Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১১৯৭/হে মানুষ:-৮/এবং কফেরর-রা বলে:-৩৯) [#হে মানুষ! তুমি তোমার রবের কাছে পৌছা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে:- #আমলনামা পাবে দু’টি পন্থায়:- #বরং কাফেররা মিথ্যা মনে করে:-] www.motaher21.net সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক পারা:৩০ ১-২৫ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- # তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:- # তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৭/হে মানুষ:-৮/এবং কফেরর-রা বলে:-৩৯)
[#হে মানুষ! তুমি তোমার রবের কাছে পৌছা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে:-
#আমলনামা পাবে দু’টি পন্থায়:-
#বরং কাফেররা মিথ্যা মনে করে:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক
পারা:৩০
১-২৫ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-
# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

# (English)Tafsir-Ibne Kasir :-

# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-

সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১
اِذَا السَّمَآءُ انۡشَقَّتۡ ۙ﴿۱﴾
যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-২
وَ اَذِنَتۡ لِرَبِّہَا وَ حُقَّتۡ ۙ﴿۲﴾
আর তার রবের আদেশ পালন করবে এবং এটাই তার করণীয় ।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-৩
وَ اِذَا الۡاَرۡضُ مُدَّتۡ ۙ﴿۳﴾
আর পৃথিবীকে যখন ছড়িয়ে দেয়া হবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-৪
وَ اَلۡقَتۡ مَا فِیۡہَا وَ تَخَلَّتۡ ۙ﴿۴﴾
এবং পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে এবং খালি হয়ে যাবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-৫
وَ اَذِنَتۡ لِرَبِّہَا وَ حُقَّتۡ ؕ﴿۵﴾
এবং তার রবের আদেশ পালন করবে এটাই তার করণীয় ।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-৬
یٰۤاَیُّہَا الۡاِنۡسَانُ اِنَّکَ کَادِحٌ اِلٰی رَبِّکَ کَدۡحًا فَمُلٰقِیۡہِ ۚ﴿۶﴾
হে মানুষ! তুমি কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো, পরে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-৭
فَاَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَہٗ بِیَمِیۡنِہٖ ۙ﴿۷﴾
অতঃপর যাকে তার ‘আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-৮
فَسَوۡفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیۡرًا ۙ﴿۸﴾
তার হিসাব নেওয়া হবে সহজভাবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-৯
وَّ یَنۡقَلِبُ اِلٰۤی اَہۡلِہٖ مَسۡرُوۡرًا ؕ﴿۹﴾
এবং সে তার স্বজনদের নিকট প্রফুল্লচিত্তে ফিরে যাবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১০
وَ اَمَّا مَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَہٗ وَرَآءَ ظَہۡرِہٖ ﴿ۙ۱۰﴾
আর যার আমলনামা তার পিছন দিক থেকে দেয়া হবে,
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১১
فَسَوۡفَ یَدۡعُوۡا ثُبُوۡرًا ﴿ۙ۱۱﴾
সে অবশ্যই তার ধ্বংস ডাকবে;
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১২
وَّ یَصۡلٰی سَعِیۡرًا ﴿ؕ۱۲﴾
এবং জ্বলন্ত আগুনে গিয়ে পড়বে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১৩
اِنَّہٗ کَانَ فِیۡۤ اَہۡلِہٖ مَسۡرُوۡرًا ﴿ؕ۱۳﴾
কেননা, সে তার স্বজনদের মধ্যে আনন্দে মত্ত ছিল।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১৪
اِنَّہٗ ظَنَّ اَنۡ لَّنۡ یَّحُوۡرَ ﴿ۚۛ۱۴﴾
যেহেতু সে ভাবতো যে, সে কখনই প্রত্যাবর্তিত হবে না।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১৫
بَلٰۤی ۚۛ اِنَّ رَبَّہٗ کَانَ بِہٖ بَصِیۡرًا ﴿ؕ۱۵﴾
اِنَّ رَبَّهٗ كَانَ بِهٖ بَصِیْرًاؕ
না ফিরে সে পারতো কেমন করে? তার রব তার কার্যকলাপ দেখছিলেন।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১৬
فَلَاۤ اُقۡسِمُ بِالشَّفَقِ ﴿ۙ۱۶﴾
আমি শপথ করি অস্তরাগের ,
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১৭
وَ الَّیۡلِ وَ مَا وَسَقَ ﴿ۙ۱۷﴾
এবং রজনীর আর তাতে যা কিছুর সমাবেশ ঘটে তার শপথ।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১৮
وَ الۡقَمَرِ اِذَا اتَّسَقَ ﴿ۙ۱۸﴾
এবং শপথ চাঁদের, যখন তা পূর্ণ হয়;
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-১৯
لَتَرۡکَبُنَّ طَبَقًا عَنۡ طَبَقٍ ﴿ؕ۱۹﴾
তোমাদের অবশ্যি স্তরে স্তরে এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-২০
فَمَا لَہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿ۙ۲۰﴾
তাদের কি হল যে, তারা ঈমান আনে না?
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-২১
وَ اِذَا قُرِئَ عَلَیۡہِمُ الۡقُرۡاٰنُ لَا یَسۡجُدُوۡنَ ﴿ؕٛ۲۱﴾
এবং এদের সামনে কুরআন পড়া হলে এরা সিজদা করে না?
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-২২
بَلِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یُکَذِّبُوۡنَ ﴿۫ۖ۲۲﴾
বরং কাফেররা মিথ্যা মনে করে।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-২৩
وَ اللّٰہُ اَعۡلَمُ بِمَا یُوۡعُوۡنَ ﴿۫ۖ۲۳﴾
অথচ এরা নিজেদের আমলনামায় যা কিছু জমা করছে আল্লাহ‌ তা খুব ভালো করেই জানেন।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-২৪
فَبَشِّرۡہُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ ﴿ۙ۲۴﴾
সুতরাং তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক:-২৫
اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَہُمۡ اَجۡرٌ غَیۡرُ مَمۡنُوۡنٍ ﴿٪۲۵﴾
তবে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৯৭/হে মানুষ:-৮/এবং কফেরর-রা বলে:-৩৯)
[#হে মানুষ! তুমি তোমার রবের কাছে পৌছা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে:-
#আমলনামা পাবে দু’টি পন্থায়:-
#বরং কাফেররা মিথ্যা মনে করে:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৮৪: আল্ – ইনশিক্বাক
পারা:৩০
১-২৫ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফী জিলালিল‌ কুরআন:-
সুরা: আল-ইনশিক্বাক

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৮৪

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : সূরা তাকভির ও সূরা ইনফিতারে এবং তারও পূর্বে সূরা নাবায় যে প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক বিপর্যয়ের বিবরণ দেয়া হয়েছে, এই সূরাও সেই ধরনের কিছু বিপর্যয়ের বিবরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। তবে এখানে এই সূরার বিবরণের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে আল্লাহর সামনে আকাশ ও পৃথিবীর পরিপূর্ণ বিনয়, আনুগত্য ও বশ্যতা সহকারে আত্মসমর্পণ ৷ যেমন বলা হচ্ছে, ‘আকাশ যখন বিদীর্ণ হবে, নিজ প্রতিপালকের প্রতি অনুগত হবে এবং এটিই তার কর্তব্য, আর পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে এবং পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা কিছু আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও সে শূন্যগর্ভা হয়ে যাবে৷ সে তার প্রতিপালকের প্রতি অনুগত হবে এবং এটিই তার করণীয় ।’ উপরোক্ত বিনয় বিধৃত ও গুরুগম্ভীর প্রাথমিক অংশটি ‘মানুষ’কে সম্বোধন করা, তার মনে তার প্রভুর প্রতি বিনয় ও আনুগত্য জাগ্রত করা, প্রতিপালকের নির্দেশ তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং আল্লাহর কাছে তার প্রত্যাবর্তনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে অনুভূতিতে যখন পরম আনুগত্য, বিনয় ও আত্মসমর্পণের প্রেরণা সৃষ্টি করে, তখন তার মনে একই সাথে আল্লাহর কাছে তার অনিবার্য প্রত্যাবর্তনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। অতপর শুরু হয় মানুষকে নিম্নরূপ সম্বোধন, ‘হে মানুষ, তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে পৌছানো পর্যন্ত …… কারণ তার প্রতিপালক তার ওপর সবিশেষে দৃষ্টি রাখেন ।’ (আয়াত-৬-১৫) আর তৃতীয় অংশটিতে এমন কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে, যা মানুষের অবচেতন মনে সংঘটিত হয়ে থাকে। সে সব দৃশ্যের কিছু আভাস-ইংগিত মানুষ পেয়ে থাকে এবং তার এমন কিছু আলামত বা লক্ষণও থাকে যা সুপরিকল্পিত ও অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া নির্দেশ করে। সেই সাথে এমন কিছু শপথবাক্যও উচ্চারিত হয়েছে, যা দ্বারা প্রতিভাত হয় যে, কিছু অদৃশ্য নিয়ন্ত্রিত ও খোদায়ী পরিকল্পনাসিদ্ধ পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে মানুষের বিবর্তন ঘটে । সেইসব পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা বা তা থেকে অব্যাহতি লাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। ‘শপথ করি প্রভাতকালের, শপথ করি রাতের এবং রাত যেসব জিনিসকে আচ্ছন্ন করে তার, আর শপথ করি চাঁদের যখন তা পূর্ণচাঁদে পরিণত হয়, নিশ্চয়ই তোমরা ধাপে ধাপে আরোহণ করবে ।’ (আয়াত-১৬-১৯) এরপর আসছে সূরার শেষাংশ। এতে যারা ঈমান আনে না তাদের ওপর বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী দুই অংশে তাদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে । আর প্রথমাংশে দেখানো হয়েছে তাদের পরিণতি ও বিশ্বনিখিলের পরিসমাপ্তির দৃশ্য । আর এই বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে যে, “তাদের কী হয়েছে যে, ঈমান আনে না এবং তাদের সামনে কোরআন পড়া হলে তারা সেজদা করে না?” সর্বশেষে তাদের সেই সব অনিবার্য আপদ মুসিবতের কথা বলা হয়েছে, যা কেবল আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তাদের অবধারিত পরিণতি সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। যথা, “বরঞ্চ কাফেররা অবিশ্বাস করছে অথচ ……. সংকর্মশীলরা এর ব্যতিক্রম ৷ তাদের জন্যে রয়েছে অফুরন্ত শুভ প্রতিদান ।”(আয়াত-২২-২৫) সূরা আল ইনশিকাক এমন একটি শান্ত ও নিরুত্তাপ সূরা, যার প্রভাব হৃদয়ে খুব সুক্ষভাবে বদ্ধমূল হয়, যার ইংগিত ও নির্দেশনা গুরুগম্ভীর এবং তার এ বৈশিষ্ট্য এমনকি সেই সর্বব্যাপী মহাজাগতিক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দৃশ্যাবলীতেও লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে, যা সূরা আত তাকওয়ীরে একটা উত্তাল পরিবেশে পরিবেশিত হয়েছে। দরদমাখা ও স্নেহময় ভংগিতে মানুষকে তত্ত্বজ্ঞান দান করাই এ সূরার মূল সুর ৷ ধীর পদক্ষেপে পর্যায়ক্রমে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ও গভীর বুদ্ধিমত্তা সহকারে হৃদয়ংগম করানোই এ সূরার বাচনভংগির বৈশিষ্ট্য। আর ‘হে মানুষ’ বলে যে সম্বোধনটি এখানে করা হয়েছে, তাতে স্মরণ করানো ও বিবেককে জাগানোর সুর ধ্বনিত । সূরাটি তার অংশগুলোকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানসিক বিষয় আলোচনা করে এবং এভাবেই তা মানুষের হৃদয়কে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে । সুপরিকল্পিতভাবে সে এই আবর্তন প্রক্রিয়ার বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকে। তা বিশ্বজগতের আত্মসমর্পণের দৃশ্য থেকে শুরু করে মানুষের মনের অনুভূতি হিসাব-নিকাশ ও কর্মফলের দৃশ্য, প্রকৃতির চলমান অবস্থা ও তার বিভিন্ন দিক পর্যন্ত পরিবেষ্টিত । অতপর এক সময় তা মানুষের মানসিক অনুভুতি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ সব কিছুর পর যারা ঈমান আনে না তাদের প্রতি বিশ্বয় প্রকাশ পর্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক আযাবের হুমকি ও শাসানী দান করা হয়েছে এবং মোমেনদেরকে অপরিমেয় প্রতিদান সহকারে আযাব থেকে অব্যাহতি দানের সুসংবাদ দান পর্যন্ত এই আবর্তন চলতে থাকে। এতোসব আবর্তন, দৃশ্যাবলীর পট পরিবর্তন, চেতনার মর্মমূলে সম্বিত তোলা ও সাড়া জাগানোসহ এসব কিছুই এমন একটি ক্ষুদ্র সূরায় চলতে থাকে, যা মাত্র কতিপয় ছত্রেই সমাপ্ত । এটা একমাত্র এই বিস্ময়কর গ্রন্থ ছাড়া আর কোথাও কল্পনা করা যায় না। বস্তুত অনেক বড় ও বিস্তৃত আলোচনায় এতোগুলো কথা, এতোগুলো লক্ষ্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় এবং তাতে এতো বলিষ্ঠতা ও প্রভাব সৃষ্টি হয় না। তবে কোরআনের কথাই আলাদা ৷ এ কেতাব যে কোনো প্রসংগকেই সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় পেশ করে এবং মানুষের মনকে প্রত্যক্ষভাবেও খুবই কাছ থেকে সম্বোধন করে। এটা মহাজ্ঞানী ও সবজান্তা আল্লাহরই বৈশিষ্ট্য ।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-৬

یٰۤاَیُّهَا الْاِنْسَانُ اِنَّكَ كَادِحٌ اِلٰى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلٰقِیْهِۚ

হে মানুষ! তুমি কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো, পরে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

“যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে এবং সে স্বীয় প্রভুর নির্দেশ পালন করবে। বস্তুত এটাই তার করণীয় । আর যখন পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হবে এবং তার গর্ভস্থ সব কিছু বের করে দিয়ে সে শূন্যগর্ভা হয়ে যাবে, আর সে স্বীয় প্রভুর অনুগত হবে এবং এটাই তার জন্যে যথোচিত ।” আকাশের বিদীর্ণ হওয়া সংক্রান্ত আলোচনা পরবর্তী সূরায়ও রয়েছে। এখানে যে বিষয়টি নতুন এসেছে, তা হলো স্বীয় মনিবের প্রতি আকাশের অনুগত হওয়া, সেটাই তার কর্তব্য বলে ঘোষিত হওয়া, তার বশ্যতা স্বীকার ও নিজ কর্তব্য পালনের জন্যে তার বিনয়াবনত হওয়া । আকাশের স্বীয় প্রতিপালকের অনুগত হওয়ার অর্থ এখানে আল্লাহর কাছে তার আত্মসমর্পণ এবং তার আদেশক্রমে বিদীর্ণ হয়ে যাওয়া ৷ ‘হুক্কাত’ শব্দের অর্থ হলো, এটাই তার যথার্থ কর্তব্য ও দায়িত্ব । এটাকে নিজের কর্তব্য হিসাবে তার স্বীকৃতি দান তার বিনয় ও আনুগত্যেরই অংশ । কেননা এটা তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ৷ কিয়ামতের কিছু খন্ড চিত্র : ‘পৃথিবীকে প্রসারিত করার’ ব্যাপারটা একটু অভিনব ও নতুন । এ দ্বারা পৃথিবীর আকৃতির হ্রাসবৃদ্ধিও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। আল্লাহর যে সব ফেরেশতা পৃথিবীকে পরিচালনা ও শাসন করতো এবং তাকে তার বর্তমান ও সর্বশেষ আকৃতিতে সংরক্ষণ করতো, তাদের পরিবর্তনের কারণে এটা ঘটে থাকতে পারে। অনেকে বলে, এর আকৃতি বল বা ডিমের ন্যায় বাক্যটির স্বাভাবিক অভিব্যক্তি থেকে প্রতিভাত হয় যে, পৃথিবীর এই পরিবর্তনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নয়, বরং কোনো মহান শক্তিধরের আদেশের ভিত্তিতে সংঘটিত হবে৷ আর এ কারণেই হয়তো এটি কর্মকারক ‘মাজহুল’ ক্রিয়াপদ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে, ‘মুদ্দাত’ অর্থাৎ যা প্রসারিত হবে! ‘এবং সে নিজের ভেতরে যা কিছু আছে নিক্ষেপ করবে …..’ এ বাক্য দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যেন পৃথিবীটা একটা জীবন্ত প্রাণী, যা নিজের ভেতরকার সবকিছু ছুঁড়ে ফেলতে ও খালি হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর ভেতরে অনেক কিছুই থাকে। আল্লাহর অগণিত সৃষ্টি সেখানে রয়েছে, যা কতো প্রজন্ম ভূপৃষ্ঠের স্তরে স্তরে জমা রয়েছে এবং ছিলো, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। ভূগর্ভে সঞ্চিত বহু রকমের ধাতু পানি ও অজানা সৃষ্টি রয়েছে, যার হদিস স্বয়ং স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ জানে না। জীব ও জড় নির্বিশেষে এসব জিনিসকে পৃথিবী হাজার হাজার বছর ধরে ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আপন উদরে ধারণ করে রেখেছে । অবশেষে সেই দিনটি সমাগত হলে এগুলোকে সে ছুঁড়ে ফেলবে । ‘সে নিজের মনিবের অনুগত হয়েছে …’ অর্থাৎ আকাশের ন্যায় পৃথিবীও আপন প্রতিপালকের আনুগত্য মেনে নিয়েছে এবং সেটা তার কর্তব্যও বটে । সে তার আদেশ শিরো ধার্য করে সবিনয়ে কার্যকরীও করেছে এবং স্বীকারও করেছে যে, এটা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সে আল্লাহর অনুগত ৷ এ আয়াতগুলোর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, যেন আকাশ ও পৃথিবী কোনো জীবন্ত প্রাণী, যারা আদেশ শোনে, তাৎক্ষণিকভাবে তা বাস্তবায়নও করে। যদিও এ দৃশ্যটি কেয়ামতের দিনের সর্বগ্রাসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দৃশ্যেরই অন্তর্ভুক্ত, তথাপি এ সূরায় তা অত্যন্ত শান্ত, স্থির, অচঞ্চল ও গুরুগম্ভীর। আর এ ব্যাপারে যে অনুভূতি জন্যে, তাহলো এই যে, আকাশ ও পৃথিবী উভয়ে যে আনুগত্য প্রকাশ করবে, তা হবে একেবারেই শর্তহীন, অত্যন্ত বিনয়াবনত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত । কোনোরূপ দ্বিধা, সংকোচ বা অবাধ্যতার লেশমাত্র পরিদৃষ্ট হবে না। এহেন বিনয়াবনত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত আনুগত্যের পরিবেশে উর্ধজগত থেকে যখন মানুষকে সম্বোধন করা হলো যে, ‘হে মানুষ তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছো আর অচিরেই তুমি তার সাক্ষাৎ পাবে।’ তখনও আকাশ ও পৃথিবী আপন প্রতিপালকের কাছে মাথা নুইয়ে রয়েছে। ‘হে মানুষ…’ যাকে তার প্রভু পরম অনুগ্রহ ও মহানুভবতা সহকারে সৃষ্টি করেছেন, তাকে মানুষ বানিয়ে সম্মানিত করেছেন, সমগ্র বিশ্বে শুধু এই মানুষেরই এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার কারণে তার আপন স্রষ্টাকে সবচেয়ে ভালো জানার কথা, আকাশ ও পৃথিবীর চেয়েও তার আদেশে তারই বেশী অনুগত থাকার কথা । কেননা তিনি তাকে ভালোমন্দ যাচাইয়ের যোগ্যতা ও তার যে কোনো একটি গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন আল্লাহর সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ার যোগ্যতা দিয়েছেন। এক কথায় জীবজগতের ভেতরে তাকেই একমাত্র পূর্ণাংগ সৃষ্টিতে পরিণত করেছেন। আর এই পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক, সুদূর প্রসারী ও এর উচ্চতা গগনচুম্বী ৷ ‘হে মানুষ, পরিশ্রম করে পরিক্রম করে তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছো, অতপর অচিরেই তুমি তার সাক্ষাৎ পাবে ।’ অর্থাৎ হে মানুষ তুমি পৃথিবীতে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজের আয়ুষ্কাল কাটিয়ে দিচ্ছ। তুমিই তোমার জীবন যাপনের পথ তৈরী করে নিচ্ছ, যাতে করে শেষ পর্যন্ত তুমি তার কাছে পৌছতে পারো । বস্তুত যাবতীয় চেষ্টা সাধনা কেবল তাঁর কাছে পৌঁছার লক্ষ্যেই চালাতে হবে। হে মানুষ! তুমি নিজের জীবিকা উপার্জনের ব্যাপারে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য । এই পৃথিবীতে পরিশ্রম ছাড়া জীবিকা উপার্জন করা সম্ভব নয়। দৈহিক না হোক মানসিক বা চিস্তাগত বা চেতনাগত বা আদর্শগত শ্রম এখানে দিতেই হবে। এই শ্রমে যে লাভবান ও সফল হবে এবং যে বঞ্চিত হবে তারা উভয়ে সমান। পার্থক্য শুধু শ্রমের গুণগত মানে । মূল শ্রমের বিষয়টি মানব জীবনে চিরদিনই আছে ও থাকবে । সবশেষে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রেও সবাই সমান । হে মানুষ! তুমি পৃথিবীতে কখনো বিশ্রাম ও অবসর পাবে না। বিশ্রামের স্থান তো এটা নয় আখেরাত । আল্লাহর আনুগত্য ও তার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যদি কেউ সেখানে অগ্রিম কিছু নেক আমল পাঠিয়ে দেয়, তবে সে সেখানে গিয়ে বিশ্রাম ও শান্তি লাভ করবে । পৃথিবীর জীবনে শ্রম ও চেষ্টা-সাধনা একই ৷ তবে তার গুণ ও স্বাদ বিভিন্ন এবং আল্লাহর কাছে পৌছার পর তার ফলাফল বিভিন্ন রকমের হবে। কেউ কেউ সেখানে এমন জীবন লাভ করবে, যাতে শ্রম থাকবে, তবে পাহিবি শ্রমের চেয়ে কম । আবার কেউ এমন সুখ লাভ করবে যে, তার সমস্ত শ্রমের কষ্ট ও গ্লানি ধুয়ে মুছে দেবে এবং তার মনে হবে যেন কোনোদিন সে কোনো কষ্টই পায়নি । হে মানুষ! যাকে ‘মানবীয়’ গুণ বৈশিষ্ট্য দিয়ে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করা হয়েছে তোমাকে আল্লাহ তায়ালা যে বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তার সাথে সামঞ্জস্যশীল নীতি অবলম্বন করো! আল্লাহর সাথে যখন তোমার সাক্ষাত হবে, তখন যাতে তোমার শ্রান্তি ও ক্লান্তি নিরেট সুখ শান্তিতে রূপান্তরিত হয়, সেই পথ অবলম্বন করো ।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-১৫

بَلٰۤى١ۛۚ اِنَّ رَبَّهٗ كَانَ بِهٖ بَصِیْرًاؕ

না ফিরে সে পারতো কেমন করে? তার রব তার কার্যকলাপ দেখছিলেন।

ফী জিলালিল কুরআন:

আমলনামা দেয়ার দু’টি পন্থা : উপরোক্ত সম্বোধনে এই বক্তব্য সুপ্ত রয়েছে, তাই চেষ্টা সাধনাকারীরা যখন তাদের পথের শেষ প্রান্তে পৌছবে, তখন তারা তার যথাযথ প্রতিদান লাভ করবে এবং শ্রম ও সাধনার পর প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে, তাই প্রত্যেকেরই উচিৎ এমন কাজ করা যাতে তার মালিক তার আমলনামা দেখে খুশি হন, তাইতো বলা হয়েছে- ‘যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব একান্ত সহজভাবেই গ্রহণ করা হবে । পক্ষান্তরে যে ব্যক্তিকে তার আমলনামা পেছন দিক থেকে দেয়া হবে।’ যাকে আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে সৌভাগ্যশালী এবং তার ওপর আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট। সে ব্যক্তি হচ্ছে ঈমান আনয়নকারী ও সংকর্মশীল ৷ আল্লাহ তায়ালা তার ওপর খুশী এবং তার জন্যে মুক্তির সিদ্ধান্ত লিখে দিয়েছেন তার হিসাব নিকাশ হাল্কা ও সহজ হবে, খুঁটিনাটির হিসাব নেয়া হবে না এবং তার কাছ থেকে কড়া হিসাব নেয়া হবে না । বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, যার পুংখানুপুংখ হিসাব নেয়া হবে সে আযাবে ভুগবে। আমি বললাম, আল্লাহ তায়ালা কি এ কথা বলেননি যে, তার হিসাব সহজ করা হবে? রসূলুল্লাহ (স.) বললেন, ওটা কোনো হিসাব নয়। ওটা কেবল উপস্থাপন করা । কেয়ামতের দিন যার হিসাব নিরীক্ষণ করা হবে, সে আযাব এড়াতে পারবে না।’ (বোখারী, মুসলিম, তিরমিমী, নাসায়ী) হযরত আয়েশা (রা.) থেকে আরো বর্ণীত আছে যে, রসূল (স.)-কে কোনো কোনো নামাযে বলতে শুনেছি যে, ‘হে আল্লাহ তায়ালা, আমার কাছ থেকে সহজ হিসাব নিও ।’ নামায শেষে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! সহজ হিসাব বলতে কী বুঝায়? রসূল (স.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা কারো আমলনামার ওপর কেবল একটু নযর বুলালেন, তারপর ভুলত্রুটি উপেক্ষা করলেন- এটাই সহজ হিসাব । ওহে আয়েশা! যার হিসাব কড়াকড়িভাবে নেয়া হবে, তার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ (আহমদ) এই হলো ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্তদের সহজ হিসাব ৷ এরপর সে মুক্তি পাবে এবং ‘আপন পরিজনের কাছে আনন্দিত চিত্তে ফিরে যাবে ।’ অর্থাৎ তার যেসব আপনজন মুক্তি পেয়ে আগেই বেহেশতে প্রবেশ করেছে তাদের কাছে ফিরে যাবে। এ বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, ঈমান ও সংকর্মশীলতার দিক দিয়ে যারা একই গোষ্ঠীভুক্ত, তারা বেহেশতে মিলিত হবে। আত্মীয় স্বজন ও প্রিয়জনদের ব্যাপারটাও তদ্রুপ ৷ এখানে যে দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়েছে, তা হলো, হিসাব নিকাশের পর মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি এমন প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হবে, যারা কড়া হিসাবের সমস্যা সংকুল স্তর পার হয়ে জান্নাতে যাবে। এ সময় সে কি আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করবে, তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত এই ব্যক্তির অবস্থা সেই ব্যক্তির অবস্থার ঠিক বিপরীত হবে, যাকে তার কুকর্মের জন্যে গ্রেফতার ও শাস্তি দিয়ে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হবে। তাকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার আমলনামা দেয়া হবে। ‘যাকে পেছন দিক থেকে আমলনামা দেয়া হবে, সে মৃত্যুকে ডাকবে এবং (ডাকতে ডাকতে) গিয়ে জলন্ত আগুনে পড়বে ।’ এ আয়াতটিতে সে কথাই বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আমরা সচরাচর দুটো পরিভাষার ব্যবহার দেখতে পাই, ডান হাতের আমলনামা ও বাম হাতের আমলনামা । কিন্তু এ আয়াতে একটা নতুন জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে, পেছন দিক থেকে প্রাপ্ত আমলনামা । সম্ভবত বাম হাতের আমলনামাটিই এভাবে কাউকে পেছন দিক থেকে দেয়া হবে৷ কেননা সে লজ্জায় আমলনামার মুখোমুখি হতে চাইবে না এবং তা নিতেও চাইবে না কিন্তু তাকে জোরপূর্বক তা পেছন দিক থেকে দেয়া হবে! আমরা অবশ্য জানিনা এই আমলনামাটি কি রকম আর কিভাবেই বা তা ডান হাত দিয়ে, বাম হাত দিয়ে বা পেছন দিক দিয়ে দেয়া হবে। তবে সোজা কথায় বুঝি যে, ডান হাত দিয়ে আমলনামা দেয়ার অর্থ মুক্তি আর বাম হাত দিয়ে আমলনামা দেয়ার অর্থ ধ্বংস ও বিনাশ ৷ এই দুটো তত্ত্বই বুঝে নেয়া ও বিশ্বাস করা আমাদের দায়িত্ব ৷ এছাড়া আর যে সব কথা বলা হয়েছে, তা শুধু আমাদের মনে কেয়ামতের ময়দানের দৃশ্য জাগরূক করা এবং চেতনায় তার সুদৃঢ় ছাপ অংকিত করার লক্ষ্যেই বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কি ঘটবে এবং কিভাবে ঘটবে, সেটা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন । বস্তুত যে ব্যক্তি পৃথিবীতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আয়ুষ্কাল কাটিয়ে দিয়েছে, কিছু গুনাহ ও নাফরমানীর মধ্যে দিন কাটিয়েছে, সেই দুকুলহারা দেউলে ব্যক্তি নিজের পরিণতি কি হবে তা জানে। সে জানে যে, তার সকল শ্রম-সাধনা বৃথা গেছে এবং তার কষ্টের কোনো বিরতি ও শেষ সীমা নেই। তাই সে মৃত্যুকে ডাকবে। সে নিজের ধ্বংস কামনা করবে, যাতে তাকে তার অবধারিত দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হতে না হয়। আর মানুষ যখন মুক্তি লাভের জন্যে নিজের ধ্বংস ও মৃত্যু কামনা করে, তখন সে এমন একটা স্তরে উপনীত হয়, যেখানে তার আর কোনো কিছু থেকে সংযম অবলম্বন করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তাই নিজের ধ্বংসই হয়ে দাড়ায় তার চূড়ান্ত বাসনা। কবি মুতানাব্বী তার একটি কবিতায় এ কথাটাই বলেছেন- ‘মৃত্যুকে যখন তুমি নিরাময়কারী হিসাবে বিবেচনা করো, তখন ব্যাধি হিসাবে সেটাই তোমার জন্যে যথেষ্ট। আর মৃত্যু যখন মানুষের কাম্য হয়ে দাড়ায়, তখন মৃত্যুই তার জন্যে যথেষ্ট’ বস্তুত এটা এমন দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয় যে, এর চেয়ে বড় আর কোনো দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয় নেই । ‘সে আগুনে প্রবেশ করবে।’ এটাই তার অবধারিত পরিণতি ৷ এটা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যেই সে মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু সে আশা সুদূর পরাহত ৷ এই বিপর্যয়কর ও মর্মান্তিক দৃশ্যের বর্ণনা দেয়ার পরই এই দুর্ভাগা ব্যক্তির অতীতের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সেই অতীতই তাকে এই মর্মসুদ ও শোচনীয় পরিণতির সম্মুখীন করেছে। ‘সে তার পরিবার পরিজনদের মধ্যে আনন্দে মেতে থাকতো, সে ভাবতো যে তাকে আর কখনো ফিরে যেতে হবে না ।” সেটি ছিলো দুনিয়ার ব্যাপার । সত্যিই তার অবস্থা সেই রকম ছিলো। কিন্তু এখন আমরা এই কোরআনের বর্ণনা অনুসারে হিসাব-নিকাশ ও কর্মফল দিবসের মধ্যে আছি। দুনিয়ার জীবনকে আমরা স্থান ও কাল উভয়ের বিচারে অনেক দূরে ফেলে এসেছি। ‘সে তার পরিবার পরিজনদের মধ্যে আনন্দে মেতে থাকতো ।’ অর্থাৎ বর্তমান মুহূর্তটি বাদে আর সব কিছু সম্পর্কে উদাসীন থাকতো । আখেরাতে তার জন্যে কি পরিণতি অপেক্ষা করছে তা নিয়ে সে ভাবতো না। আর তাই সে জন্যে কোনো জবাবদিহীরও প্রয়োজন অনুভব করতো না। আর তার জন্যে সে কোনো প্রস্তুতিও নিতো না। সে ভাবতো যে, সে কখনো আপন স্রষ্টা ও প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে না। শেষ মুহূর্তেও সে যদি চিন্তা করতো, তাহলে জবাবদিহীর জন্যে কিছুটা হলেও প্রস্তুতি নিতো । ‘হাঁ, তার প্রভু তার প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন ।’ অর্থাৎ সে যদিও ভেবেছিলো যে, তার প্রতিপালকের কাছে তার ফিরে যেতে হবে না, কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তার মনিব তার ব্যাপারে ওয়াকেফহাল ছিলেন এবং তার চালচলন সবকিছুই পর্যবেক্ষন করছিলেন ৷ তিনি জানতেন যে, তাকে তার কাছে ফিরে আসতে হবেই এবং তাকে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেয়া হবেই । আর এই হতভাগা যখন পার্থিব জীবনে আপন পরিবার পরিজনের মধ্যে আনন্দে গা ভাসিয়ে চলে, তখন তার ঠিক সেই সৌভাগ্যশালী বেহেশতবাসীর বিপরীত অবস্থা হয়ে থাকে, যে আখেরাতের দীর্ঘস্থায়ী জীবনে আপন পরিবারের কাছে আনন্দ চিত্তে ফিরে যায়। লক্ষণীয় যে, প্রথমোক্ত ব্যক্তির পার্থিব জীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী, তেমনি তা কঠোর পরিশ্রমে পরিপূর্ণ-তা যে ধরনের পরিশ্রমই হোক না কেন। পক্ষান্তরে শেষোক্ত ব্যক্তির পরকালীন জীবন অনন্তকালব্যাপী স্থায়ী, সর্বাত্মক ও অবাধ স্বাধীনতায় অলংকৃত, চিত্তাকর্ষক ও মনোরম, নির্মল সুখ-শাস্তিতে পরিপূর্ণ এবং সর্বপ্রকারের শ্রম ও ক্লেশ থেকে মুক্ত ।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-১৮

وَ الْقَمَرِ اِذَا اتَّسَقَۙ

আর চাঁদের, যখন তা পূর্ণরূপ লাভ করে।

ফী জিলালিল কুরআন:

  বিস্ময়কর কিছু শপথের ব্যাখ্যা : সুগভীর প্রভাব বিস্তারকারী দৃশ্যাবলীতে পরিপূর্ণ এই পরকালীন জগত সংক্রান্ত আলোচনার পর পার্থিব জীবনের কয়েকটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এই মুহূর্তগুলো যে ধরনের খোদায়ী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার স্বাক্ষর বহন করে মানুষ সে সম্পর্কে ওয়াকেফহাল নয়। মানুষ নিজেও এই খোদায়ী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার আওতাধীন ৷ এই আয়াত কয়টিতে মানুষ পর্যায়ত্রমে যে বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয়, তার বিবরণ দেয়া হয়েছে, ‘সান্ধকালীন রক্তিম আভার শপথ রাত ও রাত্রিকালীন সকল জিনিসের শপথ ।’ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত আবর্তনশীল এইসব মুহূর্ত নিয়ে শপথ করা হয়েছে এগুলোর দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে এবং এই মুহূর্তগুলোর তাৎপর্য ও শিক্ষার প্রতি বিশেষ ইংগিত দেয়ার জন্যে । মুহুর্তগুলো নিস্তব্ধতা, বিনয় ও গুরুগম্ভীর মাহাত্মের মিলিত বৈশিষ্টে পরিপূর্ণ । সূরার প্রথম দিকে সাধারণভাবে যে ধরনের দৃশ্যাবলী ও ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয়েছে, এখানেও অনেকটা তাই পরিলক্ষিত হয়। ‘শাফাক’ সূর্যাস্তের পর মনে এক ধরনের নিশব্দ ও গভীর আতংকের ভাব দেখা দেয়। মানব হৃদয়ে বিদায়ের অনুভুতি জাগে । একটা নীরব বেদনাবোধ ও গভীর হতাশায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। এর পাশাপাশি আসন রাতের ভীতি ও চারদিকে ছড়িয়ে পড়া ঘন অন্ধকারজনিত শংকা মানুষকে উদ্বেগাকুল করে তোলে ৷ এভাবে অজানা ভীতি, অসহায়ত্ববোধ ও নিস্তব্ধতার মিলিত অনুভূতি মানুষকে আনমনা করে তোলে । ‘রাত ও রাতের মধ্যে নিহিত যাবতীয় জিনিসের শপথ ।’‌ অর্থাৎ রাত্রিকালে যা কিছু ঘটে, যা কিছু সঞ্চিত ও পুঞ্জীভূত হয়। এখানে এই ‘যা কিছু’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ । এর সীমা-সংখ্যা বা রকমফের অজানা ৷ এতে এক ধরনের শংকাবোধও বিদ্যমান ৷ রাত্রিকালে অনেক কিছুই পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে। নীরব নিস্তব্ধতার মাঝে কল্পনার জগতে ডানা মেলে অনেক দূর চলে যাওয়া যায়। রাতের আঁধারে পুঞ্জীভূত অনেক জিনিস, অনেক প্রাণী, অনেক ঘটনা এবং অনেক আবেগ-অনুভূতির সন্ধান পাওয়া মায় । এ সময় অনেক গোপন ও প্রকাশ্য জগতের, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান অনেক জিনিসের এবং হৃদয়ের গভীরে লুকানো অনেক ধ্যান ধারণার সন্ধান মেলে । চিন্তা কল্পনা দ্বারা এভাবে অনেক কিছু খুঁজে পাওয়া গেলেও পবিত্র কোরআনের এই ক্ষুদ্র বাক্যটিতে যে ব্যাপক ও বিপুলায়তন জগতের ধারণা পাওয়া যায়, তাতে তার ধারে কাছেও পৌছা সম্ভব হয় না। বাক্যটি হলো ‘রাত ও রাতের ভেতরে যা কিছু নিহিত তার শপথ ।’ এই সুগভীর ও বিস্ময়কর বাক্যটির মধ্যে যে ভীতি ও শংকা এবং যে অসহায়ত্ব ও নিস্তব্ধতা ফুটে উঠেছে, একমাত্র তাই-ই নৈশকালীন জগতের পূর্ণ ধারণা দিতে সক্ষম । আর নিস্তব্ধতা ও শংকাবোধ সান্ধকালীন রক্তিম আভার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল । ‘চাঁদের শপথ যখন তা পুর্ণাঙ্গ হয়।’ এখানেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটা শান্ত স্নিগ্ধ চমকপ্রদ ও মায়াবী দৃশ্য । সে দৃশ্যটি হলো শুক্র পক্ষের রাতগুলোর ক্রমবিকাশমান চাঁদ ৷ এ সময় সে পৃথিবীতে বিকিরণ করে তার শান্ত স্নিগ্ধ আলো, যা মানুষকে গাম্ভীর্যপূর্ণ নীরবতা এবং বাস্তব জগতে ও সুপ্ত চেতনার জগতে দীর্ঘ ভ্রমণে উদ্দীপিত করে। এটি এমন একটি পরিবেশ, যার সাথে গোপন যোগাযোগ রয়েছে অস্তরাগের, রজনীর এবং রজনীর ভেতরে নিহিত সব কিছুর । মহত্ত্ব ও গাম্ভীর্যে, বিনয়ে এবং নীরবতায় জ্যোৎস্না স্নাত এই পরিবেশ, রাত ও রাতের যাবতীয় বস্তুর সাথে একত্রিত হয়। এই চমকপ্রদ, স্নিগ্ধ সুন্দর, গাম্ভীর্যপূর্ণ, ভীতিপ্রদ ও চেতনা সঞ্চারী প্রাকৃতিক মুহূর্তগুলোকে কোরআন ক্ষিপ্রতার সাথে আত্মগত করে এবং এগুলোর মাধ্যমে মানুষের মনকে আবেদন জানায় । কেননা মানুষের মন এই প্রাকৃতিক আবেদনকে ভুলে যায়। এই মুহূর্তগুলোর নাম নিয়ে কোরআন শপথ করে, যাতে তা তার বিবেক ও আবেগে উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে । যাতে তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য সুষমা, জীবনীশক্তি, প্রভাব ও প্রেরণা উজ্জীবিত হয় এবং যাতে তা গোটা বিশ্বের ওপর কর্তৃত্বশীল হয়, সর্বোপরি তার প্রতিটি তৎপরতার পরিকল্পনাকারী এবং তার প্রতিটি অবস্থা এবং অচেতন ও উদাসীন মানবজাতির সকল অবস্থার পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণকারী মহান সত্ত্বার নিদর্শনগুলোও যাতে দৃষ্টিগ্রাহ্য ও লক্ষণীয় হয়।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-১৯

لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَنْ طَبَقٍؕ

তোমাদের অবশ্যি স্তরে স্তরে এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:

‘তোমরা অবশ্যই দুনিয়ার একটি স্তর অতিক্রম করে মৃত্যুর আর একটি স্তরের দিকে এগিয়ে যাবে।’ অর্থাৎ নানা রকমের অবস্থার পরিবর্তনজনিত কষ্ট তোমাদেরকে ভোগ করতে হবে । আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ও পরিকল্পিত সব রকমের অবস্থা ও ভাগ্য মেনে নিতে হবে। বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ দ্বারা পরিস্থিতির আবর্তন ও বিবর্তনজনিত সুবিধা-অসুবিধা ভোগ করাকে বুঝানো হয়েছে। আরবীতে এ ধরনের পরিভাষার প্রচলন রয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে, উপায়হীন মানুষ খুব কঠিন পরিস্থিতির ওপরও চড়াও হয়।’ অর্থাৎ পরিস্থিতির প্রতিটি চড়াই উৎরাই ও আবর্তন-বিবর্তন যেন এক একটা যানবাহন, যার ওপর মানুষ ক্রমাগত আরোহণ করতে থাকে । আর এসব অবস্থা তাকে অদৃষ্টের ফয়সালা ও নির্দেশ অনুসারে জীবনের রাজপথ ধরে গন্তব্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এভাবে তাকে প্রতিটি স্তরের মোড়ে নিয়ে পৌছে দেয়। এ ধরনের প্রতিটি চড়াই-উৎরাই, প্রতিটি মোড় পরিবর্তন আল্লাহর নির্ধারিত ও পরিকল্পিত ৷ যেমন অস্তরাগ, রাত, চাঁদ প্রভৃতি পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক অবস্থা ও বস্তু আল্লাহর নির্ধারিত বিধি অনুসারে চলতে থাকে এবং মানুষকে তা তার জীবনের শেষ প্রান্তে নিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়। পূর্ববর্তী প্যারায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত এই সূরাটির বিভিন্ন প্যারায় যে সুষমামন্ডিত আবর্তন ও বিবর্তন, এক তত্ত্ব থেকে আর এক তত্ত্বে এবং এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থায় নিশব্দে ও স্থানান্তরের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তা আসলেই কোরআনের নজীরবিহীন বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। উপরোল্লেখিত দৃশ্যাবলী, পরিবর্তনসমূহ ও বিশেষ মুহূর্তগুলোর আলোকেই এক শ্রেণীর লোকের ঈমান না আনার ওপর বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে । কেননা তাদের সামনে, তাদের দেহ ও মনের অভ্যন্তরে ও বিশ্ব-প্রকৃতিতে এতো বিপুল সংখ্যক ঈমানোদ্দীপক নিদর্শনা বিদ্যমান যে, সে সবের উপস্থিতিতে কোনো মানুষের ঈমান না আনার কোনো কারণই থাকতে পারে না।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-২১

وَ اِذَا قُرِئَ عَلَیْهِمُ الْقُرْاٰنُ لَا یَسْجُدُوْنَؕ۩

এবং এদের সামনে কুরআন পড়া হলে এরা সিজদা করে না?

ফী জিলালিল কুরআন:

‘অতএব তাদের কি হলো যে, তারা ঈমান আনে না? তাদের সামনে কোরআন পড়া হলে কেন তারা সেজদা করে না?’ তাই তো! তাদের ঈমান না আনার মতো এমন কী ঘটলো? বস্তুত মানুষের মনে বিশ্ব-প্রকৃতির প্রতিটি মুহূর্তে ও প্রতিটি কোণে এমন ঈমানোদ্দীপক নিদর্শনাবলী বিদ্যমান রয়েছে যা মানুষের মনকে আলোড়িত ও উদ্বুদ্ধ করে । এসব নিদর্শন এতো বিপুল সংখ্যক, এতো গম্ভীর, এতো শক্তিশালী এবং বাস্তবতার দাড়িপাল্লায় এতো ভারী যে, মানুষের মন যদি এগুলোকে উপেক্ষা করতেও চায়, তথাপি তা তাকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে ৷ এ সব নিদর্শন মানুষের হৃদয় ও কানকে ভ্রমাগত আহ্বান জীনাতে ও নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকে। ‘তাদের কী হলো যে তারা ঈমান আনে না? তাদের সামনে কোরআন পড়া হলে কেন তারা সেজদা করে না?’ বস্তুত কোরআন প্রকৃতির ভাষায় মানুষকে আহ্বান জানায়, প্রকৃতিতে ও প্রাণী সত্ত্বায় ঈমানোদ্দীপক যে সব আলামত ও নিদর্শন রয়েছে, সেগুলোকে তার মনমগযের সামনে উন্মুক্ত করে দেয় এবং সেজদার আকারে খোদাভীতি, বিনয়, একাগ্রতা, মহান স্রষ্টার আনুগত্য এই হৃদয়ে জাগ্রত ও উদ্বেলিত করে। এ বিশ্বজগত শুধু যে অপরূপ সৌন্দর্যে মন্ডিত, তা-ই নয়, বরং তা দিকনির্দেশনামূলক সংকেতও দেয়। এতে এমন ঈমানোদ্দীপক জিনিসও রয়েছে, যা মানুষের মনকে এই সুন্দর বিশ্বনিখিল ও তার মহান স্রষ্টার সাথে সম্মিলিত করতে পারে এবং তার হৃদয়ে সৃষ্টির সেই মহাসত্য প্রবিষ্ট করে যা মহান স্রষ্টার সত্ত্বাকে বিরাট বাস্তবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এ জন্যেই এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, ‘তাদের কী হলো যে ঈমান আনে না, আর তাদের সামনে কোরআন পড়া হলে কেন তারা সেজদা করে না?’ বস্তুত এটা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-২৪

فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِیْمٍۙ

কাজেই এদের যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।

ফী জিলালিল কুরআন:

  এখান থেকে কাফেরদের অবস্থা ও তাদের অনিবার্য পরিণতির বিবরণ দেয়া শুরু হয়েছে, ‘বরং কাফেররা মিথ্যা সাব্যস্ত করে অথচ তারা যা আমলনামায় জমা করছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ভালোভাবেই জানেন । অতএব তাদের যন্ত্রণাদায়ক শান্তির সুসংবাদ দাও ।’ অর্থাৎ সব কিছুকে সর্বতোভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ও অস্বীকার করে৷ সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা ও অস্বীকার করাই তাদের স্বভাব, অভ্যাস ও জন্মগত রীতি । অথচ তাদের মনে কী লুকানো আছে তা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন । কোন কোন কুধারণা, কূমতলব ও কুপ্ররোচনার কারণে তারা এভাবে অস্বীকৃতিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, তাও আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন । এখানে তাদের প্রসংগ বাদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রসূলের সাথে কথা বলেছেন, ‘অতএব, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিয়ে দাও ।’ এমন সুসংবাদ তাদের জন্যে রয়েছে, যা শুনে কেউ খুশী হয় । আর কোনো সংবাদদাতার কাছ থেকে তা শুনতে কেউ পথ চেয়েও থাকে না। এখানে ‘সুসংবাদ’ বলে মুলত তাদেরকে ব্যংগ করা হয়েছে উপহাস করা হয়েছে সেসব অপরিনামদর্শী পাপিষ্ঠদের ।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-২৫

اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَهُمْ اَجْرٌ غَیْرُ مَمْنُوْنٍ۠

তবে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার।

ফী জিলালিল কুরআন:

  একই সাথে মোমেনদের জন্যে কি প্রতিদান অপেক্ষা করছে তাও তুলে ধরা হয়েছে। তারা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে না এবং অস্বীকার করে না। তারা যে ঈমানের দাওয়াত লাভ করেন, সৎকর্ম দ্বারা তাকে স্বাগত জানান । আলোচনার ধারায় এটি ‘এসতেমুনা’ বা ব্যতিক্রম বোধক বাক্য হিসাবে এসেছে। অর্থাৎ অবিশ্বাসীদের পরিণতি থেকে এটা আলাদা এবং তার বিপরীত । তবে মোমেন ও সংকর্মশীলদের কথা স্বতন্ত্র, তাদের জন্যে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার । আরবী ভাষায় একে ‘এসতেসনা মুনকাতে’ বলা হয়। অর্থাৎ সংকর্মশীল মোমেনরা প্রথমেও সে ‘কালো সুসংবাদ’ এর আওতাধীন ছিলেন না এবং এখনো নেই । পরে তাদেরকে ব্যতিক্রমী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অবশ্য এ ধরনের বাকরীতিতে যে জিনিসটিকে ব্যতিক্রমী বলে চিহ্নিত করা হয়, তার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সতর্ক করা হয়ে থাকে। ‘অফুরস্ত পুরস্কার’ অর্থ হচ্ছে আখরাতের অন্তহীন ও অনন্তকালব্যাপী পুরস্কার। এই সংক্ষিপ্ত ও চূড়ান্ত বক্তব্য দিয়ে আলোচ্য ক্ষুদ্র সূরাটি সমাপ্ত হলো, যা প্রাকৃতিক জগতে ও মানবীয় বিবেকবুদ্ধিতে সুদূর প্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করে থাকতে পারে।

# তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-

(৮৪-ইনশিক্বাক) : নামকরণ:

প্রথম আয়াতের اِنْشَقَّتْ শব্দটি থেকে এই নামকরণ করা হয়েছে। এর মূলে রয়েছে اِنْشَقَّاق শব্দ। ইনশিকাক মানে ফেটে যাওয়া। অর্থাৎ এ নামকরণের মাধ্যমে একথা বলতে চাওয়া হয়েছে যে, এটি এমন একটি সূরা যাতে আকাশের ফেটে যাওয়ার উল্লেখ আছে।

(৮৪-ইনশিক্বাক) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এটি মক্কা মু’আয্যমার প্রথম যুগে অবতীর্ণ সূরা গুলোর অন্তর্ভুক্ত। এ সূরার মধ্যে যেসব বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে তার আভ্যন্তরীণ বক্তব্য ও প্রমাণপত্র থেকে একথা জানা যায় যে, যখন এ সূরাটি নাযিল হয় তখন জুলুম-নিপীড়নের ধারাবাহিকতা শুরু হয়নি। তবে কুরআনের দাওয়াতকে তখন মক্কায় প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছিল। একদিন কিয়ামত হবে এবং সমস্ত মানুষকে আল্লাহর সামনে হাযির হতে হবে একথা মেনে নিতে লোকেরা অস্বীকার করছিল।

(৮৪-ইনশিক্বাক) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

এ সূরাটির বিষয়বস্তু হচ্ছে কিয়ামত ও আখেরাত। প্রথম পাঁচটি আয়াতে কেবল কিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা করা হয়নি। বরং এ সংগে কিয়ামত যে সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে তার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। তার অবস্থা বর্ণনা করে বলা হয়েছে: সেদিন আকাশ ফেটে যাবে পৃথিবীকে ছড়িয়ে দিয়ে একটি সমতল ময়দানে পরিণত করা হবে। পৃথিবীর পেটে যা কিছু আছে (অর্থাৎ মৃত মানুষের শরীরের অংশসমূহ এবং তাদের কার্যাবলীর বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ) সব বের করে বাইরে ফেলে দেয়া হবে। এমনকি তার মধ্যে আর কিছুই থাকবে না। এর সপক্ষে যুক্তি পেশ করে বলা হয়েছে, আকাশ ও পৃথিবীর জন্য এটিই হবে তাদের রবের হুকুম। আর যেহেতু এ দু’টি আল্লাহর সৃষ্টি, কাজেই তারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে পারবে না। তাদের জন্য তাদের রবের হুকুম তামিল করাটাই সত্য।

এরপর ৬ থেকে ১৯ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষ সচেতন বা অচেতন যে কোনভাবেই হোক না কেন সেই মনযিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে তার নিজেকে তার রবের সামনে পেশ করতে হবে। তখন সমস্ত মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। এক, যাদের আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে। তাদেরকে কোন প্রকার কঠিন হিসেব-নিকেশের সম্মুখীন হওয়া ছাড়াই সহজে মাফ করে দেয়া হবে। দুই, যাদের আমলনামা পিঠের দিকে দেয়া হবে। তারা চাইবে, কোনভাবে যদি তাদের মৃত্যু হতো। কিন্তু মৃত্যুর বদলে তাদেরকে জাহান্নামে ঠেলে দেয়া হবে। তারা দুনিয়ায় এই বিভ্রান্তিতে ডুবে ছিল যে, তাদেরকে কখনো আল্লাহর সামনে হাযির হতে হবে না। এ কারণে তারা এ পরিণতির সম্মুখীন হবে। অথচ তাদের রব তাদের সমস্ত কার্যক্রম দেখছিলেন। এসব কার্যক্রমের ব্যাপারে জবাবদিহি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার তাদের কোন কারণ ছিল না। দুনিয়ার কর্মজীবন থেকে আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের জীবন পর্যন্ত তাদের পর্যায়ক্রমে পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারটি ঠিক তেমনই নিশ্চিত যেমন সূর্য ডুবে যাওয়ার পর পশ্চিম আকাশে লাল আভা দেখা দেয়া, দিনের পরে রাতের আসা, সে সময় মানুষ ও সকল প্রাণীর নিজ নিজ ডেরায় ফিরে আসা এবং একাদশীর একফালি চাঁদের ধীরে ধীরে চতুরদশীর পূর্ণচন্দ্রে পরিণত হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত।

সবশেষে কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির খবর শুনানো হয়েছে। কারণ তারা কুরআনের বাণী শুনে আল্লাহর সামনে নত হওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। এ সংগে যারা ঈমান এনে নেক আমল করে তাদেরকে অগণিত পুরস্কার ও উত্তম প্রতিদানের সুখবর শুনানো হয়েছে।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-2
টিকা নং:1,

وَ اَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَ حُقَّتْۙ

এবং নিজের রবের হুকুম পালন করবে।১ আর (নিজের রবের হুকুম মেনে চলা), এটিই তার জন্য সত্য।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১) মূলে اَذِنَتْ لِرَبِّحَا শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। এর শাব্দিক মানে হয়, “সে নিজের রবের হুকুম শুনবে।” কিন্তু আরবী প্রবাদ অনুযায়ী اَذِنَ لَء এর মানে শুধু মাত্র হুকুম শুনা হয় না বরং এর মানে হয়, সে হুকুম শুনে একজন অনুগতের ন্যায় নির্দেশ পালন করেছে এবং একটুও অবাধ্যতা প্রকাশ করেনি।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-3
টিকা নং:2,

وَ اِذَا الْاَرْضُ مُدَّتْۙ

আর পৃথিবীকে যখন ছড়িয়ে দেয়া হবে।২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:২) পৃথিবীকে ছড়িয়ে দেবার মানে হচ্ছে, সাগর, নদী ও সমস্ত জলাশয় ভরে দেয়া হবে। পাহাড়গুলো চূর্ণবিচূর্ণ করে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হবে। পৃথিবীর সমস্ত উঁচু নীচু জায়গা সমান করে সমগ্র পৃথিবীটাকে একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করা হবে। সূরা ত্বা-হা’য় এই অবস্থাটিকে নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ মহান আল্লাহ “তাকে একটি সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন। সেখানে তোমরা কোন উঁচু জায়গা ও ভাঁজ দেখতে পাবে না।” ( ১০৬-১০৭ আয়াত) হাকেম মুস্তাদ্রা নির্ভরযোগ্য সনদ সহকারে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) এর বরাত দিয়ে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন পৃথিবীকে একটি দস্তরখানের মতো খুলে বিছিয়ে দেয়া হবে। তারপর মানুষের জন্য সেখানে কেবলমাত্র পা রাখার জায়গাই থাকবে।” একথাটি ভালোভাবে বুঝে নেয়ার জন্য এ বিষয়টিও সামনে রাখতে হবে যে, সেদিন সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষের জন্ম হয়েছে ও হবে সবাইকে একই সঙ্গে জীবিত করে আল্লাহর আদালতে পেশ করা হবে। এ বিরাট জনগোষ্ঠীকে এক জায়গায় দাঁড় করাবার জন্য সমস্ত সাগর, নদী, জলাশয়, পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, মালভূমি, তথা উঁচু-নীচু সব জায়গা ভেঙে-চুরে ভরাট করে সারা দুনিয়াটাকে একটি বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পরিণত করা হবে।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-4
টিকা নং:3,

وَ اَلْقَتْ مَا فِیْهَا وَ تَخَلَّتْۙ

যা কিছু তার মধ্যে আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করে সে খালি হয়ে যাবে৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৩) এর অর্থ হচ্ছে, যত মৃত মানুষ তার মধ্যে রয়েছে সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দেবে। আর এভাবে তাদের কৃতকর্মের যেসব প্রমাণপত্র তার মধ্যে রয়ে গেছে সেগুলোও পুরোপুরি বেরিয়ে আসবে। কোন একটি জিনিসও তার মধ্যে লুকিয়ে বা গোপন থাকবে না।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-5
টিকা নং:4,

وَ اَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَ حُقَّتْؕ

এবং নিজের রবের হুকুম পালন করবে। আর (নিজের রবের হুকুম মেনে চলা), এটিই তার জন্য সত্য।৪

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৪) যখন এসব ঘটনাবলী ঘটবে তখন কি হবে, একথা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। কারণ এ পরবর্তী বক্তব্যগুলো নিজে নিজেই তা প্রকাশ করে দিচ্ছে। এ বক্তব্যগুলোতে বলা হচ্ছেঃ হে মানুষ! তুমি তোমার রবের দিকে এগিয়ে চলছো। শীঘ্র তাঁর সামনে হাযির হয়ে যাবে। তখন তোমার আমলনামা তোমার হাতে দেয়া হবে। আর তোমার আমলনামা অনুযায়ী তোমাকে পুরস্কার দেয়া হবে।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-6
টিকা নং:5,

یٰۤاَیُّهَا الْاِنْسَانُ اِنَّكَ كَادِحٌ اِلٰى رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلٰقِیْهِۚ

হে মানুষ! তুমি কঠোর পরিশ্রম করতে করতে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো, পরে তাঁর সাথে সাক্ষাত করবে।৫

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৫) অর্থাৎ দুনিয়ায় তুমি যা কিছু কষ্ট সাধনা প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছ, সে সম্পর্কে তুমি মনে করতে পারো যে, তা কেবল দুনিয়ার জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ এবং দুনিয়াবী স্বার্থ লাভ করাই তার উদ্দেশ্য। কিন্তু আসলে তুমি সচেতন বা অচেতনভাবে নিজের রবের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছো এবং অবশেষে তোমাকে তাঁর কাছেই পৌঁছতে হবে।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-8
টিকা নং:6,

فَسَوْفَ یُحَاسَبُ حِسَابًا یَّسِیْرًاۙ

তার কাছ থেকে হালকা হিসেব নেয়া হবে৬

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৬) অর্থাৎ তার হিসেব নেয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হবে না। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে না, উমুক উমুক কাজ তুমি কেন করেছিলে? ঐসব কাজ করার ব্যাপারে তোমার কাছে কি কি ওজর আছে? নেকীর সাথে সাথে গোনাহও অবশ্যি তার আমলনামায় লেখা থাকবে। কিন্তু গোনাহের তুলনায় নেকীর পরিমাণ বেশী হবার কারণে তার অপরাধগুলো উপেক্ষা করা হবে এবং সেগুলো মাফ করে দেয়া হবে। কুরআন মজিদে অসৎকর্মশীল লোকদের কঠিন হিসেব-নিকেশের জন্য اَذِنَ لَء “সু-উল হিসেব” (খারাপভাবে হিসেব নেয়া) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। (আর্ রা’আদ ১৮ আয়াত) সৎ লোকদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “এরা এমন লোক যাদের সৎকাজগুলো আমি গ্রহণ করে নেবো এবং অসৎকাজগুলো মাফ করে দেবো।” (আল আহকাফ ১৬ আয়াত) রসূলুল্লাহ ﷺ এর যে ব্যাখ্যা করেছেন তাকে ইমাম আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ, হাকেম, ইবনে জারীর, আব্দ ইবনে হুমাইদ ও ইবনে মারদুইয়া বিভিন্ন শব্দাবলীর সাহায্যে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। এক বর্ণনা মতে নবী ﷺ বলেছেনঃ “যার থেকেই হিসেব নেয়া হয়েছে, সে মারা পড়েছে।” হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ কি একথা বলেননি, “যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে তার থেকে হাল্কা হিসেব নেয়া হবে?” রসূলুল্লাহ ﷺ জবাব দেনঃ “সেটি তো হলো কেবল আমলের উপস্থাপনা। কিন্তু যাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সে মারা পড়েছে।” আর একটি রেওয়ায়াতে হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি একবার নামাযে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিম্নোক্ত দোয়া পড়তে শুনিঃ ‘হে আল্লাহ! আমার থেকে হাল্কা হিসেব নাও।’ তিনি সালাম ফেরার পর আমি তাঁকে এর অর্থ জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেনঃ “হাল্কা হিসেব মানে বান্দার আমলনামা দেখা হবে এবং উপেক্ষা করা হবে। হে আয়েশা! সেদিন যার কাছ থেকে হিসেব নেয়া হয়েছে সে মারা পড়েছে।”

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-9
টিকা নং:7,

وَّ یَنْقَلِبُ اِلٰۤى اَهْلِهٖ مَسْرُوْرًاؕ

এবং সে হাসিমুখে নিজের লোকজনের কাছে ফিরে যাবে। ৭

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৭) নিজের লোকজন বলতে পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও সাথী-সহযোগীদের কথা বুঝানো হয়েছে। তাদেরকেও একইভাবে মাফ করে দেয়া হয়ে থাকবে।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-10
টিকা নং:8,

وَ اَمَّا مَنْ اُوْتِیَ كِتٰبَهٗ وَرَآءَ ظَهْرِهٖۙ

আর যার আমলনামা তার পিছন দিক থেকে দেয়া হবে,৮

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৮) সূরা আল হাক্কায় বলা হয়েছে, যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে। আর এখানে বলা হয়েছে, তার পেছন দিক থেকে দেয়া হবে। সম্ভবত এটা এভাবে হবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ডান হাতে আমলনামা পাবার ব্যাপারে প্রথম থেকে নিরাশ হয়ে থাকবে। কারণ নিজের কার্যক্রম তার ভালোভাবেই জানা থাকবে। ফলে সে নিশ্চিতভাবে মনে করবে যে, তাকে বাম হাতে আমলনামা দেয়া হবে। তবে সমস্ত মানুষের সামনে আমলনামা বাম হাতে নিতে সে লজ্জা অনুভব করবে। তাই সে নিজের হাত পেছনের দিকে রাখবে। কিন্তু এই চালাকি করে সে নিজের কৃতকর্মের ফল নিজের হাতে তুলে নেবার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। সে হাত সামনের দিকে রাখুক বা পেছনের দিকে অবশ্যি তার আমলনামা তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-13
টিকা নং:9,

اِنَّهٗ كَانَ فِیْۤ اَهْلِهٖ مَسْرُوْرًاؕ

সে নিজের পরিবারের লোকদের মধ্যে ডুবে ছিল।৯

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:৯) অর্থাৎ তার অবস্থা ছিল আল্লাহর সৎবান্দাদের থেকে আলাদা। আল্লাহর এই সৎ বান্দাদের সম্পর্কে সূরা ত্বা-হা’র ২৬ আয়াতে বলা হয়েছেঃ তারা নিজেদের পরিবারের লোকদের মধ্যে আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকদের জীবন যাপন করতো। অর্থাৎ সবসময় তারা ভয় করতো নিজেদের সন্তান ও পরিবারের লোকদের প্রতি ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের পরকাল বরবাদ না করে ফেলে। বিপরীত পক্ষে সেই ব্যক্তির অবস্থা ছিল এই যে, সে নিজের ঘরে আরামে সুখের জীবন যাপন করছিল। সন্তান-সন্তুতি ও পরিবারের লোকজনদের বিলাসী জীবন যাপনের জন্য যতই হারাম পদ্ধতি অবলম্বন এবং অন্যের অধিকার হরণ করার প্রয়োজন হোক না কেন তা তারা করে চলছিল। এই বিলাসী জীবন যাপন করতে গিয়ে আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখাগুলোকে সে চোখ বন্ধ করে ধ্বংস করে চলছিল।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-15
টিকা নং:10,

بَلٰۤى١ۛۚ اِنَّ رَبَّهٗ كَانَ بِهٖ بَصِیْرًاؕ

না ফিরে সে পারতো কেমন করে? তার রব তার কার্যকলাপ দেখছিলেন।১০

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১০) অর্থাৎ সে যেসব কাজ কারবার করে যাচ্ছিল আল্লাহ সেগুলো উপেক্ষা করতেন এবং নিজের সামনে ডেকে তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করতেন না এমনটি ছিল আল্লাহর ইনসাফ ও হিকমতের পরিপন্থী।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-19
টিকা নং:11,

لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَنْ طَبَقٍؕ

তোমাদের অবশ্যি স্তরে স্তরে এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।১১

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১১) অর্থাৎ তোমরা একই অবস্থার ওপর অপরিবর্তিত থাকবে না। বরং যৌবন থেকে বার্ধক্য, বার্ধক্য থেকে মৃত্যু থেকে বরযখ (মৃত্যু ও কিয়ামতের মাঝখানের জীবন), বরযখ থেকে পুনরুজ্জীবন, পুনরুজ্জীবন থেকে হাশরের ময়দান তারপর হিসেব নিকেশ এবং শাস্তি ও পুরস্কারের অসংখ্য মনযিল তোমাদের অবশ্যি অতিক্রম করতে হবে। এবিষয়ে তিনটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে। সূর্য অস্ত যাবার পর পশ্চিম আকাশের লালিমার, দিনের পর রাত্রির আঁধারও তার মধ্যে দিনের বেলা যেসব মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী পৃথিবীর চারদিকে বিচরণ করে তাদের একত্রে হওয়ার এবং চাঁদের সরু কাস্তের মতো অবস্থা থেকে পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে পূর্ণ চন্দ্রে পরিণত হওয়ার। অন্য কথায় বলা যায়, এ জিনিসগুলো প্রকাশ্যে সাক্ষ্য প্রদান করছে যে, মানুষ যে বিশ্ব-জাহানে বসবাস করে সেখানে কোন স্থিতিশীলতা নেই। সেখানে সর্বত্র একটি নিরন্তর পরিবর্তন ও ধারাবাহিক অবস্থান্তর প্রক্রিয়া কার্যকর রয়েছে। কাজেই শেষ নিঃশ্বাসটা বের হয়ে যাবার সাথে সাথে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে, মুশরিকদের এ ধারণা ঠিক নয়।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-21
টিকা নং:12,

وَ اِذَا قُرِئَ عَلَیْهِمُ الْقُرْاٰنُ لَا یَسْجُدُوْنَؕ۩

এবং এদের সামনে কুরআন পড়া হলে এরা সিজদা করে না?১২

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১২) অর্থাৎ এদের মনে আল্লাহর ভয় জাগে না। এরা তাঁর সামনে মাথা নত করে না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কার্যক্রম থেকে প্রমাণিত যে, তিনি কুরআনের এ আয়াতটি পড়ার সময় সিজদা করেছেন। ইমাম মালেক, মুসলিম ও নাসাঈ হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে এ রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি নামাযে এ সূরাটি পড়ে এ জায়গায় সিজদা করেন এবং বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এ জায়গায় সিজদা করেছেন। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসাঈ আবু রাফের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, হযরত আবু হুরাইরা (রা.) এশার নামাযে এ সূরাটি পড়েন এবং সিজদা করেন। আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে নামায পড়ি এবং তিনি এখানে সিজদা করেন তাই আমি আমৃত্যু এখানে সিজদা করে যেতে থাকবো। মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ এবং আরো অনেকে অন্য একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে এই সূরায় এবং ‘ ইকরা বিসমি রব্বিকাল্লাজী খালাক’ সূরায় সিজদা করেছি।

সুরা: আল-ইনশিক্বাক
আয়াত নং :-23
টিকা নং:13,

وَ اللّٰهُ اَعْلَمُ بِمَا یُوْعُوْنَ٘ۖ

অথচ এরা নিজেদের আমলনামায় যা কিছু জমা করছে আল্লাহ‌ তা খুব ভালো করেই জানেন।১৩

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

টিকা:১৩) এর আর একটি অর্থ এও হতে পারে যে, এরা নিজেদের মনে কুফরী, হিংসা, সত্যের সাথে শত্রুতা এবং অন্যান্য খারাপ ইচ্ছা ও দুষ্ট সংকল্পের যে নোংরা আবর্জনা ভরে রেখেছে আল্লাহ‌ তা খুব ভালো করেই জানেন।

Leave a Reply