনুকের প্রত্যেকটি কিভাবে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত, এতে কি কল্যাণ নিহিত রয়েছে এই সব অজানা রহস্য। এ ছাড়া আরাে যে কত সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ঢেউ খেলানাে হাড় রয়েছে, তার হিসাব কে রাখে? এসব কিছু কানের ভেতরের সেই শূন্য প্রান্তরে এমনভাবে রয়েছে, যা সহজে দেখাই যায় না। একটি কানে এক লক্ষ শ্রবণ কোষ থাকে। আর রগগুলাের শেষ প্রান্তে থাকে অতি অসংখ্য রজ্জু। এগুলাের সুক্ষ্মতা দর্শক মাত্রেরই বিবেককে স্তম্ভিত ও বিস্ময়াভিভূত করে। দর্শনেন্দ্রিয়ের কেন্দ্র হচ্ছে চোখ। এতে রয়েছে ১৩ কোটি আলােগ্রাহী যন্ত্র। এগুলাে হচ্ছে দর্শনেন্দ্রিয়ের রোগের প্রান্ত ভাগ। স্কেনেরা, কর্ণিয়া, প্লাসেন্টা ও রেটিনা নামক অংশগুলাে নিয়ে চক্ষু গঠিত। এ ছাড়া আরাে বিপুলসংখ্যক রগ এ পর্দার অন্তর্ভুক্ত। রেটিনা গঠিত হয় নয়টা পৃথক পৃথক স্তর নিয়ে। তন্মধ্যে অভ্যন্তর ভাগের শেষ প্রান্তে অবস্থিত স্তরটি বহুসংখ্যক বােটা ও মােচা দ্বারা গঠিত। হিউম্যান বায়ােলজির বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, বােটার সংখ্যা ৩ কোটি এবং মােচার সংখ্যা ৩০ লাখ। এর সব কটি পরস্পরের সাথে এবং লেন্সের সাথে সুধু আনুপাতিক হারে সংযুক্ত। প্রত্যেক মানুষের চোখের লেন্সের ঘনত্ব উভয় চোখে এক রকম নয়। এ জন্যে সকল আলােকরশ্মি একটিমাত্র কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত করা হয়। অথচ মানুষ এ ধরনের জিনিসকে একই জাতীয় একটি মাত্র বস্তুতে যথা কাচে একত্রিত করতে সক্ষম হয়না। (আধুনিক বিজ্ঞান ঈমানের উদ্দীপনা জাগায়’ নামক গ্রন্থ থেকে অধ্যাপক মাহমুদ সালেহ)।  *হৃদয় কি জিনিস? : পৃথিবীরূপী এই বিশাল সাম্রাজের মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হবার গৌরব যে গুণাবলীর ভিত্তিতে অর্জন করেছে, তা হচ্ছে বােধশক্তি, বিচার বিবেচনা ও বাছাই করার ক্ষমতা এবং জ্ঞান। আর এ তিনটি গুণেরই আরেক নাম হলাে হৃদয় । এই গুণবৈশিষ্ট্য সমূহের বলেই মানুষ সেই গুরুত্বপূর্ণ আমানত গ্রহণ করেছে, যা গ্রহণে আকাশ পৃথিবী ও পাহাড় পর্বত সাহস করেনি।(বুখারী ও মুসলিম এ হাদীসটিকে আব্দুর রাযযাক-এর বরাত দিয়ে রেওয়ায়াত করেছেন) এরপর আসে হৃদয়ের প্রসংগ। হৃদয় মানুষের সেই বৈশিষ্ট যার বদৌলতে মানুষ মানুষ হয়। সেই আমানত বা গুরুদায়িত্ব আর কিছু নয়, স্বেচ্ছায় ঈমান আনা, হেদায়াতের পথ অবলম্বন করা এবং আল্লাহর পথের ওপর টিকে থাকার দৃঢ় সংকল্প পােষণ করা। হৃদয় নামক এই শক্তির প্রকৃত স্বরূপ কি, এর উৎস বা কেন্দ্র কোথায়, শরীরের ভেতরে না বাইরে, তা কেউ জানে না। মানুষের ভেতরে এটি আল্লাহর এক দুর্ভেদ্য রহস্য। এ রহস্যের কুল কিনারা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ আমানত বা দায়িত্বকে মানুষ যাতে বহন করতে পারে সে জন্যে তাকে এতগুলাে বড় বড় নেয়ামত দান করা হয়েছে। অথচ সে তাঁর জন্য কৃতজ্ঞ হয় না। এ কথাই আল্লাহ বলেছেন আয়াতের শেষাংশে, ‘তোমরা খুব কমই শােকর আদায় করে থাক।’ এটি এমন একটি ব্যাপার, যা স্মরণ করলে লজ্জিত না হয়ে পারা যায় না। কোরআন এখানে সেই বিষয়টি প্রত্যেক কাফের ও নাফরমান বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২৪

قُلْ هُوَ الَّذِیْ ذَرَاَكُمْ فِی الْاَرْضِ وَ اِلَیْهِ تُحْشَرُوْنَ

এদেরকে বলো, আল্লাহই সেই সত্তা যিনি তোমাদের পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাঁরই কাছে তোমাদের সমবেত করা হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

*সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য : এরপর কোরআন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা যে মানুষকে সৃষ্টি ও এসব মূল্যবান গুণাবলী দ্বারা তাকে ভূষিত করেছেন, সেটা উদ্দেশ্যহীনভাবে বা আকস্মিকভাবে করেননি। বরং এটা একটা নির্বাক পরীক্ষার ক্ষেত্র। মানুষ এখানে যা করবে, আখেরাতে তার প্রতিদান পাবে। ‘তুমি বলাে, তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা যিনি পৃথিবীতে তােমাদেরকে বৃদ্ধি করেছেন এবং তার কাছেই তােমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।’ আয্ যারউ শব্দের অর্থ হলাে বৃদ্ধি করা। ছড়িয়ে দেয়া বা প্রসার ঘটানাের অর্থেও এটি ব্যবহৃত হয়। আল হাশর শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনাে জিনিসকে ছড়িয়ে দেয়ার পর আবার একত্র করা। এই দুটো জিনিস অর্থাৎ ‘আয যারউ ও আল হাশরু’ সম্পূণ পরস্পর বিরােধী। প্রথমটি হলাে সৃষ্টিকে সংখ্যায় বৃদ্ধি করা আর দ্বিতীয়টি হলাে পৃথিবীর সকল জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়ার পর তাদেরকে পুনরায় একত্রিত করা। এই দুটি দৃশ্যকে কোরআন নিজস্ব বর্ণনাভংগী অনুসারে একই আয়াতে একত্রিত করেছে, যাতে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার পরও স্মরণ করতে পারে যে, তাদেরকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিণতিতে উপনীত হতে হবে এবং একত্রিত হতে হবে। এই পার্থিব জীবনের অপর পারে এবং জীবন ও মৃত্যুর স্তর অতিক্রম করে আরেকটি অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২৭

فَلَمَّا رَاَوْهُ زُلْفَةً سِیْٓئَتْ وُجُوْهُ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا وَ قِیْلَ هٰذَا الَّذِیْ كُنْتُمْ بِهٖ تَدَّعُوْنَ

তারপর এরা যখন ঐ জিনিসকে কাছেই দেখতে পাবে তখন যারা অস্বীকার করেছে তাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যাবে। আর তাদেরকে বলা হবে, এতো সেই জিনিস যা তোমরা চাচ্ছিলে।

 

ফী জিলালিল কুরআন:

*দায়ীর কাজ শুধু সতর্ক করে যাওয়া : এরপর আল্লাহ মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় একত্রিত করার প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে অবিশ্বাসীদের সন্দেহ ও সংশয়ের উল্লেখ করছেন। তিনি বলছেন, ‘তারা বলছে, তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে বলাে, এই প্রতিশ্রুতি কবে পূরণ হবে?’ এ প্রশ্ন যেমন সত্যিকার সংশয়াপন্ন ব্যক্তিরও হতে পারে, তেমনি একগুয়ে হঠকারী অবিশ্বাসীরও হতে পারে। আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতি পূরণের সঠিক সময় নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে জানা যাবে না। আর তার প্রকৃত স্বরূপ কারাে জানা নেই। শুধুমাত্র এতটুকুই জানা যায় যে, পার্থিব জীবনের পরীক্ষার পরই এই কর্মফল পাওয়ার দিন নির্ধারিত রয়েছে। এই কর্মফল দিবস আগামীকালই হােক কিংবা লক্ষ লক্ষ বছর পরই হােক, মানব জাতির জন্যে দুটোই সমান। যে জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলাে, সেদিনটি একদিন আসবেই, সেদিন সকল মানুষ একত্রিত হবে এবং তারা নিজ নিজ কৃতকর্মের ফল পাবে। এজন্যে আল্লাহ তায়ালা তার কোনাে সৃষ্টিকে কেয়ামতের নির্দিষ্ট সময় জানাননি। কেননা তা জেনে তাদের কোন লাভ নেই। উদ্দেশ্য কর্মফল দিবসের আয়ােজন। তার সাথে তার সঠিক দিন তারিখ জানার কোনাে সম্পর্ক নেই। তেমনি ওই দিনটির সম্মুখীন হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য তার ওপর অর্পিত হয়েছে, কর্মফল দিবসের সঠিক দিন তারিখ জানলে সেই দায়িত্ব ও কর্তব্যের কিছুমাত্র বাড়বেও না, লাঘবও হবে না। বরঞ্চ গোটা সৃষ্টিজগতের কাছ থেকে সেই দিনটির সঠিক দিন তারিখ গােপন রাখাই অধিকতর লাভজনক। ওটা শুধুমাত্র আল্লাহর জ্ঞানে সীমিত থাকুক, আর কেউ না জানুক এটাই মংগলজনক। এ কথাই পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তুমি বলাে যে, প্রকৃত জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছেই রয়েছে। আমি তাে শুধু প্রকাশ্য সতর্ককারী।’ সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কি পার্থক্য, তা এখানে সুষ্ঠুভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর সত্ত্বার সাথে কারাে সাদৃশ্য নেই এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ একাই নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী। আর রসূল ও ফেরেশতাসহ সকল সৃষ্টি নিজ নিজ স্থানে আল্লাহর সুমহান মর্যাদার সামনে বিনয়াবনত। রসূল(স.) নিজেরও যে কেয়ামতের সঠিক সময় কাল সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, সে কথা মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ীতে উদ্ধৃত একটি হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। ঐ হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘জিবরাঈল যখন রসূল(স.)-কে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাে তখন জবাবে তিনি বললেন, যাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে বেশী অবহিত নয়।’ আর আলােচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, অর্থাৎ ‘আমার কাজ ও দায়িত্ব শুধু কেয়ামত সম্পর্কে সতর্ক করা এবং আমাকে যা জানানাে হয় তা প্রচার করা । কেয়ামত কবে হবে সে কথা শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন, আর কেউ নয়।’ কেয়ামত যখন সামনে দেখতে পাবে সন্দিহান চিত্তে কাফেরদের প্রশ্ন এবং কুরআনে তার অকাট্য জবাব দান থেকে প্রতীয়মান হতাে যে, যে দিনটির কথা তারা জিজ্ঞাসা করে তা সমাগত এবং যে প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ব্যাপারে তারা সন্দেহ পােষণ করতাে তা একেবারেই আসন্ন হয়ে উঠেছে। যেন তারা একেবারেই তার মুখােমুখী হয়ে পড়েছে। তখন তাদের কি অবস্থা হতাে, তা পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন তারা সেই প্রতিশ্রুত দিনটিকে একেবারে সামনাসামনি উপস্থিত দেখলাে, তখন অবিশ্বাসীদের মুখ মলিন হয়ে গেল এবং বলা হলাে যে, এই সেই দিন, যা নিয়ে তােমরা দাবী করতে।’ অর্থাৎ কোনাে প্রত্যাশা ও ভূমিকা ছাড়াই তারা সেই দিনটিকে তাদের অতি নিকটে একেবারে সামনে উপস্থিত দেখতে পেল। তাতে তাদের মুখ কালাে হয়ে গেল। তাদের মুখে ব্রিতকর ভাব ফুটে উঠলাে। তাদেরকে ধিক্কার দেয়া হতে লাগলাে এবং বলা হতে লাগলাে যে, যে দিন সম্পর্কে তােমরা দাবী করতে যে তা কখনাে আসবে না, সেদিনটি তাে এসেই গেছে। এখন কি হবে? এটি আসলে ভবিষ্যতের ঘটনা। ভবিষ্যতের ঘটনাকে এভাবে অতীতের ঘটনা হিসাবে ব্যক্ত করা কুরআনের বহুল প্রচলিত রীতি। এর উদ্দেশ্য হলাে, চেতনার জগতে আকস্মিকভাবে একটি জলজ্যান্ত দৃশ্য হাজির করার মাধ্যমে সন্দেহ সংশয় ও অবিশ্বাসের মােকাবিলা করা। অবিশ্বাসকারী যে জিনিসটাকে অবিশ্বাস করে এবং সন্দেহকারী যে জিনিসটাকে সন্দেহ করে, ঠিক সেই জিনিসটার দৃশ্যই তার সামনে উপস্থাপন করা হয়। এটা একটা বাস্তব সত্যকে কল্পনা করারও শামিল। আল্লাহর জানা মতে এ দিনটা তাে অবধারিতই। তবে সময়ের যে সীমারেখাটা তার ও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, তা কেবল মানুষের বিচারেই। এটা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। মূল সত্য আল্লাহর হিসাবে যেমন ছিলাে তেমনি রয়েছে। আল্লাহ যদি চাইতেন তবে তিনি যেমন জানেন তেমনি মানুষও এক্ষুণি দেখে নিতে পারে যে কেয়ামত কেমন জিনিস। মানুষকে এ আয়াতে যেরূপ আকস্মিকভাবে দুনিয়া থেকে আখেরাতের দিকে এবং সন্দেহ সংশয় থেকে চাক্ষুস দর্শনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা দ্বারা। এ কথাই বুঝানাে হয়েছে যে, যে আল্লাহ কেয়ামতের এরূপ জ্বলজ্যান্ত মানচিত্র দেখাতে পারেন, তিনি ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে তার আসল দৃশ্যই দেখিয়ে দিতে পারেন।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২৮

قُلْ اَرَءَیْتُمْ اِنْ اَهْلَكَنِیَ اللّٰهُ وَ مَنْ مَّعِیَ اَوْ رَحِمَنَا١ۙ فَمَنْ یُّجِیْرُ الْكٰفِرِیْنَ مِنْ عَذَابٍ اَلِیْمٍ

তুমি এদেরকে বলো, তোমরা কখনো এ বিষয়টি ভেবে দেখেছো কি যে, আল্লাহ‌ যদি আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে ধ্বংস করে দেন কিংবা আমাদের ওপর রহম করেন তাতে কাফেরদেরকে কঠিন শাস্তি থেকে কে রক্ষা করবে?

ফী জিলালিল কুরআন:

*কাফেরদের ভ্রান্ত চিন্তা : মক্কার মােশরেকরা সব সময় এই বাসনা পােষণ করতাে যে, রসূল(স.) এবং তার মােমেন সংগীরা মরে গেলে তাদের হাড় জুড়ােয়। এমনকি এ জন্যে তারা পরস্পরকে ধৈর্য ধারণেরও উপদেশ দিত যে, সময়মত তারা মারা যাবে এবং মুহাম্মদের দাওয়াতের দরুণ তাদের ঐক্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তাও জোড়া লেগে যাবে। কখনাে কখনাে তারা বড় গলা করে এরূপ আস্ফালনও করতাে যে, আল্লাহ মােহাম্মদকে ও তার সাথীদেরকে ধ্বংস করবেনই। কারণ তারা তাদের ভাষায় আল্লাহর নামে মিথ্যা রটাচ্ছে এবং তারা বিপথগামী। তাদের এই মানসিকতার প্রেক্ষাপটে এখানে কেয়ামত ও কর্মফলের দৃশ্য তুলে ধরার পর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এই বলে হুঁশিয়ারী দিচ্ছেন যে, তােমাদের কুৎসিত মনােবাসনাটি যদি পূরণ হবে বলেও ধরে নেয়া যায়, তবু তাতে তােমরা তােমাদের কুফরী ও গােমরাহীর পরিণাম থেকে রক্ষা পাবে না। সুতরাং কর্মফল দিবসের যে অব্যর্থ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে এবং যা একেবারেই আসন্ন রূপে চিত্রিত করা হয়েছে, তা বাস্তবিকপক্ষে সংঘটিত হবার আগেই তােমার আচরণ সঠিক হচ্ছে কিনা একবার ভেবে দেখো। ‘তুমি বলাে, তােমরা কি ভেবে দেখেছো যে, আল্লাহ যদি আমাকে ও আমার সাথীদেরকে ধ্বংস করে দেন কিংবা আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেন, তাহলে অবিশ্বাসীদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে কে রক্ষা করবে?’ এটি এমন প্রশ্ন, যা তাদেরকে তাদের প্রচলিত রীতি-নীতি ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর এটাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যােগ্য। কেননা তাদের মনােবাসনা যদি পূর্ণও হয় এবং আল্লাহ তায়ালা তার নবী ও তার সাহাবাদেরকে ধ্বংস করে দেন, তাতে তাদের কোনাে লাভ হবে না। অনুরূপভাবে আল্লাহ যদি তার নবী ও নবীর সহচরদের ওপর দয়া করেন, তবে তাতেও তাদের কোনাে লাভ হবে না। আল্লাহ তায়ালা তো চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তিনি তাদেরকে যেমন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তেমনি তাদেরকে একত্রিতও করবেন। কোনাে বিশেষ ব্যক্তি বা দলের বাঁচা বা মরা তার এই শাশ্বত নীতিকে কিছুমাত্র প্রভাবিত করে না। লক্ষণীয় যে, আল্লাহ তায়ালা এ কথা বলেননি, ‘কে তােমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে?’ আবার তাদেরকেও সরাসরি কাফের বলে উল্লেখ করেননি যে শাস্তি কাফেরদের প্রাপ্য। সেই শাস্তির ব্যাপারে তাদেরকে শুধু ইংগিত দিলেন।  ‘কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে কে রক্ষা করবে?’ বস্তুত এটা একটা অত্যন্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ ও বিচক্ষণ কৌশল। একদিকে তাদেরকে ভয় দেখানাে হচ্ছে, অপর দিকে তাদেরকে তাদের বর্তমান নীতি থেকে ফিরে আসার সুযােগও করা হতাে এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে তাদের নিষ্কৃতির কোনাে উপায় নেই বলা হতাে, তাহলে হয়তাে তারা গােয়ার্তুমি ও হঠকারিতা দেখাতাে এবং প্রত্যক্ষ অভিযােগ ও হুমকির মুখে পাপাচারের মধ্যেই তারা আভিজাত্য ও আত্মমর্যাদা বােধ করতাে। বস্তুত, ক্ষেত্র বিশেষে ইংগিতমূলক বাচনভংগী স্পষ্ট বাচনভংগীর চেয়ে মনের ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-২৯

قُلْ هُوَ الرَّحْمٰنُ اٰمَنَّا بِهٖ وَ عَلَیْهِ تَوَكَّلْنَا١ۚ فَسَتَعْلَمُوْنَ مَنْ هُوَ فِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ

এদেরকে বলো, তিনি অত্যন্ত দয়ালু, আমরা তাঁর ওপর ঈমান এনেছি এবং তাঁরই ওপর নির্ভর করেছি। তোমরা অচিরেই জানতে পারবে কে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে আছে?

ফী জিলালিল কুরআন:

*মুমিনের বিশ্বাস ও ভরসা : মুমিনদের ওপর দয়াই করা হােক কিংবা তাদেরকে কোনাে শাস্তি দেয়া হােক, উক্ত উভয় অবস্থাই সমান। এ কথা বলার পর আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন। মুমিনরা তাদের প্রতিপালকের ওপর কতােটা আস্থাশীল এবং নিজেদের সঠিক পথে থাকা ও মুমিনগণের ব্যাপারে কত প্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী এবং কাফেররাই যে বিভ্রান্ত, সে সম্পর্কে কত অবিচল বিশ্বাস পােষণ করে, তার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, এখানে ‘দয়াবান’ শব্দটির উল্লেখ দ্বারা রসূল ও তার সহচরদের প্রতি আল্লাহর বিরাট ও সুগভীর দয়া ও করুণার প্রতি ইংগিত করাই উদ্দেশ্য। বস্তুত কাফেরদের কামনা বাসনা অনুযায়ী আল্লাহ মুমিনদেরকে কখনাে ধ্বংস করবেন না। এ আয়াতে আল্লাহ স্বীয় নবীকে এই মর্মে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, দয়াবান আল্লাহর সাথে যে গুণ দ্বারা তােমরা সম্পর্ক গড়ে তুলেছো, তা ব্যক্ত করাে। প্রথম গুণ হচ্ছে ঈমান এবং দ্বিতীয় গুণ হলাে তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা ও আস্থা। এ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, নবী(স.) এবং মুমিনদের মাঝে যেমন, তেমনি নবী(স.) ও আল্লাহর মাঝেও এই একই ঈমানী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে ঘােষণা করতে বলার অর্থ প্রকারান্তৱে এ কথা বলা যে, কাফেরদের কথায় তুমি ভয় পেয়াে না। কেননা তুমি ও তােমার সংগীরা আমার সাথে সম্পর্কিত। আর এই মহান মর্যাদা ও মহৎ সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে ঘােষণা করার জন্যে তােমাকে অনুমিত দেয়া হলাে। তুমি ঘােষণা দাও, এটা আল্লাহর পথ থেকে পরম সম্মান ও সম্প্রীতির নিদর্শন। এরপরই রয়েছে সেই প্রচ্ছন্ন হুমকি। ‘অচিরেই জানতে পারবে কে প্রকাশ্য গোমরাহীতে লিপ্ত।’ এটাও একটি চমকপ্রদ বাকরীতি, যা কাফেরদের অব্যাহত অস্বীকৃতি হঠকারিতায় ছেদ আনতে সক্ষম। এতে কাফেরদের প্রচলিত আকীদা বিশ্বাস ও আচরণ পুনর্বিবেচনা করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তারাই গােমরাহ এবং এ আয়াতে বর্ণিত শাস্তির যােগ্য বলে সাব্যস্ত হয় কিনা, সেই শংকা তাদের মনে ঢােকানাের চেষ্টা করা হয়েছে। আবার এর পাশাপাশি তাদেরকে সরাসরি গােমরাহ বলা থেকে বিরত থাকা হয়েছে, যাতে তারা অন্যায় জিদ ও হঠকারিতার শিকার না হয়। এটা ইসলামের দাওয়াতের একটি বিশেষ কৌশল, যা স্থান কাল ও পাত্র ভেদে মানানসই ও কার্যকর।

সুরা: আল-মুলক
আয়াত নং :-৩০

قُلْ اَرَءَیْتُمْ اِنْ اَصْبَحَ مَآؤُكُمْ غَوْرًا فَمَنْ یَّاْتِیْكُمْ بِمَآءٍ مَّعِیْنٍ۠

এদেরকে বলো, তোমরা কি এ বিষয়ে কখনো চিন্তা-ভাবনা করে দেখছো যে, যদি তোমাদের কুয়াগুলোর পানি মাটির গভীরে নেমে যায় তাহলে পানির এ বহমান স্রোত কে তোমাদের ফিরিয়ে এনে দেবে?

 

ফী জিলালিল কুরআন:

সবার শেষে সুরার সর্বশেষ কার্যকর হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে, যাতে আখেরাতের আযাবের আগে দুনিয়াতেই আযাবের সম্ভাবনার ইংগিত দেয়া হয়েছে। জীবন যাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ পানি থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে এই আযাব নাযিল করা যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী, তুমি বলাে, তােমরা কি ভেবে দেখেছো যে, তােমাদের পানি যদি ভুগর্ভে উধাও হয়ে যায় তাহলে তােমাদের কাছে কে আনবে প্রবহমান পানি?’ ‘আল- গাউরু’ অর্থ ভূগর্ভে এমন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া জিনিস যা মানুষের আওতার বাইরে চলে যায়। আল- মা-ঈনু অর্থ প্রবহমান ঝর্ণা। এটি তাদের জীবনের একটি অতি ঘনিষ্ঠ ও অতি প্রয়ােজনীয় উপকরণ। এ উপকরণ থেকে তারা কখনাে বঞ্চিত হতে পারে এটা তাদের কাছে ছিলাে অকল্পনীয় এবং এতে তারা সন্দেহ পােষণ করতাে। কিন্তু সমগ্র বিশ্ব জাহানের একচ্ছত্র ক্ষমতা যার হাতে এবং যিনি সর্বশক্তিমান তিনি যদি তাদের জীবনের এই সর্বাধিক প্রয়ােজনীয় জিনিসটি ছিনিয়ে নেন, তাহলে তাদের উপায় কি হবে? আল্লাহ এই সম্ভাবনা সম্পর্কে তাদের চিন্তা ভাবনা করার আহবান জানাচ্ছেন। এভাবে এই সুরাটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুরাটি মানুষের চেতনায় ও বিবেকে মুহুর্মুহু করাঘাতকারী বক্তব্যে পরিপূর্ণ। প্রকৃতির বিভিন্ন অংশের পর্যবেক্ষণ ও পরিভ্রমণ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রায় প্রতিটি আয়াতেই রয়েছে মন-মগযের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিশেষ বক্তব্য। প্রায় প্রতিটি আয়াতেই রয়েছে মহাবিশ্বের বিভিন্ন অচেনা জগতে অথবা পরিচিত হয়েও উপেক্ষিত এমন জগতে বিচরণের আহবান। আকৃতি আয়তন ও আয়াত সংখ্যার দিক দিয়ে সুরাটি যতাে বড় আলােচ্য বিষয় ও বক্তব্যের দিক থেকে তা তার চেয়ে অনেক বড়। এর আয়াত গুলাে যেন এক একটা নতুন জগত আবিষ্কার করতে উদ্যত। এ সুরা ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি গঠন করে। মানুষের মনমগজে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তার সর্ব শক্তিমান হওয়া, কেয়ামত ও কর্মফলের প্রস্তুতি হিসাবে জীবন ও মৃত্যু দ্বারা পরীক্ষা করার তত্ত্ব আল্লাহর সৃষ্টিতে সৌন্দর্য সুষমা ও পুর্ণতার ছাপ, গােপন ও প্রকাশ্য সকল জিনিস সম্পর্কে আল্লাহর নিরংকুশ ও সর্বাত্মক জ্ঞান, আল্লাহর কাছে জীবিকার উৎস, সকল সৃষ্টিকে একমাত্র আল্লাহ-ই নিরন্তর প্রহরা দান তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ করেন। তিনি সর্বত্র সকল সময় প্রতিটি সৃষ্টির সাথে আছেন। ইত্যাকার যাবতীয় বিষয় এই সুরায় স্থান পেয়েছে যার ওপর প্রত্যেকে মুসলমানদের স্বীয় প্রতিপালন সংক্রান্ত ধারণা বিশ্বাস এবং সৃষ্টি ও স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক ও ধ্যান ধারণা নির্ভরশীল। এ ধ্যান ধারণা ও আকিদা বিশ্বাস থেকেই মুমিনের গােটা জীবন পরিচালনার নিয়ম বিধি উৎসারিত- চাই তা আল্লাহর সাথে, সমাজের সাথে কিংবা গােটা জীব জগতের সাথে সম্পর্ক ভিত্তিক হােক অথবা তার ব্যাক্তিগত ভালাে মন্দ ভিত্তিক হােক। একমাত্র এই আল্লাহর জীবন বিধানের সাথেই মানুষ তার চিন্তা চেতনা ব্যক্তিত্ব মুল্যবােধ ও জীবনের সামগ্রিক বিচার বিবেচনাকে সুসমন্বিত ও সংগতিশীল করতে সক্ষম।

Leave a Reply