Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৮২/ এবং কাফের-রা বলে:-২৭) [** কাফের-রা আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে :- *এবং কফেরর-রা বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে;- *ভন্ড ও ভ্রান্ত নেতৃত্বের কুফল :- *নূহ্ আরও বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! যমীনের কাফিরদের মধ্য কাউকে পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য রেখো না:- **হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, এবং সব মু’মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও:-] www.motaher21.net সুরা: ৭১: সুরা নূহ। পারা:২৯ ২১-২৮ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮২/ এবং কাফের-রা বলে:-২৭)
[** কাফের-রা আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে :-
*এবং কফেরর-রা বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে;-
*ভন্ড ও ভ্রান্ত নেতৃত্বের কুফল :-
*নূহ্ আরও বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! যমীনের কাফিরদের মধ্য কাউকে পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য রেখো না:-
**হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, এবং সব মু’মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭১: সুরা নূহ।
পারা:২৯
২১-২৮ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-

সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২১
قَالَ نُوۡحٌ رَّبِّ اِنَّہُمۡ عَصَوۡنِیۡ وَ اتَّبَعُوۡا مَنۡ لَّمۡ یَزِدۡہُ مَالُہٗ وَ وَلَدُہٗۤ اِلَّا خَسَارًا ﴿ۚ۲۱﴾
নূহ বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! আমার সম্পপ্ৰদায় তো আমাকে অমান্য করেছে এবং অনুসরণ করেছে এমন লোকের যার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি ।’
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২২
وَ مَکَرُوۡا مَکۡرًا کُبَّارًا ﴿ۚ۲۲﴾
এসব লোক সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করে রেখেছে।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২৩
وَ قَالُوۡا لَا تَذَرُنَّ اٰلِہَتَکُمۡ وَ لَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّ لَا سُوَاعًا ۬ۙ وَّ لَا یَغُوۡثَ وَ یَعُوۡقَ وَ نَسۡرًا ﴿ۚ۲۳﴾
এবং কফেরর-রা বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাস্রকে ।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২৪
وَ قَدۡ اَضَلُّوۡا کَثِیۡرًا ۬ۚ وَ لَا تَزِدِ الظّٰلِمِیۡنَ اِلَّا ضَلٰلًا ﴿۲۴﴾
তারা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে; সুতরাং অনাচারীদের বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।’
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২৫
مِمَّا خَطِیۡٓــٰٔتِہِمۡ اُغۡرِقُوۡا فَاُدۡخِلُوۡا نَارًا ۬ۙ فَلَمۡ یَجِدُوۡا لَہُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَنۡصَارًا ﴿۲۵﴾
তাদের অপরাধের জন্য তাদেরকে (বন্যায়) ডুবানো হয়েছিল[১] এবং পরে তাদেরকে প্রবেশ করানো হয়েছিল আগুনে, অতঃপর তারা কাউকেও আল্লাহর মুকাবিলায় সাহায্যকারী পায়নি।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২৬
وَ قَالَ نُوۡحٌ رَّبِّ لَا تَذَرۡ عَلَی الۡاَرۡضِ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ دَیَّارًا ﴿۲۶﴾
নূহ্ আরও বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! যমীনের কাফিরদের মধ্য কাউকে পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য রেখো না।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২৭
اِنَّکَ اِنۡ تَذَرۡہُمۡ یُضِلُّوۡا عِبَادَکَ وَ لَا یَلِدُوۡۤا اِلَّا فَاجِرًا کَفَّارًا ﴿۲۷﴾
‘আপনি তাদেরকে অব্যাহতি দিলে তারা আপনার বান্দাদেরকে বিভ্ৰান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুস্কৃতিকারী ও কাফির।
সুরা: ৭১: সুরা নূহ:-২৮
رَبِّ اغۡفِرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِمَنۡ دَخَلَ بَیۡتِیَ مُؤۡمِنًا وَّ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ ؕ وَ لَا تَزِدِ الظّٰلِمِیۡنَ اِلَّا تَبَارًا ﴿٪۲۸﴾
হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যারা মু’মিন হিসেবে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে তাদেরকে এবং সব মু’মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও। জালেমদের জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।

২১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: নূহ
আয়াত নং :-২১

قَالَ نُوْحٌ رَّبِّ اِنَّهُمْ عَصَوْنِیْ وَ اتَّبَعُوْا مَنْ لَّمْ یَزِدْهُ مَالُهٗ وَ وَلَدُهٗۤ اِلَّا خَسَارًاۚ

নূহ বললোঃ হে প্রভু, তারা আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ঐসব নেতার অনুসরণ করেছে যারা সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পেয়ে আরো বেশী ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

  *আল্লাহ তায়ালার দরবারে নুহ (আ.)-এর নালিশ : এবার আল্লাহর দরবারে নূহের নালিশ জানানাের প্রসংগ। নূহ বললাে, ‘হে আমার রব, ওরা আমাকে অস্বীকার করেছে, তারা অনুসরণ করেছে এমন ব্যক্তি যার ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি শুধু তার ক্ষতিই করেছে। তারা ভয়ানক রকমের ষড়যন্ত্র করেছে, আর বলছে, খবরদার! তােমাদের দেব-দেবীদের তােমরা পরিত্যাগ করাে না, ত্যাগ করাে না ‘ওয়াদ’, ‘সূয়া’, ‘ইয়াউক’ ও ‘নসর’-কে। এইভাবে তারা অনেককেই পথভ্রষ্ট করেছে। অতএব, যালেমদের গােমরাহী তুমি আরও বাড়িয়ে দাও।’ হে আমার পালনকর্তা ওরা আমার সাথে নাফরমানী করেছে। এই সংগ্রাম, এতাে কষ্ট তাদের মনােযােগ আকর্ষণ করার এতাে প্রচেষ্টা, আলাের পথে তাদেরকে এগিয়ে আনার এতাে চেষ্টা সাধনা, তাদেরকে সতর্কীকরণ ও ভীতি প্রদর্শন, ক্ষমার আশ্বাস দান, ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি এবং সহজ জীবনের ওয়াদা আমি বারবার দিয়েছি, এতদসত্ত্বেও তারা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সর্বক্ষণ তাদের গতি ভুল পথের পথিক ও ভুল পথে পরিচালনাকারী নেতৃবৃন্দের দিকেই নিবদ্ধ থেকেছে, তারা তাদের অনুসারীদেরকে ধন সম্পদ ও সন্তান সন্তুতি প্রাপ্তির ভুল প্রলােভন দিয়ে বরাবর ধোকা দিয়েছে। জাকজমকপূর্ণ জীবন ও ক্ষমতার লােভ দিয়ে ওদেরকে সেইসব ধোঁকাবাজ নেতারা বশীভূত করে রাখতে চেয়েছে। ‘তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে যার সম্পদ ও সন্তান তার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বাড়ায়নি।’ সেই বিশেষ ব্যক্তি ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততির কথা বলে তাদেরকে শুধু ধোকাই দিয়েছে। নিজে ভুল পথে চলেছে, অপরকেও ভুল পথে চালিয়েছে। অথচ এ দুটির কিছুই তার বাড়েনি, বেড়েছে শুধু তাদের দুর্ভাগ্য ও আর্থিক ক্ষতি।

ফী জিলালিল কুরআন:   *ভন্ড ও ভ্রান্ত নেতৃত্বের কুফল : সেই গােমরাহ নেতারা মানুষকে ভুলপথে পরিচালনা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ‘তারা ভয়ানক রকমের চক্রান্ত করেছে, সে ষড়যন্ত্রের মধ্যে চুড়ান্ত প্রকারের অহংকার রয়েছে।’ অর্থাৎ সে নেতারা ওদেরকে ছলেবলে কৌশলে বশীভূত করে নিজেদের প্রাধান্য কায়েমের চেষ্টাতেই লিপ্ত ছিলাে। এজন্যেই তারা নবীর দাওয়াত ব্যর্থ করে দিতে চেয়েছে এবং মানুষের অন্তরে দাওয়াতী কাজের প্রতি মনােযােগ আসার সকল পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। তারা তাদের কুফরী কাজ সুন্দর করে দেখানাের জন্যে ষড়যন্ত্র করেছে। তাদের ষড়যন্ত্রের মধ্যে এটাও একটা দিক ছিলাে যে, তারা মানুষকে সেই সকল মূর্তির পূজা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতাে যাদেরকে তারা ক্ষমতাবান মনে করতাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা বললাে তােমাদের মাবুদ (দেবতা)-দেরকে তােমরা কখনও পরিত্যাগ করাে না।’ এখানে ‘আলিহাতাকুম’ শব্দটি দ্বারা তােমাদের শক্তি সাহস বৃদ্ধির উৎস বলে সেই মিথ্যা মূর্তিগুলােকে বুঝানাে হয়েছে যা তাদের মনে এক অপরাধজনক প্রভাব বিস্তার করতাে। অর্থাৎ আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার পাশাপাশি ওদেরও কিছু শক্তি ক্ষমতা আছে বলে তারা বিশ্বাস করতাে, যেগুলােকে উপেক্ষা করলে তারা মনে করতাে তাদের বুঝি সমূহ কোনো অকল্যাণ ঘটবে সেই সকল দেবতাদের তারা ডাকতো যারা ছিলাে (তাদের ধারণায়) মান সম্ভ্রমের দিক থেকে সবার ওপরে। এই জন্যে তাদের নাম ধরে বলা হয়েছে খবরদার! ওদেরকে কখনও ছেড়ে দিও না। এর আর একটি উদ্দেশ্য এটাও ছিলাে যেন মানুষের মনের মধ্যে সেই দেবতাদের মর্যাদা বদ্ধমূল হয়ে থাকে। সেজন্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, খবরদার ওয়াদ, সুয়া, ইয়াস, ইয়াউক ও নাসর-কে ছেড়ে যেয়ােনা। সেইসব মূৰ্খ নাদানদের কাছে এইসব নামের দেবতারা ছিলাে শক্তি ক্ষমতার উৎস। মােহাম্মদ(স.)-এর যামানা পর্যন্ত বরাবর এদের বিশেষভাবে পূজা করা হতাে। আর এভাবে সে সকল নেতা যারা নিজেরা ছিলাে ভুলপথের পথিক এবং মানুষকেও ভুলপথে পরিচালনা করতাে, তারা নিজেরা সেইসব মূর্তি রাখতে এবং রীতিমত তাদের পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা করতাে। বিভিন্ন সময়ে এদের বিভিন্ন নাম থেকেছে এবং প্রত্যেক জাহেলী যামানার চাহিদা অনুসারে এদের আকৃতিও বিভিন্নভাবে গড়ে তােলা হয়েছে। সেইসব মূর্তির চতুর্দিকে এদের ভক্তরা জড় হতাে এবং সেই সকল মূর্তির সাহসিকতাপূর্ণ কীর্তিগাথা গেয়ে ভক্তদের হৃদয়কে আন্দোলিত করা হতাে, এতে ভক্তদের মনেও সাহসের সঞ্চার হতে। এইভাবে জনগণের গলায় জাহেলিয়াতের লাগাম পরিয়ে দিয়ে নেতারা তাদেরকে নিজেদের দিকে টানতাে এবং তাদের দ্বারা যা খুশী তাই তারা করাতাে। বলা হচ্ছে, ‘তারা বহু লােককে ভুলপথে চালিয়েছে।’ এইভাবে প্রত্যেক নেতা ব্যক্তির সাথে একদল লােক থাকতাে যারা সেইসব মূর্তির চতুষ্পার্শ্বে জড়াে হতাে। সেই সময় ইট পাথরের মূর্তির পাশাপাশি কোনাে ব্যক্তিকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হতাে। তাদের চিন্তারাজ্যেও কিছু মূর্তির প্রভাব ছিলাে, আর এসবগুলােই সমানভাবে আল্লাহর পথে আহবান জানানাের পথে বাধা সৃষ্টি করতে এবং ‘দায়ী ইলাল্লাহ’ (আল্লাহর পথে আহ্বানকারী) থেকে তাদের মনকে বহু দূরে সরিয়ে রাখতাে। এটা ছিলাে সকল ষড়যন্ত্রের বড়াে ষড়যন্ত্র। এই পর্যায়ে এসেই সম্মানিত নবী নূহ(আ.)-এর অন্তরে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করার কথা জাগলাে। সেসব যালেম, গােমরাহ, ষড়যন্ত্রকারীদের ধ্বংস কামনায় যে কথাগুলো তার পবিত্র মুখ থেকে বেরিয়ে এলাে তা হচ্ছে, আয় আল্লাহ, যালেমদের গোমরাহী আরও বাড়িয়ে দাও। বহু বছর ধরে সংগ্রাম ও চেষ্টা সাধনার পর এবং বহু কষ্ট স্বীকার করার পর ছিলাে তার এই দোয়া। সকল প্রকার ব্যবস্থা জ্ঞানগর্ভ কথা এবং হেকমত অবলম্বনের পর কোনাে সুফল না পাওয়ায় এই যালেমদের সম্পর্কে এই ছিলাে তার সেই হতাশাব্যঞ্জক উক্তি। নূহ(আ.) নির্ঘাত বুঝেছিলেন যে যালেম, হঠকারী ও অহংকারী জাতির পক্ষে কল্যাণ পাওয়ার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, তাদের হেদায়াত এবং নাজাত লাভের আর কোনাে উপায় নেই। এই জন্যেই তাঁর অন্তর থেকে এ বদদোয়া বেরিয়ে এলাে।

সুরা: নূহ
আয়াত নং :-২৮

رَبِّ اغْفِرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِمَنْ دَخَلَ بَیْتِیَ مُؤْمِنًا وَّ لِلْمُؤْمِنِیْنَ وَ الْمُؤْمِنٰتِ١ؕ وَ لَا تَزِدِ الظّٰلِمِیْنَ اِلَّا تَبَارًا۠

হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যারা মু’মিন হিসেবে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে তাদেরকে এবং সব মু’মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও। জালেমদের জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।

ফী জিলালিল কুরআন:

  *অপরাধী যালেমদের কঠিন পরিণতি : নুহ(আ.)-এর দোয়ার শেষ অংশ সামনে আসার পূর্বেই অপরাধী যালেমেদের দুনিয়া ও আখেরাতে যে কঠিন পরিণতি হবে তার বিবরণ এসে গেছে। আল্লাহ তায়ালা তার জ্ঞান ভান্ডারে দুনিয়ার শাস্তির সাথে সাথে আখেরাতে যে কি শাস্তি হবে তা সবই বর্তমান রয়েছে। সে শান্তি আসবেই এ ধারণার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন আসতে পারে না কেননা এটা স্বয়ং আল্লাহরই ফায়সালা । তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের অপরাধের কারণে তাদেরকে ডুবিয়ে মারা হলাে এবং তাদেরকে দোযখে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলাে।’ তাদের গুনাহ, তাদের ইচ্ছাকৃত অপরাধ, তাদের অহংকার ও নাফরমানীর কারণে তাদেরকে ডুবিয়ে মারা হলাে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলাে। আরবী ভাষায় ফা অর্থ হচ্ছে সুতরাং বা অতপর, এখানে এই ফা ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা জানানাে যে, ডুবিয়ে মারার সাথে তাদের জাহান্নামে প্রবেশ করানো অবধারিত, জাহান্নামে প্রবেশ করানাে পর্যন্ত যেটুকু বিলম্ব তা খুবই অল্প সময়, এতাে অল্প যেন তা কোনাে সময়ই নয়; এর কারণ হচ্ছে, আল্লাহর বিচারদন্ডে এতটুকু সময়ের কোনাে হিসাবই নেই। একটার পর একটা ঘটনা সংঘটিত হওয়ার মধ্যে কবরের আযাব ভােগ করার একটা সময় যদিও আছে, কিন্তু মহাকালের তুলনায় আল্লাহর বিবেচনায় তা ডুবিয়ে মারার খুবই কাছে। এরপর আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কাউকেই সাহায্যকারী হিসেবে তারা পেলাে না, কোনাে সন্তান-সন্ততি, ধন সম্পদ, ক্ষমতাবান রাজা বাদশাহ বা যে সকল দেবতাদের তারা পূজা করতাে ক্ষমতাধর বলে সাহায্যের জন্যে ডাকে-তাদের কেউই তাদের কোনাে কাজে আসলাে না। শেষের ছােট্ট আয়াত দুটোতে সেই অহংকারী, সীমালংঘনকারী, নাফরমান, হঠকারী ও অপরাধ প্রবণ জাতির চরম পরিণতি সম্পর্কে ইতি টানা হয়েছে। তাদের স্মরণও মানুষের স্মৃতিপট থেকে আজ মুছে গেছে। নুহ(আ.)-এর দোয়া ও তার জাতির ধ্বংস সম্পর্কে কোরআনে উল্লেখিত হওয়ার বহু পূর্বেই সে ইতিহাস মানুষের স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে। তাদের ডুবে মরার ঘটনা এখানে খুব বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়নি এবং যে তুফান ও প্লাবনের কারণে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাে তারও বিশেষ কোনাে বর্ণনা আসেনি। এর কারণ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা এ প্রসংগে এতটুকু জানাতে চান যে, দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট ঝড় প্লাবন বা অন্য কোনাে ঘটনার মাধ্যমেও শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তারপর আখেরাতে এর যে কষ্ট অবধারিত রয়েছে তার তাে কোনাে পরিসমাপ্তি নেই। ফা বা অতপর ব্যবহার করে অবিলম্বে দোযখের আগুনের স্থায়ী আযাব আসবে বলে ভয় দেখানাে হয়েছে। মানুষের হঠকারিতা ও যুক্তিহীন কাজের পরিণতি যে স্থায়ী আযাব সেটাই এখানকার মুখ্য আলােচ্য বিষয়। অতএব ডুবিয়ে মারা বা আগুনে পােড়ানাের বিস্তারিত ফিরিস্তি পেশ করার কোনাে প্রয়ােজন এখানে হয়নি। তারপর নূহ(আ.)-এর শেষ দোয়ার বিবরণ আসছে। তিনি তাঁর জীবনের শেষের দিকে আল্লাহর দরবারে এই দোয়া পেশ করেছিলেন। এরশাদ হচ্ছে নূহ বললাে, ‘হে আমার রব, কাফেরদের একটি ঘরও যেন পৃথিবীর বুকে ধ্বংস থেকে রেহাই পায়। হে আমার রব, আমাকে ক্ষমা করাে, আমার বাবা মাকেও ক্ষমা করাে, ক্ষমা করো তাকেও যে আমার ঘরে প্রবেশ করবে। অন্যত্র ঈমানদার পুরুষ বা নারী যারা আছে তাদেরকেও ক্ষমা করো এবং ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই দাও। বাদ বাকি অন্য যেসব যালেম আছে তাদের কাউকে ধ্বংস না করে ছেড়ে দিয়াে না।’ অবশ্যই নূহ(আ.)-এর অন্তরে একথার ইলহাম হয়েছিলাে যে, এ যমীন তার পুঞ্জীভূত অন্যায় ও পাপ পংকীলতা থেকে পুরােপুরি মুক্ত হওয়ার জন্যে একটি পূর্ণাংগ ‘গােসল’ চাচ্ছিলাে। তার সময় পর্যন্ত আল্লাহর যমীনে যত প্রকার অন্যায় অবিচার, জুলুম নির্যাতন, শােষণ দুঃশাসন চলছিলাে এবং সর্বোপরি আল্লাহর নাফরমানীর কারণে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলাে তারও একটি স্থায়ী চিকিৎসার প্রয়ােজন ছিলাে। দীর্ঘ সাড়ে তিন’শ বছরের প্রচেষ্টা বিফল হওয়ার পর সার্বিক শুদ্ধির প্রয়ােজনে অন্যায়ের সব বাহন ও সব কয়টি প্রকাশ্য ও গােপন শাখা প্রশাখা নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিলাে, কারণ তাদের কোনাে একটি ঘরও যদি অবশিষ্ট থেকে যায় এমন একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে যে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানাের কাজ কিছুতেই চুড়ান্ত রূপ নিতে পারবে না। শিরকরূপী সংক্রামক ব্যাধি তাদের কাছ থেকে আবার অন্যদের মধ্যে প্রবেশ করবে। এ সত্যটি নূহ(আ.) স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন বলেই তিনি চাচ্ছিলেন চুড়ান্ত এক আঘাত দিয়ে সেই যালেমদের সমূলে উৎখাত করা হােক, যাতে করে তাদের একটি ঘরও অবশিষ্ট না থাকে। এই উদ্দেশ্যেই তিনি বললেন, ‘তুমি যদি ওদেরকে ছেড়ে দাও তাহলে তারা তােমার অনুগত বান্দাদেরকে গোমরাহ করে দেবে।’ এখানে ইবাদুকা শব্দটি দ্বারা মােমেনদেরকেই বুঝানাে হয়েছে। কোরআনে অনুরূপ শব্দ যেখানেই ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে এর দ্বারা মােমেনদেরকেই বুঝানাে হয়েছে। এ শব্দটি এই জন্যেই ব্যবহার করা হয়েছে যে, যালেমদের সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা ও নির্যাতন সত্তেও যারা নিজেদেরকে শিরক থেকে বাঁচাতে পেরেছে এবং বরাবর আল্লাহর অভিমুখী জীবন যাপন করতে পেরেছে; তারা সেইসব লােক থেকে নিশ্চয়ই স্বতন্ত্র, যারা যালেম কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকার কারণে তাদের মনের পরিচ্ছন্নতাটুকুও বজায় রাখতে পারেনি। তারপর কোনাে ঘরকে যদি ধ্বংস থেকে রেহাই দেয়া হয় তাহলে সেখানে এমন পরিবেশ পরিস্থিতি গড়ে উঠবে যে, সেখানে আবার কাফেরই জন্ম নেবে। এখানে কুফর অর্থে সেই বিদ্রোহাত্মক প্রবণতাকে বুঝানাে হয়েছে যা সেই যালেমদের সন্তানদের মধ্যে ছােটবেলা থেকেই গড়ে উঠবে। এভাবেই মাঝারি বয়সে এসে মানুষেরা সেই প্রবণতার অনুসারী হয়ে অবশেষে কুফরীর মধ্যেই পড়ে যায় । এমতাবস্থায় মানুষ সত্যের আলাে বিকশিত হওয়ার সুযােগ হারিয়ে ফেলে; কারণ মানুষের ওপর অন্যায় ও খারাপ পরিবেশের প্রভাবই বেশী বেশী পড়ে। এই কথার দিকেই নুহ(আ.) ইংগিত দিয়েছেন, কোরআন তাঁর সেই কথাটাই তুলে ধরেছে, ‘তারা দুষ্কৃতকারী অপরাধপ্রবণ কাফের ব্যতীত আর কিছুই জন্ম দেবে না।’ এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে অপরাধপ্রবণ সেই সমাজে অন্যায়কারী ও গােমরাহ লােকদের সংখ্যাই ছিলাে বেশী, তারা বিভিন্ন রকমের বদ অভ্যাস নীচুতা, মনের সংকীর্ণতা এবং অন্ধ অনুকরণ জনিত দোষে দুষ্ট ছিলাে। এরই ফলে তাদের সন্তানরা যমীন থেকে অপরাধপ্রবণ ও কাফের হয়েই গড়ে উঠতাে। এসব বিভিন্ন কারণকে সামনে রেখেই নূহ(আ.) তার মালিকের কাছে দোয়া করেছিলেন। তার মূল্যায়ন সঠিক ছিলাে বলেই মহান আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা সেই সকল অন্যায় ও অপবিত্র অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে গােটা পৃথিবীকে গােসল করিয়ে দিলেন এবং যমীন থেকে সমস্ত যুলুম নির্যাতন ও শিরকের আবর্জনা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিলেন। তৎকালীন পৃথিবীকে পুঞ্জীভূত আবর্জনা থেকে মুক্ত করার এ কাজটি একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব ছিলাে। কোনাে সময়ই এতােবড়াে একটা ধ্বংস আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউই করতে পারে না। নূহ(আ.) সম্পূর্ণভাবে শিরক মুক্ত ও অন্যায় জুলুম ও অবিচারের জঞ্জাল থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক পৃথিবীই দেখতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তার সন্তুষ্টির আশায় তার সুদীর্ঘ জীবনের সাধনা ব্যর্থ হতে দেখে তিনি মনে প্রাণে চেয়েছিলেন শিরক থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত এক নতুন পৃথিবী গড়ে উঠুক, আর সেই জন্যেই ছিলাে তাঁর এই শেষ প্রার্থনা, হে আল্লাহ তায়ালা তুমি যালেমদেরকে ধ্বংস না করে কিছুতেই ছেড়ে দিয়াে না। সর্বগ্রাসী এই শুদ্ধি অভিযানের জন্যেই ছিলাে তার কাতর প্রার্থনা। অপরদিকে ভক্তি গদগদ কষ্ঠে তার ক্ষমা প্রার্থনাও ছিলাে তাদের জন্যে, যারা ঈমানের কারণে তার নৈকট্যলাভে ধন্য ছিলাে। তিনি বলছেন, ‘হে আমার মালিক, আমাকে ক্ষমা করাে, ক্ষমা করাে আমার পিতা মাতাকে, উপরন্তু যে কোনাে ব্যক্তি মােমেন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করবে তাকে এবং অন্যান্য সকল মােমেন-পুরুষ-নারী যে যেখানে আছে সবাইকে ক্ষমা করাে।’ আল্লাহর নবী নূহ(আ.) তার পালনকর্তার কাছে আরজী পেশ করছেন যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। এটা ছিলাে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর দরবারে সম্মানিত নবীর অতি পরিচ্ছন্ন এক শিষ্টাচার। মনীবের দরবারে বিনয়াবনত ভক্ত বান্দার এই হচ্ছে নিবেদন। এমন বান্দা যিনি তার নিজের মানুষ হওয়া ও মানুষ হিসেবে তার ভুল হওয়া সম্পর্কে সচেতন। তিনি কখনও ভুলে যান না যে তার ভুল বা ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে। গুনাহ খাতার উর্ধে তিনি নন। এটাও তিনি জানেন যে, আল্লাহর দয়া মেহেরবানী ছাড়া তার কোনাে কাজের কারণে তিনি জান্নাত লাভ করতে পারবেন না। তাঁর ভাই নবী মোহাম্মদ(স.) তাই বলেছেন। তিনি তার নাফরমান জাতিকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন কিন্তু, ইস্তেগফার করা তাে দূরের কথা, তারা তাঁর কথায় উল্টো অহংকার প্রদর্শন করেছে। তিনি সেই মহান নবী, যিনি প্রতিটি কঠিন প্রচেষ্টা এবং কঠিন পরিশ্রমের পর ক্ষমা চাইছেন এবং প্রতিবারেই তিনি আল্লাহর কাছে নিজ কাজের হিসাব দিচ্ছেন। তাঁর পিতা-মাতার জন্যে তার প্রার্থনার ধরণও লক্ষণীয়। তিনি মােমেন পিতা-মাতার সুযােগ্য পুত্র এবং নবী, যেমন করে আমরা তাঁর এই দোয়া থেকেই বুঝতে পারছি। তারা মােমেন না হলে তাদের জন্যে করা প্রার্থনাকে তেমনিভাবে ফিরিয়ে দেয়া হতাে যেমন করে কাফের পুত্রের জন্যে করা তার প্রার্থনাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিলাে। তাঁর খাস দোয়া ছিলাে সকল ব্যক্তির জন্যে যারা মােমেন হিসেবে তার ঘরে প্রবেশ করেছিলাে। এর দ্বারা মােমেন ভাই এর প্রতি তার আন্তরিক দরদ ফুটে উঠেছে। নবী(স.)-এর ভাষায় ‘ভাইয়ের জন্যে তাই পছন্দ করাে যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ করাে।’ তাই নূহ(আ.) যে প্রার্থনা নিজের জন্যে, নিজ পরিবার ও পিতা-মাতার জন্যে করছেন, সেই একই প্রার্থনা তিনি তার মােমেন ভাইদের জন্যেও করছেন। তাদের কথা তিনি এভাবে বলেছেন যে, তারা ছিলাে তার ঘরে প্রবেশকারী, কারণ এই ঘরে প্রবেশ করাতেই তারা যে নাজাত পাবে তার লক্ষণ তখন প্রকাশ পেয়েছিলাে। আর যে সকল মােমেন ব্যক্তি তার সাথে জাহাজে আরােহন করেছিলাে তাদেরও জাহাজে আরােহন করার সাথে সাথে তাদের নাজাত লাভ করা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তার দোয়া ছিলাে সকল পুরুষ নারী মােমেন সাধারণের জন্যে। তিনি সর্বদা এবং সবখানে মােমেনের জন্যে ছিলেন ঘনিষ্ট বন্ধু। তাঁর চেতনাও ছিলাে সকল আত্মীয় স্বজনের জন্যে দয়ামায়ায় ভরা। তাঁর সাহাবাদের মধ্যে পরস্পর ভালোবাসা ও আমানতদারী গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি অতি উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছিলেন। তাদের মধ্যে পরস্পরকে সাহায্য করার জন্যে একটা প্রগাড় আগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন, এমন এক গভীর মন মানসিকতা, যা সময় দূরত্বের ব্যবধান থাকা সত্তেও ম্লান হয়ে যায়নি। এ এমন এক রহস্যপূর্ণ সম্পর্ক যা আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মােমেন ব্যক্তির অন্তরে তার ঈমানের দৃঢ়তা অনুসারে দান করেছেন। এ ছিলাে ঈমানী সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট এক বিশেষ অবস্থা। এর বিপরীত যারা যুলুম করেছে, সেইসব যালেমদের জন্যে রয়েছে প্রচন্ড ঘৃণা। তাই তাদের জন্যে তার বদদোয়া ছিলাে, ‘যালেমদেরকে পুরােপুরি ধ্বংস না করে ছেড়ে দিয়াে না’ সূরাটির আলােচনা শেষ হয়ে এসেছে, এ প্রসংগে একদিকে যেমন মহান নবী নূহ(আ.)-এর জিহাদ এর বিবরণ অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে পেশ করা হয়েছে, অপরদিকে হঠকারী ও যালেম জাতি কিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলাে তার বিবরণও দেয়া হয়েছে। আমি এখন এ মহান অধ্যায়টি শেষ করছি। শ্রদ্ধাভাজন নূহ(আ.)-এর প্রতি ও তাঁর মহান জিহাদের প্রতি আন্তরিক ভক্তি শ্রদ্ধা পেশ করে সেই কঠিন ঘটনারও ইতি টানছি। নবী নূহ(আ.)-এর জীবন পরিক্রমার বর্ণনা আমরা শেষ করছি। কামনা করি, এতে আমাদের জীবন পথের জন্যে কিছু প্রাপ্তি ঘটুক-সে প্রাপ্তি যতাে কষ্টকর ও ক্লান্তিজনকই হােক না কেন, হােক সে চলার পথ বহু কোরবানী ও ব্যথা বেদনায় ভরা! আসলে এ পৃথিবীতে পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্যে এ কষ্টের পথই হচ্ছে একমাত্র পথ, কেননা এ পথ হচ্ছে বিশ্ব পালক, মহান করুণাময় আল্লাহর কাছে পৌছানাের একমাত্র পথ।

২১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
২১-২৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

নূহ (আঃ) এক পুরুষের পর দ্বিতীয় পুরুষকে অতঃপর তৃতীয় পুরুষকে এমনিভাবে সাড়ে নয়শত বছর দাওয়াতী কাজ করলেন এ আশায় যে, তারা ঈমান আনবে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী বিরতিহীন দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও তারা ঈমান আনল না। তখন নূহ (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার কাছে অভিযোগ করে বললেন : হে আল্লাহ তা‘আলা! তারা আমার অবাধ্য হয়েছে এবং এমন মা‘বূদের অনুসরণ করছে যারা ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে ক্ষতি ছাড়া কোন উপকার করতে পারে না। আর তারা হককে প্রতিহত করার জন্য সর্বপ্রকার ষড়যন্ত্র করছে।

নূহ (আঃ)-এর দাওয়াতের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত করল।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(لَئِنْ لَّمْ تَنْتَھِ یٰنُوْحُ لَتَکُوْنَنَّ مِنَ الْمَرْجُوْمِیْنَ)

‘হে নূহ! তুমি যদি বিরত না হও তবে তুমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে নিহতদের মাঝে শামিল হবে।’ (সূরা শুআরা ২৬ : ১১৬) তিনি স্বজাতিকে ডেকে বললেন : ‘‘হে আমার সম্প্রদায়! আমার অবস্থিতি ও আল্লাহর নিদর্শন দ্বারা আমার উপদেশ দান তোমাদের নিকট যদি দুঃসহ হয় তবে আমি তো আল্লাহর ওপর নির্ভর করি। তোমরা যাদেরকে শরীক করেছ তৎসহ তোমাদের কর্তব্য স্থির করে নাও, পরে যেন কর্তব্যের বিষয়ে তোমাদের কোন অস্পষ্টতা না থাকে। আমার সম্বন্ধে তোমাদের কর্ম নিষ্পন্ন করে ফেল এবং আমাকে অবকাশ দিও না। ‘আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তোমাদের নিকট আমি তো কোন পারিশ্রমিক চাই না, আমার পারিশ্রমিক আছে একমাত্র আল্লাহর নিকট, আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে আদিষ্ট হয়েছি।’ আর তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল।” (সূরা ইউনুস ১০ : ৭১-৭৩) জাতির লোকেরা তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে শির্কের ওপর অটল রইল এবং অন্যদেরকেও জানিয়ে দেয়, তোমরা নূহের কথায় তোমাদের মা‘বূদদেরকে বর্জন করো না।

(لَا تَذَرُنَّ اٰلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ)

অর্থাৎ নূহ (আঃ)-এর যুগের লোকেরা যে সকল ব্যক্তিদের পূজা করত তারা সকলে সৎ বান্দা ছিল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : নূহ (আঃ)-এর জাতির মাঝে যে প্রতিমার পূজা চালু ছিল পরবর্তীতে আরবের মাঝেও তার পূজা প্রচলিত হয়েছিল।

(ود) ওয়াদ “দাওমাতুল জান্দাল” নামক জায়গায় কালব গোত্রের একটি দেবমূর্তি, (سُوَاعً) সূওয়া হল হুযায়ল গোত্রের একটি দেবমূর্তি এবং (يَغُوْثَ) ইয়াগুছ ছিল মুরাদ গোত্রের, পরবর্তীতে তা গাতীফ গোত্রের হয়ে যায়। এর আস্তানা ছিল কওমে সাবার নিকটবর্তী “জাওফ” নামক স্থানে। (يَعُوْق) ইয়াউক ছিল হামাদান গোত্রের মূর্তি, (نَسْرًا) নাসর ছিল যুলকালা গোত্রের হিময়ার শাখার মূর্তি। নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের কতিপয় নেক লোকের নাম নাসর ছিল। তারা মারা গেলে শয়তান তাদের জাতির লোকদের অন্তরে এ কথা ঢেলে দিল যে, তারা যেখানে বসে আলোচনা করত, সেখানে তোমরা কতিপয় মূর্তি স্থাপন কর এবং ঐ সমস্ত পূন্যবান লোকদের নামেই এদের নামকরণ কর। তারা তাই করল, কিন্তু তখনও ঐসব মূর্তির পূজা করা হত না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকেরা মারা গেলে এবং মূর্তিগুলোর ব্যাপারে প্রকৃত জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে গেলে লোকজন তাদের পূজা করা শুরু করে দেয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯২০)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : তাই সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করা, তাদের মর্যাদা থেকে বেশি সম্মান প্রদর্শন করা ও শরীয়ত গর্হিত কাজ মানুষকে পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। সেজন্য তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে উপযুক্ত সম্মান দিয়ে শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় আমল করা আবশ্যক।

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা উম্মু হাবীবাহ ও উম্মু সালামাহ (রাঃ) হাবশায় গীর্জা দেখলেন, সেগুলোকে মারিয়া বলা হয়। সেখানে অনেক ছবি, প্রতিকৃতি ও মূর্তি ছিল। রাসূলুুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসব কথা বললে, তিনি বলেন : ঐ সমাজে যখন কোন সৎ লোক মারা যেত, তারা সেই সৎ লোকের কবরের ওপর মাসজিদ বানাতো এবং তাতে তাদের প্রতিকৃতি বানিয়ে রাখতো। এসব লোকেরা হল সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট। এরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি হিসাবে গণ্য হবে। (সহীহ বুখারী হা. ৪২৭, ৩৮৭৩, সহীহ মুসলিম হা. ৫২৮)

(وَقَدْ أَضَلُّوْا)

অর্থাৎ নূহ (আঃ)-এর জাতির নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অনেক লোকদেরকে প্রতিমা পূজার দিকে দাওয়াত দিয়ে পথভ্রষ্ট করেছে।

সৃষ্টির সূচনালগ্ন অর্থাৎ আদম (আঃ) থেকে নূহ (আঃ) পর্যন্ত সমস্ত মানুষ তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সে সময় ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(کَانَ النَّاسُ اُمَّةً وَّاحِدَةًﺤ فَبَعَثَ اللہُ النَّبِیّ۪نَ مُبَشِّرِیْنَ وَمُنْذِرِیْنَ…)

“মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে নাবীদেরকে পাঠালেন…।”

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আদম ও নূহ (আঃ)-এর মধ্যকার দশ যুগ বা প্রজন্মের সকলেই সত্য ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, অতঃপর তারা ধর্মীয় বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয়। ফলে তাদেরকে সত্য ধর্মের ওপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নাবীদেরকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীস্বরূপ প্রেরণ করেন (তাবারী ২/৩৩৪)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) যা বলেছেন তার সত্যতা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একটি হাদীসেও প্রমাণিত। তিনি বলেন : আদম ও নূহ (আঃ)-এর মধ্যবর্তী দশ যুগ বা প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। (তাবারী ২/৩৩৪) এ ছাড়াও অনেক প্রমাণ রয়েছে যা প্রমাণ করে-আদম ও নূহ (আঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ের লোকেরা তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।

সর্বপ্রথম যে জাতি শির্কে লিপ্ত হয় :

এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম ইবনু জারীর বলেন : এরা পাঁচজন আদম ও নূহ (আঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ের সৎ মানুষ ছিলেন। তাদের অনুসরণকারী অনেক মানুষ ছিল। তারা মৃত্যু বরণ করার পর তাদের অনুসারীরা বলল : আমরা যদি তাদের প্রতিকৃতি নির্মাণ করি তাহলে তা দেখে আমরা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের প্রতি আগ্রহী ও মনোযোগী হতে পারব। এটা মনে করে তারা তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করল। এদের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় প্রজন্মের জনগণের নিকট শয়তান এসে বলল : তোমাদের পূর্ব পুরুষগণ এদের উপাসনা করত ও এদের ওসীলায় তারা বৃষ্টি কামনা করতো। এভাবে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা তাদের উপাসনা করতে আরম্ভ করে। (তাবারী ১২/২৯/৬২, এগাছাতুল লাহফান ২/১৬১)

আরবে শির্কের অনুপ্রবেশ :

আরবে বসবাসকারী সাধারণ লোকজন ইসমাঈল (আঃ)-এর দাওয়াত ও প্রচারের ফলে ইবরাহীম (আঃ) প্রচারিত দীনের অনুসারী ছিলেন। এ কারণেই তারা ছিলেন আল্লাহ তা‘আলার একত্বে বিশ্বাসী এবং তারা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করত। কিন্তু কালপ্রবাহে ক্রমান্বয়ে তারা আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ এবং খালেস দীনি শিক্ষার কোন কোন অংশ ভুলে যেতে থাকে। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার একত্ব ও দীনে ইবরাহীমের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট থাকে। বনু খুযাআহ গোত্রের সরদার আমর বিন লুহাইকে ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি তার গভীর অনুরাগের কারণে লোকজন তাকে শ্রদ্ধা করত এবং তার কথা অনুসরণ করত। এক পর্যায়ে সে ব্যক্তি শাম দেশে ভ্রমণ করে এবং সেখানে মূর্তি পূজা দেখতে পায়। শাম দেশে বহু নাবী-রাসূলগণ এসেছেন। সেই হিসাবে লুহাই মূর্তি পূজাকে অধিকতর ভাল ও সত্য বলে ধারণা করে। তাই দেশে ফিরে আসার সময় সে হুবাল নামক একটি মূর্তি সাথে নিয়ে আসে এবং খানায়ে কাবার মধ্যে তা রেখে দিয়ে পূজা করা শুরু করে। সাথে সাথে মক্কাবাসীকেও পূজা করার জন্য আহ্বান করে। মক্কাবাসী তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মূর্তি হোবলের পূজা করতে থাকে। কাল বিলম্ব না করে হিজাযবাসীও মক্কাবাসীর অনুসরণ করে মূর্তি পূজা করতে লাগল। এভাবে একত্ববাদী আরববাসী মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়। (আর রাহীকুল মাখতূম)

(وَلَا تَزِدِ الظّٰلِمِيْنَ إِلَّا ضَلٰلًا)

অর্থাৎ নূহ (আঃ) তাঁর অবাধ্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বদ্দুআ করেছেন, যেমন মূসা (আঃ) করেছিলেন :

(وَقَالَ مُوْسٰي رَبَّنَآ إنَّكَ اٰتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلَأَه۫ زِيْنَةً وَّأَمْوَالًا فِي الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا لا, رَبَّنَا لِيُضِلُّوْا عَنْ سَبِيْلِكَ ج رَبَّنَا اطْمِسْ عَلٰٓي أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلٰي قُلُوْبِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوْا حَتّٰي يَرَوُا الْعَذَابَ الْأَلِيْمَ ‏)‏

“মূসা বলল : ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি তো ফির‘আউন ও তার পারিষদবর্গকে পার্থিব জীবনে শোভা ও সম্পদ দান করেছ, হে আমাদের প্রতিপালক! যার করণে তারা মানুষকে তোমার পথ হতে ভ্রষ্ট করছে। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের সম্পদ বিনষ্ট কর, তাদের হৃদয় কঠিন করে দাও, তারা তো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনবে না।’’ (সূরা ইউনুস ১০ : ৮৮)

সুতরাং যুগে যুগে সৎ ব্যক্তিদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকেই মূলত শিরকের আস্তানা গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশেও দেখা যায় যত মাযার, খানকা ইত্যাদি রয়েছে তার অধিকাংশ সৎ লোকদের কবরকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে। আর কিছু আছে ভন্ড শয়তান যারা কোনদিন নামায রোযার ধার ধারত না; অথচ তাদের অনুসারীরা তাদের মৃত্যুর পর কবরের ওপর মাযার গড়ে তোলে। আর কিছু মাযার রয়েছে মূলত সেখানে কোন মৃত ব্যক্তিই নেই, রাতারাতি মাযারের মত গড়ে তুলে ব্যবসা করছে। আমাদের সবাইকে এ সমস্ত ধোঁকা থেকে সাবধান থাকতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মূর্তি পূজার সূচনা জানলাম।
২. প্রকৃত জ্ঞান না থাকলে মানুষ সহজেই পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
৩. যুগে যুগে যারাই সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে তারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে।
৪. নাবীরা মুসতাজাবুত দাওয়াহ বা দু‘আ করলে কবূল হত এমন ব্যক্তি ছিলেন।
২৫-২৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

নূহ (আঃ) যখন বুঝতে পারলেন- এরা আর ঈমান আনবে না, তখন তিনি অবাধ্য জাতির ওপর বদ্দুআ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَأُوْحِيَ إِلٰي نُوْحٍ أَنَّه۫ لَنْ يُّؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ إِلَّا مَنْ قَدْ اٰمَنَ فَلَا تَبْتَئِسْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ)‏

“নূহের প্রতি ওয়াহী করা হয়েছিল, ‘যারা ঈমান এনেছে তারা ব্যতীত তোমার সম্প্রদায়ের অন্য কেউ কখনও ঈমান আনবে না। সুতরাং তারা যা করে তজ্জন্য তুমি দুঃখিত হয়ো না।” (সূরা হূদ ১১ : ৩৬)

ফলে তাদের কৃত অপরাধের দরুন আল্লাহ তা‘আলা মহাপ্লাবন দিয়ে ডুবিয়ে মারলেন এবং এর মাধ্যমে তাদের জাহান্নামে দিলেন। প্লাবনের বিবরণ সূরা হূদের ৩৭-৪৮ নম্বর আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ রয়েছে।

دَيَّارً অর্থ : গৃহবাসী। অর্থাৎ কোন গৃহবাসী কাফিরকে দুনিয়াতে বাঁচিয়ে রেখো না। কারণ এরা বেঁচে থাকলে মানুষকে পথহারা করবে এবং যে সকল সন্তান জন্ম দেবে সে সব সন্তান কাফিরই হবে। সর্বশেষে নূহ (আঃ) নিজের জন্য, পিতা মাতার জন্য এবং যারা মু’মিন হয়ে তার গৃহে প্রবেশ করবে তাদের সকলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। কারণ নূহ (আঃ)-এর পূর্ব দশ পুরুষ সবাই মু’মিন ছিলেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : নূহ (আঃ)-এর পিতার পূর্বের কেউ কুফরী করেনি। (কুরতুবী) আর কাফির জালিমদের প্রতি বদ্দুআ কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।

تَبَارًا অর্থ : ধ্বংস, ক্ষতি ইত্যাদি।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে তার খারাপ কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে।
২. জালিম ও কাফিরদের জন্য বদ্দুআ করা শরীয়তসিদ্ধ।
৩. মু’মিন নর-নারীর জন্য অন্য মুমিনের দু‘আ করা উচিত।
৪. দু‘আকারী প্রথমে নিজের জন্য দু‘আ শুরু করা মুস্তাহাব।

২১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

সুরা: নূহ
আয়াত নং :-২২

وَ مَكَرُوْا مَكْرًا كُبَّارًاۚ

এসব লোক সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করে রেখেছে।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# ষড়যন্ত্রের অর্থ হলো জাতির লোকদের সাথে নেতাদের ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা। নেতারা জাতির লোকদের হযরত নূহ আলাইহিস সালামের শিক্ষার বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করার চেষ্টা করতো। যেমন, তারা বলতোঃ “নূহ তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর কাছে অহী এসেছে তা কি করে মেনে নেয়া যায়?” (সূরা আ’রাফ ৬৩ ; হূদ -২৭ ) “আমাদের নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা না বুঝে শুনে নূহের আনুগত্য করছে। তাঁর কথা যদি সত্যিই মূল্যবান হতো তাহলে জাতির নেতা ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ তাঁর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করতো।” (হূদ -২৭ ) “আল্লাহ যদি পাঠাতেই চাইতেন তাহলে কোন ফেরেশতা পাঠাতেন।” (আল মু’মিনূন , ২৪ ) এ ব্যক্তি যদি আল্লাহর প্রেরিত রসূল হতেন, তাহলে তাঁর কাছে সবকিছুর ভাণ্ডার থাকতো, তিনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জানতেন এবং ফেরেশতাদের মত সব রকম মানবীয় প্রয়োজন ও অভাব থেকে মুক্ত হতেন। ( সুরা হূদ, ৩১ ) নূহ এবং তাঁর অনুসারীদের এমন কি অলৌকিকত্ব আছে যার জন্য তাঁদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিতে হবে? (হূদ, ২৭ ) এ ব্যক্তি আসলে তোমাদের মধ্যে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। (আল মু’মিনূন, ২৫ ) প্রায় এ রকম কথা বলেই কুরাইশ নেতারা লোকদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে বিভ্রান্ত করতো।

সুরা: নূহ
আয়াত নং :-২৩

وَ قَالُوْا لَا تَذَرُنَّ اٰلِهَتَكُمْ وَ لَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّ لَا سُوَاعًا١ۙ۬ وَّ لَا یَغُوْثَ وَ یَعُوْقَ وَ نَسْرًاۚ

তারা বলেছে, তোমরা নিজেদের দেব-দেবীদের কোন অবস্থায় পরিত্যাগ করো না। আর ওয়াদ, সুওয়া’আ, ইয়াগুস, ইয়াউক এবং নাসরকেও পরিত্যাগ করো না।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

# নূহের কওমের উপাস্যদের দেবীদের মধ্য থেকে এখানে সেসব দেব-দেবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে পরবর্তীকালে মক্কাবাসীরা যাদের পূজা করতে শুরু করেছিল এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের বিভিন্ন স্থানে তাদের মন্দিরও বর্তমান ছিল। এটা অসম্ভব নয় যে, মহাপ্লাবনে যেসব লোক রক্ষা পেয়েছিল পরবর্তী বংশধরগণ তাদের মুখ থেকে নূহের (আ) জাতির প্রাচীন উপাস্য দেব-দেবীদের নাম শুনেছিল এবং পরে তাদের বংশধরদের মধ্যে নতুন করে জাহেলিয়াত ছড়িয়ে পড়লে তারা সেসব দেব-দেবীর প্রতিমা তৈরী করে তাদের পূজা অর্চনা শুরু করেছিল।

‘ওয়াদ্দ’ ছিল ‘কুদা’আ’ গোত্রের “বনী কালব ইবনে দবরা” শাখার উপাস্য দেবতা। “দুমাতুল জানদাল” নামক স্থানে তারা এর বেদী নির্মাণ করে রেখেছিল। আরবের প্রাচীন শিলা লিপিতে তার নাম “ওয়াদ্দম আবাম” (ওয়াদ্দ বাপু) উল্লেখিত আছে। কালবীর মতে তার মূর্তি ছিল এক বিশালদেহী পুরুষের আকৃতিতে নির্মিত। কুরাইশরাও তাকে উপাস্য দেবতা হিসেবে মানতো। তাদের কাছে এর নাম ছিল “উদ্দ”। তার নাম অনুসারে ইতিহাসে “আবদে উদ্দ” নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ দেখা যায়।

“সুওয়া” ছিল হুযাইল গোত্রের দেবী। তার মূর্তি ছিল নারীর আকৃতিতে তৈরী। ইয়াম্বুর সন্নিকটস্থ “রুহাত” নামক স্থানে তার মন্দির ছিল।

“ইয়াগুস” ছিল “তায়” গোত্রের “আনউম” শাখার এবং “মাযহিজ” গোত্রের কোন কোন শাখার উপাস্য দেবতা। “মাযহিজে”র শাখা গোত্রের লোকেরা ইয়ামান ও হিজাযের মধ্যবর্তী “জুরাশ” নামক স্থানে তার সিংহাকৃতির মূর্তি স্থাপন করে রেখেছিল। কুরাইশ গোত্রেরও কোন কোন লোকের নাম আবদে ইয়াগুস ছিল বলে দেখা যায়।

“ইয়াউক” ইয়ামানের হামদান অঞ্চলের অধিবাসী হামদান গোত্রের “খায়ওয়ান” শাখার উপাস্য দেবতা ছিল। এর মূর্তি ছিল ঘোড়ার আকৃতির।

“নাসর” ছিল হিমইয়ার অঞ্চলের হিমইয়ার গোত্রের “আলে যুল-কুলা” শাখার দেবতা। “বালখা” নামক স্থানে তার মূর্তি ছিল। এ মূর্তির আকৃতি ছিল শকুনের মত। সাবার প্রাচীন শিলালিপিতে এর নাম উল্লেখিত হয়েছে “নাসূর”। এর মন্দিরকে লোকেরা “বায়তে নাসূর” বা নাসূরের ঘর এবং এর পূজারীদের “আহলে নাসূর ” বা নাসূরের পূজারী বলতো। প্রাচীন মন্দিরসমূহের যে ধ্বংসাবশেষ আরব এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলসমূহে পাওয়া যায় সেসব মন্দিরের অনেকগুলোর দরজায় শকুনের চিত্র খোদিত দেখা যায়।

সুরা: নূহ আয়াত নং :-২৪

وَ قَدْ اَضَلُّوْا كَثِیْرًا١ۚ۬ وَ لَا تَزِدِ الظّٰلِمِیْنَ اِلَّا ضَلٰلًا

অথচ এসব দেব-দেবী বহু লোককে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছে। তুমিও এসব জালেমদের জন্য গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন: এ সূরার ভূমিকাতেই আমরা এ বিষয়টি উল্লেখ করেছি যে, হযরত নূহ আলাইহিস সালামের এ বদদোয়া কোন প্রকার ধৈর্যহীনতার কারণ ছিল না। বরং এ বদদোয়া তাঁর মুখ থেকে তখনই উচ্চারিত হয়েছিল যখন তাবলীগ ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে শত শত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর জাতির ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়েছিলেন। হযরত মূসাও এরূপ পরিস্থিতিতেই ফেরাউন ও ফেরাউনের কওমের জন্য এ বলে বদদোয়া করেছিলেনঃ “হে প্রভু! তুমি এদের অর্থ-সম্পদ ধ্বংস করে দাও এবং তাদের দিলের ওপর মোহর লাগিয়ে দাও, এরা কঠিন আযাব না দেখা পর্যন্ত ঈমান আনবে না।” তার জবাবে আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছিলেনঃ তোমার দোয়া কবুল করা হয়েছে। (ইউনূস, আয়াত ৮৮-৮৯) হযরত মূসা আলাইহিস সালামের বদদোয়ার মত নূহ আলাইহিস সালামের এ বদদোয়াও ছিল আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। তাই সূরা হূদে আল্লাহ‌ তা’আলা বলেছেনঃ وَ اُوْحِىَ اِلَى نُوْحٍ اَنَّهُ لَنْ يُّؤْمِنَ مِنْ قَوْمِكَ اِلاَّ مَنْ قَدْ اَمَنَ فَلاَ تَبْتَئِسْ بَمَا كَا نُوْا يَفْعَلُوْنَ “আর অহী পাঠিয়ে নূহকে জানিয়ে দেয়া হলো, এ পর্যন্ত তোমার কওমের যেসব লোক ঈমান এনেছে এখন তারা ছাড়া আর কেউ ঈমান আনবে না। তাদের কৃতকর্মের জন্য আর দুঃখ করো না।” (হূদ, ৩৬ ) ।

সুরা: নূহ
আয়াত নং :-২৫

مِمَّا خَطِیْٓئٰتِهِمْ اُغْرِقُوْا فَاُدْخِلُوْا نَارًا١ۙ۬ فَلَمْ یَجِدُوْا لَهُمْ مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ اَنْصَارًا

নিজেদের অপরাধের কারণেই তাদের নিমজ্জিত করা হয়েছিল তারপর আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। অতঃপর তারা আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কোন সাহায্যকারী পায়নি।

তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:

# নিমজ্জিত হওয়াতেই তাদের ব্যাপারটি চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে যায়নি। বরং ধ্বংস হওয়ার পরপরই তাদের রূহসমূহকে আগুনের কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ আচরণের সাথে ফেরাউন ও তার জাতির সাথে কৃত আচরণের হুবহু মিল রয়েছে। এ বিষয়টিই সূরা আল মু’মিনের ৪৫ ও ৪৬ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মু’মিন, টীকা-৬৩) যেসব আয়াত দ্বারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের আযাব বা কবরের আযাব প্রমাণিত হয় এ আয়াতটি তারই একটি।

# তারা যেসব দেব-দেবীকে সাহায্যকারী মনে করতো, সেসব দেব-দেবীর কেউ-ই তাদের রক্ষা করতে আসেনি। এটা যেন মক্কাবাসীদের জন্য এ মর্মে সতর্কবাণী যে, তোমরাও যদি আল্লাহর আযাবে পাকড়াও হও তাহলে যেসব দেব-দেবীর ওপর তোমরা ভরসা করে আছো তারা তোমাদের কোন কাজেই আসবে না।

২১-২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
২১-২৪ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ (আঃ) সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তাঁর অতীতের অভিযোগের সাথে সাথেই আল্লাহ তা’আলার সামনে স্বীয় সম্প্রদায়ের আরেকটি আচরণের কথাও তুলে ধরে বলেছিলেনঃ আমার আহ্বান যেন তাদের কানেও না পৌঁছে এ জন্যে তারা তাদের কানে অঙ্গুলি দিয়েছিল, অথচ এটা ছিল তাদের জন্যে খুবই উপকারী। তারা আমার অনুসরণ না করে অনুসরণ করেছে এমন লোকের যার ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি তার ক্ষতি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি। কেননা, এই ধন-মাল ও সন্তান সন্ততির গর্বে গর্বিত হয়ে তারা আল্লাহকেও ভুলে বসেছিল এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল। (আরবি) এর অন্য পঠন (আরবি) রয়েছে।

কাফিরদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় ও সম্পদশালী ছিল তারা ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছিল। (আরবি) ও (আরবি) দুটোই (আরবি)-এর অর্থে ব্যবহৃত অর্থাৎ খুব বড়। কিয়ামতের দিনও তারা এ কথাই বলবেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “বরং দিন রাত তোমাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রমূলক কাজ ছিল এই যে, তোমরা আমাদেরকে আল্লাহর সাথে কুফরী করার ও তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করার নির্দেশ দিতে।” (৩৪:৩৩) তাদের বড়রা ছোটদেরকে বলেঃ তোমরা তোমাদের যে দেব-দেবীগুলোর পূজা করতে রয়েছে ওগুলোকে কখনও পরিত্যাগ করো না।

সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, হযরত নূহ (আঃ)-এর যুগের প্রতিমাগুলোকে আরবের কাফিররা গ্রহণ করে। দুমাতুল জানদালে কালব গোত্র ওয়াদ প্রতিমার, পূজা করতো। হুয়েল গোত্র পূজা করতো সূওয়া নামক প্রতিমার। মুরাদ গোত্র এবং সাবা শহরের নিকটবর্তী জারফ নামক স্থানের অধিবাসী বানু গাতীফ গোত্র ইয়াগ্স নামক প্রতিমার উপাসনা করতো। হামাদান গোত্র ইয়াউক নামক প্রতিমার পূজারী ছিল এবং যীকিলার গোত্র হুমায়ের নাসর নামক প্রতিমার পূজা করতো। প্রকৃতপক্ষে এগুলো হযরত নূহ (আঃ)-এর কওমের সৎ লোকদের নাম ছিল। তাদের মৃত্যুর পর শয়তান ঐ যুগের লোকদের মনে এই খেয়াল জাগিয়ে তুললো যে, ঐ সৎ লোকদের উপাসনালয়ে তাদের স্মারক হিসেবে কোন নিদর্শন স্থাপন করা উচিত। তাই তারা তথায় কয়েকটি নিশান স্থাপন করে ও প্রত্যেকের নামে নামে ওগুলোকে প্রসিদ্ধ করে। তারা জীবিত থাকা পর্যন্ত ঐ সৎলোকদের পূজা হয়নি বটে, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর ও ইলম উঠে যাওয়ার পর যে লোকগুলোর আগমন ঘটে তারা অজ্ঞতা বশতঃ ঐ জায়গাগুলোর ও ঐ নামগুলোর নিদর্শন সমূহের পূজা শুরু করে দেয়। হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত যহহাক (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ) এবং হযরত ইবনে ইসহাকও (রঃ) একথাই বলেন।

হযরত মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস (রঃ) বলেন যে, ঐ লোকগুলো ছিলেন আল্লাহর ইবাদতকারী, দ্বীনদার, আল্লাহওয়ালা ও সৎ। তাঁরা হযরত আদম (আঃ) ও হযরত নূহ (আঃ)-এর ছিলেন সত্য অনুসারী, যাদের অনুসরণ অন্য লোকেরাও করতো। যখন তাঁরা মারা গেলেন তখন তাদের অনুসারীরা পরস্পর বলাবলি করলোঃ যদি আমরা এঁদের প্রতিমূর্তি তৈরী করে নিই তবে ইবাদতে আমাদের ভালভাবে মন বসবে এবং এদের প্রতিমূর্তি দেখে আমাদের ইবাদতের আগ্রহ বদ্ধি পাবে। সুতরাং তারা তাই করলো। অতঃপর যখন এ লোকগুলোও মারা গেল এবং তাদের বংশধরদের আগমন ঘটলো তখন শয়তান তাদের কাছে এসে বললোঃ “তোমাদের পূর্বপুরুষরা তো ঐ বুযুর্গ ব্যক্তির পূজা করতো এবং তাদের কাছে বৃষ্টি ইত্যাদির জন্যে প্রার্থনা করতো। সুতরাং তোমরাও তাই করো!’ তারা তখন নিয়মিতভাবে ঐ মহান ব্যক্তিদের প্রতিমূর্তিগুলোর পূজা শুরু করে দিলো।

হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) হযরত শীষ (আঃ)-এর ঘটনার বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ হযরত আদম (আঃ)-এর চল্লিশটি সন্তান ছিল। বিশটি ছিল পুত্র এবং বিশটি ছিল কন্যা। তাদের মধ্যে যারা বেশী বয়স পেয়েছিল তারা হলো হাবীল, কাবীল, সালিহ এবং আব্দুর রহমান, যাঁর প্রথম নাম ছিল আবদুর হারিস এবং ওয়াদ। তাঁকে শীষ ও হিব্বাতুল্লাহও বলা হতো। সমস্ত ভাই তাঁকেই নেতৃত্ব দান করেছিল। সুওয়াআ, ইয়াগ্স, ইয়াউক এবং নাসার এই চারজন ছিলেন তাঁরই পুত্র।

হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রঃ) বলেন যে, হযরত আদম (আঃ)-এর রোগের সময় তার পাঁচটি ছেলে ছিলেন। তাঁরা হলেন ওয়াদ, ইয়াউক, ইয়াগৃস, সূওয়াআ এবং নাসর। এদের মধ্যে ওয়াদ ছিলেন সর্বাপেক্ষা বড় ও সবচেয়ে সৎ।

মসনাদে ইবনে আবী হাতিমে বর্ণিত আছে যে, আবূ জাফর (রঃ) নামায পড়ছিলেন এবং জনগণ ইয়াযীদ ইবনে মুহাল্লিবের সম্পর্কে আলোচনা করে। নামায শেষ করার পর তিনি বলেনঃ তোমরা ইয়াযীদ ইবনে মুহাল্লাব সম্পর্কে আলোচনা করছো? সে এমন এক ব্যক্তি, যাকে এমন জায়গায় হত্যা করা হয় যেখানে সর্বপ্রথম গায়রুল্লাহর ইবাদত করা হয়। অতঃপর একজন মুসলমান সম্পর্কে আলোচনা করা হয় যিনি তাঁর কওমের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তিনি খুব জ্ঞানী লোক ছিলেন। যখন তিনি মারা গেলেন তখন জনগণ তাঁর কবরের চারদিকে বসে পড়লো এবং তাদের মধ্যে কান্নার রোল উঠলো। তাঁর মৃত্যু তাদের কাছে বড়ই বিপদের কারণ হয়ে গেল। অভিশপ্ত শয়তান তাদের এই অবস্থা দেখে মানুষের রূপ ধরে তাদের নিকট আগমন করে এবং তাদেরকে বলেঃ “এই বুযুর্গ ব্যক্তির কোন স্মারক স্থাপন করছো না কেন? যা সদা-সর্বদা তোমাদের সামনে থাকবে এবং তোমরা তাঁকে ভুলবে না?” সবাই এই প্রস্তাব পছন্দ করলো। অতঃপর শয়তান ঐ বুযুর্গ লোকটির প্রতিমূর্তি তৈরী করে তাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। ঐ প্রতিমূর্তি দেখে দেখে ঐ লোকগুলো তাকে স্মরণ করতে থাকলো। যখন তারা তাতে মগ্ন হয়ে পড়লো তখন শয়তান তাদেরকে বললোঃ “তোমাদের সকলকেই এখানে আসতে হচ্ছে। এটা তোমাদের জন্যে বড়ই অসুবিধাজনক। কাজেই এটা খুব ভাল হবে যে, আমি তোমাদের জন্যে তার অনেকগুলো মূর্তি তৈরী করে দিচ্ছি। তোমরা ওগুলো নিয়ে গিয়ে নিজ নিজ বাড়ীতে রেখে দিবে।” ঐ লোকগুলো এতেও সম্মত হয়ে গেল এবং ওটা কার্যেও পরিণত হলো। এ পর্যন্ত ঐ মূর্তিগুলো শুধু স্মারক হিসেবেই ছিল। কিন্তু ঐ লোকদের উত্তরসূরীরা সরাসরিভাবে ঐ মূর্তিগুলোর পূজা শুরু করে দিলো। প্রকৃত ব্যাপারটি তারা সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে গেল এবং নিজেদের পূর্বপুরুষদেরকেও এর পূজারী মনে করে নিজেরাও এর পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়লো। ঐ বুযুর্গ ব্যক্তির নাম ছিল ওয়াদ এবং ওটাই ছিল প্রথম প্রতিমূর্তি আল্লাহ ছাড়া যার পূজা করা হয়েছিল।

তারা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। ঐ সময় হতে নিয়ে আজ পর্যন্ত আরব ও অনারবে আল্লাহকে ছাড়া অন্যদের পূজা হতে থাকে এবং মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। হযরত (ইবরাহীম) খলীল (আঃ) স্বীয় প্রার্থনায় বলেছিলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা হতে রক্ষা করুন! হে আমার প্রতিপালক! তারা অধিকাংশ লোককে পথভ্রষ্ট করেছে।”

এরপর হযরত নূহ (আঃ) স্বীয় কওমের উপর বদ দু’আ করেন। কেননা তাদের ঔদ্ধত্য, হঠকারিতা এবং শত্রুতা চরমে পৌঁছেছিল। তিনি বদ দু’আয় বলেনঃ হে আমার প্রতিপালক! আপনি যালিমদের বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করবেন না। যেমন হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউন ও তার লোকদের উপর বদ দু’আ করে বলেছিলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মাল-ধনকে আপনি ধ্বংস করে দিন ও তাদের অন্তরকে কঠোর করে দিন, সুতরাং তারা যেন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রত্যক্ষ করা পর্যন্ত ঈমান আনয়ন না করে।”(১০:৮৮)

অতঃপর হযরত নূহ (আঃ)-এর প্রার্থনা কবূল হয়ে যায় এবং তাঁর কওমকে পানিতে নিমজ্জিত করা হয় এবং তাদেরকে দাখিল করা হয় অগ্নিতে, অতঃপর তারা কাউকেও আল্লাহর মুকাবিলায় সাহায্যকারী পায়নি। পরবর্তীতে আল্লাহ তা’আলা একথাই বলেনঃ

২৫-২৮ নং আয়াতের তাফসীর

(আরবি) এর অন্য কিরআত (আরবি) ও রয়েছে। মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ পাপের আধিক্যের কারণে হযরত নূহ (আঃ)-এর কওমকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। তাদের ঔদ্ধত্য, হঠকারিতা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে পানিতে নিমজ্জিত করা হয়েছিল এবং সেখান থেকে আগুনের গর্তে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তাদেরকে আল্লাহর এই আযাব হতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কেউ এগিয়ে আসেনি এবং তারা তাদের জন্যে কোন সাহায্যকারীও পায়নি। যেমন আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ (আঃ)-এর ঐ উক্তি উদ্ধৃত করেন যে উক্তি তিনি তাঁর পুত্রের প্রতি করেছিলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আজ আল্লাহর বিধান হতে রক্ষা করবার কেউ নেই, যাকে আল্লাহ দয়া করবেন সে ব্যতীত।”(১১:৪৩)

হযরত নূহ (আঃ) স্বীয় ব্যাপক ক্ষমতাবান ও মহামহিমান্বিত আল্লাহর দরবারে ঐ হতভাগ্যদের বিরুদ্ধে বদ দু’আ করেনঃ হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিবেন না। হলো তাই, সবাই পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেল। এমনকি হযরত নূহ (আঃ)-এর নিজের পুত্র, যে তার থেকে পৃথক ছিল, সেও রক্ষা পায়নি। হযরত নূহ (আঃ) তাঁর ঐ পুত্রকে অনেক কিছু বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনই ফল হয়নি। সে মনে করেছিল যে, পানি তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, সে কোন এক উঁচু পাহাড়ের উপর উঠে গিয়ে আত্মরক্ষা করবে। কিন্তু ওটা ছিল আল্লাহর আযাব ও গযব এবং হযরত নূহ (আঃ)-এর বদ দু’আর ফল। কাজেই তা হতে রক্ষা করতে পারবে কে? পানি তাকে ওখানেই ধরে ফেলছে এবং সে তার পিতার চোখের সামনে কথা বলতে বলতে ডুবে মরছে।

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি হযরত নূহ এর তুফানের সময় আল্লাহ তা’আলা কারো প্রতি দয়া করতেন তবে তিনি ঐ মহিলাটির উপর দয়া করতেন যে উনানে পানি উথলিয়ে উঠতে দেখে নিজের শিশু সন্তানকে নিয়ে পাহাড়ের উপর উঠে গিয়েছিল। পানি যখন ওখানেও উঠে গেল তখন সে তার শিশুটিকে কাঁধের উপর উঠিয়ে নিলো। পানি যখন তার কাঁধ পর্যন্তও উঠে গেল তখন শিশুটিকে সে তার মাথার উপর বসিয়ে নিলো। মাথার উপরেও যখন পানি উঠে গেল তখন সে ছেলেকে হাতে উঠিয়ে নিয়ে মাথার ঊর্ধ্বে উঠালো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পানি সেখানেও পৌঁছে গেল এবং মাতা ও সন্তান উভয়েই পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেল। সুতরাং ঐদিন যদি আল্লাহ তা’আলা ভূ-পৃষ্ঠের কাফিরদের মধ্য হতে কারো প্রতি দয়া করতেন তবে অবশ্যই ঐ মহিলাটির উপর দয়া করতেন।” (এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল কিন্তু এর বর্ণনাকারী সবাই নির্ভরযোগ্য) মোটকথা যমীনের সমস্ত কাফিরদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। শুধু ঐ ঈমানদার লোকদেরকে রক্ষা করা হয় যারা হযরত নূহ (আঃ)-এর সাথে তার নৌকায় ছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত নূহ (আঃ) যাদেরকে তার নৌকায় উঠিয়ে নিয়েছিলেন। হযরত নূহ (আঃ) অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর কওমের লোকেরা তাঁর উপর ঈমান আনবে না, তাই তিনি নৈরাশ্য প্রকাশ করে বলেনঃ হে আমার প্রতিপালক! আমার চাহিদা এই যে, সমস্ত কাফিরকে ধ্বংস করে দেয়া হোক। যদি আপনি তাদের মধ্য হতে কাউকেও অব্যাহতি দেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করে ফেলবে এবং জন্ম। দিতে থাকবে শুধু দুষ্কৃতিকারী ও কাফিরদের। তাদের পরবর্তী বংশধরগণ তাদের মতই বদকার ও কাফির হবে। সাথে সাথে তিনি নিজের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বলেনঃ হে আমার প্রতিপালক! আপনি ক্ষমা করুন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং যারা মুমিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করবে তাদেরকে।

ঘর দ্বারা এখানে মসজিদকেও বুঝানো হয়েছে। তবে সাধারণ অর্থ ঘরই বটে।

মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “তুমি মুমিন ছাড়া কারো সঙ্গী হয়ো না এবং আল্লাহভীরু ছাড়া কেউ যেন তোমার খাদ্য না খায়।” (এ হাদীসটি সুনানে আবু দাউদ ও জামে তিরমিযীতেও বর্ণিত হয়েছ এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেন, শুধু এই সনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করা হয়েছে)

এরপর হযরত নূহ (আঃ) তাঁর দু’আকে সাধারণ করেন এবং বলেনঃ হে আল্লাহ! সমস্ত ঈমানদার নারী পুরুষকেও আপনি ক্ষমা করে দিন, জীবিতই হোক বা মৃতই হোক। এ জন্যেই মুস্তাহাব এটাই যে, প্রত্যেক মানুষ তার দু’আতে অন্য মু’মিনকেও অন্তর্ভুক্ত করবে। তাহলে হযরত নূহ (আঃ)-এর অনুসরণও করা হবে। এবং সাথে সাথে এ সম্পর্কে উল্লিখিত হাদীসগুলোর উপর আমলও করা হবে।

এরপর দু’আর শেষে হযরত নূহ (আঃ) বলেনঃ হে আমার প্রতিপালক! আপনি মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকেও ক্ষমা করে দিন এবং যালিমদের শুধু ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন!

Leave a Reply