Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২০৭ : হে মানুষ:-১৭)
[# বক্ষকে প্রশস্ত করা:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯৪ : সুরা: আলাম নাশরাহ
পারা:৩০
১-৮ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আলাম নাশরাহ
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:৯৪
(৯৪-আলাম নাশরাহ) : নামকরণ:
সূরার প্রথম শব্দ দু’টিকেই এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(৯৪-আলাম নাশরাহ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
সূরা আদ দুহার সাথে এর বিষয়বস্তুর গভীর মিল দেখা যায়। এ থেকে মনে হয় এ সূরা দু’টি প্রায় একই সময়ে একই অবস্থার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মক্কা মু’আযযমায় আদ্ দুহার পরেই এই সূরাটি নাযিল হয়।
(৯৪-আলাম নাশরাহ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এ সূরাটির উদ্দেশ্যও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত্বনা দান করা। নবুয়াত লাভ করার পর ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করার সাথে সাথেই তাঁকে যেসব অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, নবুয়াত লাভের আগে তাঁকে কখনো তেমনি অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়নি। তাঁর নিজের জীবনে এটি ছিল একটি মহাবিপ্লব। নবুয়াতে পূর্ব জীবনে এ ধরনের কোন বিপ্লবের ধারণা ছিল না। তিনি ইসলাম প্রচারে কাজ শুরু করার সাথে সাথেই দেখতে দেখতে সমগ্র সমাজ তাঁর দুশমন হয়ে যায়। অথচ পূর্বে এই সমাজে তাঁকে বড়ই মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হতো।যেসব আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, গোত্রীয় লোকজন ও মহল্লাবাসী ইতিপূর্বে তাঁকে মাথায় তুলে রাখতো তারাই এখন তাঁকে গালিগালাজ করতে থাকে। মক্কার এখন আর কেউ তাঁর কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। পথে তাঁকে দেখলে লোকেরা শিস দিতো, যা তা মন্তব্য করতো। প্রতি পদে পদে তিনি সংকটের সম্মুখীন হতে থাকেন। যদিও ধীরে ধীরে এসব অবস্থার মোকাবেলা করতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তবুও এই প্রথম দিকের দিনগুলো তাঁর জন্য ছিল বড়ই কঠিন এবং এগুলো তাঁর মনোবল ভেঙ্গে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এ জন্য তাঁকে সান্ত্বনা দেবার উদ্দেশ্যে প্রথমে সূরা আদ দুহা এবং পরে এই সূরাটি নাযিল হয়।
এই সূরায় মহান আল্লাহ প্রথমেই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন; আমি তোমাকে তিনটি বিরাট বিরাট নিয়ামত দান করেছি। এগুলোর উপস্থিতিতে তোমার মানসিক দিক দিয়ে ভেঙ্গে পড়ার কোন কারণ নেই। তার মধ্যে একটি হচ্ছে হৃদয়দেশ উন্মুক্ত করে দেয়ার নিয়ামত। দ্বিতীয় নিয়ামতটি হচ্ছে, নবুয়াত লাভের পূর্বে যে ভারী বোঝা তোমার কোমর ভেঙ্গে দিচ্ছিল তা কি আমি তোমার ওপর থেকে নামিয়ে দেইনি ? তৃতীয়টি হচ্ছে, সুনাম ও সুখ্যাতিকে উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত করার নিয়ামত। এই নিয়ামতটি তাঁর চেয়ে বেশী আর কাউকে দেয়া তো দূরের কথা তাঁর সমানও কাউকে কখনো দেয়া হয়নি। সামনের দিকের ব্যাখ্যার আমি এ তিনটি নিয়ামত বলতে কি বুঝানো হয়েছে এবং এগুলো কত বড় নিয়ামত ছিল তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি।
এরপর বিশ্ব- জাহানের প্রভু তাঁর বান্দা ও রসূলকে এই মর্মে নিশ্চিন্ততা দান করেছেন যে, সমস্যা ও সংকটের যে যুগের মধ্য দিয়ে তুমি এগিয়ে চলছো এটা কোন সুদীর্ঘ যুগ নয়। বরং এখানে সমস্যা, সংকট ও সংকীর্ণতার সাথে সাথে প্রশস্ততার যুগও চলে আসছে। এই এক কথাই সূরা আদ্ দুহায় এভাবে বলা হয়েছে: তোমার জন্য প্রত্যেকটি পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো হবে এবং শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এমন সবকিছু দেবেন যাতে তোমার মন খুশীতে ভরে যাবে।
সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, প্রাথমিক যুগের এসব কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করার শক্তি তোমার মধ্যে সৃষ্টি হবে একটি মাত্র জিনিসের সাহায্যে। সেটি হচ্ছে: নিজের কাজ-কর্ম থেকে ফুরসত পাবার সাথে সাথেই তুমি পরিশ্রম পূর্ণ ইবাদাত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত হয়ে যাও। আর সমস্ত জিনিসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের রবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করো এটি সেই একই উপদেশের পুনরাবৃত্তি যা সূরা মুয্যামমিলের ৯ আয়াতে আরো বেশী বিস্তারিতভাবে তাঁকে দান করা হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এই সূরাটি কোরআনের ৯৪নং সূরা। সূরা আদ দোহার পরপরই এ সূরাটি নাযিল হয়েছে এবং সত্য বলতে কি এটি যেন সূরা দোহারই পরিপূরক । এ সূরার মধ্যে ফুটে উঠেছে নবী করীম (স.)-এর জন্যে আল্লাহর দরদ ও মহব্বত । পুরা সূরাটি জুড়ে রয়েছে অতি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে উপস্থাপিত একটি মনোজ্ঞ আলোচনা । এর মধ্যে রসূলের প্রতি আল্লাহর যত্ন ও সজাগ দৃষ্টি রাখা সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রসূলুল্লাহ (স.)-কে অনাগত দিনের সুসংবাদ দান করা হয়েছে। বলা হয়েছে তার সংকট কেটে উঠবে এবং যাবতীয় সমস্যা দূরীভূত হয়ে সহজ ও সুন্দর দিনের দেখা পাওয়া যাবে। সূরাটির মধ্যে সহজ জীবন যাপনের মূল রহস্য ফুটে উঠেছে, আল্লাহর সাথে তার সম্পর্কের দৃঢ়তা সম্পর্কিত বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,
اَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَۙ
হে নবী! আমি কি তোমার বক্ষদেশ তোমার জন্য উন্মুক্ত করে দেইনি?১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) এ প্রশ্নটি সহকারে বক্তব্য শুরু করায় এবং এর পরবর্তী বক্তব্য যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে তা থেকে প্রকাশ হয় ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করার পর প্রথম যুগে রসূলুল্লাহ ﷺ যেসব কঠিন বিপদ ও সমস্যার সম্মুখীন হন সেগুলো তাঁকে ভীষণভাবে পেরেশান করে রেখেছিল। এ অবস্থায় আল্লাহ তাকে সম্বোধন করে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, হে নবী! আমি কি তোমার প্রতি অমুক অমুক মেহেরবানী করিনি? তাহলে এই প্রাথমিক সংকটগুলোর মুখোমুখি হয়ে তুমি পেরেশান হচ্ছো কেন? কুরআন মজীদের যেসব জায়গায় বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দেবার শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে সেগুলোর দু’টি অর্থ জানা যায়।
এক, সরা আন’আমের ১২৫ আয়াতে বলা হয়েছেঃ
َفَمَنۡ يُّرِدِ اللّٰهُ اَنۡ يَّهۡدِيَهٗ يَشۡرَحۡ صَدۡرَهٗ لِلۡاِسۡلَامِۚ
“কাজেই যে ব্যক্তিকে আল্লাহ হেদায়াত দান করার সংকল্প করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।” আর সূরা যুমারের ২২ আয়াতে বলা হয়েছেঃ
اَفَمَنۡ شَرَحَ اللّٰهُ صَدۡرَهٗ لِلۡاِسۡلٰمِ فَهُوَ عَلٰى نُوۡرٍ مِّنۡ رَّبِّهٖؕ
“তাহলে কি যার বক্ষদেশ আল্লাহ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, তারপর যে তার রবের পক্ষ থেকে একটি আলোর দিকে চলছে———?
এই উভয় স্থানে বক্ষদেশ উন্মুক্ত করার অর্থই হচ্ছে, সব রকমের মানসিক অশান্তি ও সংশয় মুক্ত হয়ে একথার ওপর নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া যে, ইসলামের পথই একমাত্র সত্য এবং ইসলাম মানুষকে যে আকীদা-বিশ্বাস, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও নৈতিকতার যে মূলনীতি এবং যে হেদায়াত ও বিধিবিধান দান করেছে তা সম্পূর্ণ সঠিক ও নির্ভুল।
দুই, সূরা শু’আরার ১২-১৩ আয়াতে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ যখন হযরত মূসাকে নবুওয়াতের মহান দায়িত্বে নিযুক্ত করে ফেরাউন ও তার বিশাল সাম্রাজ্যের সাথে সংঘাত সংঘর্ষের হুকুম দিচ্ছিলেন তখন হযরত মূসা (আ) আরয করেনঃ
رَبِّ اِنِّىۡۤ اَخَافُ اَنۡ يُّكَذِّبُوۡنِوَيَضِيۡقُ صَدۡرِىۡ
“হে আমার রব! আমার ভয় হচ্ছে তারা আমাকে মিথ্যা বলবে এবং আমার বক্ষদেশ সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।”
আর সূরা ত্বা-হা’র ২৫-২৬ আয়াতে বলা হয়েছেঃ
قَالَ رَبِّ اشۡرَحۡ لِىۡ صَدۡرِىۙ وَيَسِّرۡ لِىۡۤ اَمۡرِىۙ
“হে আমার রব! আমার বক্ষদেশ আমার জন্য খুলে দাও এবং আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও।” এখানে সংকীর্ণতার মানে হচ্ছে, নবুওয়াতের মতো একটি মহান দায়িত্ব সম্পাদন করার এবং একটি অতি পরাক্রমশালী কুফরী শক্তির সাথে একাকী সংঘর্ষ মুখর হবার হিম্মত মানুষের হয় না। আর বক্ষদেশের প্রশস্ততার মানে হচ্ছে, হিম্মত বুলন্দ হওয়া, কোন বৃহত্তর অভিযান অগ্রসর হওয়াও কোন কঠিনতর কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে ইতস্তত না করা এবং নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব পালন করার হিম্মত সৃষ্টি হওয়া।
একটু চিন্তা করলে এ বিষয়টি অনুভব করা যায় যে, এই আয়াতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দেবার এ দু’টি অর্থই প্রযোজ্য। প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে এর মানে হয়, নবুওয়াত লাভের পূর্বে রসূলুল্লাহ ﷺ আরবের মুশরিক, খৃস্টান, ইহুদী, অগ্নি উপাসক সবার ধর্মকে মিথ্যা মনে করতেন আবার আরবের কোন কোন তাওহীদের দাবীদারের মধ্যে যে ‘হানীফী ’ ধর্মের প্রচলন ছিল তার প্রতিও তিনি আস্থাশীল ছিলেন না। কারণ এটি ছিল একটি অস্পষ্ট আকীদা। এখানে সঠিক পথের কোন বিস্তারিত চেহারা দেখা যেতো না। (তাফহীমুল কুরআন, সূরা আস সাজদার ৫ টীকায় আমি এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি।) কিন্তু তিনি নিজে যেহেতু সঠিক পথ জানতেন না তাই মারাত্মক ধরনের মানসিক সংশয়ে ভুগছিলেন। নবুওয়াত দান করে আল্লাহ তাঁর এই সংশয় দূর করেন। তাঁর সামনে সঠিক পথ উন্মুক্ত করে মেলে ধরেন। এর ফলে তিনি পূর্ণ মানসিক নিশ্চিন্ততা ও প্রশান্তি লাভ করেন। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর মানে হয়, নবুওয়াত দান করার সাথে সাথে এই মহান দায়িত্বের বোঝা উঠাবার জন্য যে ধরনের মনোবল, সাহস, সংকল্পের দৃঢ়তা এবং মানসিক উদারতা ও প্রশস্ততার প্রয়োজন তা আল্লাহ তাঁকে দান করেন। তিনি এমন বিপুল ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হন, যা তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন মানুষের মধ্যে স্থিতি লাভ করতে পারতো না। তিনি এমন বাস্তব বুদ্ধি ও কলাকৌশলের অধিকারী হন, যা বৃহত্তম বিকৃতি দূর ও সংশোধন করার যোগ্যতা রাখতো। তিনি জাহেলিয়াতের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকা এবং নিরেট মূর্খ ও অজ্ঞ সমাজে কোনো প্রকার সহায় সম্বল ও বাহ্যত কোন পৃষ্ঠপোষকতাহীন শক্তির সহায়তা ছাড়াই ইসলামের পতাকাবাহী হয়ে দাঁড়িয়ে যাবার, বিরোধিতা ও শত্রুতার বড় বড় তুফানের মোকাবেলায় ইতস্তত না করার এবং এই পথে যেসব কষ্ট ও বিপদ আপদ আসে সবরের সাথে তা বরদাশত করার যোগ্যতা অর্জন করেন। কোন শক্তিই তাঁকে নিজের অবস্থান থেকে এক বিন্দু সরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখতো না। এই বক্ষদেশ উন্মোচন এবং হৃদয়ের অঙ্গন প্রশস্ত করার অমূল্য সম্পদ যখন তাঁকে দান করা হয়েছে তখন কাজের সূচনা লগ্নে যেসব সমস্যা সংকল্প-বিপদ-কষ্ট দেখা দিয়েছে তাতে তিনি মর্মাহত হচ্ছেন কেন?
কোন কোন তাফসীরকার বক্ষদেশ উন্মুক্ত করাকে বক্ষ বিদীর্ণ করা অর্থে গ্রহণ করেছেন। মূলত এই মু’জিযাটির প্রমাণ হাদীস নির্ভর। কুরআন থেকে এর প্রমাণ পেশ করার চেষ্টা করা ঠিক নয়। আরবী ভাষার দিক দিয়ে বক্ষদেশ উন্মুক্ত করাকে (شرح صدر ) কোনভাবেই বক্ষবিদীর্ণ করার (شك صدر ) অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে না। আল্লামা আলূসী রুহুল মা’আনী গ্রন্থে বলেনঃ
حمل الشرح فى الا يه على شق الصدر ضعيف عند المحققين
“গবেষক আলেমগণের মতে এই আয়াতে উন্মুক্ত করাকে বক্ষবিদীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা একটি দুর্বল কথা ছাড়া আর কিছুই নয়”
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-2
وَ وَضَعْنَا عَنْكَ وِزْرَكَۙ
আমি তোমার ওপর থেকে ভারী বোঝা নামিয়ে দিয়েছি,
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-3
টিকা নং:2,
الَّذِیْۤ اَنْقَضَ ظَهْرَكَۙ
যা তোমার কোমর ভেঙ্গে দিচ্ছিল।২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:২) কোন কোন মুফাসসির এর অর্থ এভাবে নিয়েছেন যে, নবুওয়াত পূর্ব জাহেলী যুগে নবী ﷺ এমন কিছু ত্রুটি করেছিলেন যেগুলোর চিন্তায় তিনি অত্যন্ত পেরেশান থাকতেন এবং যেগুলো তাঁর কাছে অত্যন্ত ভারী মনে হতো। এই আয়াতটি নাযিল করে আল্লাহ তাঁর এই ত্রুটি মাফ করে দিয়েছেন বলে তাঁকে নিশ্চিন্ত করে দেন। কিন্তু আমার মতে, এখানে এই অর্থ গ্রহণ করা এক মারাত্মক পর্যায়ের ভুল। প্রথমত “বিযরুন (وزر ) শব্দের অর্থ যে অবশ্যই গোনাহ হতে হবে তা নয়। বরং ভারী বোঝা অর্থেও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তাই অযথা একে খারাপ অর্থে গ্রহণ করার কোন কারণ নেই দ্বিতীয়ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত পূর্ব জীবনও এত বেশী পাক পরিচ্ছন্ন ছিল যার ফলে কুরআন মজীদের বিরোধীদের সামনে তাকে একটি চ্যালঞ্জ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তাই কাফেরদেরকে সম্বোধন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ দিয়ে একথা বলানো হয়েছেঃ فَقَدۡ لَبِثۡتُ فِيۡكُمۡ عُمُرًا مِّنۡ قَبۡلِهٖؕ “এই কুরআন পেশ করার আগে তোমাদের মধ্যে আমি জীবনের একটি বিরাট অংশ অতিবাহিত করেছি।” (ইউনুস ১৬ আয়াত ) আবার সবাইকে লুকিয়ে গোপনে গোপনে একটি গোনাহ করবেন এমন ধরনের লোকও তিনি ছিলেন না। (নাউযুবিল্লাহ) এমনটি যদি হতো, তাহলে আল্লাহ সে সম্পর্কে অনবহিত থাকতেন না এবং নিজের চরিত্রে গোপন কলঙ্ক বহন করে ফিরছেন এমন এক ব্যক্তির মুখ দিয়ে সর্ব সম্মুখে সূরা ইউনুসের পূর্বোল্লিখিত আয়াতে যে কথা বলা হয়েছে তা বলাতেন না। কাজেই আসলে এই আয়াতে “বিযর” শব্দের সঠিক অর্থ হচ্ছে ভারী বোঝা। আর এই ভারী বোঝা বলতে নিজের জাতির মূর্খতা ও জাহেলী কর্মকাণ্ড দেখে তাঁর অনুভূতিপ্রবণ মন যেভাবে দুঃখ, ব্যাথা, কষ্ট, দুশ্চিন্তা ও মর্মবেদানায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল তাই এখানে বুঝানো হয়েছে। তিনি দেখছিলেন লোকেরা হাতে বানানো মূর্তির পূজা করছে। চারদিকে শিরক ও শিরক উৎপাদিত কল্পনাবাদ ও কুসংস্কারের ছড়াছড়ি নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা ও নৈতিক চরিত্রের অবনতি গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। সমাজে জুলুম, নিপীড়ন ও লেনদেনের ক্ষেত্রে বিপর্যয় ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। শক্তিশালীদের পাঞ্জার নীচে শক্তিহীনরা পিষে মরছিল। মেয়েদের জীবন্ত কবর দেয়া হচ্ছিল। এক গোত্র অন্য গোত্রের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে লুটতরাজ করতো। কোন কোন ক্ষেত্রে শত শত বছর পর্যন্ত চলতো প্রতিশোধমূলক লড়াইয়ের জের। কারো পেছনে শক্তিশালী দলীয় শক্তি ও মজবুত জনবল না থাকলে তার ধন, প্রাণ ইজ্জত, আবরু সংরক্ষিত থাকতো না। এই অবস্থা দেখে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ ও মর্মাহত হতেন। কিন্তু এই গলদ দূর করার কোন পথই তিনি দেখছিলেন না। এই চিন্তাই তাঁর কোমর ভেঙ্গে দিচ্ছিল। মহান আল্লাহ হেদায়াতের পথ দেখিয়ে এই বিরাট বোঝা তাঁর ওপর থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। নবুওয়াতের দায়িত্ব সমাসীন হতেই তিনি জানতে পেরেছিলেন, তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের ওপর ঈমান আনাই এমন একটি চাবিকাঠি যা দিয়ে মানব জীবনের সব রকমের বিকৃতির তালা খোলা যেতে পারে এবং জীবনের সব দিকে সংশোধনের পথ পরিষ্কার করা যেতে পারে। মহান আল্লাহর এই পথনির্দেশনা তাঁর মানসিক দুশ্চিন্তার সমস্ত বোঝা হালকা করে দিয়েছিল। এর মাধ্যমে তিনি কেবল আরবের নয় বরং আরবের বাইরে ও সমগ্র দুনিয়ার মানব সমাজ যেসব অন্যায় ও দুষ্কৃতিতে লিপ্ত ছিল তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করতে পারবেন বলে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলেন।
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-4
টিকা নং:3,
وَ رَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَؕ
আর তোমার জন্য তোমার খ্যাতির কথা বুলন্দ করে দিয়েছি।৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) যে সময় একথা বলা হয়েছিল তখন কেউ কল্পনাও করতে পারতো না যে, মাত্র হাতেগোণা কয়েকজন লোক যে ব্যক্তির সঙ্গী হয়েছে এবং কেবলমাত্র মক্কা শহরের মধ্যে যার সমস্ত কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ, তাঁর আওয়াজ আবার কেমন করে সারা দুনিয়ায় বুলুন্দ হবে এবং কোন্ ধরনের খ্যাতিইবা তিনি অর্জন করবেন। কিন্তু এই অবস্থায় আল্লাহ তাঁর রসূলকে এ সুসংবাদ দিলেন এবং অদ্ভুত পদ্ধতিতে তা বাস্তবায়িতও করলেন। সর্বপ্রথম তাঁর নাম বুলন্দ ও তাঁর চর্চাব্যাপক করার কাজ সম্পন্ন করলেন তিনি তাঁর শত্রুদের সাহায্যে। মক্কার কাফেররা তার ক্ষতি করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করলো। এর মধ্যে একটি পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপঃ হজ্জের সময় আরবের সমগ্র এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক লোক মক্কা শহরে জমায়েত হতো। এ সময় কাফেরদের প্রতিনিধি দল হাজীদের প্রত্যেকটি তাঁবুতে যেতো এবং তাদেরকে এই মর্মে সতর্ক করে দিতো যে, এখানে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামে একজন ভয়ংকর লোকের আবির্ভাব হয়েছে। তিনি লোকদের ওপর এমনভাবে যাদু করেন যার ফলে পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কাজেই আপনারা তার সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলবেন। হজ্জের মওসুম ছাড়া অন্যান্য দিনেও যারা কাবা শরীফ হিযরত করতে আসতো অথবা ব্যবসায় উপলক্ষে যারা মক্কায় আসতো তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে দুর্নাম রটাতো কিন্তু এর ফলে আরবের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায়ও তাঁর নাম পৌঁছে গেলো। মক্কার অপরিচিত গণ্ডীর ভেতর থেকে বের করে এনে শত্রুরাই সারা আরব দেশের বিভিন্ন গোত্রর সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিল। এরপর লোকদের মনে এই প্রশ্ন জাগা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, এই লোকটি কে? কি বলতে চায়? সে কেমন লোক? তার যাদুতে কারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং তাদের ওপর তার যাদুর কি প্রভাব পড়ছে? মক্কার কাফেরদের প্রচারণা যত বেশী বেড়েছে লোকদের মধ্যে এই জানার আগ্রহ তত বেশী বেড়েছে। তারপর অনুসন্ধানের মাধ্যমে লোকেরা তাঁকে জেনেছে। তাঁর চরিত্র ও কাজ-কারবারের সাথে পরিচিত হয়েছে। লোকেরা কুরআন শুনেছে। তিনি যেসব বিষয় পেশ করছেন সেগুলো জেনেছে। যখন তারা দেখলো, যে জিনিসকে যাদু বলা হচ্ছে, তাতে যারা প্রভাবিত হয়েছে তাদের জীবন ধারা আরবের সাধারণ লোকদের জীবনধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে, তখন দুর্নাম সুনামে রূপান্তরিত হয়ে যেতে লাগলো। এমন কি হিজরতের আগেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেলো যার ফলে দূরের ও কাছের এমন কোন আরব গোত্রই ছিল না যার কোন না কোন লোক বা পুরা পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং যার কিছু কিছু লোক রসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর দাওয়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল ও আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। এটি ছিল তাঁর খ্যাতির কথা বুলন্দ হবার প্রথম পর্যায়। এরপর হিজরতের পর থেকে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়ে গেলো। এর মধ্যে একদিকে মোনাফেক, ইহুদি ও সমগ্র আরবের মুশরিক প্রধানরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুর্নাম রটাতে তৎপর হয়ে উঠলো এবং অন্যদিকে মদীনা তাইয়েবার ইসলামী রাষ্ট্রটি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আল্লাহ ভীতি, তাকওয়া, ইবাদাত, বন্দেগী, চারিত্রিক পরিচ্ছন্নতা, সুষ্ঠু সামাজিকতা, ইনসাফ, ন্যায়নিষ্ঠা, মানবিক সাম্য, ধনীদের বদান্যতা, গরীবদেরকে সাহায্য সহায়তা দান, অঙ্গীকার ও শপথ রক্ষা এবং মানুষের সাথে ব্যবহার ও লেনদেনের ক্ষেত্রে সততার এমন বাস্তব নমুনা পেশ করছিল, যা মানুষের হৃদয় জয় করে চলছিল। শত্রুরা যুদ্ধের মাধ্যমে তাঁর এই বর্ধিষ্ণু প্রভাব বিলীন করতে চাইলো। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে ঈমানদারদের শক্তিশালী জামায়াত তৈরী হয়েছিল। নিয়ম-শৃংখলা, বীরত্ব সাহসিকতা, মৃত্যুকে ভয় না করা এবং যুদ্ধাবস্থায়ও নৈতিক সীমারেখাকে কঠোরভাবে মেনে চলার মাধ্যমে জামায়াত নিজের শ্রেষ্ঠত্ব এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল যার ফলে সমগ্র আরব তার প্রভাবাধীন হয়ে গেলো। দশ বছরের মধ্যে তাঁর খ্যাতির কথা বুলন্দ হয়ে গেল। অর্থাৎ যে দেশে তাঁর বিরোধীরা তাঁকে বদনাম করার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল তার সমগ্র এলাকায় এবং প্রত্যন্ত প্রদেশে ও সর্বত্র “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” এর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। তারপর এই তৃতীয় পর্যায়টি শুরু হলো খোলাফায়ে রাশেদার শাসনামল থেকে। সে সময় তাঁর মুবারক নাম সারা দুনিয়ায় উচ্চারিত হতে লাগলো। এই সিলসিলাটি আজ পর্যন্ত বেড়েই চলছে। ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত বেড়ে যেতেই থাকবে। দুনিয়ার এমন কোন জায়গা নেই যেখানে মুসলমানদের কোন জনপদ নেই এবং দিনের মধ্যে পাঁচবার আযানের মধ্যে বুলন্দ আওয়াজে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সালাতের ঘোষণা করা হচ্ছে না, নামাযে রসূলুল্লাহ ﷺ ওপর দুরূদ পড়া হচ্ছে না, জুম’আর খুতবায় তাঁর পবিত্র নাম পাঠ করা হচ্ছে না এবং বছরের বারো মাসের মধ্যেকোন সময় এমন নেই যখন সারা দুনিয়ার কোন না কোন জায়গায় তাঁর মুবারক নাম উচ্চারিত হচ্ছে না। নবুওয়াতের প্রাথমিক যুগে যখন আল্লাহ বলেছিলেন (وَرَفَعۡنَا لَكَ ذِكۡرَكَؕ ) (আর তোমার নাম ও খ্যাতির কথা আমি বুলন্দ করে দিয়েছি অর্থাৎ অত্যন্ত ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করেছি।) তখন কেউ একথা অনুমানই করতে পারতো না যে, এমন সাড়স্বরে ও ব্যাপকভাবে এই নাম বুলন্দ করার কাজটি সম্পন্ন হবে। এটি কুরআনের সত্যতার একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ জিব্রীল আমার কাছে আসেন। আমাকে বলেন, আমার রব ও আপনার রব জিজ্ঞেস করছেনঃ আমি কিভাবে তোমার নাম বুলন্দ (رَفَعَذِكۡرَ ) করেছি? আমি আরজ করি, আল্লাহ ভালো জানেন। তিনি বলেন, আল্লাহর উক্তি হচ্ছেঃ যখন আমার নাম বলা হয় তখন সেই সাথে তোমার নামও বলা হবে।”(ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম, মুসনাদে আবু লাইলা, ইবনুল মুনযির, ইবনে হিব্বান, ইবনে মারদুইয়া ও আবু নু ’আইম) পরবর্তীকালের সমগ্র ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, একথাটি অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হয়েছে।
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-5
فَاِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًاۙ
প্রকৃত কথা এই যে, সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও রয়েছে।
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-6
টিকা নং:4,
اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًاؕ
আসলে সংকীর্ণতার সাথে আছে প্রশস্ততাও।৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) একথাটি দু’বার বলা হয়েছে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পুরোপুরি সান্ত্বনা দেয়াই এর উদ্দেশ্য। সে সময় তিনি যে কঠিন অবস্থা ও পর্যায় অতিক্রম করেছিলেন তা বেশীক্ষণ স্থায়ী থাকবে না বরং এরপর শিগগির ভালো অবস্থা শুরু হবে, একথা তাঁকে বুঝিয়ে দেয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য। আপাত দৃষ্টিতে সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততা এবং দারিদ্র্যের সাথে সচ্ছলতা এ দু’টি পরস্পর বিরোধী জিনিস একই সময় একসাথে জমা হতে পারে না। কিন্তু তবুও সংকীর্ণতার পর প্রশস্ততা না বলে সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততা এই অর্থে বলা হয়েছে যে, প্রশস্ততার যুগ এত বেশী নিকটবর্তী যেন মনে হয় সে তার সাথেই চলে আসছে।
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-7
فَاِذَا فَرَغْتَ فَانْصَبْۙ
কাজেই যখনই অবসর পাও ইবাদাতের কঠোর শ্রমে লেগে যাও
সুরা: আলাম নাশরাহ
আয়াত নং :-8
টিকা নং:5,
وَ اِلٰى رَبِّكَ فَارْغَبْ۠
এবং নিজের রবেরই প্রতি মনোযোগ দাও।৫
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) অবসর পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, নিজের কাজকাম থেকে অবসর পাওয়া, তা ইসলামের দাওয়াত দেয়া ও ইসলাম প্রচারের কাজ হতে পারে বা ইসলাম গ্রহণকারীদেরকে শিক্ষা ও তরবিয়ত দানের কাজও হতে পারে অথবা নিজের ঘরের ও বাইরের বৈষয়িক কাজও হতে পারে। এই নির্দেশটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, যখন আর কোনো কাজ থাকবে না তখন নিজের অবসর সময়টুকু ইবাদাতের পরিশ্রম ও সাধনায় ব্যয় করো এবং সবদিক থেকে দৃষ্টি ও মনোযোগ ফিরিয়ে এনে একমাত্র নিজের রবের প্রতি মনোযোগী হয়ে যাও।
ফী জিলালিল কুরআন:
এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তোমার বুককে তোমার জন্য খুলে দেইনি এবং যে গুরুভার তোমার পিঠকে ঝুঁকিয়ে দিচ্ছিলো! তা কি আমি লাঘব করে দেইনি? আর তোমার (সম্মান বৃদ্ধির) জন্য তোমার স্মরণকে কি আমি ওপরে তুলিনি?’ এ কথাগুলো দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, আদর্শের প্রচার প্রসারকল্পে সে সময় রসূলুল্লাহ (স.)-এর অন্তর-প্রাণ বড় কষ্টের মধ্যে ছিলো । যে দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছিলো তার মিশনের অগ্রগতির পথে যে ভীষণ বাধা-বিপত্তি আসছিলো, দ্বীনের এ দাওয়াতকে, ইসলামের উদাত্ত আহবানকে স্তব্ধ করার জন্য চতুর্দিকে যে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয়েছিলো তা যেন তাঁকে মুষড়ে ফেলতে চাইছিলো । তিনি অনুভব করছিলেন যেন তার পিঠ ওই কঠিন অবস্থার চাপে ভেংগে যাচ্ছে। এগুলোই ছিলো মূলত সে বোঝা, যা তার পিঠকে ভেংগে দিচ্ছিলো, আর এই চিন্তাতেই তার বুক ভারাক্রান্ত ছিলো। এমতাবস্থায় তিনি একান্তভাবে কারো সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন । এই দুর্গম পথের পথিক অনুভব করছিলেন যে, তার কিছু বলিষ্ঠ পাথেয়র প্রয়োজন ৷ মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন বলিষ্ঠ হাত নিয়ে কেউ এই বলে তাঁর পাশে এসে দাড়াবে, ‘আমি তোমার বক্ষকে উন্মুক্ত করে দেইনি? দাওয়াতকে প্রসারিত করার জন্যে তোমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দেইনি? এ কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়কে কি আমি সহজ করে দেইনি? তোমার অন্তরে এই কাজকে কি আমি প্রিয় করিনি? এর দুর্গম পথকে কি আমি মসৃণ করিনি? আলোতে ভরে দেইনি কি তোমার পথটি? যাতে করে সৌভাগ্যের শেষ অবধি তুমি দেখতে পারো। আল্লাহর সান্ত্বনাবাণী : তোমার অন্তরের মধ্যে হাতড়ে দেখো না একবার, সেখানে কি কোনো প্রাণ প্রবাহ, কোনো উন্মুক্ততা, কোনো উজ্জ্বলতা এবং কোনো আলো কি দেখতে পাচ্ছে না? এই মহা দানের স্বাদ তোমার অনুভূতির গভীরে দেখতে পাও কিনা তা একবার ভেবে দেখো! আর বলো, তুমি কি প্রতিবারে কষ্ট করার পর নানা প্রকারের সফলতা পাচ্ছো না ? প্রত্যেক কঠিন পরিশ্রমের পর বিশ্রাম, প্রতিটি কঠিন অবস্থার পর সহজ অবস্থা, প্রতিটি হতাশার পর সন্তোষজনক পরিণতি কি আসছে না ? ‘আমি তোমার থেকে তোমার বোঝা নামিয়ে দিয়েছি, যা তোমার পিঠকে ভেংগে দিচ্ছিলো ।’ তোমার ব্যর্থ প্রচেষ্টা তোমার পিঠের ওপর দুর্বিসহ এক বোঝারূপে অনভূত হচ্ছিলো । যার ভারে তোমার পিঠ ভেংগে যাচ্ছিলো । সেই সময়, তোমার অন্তর প্রশস্ত করে দিয়ে আমি তোমার সে বোঝাকে নামিয়ে দিলাম, আর তখন তুমি স্বস্তি বোধ করতে লাগলে, তখন আমি তোমার যোগ্যতাকে আরো বাড়িয়ে দিলাম, দাওয়াত দানের পথটি সহজ করে দিলাম । মানুষের অন্তরে তোমার কথাকে গ্রহণযোগ্য করে তুললাম, আর এমন সব গুরুত্বপূর্ণ কথা ওহী স্বরূপ পাঠালাম, যা সত্য প্রকাশে সফলতা অর্জন করলো এবং মানুষের মনের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করলো সহজ ও সাবলীল ভাষার মাধ্যমে তা গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য করে দিলো । তুমি কি ক্লান্তিময় কঠিন অবস্থায় ছিলে না যা তোমার পিঠকে ভেংগে দিচ্ছিলো? তুমি কি তোমার ব্যর্থতাকে হালকা করে দেখোনি, আর আমি (আল্লাহ) কি তোমার বুককে খুলে দেইনি? আর আমি কি তোমার স্মরণকে উঁচুতে তুলিনি, প্রধান প্রধান ফেরেশতাদের সামনে তোমার মর্যাদাকে কি উঁচু করে তুলে ধরিনি? এবং এই সৃষ্টিলোকের মধ্যেও কি আমি সমভাবে তোমার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করিনি? মানুষের অন্তরে তোমাকে স্মরণ রাখার জন্যে আমি যে ব্যবস্থা করেছি, তা একবার খেয়াল করে দেখো আমি আল্লাহ তায়ালা- কিভাবে আমার নামের সাথে তোমার নামকে অবিচ্ছেদ্য অংগ হিসাবে জুড়ে দিয়েছি। যতোবার (আমার স্মরণে) মানুষের ঠোট নড়ে ওঠে ততোবারই তোমার নামটিও সেখানে উচ্চারিত হয়, ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু, মোহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’-এর ওপর স্মরণ বৃদ্ধির আর কোনো স্তর নেই, থাকতে পারে না। এর চেয়ে বেশী কোনো সম্মানও নেই আর এই মর্যাদাপূর্ণ স্থানে তুমি একাই বসে আছো, এ স্থানে সারা জগতের আর কেউ পৌছুতে পারেনি। আর লাওহে মাহ্ফুযেও তোমার নাম লিখে রেখে তোমার মর্যাদা ও স্মরণকে আমি সমুন্নত রেখেছি। সেখান দিয়ে যেতে হবে সকলকে এবং আমার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে তোমার নামও আসবে । আমি চিরস্থায়ীভাবে এ ব্যবস্থাটি করে রেখেছি। যে কোনো যুগের বা যে কোনো জাতির মানুষ সেখান থেকে আসা যাওয়া করুক না কেন এবং যতো ফেরেশতাকুল আছে সবাই সালাত, তাসলীম ও গভীর মহব্বতের সাথে সে স্থান অতিক্রম করার সময় এ নাম দেখবে ও পড়তে থাকবে । আমি তোমার স্মরণকে আরো বেশী মর্যাদাপূর্ণ করেছি, সুউচ্চে তুলেছি। অবশ্যই আল্লাহ রব্বুল ইযযতের এই সম্মানিত পথে তোমার নাম বাঁধা রয়েছে, আর তোমার নামের এই মর্যাদা অত্যন্ত সহজ সরলভাবে সবার কাছে গৃহীত হয়েছে। এ মর্যাদা লাভ আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। হবেও না কোনোদিন । তাহলে বলো, এখন কোথায় থাকলো তোমার কষ্ট, ক্লান্তি, দুঃখ এবং এই মহা দানের সামনে তোমাকে ছোটো করার মতো সৃষ্টিজগতে কিছু কি বাকি থাকলো? এ মহান মর্যাদা তোমার সকল দুঃখ, কষ্ট, কঠোরতা ও কঠিন পরিশ্রমের জন্যে ক্লাস্তিহারক নয় কি? এর সাথে আল্লাহ তায়ালা তীর প্রিয় বন্ধুর দুঃখ দূর করে দিয়েছেন- যাকে তিনি নিজেই সবার মধ্য থেকে প্রিয়তম বলে পছন্দ করে নিয়েছেন ৷ তার জন্যে সবার মনে মহব্বতে ভরে দিয়েছেন । তাঁকে প্রশান্ত ও নিশ্চিন্ত করে দিয়েছেন, তার জন্যে যে কোনো জটিল কঠিন অবস্থা সহজ সাবলীলভাবে অতিক্রম করা সহজ করে দিয়েছেন । অনেক কষ্ট পরিশ্রমের পর তার সুদিন এন দিয়েছেন । পরিশেষে নিশ্চয়তার সাথে একথাটা জানিয়েছেন যে, এই মহিমান্বিত মর্যাদা তাকে আর কখনও ছেড়ে যাবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং প্রতিটি কঠিন অবস্থার সাথে রয়েছে সহজ অবস্থা, অবশ্যই প্রতিটি কঠিন অবস্থার সাথে সহজ অবস্থা রয়েছে ।’
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ:
الشرح শব্দের অর্থ সম্প্রসারণ করা, প্রশস্ত করা ও উন্মোচন করা ইত্যাদি। প্রথম আয়াতে উল্লিখিত نَشْرَحْ ক্রিয়া থেকে اَلشَّرْح নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
পূর্বের সূরাতে নাবী (সাঃ)-এর প্রতি তিনটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সূরাতেও মহান আল্লাহ আরো তিনটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমটা হলো : নাবী (সাঃ)-এর বক্ষ প্রশস্ত করে দেয়া। বক্ষ প্রশস্ত করে দেয়ার অর্থ হলো : দীন ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দিকে মানুষকে দাওয়াত এবং উত্তম চরিত্রের জন্য বক্ষ উন্মোচন করে দেয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَمَنْ يُّرِدِ اللّٰهُ أَنْ يَّهْدِيَه۫ يَشْرَحْ صَدْرَه۫ لِلْإِسْلَامِ)
“আল্লাহ কাউকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাইলে তিনি তার বক্ষ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন।” (সূরা আনআম ৬ : ১২৫)
আবার কেউ কেউ এ আয়াত দ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ বা সিনাচাককে বুঝিয়েছেন। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নাবী (সাঃ)-এর দু’বার সিনাচাক করা হয়েছিল। প্রথমবার ৪ বছর বয়সে। (সহীহ মুসলিম হা. ২৬১) দ্বিতীয়বার মি‘রাজের সময়। জিবরীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বুককে চিরে অন্তরকে বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে পুনরায় স্বস্থানে বসিয়ে দেন। (সহীহ বুখারী হা. ৩৪৯, সহীহ মুসলিম হা. ১৬৪)
(وَوَضَعْنَا عَنْكَ وِزْرَكَ) অর্থাৎ তোমার অপরাধসমূহ অপসারণ করে দিয়েছি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لِّیَغْفِرَ لَکَ اللہُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْۭبِکَ وَمَا تَاَخَّرَ وَیُتِمَّ نِعْمَتَھ۫ عَلَیْکَ وَیَھْدِیَکَ صِرَاطًا مُّسْتَقِیْمًا)
“যাতে আল্লাহ তোমার আগের ও পরের ভুল-ক্রটি মাফ করেন, তোমার ওপর তাঁর নেয়ামত পূর্ণ করে দেন, এবং তোমাকে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করেন।” (সূরা ফাত্হ ৪৮: ২)
(وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ)
অর্থাৎ যেখানে আল্লাহ তা‘আলার নাম আসবে সেখানে নাবী (সাঃ)-এর নামও আসবে। যেমন আযান, ইকামত, শাহাদাত ইত্যাদি। এ হিসাবে সারা বিশ্বে প্রতি মুহূর্তে তাঁর নাম উচ্চারিত ও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া পূর্ববর্তী গ্রন্থেও নাবী (সাঃ)-এর নাম ও গুণাবলীর বিবরণ রয়েছে। ফেরেশতারাও তাঁর নাম সম্মানের সাথে উল্লেখ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : একদা জিবরীল (আঃ) আমার কাছে আগমন করলেন এবং বললেন : নিশ্চয়ই আমার ও আপনার প্রভু আপনার আলোচনাকে কী করে সমুন্নত করবেন তা তিনি জানতে চান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : সেটা আল্লাহ তা‘আলা ভাল জানেন। জিবরীল (আঃ) বললেন : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : আমার কথা যখন আলোচনা করা হবে তখন আমার রাসূলের (সাঃ)-এর কথাও আলোচিত হবে। (আহমাদ ৫/১৩৯ বণর্নাকারী নির্ভরযোগ্য।)
(فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا)
আরবী ব্যাকরণে যখন দু’টি নাম একত্রে উল্লেখ করা হবে তখন তার চারটি অবস্থা থাকে।
তার দু’টি অবস্থা এখানে তুলে ধরা হয়েছে :
(১) যদি দুটি নাম নির্দিষ্ট হয় তাহলে দ্বিতীয়টা দ্বারা প্রথম নাম উদ্দেশ্য।
(২) যদি দু’টি নামই অনির্দিষ্ট হয় তাহলে দুটি নাম দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন জিনিস বুঝায়। আয়াতদ্বয়ে الْعُسْرِ শব্দটি দু’বার এসেছে। এবং দুবারেই ال (আলিফ-লাম) দ্বারা নির্দিষ্ট আর يسر শব্দটি দুবার এসেছে অনির্দিষ্ট অবস্থায়। তাহলে আয়াতদ্বয়ের অর্থ হলো: নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে, আবার ঐ কষ্টের সাথে আরেকটি স্বস্তি রয়েছে। এজন্য ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেছেন:
لن يغلب العسر يسرين
অর্থাৎ একটি কষ্ট দুটি স্বস্তির ওপর জয়ী হবে না। (মাবাহিস ফী উলূমুল কুরআন পৃ. ১৯১)
দুঃখের সাথেই সুখ রয়েছে এটা হলো মহা সুসংবাদ। এমনকি দুঃখ-কষ্ট যদি গুইসাপের গর্তে প্রবেশ করে তাহলে সুখও তাতে প্রবেশ করে তা থেকে বের করে নিয়ে আসবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(سَيَجْعَلُ اللّٰهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُّسْرًا)
“আল্লাহ কষ্টের পর সহজ করে দেবেন।” (সূরা তালাক ৬৫: ৭)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে উম্মাতকে নির্দেশ দিয়ে বলছেন : যখনই দুনিয়াবী ব্যস্ততা থেকে অবসর পাবে তখন আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে সচেষ্ট হও।
فَارْغَبْ অর্থাৎ তাঁর কাছে তুমি জান্নাতের আশা রাখ। তাঁর কাছে তোমার প্রয়োজনে চাও এবং তাঁর ওপরই নির্ভর কর।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নাবী (সাঃ)-এর ওপর আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য নেয়ামতের কথা জানতে পারলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলা যার হিদায়াত চান তার অন্তরকে এভাবে উন্মোচন করে দেন।
৩. প্রত্যেক কষ্টের সাথে দু’টি স্বস্তি রয়েছে।
৪. প্রত্যেক মু’মিনের কর্তব্য অবসর পেলেই আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে মশগুল হওয়া।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
১-৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ) কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে নবী (সঃ)! আমি তোমার কল্যাণার্থে তোমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিয়েছি, দয়ামায়াপূর্ণ এবং অনুগ্রহপুষ্ট করে দিয়েছি। যেমন অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ, “আল্লাহ যাকে হিদায়াত করার ইচ্ছা করেন তার বক্ষ তিনি ইসলামের জন্যে খুলে দেন।” (৬:১২৫) মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তোমার বক্ষ যেমন প্রশস্ত ও প্রসারিত করে দেয়া হয়েছে, তেমনই তোমার শরীয়তও প্রশস্ততা সম্পন্ন, সহজ সরল ও নম্রতাপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। তাতে কোন জটিলতা নেই এবং নেই কোন সংকীর্ণতা ও কঠোরতা। এটাও বলা হয়েছে যে, এখানে মিরাজের রাত্রের বক্ষ বিদারণ সম্বলিত ঘটনার কথা বুঝানো হয়েছে। মিরাজের রাত্রে বক্ষ বিদীর্ণ করা এবং বক্ষকে আল্লাহর রহস্যের আধারে পরিণত করা, এই দুই অর্থই নেয়া যেতে পারে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বলেন যে, হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বেশ সাহসিকতার সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে এমন সব কথা জিজ্ঞাসা করতেন যে সব কথা অন্য কেউ জিজ্ঞেস করতে পারতেন না। একবার তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে প্রশ্ন করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! নবুওয়াতের কার্যাবলীর মধ্যে সর্বপ্রথম আপনি কি প্রত্যক্ষ করেছেন?” তখন রাসূলুল্লাহ(সঃ) ভালভাবে বসে বললেনঃ “হে আবূ হুরাইরা (রাঃ)! তা হলে শুনো! আমার বয়স যখন দশ বছর কয়েক মাস। একজন লোক অন্য একজন লোককে বলছেঃ “ইনিই কি তিনি?” তারপর দু’জন লোক আমার সামনে এলেন। তাদের চেহারা এমন নূরানী বা আলোকোজ্জ্বল ছিল যে, আমি এর পূর্বে ঐ রকম চেহারা কখনো দেখিনি। তাঁদের দেহ হতে এমন সুগন্ধি বেরুচ্ছিল যে, এর পূর্বে ঐ রকম সুগন্ধি কখনো আমার নাকে আসেনি। তারা এমন পোশাক পরিহিত ছিলেন যে, ঐ রকম পোশাক পূর্বে আমি কখনো দেখিনি। তারা এসে আমার উভয় বাহু আঁকড়ে ধরলেন। কিন্তু কেউ আমার বাহু ধরেছে বলে আমার মনে হলো না। তারপর একজন অপরজনকে বললেনঃ “এঁকে শুইয়ে দাও।” অতঃপর আমাকে শুইয়ে দেয়া হলো। কিন্তু তাতেও আমার কোন প্রকার কষ্ট হয়নি। তারা একজন অন্য জনকে বললেনঃ “এঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে দাও।” অতঃপর আমার বক্ষ বিদীর্ণ করা হলো। কিন্তু তাতেও আমি মোটেই কষ্ট অনুভব করিনি। বিন্দুমাত্র রক্তও তাতে বের হয়নি। তারপর তাদের একজন অপরজনকে বললেনঃ “হিংসা বিদ্বেষ, শত্রুতা এঁর বুক থেকে বের করে দাও।” যাকে আদেশ করা হলে তিনি রক্ত পিণ্ডের মত কি একটা জিনিষ বের করলেন এবং ওটা ছুঁড়ে ফেললেন। এরপর আবার একজন অপরজনকে আদেশ করলেনঃ “বক্ষের মধ্যে দয়া মায়া, স্নেহ, অনুগ্রহ প্রবণতা ঢুকিয়ে দাও।” এই আদেশ মূলে বক্ষ হতে যে পরিমাণ জিনিষ বের করে ফেলা হয়েছিল সেই পরিমাণ রূপার মত কি একটা জিনিস বক্ষের মধ্যে ভরে দেয়া হলো। তারপর আমার ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নেড়ে তারা আমাকে বললেনঃ “যান, এবার শান্তিতে জীবন যাপন করুন। তারপর চলতে গিয়ে আমি অনুভব করলাম যে, প্রত্যেক ছোট ছেলের প্রতি আমার অন্তরের স্নেহ মমতা রয়েছে এবং প্রত্যেক বড় মানুষের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি রয়েছে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে)
এরপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ) কে সম্বোধন করে বলেনঃ “আমি তোমার বোঝা অপসারণ করেছি।” এর ভাবার্থ হলো আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবী (সঃ)-এর পূর্বাপর সমস্ত পাপ মার্জনা করে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! আমি তোমার উপর থেকে তোমার সেই ভার অপসারিত করেছি যা তোমার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে রেখেছিল।
“আর আমি তোমার জন্যে তোমার খ্যাতি সমুন্নত করেছি। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ যেখানে আমার (আল্লাহর) আলোচনা হবে সেখানে তোমারও আলোচনা হবে। যেমনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রাসুল।” হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ দুনিয়ায় এবং আখিরাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবী (সঃ)-এর আলোচনা বুলন্দ করেছেন। কোন খতীব, কোন বক্তা, কোন বাগী এবং কোন নামাযী এমন নেই যিনি আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ)এর রিসালাতের কথা উচ্চারণ করেন না। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত জিব্রাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহর (সঃ) কাছে এসে বলেনঃ “আমার এবং আপনার প্রতিপালক আপনার আলোচনাকে কি করে সমনত করবেন তা তিনি জানতে চান।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “সেটা আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন।” তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) জানিয়ে দেনঃ “আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ আমার কথা যখন আলোচনা করা হবে তখন আমার রাসূল (সঃ)-এর কথাও আলোচিত হবে।”
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি আমার প্রতিপালককে একটি প্রশ্ন করেছি, কিন্তু প্রশ্নটি না করাই ভাল ছিল। প্রশ্নটি হলোঃ হে আল্লাহ! আমার পূর্ববর্তী কোন নবীর জন্যে কি আপনি বাতাসকে তাবেদার বানিয়েছিলেন? কারো হাতে মৃতকে কি জীবিত করিয়েছেন? আল্লাহ তাআলা জবাবে বলেনঃ “আমি কি তোমাকে ইয়াতীম পেয়ে আশ্রয় দিইনি?” আমি জবাবে বললামঃ হ্যাঁ, অবশ্যই দিয়েছেন। আল্লাহ পাক আবার প্রশ্ন করেনঃ “আমি কি তোমাকে পথভ্রষ্ট অবস্থায় পেয়েও পথ নির্দেশ প্রদান করিনি?” উত্তর দিলামঃ হ্যা, অবশ্যই করেছেন। আল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ আমি কি তোমাকে দরিদ্রাবস্থায় পেয়েও বিত্তশালী করিনি?” আমি জবাবে বললামঃ হ্যা, হে আমার প্রতিপালক! অবশ্যই করেছেন। তিনি আবারও প্রশ্ন করলেনঃ “আমি কি তোমার কল্যাণে তোমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিইনি?” উত্তর দিলামঃ হে আমার প্রতিপালক! হ্যা, অবশ্যই দিয়েছেন। আল্লাহ পুনরায় প্রশ্ন করলেনঃ “আমি কি তোমার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করিনি?” আমি জবাবে বললামঃ হ্যা, হে আমার প্রতিপালক! অবশ্যই করেছেন।”
হযরত আবু নাঈম লিখিত দালাইলুন নুবুওয়াহ্ নামক গ্রন্থে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার মহান প্রতিপালক আমাকে আকাশ ও জমীনের কাজের ব্যাপারে যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই কাজ হতে অব্যাহতি লাভ করার পর আমি তাকে বললামঃ হে আমার প্রতিপালক আমার পূর্বে যত নবী গত হয়েছেন তাঁদের সবাইকে আপনি সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে বন্ধু বানিয়েছেন, হযরত মূসা (আঃ) কে কালীম বানিয়েছেন অর্থাৎ তার সাথে বাক বিনিময় করেছেন, হযরত দাউদ (আঃ)-এর জন্য পাহাড়কে বিদীর্ণ করেছেন, হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর জন্যে বাতাস এবং শয়তানকে অনুগত করেছেন, হযরত ঈসা (আঃ)-এর হাতে মতকে জীবন দান করেছেন। সুতরাং আমার জন্যে কি করেছেন? আল্লাহ তা’আলা জবাবে বলেনঃ আমি কি তোমাকে তাদের সবার চেয়ে উত্তম জিনিস প্রদান করিনি? আমার যিকির বা আলোচনার সাথে তোমার আলোচনাও করা হয়ে থাকে, এবং আমি তোমার উম্মতের বক্ষকে এমন করে দিয়েছি যে, তারা প্রকাশ্যে কুরআন পাঠ করে। এটা আমি পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে কাউকেও দিইনি। আর আমি তোমাকে আরশের ধনাগার হতে ধন দিয়েছি। সেই ধন হলোঃ (আরবি) অর্থাৎ পাকার্য হতে ফিরবার এবং ভাল কাজ করবার ক্ষমতা সমুন্নত ও মহান আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারো নেই।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এখানে আযানকে বুঝানো হয়েছে। যেমন হযরত হাসসান ইবনে সাবিতের (রাঃ) নিম্নের কবিতায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহ তা’আলা মুহরে নুবুওয়াতকে নিজের নিকটের একটি নুর বানিয়ে তাঁর (নবী সঃ)-এর উপর চমকিত করেছেন, যা তাঁর রিসালাতের সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহ নবী (সঃ)-এর নামকে নিজের নামের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন, যখন মুআযযিন পাঁচবার (পাঁচওয়াক্ত নামাযের মধ্যে) “আশহাদু’ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি) বলে। আর আল্লাহর নবী (সঃ)-এর নামকে স্বীয় নাম হতে বের করেছেন, সুতরাং আরশের মালিক (আল্লাহ) হলেন মাহমুদ এবং ইনি (নবী করীম (সঃ) হলেন মুহাম্মদ (সঃ)।” অন্যেরা বলেন যে, পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবী (সঃ)-এর নাম মর্যাদায়ে উন্নীত করেছেন। সকল নবী (সঃ)-এর নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণের দিনে আল্লাহ তা’আলা অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁর প্রিয় নবীর (সঃ) উপর বিশ্বাস স্থাপন করবেন এবং নিজ নিজ উম্মতকেও বিশ্বাস স্থাপনের নির্দেশ দিবেন। তা ছাড়া প্রিয় নবী (সঃ)-এর উম্মতের মধ্যেও আল্লাহ তাআলা তাঁর আলোচনার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন আল্লাহর আলোচনার সাথে সাথে নবী করীম (সঃ)-এরও আলোচনা করে। সরসরি (রঃ) একটি চমঙ্কার কথা বলেছেন। তিনি বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ আল্লাহর প্রিয় রাসূল (সঃ)-এর মিষ্টি নাম পছন্দনীয় এবং সুন্দর মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়ার পূর্বে আমাদের কর্তব্যজনিত আযান বিশুদ্ধ হয় না। তুমি কি দেখো না যে, আমাদের আযান এবং আমাদের কর্তব্য বিশুদ্ধ হয় না যতক্ষণ বারবার নবী করীম (সঃ)-এর নাম উচ্চারিত হয়।”
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে, অবশ্যই কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে।” আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, কষ্ট ও দুঃখের পরেই শান্তি ও সুখ রয়েছে। অতঃপর খবরের প্রতি গুরুত্ব আরোপের জন্যে এ কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
হযরত আনাস ইবনে মালিক হতে বর্ণিত আছে যে, একদা নবী করীম (সঃ) বসেছিলেন, তার সামনে একটা পাথর ছিল। তখন তিনি বললেনঃ যদি মুশকিল বা কষ্টকর অবস্থা আসে এবং এ পাথরের মধ্যে প্রবেশ করে তাহলে আসানী ও আসবে এবং পাথরের মধ্যে প্রবেশ করে তার ভিতর থেকে মুশকিল ও কষ্টকর অবস্থাকে বের করে আনবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, লোকেরা বলেঃ একটি মুশকিল দুটি আসানীর উপর জয়যুক্ত হতে পারে না।
হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা নবী করীম (সঃ) খুবই স্মিত মুখে এলেন এবং হাসতে হাসতে বললেনঃ “কিছুতেই একটি মুশকিল দুইটি আসানীর উপর জয়যুক্ত হতে পারে না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু আবী হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন এটি মুরসাল হাদীস অর্থাৎ এখানে সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হয়নি। বুঝা যায় যে, মুশকিল মাত্র একটি, আর আসানী অনেক)
হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ আমাদের কাছে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেনঃ “দুটি আসানীর উপর একটি মুশকিল জয়যুক্ত হতে পারে না। এখানে (আরবি) শব্দকে উভয় স্থানে মারিফাহ বা নির্দিষ্ট রূপে আনা হয়েছে, পক্ষান্তরে (আরবি) শব্দকে উভয় স্থানে নাকিরাহ বা অনির্দিষ্টরূপে আনয়ন করা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, মুশকিল মাত্র একটি, আর আসানী অনেক।
একটি হাদীসে রয়েছে যে, (আরবি) অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্য কষ্ট অনুপাতে আকাশ হতে অবতীর্ণ হয় এবং তা ধৈর্য ও সহনশীলতা অনুযায়ী আসমান হতে নাযিল হয়। হযরত ইমাম শাফিয়ী (রঃ) বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “ উত্তম ধৈর্য প্রশস্ততার কতই না নিকটবর্তী। নিজের কাজে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার প্রতি খেয়াল রাখে সে মুক্তি লাভ করে। যে আল্লাহর কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, কষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আল্লাহর কাছে যে। ব্যক্তি কল্যাণ প্রত্যাশা করে, সে আশা অনুযায়ীই তা লাভ করে।
হযতর আবূ হাতিম সিজিস্তানী (রঃ) বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হতাশা যখন অন্তর দখল করে নেয়, বুক যখন প্রশস্ততা সত্ত্বেও সংকীর্ণ হয়ে যায়, দুঃখ কষ্ট যখন ঘিরে ধরে, বিপদ এসে বাসা বাঁধে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার সৃষ্টি করে, মুক্তির কোন পথ খুঁজে পাওয়া যায় না, মুক্তির কোন প্রচেষ্টাই সফল হয় না, সেই সময় হঠাৎ আল্লাহর সাহায্য এসে পৌঁছে। আল্লাহ তাআলা দু’আ শ্রবণকারী। সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহ মুশকিলকে আসানীতে রূপান্তরিত করেন এবং যন্ত্রণাকে, অশান্তিকে সুখ-শান্তি ও আরাম আয়েশে পরিণত করেন। সংকীর্ণতা পুরোপুরি এসে পড়লে আল্লাহ রাব্বল আলামীন সঙ্গে সঙ্গে প্রশস্ততা অবতীর্ণ করতঃ ক্ষতিকে লাভে রূপান্তরিত করে দেন।” অন্য এক কবি বলেন(আরবি)
অর্থাৎ মানুষের উপর এমন বহু বিপদ আপতিত হয় যাতে সে সংকীর্ণ হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, অথচ আল্লাহর কাছে সে সব বিপদে নিমিত্ত নিষ্কৃতিও রয়েছে। এসব বিপদ যখন পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করে, বিপদের বন্ধন লাভ করে, মানুষ তখন ভাবতে থাকে যে, এ বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে তো? তখন হঠাৎ করুণাময় আল্লাহর অনুগ্রহ দৃষ্টি পড়ে যায় এবং তিনিই সেই বিপদ এমনভাবে দূর করে দেন যে, মনে হয় যেন বিপদ আসেইনি।”
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ অতএব, হে নবী (সঃ) যখনই তুমি অবসর পাও সাধনা করো এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করো। অর্থাৎ দুনিয়ার কাজ থেকে অব্যাহতি পেলেই আমার ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি মনোনিবেশ করো, নিয়ত পরিষ্কার করো, পরিপূর্ণ আগ্রহ সহকারে আমার প্রতি আকৃষ্ট হও। এই অর্থ বিশিষ্ট একটি সহীহ হাদীসও রয়েছে। হাদীসটির মর্ম হলোঃ খাবার সামনে থাকা অথবা পায়খানা প্রস্রাবের বেগ থাকা অবস্থায় নামায পড়তে নেই। অন্য এক হাদীসে রয়েছেঃ “সবাই নামাযে দাঁড়িয়ে গেছে এমতাবস্থায় যদি রাতের খাবার তোমার সামনে থাকে তা হলে প্রথমে খাবার খেয়ে নাও।”
হযরত মুজাহিদ (রঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ দুনিয়ার কাজ-কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে নামাযে দাঁড়াও। অতঃপর আল্লাহর নিকট মনোযোগ সহকারে দু’আ কর এবং নিজের প্রয়োজন ব্যক্ত কর ও পূর্ণ মনোযোগ সহকারে স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি আকৃষ্ট হও।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ ফরয নামায থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর তাহাজ্জুদের নামাযে দাড়িয়ে যাও। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলোঃ নামায আদায় শেষ করে বসে বসে আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হও অর্থাৎ তার যিক্র করো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ অর্থাৎ, দু’আ করো। হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) এবং যহহাক (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ জিহাদ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ইবাদতে লেগে যাও। সাওরী (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলো নিজের নিয়ত ও মনোযোগ আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ করো।