Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯০/এবং কাফের-র। বলে:-৩৪)
[**সুরা: আল-মুরসালাত
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
*সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য:-
*কাফেরদের জন্যে মহাবিপর্যয় : সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত
পারা:২৯
১-৫০ নং আয়াতের বেখ্যা :-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন::-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১
وَ الۡمُرۡسَلٰتِ عُرۡفًا ۙ﴿۱﴾
শপথ কল্যাণ স্বরূপ প্রেরিত অবিরাম বায়ুর।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২
فَالۡعٰصِفٰتِ عَصۡفًا ۙ﴿۲﴾
অতঃপর প্রলয়ংকরী ঝটিকার,
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩
وَّ النّٰشِرٰتِ نَشۡرًا ۙ﴿۳﴾
শপথ প্ৰচণ্ড সঞ্চালনকারীর,
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪
فَالۡفٰرِقٰتِ فَرۡقًا ۙ﴿۴﴾
শপথ মেঘমালা-বিক্ষিপ্তকারী বায়ুর,
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৫
فَالۡمُلۡقِیٰتِ ذِکۡرًا ۙ﴿۵﴾
শপথ তাদের যারা (মানুষের অন্তরে) উপদেশ পৌঁছিয়ে দেয়।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৬
عُذۡرًا اَوۡ نُذۡرًا ۙ﴿۶﴾
ওজর হিসেবে অথবা ভীতি হিসেবে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৭
اِنَّمَا تُوۡعَدُوۡنَ لَوَاقِعٌ ؕ﴿۷﴾
যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৮
فَاِذَا النُّجُوۡمُ طُمِسَتۡ ۙ﴿۸﴾
যখন নক্ষত্ররাজির আলো নির্বাপিত হবে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৯
وَ اِذَا السَّمَآءُ فُرِجَتۡ ۙ﴿۹﴾
যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১০
وَ اِذَا الۡجِبَالُ نُسِفَتۡ ﴿ۙ۱۰﴾
যখন পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে উড়িয়ে দেওয়া হবে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১১
وَ اِذَا الرُّسُلُ اُقِّتَتۡ ﴿ؕ۱۱﴾
আর যখন রাসূলগণকে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত করা হবে ,
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১২
لِاَیِّ یَوۡمٍ اُجِّلَتۡ ﴿ؕ۱۲﴾
এই সমুদয় বিলম্বিত করা হয়েছে কোন্ দিবসের জন্য?
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১৩
لِیَوۡمِ الۡفَصۡلِ ﴿ۚ۱۳﴾
বিচার দিনের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১৪
وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا یَوۡمُ الۡفَصۡلِ ﴿ؕ۱۴﴾
তুমি কি জান সে ফায়সালার দিনটি কি?
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১৫
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۱۵﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১৬
اَلَمۡ نُہۡلِکِ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿ؕ۱۶﴾
আমি কি পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করিনি?
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১৭
ثُمَّ نُتۡبِعُہُمُ الۡاٰخِرِیۡنَ ﴿۱۷﴾
আবার পরবর্তী লোকদের তাদের অনুগামী করে দেব।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১৮
کَذٰلِکَ نَفۡعَلُ بِالۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۸﴾
অপরাধীদের প্রতি আমি এরূপই করে থাকি।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-১৯
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۱۹﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২০
اَلَمۡ نَخۡلُقۡکُّمۡ مِّنۡ مَّآءٍ مَّہِیۡنٍ ﴿ۙ۲۰﴾
আমি কি তোমাদেরকে এক নগণ্য পানি থেকে সৃষ্টি করিনি ?
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২১
فَجَعَلۡنٰہُ فِیۡ قَرَارٍ مَّکِیۡنٍ ﴿ۙ۲۱﴾
একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তা স্থাপন করেছিলাম না?
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২২
اِلٰی قَدَرٍ مَّعۡلُوۡمٍ ﴿ۙ۲۲﴾
এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২৩
فَقَدَرۡنَا ٭ۖ فَنِعۡمَ الۡقٰدِرُوۡنَ ﴿۲۳﴾
আমি একে গঠন করেছি পরিমিতভাবে, আমি কত সুনিপুণ স্রষ্টা!
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২৪
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۲۴﴾
সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২৫
اَلَمۡ نَجۡعَلِ الۡاَرۡضَ کِفَاتًا ﴿ۙ۲۵﴾
আমি কি যমীনকে ধারণ ক্ষমতার অধিকারী বানাইনি,
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২৬
اَحۡیَآءً وَّ اَمۡوَاتًا ﴿ۙ۲۶﴾
জীবিত ও মৃত উভয়ের জন্য?
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২৭
وَّ جَعَلۡنَا فِیۡہَا رَوَاسِیَ شٰمِخٰتٍ وَّ اَسۡقَیۡنٰکُمۡ مَّآءً فُرَاتًا ﴿ؕ۲۷﴾
আমি ওতে স্থাপন করেছি সুদৃঢ় উচ্চ পর্বতমালা এবং তোমাদেরকে দিয়েছি সুপেয় পানি।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২৮
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۲۸﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-২৯
اِنۡطَلِقُوۡۤا اِلٰی مَا کُنۡتُمۡ بِہٖ تُکَذِّبُوۡنَ ﴿ۚ۲۹﴾
চলো এখন সে জিনিসের কাছে যাকে তোমরা মিথ্যা বলে মনে করতে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩০
اِنۡطَلِقُوۡۤا اِلٰی ظِلٍّ ذِیۡ ثَلٰثِ شُعَبٍ ﴿ۙ۳۰﴾
চল তিন শাখা বিশিষ্ট ছায়ার দিকে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩১
لَّا ظَلِیۡلٍ وَّ لَا یُغۡنِیۡ مِنَ اللَّہَبِ ﴿ؕ۳۱﴾
যে ছায়া শীতল নয় এবং যা রক্ষা করে না অগ্নিশিখা হতে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩২
اِنَّہَا تَرۡمِیۡ بِشَرَرٍ کَالۡقَصۡرِ ﴿ۚ۳۲﴾
এটা উৎক্ষেপ করবে বৃহৎ স্ফুলিঙ্গ অট্টালিকা তুল্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩৩
کَاَنَّہٗ جِمٰلَتٌ صُفۡرٌ ﴿ؕ۳۳﴾
ওটা হলুদ বরণ উটদলের মত।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩৪
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۳۴﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩৫
ہٰذَا یَوۡمُ لَا یَنۡطِقُوۡنَ ﴿ۙ۳۵﴾
এটা এমন একদিন যেদিন কারো মুখে কথা ফুটবে না।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩৬
وَ لَا یُؤۡذَنُ لَہُمۡ فَیَعۡتَذِرُوۡنَ ﴿۳۶﴾
এবং না তাদেরকে ওজর পেশ করার সুযোগ দেয়া হবে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩৭
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۳۷﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩৮
ہٰذَا یَوۡمُ الۡفَصۡلِ ۚ جَمَعۡنٰکُمۡ وَ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۳۸﴾
এটা চূড়ান্ত ফায়সালার দিন। আমি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের একত্রিত করেছি।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৩৯
فَاِنۡ کَانَ لَکُمۡ کَیۡدٌ فَکِیۡدُوۡنِ ﴿۳۹﴾
তোমাদের যদি কোন অপকৌশল থেকে থাকে তাহলে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে দেখো।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪০
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿٪۴۰﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪১
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ ظِلٰلٍ وَّ عُیُوۡنٍ ﴿ۙ۴۱﴾
মুত্তাকীরা আজ সুশীলত ছায়া ও ঝর্ণাধারার মধ্যে অবস্থান করছে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪২
وَّ فَوَاکِہَ مِمَّا یَشۡتَہُوۡنَ ﴿ؕ۴۲﴾
তাদের বাঞ্ছিত ফলমূলের প্রাচুর্যের মধ্যে।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪৩
کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا ہَنِیۡٓــًٔۢا بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۴۳﴾
‘তোমাদের কর্মের পুরস্কারস্বরূপ তোমরা তৃপ্তির সাথে পানাহার কর।’
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪৪
اِنَّا کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۴۴﴾
এভাবে আমরা মুহসিনদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪৫
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۴۵﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪৬
کُلُوۡا وَ تَمَتَّعُوۡا قَلِیۡلًا اِنَّکُمۡ مُّجۡرِمُوۡنَ ﴿۴۶﴾
তোমরা অল্প কিছুদিন পানাহার ও ভোগ করে নাও; তোমরা তো অপরাধী।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪৭
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۴۷﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যাজ্ঞানকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪৮
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ ارۡکَعُوۡا لَا یَرۡکَعُوۡنَ ﴿۴۸﴾
যখন তাদেরকে বলা হয়, রুকু কর তখন তারা রুকু করে না ।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৪৯
وَیۡلٌ یَّوۡمَئِذٍ لِّلۡمُکَذِّبِیۡنَ ﴿۴۹﴾
সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের জন্য।
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত:-৫০
فَبِاَیِّ حَدِیۡثٍۭ بَعۡدَہٗ یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿٪۵۰﴾
এখন এ কুরআন ছাড়া আর কোন বাণী এমন হতে পারে যার ওপর এরা ঈমান আনবে?
www.motaher21.net
সুরা: ৭৭: আল্- মুরসালাত
পারা:২৯
১-৫০ নং আয়াতের বেখ্যা :-
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন::-
সুরা: আল-মুরসালাত
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৭৭
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : প্রচন্ড আলােড়ন সৃষ্টিকারী অনেকগুলাে দৃশ্য ও সুতীব্র প্রভাব বিস্তারকারী বহু বক্তব্যে এ সূরাটি পরিপূর্ণ। মনে হয় এর প্রত্যেকটি বাক্য এক একটি জলন্ত আগুনের কাঠি। এগুলাে যেন শ্রোতার বিবেকের ওপর অত্যন্ত ভয়ংকর আঘাত করে। তার বিবেকের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ও হুমকির কিছু বান যেন ছুড়ে মারে। সুরাটি দুনিয়া ও আখেরাতের বিভিন্ন দৃশ্য, মানব সত্ত্বা সংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্ব এবং কেয়ামত ও আযাবের বহু চিত্র তুলে ধরে। আর প্রত্যেকটি দৃশ্য তুলে ধরার পর অপরাধীর মনের ওপর যেন এই বলে একটা একটা ধারালাে আগুনের শূল নিক্ষেপ করে। ‘সেদিন অবিশ্বাসীদের জন্যে ধ্বংস অনিবার্য।’ পুরাে সূরাটিতে দশবার এই ছন্দায়িত মন্তব্যটি পেশ করা হয়েছে। এটি এই সূরার একটি বিশিষ্ট বাকধারায় পরিণত হয়েছে। আলােচনার ক্ষুরধার ইংগিত, আলােড়ন সৃষ্টিকারী দৃশ্যসমূহ ও প্রভাব সৃষ্টিকারী উপস্থাপনা ভংগির সাথে এই মন্তব্যগুলাে একান্ত সংগতিপূর্ণ। সূরা আর রহমান-এ আল্লাহর এক একটি নেয়ামতের বিবরণ দেয়ার পর বারবার উচ্চারিত হয়েছে, ‘অতপর তােমরা তােমাদের প্রতিপালকের কোন নেয়ামতটি অস্বীকার করবে?’ অনুরূপভাবে সূরা আল কামার-এ প্রতিটি আযাবের ঘটনা বর্ণনা করার পর বারবার এ কথাটি উচ্চারিত হয়েছে যে, ‘অতঃপর দেখলে তাে আমার আযাব ও হুঁশিয়ারী কেমন ছিলাে?’ আলােচ্য সূরায় এই বারবার উচ্চারিত তাৎপর্যবহ বাক্যটি আগের সূরা দুটোর সে বাক্য দুটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে এটির বারবার উচ্চারণ সূরাটিকে একটি বিশেষ চরিত্রে ও মহিমায় মন্ডিত করেছে এবং তাকে বহুলাংশে ধারালাে ও তেজস্বী করে তুলেছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সূরার আয়াতগুলাে ছােট ছােট, গতিশীল ও প্রচন্ড প্রভাবময়ী। অধিকাংশই বিচিত্র মিত্রাক্ষর শব্দে সমাপ্ত আয়াতের সমষ্টি। আয়াতের শেষে কখনাে কখনাে একই মিত্রাক্ষর শব্দ পুনরুচ্চারিত হয়েছে। এসব মিত্রাক্ষর শব্দগুলাে ছােট ও গতিশীল। এর বাক্যগুলাে শ্রোতার স্নায়ুতে তীব্র এক দাহ ও প্রবল প্রেরণার সৃষ্টি করে। এসব অনুভূতি তাদের মনে একের পর এক অবিরত ধারায় সৃষ্টি হতে থাকে। একটির রেশ না মিলাতেই আর একটির উদ্ভব হয়। সূরার শুরু থেকেই এই ধারা শুরু হয়েছে। তীব্র ঘুর্ণিবায়ু অথবা ফেরেশতার উল্লেখ দ্বারা সুরার পরিবেশকে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ করা হয়েছে। এপর্যায়ে প্রথম ৭টি আয়াত লক্ষণীয়। এই উদ্বোধনী বক্তব্যগুলাে সূরার সার্বিক পরিমন্ডল ও তার প্রভাব বলয়ের সাথে পুরােপুরিভাবেই সংগতিশীল। এসব ক্ষেত্রে কোরআন একটি বিশেষ রীতি অনুসরণ করে থাকে। কোথাও সুরা আদ-দোহা’র ন্যায় স্নেহপ্রীতি ও দরদ মাখা দৃশ্য অংকন করে। আবার কোথাও অনুসরণ করে সূরা আদিয়াত এর ন্যায় উষাকালীন দ্রুতগামী অশ্বের ধুলা উড়ানাে এবং কবর খুলে কবরবাসীর পুনরুজ্জীবিত হওয়ার দৃশ্য। এভাবে বিভিন্ন দৃশ্য বিভিন্ন জায়গায় তুলে ধরা হয়ে থাকে। এই উদ্বোধনী বক্তব্যের পর সুরার যে দশটি প্যারা সম্বলিত ছােট ছােট বাক্যগুচ্ছ রয়েছে, তার প্রত্যেকটিই বলতে গেলে শ্রোতাকে এক একটি স্বতন্ত্র জগতে টেনে নিয়ে যায়। প্রত্যক জগতে পরিভ্রণের সময় সূরাটি নিজেই যেন চিন্তা গবেষণা, আবেগ, উদ্দীপনা মানসিক প্রতিক্রিয়া ও সাড়ার এক একটি বিশাল অংগনে রূপান্তরিত হয়। ব্যবহৃত ভাষা ও শব্দের তুলনায় সেই বাস্তব অংগনগুলাে অনেক প্রশস্ত ও সুপরিসর। শব্দগুলাে যেন এক একটি সাংকেতিক তীর, যা বিভিন্ন জগতের দিকে ইংগিত করে যায়। এর মধ্যে প্রথম বাক্যগুচ্ছটি (৮-১৫তম আয়াত) কেয়ামতের দিনের দৃশ্য বর্ণনা সম্বলিত। এতে আকাশ ও পৃথিবীতে যে ভয়াবহ পরিবর্তন সূচিত হবে তার একটা সুন্দর চিত্র আঁকা হয়েছে। এই চিত্র সে সময়কার, যখন রসূলরা সবাই মানব জাতির সাথে এক হয়ে হিসাব চুকিয়ে দেবেন। দ্বিতীয় প্যারাটি হচ্ছে অতীত যমানার আল্লাহদ্রোহীদের ধ্বংসের কাহিনী সম্বলিত। আল্লাহর বিধান ও দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যানকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কি নীতি অবলম্বন করে থাকেন এখানে তার প্রতি ইশারা ইংগিত রয়েছে। এ প্যারাটি ১৬ থেকে ১৯ তম আয়াত পর্যন্ত বিস্তৃত। তৃতীয় প্যারাটি মানুষের ইহকালীন জীবনের সূচনা, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত এবং এটি ২০-২৪ আয়াত জুড়ে বিস্তৃত। চতুর্থ প্যারাটি ২৫-২৮ আয়াত জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। এতে পৃথিবী, তার জীবিত ও মৃত অধিবাসীদের বাসস্থান বর্ণনা, তার স্থীতি ও তাতে জীবন দানকারী পানির প্রাচুর্যের উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম প্যারাটি রয়েছে ২৯-৩৪ আয়াত সমূহে। ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের কেয়ামতের দিন যে আযাবে ভুগতে হবে এতে তার বিবরণ রয়েছে। ষষ্ঠ (৩৫-৩৭) ও সপ্তম প্যারায় (৩৮-৪০) দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের ভয়াবহ পরিণতির আরাে কিছু বিবরণ এসেছে। পার্থিব জীবনের সব কিছুই এই আখেরাত বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় সকল প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত মূল্যবােধের বিশুদ্ধিও এর ওপর নির্ভরশীল। তাই এই আকীদাকে মনে বদ্ধমূল করার জন্যে এক দীর্ঘস্থায়ী চেষ্টা সাধনার প্রয়ােজন ছিলাে।
ফী জিলালিল কুরআন: সূরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং শপথ করে বলছেন যে, আখেরাত সংক্রান্ত এই প্রতিশ্রুতি কার্যকর হবেই। আর শুরুতে শপথ সূচক ক্রিয়াপদটি এই মর্মে ইংগিত দেয় যে, আল্লাহ তায়ালা যে জিনিসের শপথ করছেন, তা অদৃশ্য জগতের অজানা একশক্তি, যা মানবজীবনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। প্রাচীন তাফসীরকারদের মধ্যে উল্লেখিত শব্দ কয়টি মুরসালাত (প্রেরিত) আ’সিফাত (প্রবাহিত) ফারিকাত (বিচ্ছিন্নকারী) ও মুলকিয়াত (জাগরুককারী) দ্বারা প্রকৃতপক্ষে কি বুঝানাে হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, এ দ্বারা সকল রকমের বাতাসকে বুঝানাে হয়েছে। আবার কেউ বলেন, সকল শ্রেণীর ফেরেশতাকে বুঝানাে হয়েছে। আবার কারাে মতে, এর কোনাে কোনাে শব্দ দ্বারা বাতাস এবং কোনাে কোনােটি দ্বারা ফেরেশতা বুঝানাে হয়েছে। এই শেষােক্ত ব্যাখ্যার আলাকে এই শব্দ কয়টি সত্যিই রহস্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই অস্পষ্টতা ও রহস্যময়তা আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারে লুকানো অদৃশ্য জিনিসের নামে শপথ করার সাথে অধিকতর সংগতিপূর্ণ। শপথ দ্বারা এ কথাও বুঝানাে হয়েছে যে, এই সব অজানা ও অদৃশ্য জিনিস যেমন বাস্তব ও মানব জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী, ঠিক তেমনি এই শপথও বাস্তব এবং অবধারিতভাবে তা কার্যকর হবে। হযরত আবু হুরায়রা(রা.), মাসরুক, আবুদ দোহা, মুজাহিদ, সুদ্দী, রবী ইবনে আনাস ও আবু সালেহ থেকে বর্ণিত আছে যে, মুরসালাত বা প্রেরিত শব্দ দ্বারা ফেরেশতা বুঝানাে হয়েছে। সে মতে কথাটার মর্ম দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ তায়ালা ক্রমাগত ও অবিরত ধারায় প্রেরিত ফেরেশতাদের নামে শপথ করছেন। উরফ শব্দটি ঘােড়ার বিরামহীন দৌড়ের বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবু সালেহ একই রকম ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন। আসিফাত, নাশিরাত, ফারিকা ও মুলকিয়াত দ্বারাও ফেরেশতা বুঝানাে হয়েছে। ইবনে মাসউদ(রা.)-এর মতে ‘মুরসালাত’ দ্বারা ঘােড়ার মতাে জোরে ছুটে চলা বাতাসকে বুঝানাে হয়েছে। আসিফাত ও নাশিরাত শব্দদ্বয়ের ব্যাখ্যাও তিনি এভাবে করেছেন যে, এর অর্থ হচ্ছে বাতাস। কোনাে কোনাে বর্ণনা অনুসারে ইবনে আব্বাস(রা.), মুজাহিদ, কাতাদা ও আবু সালেহ-এর মতও তদ্রুপ। মুরসালাত দ্বারা যে বাতাসকে বুঝানাে হয়েছে ইবনে জরীর সে ব্যাপারে নিশ্চিত। অনুরূপভাবে নাশিরাত অর্থ হবে আকাশে মেঘ বিস্তারকারী বাতাস। ইবনে মাসউদ(রা.) বলেন, ফারিকাত ও মুলকিয়াত দ্বারা ফেরেশতা বুঝানাে হয়েছে। এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাস(রা.), মাসরূক, মুজাহিদ, কাতাদা, রবী ইবনে আনাস, সুদ্দী ও সাওরী প্রমূখও একমত। কেননা তারা আল্লাহর নির্দেশে রসূলদের কাছে আসেন, হক ও বাতিলকে পৃথক করেন এবং রাসূলের কাছে ওহী নাযিল করেন, যা সৃষ্টির ওপরও ভীতি প্রদর্শন সম্বলিত । আমার অভিমত হচ্ছে যে, এখানে যে কয়টি জিনিসের নামে শপথ করা হয়েছে, তার প্রকৃত মর্ম আমাদের কাছে অজ্ঞাত। যেমন ‘যারিয়াত’ ও ‘নাযিয়াত’ শব্দ দুটো রয়েছে। এর মর্ম নির্ণয়ে যে মতভেদ ঘটেছে তা থেকেও এর অস্পষ্টতা প্রমাণিত হয়। এগুলাের সুনিশ্চিত অর্থ অজ্ঞাত রাখার উদ্দেশ্য সম্ভবত, ভীতি ও আতংক সৃষ্টি। এই অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতাই এখানকার মূল উপাদান। অস্পষ্টতাই এখানে সব স্পষ্ট ব্যাপার। এই অস্পষ্টতাই শ্রোতার চেতনায় এক ধরনের শিহরণ আনে। এই শিহরণ ও কম্পনই সুরার বক্তব্য বিষয়ের সাথে অধিকতর মানানসই। বস্তুত সুরার প্রত্যেকটি প্যারাই হচ্ছে এক একটি শিহরণ। ঠিক যেন কোনাে ব্যক্তিকে ঘড়ি ধরে এক একটা ঝাকুনি দিয়ে তার অপরাধ সম্পর্কে বা সত্য অস্বীকার করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, ‘অতপর সেদিন সত্য অস্বীকারকারীদের ধ্বংস অনিবার্য বলে চরম একটা হুমকি দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।’
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-১৫
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
সেদিন ধ্বংস অপেক্ষা করছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
ফী জিলালিল কুরআন:
*কেয়ামতের মহাপ্রলয় : এরপর কেয়ামতের দিনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দৃশ্য তুলে ধরে তাকে আরেকটি প্রচন্ড ঝাকুনি দেয়া হচ্ছে। রসূলরা সমগ্র মানব জাতির কাছ থেকে তাদের রেসালাতের দায়িত্ব পালনের কি সাড়া পেলেন তার হিসাব মেলানাের জন্যে কেয়ামতের এই দিনটি নির্দিষ্ট রয়েছে। ‘যখন নক্ষত্রমালা দান হয়ে যাবে, আকাশ বিদীর্ণ করা হবে, পাহাড় ধুনে ফেলা হবে… সেই দিন অমান্যকারীদের জন্যে চুড়ান্ত ধ্বংস ও বিপর্যয় সংঘটিত হবে।’ কোরআনের বহু সূরায় এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়েছে। বিকট গর্জন, প্রকান্ড ফাটল ও ভয়াবহ বিক্ষোরণের মাধ্যমে দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বের সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। দুনিয়ার জীবনে মানুষ ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরীর অগ্নুৎপাত, ঝড় বন্যা প্রভৃতি হাজারাে ত্রাসসঞ্চারী বিপর্যয় দেখে থাকলেও কেয়ামতের সেই মহা বিপর্যয়ের সাথে এগুলাের কোনাে তুলনাই হবে না। কেয়ামতের ভয়াবহ ঘটনাবলীর সাথে এই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনা করার ব্যাপারটি হচ্ছে শিশুদের বাজি ফুটানাের সাথে আনবিক বোমা ও হাইড্রোজেন জাতীয় কোনাে বিস্ফোরকের মতাে। আসলে এটা একটা কাছাকাছি উদাহরণ পেশ করা মাত্র। নচেৎ এই প্রকৃতির বিপর্যয় ও বিস্ফোরণের ফলে যে আতংকের সৃষ্টি হবে, তা মানুষের কল্পনার যে কোনাে বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়াবহ ও মারাত্মক হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়াও এই সূরায় আরেকটি বিষয়ের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা এখনাে পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে। সেটি এই যে, সেদিন রসূলরা পৃথিবীতে তাদের আবহমানকালব্যাপী আল্লাহর দিনের দাওয়াত পেশ করার ফলাফল প্রকাশ করবেন। এই দিনটিই তাদের এই কাজের জন্যে নির্ধারিত ছিলাে। সেদিন তারা এ কাজের সর্বশেষ হিসাব পেশ করবেন, যাতে আল্লাহর ফয়সালা ও বিধান অনুসারে পার্থিব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিরােধের মীমাংসা করা যায় এবং যুগ যুগ পরে আল্লাহর সর্বশেষ বার্তা ও ঘােষণা করা যায়। এ আয়াত কয়টির ভাষায় এই দাওয়াতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং তার বিশালত্বকে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। ‘যখন রসূলদের উপস্থিতির সময় এসে পড়বে….’ বর্ণনাভংগী থেকে স্পষ্ট হয় যে, এখানে একটি গুরুতর বিষয়ের অবতারণা হতে যাচ্ছে। এই বিষয়টি যখন শ্রোতার অনুভূতিতে পূর্ণ ভয়াবহতা নিয়ে জাগরুক হয় এবং ম্নান হয়ে যাওয়া নক্ষত্র, ফেটে যাওয়া আকাশ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত পাহাড় পর্বতের চেয়েও তার ভয়াবহতা বেশী হয়, তখনই এই ভীতিজনক হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়, সেদিন ধ্বংস ও বিপর্যয় হবে অমান্যকারীদের জন্যে। এই হুমকি ও হুঁশিয়ারী স্বয়ং মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ সময়ে হুমকির প্রভাব যে অত্যন্ত ভীতিজনক হবে তা সহজেই বােধগম্য।
ফী জিলালিল কুরআন: *অপরাধীদের সাথে আচরণ : কেয়ামতের ভয়াল দৃশ্যের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তায়ালা অতীতের ধ্বংস হয়ে যাওয়া কাফেরদের বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘আমি কি আগের লােকদের ধ্বংস করিনি। তারপর তাদের পূরবর্তীদেরকেও একই পরিনতির শিকার করিনি। আমি অপরাধীদের সাথে এ রকমই আচরণ করে থাকি। সেদিন ধ্বংস ও বিপর্যয় হবে অস্বীকারকারীদের জন্যে!’ এভাবে দেখা গেলাে একটি আঘাতেই যেন আগের লােকদের মৃতদেহের স্তুপ পড়ে রইলাে। আরেক আঘাতে পরবর্তীদের মৃতদেহের স্তুপও পড়ে রইলাে। যতাে দূর দৃষ্টি যায়, যেন হতাহতদের বিরাণ সারি আর সারি। আর তাদের উপস্থিতিতেই যেন আল্লাহর শাশ্বত ঘােষণা জারী করা হচ্ছে ‘হাঁ আমি অপরাধীদের সাথে এ রকমই আচরণ করে থাকি।’ এটা আল্লাহর এক চিরস্থায়ী ও নিরপেক্ষ নীতি, আর যেহেতু সকল যুগের অপরাধীরাই অতীতের অপরাধীদের মতাে ধ্বংসের যােগ্য, তাই তাদের ধ্বংস ও বিপর্যয়ের হুমকি দেয়া হচ্ছে, ‘সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে ধ্বংস ও বিপর্যয় (অবধারিত)!’
ফী জিলালিল কুরআন: ধ্বংস ও বিপর্যয়ের বর্ণনা থেকে পরবর্তী প্যারায় সৃষ্টি ও উজ্জীবনের বিবরণে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। এই সৃষ্টি ও উজ্জীবন পরিকল্পিত ও সুশৃংখল ছােট ও বড় সকলের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। ‘আমি কি তােমাদেরকে অত্যন্ত তুচ্ছ পানি থেকে সৃষ্টি করিনি। আমি সব ধরনের কাজ করতে সমর্থ। আমি অতীব ক্ষমতাবান। সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে মহা বিপর্যয় ও ধ্বংস!’ এটা ছিলো মাতৃগর্ভে সন্তানের দীর্ঘ ও বিচিত্র বিবর্তনের কাহিনী, এখানে অতি সংক্ষেপে তা বর্ণনা করা হয়েছে। এক ফোটা তুচ্ছ পানিকে সুরক্ষিত জরায়ুতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে জন্যে সংরক্ষণ করা। সেই মেয়াদটির বিভিন্ন স্তরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে যে সৃজনী কাজ চলে তারই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে মন্তব্য আসছে, ‘আমি এরূপ করতে সমর্থ, আমি অতীব ক্ষমতাবান। বস্তুত আল্লাহর এই প্রজ্ঞাই পরিকল্পিতভাবে সকল জিনিসের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আল্লাহ তায়ালা এই অপ্রতিরােধ্য পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিতে পুনরায় হুমকি উচ্চারিত হয়েছে অমান্যকারীদের জন্যে সেদিন মহা বিপর্যয় ও ধ্বংস।
ফী জিলালিল কুরআন: এরপর এই পৃথিবীর প্রসংগ আলােচিত হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষের জীবনের জন্যে আল্লাহ তায়ালা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা দিয়েছেন। মানব জীবনকে সহজ ও সুগম করতে পারে, এমন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট ও উপকরণ দান করেছেন, ‘আমি কি পৃথিবীকে একটি আবাসভূমি করে বানাইনি…’ অর্থাৎ আমি জীবিত ও মৃত সকলের জন্যেই পৃথিবীকে আবাস ভূমি বানিয়েছি। এখানে উচু ও সুদৃঢ় পর্বতমালা বানিয়েছি, যার শীর্ষস্থানে মেঘমালা পুঞ্জীভূত হয় এবং তা থেকে সুপেয় পানি গড়িয়ে পড়ে। এ সব ব্যবস্থা কি স্ৰষ্টার অপার ক্ষমতা ও পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব? বিচক্ষণ প্রজ্ঞা, নিপুন কুশলতা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কি এসব আসলেই সম্ভব? এর পরও কি অমান্যকারীরা তা অমান্য করবে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৩৪
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
ফী জিলালিল কুরআন:
*কাফেরদের জন্যে মহাবিপর্যয় : সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে মহাবিপর্যয় ও ধ্বংস অনিবার্য। এ সব দৃশ্য তুলে ধরা এবং এর প্রভাবে শ্রোতার স্নায়ুমন্ডলকে আবেগে উদ্বেলিত করার পর আকস্বিকভাবে কেয়ামতের জবাবদিহী, হিসাব নিকাশ ও কর্মফল সংক্রান্ত আলােচনা শুরু করা হয়েছে। এখানে আমরা শুনতে পাচ্ছি ইসলামী দাওয়াতকে যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে প্রত্যাখ্যানকারী সেই অপরাধীদের আযাবের দিকে ধাবিত হবার জন্যে ভয়াবহ এক আদেশ জারী করা হচ্ছে, যাতে তাদের মনােকষ্ট আরাে বাড়ে, ‘চলাে তােমরা যা মিথ্যা মনে করতে তার দিকে… সেদিন মহাবিপর্যয় হবে মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের।’ কেয়ামতের ময়দানের দীর্ঘ, অবরুদ্ধ ও আটক জীবন শেষে তারা মুক্ত হয়ে রওয়ানা হবে। কিন্তু কোথায় যাবে? মনে হয় সেই মুক্তিলাভ ও রওয়ানা হওয়ার চেয়ে অবরুদ্ধ ও আটক থাকাই ভালাে ছিলাে! ‘চলাে তােমরা সেদিকে যা তােমরা মিথ্যা মনে করতে।’ কেননা সেটা তাে এখন তােমাদের সম্পূর্ণ সামনে উপস্থিত। ‘তােমরা চলাে তিন শাখা বিশিষ্ট ছায়ার দিকে।’ এ ছায়া হলো জাহান্নামের ধোয়ার ছায়া। এর ছায়া তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে লম্বা হয়ে যাবে। সেই ছায়ার চেয়ে জ্বলন্ত আগুন অনেক ভালাে! ‘তা ঠান্ডা নয় এবং আগুনের লেলিহান হল্কা থেকেও তা রক্ষা করে না।’ অর্থাৎ গরম ও শ্বাসরুদ্ধকর ছায়া। তাকে ছায়া নাম দেয়া আসলে কাফেরদের সাথে আল্লাহর এক নিষ্ঠুর উপহাস। তাদেরকে এই মর্মে আশান্বিত করা হচ্ছে যে, জাহান্নামের উত্তাপ থেকে এই ছায়ায় আশ্রয় সন্ধান করলেও করতে পারাে! রওয়ানা হয়ে যাও। কোথায় রওয়ানা হতে হবে তা তো জানাে! কাজেই তার নাম উল্লেখ করার প্রয়ােজন নেই। ‘সেই আগুন প্রাসাদতুল্য অগ্নি শিখা ছুড়ে মারবে, যেন হলুদ বর্ণের উট।’ (‘কাসর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রাসাদ। আরবরা অবশ্য যে কোনাে পাথর নির্মিত ঘরকেই কাসর বলতাে। তাই প্রচলিত অর্থে এটি প্রাসাদের মতাে বিশাল ও প্রকান্ড হওয়া জরুরী নয়।) যখন এই শিখা ক্রমাগত ছুটতে থাকবে, তখন মনে হবে তা ইতস্তত বিচরণকারী হলুদ উট। আগুনের শিখার অবস্থা যখন এরূপ, তখন সে আগুন থেকে যে শিখা বের হয়, তা কি রকম হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। এই বিবরণ সম্পর্কিত ভীতি যখন সমগ্র চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, ঠিক সেই মুহূর্তে মন্তব্য করা হচ্ছে- ‘সেদিন বিপর্যয় ও ধ্বংস অমান্যকারীদের জন্যে। এই দৃশ্যমান আযাবের দৃশ্য যথাযথভাবে তুলে ধরার পর এক কঠিন মানসিক আযাবের বিবরণের মাধ্যমে এ আলোচনা এখানে শেষ হচ্ছে, পরবর্তী আয়াত দুটোতে বলা হয়েছে ‘এটা হবে সেই দিন যখন তারা নির্বাক হয়ে যাবে, কোনাে ওযর আপত্তি তােলার কোনাে অনুমতি পাবে না।’ বস্তুত তখন এক ভীতিকর নীরবতা ও থমথমে নিস্তব্ধতার আকারে আতংকময় পরিস্থিতি বিরাজ করবে। সেই নীরবতা ভেংগে কেউ কোনাে কথা বলবে না, না কেউ কোনাে ওযর আপত্তি তুলতে পারবে। কেননা তর্কবিতর্ক করা বা ওযর বাহানা করার সময় অনেক আগেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ‘সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে শুধু বিপর্যয় ও ধ্বংসের দিন!’ কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় তাদের আক্ষেপ, অনুশােচনা, দুনিয়ায় ফেরত পাঠানাে হলে তাদের ভালাে হওয়ার শপথ এবং নানা রকমের ওযর আপত্তির বিবরণ দেখা যায়। যেহেতু কেয়ামতের দিনটি পরিমাণে অনেক বড় হবে। তাই সেখানে কিছু সময় ওযর আপত্তি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কাটবে, আবার কিছু সময় নির্বাক ও নিস্তব্ধ অবস্থায়ও কেটে যাবে, এটা হচ্ছে হযরত ইবনে আব্বাসের ব্যাখ্যা। আলােচ্য সুরায় পূর্বাপর পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই নির্বাক অবস্থাটাই বেশী মানানসই বলে সেটাই এখানে বর্ণনা করা হয়েছে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৪০
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ۠
সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
ফী জিলালিল কুরআন:
পরবর্তী আয়াত দুটোতে বলা হচ্ছে- ‘এটা হচ্ছে মীমাংসার দিন। আমি আজ তােমাদেরকে ও তােমাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে সমবেত করেছি। এখন আমার বিরুদ্ধে কোনাে ষড়যন্ত্র করতে চাইলে তােমরা করতে পারাে। সেই দিন অমান্যকারীদের জন্যে ধ্বংস ও বিপর্যয়!’ অর্থাৎ আজ মীমাংসা ও কর্মফলের দিন, ওযর বাহানা করার দিন শেষ হয়ে গেছে। আজ আমি তােমাদেরকে ও তােমাদের পূর্ববর্তীদেরকে একত্রিত করেছি। সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে কোনাে ফন্দি বা চক্রান্ত আঁটতে চাও তো আঁটো। কিছু করার ক্ষমতা থাকে তাে করো। কোনাে চক্রান্তই আঁটতে পারবে না। কোনাে ক্ষমতাও তােমাদের নেই। আজ শুধু তােমাদের মুখ ভােতা করে থাকার দিন। কঠিন মানসিক আযাব মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া তােমাদের কোনােই গত্যান্তর নেই। ‘আজ তােমাদের বিপর্যয় ও ধ্বংসের দিন।’
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৫০
فَبِاَیِّ حَدِیْثٍۭ بَعْدَهٗ یُؤْمِنُوْنَ۠
এখন এ কুরআন ছাড়া আর কোন বাণী এমন হতে পারে যার ওপর এরা ঈমান আনবে?
ফী জিলালিল কুরআন:
*মােমেনদের বিশেষ পুরষ্কার : অপরাধীদের দৈহিক ও মানসিক আযাবের বিবরণ শেষে এখন পরহেযগার ও সৎকর্মশীল লােকদের পুরস্কারের বিবরণ দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে সম্মানের সাথে এখানে সম্বােধন করা হচ্ছে, ‘পরহেযগার ও সৎকর্মশীলরা ছায়া ঝর্ণার মধ্যে থাকবে এবং থাকবে… সেদিন বিপর্যয় হবে শুধু অমান্যকারীদের!’ পরহেযগার লােকদের এই ছায়া হবে আসল ছায়া। সেই তিন শাখা বিশিষ্ট গরম ও শ্বাসরুদ্ধকর ছায়া নয়। তারা থাকবে সুপেয় পানির ঝর্ণার কাছে। শ্বাসরুদ্ধকর ধােয়ার ছায়ায় নয়; যা শুধু পিপাসাই বাড়ায়। ‘আর মজাদার ফলমূল।’ দৈহিক ভাবে উপভােগ্য ও সম্মানজনক এ সব নেয়ামত লাভের পর তারা সমগ্র মানবজাতির সামনে আরেকটি সম্মানও লাভ করবেন এবং তা হচ্ছে- ‘তােমাদের সৎ কর্মের পুরস্কার স্বরূপ তােমরা আজ এসব কিছু সসম্মানে খাও ও পান করাে। আমি সৎ কর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি।’ পুরস্কারকে আরাে উপভােগ্য করা হবে। সেই অবমাননার ঘােষণা হলাে, এই সম্মানের পাশাপাশি কাফেরদের জন্যে অবমাননাকর আযাবের ঘােষণা দিয়ে সৎকর্মের ‘সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে বিপর্যয় অনিবার্য।’ পরবর্তী আয়াতে দুনিয়ার জীবনের বন্ধ হয়ে যাওয়া পাতাটি যেন ক্ষণিকের জন্যে আবার খােলা হচ্ছে। সহসা যেন আমরা দুনিয়ায় ফিরে এসেছি, এখানে অপরাধীদের কঠোর ভাষায় বলা হচ্ছে- ‘অল্প কিছুদিন তােমরা খাওয়া দাওয়া করাে ও ভােগবিলাসে মত্ত হও, তােমরাই অপরাধী। সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে বিপর্যয় অনিবার্য!’ এভাবে পরপর দুটি প্যারায় দুনিয়া ও আখেরাতকে একত্রিত করা হয়েছে। পরস্পর বিরােধী এই দুটি দৃশ্য যেন একই সময়ে উপস্থিত হয়েছে। অথচ উভয়ের মাঝে রয়েছে অনন্ত কালের ব্যবধান। একটু আগেই যেখানে আখেরাতে পরহেযগারদেরকে সম্বােধন করা হয়েছে, সেখানে পরক্ষণেই দুনিয়ার ভােগবিলাসে মত্ত কাফেরদের উদ্দেশ্য করে কথা বলা হয়েছে। তাদেরকে যেন বলা হচ্ছে, দুই ধরনের বিশ্বাসের পরিণামের পার্থক্যটা তােমরা ভালাে করে দেখে নাও। এই দুনিয়ার ক্ষনস্থায়ী আয়েশ কিছুটা ভােগ করে নাও। তাহলেই পরিণামটা টের পাবে। সেখানে সকল আরাম আয়েশ থেকে বঞ্চিত হবে এবং সুদীর্ঘকালের আযাব ভােগ করবে। ‘সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে বিপর্যয় ও ধ্বংস।’ অতপর এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে যে, মােশরেকদের হেদায়াতের দিকে ডাকা হচ্ছে অথচ তারা তা গ্রহণ করছে না, যখন তাদেরকে বলা হয়, তােমরা রুকু করো তখন তারা রুকু করে না। সেদিন অমান্যকারীদের জন্যে বিপর্যয় ও ধ্বংস অনিবার্য। খারাপ পরিণামের বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করা এবং এর সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পর বলা হয়েছে- ‘আর কোন বাণীতে তারা অতপর বিশ্বাস স্থাপন করবে!’ আল্লাহর যে বাণী পাহাড়কে টলিয়ে দেয়, তার প্রতি যে ব্যক্তি ঈমান আনে না, সে অতপর আর কোনাে বাণীতেই বিশ্বাস আনবে না। সুতরাং এই অবিশ্বাসীদের ভাগ্যে নির্ধারিত রয়েছে শুধু দুঃখ কষ্ট, বঞ্চনা, হীনতা, চরম অশুভ পরিণাম ও ভয়াবহ বিপর্যয়। এত জোরদার এবং বিবেকের ওপর তার আঘাত এতাে তীব্র যে, তার সামনে কারাে বিবেক ও মন স্থির থাকতে পারে না এবং কোনাে মানব সত্ত্বা তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারে না। সূরাটির ভাষা এত গঠনমূলক, তার সুরেলা উপস্থাপনা এত শানিত, তার উপস্থাপিত দৃশ্যাবলী কোরআনে এই অপ্রতিরােধ্য শক্তি যিনি নিহিত রেখেছেন এবং এই কোরআনকে যিনি নাযিল করেছেন, সেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানাই, মুক্ত কষ্ঠে আমরা ঘােষণা করি সােবহানাল্লাহ!
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৭৭-মুরসালাত) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতের وَالۡمُرۡسَلٰتِ عُرۡفًاۙ শব্দটিকেই এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
(৭৭-মুরসালাত) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এ সূরার পুরো বিষয়বস্তু থেকে প্রকাশ পায় যে, এটি মক্কী যুগের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছিল। এর আগের দুটি সূরা আর্থাৎ সূরা কিয়ামাহ ও সূরা দাহর এবং পরের দুটি সূরা অর্থাৎ সূরা আননাবা ও নাযি’আত যদি এর সাথে মিলিয়ে পড়া যায় তাহলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এ সূরাগুলো সব একই যুগে অবতীর্ণ।আর এর বিষয়বস্তুও একই যা বিভিন্ন ভংগিতে উপস্থাপন করে মক্কাবাসীদের মন-মগজে বদ্ধমূল করা হয়েছে।
(৭৭-মুরসালাত) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এর বিষয়বস্তু কিয়ামত ও আখেরাতকে প্রমাণ করা এবং এ সত্যকে অস্বীকার করলে কিংবা মেনে নিলে পরিণামের যেসব ফলাফল প্রকাশ পাবে সে বিষয়ে মক্কাবাসীদের সচেতন করে দেয়া।
কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার যে খবর দিচ্ছেন তা যে অবশ্যই হবে প্রথম সাতটি আয়াত বাতাসের ব্যবস্থাপনাকে তার সত্যতা ও বাস্তবতার সপক্ষে সাক্ষ্যী হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এতে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে, যে অসীম ক্ষমতশালী সত্তা পৃথিবীতে এ বিস্ময়কর ব্যবস্থাপনা কায়েম করেছেন তাঁর শক্তি কিয়ামত সংঘটিত করতে অক্ষম হতে পারে না। আর যে স্পষ্ট যুক্তি ও কৌশল এ ব্যবস্থাপনার পেছনে কাজ করছে তাও প্রমাণ করে যে, আখেরাত অবশ্যই সংঘটিত হওয়া উচিত। কারণ পরম কুশলী স্রষ্টার কোন কাজই নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না। আখেরাত যদি না থাকে তাহলে এর অর্থ হলো, এ গোটা বিশ্ব-জাহান একেবারেই উদ্দেশ্যহীন।
মক্কাবাসীরা বারবার বলতো যে, তুমি আমাদের যে কিয়ামতের ভয় দেখাচ্ছো তা এনে দেখাও। তাহলে আমরা তা মেনে নেব। ৮ থেকে ১৫ আয়াতে তাদের এ দাবীর উল্লেখ না করে এ বলে তার জবাব দেয়া হয়েছে যে, তা কোন খেলা বা তামাশার বস্তু নয় যে, যখনই কোন ঠাট্টাবাজ বা ভাঁড় তা দেখানোর দাবী করবে তখনই তা দেখিয়ে দেয়া হবে। সেটা তো মানব জাতি ও তার প্রতিটি সদস্যের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালার দিন। সে জন্য আল্লাহ তাআলা একটি বিশেষ সময় ঠিক করে রেখেছেন। ঠিক সে সময়ই তা সংঘটিত হবে। আর যখন তা আসবে তখন এমন ভয়ানক রূপ নিয়ে আসবে যে, আজ যারা ঠাট্টা-বিদ্রুপের ভংগিতে তার দাবী করছে সে সময় তারা দিশেহারা ও অস্থির হয়ে পড়বে।তখন ঐসব রসূলগণের সাক্ষ্য অনুসারেই এদের মোকদ্দমার ফায়সালা হবে, যাদের দেয়া খবরকে এসব আল্লাহদ্রোহী আজ অত্যন্ত নি:শঙ্কচিত্তে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে।অতপর তারা নিজেরাই জানতে পারবে যে, কিভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের আয়োজন করেছে।
১৬ থেকে ১৮ আয়াত পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে কিয়ামত ও আখেরাত সংঘটিত হওয়া এবং তার অনিবার্যতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। এসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের নিজের ইতিহাস, তার জন্ম এবং যে পৃথিবীতে সে জীবন যাপন করেছে তার গঠন, আকৃতি ও বিন্যাস, সাক্ষ্য পেশ করছে যে, কিয়ামতের আসা এবং আখেরাত অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব এবং আল্লাহ তাআলার প্রাজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার দাবীও বটে। মানুষের ইতিহাস বলছে, যেসব জাতিই আখেরাত অস্বীকার করেছে পরিণামে তারা বিপথগামী হয়েছে এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এর অর্থ হলো, আখেরাত এমন একটি সত্য যে, যে জাতিরই আচার-আচরণ ও রীতি-নীতি এর বিপরীত হবে তার পরিণাম হবে সেই অন্ধের মত যে সামনেরর দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসা গাড়ীর দিকে বল্গাহারার মত এগিয়ে যাচ্ছে। এর আরো একটি অর্থ হলো, বিশ্ব-সম্রাজ্যের মধ্যে শুধু প্রাকৃতিক আইন (Physical Law, কার্যকর নয়, বরং একটি নৈতিক আইনও (Moral Law, এখানে কার্যকর রয়েছে। আর এ বিধান অনুসারে এ পৃথিবীতেও কাজের প্রতিদান দেয়ার সিলসিলা বা ধারা চালু আছে। কিন্তু দুনিয়ার এ জীবনে প্রতিদানের এ বিধান যেহেতু পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হতে পারছে না। তাই বিশ্ব-জাহানের নৈতিক বিধান অনিবার্যভাবেই দাবী করে যে, এমন একটি সময় আসা উচিত যখন তা পুরোপুরি বাস্তাবায়িত হবে এবং সেসব ভাল ও মন্দের যথোপযুক্ত প্রতিদান বা শাস্তি দেয়া হবে যা এখানে উপযুক্ত প্রতিদান বা পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল বা শাস্তি থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এর জন্য মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন হওয়া অপরিহার্য। মানুষ দুনিয়ায় যেভাবে জন্মলাভ করে সে বিষয়ে যদি সে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তার বিবেক-বুদ্ধি-অবশ্য যদি সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি থাকে- এ বিষয়টি অস্বীকার করতে পারে না যে, যে আল্লাহ নগণ্য বীর্য দ্বারা মানুষ সৃষ্টির সূচনা করে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত করেছেন যে পৃথিবীতে বাস করে মৃত্যুর পর তার শরীরের বিভিন্ন অংশ সেখান থেকে উধাও হয়ে যায় না। বরং তার দেহের এক একটি অণূ পরমাণু এ পৃথিবীতেই বিদ্যমান থাকে। পৃথিবীর এ মাটির ভাণ্ডার থেকেই সে সৃষ্টি হয়, বেড়ে উঠে ও লালিত-পালিত হয় এবং পুনরায় সে পৃথিবীর মাটির ভাণ্ডারেই গচ্ছিত হয়।যে আল্লাহ মাটির এ ভাণ্ডার থেকে প্রথমবার তাকে বের করেছিলেন তাতে মিশে যাওয়ার পর তিনি তাকে পুনরায় বের করে আনতে সক্ষম। তাঁর যুক্তি ও কৌশল সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে তোমরা এ বিষয়টিও অস্বীকার করতে পারবে না যে, পৃথিবীতে যে ক্ষমতা ও ইখতিয়ার তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার সঠিক ও ভুল প্রয়োগের হিসাব-নিকাশ নেয়াও নিশ্চিনভাবেই তাঁর বিচক্ষণতা ও বিজ্ঞতার দাবী এবং বিনা হিসেবে ছেড়ে দেয়াও তার যুক্তি ও কৌশলের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এরপর ২৮থেকে ৪০ পর্যন্ত আয়াতে আখেরাত অস্বীকারকারীদের পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে। ৪১ থেকে ৪৫ আয়াত পর্যন্ত সেসব লোকের পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে, যারা আখেরাতের ওপর ঈমান এনে দুনিয়ায় থেকেই নিজেদের পরিণাম গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। তারা আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা, নৈতিক চরিত্র ও কাজ-কর্ম এবং নিজের জীবন ও কর্মের সমস্ত মন্দ দিক থেকে দূরে অবস্থান করেছে যা মানুষের দুনিয়ার আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করলেও পরিণামকে ধ্বংস করে।
সবশেষে যারা আখেরাতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে যত আমোদ-ফূর্তি করতে চাও, করে নাও। শেষ অবধি তোমাদের পরিণাম হবে অত্যন্ত ধ্বংসকর। বক্তব্যের সমাপ্তি টানা হয়েছে এই বলে যে, কুরআনের মাধ্যমেও যে ব্যক্তি হিদায়াত লাভ করতে পারে না তাকে দুনিয়ার কোন জিনিসই হিদায়াত দান করতে সক্ষম নয়।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৬
عُذْرًا اَوْ نُذْرًاۙ
ওজর হিসেবে অথবা ভীতি হিসেবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ কখনো বাতাস বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দুর্ভিক্ষেরআশঙ্কা দেখা দেয়ায় মন নরম হয়ে যায় এবং মানুষ তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। কখনো রহমত স্বরূপ বৃষ্টি বয়ে আনার কারণে মানুষ আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে। আবার কখনো ঝড়-ঝঞ্ঝার প্রচণ্ডতা মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করে এবং ধ্বংসের ভয়ে মানুষ আল্লাহর দিকে রুজু করে। (আরো দেখুন, পরিশিষ্ট-৩)
(পরিশিষ্ট-৩)(১নং টীকার সাথে সম্পর্কিত)এ আয়াতগুলোতে প্রথম বৃষ্টি বহনকারী বাতাসসমূহের পরম্পরা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে যে, প্রথমে ক্রমাগত বাতাস চলতে থাকে। পরে তা ঝঞ্চ্বার রূপ ধারণ করে। তারপর মেঘমালাকে বহন করে নিয়ে ছড়িয়ে দেয়। অতঃপর তাকে বিদীর্ণ করে ভাগ ভাগ করে। এরপর বৃষ্টি নামার কথা উল্লেখ করার পরিবর্তে বলা হয়েছে যে, তা মনের মধ্যে আল্লাহর স্মরণকে জাগ্রত করে ওজর হিসেবে কিংবা ভীতি হিসেবে। অর্থাৎ সেটি এমন এক সময়ে ঘটে, যখন মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার হয়, তাই সে আল্লাহকে স্মরণ করতে বাধ্য হয়। কিংবা মানুষ তার দোষ-ত্রুটি ও অপরাধসমূহ স্বীকার করে দোয়া করতে থাকে, যেন আল্লাহ তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন, তার প্রতি দয়া করে যেন রহমত স্বরূপ বৃষ্টি বর্ষণ করেন। যদি দীর্ঘদিন পর্যন্ত বৃষ্টি না হয়ে থাকে এবং এক ফোঁটা পানির জন্য মানুষ কাতরাতে থাকে তাহলে সে অবস্থায় ঝঞ্ঝা প্রবাহিত হতে এবং বৃষ্টির মেঘ আসতে দেখে অনেক সময় কট্টর কাফেরও আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকে। তবে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ তীব্র বা হাল্কা হলে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ মানুষ যারা তারা সাধারণত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকে, তাই স্বাভাবিক দুর্ভিক্ষ হলেও তারা তাকে স্মরণ করবে। কিন্তু অন্যরা তখনও সাইন্সের বুলি কপচাতে থাকবে এবং বলবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। অমুক অমুক কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না। এতটুকু ব্যাপার নিয়ে দোয়া করতে শুরু করা দুর্বল আকীদা-বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই না। তবে যদি দীর্ঘদিন পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ লেগে থাকে এবং গোটা দেশ ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় তাহলে বড় বড় কাফেরদেরও তখন আল্লাহকে মনে পড়তে থাকে। মুখে বলতে লজ্জাবোধ করলেও তারা নিজের গোনাহ ও পাপ এবং অকৃজ্ঞতার জন্য লজ্জা অনুভব করে এবং আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করে যে, বাতাস বৃষ্টির যে মেঘ বহন করে আনছে তা থেকে যেন গোটা দেশে বৃষ্টিপাত হয়। এটাই হলো ওজর হিসেবে মনের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ জাগিয়ে তোলা। এরপর نُذْرًا (ভীতি) হিসেবে মনের মধ্যে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত হওয়ার ব্যাপারটা সংঘটিত হয় তখন যখন ঝড়ের বেগ বৃদ্ধি পেতে পেতে প্রচণ্ড বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করে এবং জনপদের পর জনপদ বিধ্বস্ত করে ফেলে কিংবা মুষলধারে এমন বৃষ্টি হতে থাকে যে, তা বিপদ সংকুল প্লাবনের রূপ ধারণ করে। এরূপ পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দৃঢ় মনোবলের কাফেরও আতংকগ্রস্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে বিনীতভাবে প্রার্থনা করতে থাকে। তখন তার মস্তিষ্কের গোপন প্রদেশ থেকে ঝড় ও প্লাবনের সমস্ত বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও ব্যাখ্যা উবে যায়। বাতাস প্রবাহিত হওয়ার এ অনুক্রম বা পারম্পর্য বর্ণনা করার পর বলা হচ্ছে, এসব বাতাস ওজর কিংবা ভীতি হিসেবে মনের মধ্যে আল্লাহকে স্মরণ জাগিয়ে দেয়। অন্য কথায় যেন বলা হচ্ছে দুনিয়ায় যেসব ব্যবস্থা চলছে তা মানুষকে এ সত্যটিই জানিয়ে দিচ্ছে যে, এ পৃথিবীর সবকিছু তার ইখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া হয়নি। বরং সবকিছুর ওপরে এক মহাশক্তি আছেন যিনি মানুষের ভাগ্যের ওপর কর্তৃত্ব চালাচ্ছেন। তাঁর ক্ষমতা এমন অপরাজেয় যে, যখন ইচ্ছা তিনি সমস্ত উপাদানকে মানুষের লালন ও প্রতিপালনের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। আবার যখন ইচ্ছা ঐ সব উপাদানকেই তার ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত করতে পারেন।
এরপর বাতাসের এ ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্তকে এ বিষয়ের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে যে, যে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। এখন দেখার বিষয় হলো, বাতাসের এ ব্যবস্থাপনা এ ব্যাপারে কি সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের সামনে উপস্থাপিত করছে।
কিয়ামাত ও আখেরাতের ব্যাপারে মানুষ সাধারণত দু’টি প্রশ্নে সংশয়-সন্দেহে নিপতিত হয় এবং বিব্রত বোধ করে। এক, কিয়ামত হওয়া সম্ভব কিনা? দুই, এর প্রয়োজনই বা কি? প্রশ্নের জটা জালে জড়িয়েই তার মধ্যে এ সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হয় যে, কিয়ামত কি আদৌ সংঘটিত হবে? নাকি এটি একটিকাহিনী মাত্র? এ বিষয়ে কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা থেকে প্রমাণ পেশ করে তার সম্ভাব্যতা, অনিবার্যতা এবং সংঘটিত হওয়া প্রমাণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় প্রমাণ পেশ করার যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তাহলো আল্লাহ তাআলার বিশাল সাম্রাজ্যের অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে কোন কোনটার শপথ করে বলা হয়েছে যে, তা সংঘটিত হবে। এ পন্থায় প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে তার সম্ভাব্যতা, অনিবার্যতা এবং সংঘটিত হওয়ার প্রমাণাদিও এসে যায়।
এখানেও প্রমাণ পেশের এ পন্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। এতে বায়ু প্রবাহের আবর্তন এবং বৃষ্টিপাতের ব্যবস্থাপনাকে এ বিষয়ে নিদর্শন হিসেবে পেশ করা হয়েছে যে, এটা একটা নিয়মিত ও স্থায়ী ব্যবস্থা যা একজন মহাজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান সত্তার ব্যবস্থাপনায় কায়েম হয়েছে। এটা আকস্মিকভাবে সংঘটিত কোন ঘটনা নয় যে, তার প্রভাবে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে আপনা থেকেই এ পন্থা-পদ্ধতি চালু হয়ে গিয়েছে এবং আপনা আপনি সমুদ্র থেকে বাষ্প উত্থিত হয়েছে, বাতাস তা বহন করে নিয়ে গিয়েছে এবং তা একত্র করে বৃষ্টি মেঘ সৃষ্টি করেছে। অতঃপর সে মেঘকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দিয়েছে এবং আপনা আপনি তা থেকে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কোন বিচার-বিবেচনা ও বুদ্ধি-বিবেকহীন প্রকৃতি কোন নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুন বিহীন রাজত্বে আকস্মিকভাবে এ ব্যবস্থাটি চালু করেনি। বরং এটা একটা সুনিশ্চিত ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা যা একটি বিধান মোতাবেক যথারীতি চলছে। সুতরাং সূর্যের তাপে সমুদ্রের পানি থেকে বাষ্প উত্থিত হওয়ার পরিবর্তে তা জমে বরফে পরিণত হচ্ছে এমনটা কখনো দেখা যায় না। বরং সূর্যরশ্মির উত্তাপে সমুদ্রের পানি থেকে সবসময় বাষ্পই উত্থিত হয়। মৌসুমী বায়ু প্রবাহ এমন উল্টো আচরণ কখনো করে না যে, বাষ্পীভূত পানিকে স্থলভাগের দিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সমুদ্রেই তাকে নিঃশেষ করে দিল। বরং তা বাষ্পকে সবসময় ওপরে উঠিয়ে নেয়। এমনও কখনো ঘটতে দেখা যায় না যে, মেঘমালা সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাতাস এসব মেঘ বহন করে শুষ্ক ভূ-ভাগের দিকে প্রবাহিত হওয়া বন্ধ করেছে এবং শুষ্ক ভূ-ভাগের ওপরে বৃষ্টিপাত একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোটি কোটি বছর থেকে একই নিয়মে এ ব্যবস্থা লাগাতার চলে আসছে। এমনটি যদি না হতো, এ পৃথিবীর বুকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব লাভ করা ও বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না।
এ ব্যবস্থার মধ্যে আপনি একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যমুখিতা এবং সুশৃঙ্খল বিধান কার্যকর দেখতে পাচ্ছেন। আপনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন যে, এ বায়ূপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাতের সাথে পৃথিবীর মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদরাজির জীবনের একটা অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এ ব্যবস্থাপনা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, পানির এ সরবরাহ প্রাণীকূলকে সৃষ্টি করা ও বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঠিক তার প্রয়োজন অনুসারে একটি নিয়ম বিধান মোতাবেক করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যমুখিতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা শুধু এ একটি ব্যাপারে নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের গোটা ব্যবস্থাপনায়ই তা দেখা যায় এবং মানুষের সমস্ত বৈজ্ঞানিক উন্নতি ও অগ্রগতি এর ওপরই নির্ভরশীল। আপনি একেকটি জিনিস সম্পর্কে জেনে নেন যে, তা কি কাজে লাগে এবং কোন নিয়ম অনুসারে কাজে করে। তারপর যে জিনিসগুলো সম্পর্কে আপনি যতটা জানতে পারেন তা কোন কাজে লাগে এবং কোন নিয়ম-বিধি অনুসারে কাজ করে তাকে কাজে লাগানোর ততটাই নতুন নতুন পন্থা-পদ্ধতি আপনি উদ্ভাবন করতে থাকেন এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে নিজের তামাদ্দুন ও সভ্যতার অগ্রগতি সাধন করতে থাকেন। এ পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে আর এখানকার প্রতিটি জিনিসই একটি অলংঘনীয় নিয়ম-বিধান ও শৃংখলা অনুসারে কাজ করছে এ মর্মে একটি স্বতস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক ধারণা যদি আপনার মন-মস্তিস্কে না থাকতো তাহলে আপনার মগজে কোন জিনিস সম্পর্কে এ প্রশ্ন আদৌ জাগতে না যে, তা কি উদ্দেশ্যে কাজ করছে এবং তাকে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।
এখন এ পৃথিবী এবং এর প্রতিটি জিনিস যদি উদ্দেশ্যমূলক হয়ে থাকে, যদি এ পৃথিবী এবং এর প্রতিটি জিনিসের মধ্যে একটি নিয়ম ও শৃঙ্খলা কার্যকর থেকে থাকে আর যদি তা শত শত কোটি বছর ধরে একাদিক্রমে এ উদ্দেশ্য এবং নিয়ম-বিধি ও শৃংখলা অনুসারে চলে যাক, তাহলে সে ক্ষেত্রে একজন একগুয়ে ও হঠকারী মানুষই কেবল একথা অস্বীকার করতে পারে যে, একজন মহাজ্ঞানী, মহাকৌশলী এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা সৃষ্টি করেছেন। সে আল্লাহ সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করা নিতান্তই আহমকী যে, এ পৃথিবীকে তিনি বানাতে এবং পরিচালনা করতে পারেন ঠিকই কিন্তু তা ধ্বংস করতে পারেন না এবং ধ্বংস করার পর ইচ্ছা করলে তা অন্য কোন আকৃতিতে পুনরায় বানাতেও পারেন না। প্রাচীনকালের অজ্ঞ নাস্তিকদের একটা বড় হাতিয়ার ছিল বস্তুর অবিনশ্বর ও অবিনাশী হওয়ার ধারণা। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি তাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করেছে। এখন এটা জ্ঞানগতভাবে স্বীকৃত সত্য যে, বস্তু শক্তিতে (Energy) রূপান্তরিত হতে পারে এবং শক্তিও বস্তুতে রূপন্তরিত হতে পারে। তাই এ কথা সম্পূর্ণরূপে বিবেক-বুদ্ধিসম্মত যে, চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী আল্লাহ তা’আলা এ বস্তুজগতকে যতদিন পর্যন্ত কায়েম রাখবেন ততদিন পর্যন্ত তা কায়েম থাকবে। কিন্তু যখনই তিনি একে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চাইবেন শুধু একটি ইঙ্গিতেই তা করতে পারবেন। তাছাড়া এ শক্তিকে আবার অন্য একটি বস্তুর আকৃতিতে সৃষ্টি করার জন্যও তাঁর একটি ইশারাই যথেষ্ট।
এ হলো কিয়ামতের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কথা। কোন তাত্বিক বা যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে এটাকে আর প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়। এখন যে প্রশ্নটি থেকে যায় তাহলো, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটতি হওয়া দরকার যাতে মানুষকে তার ভাল কাজের পুরস্কার এবং মন্দ কাজের শাস্তি দেয়া যায়। ব্যক্তি মানুষের নৈতিক দায় দায়িত্ব স্বীকার করে এবং একথাও স্বীকার করে যে, উত্তম কাজের পুরস্কার লাভ এবং অপরাধের শাস্তি ভোগ এ নৈতিক দায় দায়িত্বের অনিবার্য দাবী সে ব্যক্তির পক্ষে আখেরাতের অনিবার্যতা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। পৃথিবীতে এমন কোন সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেই যা প্রতিটি অপরাধ ও দুষ্কর্মের শাস্তি এবং প্রতিটি ভাল কাজের পুরস্কার দিতে পারে। অপরাধীর জন্য তার বিবেকের দংশন ও তিরষ্কার এবং উপকার ও সুকৃতিকারীর জন্য তার মনের তৃপ্তি ও হৃদয়ের প্রশান্তি যথোপযুক্ত শাস্তি বা পুরস্কার, একথা বলা একটি নিরর্থক দর্শন কপচানো ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার পর কোন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে তাকে তিরষ্কার করার জন্য তার বিবেক এত সময় কোথায় পেল? আর সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে গিয়ে অকস্মাৎ একটি বোমার আঘাত যার গোটা দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল সে যে একটি মহত উদ্দেশ্যের জন্য নিজের জীবন কুরবানী করলো তার বিবেক এ তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভের সুযোগ পেল কখন? আসল কথা হলো, আখেরাত বিশ্বাসকে এড়িয়ে চলার জন্য যত বাহানা ও ছল চতুরীর আশ্রয় নেয়া হয় তা সবই অর্থহীন। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও স্বভাব-প্রকৃতি ইনসাফ কামনা করে। কিন্তু দুনিয়ার এ জীবনে ইনসাফ পাওয়া তাও আবার যথাযথ এবং পূর্ণাঙ্গরূপে কখনো সম্ভব নয়। এরূপ ইনসাফ হলে তা আখেরাতেই হওয়া সম্ভব এবং সমস্ত জ্ঞানের আধার ও সবকিছু সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ ও ব্যবস্থাপনায়ই সম্ভব। আখেরাতের প্রয়োজনকে অস্বীকার করা প্রকৃতপক্ষে ন্যায় ও ইনসাফের প্রয়োজনকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
জ্ঞান ও যুক্তি-বুদ্ধি মানুষকে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে যে, আখেরাত সম্ভব এবং তা হওয়া উচিত। কিন্তু তা অবশ্যই সংঘটিত হবে এ জ্ঞান কেবল অহীর মাধ্যমেই লাভ করা যেতে পারে। আর অহী একথা বলে দিয়েছে যে, “যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। ” যৌক্তিক প্রমাণের মাধ্যমে আমরা এ জ্ঞানের নাগাল পেতে পারি না। তবে তা সত্য ও ন্যায়ানুগ হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস আমরা এভাবে লাভ করতে পারি যে, অহী আমাদের যে বিষয়ের খবর দিচ্ছে তা হওয়া যেমন সম্ভব, তেমনি বাঞ্ছনীয়ও বটে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৭
اِنَّمَا تُوْعَدُوْنَ لَوَاقِعٌؕ
যে জিনিসের প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হচ্ছে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এর আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, তোমাদেরকে যে জিনিসের ভয় দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ কিয়ামত এবং আখেরাত।
# কিয়ামত যে অবশ্যই সংঘটিত হবে তা বুঝানোর জন্য এখানে পাঁচটি জিনিসের শপথ করা হয়েছে। এক, وَالۡمُرۡسَلٰتِ عُرۡفًاۙ “একের পর এক বা কল্যাণ হিসেবে প্রেরিতসমূহ। দুই, الۡعٰصِفٰتِ عَصۡفًاۙ অত্যন্ত দ্রুত এবং প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিতসমূহ। তিন, النّٰشِرٰتِ نَشۡرًاۙ ভালভাবে বিক্ষিপ্তকারী বা ছড়িয়ে দেনেওয়ালাসমূহ। চার,الۡفٰرِقٰتِ فَرۡقًاۙ “বিচ্ছিন্নকারীসমূহ” পাঁচ, الۡمُلۡقِيٰتِ ذِكۡرًاۙ “স্মরণকে জাগ্রতকারীসমূহ। এ শব্দসমূহে শুধু গুণ বা বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে এগুলো কিসের বিশেষণ বা গুণ তা উল্লেখ করা হয়নি। তাই এগুলো একই বস্তুর বিশেষন না ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর বিশেষণ এ বিষয়ে মুফাস্সিরগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। একদল বলেন, এ পাঁচটি বিশেষণ দ্বারা বাতাসকে বুঝানো হয়েছে। অপর এক দল বলেন যে, এ পাঁচটি বিশেষণ দ্বারা ফেরেশদাতের বুঝানো হয়েছে। তৃতীয় দল বলেনঃ প্রথম তিনটি দ্বারা বাতাস এবং পরের দু’টি দ্বারা ফেরেশতা বুঝানো হয়েছে। চতুর্থ দল বলেনঃ প্রথম দু’টি দ্বারা বাতাস এবং পরের তিনটি দ্বারা ফেরেশতা বুঝানো হয়েছে। একদল এরূপ মতও পোষণ করেছেন যে, প্রথমটি দ্বারা রহমতের ফেরেশতা, দ্বিতীয়টি দ্বারা আযাবের ফেরেশতা এবং অবশিষ্ট তিনটি দ্বারা কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ বুঝানো হয়েছে।
আমাদের কাছে প্রথম বিবেচ্য বিষয় হলো, যখন একই কথার মধ্যে একের পর এক পাঁচটি বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর মধ্যে এমন কোন ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না যা দিয়ে বুঝা যেতে পারে যে, কোন পর্যন্ত একটি জিসিসের গুণ-পরিচয়ের বর্ণনা শুরু হয়েছে তখন অযৌক্তিকভাবে শুধু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে একথা বলা কতটা সঠিক ও যুক্তিযুক্ত হতে পারে যে, এখানে শুধু দু’টি বা তিনটি জিনিসের শপথ করা হয়েছে? বরং এক্ষেত্রে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা দাবী করে যে, সম্পূর্ণ বাক্যকে কোন একটি জিনিসের গুণ বা পরিচিতির সাথে সম্পর্কিত বলে মেনে নেয়া উচিত। দ্বিতীয় কথা হলো, কুরআন মজীদে যেখানেই সন্দেহ পোষণকারী বা অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীকে কোন অতীন্দ্রিয় বা গায়েবী সত্যকে বিশ্বাস কারানোর জন্য কোন জিনিস বা বস্তু বিশেষের শপথ করা হয়েছে সেখানেই শপথ প্রমাণ উপস্থাপনের সমার্থক হয়েছে অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য হয় একথা বুঝানো যে, এ বস্তুটি বা বস্তু সকল সে সত্যটির যথার্থতা প্রমাণ করছে। এটা তো স্পষ্ট যে, এ উদ্দেশ্যে একটি অতীন্দ্রিয় বা গায়েবী বস্তুর পক্ষে আরেকটি অতীন্দ্রিয় বা গায়েবী বস্তুর প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা ঠিক নয়। বরং অতীন্দ্রিয়বস্তুর প্রমাণ হিসেবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর প্রমাণ পেশ করাই যথার্থ এবং যথোপযুক্ত হতে পারে। সুতরাং আমাদের মতে এর সঠিক তাফসীর হলো এই যে, এর অর্থ বাতাস। যারা বলেছেন যে, পাঁচটি জিনিসের অর্থ ফেরেশতা, আমার মতে তাদের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ফেরেশতাও কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মতই অতীন্দ্রিয় বিষয়।
এবার চিন্তা করে দেখুন, বাতাসের এ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা কিয়ামতের বাস্তবতা কিভাবে প্রমাণ করছে। যেসব উপকরণের জন্য পৃথিবীর ওপর জীব-জন্তু ও উদ্ভিদের জীবন সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো বাতাস। সব প্রজাতির জীবনের সাথে বাতাসের বর্ণিত গুণাবলীর যে সম্পর্ক আছে তা এ কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, কোন একজন মহা শক্তিমান সুনিপুণ স্রষ্টা আছেন যিনি মাটির এ গ্রহে জীবন সৃষ্টির ইচ্ছা করেছেন এবং এ উদ্দেশ্যে এখানে এমন একটি জিনিস সৃষ্টি করলেন যার গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য জীবন্ত মাখলুকাতের বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তার সাথে হুবহু সামঞ্জস্যশীল। তা সত্ত্বেও তিনি শুধু এতটুকুই করেননি যে, পৃথিবীটার গায়ে বাতাসের একটি চাদর জড়িয়ে রেখে দিয়েছেন। বরং নিজের কুদরতে ও জ্ঞান দ্বারা তিনি এ বাতাসের মধ্যে বৈচিত্রপূর্ণ অসংখ্য অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। লক্ষ কোটি বছর ধরে তার ব্যবস্থাপনা এভাবে হয়ে আসছে যে, সে বৈচিত্রপূর্ণ অবস্থার কারণে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর সৃষ্টি হচ্ছে। কখনো বাতাস বন্ধ হয়ে গুমট অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কখনো স্নিগ্ধ শীলত বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। কখনো গরম পড়ে আবার কখনো ঠাণ্ডা পড়ে। কখনো মেঘের ঘনঘটায় চারদিকে আচ্ছ্ন্ন হয়ে যায় আবার কখনো বাতাসে মেঘ ভেসে যায়। কখনো আরামদায়ক বাতাস বয়ে যায় আবার কখনো প্রলংকরী ঝড়-ঝঞ্চ্বার আবির্ভাব ঘটে। কখনো অত্যন্ত উপকারী বৃষ্টিপাত হয় আবার কখনো বৃষ্টির অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। মোটকথা এক রকম বাতাস নয়, বরং বিভিন্ন সময়ে নানা রকমের বাতাস প্রবাহিত হয় এবং প্রত্যেক প্রকারের বাতাস কোন না কোন উদ্দেশ্য পূরণ করে। এ ব্যবস্থা একটি অজেয় ও পরাক্রমশালী শক্তির প্রমাণ, যার পক্ষে জীবন সৃষ্টি করা যেমন অসম্ভব নয় তেমনি তাকে ধ্বংস করে পুনরায় সৃষ্টি করাও অসম্ভব নয়। অনুরূপভাবে এ ব্যবস্থাপনা পূর্ণমাত্রায় জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তারও প্রমাণ। কোন অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকই কেবল একথা মনে করতে পারে যে, এসব কাজ-কারবার শুধু খেলাচ্ছলে করা হচ্ছে। এর পেছনে কোন মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই। এ বিস্ময়কর ব্যবস্থার সামনে মানুষ এত অসহায় যে, সে নিজের প্রয়োজনেও কোন সময় উপকারী বাতাস প্রবাহিত করতে পারে না। আবার ধ্বংসত্মক তুফানের আগমনকে ঠেকাতেও পারে না। সে যতই ঔদ্ধত্য, অসচেতনতা এক গুঁয়েমী ও হঠকারিতা দেখাক না কেন কোন না কোন সময় এ বাতাসই তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সর্বোপরি এক মহাশক্তি তৎপর আছেন যিনি জীবনের এ সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় উপকরণকে যখন ইচ্ছা তার জন্য রহমত এবং যখন ইচ্ছা তার জন্য ধ্বংসের কারণ বানিয়ে দিতে পারেন। মানুষ তার কোন সিদ্ধান্তকেই রোধ করার ক্ষমতা রাখে না। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল জাসিয়া, টীকা৭আয যারিয়াত, টীকা ১থেকে ৪।)
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৮
فَاِذَا النُّجُوْمُ طُمِسَتْۙ
অতঃপর তারকাসমূহ যখন নিষ্প্রভ হয়ে যাবে ।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ নিষ্প্রভ হয়ে যাবে এবং তার আলো নিঃশেষ হয়ে যাবে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৯
وَ اِذَا السَّمَآءُ فُرِجَتْۙ
এবং আসমান ফেঁড়ে দেয়া হবে ।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ যে সুদৃঢ় ব্যবস্থার কারণে উর্ধজগতের সমস্ত গ্রহ উপগ্রহ তার কক্ষপথে প্রতিষ্ঠিত আছে এবং যে কারণে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু নিজ নিজ সীমার মধ্যেই আবদ্ধ আছে সে ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানো হবে এবং তার সমস্ত বন্ধন শিথিল করে দেয়া হবে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-১১
وَ اِذَا الرُّسُلُ اُقِّتَتْؕ
এবং রসূলের হাজির হওয়ার সময় এসে পড়বে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, হাশরের ময়দানে যখন মানব জাতির মামলা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে তখন প্রত্যেক জাতির রসূলকে সাক্ষ্যদানের জন্য হাজির করা হবে। উদ্দেশ্য, তাঁরা যে মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন তার সাক্ষ্য দেবেন। বিপথগামী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে এটা হবে আল্লাহ তাআলার সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এর দ্বারা প্রমাণ করা হবে যে, তার ভ্রান্ত আচরণের জন্য সে নিজেই দায়ী। অন্যথায় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাকে সাবধান করার ব্যাপারে কোন ত্রুটি করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে হলে নিম্নবর্ণিত স্থানসমূহ দেখুন। তাফহীমুল কুরআন, আল আরাফ আয়াত ১৭২, ১৭৩, টীকা ১৩৪ , ১৩৫ ; আয যুমার, আয়াত ৬৯ , টীকা ৮০ ;আল মুলক, আয়াত ৮ , টীকা ১৪ ।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-১৫
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
সেদিন ধ্বংস অপেক্ষা করছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# সেসব লোকের জন্য যারা সেদিনের আগমনের খবরকে মিথ্যা বলে মনে করেছিল এবং এ ভেবে পৃথিবীতে জীবন যাপন করে চলছিল যে, এমন সময় কখনো আসবে না যখন প্রভুর সামনে হাজির হয়ে নিজের কাজ-কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-১৬
اَلَمْ نُهْلِكِ الْاَوَّلِیْنَؕ
আমি কি পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করিনি?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটা আখেরাতের সপক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ। এর অর্থ হলো, এ দুনিয়াতেই তোমরা নিজেদের ইতিহাসের প্রতি একবার তাকিয়ে দেখো। যেসব জাতি আখেরাতকে অস্বীকার করে এ দুনিয়ার জীবনকেই প্রকৃত জীবন মনে করেছে এবং এ দুনিয়াতে প্রকাশিত ফলাফলকে ভাল ও মন্দের মাপকাঠি ধরে নিয়ে সে অনুসারে নিজেদের নৈতিক আচরণ নিরূপণ করেছে স্থান-কাল নির্বিশেষে তারা সবাই শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে, প্রকৃতপক্ষে আখেরাত এক বাস্তব সত্য। যারা একে উপেক্ষা করে কাজ করে তারা ঠিক তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে ব্যক্তি যে চোখ বন্ধ করে বাস্তবকে অস্বীকার করে চলে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনুস, টীকা ১২ ; আন নামল, টীকা ৮৬ ; আর রুম, টীকা ৮ , সাবা, টিকা ২৫।)
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-১৭
ثُمَّ نُتْبِعُهُمُ الْاٰخِرِیْنَ
আবার পরবর্তী লোকদের তাদের অনুগামী করে দেব।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ এটা আমার স্থায়ী নীতি ও বিধান। আখেরাতের অস্বীকৃতি অতীত জাতিগুলোর জন্য যেভাবে ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে অনুরূপ আনাগত জাতিগুলোর জন্যও তা ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হবে। পূর্বেও কোন জাতি এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-১৯
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
সেদিন ধ্বংস অপেক্ষা করছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে এ আয়াতটির অর্থ হলো, দুনিয়াতে তাদের যে পরিণতি হয়েছে কিংবা ভবিষ্যতে হবে তা তাদের আসল শাস্তি নয়। তাদের ওপর আসল ধ্বংস নেমে আসবে চূড়ান্ত ফায়সালার দিনে। এ পৃথিবীতে যে শাস্তি দেয়া হয় তার অবস্থা হলো, যখন কোন ব্যক্তি একের পর এক অপরাধ করতে থাকে এবং কোন ভাবেই সে তার ভ্রষ্ট ও বিকৃত আচরণ থেকে বিরত হয় না তখন শেষ অবধি তাকে গ্রেফতার করা হয়। যে আদালতে তার মামলার চূড়ান্ত ফয়সালা হবে এবং তার সমস্ত কৃতকর্মের শাস্তি দেয়া হবে তা এ দুনিয়ায় না আখেরাতে কায়েম হবে এবং সেটিই হবে তার ধ্বংসের আসল দিন। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আরাফ, টীকা ৫ – ৬ ;হুদ, টীকা ১০৫ ।)
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-২১
فَجَعَلْنٰهُ فِیْ قَرَارٍ مَّكِیْنٍۙ
একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তা স্থাপন করেছিলাম না?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ মায়ের গর্ভ থলি। গর্ভ সূচনা হওয়ার সাথে সাথে ভ্রুণকে এর মধ্যে এত দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয় এবং তার হিফাযত, প্রতিপালন এবং বৃদ্ধিসাধন এমন নিখুঁত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করা করা হয় যে, কোন মারাত্মক দুর্ঘটনা ছাড়া গর্ভপাত হতে পারে না। কৃত্রিম গর্ভপাতের জন্য অস্বাভাবিকধরনের কৌশল ও ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয় যা চিকাৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি সত্ত্বেও ক্ষতি ওআশঙ্কা মুক্ত নয়।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-২২
اِلٰى قَدَرٍ مَّعْلُوْمٍۙ
এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# মূল আয়াতের বাক্যাংশ হলো قَدَرٍ مَّعۡلُوۡمٍۙ । এর অর্থ শুধু নির্দিষ্ট সময় নয়। বরং এর সময়-কাল একমাত্র আল্লাহই জানেন এ অর্থও এর মধ্যে শামিল। কোন বাচ্চা সম্পর্কে কোন উপায়েই মানুষ একথা জানতে পারে না যে, সে কত মাস, কত দিন, কত ঘণ্টা, কত মিনিট এবং কত সেকেণ্ড মায়ের পেটে অবস্থান করবে এবং তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার নির্ভুল সময়টি কি? প্রত্যেক শিশুর জন্য আল্লাহ একটি বিশেষ সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন আর সে সময়টি কেবল তিনিই জানেন।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-২৩
فَقَدَرْنَا١ۖۗ فَنِعْمَ الْقٰدِرُوْنَ
তাহলে দেখো, আমি তা করতে পেরেছি। অতএব আমি অত্যন্ত নিপুণ ক্ষমতাধর।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটা মৃত্যুর পরের জীবনের সম্ভাব্যতার স্পস্ট প্রমাণ। আল্লাহ তা’আলার এ বাণীর অর্থ হলো, যখন আমি নগণ্য এক ফোটা বীর্য থেকে সূচনা করে তোমাকে পূর্ণাঙ্গ একজন মানুষ বানাতে সক্ষম হয়েছি তখন পুনরায় তোমাদের অন্য কোনভাবে সৃষ্টি করতে সক্ষম হবো না কেন? আমার যে সৃষ্টি কর্মের ফলশ্রুতিতে তুমি আজ জীবিত ও বর্তমান তা একথা প্রমাণ করে যে, আমি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। আমি এমন অক্ষম নই যে, একবার সৃষ্টি করার পর তোমাদেরকে পুনরায় আর সৃষ্টি করতে পারবো না।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-২৪
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে এ আয়াতাংশ যে অর্থ প্রকাশ করেছে তাহলো, মৃত্যুর পরের জীবনের সম্ভাব্যতার এ স্পষ্ট প্রমাণ সামনে থাকা সত্ত্বেও যারা তা অস্বীকার করছে তারা এ নিয়ে যত ইচ্ছা হাসি-তামাসা ও ঠাট্রা-বিদ্রূপ করুক এবং এর ওপর বিশ্বাস স্থাপনকারী লোকদের তারা যত ইচ্ছা সেকেলে অন্ধবিশ্বাসী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলতে থাক। যে দিনকে এরা মিথ্যা বলছে যখন সেদিনটি আসবে তখন তারা জানতে পারবে, সেটিই তাদের জন্য ধ্বংসের দিন।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-২৭
وَّ جَعَلْنَا فِیْهَا رَوَاسِیَ شٰمِخٰتٍ وَّ اَسْقَیْنٰكُمْ مَّآءً فُرَاتًاؕ
আর আমি তাতে স্থাপন করেছি সুদৃঢ় উচ্চ পর্বতমালা আর পান করিয়েছি তোমাদেরকে সুপেয় পানি।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটা আখেরাতের সম্ভাব্যতা ও যুক্তিসঙ্গত হওয়ার আরো একটি প্রমাণ। পৃথিবী নামক এ একটি গ্রহ যা শত শত কোটি বছর ধরে অসংখ্য মাখলুকাতকে তার কোলে স্থান দিয়ে রেখেছে। নানা প্রকারের উদ্ভিদরাজ, নানা রকমের জীবজন্তু এবং মানুষ এর ওপরে জীবন ধারণ করেছে। আর সবার প্রয়োজন, পূরণ করার জন্য এর অভ্যন্তর থেকে নানা প্রকার জিনিসের অফুরন্ত ভাণ্ডার বেরিয়ে আসছে। তাছাড়া এ পৃথিবীতে, যেখানে এসব জীবজন্তুর বিপুল সংখ্যক প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করছে-এমন নজীর বিহীন ব্যবস্থাপনা রাখা হয়েছে যে, সবার মৃতদেহ এ মাটির মধ্যেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তারপর প্রত্যেকটি সৃষ্টির নবীন সদস্যের বেঁচে থাকার ও বসবাসের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে এ পৃথিবীকে বলের মত সমতল করেও সৃষ্টি করা হয়নি। বরং এর স্থানে স্থানে পর্বতশ্রেণী এবং আকাশচুম্বী পাহাড় তৈরী করে রাখা হয়েছে ঋতুসময়ের পরিবর্তনে, বৃষ্টিপাত ঘটানোতে, নদ-নদীর উৎপত্তির ক্ষেত্রে, উর্বর উপত্যকা, সৃষ্টিতে, কড়িকাঠ নির্মাণের মত বড় বড় বৃক্ষ উৎপাদনে, নানা রকমের খনিজ দ্রব্য এবং বিভিন্ন প্রকার পাথর সরবরাহের ক্ষেত্রে যার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া পৃথিবী তার অভ্যন্তরে সুপেয় পানি সৃষ্টি করা হয়েছে। এর পৃষ্ঠদেশের ওপরেও সুপেয় পানির নদী ও খাল প্রবাহিত করা হয়েছে এবং সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে পরিষ্কার-পরিছন্ন বাষ্প উত্থিত করে আসমান থেকে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব কি একথা প্রমাণ করে না যে, সর্বশক্তিমান এক সত্তাই এসব তৈরী করেছেন। আর তিনি শুধু সর্বশক্তিমানই নন বরং জ্ঞানী এবং মহাবিজ্ঞানীও বটে? অতএব তাঁর শক্তিমত্তা ও জ্ঞানের সাহায্যেই যদি এ পৃথিবী এতসব সাজ-সরঞ্জামসহ এ জ্ঞান ও কৌশলের সাথে তৈরী হয়ে থাকে তাহলে একজন জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জন্য একথাটা বুঝা এত কঠিন হবে কেন যে, এ দুনিয়া তার বিলোপ ঘটিয়ে পুনরায় নতুনভাবে আরেকটি দুনিয়া তিনি বানাতে সক্ষম আর তাঁর কর্মকৌশলের দাবীও এটাই যে, তিনি আরেকটি দুনিয়া বানাবেন যাতে মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব কাজ-কর্ম করেছে তার হিসেব নেয়া যায়।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-২৮
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে এ আয়াতাংশ এ অর্থে বলা হয়েছে যে, যেসব লোক আল্লাহ তাআলার কুদরত ও কর্মকৌশলের এ বিস্ময়কর নমুনা দেখেও আখেরাতের সম্ভাব্যতা ও যৌক্তিকতা অস্বীকার করছে এবং এ দুনিয়ার ধ্বংসের পর আল্লাহ তা’আলা আরো একটি দুনিয়া সৃষ্টি করবেন এবং সেখানে মানুষের কাছ থেকে তার কাজের হিসেব গ্রহণ করবেন এ বিষয়টিকেও যারা মিথ্যা মনে করছে, তারা তাদের এ খামখেয়ালীতে মগ্ন থাকতে চাইলে থাকুক। তাদের ধারণা ও বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত এসব কিছু যেদিন বাস্তব হয়ে দেখা দেবে, সেদিন তারা বুঝতে পারবে যে, এ বোকামীর মাধ্যমে তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের ব্যবস্থা করেছে মাত্র।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-২৯
اِنْطَلِقُوْۤا اِلٰى مَا كُنْتُمْ بِهٖ تُكَذِّبُوْنَۚ
চলো এখন সে জিনিসের কাছে যাকে তোমরা মিথ্যা বলে মনে করতে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# আখেরাতের সপক্ষে প্রমাণাদি পেশ করার পর যখন তা বাস্তবে সংঘটিত হবে তখন সেখানে এসব অস্বীকারকারীদের পরিণাম কি হবে তা বলা হচ্ছে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৩০
اِنْطَلِقُوْۤا اِلٰى ظِلٍّ ذِیْ ثَلٰثِ شُعَبٍۙ
চলো সে ছায়ার কাছে যার আছে তিনটি শাখা।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে ছায়া অর্থ ধোঁয়ার ছায়া। তিনটি শাখার অর্থ হলো, যখন অনেক বেশী ধোঁয়া উত্থিত হয় তখন তা ওপরে গিয়ে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৩৩
كَاَنَّهٗ جِمٰلَتٌ صُفْرٌؕ
(উৎক্ষেপণের সময় যা দেখে মনে হবে) তবে যেন হলুদ বর্ণের উট।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ প্রত্যেকটি স্ফুলিঙ্গ প্রাসাদের মত বড় হবে। আর যখন এসব বড় বড় স্ফূলিঙ্গ উত্থিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং চারদিকে উড়তে থাকবে তখন মনে হবে যেন হলুদ বর্ণের উটসমূহ লম্ফ ঝম্ফ করছে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৩৬
وَ لَا یُؤْذَنُ لَهُمْ فَیَعْتَذِرُوْنَ
এবং না তাদেরকে ওজর পেশ করার সুযোগ দেয়া হবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এটা হবে তাদের শেষ অবস্থা। এ অবস্থা হবে জাহান্নামে প্রবেশ করার সময়। এর আগে হারশরের ময়দানে তারা অনেক কিছুই বলবে। অনেক ওজর আপত্তি পেশ করবে, একজন আরেকজনেরওপর নিজের কৃত অপরাধের দোষ চাপিয়ে নিজে নিরপরাধ হওয়ার চেষ্টা করবে। যেসবনেতারা তাদেরকে বিপথে পরিচালনা করেছে তাদের গালি দেবে। এমনকি কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানের বক্তব্য অনুসারে, অনেকে ঔদ্ধত্যের সাথে নিজের অপরাধ অস্বীকার পর্যন্ত করবে। কিন্তু সব রকম সাক্ষ্য-প্রমাণের দ্বারা তাদের অপরাধী হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণ করে দেয়া হবে এবং তাদের নিজেদের হাত, পা এবং সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেঃ এভাবে অপরাধ প্রমাণে যখন কোন ত্রুটি থাকবে না এবং অত্যন্তসঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত পন্থায় ন্যায় ও ইনসাফের সমস্ত দাবী পূরণ করে তাদেরকে শাস্তির সিদ্ধান্ত শুনানো হবে তখন তারা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যাবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ওজর হিসেবে কোন কিছু বলার সুযোগও তাদের জন্য থাকবে না। ওজর পেশ করার সুযোগ না দেয়া কিংবা তার অনুমতি না দেয়ার অর্থএই নয় যে, সাফাই পেশ করার সুযোগ না দিয়েই তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দেয়া হবে। বরং এর অর্থ হলো, এমন অকাট্য ও অনস্বীকার্যভাবে তাদের অপরাধ প্রমাণ করে দেয়া হবে যে, তারা নিজেদের পক্ষ থেকে ওজর হিসেবে কিছু বলতেই পারবে না। এটা ঠিক তেমনি যেমন আমরা বলে থাকি যে, আমি তাকে বলতে দিইনি, কিংবা আমি তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছি। একথার অর্থ এই যে, আমি এমনভাবে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছি যে, তার মুখ খোলার বাকিছু বলার কোন সুযোগ থাকেনি এবং সে লা-জবাব হয়ে গেছে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৩৯
فَاِنْ كَانَ لَكُمْ كَیْدٌ فَكِیْدُوْنِ
তোমাদের যদি কোন অপকৌশল থেকে থাকে তাহলে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে দেখো।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# দুনিয়ায় তো তোমরা অনেক কৌশল ও চাতুর্যের আশ্রয় নিতে। এখন এখানে কোন কৌশল বা আশ্রয় নিয়ে আমার পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারলে তা একটু করে দেখাও।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৪১
اِنَّ الْمُتَّقِیْنَ فِیْ ظِلٰلٍ وَّ عُیُوْنٍۙ
মুত্তাকীরা আজ সুশীলত ছায়া ও ঝর্ণাধারার মধ্যে অবস্থান করছে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে এ শব্দটি যেহেতু مُكَذِّبِيۡنَ (মিথ্যা আরোপকারীদের) বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে তাই মুত্তাকী শব্দ বলে এখানে সেসব লোকদের বুঝানো হয়েছে যারা আখেরাতকে মিথ্যা বলে অস্বীকার করা থেকে বিরত থেকেছে এবং আখেরাতকে মেনে নিয়ে বিশ্বাসে জীবন যাপন করেছে যে, আখেরাতে আমাদেরকে নিজেদের কথাবার্তা কাজ-কর্ম এবং স্বভাব চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৪৫
وَیْلٌ یَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِیْنَ
সেদিন ধ্বংস রয়েছে মিথ্যা আরোপকারীদের জন্য।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখানে যে অর্থ এ আয়াতাংশ বলা হয়েছে তাহলো, তাদের জন্য একটি বিপদ হবে তাই যা ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা হাশরের ময়দানে অপরাধী হিসেবে উঠবে। তাদের অপরাধ প্রকাশ্যে এভাবে প্রমাণ করা হবে যে, তা দের জন্য মুখ খোলার সুযোগ পর্যন্ত থাকবে না এবং পরিণামে তারা জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের জন্য মসিবতের ওপর মসিবত হবে এই যে, যেসব ঈমানদারদের সাথে তাদের সারা জীবন দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও লড়াই হয়েছে, যাদের তারা নির্বোধ, সংকীর্ণমনা ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে আখ্যায়িত করতো, যাদের নিয়ে তারা হাসি-তামাসা ও বিদ্রূপ করতো এবং যাদের তারা নিজেদের দৃষ্টিতে হীন, নীচ ও লাঞ্ছিত মতে করতো তাদেরকেই তারা জান্নাতের মধ্যে আরাম আয়েশের জীবন যাপন করে আমোদ ফূর্তি করতে দেখবে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৪৬
كُلُوْا وَ تَمَتَّعُوْا قَلِیْلًا اِنَّكُمْ مُّجْرِمُوْنَ
খেয়ে নাও এবং ফূর্তি কর। কিছুদিনের জন্য আসলে তো তোমরা অপরাধী।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# এখন বক্তব্যের সমাপ্তি টানতে গিয়ে শুধু মক্কার কাফের নয় বরং সারা পৃথিবীর কাফেদের সম্বোধন করে একথাগুলো বলা হয়েছে।
# অর্থাৎ দুনিয়ার এ স্বল্পকাল স্থায়ী জীবনে।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৪৮
وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمُ ارْكَعُوْا لَا یَرْكَعُوْنَ
যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহর সামনে অবনত হও, তখন তারা অবনত হয় না।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# আল্লাহর সামনে আনত হওয়ার অর্থ শুধু তাঁর ইবাদাত বন্দেগী করাই নয়, বরং তাঁর প্রেরিত রসূল এবং নাযিলকৃত কিতাবকে স্বীকার করা এবং তার বিধি-বিধানের আনুগত্যও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
সুরা: আল-মুরসালাত
আয়াত নং :-৫০
فَبِاَیِّ حَدِیْثٍۭ بَعْدَهٗ یُؤْمِنُوْنَ۠
এখন এ কুরআন ছাড়া আর কোন বাণী এমন হতে পারে যার ওপর এরা ঈমান আনবে?
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
# অর্থাৎ মানুষকে হক ও বাতিলের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়ার এবং হিদায়াতের পথ দেখানোর জন্য সবচেয়ে বড় জিনিস যা হতে পারতো তা কুরআন আকারে নাযিল করা হয়েছে। এ কুরআন পড়ে বা শুনেও যদি কেউ ঈমান না আনে তাহলে একে বাদ দিয়ে আর কোন জিনিস এমন হতে পারে যা তাকে সত্য পথে আনতে সক্ষম?