Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৭/এবং কাফির-রা বলে:-৩১)
[** এদের হলো কি যে এরা এ উপদেশবাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ?:-
*তারা বলবেঃ আমরা নামায পড়তাম না:-
*আসল কথা হলো, এরা আখেরাতকে আদৌ ভয় করে না:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির
পারা:২৯
৩২- ৫৬ নং আয়াতের বেখ্যা :-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩২
کَلَّا وَ الۡقَمَرِ ﴿ۙ۳۲﴾
কখনই না। চন্দ্রের শপথ।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩৩
وَ الَّیۡلِ اِذۡ اَدۡبَرَ ﴿ۙ۳۳﴾
শপথ রাত্রির, যখন ওর অবসান ঘটে।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩৪
وَ الصُّبۡحِ اِذَاۤ اَسۡفَرَ ﴿ۙ۳۴﴾
শপথ প্রভাতকালের, যখন তা আলোকোজ্জ্বল হয় –
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩৫
اِنَّہَا لَاِحۡدَی الۡکُبَرِ ﴿ۙ۳۵﴾
নিশ্চয় জাহান্নাম ভয়াবহ বিপদসমূহের অন্যতম,
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩৬
نَذِیۡرًا لِّلۡبَشَرِ ﴿ۙ۳۶﴾
মানুষের জন্য সতর্ককারী।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩৭
لِمَنۡ شَآءَ مِنۡکُمۡ اَنۡ یَّتَقَدَّمَ اَوۡ یَتَاَخَّرَ ﴿ؕ۳۷﴾
তোমাদের মধ্যে যে অগ্রসর হতে কিংবা পিছিয়ে পড়তে চায়, তার জন্য।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩৮
کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا کَسَبَتۡ رَہِیۡنَۃٌ ﴿ۙ۳۸﴾
প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ ,
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৩৯
اِلَّاۤ اَصۡحٰبَ الۡیَمِیۡنِ ﴿ؕۛ۳۹﴾
তবে ডান দিকের লোকেরা ছাড়া
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪০
فِیۡ جَنّٰتٍ ۟ؕۛ یَتَسَآءَلُوۡنَ ﴿ۙ۴۰﴾
তারা থাকবে জান্নাতে এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে–
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪১
عَنِ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿ۙ۴۱﴾
অপরাধীদের সম্পর্কে,
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪২
مَا سَلَکَکُمۡ فِیۡ سَقَرَ ﴿۴۲﴾
‘তোমাদেরকে কিসে ‘সাকার’- এ নিক্ষেপ করেছে?’
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪৩
قَالُوۡا لَمۡ نَکُ مِنَ الۡمُصَلِّیۡنَ ﴿ۙ۴۳﴾
তারা বলবে ‘আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না ,
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪৪
وَ لَمۡ نَکُ نُطۡعِمُ الۡمِسۡکِیۡنَ ﴿ۙ۴۴﴾
আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে অন্নদান করতাম না।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪৫
وَ کُنَّا نَخُوۡضُ مَعَ الۡخَآئِضِیۡنَ ﴿ۙ۴۵﴾
এবং আমরা অনর্থক আলাপকারীদের সাথে বেহুদা আলাপে মগ্ন থাকতাম।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪৬
وَ کُنَّا نُکَذِّبُ بِیَوۡمِ الدِّیۡنِ ﴿ۙ۴۶﴾
আমরা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা মনে করতাম।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪৭
حَتّٰۤی اَتٰىنَا الۡیَقِیۡنُ ﴿ؕ۴۷﴾
পরিশেষে আমাদের নিকট মৃত্যু আগমন করল।’
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪৮
فَمَا تَنۡفَعُہُمۡ شَفَاعَۃُ الشّٰفِعِیۡنَ ﴿ؕ۴۸﴾
ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৪৯
فَمَا لَہُمۡ عَنِ التَّذۡکِرَۃِ مُعۡرِضِیۡنَ ﴿ۙ۴۹﴾
এদের হলো কি যে এরা এ উপদেশবাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ?
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫০
کَاَنَّہُمۡ حُمُرٌ مُّسۡتَنۡفِرَۃٌ ﴿ۙ۵۰﴾
তারা যেন ভীত-ত্ৰস্ত হয়ে পলায়নরত একপাল গাধা-
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫১
فَرَّتۡ مِنۡ قَسۡوَرَۃٍ ﴿ؕ۵۱﴾
যারা সিংহের সম্মুখ হতে পলায়নপর।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫২
بَلۡ یُرِیۡدُ کُلُّ امۡرِیًٴ مِّنۡہُمۡ اَنۡ یُّؤۡتٰی صُحُفًا مُّنَشَّرَۃً ﴿ۙ۵۲﴾
বস্তুতঃ তাদের প্রত্যেকেই কামনা করে যে, তাকে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ দেওয়া হোক।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫৩
کَلَّا ؕ بَلۡ لَّا یَخَافُوۡنَ الۡاٰخِرَۃَ ﴿ؕ۵۳﴾
কখনো নয় ; বরং তারা আখেরাতকে ভয় করে না ।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫৪
کَلَّاۤ اِنَّہٗ تَذۡکِرَۃٌ ﴿ۚ۵۴﴾
নিশ্চয় এ কুরআন তো সকলের জন্য উপদেশবাণী ।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫৫
فَمَنۡ شَآءَ ذَکَرَہٗ ﴿ؕ۵۵﴾
অতএব যার ইচ্ছে সে তা থেকে উপদেশ গ্ৰহণ করুক।
সুরা: ৭৪: আল্-মুদাস্সির:-৫৬
وَ مَا یَذۡکُرُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ ؕ ہُوَ اَہۡلُ التَّقۡوٰی وَ اَہۡلُ الۡمَغۡفِرَۃِ ﴿٪۵۶﴾
আর আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তারা কোন শিক্ষা গ্রহণ করবে না। একমাত্র তিনিই তাকওয়া বা ভয়ের যোগ্য। এবং (তাকওয়ার নীতি গ্রহণকারীদের) ক্ষমার অধিকারী।
৩২-৫৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
হযরত আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি এমন কিছু দেখছি যা তোমরা দেখোনা এবং আমি এমন কিছু শুনছি যা তোমরা শুনো না। আকাশ চড়ু চড়ু শব্দ করছে এবং চড়ু চডু শব্দ করার তার অধিকার রয়েছে। এমন চার অঙ্গুলী পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই যেখানে কোন না কোন ফেরেশতা সিজদায় পতিত থাকেন না। আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে অবশ্যই তোমরা হাসতে কম এবং কাঁদতে বেশী। আর তোমরা বিছানায় তোমাদের স্ত্রীদের সাথে প্রেমালাপ ও ভোগ-বিলাসে লিপ্ত হতে পারতে না, বরং ক্রন্দন ও আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতে করতে জঙ্গলের দিকে চলে যেতে!” এ কথা শুনে হযরত আবূ যার (রাঃ) বলেনঃ “আমি যদি গাছ হতাম এবং আমাকে কেটে ফেলা হতো (তবে কতই না ভাল হতো)!” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ, জামে তিরমিযী এবং সুনানে ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন। এ হাদীসটি হযরত আবূ যার (রাঃ) হতে মাওকূফ রূপেও বর্ণিত আছে)
হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “সপ্ত আকাশে পা পরিমিত, কনিষ্ঠাঙ্গুলী পরিমিত এবং হস্ততালু পরিমিত এমন জায়গা ফাঁকা নেই যেখানে কোন না কোন ফেরেশতা কিয়াম, রুকূ’ অথবা সিজদার অবস্থায় না রয়েছেন। অতঃপর কাল কিয়ামতের দিন তারা সবাই বলবেনঃ “(হে আল্লাহ!) আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি। আমরা আপনার যথোপযুক্ত ইবাদত করতে পারিনি। তবে (এ কথা সত্য যে,) আমরা আপনার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করিনি।” (এ হাদীসটি হাফিয আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে নাসর মরূযীর (রঃ) ‘কিতাবুস সলাত’ নামক পুস্তকে হযরত হাকীম ইবনে হিযাম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের সাথে ছিলেন, হঠাৎ তিনি তাঁদেরকে প্রশ্ন করলেনঃ “আমি যা শুনছি তা তোমরাও শুনছো কি?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা তো কিছুই শুনতে পাচ্ছি না!” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আমি আকাশের চড়চড় শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর আকাশকে তার এই চড়চড় শব্দের জন্য তিরস্কার করা যায় না। কেননা ফেরেশতা এতো বেশী রয়েছেন যে, আকাশের মধ্যে কনিষ্ঠাঙ্গুলী পরিমিত এমন জায়গাও ফাঁকা নেই যেখানে কোন না কোন ফেরেশতা রুকূ’ বা সিজদা অবস্থায় আছেন।”
উক্ত পুস্তকেই হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়ার আকাশে পা রাখা পরিমাণ এমন জায়গা ফাঁকা নেই যেখানে কোন একজন ফেরেশতা সিজদা অথবা কিয়ামের অবস্থায় না আছেন। এ জন্যেই কুরআন কারীমের মধ্যে ফেরেশতাদের নিম্নলিখিত উক্তি বিদ্যমান রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমাদের প্রত্যেকের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। আমরা সারিবদ্ধভাবে (দণ্ডায়মান) থাকি এবং আমরা (আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর) তাসবীহ পাঠকারী।”(৩৭:১৬৪-১৬৬) (এ হাদীসটির মারফূ’ হওয়া খুবই গরীব বা দুর্বল। অন্য রিওয়াইয়াতে এ উক্তিটি হযরতইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর বলে বর্ণিত হয়েছে। অন্য সনদে হযরত আলা ইবনে সা’দ (রাঃ) হতেও মারফূ’’রূপে এটা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সনদের দিক দিয়ে এটাও গারীব বা দুর্বল)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত উমার (রাঃ) এমন সময় (মসজিদে) আগমন করেন যে, ঐ সময় নামায শুরু হয়ে গেছে। দেখেন যে, তিনজন লোক (নামাযে না দাঁড়িয়ে) বসে আছে। তাদের একজন ছিল আবূ জাহশ লায়সী। তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা উঠো এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে নামায পড়?” তখন দু’জন উঠলো এবং আবূ জাহশ উঠতে অস্বীকার করে বললোঃ “যদি এমন কোন লোক আসে যে আমার চেয়ে শক্তিশালী এবং আমাকে সে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করে ফেলে দিতে পারে ও আমার চেহারাকে মাটিতে মিলিয়ে দিতে পারে তবে আমি উঠবো, অন্যথায় উঠবো না।” তার একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “এসো, আমিই তোমার সাথে মল্লযুদ্ধ করি।” অতঃপর তিনি তাকে মাটিতে ফেলে দিলেন এবং তার চেহারাকে মাটিতে মিলিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) আসলেন এবং আবূ জাহশকে তাঁর নিকট হতে ছাড়িয়ে নিলেন। এতে হযরত উমার অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং ঐ ক্রোধের অবস্থাতেই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে গেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “হে আবূ হাফস! তোমার হয়েছে কি?” হযরত উমার (রাঃ) তখন তার কাছে পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। ঘটনাটি শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হযরত উমার (রাঃ) তার উপর সন্তুষ্ট থাকলে অবশ্যই তার প্রতি দয়া করতো। হে উমার (রাঃ)! আল্লাহর কসম! তুমি ঐ দুশ্চরিত্র ব্যক্তির মাথা আমার কাছে আনতে পারলে আমি বড়ই খুশী হতাম।” একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) তার দিকে ধাবিত হলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ঐ নরাধম দূরে চলে গেছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে ডেকে নিয়ে বললেনঃ “হে উমার (রাঃ) তুমি এখানে বসে পড়। জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা আবূ জাহশের নামায হতে সম্পূর্ণরূপে বেপরোয়া। দুনিয়ার আকাশে বিনয় প্রকাশকারী অসংখ্য ফেরেশতা আল্লাহর সামনে সিজদায় পড়ে রয়েছেন। তাঁরা কিয়ামত পর্যন্ত মাথা উঠাবেন না এবং তারা একথা বলতে বলতে হাযির হবেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার ইবাদতের হক আদায় করতে পারিনি।” দ্বিতীয় আকাশেও এই একই অবস্থা।” হযরত উমার (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “তারা কোন্ তাসবীহ পাঠ করে থাকেন?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, দুনিয়ার আকাশবাসীরা পাঠ করেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমরা রাজত্বও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করছি।” দ্বিতীয় আকাশবাসীরা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমরা মর্যাদা ও অসীম ক্ষমতার অধিকারীর মহিমা ঘোষণা করছি।” আর তৃতীয় আকাশবাসী ফেরেশতারা পাঠ করেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমরা চিরঞ্জীব যিনি এবং যিনি মৃত্যুবরণ করেন না তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে উমার (রাঃ)! তুমি তোমার নামাযে এগুলো পাঠ করো।” হযরত উমার (রাঃ) তখন বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ইতিপূর্বে যা আপনি আমাকে শিখিয়েছিলেন এবং আমার নামাযে যা পড়তে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কি হবে?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “কখনো এটা পড়বে এবং কখনো ওটা পড়বে। প্রথমে তিনি হযরত উমার (রাঃ)-কে যা পড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা ছিল নিম্নরূপঃ (আরবি)
অর্থাৎ “(হে আল্লাহ!) আমি আপনার ক্ষমার মাধ্যমে আপনার শাস্তি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে আপনার ক্রোধ হতে আশ্রয় চাচ্ছি এবং আপনার হতে আমি আপনারই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনার চেহারা মর্যাদাপূর্ণ।” (এ হাদীসটি ইসহাক ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল ফারাভী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল হাদীস, এমন কি মুনকার বা অস্বীকৃতও বটে। এ হাদীসের বর্ণনাকারী ইসহাক ফারাভী (রঃ) হতে হযরত ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করে থাকেন এবং ইমাম ইবনু হিব্বানও (রঃ) তাঁকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের অন্তর্ভূক্ত করে থাকেন। কিন্তু ইমাম আবূ দাউদ (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ), ইমাম আকীলী (রঃ) এবং ইমাম দারকুতনী (রঃ) তাঁকে দুর্বল বলেছেন। ইমাম আবূ হাতিম রাযী (রঃ) বলেন যে, তিনি সত্যবাদী ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং কখনো কখনো তিনি তালকীন কবুল করতেন তবে তার কিতাবগুলো বিশুদ্ধ। ইমাম আবূ হাতিম রাযী (রঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, ইসহাক ফারাভী (রঃ) বর্ণনাকারী মুশতারাব এবং তার শায়েখ আবদুল মালিক ইবনে কুদামাহ আবূ কাতাদাহ জমিহীর (রঃ) ব্যাপারেও সমালোচনা রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় যে, মুহাম্মাদ ইবনে নাসর (রঃ) তাঁর এই হাদীসকে কি করে রিওয়াইয়াত করলেন। তিনি তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বললেন, না তার অবস্থা জানলেন এবং না এই হাদীসের কোন কোন বর্ণনাকারীর দুর্বলতা বর্ণনা করলেন! হ্যাঁ তবে এটুকু করেছেন যে, ওটাকে অন্য সনদে মুরসালরূপে বর্ণনা করেছেন এবং মুরসালের দু’টি সনদ এনেছেন। একটি হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে এবং অপরটি হযরত হাসান বসরী (রঃ) হতে)
হযরত আদী ইবনে ইরতাত (রঃ) মাদায়েনের জামে মসজিদে তাঁর ভাষণে বলেনঃ আমি একজন সাহাবী হতে শুনেছি যে, তিনি নবী (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলার এমন বহু ফেরেশতা রয়েছেন যারা আল্লাহর ভয়ে সদা প্রকম্পিত থাকেন। তাঁদের চক্ষু দিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়। ঐ অশ্রু ঐ ফেরেশতাদের উপর পতিত হয় যারা নামাযে নিমগ্ন থাকেন। তাদের মধ্যে এমন ফেরেশতাও রয়েছেন যারা দুনিয়ার শুরু থেকে নিয়ে রুকুতেই রয়েছেন এবং অনেকে সিজদাতেই রয়েছেন। কিয়ামতের দিন তারা তাদের পিঠ ও মাথা উঠিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আল্লাহ তা’আলার নিকট আরয করবেনঃ ‘আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমরা আপনার যথোপযুক্ত ইবাদত করতে পারিনি।” (এ হাদীসটি মুহাম্মাদ ইবনে নসর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর সনদে কোন ত্রুটি নেই)
এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ জাহান্নামের এই বর্ণনা তো মানুষের জন্যে সাবধান বাণী।
অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা চন্দ্রের অবসান ঘটা রাত্রির এবং আলোকোজ্জ্বল প্রভাতকালের শপথ করে বলেনঃ এই জাহান্নাম ভয়াবহ বিপদ সমূহের অন্যতম। এর দ্বারা যে জাহান্নামের আগুনকে বুঝানো হয়েছে তা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), মুজাহিদ (রাঃ), কাতাদাহ (রঃ), যহহাক (রঃ) এবং পূর্ব যুগীয় আরো বহু মনীষীর উক্তি।
মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা মানুষের জন্যে সতর্ককারী, তোমাদের মধ্যে যে অগ্রসর হতে চায় কিংবা যে পিছিয়ে পড়ে, তার জন্যে। অর্থাৎ যে ইচ্ছা করবে সে এই সতর্ক বাণীকে কবুল করে নিয়ে সত্যের পথে এসে যাবে এবং যার ইচ্ছা হবে সে এর পরেও এটা থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে থাকবে, এখান হতে দূরে সরে থাকবে এবং এটাকে প্রতিরোধ করতে থাকবে। সবারই জন্যে এটা সতর্ক বাণী।
৩৮-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, কিয়ামতের দিন প্রত্যেককেই তার আমলের উপর পাকড়াও করা হবে। কিন্তু যাদের ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে তারা স্বর্গোদ্যানে শান্তিতে বসে থাকবে। তারা জাহান্নামীদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তির মধ্যে দেখে তাদেরকে বলবেঃ কিসে তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে এসেছে? তারা উত্তরে বলবেঃ আমরা আমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করিনি এবং তাঁর সৃষ্টজীবের সাথে সদ্ব্যবহার করিনি। অজ্ঞতা বশতঃ আমাদের মুখে যা এসেছে তা-ই বলেছি। যেখানেই কাউকেও প্রতিবাদ করতে দেখেছি সেখানেই আমরা তাদের সঙ্গে হয়ে গেছি এবং কিয়ামতকেও অস্বীকার করেছি। শেষ পর্যন্ত আমাদের মৃত্যু হয়ে গেছে। এখানে দ্বারা মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। যেমন, নিম্নের আয়াতেও মৃত্যু অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “মৃত্যু আসা পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাকবে।” (১৫:৯৯) হযরত উসমান ইবনে মাযউন (রাঃ)-এর মৃত্যু সম্পৰ্কীয় হাদীসেও শব্দটি মৃত্যু অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তার নিকট মৃত্যু এসে গেছে।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। কেননা, শাফাআতের পাত্রের ব্যাপারেই শুধু শাফাআত ফলদায়ক হয়ে থাকে। কিন্তু যার প্রাণটিও কুফরীর উপরই বের হয়েছে তার জন্যে সুপারিশ কি করে ফলদায়ক হতে পারে? সে চিরতরে হাবিয়াহ জাহান্নামে জ্বলতে থাকবে।
এরপর প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ তাদের কী হয়েছে যে, তারা উপদেশ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়? তারা যেমন ভীত-এস্ত গর্দভ যা সিংহের সম্মুখ হতে পলায়নপর। ফারসী ভাষায় যাকে (আরবি) বলে, আরবী ভাষায় তাকে (আরবি) বা সিংহ। বলে। আর হাবশী ভাষায় তাকে (আরবি) বলা হয়।
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ বস্তুতঃ তাদের প্রত্যেকেই কামনা করে যে, তাকে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ দেয়া হোক। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যখন তাদের নিকট কোন নিদর্শন আসে তখন তারা বলেঃ আল্লাহর রাসূলদেরকে যা দেয়া হয়েছে আমাদেরকে তা না দেয়া পর্যন্ত আমরা কখনো বিশ্বাস করবো না। আল্লাহ রিসালাতের ভার কার উপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভাল জানেন।” (৬:১২৪)
হযরত কাতাদাহ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর ভাবার্থ এও হতে পারেঃ তারা চায় যে, তাদেরকে বিনা আমলেই ছেড়ে দেয়া হোক।
মহান আল্লাহ বলেনঃ প্রকৃত কারণ এই যে, তারা আখিরাতের ভয় পোষণ করে না। কারণ কিয়ামত যে সংঘটিত হবে এ বিশ্বাসই তাদের নেই। সুতরাং যেটাকে তারা বিশ্বাসই করে না সেটাকে ভয় করবে কি করে?
মহান আল্লাহ বলেনঃ প্রকৃত কথা এই যে, কুরআনই সকলের জন্যে উপদেশ বাণী। অতএব, যার ইচ্ছা সে এটা হতে উপদেশ গ্রহণ করুক। তবে আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কেউ উপদেশ গ্রহণ করবে না। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা ইচ্ছা করবে না যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন।” (৭৬:৩০) অর্থাৎ তোমাদের চাওয়া আল্লাহর চাওয়ার উপর নির্ভরশীল।
পরিশেষে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ একমাত্র তিনিই (আল্লাহই) ভয়ের যোগ্য এবং তিনিই ক্ষমা করার অধিকারী।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করে বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “একমাত্র আমিই ভয়ের যোগ্য, সুতরাং একমাত্র আমাকেই ভয় করতে হবে এবং আমার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করা চলবে না। যে ব্যক্তি আমার সাথে শরীক করা হতে বেঁচে গেল সে আমার ক্ষমা প্রাপ্তির যোগ্য হয়ে গেল।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)।
৩২-৫৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তিনটি বড় বড় নিদর্শন নিয়ে কসম করে বলছেন : জাহান্নাম তাঁর অন্যতম একটি বড় নিদর্শন, যা কাফির জালিমদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
(إِنَّهَا لَإِحْدَي الْكُبَرِ)
এ আয়াত পূর্বের আয়াতগুলোর শপথের জবাব। كبر শব্দটি كبري এর বহুবচন। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার বিশাল ও ভয়াবহ জিনিসের মধ্যে জাহান্নাম একটি। এটি জালিমদের জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে। সুতরাং যে চায় সৎ পথ গ্রহণ করুক, আর যে চায় নিজেকে ধ্বংস করুক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ধমক দিয়ে বলেছেন : “বল : ‘সত্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে; সুতরাং যার ইচ্ছা ঈমান আনুক ও যার ইচ্ছা কুফরী করুক।’ আমি জালিমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেওয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে; এটা নিকৃষ্ট পানীয়! আর জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়!” (সূরা কাহফ ১৮ : ২৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন নিদর্শন দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করেন।
২. আল্লাহ তা‘আলার বাহিনী অসংখ্য, তিনিই সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন।
৩. হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ, তাই আমাদের উচিত তাঁর কাছেই হিদায়াত চাওয়া।
৩৮-৫৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
জাহান্নামীরা কী কারণে জাহান্নামে যাবে, সে কারণগুলো এখানে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
رَهِيْنَةٌ অর্থ বন্ধক রাখা জিনিসকে বলা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার কৃত আমলের কারণে আটক, বন্ধক ও দায়বদ্ধ থাকবে। মানুষ যেমন একজন অন্যজনের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিস বন্ধক রেখে টাকা বা খাদ্য ধার করে থাকে এবং ধার করা টাকা বা খাদ্য ফেরত দিলে বন্ধক রাখা মূল্যবান জিনিস ফেরত দেওয়া হয় ঠিক তেমনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রতিটি আত্মা কিয়ামতের দিন বন্ধক থাকবে, প্রতিটি কর্মের হিসাব দিলে তা ফেরত দেওয়া হবে। তবে যারা ডান হাতে আমলনামা পাবে তারা ব্যতীত, কারণ তাদের এমন কোন খারাপ আমল থাকবে না যার কারণে তারা দায়বদ্ধ থাকবে। এ সব জান্নাতীরা পরস্পর অপরাধীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, কেন তোমরা জাহান্নামে গেলে? জাহান্নামীরা জবাবে বলবে : (১) আমরা সালাত আদায় করতাম না। (২) মিসকীনদের খাবার দিতাম না। (৩) সত্যকে খণ্ডন করার জন্য বাতিল নিয়ে সবর্দা মত্ত থাকতাম। (৪) এমনকি আখিরাতকেও অস্বীকার করতাম।
এ অবস্থা বহাল থাকতে থাকতে আমাদের মৃত্যু চলে আসল। এ কারণে আজ আমরা জাহান্নামী।
الْيَقِيْنُ শব্দের অর্থ : দৃঢ় বিশ্বাস। তবে এখানে অর্থ হল : মৃত্যু, কারণ মৃত্যুর ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّٰي يَأْتِيَكَ الْيَقِيْنُ)
“তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ‘ইবাদত কর।” (সূরা হিজর ১৫ : ৯৯)
(فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ)
সেদিন কোন সুপারিশকারীর সুপারিশ তাদের কাজে আসবে না। কারণ তাদের আমলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট নন। যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি রয়েছে এবং সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন কেবল তারাই সুপারিশ দ্বারা উপকৃত হবে। এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার আয়াতুল কুরসীতে আলোচনা করা হয়েছে।
قَسْوَرَةٍ অর্থ সিংহ, কেউ বলেছেন তীরন্দাজ। অর্থাৎ এদের সত্যের প্রতি বিদ্বেষ এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা ঐ রকমই যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত জংলী গাধা সিংহ দেখে পালায়, যখন সে তাকে শিকার করতে চায়।
(أَنْ يُّؤْتٰي صُحُفًا مُّنَشَّرَةً)
অর্থাৎ ঐ সকল প্রত্যেক মুশরিক চায় যে, তার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করা হোক যেমন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذَا جَا۬ءَتْهُمْ اٰيَةٌ قَالُوْا لَنْ نُّؤْمِنَ حَتّٰي نُؤْتٰي مِثْلَ مَآ أُوْتِيَ رُسُلُ اللّٰهِ)
“যখন তাদের নিকট কোন নিদর্শন আসে তারা তখন বলে, ‘আল্লাহর রাসূলদেরকে যা দেওয়া হয়েছিল আমাদেরকেও তা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা কখনও বিশ্বাস করব না।’ (সূরা আনআম ৬ : ১২৪) মূলত তারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হিংসা ও বিদ্বেষবশত এ কথা বলত। তাদের কাছে প্রত্যেক নিদর্শন আসলেও তারা আযাব প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ঈমান আনবে না। কারণ তাদের কাছে সত্য বর্ণনাকারী নিদর্শনসমূহ এসেছিল কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং যদি তাদের মাঝে কোন কল্যাণ থাকত তাহলে তারা ঈমান আনত। পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ধমক দিয়ে বলছেন- কক্ষনো নয়, তারা যা কামনা করে তা আমি দেব না। কার কাছে ওয়াহী প্রেরণ করা দরকার, কে তার যোগ্য সে আমিই ভাল জানি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اَللہُ اَعْلَمُ حَیْثُ یَجْعَلُ رِسٰلَتَھ۫ﺚ سَیُصِیْبُ الَّذِیْنَ اَجْرَمُوْا صَغَارٌ عِنْدَ اللہِ وَعَذَابٌ شَدِیْدٌۭ بِمَا کَانُوْا یَمْکُرُوْنَ)
“আল্লাহ তাঁর রিসালাতের ভার কার ওপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভাল জানেন। যারা অপরাধ করেছে, তাদের চক্রান্তের কারণে আল্লাহর নিকট হতে লাঞ্ছনা ও কঠোর শাস্তি তাদের ওপর পতিত হবেই।” (সূরা আন‘আম ৬ : ১২৪) প্রকৃতপক্ষে তারা আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে না। যদি ঈমান রাখত তাহলে তাদের অবস্থা এমন হত না।
আল্লাহ তা‘আলা আবার সতর্ক করে বলছেন : যদিও তারা কুরআনকে এড়িয়ে চলে, মুহাম্মাদের বিরোধিতা করে তবুও সকলের জানা উচিত যে, এ কুরআন হলো সাবধানকারী বাণী। সুতরাং যে চায় সে এখান থেকে উত্তম নির্দেশাবলী গ্রহণ করে নিজের দুনিয়াবী ও আখিরাতের জীবন সাফল্যময় করুক। আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে সে কেবল নিজেকেই ধ্বংস করল।
(وَمَا يَذْكُرُوْنَ إِلَّآ أَنْ يَّشَا۬ءَ اللّٰهُ)
অর্থাৎ এ কুরআন থেকে কেবল তারাই হিদায়াত নিতে পারবে যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করবেন। অতএব বান্দার সকল কাজই আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন এবং বান্দারও ইচ্ছা রয়েছে সে ইচ্ছাও আল্লাহর অধীন। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই হয় না।
(هُوَ أَهْلُ التَّقْوٰي وَأَهْلُ الْمَغْفِرَةِ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র মা‘বূদ যিনি ভয় ও ইবাদত পাওয়ার অধিকার রাখেন, তিনি ছাড়া এমন কোন মা‘বূদ নেই যিনি ইবাদত পাওযার যোগ্য। আর যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে তিনি তাদের ক্ষমা করেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তি কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে।
২. জাহান্নামীদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ জানতে পারলাম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা যাকে যার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন কেবল সেই তার জন্য সুপারিশ করতে পারবে।
৪. ‘আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন’ এ গুণের প্রমাণ পেলাম।
৫. হিদায়াত পাওয়ার জন্য মনে-প্রাণে ইসলামকে ভালবাসতে হবে, অন্যথায় হিদায়াত পাওয়া সম্ভব নয়।
৩২-৫৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৩২
كَلَّا وَ الْقَمَرِۙ
কখ্খনো না,চাঁদের শপথ,
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ এটা কোন ভিত্তিহীন কথা নয় যে তা নিয়ে এভাবে হাসি তামাসা বা ঠাট্রা-বিদ্রূপ করা যাবে।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৩৫
اِنَّهَا لَاِحْدَى الْكُبَرِۙ
এ দোযখও বড় জিনিসগুলোর একটি।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ চন্দ্র এবং রাত-দিন যেমন আল্লাহর কুদরতের বিরাট বিরাট নিদর্শন ঠিক তেমনি দোযখও আল্লাহর বিশাল সৃষ্টিসমূহের একটি। চাঁদের অস্তিত্ব যদি অসম্ভব না হয়ে থাকে। রাত ও দিনের নিয়মানুবর্তিতার সাথে আগমন তথা আবর্তন যদি অসম্ভব না হয় তাহলে তোমাদের মতে দোযখের অস্তিত্ব অসম্ভব হবে কি কারণে? রাত দিন সব সময় যেহেতু তোমরা এসব জিনিস দেখছো তাই এগুলো সম্পর্কে তোমাদের মনে কোন বিস্ময় জাগে না। অন্যথায় এগুলোর প্রত্যেকটি আল্লাহর কুদরতের একেকটি বিস্ময়কর মু’জিযা। কোন সময় এসব জিনিস যদি তোমরা না দেখতে। আর এ অবস্থায় কেউ যদি তোমাদের বলতো যে, চাঁদের মত একটি জিনিস এ পৃথিবীতে আছে অথবা সূর্য এমন একটি বস্তু যা আড়ালে চলে গেলে দুনিয়া আঁধারে ঢাকা পড়ে এবং আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলে দুনিয়া আলোকোদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাহলে একথা শুনেও তোমাদের মত লোকেরা অট্টহাসিতে ঠিক তেমনি ফেটে পড়তে যেমন দোযখের কথা শুনে আজ ফেটে পড়ছো।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৩৭
لِمَنْ شَآءَ مِنْكُمْ اَنْ یَّتَقَدَّمَ اَوْ یَتَاَخَّرَؕ
যে অগ্রসর হতে চায় বা পেছনে পড়ে থাকতে চায় তাদের সবার জন্য।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এর অর্থ হলো, এ জিনিসটি দ্বারা মানুষকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এখন কেউ ইচ্ছা করলে এ জিনিসটিকে ভয় করে কল্যাণের পথে আরো এগিয়ে যেতে পারে। আবার কেউ ইচ্ছা করলে পেছনে সরে যেতে পারে।
# এখানে “জিম্মী” বা “বন্ধক” শব্দটি রূপক ব্যবহার অত্যন্ত অর্থবহ। কোন ব্যক্তি যদি কাউকে কিছু ঋণ দেয় এবং ঋণদাতা তার পাওনা আদায়ের নিশ্চয়তা হিসেবে ঋণ গ্রহীতার কোন জিনিস নিজের কাছে বন্ধক রাখে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঋণ পরিশোধ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধকী বস্তু মুক্ত হবে না। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি বন্ধকী বস্তু মুক্ত না করে তাহলে বন্ধকী বস্তুটি বাজেয়াপ্ত বা হাতছাড়া হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলাও মানুষের মধ্যকার লেনদেনের বিষয়টিকে এখানে বন্ধকী লেনদেনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে যে সাজ-সরঞ্জাম, যেসব শক্তি, যেসব যোগ্যতা এবং যেসব ইখতিয়ার দিয়েছেন তা যেন মালিক তার বান্দাকে ঋণ দিয়েছেন। এ ঋণের জামানত হিসেবে বান্দা নিজেই আল্লাহর কাছে বন্ধক বা জিম্মী হয়ে রয়েছে। বান্দা যদি এসব সাজ-সরঞ্জাম, শক্তি এবং ইখতিয়ার সঠিক ভাবে ব্যবহার করে নেকী অর্জন করে— যে নেকী দ্বারা এসব ঋণ পরিশোধ হবে, তাহলে সে বন্ধকী মাল অর্থাৎ নিজেকে মুক্ত করে নেবে। অন্যথায় তা বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হবে। পূর্ববর্তী আয়াতের পরপরই একথা বলার কারণ হচ্ছে, সৎকর্মশীল ঈমানদারগণ যত বড় মর্যাদা সম্পন্নই হোক না কেন তাদের সন্তানরা নিজেদের কর্ম দ্বারা নিজেদের সত্তাকে মুক্ত না করলে তাদের বন্ধক মুক্তি হতে পারে না। বাপ-দাদার কর্ম সন্তানদের মুক্ত করতে পারে না। তবে সন্তানরা যদি যে কোন মাত্রার ঈমান ও সৎকর্মশীলদের আনুগত্য দ্বারা নিজেরা নিজেদের মুক্ত করতে পারে তাহলে আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে তাদেরকে নিম্ন মর্যাদা থেকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে বাপ-দাদার সাথে একত্রিত করে দেবেন। এটা নিছক আল্লাহ তা’আলার মেহেরবানী ও দয়া। সন্তানরা বাপ-দাদার সৎকাজের এ সুফলটুকু অন্তত লাভ করতে পারে। তবে তারা যদি নিজেদের কর্মদ্বারা নিজেরাই নিজেদেরকে দোযখের উপযোগী বানায় তাহলে এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, বাপ-দাদার কারণে তাদেরকে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। সাথে সাথে এ আয়াত থেকে একথাও বুঝা যায় যে, নিম্ন মর্যাদার নেক সন্তানদের নিয়ে উচ্চ মর্যাদার নেক পিতা-মাতার সাথে একত্রিত করে দেয়া প্রকৃতপক্ষে সেসব সন্তানের কর্মের ফল নয়, বরং তা ঐসব পিতা-মাতার কর্মের ফল। তারা নিজেদের আমল দ্বারা এ মর্যাদা লাভের উপযুক্ত হবে। তাই তাদের মন খুশী করার জন্য সন্তানদেরকেও তাদের সাথে একত্রিত করা হবে। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা মর্যাদা হ্রাস করে তাদেরকে তাদের সন্তানদের কাছে নিয়ে যাবেন না। বরং সন্তানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাদের কাছে নিয়ে যাবেন; যাতে নিজ সন্তানদের থেকে দূরে অবস্থানের কারণে মনকষ্ট না হয় এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিয়াতমসমূহ পূর্ণ করে দেয়ার ক্ষেত্রে এ কমতিটুকু না থেকে যায়।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৩৯
اِلَّاۤ اَصْحٰبَ الْیَمِیْنِؕۛ
তবে ডান দিকের লোকেরা ছাড়া
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অন্য কথায় বাম দিকের লোকেরা তাদের কৃতকর্মের বিনিময়ে পাকড়াও হবে। কিন্তু ডান দিকের লোকেরা দায়বদ্ধ অবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেবে। (ডান বা বাঁ দিকের ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ওয়াকিয়া, টীকা, ৫ ও ৬ )।
# মূল আয়াতে أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ব্যাকরণ অনুসারে ميمنة শব্দটি يمين শব্দ থেকে গৃহীত হতে পারে— যার অর্থ ডান হাত। আবার يمن শব্দ থেকেও গৃহিত হতে পারে যার অর্থ শুভ লক্ষণ। যদি ধরে নেয়া যায় যে, এ শব্দটির উৎপত্তি يمين শব্দ থেকে হয়েছে তাহলে أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ এর অর্থ হবে, “ডান হাতের অধিকারী।” কিন্তু এখানে এর আভিধানিক অর্থ অভিপ্রেত নয়। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন লোক ডান হাতকে আরবের লোকেরা শক্তি, মহত্ব ও মর্যাদার প্রতীক বলে মনে করতো। যাকে মর্যাদা প্রদর্শন উদ্দেশ্য হতো মজলিসের মধ্যে তাকে ডান হাতের দিকে বসাতো। আমার কাছে অমুক ব্যক্তির অনেক সম্মান ও মর্যাদা একথা বুঝানোর প্রয়োজন হলে বলতোঃ فُلَانٌ مِنِّى بِالْيَمِيْن সে তো আমার ডান হাতের পাশে। আমাদের ভাষাতেও কাউকে কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির ‘দক্ষিণ হস্ত’ বলার অর্থ সে তার ঘনিষ্ঠ জন। আর যদি ধরে নেয়া যায় যে, এর উৎপত্তি يمن শব্দ থেকে হয়েছে তাহলে أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ এর অর্থ হবে, ‘খোশ নসীব’ ও সৌভাগ্যবান।
# মূল ইবারতে “أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ ” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। مشئمة শব্দের উৎপত্তি হয়েছে شئوم থেকে। এর অর্থ, দুর্ভাগ্য, কুলক্ষণ, অশুভ লক্ষণ। আরবী ভাষায় বাঁ হাতকেও شومى বলা হয়। আরবরা شمال (বাঁ হাত) এবং شوم অশুভ লক্ষণ, শব্দ দু’টিকে সমার্থক বলে মনে করতো। তাদের কাছে বাঁ হাত দুর্বলতা ও লাঞ্ছনার প্রতীক। সফরে রওয়ানা হওয়ার সময় যদি পাখী তাদের বাঁ হাতের দিক দিয়ে উড়ে যেতো তাহলে তারা একে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করতো। কাউকে বাঁ পাশে বসালে তার অর্থ হতো সে তাকে নীচু মর্যাদার লোক মনে করে। আমার কাছে তার কোন মর্যাদা নেই কারো সম্পর্কে যদি একথা বলতে হয় তাহলে বলা হয় فُلَانٌ مِنِّى بِالشِّمَال সে আমার বাঁ পাশের লোক। বাংলা ভাষাতেও খুব হালকা ও সহজ কাজ বুঝাতে বলা হয়, এটা আমার বাঁ হাতের খেলা। অতএব, أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ অর্থ দুর্ভাগা লোক অথবা এমন লোক যারা আল্লাহর কাছে লাঞ্ছনার শিকার হবে এবং আল্লাহর দরবারে তাদেরকে বাঁ দিকে দাঁড় করানো হবে।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৪১
عَنِ الْمُجْرِمِیْنَۙ
অপরাধীদের
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# ইতিপূর্বে কুরআন মজীদের কয়েকটি স্থানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে যে, জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীরা পরস্পর থেকে লাখ লাখ মাইল দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও যখনই ইচ্ছা করবে কোন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই একে অপরকে দেখতে পাবে এবং সরাসরি কথাবার্তাও বলতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, আয়াত ৪৪ থেকে ৫০ , টীকা ৩৫ ; আস সাফ্ফাত, আয়াত ৫০ থেকে ৫৭ , টীকা ৩২ ।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৪৩
قَالُوْا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّیْنَۙ
তারা বলবেঃ আমরা নামায পড়তাম না।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এর অর্থ হলো, যেসব মানুষ আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং তাঁর কিতাবকে মেনে নিয়ে মানুষের কাছে আল্লাহর প্রাথমিক হক অর্থাৎ নামায ঠিকমত আদায় করেছে আমরা তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। এক্ষেত্রে একথাটি খুব ভাল করে বুঝে নেয়া দরকার যে, কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত নামায পড়তেই পারে না যতক্ষণ না সে ঈমান আনে। তাই নামাযী হওয়ার অনিবার্য অর্থ হচ্ছে ঈমানাদার হওয়া। কিন্তু নামাযী না হওয়াকে দোযখে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করার মাধ্যমে স্পষ্ট করে একথাই বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি নামায না পড়লে ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও সে দোখয থেকে বাঁচতে পারবে না।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৪৪
وَ لَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِیْنَۙ
অভাবীদের খাবার দিতাম না।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এ থেকে জানা যায় কোন মানুষকে ক্ষুধার্ত দেখার পর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও খাবার না দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কত বড় গোনাহ যে, মানুষের দোযখে যাওয়ার কারণসমূহের মধ্যে এটাকেও একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
#অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত আমরা এ নীতি ও কর্মপন্থা অনুসরণ করেছি। শেষ পর্যন্ত সে নিশ্চিত বিষয়টি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে যে সম্পর্কে আমরা গাফিল হয়ে পড়েছিলাম। নিশ্চিত বিষয় বলে মৃত্যু ও আখেরাত উভয়টিকেই বুঝানো হয়েছে।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৪৮
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشّٰفِعِیْنَؕ
সে সময় সুপারিশকারীদের কোন সুপারিশ তাদের কাজে আসবে না।
তাফসীর : তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ যারা মৃত্যু পর্যন্ত এ নীতি অনুসরণ করেছে তাদের জন্য শাফায়াত করলেও সে ক্ষমা লাভ করতে পারবে না। শাফায়াত সম্পর্কে কুরআন মজীদের বহু স্থানে এত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, কে শাফায়াত করতে সক্ষম আর কে সক্ষম নয়, কোন্ অবস্থায় শাফায়াত করা যায় আর কোন্ অবস্থায় যায় না। কার জন্য করা যায় আর কার জন্য যায় না এবং কার জন্য তা কল্যাণকরআর কার জন্য তা কল্যাণকর নয় তা জানা কারো জন্য কঠিন নয়। পৃথিবীতে মানুষের গোমরাহীর বড় বড় কারণের মধ্যে একটি হলো শাফায়াত সম্পর্কে ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস পোষণ। তাই বিষয়টি কুরআন এত খোলামেলা ও স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছে যে, এক্ষেত্রে সন্দেহের আর কোন অবকাশই বাকী রাখেনি। উদাহরণ স্বরূপ নিচে নির্দেশিত আয়াতসমূহ দেখুন, সূরা আল বাকারাহ, ২৫৫ ; আল আন’আম, ৯৪ ; আল আ’রাফ, ৫৩ ; ইউনুস, ৩ ও ১৮ ; মারয়াম, ৮৭ ; ত্বা-হা, ১০৯ ; আল আম্বিয়া, ২৮ ; সাবা, ২৩ ; আয যুমার, ৪৩ ও ৪৪ , আল মু’মিন, ১৮ ; আদ দুখান, ৪২ ; আন নাজম, ২৬ এবং আন নাবা, ৩৭ ও ৩৮ । যেসব স্থানে এসব আয়াত আছে তাফহীমুল কুরআনের সেসব জায়গায় আমরা বিস্তারিতভাবে তার ব্যাখ্যা পেশ করেছি।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৫১
فَرَّتْ مِنْ قَسْوَرَةٍؕ
পালায়নপর বন্য গাধা।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটা প্রচলিত একটি আরবী প্রবাদ। বন্য গাধার বৈশিষ্ট্য হলো বিপদের আভাস পাওয়া মাত্র এত অস্থির হয়ে পালাতে থাকে যে আর কোন জন্তু তেমন করে না। এজন্য আরবরা অস্বাভাবিক রকম অস্থির ও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পলায়নপর ব্যক্তিকে বাঘের গন্ধ বা শিকারীর মৃদু পদশব্দ শোনামাত্র পলায়নরত বন্য গাধার সাথে তুলনা করে থাকে।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৫২
بَلْ یُرِیْدُ كُلُّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ اَنْ یُّؤْتٰى صُحُفًا مُّنَشَّرَةًۙ
বরং তারা প্রত্যেকে চায় যে, তার নামে খোলা চিঠি পাঠানো হোক।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ তারা চায় যে, আল্লাহ তা’আলা যদি সত্যি সত্যিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসেবে পাঠিয়ে থাকেন তাহলে তিনি মক্কার প্রত্যেক নেতা ও সমাজপতিদের কাছে যেন একখানা করে পত্র লিখে পাঠান যে, মুহাম্মাদ ﷺ সত্যিই আমার নবী, তোমরা তাঁর আনুগত্য করো। পত্রখানা এমন হবে যেন তা দেখে তারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে যে, আল্লাহই এ পত্র লিখে পাঠিয়েছেন। কুরআন মজীদের অন্য এক জায়গায় মক্কার কাফেরদের এ উক্তিরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, “আল্লাহর রসূলদের যা দেয়া হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত তা আমাদের দেয়া না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মেনে নেব না।” (আল আন’আম ২৪) অন্য এক জায়গায় তাদের এ দাবীও উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, “আপনি আমাদের চোখের সামনে আসমানে উঠে যান এবং সেখান থেকে লিখিত কিতাব নিয়ে আসেন, আমরা তা পড়ে দেখবো।” (বনী ইসরাঈল, ৯৩)
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৫৩
كَلَّا١ؕ بَلْ لَّا یَخَافُوْنَ الْاٰخِرَةَؕ
তা কখখনো হবে না। আসল কথা হলো, এরা আখেরাতকে আদৌ ভয় করে না।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ এদের ঈমান না আনার আসল কারণ এটা নয় যে, তাদের এ দাবী পূরণ করা হচ্ছে না। বরং এর আসল কারণ হলো এরা আখেরাতের ব্যাপারে বেপরোয়া ও নির্ভীক। এরা এ পৃথিবীকেই পরম পাওয়া মনে করে নিয়েছে। তাই তাদের এ ধারণাটুকু পর্যন্ত নেই যে, এ দুনিয়ার জীবন শেষ হওয়ার পর আরেকটি জীবন আছে যেখানে তাদেরকে নিজ নিজ কৃতকর্মের হিসেব দিতে হবে। এ জিনিসটিই তাদেরকে এ পৃথিবীতে নিরুদ্বিগ্ন ও দায়িত্বহীন বানিয়ে দিয়েছে। হক ও বাতিল এবং সত্য ও মিথ্যার প্রশ্নে তারা অর্থহীন মনে করে। কারণ দুনিয়াতে এমন কোন সত্য তারা দেখতে পায় না যা অনুসরণ করার ফলাফল এ দুনিয়াতে সবসময় ভাল হয়ে থাকে এবং এমন কোন বাতিল বা মিথ্যাও তারা দুনিয়াতে দেখতে পায় না যার ফলাফল এ দুনিয়াতে সবসময় মন্দই হয়ে থাকে। তাই প্রকৃতপক্ষে সত্য কি আর মিথ্যা কি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা তারা নিরর্থক মনে করে। যে ব্যক্তি দুনিয়ার এ জীবনকে অস্থায়ী জীবন বলে মনে করে এবং সাথে সাথে এও বিশ্বাস করে যে, সত্যিকার এবং চিরস্থায়ী জীবন হলো আখেরাতের জীবন যেখানে সত্যের ফলাফল অনিবার্যরূপে ভাল এবং মিথ্যার ফলাফল অনিবার্যরূপে মন্দ হবে, হক ও বাতিল এবং সত্য ও মিথ্যার প্রশ্নটি কেবলমাত্র সে ব্যক্তির কাছেই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। এ প্রকৃতির লোক কুরআনের পেশকৃত যুক্তিপূর্ণ দলীল-প্রমাণ এবং পবিত্র শিক্ষাসমূহ দেখেই তার প্রতি ইমান আনবে এবং নিজের বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে বুঝার চেষ্টা করবে যে, কুরআন যেসব আকীদা-বিশ্বাস এবং কাজ-কর্মকে ভ্রান্ত বলছে তার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কি কি ভুল-ভ্রান্তি আছে। কিন্তু আখেরাতকে অস্বীকারকারী, যে সত্যের অনুসন্ধানে নিষ্ঠাবান নয় সে ঈমান গ্রহণ না করার জন্য নতুন নতুন দাবী পেশ করতে থাকবে। অথচ তার যে কোন দাবীই পূরণ করা হোক না কেন সত্যকে অস্বীকার করার জন্য সে আরেকটি নতুন বাহানা খাড়া করবে। এ কথাটিই সূরা আন’আমে এভাবে বলা হয়েছেঃ “হে নবী, আমি যদি কাগজে লিখিত কোন গ্রন্থও তোমার প্রতি নাযিল করতাম আর এসব লোকেরা তা হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখতো তারপরও যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে তারা বলতো, এতো স্পষ্ট যাদু।” (সূরা আন’আম, ৭)
#অর্থাৎ তাদের এ ধরনের কোন দাবী কখখনো পূরণ করা হবে না।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৫৬
وَ مَا یَذْكُرُوْنَ اِلَّاۤ اَنْ یَّشَآءَ اللّٰهُ١ؕ هُوَ اَهْلُ التَّقْوٰى وَ اَهْلُ الْمَغْفِرَةِ۠
আর আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তারা কোন শিক্ষা গ্রহণ করবে না। একমাত্র তিনিই তাকওয়া বা ভয়ের যোগ্য। এবং (তাকওয়ার নীতি গ্রহণকারীদের) ক্ষমার অধিকারী।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ নসীহত গ্রহণ করা শুধু কোন ব্যক্তির নিজের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে না বরং নসীহত গ্রহণ করার সৌভাগ্য সে তখনই লাভ করে যখন আল্লাহর ইচ্ছা তাকে নসীহত গ্রহণ করার সুমতি ও সুবুদ্ধি দান করে। অন্য কথায় এখানে এ সত্য তুলে ধরা হয়েছে যে, বান্দার কোন কাজই এককভাবে বান্দার নিজের ইচ্ছায় সংঘটিত হয় না। বরং প্রতিটি কাজ কেবল তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন আল্লাহর ইচ্ছা বান্দার ইচ্ছার অনুকূল হয়। এ সূক্ষ্ম বিষয়টি সঠিকভাবে না বুঝার কারণে মানুষের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-ভাবনা অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খায়। অল্প কথায় বিষয়টি এভাবে বুঝা যেতে পারে, প্রতিটি মানুষ যদি পৃথিবীতে এতটা ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী হতো যে, সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে তাহলে গোটা পৃথিবীর নিয়ম-শৃংখলা ভেঙে পড়তো। বর্তমানে এ পৃথিবীতে যে নিয়ম-শৃংখলা আছে তা এ কারণেই আছে যে, আল্লাহর ইচ্ছা সব ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষ যা-ই করতে ইচ্ছা করুক না কেন তা সে কেবল তখনই করতে পারে যখন আল্লাহর ইচ্ছা হয় যে, সে তা করুক। হিদায়াত ও গোমরাহীর ব্যাপারটাও ঠিক অনুরূপ। নিজের জন্য হিদায়াত কামনা করাই মানুষের হিদায়াত পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং সে হেদায়াত কেবল তখনই লাভ করে যখন আল্লাহ তার এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার ফায়সালা করেন। একইভাবে বান্দার পক্ষ থেকে গোমরাহীর পথে চলার ইচ্ছাই তার গোমরাহীর জন্য যথেষ্ট নয়। বরং তার মধ্যে গোমরাহীর দাবী ও আকাঙ্ক্ষা দেখে আল্লাহর ইচ্ছা যখন তাকে গোমরাহী ও ভ্রান্তির পথে চলার মঞ্জুরী ও ফায়সালা দেন তখনই কেবল সে ভ্রান্তি ও গোমরাহীর পথে চলতে থাকে। এভাবে সে গোমরাহীর সেসব পথে চলতে পারে যেসব পথে চলার অবকাশ আল্লাহ তাকে দেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি চোর হতে চায়, তাহলে তার এ ইচ্ছাটুকুই এজন্য যথেষ্ট নয় যে, সে যেখানে ইচ্ছা, যে ঘর থেকে ইচ্ছা এবং যা ইচ্ছা চুরি করে নিয়ে যেতে পারবে। বরং আল্লাহ তাঁর নিজের ব্যাপক জ্ঞান, যুক্তি ও প্রজ্ঞা অনুসারে তার এ ইচ্ছাকে যখন, যতটা এবং যেভাবে পূরণ করার সুযোগ দেন সে কেবল ততটুকুই পূরণ করতে পারে।
# অর্থাৎ আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যে নসীহত তোমাদের করা হচ্ছে তা এজন্য নয় যে, তাতে আল্লাহর নিজের কোন প্রয়োজন আছে এবং তোমরা তা না করলে আল্লাহর কোন ক্ষতি হবে। বরং এ নসীহত করা হচ্ছে এজন্য যে, বান্দা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করুক এবং তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে না চলুক এটা আল্লাহর হক বা অধিকার।
# অর্থাৎ কেউ আল্লাহর নাফরমানী যতই করে থাকুক না কেন যখনই সে এ আচরণ থেকে বিরত হয় তখন আল্লাহ তার প্রতি নিজের রহমতের হাত বাড়িয়ে দেন। যেহেতু তিনি বান্দা থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের কোন ইচ্ছা আদৌ পোষণ করেন না তাই এমন হঠকারী তিনি নন যে, কোন অবস্থায়ই তাকে ক্ষমা করবেন না বা শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৩২-৩৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী জিলালিল কুরআন:
এখানে আখেরাত, দোযখ ও আল্লাহর ফেরেশতা-বাহিনীর ন্যায় অদৃশ্য সৃষ্টিকে দৃশ্যমান জগতের বিভিন্ন সৃষ্টির সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। দৃশ্যমান জগতের এই জিনিসগুলােকে মানুষ সবসময়ই দেখে, কিন্তু উদাসীন ও চেতনাহীন ভাবে দেখে। অথচ এগুলাে স্রষ্টার এক নিখুঁত পরিচালনা ও সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব নির্দেশ করে। এগুলোর সৃষ্টি, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার পশ্চাতে এক মহান উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। এগুলাের শেষে রয়েছে হিসাব নিকাশ ও কর্মফল প্রদানের ব্যবস্থা। আয়াত কয়টি লক্ষণীয়, ‘কখনাে নয়, চাঁদের শপথ, পশ্চাদপসরণশীল রজনীর শপথ, বিকাশমান প্রভাতের শপথ। নিশ্চয়ই এগুলাে আল্লাহর বড় বড় নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। মানবজাতির জন্য সতর্ককারী।’ চাঁদ, অপস্রিয়মান রজনী ও আসন্ন প্রভাতকালের প্রত্যেকটির দৃশ্য অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ও শিক্ষাপ্রদ। এগুলো মানুষের মনকে অনেক কথা বলে। অনেক গােপন তথ্য তাকে জানায়। অনেক গভীর আবেগ ও অনুভূতি তার ভেতরে সঞ্চারিত করে। কোরআন তার এই সংক্ষিপ্ত ইংগিতগুলাে দ্বারা উল্লেখিত গােপন তত্ত্ব ও সুপ্ত আবেগ অনুভূতিগুলােকে শ্রোতাদের হৃদয়ে সঞ্চালিত করে। কেননা মানুষের হৃদয়ের চড়াই উৎরাই ও প্রবেশদ্বার সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বেশী। চাঁদের উদয় অস্ত ও আকাশ পরিভ্রমণের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে তা থেকে প্রাকৃতিক জগতের গােপন রহস্য সম্পর্কে কোনােরকম তথ্য লাভ করে না এমন মানুষ খুবই বিরল। এমনকি সচেতন মন ও জাগ্রত বিবেক নিয়ে এক মুহূর্তও চাঁদের আলােতে অবস্থান করলে তা মানুষের মনকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিতে পারে এবং সেটা তার জন্যে আলােতে পরিণত হওয়া বিচিত্র নয়। সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে শেষ রাতের নিঝুম মুহূর্তে যদি কেউ জাগ্রত মন নিয়ে প্রকৃতির জাগরণ ও উত্থানের দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে তার মনে সেই দৃশ্যের প্রতিক্রিয়া না হয়ে পারে না এবং তার হৃদয়ের গভীরতম প্রকোষ্ঠে স্বচ্ছ চিন্তার উন্মেষ না ঘটেও পারে না। অনুরূপভাবে উষার আগমন কালের দৃশ্য যদি কেউ জাগ্রত বিবেক নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, তবে তার ভেতরেও আলােড়ন ও সচেতন ভাবান্তর উপস্থিত না হয়ে পারে না। প্রকৃতির আলাে তার চোখে উদ্ভাসিত হওয়ার সাথে সাথে তার হৃদয় ও বিবেকেও হেদায়াতের আলাে গ্রহণের যােগ্যতা সৃষ্টি হয়ে যাবে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা মানুষের মন ও বিবেককে সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনি জানেন যে, এই সব প্রাকৃতিক দৃশ্য স্বতস্ফূর্তভাবেই কখনাে কখনাে মানুষের মনে এমন বিস্ময়কর পরিবর্তন আনে, যাকে অনেকটা পুনঃ সৃষ্টির নামান্তর বলা যেতে পারে। চাঁদ, রাত ও উষাকালের আগমন নির্গমন, আলোর বিকিরণের ঘটানাের পেছনে একটা বিস্ময়কর সত্য রয়েছে, যা অনুধাবন করার জন্যে কোরআন মানুষের মন ও বিবেককে উদ্বুদ্ধ করে। এসবের পেছনে এক অকল্পনীয় সৃজনী শক্তি, এক বিচক্ষণ প্রজ্ঞা ও এক নিপুন পরিচালনা যা সত্যিকার অর্থে বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত সমন্বয়ের এমন সুক্ষ ও অকাট্য সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মানুষের বিবেক বুদ্ধিকে ক্ষনিকের জন্যে তা বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। উদাসীন ও অবহেলা প্রবণ মানুষের সম্বিত ফেরানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা এসব প্রাকৃতিক নিদর্শনের শপথ করেছেন। কেননা এগুলাে বিরাট মর্যাদাবান সৃষ্টি এবং এগুলাের ভেতরে অনেক শিক্ষার বিষয় রয়েছে। শপথ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন যে, দোযখ ও দোযখের পরিচালনা ও প্রহরারত ফেরেশতার দল অথবা আখেরাত ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জিনিস আল্লাহর অসাধারণ, বিরাট ও বিস্ময়কর সৃষ্টি যা মানুষকে তার দৃষ্টির আড়ালে লুকানাে বিপদাশংকা সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় এগুলাে বৃহত্তম নিদর্শনাবলীর অন্যতম, যা মানুষকে সতর্ক করে।’ এই শপথ, শপথের ভাষা ও যার জন্যে শপথ করা হয়েছে সবই মানুষের মনে এক একটা হাতুড়ির মত আঘাত হানে। এর সাথে শিংগায় ফুঁক ও শিংগার ফুক জনিত চেতনার উত্থান এবং সূরার প্রারম্ভিক সম্ভাষণ ‘হে কম্বলাচ্ছাদিত, ওঠো’-এর পূর্ণ সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, সূরার গােটা প্রেক্ষাপট জুড়েই রয়েছে ফুক দেয়া, আঘাত করা ও সতর্ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। উল্লেখিত সতর্কতা ও সচেতনতা সৃষ্টিকারী আলােচনার প্রেক্ষাপটে কোরআন পরবর্তী আয়াতে ঘোষণা করে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ভালােমন্দের জন্যে ব্যক্তিগতভাবেই দায়ী। প্রত্যেকে নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণের পথ নিজেই গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যেকটি ব্যক্তি নিজের পাপ পূন্যের হাতে যিম্মী।
ফী জিলালিল কুরআন: *কর্ম অনুযায়ীই তার ফলাফল : ‘তােমাদের মধ্যে যার ইচ্ছা নিজের উন্নতি সাধন করবে যার ইচ্ছা নিজের অবনতি ঘটাতে পারে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কর্মফলের কাছে যিম্মী।’ এর অর্থ হলাে কেউই নিজের কর্মফল থেকে রেহাই পেতে পারে না, নিজের পাপ-পূণ্য দ্বারা যে কেউ নিজের মর্যাদা বাড়াতে বা কমাতে পারে। সে তার ভালাে-মন্দ কাজের হাতে বন্দী। আল্লাহ তায়ালা মানুষের ভালাে মন্দের পথ বলে দিয়েছেন, যাতে সে স্বেচ্ছায় এর যে কোনাে পথ গ্রহণ করতে পারে। প্রাকৃতিক দৃশ্যবলীর পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রেও এই একই ঘােষণা কার্যকর। দোযখের দৃশ্য বর্ণনার ক্ষেত্রেও এই একই ঘােষণা কার্যকর। এ দ্বারা মানুষকে সুপথ ও কুপথ উভয়টাই বেছে নিতে বলা হয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ কর্মফলের কাছে যিম্মী, এই সাধারণ অবস্থা থেকে আল্লাহ তায়ালা দক্ষিণ বাহুর পক্ষের লােকদেরকে (অর্থাৎ সৎকর্মশীলদেরকে) অব্যাহতি দিয়েছেন। উপরন্তু তিনি তাদেরকে অপরাধীদের শােচনীয় পরিণতির কারণ অনুসন্ধানের অধিকার দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এতে দক্ষিণ বাহুওয়ালাদের কথা ভিন্ন। তারা বেহেশতে বসে অপরাধীদের জিজ্ঞাসা করবে, তোমাদের দোযখে নিলাে কিসে? তারা বলবে, আমরা নামায পড়তাম না, দরিদ্র লােকদেরকে খাওয়াতামনা… এভাবে শেষপর্যন্ত আমাদের মৃত্যু এসে গেলো।’ দক্ষিণ বাহুওয়ালাদের এই যিম্মীদশা থেকে অব্যাহতি লাভ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। কেননা তিনি মানুষের সৎ কাজের বিনিময়ে এর বহুগুণ বেশী প্রতিদান দিয়ে থাকেন। সৎ লােকদের এই শুভ পরিণতির কথা ঘােষণা করা এখানে অপরাধীদের মনে কার্যকর প্রভাব বিস্তারে সহায়ক।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৪৮
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشّٰفِعِیْنَؕ
সে সময় সুপারিশকারীদের কোন সুপারিশ তাদের কাজে আসবে না।
ফী জিলালিল কুরআন:
*অপরাধের স্বীকারােক্তি : তারা সেদিন অবমাননাকর অবস্থায় পতিত হয়ে নিজেদের অপরাধের দীর্ঘ স্বীকারােক্তি দেবে। আর সেই সময়ে মােমেন সম্মানজনক অবস্থানে থাকবে এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মতই জিজ্ঞাসা করবে, তােমাদের কি কারণে এখানে আসতে হলাে? দুনিয়াতে তােমরা তাে আমাদের পাত্তাই দিতে না। এ বিবরণ মােমেনদের মনে এক ভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পৃথিবীর জীবনে তারা ছিল কাফেরদের জুলুম নিপীড়নের শিকার। আজ আখেরাতে তারা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আছে, আর তাদের অহংকারী দুশমনরা কি সাংঘাতিক অবমাননাকর অবস্থানেই না পড়ে আছে। উভয় পক্ষের মনে এই দৃশ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এক পক্ষ বর্তমানে যে অবস্থানে আছে, অপর পক্ষ সেই অবস্থানে থাকবে একটু পরে। এই দুনিয়া একদিন চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যাবে। এখানকার যাবতীয় সুখ-দুঃখও সেই সাথে অদৃশ্য হয়ে যাবে। অপরাধীদের দীর্ঘ স্বীকারােক্তিতে তাদের সেই সব অপরাধের ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে, যা তাদের দোযখে ঠেলে দিয়েছে। মােমেনদের সামনে তারা পরম অসহায়ের মতাে স্বীকারােক্তি দেবে, ‘তারা বলবে, হা আমরা নামায পড়তাম না।’ আসলে এ কথা দ্বারা সমগ্র ঈমান ও ইসলাম বুঝানাে হয়েছে। এই উক্তিটি দ্বারা বুঝানাে হয়েছে ইসলামে নামাযের গুরুত্ব এতাে বেশী যে, তাকে ঈমানের প্রমাণ ও সংকেত হিসাবে ধরা হয়েছে। নামাযের অস্বীকৃতি কুফরির আলামত। এ আলামত যার ভেতরে বিদ্যমান থাকে তাকে মােমেনদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তারা বলবে, ‘আমরা দরিদ্রদেরকে খাওয়াতাম না।’ এটিও ঈমানহীনতার সাথে যুক্ত এবং তার একটি লক্ষণ। আল্লাহর নিজের অধিকার প্রদানের মাধ্যমে যে এবাদাত সম্পাদিত হয়, তারপরেই আসে আল্লাহর সৃষ্টির অধিকার প্রদানের মাধ্যমে তাঁর এবাদাত করা। কোরআনের একাধিক জায়গায় দরিদ্রদেরকে আহার করানাের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এই উল্লেখ দ্বারা কোরআন যে সামাজিক অবস্থার মুখে নাযিল হয়েছে, তার ভয়াবহতা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও সে সময়ের সামাজিক যশ ও গৌরব অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বদান্যতা প্রদর্শনের রেওয়ায ছিলাে এবং খুব বড় গলায় তার ঢোলও পেটানাে হতাে, কিন্তু যেখানে বদান্যতার সত্যিকার প্রয়ােজন হতাে এবং একেবারে আন্তরিক সহানুভূতির দাবী হিসেবে তার প্রয়ােজন দেখা দিতাে, সে সব ক্ষেত্রে বদান্যতা মােটেই প্রদর্শন করা হতাে না। সত্যিকার দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি সেই নিষ্ঠুর সমাজে সহানুভূতি ও অনুগ্রহ করার কেউ ছিলাে না। ‘আমরা অন্যান্য তামাশাকারীদের সাথে মিলে তামাশা করতাম।’ এটি ইসলামের সাথে নিদারুণ অবজ্ঞা, অবহেলা ও উপহাসের পরিবেশের ইংগিতবহ। অথচ মানব জীবনে এ আদর্শ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের অন্য যে কোনাে জিনিসের চেয়ে এর মূল্য ও মর্যাদা অনেক বেশী। কারণ এই আদর্শের ভিত্তিতেই মানুষের জীবনের যাবতীয় আদর্শ, চিন্তা চেতনা, অনুভূতি ও মূল্যবােধের মান নির্ণীত হয়। এরই আলােকে মানুষ তার জীবন পথে যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে। কাজেই এ আদর্শকে অবজ্ঞা করে এর সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট মতামত নির্ণয় না করে এ নিয়ে কেবল তামাশায় লিপ্ত থাকা কোনাে সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব না। ‘আমরা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা সাব্যস্ত করতাম।’ বস্তুত এটিই হচ্ছে সকল দোষের মূল। যে ব্যক্তি পরকালকে অবিশ্বাস করে, তার সকল মূল্যবােধ এবং সকল চিন্তা-চেতনা বিকৃত হয়ে যায়। তার জীবনের পরিসর অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। কেননা পার্থিব জীবনের মধ্যেই সে তার জীবনকে সীমিত করে ফেলে। এই সংকীর্ণ পার্থিব জীবনে যা কিছু ঘটে তার ভিত্তিতেই সে সব কিছুর পরিণতি মূল্যায়ন করে। ফলে পরকালে ও কেয়ামতে কোনাে কাজের হিসাব দিতে হবে বা জবাবদিহী করতে হবে, একথা সে মনে করে না। এ জন্যে তার সকল কাজের মানদন্ড খারাপ হয়ে যায়। কোনাে কাজের পরিচালনাই তার হাতে সুস্পষ্টভাবে সম্পন্ন হয় না। দুনিয়ার সাথে সাথে তার পরকালের পরিনামও খারাপ হয়ে যায়। অপরাধীরা বলে, আমরা এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই জীবন কাটিয়ে আসছিলাম। নামায পড়তাম না, দরিদ্রকে খাওয়াতাম না, আখেরাতে বিশ্বাস করতাম না, তামাশাকারীদের সাথে তামাশায় ও ঠাট্টা বিদ্রুপে লিপ্ত হতাম। ‘অবশেষে আমাদের কাছে মৃত্যু এসে গেলাে।’ মৃত্যু এসে সকল সন্দেহ সংশয় ঘুচিয়ে দিলাে এবং আর কোনাে তাওবা, অনুতাপ ও সাজ করার সুযােগ রাখলাে না। পরবর্তী আয়াতে সেই শােচনীয় অবমাননাকর অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, যা নির্ধারিত পরিণতিকে পাল্টানাের কোনাে আশা ভরসার অবকাশ রাখে না, ‘কোনাে সুপারিশকারীর সুপারিশে তাদের কাজ হবে না।’ কারণ আত্মস্বীকৃত অপরাধীরা তাদের অবধারিত পরিণতির মুখােমুখী হয়ে গেছে। সেখানে আদৌ কোনাে সুপারিশকারীর অস্তিত্বই থাকবে না। যদি কেউ থাকেও তাদের সুপারিশে কোনাে কাজ হবে না। আখেরাতের এই চরম নৈরাশ্যজনক ও অবমাননাকর অবস্থার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাদের পার্থিব সুযােগ সুবিধার কথা আর একবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যাতে আখেরাতের সেই শােচনীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার আগে তারা এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের সদ্ব্যবহার করতে পারে। অথচ তারা সেসব সুযােগ সুবিধাকে উপেক্ষা করে চলেছে এবং অন্যদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধা দিয়ে চলেছে। পার্থিব জীবনে তাদেরকে হেদায়াত, কল্যাণ ও মুক্তির যা কিছু উপায় উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছিলাে তা থেকে তারা পালাচ্ছে।
সুরা: আল-মুদ্দাস্সির
আয়াত নং :-৫৫
فَمَنْ شَآءَ ذَكَرَهٗؕ
এখন কেউ চাইলে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক।
ফী জিলালিল কুরআন:
এই পর্যায়ে তাদের এক হাস্যকর ও বিদ্রুপাত্মক ভাবমূর্তি অংকন করা হয়েছে, তাদের কি হয়েছে যে তারা স্মরণিকাকে উপেক্ষা করছে? যেন তারা বাঘের ভয়ে পলায়নপর বন্য গাধা। ভীত সন্ত্রস্থ বন্য গাধা বাঘের ডাক শুনে চারদিকে ছুটোছুটি করে। আরবরা এ দৃশ্যের সাথে পরিচিত। এটা একটা মারাত্মক ও ভয়ংকর অবস্থা হলেও তার সাথে মানুষের সাদৃশ্য বর্ণনা করার পর এটা একটা দারুণ হাস্যকর অবস্থায় পরিণত হয়। এই মানুষগুলাে যে এভাবে বন্য গাধায় পরিণত হয়, সেটা তাদের ভয়ের কারণে নয়। বরং শুধুমাত্র এ জন্যে যে, একজন মহান ব্যক্তি তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কথা ও কর্মফলের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং তাদেরকে ভয়াবহ, লজ্জাকর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হন। এ দৃশ্যের সাথে এক নিপুন তুলি দিয়ে অপরাধীদের এই দৃশ্যটি অংকন করা হয়েছে এবং তাকে বিশ্ব প্রকৃতির স্মরণীয় দৃশ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যাতে সকলেই এ দৃশ্যকে কলংকময় মনে করে এবং সত্যকে অস্বীকার করে এই অপমানজনক দৃশ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে না চায়। ‘বাঘ থেকে পালানাে বন্য গাধা।’ এটা ছিলাে তাদের বাহ্যিক আকৃতি, এরপর তাদের আভ্যন্তরীণ ও মানসিক অবস্থা এবং ভাবাবেগকেও কোরআন অংকন করতে ভােলেনি, ‘বরঞ্চ তাদের প্রত্যেক ব্যক্তিই চায় যেন তাদেরকে প্রকাশ্য পুস্তক দেয়া হােক।’ আসলে আল্লাহ তায়ালা যে তাঁকে মনােনীত করেছেন ও তার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন, সে জন্যে তার প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষবশত এই আকাংখা পােষণ করা হতাে। প্রত্যেকের বাসনা ছিলো যে, রসূল(স.)-এর মত প্রত্যেকে যেন একই মর্যাদা লাভ করে এবং প্রত্যেকের কাছে ওহী ও কিতাব নাযিল হয়। আসলে এখানে বড় বড় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কথাই বুঝানাে হয়েছে। তাদেরকে বাদ দিয়ে আব্দুল্লাহর ছেলে মােহাম্মাদ নবী হওয়ায় তারা ভীষণ মনােক্ষুন্ন ছিলাে। যেমন সূরা আয-যুখরুফ-এ বলা হয়েছে, ‘তারা বলে দুই শহরের কোনাে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে এটা নাযিল হলাে না কেন?’ অথচ রিসালাত ও নবুওত কাকে দিতে হবে সেটা আল্লাহ তায়ালা নিজেই ভালাে জানেন। এ জন্যে তিনি সেই মহৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে মনােনীত করেছেন। সুতরাং এই জিনিসটাই তাদের বিদ্বেষের মূল কারণ আর এর কারণেই তারা সেই বন্য গাধার মত পালাতাে। এরপর তাদের মানসিক অবস্থার আরাে বিবরণ দেয়া হয়েছে। ইসলামী দাওয়াতকে তাদের উপেক্ষা ও প্রত্যাখ্যান করার মূলে লােভ ও হিংসা ছাড়া অন্য যে কারণটি ছিলাে, তা হলাে আখেরাতের ভয় না করা। তবে এই কারণটি বর্ণনা করার আগে ‘কাল্লা (কখনাে নয়) এই অব্যয়টি ব্যবহার করে বুঝানাে হয়েছে যে, তাদের আল্লাহর ওহী ও অনুগ্রহ লাভের প্রশ্নই ওঠে না। কেননা তার জন্যে প্রয়ােজনীয় যােগ্যতা ও সততার নামগন্ধও তাদের মধ্যে নেই। তাই বলা হয়েছে- ‘কখনাে নয়, আসলে তারা আখেরাতকে ভয় পায় না।’ বস্তুত আখেরাতের ভয় তাদের অন্তরে না থাকাই তাদেরকে কোরআন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এ কারণেই তারা এই দাওয়াতের প্রতি এতে বিদ্বিষ্ট ও এরথেকে পলায়নপর। আখেরাত সম্পর্কে তাদের যদি কিছুমাত্র অনুভূতিও থাকতাে, তা হলে তারা এমন কট্টর অস্বীকৃতির ভাব দেখাতাে না। অতপর পুনরায় তাদের ধিক্কার দেয়া হচ্ছে, তাদের কাছে শেষ বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে এবং তাদেরকে শেষবারের মত একটা পথ গ্রহণ করার সুযােগ দেয়া হচ্ছে, ‘কখনাে নয়, মনে রেখাে এটা একটা স্মরণিকা, যার মনে চায় সে যেন একে স্মরণ করে।’ অর্থাৎ যদিও তারা এই কোরআনকে এড়িয়ে চলে, তা শুনতে চায়না, তা থেকে বুনাে গাধার মতাে পালায় এবং তাদের মনে মােহাম্মাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও আখেরাতকে উপেক্ষা করার মনােভাব বিদ্যমান, তবুও সকলের জন্য একথা জানা উচিত যে, এই কোরআন হলাে সাবধানকারী স্মরণিকা। কাজেই যার ইচ্ছা হয় সে যেন স্মরণ করে। যে তা চাইবে না, তার পরিণতির জন্যে সে নিজেই দায়ী হবে। বেহেশতের সম্মানিত জীবন কিংবা দোযখের ঘৃণিত জীবন এই দুটোর যেটাই সে গ্রহণ করতে চায়-করতে পারে।
ফী জিলালিল কুরআন: *আহলে তাকওয়া ও আহলে মাগফেরাত : ভালাে ও মন্দ যে কোনাে পথ গ্রহণে মানুষের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে এ কথা বলার পর আল্লাহ তায়ালা উপসংহারে মন্তব্য করছেন যে, সকল ইচ্ছার উর্ধে আল্লাহর সার্বভৌম ইচ্ছার অবস্থান। সকল ব্যাপারের চূড়ান্ত ভাগ্য নিয়ন্তা হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা । সকল ঘটনা ও সকল বিষয়ের পেছনে যে আল্লাহর সার্বভৌম চূড়ান্ত ও নিরংকুশ ইচ্ছা সক্রিয় থাকে। এ ব্যাপারে ঈমান ও আকীদাকে নির্ভুল ও বিশুদ্ধ রাখার জন্যে কোরআন এ বিষয়টির কথাগুলােকে কোনাে রাখ ঢাক না রেখে দ্ব্যর্থহীনভাবে ব্যক্ত করে থাকে। তাই আল্লাহ তায়ালা এই সূরার শেষে বলেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তারা স্মরণ করতে পারে না। তিনি তাকওয়া ও ক্ষমার অধিকারী। বস্তুত, বিশ্ব জগতে যা কিছু ঘটে, তা আল্লাহর সর্বোচ্চ ও নিরংকুশ ইচ্ছার সাথে সংযুক্ত। আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে এবং তার আওতার মধ্যেই তা সংঘটিত হয়ে থাকে। এমনকি আল্লাহর কোনাে সৃষ্ট প্রাণী এমন কোনাে ইচ্ছা করে না যা আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থী। গােটা সৃষ্টি জগতের ক্ষমতার ওপরে তাঁর ইচ্ছা কার্যকর। আল্লাহর ইচ্ছায়ই গােটা সৃষ্টি জগতকে এবং তার নিয়মবিধানকে তৈরী করা হয়েছে। তাই গােটা সৃষ্টি জগত আল্লাহর সেই ইচ্ছার অধীনেই চলে। এই ইচ্ছা সকল বাধা বন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এবং কোনাে নির্দিষ্ট সীমারেখা এবং গন্ডী থেকেও মুক্ত। আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতকে স্মরণ করা এমন একটি কাজ, যার প্রেরণা ও ক্ষমতা আল্লাহই দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যাকে এ কাজের যােগ্য বলে জানেন, তার জন্যে এ কাজ সহজ করে দেন। মানুষের মন আল্লাহর কুদরতী দুই আংগুলের মধ্যে থাকে, যখন যেমন ইচ্ছা করেন তা ঘুরিয়ে দেন। কোনাে বান্দার সদিচ্ছা ও নিষ্ঠার কথা জানলে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার এবাদাত ও আনুগত্যের দিকে চালিত করেন। কোনাে বান্দা জানে না আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে কি ইচ্ছা পােষণ করেন। এটা তার অজানা বিষয় এবং তার কাছ থেকে লুকানাে অদৃশ্য বিষয়। তবে আল্লাহ তায়ালা তার কি কি কাজ পছন্দ করেন তা সে জানে। কেননা এ বিষয়টি তিনি তাকে জানিয়েছেন। কাজেই আল্লাহর পছন্দনীয় ও অর্পিত কাজ যখন সে খালেছ নিয়তে করতে ইচ্ছা করে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে সাহায্য করেন এবং তাঁর স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা বলে তাকে সেই কাজ করার দিকে চালিত করেন। কোরআন যে বিষয়টি মুসলমানের অনুভূতিতে বদ্ধমূল করতে চায় তা এই যে, আল্লাহ তায়ালা সম্পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম, সীমাহীন ও নিরংকুশ ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। শুধু তাই নয়, সকল সৃষ্টির ইচ্ছাও তাঁর ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তাঁর অধীন। এ বিষয়টি ব্যক্তির চেতনায় বদ্ধমূল করার উদ্দেশ্য এই যে, বান্দা যেন পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল একাগ্রতা ও নিষ্ঠা নিয়ে আল্লাহর শরনাপন্ন হয় এবং তার কাছে একেবারে শর্তহীন ও নিরংকুশভাবে আত্মসমর্পন করে। এই হলাে ইসলামের প্রকৃত মানসিক রূপ। ইসলাম ঠিক এই রূপ পরিগ্রহ না করা পর্যন্ত কারাে হৃদয়ে টিকে থাকতে পারে না। যখন তা কারাে হৃদয়ে অবস্থান গ্রহণ করে, তখন তা ভেতর থেকে তাকে সর্বাত্মক পােষকতা দেয় এবং তার মধ্যে এমন একটি ধারণা ও মতামত গড়ে তােলে, যার ভিত্তিতে জীবনের প্রত্যেক ঘটনায় সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যখনই বেহেশত ও দোযখের প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে বা হেদায়াত ও গােমরাহীর ব্যাপারে কোনাে কথা বলার পর আল্লাহর সার্বভৌম নিরংকুশ ও সর্বাত্মক ইচ্ছার সংক্রান্ত বক্তব্য আসে, তখন এটাই হয়ে থাকে তার উদ্দেশ্য। এখন কেউ যদি এই নিরংকুশ ও সীমাহীন ইচ্ছাকে কেন্দ্র করে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা বা বিতর্ক তােলার প্রয়াস পায়, তবে সেটা হবে একটা সার্বিক সত্য ও অখন্ড ধারণাকে খন্ডিত ও বিভক্ত করার প্রয়াস। এটা একটা চিরায়ত ও প্রশস্ত সত্যকে সংকীর্ণ ও সীমিত করার শামিল। এ দ্বারা স্বস্তিদায়ক ও সন্তোষজনক কোনাে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না। কেননা কোরআনে তাকে এরূপ সংকীর্ণ ও অবরুদ্ধ সত্য হিসাবে পেশ করা হয়নি। ‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তারা (আল্লাহ তায়ালাকে) স্মরণ করতে পারে না।’ কারণ মানুষ তার ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কার্যকরী করতে সক্ষম নয়। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া মানুষ কোনাে ব্যাপারে উদ্যোগ বা সিদ্ধান্ত এবং সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে পারে না। ‘একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাই তাকে সক্রিয় উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম করে। তিনিই তাকওয়ার অধিকারী।’ অর্থাৎ একমাত্র তিনিই এই অধিকার রাখেন যে, তাকে ভয় করা হােক, আর এ জন্যে তিনিই চান যে, বান্দারা তাকে ভয় করুক। ‘ক্ষমার অধিকারী।’ নিজের স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে যাকে খুশী অনুগ্রহ পূর্বক ক্ষমা বিতরণ করেন। খােদাভীতি ক্ষমার যােগ্যতা সৃষ্টি করে। আর আল্লাহ তায়ালা এই দুটোরই অধিকারী। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে তাকে স্মরণ করা ও ভয় করার প্রেরণা দিন এবং ক্ষমা দিয়ে আমাদের অনুগৃহীত করুন। আমীন!