Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৫/হে মানুষ:-৭)
[* হে মানুষ! কোন জিনিষ তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে, ?:-
*বিভ্রান্তির কারণ : -]
www.motaher21.net
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার
পারা:৩০
১-১৯ নং আয়াতের বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১
اِذَا السَّمَآءُ انۡفَطَرَتۡ ۙ﴿۱﴾
আকাশ যখন বিদীর্ণ হবে।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-২
وَ اِذَا الۡکَوَاکِبُ انۡتَثَرَتۡ ۙ﴿۲﴾
যখন নক্ষত্ররাজি বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে,
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-৩
وَ اِذَا الۡبِحَارُ فُجِّرَتۡ ﴿ۙ۳﴾
আর যখন সাগরগুলো বিস্ফোরিত করা হবে,
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-৪
وَ اِذَا الۡقُبُوۡرُ بُعۡثِرَتۡ ۙ﴿۴﴾
যখন কবরগুলো খুলে ফেলা হবে,
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-৫
عَلِمَتۡ نَفۡسٌ مَّا قَدَّمَتۡ وَ اَخَّرَتۡ ؕ﴿۵﴾
তখন প্রত্যেকেই জানতে পারবে সে পূর্বে যা প্রেরণ করেছে এবং পশ্চাতে কি ছেড়ে এসেছে।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-৬
یٰۤاَیُّہَا الۡاِنۡسَانُ مَا غَرَّکَ بِرَبِّکَ الۡکَرِیۡمِ ۙ﴿۶﴾
মানুষ! কোন জিনিষ তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে, ?
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-৭
الَّذِیۡ خَلَقَکَ فَسَوّٰىکَ فَعَدَلَکَ ۙ﴿۷﴾
যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-৮
فِیۡۤ اَیِّ صُوۡرَۃٍ مَّا شَآءَ رَکَّبَکَ ؕ﴿۸﴾
যে আকৃতিতে চেয়েছেন তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-৯
کَلَّا بَلۡ تُکَذِّبُوۡنَ بِالدِّیۡنِ ۙ﴿۹﴾
কখ্খনো না, বরং (আসল কথা হচ্ছে এই যে), তোমরা শাস্তি ও পুরস্কারকে মিথ্যা মনে করছো।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১০
وَ اِنَّ عَلَیۡکُمۡ لَحٰفِظِیۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾
অথচ তোমাদের ওপর পরিদর্শক নিযুক্ত রয়েছে,
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১১
کِرَامًا کَاتِبِیۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾
এমন সম্মানিত লেখকবৃন্দ,
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১২
یَعۡلَمُوۡنَ مَا تَفۡعَلُوۡنَ ﴿۱۲﴾
যারা তোমাদের প্রত্যেকটি কাজ জানে।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১৩
اِنَّ الۡاَبۡرَارَ لَفِیۡ نَعِیۡمٍ ﴿ۚ۱۳﴾
নিঃসন্দেহে নেক লোকেরা পরমানন্দে থাকবে ।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১৪
وَ اِنَّ الۡفُجَّارَ لَفِیۡ جَحِیۡمٍ ﴿ۚۖ۱۴﴾
আর পাপীরা অবশ্যি যাবে জাহান্নামে।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১৫
یَّصۡلَوۡنَہَا یَوۡمَ الدِّیۡنِ ﴿۱۵﴾
তারা বিচার দিবসে সেখানে প্রবেশ করবে।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১৬
وَ مَا ہُمۡ عَنۡہَا بِغَآئِبِیۡنَ ﴿ؕ۱۶﴾
এবং সেখান থেকে কোনক্রমেই সরে পড়তে পারবে না।
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১৭
وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا یَوۡمُ الدِّیۡنِ ﴿ۙ۱۷﴾
আর তোমরা কি জানো, ঐ কর্মফল দিনটি কি?
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১৮
ثُمَّ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا یَوۡمُ الدِّیۡنِ ﴿ؕ۱۸﴾
হ্যাঁ, তোমরা কি জানো, ঐ কর্মফল দিনটি কি?
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার:-১৯
یَوۡمَ لَا تَمۡلِکُ نَفۡسٌ لِّنَفۡسٍ شَیۡئًا ؕ وَ الۡاَمۡرُ یَوۡمَئِذٍ لِّلّٰہِ ﴿٪۱۹﴾
সেদিন কেউই কারোর জন্য কিছু করবার সামর্থ্য রাখবে না; আর সেদিন সমস্ত কর্তৃত্ব হবে (একমাত্র) আল্লাহর।
Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৫/হে মানুষ:-৭)
[* হে মানুষ! কোন জিনিষ তোমাকে তোমার মহান রবের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে, ?:-
*বিভ্রান্তির কারণ : -]
www.motaher21.net
সুরা: ৮২ : আল্ -ইনফিতার
পারা:৩০
১-১৯ নং আয়াতের বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
সুরা: আল-ইনফিতার
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৮২
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এই ক্ষুদ্র সূরাটিতে পূর্ববর্তী সূরা আত্-তাকওয়ীরে আলোচিত একই মহাজাগতিক বিপ্লব সম্পর্কিত আলোচনা অব্যাহত রয়েছে৷ তবে এ সূরাটি নিজের এক ভিন্নতর বলয় সৃষ্টি করে, একটা সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দান করে, স্বতন্ত্র কতোগুলো পরিমন্ডলের দিকে আসল বক্তব্যকে কেন্দ্রীভূত করে এবং তার অভ্যন্তরেই মানব হৃদয়কে আবর্তিত করে। এ সূরা মানুষের চেতনায় পূর্ববর্তী সূরা থেকে ভিন্নতর প্রকৃতির এক পরশ বুলায় এটা অত্যস্ত গভীর, শান্ত ও মৃদু । সেই পরশ কিছুটা ভৎর্সনা ধরনের, আবার পরোক্ষভাবে কিছুটা হুমকি এবং হুশিয়ারীও তার ভেতরে বিদ্যমান । এজন্য সূরাটিতে সেই বিপ্লবের বিভিন্ন দৃশ্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে৷ তবে সূরা তাকওয়ীরের ন্যায় এ বিষয়টি এখানে প্রধান হয়ে দাড়ায়নি। কেননা, ভৎর্সনার পরিবেশ ও পরিমন্ডল এখানে অপেক্ষাকৃত মৃদু ও গাম্ভির্যপূর্ণ এবং তার প্রভাব বিস্তারের গতিও অপেক্ষাকৃত শ্লথ ৷ সূরার সূর ব্যঞ্জনার প্রভাবও এখানে তদ্রূপ! সুতরাং বলা যায়, এই মৃদু ভৎর্সনাই এ সূরার মূল ভাবধারা । কাজেই সূরার সামগ্রিক কাঠামোর সাথে এ বৈশিষ্টটির পূর্ণ সামঞ্জস্য ও সাযূজ্য রয়েছে। সূরাটির প্রথম প্যারায় আকাশ বিদীর্ণ হওয়া, নক্ষত্রমন্ডলীর বিক্ষিপ্ত হয়ে ঝরে পড়া, সমুদ্রের উদ্বেলিত ও আলোড়িত হওয়া এবং কবর উন্মোচিত হওয়ার বিষয় আলোচিত হয়েছে। এগুলোকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যেন তা সংঘটিত হবেই এবং প্রত্যেক জীব আগে ও পরে কী পাঠিয়েছে, তা সে অবহিত হবেই ৷ এগুলো সবই যেন সেই ভয়াল সময়ের দৃশ্যমান পার্শ্বচিত্র৷ দ্বিতীয় প্যারায় প্রচ্ছন্ন হুমকি মিশ্রিত ভৎর্সনার সূচনা করা হয়েছে। যে মানুষ আপন ব্যক্তিসত্ত্বা ও দেহ কাঠামোতে নিরন্তর স্বীয় প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অগণিত অনুগ্রহ লাভ করে থাকে অথচ সেই অনুগ্রহের যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হয়না এবং আপন প্রতিপালকের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত নয়, আর তার দেয়া সম্মান, মর্যাদা ও অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞও নয়, সেই সব অকৃতজ্ঞ মানুষের প্রতিই উচ্চারিত হয়েছে এ ভৎর্সনা ৷ বলা হয়েছে, হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার প্রতিপালক সম্পর্কে বিভ্রান্ত করলো? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, সুঠাম করেছেন, সুসামঞ্জস্য করেছেন, তিনি যেমন চেয়েছেন তেমন আকৃতিতেই তোমাকে গঠন করেছেন। তৃতীয় প্যারায় এই অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাসের কারণ নির্ণয় করা হয়েছে। সে কারণটি হলো, কর্মফল দিবস তথা হিসাব নিকাশের দিনকে অস্বীকার করা ৷ এই জিনিসটি অস্বীকার ও অবিশ্বাস করা থেকেই সকল ধরনের অপকর্মের উৎপত্তি হয়। এ কারণেই এই হিসাব-নিকাশের কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে ৷ সেই সাথে এই হিসাব-নিকাশের অবধারিত ফলাফল সম্পর্কেও সুদৃঢ় ও সুনিশ্চিত বিশ্বাস জন্মানো হয়েছে। বলা হয়েছে, না, ”কখ্খনো না, তোমরা তো কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে থাকো । নিসন্দেহে তোমাদের ওপর প্রহরীর মতো নিয়োজিত রয়েছেন সম্মানিত লেখকরা । তোমরা যাই করো, তা তারা জানেন ।” সর্বশেষ প্যারাটিতে হিসাব-নিকাশের দিনটির ভয়াবহতা ও বিশালতা সম্পর্কে এবং সেদিন যে মানুষের কোনো শক্তি-সামর্থ থাকবে না সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। সেদিন একমাত্র আল্লাহই হবেন সর্বময় কর্তা । বলা হয়েছে, “তুমি জানো বিচার দিবস সম্পর্কে? আবার বলছি, তুমি কি জানো বিচার দিবস সম্পর্কে? সেদিন কোনো প্রাণীরই কোনো ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকবে না। সকল ক্ষমতা থাকবে একমাত্র আল্লাহর!” সুতরাং দেখা যাচ্ছে, গোটা আমপারায় মানব মনকে বিবিধ পন্থায় ও উপায়ে প্রভাবিত করা ও তাতে করাঘাত করার যে ধারা প্রবহমান রয়েছে, আলোচ্য সূরাটি সামগ্রিকভাবে সেই ধারারই একটি অংশ ।
(৮২-ইনফিতার) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতের শব্দ (اِ نْفَطَرَتْ ) থেকেই এর নামকরণ করা হয়েছে। এর মূলে রয়েছে ইনফিতার অর্থাৎ ফেটে যাওয়া। এ নামকরণের কারণ হচ্ছে এই যে, এ সূরায় আকাশের ফেটে যাওয়ার কথা আলোচনা করা হয়েছে।
(৮২-ইনফিতার) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এই সূরার ও সূরা আত্ তাকভীরের বিষয়বস্তুর মধ্যে গভীর মিল দেখা যায়। এ থেকে বুঝা যায়, এই সূরা দু’টি প্রায় একই সময়ে নাযিল হয়েছে।
(৮২-ইনফিতার) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এর বিষয়বস্তু হচ্ছে আখেরাত। মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনুল মন্যার, তাবারানী, হাকেম ও ইবনে মারদুইয়ায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের (রা.) একটি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُ رَأْىُ عَيْنٍ فَلْيَقْرَأْ إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ , وَ إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ , و إِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ-
“যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনটি নিজের চোখে দেখতে চায় সে যেন সূরা তাকভীর, সূরা ইনফিতার ও সূরা ইনশিকাক পড়ে নেয়।”
এখানে প্রথমে কিয়ামতের দিনের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যক্তি দুনিয়ায় যা কিছু করেছে কিয়ামতের দিন তা সবই তার সামনে উপস্থিত হবে। তারপর মানুষের মনে অনুভূতি জাগানো হয়েছে, যে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে অস্তিত্ব দান করলেন এবং যাঁর অনুগ্রহে তুমি আজ সমস্ত সৃষ্ট জীবের মধ্যে সবচেয়ে ভালো শরীর ও অংগ- প্রত্যংগ সহকারে বিচরণ করছো, তিনি কেবল অনুগ্রহকারী ইনসাফকার নন, তাঁর সম্পর্কে তোমার মনে কে এই প্রতারণার জাল বিস্তার করলো ? তাঁর অনুগ্রহের অর্থ এ নয় যে, তুমি তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ ব্যবহার ও বিচারের ভয় করবে না। তারপর মানুষকে সাবধান করে দেয়া হয়েছে, তুমি কোন ভুল ধারণা নিয়ে বসে থেকো না। তোমার পুরো আমলনামা তৈরী করা হচ্ছে। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য লেখকরা সবসময় তোমার সমস্ত কথাবার্তা, ওঠাবসা, চলাফেরা ও যাবতীয় কাজকর্ম লিখে চলছেন। সবশেষে পূর্ণ দৃঢ়তা সহকারে বলা হয়েছে, অবশ্যিই একদিন কিয়ামত হবে। সেদিন নেককার লোকেরা জান্নাতে সুখের জীবন লাভ করবে এবং পাপীরা জাহান্নামের আযাব ভোগ করবে। সেদিন কেউ কারোর কোন কাজে লাগবে না। বিচার ও ফায়সালাকারী সেদিন হবেন একমাত্র আল্লাহ।
সুরা: আল-ইনফিতার
আয়াত নং :-3
টিকা নং:1,
وَ اِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْۙ
যখন সমুদ্র ফাটিয়ে ফেলা হবে১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) সূরা তাকভীরে বলা হয়েছে, সমুদ্রগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে এবং এখানে বলা হয়েছে, সমুদ্রগুলোকে ফাটিয়ে ফেলা হবে। এই উভয় আয়াতকে মিলিয়ে দেখলে এবং কুরআনের দৃষ্টিতে কিয়ামতের দিন এমন একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হবে যা কোন একটি বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং একই সময় সারা দুনিয়াকে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে দেবে, এ বিষয়টিকেও সামনে রাখলে সমুদ্রগুলোর ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার ও তার মধ্যে আগুন লেগে যাবার প্রকৃত অবস্থাটি আমরা অনুধাবন করতে পারি। আমরা বুঝতে পারি, প্রথমে ঐ মহাভূকম্পনের ফলে সমুদ্রের তলদেশ ফেটে যাবে এবং সমুদ্রের পানি ভূগর্ভের অভ্যন্তরভাগে নেমে যেতে থাকবে যেখানে সর্বক্ষণ প্রচণ্ড গরম লাভা টগবগ করে ফুটছে। এই গরম লাভার সাথে সংযুক্ত হবার পানি তার প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ প্রাথমিক দু’টি মৌলিক উপাদান অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনে পরিণত হবে। এর মধ্যে অক্সিজেন আগুন জ্বালানোয় সাহায্য করে এবং হাইড্রোজেন নিজে জ্বলে উঠে। এভাবে প্রাথমিক মৌলিক উপাদানে পরিণত হওয়া ও আগুন লেগে যাওয়ার একটি ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া ( chain reaction ) চলতে থাকবে। এভাবে দুনিয়ার সবগুলো সাগরে আগুন লেগে যাবে। এটা আমাদের তাত্ত্বিক পর্যালোচনা ভিত্তিক অনুমান। তবে এর সঠিক জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই।
ফী জিলালিল কুরআন:
“যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে, যখন গ্রহ নক্ষত্রগুলো বিক্ষিপ্ত হবে, যখন সমুদ্রগুলোকে উদ্বেলিত করা হবে এবং যখন কবর গুলোকে খুলে দেয়া হবে, তখন প্রত্যেকে জানবে, সে কী আগে পাঠিয়েছে এবং কী সে পেছনে রেখে গেছে।” মহাবিশ্বের গভীর পর্যবেক্ষণের ফলে মানুষের স্নায়ূতে যে মর্মবাণী ছড়িয়ে যায়, সে সম্পর্কে পূর্ববর্তী সূরায় আমি আলোচনা করেছি। পরিবর্তনের যোগ্যতাসম্পন্ন হাত মাত্রই এ মর্মবাণীকে ধারণ করে এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিপ্লবের ঝাকুনিতে তা আলোড়িত ও আন্দোলিত হয়। এ বিশাল বিশ্বে কোনো বস্তুই অপরিবর্তিত থাকে না। এই মর্মবাণী মানুষকে তার আকর্ষণ ও আসক্তির যাবতীয় বস্তু বর্জনে উদ্বুদ্ধ করে, কেবলমাত্র আল্লাহকে ছাড়া, যিনি এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং যিনি সকল বস্তু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন, আর সেই চিরন্তন মহাসত্য- যার পরিবর্তন নেই এবং স্থিতিশীল ব্যবস্থাপনায় এই মহাসত্যের কাছ থেকেই মানুষ সহায়তা লাভ করতে পারে। মহান স্রষ্টা ও মাবুদ আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ স্থিতিশীল ও চিরঞ্জীব নয়। মহা প্রলয় : কেয়ামতের সেই মহাপ্রলয়ের আলামত হিসাবে এখানে আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। কিঞ্চিৎ শাব্দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্যান্য স্থানেও এর উল্লেখ রয়েছে । যেমন সূরা ‘আর রহমান’-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেদিন আকাশ চৌচির হবে, সেদিন তা রক্তের মতো লাল চামড়ার রূপ ধারণ করবে। সূরা ‘আল হাক্কা’তে বলা হয়েছে, ‘আকাশ খানখান হয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে ।’ সূরা ইনশিকাকে বলা হয়েছে, ‘যখন আকাশ ফেটে যাবে।’ বস্তুত আকাশের বিদীর্ণ হওয়া বা ফেটে চৌচির হওয়াটা সেই সংকটময় দিনের অন্যতম একটি বাস্তব ঘটনা ৷ তবে আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্য কী, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা দুস্কর ৷ অনুরূপভাবে বিদীর্ণ হওয়া বা ফেটে যাওয়ার রূপটা কেমন হবে, তাও বলা কঠিন । তবে এ দ্বারা যে জিনিসটি চেতনার ফলকে প্রতিফলিত হয়, তাহলো আমাদের নিত্য পরিদৃশ্যমান এই বিশ্বজগতের কাঠামোতে একটা আমূল পরিবর্তন, তা বর্তমান ব্যবস্থার অবসান এবং তার প্রচলিত এই সুক্ষ প্রশাসনিক অবকাঠামোর ছিননভিনন হয়ে যাওয়ার একটা দৃশ্য । এই দৃশ্যটির আরেকটি পার্শ্বচিত্র হলো সূরায় আলোচিত নক্ষত্রমন্ডলীর বিক্ষিপ্ত হয়ে ঝরে পড়ার বিষয়টি । বর্তমানে এই নক্ষত্রমন্ডলী যেরূপ অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থেকে প্রচন্ড গতিবেগে মহাশূন্যের নিজ নিজ কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, যেভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ সীমানার মধ্যে থেকে অন্যের সীমানাকে বিন্দুমাত্রও না মাড়িয়ে অবাধে বিচরণ করেছে, যেভাবে কোনো নক্ষত্র এই বিশাল মহাশূন্যে -যার সীমা-সরহদ কারো জানা নেই-এমনভাবে বিচরণ করছে যে, কখনো সে নিজ কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে না, তারপরও সেদিন তাতে এই অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা দেবে। এই নক্ষত্রমন্ডলীর আয়ুস্কাল যেদিন সত্যিই ফুরিয়ে যাবে । সেদিন তারা যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি । বর্তমানে এই নক্ষত্রমন্ডলী যেরূপ অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থেকে প্রচন্ড গতিবেগে মহাশুন্যের নিজ নিজ কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, যেভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ সীমানার মধ্যে থেকে অন্যের সীমানাকে বিন্দুমাত্রও না মাড়িয়ে অবাধে বিচরণ করেছে, যেভাবে কোনো নক্ষত্র এই বিশাল মহাশূন্যে-যার সীমা-সরহদ কারো জানা নেই-এমনভাবে বিচরণ করছে যে, কখনো সে নিজ কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে না, তারপরও সেদিন তাতে এই অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা দেবে। এই নক্ষত্রমন্ডলীর আয়ুস্কাল যেদিন সত্যিই ফুরিয়ে যাবে । সেদিন তারা যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে ঝরে পড়বে এবং নিজ নিজ অদৃশ্য ও অটুট সংযোগসূত্র ও রক্ষাব্যুহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়বে, তখন তা সমগ্র মহাশূন্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিটকে পড়বে, ঠিক যেমন অণু স্বীয় বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছুটে যায়। সমুদ্রের উদ্বেলিত হওয়ার ব্যাপারটা এভাবে ঘটতে পারে যে, তার পানি স্ফীত হয়ে শুষ্কমন্ডলকে ও নদ নদীকে প্লাবিত করবে। আবার এর অর্থ পানির দু’টি উপাদান-অক্সিজেন ও হাউড্রোজেনকে পানি থেকে আলাদা করে ফেলাও হতে পারে। এতে কারে সমুদ্রের সমস্ত পানি এই দু’টি গ্যাসে রূপান্তরিত হবে, যেমন আল্লাহর ইচ্ছায় ওই দু’টি গ্যাস একত্রিত হওয়া ও তা দ্বারা সমুদ্র সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত তা এমনি ছিলো ৷ এর অর্থ এও হতে পারে যে, এ দুটি গ্যাসের অণু-পরমাণুগুলো একটা অপরটা থেকে বিছিন্ন হয়ে যাবে । যেমন আজকাল আণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরিত হয়। যদি এই শেষোক্ত ব্যাপরটিই ঘটে, তাহলে এ বিস্ফোরণটি এমন প্রচন্ড ও ভয়াবহ হবে যে, তার মোকাবেলায় বর্তমানে প্রচলিত ত্রাস সৃষ্টিকারী বোমাগুলো শিশুদের খেলনার মতো মনে হবে৷ অথবা এ ব্যাপারটা বর্তমান মানবজাতির অজানা অন্য কোনো উপায়েও সংঘটিত হতে পারে। তবে যে উপায়েই তা ঘটুক, তা যে মানুষের চিত্তা ও কল্পনা-বহির্ভূত পর্যায়ের আতংকজনক ঘটনা হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সুরা: আল-ইনফিতার
আয়াত নং :-4
টিকা নং:2,
وَ اِذَا الْقُبُوْرُ بُعْثِرَتْۙ
এবং যখন কবরগুলো খুলে ফেলা হবে, ২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:২) প্রথম তিনটি আয়াতে কিয়ামতের প্রথম পর্বের উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই আয়াতে দ্বিতীয় পর্বের কথা বলা হয়েছে। কবর খুলে ফেলার মানে হচ্ছে, মানুষকে আবার নতুন করে জীবিত করে উঠানো।
সুরা: আল-ইনফিতার
আয়াত নং :-5
টিকা নং:3,
عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ وَ اَخَّرَتْؕ
তখন প্রত্যেক ব্যক্তি তার সামনের ও পেছনের সবকিছু জেনে যাবে।৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) আসল শব্দ হচ্ছে مَا قَدَّمَتۡ وَاَخَّرَتْ এ শব্দগুলোর কয়েকটি অর্থ হতে পারে এবং সবগুলো অর্থই এখানে প্রযোজ্য। যেমন (১) যে ভালো ও মন্দ কাজ করে মানুষ আগে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে مَا قَدَّمَتۡ এবং যেগুলো করতে সে বিরত থেকেছে তাকে مَاوَاَخَّرَتْ বলা যায়। এ দিক দিয়ে এ শব্দগুলো ইংরেজী Commission বা Omission এর মতো একই অর্থবোধক। (২) যা কিছু প্রথমে করেছে তা مَا قَدَّمَتۡ এবং যা কিছু পরে করেছে তা مَاوَاَخَّرَتْ এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সম্পাদনের ধারাবাহিকতা ও তারিখ অনুসারে মানুষের প্রত্যেকটি কাজের হিসেব সম্বলিত আমলনামা তার সামনে এসে যাবে। (৩) যেসব ভালো বা মন্দ কাজ মানুষ তার জীবনে করেছে সেগুলো مَا قَدَّمَتۡ এর অন্তর্ভুক্ত। এ মানুষের সামাজে এসব কাজের যে প্রভাব ও ফলাফল সে নিজের পেছনে রেখে এসেছে সেগুলো مَاوَاَخَّرَتْ এর অন্তর্ভুক্ত।
ফী জিলালিল কুরআন:
“যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে, যখন গ্রহ নক্ষত্রগুলো বিক্ষিপ্ত হবে, যখন সমুদ্রগুলোকে উদ্বেলিত করা হবে এবং যখন কবরগুলোকে খুলে দেয়া হবে, তখন প্রত্যেকে জানবে, সে কী আগে পাঠিয়েছে এবং কী সে পেছনে রেখে গেছে।” মহাবিশ্বের গভীর পর্যবেক্ষণের ফলে মানুষের স্নায়ূতে যে মর্মবাণী ছড়িয়ে যায়, সে সম্পর্কে পূর্ববর্তী সূরায় আমি আলোচনা করেছি। পরিবর্তনের যোগ্যতাসম্পন্ন হাত মাত্রই এ মর্মবাণীকে ধারণ করে এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিপ্লবের ঝাকুনিতে তা আলোড়িত ও আন্দোলিত হয়। এ বিশাল বিশ্বে কোনো বস্তুই অপরিবর্তিত থাকে না। এই মর্মবাণী মানুষকে তার আকর্ষণ ও আসক্তির যাবতীয় বস্তু বর্জনে উদ্বুদ্ধ করে, কেবলমাত্র আল্লাহকে ছাড়া, যিনি এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা এবং যিনি সকল বস্তু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন, আর সেই চিরন্তন মহাসত্য- যার পরিবর্তন নেই এবং স্থিতিশীল ব্যবস্থাপনায় এই মহাসত্যের কাছ থেকেই মানুষ সহায়তা লাভ করতে পারে। মহান স্রষ্টা ও মাবুদ আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ স্থিতিশীল ও চিরঞ্জীব নয়। মহা প্রলয় : কেয়ামতের সেই মহাপ্রলয়ের আলামত হিসাবে এখানে আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। কিঞ্চিৎ শাব্দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্যান্য স্থানেও এর উল্লেখ রয়েছে । যেমন সূরা ‘আর রহমান’-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যেদিন আকাশ চৌচির হবে, সেদিন তা রক্তের মতো লাল চামড়ার রূপ ধারণ করবে। সূরা ‘আল হাক্কা’তে বলা হয়েছে, ‘আকাশ খানখান হয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে ।’ সূরা ইনশিকাকে বলা হয়েছে, ‘যখন আকাশ ফেটে যাবে।’ বস্তুত আকাশের বিদীর্ণ হওয়া বা ফেটে চৌচির হওয়াটা সেই সংকটময় দিনের অন্যতম একটি বাস্তব ঘটনা ৷ তবে আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্য কী, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা দুস্কর ৷ অনুরূপভাবে বিদীর্ণ হওয়া বা ফেটে যাওয়ার রূপটা কেমন হবে, তাও বলা কঠিন । তবে এ দ্বারা যে জিনিসটি চেতনার ফলকে প্রতিফলিত হয়, তাহলো আমাদের নিত্য পরিদৃশ্যমান এই বিশ্বজগতের কাঠামোতে একটা আমূল পরিবর্তন, তা বর্তমান ব্যবস্থার অবসান এবং তার প্রচলিত এই সুক্ষ প্রশাসনিক অবকাঠামোর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা দৃশ্য । এই দৃশ্যটির আরেকটি পার্শ্বচিত্র হলো সূরায় আলোচিত নক্ষত্রমন্ডলীর বিক্ষিপ্ত হয়ে ঝরে পড়ার বিষয়টি । বর্তমানে এই নক্ষত্রমন্ডলী যেরূপ অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থেকে প্রচন্ড গতিবেগে মহাশূন্যের নিজ নিজ কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, যেভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ সীমানার মধ্যে থেকে অন্যের সীমানাকে বিন্দুমাত্রও না মাড়িয়ে অবাধে বিচরণ করেছে, যেভাবে কোনো নক্ষত্র এই বিশাল মহাশূন্যে -যার সীমা-সরহদ কারো জানা নেই-এমনভাবে বিচরণ করছে যে, কখনো সে নিজ কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে না, তারপরও সেদিন তাতে এই অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা দেবে। এই নক্ষত্রমন্ডলীর আয়ুস্কাল যেদিন সত্যিই ফুরিয়ে যাবে । সেদিন তারা যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার বিষয়টি । বর্তমানে এই নক্ষত্রমন্ডলী যেরূপ অটুট বন্ধনে আবদ্ধ থেকে প্রচন্ড গতিবেগে মহাশুন্যের নিজ নিজ কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে, যেভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ সীমানার মধ্যে থেকে অন্যের সীমানাকে বিন্দুমাত্রও না মাড়িয়ে অবাধে বিচরণ করেছে, যেভাবে কোনো নক্ষত্র এই বিশাল মহাশূন্যে-যার সীমা-সরহদ কারো জানা নেই-এমনভাবে বিচরণ করছে যে, কখনো সে নিজ কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে না, তারপরও সেদিন তাতে এই অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা দেবে। এই নক্ষত্রমন্ডলীর আয়ুস্কাল যেদিন সত্যিই ফুরিয়ে যাবে । সেদিন তারা যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে ঝরে পড়বে এবং নিজ নিজ অদৃশ্য ও অটুট সংযোগসূত্র ও রক্ষাব্যুহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়বে, তখন তা সমগ্র মহাশূন্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিটকে পড়বে, ঠিক যেমন অণু স্বীয় বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছুটে যায়। সমুদ্রের উদ্বেলিত হওয়ার ব্যাপারটা এভাবে ঘটতে পারে যে, তার পানি স্ফীত হয়ে শুষ্কমন্ডলকে ও নদ নদীকে প্লাবিত করবে। আবার এর অর্থ পানির দু’টি উপাদান-অক্সিজেন ও হাউড্রোজেনকে পানি থেকে আলাদা করে ফেলাও হতে পারে। এতে কারে সমুদ্রের সমস্ত পানি এই দু’টি গ্যাসে রূপান্তরিত হবে, যেমন আল্লাহর ইচ্ছায় ওই দু’টি গ্যাস একত্রিত হওয়া ও তা দ্বারা সমুদ্র সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত তা এমনি ছিলো ৷ এর অর্থ এও হতে পারে যে, এ দুটি গ্যাসের অণু-পরমাণুগুলো একটা অপরটা থেকে বিছিন্ন হয়ে যাবে । যেমন আজকাল আণবিক বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরিত হয়। যদি এই শেষোক্ত ব্যাপরটিই ঘটে, তাহলে এ বিস্ফোরণটি এমন প্রচন্ড ও ভয়াবহ হবে যে, তার মোকাবেলায় বর্তমানে প্রচলিত ত্রাস সৃষ্টিকারী বোমাগুলো শিশুদের খেলনার মতো মনে হবে৷ অথবা এ ব্যাপারটা বর্তমান মানবজাতির অজানা অন্য কোনো উপায়েও সংঘটিত হতে পারে। তবে যে উপায়েই তা ঘটুক, তা যে মানুষের চিত্তা ও কল্পনা-বহির্ভূত পর্যায়ের আতংকজনক ঘটনা হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কবর উন্মোচিত হওয়ার ব্যাপারটা পূর্ববর্তী এই সব ঘটনার কোনোটির কারণে সংঘটিত হতে পারে, আবার সেই ঘটনাবহুল দিনে আলাদাভাবে সংঘটিত ব্যাপারও হতে পারে। অতপর সেই কবর থেকে আল্লাহ্ তায়ালা কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্নির্মিত দেহসমুহ বের হবে- ঠিক যেভাবে তাকে ইতিপূর্বে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছিলেন সেভাবে । অতপর তারা হিসাব-নিকাশ ও কর্মফলের সম্মুখীন হবে। এই দৃশ্যের বর্ণনা দেয়ার পর এর দ্বারা সমর্থিত ও এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর একটি বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে এবং তা হচ্ছে ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে সে কী আগে পাঠিয়েছে এবং কী পেছনে রেখে গেছে।’ অর্থাৎ কী সে প্রথম জীবনে করেছে এবং কী শেষ জীবনে করেছে। অথবা কী সে নিজ জীবনে করেছে এবং কী সে অন্যদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে রেখে এসেছে। অথবা কী সে দুনিয়াতে ভোগ করে নিঃশেষ করে এসেছে এবং কী সে আখেরাতের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছে। এর অর্থ যাই হোক না কেন, এটা সুনিশ্চিত যে, মানুষ যখন নিজের কৃতকর্মের কথা জানবে এবং একই সাথে সেই ত্রাসজনক ঘটনাবলীও সংঘটিত হবে। তথন স্বাভাবিকভাবেই এ দৃশ্যাবলী ও ঘটনাবলী যেমন আতংকজনক হবে, তেমনি তার জন্যে তার নিজের কৃতকর্মও উদ্বেগজনক হবে। বস্তুত কোরআনের এ উক্তি ‘প্রত্যেকে জানবে সে কী আগে পাঠিয়েছে এবং কী পেছনে রেখে গেছে-‘ এক অতীব চমকপ্রদ বর্ণনাভংগির উদাহরণ পেশ করে। অনুরূপভাবে মানুষের সেদিন নিজের কৃতকর্মের অগ্র-পশ্চাৎ জান৷ যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট সীমায় গিয়ে থেমে থাকবে না, তাই এই জানা হবে সেদিনকার আতংকজনক ঘটনাবলীর মতোই তীতিপ্রদ। এ বিষয়টা শব্দের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে উল্লেখ না করে কেবল অভিব্যক্তির ওপরই এখানে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। একারণেই এটি অধিকতর তাৎপর্যবহ ও প্রভাবশালী ।
সুরা: আল-ইনফিতার
আয়াত নং :-8
টিকা নং:4,
فِیْۤ اَیِّ صُوْرَةٍ مَّا شَآءَ رَكَّبَكَؕ
এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন করেছেন।৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) অর্থাৎ প্রথমে তো তোমার উচিত ছিল সেই পরম করুণাময় ও অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহ লাভ করে তাঁর শোকরগুজারী করা এবং তাঁর সমস্ত হুকুম মেনে চলা। তাঁর নাফরমানী করতে গিয়ে তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নিজের যাবতীয় যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাকে তুমি নিজের কৃতিত্ব মনে করার ধোঁকায় পড়ে গেছো। তোমাকে যিনি অস্তিত্বদান করেছেন তাঁর অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেবার চিন্তা তোমার মনে একবারও উদয় হয় না। দ্বিতীয়ত, দুনিয়ায় তুমি যা ইচ্ছে করে ফেলতে পারো, এটা তোমার রবের অনুগ্রহ। তবে কখনো এমন হয়নি যে, যখনই তুমি কোন ভুল করেছো অমনি তিনি তোমাকে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত করে বিকল করে দিয়েছেন। অথবা তোমার চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন বা তোমাকে বজ্রপাতে হত্যা করেছেন। কিন্তু তাঁর এ অনুগ্রহ ও কোমলতাকে তুমি দুর্বলতা ভেবে বসেছো এবং তোমার আল্লাহর উলুহিয়াতে ইনসাফের নামগন্ধও নেই মনে করে নিজেকে প্রতারিত করেছো।
ফী জিলালিল কুরআন:
মানুষের দৈহিক গঠন প্রক্রিয়া : বিবেকবুদ্ধি ও চেতনা জাগ্রতকারী এই দৃশ্যের বর্ণনা দেয়ার পর কোরআন মানুষের বাস্তব অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিয়েই দেখতে পারবে, সে এ ব্যাপারে একেবারেই গাফেল ও উদাসীন। এখানে এসেই সে তার হৃদয়ে একটি স্নেহমাখা তিরস্কারের পরশ বুলিয়ে দেয়, প্রচ্ছন্ন হুমকি দেয় এবং তার ওপর আল্লাহ তায়ালা যে অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে অনুগ্রহটি হচ্ছে তাকে ভারসাম্যপূর্ণ সুঠাম একটি দেহ দান করা। অথচ তাকে কি ধরনের আকৃতি দেবেন সেটা স্বয়ং তার প্রতিপালকেরই নিরংকুশ ইচ্ছাধীন ব্যাপার ছিলো! তথাপি নিজ অনুগ্রহে তিনি এই সুসামঞ্জস্য ও সুন্দর দেহ দান করলেন। এ জন্য সে তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয় না এবং তার মুল্যায়নও করে না। ‘হে মানুষ! ‘এখানে “হে মানুষ’ বলে সম্বোধন করার তাৎপর্য হলো, তার সত্ত্বার সবচেয়ে সম্মানজনক দিকটি তুলে ধরা। সেটি হচ্ছে তার মনুষ্যত্ব । এটি দ্বারাই সে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে চিহ্নিত হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যের সুবাদেই সে আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। অতপর সেই সম্ভ্রমপূুর্ণ সুন্দর ভৎর্সনাটি উচ্চারণ করে বলেন যে, “তোমার মহান প্রতিপালকের ব্যাপারে তোমাকে কিসে বিভ্রান্ত করলো?” হে মানুষ! যাকে তোমার প্রতিপালক সম্মানিত করেছেন, যিনি তোমার লালন পালনকারী ও তত্ত্বাবধায়ক, তোমার মহান মনুষ্যত্বের যিনি একমাত্র সংরক্ষক, কিসে তোমাকে তোমার সেই প্রতিপালকের ব্যাপারে বিপথগামী করলো, যার ফলে তুমি তার অধিকার আদায়ে গাফলতি করছো, তার প্রতি অশালীন আচরণ করছো, তার প্রতি উদাসীন থাকছো? অথচ তিনি তোমার সুমহান প্রভু ও মনিব! যিনি তোমাকে মনুষ্যত্ব দান করেছেন, যা দ্বারা তুমি গোটা সৃষ্টির সেরা হয়েছে যা দ্বারা তুমি ন্যায় ও অন্যায়ের বাছবিচার করতে শিখেছো? অতপর আল্লাহর এই বদান্যতা ও অনুগ্রহের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হচ্ছে, যা ইতিপূর্বে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতের শুরুতে মানুষকে তার মনুষ্যত্বের নামে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এই মনুষ্যত্ব হচ্ছে তাকে প্রদত্ত আল্লাহর অপার দান। এরপর এই দানের বিশদ বিবরণ দিতে গিয়ে তার দেহের সুঠাম, সুন্দর সুসামঞ্জস্য গঠনের উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে নিজ ইচ্ছামতো যে কোনো ধরনের দৈহিক গঠন দিতে পারতেন । কিছু তাকে এই সুঠাম গঠন দিয়েছেন আপন ইচ্ছাক্রমে ৷ এটা তার দয়া, অনুগ্রহ ও মহানুভবতা ৷ অকৃতজ্ঞ মানুষের ওপর তিনি এহেন মহানুভবতা দেখিয়েছেন শুধু অকৃতজ্ঞ নয়, গর্বিত ও উদাসীন মানুষের ওপরও । “হে মানুষ। কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে বিভ্রান্ত করলো, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, সুগঠিত করেছেন ও সুসামঞ্জস্য করেছেন?” এটি এমন একটি সম্বোধন, যা জাগ্রত মানব সত্ত্বার প্রতিটি অণু-পরমাণুতে শিহরণ তোলে, অন্তরের অন্তস্থলে চেতনার সঞ্চার করে। তার মহানুভব প্রতিপালক তাকে এই ভাবগম্ভীর ভৎর্সনা করেন এবং তাকে দেয়া এই অনুগ্রহ স্মরণ করিয়ে দেন তখন, যখন সে অলসতা ও উদাসীনতায় নিমজ্জিত, যখন সে তার স্রষ্টা, তার সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য সত্ত্বার নির্মাতা মনিবের মর্যাদা সম্পর্কে অচেতন । বস্তুত মানুষকে তার বর্তমান সুন্দর, সুঠাম, সুসামঞ্জস্য আকৃতি ও কর্মক্ষমতা উভয় দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্ত্বা দিয়ে সৃষ্টি করার এই অতুলনীয় কীর্তি মহান প্রতিপালকের ব্যাপারে তার সুদীর্ঘ চিন্তা, সুগভীর কৃতজ্ঞতা, অবিমিশ্র বিনয় ও ভালোবাসার প্রেরণা যোগায় । কেননা তিনি ইচ্ছা করলে তাকে অন্য কোনো আকৃতিতে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু নিছক স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারেই তিনি এই সুন্দর সুসামঞ্জস্য আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ শুধু যে সুন্দর, সুগঠিত ও সুসামঞ্জস্য আকৃতির অধিকারী তা-ই নয়, বরং তার সন্ত্বায় এতো বিস্ময়কর ও অতুলনীয় সৃষ্টিকর্মের সমাবেশ ঘটেছে যে, তা তার নিজের উপলব্ধি ক্ষমতারও আয়ত্বের বাইরে এবং তার আশপাশে যতো সৃষ্টি দৃশ্যমান তার চেয়েও চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর ৷ তার দৈহিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক সত্ত্বা একই পর্যায়ের সৌন্দর্য, সমতা ও ভারসাম্য বিরাজমান, আর তা তার সমগ্র সত্ত্বা অত্যন্ত সুন্দর ও সুষমামন্ডিত ভাবে দৃশ্যমান । মানুষের আংগিক গঠন-প্রকৃতি, তার সুক্ষতা ও জটিলতা এবং তার সংগতি ও অখন্ডতার চমকপ্রদ বিবরণ নিয়ে এ যাবত বহু রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এখানে এই দৈহিক কাঠামো সংক্রান্ত বিস্ময়কর তথ্যসমূহ পুরোপুরিভাবে তুলে ধরার অবকাশ নেই৷ আমি শুধু এর কয়েকটির প্রতি ইংগিত দেয়াই যথেষ্ট মনে করবো। মানুষের দৈহিক কাঠামোর সাধারণ অংশগুলো হলো, অস্থিমন্ডল, অন্দ্রিমন্ডল, চর্ম, পরিপাকযন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন প্রণালী, শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থা, জননেন্দ্রী প্রণালী, স্নায়ুমন্ডল, প্রস্রাব যন্ত্র, আস্বাদন ব্যবস্থা, আঘ্রাণ ব্যবস্থা, শ্রবনেন্দ্রীয় ও দর্শনেন্দ্রীয় । উল্লেখিত অংশগুলোর প্রত্যেকটি এমন বিস্ময়কর, যার সাথে আধুনিক যুগের হতবুদ্ধিকর শৈল্পিক বিষ্ময়গুলোর কোনো তুলনাই হয় না। বস্তুত মানুষ তার নিজ সত্ত্বার এসব বিস্ময়কে ভুলে থাকলেও এর চেয়ে গভীর, সু্ক্ষ ও বৃহৎ বিস্ময় আর কল্পনা করা যায় না। ইংলিশ সায়েন্স ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে যে, মানুষের হাত হচ্ছে এক অতুলনীয় বিস্ময়। দ্রুত সংকোচন ও সম্প্রসারণশীল ! সহজ কর্মক্ষমতা ও ব্যবহারের ব্যাপকতায় হাতের সমকক্ষ কোনো যন্ত্র তৈরী করা শুধু কঠিন নয় বরং একবারেই অসম্ভব । যখন কেউ একটা বই পড়তে ইচ্ছা করে, তখন সে নিজ হাত দ্বারা তা প্রথমে ধরে, তারপর তাকে পড়ার উপযুক্ত অবস্থানে রাখে । এই সময় এই হাতই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার অবস্থানকে শুধরে দেয়। যখন সে তার একটি পাতা ওল্টাতে চেষ্টা করে, তখন তার আংগুলগুলোকে পাতার নিচে স্থাপন করে। অতপর যতটুকু চাপ দিলে পাতা ওল্টানো যায় আংগুলে ততোটুকুই চাপই সে দেয়। তারপর পাতা ওল্টানোর সাথে সাথে সেই চাপের ক্রিয়া শেষ হয়ে যায় । হাতই কলম ধরে এবং তা দিয়ে লেখে ৷ চামচ থেকে শুরু করে ছুরি ও টাইপযন্ত্র পর্যন্ত মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জামকে এই হাতই ব্যবহার ও নাড়াচাড়া করে। জানালা-দরজা খোলে ও বন্ধ করে, মানুষ যা চায় তা বহন করে। দুই হাতে ২৭টি অস্থি রয়েছে এবং প্রত্যেক হাতের ১৯টি শিরাতন্ত্রী রয়েছে ।’ (আধুনিক বিজ্ঞান ও আল্লাহ” অধ্যাপক আবদুর রায্যাক নওফেল)। ‘বিজ্ঞান মানুষকে ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করে’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে “মানুষের কানের একটি অংশ (অর্থাৎ কানের ভেতরে অংশ ) প্রায় চার হাজার সুক্ষ ও জটিল বক্র যন্ত্রের সমষ্টি । এর প্রত্যেকটি যন্ত্র ও ব্যাপ্তির দিক দিয়ে ধারাবাহিকভাবে এক সাথে বাঁধা । বলা যেতে পারে যে, এই ক্ষুদ্র যন্ত্রগুলো বাদ্যযন্ত্র সদৃশ্য । মনে হয়, এটি এমন একটি হাতিয়ার, যা মেঘের গর্জন থেকে শুরু করে গাছের পাতার মর্মরধ্বনি পর্যন্ত এবং বাদ্যযন্ত্রের মিহিসুর পর্যন্ত সকল তীব্র বা মৃদু শব্দকে মগজ পর্যন্ত পৌছে দেয় ৷ ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও আল্লাহ’ নামক গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে যে, দর্শন-যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চোখ, যা নিজে ১৩ কোটি আলো বিকিরণকারী যন্ত্রের সমষ্টি এবং এই সকল যন্ত্র হচ্ছে স্নায়ুর কেন্দ্রবিন্দু । ভ্রুআচ্ছাদিত চোখের পাতায়, চোখের দিনরাত রক্ষণাবেক্ষন করে এবং এই পাতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নড়াচড়া করে । এটি নাড়াতে কোনো ইচ্ছার দরকার হয় না। ধুলাবালি, মাটি, কংকর প্রভৃতি যাবতীয় ক্ষতিকর বহিরাগত জিনিস থেকে এই পাতাই চোখকে রক্ষা করে। অনুরুপভাবে ভ্রুর ছায়া তাকে সূর্যের উত্তাপের প্রখরতা থেকেও রক্ষা করে। চোখের পাতার ভ্রমাগত উত্থান-পতন চোখকে বহিরাগত ক্ষতিকর জিনিস থেকে রক্ষা করা ছাড়াও চোখের শুষ্কতা প্রতিরোধ করে। চোখের পানি, যাকে অশ্রু বলা হয়ে থাকে, তা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী নিষ্কাশক। মানুষের আস্বাদন-যন্ত্র হলো জিহ্বা প্রতিটি মানুষের শৈল্পিক ঝিল্লীর জীবাণুসমূহের মধ্যে বিরাজমান বিপুল সংখ্যক আস্বাদন কোষই জিহ্বার কর্মতৎপরতার উৎস। আর এ সব জীবাণু হয় বিভিন্ন আকৃতির । কতক আছে সুতোর মতো, কতক ছত্রাক ধরনের, কতক মসুরের দানার মতো! জিহ্বার যে স্নায়ূতন্ত্রী ও স্বাদতন্ত্রী খাদ্যনালীর সাথে সংযুক্ত তার শাখা-প্রশাখাই এই সব জীবাণুর খাদ্য যোগায় । আহারের সময় কেবল স্বাদতন্ত্রীতেই প্রতিক্রিয়া হয় এবং এই প্রতিক্রিয়া তৎক্ষণাৎ মগজে পৌছে যায়। জিহ্বা মানুষের মুখগহবরের সম্মুখভাগেই বিদ্যমান, যাতে ক্ষতিকর জিনিস মাত্রকেই সে সংগে সংগে উগলে ফেলে দিতে পারে। কোনো জিনিস তিক্ত না মিষ্টি, ঠাণ্ডা না গরম, টক না লোনা, কোমল না কটু, তা মানুষ এই যন্ত্রটি দ্বারাই টের পায়। জিহ্বার রয়েছে, ৯ হাজার সুক্ষ আস্বাদন কেন্দ্র, যার প্রতিটি একাধিক স্নায়ূতন্ত্রী দ্বারা মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত । এখন স্নায়ুতন্ত্রীর সংখ্যা কতো ও আকৃতি কেমন এবং কিভাবে তা স্বতন্ত্র ও এককভাবে কাজ করে এবং কিভাবে মস্তিষ্কের সাথে অনুভুতির সংযোগ ঘটায় সে প্রশ্নের জবাব ও জানা প্রয়োজন । সমগ্র দেহের ওপর পূর্ণাংগ প্রধান্য বিস্তারকারী স্নাযুতন্ত্রী এক ধরনের সুক্ষ ছিদ্র বিশিষ্ট নল দ্বারা তৈরী । এই নলের সংখ্যা বহু এবং তা শরীরের সর্বত্র বিস্তৃত । এই নলগুলো তার চেয়েও বড় কেন্দ্রীয় স্নায়ূতন্ত্রীর সাথে সংযুক্ত হয়। তাই শরীরের কোনো একটি অংশও যখন কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়, চাই তা চারপাশের পরিবেশের বিরাজমান তাপের সামান্য পরিবর্তনের কারণেই হোক না কেন, স্নায়ূতন্ত্রীগুলো সেই অনুভূতিকে সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে থাকা কেন্দ্রগুলোতে পৌছিয়ে দেয়, আর এই কেন্দ্রগুলো সেই অনুভূতিকে পৌছিয়ে দেয় মস্তিকে ৷ এই অনুভুতি মস্তিষ্ককে কর্মক্ষম ও সক্রিয় করে তোলে । স্নায়ূতন্ত্রীতে ইংগিত ও সংকেতের যাতায়াতের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে একশো মিটার ৷ (আল্লাহ ওয়াল-ইলমুল জাদীদ-আল্লাহ ও আধুনিক বিজ্ঞান) । আর যখন আমরা হজম প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি দেই এবং পরিপাকযন্ত্রকে একটা রাসায়নিক কারখানা হিসাবে এবং যে খাদ্য আমরা গ্রহণ করি তাকে অপ্রক্রিয়াজাত দ্রব্য হিসাবে বিবেচনা করি, তখন আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বুঝতে পারি, ওটা একটা বিস্ময়কর প্রক্রিয়া । কারণ এই প্রক্রিয়া খোদ পরিপাক যন্ত্রটি ছাড়া আর প্রায় সকল ভুক্ত দ্রব্যকে হজম করে ফেলে ৷ প্রথমে তো আমরা এতো হরেক রকমের খাদ্য নিক্ষেপ করি কাচা মাল হিসাবে ৷ এ সময়ে খোদ কারখানা সম্পর্কে যেমন আমরা কোনো কথা বিবেচনায় আনি না, তেমনি পরিপাকক্রিয়া কিভাবে কোন রাসায়নিক তত্ত্ব অনুসারে পরিচালিত হয় তাও ভেবে দেখি না। আমরা গোশ্ত ভুনা, মাছ ও তরি তরকারি ইত্যাদি খাই এবং যে কোনো পরিমাণ পানি দ্বারা তাকে পাকস্থলীতে ঠেলে দেই । অতপর এই মিশ্রন থেকে পাকস্থলী বেছে নেয় শুধুমাত্র উপকারী দ্রব্যগুলোকে। প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যকে সে চুর্ণবিচূর্ণ করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র অংশে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে এ কাজটি সম্পন্ন করে। এ ক্ষেত্রে বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত জিনিসগুলোর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হয় না। অতপর বাদবাকী দ্রব্যগুলোকে সে পুনরায় নতুন প্রোটিনে পরিণত করে-যা বিভিন্ন কোষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পরিপাকযন্ত্র দেহের জন্য প্রয়োজনীয় চুন, গন্ধক, আয়োডিন, লোহা এবং অন্যান্য দ্রব্য সংগ্রহ করে। সেই সাথে এ ব্যাপারেও যত্নবান থাকে যাতে এ সব জিনিসের মৌলিক উপাদানগুলো নষ্ট না হয়, হরমন উৎপাদনের সম্ভাবনা অক্ষুণ্ন থাকে, জীবনের জন্যে অত্যাশ্যক যাবতীয় জিনিস যাতে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিমাণে বিদ্যমান থাকে এবং যে কোন প্রয়োজন মেটানোর জন্য তা সদা প্রস্তুত থাকে। পরিপাকযন্ত্র বা পাকস্থলী সক্কুধাসহ যে কোনো জরুরী অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য তেল ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে রাখে । মানুষের যাবতীয় চিন্তা গবেষণা কিংবা যুক্তিতর্ক প্রদর্শন সত্ত্বেও উল্লেখিত কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। বস্তুত আমরা এই সমস্ত উপকরণ উল্লেখিত রাসায়নিক কারখানায় প্রতিনিয়ত সরবরাহ করে থাকি । কিন্তু আমরা কি কি জিনিস খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করছি, সেগুলো প্রায় পুরোপুরিই আমাদের দৃষ্টিতে উপেক্ষিত থাকে। (অর্থাৎ প্রতিটি আহার্য দ্রব্যের দোষগুণ বিবেচনা করি না) । জীবন ধারণের জন্যে এই স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার ওপরই আমরা নির্ভর করে বসে থাকি। যখন এই সকল ভুক্ত দ্রব্য হজম হয়ে বিলীন হয়ে যায় এবং নবতর জিনিসে পরিণত হয়, তখন দেহাভ্যন্তরে বিরাজমান কোটি কোটি কোষের মধ্য থেকে প্রতিটি কোষের কাছে তাকে প্রতিনিয়ত পৌছানো হাতে থাকে। এক একজন মানুষের দেহে বিদ্যমান এই সব কোষের সংখ্যা সমগ্র পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যার চেয়েও বেশী ৷ প্রতিটি স্বতন্ত্র কোষের কাছে এই সরবরাহ প্রতিনিয়ত চাল থাকা জরুরী । আর এটাও জরুরী যে, সেই নির্দিষ্ট কোষটির জন্য যে যে উপকরণের প্রয়োজন, তা ছাড়া অন্য কোনো উপকরণ যেন তাকে সরবরাহ করা না হয়। নির্দিষ্ট কোষটির এ উপকরণগুলোর প্রয়োজন হয় ওগুলোকে দিয়ে হাড়, নখ, গোশ্ত, চুল, চোখ ও দাত গঠনের জন্য । সংশ্লিষ্ট কোষটি এ সব উপকরণ পাওয়া মাত্রই হাড়, গোশ্ত, দাত, চোখ ইত্যাদি গঠন করা শুরু করে দেয়। অতএব এটা এমন একটা রাসায়নিক কারখানা যা মানুষের মেধা দ্বারা উদ্ভাবিত যে কোনো কারখানার তুলনায় ঢের বেশী উৎপাদন করে। এখানে এমন একটা সরবরাহ ব্যবস্থাও তৎপর, যা দুনিয়ার মানুষের চেনাজানা যে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা বা বন্টন ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বড় ও বিশাল । এখানে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের শৃংখলার সাথে ।’ (আল-ইলমু ইয়াদ্দূ ইলাল ঈমান’”-ঈমানের প্রেরণা সৃষ্টিতে আধুনিক বিজ্ঞানের অবদান” নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) ৷ মানুষের দেহের অন্যান্য অংগ প্রত্যংগ সম্পর্কে অনেক কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু এ সব অংগ স্পষ্টতই অলৌকিকত্বের দাবীদার ৷ যদিও এগুলোতেও কোনো না কোনোভাবে অন্যান্য জীব-জানোয়ার অংশীদার, তথাপি এগুলো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ও আধ্যাত্মিক বিশেষত্বের প্রতীক হিসাবে বিরাজ করছে। আর এ কারণেই এগুলো আলোচ্য সূরায় বিশেষ অনুগ্রহ হিসাবে স্থান পেয়েছে। সূরার প্রথম কয়েকটি আয়াতে ‘হে মানুষ’ বলে সম্বোধন করার পর বলা হয়েছে, ‘যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন ।’ এই বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তির উপলব্ধির নিগৃঢ় রহস্য আমাদের অজানা । কেননা বুদ্ধিবৃত্তি বা বিবেক স্বয়ং আমাদের বোধশক্তি বা উপলব্ধির হাতিয়ার! বিবেক নিজেকে কখনো উপলদ্ধি করতে পারে না। সে যা কিছু উপলদ্ধি করে, তাও কিভাবে করে সেটা সে বুঝতে অক্ষম। এই সমস্ত বোধক্যন্ত্র যে সুক্ষ স্নায়ুতন্ত্রীর মাধ্যমে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌছে, সেটা না হয় মেনে নিলাম। প্রশ্ন থেকে যায় যে সে এগুলোর অর্তিত তথ্যসমহ কোথায় সংরক্ষণ করে ৷ মস্তিষ্ক যদি একটি রেকর্ডকারী টেপ হতো, তাহলে মানুষের গড় বয়স ষাট বছরে লক্ষ লক্ষ মিটার টেপের প্রয়োজন হতো, যাতে এত বিপুল সংখ্যক ছবি, কথা, তত্ত্ব ও তথ্য এবং আবেগ ও অনুভূতিকে রেকর্ড রাখা যায় এবং যাতে পরবর্তী সময় তা স্মরণ করা যায়। কার্যতও মানুষ বহু দশক পরেও অতীতের অনেক কিছুই স্মরণ করতে পারে! আরো প্রশ্ন জাগে যে, ব্যক্তিগত কথাবার্তা, ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা, ব্যক্তিগত ঘটনাবলী ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি সমূহের কিভাবে সমন্বিত করা যাবে, যাতে তা দ্বারা একটা সামষ্টিক সংস্কৃতিকে সৃষ্টি করা যায়? কিভাবেই বা ছিটেফোটা তথ্যসমূহকে একটা বিদ্যায়, ইন্দ্রিয়ার্জিত তথ্যসমূহকে প্রজ্ঞায় এবং অভিজ্ঞতা সমূহকে একটা সুনির্দিষ্ট জ্ঞানে রূপাস্তরিত করা যায়? এই কাজটি করতে পারাই হলো মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট । কিন্তু এটাই তার সর্ববৃহৎ বৈশিষ্ট নয়, সর্বশ্রেষ্ট গুণও নয়। কেননা এতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত রূহ বা আত্মার আলোকরশ্মীর অবদানও রয়েছে। মানুষের এই অসাধারণ রূহ বা আত্মা সৃষ্টিজগত ও তার স্রষ্টার সৌন্দর্যের বদৌলতেই মানুষের কাছে পৌছে এবং সেই অসীম স্রষ্টার সাথে মিলিত হওয়ার কয়েকটি অত্যুজ্জ্বল মুহূর্ত তাকে দান করে। এই রূহের প্রকৃত রহস্য মানুষ জানে না। রূহ তো দূরের কথা, তার চেয়ে ক্ষুদ্র ও নগন্য জিনিসও মানুষের অজানা রয়ে গেছে। যেমন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বহু জিনিস তার জ্ঞান বহির্ভূত ৷ এই রূহ মানুষকে তার ইহলৌকিক জীবনেই উর্ধতন জগতের আনন্দ দিতে ও আলোকে উদ্ভাসিত করতে পারে। তাকে মহান ফেরেশতাদের সাথে মিলিত হওয়ার সম্মানে ভূষিত করতে পারে, তাকে বেহেশতে জীবন যাপন ও সেখানে আল্লাহর সাক্ষাত অর্জনের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। সুতরাং এ রূহ মানুষের প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় দান। এ দ্বারাই মানুষ ‘মানুষ’ হতে পেরেছে । ‘হে মানুষ’ বলে তাকে যখন কোরআনে সম্বোধন করা হয়, তখন আসলে এই আত্মাকেই সম্বোধন করা হয়। আর তাকেই তিরস্কার করা হয় এই বলে “কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রভু সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলো? এ হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে কৃত প্রতক্ষ্য সম্বোধন ও প্রত্যক্ষ তিরস্কার । এ সময় সে তার সামনে এমন একজন গুনাহগার বান্দা হিসাবে অবস্থান করে, যার মনে আল্লাহর পরাক্রম ও প্রতাপ সম্পর্কে যথাযথ উপলদ্ধি নেই এবং নিজেও তাঁর আদব-কায়দা সম্পর্কে সচেতন নয়। তাই এরপরই তাকে দেয়া শ্রেষ্ঠতম নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় এবং সেই সাথে তার অহংকার ও বেয়াদবীর কথাও ৷ এই তিরঙ্কার ও ভৎর্সনা মানুষের পাষাণ হৃদয়কেও গলিয়ে দিতে সক্ষম, যদি সে নিজের সৃষ্টির উৎস, নিজের স্রষ্টা এবং আপন প্রভুর সামনে তার মর্যাদা ও অবস্থান কি ধরনের, তা বিচার বিবচনা ও পর্যালোচনা! করে। তার প্রভুর নিম্নের উক্তিটির ভেতরে তার নিজের জন্মের উৎস, তার প্রভু ও প্রভুর সামনে তার অবস্থান এই তিনটি বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ‘হে মানুষ! তোমার সেই মহান প্রভু সম্পর্কে কিসে তোমাকে বিভ্রান্ত করলো, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, ভারসাম্যপূর্ণ ও সুঠাম করেছেন এবং যেমন আকৃতিতে গড়তে চেয়েছেন গড়েছেন ।’
সুরা: আল-ইনফিতার
আয়াত নং :-9
টিকা নং:5, 6,
كَلَّا بَلْ تُكَذِّبُوْنَ بِالدِّیْنِۙ
কখ্খনো না,৫ বরং (আসল কথা হচ্ছে এই যে), তোমরা শাস্তি ও পুরস্কারকে মিথ্যা মনে করছো।৬
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) অর্থাৎ এই ধরনের ধোঁকা খেয়ে যাওয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তোমার অস্তিত্ব নিজেই ঘোষণা করছে যে, তুমি নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়ে যাওনি। তোমার বাপ-মাও তোমাকে সৃষ্টি করেনি। তোমার মধ্যে যেসব উপাদান আছে সেগুলো নিজে নিজে একত্র হয়ে যাওয়ার ফলেও ঘটনাক্রমে তুমি মানুষ হিসেবে তৈরী হয়ে যাওনি। বরং এক মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর আল্লাহ তোমাকে এই পূর্ণাঙ্গ মানবিক আকৃতি দান করেছেন। তোমার সামনে সব রকমের প্রাণী রয়েছে, তাদের মোকাবিলায় তোমার সবচেয়ে সুন্দর শারীরিক কাঠামো এবং শ্রেষ্ঠ ও উন্নত শক্তি একেবারেই সুস্পষ্ট। বুদ্ধির দাবী তো এই ছিল, এসব কিছু দেখে কৃতজ্ঞতায় তোমার মাথা নত হয়ে যাবে এবং সেই মহান রবের মোকাবিলায় তুমি কখনো নাফরমানী করার দুঃসাহস করবে না। তুমি এও জানো যে, তোমার রব কেবলমাত্র রহীম ও করীম করুণাময় ও অনুগ্রহশীলই নন, তিনি জব্বার ও কাহ্হার—মহাপরাক্রমশালী এবং কঠোর শাস্তি দানকারীও। তাঁর পক্ষ থেকে যখন কোন ভূমিকম্প, তুফান বা বন্যা আসে তখন তার প্রতিরোধের জন্য তোমরা যতই ব্যবস্থা অবলম্বন করো না কেন সবকিছুই নিস্ফল হয়ে যায়। তুমি একথাও জানো, তোমার রব মূর্খ অজ্ঞ নন বরং তিনি মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ। জ্ঞান ও বিজ্ঞতার অপরিহার্য দাবী হচ্ছে এই যে, যাকে বুদ্ধি জ্ঞান দান করা হবে তাকে তার কাজের জন্য দায়ীও করতে হবে। যাকে ক্ষমতা-ইখতিয়ার দেয়া হবে সেই ক্ষমতা ইখতিয়ার সে কিভাবে ব্যবহার করেছে তার হিসেবও তার কাছ থেকে নিতে হবে। যাকে নিজ দায়িত্বে সৎ ও অসৎকাজ করার ক্ষমতা দেয়া হবে তাকে তার সৎকাজের জন্য পুরস্কার ও অসৎকাজের জন্য শাস্তিও দিতে হবে। এসব সত্য তোমার কাছে দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। তাই তোমার মহান রবের পক্ষ থেকে তুমি যে ধোঁকায় পড়ে গেছো তার পেছনে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, একথা তুমি বলতে পারবে না। তুমি নিজে যখন কারোর কর্মকর্তা হবার দায়িত্ব পালন করে থাকো তখন তোমার নিজের অধীন ব্যক্তি যদি তোমার ভদ্রতা ও কোমল ব্যবহারকে দুর্বলতা মনে করে তোমার মাথায় চড়ে বসে, তাহলে তখন তুমি তাকে নীচ প্রকৃতির বলে মনে করে থাকো। কাজেই তোমার প্রকৃতি একথা সাক্ষ্য দেবার জন্য যথেষ্ট যে, প্রভুর দয়া, করুণা ও মহানুভবতার কারণে তার চাকর ও কর্মচারীর কখনো তার মোকাবিলায় দুঃসাহসী হয়ে যাওয়া উচিত নয়। তার এ ভুল ধারণা পোষণ করা উচিত নয় যে, সে যা ইচ্ছা তাই করে যাবে এবং এজন্য কেউ তাকে পাকড়াও করতে ও শাস্তি দিতে পারবে না।
টিকা:৬) অর্থাৎ যে জিনিসটি তোমাকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে তার পেছনে আসলে কোন শক্তিশালী যুক্তি নেই। বরং দুনিয়ার এই কর্মজগতের পরে আর কোন কর্মফল জগত নেই, নিছক তোমার এ নির্বোধ ধারণাই এর পেছনে কাজ করেছে। এ বিভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধারণাই তোমাকে আল্লাহ থেকে গাফেল করে দিয়েছে। এরই ফলে তুমি আল্লাহর ন্যায় বিচারের ভয়ে ভীত হও না এবং এটিই তোমার নৈতিক আচরণকে দায়িত্বহীন বানিয়ে দিয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন:
বিভ্রান্তির কারণ : এরপর উদঘাটন করা হচ্ছে এই বিভ্রান্তি ও নাফরমানীর কারণ । সে কারণ হিসাব নিকাশের দিনকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণটি উন্মোচন করার পর ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিভাবে সেই হিসাব নিকাশ সংঘটিত হবে এবং তার ফলাফল বা কি হবে। এ বিষয়টি খুব জোর দিয়ে ও তাকিদ সহকারে বলা হয়েছে, “না, বরঞ্চ তোমরা প্রতিফল দানের বিষয়টি অস্বীকার করো। অথচ তোমাদের ওপর পাহারাদার রয়েছে। তারা সম্মানিত লেখকবৃন্দ। তোমরা যা কিছু করো, তা তারা জানেন। নিশ্চয়ই সৎ লোকেরা প্রাচুর্যের মধ্যে থাকবে আর পাপীরা থাকবে দোযখে ৷ সেখানে তারা জ্বলবে, প্রতিফল দিবসে তারা তা থেকে দূরে থাকবে না।’ মানুষের চলমান অবস্থা ও ধ্যান ধারণাকে যারা আঁকড়ে ধরে আছে, তাদেরকে ধমক দেয়াই হলো ‘কাল্লা’ অব্যয়টি প্রয়োগের উদ্দেশ্য । ‘কাল্লা’ দ্বারা বুঝানো হয় পূর্ববর্তী বাক্য থেকে ভিন্ন ও নতুন ধরনের বাক্যের সূচনা । পূর্ববর্তী বাক্যে ছিলো তিরঙ্কার ও ভৎর্সনা। আর এখানে আছে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, বর্ণনা দান ও নিশ্চিতকরণ । এটা ভৎর্সনা ও তিরঙ্কার থেকে ভিন্ন জিনিস! ‘না’ বরঞ্চ তোমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করো ।’ অর্থাৎ হিসাব নিকাশ, জবাবদিহী ও প্রতিফল-সব কিছুকেই অস্বীকার করো। আর এটাই হচ্ছে বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার আসল কারণ । যে মন হিসাব নিকাশ ও কর্মফলকে অস্বীকার করে, সেই মন যে হেদায়াত, কল্যাণ ও আল্লাহর আনুগত্যের ওপর স্থির থাকবে, তা কখনোই হতে পারে না। অনেকের অন্তর এতো উর্ধে উন্নীত হয়ে থাকে যে, শুধু ভালোবাসার কারণেই আল্লাহর আনুগত্য করে, তার শাস্তির ভয়েও নয় এবং তার পুরস্কারের লোভেও নয়। তবে এ ধরনের লোকেরা কেয়ামতের কর্মফল দিবসে বিশ্বাস করে। তাঁকে ভয় করে এবং তার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে৷ কেননা সেদিন সে তার সেই মনিবকে দেখতে পাবে যাকে সে ভালোবাসে, যার সাক্ষাতের জন্যে উদগ্রীব থাকে এবং যার জন্যে প্রতীক্ষমাণ থাকে! তবে মানুষ যখন এই দিনটিকে একেবারেই অস্বীকার করে, তখন তার মধ্যে আর কোনো আনুগত্য, শিষ্টাচার ও হেদায়াতের আলো থাকতে পারে না। তার হৃদয় কখনো সজীব এবং তার বিবেক কখনো জাগ্রত থাকবে না।
সুরা: আল-ইনফিতার
আয়াত নং :-12
টিকা নং:7,
یَعْلَمُوْنَ مَا تَفْعَلُوْنَ
যারা তোমাদের প্রত্যেকটি কাজ জানে।৭
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৭) অর্থাৎ তোমরা চাইলে কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করতে পারো, তাকে মিথ্যা বলতে পারো, তার প্রতি বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করতে পারো কিন্তু এতে প্রকৃত সত্য বদলে যাবে না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তোমাদের রব এই দুনিয়ায় তোমাদেরকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেননি। বরং তিনি তোমাদের প্রত্যেকের ওপর অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা নিরপেক্ষভাবে তোমাদের সমস্ত ভালো ও মন্দ কাজ রেকর্ড করে যাচ্ছে। তোমাদের কোন কাজ তাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকছে না। তোমরা অন্ধকারে, একান্ত নির্জনে, জনমানবহীন গভীর জংগলে অথবা এমন কোন অবস্থায় কোন কাজ করে থাকলে যে সম্পর্কে তোমরা পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকছো যে, তা সকল সৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে, তারপরও তা তাদের কাছ থেকে গোপন থাকছে না। এই তত্ত্ববধায়ক ফেরেশতাদের জন্য আল্লাহ “কিরামান কাতেবীন” كِرِاَمَا كَاتَبَيْنَ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ লেখকবৃন্দ যারা করীম (অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাবান)। তাদের কারোর সাথে ব্যক্তিগত ভালোবাসা বা শত্রুতা নেই। ফলে একজনের প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব এবং অন্যজনের অযথা বিরোধিতা করে সত্য বিরোধী ঘটনা রের্কড করার কোন অবকাশই সেখানে নেই। তারা খেয়ানতকারীও নয়। ডিউটি ফাঁকি দিয়ে নিজেদের তরফ থেকে খাতায় উল্টো সিধে লিখে দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ঘুষখোরও নয়। নগদ কিছু নিয়ে কারো পক্ষে বা কারো বিপক্ষে মিথ্যা রিপোর্ট দেবার কোন প্রশ্নই তাদের ব্যাপারে দেখা দেয় না। এসব যাবতীয় নৈতিক দুর্বলতা থেকে তারা মুক্ত। তারা এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। কাজেই সৎ ও অসৎ উভয় ধরনের মানুষের নিশ্চিত থাকা উচিত যে, তাদের প্রত্যেকের সৎকাজ হুবহু রেকর্ড হবে এবং কারোর ঘাড়ে এমন কোন অসৎকাজ চাপিয়ে দেয়া হবে না, যা সে করেনি। তারপর এই ফেরেশতাদের দ্বিতীয় যে গুণটি বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছেঃ “তোমরা যা কিছু করো তা তারা জানে।” অর্থাৎ তাদের অবস্থা দুনিয়ার সি, আই, ডি ও তথ্য সরবরাহ এজেন্সিগুলোর মতো নয়। সব রকমের প্রচেষ্টা ও সাধ্য-সাধনার পরও অনেক কথা তাদের কাছ থেকে গোপন থেকে যায়। কিন্তু এ ফেরেশতারা প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেকটি কাজ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত। সব জায়গায় সব অবস্থায় সকল ব্যক্তির সাথে তারা এমনভাবে লেগে আছে যে, তারা জানতেই পারছে না যে, কেউ তাদের কাজ পরিদর্শন করছে। কোন্ ব্যক্তি কোন্ নিয়তে কি কাজ করেছে তাও তারা জানতে পারে। তাই তাদের তৈরি করা রেকর্ড একটি পূর্ণাংগ রেকর্ড। এই রেকর্ডের বাইরে কোন কথা নেই। এ সম্পর্কেই সূরা কাহাফের ৪৯ আয়াতে বলা হয়েছেঃ কিয়ামতের দিন অপরাধীরা অবাক হয়ে দেখবে তাদের সামনে যে আমলনামা পেশ করা হচ্ছে তার মধ্যে তাদের ছোট বড় কোন একটি কাজও অলিখিত থেকে যায়নি। যা কিছু তারা করেছিল সব হুবহু ঠিক তেমনিভাবেই তাদের সামনে আনা হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন:
কিরামান কাতিবিন : আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা কর্মফল দিবসকে অবিশ্বাস করো’…… অথচ তোমরা সেই দিনের দিকেই ধাবমান, তোমাদের সকল কৃতকর্মের হিসাব-নিকাশ সেদিন চুড়ান্ত করা হবে। তার মধ্যে থেকে কিছুই নষ্ট হবে না বা বিস্মৃত হবে না। তোমাদের ওপর প্রহরী নিযুক্ত রয়েছেন, তারা সম্মানিত লেখক, তোমরা যা-ই করো, তা তারা জানেন ।’ এসব প্রহরী হচ্ছেন মানুষের তত্ত্বাবধান, সার্বক্ষণিক তদারক ও প্রতিটি কার্যকলাপ বা কথাবার্তাকে গুণে গুণে লিপিবদ্ধ করে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত আল্লাহর ফেরেশতা ৷ আমরা জানি না এই কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হয়। এটা জানা আমাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্তও নয়। এসব জিনিস জানা ও বুঝার ক্ষমতা ও যোগ্যতা যে আমাদের দেয়া হয়নি, সে কথা আল্লাহ তায়ালাই জানেন । এসব বিষয় জানার মধ্যে আমাদের জন্য কোনো কল্যাণও নিহিত নেই৷ কেননা এটা আমাদের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যেরও আওতাভুক্ত নয়। কাজেই আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে অদৃশ্য বিষয়সমূহের মধ্য থেকে যেটুকু জানবার সুযোগ দিয়েছেন, তার অতিরিক্ত কোনো কিছু জানতে চেষ্টা করা আমাদের জন্য অনাবশ্যক। মানুষের মনে শুধু এতটুকু সাবধানবাণী দিয়ে দেয়াকেই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে যে, তাকে যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা দেয়া হয়নি এবং তাকে বিনা জবাবদিহীতে ছেড়ে দেয়া হবে না। বরঞ্চ তার ওপর সম্মানিত লেখকদের প্রহরী নিয়োজিত করা হয়েছে, যারা তাদের প্রতিটি তৎপরতা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল, যাতে সে জাগ্রত ও সতর্ক হয় এবং শিষ্টাচারী হয়। এটাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য ৷ লক্ষণীয় যে, গোটা সূরার পরিবেশ সম্মান ও মর্যাদার পরিবেশ, প্রহরীদের সাথে ‘সম্মানিত’ বিশেষণটি যুক্ত হয়েছে। এর উদ্দেশা এই যে, মানুষের মনে যেন এই সম্মানিত ফেরেশতাদের সামনে শোভনীয় ও ভদ্রচিত কাজ করার প্রেরণা এবং অশোভন কাজের বিরুদ্ধে লজ্জার অনুভুতি গড়ে ওঠে । বস্তুত এটা মানুষের স্বভাবজাত ব্যাপার যে, সম্মানিত ও মর্যাদাবান মানুষের সামনে কোনো আজে বাজে বা অশোভন কাজ করতে সে লজ্জা অনুভব করে থাকে । মর্যাদাবান মানুষের সামনে যখন তার এ অবস্থা, তখন প্রতিটি মুহূর্তে একদল ‘মর্যাদাবান’ তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতার সামনে থাকার অনুভূতি যার মধ্যে বিদ্যমান, তার কি অবস্থা হতে পারে, এটা সহজেই অনুমেয় । বিশেষত তারা যখন এমন ফেরেশতা, যারা মানুষের পক্ষ থেকে ভালো কাজ ও ভালো কথা ছাড়া আর কিছুই আশা করে না। কোরআন মানুষের হৃদয়ে তার সহজাত প্রজ্ঞা ও উপলব্ধির অতি নিকটবর্তী! এই ধ্যান-ধারণাকে জাগ্রত ও প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে তার হৃদয়ে সর্বোচ্চ মানের প্রেরণা সৃষ্টি করে।
সুরা: আল-ইনফিতার
আয়াত নং :-19
টিকা নং:8,
یَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِّنَفْسٍ شَیْئًا١ؕ وَ الْاَمْرُ یَوْمَئِذٍ لِّلّٰهِ۠
এটি সেই দিন যখন কারোর জন্য কোন কিছু করার সাধ্য কারোর থাকবে না।৮ ফায়সালা সেদিন একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারে থাকবে।
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৮) অর্থাৎ কাউকে সেখানে তার কর্মফল ভোগ করার হাত থেকে নিষ্কৃতি দান করার ক্ষমতা কারোর থাকবে না। কেউ সেখানে এমন প্রভাবশালী বা আল্লাহর প্রিয়ভাজন হবে না যে, আল্লাহর আদালতে তাঁর রায়ের বিরুদ্ধে বেঁকে বসে একথা বলতে পারে, উমুক ব্যক্তি আমার আত্মীয়, প্রিয় বা আমার সাথে সম্পর্কিত, কাজেই দুনিয়ায় সে যত খারাপ কাজ করে থাকুক না কেন তাকে তো মাফ করতেই হবে।
ফী জিলালিল কুরআন:
পাপিষ্ঠ ও পুণ্যবানদের পরিণতি : এরপর বলা হয়েছে হিসাবের পর সৎলোক ও অসৎ লোকদের পরিণতি ও কর্মফল কী হবে । আর বলাই বাহুল্য যে, এই হিসাব নিকাশের ভিত্তি হবে তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের লেখায রেজিষ্টারসমূহ । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পূণ্যবান লোকেরা অবশ্যই প্রাচুর্যের মধ্যে থাকবে আর পাপিষ্ঠরা থাকবে জাহান্নামে । কর্মফল দিবসে তারা তাতে জ্বলবে । আর জাহান্নাম তাদের কাছ থেকে দূরে থাকবে না।’ – এর সুনিশ্চিত পরিণতি এই যে, সংলোকেরা প্রাচুর্যে ভরা বেহেশতে এবং অসৎ লোকেরা জাহান্নামে যাবে। ‘আবরার’ শব্দটি “বার” শব্দের বহুবচন এবং এ শব্দটি সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে পুণ্যের কাজ ও সৎকাজ করতে করতে সেটি তার সার্বক্ষণিক ও চিরস্থায়ী স্বভাব ও অভ্যাসে পরিণত হয়। আর সৎকর্ম বা পুণ্যকর্ম বলতে যে কোনো ভালো কাজকেই বুঝায় । এর সাথে যে বিশেষণ যুক্ত হয়, সেটা এ ভালো কাজের প্রভাবাধীনেই মানবতা ও মহত্ত্বের সাথে সমন্বিত রূপ লাভ করে। এর ঠিক বিপরীত বিশেষণ হলো ‘ফুজ্জার’ তথা পাপিষ্ঠ লোকেরা । এ শব্দটির মর্মমূলে রয়েছে বেয়াদবী এবং গুনাহ ও পাপ কাজের স্পর্ধা ও ধৃষ্টতা । ‘জাহীম’ হচ্ছে পাপ কাজের উপযুক্ত ও সমকক্ষ জায়গা । তারপর পাপিষ্ঠরা যখন সেখানে অবস্থান করবে, তখন তাদের অবস্থা আরো স্পষ্ট হবে। এ কথাই বলা হয়েছে এই আয়াতে-‘কর্মফলের দিন তারা তাতে জ্বলবে ।’ তারপর এ বক্তব্যের ওপর আরো জোর দেয়া হয়েছে এই বলে যে, ‘সেটি তাদের কাছ থেকে অন্তর্হিত হবে না।’ অর্থাৎ শুরুতেও তারা তা থেকে পালিয়ে অব্যাহতি পাবে না, আর একবার সেখানে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্য তারা বাইরে যেতে পারবে না। এভাবে পুণ্যবান ও পাপিষ্ঠ আর বেহেশত ও দোযখের ঠিক বিপরীত অবস্থা ফুটিয়ে তোলা হলো। সেই সাথে জাহান্নামে নিক্ষিপ্তদের অবস্থা আরো বেশী করে স্পষ্ট করে দেয়া হলো । যেহেতু কর্মফলের দিনটিই অস্বীকৃতি ও অবিশ্বাসের শিকার, তাই সেটি একবার উল্লেখ করার পর তার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে! এই পুনরাবৃত্তি এমনভাবে করা হয়েছে যে, একদিকে ওই দিনটি সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে তাকে আরো বিরাট ও ভয়াবহ জিনিস হিসাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অপরদিকে সেদিন মানুষ যে একেবারেই অসহায়, দিশেহারা এবং সর্বপ্রকারের সাহায্য ও সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে একথা ব্যক্ত করার মাধ্যমে দিনটির ভয়াবহতা স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে এ কথাও বলা হয়েছে যে, সেই ভয়ংকর বিপদের দিনে একমাত্র আল্লাহই
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও গুরুত্ব:
الانفطار শব্দটি فطر মূল অক্ষর থেকে গঠিত। অর্থ : বিদীর্ণ হওয়া, ফেটে যাওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া। কিয়ামতের পূর্বে আকাশ ফেটে যাবে, তারকারাজি বিক্ষিপ্ত হবে ও সূরায় বর্ণিত অন্যান্য আলামত প্রকাশ পাবে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الانفطار শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মুআয বিন জাবাল (রাঃ) ইশার সালাতের ইমামতি করেন এবং তাতে তিনি লম্বা কিরাত পাঠ করেন। (তখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো) নাবী (সাঃ) তাকে বললেন : হে মুআয তুমি কি ফিতনা সৃষ্টি করতে চাও?
(سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَي)
বা সূরা আলা, وَالضُّحَي সূরা যুহা এবং
(إِذَا السَّمَا۬ءُ انْفَطَرَتْ)
বা সূরা ইনফিতার এগুলো তেলাওয়াত করা থেকে কোথায় ছিলে? (সহীহ বুখারী হা. ৬১০৬) এ ছাড়াও পূর্বের সূরাতে অত্র সূরার গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। সূরাতে কিয়ামতের কিছু দৃশ্যপট, মানুষের আমল লেখক ফেরেশতাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কিয়ামতের দিন সৎকর্মশীল ও অসৎকর্মশীল দুদলে বিভক্ত হবে ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
১-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
কিয়ামত শুরুর প্রাক্কালে আকাশের অবস্থা কেমন হবে তার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : انْتَثَرَت অর্থ تساقطت বা তারকারাজি বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়া। فُجِّرَتْ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : একটি অন্যটির মাঝে উদ্বেলিত করবেন। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : লবণাক্ত ও মিষ্টি পানি সব একাকার হয়ে যাবে। ফলে সব সাগর এক সাগরে পরিণত হয়ে যাবে। (ইবনু কাসীর)
بُعْثِرَتْ অর্থাৎ যখন কবর তার মধ্য থেকে মৃত মানুষদের বের করে দেবে, ফলে সবাই হিসাব-নিকাশ ও কর্মের প্রতিদানের জন্য আল্লাহ তা‘আলার সামনে হাজির হবে। শুধু কবরস্থ মানুষই আল্লাহ তা‘আলার সামনে হাজির হবে এমন নয় বরং প্রত্যেক আত্মা তাকে কবরস্থ করা হোক আর নাই হোক সে আল্লাহ তা‘আলার সামনে হাজির হবে। যেহেতু অধিকাংশ মৃত ব্যক্তিদেরকে কবর দেয়া হয় তাই কবরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
(مَّا قَدَّمَتْ وَأَخَّرَتْ)
অর্থাৎ যখন এ উল্লিখিত বিষয়গুলো সংঘটিত হবে, তখন মানুষের কৃত আমল প্রকাশ পেয়ে যাবে। যা কিছু ভাল মন্দ আমল করেছে, তা সামনে উপস্থিত পাবে। “পশ্চাতে ছাড়া আমল” বলতে নিজের চাল চলন এবং ভাল মন্দ কাজের নমুনা যা মানুষ দুনিয়ায় ছেড়ে যায় এবং লোকেরা সেই আদর্শের ওপর আমল করে। যদি ভাল আদর্শ রেখে মারা যায় আর লোকেরা তার অনুসরণ করে তাহলে তার জন্য সওয়াব পাবে আর খারাপ আদর্শ ছেড়ে আসলে পাপের ভাগী হবে।
(مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيْمِ)
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তিরস্কার করে বলছেন: কোন্ বস্তু তোমাদেরকে ধোঁকা ও প্রতারণায় ফেলে রেখেছে। যার কারণে তুমি প্রভুকে অস্বীকার করছো। অথচ তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অস্তিত্ব প্রদান করেছেন, তোমাদের সামনে এ নিদর্শন পাঠ করে শোনানো হচ্ছে।
(فَعَدَلَكَ) অর্থাৎ উত্তম আকৃতি ও উপযুক্ত গঠন দান করেছেন। বুসর বিন জাহহাশ আল কুরাশী (রাঃ) বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর হাতের তালুতে থুথু ফেলে তার ওপর আঙ্গুল রাখলেন এবং বললেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: হে আদম সন্তান! তুমি কি আমাকে অপারগ করতে পারবে? অথচ আমি তোমাকে এই রকম জিনিস হতে সৃষ্টি করেছি। তারপর সুঠাম করেছি এবং উত্তম গঠন ও আকৃতি দান করেছি। অতঃপর পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে চলাফেরা করতে শিখিয়েছি। পরিশেষে তোমার ঠিকানা হবে মাটির গর্ভে। অথচ তুমি বড়ই অহংকার করছো, আমার পথে দান করা থেকে বিরত থেকেছো। তারপর যখন কণ্ঠনালীতে নিঃশ্বাস এসে যায় তখন বলছো; আমি দান খয়রাত করে আসি, এখন দান খয়রাত করার সময় কোথায়? (ইবনু মাযাহ হা. ২৭০৭, সনদ হাসান।)
(فِيْٓ أَيِّ صُوْرَةٍ مَّا شَا۬ءَ رَكَّبَكَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ভ্রুণকে যার মত ইচ্ছা তার রূপ ও আকারে সৃষ্টি করেন। তার চেহারা পিতা-মাতা, মামা অথবা চাচাদের মত করেন। আবার তিনি ইচ্ছা করলে পশুদের আকৃতিতেও সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ যে, তিনি এরূপ করবেন না। উম্মু সুলাইম (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন : মহিলারা যদি স্বপ্নে তা দেখে পুরুষেরা যা দেখে (এবং এতে কি গোসল করতে হবে?) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : মহিলারা যদি ঐরূপ দেখে (অর্থাৎ স্বপ্নদোষ হয়) তাহলে গোসল করতে হবে। উম্মু সুলাইম (রাঃ) বলেন: এতে আমি লজ্জাবোধ করলাম: তিনি বললেন: এরূপ কি হয়? নাবী (সাঃ) বললেন : হ্যাঁ, তা নাহলে বাচ্চা (পিতা-মাতার) সদৃশ কিভাবে হয়? পুরুষের বীর্য মোটা ও সাদা আর মহিলাদের বীর্য পাতলা ও হলুদ বর্ণের। অতএব যার বীর্য প্রাধান্য পাবে তার সাদৃশ্য নিয়ে সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৩৬) আল্লাহ তা‘আলা এত সুন্দর করে মানুষ সৃষ্টি করলেন এবং সবকিছু তার কর্তৃত্বাধীন করে দিলেন তারপরেও কিভাবে মানুষ আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করে, তাঁর দীনকে বর্জন করে?
(كَلَّا بَلْ تُكَذِّبُوْنَ بِالدِّيْنِ)
অর্থাৎ এত সতর্ক, নসিহত ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরেও তোমরা কিভাবে দীনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার ওপর বহাল রয়েছো।
(وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِيْنَ)
অর্থাৎ তোমাদের আমলসমূহ সংরক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন সম্মানিত ফেরেশতা। তারা তোমাদের কথা ও কাজসমূহ জানে এবং লিপিবদ্ধ করে। এতে অন্তরের কাজ ও বাহ্যিক অঙ্গ-প্রতঙ্গের কাজ সবকিছু শামিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: তোমরা সম্মানিত লেখক ফেরেশতাদের সম্মান কর। তাঁরা নাপাক ও পায়খানা যাওয়া অবস্থা ছাড়া কখনও তোমাদের থেকে পৃথক হয় না। অন্য বর্ণনায় গোসলের কথা এসেছে। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ ১/২৬৮)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে আকাশ, তারকা, সাগর ও কবরের কী অবস্থা হবে তা জানতে পারলাম।
২. মানুষ দুনিয়াতে ভাল বা মন্দ কোন কাজের নমুনা রেখে গেলে তার ফলাফল মারা যাওয়ার পরেও পাবে।
৩. মানুষ ভাল-মন্দ যা করছে সবকিছু ফেরেশতা লিখে রাখছেন।
১৩-১৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াতগুলোতে মানুষকে দু’শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যারা সৎ লোক তারা আখিরাতে পরম নেয়ামত তথা জান্নাতে থাকবে আর যারা পাপাচারী তারা জাহান্নামে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَرِيْقٌ فِي الْجَنَّةِ وَفَرِيْقٌ فِي السَّعِيْر)
“(সেদিন) এক দল জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং একদল জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা শূরা ৪২: ৭) এ দু’দলের বিভক্তি তাদের আকীদাহ ও আমলের কারণে হবে। যদিও আল্লাহ তা‘আলা এসব পূর্বেই জানতেন। আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে সবাইকে একই দলভুক্ত করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَوْ شَا۬ءَ اللّٰهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَّاحِدَةً وَّلٰكِنْ لِّيَبْلُوَكُمْ فِيْ مَآ اٰتَاكُمْ)
“আর যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে অবশ্যই তিনি তোমাদের সবাইকে এক সম্প্রদায় করে দিতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যাচাই করতে চান যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার মাধ্যমে।” (সূরা মায়িদাহ ৫: ৪৮)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করার পর সুস্থ বিবেক দিয়ে ভাল-মন্দ দু’টি পথই দেখিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সে ইচ্ছা করলে ভাল কাজ করতে পারবে আবার ইচ্ছা করলে মন্দ কাজও করতে পারবে, তবে সাথে সাথে উভয় কাজের পরিণামও জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং মানুষ তার কাজের জন্য নিজেই দায়ী। যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে বাধ্য করেছেন তথা জাবারিয়া সম্প্রদায়ের দাবীÑযা মিথ্যা ও অবান্তর।
(يَوْمَ الدِّيْنِ) অর্থাৎ কিয়ামত দিবসে। بِغَآئِبِيْنَ অর্থাৎ তারা আযাব থেকে একটু সময়ের জন্যও অন্তর্হিত হতে পারবে না এবং তাদের জন্য আযাব হালকাও করা হবে না। এখানে কর্মফল দিবসকে বারবার উল্লেখ করেছেন কিয়ামতের বিষয়টিকে বড় করে দেখানোর জন্য। অতএব সকলকে পুনরুত্থিত হতে হবে এবং কর্মের হিসাব দিতে হবে।
(يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ)
অর্থাৎ সে কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি কাউকে বিন্দু পরিমাণ উপকার করতে পারবে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে যার জন্য অনুমতি প্রদান করবেন সে ব্যতীত। কিয়ামতের দিন কে কার জন্য সুপারিশ করতে পারবে সে সম্পর্কে সূরা বাক্বারায় আলোচনা করা হয়েছে। তাই নাবী (সাঃ) বানী হাশেমকে লক্ষ্য করে বলেছেন: তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর। আমি আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে তোমাদের রক্ষা করতে সক্ষম হব না। এমনিভাবে তিনি আরো বলেন: হে বনু কা‘ব বিন লুআই! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, হে বনু আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, হে বনু আব্দিল মুত্তালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, হে আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব! আমি আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে তোমার কোনই কাজে আসব না। হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, কেননা আমি তোমাদের কাউকে আল্লাহ তা‘আলার পাকড়াও হতে রক্ষা করতে পারব না। (সহীহ বুখারী হা. ২৭৫৩)
(وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِّـلّٰهِ)
যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(یَوْمَ ھُمْ بٰرِزُوْنَﹰ لَا یَخْفٰی عَلَی اللہِ مِنْھُمْ شَیْءٌﺚ لِمَنِ الْمُلْکُ الْیَوْمَﺚ لِلہِ الْوَاحِدِ الْقَھَّارِ)
“যেদিন তারা (কবর হতে) বের হয়ে পড়বে, সেদিন আল্লাহর নিকট তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। (আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন) আজ কর্তৃত্ব কার? এক পরাক্রমশালী আল্লাহরই।” (সূরা মু’মিন ৪০: ১৬)
সুতরাং যেদিনে পিতা সন্তানের কোন কাজে আসবে না, ভাই ভায়ের কোন কাজে আসবে না, স্বামী স্ত্রীর কোন কাজে আসবে না সেদিনের জন্য আমাদের অবশ্যই পাথেয় সংগ্রহ করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সৎ বান্দারা নেয়ামতপূর্র্র্ণ জান্নাতে থাকবে আর অসৎ বান্দারা জাহান্নামে থাকবে।
২. কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তিকে বিন্দুমাত্র উপকার করতে পারবে না। যেখানে নাবী-রাসূলগণ পারবেন না সেখানে পীর-ওলী-আওলিয়াদের অবস্থান কোথায়?
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত মুআয (রাঃ) ইশার নামাযে ইমামতি করেন এবং তাতে তিনি লম্বা কিরআত করেন। (তখন তার বিরুদ্ধে এটার অভিযোগ করা হলে) নবী (সঃ) তাকে বলেনঃ “হে মুআয (রাঃ)! তুমি তো বড়ই ক্ষতিকর কাজ করেছে? (আরবি) এবং (আরবি)-এই সূরাগুলো কি নেই? এই হাদীসের মূল সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও রয়েছে। হ্যা, তবে (আরবি) এর বর্ণনা শুধু সুনানে নাসাঈতে রয়েছে। আর ঐ হাদীসটি ইতিপূর্বে গত হয়েছে যাতে রয়েছেঃ “য়ে ব্যক্তি কামনা করে যে, কিয়ামতকে সে যেন স্বচক্ষে দেখছে, সে যেন (আরবি) এবং (আরবি)-এই সূরাগুলো পাঠ করে।”
১-১২ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন যে, কিয়ামতের দিন আকাশ ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “ওর সাথে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে।” (৭৩:১৮)
‘আর নক্ষত্ররাজি বিক্ষিপ্তভাবে ঝরে পড়বে। লবণাক্ত ও মিষ্টি পানির সমুদ্র পরস্পর একাকার হয়ে যাবে। পানি শুকিয়ে যাবে, কবরসমূহ ফেটে যাবে। কবর, ফেটে যাওয়ার পর মৃতেরা জীবিত হয়ে উঠবে। তারপর সব মানুষ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব আমল সম্পর্কে অবহিত হবে। এরপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দাদেরকে ধমক দিয়ে বলেনঃ হে মানুষ! কিসে তোমাদেরকে প্রতিপালক হতে প্রতারিত করলো? আল্লাহ তা’আলা যে, এ কথার জবাব চান বা শিক্ষা দিচ্ছেন তা নয়। কেউ কেউ এ কথাও বলেন যে, বরং আল্লাহ্ তা’আলা জবাব দিয়েছেন যে, আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ তাদেরকে গাফিল করে ফেলেছে। এ অর্থ বর্ণনা করা ভুল। সঠিক অর্থ হলো? হে আদম সন্তান! নিজেদের সম্মানিত প্রতিপালকের প্রতি তোমরা এতোটা উদাসীন হয়ে পড়লে কেন? কোন্ জিনিস তোমাদেরকে তাঁর অবাধ্যতায় উদ্বুদ্ধ করেছে? কেনই বা তোমরা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লেগে পড়েছো? এটা তো মোটেই সমীচীন হয়নি। যেমন হাদীস শরীফে এসেছেঃ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ হে আদম-সন্তান! কোন জিনিস তোমাকে আমার সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করেছে? হে আদম সন্তান! তুমি আমার রাসূলদেরকে কি জবাব দিয়েছো?”
হযরত সুফিয়ান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ) একটি লোককে (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করতে শুনে বলেনঃ “অজ্ঞতা।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অর্থাৎ মানুষের অজ্ঞতাই তাকে তার মহান প্রতিপালক সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করেছে। হযরত ইবনে উমার (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন হতেও এরূপই বর্ণিত হয়েছে।
কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, মানুষকে বিভ্রান্তকারী হলো শয়তান। হযরত ফুযায়েল ইবনে আইয়ায (রঃ) বলেন, যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “কিসে বিভ্রান্ত করেছে। তবে অবশ্যই আমি বলবো: তোমার লটকানো পর্দাই তোমাকে বিভ্রান্ত করেছে। আবু বকর আল আররাক (রঃ) বলেনঃ “কিসে তোমাকে তোমায় মহাম প্রতিপালক সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করেছে?” যদি এ প্রশ্ন আমাকে করা হয় তবে অবশ্যই আমি বলবো: অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহই আমাকে বিভ্রান্ত করেছে।
মা’রেফাত অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কারো কারো মতে এখানে (আরবি) শব্দটিই যেন জবাবের ইঙ্গিত বহন করছে। কিন্তু এ উক্তিটি তেমন যুক্তিযুক্ত নয়। বরং এর প্রকৃত তাৎপর্য হলো এই যে, অনুগ্রহশীল আল্লাহর অনুগ্রহের মুকাবিলায় মন্দ কাজ তথা দুস্কৃতি না করাই সমীচীন। কালবী (রঃ) এবং মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি আসওয়াদ ইবনে শুরায়েকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। এই দুবৃত্ত নবী পাক (সঃ)-কে মেরেছিল। তৎক্ষণাৎ তার উপর আল্লাহর আযাব না আসায় সে আনন্দে আটখানা হয়েছিল। তখন এই আয়াত নাযিল হয়।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করেছেন এবং তৎপর সুবিন্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করেছে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তোমাকে সুঠাম করেছেন এবং মধ্যম ধরনের আকার-আকৃতি প্রদান করেছেন ও সুন্দর চেহারা দিয়ে সুদর্শন করেছেন?
হযরত বিশর ইবনে জাহ্হা আল ফারাশী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাতের তালুতে থুথু ফেলেন এবং ওর উপর তার একটি আঙ্গুল রেখে বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ হে আদম সন্তান! তুমি কি আমাকে অপারগ করতে পার? অথচ আমি তোমাকে এই রকম জিনিস হতে সৃষ্টি করেছি, তারপর ঠিকঠাক করেছি, এরপর সঠিক আকার-আকৃতি দিয়েছি। অতঃপর পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে চলাফেরা করতে শিখিয়েছি। পরিশেষে তোমার ঠিকানা হবে মাটির গর্ভে। অথচ তুমি তো বড়ই বড়াই করছো, আমার পথে দান করা হতে বিরত থেকেছে। তারপর যখন কণ্ঠনালীতে নিঃশ্বাস এসে পৌঁছেছে তখন বলেছেঃ এখন আমি সাদকা বা দান-খয়রাত করছি। কিন্তু এখন আর দান-খয়রাত করার সময় কোথায়? (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
এরপর ঘোষিত হচ্ছেঃ যেই আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন। অর্থাৎ পিতা, মাতা, মামা, চাচার চেহারার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করে গঠন করেছেন। আলী ইবনে রাবাহ (রাঃ) তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর দাদাকে নবী (সঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার ঘরে কি সন্তান জন্মগ্রহণ করবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “ছেলে হবে অথবা মেয়ে হবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ “কার সাথে সাদৃশ্যযুক্ত হবে। তিনি জবাবে বললেনঃ ! হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার সাথে অথবা তার মায়ের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত হবে।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাকে বললেনঃ “থামো, এরূপ কথা বলো না। বীর্য যখন জরায়ুতে অবস্থান করে তখন হযরত আদম (আঃ) পর্যন্ত নাসাব বা বংশ ওর সামনে থাকে। তুমি কি আল্লাহ্ তা’আলার কিতাবের (আরবি)-এই আয়াতটি পড়নি? অর্থাৎ “যেই আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ), ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) এবং ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা যদি সহীহ হতো তবে এটা আয়াতের অর্থ প্রকাশের জন্যে যথেষ্ট হতো কিন্তু এ হাদীসের সনদ সঠিক প্রমাণিত নয়। কেননা, মুতহির ইবনে হায়সাম (রঃ) বলেন যে, এতে আবু সাঈদ ইবনে ইউনুস নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন যার হাদীস পরিত্যক্ত। তাছাড়া তার ব্যাপারে আরো অভিযোগ রয়েছে)
সহীহ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক বলেনঃ “হে আল্লাহ্র রাসূল (সঃ)! আমার স্ত্রী একটি কালো বর্ণের সন্তান প্রসব করেছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “তোমার উট আছে কি?” লোকটি উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, আছে।” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “উটগুলো কি রঙ এর?” লোকটি জবাব দিলেনঃ “লাল রঙ-এর।” তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ “উটগুলোর মধ্যে সাদা-কালো রঙ বিশিষ্ট কোন উট আছে কি?” লোকটি উত্তর দিলেনঃ “হ্যা, আছে।” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “লাল রঙ বিশিষ্ট নর-মাদী উটের মধ্যে এই রঙ-এর উট কিভাবে জন্ম নিলো?” লোকটি বললেনঃ “সম্ভবতঃ উর্ধ্বতন বংশধারায় কোন শিরা সে টেনে নিয়েছে।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) লোকটিকে বললেনঃ “তোমার সন্তানের কালো রঙ হওয়ার পিছনেও এ ধরনের কোন কারণ থেকে থাকবে।” হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, তিনি ইচ্ছা করলে বানরের বা শূকরের আকৃতিতেও সৃষ্টি করতে পারেন। আবু সালেহ্ (রঃ) বলেন যে, তিনি (আল্লাহ্) ইচ্ছা করলে কুকুরের আকৃতিতেও সৃষ্টি করতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে গাধা বা শূকরের আকৃতি দিয়ে গঠন করতে পারেন।
কাতাদাহ্ (রঃ) বলেনঃ এ সবই সত্য যে, আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা সব কিছুরই উপর সক্ষম। কিন্তু আমাদের সেই মালিক আমাদেরকে উন্নত, উৎকৃষ্ট, হৃদয়গ্রাহী এবং সুন্দর আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ মহান ও অনুগ্রহশীল আল্লাহ্র অবাধ্যতায় তোমাদেরকে কিয়ামতের প্রতি অবিশ্বাসই শুধু উদ্বুদ্ধ করেছে। কিয়ামত যে অবশ্যই সংঘটিত হবে এটা তোমাদের মন কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। এ কারণেই তোমরা এ রকম বেপরোয়া মনোভাব ও ঔদাসীন্য প্রদর্শন করেছে। তোমাদের এই বিশ্বাস রাখা অবশ্যই উচিত যে, তোমাদের উপর সম্মানিত, সংরক্ষণকারী লিপিকর ফেরেশতাবৃন্দ নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে তোমাদের সচেতন হওয়া দরকার। তারা তোমাদের আমলসমূহ লিপিবদ্ধ করছেন ও সংরক্ষণ করছেন। পাপ, অন্যায় বা মন্দ কাজ করার ব্যাপারে তোমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা সম্মানিত লিপিকর ফেরেশতাদের সম্মান করো। তাঁরা নাপাক অবস্থা এবং পায়খানায় যাওয়ার অবস্থা ছাড়া কখনোই তোমাদের থেকে পৃথক হন না। গোসলের সময়েও তোমরা পর্দা করবে। দেয়াল যদি না থাকে তবে উট দ্বারা হলেও পর্দার ব্যবস্থা করবে। যদি সেটাও সম্ভব না হয় তবে নিজের কোন সাথীকে দাঁড় করিয়ে রাখবে, তাহলে ওটাই পর্দার কাজ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হাফিয আবু বকর আল বাযার (রঃ) এ হাদীসটি হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। এতে শব্দের কিছু হেরফের রয়েছে। এতে একথাও রয়েছেঃ আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদেরকে উলঙ্গ হতে নিষেধ করেছেন। তোমরা আল্লাহর এই ফেরেশতাদের সম্মান করো। এতে এও আছে যে, গোসলের সময়েও এই ফেরেশতারা দূরে চলে যান।
অন্য একটি হাদীসে আছে যে, কিরামান কাতিবীন আল্লাহর সামনে বান্দার দৈনন্দিনের আমল উপস্থাপন করেন। যদি দেখা যায় যে, শুরুতে ও শেষে ইসতিগফার রয়েছে, তবে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমি আমার এ বান্দার (শুরু ও শেষের) মধ্যবর্তী সমস্ত গুণাহ মাফ করে দিলাম।
আরো একটি দুর্বল হাদীসে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা’আলার কোন কোন ফেরেশতা মানুষ এবং তাদের আমলসমূহ জানেন ও চিনেন। কোন বান্দাকে পুণ্য কাজে লিপ্ত দেখলে তারা পরস্পর বলাবলি করেন যে, আজ রাত্রে অমুক ব্যক্তি মুক্তি লাভ করেছে। পক্ষান্তরে কাউকে পাপ কর্মে লিপ্ত দেখলে তারা নিজেদের মধ্যে সেটাও আলোচনা করেন এবং বলেন যে, আজ রাত্রে অমুক ব্যক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
১৩-১৯ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে আল্লাহ তা’আলা তাঁর ঐ বান্দাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন যারা তাঁর অনুগত, বাধ্যগত এবং যারা পাপকর্ম হতে দূরে থাকে। (এ হাদীসটি ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “তাদেরকে আবরার’ বলা হয়েছে এই কারণে যে, তারা পিতামাতার অনুগত ছিল এবং সন্তানদের সাথে ভাল ব্যবহার করতো।”
পাপাচারীরা থাকবে জাহান্নামে। হিসাব-নিকাশ এবং প্রতিদান লাভ করার দিনে তথা কিয়ামতের দিনে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এক ঘন্টা বা মুহুর্তের জন্যেও তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে নিষ্কৃতি দেয়া হবে না। তারা মৃত্যু বরণও করবে না এবং শান্তিও পাবে না। ক্ষণিকের জন্যেও তারা শাস্তি হতে দূরে থাকবে না।
এরপর কিয়ামতের বিভীষিকা প্রকাশের জন্যে দুই দুইবার আল্লাহ পাক বলেনঃ ঐদিন কেমন তা তোমাদেরকে কোন জিনিস জানিয়েছে? তারপর তিনি নিজেই বলেনঃ কেউ কারো কোন উপকার করতে পারবে না এবং শাস্তি হতে নিষ্কৃতি দেয়ার ক্ষমতা রাখবে না। তবে হ্যা, কারো জন্যে সুপারিশের অনুমতি যদি স্বয়ং আল্লাহ কাউকেও প্রদান করেন তবে সেটা আলাদা কথা।
এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। তাহলো এই যে, নবী (সঃ) বলেনঃ “হে বানু হাশিম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা কর। (জেনে রেখো যে,) আমি (কিয়ামতের দিন) তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করার কোনই অধিকার রাখবো না।
সূরা শুআ’রার তাফসীরের শেষাংশে এ হাদীসটি গত হয়েছে। এখানে এ কথাও বলেছেন যে, সেই দিন কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আজ কতৃত্ব কার? এক, পরাক্রমশালী আল্লাহরই।” (৪০:১৬) আর বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যিনি কর্মফল দিবসের মালিক।” আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “সেই দিন প্রকৃত কর্তৃত্ব হবে দয়াময়ের (অর্থাৎ আল্লাহর)” (২৫:২৬)
এসব আয়াতের আসল বক্তব্য হলো এই যে, সেই দিন মালিকানা ও সময় কর্তৃত্ব একমাত্র কাহহার ও রহমানুর রাহীম আল্লাহর হাতে ন্যস্ত থাকবে। অবশ্য এখনো তিনিই সর্বময় ক্ষমতা ও একচ্ছত্র কর্তৃত্বের অধিকারী বটে, কিন্তু সেই দিন বাহ্যিকভাবেও অন্য কেউই কোন হুকুমত ও কর্তৃত্বের অধিকারী থাকবে না। বরং সমস্ত কর্তৃত্ব হবে একমাত্র আল্লাহর।