Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৮/হে মানুষ:-৩)
[** কিয়ামত:-
*মানুষ ভবিষ্যতেও কুকর্ম করতে চায়!:-
*আখেরাতকে অস্বীকার করার কারণ:-
*মানুষ কি মনে করে যে:-?
*মৃত্যুর পরের জীবনের সম্ভাব্যতার প্রমাণ। :-
*কোরআনের পাঠ ও সংরক্ষণ : -]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ
পারা:২৯
১-৪০ নং আয়াতের বেখ্যা :-
(১)তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
(২)তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
(৩)তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন:-
(৪) তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১
لَاۤ اُقۡسِمُ بِیَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ ۙ﴿۱﴾
আমি শপথ করছি কিয়ামত দিবসের।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২
وَ لَاۤ اُقۡسِمُ بِالنَّفۡسِ اللَّوَّامَۃِ ؕ﴿۲﴾
আমি শপথ করছি তিরস্কারকারী আত্মার।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩
اَیَحۡسَبُ الۡاِنۡسَانُ اَلَّنۡ نَّجۡمَعَ عِظَامَہٗ ؕ﴿۳﴾
মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্র করতে পারব না?
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৪
بَلٰی قٰدِرِیۡنَ عَلٰۤی اَنۡ نُّسَوِّیَ بَنَانَہٗ ﴿۴﴾
অবশ্যই। আমি ওর আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৫
بَلۡ یُرِیۡدُ الۡاِنۡسَانُ لِیَفۡجُرَ اَمَامَہٗ ۚ﴿۵﴾
কিন্তু মানুষ ভবিষ্যতেও কুকর্ম করতে চায়।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৬
یَسۡـَٔلُ اَیَّانَ یَوۡمُ الۡقِیٰمَۃِ ؕ﴿۶﴾
সে প্রশ্ন করে, কখন কিয়ামত দিবস আসবে?
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৭
فَاِذَا بَرِقَ الۡبَصَرُ ۙ﴿۷﴾
যখন চোখ স্থির হয়ে যাবে ,
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৮
وَ خَسَفَ الۡقَمَرُ ۙ﴿۸﴾
এবং চন্দ্র জ্যোতিবিহীন হয়ে পড়বে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৯
وَ جُمِعَ الشَّمۡسُ وَ الۡقَمَرُ ۙ﴿۹﴾
যখন সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১০
یَقُوۡلُ الۡاِنۡسَانُ یَوۡمَئِذٍ اَیۡنَ الۡمَفَرُّ ﴿ۚ۱۰﴾
সেদিন মানুষ বলবে, আজ পালাবার স্থান কোথায়?
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১১
کَلَّا لَا وَزَرَ ﴿ؕ۱۱﴾
কখনোই নয়, কোন আশ্রয়স্থল নেই।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১২
اِلٰی رَبِّکَ یَوۡمَئِذِۣ الۡمُسۡتَقَرُّ ﴿ؕ۱۲﴾
সেদিন ঠাঁই হবে আপনার রবেরই কাছে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১৩
یُنَبَّؤُا الۡاِنۡسَانُ یَوۡمَئِذٍۭ بِمَا قَدَّمَ وَ اَخَّرَ ﴿ؕ۱۳﴾
সেদিন মানুষকে তার আগের ও পরের কৃতকর্মসমূহ জানিয়ে দেয়া হবে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১৪
بَلِ الۡاِنۡسَانُ عَلٰی نَفۡسِہٖ بَصِیۡرَۃٌ ﴿ۙ۱۴﴾
বস্তুতঃ মানুষ নিজের সম্বন্ধে সম্যক অবগত।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১৫
وَّ لَوۡ اَلۡقٰی مَعَاذِیۡرَہٗ ﴿ؕ۱۵﴾
যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১৬
لَا تُحَرِّکۡ بِہٖ لِسَانَکَ لِتَعۡجَلَ بِہٖ ﴿ؕ۱۶﴾
হে নবী, এ অহীকে দ্রুত আয়ত্ত করার জন্য তোমার জিহবা দ্রুত সঞ্চালন করো না।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১৭
اِنَّ عَلَیۡنَا جَمۡعَہٗ وَ قُرۡاٰنَہٗ ﴿ۚۖ۱۷﴾
নিশ্চয় এটার সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১৮
فَاِذَا قَرَاۡنٰہُ فَاتَّبِعۡ قُرۡاٰنَہٗ ﴿ۚ۱۸﴾
কাজেই যখন আমরা তা পাঠ করি আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন,
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-১৯
ثُمَّ اِنَّ عَلَیۡنَا بَیَانَہٗ ﴿ؕ۱۹﴾
অতঃপর এর অর্থ বুঝিয়ে দেয়াও আমার দায়িত্ব।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২০
کَلَّا بَلۡ تُحِبُّوۡنَ الۡعَاجِلَۃَ ﴿ۙ۲۰﴾
কখনো না, বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে ভালবাস;
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২১
وَ تَذَرُوۡنَ الۡاٰخِرَۃَ ﴿ؕ۲۱﴾
আর তোমরা আখেরাতকে উপেক্ষা কর ।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২২
وُجُوۡہٌ یَّوۡمَئِذٍ نَّاضِرَۃٌ ﴿ۙ۲۲﴾
সেদিন কোন কোন মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে,
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২৩
اِلٰی رَبِّہَا نَاظِرَۃٌ ﴿ۚ۲۳﴾
নিজের রবের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২৪
وَ وُجُوۡہٌ یَّوۡمَئِذٍۭ بَاسِرَۃٌ ﴿ۙ۲۴﴾
আর কিছু সংখ্যক চেহারা থাকবে উদাস-বিবর্ণ।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২৫
تَظُنُّ اَنۡ یُّفۡعَلَ بِہَا فَاقِرَۃٌ ﴿ؕ۲۵﴾
মনে করতে থাকবে যে, তাদের সাথে কঠোর আচরণ করা হবে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২৬
کَلَّاۤ اِذَا بَلَغَتِ التَّرَاقِیَ ﴿ۙ۲۶﴾
কখনই (তোমাদের ধারণা ঠিক) না, যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হবে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২৭
وَ قِیۡلَ مَنۡ ٜ رَاقٍ ﴿ۙ۲۷﴾
এবং বলা হবে, ‘কে তাকে রক্ষা করবে ?’
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২৮
وَّ ظَنَّ اَنَّہُ الۡفِرَاقُ ﴿ۙ۲۸﴾
সে দৃঢ়-বিশ্বাস করে নেবে, এটাই তার বিদায়ের সময়।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-২৯
وَ الۡتَفَّتِ السَّاقُ بِالسَّاقِ ﴿ۙ۲۹﴾
উভয় পায়ের গোছা বা নলা একত্র হয়ে যাবে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩০
اِلٰی رَبِّکَ یَوۡمَئِذِۣ الۡمَسَاقُ ﴿ؕ٪۳۰﴾
সেদিনটি হবে তোমার প্রভুর কাছে যাত্রা করার দিন।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩১
فَلَا صَدَّقَ وَ لَا صَلّٰی ﴿ۙ۳۱﴾
কিন্তু সে সত্যকে অনুসরণও করেনি। নামাযও (সালাত) পড়েনি।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩২
وَ لٰکِنۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی ﴿ۙ۳۲﴾
বরং সে মিথ্যা মনে করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩৩
ثُمَّ ذَہَبَ اِلٰۤی اَہۡلِہٖ یَتَمَطّٰی ﴿ؕ۳۳﴾
তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে নিজের পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে গিয়েছে।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩৪
اَوۡلٰی لَکَ فَاَوۡلٰی ﴿ۙ۳۴﴾
এ আচরণ তোমার পক্ষেই শোভনীয় এবং তোমার পক্ষেই মানানসই।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩৫
ثُمَّ اَوۡلٰی لَکَ فَاَوۡلٰی ﴿ؕ۳۵﴾
হ্যাঁ,, এ আচরণ তোমার পক্ষেই শোভনীয় এবং তোমার পক্ষেই মানানসই।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩৬
اَیَحۡسَبُ الۡاِنۡسَانُ اَنۡ یُّتۡرَکَ سُدًی ﴿ؕ۳۶﴾
মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে?
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩৭
اَلَمۡ یَکُ نُطۡفَۃً مِّنۡ مَّنِیٍّ یُّمۡنٰی ﴿ۙ۳۷﴾
সে কি বীর্যরূপ এক বিন্দু নগণ্য পানি ছিল না যা নিক্ষিপ্ত হয়।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩৮
ثُمَّ کَانَ عَلَقَۃً فَخَلَقَ فَسَوّٰی ﴿ۙ۳۸﴾
অতঃপর তা মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ তার সুন্দর দেহ বানালেন এবং তার অংগ-প্রতংগগুলো সুসামঞ্জস্য করলেন।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৩৯
فَجَعَلَ مِنۡہُ الزَّوۡجَیۡنِ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰی ﴿ؕ۳۹﴾
তারপর তা থেকে নারী ও পুরুষ দুরকম মানুষ বানালেন।
সুরা: ৭৫.: আল্-কিয়ামাহ:-৪০
اَلَیۡسَ ذٰلِکَ بِقٰدِرٍ عَلٰۤی اَنۡ یُّحۡیِۦَ الۡمَوۡتٰی ﴿٪۴۰﴾
সেই স্রষ্টা কি মৃতদের পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম নন?
১-৪০ নং আয়াতের বেখ্যা :-
(১)তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ
: القيامة কিয়ামত, যা অবশ্যই ঘটবে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। প্রথম দুটি আয়াতে কিয়ামত সংক্রান্ত বচন ও মন সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্য দিয়ে সূরাটির সূচনা হয়েছে, তারপর কিয়ামতের কিছু নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর কুরআন নাযিলের সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
১-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
لَآ أُقْسِمُ বাক্যতে لَآ অক্ষরটিকে কেউ অতিরিক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : যে জিনিসকে কেন্দ্র করে শপথ করা হয় (المقسم عليه) তা যদি নাবোধক হয় তাহলে গুরুত্ব বুঝোনোর জন্য শপথের (القسم) পূর্বে নাবোধক لَآ নিয়ে আসা হয়। (ইবনু কাসীর)
আল্লামা সাদী (রহঃ) বলেন : এখানে لا অক্ষরটি নাবোধকও নয় বা অতিরিক্তও না। বরং এখানে নিয়ে আসা হয়েছে সূচনা করা ও গুরুত্ব বুঝোনোর জন্য। (তাফসীর সা‘দী)
আবার কেউ কেউ বলেছেন, এ শপথের পূর্বে কাফিরদের কথার খন্ডন করা হয়েছে। তারা বলত যে, মরণের পর আর কোন জীবন নেই। لا দ্বারা বলা হল যে, তোমরা যেমন বলছ ব্যাপারটা তেমন নয়। এ ব্যাপারে আমি কিয়ামতের দিনের শপথ করে বলছি। কিয়ামতের দিনের শপথের উদ্দেশ্য হল তার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বুঝানো।
(النَّفْسِ اللَّوَّامَةِ)
‘তিরস্কারকারী আত্মা’ সূরা ইউসুফে আলোচনা করা হয়েছে যে, نفس (আত্মা) তিন প্রকার, তার মধ্যে এটি একটি। এ আত্মাকে لوامة বলা হয়
لكثرة تلو وترددها وعدم بثوتها علي حالة من أحوالها
বিভিন্ন রং ধারণ ও বেশি বেশি পরিবর্তন হওয়ার কারণে এবং একই অবস্থার ওপর বহাল না থাকার কারণে। প্রত্যেক আত্মাই নিজেকে তিরস্কার করবে, ভাল আত্মা নিজেকে তিরস্কার করে বলবে কেন আরো ভাল কাজ করিনি? আর খারাপ আত্মা নিজেকে খারাপ কাজ করার জন্য ভর্ৎসনা করবে। কিয়ামত ও নাফসে লাওওয়ামাহর শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামত অবধারিত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তবে সেটা কিছুটা ভিন্ন আংগিকে যথা :
(أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ)
এটা শপথের জবাব। এখানে ইনসান বা মানুষ বলতে কাফির ও নাস্তিকদেরকে বুঝোনো হয়েছে যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে থাকে। যারা বলে, আমরা মারা গেলে পচে গলে যাব, কোন অস্তিত্ব থাকবে না। আবার কি আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একত্রিত করা সম্ভব? জবাবে আল্লাহ বলছেন : بلي হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা এতে সক্ষম। শুধু তাই নয়, বরং আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত যথাযথভাবে সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম। এখানে বিশেষ করে আঙ্গুলের অগ্রভাগের কথা উল্লেখ করার কারণ হল : একজন মানুষের আঙ্গুলের অগ্রভাগের ছাপের সাথে অন্য মানুষের আঙ্গুলের ছাপের মিল নেই। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের এ সূক্ষ্ম পার্থক্যটুকুসহ নিয়ে আসতে সক্ষম।
এ আয়াতকে কেন্দ্র করে আবিস্কার করা হল (ফিঙ্গার প্রিন্ট) যা ব্যক্তিগত কাজে অপরাধীকে সনাক্তকরণে ব্যবহার করা হয়।
(لِيَفْجُرَ أَمَامَه۫) الفجور
-বলা হয় স্বেচ্ছায় মিথ্যা কথা বলাকে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : মানুষ বলে যে, খারাপ কাজ করতে থাকব, অতঃপর কিয়ামতের পূর্বে তাওবা করে নেব। (ইবনু কাসীর) তারপর আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করছেন।
(بَرِقَ الْبَصَرُ)
অর্থাৎ কিয়ামতের আতংকে চক্ষু খুলে স্থির হয়ে যাবে আর পলক পড়বে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَلَا تَحْسَبَنَّ اللّٰهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظّٰلِمُوْنَ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيْهِ الْأَبْصَارُ)
“তুমি কখনও মনে কর না যে, জালিমরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ গাফিল, নিশ্চয়ই তিনি তাদেরকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দেন যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফোরিত হবে।” (সূরা ইবরাহীম ১৪ : ৪২)
(خَسَفَ الْقَمَرُ)
অর্থাৎ চাঁদের আলো থাকবে না।
(وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ)
‘যখন সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে’ আজ পর্যন্ত চাঁদ ও সূর্য একত্রিত হয়নি। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা চাঁদকে আলোহীন আর সূর্যকে গুটিয়ে নিয়ে উভয়কে একত্রিত করবেন।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا النُّجُوْمُ انْكَدَرَت)
“সূর্যকে যখন গুটিয়ে আলোহীন করা হবে, নক্ষত্ররাজি যখন খসে পড়বে।” (সূরা তাকভীর ৮১ : ১-২)
কিয়ামতের এ ভয়াবহ অবস্থা দেখে কাফিররা পলায়ন করার চেষ্টা করবে কিন্তু পলায়নের জায়গা কোথায়? পালানোর কোন জায়গা থাকবে না।
وزر অর্থ : এমন পাহাড় বা দুর্গকে বলা হয় যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করা যায়। অর্থাৎ সেদিন কোন আশ্রয়স্থল থাকবেনা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( مَا لَكُمْ مِّنْ مَّلْجَإٍ يَّوْمَئِذٍ وَّمَا لَكُمْ مِّنْ نَّكِيْرٍ)
“যেদিন তোমাদের কোন আশ্রয়স্থল থাকবে না এবং তোমাদের জন্য তা প্রতিরোধকারী কেউ থাকবে না।” (সূরা শুয়ারা ৪২ : ৪৭)
(يُنَبَّؤُا الْإِنْسَانُ. . . )
“সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে, যা সে অগ্রে পাঠিয়েছে ও পশ্চাতে রেখে গেছে।” যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(وَوَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا ط وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا)
“তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে; তোমার প্রতিপালক কারোর প্রতি জুলুম করেন না।” (সূরা কাহাফ ১৮ : ৪৭)
(بَصِيرَةٌ . . . . . وَّلَوْ أَلْقٰي مَعَاذِيرَه)
অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ তার কৃতকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত যদিও সে নানা রকমের বাহানা বা অজুহাত পেশ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اِقْرَأْ كِتٰبَكَ ط كَفٰي بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْبًا)
‘তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসেব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।’ (সূরা ইসরা ১৭ : ১৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : যদিও মানুষ তাদের কৃত পাপ কাজ অস্বীকার করার জন্য বিতর্ক করবে কিন্তু সে ভাল করেই অবগত যে, এগুলো আমার দ্বারা কৃত অপরাধ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(ثُمَّ لَمْ تَكُنْ فِتْنَتُهُمْ إِلَّآ أَنْ قَالُوْا وَاللّٰهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِيْنَ)
“অতঃপর (যখন তাদের শরীকদের সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তখন) তাদের এটা ছাড়া বলার অন্য কোন অজুহাত থাকবে না-‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহর শপথ! আমরা তো মুশরিকই ছিলাম না।” (সূরা আনআম ৬ : ২৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. نفس اللوامة
এর পরিচয় ও তিরস্কার করার কারণ জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পুক্সক্ষানুপুক্সক্ষভাবে পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
৩. কিয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানলাম।
৪. সেদিন মানুষ কৃত অপরাধ অস্বীকার করতে চাইবে, পলায়ন করতে চাইবে কিন্তু কোন পথ পাবে না।
১৬-২৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
শানে নুযূল :
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট যখন ওয়াহী নাযিল করা হত তখন তা মুখস্থ করার জন্য তিনি তাড়াতাড়ি পড়তেন। তখন এ আয়াত
(لاَ تُحَرِّكْ بِه۪ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِه۪)
অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯২৭, সহীহ মুসলিম হা. ৪৪৮)
কুরআন নাযিল সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্বভার আল্লাহ তা‘আলা গ্রহণ করেছেন। ওয়াহী প্রেরণ থেকে শুরু করে নির্ভূলভাবে তা সংরক্ষণ, সংকলন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পর্যন্ত সব কিছুই তাঁর প্রত্যক্ষ দায়িত্বের আওতাধীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَه۫ لَحٰفِظُوْنَ)
“নিশ্চয়ই আমিই এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং অবশ্যই আমিই তার সংরক্ষক।” (সূরা হিজর ১৫ : ৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(لَّا یَاْتِیْھِ الْبَاطِلُ مِنْۭ بَیْنِ یَدَیْھِ وَلَا مِنْ خَلْفِھ۪ﺚ تَنْزِیْلٌ مِّنْ حَکِیْمٍ حَمِیْدٍ)
“কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবে না- অগ্র হতেও নয়, পশ্চাত হতেও নয়। এটা প্রজ্ঞাবান, প্রশংসনীয় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ।” (সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১ : ৪২)
(وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ – إِلٰي رَبِّهَا نَاظِرَةٌ)
‘কোন কোন মুখমণ্ডল সেদিন উজ্জ্বল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
أَتُضَامُونَ فِي رُؤْيَةِ القَمَرِ لَيْلَةَ البَدْرِ، وَتُضَامُونَ فِي رُؤْيَةِ الشَّمْسِ ؟ قَالُوا : لَا، قَالَ : فَإِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ القَمَرَ لَيْلَةَ البَدْرِ لَا تُضَامُونَ فِي رُؤْيَتِهِ
তোমাদের কি পূর্ণিমার রাতে চাঁদ ও দিনের বেলা সূর্যকে দেখতে কোন সমস্যা হয়? তারা বলল : না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : পূর্ণিমার রাতে চাঁদকে দেখতে তোমাদের যেমন কোন সমস্যা হয় না তেমনি তোমরা তোমাদের প্রভুকে দেখতে পাবে। (তিরমিযী হা. ২৫৫৪, সহীহ) মু’মিনরা কিয়ামতের দিন এবং জান্নাতে আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে। এ সম্পর্কে পূর্বের সূরাগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَوُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍۭ بَاسِرَةٌ)
অর্থাৎ সেদিন কাফিরদের চেহারা হবে বিবর্ণ, চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(وَوُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ أُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ)
“এবং কতক মুখমন্ডল হবে সেদিন ধূলি মিশ্রিত। সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে কালো বর্ণ। তারাই কাফির ও পাপাচারী।” (সূরা আবাসা ৮০ : ৪০-৪২)
সুতরাং কুরআন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেছেন এবং তিনিই তা সংরক্ষণ করবেন। এ ব্যাপারে কোন অসৎ উদ্দেশ্যকারীর উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। আর মু’মিনরা আল্লাহ তা‘আলাকে কিয়ামতের দিন দেখতে পাবে, এতে কোন সংশয় নেই। কিন্তু কিভাবে দেখবে তা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের সকল প্রকার পরিবর্তন-পরিবর্ধন থেকে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন।
২. অধিকাংশ মানুষের আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার প্রতি অধিক মোহ রয়েছে।
৩. আখিরাতে মু’মিনরা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পাবে, ফলে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। আর কাফিরদের চেহারা হয়ে যাবে বিবর্ণ।
২৬-৪০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মানুষের মৃত্যু যখন কণ্ঠনালীতে পৌঁছে যাবে তখন তার যে ভয়ানক অবস্থা হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
التَّرَاقِيَ হল ترقوة এর বহুবচন, অর্থ : কণ্ঠমূল, কণ্ঠনালী। অর্থাৎ মৃত্যু যখন কণ্ঠনালীতে এসে পৌঁছে যাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَلَوْلَآ إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُوْمَ وَأَنْتُمْ حِيْنَئِذٍ تَنْظُرُوْنَ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلٰكِنْ لَّا تُبْصِرُوْنَ)
“তবে কেন নয়- প্রাণ যখন কণ্ঠাগত হয়। এবং তখন তোমরা তাকিয়ে থাকবে। আর আমি তোমাদের অপেক্ষা (জানার দিক দিয়ে) তার নিকটতর; কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না।” (সূরা ওয়াকিয়া ৫৬ : ৮৩)
(وَقِيْلَ مَنْ رَاقٍ)
অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির নিকট উপস্থিত ব্যক্তিদের বলা হবে- কেউ কি আছো যারা ঝাড় ফুঁক করে একে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে? মূলত মানুষের অক্ষমতাকে এখানে প্রকাশ করা হয়েছে। কেননা কোনক্রমেই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব না। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : বলা হবে- এ মৃত ব্যক্তির আত্মা কোন্ ফেরেশতা বহন করে নেবে? রহমতের ফেরেশতা না আযাবের ফেরেশতা?
(وَالْتَفَّتِ السَّاقُ بِالسَّاقِ)
এ থেকে মৃত্যুর সময় পদনালীর সাথে পদনালীর জড়িয়ে দেওয়াকে বুঝানো হয়েছে। অথবা এখানে কষ্টের পর কষ্ট হবে সে কথা বুঝোনো হয়েছে। তবে দ্বিতীয় মতটি অধিক সঠিক।
(فَلَا صَدَّقَ…. فَأَوْلٰي)
এ সবই কাফিরদের বদগুণ। এদের সম্পর্কে সূরা মুতাফফিফীনে ও ইনশিক্বাকে আলোচনা করা হবে। ইনশা-আল্লাহ।
(أَنْ يُّتْرَكَ سُدًي)
অর্থাৎ মানুষকে অদেশ-নিষেধ দ্বারা পরীক্ষা করা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হবে? আখিরাতে কর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে না? না, বরং সবকিছুর হিসাব-নিকাশ ও ফলাফল দেওয়ার জন্য সবাইকে একত্রিত করবেন। এখানে মানুষের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তারা সতর্ক হয়ে যায়। মানুষের বিবেকও বলে, উপযুক্ত একটি বিচার-ফায়সালার দিন হওয়া দরকার। কারণ পৃথিবীতে সবল ও দুর্বল উভয় শ্রেণির মানুষ রয়েছে। যুগে যুগে সবলরা দুর্বলদের ওপর অত্যাচার ও অবিচার চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্বলরা কোন যথাযথ বিচার পাচ্ছে না।
পৃথিবীতে কেউ এসব সবলের বিচার করার ক্ষমতা রাখেনা। তাহলে কি এ সবলরা আজীবন অত্যাচার ও অন্যায় করেই যাবে? না, যারা দুর্বল ব্যক্তিদের ওপর অত্যাচার করছে যদিও পৃথিবীতে তাদের বিচার হয় না কিন্তু তাদের কর্মের উপযুক্ত বিচারের জন্য অবশ্যই একটি বিচারের দিন হওয়া দরকার। সেদিন হল কিয়ামতের দিন।
(أَلَيْسَ ذٰلِكَ بِقَادِرٍ)
হ্যাঁ আল্লাহ তা‘আলা মৃতকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম। এ সূরার শেষে بلي পড়ার বিধান সূরা মুরসালাতে আলোচনা হবে। সুতরাং যেহেতু পুনর্জীবিত হতে হবে সেহেতু পরপারের জন্য পাথেয় সাথে নিয়ে যাওয়া প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির অবশ্য কর্তব্য। এ অকাট্য প্রত্যয় দীপ্ত উপসংহার দ্বারা মানুষের চেতনাকে পরিতৃপ্ত করা এবং মানুষের জন্ম রহস্য ও তার ব্যাপারে মহান আল্লাহর অতুলনীয় দক্ষ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার তথ্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে সূরাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মৃত্যুর সময় মানুষ খুব যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়।
২. যারা মিথ্যুক ও আখিরাতে অবিশ্বাসী তাদের জন্য উভয় জগতে দুর্ভোগ।
৩. মানুষকে পরীক্ষা করা ছাড়াই এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে না।
৪. আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই সব মৃতকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম।
(২)তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-১৫ নং আয়াতের তাফসীর
এটা কয়েকবার বর্ণনা করা হয়েছে যে, যে জিনিসের উপর শপথ করা হয় ওটা যদি প্রত্যাখ্যান করার জিনিস হয় তবে ওর পূর্বে (আরবি) এ কালেমাটি নেতিবাচকের গুরুত্বের জন্যে আনয়ন করা বৈধ। এখানে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার উপর এবং অজ্ঞ লোকদের এর প্রত্যাখ্যানের উপর যে, কিয়ামত হবে না, শপথ করা হচ্ছে। মহান আল্লাহ তাই বলছেনঃ আমি শপথ করছি কিয়ামত দিবসের এবং আরো শপথ করছি তিরস্কারকারী আত্মার।
হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, কিয়ামতের কসম, এবং তিরস্কারকারী আত্মার কসম নয়। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, দুটোরই কসম! হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত আ’রাজ (রঃ)-এর কিরআতে (আরবি) রয়েছে। এর দ্বারাও হযরত হাসান (রঃ)-এর উক্তি প্রাধান্য পাচ্ছে। কেননা, তাঁর মতে প্রথমটির শপথ এবং দ্বিতীয়টির শপথ নয়। কিন্তু সঠিক উক্তি এই যে, আল্লাহ পাক দুটোরই শপথ করেছেন। যেমন হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের হতেও এটাই বর্ণিত আছে।
কিয়ামতের দিন সম্পর্কে সবাই অবহিত। (আরবি)-এর তাফসীরে হযরত হাসান বসরী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা মুমিনের নফস উদ্দেশ্য এটা সব সময় নিজেই নিজেকে তিরস্কার করতে থাকে যে, এটা কেন করলে? কেন এটা খেলে? কেন এই ধারণা মনে এলো? হ্যাঁ, তবে ফাসিকের নফস সদা উদাসীন থাকে। তার কি দায় পড়েছে যে, সে নিজের নফসকে তিরস্কার করবে?
এটাও বর্ণিত আছে যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত মাখলূক কিয়ামতের দিন নিজেই নিজেকে তিরস্কার করবে। সৎকর্মশীল নফস সৎকর্মের স্বল্পতার জন্যে এবং অসৎকর্মশীল নফস অসৎকর্মের আবির্ভাবের কারণে নিজে নিজেকে ভৎসনা করবে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা নিন্দনীয় নফসকে বুঝানো হয়েছে, যা অবাধ্য নফস। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ঐ নফস উদ্দেশ্য যা ছুটে যাওয়া জিনিসের উপর লজ্জিত হয় এবং তজ্জন্যে নিজেকে ভৎসনা করে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এ উক্তিগুলো ভাবার্থের দিক দিয়ে প্রায় একই ভাবার্থ এই যে, এটা ঐ নফস যা পুণ্যের স্বল্পতার জন্যে এবং দুষ্কার্য হয়ে যাওয়ার জন্যে নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারবো না? এটা তো তাদের বড়ই ভুল ধারণা। আমি ওগুলোকে বিভিন্ন জায়গা হতে একত্রিত করে পুনরায় দাঁড় করিয়ে দিবো এবং ওকে পূর্ণভাবে গঠিত করবো।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ আমি ওকে উট বা ঘোড়ার পায়ের পাতার মত বা খুরের মত বানিয়ে দিতে সক্ষম। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হচ্ছেঃ দুনিয়াতেও ইচ্ছা করলে আমি তাকে এরূপ করে দিতে পারতাম। শব্দ দ্বারা তো বাহ্যতঃ এটাই জানা যাচ্ছে যে, (আরবি) শব্দটি (আরবি) হতে (আরবি) হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ কি ধারণা করে যে, আমি তার অস্থিগুলো একত্রিত করবো না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্বরই আমি ওগুলো একত্রিত করবো। আমি তার অঙ্গুলীর অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম। আমি ইচ্ছা করলে সে পূর্বে যা ছিল তার চেয়েও কিছু বেশী করে দিয়ে তাকে পুনরুত্থিত করতে পারবো। ইবনে কুতাইবাহ (রঃ) ও যাজ্জাজ (রঃ)-এর উক্তির অর্থ এটাই।
মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ মানুষ তার সামনে পাপকর্মে লিপ্ত হতে চায়। অর্থাৎ পদে পদে সে এগিয়ে চলেছে। বুকে আশা বেঁধে রয়েছে এবং বলছেঃ পাপকর্ম করে তো যাই, পরে তাওবা করে নিবো। তারা কিয়ামত দিবসকে, যা তাদের সামনে রয়েছে, অস্বীকার করছে। যেন সে তার মাথার উপর সওয়ার হয়ে আগে বেড়ে চলেছে। সদা-সর্বদা তাকে এ অবস্থাতেই পাওয়া যাচ্ছে যে, সে পদে পদে নিজেকে আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবে যার উপর আল্লাহ পাক দয়া করেন সেটা স্বতন্ত্র কথা।
এই আয়াতের তাফসীরে পূর্ব যুগীয় অধিকাংশ মনীষীর উক্তি এটাই যে, সে পাপকার্যে তাড়াতাড়ি করছে এবং তাওবা করতে বিলম্ব করছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, অর্থ হলোঃ সে হিসাবের দিনকে অস্বীকার করছে। ইবনে যায়েদেরও (রঃ) এটাই উক্তি। এটাই বেশী প্রকাশমান ভাবার্থও বটে। কেননা, এরপরেই রয়েছেঃ সে প্রশ্ন করেঃ কখন কিয়ামত দিবস আসবে? তার এ প্রশ্নটি অস্বীকৃতিসূচক। তার বিশ্বাস তো এটাই যে, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তারা বলে- যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে বলঃ কিয়ামত কখন হবে? তুমি তাদেরকে বলে দাও – ওর জন্যে একটি নির্ধারিত সময় রয়েছে যা হতে তোমরা এক ঘন্টা আগেও বাড়তে পার না এবং পিছনেও সরতে পার না।” (৩৪:২৯-৩০)
এখানেও মহান আল্লাহ বলেনঃ যখন চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে।” (১৪:৪৩) তারা ভয়ে ও সন্ত্রাসে চক্ষু ফেড়ে ফেড়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকবে। (আরবি) শব্দটি অন্য পঠনে (আরবি) রয়েছে। দুটোর অর্থ প্রায় একই।
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ চন্দ্র হয়ে পড়বে জ্যোতিহীন। আর সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে। অর্থাৎ দুটোকেই জ্যোতিহীন করে জড়িয়ে নেয়া হবে। ইবনে যায়েদ (রঃ) এ আয়াতের তাফসীরে নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সূর্য যখন নিষ্প্রভ হবে এবং যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে।” (৮১:১-২) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবি) রয়েছে।
মানুষ এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে বলবেঃ আজ পালাবার স্থান কোথায়? তখন আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে জবাব দেয়া হবেঃ না, কোন আশ্রয়স্থল নেই। এই দিন ঠাঁই হবে তোমার প্রতিপালকেরই নিকট। এ আয়াতটি নিম্নের আয়াতটির মতইঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আজ না আছে তোমাদের জন্যে কোন আশ্রয়স্থল এবং না আছে এমন জায়গা যেখানে গিয়ে তোমরা অচেনা ও অপরিচিত হয়ে যাবে।” (৪২:৪৭)।
ঘোষিত হচ্ছেঃ সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে সে কী অগ্রে পাঠিয়েছে ও কী পশ্চাতে রেখে গেছে। যেমন মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি যুলুম করেন না।”
মহান আল্লাহ এখানে বলেনঃ বস্তুতঃ মানুষ নিজের সম্বন্ধে সম্যক অবগত, যদিও সে নানা অজুহাতের অবতারণা করে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব নিকাশের জন্যে যথেষ্ট।” (১৭:১৪) তার চক্ষু-কৰ্ণ, হাত, পা এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। বড়ই আফসোসের বিষয় যে, সে অন্যদের দোষ-ত্রুটি দেখতে রয়েছে, আর নিজের দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধে রয়েছে সম্পূর্ণ উদাসীন! বলা হয় যে, তাওরাতে লিখিত রয়েছেঃ “হে আদম সন্তান! তুমি তোমার ভাই এর চোখের খড়-কুটা দেখতে পাচ্ছ, অথচ তোমার নিজের চোখের তীরটিও দেখতে পাচ্ছ না?”
কিয়ামতের দিন মানুষ বাজে বাহানা, মিথ্যা প্রমাণ এবং নিরর্থক ওর পেশ করবে, কিন্তু তার একটি ওযরও গৃহীত হবে না।
(আরবি)-এর আর একটি ভাবার্থ বর্ণনা করা হয়েছে। তা হলোঃ যদিও সে পর্দা ফেলে দেয়। ইয়ামনবাসী পর্দাকে (আরবি) বলে থাকে। কিন্তু উপরের অর্থটিই সঠিকতর। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কোন জ্ঞান সম্মত ওযর পেশ করতে না পেরে তার নিজেদের শিরককে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বলবেঃ আল্লাহর কসম, আমরা মুশরিকই ছিলাম না।” (৬:২৩) আল্লাহ পাক আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যেদিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন তখন তারা তাঁর সামনে শপথ করে করে নিজেদেরকে সত্যবাদী বানাতে চাইবে, যেমন আজ দুনিয়ায় তোমাদের সামনে মিথ্যা কসম খাচ্ছে, তারা নিজেদেরকে কিছু একটা মনে করছে, কিন্তু আল্লাহ নিশ্চিতরূপে জানেন যে, তারা মিথ্যাবাদী।” মোটকথা, কিয়ামতের দিন তাদের ওযর-আপত্তি তাদের কোনই উপকারে আসবে না। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সীমালংঘনকারীদের ওযর-আপত্তি তাদের কোন কাজে আসবে না।” (৪০:৫২) তারা তো শিরকের সাথে সাথে নিজেদের সমস্ত দুষ্কর্মকেই অস্বীকার করে ফেলবে, কিন্তু সবই বৃথা হবে। তাদের ঐ অস্বীকৃতি তাদের কোনই উপকারে আসবে না।
১৬-২৫ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে শিক্ষা দিচ্ছেন যে, তিনি ফেরেশতার নিকট হতে কিভাবে ওহী গ্রহণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওহী গ্রহণ করার ব্যাপারে খুবই তাড়াতাড়ি করতেন। তাই আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ যখন ফেরেশতা ওহী নিয়ে আসবে তখন তুমি শুনতে থাকবে। অতঃপর যে ভয়ে তিনি এরূপ করতেন সেই ব্যাপারে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার বক্ষে ওটা জমা করে দেয়া এবং তোমার ভাষায় তা পড়িয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমার। অনুরূপভাবে তোমার দ্বারা এর ব্যাখ্যা করিয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমার। সুতরাং প্রথম অবস্থা হলো মুখস্থ করানো, দ্বিতীয় অবস্থা হলো পড়িয়ে নেয়া এবং তৃতীয় অবস্থা হলো বিষয়টির ব্যাখ্যা করিয়ে নেয়া। তিনটিরই দায়িত্ব আল্লাহ পাক নিজে গ্রহণ করেছেন। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমার প্রতি আল্লাহর ওহীর সম্পূর্ণ হবার পূর্বে কুরআন পাঠে তুমি ত্বরা করো না এবং বলঃ হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞানের বৃদ্ধি সাধন করুন।” (২০:১১৪)
মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি ওটা পাঠ করি অর্থাৎ আমার নাযিলকৃত ফেরেশতা ওটা পাঠ করে তখন তুমি ঐ পাঠের অনুসরণ কর অর্থাৎ শুনতে থাকে এবং তার পাঠ শেষ হলে পর পাঠ করো। আমার মেহেরবানীতে তুমি পূর্ণরূপে মুখস্থ রাখতে সক্ষম হবে। শুধু তাই নয়, বরং এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্বও আমারই। মুখস্থ ও পাঠ করিয়ে নেয়ার পর এটাকে ব্যাখ্যা করে তোমাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে, যাতে তুমি আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং স্পষ্ট শরীয়ত সম্পর্কে অবহিত হতে পার।
মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ইতিপূর্বে ওহী গ্রহণ করতে খুবই কষ্ট বোধ হতো। এই ভয়ে যে, না জানি হয়তো তিনি ভুলে যাবেন। তাই তিনি ফেরেশতার সাথে সাথে পড়তে থাকতেন এবং স্বীয় ওষ্ঠ মুবারক হেলাতে থাকতেন। এ হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) স্বীয় ওষ্ঠ নড়িয়ে দেখিয়ে দেন এবং তাঁর শিষ্য হযরত সাঈদ (রঃ)-ও নিজের উস্তাদের মত নিজের ওষ্ঠ নড়িয়ে তাঁর শিষ্যকে দেখান। ঐ সময় মহামহিমান্বিত আল্লাহ (আরবি) এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! তাড়াতাড়ি ওহীর আয়ত্ত্ব করার জন্যে তুমি তোমার জিহ্বা ওর সাথে সঞ্চালন করো না। এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন জিবরাঈল (আঃ) এটা পাঠ করে তখন তুমি নীরবে তা শ্রবণ করবে। তার চলে যাওয়ার পর তার মত করেই তোমাকে পড়ানোর দায়িত্ব আমার। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এ রিওয়াইয়াতটি রয়েছে। সহীহ বুখারীতে এও রয়েছে যে, যখন ওহী অবতীর্ণ হতো তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) চক্ষু নীচু করে নিতেন এবং ফেরেশতা চলে যাওয়ার পর তিনি তা পাঠ করতেন মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমেও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতে এটা বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্বযুগীয় বহু মুফাসির গুরুজনও এটাই বলেছেন)
এও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সদা-সর্বদা তিলাওয়াত করতে থাকতেন এই ভয়ে যে, না জানি হয়তো তিনি ভুলে যাবেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। হযরত
ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আতিয়্যাহ আওফী (রঃ) বলেন যে, (আরবি) এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ হালাল ও হারামের বর্ণনা দেয়ার দায়িত্ব আমারই। হযরত কাতাদারও (রঃ) এটাই উক্তি।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এই কাফিরদেরকে কিয়ামতকে অস্বীকার করতে, আল্লাহর পবিত্র কিতাবকে অমান্য করতে এবং তাঁর প্রসিদ্ধ রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য না করতে উদ্বুদ্ধকারী হচ্ছে দুনিয়ার প্রেম এবং আখিরাত বর্জন। অথচ আখিরাতের দিন হলো বড়ই গুরুত্বপূর্ণ দিন।
ঐ দিন বহু লোক এমন হবে যাদের মুখমণ্ডলে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যেমন সহীহ্ বুখারীতে বর্ণিত আছেঃ “শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা প্রকাশ্য দৃষ্টিতে দেখতে পাবে। বহু হাদীসে মুতাওয়াতির সনদে, যেগুলো হাদীসের ইমামগণ নিজেদের কিতাবসমূহে আনয়ন করেছেন, এটা বর্ণিত হয়েছে যে, মুমিনরা কিয়ামতের দিন তাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে। এ হাদীসগুলোকে কেউ সরাতেও পারবে না এবং অস্বীকারও করতে পারবে না। সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) ও হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জনগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কিয়ামতের দিন কি আমরা আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবো?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “যখন আকাশ মেঘশূন্য ও সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে তখন সূর্য ও চন্দ্রকে দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট ও অসুবিধা হয় কি?” উত্তরে তারা বললেনঃ “জ্বী, না।” তখন তিনি বললেনঃ “এভাবেই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে।”
সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেই হযরত জারীর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সঃ) চৌদ্দ তারিখের পূর্ণিমার চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে যেমনভাবে এই চন্দ্রকে তোমরা দেখতে পাচ্ছ। সুতরাং তোমরা সক্ষম হলে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বের নামাযে (অর্থাৎ ফজরের নামাযে) এবং সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বের নামাযে (অর্থাৎ আসরের নামাযে) কোন প্রকার অবহেলা করো না।
এই বিশুদ্ধ কিতাব দু’টিতেই হযরত আবূ মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দু’টি জান্নাত রয়েছে স্বর্ণের, তথাকার পাত্র এবং প্রত্যেক জিনিসই স্বর্ণ নির্মিত, আর দু’টি জান্নাত রয়েছে রৌপ্যের, তথাকার পাত্র, বাসন এবং সব কিছুই রৌপ্য নির্মিত। এই জান্নাতগুলোর অধিবাসীদের এবং আল্লাহর দীদারের (দর্শনের) মাঝে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের চাদর ছাড়া আর কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এটা জান্নাতে আদনের বর্ণনা।”
সহীহ মুসলিমে হযরত সুহায়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেন, জান্নাতীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেনঃ “তোমাদের জন্যে আমি আরো কিছু বৃদ্ধি করে দিই তা তোমরা চাও কি?” তারা উত্তরে বলবেঃ “আপনি আমাদের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল করেছেন, আমাদের জান্নাতে প্রবিষ্ট করেছেন এবং আমাদেরকে জাহান্নাম হতে রক্ষা করেছেন। সুতরাং আমাদের আর কোন্ জিনিসের প্রয়োজন থাকতে পারে?” তৎক্ষণাৎ পর্দা সরে যাবে। তখন ঐ জান্নাতীদের দৃষ্টি তাদের প্রতিপালকের প্রতি পতিত হবে এবং তাতে তারা যে আনন্দ ও মজা পাবে তা অন্য কিছুতেই পাবে না। এই দীদারে বারী তা’আলাই হবে তাদের নিকট সবচেয়ে প্রিয়। এটাকেই (আরবি) বলা হয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “সৎকর্মশীলদের জন্যে রয়েছে জান্নাত এবং তারা মহান আল্লাহ্ দীদার বা দর্শনও লাভ করবে।” (১০:২৬)
সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে আছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের ময়দানে মুমিনদের উপর হাসিযুক্ত তাজাল্লী নিক্ষেপ করবেন।
এসব হাদীস দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, মুমিনরা কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ পাকের দীদার বা দর্শন লাভে ধন্য হবে।
মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “সর্বনিম্ন পর্যায়ের জান্নাতী তার রাজ্য ও রাজত্ব দু’হাজার বছর দেখতে থাকবে। দূরবর্তী ও নিকটবর্তী বস্তু সমান দৃষ্টির মধ্যে থাকবে। সব জায়গাতেই তারই স্ত্রী ও খাদেম দেখতে পাবে। আর সর্বোচ্চ পর্যায়ের জান্নাতী প্রত্যহ দুই বার করে আল্লাহ্ পাকের চেহারা অবলোকন করবে। (এ হাদীসটি জামে তিরমিযীতেও রয়েছে। আমরা ভয় করছি যে, যদি এই প্রকারের সমস্ত হাদীস ও রিওয়াইয়াত এবং এগুলোর সনদসমূহ ও বিভিন্ন শব্দ এখানে জমা করি তবে বিষয় খুব দীর্ঘ হয়ে যাবে। বহু সহীহ ও হাসান হাদীস, বহু সনদ অন্যান্য সুনানের কিতাবগুলোতে বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই আমাদের এই তাফসীরের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে এসেও গেছে। অবশ্য তাওফীক প্রদানের মালিক একমাত্র আল্লাহ)
আল্লাহর শুকর যে, এই মাসআলায় অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার দীদার কিয়ামতের দিন মুমিনদের লাভ হওয়া সম্পর্কে সাহাবা, তাবেঈন এবং পূর্বযুগীয় গুরুজনদের ইত্তেফাক ও ইজমা রয়েছে। ইসলামের ইমামগণ ও মানব জাতির হাদীগণও এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন। যারা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, এর দ্বারা আল্লাহ তা’আলার নিয়ামত রাশিকে দেখা বুঝানো হয়েছে, যেমন হযরত মুজাহিদ (রঃ) ও হযরত আবূ সালিহ্ (রঃ) হতে তাফসীরে ইবনে জারীরে বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের এ উক্তি সত্য হতে বহু দূরে এবং এটা কৃত্রিমতাপূর্ণ। তাঁদের কাছে এ আয়াতের জবাব কোথায়? যেখানে পাপীদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কখনই (তাদের ধারণা সত্য) নয়, নিশ্চয়ই সেই দিন তাদের প্রতিপালক হতে তাদেরকে পর্দার মধ্যে রেখে দেয়া হবে (অর্থাৎ তারা তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাৎ লাভে বঞ্চিত হবে)।” (৮৩:১৫) হযরত ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন যে, পাপী ও অপরাধীদের দীদারে ইলাহী হতে বঞ্চিত হওয়া দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সৎ লোকেরা দীদারে ইলাহী লাভ করে ধন্য হবে। মুতাওয়াতির হাদীস সমূহ দ্বারাও এটা সাব্যস্ত হয়ে গেছে এবং (আরবি)-এ আয়াতের শব্দের ধারাও এটাই প্রমাণ করছে যে, মুমিনরা মহান প্রতিপালকের দর্শন লাভ করবে।
হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, সেদিন কোন কোন মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে’ এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ কতকগুলো চেহারা সেদিন অতি সুন্দর দেখাবে। কেননা, দীদারে রবের উপর তাদের দৃষ্টি পড়তে থাকবে, তাহলে কেন তাদের চেহারা সুন্দর ও উজ্জ্বল হবে না? পক্ষান্তরে, বহু মুখমণ্ডল সেদিন হয়ে পড়বে বিবর্ণ, এই আশংকায় যে, এক ধ্বংসকারী বিপর্যয় আসন্ন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হবে যে, সত্বরই তাঁদের উপর আল্লাহর পাকড়াও আসছে এবং অচিরেই তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হচ্ছে। এ বিষয়টি আল্লাহ্ পাকের নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সেদিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে এবং কতক মুখ কালো হবে।” (৩:১০৬) মহান আল্লাহর নিম্নের উক্তিগুলোও অনুরূপঃ (আরবি) অর্থাৎ “অনেক মুখমণ্ডল সেদিন হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুল্ল। আর বহু মুখমণ্ডল সেদিন হবে ধূলিধূসর। সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে কালিমা। এরাই কাফির ও পাপাচারী।” (৮০:৩৮-৪২)
মহিমান্বিত আল্লাহর এ উক্তিগুলোও ঐ রূপঃ (আরবি) অর্থাৎ “সেই দিন বহু মুখমণ্ডল অবনত, ক্লিষ্ট ও ক্লান্ত হবে। তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত অগ্নিতে। তাদেরকে অত্যুষ্ণ প্রস্রবণ হতে পান করানো হবে। তাদের জন্যে খাদ্য থাকবে না যারী’ (এক প্রকার কন্টকময় গুল) ব্যতীত, যা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং তাদের ক্ষুধা নিবৃত্ত করবে না। বহু মুখমণ্ডল সেই নি হবে আনন্দোজ্জ্বল, নিজেদের কর্ম-সাফল্যে পরিতৃপ্ত, সুমহান জান্নাতে।” (৮৮:২-১০) এই বিষয়েরই আরো বহু আয়াত রয়েছে।
২৬-৪০ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে মৃত্যু ও মৃত্যু-যাতনার খবর দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ্ আমাদেরকে ঐ কঠিন অবস্থায় সত্যের উপর স্থির থাকার তাওফীক দান করুন! (আরবি) শব্দটিকে এখানে ধমকের অর্থে নেয়া হলে অর্থ হবেঃ হে আদম সন্তান! তুমি যে আমার খবরকে অবিশ্বাস করছে তা ঠিক ও উচিত নয়, বরং তার কাজ-কারবার তো তুমি দৈনন্দিন প্রকাশ্যভাবে দেখতে রয়েছে। আর যদি এটা (আরবি) অর্থে নেয়া হয় তবে তো ভাবার্থ বেশী প্রতীয়মান হবে। অর্থাৎ যখন তোমার রূহ্ তোমার দেহ থেকে বের হতে লাগবে এবং তোমার কণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। (আরবি) শব্দটি (আরবি) শব্দের বহু বচন। এটা ঐ অস্থিগুলোকে বলা হয় যেগুলো বক্ষ এবং কাঁধের মাঝে থাকে। যেমন আল্লাহ পাক অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “পরন্তু কেন নয়- প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত হয় এবং তোমরা তাকিয়ে থাকো, আর আমি তোমাদের অপেক্ষা তার নিকটতর, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না। তোমরা যদি কর্তৃত্বাধীন না হও, তবে তোমরা ওটা ফিরাও না কেন? যদি তোমরা সত্যবাদী হও!” (৫৬:৮৩-৮৭)
এখানে ঐ হাদীসটিও লক্ষ্যণীয় যা বিশর ইবনে হাজ্জাজ (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতে সূরা ইয়াসীনের তাফসীরে গত হয়েছে। (আরবি) যা (আরবি)-এর বহুবচন, ঐ হাড় যা হলকূমের কাছে রয়েছে। বলা হবেঃ কে তাকে রক্ষা করবে? হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হলোঃ কোন ঝাড়-ফুঁককারী আছে কি? আবূ কালাবা (রঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হলোঃ কোন ডাক্তার ইত্যাদির দ্বারা কি আরোগ্য দান করা যেতে পারে? হযরত কাতাদাহ্ (রঃ), হযরত যহ্হাক (রঃ) এবং ইবনে যায়েদ (রঃ)-এরও এটাই উক্তি। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এটা ফেরেশতাদের উক্তি। অর্থাৎ এই রূহকে নিয়ে কোন্ ফেরেশতারা আকাশের উপর উঠে যাবে, রহমতের ফেরেশতারা, না আযাবের ফেরেশতারা?
মহান আল্লাহ্ উক্তিঃ পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যাবে। এর একটি ভাবার্থ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন হতে এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, দুনিয়া ও আখিরাত তার উপর জমা হয়ে যাবে। ওটা দুনিয়ার শেষ দিন হয় এবং আখিরাতের প্রথম দিন হয়। সুতরাং সে কঠিন হতে কঠিনতম অবস্থার সম্মুখীন হয়, তবে কারো উপর আল্লাহ্ রহম করলে সেটা স্বতন্ত্র কথা।
দ্বিতীয় ভাবার্থ হযরত ইকরামা (রঃ) হতে এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক বড় ব্যাপার অন্য এক বড় ব্যাপারের সাথে মিলিত হয়। বিপদের উপর বিপদ এসে পড়ে।
তৃতীয় ভাবার্থ হযরত হাসান বসরী (রঃ) প্রমুখ মনীষী হতে বর্ণিত হয়েছে যে, স্বয়ং মরণোন্মুখ ব্যক্তির কঠিন যন্ত্রণার কারণে তার পায়ের সাথে পা জড়িয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। পূর্বে সে তো এই পায়ের উপর চলাফেরা করতো, কিন্তু এখন এতে জীবন কোথায়? আবার এও বর্ণিত হয়েছে যে, কাফন পরানোর সময় পদনালীর সাথে পদনালী মিলে যাওয়াকে বুঝানো হয়েছে। হযরত যহহাক (রঃ) হতে এও বর্ণিত আছে যে, দু’টি কাজ দু’দিকে জমা হয়ে যায়। এক দিকে তো মানুষ তার মৃতদেহ ধুয়ে-মুছে মাটিকে সমর্পণ করতে প্রস্তুত, অপরদিকে ফেরেশতারা তার রূহ নিয়ে যেতে ব্যস্ত। নেককার হলে তো ভাল প্রস্তুতি ও ধুমধামের সাথে নিয়ে যান এবং বদকার হলে অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থার সাথে নিয়ে যান।
মহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সেই দিন আল্লাহর নিকট সব কিছু প্রত্যানীত হবে। রূহ আকাশের দিকে উঠে যায়। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দেনঃ তোমরা এই রূহকে পুনরায় যমীনেই নিয়ে যাও। কারণ আমি তাদের সবকে মাটি হতেই সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিবো এবং তা হতেই পুনর্বার তোমাদেরকে বের করবো। যেমন এটা হযরত বারা (রাঃ) বর্ণিত সুদীর্ঘ হাদীসে এসেছে। এ বিষয়টিই অন্য জায়গায় বর্ণিত হয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তিনিই তাঁর বান্দাদের উপর বিজয়ী, তিনিই তোমাদের হিফাযতের জন্যে তোমাদের নিকট ফেরেশতা পাঠিয়ে থাকেন, শেষ পর্যন্ত যখন তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় এসে যায় তখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা তার মৃত্যু ঘটিয়ে থাকে এবং এ ব্যাপারে তারা কোন ত্রুটি করে না। তারপর তাদের সকলকেই তাদের সত্য মাওলা আল্লাহর নিকট ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জেনে রেখো যে, হুকুম তারই এবং তিনিই সত্বরই হিসাব গ্রহণকারী।” (৬:৬১-৬২)
এরপর ঐ কাফির ব্যক্তির অবস্থা বর্ণনা করা হচ্ছে যে, নিজের আকীদায় সত্যকে অবিশ্বাসকারী এবং স্বীয় আমলে সত্য হতে পৃষ্ঠ প্রদর্শনকারী ছিল। কোন মঙ্গলই তার মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না। না সে আল্লাহর কথাকে আন্তরিয্কভাবে বিশ্বাস করতো, না শারীরিকভাবে তার ইবাদত করতো, এমনকি সে নামাযও কায়েম করতো না। বরং সে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অতঃপর সে তার পরিবার-পরিজনের নিকট ফিরে গিয়েছিল দম্ভভরে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যখন তারা তাদের আপন জনের নিকট ফিরে আসতো তখন তারা ফিরতো উফুল্ল হয়ে।” (৮৩:৩১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সে তার পরিজনের মধ্যে তো আনন্দে ছিল। যেহেতু সে ভাবতো যে, সে কখনই ফিরে যাবে না।” (৮৪:১৩-১৪) এর পরেই মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ফিরে যাবে। তার প্রতিপালক তার উপর সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন।” (৮৪:১৫)।
এরপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা ধমক ও ভয় প্রদর্শনের সুরে বলেনঃ দুর্ভোগ তোমার জন্যে, দুর্ভোগ! আবার দুর্ভোগ তোমার জন্যে, দুর্ভোগ! আল্লাহ্ সঙ্গে কুফরী করেও তুমি দম্ভ প্রকাশ করছো! যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ “(বলা হবেঃ) আস্বাদ গ্রহণ কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত, অভিজাত।” এটা তাকে ঘৃণা ও ধমকের সুরে কিয়ামতের দিন বলা হবে। আরো বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা অল্প কিছুদিন খাও ও সুখ ভোগ করে নাও, নিশ্চয়ই তোমরা তো অপরাধী।” (৭৭:৪৬) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যাও, আল্লাহ ছাড়া যার ইচ্ছা ইবাদত করতে থাকো।” (৩৯:১৫) এ সমুদয় স্থানে এসব কথা ধমকের সুরেই বলা হয়েছে।
হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ)- কে (আরবি)-এই আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন যে, নবী পাক (সঃ) আবূ জেহেলকে এই কথাগুলো বলেছিলেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন কারীমে হুবহু এই শব্দগুলো অবতীর্ণ করেন। সুনানে নাসাঈতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও প্রায় এরূপই বর্ণিত আছে।
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত কাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই ফরমানের পর আল্লাহর ঐ দুশমন বলেছিলঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি আমাকে ধমকাচ্ছ? জেনে রেখো যে, তুমি ও তোমার প্রতিপালক আমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। এই দুই পাহাড়ের মাঝে চলাচলকারীদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি আমিই।”
মহা মহিমান্বিত আল্লাহ এরপর বলেনঃ মানুষ কি মনে করে যে, তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হবে? অর্থাৎ সে কি এটা ধারণা করে যে, তাকে মৃত্যুর পরে পুনর্জীবিত করা হবে না? তাকে কোন হুকুম ও কোন কিছু হতে নিষেধ করা হবে না? এরূপ কখনো নয়, বরং দুনিয়াতেও তাকে আদেশ ও নিষেধ করা হবে এবং পরকালেও তার কৃতকর্ম অনুসারে তাকে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। এখানে উদ্দেশ্য হলো কিয়ামতকে সাব্যস্ত করা এবং কিয়ামত অস্বীকারকারীদের দাবী খণ্ডন করা। এ জন্যেই এর দলীল হিসেবে বলা হচ্ছেঃ মানুষ তো প্রকৃত পক্ষে শুক্রের আকারে প্রাণহীন ও ভিত্তিহীন পানির এক নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ ফোটা ছাড়া কিছুই ছিল না। অতঃপর আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা ওটাকে রক্তপিণ্ডে পরিণত করেন, তারপর তা গোশতের টুকরায় পরিণত হয়, এরপর মহান আল্লাহ্ ওকে আকৃতি দান করেন এবং সুঠাম করেন। অতঃপর তিনি তা হতে সৃষ্টি করেন যুগল নর নারী। যে আল্লাহ্ এই তুচ্ছ শুক্রকে সুস্থ ও সবল মানুষে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনি কি তাকে ধ্বংস করে দিয়ে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন না? অবশ্যই যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আরো বেশী সক্ষম হবেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহ্ তিনিই যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, আবার ওকে ফিরিয়ে আনবেন (মৃত্যুর পর পুনরায় সৃষ্টি করবেন) এবং এটা তাঁর কাছে খুবই সহজ।” (৩০:২৭) এই আয়াতের ভাবার্থের ব্যাপারেও দু’টি উক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই বেশী প্রসিদ্ধ। যেমন সূরা রুমের তাফসীরে এর বর্ণনা ও আলোচনা গত হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত মূসা ইবনে আবী আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক স্বীয় ঘরের ছাদের উপর উচ্চস্বরে কুরআন মাজীদ পাঠ করছিলেন। যখন তিনি এই সূরার (আরবি)-এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন তখন তিনি (আরবি)পাঠ করেন অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র ও মহান। হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই এতে সক্ষম।” জনগণ তাঁকে এটা পাঠ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এটা পাঠ করতে শুনেছি।” (এ হাদীসটি সুনানে আবী দাউদেও রয়েছে। কিন্তু দু’টি কিতাবেই ঐ সাহাবী (রাঃ) -এর নাম উল্লেখ করা হলেও কোন ক্ষতি নেই)
সুনানে আবূ দাউদেই হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সূরা (আরবি) পাঠ করবে এবং (আরবি) (৯৫:৮) এই আয়াত পর্যন্ত পড়বে সে যেন পাঠ করেঃ (আরবি) অর্থাৎ “হ্যাঁ, (আপনি বিচারকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক) এবং সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আমি নিজেও একজন সাক্ষী।” (৯৫:১) আর যে, ব্যক্তি (আরবি) এ সূরাটি পাঠ করবে এবং (আরবি) এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছবে তখন যেন সে (আরবি) (হ্যাঁ) পাঠ করে। আর যে ব্যক্তি (আরবি)-এ সূরাটি পাঠ করবে এবং (আরবি) (অর্থাৎ “সুতরাং তারা কুরআনের পরিবর্তে আর কোন্ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবে!”) (৭৭:৫০) এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছবে তখন যেন সে (আরবি) (আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি) বলে। এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ এবং জামে তিরমিযীতেও রয়েছে।
তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত কাতাদাহ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) এই সূরা কিয়ামাহর শেষ আয়াতের পরে (আরবি) বলতেন।
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি) পাঠ করার পর (আরবি) বলেছেন।
(৩)তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আল-কিয়ামাহ
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৭৫
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই ক্ষুদ্র সূরাটি মানুষের হৃদয়ে এত বিপুল পরিমাণ উচু মানের তত্ত্ব ও তথ্য, ইশারা ও ইংগিত, দৃশ্য ও চিত্র এবং অনুভূতি ও উপলব্ধির সমাবেশ ঘটায়, যাকে সে প্রতিরােধও করতে পারে না আবার উপেক্ষাও করতে পারে না। অত্যন্ত ক্ষুরধার ভাষায় ও বিশেষ কোরআনিক বাচনভংগীর আশ্রয় নেয় যা তার ভাষাগত কাঠামােতে এবং শৈল্লিক সূরে ও ধ্বনিতে সমভাবে প্রতিফলিত হয়। ভাষাগত ও ধ্বনিগত উভয় প্রকারের বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে এতে এক শক্তিশালী প্রভাবের সৃষ্টি হয়, যার মােকাবেলাও করা যায় না, আবার তাকে উপেক্ষাও করা যায় না। প্রথম দুটি আয়াতে কেয়ামত সংক্রান্ত বচন ও মন সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্য দিয়ে সূরাটির সূচনা হয়েছে। তারপর মন ও কেয়ামত সংক্রান্ত বক্তব্য অব্যাহত রয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুটি বিষয় পাশাপাশি চলেছে। এ হিসাবে প্রথম দুই আয়াতের বক্তব্যকে সূৱার বিষয়বস্তুর বিবরণ অথবা এমন একটি জরুরী বক্তব্য বলে আখ্যায়িত করা যায়, যা সূরার বহুসংখ্যক বাক্যে ঘুরে ফিরে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এই পুনরাবৃত্তি হয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও চমকপ্রদ ভংগীতে। মানুষের মনের সামনে এই সূরা যে বড় বড় তত্ত্ব ও তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে তার চারপাশে দুর্লংঘ্য প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে মৃত্যু সংক্রান্ত নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ সত্যটি। এটি এমন নির্মম বাস্তবতা, প্রত্যেক প্রাণীই যার সম্মুখীন হয়ে থাকে, অথচ সে নিজে অথবা তার আশপাশের কেউই তা প্রতিরােধ করতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে অগণিত প্রাণী মৃত্যুর শিকার হচ্ছে, কি ধনী, কি দরিদ্র, কি শিশু, কি বৃদ্ধ, কি সবল, কি দুর্বল, সকলেই এর শিকার হচ্ছে অথচ সকলে তার সামনে একই রকম অসহায়। কোনাে কলাকৌশল বা ফন্দি-ফিকির, কোনাে উপায়-উপকরণ, কৌশল প্রয়োগ করে তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দিক থেকেই কোনাে জোর-জবরদস্তি, কোনাে সুপারিশ, কোনাে প্রতিরােধ কিংবা কোনাে বিলম্বিত করণের তার সামনে আসে এবং মানুষ তা ঠেকানাের কোনাে উপায়ই জানে না। মৃত্যুর কাছে এবং যে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তা পাঠায় তার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া মানুষের আর কিছুই করার থাকে না। সূরার ২৬-৩০ আয়াতে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় এ বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। সূরার উপস্থাপিত বিষয়সমূহের আর একটি অন্যতম বিষয় হলাে মানুষের ইহকালীন জন্ম। এই জন্ম দ্বারা তার মৃত্যু পরবর্তী পুনর্জন্ম এবং মানব সৃষ্টির মূলে নিহিত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। এটি এমন একটি বাস্তবতা, যার সূক্ষ্মতা, নিপুণতা এবং অব্যাহত পুনরাবৃত্তি একমাত্র আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব। যারা আখেরাতকে অস্বীকার করে এবং তাতে সন্দেহ পােষণ করে তারাও কখনাে একথা দাবী করে না যে, পৃথিবীর কোনাে একটি জিনিসও তারা সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, সৃষ্টি জগতের সৃষ্টি ও পরিচালনা-ব্যবস্থাপনার কাজ একজন স্ৰষ্টাই করে থাকেন। এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা এই মর্মেও সাক্ষ্য দেয় যে, পরকালীন পুনরুজ্জীবন আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সহজই শুধু নয়, বরং অপরিহার্য। কেননা প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার তত্ত্ব সাক্ষ্য দেয় যে, মানুষকে নিরর্থক সৃষ্টি করা হয়নি এবং তার জীবন ও কর্মকে পরিমাপ ও মূল্যায়ন না করে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে না। এই বক্তব্য নিয়েই এই সূরা মানব হৃদয়কে স্পর্শ করে। সূরার সূচনাতেই সে বলেছে, মানুষ কি মনে করে যে, আমি কখনাে তার হাড়গুলােকে একত্রিত করবাে না? আবার শেষের দিকে বলেছে, মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে। সূরার উপস্থাপিত অন্যতম শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দৃশ্য হচ্ছে কেয়ামতের দৃশ্য, কেয়ামতে সংঘটিত প্রাকৃতিক জগতের ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার দৃশ্য। মনস্তাত্তিক বিপর্যয় এবং সমগ্র সৃষ্টিতে ছড়িয়ে পড়া সর্বাত্মক ভীতি ও ত্রাস। মানুষের প্রশ্নের জবাবে কেয়ামতের এই বিরাট ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ দেয়া হবে অত্যন্ত সংক্ষেপে ও দ্রুতগতিতে। যথা, ‘আসলে মানুষের ইচ্ছা, আল্লাহর সামনেই পাপাচারে লিপ্ত হয়। সে জিজ্ঞাসা করে, কবে হবে কেয়ামত । সেটি হবে সেই দিন যেদিন দৃষ্টিশক্তি যাবে….’ সেদিনের দৃশ্যসমূহের মধ্যে আর একটি উল্লেখযােগ্য দৃশ্য হবে মােমেনদের দৃশ্য। তারা সেদিন পরম আনন্দে ও শান্তিতে থাকবে। সেই ভয়াবহ দিনে তারা আল্লাহর সাক্ষাত লাভের আশায় আশান্বিত থাকবে। অপর দৃশ্যটি হবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন, হতাশাগ্রস্ত, আপন পাপ ও কুফরীর শাস্তির আশংকায় তটস্থ অবাধ্য লােকদের দৃশ্য। এ দৃশ্যটি এত শক্তিশালী ও জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়, যেন তা কোরআন পাঠের সময় পাঠকের সামনেই উপস্থিত। এতে মানুষের ইহকাল প্রীতি ও আখেরাতকে অবহেলার সমালােচনা করা হয়েছে। ‘কখনাে নয়, তােমরা বরঞ্চ দুনিয়ার জীবনকেই ভালােবাস আর আখেরাতকে ছেড়ে দাও।’ এইসব দৃশ্য বর্ণনার মাঝখানে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয় কোরআন শিক্ষার ব্যাপারে রসূল(স.)-এর ব্যাকুলতা সম্পর্কে দেয়া বিশেষ নির্দেশ সম্বলিত চারটি আয়াত। মনে হয় খােদ সূরার ভিতরেই এই শিক্ষার প্রসংগ বিদ্যমান রয়েছে। রসূল(স.) আশংকা করতেন যে, কোরআনের কোনাে অংশ হয়তাে তিনি ভুলে যাবেন। তাই ভুলে যাওয়ার ভয়ে তিনি ওহী নাযিল হওয়ার সময় এর এক একটি করে বাক্য বারবার মুখে আউড়িয়ে মুখস্থ করার চেষ্টা করতেন। এই প্রসংগেই নাযিল হয়, ‘তাড়াহুড়া করে মুখস্থ করার জন্যে কোরআনের আয়াত উচ্চারণ করে নিজের জিহবা নাড়িও না। একে একত্রিত করা ও পড়িয়ে দেয়া আমারই দায়িত্ব। যখন আমি পড়বো, তখন তা অনুসরণ করে পড়ো। তারপর তার ব্যাখ্যা করাও আমার দায়িত্ব।’ তাঁর কাছে এ নির্দেশিকা আসার কারণ এই যে, কোরআনের সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ সংক্রান্ত সমস্ত কাজ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দায়িত্ব-এটা যেন তিনি বুঝেন ও নিশ্চিন্ত থাকেন। তাঁর ভূমিকা শুধু কোরআন নিজে আহরণ করা ও অন্যদের কাছে পৌছানাে। যথাসময়ে তিনি পুরাে কোরআন তার অন্তরে রক্ষিত দেখতে পাবেন। আসলে হয়েছিলােও তাই। এই নির্দেশ কুরআন নাযিল হওয়ার সময়েই সত্য প্রমাণিত হয়েছিলাে। যেহেতু এ নির্দেশটি স্বয়ং আল্লাহরই উক্তি, তাই আল্লাহর এই উক্তি অকাট্য ও অক্ষয় প্রমাণিত হয়েছিলাে। খােদ কোরআনের মতােই এ কথাগুলােও অক্ষরে অক্ষরে সংরক্ষিত হয়েছে। এ থেকে একটি অক্ষরও হারায়নি বা খােয়া যায়নি। বস্তুত এ কথাগুলােও ছিল অকাট্য সত্য। এই সূরাটি পড়ার সময় প্রত্যেক পাঠকের মন উপলব্ধি করে যে, সে চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে আছে তার পালানাের অবকাশ নেই। তার কর্মফলের সাথেই তার ভাগ্য আবদ্ধ। এ থেকে তার নিস্তার নেই। এ থেকে তার কোথাও আশ্রয় নেই। কেউ তার রক্ষক নেই। স্বয়ং আল্লাহর জ্ঞান ও পরিকল্পনা দ্বারা তার জন্ম ও তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত। দুনিয়াতে ও আখেরাতে একইভাবে নিয়ন্ত্রিত-চাই সে যতই খেলাধুলা, তামাশা ও অহংকার করে কাটাক না কেন। এ কথাই পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে বিধৃত হয়েছে, ‘কিন্তু সে-না সত্য মেনে নিলাে, না সে নামায পড়লাে। বরং সত্যকে মনে করলাে ও ফিরে গেলাে। পরে অহমিকা সহকারে নিজের পরিবার পরিজনের কাছে রওনা হয়ে গেলাে।’ আর সেই বিপুলসংখ্যক তত্ত্ব, তথ্য ও আবেগ অনুভূতির সমাবেশ ঘটানাের পাশাপাশিই পরােক্ষ হুমকির বাণী শােনানাে হয়েছে এভাবে, ‘এরূপ আচরণ তােমার জন্যেই উপযুক্ত এবং তােমাতেই শােভা পায়। হাঁ, এই আচরণ তােমার জন্যেই উপযুক্ত এবং তােমাতেই শােভা পায়।’ এ ভাবেই সূরাটি মানুষের মনের একগুয়েমী, গােয়ার্তুমী, হঠকারিতা, অবহেলা, ও খেল তামাশা প্রভৃতি রোগের চিকিৎসা করে এবং তাকে গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে সজাগ করে তা হচ্ছে কেয়ামত ও মন সংক্রান্ত সত্য নিয়ন্ত্রিত ও সূক্ষ্ম হিসাবের আওতাভুক্ত জীবনের বাস্তবতা এবং প্রতিটি অক্ষর সহ সংরক্ষিত এই অকাট্য কোরআনের বাস্তবতা। কেননা এ কোরআন মহান প্রভু আল্লাহর কালাম । সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি তার কালামে মুখরিত, প্রকৃতির নিরাপদ রেজিষ্টারে তা সুরক্ষিত এবং এই পবিত্র গ্রন্থে তা সংরক্ষিত। ইতিপূর্বে আমি নিছক বর্ণনার খাতিরে সূরার বক্তব্য বিষয় ও দৃশ্যসমূহ তুলে ধরেছি। কিন্তু মূল সূরায় সে বিষয়গুলাের স্বরূপ সম্পূর্ণ অন্যরকম। কেননা উক্ত বিষয়গুলাে ক্রমাগতভাবে বর্ণনা করা, কোথাও একাধিক বিষয়ের একত্র সমাবেশ, আবার কোথাও সত্যের একটি বিশেষ দিক হৃদয়ে বদ্ধমূল করা এবং পুনরায় তার অপরাংশের বর্ণনায় প্রত্যাবর্তন-এ সবই মানব হৃদয়কে সম্বােধন করে ব্যবহৃত কোরআনের বিশেষ বাচনভংগী। অন্য কোনাে বাচনভংগী এর ধারে কাছেও যেতে পারেনি। এবার আমরা সূরাটির তাফসীরে মনােনিবেশ করবাে।
ফী জিলালিল কুরআন:
সূরার প্রথম থেকে ১৫ নং আয়াত পর্যন্ত পড়লে দেখা যাবে, এখানে যে পরােক্ষ শপথ করা হয়েছে তা প্রত্যক্ষ শপথের চেয়েও অন্তরে বেশী প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাব বিস্তার করাই এর আসল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য এই বিশেষ বাচনভংগীই অধিকতর সফল হয়। এই বাচনভংগীর প্রয়ােগ কোরআনের একাধিক জায়গায় দেখা যায়। অতপর কিয়ামত ও তিরস্কারকারী মনের তত্ত্বকথা উন্মোচন করা হয়। *নাফসে লাওয়ামা বা তিরস্কারকারীর মন : কেয়ামতের ব্যাপারটি তো সূরায় ব্যাপকভাবে আলােচিত হয়েছে। তাই তার তেমন বেশী ব্যাখ্যার দরকার নেই। কিন্তু ‘নাফসে লাওয়ামা’ বা তিরস্কারকারী মন সম্পর্কে বহু মত রয়েছে। হাসান বসরী বলেন, আল্লাহর কসম, কোনাে মােমেনকে তুমি যখনই দেখবে, দেখবে সে নিজেকে তিরস্কার তথা আত্মসমালােচনা করছে। সে নিরন্তর নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে, আমার কথার উদ্দেশ্য কি? আমার খাওয়ার উদ্দেশ্য কি? আমার নিজের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্য কি? আর পাপী লােককে দেখবে, চলছে তাে চলছেই। সে একটুও আত্মসমালােচনা করছে না। হাসান বলেন, কেয়ামতের দিন প্রত্যেকেই নিজেকে ধিক্কার দেবে ও আত্মসমালােচনা করবে। ইকরামার মতে ভালাে ও মন্দ উভয় প্রকার কাজ করেই নিজের সমালােচনা ও পর্যালােচনা এভাবে করা যে, আমি যদি এভাবে কাজ করতাম! হযরত সাঈদ ইবনে যােবায়ার এবং হযরত ইবনে আব্বাস বলেন, এ হচ্ছে আত্মসমালােচক মন। তিনি এর অর্থ, সমালােচিত মনও বলেছেন। মুজাহিদ বলেন, যে সৎ কাজ হাত ছাড়া হয়ে গেছে তার জন্যে আফসােস ও অনুশােচনা করা এবং নিজেকে ভরসা করা। কাতাদা(র.)-এর মতে, লাওয়ামা অর্থ পাপী। ইবনে জরীর বলেন, এই সব কয়টি উক্তি প্রায় কাছাকাছি অর্থবােধক। কোরআনের উক্তিতে এর অর্থ বাহ্যত, ভালাে ও মন্দ কাজের ওপর সমালােচনাকারী ও ছুটে যাওয়া সৎ কাজের জন্যে অনুশােচনাকারী মােমেন। আমার কাছে ‘নাফসে লাওয়ামা’-এর ব্যাখ্যায় হাসান বসরীর উপরােক্ত উক্তিই সঠিক বলে মনে হয় । এহনে আত্মসমালােচক, সদাসতর্ক, আল্লাহভীরু মনই আল্লাহর কাছে অতীব সম্মানিত মন, কেননা সর্বক্ষণ তার পরিবেশের প্রতি নযর থাকে। স্বীয় কুপ্রবৃত্তি সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে হুশিয়ার থাকে। এ কারণেই এই মনের কথা হিসাবের দিন কেয়ামতের সাথেই বলা হয়েছে। তা ছাড়া এটি পাপাসক্ত মনের ঠিক বিপরীত। পাপাসক্ত মন হচ্ছে সর্বদা অপরাধ প্রবণ, সে দাওয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ও ফিরে যায় এবং আপন পরিবারের কাছে গর্বের সাথে যায়, কোনাে আত্মসমালােচনার প্রয়ােজন অনুভব করে না।
ফী জিলালিল কুরআন: *মানুষের পুনরুত্থান অবধারিত সত্য : কেয়ামত ও নাফসে লাওয়ামার শপথ করে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের অবধারিত হওয়ার কথা ঘােষণা করেছেন। তবে সেটা কিছুটা ভিন্ন আংগিকে। যথা : ‘মানুষ কি ভেবেছে যে আমি তার হাড়গুলােকে একত্রিত করবাে না? আমি তাে তার আংগুলের গিরাগুলােও যথাযথভাবে বানিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখি।’ মােশরেকদের মনস্তাত্বিক সমস্যা ছিলাে এই যে, তারা মনে করতাে, মৃত মানুষের হাড়গােড় মাটির গভীরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে হারিয়ে যাওয়ার পর তা পুনরায় একত্রিত করে মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা কি করে সম্ভব, তা তারা ভাবতেই পারতাে না। বর্তমান যুগেও বােধকরি এটা অনেকে অসম্ভব মনে করে। হাড়গোড় একত্রিত করার এ ব্যাপারটিকে অসম্ভব মনে করাকে কোরআন দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এ কাজটি সংঘটিত হবেই বলে ঘােষণা করেছে। আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে, অবশ্যই আমি তার আংগুলের গিরাগুলােকেও যথাযথভাবে বানিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখি। ‘বানান’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে আংগুলের প্রান্তভাগ বা গিরা। কোরআন বলতে চাচ্ছে যে, শুধুমাত্র হাড়গোড় একত্রিত করা আর এমন কি? আল্লাহ তায়ালা তাে তার চেয়েও উন্নততর ও সুক্ষ্মতর কাজ যথা আংগুলগুলাের গিরাগুলাে পর্যন্ত যথাযথভাবে বানিয়ে দিতে সক্ষম। অর্থাৎ মানবদেহকে এত সুক্ষ্মভাবে ও পূর্ণাংগভাবে পুনর্গঠিত করতে সক্ষম, যাতে তার একটা আংগুলও খােয়া না যায়, স্থানচ্যুত না হয়, কোনাে অংগহানি বা অংগের বিকৃতি না ঘটে-চাই তা যতই ছােট ও সূক্ষ্ম হােক কেন। একেবারে যেমনটি পূর্বে ছিলাে, ঠিক তেমনটি বানিয়ে দিতে তিনি সক্ষম। এখানে আল্লাহ তায়ালা শুধু এতটুকু যুক্তি প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। সূরার শেষভাগে আল্লাহ তায়ালা আরাে একটা যুক্তি পেশ করেছেন প্রথম সৃষ্টির বাস্তবতার আলােকে। এখানে মানুষের এরূপ ধারণার পেছনে এবং আল্লাহ তায়ালা হাড়গােড় একত্রিত করতে পারবেন না-বলে মনে করার পেছনে একটি মনস্তাত্তিক কারণ দেখিয়েছেন। সেটি এই যে, মানুষ পাপ করতে চায়, কিন্তু সে এও চায় এক্ষেত্রে কেউ যেন তাকে বাধা দিতে না পারে এবং কোনাে হিসাব নিকাশ ও জবাবদিহীর সম্মুখীন তাকে যেন হতে না হয়। এরূপ একটি মনস্তাত্তিক ঝোকের বশে সে মনে করে যে, পুনরুজ্জীবিত হওয়া ও কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। বরঞ্চ মানুষ তার সামনে পাপ করতে চায়, তাই জিজ্ঞাসা করে যে, কেয়ামত আবার কবে হবে? আসলে এ প্রশ্নটির মূল সুর হচ্ছে, কেয়ামত হবে না, হতেও পারে না। আসলে পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া এবং অপ্রতিহত গতিতে পাপ কাজ চালিয়ে যাওয়ার অদম্য বাসনা থেকেই এই ধারণার উৎপত্তি। সে চায় আখেরাতের জবাবদিহী ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কল্পরূপ যেন তার পাপে মত্ত জীবনকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। কেননা আখেরাত বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে, তা পাপাসক্ত প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরে এবং পাপ প্রবণ মনের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়। এ জন্যে সে কেয়ামতকে অস্বীকার করার মাধ্যমে এই লাগামটি দূরে নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে, যাতে তার উদ্দাম ও সীমাহীন দুষ্কর্ম অব্যাহত থাকে। এ কারণে কেয়ামতকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা ও অসম্ভব মনে করার ঔদ্ধত্যের জবাবে অতি দ্রুত ও আকস্মিকভাবে কেয়ামতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। কেয়ামতের এ দৃশ্যটিতে মানুষের অনুভুতি, ভাবাবেগ ও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর একত্র সমাবেশ ঘটেছে, ‘যখন বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যাবে, চাঁদ আলােহীন হয়ে যাবে, চাঁদ ও সূর্যকে মিলিয়ে একাকার করে দেয়া হবে, তখন মানুষ বলবে, এখন কোথায় পালাই?” দৃষ্টিশক্তি যখন বিদ্যুতের মতাে দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হবে ও ঝলসে যাবে, চাঁদ আলােহীন হয়ে যাবে এবং সুর্য বিচ্ছিন্ন থাকার পর চাঁদের সাথে মিলে যাবে এবং সৌর মন্ডলের প্রচলিত নিয়ম-শৃংখলা ভেংগে গিয়ে গােটা প্রাকৃতিক জগত বিপর্যস্থ হয়ে পড়বে, তখন সেই সময় আলোড়ন ও আতংকের পরিবেশে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ বলবে, ‘এখন কোথায় পালাই!’ তার এ প্রশ্নে ভয়ে দিশাহারা হয়ে যাওয়ার মনােভাব পরিস্ফূট। মনে হয় একবার সে চারদিক তাকিয়ে দেখবে, তারপর সব পথ রুদ্ধ দেখে এ কথা বলবে। আসলে সেদিন আল্লাহর আক্রোশ ও পাকড়াও থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনাে পথ থাকবে না, তার কাছে ছাড়া আশ্রয় নেয়ার কোনাে জায়গা থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কখনাে নয়, কোনােই আশ্রয় স্থল থাকবে না। সেদিন একমাত্র তােমার প্রভুর কাছেই থাকবে অবস্থানের স্থান। ইতিপূর্বে মানুষ অবাধে পাপ করে বিনা হিসাবে ও বিনা শাস্তিতে ছাড়া পাবে বলে যে আশা ছিলাে, সেদিন আর তা থাকবে না। সেদিন যা কিছু সে করেছে কড়ায় গন্ডায় তার হিসাব বুঝে পাবে। যদি ভুলে যায় তবে তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। অতপর তার সকল কৃতকর্মকে সে স্মরণ করতে পারবে এবং তার সামনেই উপস্থিত পাবে, সেদিন মানুষ যা আগে করেছে ও পরে করেছে তা তাকে জানানাে হবে। কাজের জের হিসাবে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে, তাও তাকে অবহিত করা হবে। বস্তুত, হিসাব নিকাশের শেষে প্রত্যেক ব্যক্তির আমলনামায় সেইসব কাজ যুক্ত হবে, যা তার মৃত্যুর পরে তার কাজের প্রতিক্রিয়া হিসাবে সংঘটিত হবে। অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে যে সব কাজ সে নিজে এবং মৃত্যুর পরে তার সম্পাদিত ভালাে বা মন্দ মানুষ তার কৃতকর্মের পক্ষে যত ওযর বাহানা ও সাফাই পেশ করুক না কেন, তা গৃহীত হবে না। কেননা তার প্রবৃত্তির দায়দায়িত্ব তার নিজেরই ঘাড়ে থাকবে। নিজের প্রবৃত্তিকে সৎপথে পরিচালিত করা তারই দায়িত্ব ছিলাে। কিন্তু তা যখন সে করেনি এবং অপকর্ম করেছে, তখন তার জন্যে তাকেই দায়ী হতে হবে, বরঞ্চ মানুষ নিজে নিজেকে খুব ভালােভাবেই জানে, চাই যতই সাফাই সে পেশ করুক না কেন। লক্ষণীয় যে, প্রতিটি বাক্য ছােট ছােট ও দ্রুত গতিশীল। প্রত্যেকটির মাঝে সামান্য বিরতি। প্রত্যেকটিতে অপূর্ব সুরেলা ছন্দ ও চোখ ধাঁধানাে দৃশ্যের সমাবেশ। হিসাব নিকাশের অনুষ্ঠানটিও তদ্রুপ অল্প কথায় সমাপ্ত। মানুষকে তার আগের ও পরের কৃতকর্ম অবগত করা হবে। এভাবে দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত বচনে বিবরণ দেয়া হয়েছে। কারণ এ দ্বারা দীর্ঘ আশা ও হিসাবের দিনের প্রতি অবজ্ঞার জবাব দেয়া হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন: *কোরআনের পাঠ ও সংরক্ষণ : এরপরই আসছে সেই বিশেষ চারটি আয়াত, যাতে রসূল(স.)-কে ওহী ও কোরআন মুখস্থ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ‘এই ওহীর বাণী দ্রুত উচ্চারণ করার জন্যে জিহবা নাড়িও না, একে সংরক্ষণ করা ও পড়ার ব্যবস্থা করা আমারই দায়িত্ব। আমি যখন পড়বাে তখন তুমিও পড়াে। তারপর তার ব্যাখ্যার দায়িত্বও আমার।’ সূরার ভূমিকায় আমরা এ আয়াতগুলাে সম্পর্কে যা বলেছি, তার সাথে আরেকটি কথা এখানে যােগ করতে চাই এবং তা এই যে, এই আয়াতগুলাে থেকে মনে যে ধারণাগুলাে বদ্ধমূল হয় তা হলাে, ১. এই কোরআন সংক্রান্ত যাবতীয় দায়দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং গ্রহণ করেছেন। ওহী প্রেরণ থেকে শুরু করে নির্ভুলভাবে তা সংরক্ষণ, সংকলন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পর্যন্ত সব কিছুই তার প্রত্যক্ষ দায়িত্বের আওতাধীন। ২. এই কোরআন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর রচিত এবং তা তিনি তার কাছ থেকেই পেয়েছেন। ৩. রসূল(স.)-এর ওপর কোরআনের ব্যাপারে অর্পিত দায়িত্ব শুধু এতটুকু যে, তিনি তা বহন করবেন ও প্রচার করবেন। ৪. রসূল(স.) কর্তৃক কোরআনকে সম্পূর্ণরূপে মুখস্থ করার প্রবল আবেগ ও আগ্রহ পােষণ করতেন এবং এ কাজকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন শুধু এই ভয়ে যে, এর একটি শব্দও যেন তার কাছ থেকে খোয়া না যায়। আর এ কারণেই জিবরাঈল যখন কোরআন পড়ে তাকে শােনাতেন তখন তিনিও তার অনুকরণে প্রতিটি আয়াত ও শব্দ উচ্চারণ করতেন। যাতে তার একটি শব্দও তার কাছ থেকে হারিয়ে না যায়। এবং সম্পূর্ণ সংরক্ষিত হয়েছে এই মর্মে পরবর্তীকালে নিশ্চিত থাকতে পারেন। কোরআনে এই ঘটনার উল্লেখ এবং স্থায়ীভাবে এর সংরক্ষণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ দ্বারা সূরার ভূমিকায় যা বলেছি এবং উপরােক্ত বক্তব্যগুলাের সত্যতাই সমর্থিত হয়।
ফী জিলালিল কুরআন: *কেয়ামতের দিনের একটি চিত্র : এরপর সূরায় কেয়ামতের দৃশ্যাবলী ও সেখানে আত্মসমালােচক মনের যে অবস্থা হবে তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। এত মানুষের মনের স্বভাব ও ব্যাধিগুলাে, যথা দুনিয়ার আসক্তি ও তাতে সর্বাত্মকভাবে নিমজ্জিত হওয়া এবং আখেরাতকে অবহেলা করা প্রভৃতির চিকিৎসার ব্যবস্থা নির্দেশ করা হয়েছে। অতপর আখেরাতের ব্যাপারে তাদের উদাসীন ভূমিকা ও তার ফলে কেয়ামতে তাদের যে দুর্গতি হবে তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। একটি জীবন্ত দৃশ্যের উপস্থাপনার মাধ্যমে এ দুরবস্থা চিত্রিত করা হয়েছে। এ দৃশ্য অত্যন্ত প্রভাবশালী ও উদ্দীপনাময়, ‘কখনাে নয়। বরঞ্চ তােমরা দুনিয়াকে ভালােবাসছাে এবং আখেরাতকে ত্যাগ করছে। প্রকৃতপক্ষে সেদিন কিছু সংখ্যক মানুষের চেহারা উজ্জ্বল আলােয় ভরে উঠবে এবং নিজের প্রভুর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আর কিছু সংখ্যক মুখাবয়ব উদাস ও ম্লান হবে। মনে করতে থাকবে যে, তাদের সাথে বুঝি এখনি নৃশংস আচরণ করা হবে।’ সর্বপ্রথম যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা এই যে, এখানে দুনিয়াকে ‘আ’জিলা’ অর্থাৎ দ্রুতগামী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যদিও এ শব্দের প্রধান প্রতিপাদ্য হলাে, দ্রুত অতিক্রমকারী ও ক্ষণস্থায়ী এবং এখানেও সেই অর্থেই এটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এই শব্দের সাথে পূর্ববর্তী আয়াতে তাড়াতাড়ি ওহীকে আয়ত্ত করার জন্যে জিহবা নাড়িও না এই নির্দেশটির একটি তত্ত্বগত ও অর্থগত মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই ‘ত্বরিত প্রাপ্তির আকাংখ্যা’ পার্থিব জীবনে মানবীয় চরিত্রের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্যরূপে চিহ্নিত হয়েছে। কোরআনের ভাষায় এটা মানবীয় চেতনার একটা সুক্ষ্ম ও গভীর সমন্বয়। এরপর কেয়ামতের যে অবস্থাটি কোরআন অতি সুন্দর ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছে তা হলাে, সেদিন বহুসংখ্যক মুখাবয়ব থাকবে উজ্জ্বল ও তরতাজা, আপন প্রভূর দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ এই বক্তব্যটুকু অতি সংক্ষেপে এমন একটি অবস্থার দিকে ইংগিত করেছে, যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না এবং কল্পনা শক্তি দ্বারাও তাকে পুরােপুরিভাবে কল্পনা করা যায় না। ভাগ্যবান লােকদের সম্পর্কে এখানে এমন একটি সুখকর অবস্থার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, যার সাথে কোনাে কিছুর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কি পাশেই অবস্থিত বেহেস্ত তার সকল নানা নেয়ামত নিয়েও তার সামনে নগ্ন। এই সকল তরতাজা উজ্বল চেহারা কেন এত উজ্জ্বল। কারণ, তারা আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য হয়েছে। এটি যে কত উচু স্তরের সৌভাগ্য এবং কত উচ্চ মার্গের সুখ, তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায়না। মানুষের আত্মা বিশ্ব প্রকৃতিতে অথবা মানবীয় সত্তায় আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি নৈপূণ্যের কিছু কিছু নমুনা দেখে সে সময় অভিভূত ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কখনাে জোৎস্না-স্নাত রাতে, ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘেরা রজনীতে। নবীন প্রভাতে দীর্ঘ সুশীতল ছায়া ঘেরা অরণ্যে, তরঙ্গস্ফীত সমুদ্রে, জনহীন মরুভূমিতে, সুশােভিত বাগানে, সুদৃশ্য চেহারায়, মহত্বপূর্ণ হৃদয়ে অটল অবিচল ঈমানে, অথবা মনােমুগ্ধকর ধৈর্যে এবং আনন্দোদ্দীপক দৃশ্য দেখে সে ক্ষণিকের জন্যে সকল দুঃখ কষ্টের তিক্ত স্মৃতি ও অনুভূতি ভুলে যায় । আল্লাহর সৃষ্টির দিকে দেখে যদি এরূপ তৃপ্তি লাভ হতে পারে, তাহলে স্বয়ং আল্লাহর সৌন্দর্য দেখে কি অবস্থা হতে পারে? এ অবস্থাকে ভাষায় বর্ণনা করা তাে দূরের কথা, মানুষ যাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে এই অকল্পনীয় সুখ, আনন্দ তৃপ্তিকে উপভােগ করতে পারে, সে জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকেই তাকে দীর্ঘ আয়ু ও দৃঢ়তা প্রদান করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। সুতরাং আল্লাহর সৌন্দর্য উপভােগ করার ভেতরে তার মুখাবয়বে ঔজ্জল্য আসবে না কেন? প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিভিন্ন দৃশ্য দেখলেই তাে মানুষের তৃপ্তির আলামত মাঝে মাঝে তার হৃদয়ের চৌহদ্দী অতিক্রম করে মুখমন্ডলেও প্রতিফলিত হয়। এসময় তার মুখমন্ডল উজ্জ্বল ও তরতাজা মনে হয়। কাজেই এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্রষ্টা যিনি, যিনি সব দিক থেকেই পূর্ণাংগ ও সৰ্বোচ্চস্তরে উন্নীত, তার সীমাহীন সৌন্দর্য দেখে তার মুখমন্ডলে উজ্জল আভা ফুটে উঠবে না কেন? একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বেহেস্তে যখন মানুষ আল্লাহ তায়ালার দর্শন লাভ করবে তখন পার্থিব জীবনে সেই অপরূপ সৌন্দর্য অবলােকনের যত অক্ষমতা ও অযােগ্যতা মানুষের মধ্যে ছিলাে, তা সবই দূরীভূত হয়ে যাবে এবং যে স্তরে উন্নীত হলে তার ভেতরে এই যােগ্যতা সৃষ্টি হবে সে স্তরেই সে উন্নীত হবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তারা আল্লাহকে কিভাবে দেখবে, কোন অংগ দিয়ে দেখবে, কোন যন্ত্র দিয়ে দেখবে? এর জবাব এই যে, যার হৃদয়ে কোরআন আনন্দের ফোয়ারা বইয়ে দেয়, তার হৃদয়ে এ প্রশ্ন ওঠে না। যার আত্মায় সৌভাগ্যের পরশ বুলানাে থাকে এবং যার আত্মা এই দর্শনের আশায় মতােয়ারা থাকে, এ প্রশ্ন তার মনে জাগে না। যেসব মানুষ নিজের আত্মাকে এই পরম সুখ, সৌভাগ্য ও আলাের বন্যা থেকে বঞ্চিত করছে এবং যে জিনিসকে মানবীয় বিবেক বুদ্ধির নির্ধারিত নিয়ম নীতি দ্বারা বুঝা যায় না, তা নিয়ে নিরর্থক তর্ক ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে তাদের অবস্থাটা অবশ্যই ভেবে দেখার মতাে। পরকালীন জীবনে মানুষের নৈতিক সত্তা তার বস্তুগত সত্তার সীমিত গন্ডী থেকে মুক্তি লাভ করবে। এই মুক্তির ফলেই মহাসত্যের সাথে অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার সাথে তার মিলন ও সাক্ষাৎ সম্ভব হবে। এই মুক্তির আগে তার পক্ষে উক্ত সাক্ষাতের সম্ভাবনা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের বিষয় কে কেন্দ্র করে ‘মুতাজিলা’ সম্প্রদায় ও তাদের বিরােধীদের দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক একটা নিরর্থক ও বৃথা বিতর্ক ছাড়া আর কিছু নয়। আসল ব্যাপার এই যে, তারা পার্থিব ও ইহকালীন মানদন্ড দিয়েই সব কিছু পরিমাপ করতে চাইতাে। তারা কথা বলতে পার্থিব বিবেক বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত মানুষ সম্পর্কে এবং চিন্তা করতে সীমিত চিন্তা শক্তি ও বােধশক্তির সাহায্যে।[‘মোতাযিলা’ একটি বাতিল ফের্কার নাম। আব্বাসীয় খেলাফতের আমলে ইসলামের কতিপয় মৌলিক আকীদা বিশ্বাস যেমন, বেহেশতে আল্লাহ তায়ালার দর্শন লাভ, কোরআনের সৃষ্টি, কবিরা গুনা করলে কাফের সাব্যস্ত হওয়া ও এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড, মানুষের ব্যক্তিগত কাজের আসল সিদ্ধান্তকর ক্ষমতা-ইত্যাদি ব্যাপারে তারা কিছু বিভ্রান্তিমূলক চিন্তাধারা ছড়িয়েছিলাে, যেগুলাে মুসলিম মিল্লাতের স্বীকৃত আলেমদের বিরােধীতার মুখে বলতে গেলে তখন রহিতই হয়ে গিয়েছিলাে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই বাতিল ফের্কাটি বাতিল হয়ে গেলেও এখন তাদেরই উচ্ছিষ্ট চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে এখন বহু নতুন মতবাদ গজিয়ে উঠছে। নামের একটু হেরফের হলেও চিন্তা ও দর্শনে এরা সবাই এক-সম্পাদক] ভাষা দ্বারা মনের যে ভাব প্রকাশ করা হয়, তা আমাদের সীমাবদ্ধ বিবেক বুদ্ধি ও ধ্যান-ধারণার ওপর নির্ভরশীল। আমরা যদি কখনাে এই ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে যাই, তাহলে আমাদের ভাষার প্রকৃতি বদলে যাবে। কেননা ভাষা হলাে মানুষের মনমগযে বিদ্যমান ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে নানাবিধ জিনিসের নির্দেশক কতিপয় সংকেত চিহ্ন মাত্র। তাই মানুষের শক্তির তারতম্য ঘটলে তার ধ্যান-ধারণারও পরিবর্তন ঘটবে এবং সেই সাথে ভাষা দ্বারা প্রকাশিত মনােভাবের প্রকৃতি পাল্টে যাবে। আমরা দুনিয়াতে আমাদের অবস্থা অনুসারে ভাষার সেই সংকেতগুলাে দ্বারাই কাজ নিয়ে থাকি, যার দ্বারা কাজ করতে আমরা অভ্যন্ত। পৃথিবীতে আমরা যে ভাষা দ্বারা যে অর্থ বুঝি, তা যেখানে পরিবর্তিত হয়ে যাবে সেই জগত সম্পর্কে আমরা কিভাবে মতামত ব্যক্ত করতে পারি? কাজেই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমাদের মনমগজ ও অন্তরাত্মাকে যেন সাধ্যমত সেই অপার্থিব জগতের পবিত্র ও নিষ্কলুষ প্রেরণা লাভের চেষ্টায় নিয়ােজিত করা। কেননা তা আমাদের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত। বস্তুত এই চেষ্টা এমন এক দুর্লভ নেয়ামত, যার ওপরে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাত লাভ ছাড়া আর কোনাে নেয়ামত নেই।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৩০
اِلٰى رَبِّكَ یَوْمَئِذِ اِ۟لْمَسَاقُ٢ؕ۠
সেদিনটি হবে তোমার প্রভুর কাছে যাত্রা করার দিন।
ফী জিলালিল কুরআন:
*অপরাধীদের উদাস চেহারা : ‘কিছু সংখ্যক মুখাবয়ব সেদিন উদাস ও স্নান থাকবে…’ এই মুখাবয়বগুলাের ম্লান ও উদাস হওয়ার কারণ এই যে পাপের কালিমায় অতিমাত্রায় লিপ্ত থাকার কারণে তা আল্লাহর সাক্ষাত ও দর্শন লাভের যেমন যােগ্য থাকবে না, তেমনি কখন সে কোমর ভেংগে দেয়ার মতাে আযাবে নিপতিত হবে এই ভেবে নিদারুণভাবে বিমর্ষ থাকবে। ভয়ে ও আশায় তাদের মুখমন্ডলে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা চিহ্ন ফুটে উঠবে। এই হচ্ছে সেই আখেরাত যাকে তারা অবহেলা করে পার্থিব জীবনকে অধিকতর ভালােবাসে। আর তাদের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে কেয়ামতের সেই ভয়াবহ দিন, যখন বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন রকমের কর্মফল ভােগ করবে। ফলাফলের এই বিভিন্নতাই উপরােক্ত আয়াত কয়টিতে ফুটে উঠেছে। আয়াতসমূহ কেয়ামতের দিনের সার্বিক বিপর্যয়, মানুষের পালানাের জায়গা খোজার ব্যাকুলতা এবং নানান ধরনের মানুষের নানান ধরনের কর্মফল সম্বলিত দৃশ্য বর্ণনা করে। আর সে দৃশ্যসমূহ যখন মানুষের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং কোরআনের ক্ষুরধার বর্ণনাভংগী সেই শক্তি ও প্রভাবকে সুনির্দিষ্টভাবে জীবন্ত করে তুলে ধরে, তখন শ্রোতাদের চেতনায় তা আরাে একটা দৃশ্যকে অংকিত করে। এই দৃশ্যটি প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতিদিন বারবার প্রত্যক্ষ করে এবং প্রতি মুহূর্তে তার সামনে তা পূর্ণ শক্তি ও তীব্রতা নিয়ে হাযির হয়। এই দৃশটি হলাে মৃত্যুর দৃশ্য। প্রত্যেক প্রাণীর এটি হচ্ছে শেষ পরিণতি। কোনাে প্রাণী এই পরিণতি থেকে নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে রক্ষা করতে পারে না। মৃত্যু প্রিয়জনকে প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে করতে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলে। কারাে দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না, কোনাে শােকার্ত মানুষের বিলাপে, ব্যথিত প্রিয়জনের আক্ষেপে, কোনাে আগ্রহী মানুষের আগ্রহে কিংবা ভীরু মানুষের ভয়ে মুহর্তের জন্যে থমকে দাড়ায় না। এই মৃত্যু একজন ক্ষুদ্র নগন্য ও দুর্বলকে যেমন সহজে সাবাড় করে, ঠিক তেমনি অনায়াসে খতম করে বড় বড় পরাক্রমশালী স্বৈরাচারী প্রতাপশালী শাসককেও। যে মৃত্যুর বিরুদ্ধে মানুষের বিন্দুমাত্রও কোনাে ফন্দিফিকির চলে না, তার অপ্রতিরোধ্য শক্তি সম্পর্কে মানুষ কিছুই চিন্তাভাবনা করে না। ২৬ থেকে ৩০ নম্বর আয়াত কয়টির মর্মার্থ এটাই। এ আয়াত কয়টি পড়ে মনে হয়, কোরআন যেন একটি মুমূর্ষ ব্যক্তির শিয়রে উপনীত। মৃত্যু সেখানে সামনে দাঁড়ানো। ‘কখনাে নয়, প্রাণ যখন কন্ঠদেশ পর্যন্ত পৌছে যাবে।’ বস্তুত প্রাণ যখন কণ্ঠদেশ পর্যন্ত পৌছে যাবে, তখন প্রাণ বায়ু নির্গত হবার সময় সমাগত হবে। তখন চেতনা হরণকারী এক অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং যন্ত্রণার চোটে চোখ বিস্ফারিত হবে, আর মুমুর্ষ ব্যক্তির পাশে হাযির লােকেরা বেদনা বিধুর আত্মাটিকে উদ্ধারের কৌশল ও উপায় উদ্ভাবনের জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাবে। বলা হবে, ‘ঝাড়-ফুক দেয়ার কেউ আছে কি?’ হয়তাে বা এই ঝাড় ফুক বা তাবিয তুমারে কোনাে উপকার হতে পারে। হয়তাে বা মুমূর্ষ ব্যক্তিটি ভালােও হয়ে যেতে পারে। ‘আর পায়ের সাথে পা জড়িয়ে যাবে।’ সকল কৌশল ব্যর্থ হয়ে যাবে, সকল ফন্দিফিকির নিষ্ফল হবে এবং সেই একমাত্র পথটিই সামনে এসে যাবে, যা প্রত্যেক প্রাণীর শেষ পথ, ‘সেদিনটি হবে তােমার প্রভুর দিকে যাত্রা করার দিন।’ দৃশ্যটি যেন একটি সচল ও সবাক চিত্র। প্রত্যেক আয়াত একটি গতিশীল অবস্থা তুলে ধরছে। প্রতিটি বাক্য যেন একটি মুহূর্তকে তুলে ধরছে। মুমূর্ষাবস্থা চিহ্নিত হচ্ছে আর সেই সাথে চিহ্নিত হচ্ছে বিলাপ, হতাশা, দিশাহারা অবস্থা ও নিষ্ঠুর সত্যের সম্মুখীন হওয়ার প্রস্তুতি। সে নিষ্ঠুর সত্যকে প্রতিরােধ করার কেউ নেই, ঠেকাবার কোনাে উপায় নেই, তারপর সামনে এসে যাচ্ছে সেই চরম মুহূর্ত, যা থেকে পালাবার কোনাে পথ নেই। সেদিন তােমার প্রভুর দিকেই যাত্রা করার দিন। এ পর্যন্ত এসে বেদনাময় দৃশ্যের যবনিকাপাত ঘটছে। কিন্তু চোখে মুখে ও স্নায়ুতে তা তার প্রতিবিম্ব ও প্রতিক্রিয়া রেখে যাচ্ছে, রেখে যাচ্ছে গােটা পরিবেশে একটা থমথমে নিস্তব্ধতা।
P
ফী জিলালিল কুরআন: উল্লেখিত শোক সন্তপ্ত, বেদনাবিধুর ও নির্মম বাস্তব পরিস্থিতির বিপরীতে পেশ করা হচ্ছে তামাশারত অবিশ্বাসীরা, যারা কোনাে সৎকর্ম বা এবাদাত দ্বারা মৃত্যুকে আলিংগন করার প্রস্তুতি নেয়নি, বরং কেবল পাপ কাজ করেই চলেছে এবং অবজ্ঞা, অবহেলা ও অহংকারে লিপ্ত থেকেছে, ‘সে সত্য মেনে নিলাে না, নামাযও পড়লাে না, বরং সত্যকে মিথ্যা মনে করলাে এবং ফিরে গেলাে। তারপর অহমিকতা সহকারে আপন পরিবার-পরিজনের দিকে রওনা হয়ে গেলাে।’ *অহংকারী ও দাম্ভিক আবু জাহেল : বর্ণিত আছে যে, এ আয়াতগুলাে দ্বারা আবু জাহেল আমর বিন হিশামকে বুঝানা হয়েছে। সে মাঝে মাঝে রাসূল(স.)-এর কাছে আসতাে ও কোরআন শুনতাে। তারপর সেখান থেকে চলে যেত। তার ভেতরে কোনাে পরিবর্তন আসতাে না, সে ঈমান আনতাে না, আনুগত্যও করতাে না কিংবা কোনাে ভয়ভীতি বা আদব তমীযও শিখতাে না। বরঞ্চ রসূল(স.)-কে কটুবাক্য দ্বারা কষ্ট দিতাে এবং মানুষকে আল্লাহ তায়ালার পথে আসতে বাধা দিতাে। তারপর আবার নিজের অপকর্মের জন্যে গর্ববােধ করতাে। যেন সে একটা উল্লেখযােগ্য ভালো কাজ করে ফেলেছে । কোরআনের ভংগীটি তার প্রতি বিদ্রুপাত্মক। এতে তার অহংকার সহকারে আপন পরিজনের কাছে যাওয়ার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাসে এ রকমের আবু জাহেল আরাে অনেক ছিলাে, আছে এবং থাকবে। দাওয়াত শুনবে, প্রত্যাখ্যান করবে, আল্লাহর পথে যেতে মানুষকে এরা বাধা দেবে, আহবানকারীদের ওপর নির্যাতন চালাবে, চক্রান্ত চালাবে এবং তারপরও নিজেদের অপকর্ম, অনাচার, নৈরাজ্য, ষড়যন্ত্র ও দাংগা ফাসাদের জন্যে গর্ব বােধ করবে। কোরআন এই সব অহংকারী দুরাচারকে কঠোর হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘হাঁ, এই আচরণ তােমার জন্যেই উপযুক্ত এবং তােমার পক্ষেই মানানসই।’ এটা হচ্ছে হুমকি সম্বলিত একটা পরিভাষা। একবার রসূল (স.) আবু জাহেলের গলা টিপে ধরে প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে বলেছিলেন, এ আচরণ তােমার জন্যেই উপযুক্ত এবং তােমার জন্যেই এটা মানানসই। তখন আবু জাহেল বলেছিলাে, ‘হে মােহম্মদ! আমাকে কি তুমি ভয় দেখাচ্ছ? তুমি তাে দূরের কথা, তােমার খােদাও আমার কিছু করতে পারবে না। দুই পাহাড়ের মাঝখানে যত মানুষ চলাফেরা করে, তাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশী ক্ষমতাবান। বদরের যুদ্ধে সে মােমেনদের হাতে ধরা পড়ে। সেদিন সে মােহাম্মাদ(স.) ও তাঁর মহাপরাক্রমশালী প্রভুর শক্তি দেখে নিয়েছিলাে। ইতিপূর্বে ফেরাউন বলেছিলাে, ‘আমি তো তােমাদের জন্যে আমি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ আছে বলে জানি না।’ সে আরাে বলেছিলাে, ‘মিশরের রাজত্ব কি আমার নয়? এইসব নদীনালা তাে আমার অধীনেই চলছে।’ অতপর আল্লাহ তায়ালা একইভাবে তাকেও পাকড়াও করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু আবু জাহলের সন্ধান পাওয়া যায়। যারা নিজের আত্মীয় স্বজন, শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির বলে বলিয়ান হয়ে মনে করতাে, আমি বিরাট একটা কিছু হয়ে গেছি। আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে যেতাে। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের একটা ব্যাঙ বা মাছির চেয়েও নিকৃষ্টভাবে পাকড়াও করলেন। তবে এ জন্যে একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, যার এক মুহূর্ত আগেও পাকড়াও করা হয় না, এক মুহূর্ত পরেও না।
ফী জিলালিল কুরআন: *একটি জীবননির্ভর সত্য ঘটনা : পরিশেষে এখানে অন্য একটি বাস্তব ও জীবননির্ভর সত্য দিয়ে শ্রোতাদের মনমানসকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ সত্যটির যেমন মানুষের পার্থিব জীবনের পরিচালনা ও পরিকল্পনায় ভূমিকা রয়েছে, তেমনি আখেরাতের জীবন সম্পর্কেও রয়েছে এর অকাট্য সাক্ষ্য প্রমাণ। ‘মানুষ কি মনে করেছে যে, তাকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে… আল্লাহ তায়ালা কি মৃতদেরকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম নয়?’ আরবের পৌত্তলিকদের চোখে জীবনের কোনাে উৎস ছিলাে না এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিলাে না। তারা ভাবতাে, মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ট হওয়া এবং কবরের পেটে শেষ আশ্রয় নেয়া এই হলাে মানুষের নিয়তি। এর মাঝে যে সময়টুকু, তা আনন্দ ফুর্তির জন্যে, পক্ষান্তরে জীবনের জন্যে কোনাে আইন বা নৈতিক বিধান থাকার প্রশ্ন, একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় পৃথিবীতে আগমনকে একটি পরীক্ষা হিসাবে চিহ্নিত করা এবং তার শেষে প্রতিদান ও প্রতিফলের আশা করা এবং এই বিশ্ব জগতের জন্যে এক অদৃশ্য, অসীম শক্তিধর ও মহাজ্ঞানী স্রষ্টা ও পরিচালকের অপরিহার্যতার ইত্যাদি প্রশ্ন ছিলাে তাদের কাছে একেবারেই অবাস্তব, অসম্ভব ও অকল্পনীয় । যে জিনিস মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে তা হলাে, সময় ঘটনাবলী ও লক্ষ্যের মধ্যে পারস্পরিক সংযােগের অস্তিত্ব উপলব্ধি করা, মানব জীবন এবং তার পারিপার্শিক যাবতীয় জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা, উপরােক্ত উপলব্ধির বিকাশ ও সম্প্রসারণের সাথে সাথে তার মনুষ্যত্বের সিড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধন। জীবনের জন্যে নৈতিক বিধান থাকার পক্ষে ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা করা এবং উক্ত বিধানের সাথে ঘটনাবলী ও বস্তুনিচয়ের সংযােগ সাধন করা। মানুষ নানা মুহূর্তে ও নানা ঘটনার মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে জীবন ধারণ করতে পারে না। বরং স্থান, কাল, পরস্পরের সাথে সাথে সম্পৃক্ত থাকে। তারপর এই জিনিসটাই গােটা মহাবিশ্বের সাথে ও তার নিয়ম বিধির সাথে গিয়ে সম্পৃক্ত হয়। এরপর এই গােটাবিশ্ব সম্পৃক্ত হয় তার স্রষ্টা, নিয়ন্তা ও পরিচালকের সর্বোচ্চ ইচ্ছার সাথে যিনি মানুষকে অকারণ সৃষ্টি করেন না এবং তাকে লক্ষাহীনভাবেও ছেড়ে দেন না। এটাই হচ্ছে আবহমান কাল থেকে চলে আসা সেই চিন্তাধারা, যার একান্ত কাছাকাছি কোরআন মানুষকে নিয়ে গেছে। সে সমাজে বিরাজমান অন্যান্য বাতিল চিন্তাধারার কাছে তাকে নিয়ে যায়নি। এ চিন্তাধারা সেকালেও ছিলাে অভিনব এবং এ যুগেও অভিনব। প্রাচীন দর্শনের সাথে পরিচিত জীবন ও জগত সংক্রান্ত যাবতীয় মানব রচিত চিন্তাধারার কাছেও এটা অভিনব। *কোরআনের জিজ্ঞাসা : এমনিই কি ছেড়ে দেয়া হবে? : ‘মানুষ কি মনে করে যে তাকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে?’ এটি মানুষের মনের কাছে উত্থাপিত কোরআনের একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রশ্ন। এর উদ্দেশ্য এই যে, সে যেন একটু চিন্তা-ভাবনা করে এবং বুঝতে চেষ্টা করে যে, পারিপার্শ্বিক সৃষ্টি জগত ও স্রষ্টার সাথে তার কোনাে সম্পর্ক সংযোগ আছে কিনা। এরপর অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় এই মর্মে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, মানুষকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া হবে না। এক্ষেত্রে যুক্তিগুলাে হচ্ছে তার পার্থিব ও প্রথম জন্ম সংক্রান্ত, ‘সেটি কি এক ফোঁটা টপকানাে বীর্য ছিলাে না? অতপর তা একটি জমাট রক্তপিন্ড হলাে এবং তারপর আল্লাহ তায়ালা তার দেহ সৃষ্টি করলেন ও অংগ প্রত্যঙ্গকে সুষ্ঠু ও সংগতিপূর্ণ বানালেন। তারপর তা থেকে পুরুষ ও নারী দু ধরনের মানুষ বানালেন।’ কে এই মানুষ? কিসের থেকে তাকে সৃষ্টি করা হলাে? সে কেমন ছিলাে? কেমন হলাে? কিভাবে সে এতাে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এই গ্রহে পৌছলাে? সে কি ক্ষুদ্র এক ফোঁটা পানি তথা টপকানাে বীর্য ছিলাে না? সে কি একটি সেল গ্রহণ করেনি? বেঁচে থাকা ও খাদ্য লাভের জন্যে সে কি মাতৃগর্ভে অবস্থান গ্রহণ করেনি? মাতৃগর্ভের সাথে সে কি সর্বদা ঝুলে থাকতাে না। কে তাকে নড়াচড়ার শক্তি ও গতি দান করলাে, তারপর কে তাকে ভারসাম্য এই পূর্ণ মানবদেহের রূপ দিলাে? কোটি কোটি জীবন্ত ‘সেল’ থেকে তার যে দেহ তৈরী হলাে তা আসলে একটি মাত্র সেল ও ডিম্বানু থেকেই তৈরী। একটি সেল থেকে সুগঠিত মানবদেহে রূপান্তরিত হতে তার যে স্তরগুলাে পার হতে হয়েছে, তা জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনের স্তরগুলাের চেয়ে অনেক দীর্ঘ। অনুরূপভাবে মাতৃগর্ভে তার মধ্যে যে পরিবর্তনগুলাে ঘটে, তাও তার ভূমিষ্ট হওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যতগুলাে স্তরের সম্মুখীন হতে হয় তার চেয়ে বেশী ও ব্যাপক। কে তাকে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পথ দেখালাে? অথচ সে ছিলাে তখন অতীব দুর্বল একটি ক্ষুদ্র সৃষ্টি। তার কোনাে বুঝও ছিলাে না, অভিজ্ঞতাও ছিলাে না। সবশেষে প্রশ্ন জাগে, যে একটি মাত্র সেল থেকে কে পুরুষ ও স্ত্রী বানালাে, সে সেলটিকে পুরুষে অথবা স্ত্রীতে পরিণত করতে কার ইচ্ছা কার্যকর হয়েছিলাে? অথবা কে সে-যে, মাতৃগর্ভের নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে সেলটিকে স্বেচ্ছায় পুরুষ বা স্ত্রী হওয়ার পথ দেখিয়ে দিয়েছে? এ কথা না মেনে কোনাে গত্যন্তর নেই যে, এক অতীব বিচক্ষণ ও নিপুণ কুশলী হাত এই টপকেপড়া শুক্রের ফোটাকে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এই রূপান্তরের শেষ ধাপে পৌছে দিয়েছে। মানুষের চেতনার ওপর অংকিত এই অকাট্য সত্যের প্রেক্ষাপটে এই সূরায় আলােচিত সকল তত্ত্বের সার নির্যাস হিসাবে একটি মৌলিক বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে, ‘এই মহান সত্তা কি মৃতদেরকে জীবিত করতে সক্ষম নন?’ হাঁ, নিশ্চয়ই তিনি সক্ষম, আর মানুষের পক্ষে এই সত্যকে মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই অকাট্য প্রত্যয়দীপ্ত উপসংহার দ্বারা মানুষের চেতনাকে পরিতৃপ্ত করা এবং মানুষের জন্ম রহস্য ও তার ব্যাপারে মহান আল্লাহর অতুলনীয় দক্ষ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার তথ্য উদঘাটনের মধ্য দিয়ে সূরাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
১-৪০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
(৭৫-কিয়ামাহ) : নামকরণ:
সূরার প্রথম আয়াতের الۡقِيٰمَةِۙ আলকিয়ামহ শব্দটিকে এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি শুধু সূরাটির নামই নয়, বরং বিষয়ভিত্তিক শিরোনামও। কারণ এ সূরায় শুধু কিয়ামত সম্পর্কে আলোচন করা হয়েছে।
(৭৫-কিয়ামাহ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
কোন হাদীস থেকে যদিও এ সূরার নাযিল হওয়ার সময়-কাল জানা যায় না। কিন্তু এর বিষয়বস্তুর মধ্যেই এমন একটি প্রমাণ বিদ্যমান যা থেকে বুঝা যায়, এটি নবুয়াতের একেবারে প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্যতম। সূরার ১৫ আয়াতের পর হঠাৎ ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে: এ অহীকে দ্রুত মুখস্ত করার জন্য তুমি জিহবা নাড়বে না। এ বাণীকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং পড়িয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। অতএব আমি যখন তা পড়ি তখন তুমি তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকো। এর অর্থ বুঝিয়ে দেয়াও আমার দায়িত্ব। এরপর ২০ নম্বর আয়াত থেকে আবার সে পূর্বের বিষয়ে আলোচনা শুরু হচ্ছে যা প্রথম থেকে ১৫ নম্বর আয়াত পর্যন্ত চলছিল। সে সময় হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এ সূরাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শুনাচ্ছিলেন পরে ভুলে যেতে পারেন এ আশংকায় তিনি এর কথাগুলো বার বার মুখে আওড়াচ্ছিলেন। এ কারণে পূর্বাপর সম্পর্কহীন এ বাক্যটি পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং হাদীসের বর্ণনা উভয় দিক থেকেই বক্তব্যের মাঝখানে সন্নিবেশিত হওয়া যথার্থ হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, এ ঘটনা সে সময়ের যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবে মাত্র অহী নাযিলের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করছেন এবং অহী গ্রহণের পাকাপোক্ত অভ্যাস তাঁর তখনো ও গড়ে ওঠেনি। কুরআন মজীদে এর আরো দু’টি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। একটি সূরা ত্বা-হা যেখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাহকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে:
لَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَى إِلَيْكَ وَحْيُهُ
“আর দেখো, কুরআন পড়তে তাড়াহুড়া করো না, যতক্ষণ না তোমাকে অহী পূর্ণরূপে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। (আয়াত ১১৪)
দ্বিতীয়টি সূরা আলায়। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে: سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسَى “আমি অচিরেই তোমাকে পড়িয়ে দেব তারপর তুমি আর ভুলে যাবে না।”(আয়াত ৬) পরবর্তী সময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অহী গ্রহনে ভালভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এ ধরনের নির্দেশনা দেয়ার আর প্রয়োজন থাকেনি। তাই কুরআনের এ তিনটি স্থান ছাড়া এর আর কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না।
(৭৫-কিয়ামাহ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এ সূরা থেকে কুরআন মজীদের শেষ পর্যন্ত যতগুলো সূরা আছে তার অধিকাংশের বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভঙ্গী থেকে বুঝা যায় যে, সূরা মুদ্দাস্সিরের প্রথম সাতটি আয়াত নাযিল হওয়ার পর যখন অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি বর্ষণের মত কুরআন নাযিলের সিলসিলা শুরু হলো, এ সূরাটিও তখনকার অবতীর্ণ বলে মনে হয়। পর পর নাযিল হওয়া এসব সূরায় জোরালো এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় অত্যন্ত ব্যাপক কিন্তু সংক্ষিপ্ত বাক্যে ইসলাম এবং তার মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক শিক্ষাসমূহ পেশ করা হয়েছে এবং মক্কাবাসীদেরকে তাদের গোমরাহী সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। এ কারণে কুরাইশ নেতারা অস্থির হয়ে যায় এবং প্রথম হজ্বের মওসুম আসার আগেই তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরাভুত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নানা রকম ফন্দি-ফিকির ও কৌশল উদ্ভাবনের জন্য একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। সূরা মুদ্দাস্সিরের ভূমিকায় আমরা এ বিষয়ের উল্লেখ করেছি।
এ সূরায় আখেরাত অবিশ্বাসীদের সম্বোধন করে তাদের এককেটি সন্দেহ ও একেকটি আপত্তি ও অভিযোগের জওয়াব দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত মজবুত প্রমাণাদি পেশ করে কিয়ামত ও আখেরাতের সম্ভাব্যতা, সংঘটন ও অনিবার্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। আর একথাও স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তিই আখেরাতকে অস্বীকার করে, তার অস্বীকৃতির মূল কারণ এটা নয় যে, তার জ্ঞানবুদ্ধি তা অসম্ভব বলে মনে করে। বরং তার মূল কারণ ও উৎস হলো, তার প্রবৃত্তি তা মেনে নিতে চায় না। সাথে সাথে মানুষকে এ বলে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, যে সময়টির আগমনকে তোমরা অস্বীকার করছো তা অবশ্যই আসবে। তোমাদের সমস্ত কৃতকর্ম তোমাদের সামনে পেশ করা হবে। প্রকৃতপক্ষে আমলনামা দেখার পূর্বেই তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই জানতে পারবে যে, সে পৃথিবীতে কি কি কাজ করে এসেছে। কেননা কোন মানুষই নিজের ব্যাপারে অজ্ঞ বা অনবহিত নয়। দুনিয়াকে প্রতারিত করার জন্য এবং নিজের বিবেককে ভুলানোর জন্য নিজের কাজকর্মও আচরণের পক্ষে যত যুক্তি, বাহানা ও ওযর সে পেশ করুক না কেন।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-১
لَاۤ اُقْسِمُ بِیَوْمِ الْقِیٰمَةِۙ
না, আমি শপথ করেছি কিয়ামতের দিনের।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# ‘না’ শব্দ দ্বারা বক্তব্য শুরু করাই প্রমাণ করে যে, আগে থেকেই কোন বিষয়ে আলোচনা চলছিল যার প্রতিবাদ করার জন্য এ সূরা নাযিল হয়েছে। পরবর্তী বক্তব্য স্বতঃই স্পষ্ট করে দেয় যে, আলোচনার বিষয় ছিল কিয়ামত ও আখেরাতের জীবন। আর মক্কার লোকেরা এটি শুধু অস্বীকারই করে আসছিলো না বরং অস্বীকৃতির সাথে সাথে তা নিয়ে ঠাট্রা-বিদ্রুপও করে আসছিলো। একটি উদাহরণ দ্বারা এ বর্ণনাভঙ্গী ভাল করে বুঝা যেতে পারে। আপনি যদি শুধু রসূলের সত্যতা অস্বীকার করতে চান তাহলে বলবেনঃ আল্লাহর কসম রসূল সত্য। “কিন্তু কিছু লোক যদি রসূলকে অস্বীকার করতে থাকে তবে তার উত্তরে আপনি কথা বলতে শুরু করবেন এভাবেঃ না, আল্লাহর কসম, রসূল সত্য। এর অর্থ হবে, তোমরা যা বলছো তা ঠিক নয়। আমি কসম করে বলছি, প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এটি।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২
وَ لَاۤ اُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِؕ
আর না, আমি শপথ করছি তিরস্কারকারী নফসের।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# কুরআন মজীদে মানুষের নফসের তিনটি রূপ উল্লেখ করা হয়েছে। এক, একটি ‘নফস’ মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে। এটির নাম ‘নফসে আম্মারা’ । দুই, একটি ‘নফস’ ভুল বা অন্যায় কাজ করলে অথবা ভুল বা অন্যায় বিষয়ে চিন্তা করলে কিংবা খারাপ নিয়ত রাখলে লজ্জিত হয় এবং সেজন্য মানুষকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করে। এটির নাম নফসে ‘লাউয়ামাহ’। আধুনিক পরিভাষায় একেই আমরা বিবেক বলে থাকি। তিন, যে নফসটি সঠিক পথে চললে এবং ভুল ও অন্যায়ের পথ পরিত্যাগ করলে তৃপ্তি ও প্রশান্তি অনুভব করে তাকে বলে ‘নফসে মুত্মাইন্নাহা’।
এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কি কারণে কিয়ামতের দিন এবং তিরস্কারকারী নফসের কসম করেছেন তা বর্ণনা করেননি। কারণ পরবর্তী আয়াতটি সে বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করছে। যে জন্য কসম করা হয়েছে তাহলো, মানুষের মরার পর আল্লাহ তা’আলা পুনরায় তাকে অবশ্যই সৃষ্টি করবেন। তা করতে তিনি পুরোপুরি সক্ষম। এখন প্রশ্ন হলো এ বিষয়টির জন্য এ দু’টি জিনিসের কসম করার পেছনে কি যৌক্তিকতা আছে?
কিয়ামতের দিনের কসম খাওয়ার কারণ হলো, কিয়ামতের আগমন নিশ্চিত ও অনিবার্য। গোটা বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনাই প্রমাণ করছে যে, এ ব্যবস্থাপনা অনাদী ও অন্তহীন নয়। এর বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে এটা চিরদিন ছিল না এবং চিরদিন থাকতে ও পারে না। মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি এ ভিত্তিহীন ধ্যান-ধারণার সপক্ষে ইতিপূর্বেও কোন মজবুত দলীল-প্রমাণ খুঁজে পায়নি যে, প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল এ পৃথিবী কখনো অনাদি ও অবিনশ্বর হতে পারে। কিন্তু এ পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে এ বিষয়টি তার কাছে ততই নিশ্চিত হতে থাকে যে, এ চাঞ্চল্য মুখর বিশ্ব-জাহানের একটি শুরু বা সূচনা বিন্দু আছে যার পূর্বে এটি ছিল না। আবার অনিবার্যরূপে এর একটি শেষও আছে যার পরে এটি আর থাকবে না। এ কারণে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে কিয়ামতেরই কসম করেছেন। এ কসমটির ধরন এরূপ যেমন আমরা অতিশয় সন্দেহবাদী কোন মানুষকে-যে তার আপন অস্তিত্ব সম্পর্কেও সন্দেহ করছে-সম্বোধন করে বলিঃ তোমার প্রাণ সত্তার কসম, তুমি তো বর্তমান। অর্থাৎ তোমার অস্তিত্বই সাক্ষী যে তুমি আছ।
কিয়ামতের দিনের কসম শুধু এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, একদিন বিশ্ব-জাহানের এ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর মানুষকে পুনরায় জীবিত করে উঠানো হবে। তাকে নিজের সমস্ত কাজের হিসেব দিতে হবে এবং সে নিজের কৃতকর্মের ভাল বা মন্দ ফলাফল দেখবে। এর জন্য পুনরায় ‘নফসের লাউয়ামাহ’ কসম করা হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যার মধ্যে বিবেক বলে কোন জিনিস নেই। এ বিবেকের মধ্যে অনিবার্যরূপে ভাল এবং মন্দের একটি অনুভূতি বিদ্যমান। মানুষ ভাল এবং মন্দ যাচাইয়ের যে মানদণ্ডই স্থির করে থাকুক না কেন এবং তা ভুল হোক বা নির্ভুল হোক, চরম অধঃপতিত ও বিভ্রান্ত মানুষের বিবেকও মন্দ কাজ করলে কিংবা ভাল কাজ না করলে তাকে তিরষ্কার করে। এটিই প্রমাণ করে যে, মানুষ নিছক একটি জীব নয়, বরং একটি নৈতিক সত্ত্বাও বটে। প্রকৃতিগতভাবেই তার মধ্যে ভাল এবং মন্দের উপলব্ধি বিদ্যমান। সে নিজেই ভাল এবং মন্দ কাজের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে। সে অন্যের সাথে যখন কোন খারাপ আচরণ করে তখন সে ব্যাপারে নিজের বিবেকের দংশনকে দমন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেও অন্য কেউ যখন তার সাথে একই আচরণ করে তখন আপনা থেকেই তার বিবেক দাবী করে যে, এ ধরনের আচরণকারীর শাস্তি হওয়া উচিত। এখন কথা হলো, মানুষের নিজ সত্তার মধ্যেই যদি এ ধরনের একটি “নফসে লাউয়ামাহ” বা তিরষ্কারকারী বিবেকের উপস্থিতি একটি অনস্বীকার্য সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এ সত্যটিও অনস্বীকার্য যে, এ “নফসে লাউয়ামা”ই মৃত্যুর পরের জীবনের এমন একটি প্রমাণ যা মানুষের আপন সত্তার মধ্যে বিদ্যমান। কেননা যেসব ভাল এবং মন্দ কাজের জন্য মানুষ দায়ী সেসব কাজের পুরস্কার বা শান্তি তার অবশ্যই পাওয়া উচিত। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবী। কিন্তু মৃত্যুর পরের জীবন ছাড়া আর কোনভাবেই তার এ দাবী পূরণ হতে পারে না। মৃত্যুর পরে মানুষের সত্তা যদি বিলীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে তার অনেক ভাল কাজের পুরস্কার থেকে সে নিশ্চিতরূপে বঞ্চিত থেকে যাবে। আবার এমন অনেক মন্দ কাজ আছে যার ন্যায্য শাস্তি থেকে সে অবশ্যই নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে। বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন কোন মানুষই এ সত্য অস্বীকার করতে পারে না। অযৌক্তিক একটি বিশ্বে বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ জন্মলাভ করে বসেছে এবং নৈতিক উপলব্ধি সম্পন্ন মানুষ এমন এ পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে বসেছে মৌলিকভাবে যার পুরা ব্যবস্থাপনায় নৈতিকতার কোন অস্তিত্বই নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ এ অর্থহীন ও অযৌক্তিক কথাটি স্বীকার না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে মৃত্যুর পরের জীবনকে অস্বীকার করতে পারে না। একইভাবে পুনর্জন্ম বা জন্মান্তরবাদী দর্শন প্রকৃতির এ দাবীর যথার্থ জবাব নয়। কারণ মানুষ যদি নিজের নৈতিক কাজ-কর্মের পুরস্কার ব শাস্তি লাভের জন্য একের পর এক এ কাজ-কর্ম করতে থাকবে যা নতুন করে পুরস্কার বা শাস্তি দাবী করবে। আর এ অন্তহীন ধারাবাহিকতার ঘুর্ণিপাকে পরে তার হিসেব-নিকেশের কোন ফয়সালা হবে না। বরং তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। সুতরাং প্রকৃতির এ দাবী কেবল একটি অবস্থায়ই পূরণ হতে পারে। তাহলো, এ পৃথিবীতে মানুষের একটি মাত্র জীবন হবে এবং গোটা মানব জাতির আগমনের ধারা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আরেকটি জীবন হবে সে জীবনে মানুষের সমস্ত কাজকর্ম যথাযথভাবে হিসেব-নিকেশ করে তাকে তার প্রাপ্য পুরো পুরস্কার বা শস্তি দেয়া হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, আল আরাফ, টীকা ৩০)।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৩
اَیَحْسَبُ الْاِنْسَانُ اَلَّنْ نَّجْمَعَ عِظَامَهٗؕ
মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার হাড়সমূহ একত্র করতে পারবো না?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# কসম আকারে ওপরে বর্ণিত দু’টি দলীল শুধু দু’টি বিষয় প্রমাণ করে। এক, এ দুনিয়ার পরিসমাপ্তি (অর্থাৎ কিয়ামদের প্রথম পর্যায়) একটি নিশ্চিত ও অনিবার্য ব্যাপার। দুই, মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ তা ছাড়া মানুষের একটি নৈতিক সত্তা হওয়ার যৌক্তিক ও প্রকৃতিগত দাবী পুরণ হতে পারে না। আর এ ব্যাপারটি অবশ্যই সংঘটিত হবে। মানুষের মধ্যে বিবেক থাকাটাই তা প্রমাণ করে। মৃত্যুর পরের জীবন যে সম্ভব একথা প্রমাণ করার জন্যই এ তৃতীয় দলীলটি পেশ করা হয়েছে। মক্কার যেসব লোক মৃত্যুর পরের জীবনকে অস্বীকার করতো তারা বার বার একথা বলতো যে, যেসব লোকেরা মৃত্যুর পর হাজার হাজার বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, যাদের দেহের প্রতিটি অণূ-পরমাণু মাটিতে মিশে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, যাদের হাড়গোড় পচে গলে পৃথিবীর কত জায়গায় যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে তার কোন হদিস নেই, যাদের কেউ মরেছে আগুনে পুড়ে, কেউ হিংস্র জন্তুর আহারে পরিণত হয়েছে। আবার কেউ সমুদ্রে ডুবে মাছের খোরাক হয়েছে। তাদের সবার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আবার একত্র হবে এবং প্রতিটি মানুষ আবার হুবহু সে মানুষটি হয়ে জীবনলাভ করবে, যে মানুষটি দশ-বিশ হাজার কোন এক সময় ছিল, এটা কি করে সম্ভব? মক্কার লোকদের এসব কথার জবাব আল্লাহ তা’আলা একটি ছোট প্রশ্নের আকারে অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ও বলিষ্ঠভাবে দিয়েছেন। তিনি বলছেনঃ “মানুষ কি মনে করেছে যে, আমি তার হাড়গোড় আদৌ একত্রিত করতে পারবো ন”? অর্থাৎ যদি তোমাদেরকে বলা হতো, তোমাদের দেহের বিক্ষিপ্ত এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোন এক সময় আপনা থেকেই একত্রিত হয়ে যাবে এবং তোমরাও আপনি থেকেই হুবুহু এই দেহ নিয়েই জীবিত হয়ে যাবে তাহলে এরূপ হওয়াটিকে অসম্ভব মনে করা তোমাদের নিঃসন্দেহে যুক্তিসঙ্গত হতো। কিন্তু তোমাদের তো বলা হয়েছে এ কাজটি আপনা থেকেই হবে না। বরং তা করবেন আল্লাহ তা’আলা নিজে। তাহলে কি তোমরা প্রকৃতপক্ষেই মনে করো যে, সারা বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা-যাকে তোমরা নিজেরাও সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করে থাকো-এ কাজ করতে অক্ষম? এটা এমন একটি প্রশ্ন যে, যারা আল্লাহ তা’আলাকে বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা বলে স্বীকার করে, সে যুগেও তারা বলতে পারতো না এবং বর্তমান যুগেও বলতে পারে না। যে, আল্লাহ তা’আলা নিজেও এ কাজ করতে চাইলে করতে পারবেন না। আর কোন নির্বোধ যদি এমন কথা বলেও ফেলে তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে যে, তুমি আজ যে দেহের অধিকারী তার অসংখ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বাতাস, পানি, মাটি এবং অজ্ঞাত আরো কত জায়গা থেকে এনে একত্রিত করে সে আল্লাহ এ দেহটি কিভাবে তৈরী করলেন যার সম্পর্কে তুমি বলছো যে, তিনি পুনরায় এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একত্রিত করতে সক্ষম নন?
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৪
بَلٰى قٰدِرِیْنَ عَلٰۤى اَنْ نُّسَوِّیَ بَنَانَهٗ
কেন পারবো না? আমি তো তার আংগুলের জোড়গুলো পর্যন্ত ঠিকমত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ বড় বড় হাড়গুলো একত্রিত করে পুনরায় তোমার দেহের কাঠামো প্রস্তুত করা এমন কিছুই নয়। আমি তা তোমার দেহের সূক্ষ্মতম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি তোমার আঙ্গুলের জোড়াগুলোও পুনরায় ঠিক তেমন করে বানাতে সক্ষম যেমন তা এর আগে ছিল।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৫
بَلْ یُرِیْدُ الْاِنْسَانُ لِیَفْجُرَ اَمَامَهٗۚ
কিন্তু মানুষ ভবিষ্যতেও কুকর্ম করতে চায়।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এ ছোট বাক্যটিতে আখেরাত অবিশ্বাসকারীদের আসল রোগ কি তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। যেসব জিনিস এসব লোককে আখেরাত অস্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করতো তা মূলত এ নয় যে, প্রকৃতই তারা কিয়ামত ও আখেরাতকে অসম্ভব মনে করতো। বরং তারা যে কিয়ামত ও আখেরাতকে অস্বীকার করে তার মূল কারণ হলো, আখেরাতকে মেনে নিলে তাদের ওপর অনিবার্যভাবে কিছু নৈতিক বাধ্যবাধকতা আরোপিত হয়। সে বাধ্যবাধকতা মেনে নেয়া তাদের কাছে মোটেই মনঃপূত নয়। তারা চায় আজ পর্যন্ত তারা পৃথিবীতে যেরূপ লাগামহীন জীবন যাপন করে এসেছে ভবিষ্যতেও ঠিক তেমনি করতে পারে। আজ পর্যন্ত তারা যে ধরনের জুলুম-আত্যাচার, বেঈমানী, পাপাচার ও দুষ্কর্ম করে এসেছে ভবিষ্যতেও তা করার অবাধ স্বাধীনতা যেন তাদের থাকে। একদিন তাদেরকে আল্লাহর বিচারালয়ে দাঁড়িয়ে এসব কাজের জবাবদিহি করতে হবে এ বিশ্বাস যেন তাদের অবৈধ লাগামহীন স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পথ রোধ করতে না পারে। তাই প্রকৃতপক্ষে তাদের বিবেক-বুদ্ধি তাদেরকে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনতে বাধা দিচ্ছে না। বরং তাদের প্রবৃত্তির কামনা বাসনাই এ পথের প্রতিবন্ধক।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৬
یَسْئَلُ اَیَّانَ یَوْمُ الْقِیٰمَةِؕ
সে জিজ্ঞেস করে, কবে আসবে কিয়ামতের সেদিন?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এ প্রশ্ন প্রকৃতপক্ষে জানার জন্য নয়। বরং তা অস্বীকৃতিমূলক ও বিদ্রূপাত্মক প্রশ্ন অর্থাৎ কিয়ামত কবে আসবে তা জানতে চায়নি তারা। বরং তারা একথা বলেছিলো বিদ্রূপ করে যে, জনাব আপনি যে দিনটির আসার খবর দিচ্ছেন তা আসার পথে আবার কোথায় আটকে রইলো?
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৭
فَاِذَا بَرِقَ الْبَصَرُۙ
অতঃপর চক্ষু যখন স্থির হয়ে যাবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মূল আয়াতে برق البصر শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হলো বিদ্যুতের ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া। কিন্তু প্রচলিত আরবী বাক রীতিতে একথাটি শুধু এ একটি অর্থ জ্ঞাপনই নয়। বরং ভীতি-বিহবলতা, বিস্ময় অথবা কোন দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় যদি কেউ হতবুদ্ধি হয়ে যায় এবং সে ভীতিকর দৃশ্যের প্রতি তার চক্ষু স্থির-নিবদ্ধ হয়ে যায় যা সে দেখতে পাচ্ছে তাহলে এ অবস্থা বুঝাতেও একথাটি বলা হয়ে থাকে। একথাটিই কুরআন মজিদের আরেক জায়গায় এভাবে বলা হয়েছেঃ إِنَّمَا يُؤَخِّرُهُمْ لِيَوْمٍ تَشْخَصُ فِيهِ الْأَبْصَارُ “আল্লাহ্ তো তাদের অবকাশ দিচ্ছেন সেদিন পর্যন্ত যখন চক্ষুসমূহ স্থির হয়ে যাবে। “( সূরা ইবরাহীম, ৪২ )।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৯
وَ جُمِعَ الشَّمْسُ وَ الْقَمَرُۙ
এবং চাঁদ ও সূর্যকে একত্র করে একাকার করে দেয়া হবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটা কিয়ামতের প্রথম পর্যায়ে বিশ্ব-জাহানের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ। চাঁদের আলেহীন হয়ে যাওয়া এবং চাঁদ ও সূর্যের পরস্পর একাকার হয়ে যাওয়ার অর্থ এও হতে পারে যে, সূর্য থেকে প্রাপ্ত চাঁদের আলোই শুধু ফুরিয়ে যাবে না। বরং সূর্য নিজেও অন্ধকার হয়ে যাবে এবং আলোহীন হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উভয়ের অবস্থা হবে একই। দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, হঠাৎ পৃথিবী উল্টা দিকে চলতে শুরু করবে এবং সেদিন চাঁদ ও সূর্য একই সাথে পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। এর তৃতীয় আরেকটি অর্থ এও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, চাঁদ অকস্মাৎ পৃথিবীর মহাকর্ষ থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে যাবে এবং সূর্যের ওপরে গিয়ে আছরে পড়বে। এছাড়া এর আরো কোন অর্থ হতে পারে যা বর্তমানে আমাদের বোধগম্য নয়।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-১৩
یُنَبَّؤُا الْاِنْسَانُ یَوْمَئِذٍۭ بِمَا قَدَّمَ وَ اَخَّرَؕ
সেদিন মানুষকে তার আগের ও পরের কৃতকর্মসমূহ জানিয়ে দেয়া হবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মূল বাক্যটি হলো بِمَا قَدَّمَ وَاَخَّرَ । এটা একটা ব্যাপক অর্থব্যঞ্জক বাক্য। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে এবং সম্ভবত সবগুলোই এখানে প্রযোজ্য। এর একটি অর্থ হলো দুনিয়ার জীবন মানুষ মৃত্যুর পূর্বে কি কি নেক কাজ বা বদ কাজ করে আখেরাতের জন্য অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছিল সেদিন তাকে তা জানিয়ে দেয়া হবে। আর দুনিয়াতে সে নিজের ভাল এবং মন্দ কাজের কি ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে এসেছিল যা তার দুনিয়া ছেড়ে চলে আসার পরও পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত চলেছিল সে হিসেবেও তার সামনে পেশ করা হবে। দ্বিতীয় অর্থ হলো। তার যা কিছু করা উচিত ছিল অথচ সে তা করেনি আর যা কিছু করা উচিত ছিল না অথচ সে তা করেছে তাও সব তাকে জানিয়ে দেয়া হবে। তৃতীয় অর্থ হলো, যেসব কাজ সে আগে করেছে এবং যেসব কাজ সে পরে করেছে দিন তারিখ সহ তার পুরো হিসেব তার সামনে পেশ করা হবে। চতূর্থ অর্থ হলো, যেসব ভাল বা মন্দ কাজ সে করেছে তাও তাকে জানিয়ে দেয়া হবে। আর যেসব ভাল বা মন্দ কাজ করা থেকে সে বিরত থেকেছে তাও তাকে অবহিত করা হবে।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-১৫
وَّ لَوْ اَلْقٰى مَعَاذِیْرَهٗؕ
সে যতই অজুহাত পেশ করুক না কেন।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মানুষের সামনে তারা আমলনামা পেশ করার উদ্দেশ্য আসলে অপরাধীকে তার অপরাধ সম্পর্কে অবহিত করা নয়। বরং এরূপ করা জরুরী এই কারণে যে, প্রকাশ্য আদালতে অপরাধের প্রমাণ পেশ করা ছাড়া ইনসাফের দাবী পূরণ হয় না। প্রত্যেক মানুষই জানে, সে নিজে কি? সে কি, একথা তাকে অন্য কারো বলে দিতে হয় না। একজন মিথ্যাবাদী গোটা দুনিয়াকে ধোঁকা দিতে পারে। কিন্তু সে নিজে একথা জানে যে, সে যা বলছে ত মিথ্যা। একজন চোর তার চৌর্যবৃত্তিকে ঢাকার জন্য অসংখ্য কৌশল অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু সে যে চোর তা তার নিজের কাছে গোপন থাকে না। একজন পথভ্রষ্ট লোক হাজারো প্রমাণ পেশ করে মানুষকে একথা বিশ্বাস করাতে পারে যে, সে যে কুফরী, নাস্তিকতা ও শিরকের সামর্থ্যক তা তার মনের বিশ্বাসভিত্তিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তার নিজের বিবেক একথা ভাল করেই জানে যে, সে ঐসব আকীদা-বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে আছে কেন এবং মধ্যকার ভুল বুঝতে ও মেনে নিতে কিসে তাকে বাধা দিচ্ছে? জালেম, অসচ্চরিত্র, দৃষ্কর্মশীল এবং হারামখোর মানুষ নিজের অপকর্মের পক্ষে নানা রকম ওজর-আপত্তি ও কৌশল পেশ করে নিজের বিবেকের মুখ পর্যন্ত বন্ধ করার চেষ্টা চালাতে পারে যাতে বিবেক তাকে তিরষ্কার করা থেকে বিরত থাকে এবং স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, সত্যিকারভাবেই কিছু বাধ্যবাধকতা, কিছু বৃহত্তর কল্যাণ এবং কিছু অনিবার্য প্রয়োজনে সে এসব করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সর্বাবস্থায় তার এটা জানা থাকে যে, সে কার প্রতি কতটা জুলুম করেছে, কার হক মেরে খেয়েছে, কার সতীত্ব নষ্ট করেছে, কাকে প্রতারণা করেছে এবং কোন অবৈধ পন্থায় কি কি স্বার্থ উদ্ধার করেছে। তাই আখেরাতের আদালতে হাজির করার সময় প্রত্যেক কাফের, মুনাফিক, পাপী ও অপরাধী নিজেই বুঝতে পারবে যে, সে কি কাজ করে এসেছে এবং কোন অবস্থায় নিজ প্রভুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-১৬
لَا تُحَرِّكْ بِهٖ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهٖؕ
হে নবী, এ অহীকে দ্রুত আয়ত্ত করার জন্য তোমার জিহবা দ্রুত সঞ্চালন করো না।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:-
# এখান থেকে শুরু করে “এর অর্থ বুঝিয়ে দেয়াও আমার দায়িত্ব” কথাটি পর্যন্ত পুরা বাক্যটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গের বাক্য, যা মূল কথার ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে। আমরা সূরার ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছি যে, নবুয়তের প্রাথমিক যুগে-যে সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অহী গ্রহণ করার অভ্যাস পুরোপুরি রপ্ত হয়নি-যখন তাঁর ওপর অহী নাযিল হতো তখন তিনিআশঙ্কা করতেন যে আল্লাহর বাণী জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাঁকে শুনাচ্ছেন তা হয়তো তিনি ঠিকমত স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারবেননা। তাই অহী শোনার সাথে সাথে তিনি তা মুখস্থ করার চেষ্টা করতেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম যখন সূরা কিয়ামাহর এ আয়াতগুলো তাঁকে শুনাচ্ছিলেন তখনও ঠিক একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাই কথার ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে তাঁকে বলা হয় যে, আপনি অহীর কথা মুখস্থ করার চেষ্টা করবেন না, বরং গভীর মনযোগ সহকারে তা শুনতে থাকুন। তা স্মরণ করানো এবং পরবর্তী সময়ে আপনাকে তা পড়িয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। আপনি নিশ্চিত থাকুন, এ বাণীর একটি শব্দও আপনি ভুলবেন না এবং তা উচ্চারণ করা বা পড়ার ব্যাপারে আপনার কোন ভুল হবে না। এ নির্দেশনামা দেয়ার পর পুনরায় মূল কথার ধারাবাহিকতা “কখনো না, আসল কথা হলো” কথাটি দ্বারা শুরু হয়েছে। যারা এ পটভূমি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নয় তারা এখানে এ বাক্যাংশ দেখে মনে করে যে, এখানে একথাটি একেবারেই খাপ ছাড়া। কিন্তুএ পটভূমি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর কথার মধ্যে কোন অসংলগ্নতা আছে বলে মনে হয় না। এর উদাহরণ এভাবে দেয়া যায়, একজন শিক্ষক পাঠদানের সময় হঠাৎ দেখলেন যে, তাঁর ছাত্রের মন অন্য কোন দিকে আকৃষ্ট। তাই তিনি পাঠ দানের ধারাবাহিকতা ছিন্ন করে বললেনঃ “আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন।” এরপর তিনি পুনরায় নিজের কথা শুরু করলেন। এ পাঠ দান যদি হুবহু ছাপিয়ে প্রকাশ করা হয় তাহলে যেসব লোক এ ঘটনা সম্পর্কে ওয়াফিহাল নন তারা বক্তৃতার ধারাবাহিকতার মধ্যে একথাটিকে খাপছাড়া মনে করবেন। কিন্তু যে কারণে একথাটি বাক্যের মধ্যে সংযোজিত হয়েছে যে ব্যক্তি সে আসল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকবেন তিনি নিশ্চিত হয়ে যাবেন যে, পাঠ দানের বক্তব্যটি আসলে হুবহু উদ্ধৃত করা হয়েছে। তা বর্ণনা বা উদ্ধৃত করতে কোন প্রকার কমবেশী করা হয়নি। এসব আয়াতের মাঝখানে এ বাক্যাংশটির অপ্রাসঙ্গিকভাবে আনারও যে কারণ আমরা ওপরে বিশ্লেষণ করেছি তা শুধু অনুমান নির্ভর নয়। বরং নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতসমূহে তার এ একই কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে জারীর, তাবরানী, বায়হাকী এবং অন্যসব মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন সনদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন যে, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কুরআন নাযিল হতো তখন পাছে তিনি ভুলে যান এ ভয়ে জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সাথে কথাগুলো বার বার আওড়াতে থাকতেন। তাই বলা হয়েছেلَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ……………….. শাবী, ইবনে যায়েদ, দ্বাহ্হাক, হাসান বাসরী, কাতাদা, মুজাহিদ এবং আরো অনেক বড় বড় মুফাস্সির থেকেও একথাটিই উদ্ধৃত হয়েছে।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-১৮
فَاِذَا قَرَاْنٰهُ فَاتَّبِعْ قُرْاٰنَهٗۚ
তাই আমি যখন তা পড়ি তখন এর পড়া মনযোগ দিয়ে শুনবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# জিবরাঈল আলাইহিস সালাম যদিও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরআন পাঠ করে শুনাতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজের পক্ষ থেকে তা শুনাতেননা, বরং আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে পড়ে শুনাতেন। তাই একথাটিও আল্লাহ তা’আলাই বলেছেনঃ “যখন আমি তা পাঠ করতে থাকবো। “
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-১৯
ثُمَّ اِنَّ عَلَیْنَا بَیَانَهٗؕ
অতঃপর এর অর্থ বুঝিয়ে দেয়াও আমার দায়িত্ব।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এ থেকে ধারণা জন্মে যে, সম্ভবত নবুওয়াতের প্রাথমিক যুগেই অহী নাযিল হওয়ার সময় রসূলুল্লাহ ﷺ কুরআনের কোন আয়াত অথবা কোন শব্দ অথবা কোন বিষয়ের অর্থ জিবরাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতেন। তাই তাঁকে শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়নি যে, যখন অহী নাযিল হতে থাকবে তখন নিরবে তিনি তা শুনতেন, কিংবা শুধু এ নিশ্চয়তা ও সন্ত্বনাই দেয়া হয়নি যে, অহীর প্রতিটি শব্দ তাঁর স্মৃতিতে অবিকল সংরক্ষিত করে দেয়া হবে এবং কুরআনকে তিনি ঠিক সেভাবে পাঠ করতে সক্ষম হবেন যেভাবে তা নাযিল হয়েছে। বরং সাথে সাথে তাঁকে প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলার প্রতিটি নির্দেশ ও বাণীর মর্ম এবং উদ্দেশ্যও তাঁকে পুরোপুরি বুঝিয়ে দেয়া হবে।
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত। এ আয়াত দ্বারা এমন কয়েকটি মৌলিক বিষয় প্রমাণিত হয়, যা কোন ব্যক্তি ভালভাবে বুঝে নিলে এমন কিছু গোমরাহী থেকে রক্ষা পেতে পারে যা ইতিপূর্বেও কিছুলোক ছড়িয়েছে এবং বর্তমানেও ছড়াচ্ছে।
প্রথমত, এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শুধু কুরআনে লিপিবদ্ধ অহী-ই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল হতো না। বরং এ অহী ছাড়াও তাঁর প্রতি আরো অহী নাযিল হতো এবং সে অহীর মাধ্যমে তাঁকে এমন জ্ঞান দেয়া হতো যা কুরআনে লিপিবদ্ধ নেই। তাই কুরআনের হুকুম-আহকাম ও নির্দেশাবলী, তার ইঙ্গিত, তার শব্দমালা এবং তার বিশেষ পরিভাষার যে অর্থ ও মর্ম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হতো তা যদি কুরআনের মধ্যেই সংযোজিত থাকবে তাহলে একথা বলার কোন প্রয়োজনই ছিল না, যে তার অর্থ বুঝিয়ে দেয়া বা তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেয়া আমারই দায়িত্ব। কারণ এমতাবস্থায় তা আবার কুরআনের মধ্যেই পাওয়া যেতো। অতএব, একথা মানতে হবে যে, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআনের শব্দমালা বহির্ভূত অন্য কিছু। এটা “অহীয়ে খফীর” আরো একটি প্রমাণ যা খোদ কুরআন থেকেই পাওয়া যায়। (কুরআন মজীদ থেকে এর আরো প্রমাণ আমি আমার “সুন্নাত কি আইনী হাইসিয়াত” গ্রন্থের ৯৪-৯৫ এবং ১১৮ থেকে ১২৫ পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছি।)
দ্বিতীয়ত, আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুরআনের অর্থ ও মর্ম এবং হুকুম-আহকামের যে ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল তা তো এ জন্যই দেয়া হয়েছিল যে, তিনি তদনুযায়ী নিজের কথা ও কাজ দ্বারা মানুষকে কুরআন বুঝিয়ে দেবেন এবং তার আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী কাজ করা শেখাবেন। একথার মর্ম ও অর্থ যদি তা না হয় এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যদি শুধু এ জন্য এ ব্যাখ্যা বলে দেয়া হয়ে থাকে যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিজের কাছেই সে জ্ঞান সীমাবদ্ধ রাখবেন তাহলে এটা হতো একটা অর্থহীন কাজ। কারণ, নুওয়াতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে তা থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যেতো না। সুতরাং কোন নির্বোধই কেবল একথা বলতে পারে যে, ব্যাখ্যামূলক এ জ্ঞানের শরীয়াতের বিধান রচনার ক্ষেত্রে আদৌ কোন ভূমিকা ছিল না। সূরা “ নাহলের ৪৪ আয় াতে আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলেছেনঃ
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
“হে নবী, আমি তোমার কাছে এ “যিকির “নাযিল করেছি, এ জন্য যেন তুমি মানুষের জন্য নাযিলকৃত শিক্ষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাকো। ” (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নাহল টীকা ৪০)
কুরআন মজীদের চারটি স্থানে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ শুধু আল্লাহর কিতাবের আয়াতসমূহ শুনিয়ে দেয়াই ছিল না। বরং এ কিতাবের শিক্ষা দেয়াও ছিল তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। (আল বাকারাহ, আয়াত ১২৯ ও ১৫১ ; আলে ইমরান, ১৬৪ এবং আল জুম’আ, ২ । আমি “কি আইনী হাইসিয়াত, গ্রন্থের ৭৪ থেকে ৭৭ পৃষ্ঠায় এসব আয়াতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি।) এরপর কোন মানুষ কি করে একথা অস্বীকার করতে পারে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে কুরআনের যে, ব্যাখ্যা পেশ করেছেন তা-ই প্রকৃতপক্ষে কুরআনের সঠিক নির্ভরযোগ্য ও সরকারী ব্যাখ্যা। কেননা, তা তাঁর নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা নয় বরং কুরআন নাযিলকারী আল্লাহর বলে দেয়া ব্যাখ্যা। এ ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে কিংবা তা পাশ কাটিয়ে যে ব্যক্তিই কুরআনের কোন আয়াতের অথবা কোন শব্দের মনগড়া অর্থ বর্ণনা করে সে এমন ধৃষ্টতা দেখায় যা কোন ঈমানদার ব্যক্তি দেখাতে পারে না।
তৃতীয়ত, কেউ যদি সাধারণভাবেও কুরআন অধ্যয়ন করে থাকে তাহলেও সে দেখবে যে, তাতে এমন অনেক বিষয় আছে একজন আরবী জানা লোক শুধু কুরআনের শব্দ বা বাক্য পড়ে তার অর্থ বা মর্ম উদ্ধার করতে এবং তার মধ্যে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা কিভাবে মেনে চলবে তা জানতে পারবে না। উদাহরণ হিসেবে صلواة (সালাত) শব্দটির কথাই ধরুন। কুরআন মজীদে যদি ঈমানের পরে অন্য কোন আমলের ওপরে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে তবে তা হলো সালাত বা নামায। কিন্তু কেবল আরবী ভাষার সাহায্য কেউ এর অর্থ পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারতো না। কুরআন মজীদে এ শব্দটির বার বার উল্লেখ দেখে কেউ বড় জোর এতটুকু বুঝতে সক্ষম যে, আরবী ভাষার এ শব্দটিকে কোন বিশেষ পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এর অর্থ সম্ভবত এমন কোন বিশেষ কাজ যা আঞ্জাম দেয়ার জন্য ঈমানদারদের কাছে দাবী জানানো হচ্ছে। কিন্তু শুধু কুরআন পাঠ করে কোন আরবী জানা লোক এ সিদ্ধান্ত পৌঁছতে সক্ষম হবে না যে, সে বিশেষ কাজটি কি এবং কিভাবে তা আঞ্জাম দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, কুরআন প্রেরণকারী যদি তাঁর পক্ষ থেকে একজন শিক্ষক নিয়োগ করে এ পারিভাষিক অর্থ তাঁকে যথাযথভাবে না বলে দিতেন এবং সালাত “আদায় করার নির্দেশ পালনের পন্থা-পদ্ধতি স্পষ্টভাবে তাঁকে না শেখাতেন তাহলে দুনিয়াতে দু’জন মুসলমানও এমন পাওয়া যেতো না যারা শুধু কুরআন পাঠ করে করে “সালাত” আদায় করার নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে কোন একটি পন্থা মেনে নিতে একমত হতে পারতো? দেড় হাজার বছর ধরে মুসলমানরা যে পুরুষাণুক্রমে একই নিয়ম ও পন্থায় নামায পড়ে আসছে এবং দুনিয়ার আনাচে-কানাচে কোটি কোটি মুসলমান একই নিয়ম-পন্থায় যেভাবে নামাযের হুকুম পালন করছে তার কারণ তো শুধু এই যে, ঐ সব শব্দ এবং বাক্যের অর্থ এবং মর্মও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পুরোপুরি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর যারা তাঁকে আল্লাহর রসূল এবং কুরআনকে আল্লাহর কিতাব হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন তিনি সেসব লোককেই এর অর্থ ও মর্ম শিক্ষা দিয়েছিলেন।
চতুর্থত, কুরআনের শব্দসমূহে যে ব্যাখ্যা আল্লাহ তা’আলা তাঁর রসূলকে ﷺ বুঝিয়েছেন এবং রসূল ﷺ তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে উম্মতকে যে শিক্ষা দিয়েছেন, হাদীস এবং সুন্নাত ছাড়া তা জানার আর কোন উপায় আমাদের কাছে নেই। হাদীস বলতে বুঝায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা ও কাজ সম্পর্কে যেসব বর্ণনা সনদসহ তৎকালীন লোকদের নিকট থেকে আমাদের কালের লোকদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। আর সুন্নাত বলতে বুঝায় সেসব নিয়ম-কানুন কে যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৌখিক ও বাস্তব শিক্ষার দ্বারা মুসলিম সমাজের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে চালু হয়েছে, যার বিস্তারিত বিবরণ নির্ভরযোগ্য ও রেওয়ায়াতের মাধ্যমে পূর্ববর্তী লোকদের নিকট থেকে পরবর্তী লোকেরা লাভ করেছে এবং পরবর্তী যুগের লোকরা পূর্ববর্তী যুগের লোকদের মধ্যে তা কার্যকর হতে দেখেছে। জ্ঞানের এ উৎসকে যে ব্যক্তি অস্বীকার করে প্রকারান্তরে সে যেন একথাই বলে ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ বলে আল্লাহ তা’আলা তাঁর রসূলকে ﷺ কুরআনের অর্থ ও মর্ম বুঝিয়ে দেয়ার যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তা পূরণ করতে (না’উযুবিল্লাহ) তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, শুধু রসূলকে ব্যক্তিগতভাবে কুরআনের অর্থ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এ দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়েছিল না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল রসূলের মাধ্যমে উম্মাতকে আল্লাহর কিতাবের অর্থ বুঝানো। হাদীস ও সুন্নাত আইনের উৎস একথা অস্বীকার করলে আপনা থেকেই তার অনিবার্য অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ তা’আলা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। না’উযুবিল্লাহ! এর জবাবে যারা বলে যে, অনেক লোক তো মিথ্যা হাদীস রচনা করেছিল, তাকে আমরা বলবো, মিথ্যা, হাদীস রচনা করাই সর্বোপেক্ষা বড় প্রমাণ যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে গোটা মুসলিম উম্মাহ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা ও কাজকে আইনের মর্যাদা দান করতো। তা না হলে গোমরাহীর বিস্তারকারীদের মিথ্যা হাদীস রচনার প্রয়োজন হবে কেন? মুদ্রা জালকারীরা কেবল সে মুদ্রাই জাল করে যা বাজারে চালু থাকে। বাজারে যেসব নোটের কোন মূল্য নেই কে এমন নির্বোধ আছে যে, সেসব নোট জাল করে ছাপাবে? তাছাড়াও এ ধরনের কথা যারা বলে তারা হয়তো জানে না যে, যে পবিত্র সত্তার ﷺ কথা ও কাজ আইনের মর্যাদা সম্পন্ন তাঁর সাথে যাতে কোন মিথ্যা কথাসম্পর্কিত হতে না পারে প্রথম দিন থেকেই মুসলিম উম্মাহ গুরুত্বসহ সে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এ পবিত্র সত্তার ﷺ প্রতি কোন মিথ্যা কথা আরোপেরআশঙ্কা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছিল এ উম্মতের কল্যাণকামীরা তত অধিক মাত্রায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন সত্য ও মিথ্যাকে আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য। সত্যও মিথ্যা হাদীস পৃথকীকরণের এ জ্ঞান এমন একটি অত্যুচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান যা একমাত্র মুসলিম জাতি ছাড়া আজ পর্যন্ত পৃথিবীর আর কেউ আবিষ্কার করেনি। যারা এ জ্ঞান অর্জন না করেই শুধু মাত্র পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদদের প্রতারণা ও প্রলোভনের শিকার হয়ে হাদীস ও সুন্নাতকে অনির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করে এবং একথাও জানে না যে, তারা তাদের এ মূর্খতা নির্ভর ধৃষ্টতা দ্বারা ইসলামের কত মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে। তারা আসলেই বড় হতভাগা।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২০
كَلَّا بَلْ تُحِبُّوْنَ الْعَاجِلَةَۙ
কখ্খনো না আসল কথা হলো, তোমরা দ্রুত লাভ করা যায় এমন জিনিসকেই (অর্থাৎ দুনিয়া) ভালবাস
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মাঝের অপ্রাসঙ্গিক কথাটির আগে বক্তব্যের যে ধারাবাহিকতা ছিল এখানে এসে আবার সে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে। কখখনো না, অর্থ হলো, তোমাদের আখেরাতকে অস্বীকার করার আসল কারণ এটা নয় যে, বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা কিয়ামত সংঘটিত করতে কিংবা মৃত্যুর পর তোমাদেরকে আবার জীবিত করতে পারবেন না বলে তোমরা মনে করো বরং আসল কারণ হলো এটি।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২১
وَ تَذَرُوْنَ الْاٰخِرَةَؕ
এবং আখেরাতকে উপেক্ষা করে থাকো।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটি আখেরাতকে অস্বীকার করার দ্বিতীয় কারণ। প্রথম কারণটি ৫ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছিল। কারণটি হলো, মানুষ যেহেতু অবাধে পাপাচার চালাতে চায় এবং আখেরাতকে মেনে নিলে অনিবার্যরূপে যেসব নৈতিক বিধিবন্ধন মেনে চলার দায়িত্ব বর্তায় তা থেকে বাঁচতে চায়। তাই তার কুপ্রবৃত্তি তাকে আখেরাতকে অস্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার এ অস্বীকৃতিকে যুক্তিসঙ্গত বলে প্রমাণ করার জন্য সে সুন্দর করে সাজিয়ে যৌক্তিক প্রমাণাদি পেশ করে। এখন দ্বিতীয়, কারণটি বর্ণনা করা হচ্ছে। আখেরাত অস্বীকারকারীরা যেহেতু সংকীর্নমনা ও স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন হয় তাই তাদের দৃষ্টি কেবল এ দুনিয়ার ফলাফলের প্রতি নিবদ্ধ থাকে। আর আখেরাতে যে ফলাফলের প্রকাশ ঘটবে তাকে তারা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয় না। তারা মনে করে, যে স্বার্থ বা ভোগের উপকরণ বা আনন্দ এখানে লাভ করা সম্ভব তারই অন্বেষণে সবটুকু পরিশ্রম করা এবং প্রচেষ্টা চালানো উচিত। কারণ, তা যদি তারা লাভ করে তাহলে যেন সবকিছুই তারা পেয়ে গেল। এতে আখেরাতে তাদের পরিণাম যত খারাপই হোক না কেন। একইভাবে তারা এ ধারণাও পোষণ করে যে, যে ক্ষতি, কষ্ট বা দুঃখ-বেদনা এখানে হবে তা থেকে মূলত নিজেদের রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেখার দরকার নেই যে, তা বরদাশত করে নিলে আখেরাতে তার বিনিময়ে কত বড় পুরস্কার লাভ করা যাবে। তারা চায় নগদ সওদা। আখেরাতের মত বহু দূরের জিনিসের জন্য তারা আজকের কোন স্বার্থ যেমন ছাড়তে চায় না তেমনি কোন ক্ষতিও বরদাশত করতে পারে না। এ ধরনের চিন্তাধারা নিয়ে যখন তারা আখেরাত সম্পর্কে যৌক্তিক বিতর্কে অবতীর্ণ হয় তখন আর তা খাঁটি যুক্তিবাদ থাকে না। বরং তখন তার পেছনে এ ধ্যান-ধারণাটিই কাজ করতে থাকে। আর সে কারণে সর্বাবস্থায় তার সিদ্ধান্ত এটাই থাকে যে, আখেরাতকে মানা যাবে না। যদিও ভেতর থেকে বিবেক চিৎকার করে বলতে থাকে যে, আখেরাত সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা এবং তার অনিবা উচ্চর্যতা সম্পর্কে কুরআন যেসব দলীল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত আর তার বিপক্ষে যেসব যুক্তি তারা দেখাচ্ছে তা অত্যন্ত ভোঁতা ও অন্তসারশূন্য।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২২
وُجُوْهٌ یَّوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌۙ
সেদিন কিছু সংখ্যক চেহারা তরতাজা থাকবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ খুশীতে তারা দীপ্তিময় হয়ে উঠবে। কারণ, তারা যে আখেরাতের প্রতি ঈমান এনেছিল তা হুবহু তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী চোখের সামনে বিদ্যমান থাকবে। যে আখেরাতের প্রতি ঈমান আনার কারণে তারা দুনিয়ার যাবতীয় অবৈধ স্বার্থ পরিত্যাগ করেছিল এবং সত্যিকার অর্থেই ক্ষতি স্বীকার করেছিল তা চোখের সামনে বাস্তবে সংঘটিত হতে দেখে নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, তারা নিজেদের জীবনাচরণ সম্পর্কে অত্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এখন তার সর্বোত্তম ফলাফল দেখার সময় এসে গেছে।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২৩
اِلٰى رَبِّهَا نَاظِرَةٌۚ
নিজের রবের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মুফাস্সিরগণের কেউ কেউ একথাটিকে রূপক অর্থে গ্রহণ করেছেন। তারা বলেনঃ “কারো প্রতি তাকিয়ে থাকা” কথাটি প্রচলিত প্রবাদ হিসেবে তার কাছে কোন কিছু আশা করা, তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করা এবং তার দয়া প্রার্থী হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়। এমন কি অন্ধ ব্যক্তিও অনেক সময় বলে যে, আমি তো অমুকের দিকে তাকিয়ে আছি, তিনি আমার জন্য কি করেন তা দেখার জন্য। কিন্তু বহু সংখ্যক হাদীসে এর যে ব্যাখ্যা রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয়েছে তাহলো, আখেরাতে আল্লাহর নেককার বান্দাদের আল্লাহর সাক্ষাত লাভের সৌভাগ্য হবে। বুখারী, শরীফের বর্ণনায় আছেঃإِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عِيَانًا “তোমরা প্রকাশ্যে সুষ্পস্টভাবে তোমাদের রবকে দেখতে পাবে। ” মুসলিম এবং তিরমিযীতে হযরত সুহাইব থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবী ﷺ বলেছেনঃ বেহেশতবাসীরা বেহেশতে প্রবেশ করার পর আল্লাহ তা’আলা তাদের জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা কি চাও, যে, আমি তোমাদের আরো কিছু দান করি? তারা আরয করবে, আপনি কি আমাদের চেহারা দীপ্তিময় করেননি? আপনি কি আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করেননি এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেননি? তখন আল্লাহ তা’আলা পর্দা সরিয়ে দেবেন। ইতিপূর্বে তারা যেসব পুরস্কার লাভ করেছে তার কোনটিই তাদের কাছে তাদের ‘রবের’ সাক্ষাত লাভের সম্মান ও সৌভাগ্য থেকে অধিক প্রিয় হবে না। এটিই সে অতিরিক্ত পুরস্কার যার কথা কুরআনে এভাবে বলা হয়েছেঃ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ অর্থাৎ “যারা নেক কাজ করেছে তাদের জন্য উত্তম পুরস্কার রয়েছে। আর এছাড়া অতিরিক্ত পুরস্কারও রয়েছে।”(ইউনুস, ২৬) বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু সাঈদ খুদরী এবং হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল, আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের রবকে দেখতে পাবো? জবাবে নবী (সা.) বললেনঃ যখন মেঘের আড়াল থাকে না তখন সুর্য ও চাঁদকে দেখতে তোমাদের কি কোন কষ্ট হয়? সবাই বললো “না” তিনি বললেনঃ তোমরা তোমাদের রবকে এ রকমই স্পষ্ট দেখতে পাবে। বুখারী ও মুসলিমে হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে এ বিষয়ের প্রায় অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, দারকুতনী, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, তাবারানী, বায়হাকী, ইবনে আবী শায়বা এবং আরো কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিস কিছুটা শাব্দিক তারতম্যসহ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, যার বিষয়বস্তু হলো, জান্নাতবাসীদের মধ্যে সর্বনিম্ন মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিও দুই হাজার বছরের দুরত্ব পর্যন্ত তার সাম্রাজ্যের বিস্তার দেখতে পাবে এবং সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি প্রতিদিন দুই বার তার রবকে দেখতে পাবে। একথা বলার পর নবী ﷺ এ আয়াতটি পাঠ করলেন যে, “সেদিন কিছু সংখ্যক চেহারা তরতাজা থাকবে। নিজের রবের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবে।” ইবনে মাজাতে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত একটি হাদীসে আছে যে, আল্লাহ তাদের প্রতি তাকাবেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি তাকাবে। অতঃপর যতক্ষণ আল্লাহ তা’আলা তাদের থেকে অন্তর্হিত না হবেন ততক্ষণ তারা জান্নাতের কোন নিয়ামতের প্রতি মনোযোগ দিবে না এবং আল্লাহর প্রতি তাকিয়ে থাকবে। এটি এবং অন্য আরো বহু হাদীসের ভিত্তিতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীগণ প্রায় সর্বসম্মতভাবেই এ আয়াতের যে অর্থ করেন তাহলো, জান্নাতবাসীগণ আখেরাতে মহান আল্লাহর সাক্ষ্যাৎ লাভে ধন্য হবে। কুরআন মজীদের এ আয়াত থেকেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ “কখ্খনো নয়, তারা (অর্থাৎ পাপীগণ) সেদিন তাদের রবের সাক্ষ্যাৎ থেকে বঞ্চিত হবে।”(আল মুতাফফিফীন, ১৫ ) এ থেকে স্বতই এ সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যায় যে, এ বঞ্চনা হবে পাপীদের জন্য, নেককাদের জন্য নয়। এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। তাহলো, মানুষের পক্ষে আল্লাহকে দেখা কিভাকে সম্ভব? কোন জিনিসকে দেখতে পাওয়ার জন্য যা অনিবার্যরূপে প্রয়োজন তাহলো, সে জিনিসটিকে কোন বিশেষ দিক, স্থান, আকৃতি ও বর্ণ নিয়ে সামনে বিদ্যমান থাকতে হবে। আলোক রশ্মি তাতে প্রতিফলিত হয়ে চোখের ওপর পড়বে এবং চোখ থেকে তার ছবি বা প্রতিবিম্ব মস্তিস্কের দর্শনকেন্দ্রে পৌঁছবে। মানুষের আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পবিত্র সত্তাকে এভাবে দেখতে পাওয়ার কল্পনাও কি করা যায়? কিন্তু এ ধরনের প্রশ্ন মূলত একটি বড় ভ্রান্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে দু’টি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। একটি হলো, দেখার তাৎপর্য। আর অপরটি হলো দেখার কাজটি সংঘটিত হওয়ার সেই বিশেষ অবস্থা বা প্রক্রিয়াটি যার সাথে আমরা এ পৃথিবীতে পরিচিত। দেখার তাৎপর্য হলো, দর্শনকারী ব্যক্তির মধ্যে দৃষ্টিশক্তি থাকতে হবে। অর্থাৎ সে অন্ধ হবে না। দৃশ্যমান বস্তু তার কাছে স্পষ্ট হবে, অদৃশ্য বা চোখের আড়াল হবে না। কিন্তু দুনিয়াতে আমরা যে জিনিসের অভিজ্ঞতা লাভ করি বা তা পর্যবেক্ষণ করে থাকি তা দেখার সে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয় যার সাহায্যে কোন মানুষ বা পশু কার্যত কোন জিনিসকে দেখে থাকে। এ জন্য অনিবার্যরূপে যা প্রয়োজন তা হলো, দর্শনকারীর দেহে চোখ নামক একটি অংগ থাকবে। সে অংগটিতে দেখার শক্তি বর্তমান থাকবে। তার সামনে একটি সসীম রঙীন বা বর্ণময় দেহ বিদ্যমান থাকবে যা থেকে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে চোখের পর্দার ওপর পড়বে এবং চোখের পর্দায় তার আকৃতির স্থান সংকুলান হতে হবে। এখন যদি কেউ মনে করে যে, দেখতে পাওয়ার মূলে এ দুনিয়াতে যে প্রক্রিয়াটি কার্যকর বলে আমরা জানি শুধু সে প্রক্রিয়াতেই দেখার কাজটি কার্যত প্রকাশ পেতে বা ঘটতে পারে তাহলে তা তার নিজের মন-মগজ তথা ধী-শক্তির সংকীর্ণতা। অন্যথায় আল্লাহ তা’আলার নিজের সাম্রাজ্যে দেখার জন্য এত অসংখ্য উপায় ও প্রক্রিয়া থাকা সম্ভব যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এ প্রশ্ন নিয়ে যে ব্যক্তি বিতর্কে লিপ্ত হয় সে নিজেই বলুক, তার রব চক্ষুষ্মান না অন্ধ? তিনি যদি চক্ষুষ্মান তথা দৃষ্টিশক্তির অধিকারী হয়ে থাকেন এবং গোটা বিশ্ব-জাহান ও তার প্রতিটি বস্তু দেখে থাকেন তাহলে কি তিনি চোখ নামের একটি অংগ দিয়ে দেখছেন যা দিয়ে দুনিয়ায় মানুষ ও অন্য সব জীবজন্তু দেখে থাকে এবং আমাদের দ্বারা যেভাবে দেখার কাজটা সংঘটিত হচ্ছে তাঁর দ্বারাও কি সেভাবেই সংঘটিত হচ্ছে? সবারই জানা যে, এর জবাব হবে নেতিবাচক। এর জবাব যখন নেতিবাচক, তখন কোন বিবেক ও বোধ সম্পন্ন মানুষের একথা বুঝাতে কষ্ট হবে কেন যে, দুনিয়াতে মানুষ যে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কোন জিনিসকে দেখে থাকে জান্নাতবাসীগণ সে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আল্লাহর দর্শন লাভ করবেন না। বরং সেখানে দেখার ধরন, প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া হবে অন্য রকম যা এখানে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। দাম্পত্য জীবন কি এবং কেমন একটি দুই বছরের শিশুর পক্ষে তা বুঝা যতটা কঠিন, প্রকৃতপক্ষে আখেরাতের সবকিছু সঠিকভাবে বুঝা আমাদের জন্য তার চেয়েও বেশী কঠিন। অথচ যৌবনে উপনীত হয়ে এ শিশু নিজের দাম্পত্য জীবন যাপন করবে।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২৬
كَلَّاۤ اِذَا بَلَغَتِ التَّرَاقِیَۙ
কখ্খনো না, যখন প্রাণ কণ্ঠনালীতে উপনীত হবে
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এ কখ্খো না” কথাটি সেই ধারাবাহিক কথাটির সাথে সম্পৃক্ত। যা আগে থেকে চলে আসছে। অর্থাৎ তোমাদের এ ধারণা ভুল যে, তোমরা মরে বিলীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং নিজ প্রভুর সামনে তোমাদের ফিরে যেতে হবে না।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২৭
وَ قِیْلَ مَنْ١ٚ رَاقٍۙ
এবং বলা হবে, ঝাঁড় ফুঁক করার কেউ আছে কি?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মূল আয়াতে راق শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এটি رقية ধাতু থেকেও উৎপন্ন হতে পারে। এর অর্থ তাবীজ-কবচ এবং ঝাড়-ফুঁক। আবার رقي ধাতু থেকেও উৎপন্ন হতে পারে। এর অর্থ ওপর দিকে ওঠা। যদি প্রথম অর্থটি গ্রহণ করা হয় তাহলে যা বুঝাবে তাহলো, শেষ মুহূর্তে যে সময় রোগীর সেবা শুশ্রূসাকারীরা সব রকমের ওষুধ পত্র সম্পর্কে নিরাশ হয়ে যাবে তখন বলবেঃ আরে, কোন ঝাড় ফূঁককারীকেই অন্তত খুঁজে আনো যে এর জীবনটা রক্ষা করবে। আর যদি দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে যা বুঝাবে তা হলো, সে সময় ফেরেশতারা বলবেঃ কে এ রূহটা নিয়ে যাবে? আযাবের ফেরেশতারা না রহমতের ফেরেশতারা? অন্য কথায় সে সময় সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে, ঐ ব্যক্তি আখেরাতের দিকে কি মর্যাদা নিয়ে যাত্রা করেছে। সৎ মানুষ হলে রহমতের ফেরেশতারা নিয়ে যাবে। অসৎ মানুষ হলে রহমতের ফেরেশতারা তার ছায়াও মাড়বে না। আযাবের ফেরেশতারাই তাকে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-২৯
وَ الْتَفَّتِ السَّاقُ بِالسَّاقِۙ
উভয় পায়ের গোছা বা নলা একত্র হয়ে যাবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# তাফসীরকাদের অনেকেই ساق (পায়ের নলা) শব্দটির সাধারণ আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করেছেন। এ হিসেবে কথাটির অর্থ হয় মরার সময় যখন পা শুকিয়ে একটি আরেকটির সঙ্গে লেগে যাবে। আবার কেউ কেউ প্রচলিত আরবী বাকরীতি অনুসারে শব্দটিকে কঠোরতার রূঢ়তা ও বিপদাপদ অর্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ সে সময় দু’টি বিপদ একসাথে এসে হাজির হবে। একটি এ পৃথিবী এবং এর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিপদ। আরেকটি, একজন অপরাধী হিসেবে গ্রেফতার হয়ে পরকালীন জগতে যাওয়ার বিপদ যার মুখোমুখী হতে হবে প্রত্যেক কাফের মুনাফিক এবং পাপীকে।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৩৩
ثُمَّ ذَهَبَ اِلٰۤى اَهْلِهٖ یَتَمَطّٰىؕ
তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে নিজের পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে গিয়েছে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থ হলো, যে ব্যক্তি আখেরাতকে মানতে প্রস্তুত ছিল না সে পূর্ব বর্ণিত আয়াতগুলোতে উল্লেখিত সবকিছু শোনার পরেও তা অস্বীকার করে যেতে থাকলো এবং এসব আয়াত শোনার পর দর্পভরে নিজের বাড়ীর দিকে চলে গেল। মুজাহিদ, কাতাদ ও ইবনে যায়েদের মতে এ লোকটি ছিল আবু জেহেল। আয়াতের শব্দসমূহ থেকেও এটাই প্রকাশ পায় যে, সে এমনকোন ব্যক্তি ছিল যে সূরা কিয়ামার ওপরে বর্ণিত আয়াতগুলো শোনার পর এ আচরণ ও কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিল।
আয়াতের “সে সত্যকে অনুরসণ করেনি, নামাযও পড়েনি”কথাটি বিশেষভাবে মনযোগলাভের যোগ্য। এর থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে আল্লাহ এবং তাঁর রসূল ও তাঁর কিতাবের সত্যতা স্বীকার করার পর তার প্রাথমিক এবং অনিবার্য দাবী হলো, মানুষ যেন নামায পড়ে। আল্লাহর দেয়া শরীয়াতের অন্য সব হুকুম-আহকাম তামীল করার পর্যায় বা অবকাশ তো আসে আরো পরে। কিন্তু ঈমান আনার পর কিছু সময় যেতে না যেতেই নামাযের সময় এসে হাজির হয়। আর তখনই জানা যায় সে যা মেনে নেয়ার অঙ্গীকার মুখ থেকে উচ্চারণ করেছিল তা সত্যিই তার হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, না কি কয়েকটি শব্দের আকারে মুখ থেকে উচ্চারিত ফাঁকা বুলি মাত্র।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৩৫
ثُمَّ اَوْلٰى لَكَ فَاَوْلٰىؕ
হ্যাঁ,, এ আচরণ তোমার পক্ষেই শোভনীয় এবং তোমার পক্ষেই মানানসই।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# তাফসীরকারগণاولى لك আয়াতাংশের কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। যেমন ঠিক তোমাকে! সর্বনাশ হোক তোমার! মন্দ, ধ্বংস এবং দুর্ভাগ্য হোক তোমার! তবে বাক্যটির অবস্থান বিবেচনা করলে আমার মতে এর দু’টি উপযুক্ত অর্থ হতে পারে যা হাফেয ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ “তুমি যখন তোমার সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা করছো। ” এটি একটি শ্লেষ বাক্য। কুরআন মজীদের আরো এক জায়গায় এ ধরনের বাক্য প্রয়োগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, দোযখে আযাব দেয়ার সময় পাপী লোকদের বলা হবেঃ ذُقْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْكَرِيمُ “নাও, এর মজা চাখো। তুমি অতি বড় সম্মানী মানুষ কিনা। ” ( আদ দুখান, ৪৯ )।
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৩৬
اَیَحْسَبُ الْاِنْسَانُ اَنْ یُّتْرَكَ سُدًىؕ
মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে বক্তব্যের সমাপ্তি টানতে গিয়ে সেই একই বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে যা দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়েছিল। অর্থাৎ মৃত্যুর পরের জীবন অনিবার্যও এবং তা সম্ভবও।
# আরবী ভাষায় ابل سدي বলা হয় এমন উটকে যা বেঁধে রাখা হয় না, উদ্দেশ্যহীনভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় এবং তার খোঁজ-খবর নেয়ার কেউ থাকেনা। লাগামহীন উট বলে আমরা এ অর্থটিই প্রকাশ করে থাকি। অতএব, আয়াতের অর্থ হলো, মানুষ কি নিজকে লাগামহীন উট মনে করে যে, তার স্রষ্টা তাকে এ পৃথিবীতে দায়িত্বহীন করে ছেড়ে দিয়েছেন? তার কোন দায়িত্ব ও কর্তব্য নেই? কোন জিনিস তার জন্য নিষিদ্ধ নয়? আর এমন কোন সময়ও কি তার আসবে না যখন তাকে তার কাজ-কর্মের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? একথাটিই কুরআন মজীদের অন্য একস্থানে এভাবে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আল্লাহ কাফেরদের বলবেনঃ
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ
“তোমরা কি মনে করেছো যে, আমি তোমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেছি? তোমাদেরকে কখনো আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না? “(আল মু’মিনূন, ১১৫ ) এ দু’টি স্থানে মৃত্যুর পরের জীবনের অনিবার্যতার প্রমাণ প্রশ্নের আকারে পেশ করা হয়েছে। প্রশ্নের সারমর্ম হলো, তোমরা কি প্রকৃতই নিজেদেরকে নিছক পশু বলে মনে করে নিয়েছো? তোমরা কি তোমাদের ও পশুদের মধ্যে এ স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পাও না যে, পশুদের কোন ইখতিয়ার ব স্বাধীনতা নেই, কিন্তু তোমাদের ইখতিয়ার ও স্বাধীনতা আছে? পশুর-কাজ-কর্ম নৈতিক ভাল-মন্দের প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু তোমাদের কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন যেমন দায়িত্বমুক্ত, তাদের যেমন কোন জবাবদিহি করতে হবে না, তোমাদের ব্যাপারটাও ঠিক তাই? পশুদের পুনরায় জীবত করে না উঠানোর যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বুঝা যায়। তারা তাদের সহজাত ও প্রকৃতিগত ধরা বাঁধা দাবী পুরণ করেছে মাত্র। নিজেদের বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে কোন দর্শন রচন করেনি, কোন বিশেষ মত ও পথের অনুসারী গোষ্ঠির সৃষ্টি করেনি, কাউকে উপাস্য বানায়নি এবং নিজেও কারো উপাস্য হয়নি, এমন কোন কাজ করেনি যাকে নেককাজ ব বদকাজ বলে অভিহিত করা যায়। কোন ভাল বা মন্দ রীতি-প্রথার প্রচলন করেনি যার প্রভাব পুরুষাণুক্রমে চলেছে এবং সেজন্য সে পুরস্কার বা শাস্তি লাভের উপযুক্ত। তাই তারা যদি মরার পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে সেটা বোধগম্য ব্যাপার। কারণ তার উপর কোন কাজের দায়-দায়িত্ব বর্তায় না যে, তার জবাবদিহের জন্য পুনরায় তাকে জীবিত করে উঠানোর প্রয়োজন হবে। কিন্তু তোমাদেরকে মৃত্যুর পরের জীবন থেকে কিভাবে অব্যহতি দেয়া যেতে পারে? কারণ মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও তোমরা এমন সব নৈতিক কাজ-কর্ম করতে থাকো যার ভাল বা মন্দ হওয়া এবং পুরস্কার বা শাস্তির উপযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তোমাদের বিবেক-বুদ্ধিই সিদ্ধান্ত দেয়। যে ব্যক্তি কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে এবং পরক্ষনেই আকস্মিক কোন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে তোমাদের মতে কি তার অবাধে(Scotfree) বেঁচে যাওয়া এবং এ জুলুমের প্রতিফল কোন দিনই না পাওয়া উচিত? যে ব্যক্তি দুনিয়ায় এমন কোন বিপর্যয়ের বীজ বপন করে গিয়েছে মানব সন্তানেরা শত শত বছর ধরে যার বিষময় ফল ভোগ করলো বা দুর্ভোগ পোহালো সে-ও নগন্য পোকা মাকড় ও কীট পতঙ্গের মত মৃত্যুর পর বিলীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক, যার কৃতকৃমের ফলে হাজার হাজার ও লাখ লাখ মানুষের জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছে পুনরায় জীবিত হয়ে তাকে সেসব কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে না হোক এরূপ ব্যবস্থায় কি তোমাদের বুদ্ধি-বিবেক সত্যিই সন্তুষ্ট হতে পারবে? পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি জীবন ব্যাপী হক ও ইনসাফ এবং কল্যাণ ও সৎকর্মশীলতার জন্য নিজের জীবনপাত করলো এবং জীবনভর শুধু বিপদ-মুসিবতই পোহালো তোমাদের বিবেচনায় কি সে পোকা-মাকড় ও কীট-পতঙ্গের মতই কোন নগণ্য সৃষ্টি, যার নিজের ভাল কাজের পুরস্কার লাভ কোন অধিকারই নেই?
সুরা: আল-কিয়ামাহ
আয়াত নং :-৪০
اَلَیْسَ ذٰلِكَ بِقٰدِرٍ عَلٰۤى اَنْ یُّحْیَِۧ الْمَوْتٰى۠
সেই স্রষ্টা কি মৃতদের পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম নন?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটি মৃত্যুর পরের জীবনের সম্ভাব্যতার প্রমাণ। যারা একথা বিশ্বাস করে যে, প্রাথমিক পর্যায়ের বীর্য দ্বারা সৃষ্টির সূচনা করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করা পর্যন্ত গোটা কাজটাই মহান আল্লাহর শক্তি ও কৌশলের একটা বিস্ময়কর নমুনা, তাদের কাছে প্রকৃতপক্ষে এ প্রমাণের কোন জবাব নেই। কেননা, তারা যতই ঔদ্ধতা দেখাক না কেন তাদের বিবেক-বুদ্ধি একথা না মেনে পারে না যে, যে আল্লাহ এভাবে দুনিয়ায় মানুষ সৃষ্টি করেন তিনি পুনরায় এ মানুষকি অস্তিত্ব দান করতেও সক্ষম। তবে যারা এ স্পষ্ট জ্ঞানগর্ভ ও যুক্তিসঙ্গত কাজকে কেবল আকস্মিকতার ফল বলে মনে করে তারা যদি হঠকারী আচরণ করতে বদ্ধপরিকর না হয়ে থাকে তাহলে একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে। বিষয়টি হলো, একই ধরনের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর প্রতিটি অংশে প্রত্যেক জাতির মধ্যে নারী ও পুরুষের জন্মের যে অনুপাতে চলে আসছে তাতে কোথাও কোন যুগে এমন অবস্থা কখনো দেখা দেয়নি যে, কোন জনপদ ক্রমাগত শুধু পুরুষ অথবা শুধু নারীই জন্ম লাভ করেছে এবং ভবিষ্যতে তাদের বংশধারা টিকে থাকার কোন সম্ভাবনাই থাকেনি। তাদের কাছে এরূপ না হওয়ার কি যুক্তি ও ব্যাখ্যা আছে? কাজটিও কি আকস্মিকভাবেই হয়ে চলেছে? এত বড় দাবী করার জন্য কোন মানুষকে অন্তত এতটা নির্লজ্জ ও বেশরম হওয়া চাই যাতে সে একদিন এ দাবীও করে বসতে পারে যে, লণ্ডন, নিউইয়র্ক, মস্কো এবং পিকিং এর মত শহর আকস্মিকভাবে আপনা আপনি অস্তিত্ব লাভ করেছে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আর রূম, টীকা ২৭ থেকে ৩০ ; আশ শূরা, টীকা৭৭ )
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়, রসূলুল্লাহ ﷺ যখন এ আয়াতটি পড়তেন তখন আল্লাহর এ প্রশ্নের জবাবে কখনোبلى (কেন সক্ষম নন) কখনো سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ فَبَلَى (তোমার সত্তা অতি পবিত্র, হে আল্লাহ, কেন সক্ষম নয়) এবং কখনো سُبْحَانَكَ فَبَلَى অথবা سُبْحَانَكَ وبلى বলতেন। (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম ও আবু দাউদ) আবু দাউদে হযরত আবু হুরায়রা থেকে এ মর্মে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, নবী ﷺ বলেছেনঃ যখন তোমরা সূরা ত্বীনের আয়াত أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ (আল্লাহ কি সব বিচারকের চেয়ে বড় বিচারক নন? ) পড়বে তখন বলবে بَلَى وَأَنَا عَلَى ذَلِكَ مِنَ الشَّاهِدِينَ (কেন নয়, আমি নিজেও এর একজন সাক্ষ্যাদাতা, ) সূরা কিয়ামাহার এ আয়াতটি যখন পড়বে তখন বলবে এবং যখন সূরা মুরসালাতের আয়াত فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَهُ يُؤْمِنُونَ (এ কুরআন ছাড়া আর কোন জিনিসের প্রতি তারা বিশ্বাস পোষণ করবে? ) পড়বে তখন বলবেঃ(আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি।) ইমাম আহমাদ, তিরমিযী, ইবনুল, মুনযির, ইবনে মারদুইয়া, বায়হাকী এবং হাকেমও অনুরূপ বিষয় সম্বলিত হাদীসবর্ণনা করেছেন।