Motaher21.net أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ ( বই # ১২০৩/হে মানুষ:-১৩) [# জীবন মানেই পরিশ্রম:- # ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার:-] www.motaher21.net সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ পারা:৩০ ১-২০ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :- #তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০৩/হে মানুষ:-১৩)
[# জীবন মানেই পরিশ্রম:-
# ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ
পারা:৩০
১-২০ নং আয়াতের ‌বেখ্যা :-

#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-

সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১
لَاۤ اُقۡسِمُ بِہٰذَا الۡبَلَدِ ۙ﴿۱﴾
শপথ করছি এই (মক্কা) নগরের।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-২
وَ اَنۡتَ حِلٌّۢ بِہٰذَا الۡبَلَدِ ۙ﴿۲﴾
আর অবস্থা হচ্ছে এই যে (হে নবী!) তোমাকে এই নগরে হালাল করে নেয়া হয়েছে।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-৩
وَ وَالِدٍ وَّ مَا وَلَدَ ۙ﴿۳﴾
কসম খাচ্ছি বাপের এবং তার ঔরসে যে সন্তান জন্ম নিয়েছে তার।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-৪
لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡ کَبَدٍ ؕ﴿۴﴾
আসলে আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্যে সৃষ্টি করেছি।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-৫
اَیَحۡسَبُ اَنۡ لَّنۡ یَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ اَحَدٌ ۘ﴿۵﴾
সে কি মনে করে যে, কখনো তার উপর কেউ ক্ষমতাবান হবে না?
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-৬
یَقُوۡلُ اَہۡلَکۡتُ مَالًا لُّبَدًا ؕ﴿۶﴾
সে বলে, ‘আমি রাশি রাশি অর্থ উড়িয়ে দিয়েছি।’
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-৭
اَیَحۡسَبُ اَنۡ لَّمۡ یَرَہٗۤ اَحَدٌ ؕ﴿۷﴾
সে কি ধারণা করে যে, তাকে কেউই দেখে নি?
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-৮
اَلَمۡ نَجۡعَلۡ لَّہٗ عَیۡنَیۡنِ ۙ﴿۸﴾
আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি চক্ষুযুগল?
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-৯
وَ لِسَانًا وَّ شَفَتَیۡنِ ۙ﴿۹﴾
আর জিহ্বা ও দুই ঠোঁট ?
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১০
وَ ہَدَیۡنٰہُ النَّجۡدَیۡنِ ﴿ۚ۱۰﴾
আমি কি তাকে দু’টি সুস্পষ্ট পথ দেখাইনি?
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১১
فَلَا اقۡتَحَمَ الۡعَقَبَۃَ ﴿۫ۖ۱۱﴾
কিন্তু সে দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করার সহস করেনি।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১২
وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا الۡعَقَبَۃُ ﴿ؕ۱۲﴾
কি জানো সেই দুর্গম গিরিপথটি কি?
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১৩
فَکُّ رَقَبَۃٍ ﴿ۙ۱۳﴾
তা হচ্ছে ক্রীতদাসকে মুক্তি প্রদান।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১৪
اَوۡ اِطۡعٰمٌ فِیۡ یَوۡمٍ ذِیۡ مَسۡغَبَۃٍ ﴿ۙ۱۴﴾
অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্যদান —
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১৫
یَّتِیۡمًا ذَا مَقۡرَبَۃٍ ﴿ۙ۱۵﴾
পিতৃহীন আত্মীয়কে।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১৬
اَوۡ مِسۡکِیۡنًا ذَا مَتۡرَبَۃٍ ﴿ؕ۱۶﴾
বা ধূলি মলিন মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১৭
ثُمَّ کَانَ مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡمَرۡحَمَۃِ ﴿ؕ۱۷﴾
তদুপরি অন্তর্ভুক্ত হওয়া তাদের যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্যধারণের ও দয়া দাক্ষিণ্যের।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১৮
اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡمَیۡمَنَۃِ ﴿ؕ۱۸﴾
এরাই ডানপন্থী।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-১৯
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِنَا ہُمۡ اَصۡحٰبُ الۡمَشۡـَٔمَۃِ ﴿ؕ۱۹﴾
পক্ষান্তরে যারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাই হল হতভাগ্য।
সুরা: ৯০ : আল্ – বালাদ:-২০
عَلَیۡہِمۡ نَارٌ مُّؤۡصَدَۃٌ ﴿٪۲۰﴾
তারা পরিবেষ্টিত হবে অবরুদ্ধ আগুনে।

সুরা: আল-বালাদ

بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

* ভূমিকা:৯০

ফী জিলালিল কুরআন:

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এ ছোট্ট সূরাটিতে মানব জীবনের বেশ কিছু মৌলিক বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, যা সূরাটির বাচনভংগির চাতুর্যে অত্যন্ত জোরালো ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এই ছোট্ট সূরাটিতে সে মৌলিক‌ বিষয়গুলোর এমন চমৎকারভাবে সমাবেশ ঘটেছে যা কোরআনে কারীম ছাড়া অন্য কিছুতে সম্ভব নয়। এই অসাধারণ বর্ণনাভংগি হৃদয়ের সূক্ষ্ম তন্ত্রীগুলোতে অত্যন্ত গভীরভাবে সাড়া জাগায় । সূরাটি শুরু হয়েছে কঠিন শপথ বাণীর সাথে। বলা হচ্ছে, ‘কসম এই মহানগরীর, যার এক সম্মানিত বাসিন্দা তুমি । কসম জন্মদাতা বাপের এবং কসম সন্তানের ৷ অবশ্যই আমি (সর্বশক্তিমান আল্লাহ) সৃষ্টি করেছি মানুষকে কষ্টকর কাজের কর্মী হিসাবে ।’ মহানগরী বলতে এখানে মক্কা শরীফকে বুঝানো হয়েছে, যেখানে আল্লাহর সম্মানিত ঘর বর্তমান । পৃথিবীতে মানুষের জন্য প্রথম এই ঘরটি তৈরী করা হয়েছে, যা গোটা মানবমন্ডলীর আশ্রয়স্থল এবং নিরাপত্তা বিধানকারী । এখানে এসে তারা তাদের যাবতীয় অস্ত্র সংবরণ করে, ঝগড়া-বিবাদ ভুলে যায়। ভুলে যায় শত্রুতার কথা এবং একে অপরের সাথে শান্তিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে মিলিত হয়। একজন আর এক জনের জন্য সশ্রদ্ধ ও নিবেদিত । এমনি করে এ ঘরটি এবং এর মধ্যে অবস্থিত গাছপালা, পাখী এবং যা কিছু আছে তা সবই নিরাপদ । তারপর আরো রয়েছে এর মধ্যে ইসমাঈল (আ.)-এর পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর ঘর ৷ তিনি গোটা আরব এবং সকল মুসলমানের পিতা ।

সুরা: আল-বালাদ
আয়াত নং :-3

وَ وَالِدٍ وَّ مَا وَلَدَۙ

কসম খাচ্ছি বাপের এবং তার ঔরসে যে সন্তান জন্ম নিয়েছে তার।

ফী জিলালিল কুরআন:

আল্লাহ তায়ালা তার নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে এই মহানগরীতে পয়দা করে সম্মানিত করেছেন। তার মান-মর্যাদার কথা ঘোষণা করেছেন এবং এখানে তার বাসস্থানে ও বসবাসের কথা উল্লেখ করে এ শহরের মর্যাদাকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন, বৃদ্ধি করেছেন এর শ্রেষ্ঠত্বকে। এসব মান-সম্মান বৃদ্ধির উল্লেখ দ্বারা এ স্থানের মর্যাদাকে প্রভূত পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে মোশরেকরা এ ঘরের মর্যাদা বিনষ্ট করাকে বৈধ করে নিয়েছে। এই শহরের মধ্যেই তারা নবী ও তাঁর সঙ্গী সাথীদেরকে কষ্ট দিয়েছে। অথচ ঘরটি তো চিরস্থায়ী মর্যাদার অধিকারী । আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বাড়ী এখানে হওয়ায় এ শহরের মর্যাদা আরো বহুগুণে বেড়ে গেছে। এই কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই ঘর এবং এর বাসিন্দার কসম খেয়েছেন । তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদার কারণেই এ শহরের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন৷ এসব কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা মোশরেকদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। যেহেতু তারা নিজেদেরকে এ ঘরের মোতাওয়াল্লী বলে দাবী করতো, আরো দাবী করতো যে, তারা ইসমাঈলের বংশধর এবং ইবরাহীম (আ.)-এর মত ও পথের পথিক । তাদের এ ভূমিকা ছিলো সবদিক দিয়ে অপ্রিয় ও জঘন্য ৷ বংশানুক্রমিক সৃষ্টিতত্ত্ব : এ প্রসঙ্গে এই ব্যাখ্যাটিই সম্ভবত বেশী উপযোগী ৷ ‘পিতা ও সন্তানের কসম’ একথা দ্বারা বিশেষভাবে ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর দিকে ইংগিত করা হয়েছে, আর এই শহর, এখানকার অধিবাসী, নবী ও এ ঘরের প্রতিষ্ঠাতা এবং যাকে তিনি জন্ম দিয়েছেন এ সবই ইবরাহীম (আ.)-এর সম্পর্কে বলা হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, আর কোনো ব্যাখ্যা এখানে হতে পারে না। পিতা ও পুত্রের কথা বলতে মানব সাধারণ-এর পিতা পুত্রের সম্পর্কও বুঝানো হতে পারে। যাদের মাধ্যমে সৃষ্টি প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। এই সূরার ভূমিকা হিসাবে মানব সৃষ্টির রহস্য তুলে ধরা হয়েছে এবং এটাই সুরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । এ প্রসঙ্গে ওস্তাদ শেখ মোহাম্মদ আব্দুহু তার তাফসীরের ‘জুয্য়ে আম্মা’তে এ সূরার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বড় চমৎকার একটি কথা বলেছেন, যা আমি এখানে উল্লেখ করা জরুরী মনে করছি। যেহেতু এই তাফসীর ‘ফী যিলালিল কোরআন’-এর সাথে সে তাফসীর-এর অনেক মিল রয়েছে। এরপর আল্লাহ তায়ালা পিতা ও পুত্রের কসম খেয়েছেন যাতে করে সৃষ্টি জগতের বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে এবং মানব সৃষ্টির বিভিন্ন, স্তরের প্রতি আমাদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয় এবং আমরা খেয়াল করে দেখি যে, কিভাবে মানুষ পৃথিবীতে এলো এবং কোন কোন পর্যায় অতিক্রম করে আজ নিজেকে সে উন্নত জীব বলে ভাবতে পারছে এবং কিভাবে তার পরিসমাপ্তি ঘটবে । যখন গাছপালার জন্ম ও বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনি চিন্তা করবেন, তখন দেখবেন কেমন করে বীজ মাটিতে পড়ার পর অংকুরিত হয়। তারপর বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সে অংকুর বেড়ে উঠে । তাকে প্রাকৃতিক কতো দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হয় এবং বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য আশপাশের সবকিছু থেকে কি কঠিনভাবে তার খাবার সংগ্রহ করা দরকার হয়। এভাবে সে শেষ পর্যন্ত পত্রপল্পব সজ্জিত শাখা-প্রশাখা সম্বলিত সুদৃঢ় গাছে পরিণত হয় । তখন সে আরও একটি বা একাধিক বীজ প্রদানে সক্ষম হয় যা তারই গাছপালার জন্ম ও বিস্তার দান করে এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে নিজেদের সঠিক ভূমিকা পালন করে। এসব বিবর্তনের দিকে যখন আপনি দৃষ্টিপাত করবেন, চিস্তা করবেন সৃষ্টির এই বৈচিত্র সম্পর্কে এবং আরও চিন্তা করবেন এসব গাছপালার উর্ধের জিনিস জীব-জন্তু ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কে, তখন আপনার সামনে ভেসে উঠবে সব থেকে বৈচিত্রময় সৃষ্টি, পিতা ও পুত্রের জন্ম রহস্য, যা সৃষ্টিকুলে সংঘটিত করেছে সব থেকে বড় বিপ্লব, যার জন্য প্রয়োজন মহা বিজ্ঞানময় এক দক্ষ পরিকল্পনা, যাতে করে এ মহা সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখা যায় এবং যাতে বিশ্ব প্রকৃতির প্রবৃদ্ধিতে নিত্য নতুন সৌন্দর্যের সংযোজন ও বিকাশ ঘটে । এখানে শপথ গ্রহণের পদ্ধতিটি মানব জীবনের এক মহা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বলা হয়েছে- ‘অবশ্যই আমি (মহান আল্লাহ) সৃষ্টি করেছি মানুষকে দুঃখ কষ্ট ও পরিশ্রম করে চলার প্রকৃতি দিয়ে ।’ অর্থাৎ বিভিন্ন কষ্ট দুর্ভোগ ও চেষ্টা চরিত্র করে চলার ও কঠিন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জীবন দিয়ে পয়দা করেছি। এমনি করে অন্য আর একটি সূরাতেও বলা হয়েছে, ‘হে মানবকুল, নিশ্চয়ই তোমাকে বহু দুঃখ কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তোমার রবের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবেই তার সাথে তোমার মোলাকাত হবে’ জীবন্ত শুক্রকীট মাতৃগর্ভে প্রবেশ করার পর তাকে জীবিত থাকার জন্য, টিকে খাকার জন্য এবং গড়ে ওঠার জন্য অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়, তবেই আল্লাহর হুকুমে সেখানে তার অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব হয় । এভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেখানে থাকার পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যমে তার পথ পরিক্রমার সমাপ্তি ঘটে । কিন্তু সেখানে মায়ের কষ্টের সাথে সাথে তাকেও যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করতে হয়। পৃথিবীর আলো দেখা ততোক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব হয় না যতোক্ষণ পর্যন্ত না পৃথিবীতে পদার্পণ করতে ইচ্ছুক এই ভ্রুণকে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টকর সংকোচন সম্প্রসারণ, এগিয়ে দেয়া ও পেছনে টেনে নিয়ে আসা, চাপ দেয়া ও ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি পদ্ধতিতে এগিয়ে আসতে হয়। এমনকি গর্ভাশয় থেকে বেরিয়ে আসার কোনো কোনো সময় তার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়।

ফী জিলালিল কুরআন: জীবন মানেই পরিশ্রম : আর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে যায় তার কঠিন জীবন সংগ্রাম, যা প্রতি পদে পদে যন্ত্রণাদায়ক ৷ সর্বপ্রথম শুরু হয় এমন এক পরিবেশে ভ্রুণটির শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার সংগ্রাম, যা তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত এবং এ কাজটি তার জন্য একেবারেই নতুন এক অভিজ্ঞতা । ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সর্বপ্রথম সে চীৎকার দিয়ে মুখ খুলে এবং ফুসফুস যন্ত্রকে সম্প্রসারিত করে দিয়ে সজোরে দম বের করে দিয়ে জানায় যে, দুনিয়ায় তার বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার এবং কোনোভাবেই তা সহজ নয়। আরও জানায়, এখন থেকে শুরু হয়ে গেলো তার বাচার জন্য কষ্টকর সংগ্রাম । এ সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় তার হজম শক্তিকে কাজে লাগানো এবং রক্ত সঞ্চালন ক্রিয়াজনিত অস্বাভাবিক অজানা এক পদ্ধতি। শুরু হয়ে যায় পাকস্থলীর পক্ষে অপ্রয়োজনীয় খাদ্যাংশ বের করে দেয়ার কষ্টকর সংগ্রামের এক নতুন প্রক্রিয়া । তার পর থেকে প্রত্যেকটি পদক্ষেপ কষ্টই কষ্ট বহন করে নিয়ে আসে এবং প্রতিটি অংগসঞ্চালন বা নড়াচড়া মাত্রই কষ্ট। বাচ্চা যখন হামাগুড়ি দেয়া শুরু করে এবং যখন দাড়াতে শেখে এ অবস্থা যে-ই দেখে, সে বুঝতে পারবে তার তুচ্ছ এবং প্রাথমিক এ কাজগুলো কতো কঠিন । দাত ওঠার সময় কিছু কষ্ট হয়। যখন দাড়াতে শেখে তখনও কষ্ট হয়। যখন হাটতে শেখে তখনও হয় এরকম কষ্ট । যখন লেখাপড়া শেখে, তখন হয় আর এক ধরনের কষ্ট ৷ যখন বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা লাগে, তখনও হয় অন্য আর এক প্রকারের কষ্ট । এভাবে প্রতিটি নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সময় পৃথক পৃথক ধরনের চিন্তা ও দুর্ভোগ আসে । যেমন হামাগুড়ি দেয়ার সময় এক রকম কষ্ট আবার চলতে শুরু করলেও হয় প্রায় ওই একই রকমের পেরেশানী । তারপর জীবনের পথ বিভিন্ন হয়ে যায় এবং চেষ্টা সংগ্রামও বিভিন্ন রূপ নেয়। কেউ কেউ সংগ্রাম করে পেশীশক্তি দিয়ে, কেউ সংগ্রাম করে মানসিক শক্তি বা চিন্তাশক্তি দিয়ে, আবার কেউ সংগ্রাম করে আত্মশক্তি দিয়ে । কেউ সংগ্রাম করে ভাত-কাপড়ের জন্য, জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে, আবার কেউ চেষ্টা-সংগ্রাম করে হাজার থেকে লাখ টাকা বৃদ্ধি করে পুঁজির পাহাড় গড়তে ৷ কেউ নিজেকে পেরেশানিতে ফেলে পদমর্যাদা অথবা ক্ষমতার মোহে, আবার কেউ আল্লাহর পথে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা-সংগ্রাম করে। কেউ সংগ্রাম করে তার লাগাম ছাড়া চাহিদা মেটানোর জন্য আর কেউ তার আকীদা বিশ্বাস এবং দ্বীনের দাওয়াত দান কল্পে চেষ্টা সাধনা করে জান্নাতের দিকে যাওয়ার জন্য । আর এদের প্রত্যেককেই কিছু দায়িত্বের বোঝা বহন করতে হয়, বহু পরিশ্রম করে দুর্গম পথে চলতে হয় এবং কষ্ট পরিশ্রম করে আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাতের জন্য শেষ পর্যন্ত তার দরবারে হাযির হতে হয়। হতভাগা ও দুষ্ট প্রকৃতির লোকের জন্য তখন সব থেকে বড় পেরেশানীর কারণ হবে এই সাক্ষাতকার আর নেককার ও সৌভাগ্যবানদের জন্য আল্লাহ তায়ালার এই দীদার বড়ই আরামদায়ক । দুনিয়ার কষ্ট-পরিশ্রম ও পেরেশানী একটি অতি স্বাভাবিক ব্যাপার । যদিও এর প্রকার ও কারণ বিভিন্ন তবে হেতু যাই হোক না কেন দুনিয়াতে পেরেশানী যে আছেই এটা নিশ্চিত । তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত সেই ব্যক্তি, যে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও সুখ-শান্তির জন্য নিজেকে নানা প্রকার পেরেশানীতে ফেলে কিন্তু আখেরাতের জন্য কিছুই না করার কারণে যখন জীবনাবসন হয়, তখন সে বদনসীবী ও চরম দুর্দশার শিকার হয়ে যায়। আর সবচেয়ে সফলকাম ও খোশনসীব সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ তায়ালার ছায়াতলে আশ্রয় পেয়ে পরম শান্তি লাভ করে। পৃথিবীর জীবনে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক । এ কষ্ট জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ৷ তবে এর রূপ ও প্রকৃতি বিভিন্ন । কষ্ট মানুষকে করতেই হয়, তা সে ভালোর জন্যেই হোক আর মন্দের জন্য হোক। যে ব্যক্তি চেষ্টা-পরিশ্রম করে ভালোর জন্য অবশ্যই সে চেষ্টা পরিশ্রমের প্রকৃতি মন্দের জন্য কষ্টকর পরিশ্রম করা থেকে ভিন্ন ৷ মন্দ কাজের জন্য যে চেষ্টা ও পরিশ্রম করা হয় তার মধ্যে মানসিক কোনো শান্তি থাকে না, থাকে না কোনো তৃপ্তির অনুভূতি, যা ভালোর জন্য চেষ্টা-সাধনা ও কষ্টের মধ্যে অনুভূত হয়। এ আরাম ও শান্তি আসে অপরের জন্য খরচের মাধ্যমে, আসে অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মাধ্যমে। সুতরাং যে পরিশ্রম করে, তার কাজটাও নরম কাদা ব্যবহারের মতো সহজ হয়ে যায়। তবে এই শক্ত কাদার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা আর নরম কাদার মধ্যে পোকা-মাকড় বা কীট-পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিয়ে অতিক্রম করা বা মাটির সাথে মিশে যাওয়া সমান নয়। এমনি করে যে ব্যক্তি দাওয়াতী কাজ করতে করতে মারা যায়, সে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাওয়া ব্যক্তির সমান হতে পারে না। যেহেতু এ ব্যক্তি কঠিন কোনো কাজ করার জন্য কষ্ট-পরিশ্রম করার চিন্তা বা চেষ্টাই করেনি।

ফী জিলালিল কুরআন: ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার : মানব জীবনের এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর মানুষের কিছু স্বাভাবিক দাবী ও সচরাচর যে চিন্তা-ভাবনা সে করে, সে সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়োজনবোধ করা হয়েছে  ‘সে কি মনে করে যে, তার ওপর কেউ ক্ষমতা খাটাতে পারবে না? সে বলে, আমি যথেষ্ট সম্পদ খরচ করেছি। সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখে না? ‘ অবশ্যই এই মানুষ যদিও সে সৃষ্টির সেরা, তবু তাকে পরিশ্রমজনিত কষ্টের মধ্যেই বাস করতে হয়। সে চেষ্টা-সাধনা ও পরিশ্রমের কষ্ট থেকে রেহাই পেতে পারে না এবং এ কষ্ট একবারে শেষ হবারও নয়। তার অস্তিত্বের রহস্য ও বাস্তবতা সে ভুলে যায় এবং তাকে আল্লাহর খলীফা হিসেবে প্রদত্ত শক্তি, ক্ষমতা, চিন্তাশক্তি ও সম্পদ-সম্পত্তি ব্যবহারের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার মোহে পড়ে নিজেকে সে এ সকল জিনিসের মালিক বলে মনে করে ধোকা খায়। এই কারণেই তাকে প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করতে বা কোনো অন্যায় কাজ করতে সে দ্বিধাবোধ করে না। যেহেতু সে মনে করে যে তাকে কোনোদিন পাকড়াও হতে হবে না এবং তার ওপর ক্ষমতা খাটানোরও কেউ নেই । এ ভুল চিন্তার কারণে সে প্রায় সময়েই সীমালংঘন করে, মানুষের ওপর যুলুম করে, মানুষের ধনসম্পদ ছিনিয়ে নেয়, লুটপাট করে এবং এভাবে সম্পদ পুঞ্জীভূত ও বৃদ্ধি করে। আর এই সম্পদের দাপটে সে নানা প্রকার অন্যায় ও পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। ঈমান থেকে মানুষের অন্তর যখন খালি হয়ে যায়, তখন তার কোনো ডর ভয় থাকে না এবং কোনো অন্যায়কেই সে পাপ মনে করে না । তারপর যখন তাকে কোনো ভাল কাজের জন্য খরচ করতে বলা হয় ( যেমন এ সূরার অন্যত্র বলা হয়েছে ), তখন সে বলে আমি প্রচুর এবং যথেষ্ট পরিমাণে খরচ করেছি এবং যা আমি অন্যকে দিয়েছি, আমার জন্য তাই-ই যথেষ্ট । আল্লাহ তায়ালা বলছেন, সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখছে না? অথচ সে ভুলে যায় যে, তার ওপর (সদাসর্বদা) আল্লাহর নযর রয়েছে এবং তার সকল কাজই আল্লাহ্‌র জানা আছে। তিনি তো দেখেছেনই কোন কারণে সে কী খরচ করেছে। কিন্তু এই যে (আখেরাত-বিমুখ) “মানুষ”, সে এগুলো সব ভুলে যায় এবং মনে করে যে, সে আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে রয়েছে। তার এই অহংকারের কারণেই সে নিজেকে শক্তিশালী ও অজেয় মনে করে। যে ধন-সম্পদ সে লাভ করেছে তার কারণে এবং তার হৃদয়ের সংকীর্ণতার কারণে সে মনে করে যে, সে যথেষ্ট খরচ করে ফেলেছে। আল্লাহ তায়ালা এর জবাব দিতে পিয়ে তাকে যেসব বৈশিষ্ট দিয়েছেন এবং তার যোগ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে যে সব নেয়ামত দিয়েছেন তার উল্লেখ করে বলেছেন যে, এসব নেয়ামত যার কাছ থেকে সে পেয়েছে, তার শোকর সে করে না এবং তাঁর হকও সে আদায় করে না।

ফী জিলালিল কুরআন: এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি (আল্লাহ্‌ তায়ালা) তার দুটি চোখ, জিহবা ও দুটি ঠোট কি বানাইনি এবং তাকে দুটি পথ কি দেখাইনি ?’ সাধারণভাবে মানুষ শক্তির বড়াই করে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্‌তায়ালাই হচ্ছেন সকল শক্তি ও নেয়ামত দানকারী ৷ শক্তি-ক্ষমতার অধিকারী হওয়া একমাত্র তারই দান। সে ধন, সম্পদের বড়াই করে, অথচ তার বুঝা দরকার যে, এ অর্থ-সম্পদ তিনিই দিয়েছেন। এই অহংকারের কারনেই সে সঠিক পথ গ্রহণ করতে চায় না এবং শোকরও করে না । যুক্তির এই জগতে বিচরণের জন্য আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন। তাকিয়ে দেখুন এক একটি করে দেয়া আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতগুলোর দিকে। তিনি বানিয়ে দিয়েছেন তার জন্য (কী সুন্দর করে) মহামূল্যবান দুটি চোখ। যার নির্মাণ কৌশল কতো জটিল ও নিপুণ, যার দৃষ্টিশক্তি কত আশ্চর্যজনক। তিনি কথা বলার শক্তি দিয়ে, যার দ্বারা কতো সুন্দরভাবে সে মনের ভাব প্রকাশ করে। তাকে অন্য জীব থেকে পৃথক করেছেন, আর এই কাজের জন্য তাকে দিয়েছেন (বহিরাংগ) জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট । তারপর দিয়েছেন ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার বিশেষ যোগ্যতা ও শক্তি । সঠিক ও বেঠিক পথের মধ্যে পার্থক্য জানা, বুঝা ও বাছাই করার সক্ষমতা ও স্বাধীনতা, যাতে করে এ দুয়ের মধ্যে যেটা খুশী সে গ্রহণ করতে পারে। আরও দিয়েছেন তাকে সত্য ও অসত্য পথের খবর ৷ এরশাদ হচ্ছে, ‘এবং আমি (আল্লাহ তায়ালা) তাকে দুটি পথ দেখিয়েছি’ যাতে দুটির যে কোনো একটা সে খুশীমতো গ্রহণ করতে পারে। তার প্রকৃতির মধ্যে দুটির যে কোনো একটি গ্রহণ করার ক্ষমতা পুরোপুরিই দেয়া হয়েছে। ‘নাজ্দ’ বলতে বুঝায় সুউচ্চ গিরিপথ । আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকে এই দুটি পথের যে কোনোটাতে সে যেন চলতে পারে তার ক্ষমতা দিয়েছেন। আর বৈবাহিক জীবন পদ্ধতির মাধ্যমে তার সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে চালু রাখা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি-কৌশলের এক বিশেষ নিয়ম । সকল সৃষ্টির জন্যে বিভিন্ন আকৃতি, রূপদান এবং পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে তার উপযোগী পেশায় নিয়োজিত করা এ সবই আল্লাহ তায়ালার একান্ত মেহেরবানী । আলোচ্য আয়াতটির মাধ্যমে মানব প্রকৃতির মূল রহস্য উঘাটন করা হয়েছে, যেমন করে আর একটি নিয়ম রয়েছে (যাকে ইসলামের আধ্যাত্মিক মতবাদ বলে) সে সম্পর্কে আলোচনা এসেছে সুরা ‘আশ্‌ শামস’ এ ৷ এতে বলা হচ্ছে, ‘কসম মানবাত্মার এবং তার, যিনি একে সুসামঞ্জস্য করে তৈরী করেছেন। তারপর এর মধ্যে দান করেছেন পাপ-প্রবণতা ও নেকী করার পবিত্র আবেগ । সেই ব্যক্তি অবশ্যই সাফল্য লাভ করলো, যে একে পবিত্র রাখলো এবং সে ব্যর্থ হলো যে, একে ষড়যন্ত্রের কারখানা বানিয়ে কলুষিত করলো ।’ ইনশা আল্লাহ্‌, আমরা এ বিষয়ে সূরা ‘আশ্‌শামস’-এর বিস্তারিত আলোচনা করবো। উল্লেখিত এই সকল জিনিস আল্লাহর দেয়া সব নেয়ামত যা শুধুমাত্র মানব জাতিকেই তিনি দিয়েছেন, যাতে করে সে তার মধ্যে নিহিত ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে, তার উচিত জগতের বুকে ভূমিকা রাখা এবং সঠিক পথে চলার ব্যপারে সাহায্য করা। যে দুটি চোখ দিয়ে সে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতার নিদর্শনগুলো দেখে সেগুলো তার ঈমানকেও উজ্জীবিত করে। আসলে আল্লাহ তায়ালার শক্তি ক্ষমতার নিদর্শন বিশ্বের সর্বত্র এতো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে, যে কোনো চিন্তাশীল লোকই তা প্রত্যক্ষ করতে পারে। তার জিহ্বা ও ঠোঁট দুটি তার মনের ভাব ও অন্য যে কোনো জিনিসের বিবরণ পেশ করার মাধ্যমে! এগুলো দ্বারা মানুষ আরও বহু কাজ করে তা এতো বেশী কার্যকর ও তীক্ষ্ম যে, অনেক সময় সে কথাগুলো তরবারি ও বন্দুকের তীক্ষ্ম ক্ষমতাকেও হার মানায় । জিহ্বার অবদান হচ্ছে কথা, তা একদিকে যেমন জান্নাতের দিকে মানুষকে এগিয়ে দেয়, তেমনি জাহান্নামের দিকেও মানুষকে ধাবিত করে, আবার জাহান্নামের আগুন নিভাতেও সাহায্য করে। হযরত মায়া’য ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, তিনি বলেন এক সফরে আমি নবী করীম (স.)-এর সাথে ছিলাম, একদিন আমি তার পাশাপাশি চলছিলাম তখন আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, আমাকে এমন একটি কাজ সম্পর্কে বলুন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেবে । তিনি বললেন, তুমি এক বিরাট জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বসেছো ৷ অবশ্য এটা তার জন্যই সহজ, যার জন্য আল্লাহ তায়ালা এটাকে সহজ করে দিয়েছেন। আর সে কাজ হচ্ছে, তুমি আল্লাহ্‌র নিরংকুশ আনুগত্য করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, সালাত (নামায) কায়েম করবে, যাকাত দান করবে, রমযান মাসের রোযা রাখবে এবং হজ্জ করবে। (একটু থেমে) তিনি পুনরায় বললেন, আমি কি তোমাকে কল্যাণের দুয়ারসমূহের দিকে পথ নির্দেশ করবো না? বললাম, অবশ্যই ইয়া রসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, ‘রোযা হচ্ছে আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য ঢাল, দান খয়রাত ত্রুটি বিচ্যুতিকে তেমনি করে মুছে দেয়, যেমন করে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। আর গভীর রাতে উঠে নামায পড়া নেককার লোকদের জন্য ঈমানের পরিচয়বাহী বিশেষ এক চিহ্ন । এক পর্যায়ে তিনি কোরআনে উল্লেখিত আল্লাহ পাকের আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘তারা তাদের দেহের পার্শ্বগুলোকে বিছানা থেকে তুলে নেয়’। তারপর বললেন, তোমাকে শীর্ষ স্থানীয় একটি কাজের কথা বলবো কি? আর বলব কি সেই স্তম্ভগুলো সম্পর্কে যা এই কাজকে খাড়া রাখতে সাহায্য করে, সর্বোপরি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা সর্বোচ্চ চূড়া সম্পর্কে কি জানাবো? বললাম, অবশ্যই বলুন, ইয়া রসূলাল্লাহ । তিনি বললেন, শীর্ষস্থানীয় কাজ বা কাজের মাথা হচ্ছে ইসলাম । এর সহায়ক খুঁটিগুলো হচ্ছে নামায, আর সর্বোচ্চ কাজ হচ্ছে সর্বাত্মক সংগ্রাম (জেহাদ) ৷ এরপর রসূল (স.) আবার বললেন, তোমাকে বলবো কি এসব কিছুর পরিচালিকা শক্তি কোন জিনিস? বললাম, অবশ্যই বলুন, ইয়া রসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, বলোতো তোমার ওপর এর প্রভাব কতোটুকু, এই বলে তিনি তার নিজের জিহবার দিকে ইশারা করলেন । তখন আমি বললাম হে আল্লহর নবী, আমাদের কি পাকড়াও করা হবে সে সকল কথার জন্যে-যা আমরা কথা প্রসংগে বলি? তিনি বললেন, তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুন! তুমি এতোটুকু কথা বুঝলে না’জিহবার আগা যে ফসলগুলো কাটে (অর্থাৎ যে কথাগুলো উচ্চারণ করে) সেগুলো ছাড়া আর কোন্‌ জিনিসের কারণে মানুষকে মুখের ওপর ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে (অথবা বলেছেন নাকের ডগার ওপর ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে) টেনে নিয়ে উল্টা করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে? (রেওয়ায়াত করেছেন আহমাদ, তিরমিমি, নাসায়ী এবং ইবনে মা’জা)।
ফী জিলালিল কুরআন: আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ভালো এবং মন্দের বুঝ দান করেছেন এবং জানিয়েছেন তাকে জান্নাত ও দোযখের পথ ৷ আর এই পথনির্দেশনার মাধ্যমে ভালো পথ গ্রহণের ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছেন। এই সমস্ত নেয়ামতের মধ্যে ডুবে থাকার কারণে মানুষ জীবনের দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করতে সাধারণভাবে অনিচ্ছুক হয় আর এই দুর্গম ও দুর্ভেদ্য পথই তার ও জান্নাতের মধ্যে বাধার বিন্ধাচল হিসাবে দন্ডায়মান । এই দুর্গমগিরি পার হয়েই সকল আশা-আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দু চির-বাঞ্ছিত অমর জান্নাতে পৌছুতে হয় যার বিস্তারিত বিবরণ আল্লাহ তায়ালা আলোচ্য আয়াতগুলোতে পেশ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘এতসব নেয়ামত মানুষকে আমি দিয়েছি …… তারাই হবে ডান দিকে যারা থাকবে সেই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ।’ (আয়াত ১৩-২০) জীবন পথে চলতে গিয়ে মানুষকে মাঝে মাঝে দুর্গম গিরি অতিক্রম করতে হয়। তবে ব্যতিক্রম সেই ব্যক্তি যে পরিপূর্ণ ঈমান নিয়ে আল্লাহ তায়ালার সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে। আসলে, এটিই হচ্ছে কোরআনে উল্লেখিত সেই কন্টকাকীর্ণ গিরিপথ, যা তার ও জান্নাতের মধ্যে বাধার প্রাচীর হয়ে দাড়িয়ে আছে৷ এই বাধাকে অপসারিত করার দৃঢ় মনোবল নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলেই সে তার বাঞ্ছিত মনযিলে পৌছে যাবে । সে পথের যে চিত্র এখানে আঁকা হয়েছে, তা প্রত্যেক ব্যক্তিকে সেই বাধা অতিক্রম করে মহা সাফল্যের মনযিলের দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে। বিশেষ করে যে এই প্রবল বাধাগুলোকে স্পষ্টভাবে বুঝেছে এবং তা পার হওয়ার দৃঢ় মনোভাব গ্রহণ করতে পেরেছে । ‘কিন্তু না, সে সেই দুর্গম গিরিপথ পাড়ি দিলো না’ এ কথাটির মধ্যে রয়েছে মানুষকে কঠিন পথে এগিয়ে দেয়ার জন্য এক বলিষ্ঠ অনুপ্রেরণা, রয়েছে বাধা-বিঘ্নকে উপেক্ষা করে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করার এক প্রবল উৎসাহ। দুস্থ মানবতার পাশে ইসলাম : এরপর, এ লক্ষ্যবস্তুর গুরুত্ব ও মাহাত্ম তুলে ধরা হয়েছে এই আয়াতে, “তুমি কি জানো, ‘দুর্গম পথ’ বস্তুটি কি?” আসলে এ কথার দ্বারা ওই পথের জটিলতা তুলে ধরাই শুধু উদ্দেশ্য নয়, বরং আল্লাহর কাছে আসল গুরুত্ব হচ্ছে কষ্টকর হলেও ওই পথটি পার হতে হবে একথাটি বলা । অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা বলতে চান, ঐ পথটি অত্যন্ত কঠিন সন্দেহ নেই, কিন্তু তোমাদেরকে এ পথটি পার হতেই হবে৷ কারণ সে পথটি অতিক্রম করতে পারলেই মনযিলে মকসূদে উপনীত হতে পারবে । এই পর্যায়ে আরও একটি কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, মূল্যবান জিনিস মূল্য দিয়েই গ্রহণ করতে হয় চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্যবস্তু যতো বেশী শুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান হবে তা অর্জন করতে ততো বেশী কষ্ট করতে হবে ও অজস্র ত্যাগ স্বীকার করতে হবে৷ সংগে সংগে একথাটিও এখানে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সে কঠিন পথ-পরিক্রমা তথা কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার কখনও বৃথা যেতে পারে না। সর্বশক্তিমান ও সবকিছুর মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এ আশ্বাসবাণী পাঠকের মনকে অবশ্যই উৎসাহিত করবে । আশার আলোকে উদ্ভাসিত করবে তার গোটা দেহ মনকে । আল্লাহ তায়ালার এই চিত্তাকর্ষক ভাষার মাধ্যমে ‘আকাবা’র যে ছবিটি এখানে ফুটে উঠেছে, তা মানুষকে আলোচ্য সত্য-সঠিক লক্ষ্য বস্তুর গুরুত্ব ও মাহাত্ম বুঝতে সাহায্য করেছে এবং সেই দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই আয়াতগুলোতে এক মধুর আবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ছিন্নবন্ত্র ও অসহায় মানব সন্তান গোলামীর জিঞ্জীর পরে তোমার দুয়ারে কী করুণ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে। চেয়ে দেখো একবার হে সভ্যতাগর্বী মানুষ! মানবতার এ নিদারুণ ব্যথা দূর করার জন্য তুমি কি এগিয়ে আসবে না? সৃষ্টিকর্তার রহস্য প্রত্যাশী হে মোমেনরা! বস্ত্রহীন সেই অসহায় মানুষকে গোলামী থেকে মুক্ত করা, অনুকষ্টে জর্জরিত বুভুক্ষু আদম সন্তানকে অনুদান করা, ব্যাধিগ্রস্ত, রোগক্লিষ্ট, শক্তিসামর্থহীন, পথের কাংগাল, যারা সকল যামানায় বিত্তশালী ও যুলুমবাজদের হিংস্র ব্যবহারে নিস্পিষ্ট, তাদের উদ্ধারকল্পে এবং মানবতার গৌরবাসনে তাদেরকে পুনরায় সমাসীন করতে তোমরা এগিয়ে এসো । হে মোমেন, মুছে দাও অবহেলিত মানবতার এই নিদারুণ গ্লানি, তবেই তো তুমি রহমানুর রহীমের করুনা ধারা পাবে। মানবতার এই মুক্তি ধারায় যারা সঠিক অবদান রাখতে পেরেছে তাদের জন্য পরবর্তী আশ্বাসবাণী ‘তারপর তারা ওই সকল ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে. সবর করার জন্য ও যথাযথভাবে দুস্থ মানবতার প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার জন্যও একে অপরকে উপদেশ দিচ্ছে ‘। বলা হয়, ‘ফাক্কু রাক্বাবাতিন’ শব্দ দুটির অর্থ দাস বা দাসীকে মুক্ত করায় শরীক হওয়া ‘এতকুন’ অর্থ পুরোপুরি মুক্ত করা। অর্থ যাই হোক না কেন, এক উদ্দেশ্যেই দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয় এবং মূল লক্ষ্যও দুইয়ের একটিই । মক্কায় ইসলামের চরম দুর্দিনে এ আয়াতগুলো নাযিল হয় । ইসলামী শরীয়তের বিধি বিধান চালু করার জন্যে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রক্ষমতা, তখনও রসূলুল্লাহ্‌ (স.)-এর হাতে আসেনি আর সেই সময় সাধারণভাবে আরবের সে সমাজে. দাস-প্রথা চালু ছিলো। আরব-উপদ্বীপের বাইরে অনেক জায়গাতেও এ বিশ্রী প্রথা চালু ছিলো। তখনকার দিনে দাসদেরকে অত্যন্ত কঠিনভাবে খাটানো হতো । তারপর এক সময় তাদের মধ্যে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। যেমন আম্মার ইবনে ইয়াসির ও তার পরিবার, বেলাল ইবনে রাবাহ, সোহায়ব এবং আরও অনেকে (আল্লাহ্‌ তায়ালা এদের সবার ওপর সন্তুষ্ট থাকুন) ৷ এদের দাম্ভিক মনিবরা তাদের ওপর অশেষ নির্যাতন চালাতো। এদের ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদেরকে তাদের শক্তির বাইরে কষ্ট দেয়া হতে লাগলো । তাদের এই দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্ত করার একটিই পথ ছিলো আর তা হলো, তাদের ওই হৃদয়হীন নিষ্ঠুর মনিবদের থেকে তাদেরকে খরিদ করে মুক্ত করে দেয়া । আবু বকর (রা.) ছিলেন সেই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এ ব্যাপারে সবার আগে এগিয়ে আসেন এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রাসূল (স.)-এর মাধ্যমে পাওয়া আল্লাহ্‌র এই ডাকে সাড়া দেন । এই দাস-মুক্তি ও অন্যান্য হুকুম পালনের ব্যাপারে তার সাহসিকতাপূর্ণ কাজ আজও এক নযীরবিহীন দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। ইবনে ইসহাক বলেন, বেলাল ছিলেন আবূ বকরের মুক্ত করা ক্রীতদাস, তিনি যদিও ক্রীতদাস ছিলেন, কিছু দিলেন সাচ্চা মুসলমান । তার মনিব ছিলো উমাইয়া ইবনে খালফ। দুপুরে সূর্যের তাপ যখন অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে যেতো, সেই সময়ে সে তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রখর রৌদ্রের মধ্যে গরম বালির ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিতো! তারপর বিরাট এক পাথর এনে তার বুকের উপর চাপা দিয়ে রাখার জন্য কাউকে হুকুম দিতো ৷ এরপর বলতো, এই অবস্থায় থেকে থেকে তুই মরে যাবি, তবু তোকে ছাড়বো না-যদি মোহাম্মদকে অস্বীকার করে ‘লাত’ ও ‘ওযযাকে’ মাবুদ রূপে গ্রহণ না করিস। এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় তার মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বেরুতে থাকতো, ‘আহাদ, আহাদ ।’ একদিন সেই পথ দিয়ে আবূ বকর (রা.) যাচ্ছিলেন। তখন বেলাল (রা.)-কে এই কঠিন দুরাবস্থায় দেখতে পেলেন। তার বাড়ী ছিলো বনী জামাহ গোত্রের এলাকায় । এই করুণ অবস্থা দেখে তার মন কেঁদে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে তিনি উমাইয়া ইবনে খালফকে বললেন, এই সর্বহারার ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহ্‌কে ভয় করো না? একে মরণ পর্যন্ত এই অবস্থায় রাখতে চাও? এর ওপর আর কতো অত্যাচার করতে চাও? সে বলল, “তুমিই তো একে নষ্ট করেছো, এখন পারলে তুমি এ কষ্ট থেকে ওকে বাঁচাও ।’ তখন আবূ বকর (রা.) বললেন, ঠিক আছে, যা দরকার হয় আমি করবো, আমার কাছে ওর থেকে ভালো ও শক্তিশালী কালো একজন গোলাম আছে এবং সে তোমার ধর্মের অনুসারীও বটে ৷ এর বদলে তাকেই তোমায় দিতে চাই ।’ সে বললো, ‘বেশ আমি রাযী হলাম ।’ আবূ বকর (রা.) বললেন, ‘বহুত আচ্ছা, এখন থেকে সে তোমার৷’ সুতরাং আবু বকর (রা.) তাকে সেই গোলামটি দিয়ে বেলাল (রা.)-কে মুক্ত করেদিলেন। তারপর, মদীনায় হিজরত করার পূর্বে বেলাল (রা.)-এর সাথে ইসলাম গ্রহণ করার কারণে আবু বকর (রা.) আরও ছয়জন গোলামকে আযাদ করেছিলেন । বেলাল (রা.) ছিলেন সপ্তম ব্যক্তি (যাকে ইসলাম গ্রহণের কারণে আযাদ করা হয়েছিলো) ৷ এরা হচ্ছেন ১। আমির ইবনে ফুহায়রাহ্‌ (তিনি বদর যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন এবং বী’রে মাউনা অর্থাৎ মাউনা নামক কূপের কাছে যে প্রচারক দলকে হত্যা করা হয়েছিলো তাদের সাথে থেকে শহীদ হন) ২। উম্মে উবায়েস। ৩। যানীরা (কিংবা যোনায়রা-যাকে আযাদ করার পূর্বেই তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো । তাকে কোরায়শের লোকেরা দেখে বলে উঠেছিলো, ‘লাত ও ওযযা দেবীরাই ওর চোখ নষ্ট করে দিয়েছে৷’ একথা শুনে এ বীরাংগনা মোমেনা বলেছিলেন, বায়তুল্লাহ্‌র (আল্লাহর ঘরের) কসম, ওরা মিথ্যা বলেছে। লাত ও ওযযা না পারে কোনো ক্ষতি করতে আর না পারে কোনো উপকার করতে । এর পরে আল্লাহ্‌ তায়ালা সেই মহীয়সী মহিলার চোখ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । নাহ্‌দিয়াহ্‌ এবং তার কণ্যাকে আযাদ করেছিলেন। এরা দুজনেই বনী আব্দুদ্দার গোত্রের এক মহিলার দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ ছিলেন । একদিন উক্ত মহিলা এদেরকে আটা তৈরী করতে দিয়ে কথা প্রসংগে বলেন, আল্লাহর কসম, তোদের আমি কোনোদিন মুক্তি দেবো না। কথাটি জানতে পেরে আবু বকর (রা.) তাকে অনুরোধের সূরে বলেন, দয়া করে তোমার কসম ফিরিয়ে নাও এবং ওদেরকে মুক্তি দিয়ে দাও! অর্থাৎ তোমার দাসত্বের নিগড় থেকে ওদেরকে দয়া করে আযাদ করে দাও। সে বললো, ‘তুমিই তো ওদের নষ্ট করেছো, এখন তুমি ওদেরকে আযাদ করো ।’ আবূ বকর (রা.) বললেন, ঠিক আছে, ওদের দাম কতো বলো ।’ সে বললো, ‘এতো এবং এতো ।’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি ওদের নিয়ে নিলাম আজ থেকে ওরা মুক্ত স্বাধীন ৷ যাও, সে মহিলাকে তার আটা ফিরিয়ে দিয়ে এসো ।” ওরা বললেন, হে আবু বকর, আমরা ওর আটাটা তৈরী করে দিয়ে আসি ।’ আবূ বকর (রা.) বললেন, ‘এটা তোমাদের খুশী ৷’ সপ্তম ব্যক্তি হচ্ছেন বনি আদি কাবীলার একজন মহিলা, তিনি ছিলেন বনি মোয়াম্মাল গোত্রের অন্তর্ভুক্ত । তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে তাকে ভীষণ কষ্ট দিতেন ৷ এতে করে তিনি ইসলাম পরিত্যাগ করেন৷ একদিন ওমর এ মহিলাকে মারধর করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ওই সময় তিনি বললেন, ‘আমাকে মাফ করো, তোমাকে যারা আমি এই জন্য শুধু বন্ধ করেছি যে, আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ।’ মহিলাটি বললেন, হা আল্লাহ্‌ তায়ালাই আপনাকে ক্লান্ত করে দিয়েছেন । এরপর আবু বকর রা.) তাকেও খরীদ করে মুক্ত করে দেন। ইবনে ইসহাক মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে যোবায়রের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি পরিবারের এক ব্যক্তির কাছে শুনেছেন যে, আবু কোহাফা [আবু বকর (রা.)-এর পিতা] তাকে বলেন, হে আমার ছেলে, আমি দেখছি, তুমি শুধু দুর্বল দাসদেরকে মুক্ত করছো, এমন করলে কি ভালো হতো না যে, কিছু সামর্থবান লোকদেরও আযাদ করতে, তাহলে তারা দরকারে তোমার পাশে দাড়াতো এবং বিপদ-আপদে তোমাকে সাহায্য করতো! আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আব্বা’, আমি যা কিছু করছি তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই করছি।’ এইভাবেই সিদ্দীকে আকবার (রা.) অসহায় কৃতদাসদেরকে মুক্ত করে সেই ‘দুর্ভেদ্য দূর্গম ঘাঁটি পাড়ি দিয়েছিলেন। তিনি এ কাজ করেছেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে । তৎকালীন পরিস্থিতিতে তার এই পদক্ষেপ ও সদয় আচরণ আল্লাহর পথে সে দুর্গম ঘাটি পার হওয়ার ব্যপারে এক অনবদ্য অবদান রেখেছিলো । এ প্রসংগে উল্লেখিত আল্লাহর বাণী, ‘অথবা খাদ্য দান করো দুর্ভিক্ষের দিনে নিকটাত্মীয় ও এতীমদেরকে, অথবা ধূলামলিন, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদেরকে ।’ ‘মাসগাবাতুন’ বলতে বুঝায় জাহেলী যুগের ওই ভীষণ দুর্ভিক্ষের দিনকে, যখন খাদ্যসংকট চরম রূপ নিয়েছিলো, সেই সময়ে অভুক্তদেরকে খাদ্য দানই ছিলো ঈমানের প্রমাণ পেশ করার একটি বড় উপায় । জাহেলী যুগে আরবের এ নিষ্ঠুর পরিবেশে এতীমদের সাথে চরম হৃদয়হীন ব্যবহার করা হতো । তাদের প্রতি যুলুম নির্যাতন, অবিচার অনাচার, সকল সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিলো । এমনকি অতি আপন লোকদের সন্তানরা এতীম হয়ে গেলে তাদের সাথেও এই একই আচরণ করা হতো । এই সময়ে ইয়াতীমদের সাথে সদ্ধ্যবহারের ব্যাপারে কোরআনের বিভিন্ন অধ্যায়ে উপদেশের বিপুল সমাবেশ ঘটেছে। যেগুলো দেখলে সে সমাজে এতীমদের প্রতি যে কি নিদারুণ ব্যবহার করা হতো তা সম্যক উপলদ্ধি করা যায় মাদানী সূরা গুলোতেও মীরাস, ওসিয়ত ও বিয়ে-শাদী সম্পর্কিত আইন প্রবর্তন উপলক্ষে এতীমদের ব্যাপারে বহু উপদেশ এসেছে। বিশেষভাবে সূরা ‘নিসা’ তে এ বিষয়ক আলোচনা প্রচুর । সূরা বাকারা সহ আরও কয়েকটি সূরাতে এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে এ আলোচনা এসেছে। এসেছে অভাবগ্রস্ত ও নিঃস্ব মানব শ্রেণীকে খাদ্য খাওয়ানোর কথা৷ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত সে সব মানুষ, যারা ক্ষুধার জ্বালা ও চরম দুরবস্থার কারণে মাটির সাথে মিশে থাকতো । কোরআন পাকে চরম ‘দুর্ভিক্ষের দিন’ এ খাদ্য দান শব্দটি উল্লেখ করে এ কাজের সাথে ভীষণ কন্টকাকীর্ণ ‘দুর্গম গিরিপথে’ চলার তুলনা করা হয়েছে। কারণ এ দুঃসময়ে সবাই যখন কঠিন দুর্যোগের কবলে পতিত, তখন ত্যাগ-তিতিক্ষা, দয়া-সহানুভূতি, দুঃস্থ মানুষের খোজ-খবর নেয়া ও নিজ প্রয়োজনের ওপর অপরের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দানের মাধ্যমে যে ঈমানী জযবা ফুটে ওঠে এবং একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির আকাংখার উদ্দেশ্যে দাসমুক্তি ও খাদ্য দানের যে বদান্যতার বহিপ্রকাশ ঘটে তা অবশ্যই গভীর ঈমানী চেতনার পরিচয় বহন করে। যদিও অন্যান্য সময়ে এ দুটি গুণ অনেকের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু এ কঠিন সময়ে এ দুটি কাজের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ হয়েছে৷ তারপর এই কঠিন কাজ এ কঠিন সময়ে যারা করতে পেরেছে তারাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেই মোবারক দলে-যারা ঈমান এনেছে এবং একে অপরকে উপদেশ দিয়েছে সবরের ও দয়া প্রদর্শনের । আল্লাহ তায়ালা তার কিতাবে যে বিশেষ বর্ণনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন তারই কারণে সকল শব্দ সকল জায়গায় একইভাবে ব্যবহৃত হয়নি। তাই, ‘সূম্মা’ এখানে সময়-জ্ঞাপক হিসেবে আসেনি, বরং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি এখানে বলতে চাওয়া হচ্ছে এ শব্দটি (অব্যয়টি) যেন সেই কথার-ভূমিকা । এই ভূমিকা দ্বারা এই কথাটি বলতে চাওয়া হচ্ছে যে, ঈমান আনার কারণেই তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সবর করার উৎসাহদান, দয়া, মায়া, মমতা, ভালবাসা বিনিময়ের অভ্যাস গড়ে উঠেছে। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে গভীর বিশ্বাস ও তাঁর প্রিয় হওয়ার প্রবল আকাংখা না থাকলে এই গুণ অর্জন করা সম্ভব নয়। মুল্যবান গোলাম, যার দ্বারা অনেক কাজ পাওয়া যায় এবং আরাম-আয়েশ লাভ করা সম্ভব হয় তাকে মুক্ত করে স্বাধীন করে দেয়া ও কঠিন দুর্দিনে অভাবী মানুষদের খাবার খাওয়ানো পার্থিব দৃষ্টিতে বড় একটা ক্ষতি স্বেচ্ছায় মেনে নেয়ার নামান্তর কিন্তু আখেরাতের বিচার দিনে পাপ-পুণ্য ওযনের পাল্লায় যে এটি বিরাট অবদান রাখবে একথার প্রতি গভীর ও অবিচল ঈমান না থাকলে এ কাজ করা কঠিন । একমাত্র পাক্কা ঈমানদার ব্যক্তিই অনুভব করে যে, এই ত্যাগ স্বীকার ব্যর্থ হবে না এবং এর বিনিময় সেই কঠিন দিনে পাওয়া যাবে আল্লাহ্‌ তায়ালার সন্তুষ্টি আকারে, যা সেদিন তার বড় প্রয়োজন হবে। আল্লাহ তায়ালা যেন বলতে চান, দাসমুক্তি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বন্দীমুক্তি বা ঋণগ্রস্তকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে ঋণ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ করে দেয়! অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অভাবীদেরকে খাওয়ানো, কিংবা বাস্তহারাকে আশ্রয় দান, সর্বোপরি পরিপূর্ণ ঈমানদার হয়ে যাওয়া এবং পরস্পরের মধ্যে সবরের উৎসাহ দান ও দয়া প্রদর্শন করা-এগুলো বড়ই মহৎ গুণ । সুতরাং ‘সুম্মা’ এখানে সম্মান ও মহত্ত্বের গুণকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে। ঈমানদার মানুষের সাধারণ গুণাবলীর মধ্যে সবরের গুণটি এক বিশেষ উপাদান । দুর্গম ঘাটি অতিক্রম করা হচ্ছে একটি বিশিষ্ট গুণ । এসব গুণ অর্জনের জন্য উৎসাহ দান সবরের মর্যাদার ওপর অতিরিক্ত আর এক ধাপ মর্যাদা বয়ে আনে, মোমেনদের দল অবশ্যই এ গুণটির অধিকারী হবে। সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকার জন্য এরা পরস্পরকে উৎসাহ দেবে এবং উপদেশ দান করার মাধ্যমে এ গুণটিকে বাস্তব রূপ দেবে। ঈমানী চেতনাকে কাজে লাগানোর জন্য এই গুণের অধিকারীরা একে অপরের সহযোগিতা করে। সবরের এ গুণটি হচ্ছে এক তীব্র অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ৷ যার দ্বারা ইসলামী দলের লোকেরা পৃথিবীর বুকে ঈমান ও তার দাবী প্রতিষ্ঠার নিরন্তর সংগ্রাম-সাধনায় প্রচুর শক্তি লাভ করে। এ জন্যেই তারা পরস্পরকে সবরের মযবুত বাধনে আবদ্ধ রাখতে চায়। তারা একে অপরকে দৃঢ়তা অবলম্বনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে, যেন কোনো অবস্থাতেই তাদের মধ্যে অস্থিরতা না আসে । এহেন ইসলামী দলের সদস্যরা পরস্পরকে শক্তি যোগায়, যার ফলে এরা জীবনের কোনো অবস্থাতেই হার স্বীকার করে না। একটু চিন্তা করলেই এটা বুঝা সহজ হবে যে, সবরের এই কাজটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কোনো গুণ নয় এটি একটি সামষ্টিক গুণ । তবে হা ব্যাক্তিগতভাবে কারো মধ্যে সবর থাকলে তাও ওই একইভাবে মোমেনদের দলবদ্ধ জীবনে অপরের জন্য উদ্দীপক শক্তি হিসেবে কাজ করে । মানুষের মধ্যে লালিত এ গুণটি তাকে অপমানিত বা লাঞ্চিত করে না, বরং তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তা সহায়ক হয়। তাকে কোনো অপমানজনক পরাজয়ের দিকে এগিয়ে দেয়না, বরং তাকে ‘দুর্গম’ ও কঠিন পথ-পরিক্রমায় শক্তি যোগায় । তার অন্তর মনকে ভয়ে আচ্ছন্ন করে না, বরং তাকে দান করে এমন এক আত্মসম্ভ্রম যার কারণে সে পরম পরিতূপ্তি অনুভব করে। এ ভাবে মোমেনের যিন্দিগীতে পারস্পরিক দয়ামায়া প্রদর্শনের জন্য উৎসাহ দান সমভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। দয়া প্রদর্শনের সাথে সাথে এ গুণটি আর একটি বাড়তি গুণ হিসেবে কাজ করে। দলবদ্ধ যিন্দিগীর প্রতিটি ধাপে দয়া-সহানুভুতির পারস্পরিক বিনিময় সে দলের সদস্যদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে দয়ালু হওয়া ও দয়া প্রদর্শন করার মহৎ গুণ সৃষ্টি করে । এভাবে ব্যক্তি মানুষ থেকে সঞ্চারিত দয়া-সহানুভূতির স্রোতধারা সমষ্টির মনোজগতে এক দুর্জয় প্লাবন আনে। তদুপরি অপরকে উৎসাহ দান করা ব্যক্তিগত গুণের মর্যাদা থেকে উন্নীত করে সামষ্টিক গুণে পরিণত করে। এর ফলে সামষ্টিক জীবনে পরস্পরের মধ্যে পরিচয় বৃদ্ধি পায় এবং একে অপরকে সাহায্য করার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। এ জীবন ব্যাখ্যার মধ্যে জামায়াত বা দলবদ্ধ জীবন যাপন ও দলবদ্ধভাবে কাজ করার কথা প্রচ্ছন্ন রয়েছে। এ দলবদ্ধ  যিন্দিগী সম্পর্কে যেমন কোরআনের বিভিন্ন স্থানে স্পষ্ট কথা এসেছে-হাদীসেও এ বিষয়ে পরিষ্কার বর্ণনা এসেছে, যাতে করে দ্বীন ইসলামের মূল উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে দলের প্রয়োজন যথাযথভাবে অনুভূত হয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হচ্ছে গোটা মানবমন্ডলীর সুখশান্তি সমৃদ্ধির প্রয়োজনে প্রদত্ত একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা । এখানে ব্যক্তির স্বার্থ ও প্রয়োজনকে পুরোপুরি অক্ষুন্ন রেখেই সমষ্টির নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসা এই জনতাই ‘দুর্গম পথ’ অতিক্রম করবে৷ এদের সম্পর্কেই কোরআনে পাকে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। বলা হচ্ছে, ‘ওরাই ডানপন্থী যারা যুক্তিপূর্ণ ও সঠিক পথের শান্তিকামী যাত্রী ।’ এভাবে কোরআনের আরও বিভিন্ন স্থানে এই ডানপন্থী লোকদের গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। এদের কথা বলা হয়েছে যে, এরা দক্ষিণপন্থী, এরাই সাফল্য ও সৌভাগ্যের অধিকারী ৷ ওপরে বর্ণিত উভয় অর্থই ঈমানী যিন্দিগীর সাথে সামঞ্জস্যশীল । ‘আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ, আমার আয়াতগুলোতে যথাযথ বিবৃত এবং সুস্পষ্ট বর্ণিত করা ও নিশ্চিত সত্য সমাগত হওয়ার পর তাকে অস্বীকার করে যারা কুফরী করেছে তারাই হচ্ছে বামপন্থী, তাদের জন্যই রয়েছে আটকে রাখা আগুন যা তাদেরকে ঘেরাও করে রাখবে ।’ এখানে এসে বামপন্থীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে নীচের এই কথাটি ছাড়া অন্য কোনো গুণ বর্ণিত হয়নি। ‘আমার আয়াতগুলোকে যারা অস্বীকার করেছে; কারণ অস্বীকার করার এই খাসলতটি উদ্দেশ্যের দিকে ও সঠিক লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পথে বিরাট অন্তরায় । সূতরাং কুফর বা অস্বীকৃতির সাথে কোনো কল্যাণ বা ‘ভালো’র কোনো সম্পর্ক নেই। আর ‘কুফরী’ থেকে নিকৃষ্ট জিনিস আর কিছু নেই। সব মন্দ এই কুফরীর মধ্যেই নিহিত ৷ (প্রচলিত পরিভাষায় ডানপন্থী ও দক্ষিণপন্থী বলতে যা বুঝায় কোরআনে বর্ণিত এ পরিভাষার সাথে কিন্তু এর কোনো সম্পর্ক নেই-কোরআনে নেককাজকে মাঝে মাঝে ‘ডান বা দক্ষিন’ বলে পেশ করা হয়েছে ।-সম্পাদক) এরাই হচ্ছে বামপন্থী হতভাগার দল । বামপন্থী বা হতাশাবাদী হওয়ার কারণে এরা চরমভাবে অধপতিত । এরা ‘দুর্গম ঘাটির’ অপর প্রান্তে অবস্থান করবে, ঘাটি পাড়ি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌছানো এদের পক্ষে সম্ভব নয়। ‘এদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে আবদ্ধ করে রাখা আগুন ।’ অর্থাৎ এমন আগুন যা তাদেরকে ঘিরে রাখবে । এর অর্থ এটাও হতে পারে যে, যখন তারা দোযখের আগুনে শাস্তি পেতে থাকবে, তখন তার দরজাগুলো বন্ধ থাকার কারণে তার তাপ বের হওয়ার কোনো রাস্তা থাকবে না, অথবা এর অন্য অর্থ এটা হতে পারে যে, ওরা. সে আযাবের জায়গা থেকে কোনোভাবেই আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। কেননা আল্লাহরই হুকুমে ও ব্যবস্থাপনায় তাদের ওখানে আবদ্ধ থাকা । অতএব, সে প্রতিবন্ধকতা দূর করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অবশ্য দুটি অর্থ একে অন্যের পরিপূরক-বিরোধী নয়। এই স্বল্প পরিসরে মানুষের সীমিত শক্তি ও ব্যাখ্যার যোগ্যতায় উপস্থাপিত এগুলোই হচ্ছে মানব-জীবনের মৌলিক সত্য, যা ঈমানী দৃষ্টিকোন থেকে নির্ধারিত হয়ে আছে এবং এগুলো কোরআনের বিশেষ বর্ণনাভংগি ও একক ব্যখ্যায় বর্ণিত চরম সত্য।

Leave a Reply