Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৭৮/ এবং কাফের-রা বলে:-২৪) [*আখিরাত সম্পর্কিত প্রশ্ন :- *যে আযাব কাফেরের জন্য অবধারিত:- **দাওয়াতের কাজে ধৈৰ্য্য অপরিহার্য : – **ইসলামী দাওয়াত অস্বীকারের কারণ :-] www.motaher21.net সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ পারা:২৯ ১-১৮ নং আয়াত:- আয়াতের ব্যাখ্যা:- তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

( বই # ১১৭৮/ এবং কাফের-রা বলে:-২৪)
[*আখিরাত সম্পর্কিত প্রশ্ন :-
*যে আযাব কাফেরের জন্য অবধারিত:-
**দাওয়াতের কাজে ধৈৰ্য্য অপরিহার্য : –
**ইসলামী দাওয়াত অস্বীকারের কারণ :-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ
পারা:২৯
১-১৮ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১
سَاَلَ سَآئِلٌۢ بِعَذَابٍ وَّاقِعٍ ۙ﴿۱﴾
এক প্রার্থনাকারী আযাব প্রার্থনা করেছে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-২
لِّلۡکٰفِرِیۡنَ لَیۡسَ لَہٗ دَافِعٌ ۙ﴿۲﴾
যে আযাব কাফেরের জন্য অবধারিত। তা প্রতিরোধ করার কেউ নেই।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৩
مِّنَ اللّٰہِ ذِی الۡمَعَارِجِ ؕ﴿۳﴾
আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি উর্ধ্বারোহণের সোপান সমূহের অধিকারী।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৪
تَعۡرُجُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ الرُّوۡحُ اِلَیۡہِ فِیۡ یَوۡمٍ کَانَ مِقۡدَارُہٗ خَمۡسِیۡنَ اَلۡفَ سَنَۃٍ ۚ﴿۴﴾
ফিরিশতা এবং রূহ তাঁর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এক দিনে যা (পার্থিব) পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৫
فَاصۡبِرۡ صَبۡرًا جَمِیۡلًا ﴿۵﴾
কাজেই আপনি ধৈর্য ধারণ করুন পরম ধৈৰ্য।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৬
اِنَّہُمۡ یَرَوۡنَہٗ بَعِیۡدًا ۙ﴿۶﴾
নিশ্চয় তারা এ (শাস্তি)কে সুদূর মনে করছে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৭
وَّ نَرٰىہُ قَرِیۡبًا ؕ﴿۷﴾
কিন্তু আমি দেখছি তা নিকটে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৮
یَوۡمَ تَکُوۡنُ السَّمَآءُ کَالۡمُہۡلِ ۙ﴿۸﴾
সেদিন আকাশ হবে গলিত ধাতুর মত।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-৯
وَ تَکُوۡنُ الۡجِبَالُ کَالۡعِہۡنِ ۙ﴿۹﴾
এবং পর্বতসমূহ হবে রঙ্গীন পশমের মত,
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১০
وَ لَا یَسۡـَٔلُ حَمِیۡمٌ حَمِیۡمًا ﴿ۚۖ۱۰﴾
কোন পরম বন্ধুও বন্ধুকে জিজ্ঞেস করবে না।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১১
یُّبَصَّرُوۡنَہُمۡ ؕ یَوَدُّ الۡمُجۡرِمُ لَوۡ یَفۡتَدِیۡ مِنۡ عَذَابِ یَوۡمِئِذٍۭ بِبَنِیۡہِ ﴿ۙ۱۱﴾
অথচ তাদেরকে পরস্পরে দৃষ্টি সীমার মধ্যে রাখা হবে। অপরাধী সেদিনের আযাব থেকে মুক্তির বিনিময়ে তার সন্তান-সন্ততিকে,
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১২
وَ صَاحِبَتِہٖ وَ اَخِیۡہِ ﴿ۙ۱۲﴾
তার স্ত্রী ও ভাইকে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১৩
وَ فَصِیۡلَتِہِ الَّتِیۡ تُــٔۡوِیۡہِ ﴿ۙ۱۳﴾
তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে, যারা তাকে আশ্রয় দিত।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১৪
وَ مَنۡ فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا ۙ ثُمَّ یُنۡجِیۡہِ ﴿ۙ۱۴﴾
এমনকি, পৃথিবীর সবকিছুই দিতে চাইবে – অত:পর যেন তাকে মুক্তি দেওয়া হয় !
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১৫
کَلَّا ؕ اِنَّہَا لَظٰی ﴿ۙ۱۵﴾
কখনই নয়, নিশ্চয় এটা লেলিহান আগুন,
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১৬
نَزَّاعَۃً لِّلشَّوٰی ﴿ۚۖ۱۶﴾
যা শরীরের গোশত ও চামড়া ঝলসিয়ে নিঃশেষ করে দেবে।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১৭
تَدۡعُوۡا مَنۡ اَدۡبَرَ وَ تَوَلّٰی ﴿ۙ۱۷﴾
জাহান্নাম সে ব্যক্তিকে ডাকবে, যে সত্যের প্রতি পিঠ দেখিয়েছিল এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
সুরা: ৭০: আল্-মাআরিজ:-১৮
وَ جَمَعَ فَاَوۡعٰی ﴿۱۸﴾
আর সম্পদ জমা করে ডিমে তা দেয়ার মত করে আগলে রেখেছিল।

১-১৮ নং আয়াত:-
আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: আল-মাআরিজ

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

ফী জিলালিল কুরআন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ সে সকল সূরার অন্যতম যা মানুষের অন্তরকে জাহেলিয়াতের গভীর অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। তবে আমরা যদি একটু ভালােভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাবাে যে, প্রাচীনকালের জাহেলিয়াত এবং আধুনিক কালের জাহেলিয়াতের মধ্যে পার্থক্য শুধুই বাহ্যিক, মৌলিকভাবে এতে কোনাে পার্থক্য নেই, তাই আধুনিককালের যে কোনাে জাহেলিয়াতের মােকাবেলায়ও এ সূরাটি সমভাবে ক্রিয়াশীল। অন্য কথায় বলতে গেলে অতীত থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত মানব মনে যতাে প্রকার সংকট ও সমস্যা এসে তাকে কঠিন অবস্থায় নিক্ষেপ করেছে এবং সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুঞ্জীভূত যে সকল কুসংস্কার মানুষকে সরল সত্য পথ গ্রহণ থেকে বিরত রেখেছে, সবকয়টাই তৎকালীন মুসলমানদেরকে মােকাবেলা করতে হয়েছে। ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে তাদেরকে এই সব ধরনের জটিলতারই সম্মুখীন হতে হয়েছিলাে। যে অবধারিত সত্য এ সূরার আলােচ্য বিষয় তা হচ্ছে আখেরাত অবশ্যই সংঘটিত হবে এবং সেখানে প্রত্যেক মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হবে, বিশেষ করে কাফেরদেরকে অবশ্যই আযাব পেতে হবে। কোরআনে করীমের বহু স্থানে এই আযাবের বিশদ বর্ণনা এসেছে। ঈমানের পথে দৃঢ়ভাবে টিকে থাকা এবং ঈমানের দাবী অনুসারে জীবনকে গড়ার জন্যে যে মযবুত ইচ্ছার প্রয়ােজন তাকে এক রকম পাগলামীর সাথেই তুলনা করা যায়, কারণ জীবনলক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে পাগলপ্রায় না হলে সে লক্ষ্য লাভ করা সম্ভব নয়। এ কাজে দুঃখ কষ্ট সহ্য করা, বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করা ও অনেক রকমের ত্যাগ স্বীকারের দাবী জানায়। এ বাস্তব সত্য ঈমানে পরিপূর্ণ দিল এবং ঈমান শূন্য অন্তর উভয়ের জন্যে সমানভাবে প্রযােজ্য। যদিও লক্ষ্য তাদের সম্পূর্ণ ভিন্নমূখী, কিন্তু উভয় শ্রেণীর মানুষই নিজ নিজ লক্ষ্যে। উপনীত হওয়ার জন্যে দেওয়ানা না হয়ে সে লক্ষ্যে পৌছতে পারে না। চিন্তার ক্ষেত্রে, চলার পথে ও মর্যাদা লাভের আকাঙ্খায়, সর্বত্র তার এই একাগ্রতা একান্ত প্রয়ােজন। কিন্তু আল্লাহর পথকে পরিহার করে যে ব্যক্তি দুনিয়ায় বড় হয়ে থাকার জন্যে তার সকল কাজ ও ব্যবহারকে পরিচালনা করবে তার জন্যে আল্লাহ তায়ালা হীনতা, অপমান এবং ঘৃণা নির্ধারিত করে রেখেছেন। এই দুই শ্রেণীর মানুষের মূল্যের পার্থক্য আল্লাহর কথা থেকে যেমন জানা যায় তেমনি প্রকাশ পায় মানুষের কথা থেকেও। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও তাদের এই পার্থক্য ধরা পড়ে। জাহেলিয়াতের সে জটিল গ্রন্থি গুলো খােলা এবং মানুষের মন-মানসিকতার দুর্ভেদ্য সংকট দূর করার জন্যে এ সূরাটির অবতারণা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোরআনে কারীম যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনের জন্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং গােটা সমাজকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানােই তার উদ্দেশ্য। এ ব্যাপারে ব্যক্তি জীবনে পরিবর্তন এনে সমাজের মধ্যে তাকে মডেল হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে কোরআনে কারীম আপন বক্তব্য তুলে ধরেছে। একারণেই মােমেনের হাতে তরবারি তুলে দেয়ার পূর্বে তাদেরকে এমন সব মানবীয় গুণাবলীতে ভূষিত করা হয়েছে যার ফলে ইসলামের দুশমনদেরকে শেষপর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছে। কোরআনে পাককে যারা মনােনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করে তাদের কাছে নবী মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর মধুর চরিত্র এমনভাবে মুর্ত হয়ে ওঠে যে, তা এদের মন মেজাযের ওপর এক স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। সে শক্তিশালী প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া তাদের জন্যে আর সম্ভব হয় না। রসূলুল্লাহ(স.)-এর মেনে নিতে বাধ্য করে। মক্কার জনগণ এভাবেই তাকে শেষপর্যন্ত তাদের নেতা হিসেবে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলাে। অদ্ভূত ও আশ্চর্য আকর্ষণ অবশেষে তাদেরকে তার নেতৃত্ব তার এই সর্বগ্রাসী চারিত্রিক প্রভাবকে কখনও এক ভীষণ তুফানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যার আওতা থেকে কিছুই রেহাই পায় না। আবার কখনও সে যাতাকলের সাথে তুলনা করা যায়, যার মধ্যে কিছু পড়লে তা গুঁড়িয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় অথবা এমন চাবুকের সাথে তুলনা করা যায় যার ভীষণ যন্ত্রনাদায়ক কষাঘাত থেকে যেমন রেহাই পাওয়া যায় না তেমনি তা সহ্যও করা যায় না। এর অগ্নিবর্ষি আয়াতে হৃদয় মন বিকল হয়ে যেতে চায়, আবার সে আকুল আবেদনের সাথে কখনও তুলনা করা যেতে পারে যা অগ্রাহ্য করা মুশকিল। অথবা তুলনা করা যায় সে মনােরম সফরের সাথে যা যে কোনাে যাত্রীর হৃদয় মনকে মুগ্ধ-আবেগে এমনভাবে বিমােহিত করে যেন তার সেখানে নিজস্ব চেতনা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কখনও আবার তার ভীষণ প্রভাবকে এক নিদারুণ ভীতি ও ভয়ংকর চীৎকার ধ্বনির সাথে তুলনা করা যায়, যার কারণে মানুষ ভীত বিহবল চিত্ত ও বিস্ফোরিত নয়নে তার দিকে চেয়েই থাকে, কখনও এই প্রভাব বলয়ের মধ্যে পতিত হওয়ার কারণে তার কাছে সত্য এমনভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তা এড়িয়ে যাওয়ার কোনাে সুযােগই তার থাকে না। রসূলুল্লাহ(স.)-এর মধুর চরিত্রের সংস্পর্শে এসে সুন্দর এক সপ্নিল আশায় মােমেনের মনপ্রাণ ভরপুর হয়ে যায়, পার্থিব যে সংকটাবর্তে ইতিপূর্বে তারা হাবুডুবু খাচ্ছিলাে তা থেকে স্বানন্দে বেরিয়ে আসে। অনাগত দিনের আগমন কামনায় তাদের অন্তর উদ্বেলিত হয়। আবার কখনও একে তুলনা করা যায় সে অবস্থার সাথে যে, সত্যের সংস্পর্শে এসে বিরােধীদের ভ্রুকুটিতে মন যখন বিচলিত হয়ে পড়তে চায়, তখন মনে হয় বন্ধুর গিরিসংকট অতিক্রম করার পর্যায়ে এসে ক্লান্ত পথিকের সামনে সেই হতাশ মুহূর্তে তা যেন অকস্মাৎ আশার এক আলোক রেখা। যেন সংকটাবর্তের গভীরে নিজ চোখে আশার আলাে দেখতে পাচ্ছে। এগুলাের যারা বিরােধিতা করে তাদেরকে পরাজয়ের গ্লানি লজ্জিত করে তােলে, সত্যের এই প্রসারকে তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না, সত্য থেকে গাফেল এই গােষ্ঠি তখন নানা প্রকার প্রতিহিংসায় ফেটে পড়তে চায়। এই বিরােধিতায় যারা সত্যের বিজয়কে গভীর উৎসাহের সাথে অবলােকন করতে থাকে, তাদের সামনে যখন কোরআনের পাঠক তার দিগবিজয়ী দাওয়াতকে তুলে ধরে এবং একজন দায়ী ইলাল্লাহ (সত্যের দিকে আহ্বানকারী) সকল কিছুর বিনিময়ে সত্যের এই সংগ্রামী পথ পরিক্রমায় সফলতা লাভ করে-যখন সত্যের মুঠো মুঠো আলােতে সে নিজে অবগাহন করতে তাকে তখন সমাজ জীবনের ব্যাধিসমূহ এমনিই ধীরে ধীরে অপসারিত হতে থাকে। এ সময় এই সত্য সন্ধিৎসু ব্যক্তি দেখতে পায় কেমন করে কোরআনে পাক সেই বিদ্রোহী ও কঠিন হৃদয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করে চলেছে। সত্যের এই উদাত্ত আহ্বান পেশ করে জাহেলিয়াতের পর্দা উন্মোচনের প্রচেষ্টা চালানাের সাথে সাথে সূরাটি আখেরাতের বাস্তবতাকেও ফুটিয়ে তুলেছে। এই আখেরাত-কেন্দ্রিক জীবন গ্রহণ করতে গিয়ে দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ও কঠিন পথ পরিক্রমের প্রয়ােজন। আখেরাতের বাস্তবতা মেনে নেয়ার জন্যে বিরােধীদের কাছে সূরা আল হাক্কাহ তে প্রচুর যুক্তি পেশ করা হয়েছে। অবশ্য সেখানে আলােচনা এসেছে কিছুটা ভিন্নভাবে, সেখানে সম্পূর্ণ এক নতুন দিক ফুটিয়ে তােলার চেষ্টা করা হয়েছে। সূরা আল-হাক্কাহ-তে আখেরাতের ভয়াল ও বিভীষিকাময় অবস্থার চিত্র আঁকা হয়েছে, কিন্তু এ সূরার আলােচনা এসেছে ভিন্ন পদ্ধতিতে। এখানে নতুন এক দৃষ্টিকোণ এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন একটিবার মাত্র শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে এবং পৃথিবী ও পাহাড় পর্বতও যখন একটিবার ভীষণভাবে দুলে উঠবে সেই দিনই কেয়ামত সংঘটিত হবে এবং তখন সে আকাশ ফেটে পড়বে। সেদিন সেই ভয়ানক অবস্থা সকল কিছুকে শক্তিহীন করে দেবে। পেশ করা হয়েছে, নতুন চিত্র ও মর্মস্পর্শী কিছু নতুন অবস্থা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ‘ফেরেশতারা সেদিন নিজ নিজ স্থানে স্থবির হয়ে পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষমান থাকবে এবং তােমার মালিকের আরশ-কে সেদিন আটজন (ফেরেশতা) তাদের মাথার ওপরে ধরে রাখবে।’ সে অবস্থার বর্ণনা মানুষের চেতনাসমূহকে ভীষণভাবে প্রকম্পিত ও অভীভূত করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘সেদিন তােমাদের সবাইকে হাযির করা হবে, কোনাে আত্মগােপনকারীই সেদিন নিজেকে গোপন রাখতে পারবে না। এভাবে সেই দিনের আযাবের দৃশ্যসমূহ মানুষের মনে এমন ভয় ভীতির সঞ্চার করবে যে এতে তাদের বাকশক্তি রূদ্ধ হয়ে যাবে। হুকুম হবে, ‘পাকড়াও করাে ওকে, কষে বেঁধে ফেলাে তাকে, তারপর ওকে জাহান্নামে ঢুকিয়ে দাও। অতপর ৭০ গজ দীর্ঘ শিকলে আবদ্ধ করে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাও।’ এ বর্ণনায় শাস্তিপ্রাপ্ত এ ব্যক্তিদের চীৎকার হা-হুতাশ ও হাহাকারের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলবে, হায় আফসােস, আমাকে যদি আমার আমলনামা নাই দেয়া হতাে, যদি আমি আমার ভাগ্য-লিখন মােটেই না জানতাম! হায়, আমি যদি (আজ জ্যান্ত মানুষ না হয়ে) মৃত হতাম। এ সূরার মধ্যে কেয়ামতের বিভীষিকার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে সেখানে তাদের চেহারার কি ভয়ানক রূপ হবে তা দেখানাে হয়েছে, কেমন সন্ত্রস্তভাবে তারা হাঁটবে এবং তাদের চলার পথ কতাে ভয়ংকর হবে। এ অবস্থা পৃথিবীর যে কোনাে ভয়ংকর অবস্থা থেকে অনেক বেশী গুণে কঠিন হবে। আসলে সে ভয়ংকর অবস্থার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না, অর্থাৎ যতাে প্রকার ভীতিজনক অবস্থা মানুষ চিন্তা করতে পারে এটা তার থেকেও অনেক কঠিন। আগুন এর শাস্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, তা পায়ের গিরা স্পর্শ করলে তার তাপে মাথার মগ পর্যন্ত টগবগ করে ফুটতে থাকবে। সে বর্ণনা দিতে গিয়ে কোরআনে পাক বলছে, ‘সেদিন আকাশ বিগলিত তামার মতাে হয়ে যাবে এবং পাহাড়-পর্বতগুলাে সব হয়ে যাবে ধুনা তুলার মতো।’ সে সময় অন্তরংগ বন্ধু তার পরম বন্ধুকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। অপরাধী ব্যক্তি সেই কঠিন দিনে নিজের ছেলেকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে তার বিনিময়ে কঠিন আযাব থেকে বাঁচতে চাইবে। শুধু তাই নয়, নিজের জীবন-সংগিনী, ভাই, নিজের এমন আত্মীয় যার কাছে সে (প্রয়ােজনের সময়) আশ্রয় নিয়েছে এবং পৃথিবীর যতাে মানুষ ও সম্পদ আছে সকলের বিনিময়ে হলেও নিজেকে সে শাস্তি থেকে বাঁচাতে চাইবে। জাহান্নামের যে ছবি এখানে তুলে ধরা হয়েছে, তাতে মনে হয় তার নিজস্ব ও স্বতন্ত্র এক গতিশক্তি এবং এক অনুভূতি থাকবে। এ জাহান্নাম জীবন্ত কিছুর মতাে জীবন্ত প্রাণীকে ভীতি প্রদর্শনে সক্ষম হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘জাহান্নামের সে ডগড়গে আগুন গােটা দেহকে ঝলসে দেয়ার পর শরীরের চামড়া ও মাংসকে খসিয়ে দিতে থাকবে। সে ওই ব্যক্তিকে তার দিকে ডাকতে থাকবে যে সত্য থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাে এবং মুখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছিলাে। যে ধন সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখতে এবং তাই নিয়েই সর্বদা মাথা ঘামাতাে ও তাতেই মেতে থাকতো। আর যে আযাবের কথা এখানে বলা হচ্ছে তা অপরাধীদেরকে ঘিরে ফেলবে এবং অকল্পনীয়ভাবে একের পর এক তার ওপর বিপদসমূহ আসতে থাকবে। বলা হচ্ছে ‘সেদিন তারা কবর থেকে এমন দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসবে যেন কোনাে এক লক্ষ্যস্থলে পৌছানাের জন্যে তারা সবাই ছুটে চলেছে। তাদের চোখগুলাে থাকবে ভীত সন্ত্রস্ত এবং হীনতা-দীনতা ও বে-ইযযতির গ্লানিতে তাদের গােটা সত্বা ঢাকা থাকবে, এ দিনের আগমন সম্পর্কে তাদের তাদের কাছে ওয়াদা করা হচ্ছে।’ এ দিনের দৃশ্য, বাস্তব ছবি ও প্রতিবিম্বের যেসব কথা এই সূরাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে তা সূরা আল হাককাহ-এর বর্ণনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু সূরা দুটিতে বর্ণনার ভিন্নতা থাকলেও বিষয়বস্তু মূলত একই। সুখে দুঃখে, সংকটে সচ্ছলতায় এবং ঈমানদার অবস্থায় বা ঈমানহীন অবস্থায় জীবন যাপন করতে গিয়ে একজন মানুষের মধ্যে যতাে প্রকার অবস্থা দেখা দিতে পারে সূরায়ে ‘মায়ারেজ’-এ তার বিশদ বর্ণনা পেশ করা হয়েছে। সাধারণভাবে সকল মানুষের মধ্যে যে অভ্যাসটি একই রকম দেখা যায় তা হচ্ছে। নিশ্চয়ই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ব্যস্ত চরিত্রের সৃষ্টি রূপে, যখন কোনাে দুঃখ কষ্ট বা অকল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন সে পেরেশান হয়ে যায়, আবার যখন কল্যাণ ও শুভদিনের মুখ দেখে তখন কাউকে দান করার ব্যাপারে সে সংকীর্ণ-হৃদয় হয়ে ওঠে, তবে সেই সকল নামাযী, যারা সদা সর্বদা নামাযে যত্নবান তাদের কথা আলাদা।’ তারপর বর্ণনার ধারা সাবলিল গতিতে এগিয়ে চলেছে এবং মােমেনদের গুণাবলী, মন মানসিকতা ও তাদের চলার প্রকাশ্য ও গােপন পথ সম্পর্কে এ সূরাটির মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। মানুষের মধ্যে ভাল ও মন্দ, আল্লাহর অনুগত ও না-ফরমান উভয় প্রকার লােকই বর্তমান থাকে। আল্লাহর অনুগত যারা, সকল যামানায় তাদের বৈশিষ্ট্য গুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যেসব গুণ থাকতে পারে এ সূরার মধ্যে সেগুলোও তুলে ধরা হয়েছে এবং আল্লাহর ভাষায় তা হচ্ছে, তবে সে সকল মুসল্লী যারা নামাযে যত্নবান, তাদের সম্পদের মধ্যে সে সব লােকের হক রয়েছে যারা হাত পেতে কিছু চায় এবং যারা প্রয়ােজনীয় মৌলিক বস্তুসমূহ থেকে বঞ্চিত। (সে সকল ব্যক্তিও সদগুনের অধিকারী) যারা বিচার দিনের সত্যতা মেনে নেয় এবং তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আসা আযাবকে ভয় করে। সূরা আল হাক্কাহ-তে যে মূল বিষয়ের আলােচনা পাওয়া যায় তা হচ্ছে মানুষের আকীদা-বিশ্বাস, মূলত এর ভিত্তিতেই মানুষের সমস্ত কাজ পরিচালিত হয়। তারপর অন্য যে সব বিষয় এখানে আলােচিত হয়েছে তার মধ্যে আখেরাত অন্যতম। এ সূরায় আলােচ্য আরাে কিছু বিষয় হচ্ছে সত্য অস্বীকারকারী এবং সত্যকে প্রত্যাখ্যানকারী ব্যক্তি সম্পর্কে। এরা আখেরাতে ধরা পড়ে যাবে এবং তাদের রেহাই পাওয়ার কোনাে উপায়ই থাকবে না। অপরদিকে সূরা মায়ারেজ-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে আখেরাতের বাস্তবতা তুলে ধরা এবং সেখানে যে প্রতিফল ভােগ করতে হবে সে বিষয়ের প্রামাণ্য চিত্র অংকন করা। আসলে সূরাটির মূল বক্তব্যই হলাে আখেরাত যে সংঘটিত হবেই সকল প্রকার সম্ভাব্য যুক্তির মাধ্যমে তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা। অন্যান্য যতাে কথাই এ সূরার মধ্যে বলা হয়েছে তার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে আখেরাতের সাথে অর্থাৎ আখেরাতকে কেন্দ্র করেই অপর সকল বিষয়ের অবতারণা। আলােচনার মধ্যে আখেরাত অস্বীকারকারীদের প্রতি আল্লাহর পাকড়াও এবং মানুষের তরফ থেকে তাদের ওপর নেমে আসা শাস্তির বর্ণনাও পেশ করা হয়েছে। অতপর এরশাদ হচ্ছে তার কাছে ফেরেশতারা এবং রহ উঠে যায় এমন এক দিনে যেদিন পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান; অতএব সুন্দরভাবে সবর করো, সে (বিষয়)-কে তারা সুদূর পরাহত মনে করে আমি তাে তা দেখছি খুবই কাছে…। একথাগুলাে আখেরাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। ঈমানদার ও বে-ঈমান লােকদের দুঃখ ও সুখের জীবন যাপনের মধ্যে এই ধরনেরই পার্থক্য সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়। এই উভয় প্রকার লােকদেরকেই শেষ বিচারের দিনে নিজ নিজ কাজের বদলা পেতে হবে। সূরার আলােচ্য বিষয়গুলাের মধ্যে এটাও আলােচ্য বিষয় যে, কাফেররা চরম ধােকার মধ্যে রয়েছে, তারা এটা মনে করে খুবই আশান্বিত হয় যে, তারা সবাই (সনাতন ধর্মের ওপর থাকার কারণে) অবশ্যই নেয়ামতে ভরা জান্নাতে যাবে, যতােই তারা অপমানজনক কথা বলুক বা পরকাল সম্পর্কে যতােই উদাসীন থাকুক না কেন। সূরার মূল আলােচ্য বিষয়ের সাথে কাফেরদের এই মিথ্যা আশার কথা পেশ করা এখানে একটি উল্লেখযােগ্য বিষয়। এই সূরা আখেরাতের অন্যান্য তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া থেকে বিরত থেকেছে, অথচ সে বিষয়ের অন্যান্য তথ্য জানার জন্যে পাঠকের হৃদয় মন ব্যাকুল হয়ে থাকে । আর একটি বিষয়ও এ সূরার মধ্যে সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং এখানে দেখা যায় তা নতুন এক ভংগিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা অন্য সূরাগুলাে থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । সূরায়ে ‘আল হাককা এবং এ সূরার বর্ণনায় ভংগির মধ্যে আরাে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান, যদিও আভ্যন্তরীন আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আলােচ্য বিষয় একই। সূরা মায়ারেজ-এর এ বর্ণনায় বৈচিত্র রয়েছে, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, শুধু বাক্যের ছন্দের মিলই নয় বরং প্রতিটি শব্দও অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এখানে সজ্জিত রয়েছে। এখানে প্রতিটি বাক্যের মধ্যে যে ভারসাম্য পরিলক্ষিত হয় তা অন্য যে কোনাে সূরার তুলনায় অনেক বেশী ব্যাপক। সূরাটির প্রথমার্ধে আরাে কিছু বর্ণনা বৈচিত্র অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রথমার্ধের শুরুর তিনটি বাক্যের দিকে তাকালে সূরাটির বর্ণনা বৈচিত্রের প্রথম বৈশিষ্ট্যটি বুঝা সহজ হবে। এখানে দেখা যায়, বাক্যের মধ্যে আলােচিত কথাগুলাে তার সমাপনী কথার দৈর্ঘের সাথে ও নিম্ন বর্ণিত কিছু বিষয়ের সাথে পরিপূর্ণভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। এরশাদ হচ্ছে, ‘জিজ্ঞাসা করলাে এক ব্যক্তি সে আযাব সম্পর্কে যা কাফেরদের জন্যে নির্দিষ্ট রয়েছে এবং যাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার মতাে কেউ নেই।'(আয়াত ১-২) পঞ্চম আয়াতের শেষে সবর-এর কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘ টান দেয়ার মতাে ‘আলিফ’ ব্যবহার করা হয়েছে। ওরা তাে দেখছে সে দিনটি অনেক দূরে, আর আমি দেখছি সে দিনটিকে অত্যন্ত কাছে।’ এখানেও দ্বিতীয় বারের মতা দীর্ঘ আলিফ’ ব্যবহার হয়েছে। সে দিন আকাশ হবে বিগলিত (তরল) তামার মতো, আর পাহাড়গুলাে হবে ধুনা তুলার মতাে এবং সে দিন কোনাে অন্তরংগ বন্ধুই তার বন্ধু সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না-কেউ কারাে খোজ খবরও নেবে । এখানেও তৃতীয়বারের মত দীর্ঘ ‘আলিফ’ দ্বারা বাক্য শেষ করা হয়েছে, আয়াতের অভ্যন্তরে কিন্তু একই ধরনের শব্দ বা বর্ণনাভংগী ব্যবহার করা হয়নি। আযাব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে আযাবের দৃশ্যগুলাে যখন তাদেরকে দেখানাে হবে তখন অপরাধী সেই কঠিন অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে নিজের ছেলেকে মুক্তিপন হিসেবে সােপর্দ করতেও প্রস্তুত হয়ে যাবে। এখানেও দেখা যায় প্রথম বারের মতাে দীর্ঘায়িত ‘আলিফ’ দ্বারা বাক্য শেষ করা হয়েছে। সে ভয়ানক আগুন ঝলসিয়ে দিয়ে শরীরের চামড়া ও রক্ত মাংসকে খসিয়ে দিতে থাকবে, ডাকতে থাকবে সে ব্যক্তিকে যে (সত্যকে) পেছন (ফেলে) চলে গিয়েছিলাে এবং সত্য গ্রহণ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। (আয়াত ১৫-১৭) এ সূরার মধ্যে যে পাঁচ জায়গায় দীর্ঘায়িত ‘আলিফ’ রয়েছে সেখানকার দুটি সমাপনী আলিফ-এর উচ্চারণ প্রথম তিনটি আয়াতের উচ্চারণ থেকে আবার একটু ভিন্ন। এরপর সূরার অবশিষ্ট আয়াতগুলােতে দেখা যায় মীম এবং নূন দিয়ে শেষ করা হয়েছে এবং এগুলাের প্রায় সবগুলাের পূর্বেই ওয়াও অথবা ইয়া এসেছে। আর একটি বৈশিষ্ট এ সূরার শুরুতে রয়েছে যা সূরাটিকে অত্যন্ত গােছালাে এবং এর বর্ণনা পরস্পরাকে চমৎকারভাবে সামঞ্জস্যশীল বানিয়ে দিয়েছে এবং তা হচ্ছে, যে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, সে ঘটনা সংঘটিত হবেই। যে কোনাে শ্রোতার মনে একথাটি দৃঢ় প্রত্যয় জাগায়। তৎকালীন আরব পরিবেশে যে ধর্ম-বিশ্বাস বিরাজ করছিলাে তাতে পরকালের আযাবের কথা বলা যেমন কোনাে পরিচিত বিষয় ছিলাে না, তেমনি আরববাসীদের কানগুলােও এমন কোনাে কথা শুনতে এবং তার প্রভাব গ্রহণ করতে মােটেই অভ্যস্থ ছিলাে না। এ অবস্থায় আখেরাতের আযাব সম্পর্কে কোরআন অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে মানুষকে এমন কিছু কথা জানিয়েছে যা তৎকালীন আরাসীরা সাধারণভাবেই গ্রহণ করতে পেরেছে, যদিও তারা যেভাবে জীবন যাপন করছিলাে তাতে এ দাওয়াত তাদের কাছে ছিলাে নতুন এবং অপরিচিত। এবার আমরা সূরাটির ওপর বিস্তারিত আলােচনা করতে চাই। (উৎসাহীদের এ ব্যাপারে ‘আত্তাসওয়ীরুল ফান্নী ফিল কোরআন’ পুস্তকের ‘আত তানাসুকুল ফান্নী ফিল কিতাব’ অধ্যায় দেখার জন্য অনুরােধ করছি)।
ফী জিলালিল কুরআন:   *আখিরাত সম্পর্কিত প্রশ্ন : ‘একজন প্রশ্নকারী সে আযাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাে, যা অবশ্যই আসবে। সে আযাব আসবে কাফেরদের ওপর, যা রােধ করার কেউ থাকবে না।’ আরবের মােশরেকদের কাছে আখেরাত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারটি সঠিকভাবে অনুভব করানাে আসলেই দুরূহ ব্যাপার ছিলাে। কেউ কেউ এ সম্পর্কে চিন্তা করতাে, এটাকে সম্পূর্ণ একটা নুতন কথা বলে মনে করে কেউ কেউ আশ্চর্য হয়ে এ সম্পর্কিত কথাবার্তা শুনতাে, তারা প্রায়ই আখেরাত সম্পর্কিত কথাগুলােকে অস্বীকার করতাে, তারা রসূল(স.)-কে বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছিলাে-ওয়াদা করা আযাবকে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে আসার জন্যে। আবার কখনও প্রশ্ন করছিলাে কখন এটা সংগঠিত হবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আযাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাে সে ছিলাে নাযার ইবনুল হারেস। একই বর্ণনাকারী থেকে আর একটি রেওয়ায়াত পাওয়া যায়, তাতে বলা হয়েছে, আল্লাহর আযাব সম্পর্কে সাধারণভাবেই কাফেররা প্রশ্ন করতাে যে, কখন এটা সংঘটিত হবে। সূরাটির মধ্যে বলা হয়েছে যে এক ব্যক্তি আখেরাত সংঘটিত হওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাে এবং দাবী করছিলাে যে ‘সেই আযাবকে জলদী করে নিয়ে আসা হােক’ এর জবাবে বলা হয়েছে, আসবে সে আযাব নির্দিষ্ট সময়ে, যাকে কেউই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এর দ্বারা সেই ব্যস্ত স্বভাবের মানুষ নিজের জন্যে পরিষ্কারভাবে একটা ধ্বংসই ডেকে আনছিলাে। এ আযাব হবে সাধারণভাবে কাফেরদের জন্যে। এর অন্তর্গত হবে তারাও যারা এই আযাবকে অস্বীকার করার মনােভাব নিয়ে আশ্চর্য হয়ে নানা প্রকার প্রশ্ন তুলত। ‘এ আযাব তাে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই নাযিল হয়েছে যিনি সমুন্নত মর্যাদার অধিকারী।’ সিঁড়ির মালিক বলতে আল্লাহর বড়ত্ব এবং উঁচু মর্যাদার কথা বুঝানাে হয়েছে, যেমন অন্য একটি সুরায় বলা হয়েছে, “তিনি বিভিন্ন স্তরের মর্যাদাবৃদ্ধিকারী এবং আকাশের মালিক। এইভাবে সূরাটির সূচনাতে চূড়ান্ত কথার মাধ্যমে আযাবের বিষয়টি যে বাস্তব সত্য তার প্রমাণ হাযির করা হয়েছে এবং কে তার ভাগী হবে তাও স্পষ্ট করে জানানাে হয়েছে। আরও বলা হচ্ছে, কার কাছ থেকে তা হঠাৎ করে এসে পড়বে এবং যার কাছ থেকে তা আসবে তার মর্যাদা কত বড়। তাঁর উঁচু মর্যাদার এটা একটা দিক যে তার ফয়সালা হবে খুব উঁচু এবং সে ফয়সালা আসবেই। সে ফয়সালাকে ফিরিয়ে দেয়ার বা বাতিল করে দেয়ার মতাে ক্ষমতা কারােই থাকবে না। যাদের ওপর সেই আযাব আসবে এবার তাদের কথা বলা হচ্ছে, তারা হচ্ছে, সেই সব লােক যারা এ আযাবের ব্যাপারে খুবই ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। (তারা বলছে কেন আসে না সে আযাব, জলদি নিয়ে এসাে তা, কিন্তু তারা জানে না যে,) সে আযাব তাদের খুব কাছেই আছে। বরং সকল সত্যের বড় সত্য হচ্ছে যে আল্লাহর ফয়সালা বান্দার ফয়সালার চাইতে বড়, তার মাপকাঠিও ওদের মাপকাঠি থেকে ভিন্ন।
ফী জিলালিল কুরআন:   *একটি দিন হবে ৫০ হাজার বছরের সমান : ‘তাঁর কাছে ফেরেশতারা এবং পবিত্র আত্মা (রূহ-জিবরাঈল) উঠে যায় এমন একটি দিনে যার দৈর্ঘ্য পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। অতএব উত্তমভাবে সবর করাে। সে আযাবকে তারা অনেক দুরে ভাবছে, কিন্তু আমি তাে দেখছি তা খুব কাছে।’ সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য কথা এটাই যে, যে দিনের কথা এখানে বলা হয়েছে সেই দিনেই ফেরেশতারা ও পবিত্র রূহ, জিবরাঈল(আ.) উর্ধাকাশে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে পৌছুবেন। এমন একটি দিন যার দৈর্ঘ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। রূহ বলতে এখানে জিবরাঈল(আ.)-কেই যে বুঝানাে হয়েছে। সেই অর্থই অধিকতর গ্রহণযােগ্য, যেমন অন্যত্র এই নামেই তার কথা উল্লেখিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ফেরেশতাদের কথা বলার পর তার কথা পৃথকভাবে বলায় তার বিশেষ মর্যাদা সম্পর্কে জানা যায় । আবার সেই দিনে ফেরেশতাদের ও পবিত্র আত্মার আরােহন করার কথা আলাদা করে বলায় সেই দিনেরও আলাদা বৈশিষ্ট নিরূপিত হয়েছে। সেই দিনে তাদের উর্ধমূখে আরােহণ করাটাও সেই দিনের বিশেষ কাজগুলোর অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের মধ্যেও একটি। আসলে এই বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সঠিকভাবে কিছুই জানিনা, আর তার গুরুত্ব সম্পর্কে না জানার জন্যে আমাদেরকে দায়ী করা হবে না। ফেরেশতারা সেখানে কেমন করে উঠবেন এবং উঠে কোথায় পৌছুবেন তাও আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না। এ সব বিষয় হচ্ছে গায়ব (অদেখা জিনিস)-এর ব্যাপার। এ ব্যাপারে আল্লাহর এ বাণীর মূল রহস্য আমাদের পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়, আল্লাহর এসব জ্ঞানগর্ভ কথার রহস্য বুঝার কোনাে উপায়ও আমাদের কাছে নেই। এসব বিষয়ের কোন দলীল প্রমাণও আমাদের হাতে নেই। সুতরাং এসব দৃশ্যের বর্ণনা থেকে আমরা সেই দিনের গুরুত্বই অনুধাবন করতে পারি মাত্র; যেহেতু সেই ফেরেশতারা এবং পবিত্র আত্মা (জিবরাঈল) উর্ধাকাশে আরােহণ করার ব্যাপারে সেদিন সক্রিয় হয়ে উঠবেন এবং তাদের এই ভূমিকাই এ মহান দিনের অন্যতম বৈশিষ্ট হবে। সেই দিনের বৈশিষ্ট জানাতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘দিনটি দৈর্ঘ্যে হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।’ একথা দ্বারা সেই দিনের দৈর্ঘ্যের দিকে ইংগীত করা হয়েছে এবং আরবী ভাষায় সময়ের দৈর্ঘ্য বুঝানাের জন্যে এই ধরনের পরিভাষা ব্যবহার করার রীতি চালু আছে। এর দ্বারা একটি সুনির্দিষ্ট সত্যকে বুঝানাে হয়েছে মাত্র। এদিনের পরিমান বা দৈর্ঘ্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে পৃথিবীবাসীদের গণনা মতে ‘পঞ্চাশ হাজার বছর’ সংখ্যাটি একটি দীর্ঘ সময়ের জন্যেও ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা পৃথিবীতে যে দিন গণনা করি তার দৈর্ঘ্য হচ্ছে চব্বিশ ঘন্টা এবং এই চব্বিশ ঘন্টার দিনকেই মাপকাঠি হিসেবে এখানে ধরা হয়েছে। এইভাবে তারকারাজির আবর্তনের দৈর্ঘ্যের পরিমাণ নির্ণয় করতে গিয়েও আমাদের ব্যবহৃত হাজার হাজার ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং একেবারে পঞ্চাশ হাজার বছর সুনির্দিষ্টভাবেই হতে হবে তা জরুরী নয় । এ সত্যটিকে আমি এই জন্যে উল্লেখ করলাম যে, এতে করে আজকের এক দিনের সাথে সেই দিনের একটা পার্থক্য স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। আবার যখন আল্লাহর দিনগুলাের মধ্যকার একটি দিন পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান হবে বলে তারা জানতে পারছে সে সময় তারা সে দিনটিকে বা সেই দিনের আযাবকে আবার বহু দূরে দেখতে পাচ্ছে বলে মনে করছে, অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা বলছেন সে ভয়ানক দিনটি খুব কাছে। সেই অবস্থাতেই আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে উত্তমভাবে সবর করতে বলছেন।
ফী জিলালিল কুরআন:   *দাওয়াতের কাজে ধৈৰ্য্য অপরিহার্য : ঠিক যখন- তারা আযাবকে অস্বীকার ও উপেক্ষা করছে সেই মুহূর্তে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব তুমি উত্তমভাবে সবর করাে, ওরা সেই দিনকে দূরে দেখছে, কিন্তু আমি দেখছি তা খুব কাছে।’ সবর করার আহবান এবং আল্লাহর দিকে রুজু করার জন্যে জনগনের মনােযােগ আকর্ষণ করা সকল দাওয়াতেরই মূলকথা। প্রত্যেক রসূলকেই এই একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর রসূলের অনুসারী প্রত্যেক মােমেনের জন্যেও সেই একই নির্দেশ রয়েছে। প্রতিটি কঠিন ও ক্লান্তিকর অবস্থার মধ্যে এই সবই হচ্ছে জরুরী জিনিস, যা মানব মন্ডলীকে রক্ষার জন্যেও প্রয়ােজন। প্রসন্ন বদনে সবর করতে পারলেই দূরবর্তী লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার আশা করা যায় এবং আদিগন্ত পরিব্যাপ্ত সাফল্যের অধিকারী হওয়া সম্ভব হয়। দুশ্চিন্তাহীন ধৈর্য! আর সবরে জামীল’ অর্থাৎ সুন্দর সবর হচ্ছে নিশ্চিন্ততা-দানকারী সবর যার সাথে কোনাে ক্রোধ, কোনাে অস্থিরতা, কোনাে সন্দেহ জড়িত থাকে না, এমন সবর যার পরিণতি সুন্দর ও নিশ্চিত, সবরকারী ব্যক্তি সত্য পথে টিকে থাকার সংকল্পে অবিচল এবং ধৈর্য অবলম্বনের শুভ পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত, আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য লিখনে সে সন্তুষ্ট। যে কোনাে পরীক্ষার মধ্যেই যে আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন-তা সে গভীরভাবে অনুভব করে, একদিন সে তার কাছেই পৌছুবে। যা কিছু সুকীর্তি তার আছে এবং যা কিছু সে করছে সকল ব্যাপারেই তাকে হিসাব দিতে হবে বলে সে বিশ্বাস করে। এখানে ‘সবর’-এর এই গুনটি বিশেষ ভাবে ইসলামী দাওয়াতের কর্মীদের মধ্যে থাকা একান্ত প্রয়ােজন। কেননা সবর করার দাওয়াত হচ্ছে জনগণের কাছে আল্লাহর দাওয়াত, আর ইসলামের দাওয়াত বলতে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান জানানােই বুঝায়। এই দাওয়াতে তার নিজের কোনাে স্বার্থ নেই এবং এই দাওয়াত দান করার মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত কোনাে উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সুযােগও নেই। এর মাধ্যমে আল্লাহর পথে কাজ করা ব্যতীত অন্যকিছু সে আশাও করে না। একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কেই সে মানুষকে জানাতে থাকে। সুতরাং এই কাজ করতে গিয়ে সে যে সুন্দর ধৈর্য ও অবিচলতা প্রদর্শন করে, তা তার দাওয়াতী কাজের জন্যে অত্যন্ত উপযােগী এবং তার বিবেকের গভীরে এই সবর-এর প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন এই দাওয়াতের মূল কেন্দ্র। তার দিকেই মানুষকে ডাকা হয়। সত্যকে অস্বীকারকারী কাফেররা এই দাওয়াতের পথে প্রবল বাধা সৃষ্টি করে। আযাবের ওয়াদা-প্রদানকারী আল্লাহু তায়ালার কাছে তারা জলদী করে আযাব পাঠানাের দাবী জানায়, ‘আসলে আযাব যে আসবে একথাটাকে তারা একটা মিথ্যা বলে মনে করে। যাবতীয় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই সে সব বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং কোন সময়ে সেগুলাে ঘটবে সে সময়ও আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে। গােটা বিশ্বের প্রয়ােজনকে সামনে রেখে তার জ্ঞান ও সুকৌশলপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সে ঘটনাগুলাে ঘটতে থাকে। কিন্তু মানুষ তার ব্যবস্থাপনা ও পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত না জানা ও না বুঝার কারণে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার কোনাে উদ্দেশ্য সফল হতে বিলম্ব হলে তার সাফল্য সম্পর্কে সে সন্দিহান হয়ে যায়। এর ফলে দাওয়াত দানকারীদের অন্তরের মধ্যেও কিছুটা পেরেশানী এসে পড়ে। এ কারণে তাদের মধ্যে প্রতিশ্রুত মনযিলে মকসূদে পৌছানাের আকাংখা, আগ্রহ ও ব্যস্ততা দেখা যায়। এমনই পর্যায়ে এসে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্যে সান্তনার-বাণী দান করা হয় ‘অতএব, সুন্দর ভাবে সবর করাে’ নিজ লক্ষ্যে পৌছানাের সংগ্রামে অবিচল থাকে। এর মাধ্যমে রাসূল(স.)-এর অন্তরকে এ কঠিন দুঃসময়ে শক্তি যােগানাে হয়েছে, বিশেষ করে যখন তিনি চরম বিরােধিতা ও উপেক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তার কথাগুলােকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছিলাে। সেই সময় আল্লাহ তায়ালা এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যে, মানুষ যা ভাবে তা হয় না, হয় তাই যা আল্লাহ তায়ালা করতে চান এবং যে কর্মকান্ডের ভাল মন্দের ব্যাপারে তার মাপকাঠিগুলােই সঠিক, মানুষের সংকীর্ণ-দৃষ্টিসম্মত মাপকাঠি কস্মিনকালেও সঠিক নয়। এরশাদ হচ্ছে ‘ওরা দেখছে সে দিনটিকে অনেক দূরে, আর আমি দেখছি সে দিনটিকে খুবই কাছে।’
ফী জিলালিল কুরআন:   *কেয়ামতের কিছু খণ্ড চিত্র : তারপর আল্লাহ তায়ালা এ দিনটিকে বুঝার জন্যে বিশ্বের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে বহু দৃশ্য ছড়িয়ে রেখেছেন, আর তা বুঝার জন্যে মানুষকে দিয়েছেন সুতীব্র এক অনুভূতি। এই দৃশ্যগুলাে যেমন ভীতিপ্রদ, তেমনি সারা বিশ্বের বুকে এবং খােদ মানুষের অন্তরের মধ্যে সমানভাবে প্রকম্পন-সৃষ্টিকারী। এরশাদ হচ্ছে ‘যে দিন মহাকাশ বিগলিত তামার মতাে হয়ে যাবে আর পাহাড় পর্বতগুলাে ধুনা তুলার মতাে হয়ে যাবে।’ ‘মুহল’ বলতে বুঝায় খনির কর্দমাক্ত বা আবর্জনাযুক্ত গলিত লাভা। তেলের গড়ানিকেও মুহল বলে। আর ইহনুন অর্থ পশম ধুনা। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে যে সব বর্ণনা এসেছে তাতে বুঝা যায়, বিশ্বজোড়া মহাবিপর্যয় সার্বিকভাবে সেই দিনেই সংঘটিত হবে। সে সময় সারা জাহানব্যাপী একটা পরিবর্তন দেখা দেবে, সব কিছুর পারস্পরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। গ্রহ নক্ষত্রর একটার সাথে অন্যটার যে যােগাযোগ আজ বিদ্যমান রয়েছে সে সব কিছু থেমে যাবে। সে দিন যে পরিবর্তনগুলাে সংঘটিত হবে সেগুলাের মধ্যে এটাও একটি যে, আকাশকে দেখা যাবে গলিত তামার মতাে। এসব বর্ণনা প্রকৃতি বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদদের জ্ঞান-গবেষণার জন্য অত্যন্ত সহায়ক বিষয়। এ সকল বিজ্ঞানীদের মতে সেই মহা-প্রলয়ের দিন আকাশের মধ্যেকার গ্রহ নক্ষত্রগুলাে তরল পদার্থে পরিণত হওয়ার পর বায়বীয় বা গ্যাসের আকার ধারণ করবে; অতপর আরও কয়েকটি বিবর্তনের মাধ্যমে প্রবাহমান তরল অবস্থায় পৌছে যাওয়ার পরই এটা সংঘটিত হবে। কেয়ামতের দিন সব কিছু জ্যোতিহীন হয়ে যাবে। যেমন পুনরায় বলা হয়েছে, আর যখন তারকারাজি জ্যোতিহীন হয়ে যাবে। এর পরে হয়তাে সব কিছু ঠান্ডা হয়ে যাবে এবং সব কিছু পুনরায় বায়বীয় পদার্থের রূপ নেবে, আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। এ সব হচ্ছে সম্ভাবনা। তবে যারা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়ােজিত তাদের জন্যে এসব বর্ণনাকে সামনে রেখে যখন কিছু লিখতে শুরু করি এবং আশপাশের সকল কিছুর দিকে যখন সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে আমরা তাকাই তখন সত্যিই আমরা অবাক বিষ্ময়ে অভীভূত হয়ে যাই। এখানে কোরআন অত্যন্ত চমৎকার ও প্রাণস্পর্ষী বর্ণনা পেশ করছে, ‘সেই দিন কোনাে বন্ধু তার বন্ধুর খোঁজ খবর নেবে না।’ তাদেরকে সেই সময়কার সকল দৃশ্যই দেখানাে হবে। সেদিন প্রত্যেক অপরাধী ব্যক্তিই চাইবে নাজাত পেতে, তাতে যদি তার পুত্র-সন্তানকে মুক্তিপন দেয়ার প্রয়ােজন হয় তাও দেয়ার জন্যে সে প্রস্তুত হয়ে যাবে, তার প্রিয়তমা জীবন সাথীকে দিয়ে দিতে রাযি হবে, তার গােষ্ঠির লােকজন যারা তাকে সারাটি জীবন আগলে রেখেছে তাদের সবাইকে পরিত্যাগ করতে রাযি হবে, এমনকি পৃথিবীর সমুদয় অর্থ সম্পদের মালিকও যদি সে হতাে, তাও সেদিনের সে মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মুক্তিপন হিসেবে দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। সব কিছুর বিনিময়েও যদি নাজাত লাভ করা যায় তাও সে পেতে চাইবে। গুরুত্ব সহকারে এগুলাের আলােচনা দ্বারা একথাই বুঝানাে হয়েছে যে, সে সময়ের লােকদের মাঝে কৃপণতা, লালসা, কুফুরীর প্রতি ঝোঁক প্রবণতার অভ্যাস বিদ্যমান ছিলাে। আরাে ছিলাে নবীকে উপেক্ষা ও মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার প্রয়াস এবং গােমরাহীর প্রতি ঝুঁকে থাকার প্রবণতা, আর এ সকল অবস্থার মােকাবেলায় নবীকে ইসলামী দাওয়াত পেশ করার কাজ করতে হয়েছে। এই দাওয়াতের প্রসারকল্পে বারবার এক কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সময় থাকতেই তাদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক ও ভীতি প্রদর্শন দ্বারা সাবধান হওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কুফুরী ও আল্লাহর সাথে কারাে শরীক করার পরিণামে তাদের জন্যে যে কঠিন শাস্তি অবধারিত রয়েছে তাও জানানাে হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন:   *ইসলামী দাওয়াত অস্বীকারের কারণ : এই সূরার মধ্যে আরও কিছু ইশারা ইংগীত পাওয়া এগুলাে সবই তকালীন মক্কার পরিবেশে মজুদ ছিলাে। সেখানে সাধারণভাবে লােকেরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সূদী কারবার করে ধন সম্পদ সঞ্চয় করত, আর কুরাইশদের দলপতিরাই ছিলাে এর প্রধান হােতা। শীত ও গ্রীষ্মের দুটি মৌসুমে যে কাফেলাগুলাে বাণিজ্য যাত্রা করতাে তাদের মধ্যেও প্রধানত কোরায়শ সর্দার বা তাদের প্রতিনিধিরাই থাকতাে বেশী। সেখানে ধন সম্পদ বৃদ্ধির জন্যে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতাে। সম্পদ বৃদ্ধির লােভ ও তাদের অন্তরের সংকীর্ণতা অভাবগ্রস্তদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বঞ্চিত করতাে। এতীমদের সর্বনাশ সাধন করতাে। এই কারণেই কোরআনে কারীমের বিভিন্ন স্থানে এই বিষয়টি বারবার উল্লেখ করে এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। আল কোরআন এই লােভ ও লালসাকে দমন করার অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে। মক্কা বিজয়ের আগে ও পরে লােভ-লালসার টানাপােড়েনে থাকার কারণে সত্যপথ গ্রহণ করতে মানুষ যে বিলম্ব করছিলাে সে বিষয়েও কোরআনে পাক বিশদ আলােচনা করেছে। এগুলাের মধ্যে স্পষ্টভাবে যে জিনিসটি নযরে পড়ে তা হচ্ছে সূদী কারবার। সে বিষয়ে কোরআনের বহু সতর্কবাণী এসেছে। তৎকালীন আরব সমাজে মানুষের ধন-সম্পদ মেরে খাওয়ার প্রবণতা এবং বিশেষভাবে এতীমদের অসহায়ত্বের সুযােগ নিয়ে তাদেরকে সর্বশান্ত করে দেয়া ও তাদের ধন-সম্পদ দ্বারা নিজেদের পুঁজির পাহাড় গড়া ইত্যাদির আলােচনা এসেছে। এর পাশাপাশি এতীম মেয়েদের প্রতি জুলুম এবং তাদের সম্পদের লােভে তাদেরকে জোর করে বিয়ে করতে চাওয়া, দরিদ্র-অভাবগ্ৰস্ত যারা অভাবে পড়ে হাত পাততে বাধ্য হয় তাদেরকে ধমক দেয়া, এতীমদের প্রতি নির্দয় ব্যবহার করা এবং বাস্তুহারা নিঃস্ব ব্যক্তিদেরকে কিছু দিতে অস্বীকার করা ইত্যাদি নিষ্ঠুর আচরণ তৎকালীন আরব-পরিবেশকে বিষাক্ত করে ফেলেছিলাে। সুতরাং তাদের মন মানসিকতার মধ্যে আমুল পরিবর্তন আনা এবং সকল পরিস্থিতিতে মানবতার উন্নয়ন সাধনের চেষ্টা করা প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিলাে। সম্পদের মােহব্বত এবং অর্থবৃদ্ধির লালসার ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্তরের সংকীর্ণতা বৃদ্ধি পায়। সম্পদের দিকে পরিপূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়া এমন একটি অবস্থা, যা মানুষের গলায় মরণ ফাঁদের মতাে ফাঁস পরিয়ে দেয়। তাই এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে প্রবল প্রচেষ্টা ও ক্রমাগত সংগ্রাম প্রয়ােজন। অর্থগৃধনুতার ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্যে একটা দীর্ঘ চিকিৎসা জরুরী। এ পর্যন্ত এসে সে ভয়ংকর দিনের ছবি পেশ করা সমাপ্ত হলাে। কি কঠিন আযাব সে দিন আসবে তাও এখানে আলােচনা করা হলাে।

১-১৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
১-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

سَأَلَ سَآئِلٌ (একজন জিজ্ঞাসকারী) এ জিজ্ঞাসকারী কে তা নিয়ে ইমাম শাওকানী (রহঃ) কয়েকটি মত নিয়ে এসেছেন। মতগুলোর মধ্যে সঠিক কথা হচ্ছে : সে নজর বিন হারেস। সে বলল : যে আযাব আমাদের ওপর আসার কথা তা আসুক। আল্লাহ তা‘আলা তার কথা তুলে ধরে বলেন :

وَإِذْ قَالُوا اللّٰهُمَّ إِنْ كَانَ هٰذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَا۬ءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ

“স্মরণ কর! যখন তারা বলছিল, ‘হে আল্লাহ! এটা যদি তোমার পক্ষ হতে সত্য হয়, তবে আমাদের ওপর আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও।” (সূরা আনফাল ৮ : ৩২) এ লোকটি বদরের দিন বাধা অবস্থায় নিহত হয়েছে।

لَيْسَ لَه دَافِعٌ

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যখন কাফিরদের ওপর আযাব দিতে চাইবেন তখন তা কেউ ঠেকাতে পারবে না। তা অবশ্যই ঘটবে। অতএব যে আযাব দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পাকড়াও করবেন তা হতে পারে দুনিয়াতেই অথবা আখিরাতে। (তাফসীর সা‘দী)

যেমন দুনিয়াতে বদরের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করলেন।

(تَعْرُجُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ وَالرُّوْحُ)

মহান আল্লাহ যার দিকে ফেরেশতারা ঊর্ধ্বগামী হয় এবং রূহ ঊর্ধ্বগামী হয়। এখানে الرُّوْحُ রূহ বলতে মানুষের আত্মা হতে পারে অথবা জিবরীল (আঃ) হতে পারেন। (ইবনু কাসীর)।

এ আয়াত প্রমাণ করছে আল্লাহ তা‘আলা সসত্ত্বায় সর্বত্র বিরাজমান নন। তিনি যদি সর্বত্র বিরাজমান হতেন তাহলে ফেরেশতাসহ রূহের ঊর্ধ্বগামী হওয়ার কোনই প্রয়োজন ছিল না। যেখানে সেখানে আল্লাহ তা‘আলাকে পাওয়া যেত। (শারহু আকীদাহ ওয়াসিতিয়া)

كَانَ مِقْدَارُه خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ

আল্লামা ইবনু কাসীর (রহঃ) এ আয়াতের তাফসীরে চারটি কথা তুলে ধরেছেন। যথা-

১. ৫০ হাজার বছরের সমপরিমাপ দ্বারা আরশে আযীম থেকে সপ্ত জমিন (পাতাল) পর্যন্ত যে দূরত্ব তার পরিমাপ বুঝোনো হয়েছে। সাত জমিনের এক জমিন থেকে অন্য জমিনের দূরত্ব ৫০০ বছরের সমান, আর প্রত্যেক জমিনের পূরুত্ব ৫০০ বছরের দূরত্বের সমান। এখানে মোট দূরত্ব হল : ৭০০০ বছরের দূরত্ব। আবার প্রত্যেক আকাশের পূরুত্ব ৫০০ বছরের দূরত্বের সমান। এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব ৫০০ বছরের দূরের সমান। এখানে মোট দূরত্ব ৭০০০ বছরের সমান। আর সাত আকাশ ও আরশের মাঝে দূরত্ব ৩৬ হাজার বছরের দূরত্বের সমান। তাহলে মোট দূরত্ব (৭০০০+৭০০০+৩৬০০০)=৫০০০০ বছরের দূরত্ব।

২. এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল : পৃথিবী সৃষ্টির সূচনা থেকে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মোট পৃথিবীর বয়স।

৩. এর দ্বারা উদ্দেশ্য দুনিয়া ও আখিরাতের পার্থক্যসূচক একটি দিনের পরিমাপ।

৪. এটা হল কিয়ামতের দিনের পরিমাপ। অর্থাৎ কাফিরদের ওপর হিসাবের এ দিনটি ৫০ হাজার বছরের মত বড় মনে হবে। কিন্তু মুমিনের জন্য এক ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করার চেয়েও কম সময় মনে হবে। ইবনু কাসীর (রহঃ) চতুর্থ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ এর সমর্থনে হাদীস রয়েছে যাতে বলা হয়েছে : কিয়ামতের দিন তোমাদের গণনানুযায়ী ৫০ হাজার বছরের সমান হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ২৬, অধ্যায়/৯৮৭)

(فَاصْبِرْ صَبْرًا)

অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুমি ধৈর্য ধর তাদের কথায় মনক্ষুণœ হয়ো না। যদিও তারা মনে করছে কিয়ামত অনেক দূরে কিন্তু আমার কাছে তা অনেক নিকটে। অতএব অচিরেই তাদেরকে শাস্তিতে নিপতিত করব।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে। এর ওপর ঈমান আনতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা সপ্ত আকাশের ওপরস্থিত আরশে আজীমে সমুন্নত আছেন। স্বসত্ত্বায় সর্বত্র বিরাজমান নন।
৮-১৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :-

(یَوْمَ تَکُوْنُ السَّمَا۬ئُ کَالْمُھْلِ… وَجَمَعَ فَاَوْعٰی)

এ আয়াতগুলোতে কিয়ামতের পূর্বে আকাশ-জমিন ও উভয়ের মধ্যস্থিত বস্তুর যে অবস্থা হবে তার বিবরণ এবং অপরাধীরা জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সন্তান, স্ত্রী, ভাই এমনকি পৃথিবীর সব কিছু দিতে প্রস্তুত থাকবে কিন্তু তার বিনিময়েও শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না সে বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

الْمُهْل অর্থ : ইবনু আব্বাস (রাঃ)-সহ প্রসিদ্ধ মুফাসসিরগণ বলেছেন :

دردي الزيت

বা তেল গলানোর পর নিচে যে সরিষার আঁশ/বস্তু (খইল) পড়ে থাকে তাই হল دردى الزيت। কিয়ামতের দিন আকাশ এরূপ হয়ে যাবে।

الْعِهْن ঘরের ভেতর ছিদ্র দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করলে আলোতে যে ধূলিকণা উড়তে দেখা যায় তাই-ই হল الْعِهْن। কিয়ামতের দিন পাহাড়সমূহ এরূপ হয়ে যাবে। حَمِيْمٌ বলা হয় অন্তরঙ্গ বন্ধুকে।

يُّبَصَّرُوْنَهُمْ

অর্থাৎ যদিও একজন অন্যজনকে প্রত্যক্ষ করতে পারবে কিন্তু সবাই নিজ চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে, কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করবে না।

ثُمَّ يُنْجِيْهِ অর্থাৎ দুনিয়াতে স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ ইত্যাদি তার কত প্রিয় ছিল কিন্তু আখিরাতে এ সবের কোন মূল্যই থাকবে না। এ সব কিছূু দিয়ে হলেও সে বাঁচতে চাইবে। কিন্তু সে কখনো বাঁচতে পারবে না।

فَصِيْلَتِهِ অর্থ : গোষ্ঠি, জাতি।

لَظٰي হল জাহান্নামের একটি নাম। এ অংশের প্রখরতা খুব বেশি, ফলে চামড়া পুুড়ে শরীর থেকে খসে যাবে।

(تَدْعُوْا مَنْ أَدْبَرَ وَتَوَلّٰي)

অর্থাৎ জাহান্নাম তাকে ডাকবে সত্য দীন গ্রহণ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে বলে।

(وَجَمَعَ فَأَوْعٰي)

অর্থাৎ সম্পদ জমা করে রাখত যাকাত দিত না-এমনসব ব্যক্তিদের জন্য জাহান্নামের এরূপ শাস্তি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এমন অবস্থা থেকে মুক্তি দান করুন। আমীন!

(اِنَّ الْاِنْسَانَ خُلِقَ ھَلُوْعًا… اُولٰ۬ئِکَ فِیْ جَنّٰتٍ مُّکْرَمُوْنَ)

এখানে মানুষের চিরাচরিত একটি স্বভাবের কথা আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন হা-হুতাশ করে আর যখন কোন নেয়ামত পায় তথা ধন-সম্পদ বা শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদি তখন কৃপণতা করে আল্লাহ তা‘আলার হক যথাযথ আদায় করে না, তবে যারা সৎ বান্দা তারা ব্যতীত।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

্রشَرُّ مَا فِي رَجُلٍ شُحٌّ هَالِعٌ وَجُبْنٌ خَالِعٌগ্ধ

মানুষের মাঝে নিকৃষ্টতম স্বভাব হলো অত্যন্ত কৃপণতা ও চরম কাপুরুষতা। (আবূ দাঊদ : ২৫১৩, সিলসিলা সহীহাহ : ৫৬০)
পরের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের গুণাবলী উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা মু’মিনূনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কিয়ামতের পূর্বে আকাশ-জমিনের ভয়াবহ অবস্থা হবে।
২. মানুষ সেদিন সব কিছুর বিনিময়ে হলেও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে কিন্তু সক্ষম হবে না।
৩. জাহান্নাম যাদেরকে ডাকবে তাদের পরিচয় জানলাম।
৪. সুখ-সাচ্ছন্দ্যে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা এবং দুঃখ-বেদনায় ধৈর্য ধারণ করা উচিত। সুখ-শান্তি পেয়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ভুলে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা উচিত নয়।
৫. সম্পদের হকের কথা ভুলে যায় না।

১-১৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৭০-মাআরিজ) : নামকরণ:

সূরার তৃতীয় আয়াতের ذِي الْمَعَارِجِ যিল মাআরিজি শব্দটি থেকে এর নামকরণ হয়েছে।
(৭০-মাআরিজ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

কাফেররা কিয়ামত, আখেরাত এবং দোযখ ও বেহেশত সম্পর্কিত বক্তব্য নিয়ে বিদ্রূপ ও উপহাস করতো এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ মর্মে চ্যালেঞ্জ করতো যে, তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো আর তোমাকে অস্বীকার করে আমরা জাহান্নামের শাস্তিলাভের উপযুক্ত হয়ে থাকি তাহলে তুমি আমাদেরকে যে কিয়ামতের ভয় দেখিয়ে থাকো তা নিয়ে এসো। যে কাফেররা এসব কথা বলতো এ সূরায় তাদের সতর্ক করা হয়েছে এবং উপদেশ বাণী শোনানো হয়েছে। তাদের এ চ্যালেঞ্জের জবাবে এ সূরার গোটা বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।
(৭০-মাআরিজ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

সূরার প্রথমে বলা হয়েছে প্রার্থনাকারী আযাব প্রার্থনা করছে। নবীর দাওয়াত অস্বীকারকারীর ওপর সে আযাব অবশ্যই পতিত হবে। আর যখন আসবে তখন কেউ তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। তবে তার আগমন ঘটবে নির্ধারিত সময়ে। আল্লাহর কাজে দেরী হতে পারে। কিন্তু তার কাছে বেইনসাফী বা অবিচার নেই। কিন্তু আমি দেখছি তা অতি নিকটে।

এরপর বলা হয়েছে, এসব লোক হাসি-ঠাট্টাচ্ছলে কিয়ামত দ্রুত নিয়ে আসার দাবি করছে। অথচ কত কঠোর ও ভয়ানক সেই কিয়ামত।যখন তা আসবে তখন এসব লোকের কি যে ভয়ানক পরিণতি হবে। সে সময় এরা আযাব থেকে বাঁচার জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি এবং নিকট আত্মীয়দেরকে বিনিময় স্বরূপ দিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। কিন্তু কোনভাবেই আযাব থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারবে না।

এরপর মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সেদিন মানুষের ভাগ্যের ফায়সালা হবে সম্পূর্ণরূপে তাদের আকীদা-বিশ্বাস নৈতিক চরিত্র ও কৃতকর্মের ভিত্তিতে। দুনিয়ার জীবনে যারা ন্যায় ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং ধন-সম্পদ জমা করে ডিমে তা দেয়ার মত সযত্নে আগলে রেখেছে তারা হবে জাহান্নামের উপযুক্ত। আর যারা আল্লাহর, আযাবের ভয়ে ভীত থেকেছে। আখেরাতকে বিশ্বাস করেছে, নিয়মিত নামায পড়েছে, নিজের উপার্জিত সম্পদ দিয়ে আল্লাহর অভাবী বান্দাদের হক আদায় করেছে, ব্যভিচার থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছে, আমানতের খেয়ানত করেনি, ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি এবং কথাও কাজ যথাযথভাবে রক্ষা করে চলেছে এবং সাক্ষ্যদানের বেলায় সত্যবাদিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে তারা সম্মান ও মর্যাদার সাথে জান্নাতে স্থান লাভ করবে।

পরিশেষে মক্কার কাফেরদের সাবধান করা হয়েছে যারা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখামাত্র বিদ্রূপ ও উপহাস করার জন্য চারদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তো। তাদেরকে বলা হয়েছে যদি তোমরা তাঁকে না মানো তাহলে আল্লাহ তাআলা অন্যদেরকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই বলে উপদেশ দেয়া যেন তিনি এসব উপহাস- বিদ্রূপের তোয়াক্কা না করেন। এরা যদি কিয়ামতের লাঞ্ছনা দেখার জন্যই জিদ ধরে থাকে তাহলে তাদেরকে এ অর্থহীন তৎপরতায় লিপ্ত থাকতে দিন। তারা নিজেরাই এর দু:খজনক পরিণতি দেখতে পাবে।
সুরা: আল-মাআরিজ
আয়াত নং :-১

سَاَلَ سَآئِلٌۢ بِعَذَابٍ وَّاقِعٍۙ

এক প্রার্থনাকারী আযাব প্রার্থনা করেছে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# মূল আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হলো سَأَلَ سَائِلٌ (ছায়ালা ছাইলুন)। কোন কোন মুফাস্সির এখানে ছায়ালা اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (الانفال : 32) শব্দটিকে জিজ্ঞেস করা অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে আয়াতের অর্থ হলো একজন জিজ্ঞেসকারী জানতে চেয়েছে যে, তাদেরকে যে আযাব সম্পর্কে অবহিত করা হচ্ছে তা কার ওপর অপতিত হবে? আল্লাহ‌ তাআলা এ প্রশ্নের জওয়াব দিয়েছেন এই বলে যে, তা কাফেরদের ওপর পতিত হবেই। তবে অধিকাংশ মুফাস্সির এক্ষেত্রে চাওয়াকে দাবী করা অর্থ গ্রহণ করেছেন। নাসায়ী এবং আরো কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস ইবনে আব্বাস থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিস হাকেম এটিকে সহীহ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হলো নাদর ইবনে হারেস ইবনে কালাদা বলেছিলঃ

اَلّلهُمَّ اِنْ كَانَ هَذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْعِنْدِكَ فَاَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَالسَّمَاءِ اَوِئتِنَا بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ (الانفالঃ ٣٢)

“হে আল্লাহ, এটি যদি সত্যিই তোমার পক্ষ থেকে আসা একটা সত্য বাণী হয়ে থাকে, তাহলে আসমান থেকে আমাদের ওপর পাথর বর্ষণ করো অথবা আমাদেরকে ভীষণ কষ্টদায়ক শাস্তি দাও।”

এটি ছাড়াও কুরআন মজীদের আরো অনেক স্থানে মক্কার কাফেরদের এ চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করা হয়েছে যে, তুমি আমাদের যে আযাবের ভয় দেখাচ্ছো তা নিয়ে আসছো না কেন? উদাহরণস্বরূপ নীচে উল্লেখিত স্থানসমূহ দেখুন। সূরা ইউনুস, আয়াত ৪৬ থকে ৪৮ ; সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৬ থেকে ৪১ ; সূরা আন নামল আয়াত ৬৭ থেকে ৭২ ; সূরা সাবা আয়াত ২৬ থেকে ৩০ ; ইয়াসীন, আয়াত, ৪৫থেকে ৫২ এবং সূরা মূলক ২৪ থেকে ২৭ ।

# মূল ইবারতে ذِي الْمَعَارِجِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। معرج শব্দের বহুবচন হলো معارج । এর অর্থ হলো ধাপ বা সিড়ি, অথবা এমন জিনিস যার সাহায্যে ওপরে ওঠা যায়। আল্লাহ‌ তা’আলাকে معارج এর অধিকারী বলার মানে হলো তাঁর সত্তা অনেক উচ্চ ও সমুন্নত। তার দরবারে পৌঁছার জন্য ফেরেশতাদের একের পর এক ওপর দিকে উঠতে হয়। পরবর্তী আয়াতে এ বিষয়টিই বলা হয়েছে।
# রূহ অর্থ জিবরাঈল আলাইহি সালাম। অন্য সব ফেরেশতাদের থেকে আলাদাভাবে জিবরাঈলকে উল্লেখ তাঁর বিশেষ মর্যাদা প্রকাশ করে। সূরা শূ’আরায় বলা হয়েছে,نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ – عَلَى قَلْبِكَ (রূহুল আমীন এ কুরআন নিয়ে তোমার দিলের মধ্যে নাযিল হয়েছে)। সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِجِبْرِيلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ………….. “বলো, যে ব্যক্তি শুধু এ কারণে জিবরাঈলের দুশমন হয়ে গিয়েছেন যে, সে তোমার অন্তরে কুরআন নাযিল করেছেন…………..।” এ দু’টি আয়াত এক সাথে পড়লে বুঝা যায় যে, রূহ মানে জিবরাইল (আ) ছাড়া আর কিছু নয়।

# এ পুরো বিবরণটি “মুতাশাবিহাতের” অন্তর্ভুক্ত। এর কোন নির্দিষ্ট অর্থ করা যায় না। আমরা ফেরেশতার সঠিক তাৎপর্য কি তা জানিনা। আমরা তাদের উর্ধ্বারোহণের সঠিক রূপও জানি না। যে ধাপগুলো পেরিয়ে ফেরেশতারা ওপরে ওঠেন তা কেমন তাও আমরা জানি না। মহান আল্লাহ‌ সম্পর্কে ও এ ধারণ করা যায় না যে, তিনি কোন বিশেষ স্থানে অবস্থান করেন। কারণ তাঁর মহান সত্তা স্থান ও কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।
# সূরা হজ্জের ৪৭ আয়াতে বলা হয়েছেঃ এসব লোক এ মুহূর্তেই আযাব নিয়ে আসার জন্য তোমার কাছে দাবী করেছে। আল্লাহ‌ কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন না। তবে তোমরা রবের হিসেবের একদিন তোমাদের হিসেবের হাজার হাজার বছরের সমান হয়ে থাকে। সূরা আস সাজদার ৫ আয়াতে বলা হয়েছেঃ “তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত গোটাবিশ্ব-জাহানের সব বিষয় পরিচালন করেন। এরপর (তার রিপোর্ট) এমন একটি দিনে তার কাছে পৌঁছে যা তোমাদের গণনার এ হাজার বছরের সমান। ” আর এখানে আযাব দাবী করার জবাবে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ‌ তা’আলার একদিন পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে যারা বিদ্রূপ করে আযাব দাবী করেছে তাদের এসব কথায় ধৈর্য ধারণ করুন। তারপর বলা হচ্ছে, এসব লোক আযাবকে দূরে মনে করছে। কিন্তু আমি দেখছি তা অত্যাসন্ন। এসব বক্তব্যের প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষ তার মন-মানসিকতা, চিন্তা ও দৃষ্টির পরিসর সংকীর্ণ হওয়ার কারণে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলীকে নিজেদের সময়ের মান অনুযায়ী পরিমাপ করে থাকে। তাই একশো বছর বা পঞ্চাশ বছর সময়ও তাদের কাছে অত্যন্ত দীর্ঘ সময় বলে মনে হয়। কিন্তু আল্লাহর এক একটি পরিকল্পনা হাজার হাজার বছর বা লাখ লাখ বছর মেয়াদের হয়ে থাকে। এ সময়টিও বলা হয়েছে উদাহরণ হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে মহা বিশ্ব ভিত্তিক পরিকল্পনা লক্ষ লক্ষ ও শত শত কোটি বছর মেয়াদেও হয়ে থাকে। এসব পরিকল্পনার মধ্য থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার অধীনে এ পৃথিবীতে মানব জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর একটা নির্দিষ্ট সময় দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তাদেরকে এখানে একটি বিশেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করার অবকাশ দেয়া হবে। কোন মানুষই জানে না এ পরিকল্পনা কখন শুরু হয়েছে, তা কার্যকরী করার জন্য কি পরিমাণ সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার পরিসমাপ্তির জন্য কোন মুহূর্তটি নির্ধারিত করা হয়েছে যে, মুহূর্তটিতে কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত জন্মলাভকারী সমস্ত মানুষকে এক সাথে জীবিত করে উঠিয়ে বিচার করার জন্য কোন সময়টি ঠিক করে রাখা হয়েছে। আমরা এ মহা পরিকল্পনার ততটুকুই কেবল জানি যতটুকু আমাদের চোখের সামনে সংঘটিত হচ্ছে অথবা অতীত মহাকালে সংঘটিত ঘটনাবলীর যে আংশিক ইতিহাসটুকু আমাদের সামনে বিদ্যমান আছে। এর সূচনা ও পরিণতি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, সে সম্পর্কে জানা তো দূরের কথা তা বুঝার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। এখন কথা হলো, যেসব লোক দাবী করছে যে, এ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তার পরিণাম এখনই তাদের সামনে এনে হাজির করা হোক। আর যদি তা না করা হয় তাহলে পরিণাম সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে সেটিই মিথ্যা, তারা আসলে নিজেদের অজ্ঞতাই প্রমাণ করেছে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাহফীমুল কুরআন, সূরা আল হজ্ব, টীকা ৯২ – ৯৩ এবং আস সাজদা, )

# অর্থাৎ এমন ধৈর্য যা একজন মহত উদার ও সাহসী মানুষের মর্যাদার উপযোগী।
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, তারা এ ব্যাপারটিকে অসম্ভব মনে করে। অথচ আমাদের কাছে তা অত্যসন্ন। দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, তারা কিয়ামতের অনেক দূরের ব্যাপার বলে মনে করে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে তা এত কাছের যেন আগামীকালই সংঘটিত হবে।
# একদল মুফাস্সির এ আয়াতাংশকে فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ আয়াতাংশের সাথে সম্পৃক্ত বলে ধরে নিয়েছেন। তারা বলেনঃ যে দিনটির স্থায়িত্ব পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান বলা হয়েছে সেটি কিয়ামতের দিন। মুসনাদে আহমাদ ও তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত আবু সায়িদ খুদরী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াতটি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হলো, তাহলে তো সেদিনটি খুবই দীর্ঘায়িত হবে। একথা শুনে তিনি বললেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ সেই মহান সত্তার শপথ একটি ফরয নামায পড়তে দুনিয়াতে যতটুকু সময় লাগে একজন ঈমানদারের জন্য সেদিনটি তার চাইতেও সংক্ষিপ্ত হবে।” এটি সহীহ সনদে বর্ণিত রেওয়াতের হলে এটি ছাড়া এ আয়াতের অন্য কোন ব্যাখ্যা করার অবকাশই থাকতো না। হাদীসটির সনদে উল্লেখিত বর্ণনাকারী দাররাজ এবং তার উস্তাদ আবুল হাইসাম উভয়েই যয়ীফ।
# অর্থাৎ বার বার রং পরিবর্তন হবে।
# পাহাড়সমূহের রং যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন তাই তখন তা স্থানচ্যুত ওজনহীন হয়ে উড়তে থাকবে তখন মনে হবে যেন রংবেরংয়ের ধুনিত পশম বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
# অর্থাৎ তারা একজন আরেকজনকে দেখতে পাবে না বলে জিজ্ঞেস করবে না তা নয়। বরং অন্যের ব্যাপারে যা ঘটেছে তা প্রত্যেকেই নিজ চোখে দেখতে পাবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তাকে জিজ্ঞেস করবে না। কেননা, সে তখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।
# এ স্থানে ও আখেরাতের মানুষের মন্দ পরিণামের দু’টি কারণ বলা হয়েছে যা সূরা আল হাক্কার ৩৩ও ৩৪ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। একটি হলো হক থেকে ফিরে যাওয়া এবং ঈমান আনয়নের অস্বীকৃতি। অপরটি হলো দুনিয়া পূজা ও কৃপণতা। এ কারণেই মানুষ সম্পদ জমা করে এবং কোন কল্যাণকর কাজের জন্য তা খরচ করে না।

Leave a Reply