Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৮৯/হে মানুষ:-৪, এবং কাফের-রা বলে:-৩৩) [*মানুষের এক সময় অতিক্রম করেছে,যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।:- *দ্বীনের দায়ীদের কর্তব্য : – ** সুযােগের সদ্ব্যবহারের জন্যে সজাগ করে তােলা হচ্ছে:- *‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্রসংশাযোগ্য:- *অকৃতজ্ঞ কাফিরের আনুগত্য করবেন না:-] www.motaher21.net সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার পারা:২৯

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৯/হে মানুষ:-৪, এবং কাফের-রা বলে:-৩৩)
[*মানুষের এক সময় অতিক্রম করেছে,যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।:-
*দ্বীনের দায়ীদের কর্তব্য : –
** সুযােগের সদ্ব্যবহারের জন্যে সজাগ করে তােলা হচ্ছে:-
*‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্রসংশাযোগ্য:-
*অকৃতজ্ঞ কাফিরের আনুগত্য করবেন না:-]

www.motaher21.net
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার
পারা:২৯
১- ৩১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
তাফসীরে‌ ফি জিলালিল‌ কুরআন:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১
ہَلۡ اَتٰی عَلَی الۡاِنۡسَانِ حِیۡنٌ مِّنَ الدَّہۡرِ لَمۡ یَکُنۡ شَیۡئًا مَّذۡکُوۡرًا ﴿۱﴾
মানুষের ওপরে কি অন্তহীন মহাকালের এমন একটি সময়ও অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন জিনিসই ছিল না?
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২
اِنَّا خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ اَمۡشَاجٍ ٭ۖ نَّبۡتَلِیۡہِ فَجَعَلۡنٰہُ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا ﴿۲﴾
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু হতে,যাতে আমি তাকে পরীক্ষা করি, এই জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৩
اِنَّا ہَدَیۡنٰہُ السَّبِیۡلَ اِمَّا شَاکِرًا وَّ اِمَّا کَفُوۡرًا ﴿۳﴾
নিশ্চয় আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি; এরপর হয় সে শোকরগোজার হবে নয়তো হবে কুফরের পথ অনুসরণকারী।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৪
اِنَّاۤ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ سَلٰسِلَا۠ وَ اَغۡلٰلًا وَّ سَعِیۡرًا ﴿۴﴾
আমি কাফেরদের জন্য শিকল, বেড়ি এবং জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৫
اِنَّ الۡاَبۡرَارَ یَشۡرَبُوۡنَ مِنۡ کَاۡسٍ کَانَ مِزَاجُہَا کَافُوۡرًا ۚ﴿۵﴾
(বেহেশতে) নেককার লোকেরা পানপাত্র থেকে এমন শরাব পান করবে যাতে কর্পূর পানি সংমিশ্রিত থাকবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৬
عَیۡنًا یَّشۡرَبُ بِہَا عِبَادُ اللّٰہِ یُفَجِّرُوۡنَہَا تَفۡجِیۡرًا ﴿۶﴾
এমন একটি ঝরণা; যা হতে আল্লাহর দাসরা পান করবে, তারা এ (ঝরনা ইচ্ছামত) প্রবাহিত করবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৭
یُوۡفُوۡنَ بِالنَّذۡرِ وَ یَخَافُوۡنَ یَوۡمًا کَانَ شَرُّہٗ مُسۡتَطِیۡرًا ﴿۷﴾
এরা হবে সেসব লোক যারা (দুনিয়াতে) মানত পূরণ করে সে দিনকে ভয় করে যার বিপদ সবখানে ছড়িয়ে থাকবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৮
وَ یُطۡعِمُوۡنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّہٖ مِسۡکِیۡنًا وَّ یَتِیۡمًا وَّ اَسِیۡرًا ﴿۸﴾
আর আল্লাহর মহব্বতে মিসকীন, ইয়াতীম এবং বন্দীকে খাবার দান করে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৯
اِنَّمَا نُطۡعِمُکُمۡ لِوَجۡہِ اللّٰہِ لَا نُرِیۡدُ مِنۡکُمۡ جَزَآءً وَّ لَا شُکُوۡرًا ﴿۹﴾
এবং (তাদেরকে বলে) আমরা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তোমাদের খেতে দিচ্ছি। আমরা তোমাদের কাছে এর কোন প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা পেতে চাই না।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১০
اِنَّا نَخَافُ مِنۡ رَّبِّنَا یَوۡمًا عَبُوۡسًا قَمۡطَرِیۡرًا ﴿۱۰﴾
আমরা তো আমাদের রবের পক্ষ থেকে সেদিনের আযাবের ভয়ে ভীত, যা হবে কঠিন বিপদ ভরা অতিশয় দীর্ঘ দিন।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১১
فَوَقٰہُمُ اللّٰہُ شَرَّ ذٰلِکَ الۡیَوۡمِ وَ لَقّٰہُمۡ نَضۡرَۃً وَّ سُرُوۡرًا ﴿ۚ۱۱﴾
আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে সেদিনের অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে সজীবতা ও আনন্দ দান করবেন।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১২
وَ جَزٰىہُمۡ بِمَا صَبَرُوۡا جَنَّۃً وَّ حَرِیۡرًا ﴿ۙ۱۲﴾
আর তাদের ধৈর্যশীলতার পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে দেবেন জান্নাত ও রেশমী বস্ত্র।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৩
مُّتَّکِـِٕیۡنَ فِیۡہَا عَلَی الۡاَرَآئِکِ ۚ لَا یَرَوۡنَ فِیۡہَا شَمۡسًا وَّ لَا زَمۡہَرِیۡرًا ﴿ۚ۱۳﴾
তারা সেখানে উঁচু আসনের ওপরে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রোদের উত্তাপ কিংবা শীতের তীব্রতা তাদের কষ্ট দেবে না।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৪
وَ دَانِیَۃً عَلَیۡہِمۡ ظِلٰلُہَا وَ ذُلِّلَتۡ قُطُوۡفُہَا تَذۡلِیۡلًا ﴿۱۴﴾
জান্নাতের বৃক্ষরাজির ছায়া তাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছায়া দিতে থাকবে। আর তার ফলরাজি সবসময় তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে ।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৫
وَ یُطَافُ عَلَیۡہِمۡ بِاٰنِیَۃٍ مِّنۡ فِضَّۃٍ وَّ اَکۡوَابٍ کَانَتۡ قَؔوَارِیۡرَا۠ ﴿ۙ۱۵﴾
আর তাদের উপর ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে রৌপ্যপাত্ৰে এবং স্ফটিক-সচ্ছ পানপাত্রে—
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৬
قَؔ‍وَارِیۡرَا۠ مِنۡ فِضَّۃٍ قَدَّرُوۡہَا تَقۡدِیۡرًا ﴿۱۶﴾
রূপালী স্ফটিক-পাত্র, পরিবেশনকারীরা যথাযথ পরিমাণে তা পূর্ণ করবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৭
وَ یُسۡقَوۡنَ فِیۡہَا کَاۡسًا کَانَ مِزَاجُہَا زَنۡجَبِیۡلًا ﴿ۚ۱۷﴾
আর সেখানে তাদেরকে পান করানো হবে যান্জাবীল মিশ্ৰিত পূৰ্ণপাত্ৰ-পানীয় ।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৮
عَیۡنًا فِیۡہَا تُسَمّٰی سَلۡسَبِیۡلًا ﴿۱۸﴾
জান্নাতের এমন এক ঝরণার, যার নাম ‘সালসাবীল’।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৯
وَ یَطُوۡفُ عَلَیۡہِمۡ وِلۡدَانٌ مُّخَلَّدُوۡنَ ۚ اِذَا رَاَیۡتَہُمۡ حَسِبۡتَہُمۡ لُؤۡلُؤًا مَّنۡثُوۡرًا ﴿۱۹﴾
আর তাদের উপর প্রদক্ষিণ করবে চির কিশোরগণ, যখন আপনি তাদেরকে দেখবেন তখন মনে করবেন তারা যেন বিক্ষিপ্ত মুক্তা।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২০
وَ اِذَا رَاَیۡتَ ثَمَّ رَاَیۡتَ نَعِیۡمًا وَّ مُلۡکًا کَبِیۡرًا ﴿۲۰﴾
তুমি সেখানে যে দিকেই তাকাবে সেদিকেই শুধু নিয়ামত আর ভোগের উপকরণের সমাহার দেখতে পাবে এবং বিশাল সাম্রাজ্যের সাজ-সরঞ্জাম তোমাদের দৃষ্টিগোচর হবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২১
عٰلِیَہُمۡ ثِیَابُ سُنۡدُسٍ خُضۡرٌ وَّ اِسۡتَبۡرَقٌ ۫ وَّ حُلُّوۡۤا اَسَاوِرَ مِنۡ فِضَّۃٍ ۚ وَ سَقٰہُمۡ رَبُّہُمۡ شَرَابًا طَہُوۡرًا ﴿۲۱﴾
তাদের দেহে হবে মিহি সবুজ এবং মোটা রেশমী কাপড়, তারা অলঙ্কৃত হবে রৌপ্য-নির্মিত কঙ্কনে, আর তাদের প্রতিপালক তাদেরকে পান করাবেন বিশুদ্ধ পানীয়।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২২
اِنَّ ہٰذَا کَانَ لَکُمۡ جَزَآءً وَّ کَانَ سَعۡیُکُمۡ مَّشۡکُوۡرًا ﴿٪۲۲﴾
‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্রসংশাযোগ্য।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৩
اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡقُرۡاٰنَ تَنۡزِیۡلًا ﴿ۚ۲۳﴾
নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি ক্রমে ক্রমে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৪
فَاصۡبِرۡ لِحُکۡمِ رَبِّکَ وَ لَا تُطِعۡ مِنۡہُمۡ اٰثِمًا اَوۡ کَفُوۡرًا ﴿ۚ۲۴﴾
কাজেই আপনি ধৈর্যের সাথে আপনার রবের নির্দেশের প্রতীক্ষা করুন এবং তাদের মধ্য থেকে কোন পাপিষ্ঠ বা ঘোর অকৃতজ্ঞ কাফিরের আনুগত্য করবেন না।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৫
وَ اذۡکُرِ اسۡمَ رَبِّکَ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا ﴿ۖۚ۲۵﴾
আর আপনার রবের নাম স্মরণ করুন সকালে ও সন্ধ্যায়।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৬
وَ مِنَ الَّیۡلِ فَاسۡجُدۡ لَہٗ وَ سَبِّحۡہُ لَیۡلًا طَوِیۡلًا ﴿۲۶﴾
রাতের বেলায়ও তার সামনে সিজদায় অবনত হও। রাতের দীর্ঘ সময় তাঁর তাসবীহ অর্থাৎ পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকো।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৭
اِنَّ ہٰۤؤُلَآءِ یُحِبُّوۡنَ الۡعَاجِلَۃَ وَ یَذَرُوۡنَ وَرَآءَہُمۡ یَوۡمًا ثَقِیۡلًا ﴿۲۷﴾
এসব লোক তো দ্রুত লাভ করা যায় এমন জিনিসকে (দুনিয়াকে) ভালবাসে এবং ভবিষ্যতে যে কঠিন দিন আসছে তাকে উপেক্ষা করে চলছে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৮
نَحۡنُ خَلَقۡنٰہُمۡ وَ شَدَدۡنَاۤ اَسۡرَہُمۡ ۚ وَ اِذَا شِئۡنَا بَدَّلۡنَاۤ اَمۡثَالَہُمۡ تَبۡدِیۡلًا ﴿۲۸﴾
আমিই এদের সৃষ্টি করেছি এবং এদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সন্ধিস্থল মজবুত করেছি। আর যখনই চাইবো তাদের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে দেব।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৯
اِنَّ ہٰذِہٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا ﴿۲۹﴾
নিশ্চয় এটা এক উপদেশ, অতএব যার ইচ্ছা সে তার প্রতিপালকের দিকে পথ অবলম্বন করুক।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৩০
وَ مَا تَشَآءُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا ﴿٭ۖ۳۰﴾
তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না যদি আল্লাহ‌ না চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সুবিজ্ঞ।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৩১
یُّدۡخِلُ مَنۡ یَّشَآءُ فِیۡ رَحۡمَتِہٖ ؕ وَ الظّٰلِمِیۡنَ اَعَدَّ لَہُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿٪۳۱﴾

যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে শামিল করেন। আর জালেমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৯/হে মানুষ:-৪, এবং কাফের-রা বলে:-৩৩)
[*মানুষের এক সময় অতিক্রম করেছে,যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।:-
*দ্বীনের দায়ীদের কর্তব্য : –
** সুযােগের সদ্ব্যবহারের জন্যে সজাগ করে তােলা হচ্ছে:-
*‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্রসংশাযোগ্য:-
*অকৃতজ্ঞ কাফিরের আনুগত্য করবেন না:-]

www.motaher21.net
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার
পারা:২৯
১- ৩১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
তাফসীরে‌ ফি জিলালিল‌ কুরআন:-

সুরা: আদ-দাহর

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৭৬

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : কোনাে কোনাে বর্ণনায় যদিও এই সূরাটিকে মাদানী বলে অভিহিত করা হয়েছে কিন্তু আসলে এটি হচ্ছে একটি মক্কী সূরা। বিষয়বস্তু, বক্তব্য ও যাবতীয় লক্ষণের দিক দিয়ে এর মক্কী হওয়াটাই স্পষ্ট। এ জন্যে আমরা এর মক্কী হওয়া সংক্রান্ত বর্ণনাকেই অগ্রগণ্য মনে করেছি। এর বক্তব্য বিবেচনা করলে মনে হয়, এ সূরা কোরআনের মক্কায় নাযিল হওয়া অংশের প্রথম ভাগের অন্তর্ভুক্ত। এতে আখেরাতের জীবনে দৈহিক উপভােগ্য নেয়ামতসমূহের পাশাপাশি কঠিন ও ভয়ংকর আযাবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। সেই সাথে রসূল(স.)-কে স্বীয় প্রতিপালকের সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করা এবং পাপিষ্ঠ ও অবাধ্য মােশরেকদের কারাে আনুগত্য না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সময়ে ইসলামী আন্দোলন ও তার কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলছিলাে। একদিকে মােশরেকদেরকে আরাে একটু সময় দেয়া এবং অপরদিকে রসূল(স.)-কে তার কাছে নাযিল করা ওহীর ওপর অবিচল থাকা, বাতিলপন্থীদের চাপ ও প্রলােভনের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সূরা আল কালাম, সূরা আল মুজ্জাম্মিল ও সূরা আল মুদ্দাসসির-এর বক্তব্যও অনেকটা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই আমাদের দৃষ্টিতে এই সূরার মাদানী হওয়ার সম্ভাবনা এতাে কম যে, তা বিবেচনা না করলেও চলে। সামগ্রিকভাবে সুরার বক্তব্য হচ্ছে আল্লাহর অনুগত হওয়া, তার কাছে একাগ্রমনে আশ্রয় প্রার্থনা করা, তার সন্তোষ কামনা করা, তার নেয়ামতসমূহকে স্মরণ করা, তার অনুগ্রহকে অনুভব করা, তার আযাব থেকে সতর্ক হওয়া, তাছাড়া তার পরীক্ষা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তার সৃষ্টি, নেয়ামত বিতরণ পরীক্ষা ও দুঃখ-কষ্টে নিক্ষেপ করার পেছনে যে মহত্তর সুক্ষ্ম, গভীর জ্ঞান ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তা উপলব্ধি করার উদাত্ত, বিনম্র ও মৃদু আহবানও এতে রয়েছে । সূরার শুরুতেই এই মর্মে প্রশ্ন উত্থাপন করে মানুষের হৃদয়ে একটি হালকা অনুভূতির পরশ বুলাতে চেষ্টা করা হয়েছে যে, মানুষ তার জন্মের পূর্বে কোথায় ছিলাে? কে তাকে অস্তিত্বে আনলাে? এক সময়ে যার কোনাে অস্তিত্ব ছিলাে না, যার কোনাে উল্লেখও ছিলাে না, সেই মানুষ একদিন এই সৃষ্টিজগতে কিভাবে উল্লেখযােগ্য বিষয়ে পরিণত হলাে। বলা হয়েছে, ‘মানুষের ওপর কি মহাকালের এমন একটা সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযােগ্য কোনাে জিনিসই ছিলো না।’ এরপর তার জন্মের উৎস ও রহস্য উঘাটন করে তার সৃষ্টির পেছনে কোনাে মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে তা বর্ণনা করা হয়েছে, অতপর তার যাবতীয় দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ করে আরেকটি হালকা পরশ বুলানাে হয়েছে। ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্রিত বীর্য থেকে, যাতে করে আমি তার পরীক্ষা নিতে পারি, অতপর আমি তাকে শ্রবণ শক্তিসম্পন্ন বানিয়েছি।’ এরপর তৃতীয় আরেকটি পরশ বুলানাে হয়েছে এই মর্মে যে, আল্লাহ তায়ালাই তাকে সঠিক পথের নির্দেশ দিয়েছেন, সত্য ও সঠিক পথে চলতে তাকে সাহায্য করেছেন, অতপর নিজের গন্তব্যস্থল নিজেই বেছে নেয়ার জন্যে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন, আমি তাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছি, এখন চাই সে কৃতজ্ঞ হােক কিংবা অকৃতজ্ঞ হােক। ওহীর মাধ্যমে এই তিনটি পরশ বুলানাে এবং এগুলাের ফলে মানুষের মনে সৃষ্ট গভীর চিন্তা-ভাবনা করা, আগে পিছে ভাবতে বলা হয়েছে, অতপর নির্দিষ্ট পথটি মনােনীত করার প্রাক্কালে সতর্কতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে তাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে । সূরাটি মানুষকে জাহান্নামের পথ প্রত্যাখ্যান করারও আহ্বান জানিয়েছে এবং তার দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে চেষ্টা করেছে। এ জন্যে উৎসাহ দানের যতাে পথ ও পন্থা থাকতে পারে তাও দেখানাে হয়েছে। আরাম আয়েশ, সুখ শান্তি ও উচ্চ মর্যাদার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে যতাে আকর্ষণীয় ভাষা থাকতে পারে তা প্রয়ােগ করা হয়েছে। যথা, ‘আমি কাফেরদের জন্যে হাতকড়া, জিঞ্জির ও জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি সৎ লােকেরা এমন পেয়ালায় পান করবে, যার সাথে কর্পুরের সুগন্ধি মিশ্রিত থাকবে। তা হবে এমন একটি প্রবহমান ঝর্ণা, যার কিনারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর বান্দারা পান করবে এবং যেখানে যেমন খুশী তারা তার শাখা-প্রশাখা বের করে নেবে।’ আখেরাতের সেই অঢেল সুখ সমৃদ্ধির উপকরণগুলাে বর্ণনা করার আগে এই সৎ লােকদের গুণ বৈশিষ্টসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনার জন্যে এমন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যাতে আগাগােড়াই সহানুভুতি, ঔদার্য, সৌন্দর্য ও আন্তরিকতার অভিব্যক্তি রয়েছে, আর এই সবই হচ্ছে সৎ লােকদের জন্যে নির্ধারিত সেই আনন্দদায়ক তৃপ্তিকর ও মনােমুগ্ধকর নেয়ামতসমূহের সাথে পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যথা, ‘তারা মান্নত পূরণ করে এবং সেই দিনটিকে ভয় করে যার বিপদ সবত্র বিস্তৃত হবে, খাবারের প্রতি নিজেদের থাকা সত্তেও তারা মেসকীন, এতীম ও কয়েদীদেরকে খাবার খাওয়ায়…’ তারপর এই সব সৎ বান্দাদের পুরস্কারের কথা ঘােষণা করা হয়েছে, যারা আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনমনীয় ও সংকল্পবদ্ধ ছিলাে, যারা আখেরাতের কঠিন দিনকে ভয় করতাে, যারা নিজেদের প্রয়ােজনকে উপেক্ষা করে নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দরিদ্রদেরকে খাওয়াতাে এবং এ জন্যে কারাে কাছ থেকে কৃতজ্ঞতার প্রত্যাশা করতাে না, শুধুমাত্র কেয়ামতের কঠিন দিনের ভয়েই তারা খাবার খাওয়াতাে। এভাবে যারা নিছক আখেরাতের ভয়ে দরিদ্রদের প্রয়ােজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে খাওয়াতাে, তাদের কি প্রতিদান দেয়া হবে পরবর্তী আয়াতে এবার তার বিবরণ দেয়া হচ্ছে, তাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সেই দিনের মুসিবত ও আযাব থেকে রক্ষা করবেন এবং দান করবেন প্রফুল্লতা ও আনন্দ। ‘তাদের ধৈর্যের কারণে তাদের প্রতিপালক তাদেরকে প্রতিদান হিসাবে বেহেশত ও রেশমি বস্ত্র দেবেন…’ এভাবে প্রথম রুকুর শেষপর্যন্ত এই প্রতিদানের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এই তৃপ্তিকর নেয়ামতের দৃশ্য তুলে ধরার পর স্বয়ং রাসূল(স.)-কে সম্বাধন করে তাকে সকল অবজ্ঞা অবহেলা ও অস্বীকৃতির মুখে দাওয়াতের কাজে অবিচল থাকা ও ধৈর্যধারণ করতে বলা হয়েছে। আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করা এবং সর্বক্ষণ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা ও পথ যতােই দীর্ঘ হােক তার কাছ থেকেই সাহায্য প্রার্থনা করার আদেশও তাকে দেয়া হয়েছে। সূরার দ্বিতীয় রুকুর প্রথম চারটি আয়াত হচ্ছে এই আদেশ সম্বলিত। অতপর সূরার শেষ আয়াতগুলােতে কেয়ামতের কঠিন দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে যে, অবিশ্বাসীরা এই দিনটির যথাযথ গুরুত্ব না দিলেও নেককার লােকেরা তাকে ভয় করে, সাবধানতা অবলম্বন করে। সেই সাথে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই অবিশ্বাসীদেরকে খতম করে দিয়ে তাদের জায়গায় নতুন মানব গােষ্ঠীকে সৃষ্টি করা আল্লাহ তায়ালার পক্ষে খুবই সহজ কাজ। কেননা তিনিই তাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দেহ ও মনে বিদ্যমান যাবতীয় শক্তি ও যােগ্যতার যােগান দিয়েছেন। এখানে তাদেরকে বাচিয়ে রাখার উদ্দেশ্য কি এবং তার পরীক্ষার কি পরিণতি হয়ে থাকে তাও তিনি এ সুরায় ব্যক্ত করেছেন। মানুষের জন্মের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং তাকে যে আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষার উদ্দেশ্যেই পৃথিবীতে পাঠানাের পরিকল্পনা করেছেন, তা জানানাের মধ্য দিয়ে সূরাটির সূচনা হয়েছে, আর সূরাটির সমাপ্তি ঘটানাে হয়েছে সে পরীক্ষার ফলাফল ঘােষণার মধ্য দিয়ে। কেননা শুরু থেকেই এ ধরনের পরিকল্পনা আল্লাহর ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। সুরাটির উল্লেখিত সূচনা ও উপসংহার জীবনের বাইরের সকল পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার প্রতি সুস্পষ্ট ইংগিত দেয়। এটাকে বুঝবার চেষ্টা না করে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের পক্ষে বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা তাকে পরীক্ষার জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে, আর উপরােক্ত সত্যকে বুঝবার চেষ্টা করাটাও এই পরীক্ষার আওতাভুক্ত। বুঝবার ক্ষমতাটুকু তাকে এ জন্যে দেয়া হয়েছে যেন সে পরীক্ষায় কামিয়াব করতে পারে। সূচনা ও সমাপ্তির মাঝে আখেরাতের নেয়ামতসমূহের যে বিবরণ দেয়া হয়েছে তা কোরআনের দীর্ঘতম বিবরণ। অথবা বলা যেতে পারে যে, সুরা আল ওয়াকেয়া-য় যে বিবরণ এসেছে তার তুলনায় এটা দীর্ঘ। সামগ্রিকভাবে এ নেয়ামত দৈহিকভাবে অনুভবযােগ্য ও উপভােগ্য। সেই সাথে রয়েছে আল্লাহর কাছে গ্রহণযােগ্য ও সম্মানের বাড়তি পুরস্কার। এই উভয় ধরনের পুরস্কার বা প্রতিদানের বিবরণ স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, এ সূরা মক্কায় অবতীর্ণ। কেননা মক্কাবাসীরাই ছিলাে জাহেলিয়াতের সাথে সবচেয়ে বেশী ঘনিষ্ট। দৈহিকভাবে উপভােগ্য সামগ্রীর প্রতি তাদের আকর্ষণ ছিলাে তীব্র। এ ধরনের ভােগ্য সামগ্রী সমাজের বহু শ্রেণী ও গােষ্ঠীর মনকে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে। প্রতিদান হিসাবেও এ ধরনের দ্রব্যসামগ্রী অনেকের কাছে সর্বোত্তম বিবেচিত হয়। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে কাদের কি অভিরুচি, কাদের কাছে কি বেশী প্রিয়, কার মন-মানসিকতার সাথে কোন দ্রব্য সামগ্রী বেশী উপযােগী ও মানানসই, তা তিনিই ভালাে জানেন। তাঁর বান্দাদের মধ্যে আবার অনেকে এমনও আছে, যাদের কাছে ভুল ভােগ্য সামগ্রীর চেয়ে উন্নতমানের প্রতিদান বেশী আকর্ষণীয়। যেমন সূরা আল কিয়ামায় আছে, ‘কিছু মুখমন্ডল সেদিন প্রফুল্ল থাকবে এবং তারা আপন প্রভুর দিকে তাকিয়ে থাকবে।’ এবার আমি সূরাটির তাফসীরে মনােনিবেশ করবাে।

ফী জিলালিল কুরআন: সূরার শুরুতেই রয়েছে একটি প্রশ্নবােধক বাক্য, ‘মানুষের ওপর কি মহাকালের এমন একটি সময়ও অতিবাহিত হয়েছে, যখন সে কোনাে উল্লেখযােগ্য জিনিসই ছিলাে না?’ এর উত্তরটি হাঁ বােধক। অর্থাৎ হাঁ এমন সময় অতিবাহিত হয়েছে। তবে এখানে প্রশ্নটি উত্থাপনের উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করুক যে, এমন একটি সময় তার ওপর অতিবাহিত হয়েছে-তা কি সে জানে যে, সে তখন আদৌ কোনাে উল্লেখযােগ্য বিষয়ই ছিলাে না! তারপরও এই ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে কি সে কিছু চিন্তা-ভাবনা করে না? আর যদি চিন্তা-ভাবনা করে থাকে তবে তার চিন্তা-ভাবনা কি তার মনে সেই অদৃশ্য হাত সম্পর্কে কিছুমাত্র অনুভূতি সঞ্চার করে না, যা তাকে এই অস্তিত্বের জগতে ঠেলে পাঠিয়েছে, না চাইতে তাকে জ্ঞানের আলাে বিতরণ করেছে এবং এক সময় অনুল্লেখযােগ্য থাকার পর তাকে উল্লেখযােগ্য জিনিসে পরিণত করেছে। এভাবে এই প্রশ্নবােধক বাক্যটি দ্বারা অনেক গভীর ও সূক্ষ্ম ভাবনার জন্ম দেয়া হয়েছে,  *অস্তিত্ববিহীনতা থেকে মানুষের অস্তিত্ব : প্রথম ভাবনাটি হলাে মানুষের সৃষ্টির পূর্ববর্তী অবস্থা এবং তার আদি অস্তিত্ব সংক্রান্ত। তার সেই আদি সত্তা মানবশূন্য প্রকৃতির মধ্যেই অবস্থান করছিলাে। তখন সে কেমন ছিলাে? যুগ যুগ কালধরে সে অন্য কোথাও অবস্থান করছিলাে, আজ তা সে ভুলে গেছে। আসলে মানুষ নামের এই প্রাণীটির জন্যে বিশ্ব প্রকৃতির কোনাে প্রত্যাশা বা প্রতীক্ষাই ছিলাে না। শুধু আল্লাহর ইচ্ছাতেই এখানে তার জন্ম হয়েছে। অপর ভাবনাটি মানুষের উৎপত্তির লগ্ন সংক্রান্ত। যদিও এই মুহূর্তটির কথা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না, তথাপি ভাবনাটি এই সময়টিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টিজগতে এই সৃষ্টির যে সংযােজন সম্পন্ন করেন, তার পরিকল্পনা তিনি করেন তারও অনেক আগে। অপর ভাবনাটি হলাে স্রষ্টার সেই মহাশক্তিধর ক্ষমতা সংক্রান্ত, যা মানুষ নামের এই সৃষ্টিকে প্রকৃতির এই নাট্যমঞ্চে জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেয়, তাকে তার ভূমিকা পালনের যােগ্য বানায়, তার জন্যে যথাযথ ময়দান তৈরী করে, সমগ্র সৃষ্টিজগতের সাথে তার জীবনের যােগসূত্র গড়ে তােলে, তার স্থীতি ও ভূমিকা পালন সম্ভব ও সহজ হয় এমন এক পরিবেশ তার জন্যে গড়ে তােলে, তারপর প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর সেই ভূমিকা অব্যাহত রাখার ক্ষমতা যোগায় এবং সেই সাথে সমগ্র মহাবিশ্বের সাথে তার যােগসূত্রকে অটুট রাখে। এছাড়াও এই প্রাথমিক আয়াতটি মানুষের বিবেকে আরাে অনেক চিন্তা-ভাবনা ও | আত্মজিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। মানুষের জন্মের উৎস, পার্থিব জীবন ও তার চুড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে তাকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর আসে জন্মের পর মানুষের স্থীতি ও প্রজাতিক বিস্তৃতির প্রসংগ। এর পেছনে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক কাহিনী! সূরার দ্বিতীয় আয়াতে এই কাহিনী শুনুন, ‘আমি মানুষকে মিশ্রিত বীর্য থেকে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি, অতপর তাকে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণ শক্তিসম্পন্ন করেছি।’ ‘আমশাজ’ শব্দটির অর্থ মিশ্রিত। সম্ভবত এ দ্বারা এই মর্মে ইংগিত করা হয়েছে যে, যে বীর্য দ্বারা মানুষ সৃষ্টি হয় তা জরায়ুতে প্রবিষ্ট বীর্যের পুরুষ কোষ ও নারী ডিম্বানুর মিশ্রণের পরেই তৈরী হয়। এ দ্বারা বীর্যের ভেতরে নিহিত পরবর্তী প্রজন্ম ও উত্তরাধিকারের বিষয়টিও বুঝানাে হয়ে থাকতে পারে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এরই নাম হচ্ছে ‘জিন’। প্রথমত প্রজাতিক ধারায় হস্তান্তরিত মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টসমূহকে এবং সর্বশেষে গর্ভস্থ সন্তানের পারিবারিক বৈশিষ্টসমূহকে ‘জিন’ বলা হয়ে থাকে। মানুষের বীর্য তার ধারাবাহিক পথ পরিক্রমা অতিক্রম করে অন্য কোনাে প্রাণীর নয় বরং মানুষের সন্তান তৈরীর লক্ষেই এগিয়ে যায় এবং মানব সন্তানের মধ্যে তার পারিবারিক গুণাবলীরই বিকাশ ঘটায়, ‘মিশ্রিত বীর্য’ বা ‘জিন কথাটা সম্ভবত সেই সত্যটিই প্রকাশ করে। অবশ্য এই ‘মিশ্রিত বীর্য’ নিজেও বিভিন্ন উত্তরাধিকারের এক মিলন কেন্দ্র।   *মানুষকে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি দানের কারণ : অসীম শক্তিধর স্রষ্টা এভাবে মিশ্রিত বীর্য থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। নিছক তামাসাচ্ছলে বা উদ্দেশ্যহীনভাবে নয়, বরং তাকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও আল্লাহ তায়ালা ভালােভাবেই জানেন, মানুষ কেমন সৃষ্টি এবং তাকে পরীক্ষা করার ফলাফলই বা কী হবে। কিন্তু তিনি চান, সেই ফলাফলটা প্রকৃতির নাট্যমঞ্চে এসে প্রকাশ পাক, সৃষ্টির সমগ্র অবকাঠামােতে তার সেই পরীক্ষার পরিকল্পিত প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হােক এবং তার পরবর্তী পরিকল্পিত প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ পাক। অতপর তিনি তার পরীক্ষার এই সমস্ত পর্যায়ক্রমিক ফলাফল অনুসারে তাকে প্রতিদান দিতে চান। এ কারণেই তিনি মানুষকে দৃষ্টি শক্তি ও শ্রবণ শক্তিসম্পন্ন করেছেন। অর্থাৎ তাকে বুঝবার ও উপলব্ধি করার প্রয়ােজনীয় সকল উপায় উপকরণ ও হাতিয়ার দান করেছেন, যাতে সে প্রয়ােজনীয় প্রাথমিক তথ্য আহরণ করতে পারে, বিভিন্ন জিনিসের মূল্যমান বুঝতে পারে, সেসব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সর্বোপরি একটি নির্দিষ্ট জিনিস বা পথ বেছে নিতে পারে এবং সে বাছাই অনুসারে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে। সুতরাং মানুষের সৃষ্টি, তার অব্যাহত প্রজাতির বিস্তার, তাকে তার প্রয়ােজনীয় উপায় উপকরণ তথা অংগ প্রত্যংগ ও শক্তি সামর্থ্য ইত্যাদিতে আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকর রয়েছে। মিশ্রিত বীর্য থেকে সৃষ্টি করার পেছনেও আল্লাহর যে ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত সক্রিয় রয়েছে, তার পেছনে মহৎ উদ্দেশ্য, সূক্ষ্ম প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিহিত রয়েছে। এ কাজ নেহাৎ কোনাে তামাসা নয়। এ সৃষ্টিতে আগে থেকেই তাকে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা ছিলাে। সে জন্যেই তাকে তথ্য আহরণ, জ্ঞান অর্জন ও ভালােমন্দ বাছাই করার ক্ষমতা প্রদান করেছেন। প্রথমে মানুষকে সৃষ্টি করা, অতপর তাকে নানা রকমের জ্ঞানার্জন ও উপলব্ধি দান করা, উপায় উপকরণে সজ্জিত করা ও বাস্তব জীবনে পরীক্ষার সম্মুখীন করা এই সব কয়টি কাজের প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিতভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছে। জ্ঞান দানের পর তাকে জীবন যাপনের পথ নির্ধারনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং কোন পথটি সঠিক ও অভ্রান্ত গন্তব্যে পৌছে দিতে পারে তাও বলে দেয়া হয়েছে। তারপর তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, এখন চাই সে সেই নির্ভুল পথ গ্রহণ করুক অথবা ভ্রান্ত পথ গ্রহণ করে বিপথগামী হয়ে যাক, এটা তার ব্যাপার আল্লাহ তায়ালা সেই কথাই বলছেন পরবর্তী আয়াতে, ‘আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি, চাই সে কৃতজ্ঞ হােক বা অকৃতজ্ঞ’ ‘শাকুরা’ শব্দটি দ্বারা একটি সার্বিক ভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। কারণ যে ব্যক্তি সঠিক পথের সন্ধান চায় এবং একথাও জানে যে, একদিন সে এই পৃথিবীতে আদৌ কোনাে উল্লেখযােগ্য জিনিসই ছিলাে না, পরে তার প্রভু তাকে উল্লেখযােগ্য সৃষ্টি হিসাবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তাকে দৃষ্টি শক্তি ও শ্রবণ শক্তি দিয়েছেন, তারপর তাকে জানার ও বুঝার ক্ষমতা দিয়েছেন, অতপর তাকে যে কোনাে একটি পথ গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন, সে ব্যক্তির হৃদয় এসব কথা জানার পর স্বতস্ফূর্তভাবেই আপন প্রভুর কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠবে এবং তার দেখানাে নির্ভুল পথটিতে বেছে নেয়ার পক্ষেই তার মন সাড়া দেবে। এই কৃতজ্ঞতার কথা যদি সে গ্রহণ না করে তা হলে বুঝতে হবে যে, সে চরম অকৃতজ্ঞ। বিবেকের ওপর পরপর উক্ত তিনটি মৃদু পরশ বুলানাের উদ্দেশ্য হলাে যাতে মানুষ কোরআনের দাওয়াতের গুরুত্ব ও তীক্ষ্ণতা উপলব্ধি করতে পারে। সে বুঝতে পারে যে, সে কোনাে উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি নয়; বরং তার সৃষ্টির পেছনে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রয়েছে। সে এও বুঝতে পারে যে, সে কোনাে বন্ধনমুক্ত সৃষ্টি নয় বরং মহাবিশ্বের এক নির্দিষ্ট কেন্দ্রের সাথে তার যােগসূত্র রয়েছে, আর তাকে সকল প্রয়ােজনীয় জ্ঞান দান করা হয়েছে, সেই জ্ঞানের আলােকে তাকে নিজের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। পৃথিবীতে তাকে পরীক্ষা দিতে ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই পাঠানাে হয়েছে। সুতরাং পৃথিবীকে সে একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবেই দেখতে পায়। তাই এ তিনটি আয়াত থেকে সে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু চিন্তার খোরাক লাভ করে। দুনিয়ার জীবনকে সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জবাবদিহিতায় পরিপূর্ণ দেখতে পায়। পার্থিব জীবনকে পরীক্ষায় পরিপূর্ণ জীবন হিসাবে উপলব্ধি করার পর সে এখানকার পরীক্ষাসমূহের কি ফলাফল পরবর্তী জীবনে পাবে, সে সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক হয়।

সুরা: আদ-দাহর
আয়াত নং :-৪

اِنَّاۤ اَعْتَدْنَا لِلْكٰفِرِیْنَ سَلٰسِلَاۡ وَ اَغْلٰلًا وَّ سَعِیْرًا

আমি কাফেরদের জন্য শিকল, বেড়ি এবং জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি।

ফী জিলালিল কুরআন:

প্রথম তিনটি ক্ষুদ্র আয়াত তার দৃষ্টিকে তার সৃষ্টির লক্ষ্য পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে, এর মূল্যবােধ সম্পর্কে তার মনে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তােলে। এ জন্যে পরীক্ষা তথা কৃতজ্ঞতা অথবা অকৃতজ্ঞতার পথ অবলম্বন করার পর মানুষের জন্যে কি পরিণতি অপেক্ষা করছে, তার বিবরণ এ আয়াত থেকে দেয়া শুরু হয়েছে। অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞের জন্যে যে, অশুভ পরিণতি অপেক্ষা করছে তার বিবরণ খুবই সংক্ষেপে দেয়া হয়েছে। কেননা দৃশ্য রূপায়ন ও প্রভাব সৃষ্টি উভয়দিক দিয়েই এ সূরার সাধারণ পরিবেশ কোমলতা এবং আনন্দদায়ক নেয়ামতসমূহের বিবরণ সমৃদ্ধ। আযাবের বিবরণ যেটুকু এসেছে তা সংক্ষিপ্ত ইশারা ইংগিতের চেয়ে বেশী কিছু নয়। যেমন, ‘আমি কাফেরদের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছি জিঞ্জির হাতকড়া ও জ্বলন্ত আগুন।’ অর্থাৎ পায়ে দেয়ার জন্যে শিকল, হাতে পরানাের জন্যে হাতকড়া থাকবে এবং হাত পা বাঁধা এই অপরাধীদেরকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:   *বেহেশতের কিছু বর্ণনা : এতটুকু বলেই দ্রুত গতিতে পুনরায় বেহেশতের সুখের বর্ণনা দেয়া শুরু হয়েছে, ‘পুন্যবান লােকের কর্পুর সুরভিত পেয়ালা থেকে শরাব পান করবে। সেটি হবে এমন এক প্রবহমান ঝর্না, যার কিনারে আল্লাহর বান্দারা শরাব পান করবে এবং যেখানে যেমন খুশী, ঝর্নার শাখা-প্রশাখা তারা বের করে নেবে।’ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, বেহেশতবাসী পূন্যবানদের পানীয় কর্পুর মিশ্রিত থাকবে, আর যে পেয়ালায় তারা পান করবে, তা ঝর্না থেকে ভরে দেয়া হবে। সেই ঝর্নার শাখা প্রশাখা সর্বত্র বিস্তৃত হবে, যাতে পানীয়ের প্রাচুর্য ও সরবরাহ অব্যাহত থাকে। স্বাদ বাড়ানাের জন্যে আরবরা তাদের মদের সাথে কখনাে কর্পূর এবং কখনাে আদা মেশাতাে। এ আয়াত থেকে তারা জানতে পারলাে যে, বেহেশতে কর্পুর মিশ্রিত পানীয় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাবে। এই পানীয়ের মান যে দুনিয়ার মদের চেয়ে অনেক উন্নত তাও বুঝা গেছে। এই পানীয়ের স্বাদ ক্রমেই বাড়তে থাকবে। অবশ্য পৃথিবীতে বসে আমরা সেখানকার খাদ্য ও পানীয়ের স্বাদ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারি না যে, তা কি ধরনের ও কি মানের। এখানে শুধু তার কাছাকাছি একটা ধারণা সৃষ্টি করে কিছু বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। কেননা আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, এই অদৃশ্য ও অজানা বস্তুর ধারণা লাভের জন্যে মানুষের কাছে এই শব্দগুলাে ছাড়া আর কোনাে বিকল্প নেই। প্রথম আয়াতে বেহেশতবাসীদেরকে আবরার (পুন্যবান) ও দ্বিতীয় আয়াতে আবদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোথাও আপন করে নেয়া, সম্মান প্রদর্শন করা ও অনুগ্রহ বর্ষণের কথা ঘােষণা করা, আবার কোথাও আল্লাহর নৈকট্যের ও ঘনিষ্টতার কথা ব্যক্ত করা। যেখানে সম্মান প্রদর্শন ও নেয়ামতের প্রাচুর্যের উল্লেখ থাকে সেখানে শেষােক্ত উদ্দেশ্যই ব্যক্ত হয়ে থাকে।

ফী জিলালিল কুরআন:   *পুণ্যবানদের পরিচয় : পরবর্তী আয়াতে এসব পূন্যবান বান্দাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে, তারা মান্নত পূরন করে এবং সেই দিনকে ভয় করে যার বিপদ সর্বত্র বিস্তৃত হবে এবং খাদ্যের প্রতি নিজেদের দুর্বলতা সত্তেও এতীম ও বন্দীকে আহার করায়, (আর বলে যে) আমরা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেও তােমাদেরকে খাওয়াচ্ছি। এ জন্যে তােমাদের কাছ থেকে কোনাে প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চাই না। আমরা শুধু আমাদের প্রভুর প্রতি সেই দিনের আযাবের ভয়ে ভীত, যেদিন কঠিন বিপদের দিন অতিশয় দীর্ঘ হবে। নির্ভেজাল ইসলামী আকীদা ও ঈমানে উদ্বুদ্ধ আল্লাহর যে বান্দারা আল্লাহর প্রতি অবিচল আনুগত্যের প্রমাণ দিতে গিয়ে আল্লাহর দুর্বল বান্দাদের প্রতি করুণা ও বদান্যতা প্রদর্শন করে, নিজেদের প্রয়ােজনের চেয়ে অন্যদের প্রয়ােজনকে অগ্রাধিকার দেয়, তারা সফল। যারা যথার্থ আল্লাহভীতির প্রমাণ দেয়, তার সন্তোষ কামনা করে, আর আল্লাহর আযাবের ভয়ে পাপ কাজ থেকে দূরে থাকে, কঠিন দায়িত্ব ও কর্তব্যকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করে, সেই বান্দাদের মন কত উজ্জ্বল, স্বচ্ছ ও নির্মল হয়ে থাকে, তা এই আয়াতগুলাে থেকে প্রতিভাত হয়। ‘তারা মান্নত পূরণ করে।’ অর্থাৎ যে সৎ কাজের সংকল্প গ্রহণ করে সেগুলােকে তারা তারা যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই গ্রহণ করে, কোনাে রকম ফাঁকি দেয় না বা গড়িমসি করে না এবং সেই দায়িত্বের দাবীকে অস্বীকার করে। এটাই মান্নত পুরণের তাৎপর্য। মান্নত শব্দটির প্রচলিত অর্থের তুলনায় এই অর্থটি অপেক্ষাকৃত ব্যাপক। ‘এবং সেই দিনকে ভয় করে যার ভয় সর্বত্র বিস্তৃত হবে।’ অর্থাৎ তারা এই দিনের স্বরূপ উপলব্ধি করে। এ দিনের বিপদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে এবং গুনাহগারদেরকে তা আক্রান্ত করবে। তাই তারা আশংকা করে যে, এর বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়ার কিছু অংশ তাদের ওপরও আপতিত হতে পারে। এটা হচ্ছে মােত্তাকী বা আল্লাহভীরু লােকদের আলামত। তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে এত সচেতন ও স্পর্শকাতর হয়ে থাকে যে, শত এবাদাত ও পূন্যের কাজ করা সত্তেও তাদের গুরুদায়িত্বে কোনাে ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকে গেলাে কিনা, তা নিয়ে তারা সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকে। নিজেরা খাদ্যকে ভালােবাসা সত্তেও তারা এতীম, মিসকীন ও বন্দীকে আহার করায়। নিজের খাদ্যের অভাব ও প্রয়ােজন থাকার কারণে খাদ্যের প্রতি মনের স্বাভাবিক ভালােবাসা থাকা সত্তেও অন্যকে খাবার খাওয়ানোর মধ্যে অন্যের প্রতি সহানুভূতি এবং সেবা ও কল্যাণের মনােবৃত্তির যে প্রকাশ পাওয়া যায়, তা এ আয়াতে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ ধরনের লােকদের সম্পর্কে সাধারণভাবে এ কথা বলা হয় যে, বিভিন্ন পর্যায়ের অভাবী লােকদেরকে তারা যে খাবার খাওয়ায়, তার প্রতি তাদের নিজেদেরও মনের টান আছে। এ খাদ্যের তারাও মুখাপেক্ষী হয়। কিন্তু নিজেদের প্রয়ােজনের ওপরে তারা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র লােকদের প্রয়ােজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, আয়াতে একথাই বুঝানাে হয়েছে। মক্কায় মােশরেকদের সমাজে এক অবর্ণনীয় হৃদয়হীন পরিবেশ বিরাজ করতাে। সেখানে দুর্বল ও দরিদ্র মানুষের জন্যে কোনাে কল্যাণের ব্যবস্থাই ছিলাে না। সেই সমাজের মােড়লরা অবশ্য লােক দেখানাে এবং সুনামের খাতিরে অনেক বদান্যতা দেখাতাে। কিন্তু আল্লাহর সৎ মােমেন বান্দারা ছিলাে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা ছিলাে সকল দুঃখী ও আর্তমানুষের জন্যে হিংসা বিদ্বেষে পরিপূর্ণ মরু ভূমিতে ছায়াশীতল মরুদ্যান স্বরূপ। তারা পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও দরদভরা মন নিয়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে গরীব দুঃখীদের আহার করাতাে। এই সুরার আয়াতে তাদের মনের কথার যথার্থ প্রতিধ্বনি করে বলা হয়েছে আমরা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির খাতিরেই তােমাদেরকে খাওয়াচ্ছি। তােমাদের কাছ থেকে কোনাে প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা পাওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা তাে শুধু সেই দিনের ভয়ে ভীত, যে কঠিন বিপদের দিন হবে অতিশয় দীর্ঘ। বস্তুত এ হচ্ছে এমন এক দুর্লভ দয়ালু মানসিকতা, যা অত্যন্ত কোমল ও বন্ধুসূলভ হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে। এ দয়া শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই কামনা করে। তাছাড়া আর কারাে কৃতজ্ঞতা বা আর কোনাে প্রতিদান চায় না। দরিদ্র লােকদের ওপর আধিপত্য বিস্তারেরও স্বপ্ন দেখে না, কিংবা অহংকারী হবারও দুরাশা পােষণ করে না। শুধুমাত্র আখেরাতের আযাব থেকে রক্ষা পাওয়া ছাড়া আর কিছুই তারা আশা করে না। রসূল(স.) একটি হাদীস দ্বারা এ ব্যাপারে তাঁর সাথীদের উৎসাহিত করেছেন। হাদীসটি হলাে, একটি খােরমার অংশ বিশেষ দিয়ে হলেও তােমরা আগুন থেকে বাচো। এরূপ প্রত্যক্ষভাবে খাবার খাওয়ানাে মনের এই দয়া ও কোমলতা প্রকাশের একটি মাধ্যম ছিলাে। এটি ছিলাে দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সৌহার্দ্য প্রকাশ ও তাদের প্রয়ােজন পুরনের একটা বিশেষ পন্থা। তবে পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুসারে এই অনুগ্রহ ও দয়া প্রদর্শনের মাধ্যম ও পন্থার পরিবর্তন হতে পারে। তবে যে জিনিসটা সব সমাজের জন্যে অপরিবর্তিত থাকা প্রয়ােজন তা হলাে মনের এই কোমলতা, দয়ার্দ্রতা, স্পর্শকাতরতা, সহানুভূতিশীলতা, আল্লাহর সন্তুষ্টির খাতিরে মানবতার প্রতি সেবার মনােভাব এবং পার্থিব লাভ বা অন্য কোনাে স্বার্থ মুক্ত হয়ে জনসেবার আকাংখা। আজকাল দেশে দেশে দুর্গত মানুষের সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার নামে বিভিন্ন রকমের কর আদায় করা হয়ে থাকে এবং এভাবে জনগণের ওপর অনেক দায়িত্বের বােঝা চাপানাে হয়। কিন্তু এসব ব্যবস্থা দ্বারা আলােচ্য আয়াতসমূহে যে ইসলামী বিধানের উল্লেখ করা হয়েছে, তার একটি অংশ পূরণ হয় মাত্র। ইসলামের এই বিধানটি যাকাত বিধানের অংগীভূত। এই অংশটি হলাে দুর্গত মানুষের সেবা বা অভাব পূরণ। এ হলাে এর একটি দিক বা অংশ, অপর অংশটি হলো দাতাদের আত্মার বিশুদ্ধি করণ এবং তার সঠিক উন্নয়ন। এটি এমন একটি বিষয় যাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করার কোনাে অবকাশ নেই। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আজ এই দ্বিতীয় অংশটিকে শুধু অবজ্ঞা ও অবহেলাই করাই হচ্ছে না, বরং তা বিকৃত করে বলা হচ্ছে যে, এটা না করলে নাকি গ্রহীতাদের অবমাননা ও দাতাদের দানের উৎসাহ নষ্ট হবে। মনে রাখা দরকার যে, ইসলাম একদিকে যেমন আমাদের বিবেক ও মনের জন্যে কিছু আকীদা বিশ্বাস মনোনীত করে, অপরদিকে এই মনকে পরিশীলিত করার জন্যে একটা ব্যবস্থাও পেশ করে। স্বার্থমুক্ত, নির্মল ও মহানুভবতাপূর্ণ দয়া ও সহানুভূতি যেমন দাতাকে কলুষমুক্ত ও পরিশীলিত করে, তেমনি যে ভাইকে সে দান করে তারও এতে প্রভুত উপকার সাধন করে। এটি ইসলামের কাংখিত দানশীলতার উভয় দিক এবং উভয় অংশই পূরণ করে। এই নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ দানের চিত্রই উপরােক্ত আয়াতে অংকন করা হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, তাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সেই দিনের বিপদ থেকে রেহাই দিলেন এবং তাদেরকে আনন্দ ও প্রফুল্লতা দান করলেন। কোরআন এখানে আখেরাতের অন্যান্য দিকের উল্লেখের আগে অতি দ্রুত কেয়ামতের বিপদ থেকে উদ্ধারের সুসংবাদ দিয়ে এই পুণ্যবান বান্দাদেরকে সান্তনা দিচ্ছে। কেননা তারা যখন এই কোরআন শুনতাে ও বিশ্বাস করতাে, তখন তাদের মনে কেয়ামতের ব্যাপারে আতংক সৃষ্টি হতাে, তাই এখানে তাদেরকে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে যে, তােমাদের সেই দুর্বিসহ দীর্ঘ কেয়ামতের ভয়ে অস্থির হতে হবে না, তােমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা আনন্দ ও প্রফুল্লতা দান করবেন। এটা তােমাদের আখেরাত ভীতির যথার্থ পুরস্কার এবং হৃদয়ের কোমলতা ও দয়ার্দ্রতার প্রতিদান।

ফী জিলালিল কুরআন:   *বেহেশতের অপরিসীম নেয়ামত : এরপর তাদের জন্যে বেহেশতের নেয়ামতসমূহের বিবরণ দেয়া হয়েছে, তাদের ধৈর্ষের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বেহেশত ও রেশমী বস্ত্র প্রদান করবেন।’ বসবাসের জন্যে হচ্ছে বেহেশত এবং পরিধানের জন্যে হচ্ছে রেশমী বন্ত্ৰ। সেখানে তারা বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকবে, তারা না দেখবে সেখানে রৌদ্র, আর না দেখবে কোনাে মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা। এ থেকে বুঝা গেলাে যে, বেহেশতে অতিশয় শান্ত, সুখময়, নিরুদ্বেগ, কোমল, সৌহার্দময় ও নাতিশীতােষ্ণ পরিবেশ বিরাজ করবে। অন্যকথায় বলা যায়, সেটি হবে একটি আলাদা জগত তাতে আমাদের আজকের এই সূর্য কিংবা অন্য কোনাে এক বা একাধিক সূর্যের অস্তিত্ব থাকবে । সেই জগত সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট। বেহেশতের ছায়া তাদের ওপর অবনত হয়ে থাকবে এবং তার ফলসমূহ সব সময় তাদের আওতাধীন থাকবে। ছায়া অবনত হয়ে থাকা এবং ফলসমূহ নিজের আয়ত্তাধীন থাকা এমন এক সুখময় পরিবেশের চিত্র তুলে ধরে, যার চেয়ে সুখময় পরিবেশ এখানে বসে কল্পনা করা যায় না। এই হচ্ছে আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য পুরস্কার হিসাবে বরাদ্দকৃত বেহেশতের একটি সাধারণ রূপরেখা। দুনিয়ার প্রচলিত ভাষায় এর চমকপ্রদ একটি বিবরণ ওপরের আয়াতগুলােতে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর আসছে সেখানকার নিত্য উপভােগ্য নেয়ামত ও সেবার বিবরণ, তাদের সম্মুখে রূপার তৈরী পাত্র ও কাঁচের পেয়ালা ঘােরানাে হবে। সেই কাচ হবে রূপা জাতীয় এবং সেগুলোকে (বেহেশতের ব্যবস্থাপকরা) পরিমানমতাে ভরে রাখবে। তাদেরকে সেখানে এমন শুরা পান করানাে হবে, যাতে আদা মিশ্রিত থাকবে। সেটি হবে জান্নাতের একটি ঝর্ণা, যাকে ‘সালসাবীল’ বলা হয়। এভাবে তারা সুখভােগে মত্ত থাকবে। নিবীড় ছায়ার মধ্যে ফলমূল এবং বিলাস সামগ্রীর সমাহার। এই পরিবেশে তারা বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকবে। তদুপরি রূপার তৈরী পাত্র ও পেয়ালা ডর্তি শরাব তাদের সামনে দিয়ে ঘােরানাে হবে। এই পেয়ালাগুলাে রূপার হলেও কাচের মত স্বচ্ছ হবে, যা পৃথিবীতে অকল্পনীয়। আর এগুলাের আকৃতি ও পরিমিত সৌন্দর্যে তা হবে মনােরম এবং ভােগেও হবে তা অপূর্ব। আবার সেই পানীয় হবে আদা মিশ্রিত, মাঝে মাঝে এটা কর্পূর মিশ্রিতও হবে বলা হয়েছে। সালসাবীল নামক একটি সদা প্রবহমান ঝর্না থেকে তা পূর্ণ করা হবে। পানকারীদের জন্যে তৃপ্তিদায়ক হওয়ার কারণেই তা সালসাবীল নামে আখ্যায়িত হবে। এই পানীয় সরবরাহটা আরো বেশী উপভােগ্য হবে এ জন্যে যে, যারা এসব পাত্র ও পেয়ালা নিয়ে ঘুরবে, তারা হবে উজ্জ্বল চেহারাধারী কিশাের, যাদের চেহারায় কখনােই বয়সের ছাপ পড়বে না। তাই তারা হবে চির কিশাের ও চির উজ্জ্বল। তাদেরকে এখানে সেখানে ছড়ানাে ছিটানাে কতিপয় মুক্তার দানার মতাে মনে হবে, তাদের সেবাকার্যে ছুটাছুটি করতে থাকবে এমন সব বালক যারা চিরকাল বালকই থাকবে। তুমি তাদেরকে দেখলে মনে করবে, তারা যেন কিছু ছড়ানাে ছিটানাে মুক্তা। এরপর সেখানকার বিরাজমান পরিবেশের ওপর হৃদয় ও চোখের প্রভাবকে বদ্ধমূল করার জন্যে তার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরা হচ্ছে, ‘সেখানে যেদিকেই তুমি তাকাবে শুধু নেয়ামত আর নেয়ামতই দেখবে এবং (নেয়ামতের) একটি বিরাট সম্রাজ্য দেখতে পাবে।’ এই নেয়ামতে ভরপুর সম্রাজ্যটিই হচ্ছে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও সৎকর্মশীল বান্দাদের সাধারণ আবাস ভূমি। অতপর সেই নেয়ামত ও বিশালসম্রাজ্যের অগণিত বৈশিষ্টের মধ্য থেকে আরেকটি বৈশিষ্টের উল্লেখ করা হচ্ছে। এটাকে উপরোক্ত নেয়ামতপূর্ণ সম্রাজ্যের ব্যাখ্যা ও তার বিশ্লেষণ রূপে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তারা আবৃত থাকবে সূক্ষ্ম রেশমের সবুজ পােশাকে এবং মখমল কাপড়ে। তাদেরকে রূপার কংকন পরানাে হবে এবং তাদের প্রভু তাদেরকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন শরাব পান করাবেন। ‘সুনদুস’ হচ্ছে পাতলা রেশমের কাপড়, আর ইসতাবরাক হচ্ছে ভারী ও মােটা রেশমের কাপড়, যাকে মখমল বলা হয়। এই অপরূপ বেশভূষা ও বিলাস বহুল সাজসজ্জায় তারা স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই সজ্জিত হবে। মহান দাতার মহাদান বটে! এটা বেহেশতের অন্যান্য নেয়ামতের শােভা ও মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এর ওপর আরাে যুক্ত হবে মহাপ্রভুর আদর, স্নেহ ও সম্মান। ‘নিশ্চয়ই এসব তােমাদের যথােচিত প্রতিদান এবং তােমাদের চেষ্টা মর্যাদার সাথে গৃহীত হয়েছে।’ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এই ঘোষণা বেহেশতের সকল নেয়ামতের সমান মর্যাদা রাখে এবং সেগুলাের মানকে আরাে সমুন্নত করে। এভাবে পরকালীন জীবনের সেই বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত আল্লাহর সেই উদাত্ত আহ্বান সমাপ্ত হচ্ছে। এই উদাত্ত আহ্বান ছিলাে বেহেশতের অনুপম নেয়ামতের প্রতি। দোযখের দাউদাউ করা আগুন, শিকল ও বেড়ি থেকে আত্মরক্ষার প্রতি আহবান। মূলত এই হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুটো পথ। একটি পথ নিয়ে যায় জান্নাতের দিকে, অপরটি নিয়ে যায় দোযখের দিকে।

ফী জিলালিল কুরআন:   *ইসলামী আন্দোলনে কর্মীদের শিক্ষণীয় বিষয় : বেহেশত ও তার নেয়ামতের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানাের এই পর্ব সমাপ্ত হবার পর কোরআন এবার হটকারী, জেদী ও একগুয়ে মােশরেকদের প্রসংগ তুলছে, যারা আল্লাহর আহবানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে ও তার বিরুদ্ধাচরণ করতে বদ্ধ পরিকর। ইসলামের এই দাওয়াতের মর্ম উপলব্ধি না করে তারা তা নিয়ে রসূল(স.)-এর সাথে দরকষাকষি করতে উদ্যোগী হয়, যাতে করে তিনি এই দাওয়াতের কাজ হয় পুরােপুরি বাদ দেন, নচেত ইসলামের যে সব বিধান পালন করা মােশরেকদের জন্যে কষ্টকর সেগুলােকে শিথিল করে দেন। তারা একদিকে রসূল(স.)-এর সাথে এই দরকষাকষি, অন্যদিকে সাধারণ মােমেনদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে ইসলাম থেকে ফেরানাের চেষ্টা করতে থাকে, অন্যদেরকে এই দাওয়াত গ্রহণে বাধা দান করা এবং বেহেশত ও তার নেয়ামতকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকার এই পরিবেশ নিয়ে সূরার শেষাংশ নাযিল হয়। এতে কোরআন তার নিজস্ব ভংগীতে মােশারেকদের উক্ত পরস্পর বিরােধী ভূমিকার পর্যালোচনা করেছে, ‘মূলত আমি তােমার প্রতি এই কুরআন অল্প অল্প করে নাযিল করেছি। অতএব (এদের ব্যাপারেও) তুমি ধৈর্যের সাথে তােমার প্রভুর নিদের্শের অপেক্ষা করে। আর এদের মধ্যেকার পাপি ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের কথা কখনাে কখনাে শুনবে না। সকাল সন্ধ্যা তুমি তােমার মালিকের নাম স্মরণ করতে থাকো।’ উল্লেখিত চারটি আয়াতে ইসলামী দাওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিহিত রয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে ইসলামী দাওয়াতের পতাকাবাহী প্রত্যেক কর্মীর গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত এবং এর প্রধান প্রধান সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বিশ্বাসগত প্রতিক্রিয়াসমূহকে ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে উপলব্ধি করা উচিত। রসূল(স.) যদিও একমাত্র আল্লাহর এবাদাতের আহ্বান নিয়েই মােশরেকদের মুখােমুখী হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এর সাথে তাদের মন-মগযের একটা প্রতিকুল বিশ্বাসের মােকাবেলাও করেছেন। এই ব্যাপারটা ছিলাে আরাে ব্যাপক। প্রথম অর্থে তার কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ হতাে। কেননা পৌত্তলিকতার মত জটিল, পেচালাে, হেয়ালীপূর্ণ, দুর্বোধ্য ও ভংগুর ধরনের বিশ্বাস কখনাে এতটা শক্তিশালী ও মযবুত হতে পারে না যে, তা ইসলামের মতাে সহজ, স্বচ্ছ সরল মযবুত ও দৃঢ় আদর্শের মােকাবেলায় টিকে থাকতে পারে। বরং পৌত্তলিকতার বিশ্বাসকে ঘিরে এমন কিছু আনুসংগিক কায়েমী স্বার্থ নিহিত ছিলাে, যার তাগিদে পৌত্তলিকরা ইসলামের বিরুদ্ধে চরম প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলাে। পবিত্র কোরআনের একাধিক জায়গায় যেসব রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে তার একমাত্র উৎস ছিলাে এই আনুসংগিক কায়েমী স্বার্থ। পৌত্তলিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংশ্লিষ্ট বস্তুগত স্বার্থের ভিত্তিতে পৌত্তলিক সমাজে এক শ্রেণীর মানুষের যে সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জিত হয়েছিলাে, তাই-ই ছিলাে এই কায়েমী স্বার্থ । এই কায়েমী স্বার্থই ছিলাে শক্তিশালী ইসলামী আদর্শের মোকাবেলায় মিথ্যা ও অসার পৌত্তলিক বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে রাখার একটি প্রধান ও মূল কারণ। এর ধারকদেরকে আরাে অনমনীয় ও একগুয়ে করে তুলেছিলাে জাহেলিয়াতের বিভিন্ন রসম রেওয়াজ। এইসব ভােগবাদী জীবনাচার ও প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থকারী নানা রকমের দুষ্কর্মের লাগামহীন স্বাধীনতা এই পৌত্তলিক আকীদা-বিশ্বাসকে আরাে দৃঢ়তা ও শক্তি যুগিয়েছিলো। এসব উপকরণ ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ, সংঘর্ষ ও অস্বীকৃতির মনােভাবকে অনেকাংশেই জোরদার করে রেখেছিলাে। কারণ ইসলামের উন্নত নৈতিক মূল্যবােধ মানুষকে অবাধ যৌনাচার ও নীতি গর্হিত কাজের অনুমতি দেয় না। সামাজিক মর্যাদা ও মূল্যবােধ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি, অর্থ সম্পদ ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, এর সাথে সম্পৃক্ত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন আদত অভ্যাস, রসম রেওয়ায ঐতিহ্যগত রীতিপ্রথাও ছিলাে এক একটা বিরাট কারণ। এর সাথে সংশ্লিষ্ট নৈতিক মূল্যবােধ ও শৃংখলাহীনতা শুধু যে মুহাম্মদ(স.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত প্রথম ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছিলাে তাই নয়, বরং প্রত্যেক দেশে ও প্রত্যেক প্রজন্মে তা ইসলামী দাওয়াতের সাফল্যর পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বিপরীত আকীদা ও বিশ্বাসের সংঘাতের সব কয়টি উপকরণ ও কার্যকারণ ইসলাম ও জাহেলিয়াতের এই সংঘাতে সর্বদাই উপস্থিত থাকে এবং এর কারণে এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ও চরম হঠকারী সংঘাতে পরিণত হয়। এই দুঃসহ প্রাণান্তকর সংঘাত ইসলামী আকীদা ও আদর্শের ওপর অবিচল থাকা ও তার বিধিবিধান মেনে চলাকে কঠিন কাজে পরিণত করে দেয়।  *দ্বীনের দায়ীদের কর্তব্য : এ জন্যে ইসলামের দিকে আহ্বানকারী প্রত্যেক ব্যক্তিরই উচিত, উক্ত চারটি আয়াতে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ সময় চিন্তা-ভাবনা করা। যে প্রসংগে এ আয়াতগুলাে রসূল(স.)-এর ওপর নাযিল হয়েছিলাে তা গভীরভাবে পর্যালােচনা করা। কারণ তিনি যে দেশের ও যে যুগের মানুষই হােক না কেন তাকে ইসলামী আন্দোলনের গতিধারা অব্যাহত রাখার জন্যে এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা এগুলােই সংঘাতের উৎস এবং যুদ্ধের মূল কারণ। ইসলামী দাওয়াতের প্রত্যেক সৈনিককে প্রত্যেক ভুখন্ডে ও প্রত্যেক যুগে এর সম্মুখীন হতে হয়। ‘হে কম্বলাচ্ছাদিত, ওঠো এবং সাবধান করাে’ এই সম্বােধনের মাধ্যমে রসূল(স.) স্বীয় প্রতিপালকের পক্ষ থেকে মানব জাতিকে সতর্ক করার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভ করেন। যখনই তিনি এই দায়িত্ব পালনের উদ্যোগ নিলেন, অমনি নতুন দাওয়াতকে প্রতিরােধকারী এই উপকরণগুলাে তার সামনে এসে দাড়ালাে। এই উপকরণগুলাে আরববাসীকে নতুন দাওয়াত গ্রহণে বাধা দিতে লাগলাে এবং তাদের প্রচলিত আকীদা বিশ্বাসকে দূর্বল, বাসি ও অকেজো জানা সত্তেও তাকে তারা আঁকড়ে ধরতে উদ্বুদ্ধ করলাে। শুধু তাই নয় তাদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে চরম হঠকারী ভূমিকা গ্রহণ করা এবং নিজেদের ধ্যান-ধারণা, সামাজিক অবস্থা, মর্যাদা ও কায়েমী স্বার্থকে যে কোনাে মূল্যে টিকিয়ে রাখতে প্ররােচিত করলাে। তাদের প্রচলিত ও চিরাচরিত রীতিনীতি আমােদ-প্রমােদ ও যৌন সম্ভোগের লাগামহীন স্বাধীনতা দান করলাে, এক কথায় ইসলামের বিধান প্রচলিত যেসব রীতিনীতি ও চালচলনের ওপর আঘাত হানে তারা সেগুলাের দিকেই আহ্বান জানালাে। এই প্রবল সংরক্ষণ প্রচেষ্টা বিভিন্ন রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে লাগলাে। প্রথমেই তা এলাে নবাগত এই দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ঈমান আনয়নকারী মুষ্টিমেয় সংখ্যক মােমেনদেরকে নির্যাতন ও নিপীড়নের আকারে। হুমকি ধমকি ও অত্যাচারের মাধ্যমে তাদেরকে তাদের আকীদা ও আদর্শ থেকে ফেরানাের প্রচেষ্টা বিভিন্ন মিথ্যা অপবাদ ও বিভিন্ন উপায়ে এই আদর্শের ভাবমূর্তি ম্লান করা ও তার নবী(স.)-এর সুনাম ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করা, যাতে করে নতুন আর কোনাে লােক তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়। কেননা যারা নয়া আদর্শকে গ্রহণ করেছে ও তার মর্ম উপলব্ধি করেছে, তাদেরকে তা থেকে ফেরানাের চাইতে নতুন লােকদেরকে তা গ্রহণ থেকে ঠেকিয়ে রাখা ছিলাে সহজতর। এর সাথে তারা দাওয়াতের মূল নেতার কাছে গিয়েও হুমকি ও নির্যাতনের পাশাপাশি প্রলােভনের কৌশলও প্রয়ােগ করতে থাকে, যাতে তাকে একটা আপােষ রফায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাকে তাদের আকীদা, প্রচলিত অবস্থা ও ঐতিহাগত রীতিনীতির সমালােচনা থেকে বিরত রাখা যায়, সর্বোপরি উভয় পক্ষের গ্রহণযােগ্য কোনাে শর্তে তার সাথে একটা সন্ধি স্থাপন করা যায় কেননা প্রচলিত সমাজ রীতিতেও এরূপ রেওয়ায ছিলাে যে, সংশ্লিষ্ট স্বার্থে কিংবা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলাের স্বার্থ নিয়ে বিরােধ দেখা দিলে উভয় পক্ষের ছাড় দেয়ার মাধ্যমে একটা গ্রহণযােগ্য মধ্যম পথ অবলম্বন করা হতাে। এ ধরনের বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকুল পরিবেশের সম্মুখীন হওয়া যে কোন যুগের ও যে কোনাে দেশের ইসলামের আহবায়ক এর পক্ষেই সম্ভব। হযরত মুহাম্মদ(সা.) একজন রাসূল হওয়া সত্তেও এবং সকল গােমরাহী ও মানবসৃষ্ট বিপদ থেকে তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি থাকা সত্তেও যেহেতু তিনি একজন মানুষ ছিলেন, তাই মুষ্টিমেয় সংখ্যক দুর্বল মােমেনদেরকে সাথে নিয়ে এই কঠিন বাস্তবতার তিনি সম্মুখীন ছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তার এই বাস্তব অবস্থা জানার কারণে তাকে অসহায় অবস্থায় রেখে দেননি এবং পথের বাঁধা বন্ধন সম্পর্কে দিক নির্দেশনাহীন অবস্থায়ও ছেড়ে দেননি। বরং তাকে এই কঠিন পরিস্থিতি মােকাবেলার পন্থা অবহিত করেছেন। এই দিক নির্দেশনা ও সহায়তাই পরবর্তী আয়াতগুলাের আলােচ্য বিষয়। ‘আমি তােমার ওপর অল্প অল্প করে কোরআন নাযিল করেছি।’ এই দাওয়াতের দায়িত্ব কোথা থেকে এলাে এবং এর মূলমন্ত্রের উৎস কি, তা হচ্ছে এই বারটি আয়াতের প্রথম পর্বের বক্তব্য। এর মূলকথা এই যে, এ দাওয়াত হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। তিনিই এর একমাত্র উৎস। তিনিই এই দাওয়াতের বাণীসহ কোরআন নাযিল করেছেন। তিনি ছাড়া এর আর কোনাে উৎস নেই। এই উৎস থেকে উৎসারিত নয় এমন কোনাে জিনিস এর সাথে মিশতেও পারে না। এই উৎস ছাড়া আর কোনাে উৎস থেকে নেয়া কোনাে জিনিস দিয়ে এর সাথে জোড়াতালি দেয়াও সম্ভব নয়। আর আল্লাহ তায়ালা যখন এই কোরআন নাযিল করেছেন এবং ইসলামের দাওয়াত প্রচারের দায়িত্ব অর্পন করেছেন, তখন তিনি একে সাফল্য মন্ডিত না করে ছাড়বেন না। তিনি এর আহবায়ককেও অসহায় ছেড়ে দেবেন না। কারণ তিনিই তাকে এই দায়িত্ব অর্পন করেছেন এবং তিনিই তার ওপর কোরআন নাযিল করেছেন। কিন্তু তা সত্তেও বাতিল শক্তির বড়াই এবং অপশক্তির হুংকার ও আস্ফালন অব্যাহত থাকলাে। মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকলো। তাদেরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা চলতে লাগলাে। তাছাড়া আকীদা বিশ্বাস, সমাজ ব্যবস্থা, প্রচলিত রীতি প্রথা, সর্বাত্মক অরাজকতা ও অনাচারে তারা লিপ্ত ছিলো, তার ওপর জিদ ও একগুয়েমী ছিলােই, তদুপরি তারা আপােষ রফার মাধ্যমে মক্কা শহরকে দুই ভাগ করা এবং উভয় পক্ষের গ্রহণযােগ্য একটা মধ্যম পন্থা অবলম্বনের জন্য রাসূল(স.) কে চাপ দিতে লাগলাে। সেই কঠিন ও প্রাণান্তকর পরিস্থিতিতে এ ধরনের আপােষ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা ছিলাে আসলেই খুব কঠিন কাজ।  *ইসলামের বক্তব্য আপােষহীন : এই প্রেক্ষাপটেই দ্বিতীয় পর্বের বক্তব্য হাযির করা হয়েছে, ‘অতএব তুমি তােমার প্রভুর সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করাে এবং তাদের মধ্য থেকে কোনাে দুষ্কৃতিকারী বা অকৃতজ্ঞের কথা মেনে নিও না।’ অর্থাৎ সবকিছুই আল্লাহর পরিকল্পনার অধীন। তিনি বাতিল শক্তিকে এবং দুষ্কর্মপরায়নদেরকে সময় দেন । মােমেনদের পরীক্ষা, বিপদ মুসিবত ও যাচাই বাছাইর কাজটিকে একটু দীর্ঘস্থায়ী করেন। এর পেছনে এমন নিশুঢ় রহস্য ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে যা শুধু তিনিই জানেন। সেই বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরেই তিনি নিজের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। সুতরাং তার পরিকল্পিত ও নির্ধারিত সময় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাে। বিপদ মুসিবত এলেও ধৈর্যধারণ করাে। বাতিল জয়ী হয়ে যায় যাক, অপশক্তি হুংকার দিতে থাক তবুও ধৈর্যধারণ করো। যে মহাসত্য নিয়ে তােমার ওপর কোরআন নাযিল হয়েছে তার ওপর আরাে বেশী করে দৃঢ়তা অবলম্বন করাে। আকীদা-বিশ্বাসের প্রশ্নে যে আপােষের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাতে রাজী না হয়ে ধৈর্যধারণ করো। ‘তাদের মধ্য থেকে কোনাে দুর্নীতিপরায়ন ও অকৃতজ্ঞ লোকের কথা মেনে নিও না।’ অর্থাৎ তারা সকলেই পাপী, কাফের ও অকৃতজ্ঞ। তারা কোনাে সৎ কাজে বা কল্যাণের কাজে ডাকতে পারে না। তারা যখন আপােষের আহ্বান জানাবে তখন পাপ ও কুফরীর দিকেই আহ্বান জানাবে। তারা তােমার কাছে এমন প্রস্তাব দেবে, যা তােমার ভালাে লাগবে বলেই তাদের ধারণা। ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থাবলী সাক্ষী যে, রসূল(স.)-কে তারা ক্ষমতা, ধন সম্পদ ও রূপ যৌবনের লালসা দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলাে। তাকে উচ্চতর নেতা বানানাের প্রস্তাব দিয়েছিলাে। আবার বিকল্প হিসাবে তাকে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী বানিয়ে দেবে বলেও প্রলোভন দেখিয়েছিলো। দেশের সর্বাপেক্ষা সুন্দরী নারীকে তার সাথে বিয়ে দেয়ার টোপও তারা ফেলেছিলাে। ওতবা ইবনে রাবীয়া তাে এও বলেছিলাে যে, ‘এই ইসলামের দাওয়াতের কাজটা তুমি বাদ দাও, তােমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবাে। আর কোরায়শ বংশে আমার মেয়েদের মতাে সুন্দরী আর কারাে নেই।’ সাধারনত বাতিল শক্তি সর্বকালে ও সর্বদেশে ইসলামের দাওয়াত দাতাদেরকে খরিদ করার জন্যে এই কয়টি প্রলােভনের টোপই দিয়ে থাকে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতের মাধ্যমে রসূল(স.)-কে পরীক্ষার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের সাথে তােমার কোনাে আপােষ হতে পারে না। কেননা তাদের জীবনপদ্ধতি ও তােমার জীবনপদ্ধতির মাঝে বিস্তর ব্যাবধান রয়েছে। জীবন ও জগত সম্পর্কে তােমার চিন্তাধারা ও তাদের চিন্তাধরা, তােমার সত্য ও ন্যায়ের আদর্শে এবং তাদের বাতিল মতবাদে এবং তােমার ঈমান ও তাদের কুফরীতে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। তাছাড়া তোমার আলােতে ও তাদের অন্ধকারে এবং তােমার সত্য জ্ঞানে ও তাদের জাহেলিয়াতে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে, তা ঘুচাতে কোনাে পুল তৈরী করার অবকাশও নেই। তাই সময় ও পথ যতাে দীর্ঘই হােক এবং নির্যাতনের অগ্নী পরীক্ষা ও প্রলােভনের শক্তি যতাে কঠিন ও দুঃসহই হােক, তােমাকে ধৈর্যধারণ করেই যেতে হবে। কিন্তু ধৈর্যধারণ করা এত কঠিন কাজ যে, সাহায্য ও রসদ ছাড়া তা অসাধ্য, তাই সেই শক্তি ও রসদ সংগ্রহের উপায় নির্দেশ করা হচ্ছে সকাল সন্ধ্যায় তােমার প্রভুর নাম স্মরণ করাে। রাতেও তার জন্যে সেজদা করাে এবং দীর্ঘ রাতব্যাপী তার তাসবীহ করা। সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহকে স্মরণ করা এবং রাতে সেজদা ও তাসবীহ হচ্ছে এর রসদ। এর মাধ্যমেই সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে কোরআন নাযিলকারী ও দাওয়াতের দায়িত্ব অর্পনকারী উৎসের সাথে। তিনিই সকল শক্তি, সাহায্য ও রসদের উৎস। রাতব্যাপী যিকির, এবাদাত, দোয়া ও তাসবীহ’র মাধ্যমেই এই সংযোগ মযবুত হবে। রাস্তা অনেক দীর্ঘ। বােঝাও ভারী। তাই অনেক সাহায্য ও রসদের প্রয়ােজন। আল্লাহর সাথে বান্দার গােপন সাক্ষাতেই এই রসদ ও সাহায্য পাওয়ার পথ খুলে যাবে। এরূপ নিভৃত সাক্ষাতে যে ঘনিষ্টতা ও ভালােবাসা জন্মে তা সকল ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে দেয়। এই সাক্ষাতকারের মাধ্যমেই দাওয়াতী দায়িত্ব ও আমানতের বিশালত্ব উপলব্ধি করা যায়। ফলে পথের যাবতীয় বাধা ও বিপদ তার সামনে নিতান্ত ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হয়। আল্লাহ তায়ালা দয়ালু। তাই তাঁর বান্দা ও নবীকে যখন দাওয়াতের এই বিশাল কাজের দায়িত্ব দিলেন, তার ওপর কোরআনও নাযিল করলেন। এই পথের বাধা বিঘ্নও তার অজানা নয়, এ অবস্থায় তাকে তিনি বিনা সাহায্যে কিভাবে ছেড়ে দিতে পারেন। এ জন্যে এই সাহায্যকেই তিনি তার কন্টকাকীর্ণ পথের সবচেয়ে কার্যকর সাহায্য বলে বিবেচনা করেছেন। সর্বকালের ও সকল দেশের ইসলামী দাওয়াতের কর্মীদের জন্যে এটাই যথার্থ সাহায্য এবং কার্যকর রসদ। কেননা সর্বত্র ও সর্বকালে এটি হচ্ছে একই দাওয়াত এবং একই আন্দোলন। এর সমস্যা ও বাধা বিপত্তি সব সময় একই রকম এবং এর ব্যাপারে বাতিল শক্তির ভূমিকাও সব সময় ছিলাে একই রকম। এ ভূমিকার ধারাও এক। বাতিল শক্তি যে উপায় উপকরণ নিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে রুখে দাঁড়ায় তাও সর্বত্র এক। সুতরাং সত্যের সৈনিকদের জন্যে যে জিনিস আবহমান কাল ধরে কার্যকর শক্তি, হাতিয়ার ও রসদ হিসাবে আল্লাহর কাছে বিবেচিত-এখনও ঠিক সেগুলােই কার্যকর রয়েছে। সেই জিনিস-যা আল্লাহ তায়ালা এই দাওয়াতের প্রথম নিশানবাহী রসূল(স.)-কে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সে বিষয়টি এই যে, এই দাওয়াতের দায়িত্ব ও নির্দেশ সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। এ দাওয়াতের মালিক তিনিই। যে সত্য সহকারে এই দাওয়াতের আবির্ভাব ঘটেছে, তার সাথে কোনাে বাতিলের সংমিশ্রণ ঘটা সম্ভব নয়। তাই হক ও বাতিলের মধ্যে সহযােগিতার কোনাে পথ নেই।

সুরা: আদ-দাহর
আয়াত নং :-২৭

اِنَّ هٰۤؤُلَآءِ یُحِبُّوْنَ الْعَاجِلَةَ وَ یَذَرُوْنَ وَرَآءَهُمْ یَوْمًا ثَقِیْلًا

এসব লোক তো দ্রুত লাভ করা যায় এমন জিনিসকে (দুনিয়াকে) ভালবাসে এবং ভবিষ্যতে যে কঠিন দিন আসছে তাকে উপেক্ষা করে চলছে।

ফী জিলালিল কুরআন:

  *হক ও বাতিলের মধ্যে কোনাে আপােষ নেই : হকপন্থীদের সাথে বাতিলপন্থীদের কোনাে আপােষ কখনােই সম্ভব নয়। উভয়ের পথ সম্পূর্ণ আলাদা। কোথাও গিয়ে তা পরস্পরের সাথে মিলিত হয় না। মােমেনদের দুর্বলতা ও সংখ্যাস্বল্পতার সুযােগে এবং নিজের শক্তি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যখন বাতিলশক্তি মােমেনদের ওপর জয়ী হয় এবং আল্লাহ তায়ালা তার বিবেচনা অনুসারে কোনাে বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে তদ্রুপ অবস্থার উদ্ভব ঘটতে দেন, তখন আল্লাহর পরবর্তী ফয়সালা না আসা পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করাই মােমেনদের একমাত্র কর্তব্য। দোয়া ও তাসবীহর মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেই এই কঠিন সময়টি কাটিয়ে দিতে হবে। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামী দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিত সকলের এ বিষয়টি হৃদয়ংগম করা খুবই জরুরী। ইসলামী দাওয়াতের পতাকাবাহীদেরকে যে বিষয়টি ভালাে করে বুঝতে হবে তা অবিকল পরবর্তী আয়াতেও এই আলােচনা অব্যাহত রয়েছে যে, রসূল(স.) আনীত জীবন পদ্ধতি ও জাহেলিয়াতের জীবন পদ্ধতির মাঝে দুস্তর ব্যবধান রয়েছে। জাহেলিয়াতের জীবনপদ্ধতি সে পন্থীদের সত্য ও ন্যায়ের পথ এড়িয়ে চলাকে পূর্ণ সমর্থন দেয় এবং তাদের চিন্তাধারা ও মূল্যবােধের সমালােচনা করে, ‘তারা এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে অধিকতর ভালােবাসে এবং এরপর তাদের ওপর যে বিপদসংকুল দিনটি আসছে তাকে তারা অবহেলা করে।’ অর্থাৎ যাদের গন্তব্য অত্যন্ত কাছাকাছি এবং যাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অত্যন্ত তুচ্ছ ও নগণ্য, তারা এই দুনিয়াকে নিয়েই ডুবে থাকে এবং পরকালের ভয়াবহ সেই দিনকে উপেক্ষা করে, কোনাে ব্যাপারেই তাদের অনুকরণ ও অনুসরণের অবকাশ নেই! মােমেনদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে তাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কোনােই মিল নেই। এই দুনিয়ার জীবনের যে ধন সম্পদ ও ক্ষমতা প্রতাপের লােভে তারা লালায়িত, তার প্রতি মোমেনের আকৃষ্ট হওয়ার কোনাে কারণ নেই। কেননা তা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী ও তুচ্ছ সম্পদ। আর বাতিলপন্থীরা বড়ই অসহায়। বাতিলপন্থীরা যে আপন কল্যাণের ব্যাপারেও উদাসীন সে কথাও এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা ক্ষণস্থায়ী জীবনকে গ্রহণ করেছে এবং যেদিন কঠিন হিসাব কিতাবের পর তাদেরকে শেকল, বেড়ী ও আগুন দিয়ে সম্বর্ধনা জানানাে হবে-সেই দিনকে তারা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেছে। আয়াতটিতে রাসূল(স.) ও তার সাথী মােমেনদের মনােবল দৃঢ় করারও চেষ্টা করা হয়েছে। কেননা ক্ষনস্থায়ী পার্থিব জীবনের সকল কাংখিত বস্তুর প্রাচুর্যে যাদের জীবন ধন্য, তাদের মােকাবেলা করতে সুদৃঢ় মনােবলের প্রয়ােজন। তবে এতে পরকালের বিপদসংকুল দিকের উল্লেখ করার মাধ্যমে ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ সম্ভোগে ও ভােগবিলাসে মাতােয়ারা লােকদের প্রতি পরােক্ষ হুমকি এবং হুঁশিয়ারীও দেয়া হয়েছে।

সুরা: আদ-দাহর
আয়াত নং :-২৮

نَحْنُ خَلَقْنٰهُمْ وَ شَدَدْنَاۤ اَسْرَهُمْ١ۚ وَ اِذَا شِئْنَا بَدَّلْنَاۤ اَمْثَالَهُمْ تَبْدِیْلًا

আমিই এদের সৃষ্টি করেছি এবং এদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সন্ধিস্থল মজবুত করেছি। আর যখনই চাইবো তাদের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে দেব।

ফী জিলালিল কুরআন:

  *বাতিলপন্থীদের জন্যে সতর্কবাণী : পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে- যে শক্তি সামর্থ্য আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দিয়েছেন, তা আল্লাহর চোখে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা তিনি তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাদের জায়গায় অন্য জাতির উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম। তবে তিনি তা করেন না। কল্যাণ ও সূক্ষ্মতর প্রজ্ঞার আলােকে তার প্রাচীন প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা চলে আসছে, তার তাগিদেই তিনি এ জিনিসটিকে বিলম্বিত করছেন, ‘আমিই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছি। আর যখন আমি চাইবো, তখন তাদের পরিবর্তে অন্যদেরকে সৃষ্টি করবে।’ আলােচনার এই পর্বটি এক শ্রেণীর লােকদের জন্যে হুঁশিয়ারী স্বরূপ। আপন শক্তির মধ্যে মত্ত এসব লােককে তাদের জন্ম ও শক্তির উৎসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। অতপর দুর্বল ও স্বল্প সংখ্যক মুসলমানদেরকে এই বলে প্রবােধ দেয়া হয়েছে যে, সকল শক্তির দাতা তিনিই, যার সাথে তারা সম্পৃক্ত এবং যার দাওয়াত প্রচারে তারা নিয়ােজিত। সেই সাথে আল্লাহর ভাগ্য নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের একক ক্ষমতা এবং এর পেছনে যে সূক্ষ্ম প্রজ্ঞা সক্রিয় রয়েছে, সে বিষয়টিও তাদের মনে বদ্ধমূল করা হয়েছে। বস্তুত আল্লাহর এই প্রজ্ঞা ও সূক্ষ্মদর্শিতা অনুসারেই বিশ্বজগতের সকল ছােট বড় ঘটনা সংঘটিত হয় এবং তার ফয়সালার ওপরই সব কিছু নির্ভরশীল। তিনিই শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। ‘আর যখন চাইবাে তাদের পরিবর্তে তাদের মতাে অন্যদেরকে সৃষ্টি করবাে।’ অর্থাৎ তারা তাদের শক্তি দ্বারা আল্লাহকে পরাডূত করতে পারবে না। কেননা তিনিই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং শক্তি সামর্থ্য দিয়েছেন। তাদের জায়গায় তাদের মতাে অন্যদেরকে সৃষ্টি করতে তিনি সক্ষম। তথাপি তিনি যখন তাদেরকে সময় দিয়েছেন এবং তাদেরকে ধ্বংস করে তাদের স্থলে অন্যদেরকে সৃষ্টি করেননি, তখন বুঝতে হবে যে, এটা আল্লাহর পরম করুনা ও অনুগ্রহ । এটাই তার সিদ্ধান্ত এবং এটাই কল্যাণকর। আয়াতের এই শেষাংশে রাসূল(স.) ও তার সাহাবীদের মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা এবং তাদের ভূমিকা ও অন্যদের ভূমিকার বিশ্লেষণ লক্ষণীয়। সেই সাথে এতে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভােগবিলাসে মত্ত লােকদের বিবেকে একটি মৃদু কষাঘাত করা হয়েছে, যেন তারা তাদের শক্তির নেশায় দিশাহারা না হয়, আল্লাহর নেয়ামতকে যেন স্মরণ করে। সে নেয়ামত নিয়ে বড়াই করে অথচ শােকর করে না। এই নেয়ামতের পেছনে যে পরীক্ষার উদ্দেশ্যটি লুকিয়ে আছে তা যেন সে বুঝতে চেষ্টা করে। সূরার শুরুতেও এ পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন: অতঃপর তাদেরকে প্রদত্ত সুযােগের সদ্ব্যবহারের জন্যে সজাগ করে তােলা হচ্ছে। তাদের সামনে কোরআন পেশ করে তাদের সতর্ক করা হচ্ছে। ‘নিশ্চয়ই এই কোরআন একটি উপদেশ বিশেষ, যার ইচ্ছা হয় সে যেন এর মাধ্যমে আপন প্রভুর কাছে যাওয়ার নিজের পথ করে নেয়।’ পরবর্তী আয়াতে এই মর্মে মন্তব্য করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা অবাধ ও সার্বভৌম ইচ্ছাশক্তির অধিকারী এবং সবকিছুই তার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এর উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ যেন চূড়ান্তভাবে তারই দিকে মনােনিবেশ করে এবং তারই কাছে চুড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে, আর মানুষ যেন নিজের শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা পরিহার করে আল্লাহর শক্তি ও সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। এটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।

সুরা: আদ-দাহর
আয়াত নং :-৩১

یُّدْخِلُ مَنْ یَّشَآءُ فِیْ رَحْمَتِهٖ١ؕ وَ الظّٰلِمِیْنَ اَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا اَلِیْمًا۠

যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে শামিল করেন। আর জালেমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।

ফী জিলালিল কুরআন: ‘আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তােমরা কোনাে কিছুর ইচ্ছা করতে পারাে না। আল্লাহ তায়ালা মহাজ্ঞানী, বিচক্ষন প্রজ্ঞাময়।’ এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ জানুক যে, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সর্বময় কর্তা ও নিরংকুশ ক্ষমতার মালিক। তিনি দোর্দন্ড প্রতাপশালী ও সার্বভৌম। এ কথা জানার পর সে সহজেই তার দিকে মনােনিবেশ ও আত্মসমর্পণের পন্থা কি তা জানতে পারবে। কোরআনের যেখানে যেখানে এ ধরনের কথা উচ্চারিত হয়েছে, সেখানে তার মােটামুটি মর্ম এটাই। এখানে এ কথাও ঘােষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা নিজের ইচ্ছা অনুসারে মানুষকে সত্য ও মিথ্যা, হক ও বাতিল এবং ন্যায় ও অন্যায় বুঝার ক্ষমতা দিয়েছেন এবং আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে ভালাে বা মন্দ পথে চালিত হওয়ার ক্ষমতাও তিনি তাকে দিয়েছেন। তিনি প্রত্যেক মানুষের মনের স্বভাবপ্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে যেমন পথের সন্ধান দিয়েছেন, তাদের কাছে রসূল পাঠিয়েছেন এবং কোরআন নাযিল করেছেন, তেমনি তাকে জ্ঞান ও বােধশক্তিও দান করেছেন। তবে এসব কিন্তু একান্তভাবে আল্লাহর ফয়সালার ওপর নির্ভরশীল। তাই তার কাছেই সকলের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আল্লাহকে স্মরণ করা ও তার আনুগত্য করার শক্তিও তিনি স্বয়ং নিজেই তাদের দিয়ে থাকেন। আল্লাহর সর্বব্যাপী ক্ষমতার বিষয়টি যদি কারাে অজানা বা অবহেলিত থাকে এবং সে জন্যে সে তার কাছে তাঁর আনুগত্য সহজ করে দেয়া ও তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা না করে, তাহলে তার হেদায়াত লাভ ও তার কথা স্মরণ করার সম্ভাবনা সুদূর পরাহতই থেকে যাবে এবং সে কল্যাণের দিকে চলার কোনাে প্রেরণাই পায় না। এ জন্যেই পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যাকে তিনি ইচ্ছা করেন নিজের অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করেন, আর যালেমদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।’ বস্তুত তিনি যা ইচ্ছা তাই করার অবাধ ক্ষমতা রাখেন। তার ইচ্ছা অনুসারে যে কোনাে ব্যক্তিকে আপন অনুগ্রহের আওতাভুক্ত করাও তাঁর ক্ষমতার অধীন। এই ক্ষমতা ও ইচ্ছা তিনি তাদের ওপরই প্রয়ােগ করেন, যারা তার কাছে ধর্না দেয় এবং তার কাছে হেদায়াত ও আনুগত্যের তাওফীক কামনা করে। আর যালেমদের জন্যে তিনি যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। তাদেরকে তিনি সময় দিয়ে রেখেছেন, যাতে তারা এই যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি লাভের যােগ্য হয়। এই উপসংহার সূরার সূচনার সাথে পুরােপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুরুতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পরীক্ষার উদ্দেশ্যেই মিশ্রিত বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে চোখ ও কান দিয়েছেন এবং তাকে দোযখ অথবা বেহেশতের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, আর এখানে সূরার উপসংহারে তাদের উক্ত পরীক্ষার শেষ অবস্থাটি চিত্রিত করা হয়েছে।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৯/হে মানুষ:-৪, এবং কাফের-রা বলে:-৩৩)
[*মানুষের এক সময় অতিক্রম করেছে,যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।:-
*দ্বীনের দায়ীদের কর্তব্য : –
** সুযােগের সদ্ব্যবহারের জন্যে সজাগ করে তােলা হচ্ছে:-
*‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্রসংশাযোগ্য:-
*অকৃতজ্ঞ কাফিরের আনুগত্য করবেন না:-]

www.motaher21.net
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার
পারা:২৯
১- ৩১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
তাফসীরে‌ ফি জিলালিল‌ কুরআন:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১
ہَلۡ اَتٰی عَلَی الۡاِنۡسَانِ حِیۡنٌ مِّنَ الدَّہۡرِ لَمۡ یَکُنۡ شَیۡئًا مَّذۡکُوۡرًا ﴿۱﴾
মানুষের ওপরে কি অন্তহীন মহাকালের এমন একটি সময়ও অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কোন জিনিসই ছিল না?
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২
اِنَّا خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ اَمۡشَاجٍ ٭ۖ نَّبۡتَلِیۡہِ فَجَعَلۡنٰہُ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا ﴿۲﴾
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু হতে,যাতে আমি তাকে পরীক্ষা করি, এই জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৩
اِنَّا ہَدَیۡنٰہُ السَّبِیۡلَ اِمَّا شَاکِرًا وَّ اِمَّا کَفُوۡرًا ﴿۳﴾
নিশ্চয় আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি; এরপর হয় সে শোকরগোজার হবে নয়তো হবে কুফরের পথ অনুসরণকারী।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৪
اِنَّاۤ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ سَلٰسِلَا۠ وَ اَغۡلٰلًا وَّ سَعِیۡرًا ﴿۴﴾
আমি কাফেরদের জন্য শিকল, বেড়ি এবং জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৫
اِنَّ الۡاَبۡرَارَ یَشۡرَبُوۡنَ مِنۡ کَاۡسٍ کَانَ مِزَاجُہَا کَافُوۡرًا ۚ﴿۵﴾
(বেহেশতে) নেককার লোকেরা পানপাত্র থেকে এমন শরাব পান করবে যাতে কর্পূর পানি সংমিশ্রিত থাকবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৬
عَیۡنًا یَّشۡرَبُ بِہَا عِبَادُ اللّٰہِ یُفَجِّرُوۡنَہَا تَفۡجِیۡرًا ﴿۶﴾
এমন একটি ঝরণা; যা হতে আল্লাহর দাসরা পান করবে, তারা এ (ঝরনা ইচ্ছামত) প্রবাহিত করবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৭
یُوۡفُوۡنَ بِالنَّذۡرِ وَ یَخَافُوۡنَ یَوۡمًا کَانَ شَرُّہٗ مُسۡتَطِیۡرًا ﴿۷﴾
এরা হবে সেসব লোক যারা (দুনিয়াতে) মানত পূরণ করে সে দিনকে ভয় করে যার বিপদ সবখানে ছড়িয়ে থাকবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৮
وَ یُطۡعِمُوۡنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّہٖ مِسۡکِیۡنًا وَّ یَتِیۡمًا وَّ اَسِیۡرًا ﴿۸﴾
আর আল্লাহর মহব্বতে মিসকীন, ইয়াতীম এবং বন্দীকে খাবার দান করে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৯
اِنَّمَا نُطۡعِمُکُمۡ لِوَجۡہِ اللّٰہِ لَا نُرِیۡدُ مِنۡکُمۡ جَزَآءً وَّ لَا شُکُوۡرًا ﴿۹﴾
এবং (তাদেরকে বলে) আমরা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তোমাদের খেতে দিচ্ছি। আমরা তোমাদের কাছে এর কোন প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা পেতে চাই না।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১০
اِنَّا نَخَافُ مِنۡ رَّبِّنَا یَوۡمًا عَبُوۡسًا قَمۡطَرِیۡرًا ﴿۱۰﴾
আমরা তো আমাদের রবের পক্ষ থেকে সেদিনের আযাবের ভয়ে ভীত, যা হবে কঠিন বিপদ ভরা অতিশয় দীর্ঘ দিন।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১১
فَوَقٰہُمُ اللّٰہُ شَرَّ ذٰلِکَ الۡیَوۡمِ وَ لَقّٰہُمۡ نَضۡرَۃً وَّ سُرُوۡرًا ﴿ۚ۱۱﴾
আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে সেদিনের অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদেরকে সজীবতা ও আনন্দ দান করবেন।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১২
وَ جَزٰىہُمۡ بِمَا صَبَرُوۡا جَنَّۃً وَّ حَرِیۡرًا ﴿ۙ۱۲﴾
আর তাদের ধৈর্যশীলতার পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে দেবেন জান্নাত ও রেশমী বস্ত্র।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৩
مُّتَّکِـِٕیۡنَ فِیۡہَا عَلَی الۡاَرَآئِکِ ۚ لَا یَرَوۡنَ فِیۡہَا شَمۡسًا وَّ لَا زَمۡہَرِیۡرًا ﴿ۚ۱۳﴾
তারা সেখানে উঁচু আসনের ওপরে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রোদের উত্তাপ কিংবা শীতের তীব্রতা তাদের কষ্ট দেবে না।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৪
وَ دَانِیَۃً عَلَیۡہِمۡ ظِلٰلُہَا وَ ذُلِّلَتۡ قُطُوۡفُہَا تَذۡلِیۡلًا ﴿۱۴﴾
জান্নাতের বৃক্ষরাজির ছায়া তাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে ছায়া দিতে থাকবে। আর তার ফলরাজি সবসময় তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে ।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৫
وَ یُطَافُ عَلَیۡہِمۡ بِاٰنِیَۃٍ مِّنۡ فِضَّۃٍ وَّ اَکۡوَابٍ کَانَتۡ قَؔوَارِیۡرَا۠ ﴿ۙ۱۵﴾
আর তাদের উপর ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে রৌপ্যপাত্ৰে এবং স্ফটিক-সচ্ছ পানপাত্রে—
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৬
قَؔ‍وَارِیۡرَا۠ مِنۡ فِضَّۃٍ قَدَّرُوۡہَا تَقۡدِیۡرًا ﴿۱۶﴾
রূপালী স্ফটিক-পাত্র, পরিবেশনকারীরা যথাযথ পরিমাণে তা পূর্ণ করবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৭
وَ یُسۡقَوۡنَ فِیۡہَا کَاۡسًا کَانَ مِزَاجُہَا زَنۡجَبِیۡلًا ﴿ۚ۱۷﴾
আর সেখানে তাদেরকে পান করানো হবে যান্জাবীল মিশ্ৰিত পূৰ্ণপাত্ৰ-পানীয় ।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৮
عَیۡنًا فِیۡہَا تُسَمّٰی سَلۡسَبِیۡلًا ﴿۱۸﴾
জান্নাতের এমন এক ঝরণার, যার নাম ‘সালসাবীল’।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-১৯
وَ یَطُوۡفُ عَلَیۡہِمۡ وِلۡدَانٌ مُّخَلَّدُوۡنَ ۚ اِذَا رَاَیۡتَہُمۡ حَسِبۡتَہُمۡ لُؤۡلُؤًا مَّنۡثُوۡرًا ﴿۱۹﴾
আর তাদের উপর প্রদক্ষিণ করবে চির কিশোরগণ, যখন আপনি তাদেরকে দেখবেন তখন মনে করবেন তারা যেন বিক্ষিপ্ত মুক্তা।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২০
وَ اِذَا رَاَیۡتَ ثَمَّ رَاَیۡتَ نَعِیۡمًا وَّ مُلۡکًا کَبِیۡرًا ﴿۲۰﴾
তুমি সেখানে যে দিকেই তাকাবে সেদিকেই শুধু নিয়ামত আর ভোগের উপকরণের সমাহার দেখতে পাবে এবং বিশাল সাম্রাজ্যের সাজ-সরঞ্জাম তোমাদের দৃষ্টিগোচর হবে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২১
عٰلِیَہُمۡ ثِیَابُ سُنۡدُسٍ خُضۡرٌ وَّ اِسۡتَبۡرَقٌ ۫ وَّ حُلُّوۡۤا اَسَاوِرَ مِنۡ فِضَّۃٍ ۚ وَ سَقٰہُمۡ رَبُّہُمۡ شَرَابًا طَہُوۡرًا ﴿۲۱﴾
তাদের দেহে হবে মিহি সবুজ এবং মোটা রেশমী কাপড়, তারা অলঙ্কৃত হবে রৌপ্য-নির্মিত কঙ্কনে, আর তাদের প্রতিপালক তাদেরকে পান করাবেন বিশুদ্ধ পানীয়।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২২
اِنَّ ہٰذَا کَانَ لَکُمۡ جَزَآءً وَّ کَانَ سَعۡیُکُمۡ مَّشۡکُوۡرًا ﴿٪۲۲﴾
‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্রসংশাযোগ্য।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৩
اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا عَلَیۡکَ الۡقُرۡاٰنَ تَنۡزِیۡلًا ﴿ۚ۲۳﴾
নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি ক্রমে ক্রমে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৪
فَاصۡبِرۡ لِحُکۡمِ رَبِّکَ وَ لَا تُطِعۡ مِنۡہُمۡ اٰثِمًا اَوۡ کَفُوۡرًا ﴿ۚ۲۴﴾
কাজেই আপনি ধৈর্যের সাথে আপনার রবের নির্দেশের প্রতীক্ষা করুন এবং তাদের মধ্য থেকে কোন পাপিষ্ঠ বা ঘোর অকৃতজ্ঞ কাফিরের আনুগত্য করবেন না।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৫
وَ اذۡکُرِ اسۡمَ رَبِّکَ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا ﴿ۖۚ۲۵﴾
আর আপনার রবের নাম স্মরণ করুন সকালে ও সন্ধ্যায়।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৬
وَ مِنَ الَّیۡلِ فَاسۡجُدۡ لَہٗ وَ سَبِّحۡہُ لَیۡلًا طَوِیۡلًا ﴿۲۶﴾
রাতের বেলায়ও তার সামনে সিজদায় অবনত হও। রাতের দীর্ঘ সময় তাঁর তাসবীহ অর্থাৎ পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকো।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৭
اِنَّ ہٰۤؤُلَآءِ یُحِبُّوۡنَ الۡعَاجِلَۃَ وَ یَذَرُوۡنَ وَرَآءَہُمۡ یَوۡمًا ثَقِیۡلًا ﴿۲۷﴾
এসব লোক তো দ্রুত লাভ করা যায় এমন জিনিসকে (দুনিয়াকে) ভালবাসে এবং ভবিষ্যতে যে কঠিন দিন আসছে তাকে উপেক্ষা করে চলছে।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৮
نَحۡنُ خَلَقۡنٰہُمۡ وَ شَدَدۡنَاۤ اَسۡرَہُمۡ ۚ وَ اِذَا شِئۡنَا بَدَّلۡنَاۤ اَمۡثَالَہُمۡ تَبۡدِیۡلًا ﴿۲۸﴾
আমিই এদের সৃষ্টি করেছি এবং এদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সন্ধিস্থল মজবুত করেছি। আর যখনই চাইবো তাদের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে দেব।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-২৯
اِنَّ ہٰذِہٖ تَذۡکِرَۃٌ ۚ فَمَنۡ شَآءَ اتَّخَذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا ﴿۲۹﴾
নিশ্চয় এটা এক উপদেশ, অতএব যার ইচ্ছা সে তার প্রতিপালকের দিকে পথ অবলম্বন করুক।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৩০
وَ مَا تَشَآءُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا ﴿٭ۖ۳۰﴾
তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না যদি আল্লাহ‌ না চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সুবিজ্ঞ।
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার:-৩১
یُّدۡخِلُ مَنۡ یَّشَآءُ فِیۡ رَحۡمَتِہٖ ؕ وَ الظّٰلِمِیۡنَ اَعَدَّ لَہُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿٪۳۱﴾

যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তাঁর রহমতের মধ্যে শামিল করেন। আর জালেমদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কঠিন শাস্তি।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৮৯/হে মানুষ:-৪, এবং কাফের-রা বলে:-৩৩)
[*মানুষের এক সময় অতিক্রম করেছে,যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না।:-
*দ্বীনের দায়ীদের কর্তব্য : –
** সুযােগের সদ্ব্যবহারের জন্যে সজাগ করে তােলা হচ্ছে:-
*‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্রসংশাযোগ্য:-
*অকৃতজ্ঞ কাফিরের আনুগত্য করবেন না:-]

www.motaher21.net
সুরা: ৭৬.: আদ্-দাহার
পারা:২৯
১- ৩১ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সহীহ্ মুসলিমের হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীস ইতিপূর্বে গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) জুমআ’র দিন ফজরের নামাযে সূরা আলিফ-লাম-তানযীল এবং হাল আতা আলাল ইনসান পাঠ করতেন। একটি মুরসাল গারীব হাদীসে রয়েছে যে, যখন এই সূরাটি অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তা পাঠ করেন তখন তাঁর নিকট একটি কালো বর্ণের সাহাবী (রাঃ) বসেছিলেন। যখন জান্নাতের গুণাবলীর বর্ণনা আসে তখন হঠাৎ তাঁর মুখ হতে একটা ভীষণ চীৎকার বের হয় এবং সাথে সাথে তাঁর দেহ হতে প্রাণ পাখী উড়ে যায়। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে বলেনঃ “তোমাদের সাথী এবং তোমাদের ভাই-এর প্রাণ জান্নাতের আগ্রহে বেরিয়ে গেছে।”

১-৩ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিতে গিয়ে বলেন যে, তিনি মানুষকে এমন অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন যে, তার নিকৃষ্টতা ও দুর্বলতার কারণে সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। তিনি তাকে পুরুষ ও নারীর মিলিত শুক্রের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন অবস্থায় পরিবর্তিত করার পর তাকে বর্তমান রূপ ও আকৃতি দান করেছেন। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ আমি তাকে পরীক্ষা করবার জন্যে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন করেছি। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেছেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমাদেরকে পরীক্ষা করবার জন্যে যে, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম?” (৬৭:২) সুতরাং তিনি তোমাদেরকে কর্ণ ও চক্ষু দান করেছেন যাতে আনুগত্য ও অবাধ্যতার মধ্যে পার্থক্য করতে পার।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি। অর্থাৎ অত্যন্ত স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে আমার সরল সোজা পথ তোমার কাছে খুলে দিয়েছি।

যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “সামূদ সম্প্রদায়কে আমি পথের নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা অন্ধত্বকে হিদায়াতের উপর প্রাধান্য দিয়েছিল।” (৪১:১৭) আর এক জায়গায় আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি তাকে দু’টি পথই দেখিয়েছি।” (৯০:১০) অর্থাৎ ভাল ও মন্দ দু’টি পথই প্রদর্শন করেছি। (আরবি)-এই আয়াতের তাফসীরে হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত আবূ সালিহ্ (রঃ), হযরত যহহাক (রঃ) এবং হযরত সুদ্দী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, পথ দেখানো দ্বারা উদ্দেশ্য হলোঃ আমি তাকে মায়ের পেট হতে বের হবার পথ দেখিয়েছি। কিন্তু এটা গারীব উক্তি। প্রথম উক্তিটিই সঠিক।

(আরবি) এখানে (আরবি) হওয়ার কারণে (আরবি) এবং (আরবি)-এর উপর (আরবি) বা যবর হয়েছে। এর (আরবি) হলো (আরবি) এর সর্বনামটি। অর্থাৎ আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি এমন অবস্থায় যে সে হতভাগ্য বা ভাগ্যবান। যেমন সহীহ মুসলিমে হযরত আবূ মালিক আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তি সকাল বেলায় স্বীয় নফসকে বিক্রিকারী হয়ে থাকে, হয় সে ওকে মুক্তকারী হয়, না হয় ওকে ধ্বংসকারী হয়।”

মুসনাদে আহমাদে হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, নবী (সঃ) হযরত কা’ব ইবনে আজরা (রাঃ)-কে বলেনঃ “আল্লাহ তোমাকে নির্বোধদের নেতৃত্ব হতে রক্ষা করুন!” হযরত কাব (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! নির্বোধদের নেতৃত্ব কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “তারা ঐ সব নেতা যারা আমার পরে নেতৃত্ব লাভ করবে। তারা না আমার সুন্নাতের উপর আমল করবে, না আমার তরীকার উপর চলবে। যারা তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে এবং উৎপীড়নমূলক কার্যে সাহায্য করবে তারা আমার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। জেনে রেখো যে, তারা আমার হাউযে কাওসারের উপরও আসতে পারবে না। পক্ষান্তরে, যারা তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে না এবং তাদের অত্যাচারমূলক কাজে সাহায্য সহযোগিতা করবে না তারা আমার এবং আমি তাদের। তারা আমার হাউযে কাওসারে আমার সাথে মিলিত হবে। হে কা’ব (রাঃ)! রোযা ঢাল স্বরূপ, সাদকা বা দান-খয়রাত পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয় এবং নামায আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ অথবা বলেছেনঃ মুক্তির দলীল। হে কাব (রাঃ)! (দেহের) ঐ গোশত জান্নাতে প্রবেশ করবে না যা হারাম দ্বারা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে। ওটা জাহান্নামেরই যোগ্য। হে কা’ব (রাঃ)! মানুষ সকাল বেলায় নিজের নফসকে বিক্রী করে থাকে। কেউ ওকে আযাদকারী হয় এবং কেউ হয় ওকে ধ্বংসকারী।” সূরা রূমের (আরবি) আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। (৩০:৩০) এ আয়াতের তাফসীরে হযরত জাবির (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিম্নের উক্তিটি গত হয়েছেঃ “প্রত্যেক সন্তান ইসলামের ফিতরাত বা প্রকৃতির উপর সৃষ্ট হয়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত তার জিহ্বা চলতে থাকে, হয় সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী হয়, না হয় অকৃতজ্ঞ হয়।”

মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তিই (বাড়ী হতে) বের হয় তারই দরজার উপর দু’টি পতাকা থাকে, একটি থাকে ফেরেশতার হাতে এবং অপরটি থাকে শয়তানের হাতে। যদি সে এমন কাজের জন্যে বের হয়ে থাকে যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট, তবে ফেরেশতা তাঁর পতাকা নিয়ে তার সাথী হয়ে যান এবং তার প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সে ফেরেশতার পতাকার নীচেই থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টির কাজে বের হয়, শয়তান তার পতাকা নিয়ে তার সাথে হয়ে যায় এবং তার প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সে শয়তানের পতাকা তলেই থাকে।”

৪-১২ নং আয়াতের তাফসীর

এখানে আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, তাঁর মাখলূকের মধ্যে যে কেউই তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হবে তার জন্যে তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন শৃংখল, বেড়ি ও লেলিহান অগ্নি। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “যখন তাদের গলদেশে বেড়ি ও শৃংখল থাকবে, তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে।” (৪০:৭১-৭২)

হতভাগ্যদের শাস্তির বর্ণনা দেয়ার পর এখন সৎ ও ভাগ্যবানদের পুরস্কারের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাদেরকে পান করানো হবে এমন পানীয় যার মিশ্রণ হবে কাফূর। কাফূর একটি নহরের নাম যা হতে আল্লাহর খাস বান্দারা পানি পান করবে এবং শুধু ওর দ্বারাই পরিতৃপ্তি লাভ করবে। এ জন্যেই এখানে এটাকে (আরবি) দ্বারা (আরবি) করা হয়েছে এবং (আরবি) হিসেবে (আরবি)-এর উপর (আরবি) বা যবর দেয়া হয়েছে। কিংবা এই পানি সুগন্ধির দিক দিয়ে কপূরের মত অথবা ওটা আসলই কপূর। আর (আরবি)-এর উপর যবর হয়েছে (আরবি) ক্রিয়াটির কারণে। এই নহর পর্যন্ত যাওয়াও তাদের প্রয়োজন হবে না। তারা তাদের বাগানে, মহলে, মজলিসে, বৈঠকে যেখানেই ইচ্ছা করবে তাদের কাছে ঐ পানি পৌঁছিয়ে দেয়া হবে।

(আরবি)-এর অর্থ হলো প্রবাহিত করা বা উৎসারিত করা যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তারা বলে – আমরা কখনো তোমাতে ঈমান আনবো না যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি হতে এক প্রস্রবণ উৎসারিত করবে।” (১৭:৯০) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “এবং আমি উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত করেছিলাম নহর।” (১৮:৩৩)

এখন এই লোকদের পুণ্যময় কাজের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, যে ইবাদতের দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাদের উপর ছিল তা তো তারা যথাযথভাবে পালন করতোই, এমন কি তারা যেসব দায়িত্ব নিজেরাই নিজেদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল সেগুলোও তারা পুরোপুরিভাবে পালন করতো। অর্থাৎ তারা তাদের নযরও পুরো করতো। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করার নযর মানবে বা প্রতিজ্ঞা করবে তা যেন সে পুরো করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানী করার নযর মানবে সে যেন তা পুরো না করে (অর্থাৎ যেন সে আল্লাহর নাফরমানী না করে)।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ইমাম মালিক (রঃ)-এর রিওয়াইয়াতে বর্ণনা করেছেন)

আর তারা কিয়ামত দিবসের ভয়ে নিষিদ্ধ কাজগুলোকে পরিত্যাগ করে, যে দিবসের সন্ত্রাস সাধারণভাবে সবকেই পরিবেষ্টন করবে। সেই দিন সবাই ব্যতিব্যস্ত থাকবে, তবে আল্লাহ পাক কারো প্রতি রহম করলে সেটা স্বতন্ত্র কথা। ঐদিন সন্ত্রাস আকাশ ও পৃথিবী পর্যন্ত ছেয়ে যাবে।

(আরবি)-এর অর্থ হলো ব্যাপকভাবে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া বা চতুর্দিক পরিবেষ্টন করা।

মহান আল্লাহ বলেনঃ এই সৎকর্মশীল লোকগুলো আল্লাহর মহব্বতে হকদার লোকদের উপর সাধ্যমত খরচ করে থাকে। কারো কারো মতে, সর্বনামটি (আরবি)-এর দিকে ফিরেছে। শব্দের দিক দিয়ে এটাই বেশী প্রকাশমানও বটে। অর্থাৎ খাদ্যের প্রতি চরম আসক্তি এবং এর প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা তা আল্লাহর পথে খরচ করে থাকে এবং অভাবগ্রস্তদেরকে দিয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “মালের প্রতি আসক্তি এবং ওর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ওটা সে আল্লাহর পথে খরচ করে থাকে।” (২:১৭৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা যা ভালবাস তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনো পুণ্য লাভ করতে পারবে না।” (৩:৯২)

হযরত নাফে (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একবার হযরত ইবনে উমার (রাঃ) রুগ্ন হয়ে পড়েন। আঙ্গুরের মৌসুমে আঙ্গুর পাকতে শুরু করলে তার স্ত্রী হযরত সুফিয়া (রাঃ) লোক পাঠিয়ে এক দিরহামের আঙ্গুর আনিয়ে নেন। ঠিক ঐ সময়েই দরজায় এক ভিক্ষুক এসে পড়ে এবং ভিক্ষা চায়। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) এই আঙ্গুর ভিক্ষুককে দিয়ে দিতে বলেন। সুতরাং তা ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর আবার লোক গিয়ে আঙ্গুর ক্রয় করে আনে। কিন্তু এবারও ভিক্ষুক এসে পড়ে এবং ভিক্ষা চেয়ে বসে। এবারও হযরত ইবনে উমার (রাঃ) তা ভিক্ষুককে দিয়ে দিবার নির্দেশ দেন। সুতরাং এবারও ঐ আঙ্গর ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু হযরত সুফিয়া (রাঃ) এবার ঐ ভিক্ষুককে বলে দেনঃ “আল্লাহর কসম! এর পরেও তুমি ফিরে আসলে তোমাকে আর কিছুই দেয়া হবে না।” অতঃপর আবার তিনি এক দিরহামের আঙ্গুর আনিয়ে নেন।” (এটা ইমাম বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “উত্তম সাদকা হলো ঐ সাদকা যা তুমি এমন অবস্থায় করছো যে, তুমি সুস্থ শরীরে রয়েছে, মালের প্রতি তোমার ভালবাসা রয়েছে, ধনী হওয়ার তোমার আকাঙ্খা আছে এবং গরীব হয়ে যাওয়ার ভয়ও তোমার রয়েছে (এতদসত্ত্বেও তুমি সাদকা করছে)।” অর্থাৎ মালের প্রতি লোভ-লালসাও রয়েছে, ভালবাসাও আছে এবং অভাব অনটনও রয়েছে, এতদসত্ত্বেও আল্লাহর পথে দান করা হচ্ছে।

ইয়াতীম ও মিসকীন কাকে বলে এর বর্ণনা ও বিশেষণ ইতিপূর্বে গত হয়েছে। আর বন্দী সম্পর্কে হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) হযরত হাসান (রঃ) এবং হযরত যহহাক (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা মুসলমান আহলে কিবলা বন্দীকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ঐ সময় তো শুধু মুশরিক বন্দীরাই ছিল। এর প্রমাণ হলো ঐ হাদীসটি যাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বদরী বন্দীদের সম্পর্কে তাঁর সাহাবীদেরকে (রাঃ) বলেছিলেন যে, তাঁরা যেন তাদের সম্মান করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই নির্দেশ অনুসারে সাহাবীগণ পানাহারের ব্যাপারে নিজেদের অপেক্ষা ঐ বন্দীদের প্রতিই বেশী লক্ষ্য রাখতেন। হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এখানে বন্দী দ্বারা গোলামকে বুঝানো হয়েছে। আয়াতটি আম বা সাধারণ হওয়ার কারণে ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাকেই পছন্দ করেছেন এবং মুসলমান ও মুশরিক সবকেই এর অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। গোলাম ও অধীনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহারের তাগীদ বহু হাদীসেই রয়েছে। এমন কি হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সঃ) স্বীয় উম্মতকে বিদায় উপদেশে বলেনঃ “তোমরা নামাযের হিফাযত করবে এবং তোমাদের অধীনস্থদের (গোলাম ও বাদীদের) সাথে সদ্ব্যবহার করবে।”

মহান আল্লাহ বলেন যে, তারা বলেঃ শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি। আমরা তোমাদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়। অর্থাৎ তারা এই সদ্ব্যবহারের কোন প্রতিদান মানুষের কাছে চায় না এবং তারা তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুক এ কামনাও তারা করে না। বরং তারা নিজেদের অবস্থা দ্বারা যেন এটাই ঘোষণা করে যে, তারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই খরচ করে থাকে। তারা যেন এর বিনিময়ে আল্লাহ পাকের নিকট পারলৌকিক পুণ্য লাভ করতে পারে।

হযরত সাঈদ (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর কসম! ঐ পুণ্যময় লোকেরা উপরোক্ত কথা মুখে প্রকাশ করেন না, বরং এটা তাদের মনের ইচ্ছা, যা আল্লাহ পাক জানেন এবং তিনি তা প্রকাশ করে থাকেন যাতে এতে জনগণের আগ্রহ জন্মে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এই পবিত্র দলটি এই খায়রাত ও সাদকা করে এক ভীতিপ্রদ ভয়ংকর দিনের আযাব হতে বাঁচতে চায়, যা অত্যন্ত সংকীর্ণ, অন্ধকার এবং সুদীর্ঘ। তাদের বিশ্বাস যে, এর উপর ভিত্তি করে আল্লাহ তাদের উপর দয়া করবেন এবং ঐ ভীতিপ্রদ ও ভয়ংকর দিনে তাদের এই পুণ্যের কাজগুলো তাদের উপকারে আসবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো সংকীর্ণতা এবং (আরবি)-এর অর্থ হলো দীর্ঘতা। হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, ঐদিন কাফিরদের মুখ বিকৃত হয়ে যাবে, ভ্রূকুঞ্চিত হবে এবং তাদের চক্ষুদ্বয়ের মাঝখান দিয়ে ঘর্ম বইতে থাকবে যা রওগণ গন্ধকের মত হবে। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, তাদের ওষ্ঠ উপরের দিকে উঠে যাবে এবং চেহারা জড় হয়ে যাবে। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, ভয় সন্ত্রাসের কারণে তাদের আকৃতি বিকৃত হয়ে যাবে এবং কপাল সংকীর্ণ হয়ে যাবে। হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, ওটা হবে খুবই মন্দ ও কঠিন দিন। কিন্তু সবচেয়ে উত্তম ও যুক্তিসঙ্গত হলো হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তিটি। ইমাম ইবনে জারীর (রাঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর আভিধানিক অর্থ হলো কাঠিণ্য। অর্থাৎ ঐদিন হবে অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ।

মহান আল্লাহ বলেন যে, তাদের এ আন্তরিযকতা ও সৎ কর্মের কারণে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে ঐ দিনের ভয়ংকর অবস্থা হতে রক্ষা করবেন। শুধু তাই নয়, এমন কি সেই দিনের দুরবস্থার স্থলে তাদেরকে দিবেন উৎফুল্লতা ও আনন্দ। এখানে কতই না অলংকার পূর্ণ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “অনেক মুখমণ্ডল সেদিন হবে উজ্জ্বল সহাস্য ও প্রফুল্ল।” (৮০:৩৮-৩৯) এটা প্রকাশমান কথা যে, মন আনন্দিত ও উৎফুল্ল থাকলে চেহারাও হবে উজ্জ্বল ও হাস্যময়।

হযরত কা’ব ইবনে মালিক (রাঃ)-এর সুদীর্ঘ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কোন সময় আনন্দিত হলে তার চেহারা মুবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠতো এবং মনে হতো যেন চন্দ্রের খণ্ড।

হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর দীর্ঘ হাদীসে রয়েছে, তিনি বলেনঃ “একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট আগমন করেন, ঐ সময় তার চেহারা মুবারকের শিরাগুলো আনন্দে উজ্জ্বল ও চমকিত ছিল (শেষ পর্যন্ত)।”

আল্লাহ পাক বলেনঃ তাদের ধৈর্যশীলতার পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে দিবেন উদ্যান ও রেশমী বস্ত্র। অর্থাৎ তাদের বসবাস ও চলাফেরার জন্যে মহান আল্লাহ তাদেরকে দান করবেন প্রশস্ত জান্নাত ও পবিত্র জীবন এবং পরিধান করার জন্যে দিবেন রেশমী বস্ত্র। অর্থাৎ তাদের বসবাস ও চলাফেরার জন্যে মহান আল্লাহ তাদেরকে দান করবেন প্রশস্ত জান্নাত ও পবিত্র জীবন এবং পরিধান করার জন্যে দিবেন রেশমী বস্ত্র।

ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, একদা সুলাইমান দারানীর (রঃ) সামনে (আরবি) সূরাটি পাঠ করা হয়। কারী যখন (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করেন তখন তিনি বলেন যে, তাঁরা পার্থিব কামনা বাসনা পরিত্যাগ করেছিলেন। অতঃপর তিনি নিম্নের কবিতা পাঠ করেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “বড়ই আফসোস যে, প্রবৃত্তির চাহিদা এবং মঙ্গলের স্থলে কামনা বহুজনকে গলাটিপে হত্যা করেছে। প্রবৃত্তির চাহিদা এমনই এক জিনিস যা মানুষকে নিকৃষ্টতম লাঞ্ছনা, অপমান এবং বিপদ আপদের মধ্যে নিক্ষেপ করে থাকে।”

১৩-২২ নং আয়াতের তাফসীর

জান্নাতীদের নিয়ামতরাশি, তাদের সুখ-শান্তি এবং ধন-সম্পদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা সর্বপ্রকারের শান্তিতে ও মনের সুখে জান্নাতের সুসজ্জিত আসনে সমাসীন থাকবে। সূরা সাফফাতের তাফসীরে এর পূর্ণ ব্যাখ্যা গত হয়েছে। সেখানে এটাও বর্ণিত হয়েছে যে, (আরবি) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শয়ন করা বা কনুই পেড়ে বসা বা চার জানু বসা অথবা কোমর লাগিয়ে হেলান দিয়ে বসা। এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, (আরবি) বলা হয় ছাপর খাটকে।

অতঃপর এখানে আর একটি নিয়ামতের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, সেখানে সূর্যের প্রখর তাপে তাদের কোন কষ্ট হবে না বা সেখানে তারা অতিশয় শীতও বোধ করবে না। অথবা না তারা অত্যধিক গরম বোধ করবে, না অত্যধিক ঠাণ্ডা বোধ করবে। বরং তথায় সদা-সর্বদা বসন্তকাল বিরাজ করবে। গরম-ঠাণ্ডার ঝামেলা হতে তারা সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকবে। জান্নাতী গাছের শাখাগুলো ঝুঁকে ঝুঁকে তাদের উপর ছায়া করবে। গাছের ফলগুলো তাদের খুবই নিকটে থাকবে। ইচ্ছা করলে তারা শুয়ে শুয়েই ভেঙ্গে খাবে, ইচ্ছা করলে বসে বসে ভেঙ্গে নিবে এবং ইচ্ছা করলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও ভেঙ্গে খেতে পারবে। কষ্ট করে গাছে উঠবার কোন প্রয়োজনই হবে না। মাথার উপর ফলের ছড়া বা কাঁদি লটকে থাকবে। পাড়বে ও খাবে। দাঁড়ালে দেখবে যে, ডাল ঐ পরিমাণ উঁচুতে রয়েছে, বসলে দেখতে পাবে যে, ডাল কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে এবং শুয়ে গেলে দেখবে যে, ফলসহ ডাল আরো নিকটে এসে গেছে। না কাঁটার কোন প্রতিবন্ধকতা আছে, না দূরে থাকার কোন ঝামেলা রয়েছে।

মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, জান্নাতের যমীন হলো রৌপ্যের, ওর মাটি হলো খাঁটি মৃগনাভীর, ওর বৃক্ষের কাণ্ড হলো সোনা-চাঁদির, শাখা মণি-মুক্তা, যবরজদও ইয়াকূতের। এগুলোর মাঝে রয়েছে পাতা ও ফল, যেগুলো পেড়ে নিতে কোন কষ্ট ও কাঠিণ্য নেই। ইচ্ছা করলে শুয়ে, বসে এবং দাঁড়িয়ে পেড়ে নেয়া ও খাওয়া যাবে।

একদিকে দেখবে যে, সুশ্রী সুদর্শন ও কোমলমতি অনুগত কিশোর পরিচারক নানা প্রকারের খাদ্য রৌপ্যপাত্রে সাজিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং অপরদিকে দেখতে পাবে যে, বিশুদ্ধ পানীয় পূর্ণ রজতশুভ্র স্ফটিক পাত্র হাতে নিয়ে পরিবেশনকারীরা আদেশের জন্যে অপেক্ষমান রয়েছে। ঐ পানপাত্রগুলো পরিষ্কার ও স্বচ্ছতার দিক দিয়ে কাঁচের মত এবং শুভ্রতার দিক দিয়ে রৌপ্যের মত। ভিতরের জিনিস বাহির থেকে দেখা যাবে। জান্নাতের সমস্ত জিনিস শুধু বাহ্যিকভাবে দুনিয়ার জিনিসের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত হবে। কিন্তু আসলে ঐ রৌপ্য ও কাঁচের পানপাত্রগুলোর কোন তুলনা দুনিয়ায় নেই। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, প্রথম (আরবি) শব্দটির উপর (আরবি)-এর হিসেবে যবর হয়েছে এবং দ্বিতীয় (আরবি)-এর উপর যবর হয়েছে (আরবি)-এর ভিত্তিতে।

পরিবেশনকারীরা পানপাত্র যথাযথ পরিমাণে পূর্ণ করবে। অর্থাৎ পানকারীরা যে পরিমাণ পান করতে পারবে সেই পরিমাণ পানীয় দ্বারাই ঐ পানপাত্রগুলো পূর্ণ করা হবে। ঐ পানীয় পান করার পর কিছু বাঁচবেও না, আবার তৃপ্তি সহকারে পান করতে গিয়ে তা কমেও যাবে না। জান্নাতীরা এই সব দুষ্প্রাপ্য পানপাত্রগুলোতেও এই যে সুস্বাদু, আনন্দদায়ক নেশাবিহীন সুরা প্রাপ্ত হবে ওগুলো সালসাবীল নামক নহরের পানি দ্বারা মিশ্রিত করে তাদেরকে প্রদান করা হবে। যেমন উপরে বর্ণনা গত হয়েছে যে, কাফূরের পানি দ্বারা মিশ্রিত করে দেয়া হবে। তাহলে ভাবার্থ এই যে, কখনো ঠাণ্ডা পানি মিশ্রিত করা হবে এবং কখনো গরম পানি মিশ্রিত করা হবে যাতে সমতা রক্ষা পায় এবং নাতিশীতুষ্ণ হয়ে যায়। এটা সৎকর্মশীল লোকদের বর্ণনা। খাস ও নৈকট্যলাভকারী বান্দারাই এই নহরের শরবত পান করবে।

হযরত ইকরামা (রঃ)-এর মতে ‘সালসাবীল’ হলো জান্নাতের একটি প্রস্রবণের নাম। কেননা, ওটা পর্যায়ক্রমে দ্রুতবেগে প্রবাহিত রয়েছে। ওর পানি অত্যন্ত হালকা, খুবই মিষ্টি, সুস্বাদু এবং সুগন্ধময়। ওটা অতি সহজেই পান করা যাবে। এই নিয়ামতরাজির সাথে সাথে জান্নাতীদের জন্যে রয়েছে সুন্দর, সুশ্রী অল্প বয়স্ক কিশোরগণ, যারা তাদের খিদমতের জন্যে সদা প্রস্তুত থাকবে। এই জান্নাতী বালকরা চিরকাল এক বয়সেরই থাকবে। তাদের বয়সের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। এমন নয় যে, তারা বয়স্ক হয়ে যাবার ফলে তাদের আকৃতি বিকত হবে। তাদেরকে দেখে মনে হবে তারা যেন বিক্ষিপ্ত মুক্তা। তারা মূল্যবান পোশাক ও অলংকার পরিহিত বিভিন্ন কাজে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করবে। এ কারণেই মনে হবে যে তারা ছড়ানো মণি-মুক্তা। এরচেয়ে বড় উপমা তাদের জন্যে আর কিছু হতে পারে না। তারা এরূপ সৌন্দর্য, মূল্যবান পোশাক পরিচ্ছদ এবং অলংকারাদি নিয়ে তাদের জান্নাতী মনিবদের খিদমতের জন্যে সদা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি ও ছুটাছুটি করবে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যেক জান্নাতীর জন্যে এক হাজার করে খাদেম থাকবে যারা বিভিন্ন কাজ-কর্মে লেগে থাকবে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি যখন সেথায় দেখবে, দেখতে পাবে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বিশাল রাজ্য। হাদীস শরীফে রয়েছে যে, সর্বশেষে যাকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হবে, তাকে মহান আল্লাহ বলবেনঃ “তোমার জন্যে রয়েছে দুনিয়া পরিমাণ জিনিস এবং তারও দশগুণ।”

হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতে ঐ হাদীসটিও গত হয়েছে, যাতে রয়েছে যে, সর্বনিম্ন শ্রেণীর জান্নাতীর রাজ্য ও রাজত্বের মধ্যে ভ্রমণপথ হবে দু’হাজার বছর (অর্থাৎ দু’হাজার বছর ধরে ভ্রমণ করা যাবে)। দূরবর্তী ও নিকটবর্তী সব জিনিসই সে এক রকমই দেখবে। এই অবস্থা তো হবে সর্বনিম্ন শ্ৰেণীর জান্নাতীর। তাহলে সর্বোচ্চ শ্রেণীর জান্নাতীর মর্যাদা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একজন হাবশী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তোমার যা কিছু জানবার ও বুঝবার আছে তা আমাকে প্রশ্ন কর।” তখন সে বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! রূপে ও রঙে এবং নবুওয়াতের দিক থেকে আপনাকে আমাদের উপর ফযীলত দেয়া হয়েছে। এখন বলুন তো, যার উপর আপনি ঈমান এনেছেন তার উপর যদি আমিও ঈমান আনি এবং যার উপর আপনি আমল করছেন তার উপর যদি আমিও আমল করি তবে কি আমিও আপনার সাথে জান্নাতে থাকতে পারি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! কালো বর্ণের লোককে জান্নাতে ঐ সাদা রঙ দেয়া হবে যা হাজার বছরের পথের দূরত্ব হতে দেখা যাবে!” তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে তার জন্যে আল্লাহর আহদ বা প্রতিশ্রুতি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’ বলে তার জন্যে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পুণ্য লিখা হয়। লোকটি তখন বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এরপরেও আমরা কি করে ধ্বংস হতে পারি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “একটা লোক এতো বেশী (সৎ) আমল নিয়ে আসবে যে, যদি ওগুলো কোন পাহাড়ের উপর রেখে দেয়া হয় তবে ওর উপর অত্যন্ত ভারী বোঝা হয়ে যাবে। কিন্তু এগুলোর মুকাবিলায় যখন আল্লাহর নিয়ামতরাশি আসবে তখন ঐ সমুদয় আমল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কিন্তু আল্লাহর দয়া হলে সেটা স্বতন্ত্র কথা।” ঐ সময় (আরবি) পর্যন্ত এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়। তখন হাবশী বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) জান্নাতে আপনার চক্ষু যা দেখবে তাই আমার চক্ষুও দেখবে কি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হ্যাঁ, হ্যাঁ।” একথা শুনে লোকটি কাঁদতে লাগলো। এমন কি (কাঁদতে কাঁদতে) তার দেহ হতে প্রাণপাখী উড়ে গেল। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “আমি দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের হাতে তাকে দাফন করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা অত্যন্ত গারীব হাদীস)

এরপর জান্নাতীদের পোশাকের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তাদের দেহের আবরণ হবে সূক্ষ্ম সবুজ রেশম ও স্কুল রেশম। (আরবি) হলো ঐ উন্নত মানের রেশম যা খাটি ও নরম এবং যা দেহের সাথে লেগে থাকবে। আর (আরবি) হলো উত্তম ও অতি মূল্যবান রেশম যাতে উজ্জ্বল্য থাকবে এবং যা উপরে পরিধান করানো হবে। সাথে সাথে হাতে চাঁদীর কংকন থাকবে। এটা হলো সৎলোকদের পোশাক। আর বিশেষ নৈকট্যলাভকারীদের ব্যাপারে অন্য জায়গায় ইরশাদ হয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ তাদেরকে জান্নাতে সোনা ও মুক্তার কংকন পরানো হবে এবং তাদের পোশাক হবে খাঁটি নরম রেশমের।” (২২:২৩)

এই বাহ্যিক ও দৈহিক নিয়ামতরাশির বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ পাক বলেনঃ তাদের প্রতিপালক তাদেরকে পান করাবেন বিশুদ্ধ পানীয় যা তাদের বাইরের ও ভিতরের সমস্ত কলুষতাকে দূর করে দিবে। যেমন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন জান্নাতীরা জান্নাতের দরজায় পৌঁছবে তখন তারা দু’টি নহর দেখতে পাবে, যার খেয়াল যেন তাদের মনেই জেগেছিল। একটির পানি তারা পান করবে। ফলে তাদের অন্তরের কালিমা সবই দূরীভূত হয়ে যাবে। অন্যটিতে তারা গোসল করবে। ফলে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন উভয় সৌন্দর্যই তারা পুরো মাত্রায় লাভ করবে। এখানে এটাই বর্ণনা করা হয়েছে।

অতঃপর তাদেরকে খুশী করার জন্যে এবং তাদের আনন্দ বৃদ্ধি করার জন্যে বারবার বলা হবেঃ এটা তোমাদের সৎকর্মের প্রতিদান এবং তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা স্বীকৃত। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমরা পানাহার কর তৃপ্তির সাথে, তোমরা অতীত দিনে যা করেছিলে তার বিনিময়ে।” (৬৯:২৪) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ তাদেরকে ডাক দিয়ে বলা হবেঃ তোমাদের কৃতকর্মের বিনিময়ে তোমাদেরকে এই জান্নাতের ওয়ারিশ বানিয়ে দেয়া হয়েছে।” (৭:৪৩) এখানেও বলা হয়েছেঃ তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা স্বীকৃত। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে কম আমলের বিনিময়ে বেশী প্রতিদান প্রদান করেছেন।

২৩-৩১ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-এর উপর যে খাস অনুগ্রহ করেছেন তা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বলেনঃ আমি ক্রমে ক্রমে অল্প অল্প করে এই কুরআন তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি। এখন এই অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে তুমি আমার পথে ধৈর্যের সাথে কাজ করে যাও। আমার ফায়সালার উপর ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ থাকো। তুমি দেখবে যে, আমি তোমাকে অত্যন্ত নিপুণতার সাথে মহাসম্মানিত স্থানে পৌঁছিয়ে দিবো। এই কাফির ও মুনাফিকদের কথার প্রতি তুমি মোটেই ভ্রূক্ষেপ করবে না। তারা তোমাকে এই তাবলীগের কাজে বাধা দিলেও তুমি তাদের বাধা মানবে না। বরং তাবলীগের কাজে তুমি নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাবে। তুমি নিরাশ ও মনঃক্ষুন্ন হবে না। আমার সত্ত্বার উপর তুমি ভরসা রাখবে। আমি তোমাকে লোকদের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবো। তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।

(আরবি) বলা হয় বা দুষ্কর্মশীল নাফরমানকে। আর (আরবি) হলো ঐ ব্যক্তি যার অন্তর সত্যকে প্রত্যাখ্যানকারী।

মহান আল্লাহ বলেনঃ তুমি সকাল ও সন্ধ্যায় তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ কর। অর্থাৎ দিনের প্রথম ও শেষ ভাগে আল্লাহর নাম স্মরণ কর।

আর রাত্রির কিয়দংশে তাঁর প্রতি সিজদায় নত হও এবং রাত্রির দীর্ঘ সময় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। যেমন আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে, এটা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় যে, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।” (১৭:৭৯) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত, অর্ধ রাত্রি কিংবা তদপেক্ষা অল্প অথবা তদপেক্ষা বেশী। আর কুরআন আবৃত্তি কর ধীরে ধীরে, স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে।” (৭৩:১-৪)

এরপর কাফিরদেরকে ধমকের সুরে বলা হচ্ছেঃ তোমরা দুনিয়ার প্রেমে পড়ে আখিরাতকে পরিত্যাগ করো না। ওটা বড়ই কঠিন দিন। এই নশ্বর জগতের পিছনে পড়ে ঐ ভয়াবহ দিন হতে উদাসীন থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সবারই সৃষ্টিকর্তা আমিই। সবারই গঠন সুদৃঢ় আমিই করেছি। কিয়ামতের দিন তাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করার পূর্ণ ক্ষমতাও আমার রয়েছে। এটাকে অর্থাৎ প্রথম সৃষ্টিকে পুনর্বার সৃষ্টিকরণের দলীল বানানো হয়েছে। আবার এর ভাবার্থ এও হবেঃ আমি যখন ইচ্ছা করবো তখন তাদের পরিবর্তে তাদের অনুরূপ এক জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবো। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে লোক সকল! তিনি (আল্লাহ) ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে সরিয়ে অন্যদেরকে আনয়ন করবেন এবং এর উপর আল্লাহ পূর্ণ ক্ষমতাবান।” (৪:১৩৩) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে সরিয়ে দিয়ে অন্য জাতি আনয়ন করবেন এবং ওটা আল্লাহর উপর মোটেই কঠিন কাজ নয়।” (১৪:১৯-২০)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই এটা এক উপদেশ, অতএব যার ইচ্ছা সে তার প্রতিপালকের দিকে পথ অবলম্বন করুক। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যদি তারা আল্লাহর উপর ও পরকালের উপর ঈমান আনতো তবে তাদের উপর কি বোঝা চাপতো? (শেষ পর্যন্ত)!” (৪:৩৯)

অতঃপর ইরশাদ হচ্ছেঃ ব্যাপার এই যে, তোমরা ইচ্ছা করবে না যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা হিদায়াত লাভের যোগ্য পাত্র তাদের জন্যে তিনি হিদায়াতের পথ সহজ করে দেন এবং হিদায়াতের উপকরণ প্রস্তুত করে দেন। আর যে নিজেকে পথভ্রষ্টতার পাত্র বানিয়ে নেয় তাকে তিনি হিদায়াত হতে দূরে সরিয়ে দেন। প্রত্যেক কাজেই তার পূর্ণ নিপুণতা ও পুরো যুক্তি রয়েছে। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন নিজের রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দেন এবং সরল সঠিক পথে দাঁড় করিয়ে দেন। আর যাকে ইচ্ছা করেন পথভ্রষ্ট করে থাকেন এবং সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন না। তার হিদায়াতকে না কেউ হারিয়ে দিতে পারে এবং না কেউ তার গুমরাহীকে হিদায়াতে পরিবর্তিত করতে পারে। তার শাস্তি পাপী, যালিম এবং অন্যায়কারীর জন্যে নির্দিষ্ট রয়েছে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও গুরুত্ব :

الدهر শব্দের অর্থ : সময়, যুগ, কাল ইত্যাদি। এ সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। প্রথম আয়াতে الإنسان (মানুষ) শব্দটি বিদ্যমান। তাই ইনসান নামেও এ সূরাকে অভিহিত করা হয়। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ, না মদীনায় অবতীর্ণ-এ ব্যাপারে মতভেদ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ আলেমদের মতে এটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন : শেষের দশ আয়াত মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। (ফাতহুল কাদীর)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর দিন ফজরের সালাতে প্রথম রাকাতে সূরা সাজদাহ দ্বিতীয় রাকাতে অত্র সূরা পাঠ করতেন। (নাসায়ী হা. ৯৫৫, ইবনু মাযাহ হা. ৮২১, সহীহ)

সূরার শুরুতেই প্রশ্নাকারে মানুষের সৃষ্টির উৎস ও রহস্য উদঘাটন করে তার সৃষ্টির পেছনে কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে, তারপর কাফিরদের শাস্তির কথা সংক্ষিপ্তাকারে বলার পর সৎ, কৃতজ্ঞ ও সৃষ্টি জীবের প্রতি দয়ালু ব্যক্তিদের জন্য তৈরি করা জান্নাতের নেয়ামত ও তাতে তাদের সাচ্ছন্দ্যে বসবাসের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সৃষ্টির প্রাথমিক ও তার পূর্বের অবস্থা বর্ণনা করছেন। মানুষকে সৃষ্টি করার পূর্বে সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। এ আয়াতটি মানুষের বিবেকে আরো অনেক চিন্তা-ভাবনা ও আত্মজিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। মানুষের জন্মের উৎস, পার্থিব জীবন ও তার চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে তাকে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর আসে জন্মের পর মানুষের স্থীতি ও প্রজাতিক বিস্তৃতির প্রসংগ। এর পেছনে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক কাহিনী। আয়াতে حِيْنٌ مِّنَ الدَّهْرِ বলতে মায়ের গর্ভে রূহ ফুঁকে দেওয়ার পূর্বের সময়কালকে বুঝোনো হয়েছে, যে সময় বীর্য আকারে জরায়ুতে বিদ্যমান ছিল। এ সময়টা ছিল চল্লিশ দিন।

(مِنْ نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ)

“আমশাজ” অর্থ : মিশ্রিত, অর্থাৎ স্বামী ও স্ত্রীর ডিম্বাণু উভয়ের সংমিশ্রণকে বুঝোনো হয়েছে। স্বামীর বীর্য স্ত্রীর ডিম্বাণুর সংমিশ্রণে চল্লিশ দিন বিদ্যমান থাকার পর আল্লাহ তা‘আলা মায়ের জরায়ুতে রূহ ফুঁকে দেন। তারপর স্তরে স্তরে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেন। অসীম শক্তিধর স্রষ্টা এভাবে মিশ্রিত বীর্য থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিছক তামাসাচ্ছলে বা উদ্দেশ্যহীনভাবে নয় বরং তাকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে সৎ আমলে উত্তম। এ কারণেই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করার পর তাকে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন করেছেন। তারপর তাকে ভাল ও মন্দ উভয় পথ দেখিয়ে বিবেকের স্বাধীনতা দান করেছেন। যাতে আখিরাতে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সে কোন অভিযোগ করতে না পারে। এ সম্পর্কে সূরা মু’মিনূনে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

نَّبْتَلِيْهِ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য, কে সৎ আমলে উত্তম। যেমন তিনি বলেন :

(الَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيٰوةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ط وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْغَفُوْرُ) ‏

“যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করবার জন্য কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম। আর তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।” (সূরা মুলক ৬৭ : ২)

(إِنَّا هَدَيْنٰهُ السَّبِيْلَ)

অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা‘আলা ভালমন্দের দুটি পথই দেখিয়ে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَهَدَيْنٰهُ النَّجْدَيْن)

“আর আমি কি তাকে দু’টি পথ দেখাইনি?” (সূরা বালাদ ৯০ : ১০)

অনেকে বলে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা খারাপ পথ না দেখিয়ে শুধু ভাল পথ দেখালে তো মানুষ অন্যায় কাজ করত না। হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা উভয় পথকে দেখিয়ে দিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। সাথে সাথে বলে দিয়েছেন যারা ভাল পথে চলবে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে উত্তম প্রতিদান আর যারা খারাপ পথ অবলম্বন করবে তাদের পরিণাম হবে ভয়াবহ ও অত্যন্ত খারাপ।

(إِمَّا شَاكِرًا وَّإِمَّا كَفُوْرًا)

অর্থাৎ মানুষকে ভালমন্দের উভয় পথ দেখিয়ে দেওয়ার পর একশ্রেণির মানুষ আল্লাহ তা‘আলার পথে চলে আরেক শ্রেণি আল্ল্হার সাথে কুফরী করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : প্রত্যেক ব্যক্তি সকাল করে নিজেকে বিক্রিত অবস্থায়। বিক্রি করে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় (অর্থাৎ কুফরী করে জাহান্নামে যায়) অথবা নিজেকে মুক্ত করে। (অর্থাৎ ঈমান এনে জাহান্নাম থেকে নিজেকে মুক্ত করে)। (সহীহ মুসলিম হা. ২২৩)

সুতরাং বিবেক ও মত প্রকাশ ইত্যাদির স্বাধীনতা পেয়ে যেন আল্লাহদ্রোহী কাজে লিপ্ত না হই সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত, কারণ সব কিছুর হিসাব দিতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. সূরার গুরুত্ব অবগত হলাম।
২. মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সাধারণ একটু পানি থেকে, অতএব গর্ব অহংকারের সাথে দম্ভভরে চলার কোন কারণ নেই।
৩. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টির পর ভালমন্দ উভয় পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।
৪. যারা সৎপথ বেছে নিয়েছে তারা সফলকাম আর যারা সৎপথ বর্জন করেছে তারা হতভাগা।
৫. মানুষকে উভয় পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্য হল পরীক্ষা করা। কে ঈমানের পথে চলে আর কে তা বর্জন করে।

৪-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

পূর্বের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করার পর ঈমান ও কুফরীর পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, অতএব যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করে কাফির হবে তাদের জন্য পূর্ব প্রতিশ্র“ত পরিণতিস্বরূপ আল্লাহ তা‘আলার জাহান্নামের শৃংখল, বেড়ি ও লেলিহান আগুনে প্রবেশ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

( إِذِ الْأَغْلٰلُ فِيْٓ أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلٰسِلُ يُسْحَبُوْنَ فِي الْحَمِيْمِ ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُوْنَ)

“যখন তাদের গলদেশে বেড়ি ও শৃঙ্খল থাকবে, তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে।” (সূরা মু’মিন ৪০ : ৭১-৭২)

পক্ষান্তরে যারা সৎ আমল করত আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবে তাদের জন্য রয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত।

كأس বলা হয় এমন পান পাত্রকে যা শরাব দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে উচ্ছ্বলিত হতে থাকে।

كافور হল সুগন্ধী যা মিশ্রণে স্বাদ আরো বেড়ে যায় এবং তার সুগন্ধ মস্তিষ্ককে সতেজ করে তোলে।

تفجير অর্থ الانباع বা নির্গমন, উদ্ভব। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَقَالُوْا لَنْ نُّؤْمِنَ لَكَ حَتّٰي تَفْجُرَ لَنَا مِنَ الْأَرْضِ يَنْـ ـبُوْعًا ‏)‏

“এবং তারা বলে : ‘আমরা কখনই তোমাতে ঈমান আনব না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি হতে একটি প্রস্রবণ উৎসারিত কর” (সূরা ইসরা ১৭ : ৯০)

অর্থাৎ জান্নাতীদের চাহিদা অনুযায়ী সেই ঝর্ণা ব্যবহার উপযোগী করে দেওয়া হবে।

(يُوْفُوْنَ بِالنَّذْرِ)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা শরীয়তের মাধ্যমে যেসব কাজ করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং নিজেরা যা নযরের মাধ্যমে ওয়াজিব করে নেয় সবকিছু একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সম্পাদন করে। এ থেকে বুঝা যায়, মানত পূরণ করা ওয়াজিব, যদি সেটা ভাল কাজের জন্য হয়। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশার্থে মানত করবে সে যেন তার আনুগত্য প্রকাশ করে (অর্থাৎ মানত পূর্ণ করে) আর যে ব্যক্তি মানত করে আল্লাহর অবাধ্য কাজে সে যেন মানত পূর্ণ করে আল্লাহর অবাধ্য না হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৬৬৯৬)

অতএব কেউ যদি কোন মাযারে কিছু দেবে, বা কোন পীর, গাউছ কুতুব অথবা শির্ক করা হয় এমন কোন জায়গায় কিছু দেওয়ার মানত করে তাহলে সে যেন তা পূর্ণ না করে। বরং মানতের কাফফারা দিয়ে দেবে।

(عَلٰي حُبِّه….) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবেসে, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য ইয়াতীম মিসকীনদেরকে খাদ্য খাওয়ায়। আবার এই অর্থও করা হয় যে, খাদ্যের প্রতি লালসা থাকা সত্ত্বেও গরীব-মিসকীনকে খাদ্য খাওয়ায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَاٰتَي الْمَالَ عَلٰي حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبٰي وَالْيَتٰمٰي وَالْمَسٰكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ لا وَالسَّآئِلِيْنَ وَفِي الرِّقَابِ)

“এবং তাঁরই ভালবাসা অর্জনের জন্য আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, দরিদ্র, পথিক ও ভিক্ষুকদেরকে এবং দাসত্ব মোচনের জন্য ধন-সম্পদ দান করে” (সূরা বাকারাহ ২ : ১৭৭)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : উত্তম সাদকাহ হল তুমি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করবে এমনবস্থায় যে, তুমি সুস্থ এবং সম্পদের প্রতি তোমার আসক্তি রয়েছে। অর্থাৎ ধনী হওয়ার আশাবাদী ও দরিদ্রতার আশংকা কর। হাফেয ইবনু কাসীর (রহঃ) দ্বিতীয় মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (ইবনু কাসীর)

أَسِيْرًا তথা বন্দী। বন্দী ও দাস-দাসীদের সাথে ভাল আচরণ করার প্রতি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এমনকি মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি বলেছেন : সালাত সালাত এবং তোমাদের অধিনস্ত দাস দাসী। (আহমাদ হা. ২৬৪৮৩)

عَبُوْسًا ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর অর্থ সংকীর্ণ, কঠিন।

قَمْطَرِيْرًا অর্থ : طويلا বা সুদীর্ঘ। অর্থাৎ আমরা এসব ভাল কাজ করি এ আশায় যে, হয়তো আল্লাহ তা‘আলা কঠিন ও দীর্ঘ দিনে আমাদের ওপর রহম করবেন। (ইবনু কাসীর)

(نَضْرَةً وَّسُرُوْرًا)

অর্থাৎ উজ্জ্বল হবে তাদের চেহারা এবং প্রফুল্ল হবে তাদের মন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ مُّسْفِرَةٌ لا ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ)

“সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে; হাস্যেজ্জল ও প্রফুল্ল।” ( সূরা আবাসা ৮০ : ৩৮-৩৯)

(وَجَزٰـهُمْ بِمَا صَبَرُوْا)

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত কাজ পালনে নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকতে এবং দীনের পথে চলতে তোমরা যেসব দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ করেছে তার প্রতিদান হল জান্নাত এবং তার আরাম-আয়েশ। অতএব যারা এমন জান্নাতের আশা করে তারা কখনো আল্লাহদ্রোহী কাজ করতে পারে না বরং সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিমূলক কাজে নিজেকে লিপ্ত রাখে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যারা স্বেচ্ছায় কুফরীর পথ বেছে নেবে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে জাহান্নাম।
২. যারা ঈমানের পথ বেছে নেবে তাদের জন্য নেয়ামত পূর্ণ জান্নাত প্রস্তুত রয়েছে।
৩. মানত করতে হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য, কোন ব্যক্তি বা মাযারের জন্য বা নিকটে নয়।
১৩-২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতেগুলোতে জান্নাতীদের জন্য যে অশেষ নেয়ামত প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। জান্নাতীরা জান্নাতে অতিশয় শান্ত, সুখময়, নিরুদ্বেগ, কোমল, সৌহার্দময় ও নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে থাকবে।

(لَا يَرَوْنَ فِيْهَا شَمْسًا وَّلَا زَمْهَرِيْرًا) زمهرير-

অর্থ কঠিন শীত। অর্থাৎ জান্নাতে কোন গরম এবং ঠান্ডা অনুভব করবে না।

(وَدَانِيَةً عَلَيْهِمْ ظِلَالُهَا)

অর্থাৎ গাছের ছায়া তাদের প্রতি ঝুঁকে থাকবে, এবং গাছের ফলগুলো তাদের আয়ত্তাধিন করে দেওয়া হবে, মন চাইলে হাত বাড়ালেই ওর ফল নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

إِنَّ فِي الجَنَّةِ لَشَجَرَةً يَسِيرُ الرَّاكِبُ فِي ظِلِّهَا مِائَةَ سَنَةٍ

জান্নাতে এমন একটি গাছ রয়েছে যার ছায়াতলে একজন আরোহী একশত বছর অতিক্রম করবে। (সহীহ বুখারী হা. ৩২৫২, সহীহ মুসলিম হা. ২৮২৬)

قَوَارِيْرَا অর্থ : কাঁচের পাত্র। এ কাঁচের পাত্রগুলোও রৌপ্যের হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

لاَ تَلْبَسُوا الحَرِيرَ وَلاَ الدِّيبَاجَ، وَلاَ تَشْرَبُوا فِي آنِيَةِ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ، وَلاَ تَأْكُلُوا فِي صِحَافِهَا، فَإِنَّهَا لَهُمْ فِي الدُّنْيَا وَلَنَا فِي الآخِرَةِ

তোমরা রেশমি কাপড় পরিধান করো না, স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্রে পান করিও না এবং সে সব পাত্রে খাবে না। কেননা এগুলো তাদের (কাফির) জন্য দুনিয়াতে আর তোমাদের জন্য আখিরাতে। (সহীহ বুখারী হা. ৫৪২৬, সহীহ মুসলিম হা. ২০২৭)

(قَدَّرُوْهَا تَقْدِيْرًا)

অর্থাৎ যে পানপাত্রে পানীয় পরিবেশন করা হবে তা তাদের তৃষ্ণা পরিমাণ। ফলে পান করার পর অতিরিক্ত থাকবে না।

زَنْجَبِيْلًا শুকনো আদা (শুঠ)-কে বলে। এটা গরম জাতীয় জিনিস। এর মিশ্রণে সুগন্ধময় এক ধরনের ঝাঁঝ সৃষ্টি হয়।

(وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُوْنَ)

অর্থাৎ জান্নাতী যুবক যারা এক অবস্থায় চিরস্থায়ী থাকবে। তাদের বয়স বৃদ্ধি হবে না। তাদের কিশোর সুলভ বয়স ও সৌন্দর্য অব্যাহত থাকবে। তাদের সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সজীবতা ও সতেজতা দেখে মনে হবে যেন তারা মণি-মুক্তা।

ثَمَّ শব্দ দ্বারা স্থানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ জান্নাতের যেদিকেই তাকাবে সেদিকেই দেখতে পাবে অসংখ্য নিয়ামত ও আল্লাহর সীমাহীন রাজত্ব।

سُنْدُسٍ হল পাতলা বা চিকন রেশমী আর إِسْتَبْرَقٌ হল মোটা রেশমী পোশাক। আলী (রাঃ) বলেন : যখন জান্নাতীরা জান্নাতের দরজায় পৌঁছবে তখন তারা দুটি নহর দেখতে পাবে, যার খেয়াল যেন তাদের মনেই জেগে ছিল। একটির পানি তারা পান করবে। ফলে মনের কালিমা সবই দূরীভূত হয়ে যাবে। অন্যটিতে তারা গোসল করবে। ফলে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় সৌন্দর্যই তারা পুরো মাত্রায় লাভ করবে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৪৩) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَي قَلْبِ بَشَرٍ

আমি আমার সৎ বান্দাদের জন্য এমন কিছু তৈরি করে রেখেছি যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান তা শ্রবণ করেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে তা কল্পনাতেও আসেনি। (সহীহ বুখারী হা. ৩২৪৪, সহীহ মুসলিম হা. ২৮২৪)

আমরা যেন এ নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত পেতে পারি সে জন্য উপযুক্ত আমল করতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. জান্নাতীদের জন্য প্রস্তুত রাখা অশেষ নেয়ামত রাজির কথা জানতে পারলাম।
২৩-৩১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি প্রদত্ত অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, অতএব আমার ফায়সালার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ কর। আর যদি কাফির ও মুনাফিকরা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তা প্রচারে ও পালনে বাধা প্রদান করতে চায় তাহলে তাদের অনুসরণ করো না বরং দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যাও।

আল্লামা ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : الاثم হল যে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা করা হয়। আর كَفُوْرً হল যে অন্তর অবিশ্বাসী। ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থাবলী সাক্ষ্য দেয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তারা ক্ষমতা, ধন সম্পদ ও রূপ যৌবনের লালসা দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতে চিয়েছিল। তাকে উচ্চতর নেতা বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। আবার বিকল্প হিসাবে তাকে তাদের মধ্যে সবেেচয়ে ধনী বানিয়ে দেবে বলেও প্রলোভন দেখিয়েছিল। দেশের সুন্দরী নারীর সাথে বিবাহ দিতে মত পোষণ করেছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের কোন প্রস্তাবই মেনে নেননি। বরং তিনি দীনের পথে মানুষকে আহ্বান করেই গেছেন। যত বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তত দাওয়াতী মিশন বৃদ্ধি পেয়েছে।

(بُكْرَةً وَّأَصِيْلًا)

সকাল-সন্ধ্যা বলতে সারাদিন, এতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ও নফলসহ সকল প্রকার সালাত শামিল। এ অংশ এ কথাও প্রমাণ করছে- শুধু মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পথে আহ্বান করলেই যথেষ্ট হবে না বরং সেই সাথে নিজে সদামল করতে হবে, আর আল্লাহ তা‘আলাকে সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে।

(وَّمِنَ اللَّيْلِ فَاسْجُدْ)

‘রাতে তাঁর জন্য সিজদায় নত হও’ অনুরূপ মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন :

(وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِه۪ نَافِلَةً لَّكَ عَسٰٓي أَنْ يَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا) ‏

“এবং রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুত কায়েম কর, এটা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।” ( সূরা ইসরা ১৭ : ৭৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(يٰٓأَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ ‏ قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيْلًا لا ‏ نِّصْفَه۫ أَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِيْلًا لا ‏ أَوْ زِدْ عَلَيْهِ وَرَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِيْلًا )

“হে বস্ত্রাবৃত (ব্যক্তি)! রাত্রি জাগরণ (নামায আদায়) কর, কিছু অংশ। তার অর্ধেক কিংবা তদপেক্ষা কিছু কম। অথবা তদপেক্ষা বেশি। আর কুরআন পাঠ কর ধীরে ধীরে, (থেমে থেমে সুন্দরভাবে)” (সূরা মুজ্জাম্মিল ৭৩ : ১-৪)

(إِنَّ هٰٓؤُلَا۬ءِ)

‘নিশ্চয়ই তারা’ বলতে মক্কার কাফিরদেরকে বুঝোনো হয়েছে। তবে এতে সকল কাফির শামিল। অর্থাৎ যাদের গন্তব্য অত্যন্ত কাছাকাছি এবং যাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অত্যন্ত তুচ্ছ ও নগণ্য তারা এ দুনিয়াকে নিয়েই ডুবে থাকে এবং পশ্চাতের বিপদসংকুল দিনকে উপেক্ষা করে। সুতরাং কোন ব্যাপারেই তাদের অনুকরণ ও অনুসরণের অবকাশ নেই। তাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে মু’মিনদের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কোন মিল নেই।

(يَوْمًا ثَقِيْلًا) কঠিন দিন বলতে কিয়ামত দিবসকে বুঝোনো হয়েছে।

(وَإِذَا شِئْنَا بَدَّلْنَآ…)

‘আমি যখন ইচ্ছা করব তখন তাদের পরিবর্তে…’ ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তাদের ছাড়া অন্য জাতিকে নিয়ে আসতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنْ يَّشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِاٰخَرِيْنَ ط وَكَانَ اللّٰهُ عَلٰي ذٰلِكَ قَدِيْرًا )‏

“হে মানুষ! তিনি (আল্লাহ) ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে অপসারিত করে অপরকে আনতে পারেন; আল্লাহ এটা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম।” (সূরা নিসা : ৪ : ১৩৩)

(وَمَا تَشَا۬ءُوْنَ إِلَّآ أَنْ يَّشَا۬ءَ اللّٰهُ)

‘তোমরা ইচ্ছা কর না যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন।’ অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। মানুষ ইচ্ছা করলেই কিছু করতে পারে না যদি আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা না করেন। সুতরাং যাকে ইচ্ছা তিনি তাঁর রহমত তথা ইসলামে প্রবেশ করার সুযোগ দান করেন আর যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করেন। ‘আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা’ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং প্রতিটি মু’মিন-মুসলিমের উচিত নিজে সদামল করবে এবং সাথে সাথে সদামলের দিকে মানুষকে আহ্বান করবে। এতে যত বাধা বা তা বর্জন করতে যত প্রলোভন আসুক তা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের ভালবাসার সামনে তুচ্ছ মনে করবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পাপিষ্ঠ কাফিরদের অনুসরণ করা হারাম।
২. মু’মিনদের উচিত সালাত, যিকির ও দু‘আর মাধ্যমে সাহায্য চাওয়া।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন তার প্রমাণ পেলাম।
৪. কুরআন মু’মিনদের জন্য উপদেশবাণী।
৫. দুনিয়ার কোন মোহ মু’মিনকে আল্লাহ তা‘আলার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। বরং দুনিয়ার সকল কিছুর ওপর সে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলকে প্রাধান্য দেয়।

Leave a Reply