Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২১২/ হে মানুষ:-২০)
[# মানুষ বলবে:-
#মানুষ তার কৃত বিন্দু পরিমাণ ভালমন্দ আমলও দেখতে পাবে:-]
www.motaher21.net
সুরা: ৯৮ : সুরা: আয্-যিলযিলা
পারা:৩০
১- ৮ নং আয়াতের বেখ্যা :-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-১
اِذَا زُلۡزِلَتِ الۡاَرۡضُ زِلۡزَالَہَا ۙ﴿۱﴾
পৃথিবী যখন আপন কম্পনে প্রবলভাবে প্রকম্পিত হবে। [
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-২
وَ اَخۡرَجَتِ الۡاَرۡضُ اَثۡقَالَہَا ۙ﴿۲﴾
এবং পৃথিবী যখন তার ভারসমূহ বের করে দেবে,
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-৩
وَ قَالَ الۡاِنۡسَانُ مَا لَہَا ۚ﴿۳﴾
এবং মানুষ বলবে, ‘এর কি হল?’
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-৪
یَوۡمَئِذٍ تُحَدِّثُ اَخۡبَارَہَا ۙ﴿۴﴾
সেদিন সে তার নিজের (ওপর যা কিছু ঘটেছে সেই) সব অবস্থা বর্ণনা করবে।
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-৫
بِاَنَّ رَبَّکَ اَوۡحٰی لَہَا ؕ﴿۵﴾
কারণ তোমার প্রতিপালক তাকে আদেশ করবেন।
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-৬
یَوۡمَئِذٍ یَّصۡدُرُ النَّاسُ اَشۡتَاتًا ۬ۙ لِّیُرَوۡا اَعۡمَالَہُمۡ ؕ﴿۶﴾
সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলে বের হবে , যাতে তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখান যায় ,
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-৭
فَمَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ خَیۡرًا یَّرَہٗ ؕ﴿۷﴾
সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে, সে তা দেখতে পাবে।
সুরা: ৯৮ : সুরা:আয্-যিলযিলা;-৮
وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ مِثۡقَالَ ذَرَّۃٍ شَرًّا یَّرَہٗ ٪﴿۸﴾
এবং কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে, তাও সে দেখতে পাবে।
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও ফযীলত:
زِلْزَالَ শব্দটি ক্রিয়া মূল। শব্দের অর্থ : কম্পণ, ভূ-কম্পন। অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরাটি মক্কা বা মদীনায় অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। তবে সঠিক মত হলো সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ সূরার ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে কোন বর্ণনা দুর্বলতা থেকে মুক্ত না, তাই উল্লেখ করা হল না। সূরায় কিয়ামত অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে এবং প্রত্যেকে তার ভাল-মন্দ আমলের প্রতিদান পাবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
তাফসীর:
কিয়ামতের পূর্বে জমিনে কম্পণ সৃষ্টি হবে সে সম্পর্কে সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّکُمْﺆ اِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَیْءٌ عَظِیْمٌﭐیَوْمَ تَرَوْنَھَا تَذْھَلُ کُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّآ اَرْضَعَتْ وَتَضَعُ کُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَھَا وَتَرَی النَّاسَ سُکٰرٰی وَمَا ھُمْ بِسُکٰرٰی وَلٰکِنَّ عَذَابَ اللہِ شَدِیْدٌ)
“হে মানুষ! ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে; কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার! যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করে ফেলবে; মানুষকে দেখবে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি কঠিন। (সূরা হাজ্জ ২২: ১-২)
সেদিন জমিন তার মধ্যস্থ সবকিছু তথা তার মধ্যে যত মৃত মানুষ, খনিজ ও প্রোথিত সম্পদ আছে সব বের করে দেবে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : জমিন তার কলিজার টুকরোগুলোকে উগরে দেবে এবং বাইরে নিক্ষেপ করবে। স্বর্ণ-রৌপ্য স্তুপের আকারে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। হত্যাকারী সে সব দেখে বলবে: হায়! আমি এ সম্পদের জন্য অমুককে হত্যা করেছি, অথচ আজ এগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে, কেউ যেন এগুলোর দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজনের সাথে দুর্ব্যবহারকারী দুঃখ করে বলবে হায়! এ সম্পদের মোহে পড়ে আমি আমার আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করিনি। চোর বলবে: হায়! এ সম্পদের জন্য আমার হাত কেটে দেয়া হয়েছিল। অতঃপর এগুলো তাদেরকে ডাকবে, কিন্তু তারা ওগুলো হতে কিছুই গ্রহণ করবে না। (সহীহ মুসলিম, তিরমিযী হা. ২২০৮)
(وَقَالَ الْإِنْسَانُ)
অর্থাৎ জমিনের এ অবস্থা দেখে মানুষ আশ্চর্য হয়ে বলবে জমিনের কী হল! কারণ ইতোপূর্বে তারা এমন অবস্থা দেখেনি।
(تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا)
অর্থাৎ জমিন তার ওপর মানুষ যা কিছু করেছে সব বলে দেবে। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ আয়াতটি পাঠ করলেন এবং বললেন: তোমরা কি জান, জমিনের খবর কী? সবাই বলল: আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাঃ) অধিক জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: জমিনের সংবাদ হলো: প্রত্যেক নর-নারী জমিনের ওপর যা কিছু করেছে সব কিছু বলে দেবে। জমিন বলবে : অমুক অমুক কাজ অমুক দিন করেছে। এটাই হলো জমিনের সংবাদ। (তিরমিযী হা. ৩৩৫৩ সহীহ।)
(أَوْحٰي لَهَا) অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা মাটিকে কথা বলার শক্তি দেবেন। সেদিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কথা বলবে। জড় পদার্থের কথা বলা, শব্দ ধরে রাখা এবং প্রয়োজনে তা শুনিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আজ বিজ্ঞানও তা প্রমাণ করেছে।
يَّصْدُرُ শব্দের অর্থ হলো : প্রকাশ পাওয়া, বের হওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ কবর থেকে বের হয়ে হিসাবের ময়দানের দিকে অথবা হিসাব শেষে জান্নাত অথবা জাহান্নামের দিকে ফিরে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَّتَفَرَّقُوْنَ فَأَمَّا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَهُمْ فِيْ رَوْضَةٍ يُّحْبَرُوْنَ وَأَمَّا الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَكَذَّبُوْا بِاٰيٰتِنَا وَلِقَآئِ الْاٰخِرَةِ فَأُولٰ۬ئِكَ فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُوْنَ)
“আর যেদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং যারা ঈমান আনে এবং ভাল কাজ করেছিল, তারা তো জান্নাতে আনন্দে থাকবে। আর যারা কুফরী করে এবং অবিশ্বাস করে আমার আয়াতসমূহকে ও আখিরাতের সাক্ষাতকে, তাদেরকেই ‘আযাবের মধ্যে উপস্থিত করা হবে।” (সূরা রূম ৩০: ১৪-১৬)
أَشْتَاتًا শব্দের অর্থ : ভিন্ন ভিন্ন, দলে দলে। অর্থাৎ সেদিন সৎ আমলকারীরা একদলে আর খারাপ আমলকারীরা অন্য দলে বিভক্ত হয়ে যাবে।
ذَرَّةٍ অর্থ : অণু। এখানে উদ্দেশ্য সবচেয়ে ছোটতম গুনাহ বা নেকী তাও দেখতে পাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(یَوْمَ تَجِدُ کُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَیْرٍ مُّحْضَرًاﹴ وَّمَا عَمِلَتْ مِنْ سُوْ۬ئٍﹱ تَوَدُّ لَوْ اَنَّ بَیْنَھَا وَبَیْنَھ۫ٓ اَمَدًۭا بَعِیْدًا)
“প্রত্যেক মানুষ যা ভাল করেছে এবং খারাপ করেছে কিয়ামতের দিন সবই উপস্থিত পাবে। সে কামনা করবে তার ও তার অন্যায় কাজের মধ্যে যদি অনেক দুরত্ব থাকত!” (সূরা আলি ইমরান ৩: ৩০)
মূলত এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে ভাল কাজে উৎসাহ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাই আমাদের ভাল কাজে উৎসাহী ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের পূর্বে ভূমিকম্প হবে যার ফলে সকল মৃত মানুষ ও ধন সম্পদ বের হয়ে আসবে।
২. মানুষ যা কিছু করছে সব ব্যাপারে জমিন সাক্ষ্য দেবে।
৩. মানুষ তার কৃত বিন্দু পরিমাণ ভালমন্দ আমলও দেখতে পাবে।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
জামে তিরমিযীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছে এসে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে পড়িয়ে দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ (আরবি) যুক্ত তিনটি সূরা পাঠ করো।” লোকটি বললো “আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, স্মৃতিশক্তি আমার দুর্বল হয়ে গেছে এবং জিহ্বা মোটা হয়ে গেছে (সুতরাং এই সূরাগুলো পড়া আমার পক্ষে কঠিন)।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, “আচ্ছা, তাহলে (আরবি) যুক্ত সূরাগুলো পড়।” লোকটি পুনরায় একই ওযর পেশ করলো। তখন নবী করীম (সঃ) তাকে বললেন “তাহলে (আরবি) বিশিষ্ট তিনটি সূরা পাঠ করো।” লোকটি ঐ উক্তিরই পুনরাবৃত্তি করলো এবং বললোঃ আমাকে একটি সূরার সবক দিন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে (আরবি) এই সূরাটিই পাঠ করালেন। পড়া শেষ করার পর লোকটি বললোঃ “আল্লাহর কসম! আমি কখনো এর অতিরিক্ত কিছু করবো না।” এই কথা বলে লোকটি চলে যেতে শুরু করলো। তখন নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “এ লোকটি সাফল্য অর্জন করেছে ও মুক্তি পেয়ে গেছে।”
তারপর তিনি বললেনঃ “তাকে একটু ডেকে আনে।” লোকটিকে ডেনে আনা হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ আমাকে ঈদুল আযহার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই দিনকে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্যে ঈদের দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।” একথা শুনে লোকটি বললোঃ “যদি আমার কাছে কুরবানীর পশু না থাকে এবং কেউ আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা পশু উপটৌকন দেয় তবে কি আমি ঐ পশুটি যবাহ করে ফেলবো?” রাসূলুল্লাহ উত্তরে বললেনঃ না, (এ কাজ করো না। বরং চুল ছাটিয়ে নাও, নখ কাটিয়ে নাও, গোঁফ ছোট করো এবং নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করো, এ কাজই আল্লাহর কাছে তোমার জন্যে পুরোপুরি কুরবানী রূপে গণ্য হবে।” (এ হাদীসটি সুনানে আবী দাউদ ও সুনানে নাসাঈতেও বর্ণিত হয়েছে)
জামে তিরমিযীতে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এই সূরা পাঠ করে সে অর্ধেক কুরআন পাঠের সওয়াব লাভ করে।” (এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল)
অন্য এক হাদীসে রয়েছে যে, (আরবি) সূরাটি অর্ধেক কুরআনের সমতুল্য, (আরবি) সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য এবং এ সূরাটি কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমতুল্য। (এটাও গারীব বা দুর্বল হাদীস)
অন্য একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের একজনকে বলেনঃ “তুমি কি বিয়ে করেছো?” লোকটি উত্তরে বলেনঃ “জ্বী, না। আমার বিয়ে করার মত সামর্থ্য নেই।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ (আরবি) “এ সূরাটি কি তোমার সাথে নেই (অর্থাৎ এ সূরাটি কি তোমার মুখস্ত নেই)?” লোকটি জবাবে বললেনঃ “হ্যা (তা তো আছেই)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এতে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ হলো। তারপর বললেনঃ “তোমার সাথে কি (আরবি) এই সূরাটি নেই?” লোকটি বললেনঃ “হ্যা’, আছে। নবী করীম (সঃ) বললেনঃ “এতে কুরআনের এক চতুর্থাংশ হলো। এরপর বললেন (আরবি) “এ সূরাটি কি তোমার জানা নেই?” লোকটি জবাব দিলেনঃ “হ্যা আছে।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “এটা কুরআনের এক চতুর্থাংশ” অতঃপর বললেনঃ “তোমার কি (আরবি) এ সূরাটি মুখস্ত নেই?” লোকটি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই আছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এটাও কুরআনের এক চুতর্থাংশ। যাও, এবার বিয়ে করে নাও।” (এই হাদীসটি হাসান। এই তিনটি হাদীসই ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। তিনি ছাড়া আসহাবুল কুতুবের অন্য কেউ এটা বর্ণনা করেননি)
১-৮ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি) এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ জমীনকে যখন ভীষণ কম্পনে কম্পিত করা হবে, নীচে থেকে উপর পর্যন্ত প্রকম্পনে ভিতরের সমস্ত মৃতকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হবে। যেমন অন্যত্র রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে মানুষ! ভয় কর তোমাদের প্রতিপালককে; কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ানক ব্যাপার।” (২২:১) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অথাৎ “এবং পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে ও পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাইরে নিক্ষেপ করবে ও শূন্যগর্ভ হবে।” (৮৪:৩-৪)
সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জমীন তার কলেজার টুকরোগুলোকে উগরে দিবে এবং বাইরে নিক্ষেপ করবে। স্বর্ণ রৌপ্য স্তম্ভের মত বাইরে বেরিয়ে পড়বে। হত্যাকারী সে সব দেখে বলবেঃ হায়! আমি এই ধন সম্পদের জন্য অমুককে হত্যা করে ছিলাম, অথচ আজ ওগুলো এভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, কেউ যেন ওগুলোর দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না!” আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দুর্ব্যবহারকারী দুঃখ করে বলবেঃ “হায়! এই ধন সম্পদের মোহে পড়ে আমি আমার আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাল ব্যবহার করিনি!” চোর বলবেঃ “হায়! এই মাল ধনের জন্যে আমার হাত কেটে দেয়া হয়েছিল!” অতঃপর ওগুলো তাদেরকে ডাকবে, কিন্তু তারা ওগুলো হতে কিছুই গ্রহণ করবে না।”
মোটকথা, সেই ধন সম্পদ এমনভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে যে, ওগুলোর প্রতি কেউ চোখ তুলেও চাইবে না। মানুষ বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে সেদিকে তাকিয়ে বলবেঃ হায়! এগুলোর তো নড়া চড়া করার কোন শক্তি ছিল এগুলো তো স্তব্ধ নিথর হয়ে পড়ে থাকতো। আজ এগুলোর কি হলো যে, এমন থরথর করে কাঁপছে! পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মৃতদেহ জমীন বের করে দিবে। তখন মানুষ বলবেঃ এর কি হলো? জমীন ও আসমান সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দেয়া হবে। ঐ দৃশ্য সবাই দেখবে এবং সবাইকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে হাযির করা হবে। জমীন খোলাখুলি ও সুস্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিবে যে, অমুক অমুক ব্যক্তি তার উপর অমুক অমুক নাফরমানী করেছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) এই আয়াতটি পাঠ করে বললেনঃ “জমীনের বৃত্তান্ত কি তা কি তোমরা জাননা?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আদম সন্তান যে সব আমল জমীনে করেছে তার সব কিছু জমীন এভাবে প্রকাশ করে দিবে, যে অমুক ব্যক্তি অমুক সময়ে অমুক জায়গায় এই এই পাপ ও এই এই পুণ্য কাজ করেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং আবু আবদির রহমান নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটি হাসান-সহীহ গারীব বলেছেন)
মু’জামে তিবরানীতে হযরত রাবীআহ হাদাসী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জমীনের ব্যাপারে সাবধান থেকো। ওটা তোমাদের মা। ওর উপর যে ব্যক্তি যে পাপ বা পুণ্য কাজ করবে সে তো খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করে দিবে।” এখানে অহী দ্বারা আদেশ করা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা জমীনকে বলবেনঃ ‘বলে দাও। তখন সে বলে দিবে। সেদিন মানুষ হিসাবের জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের দলে বিভক্ত হয়ে ফিরবে। কেউ হবে পুণ্যবান এবং কেউ হবে পাপী। কেউ জান্নাতী হবে, আবার কেউ জাহান্নামী হবে। এ অর্থও করা হয়েছে যে, এখান থেকে তারা পৃথক হবে, আর তারা মসবেত হবে না। এর কারণ হলো এই যে, তারা নিজেদের আমলসমূহ জেনে নিবে এবং ভালমন্দের প্রতিফল পেয়ে যাবে। এজন্যেই শেষেও একথাই বলে দেয়া হয়েছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঘোড়ার মালিকরা তিন প্রকারের। এক প্রকার হলো তারা যারা পুরস্কার ও পারিশ্রমিক লাভকারী। দ্বিতীয় প্রকার হলো তারা যাদের জন্যে ঘোড়া আবরণস্বরূপ। তৃতীয় প্রকার হলো তারা যাদের জন্যে ঘোড়া বোঝাস্বরূপ অর্থাৎ তারা পাপী।
পুরস্কার বা পারিশ্রমিক লাভকারী বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা জিহাদের উদ্দেশ্যে ঘোড়া পালন করে। যদি ঘোড়ার দেহে ও পায়ে শিথিলতা দেখা দেয় এবং ঐ ঘোড়া এদিক ওদিকের চারণ ভূমিতে বিচরণ করে তাহলে এজন্যেও মালিক সওয়াব লাভ করবে। যদি ঘোড়ার রশি ছিড়ে যায় এবং ঐ ঘোড়াটি এদিক ওদিক চলে যায় তবে তার পদচিহ্ন এবং মল মূত্রের জন্যেও মালিক সওয়াব বা পুণ্য লাভ করবে। মালিকের পানি পান করাবার ইচ্ছা না থাকলেও ঘোড়া যদি কোন জলাশয়ে গিয়ে পানি পান করে তাহলেও মালিক সওয়াব পাবে। এই ঘোড়া তার মালিকের জন্যে পুরোপুরি পুণ্য ও পুরস্কারের মাধ্যম। দ্বিতীয় হলো ঐ ব্যক্তি যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়ার জন্যে ঘোড়া পালন করেছে, যাতে প্রয়োজনের সময় অন্যের কাছে ঘোড়া চাইতে না হয়, কিন্তু সে আল্লাহর অধিকারের কথা নিজের ক্ষেত্রে এবং নিজের সওয়ারীর ক্ষেত্রে বিস্মৃত হয় না। এই সওয়ারী ঐ ব্যক্তির জন্যে পর্দা স্বরূপ। আর তৃতীয় হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে অহংকার এবং গর্বের কারণে এবং অন্যদের উপর জুলুম অত্যাচার করার উদ্দেশ্যে ঘোড়া পালন করে, এই পালন তার উপর একটা বোঝা স্বরূপ এবং তার জন্যে গুনাহ স্বরূপ। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে তখন জিজ্ঞেস করা হলোঃ “গাধা সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ তা’আলা আমার প্রতি এই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অর্থবহ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন যে, বিন্দুমাত্র পুণ্য এবং বিন্দুমাত্র পাপও প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ফারদাকের (রাঃ) চাচা হযরত সাআ’সাআ ইবনে মুআবিয়া (রাঃ) নবী (সঃ)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তার সামনে (আরবি) আয়াত দু’টি পাঠ করেন। তখন হযরত সাআ’সাআ (রাঃ) বলেনঃ “এ আয়াত দু’টিই আমার জন্যে যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশী যদি নাও শুনি তবুও কোন অসুবিধা হবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
সহীহ বুখারীতে হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অর্ধেক খেজুর সাদকা করার মাধ্যমে হলেও এবং ভাল কথার মাধ্যমে হলেও আগুন হতে আত্মরক্ষা করো।” একইভাবে সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “পুণ্যের কাজকে কখনো হালকা মনে করো না, নিজের বালতি দিয়ে পানি তুলে কোন পিপাসার্তকে পান করানো অথবা কোন মুসলমান ভাই এর সাথে অন্তরঙ্গ অনুভূতি সহকারে দেখা করাও পুণ্যের কাজ বলে মনে করবে।”
অন্য একটি সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “হে নারীদের দল! তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীদের পাঠানো উপঢৌকনকে তুচ্ছ মনে করো না, যদিও তারা এটা পায়ের গোড়ালীও অর্থাৎ খুরও পাঠায়। অন্য একটি হাদীসে রয়েছেঃ “ভিক্ষুককে কিছু না কিছু দাও, আগুনে পোড়া একটা খুর হলেও দাও।”
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে আয়েশা। (রাঃ)! পাপকে কখনো তুচ্ছ মনে করো না। মনে রেখো, তারও হিসাব হবে।”
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাথে আহার করছিলেন এমন সময় এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন খাবার হতে হাত তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপেরও বদলা আমাকে দেয়া হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! পৃথিবীতে তুমি যে সব দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছে তাতে তোমার ছোট খাট পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে, পুণ্যসমূহ তোমার জন্যে আল্লাহর কাছে রক্ষিত রয়েছে। এগুলোর প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে কিয়ামতের দিন তোমাকে প্রদান করা হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, এ সূরাটি হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর উপস্থিতিতে অবতীর্ণ হয়। তিনি শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “এই সূরাটি আমাকে কাঁদিয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না। এরূপ ধারণা করে তোমরা যদি গুনাহ না করতে তাহলে আল্লাহ তা’আলা অন্য কোন উম্মত সৃষ্টি করতেন যারা ভুল করতো ও গুনাহ করতো, অতঃপর পরম করুণাময় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করতেন।” (এ হাদীসটিও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি) যখন আয়াত দু’টি অবতীর্ণ হয় তখন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি কি আমার সব আমলই দেখবো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা।” তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “বড় বড় সব আমল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা” তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ “ছোট ছোট সব আমল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা তখন হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বললেনঃ “হায়, আফসোস!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “হে আবু সাঈদ (রাঃ)! খুশী হয়ে যাও, জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা’আলা পুণ্যের পরিমাণ দশগুণ হতে সাতশ গুণ পর্যন্ত দেন, এমনকি যাকে ইচ্ছা করেন তার চেয়েও বেশী প্রদান করেন কিন্তু গুনাহ সমপরিমাণই থাকবে অথবা আল্লাহ গুনাহগারকে ক্ষমা করে দিবেন। মনে। রাখবে যে, কোন লোককে শুধু তার আমল মুক্তি দিতে পারবে না।” একথা শুনে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) আপনাকেও নয়?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হ্যা, আমাকেও নয়। তবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে তার রহমত দ্বারা ঢেকে দিবেন। আবু যারআহ (রঃ) বলেন যে, (এই হাদীসটি শুধুমাত্র ইবনে লাহীআহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন, যখন(আরবি) (অর্থাৎ “আহার্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে (৭৬:৮)।” যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন মুসলমানরা মনে করেন যে, তারা সামান্য জিনিস প্রদান করলে কোন বিনিময় প্রাপ্ত হবেন না। তাই, তাদের দরজায় ফকীর মিকসীন আসলে তারা তাদেরকে এক আধটা খেজুর, রুটির টুকরা ইত্যাদি দেয়াকে বৃথা মনে করে শূন্য হস্তেই ফিরিয়ে দিতেন। তারা চিন্তা করতেন যে, যদি দিতে পারেন তবে ভালো ও উৎকৃষ্ট কোন জিনিসই দিবেন। এ ধরনের চিন্তা একটি দল করতেন। অন্য কেটি দল মনে করতেন যে, ছোট খাট পাপের জন্য কৈফিয়ত তলব করা হবে না। যেমন কখনো মিথ্যা কথা বলা, এদিক ওদিক তাকানো, কারো গীবত করা ইত্যাদি। তখন অবতীর্ণ হলো, (আরবি) এই আয়াত দু’টি। অর্থাৎ “কেউ অণু পরিমাণ সঙ্কাজ করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসত্তাজ করলে তাও দেখবে।” তাদেরকে আরো বলা হলোঃ ছোট খাট পুণ্য বা নেক কাজকে তুচ্ছ মনে করো ওটা বড়রূপে দেখা দিবে। আর ছোট খাট পাপকেও তুচ্ছ মনে করো না। কেন না, এই ছোট খাট পাপসমূহই একত্রিত হয়ে বিরাট আকার ধারণ করবে।”
এর অর্থ হলো ছোট পিপীলিকা। অর্থাৎ আমলনামায় ছোট বড় সব আমলই দেখা যাবে। গুনাহ তো একটির স্থলে একটিই লিখা হয়, কিন্তু পুণ্য বা নেককাজ একটির বদলে দশ, বরং যার জন্যে আল্লাহ চান এরচেয়ে অনেকগুণ বেশী লিখেন। আবার অনেক সময় নেকীর বদলে গুনাহ্ মার্জনাও করে দেন। এক একটি নেকীর বদলে দশ দশটি গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তারপর এমনও রয়েছে যে, যার পুণ্য বা নেকী গুনাহর চেয়ে একবিন্দু পরিমাণ বেশী হবে সে জান্নাতে প্রবেশাধিকার লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “পাপকে হালকা মনে করো সব পাপ একত্রিত হয়ে ধ্বংস করে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এসব পাপের উদাহরণ প্রসঙ্গে বলেনঃ “যেমন কিছু লোক কোন জায়গায় অবতরণ করলো। তারপর একটি লোক একটি দু’টি করে কাঠ কুড়িয়ে জমা করলো। এতে কাঠের একটা স্কুপ হয়ে গেল। তারপর ঐ কাঠে অগ্নি সংযোগ করা হলো এবং তারা যা ইচ্ছা করলো তা রান্না করলো।”
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
(৯৯-যিলযাল) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতে যিলযালাহা (زِلۡزَالَهَاۙ, শব্দ থেকে এই নামকরণ করা হয়েছে।
(৯৯-যিলযাল) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এর মক্কী বা মাদানী হবার ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে মাসউদ (রা., , আতা, জাবের ও মুজাহিদ বলেন, এটি মক্কী সূরা। ইবনে আব্বাসের (রা.) একটি উক্তিও এর সমর্থন করে। অন্যদিকে কাতাদাহ ও মুকাতিল বলেন, এটি মাদানী সূরা। এর মাদানী হবার সমর্থনে ইবনে আব্বাসেরও (রা.) আর একটি উক্তি পাওয়া যায়। ইবনে আবী হাতেম হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে যে রেওয়ায়াতটি উদ্ধৃত করেছেন তার থেকেও এর মাদানী হবার সমর্থনে প্রমাণ পেশ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে: যখন فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ – وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ আয়াতটি নাযিল হয় তখন আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম: “হে আল্লাহর রসূল! আমি কি আমার আমল দেখবো?” তিনি জবাব দিলেন, “হাঁ।” আমি বললাম, “এই বড় বড় গোনাহগুলোও দেখবো?” জবাব দিলেন, “হাঁ।” বললাম, “আর এই ছোট ছোট গোনাহগুলোও?” জবাব দিলেন, “হাঁ।” একথা শুনে আমি বললাম, “তাহলে তো আমি মারা পড়েছি।” তিনি বললেন, “আনন্দিত হও, হে আবু সাঈদ কারণ প্রত্যেক নেকী তার নিজের মতো দশটি নেকীর সমান হবে।” এই হাদীস থেকে এই সূরাটির মাদানী হবার ভিত্তিমূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) মদীনার অধিবাসী ছিলেন। ওহোদ যুদ্ধের পরে তিনি বালেগ হন। তাই যদি তাঁর উপস্থিতিতে নাযিল হয়ে থাকে তাহলে এর মাদানী হওয়া উচিত। কিন্তু আয়াত ও সূরার শানেনুযুল বর্ণনা সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেঈগণের যে পদ্ধতি ছিল তা ইতিপূর্বে সূরা দাহর এর ভূমিকায় আমি বর্ণনা করে এসেছি। তা থেকে জানা যায়, কোন আয়াত সম্পর্কে সাহাবীর একথা বলা যে, এ আয়াতটি অমুক ঘটনা প্রসংগে নাযিল হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট আয়াতটির ঐ সময় নাযিল হওয়ার চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। হতে পারে হযরত আবু সাঈদ জ্ঞান হবার পর যখন সর্বপ্রথম আয়াতটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে শুনেন তখন তার শেষ অংশ তাঁর মনে ভীতির সঞ্চার করে থাকবে এবং তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ওপরে বর্ণিত প্রশ্নগুলো করে থাকবেন। আর এই ঘটনাটিকে তিনি এমনভাবে বর্ণনা করে থাকবেন যাতে মনে হবে এই আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই প্রশ্নগুলো করেন। যদি এই হাদীসটি সামনে না থাকে তাহলে কুরআনকে বুঝে অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই অনুভব করবেন এটি একটি মক্কী সূরা। বরং এর বক্তব্য বিষয় ও বর্ণনাভঙ্গী থেকে অনুভূত হবে, এটি মক্কায় প্রাথমিক যুগে এমন সময় নাযিল হয় যখন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে ইসলামের বুনিয়াদি আকিদা-বিশ্বাস মানুষের সামনে পেশ করা হচ্ছিল।
(৯৯-যিলযাল) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এর বিষয়বস্তু মৃত্যুর পরবর্তী জীবন এবং সেখানে দুনিয়ায় করা সমস্ত কাজের হিসেব মানুষের সামনে এসে যাওয়া। সর্বপ্রথম তিনটি ছোট ছোট বাক্যে বলা হয়েছে, মৃত্যুর পর মানুষের দ্বিতীয় জীবনের সূত্রপাত কিভাবে হবে এবং মানুষের জন্য তা হবে কেমন বিস্ময়কর। তারপর দু’টি বাক্যে বলা হয়েছে, মানুষ এই পৃথিবীর বুকে অবস্থান করে নিশ্চিন্তে সব রকমের কাজ করে গেছে। সে কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই নিষ্প্রান জিনিস কোনদিন তার কাজকর্মের পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহর হুকুমে সেদিন সে কথা বলতে থাকবে। প্রত্যেকটি লোকের ব্যাপারে সে বলবে, কোন সময় কোথায় সে কি কাজ করেছিল। তারপর বলা হয়েছে, সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের নিজেদের কবর থেকে বের হয়ে দলে দলে আসতে থাকবে। তাদের কর্মকাণ্ড তাদেরকে দেখানো হবে। এমন পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিতভাবে এই কর্মকাণ্ড পেশ করা হবে যে, সামান্য বালুকণা পরিমাণ নেকী বা পাপও সামনে এসে যাবে।
সুরা: আয-যিলযাল
আয়াত নং :-1
টিকা নং:1,
اِذَا زُلْزِلَتِ الْاَرْضُ زِلْزَالَهَاۙ
যখন পৃথিবীকে প্রবলবেগে ঝাঁকুনি দেয়া হবে।১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) মূল শব্দগুলো হচ্ছে, زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ زِلْزَالَهَا ‘যালযালাহু’ মানে হচ্ছে, একাদিক্রমে পরপর জোরে জোরে ঝাড়া দেয়া। কাজেই زُلْزِلَتِ الْأَرْضُ বলতে ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে এবং ভূমিকম্পের পর ভূমিকম্পের মাধ্যমে পৃথিবীকে ভীষণভাবে কাঁপিয়ে দেয়া হবে। আর যেহেতু পৃথিবীকে নাড়া দেবার কথা বলা হয়েছে তাই এ থেকে আপনা-আপনিই এই অর্থ বের হয়ে আসে যে, পৃথিবীর কোন একটি অংশ কোন একটি স্থান বা অঞ্চল নয় বরং সমগ্র পৃথিবীকে কম্পিত করে দেয়া হবে। তারপর এই নাড়া দেবার এই ভূকম্পনের ভয়াবহতা আরো বেশী করে প্রকাশ করার জন্য তার সাথে বাড়তি زِلْزَالَهَا শব্দটিও বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এ শব্দটির শাব্দিক মানে হচ্ছে, “কম্পিত হওয়া।” অর্থাৎ তার মতো বিশাল ভুগোলককে যে ভাবে ঝাঁকানি দিলে কাঁপে অথবা যেভাবে ঝাঁকানি দিলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে ভীষণভাবে কাঁপে ঠিক সেভাবে তাকে ঝাঁকানি দেয়া হবে। কোন কোন মুফাসসির এই কম্পনকে প্রথম কম্পন ধরে নিয়েছেন। তাদের মতে কিয়ামতের প্রথম পর্বের সূচনা হবে যে কম্পন থেকে এটি হচ্ছে সেই কম্পন। অর্থাৎ যে কম্পনের পর দুনিয়ার সব সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার সমগ্র ব্যবস্থাপনা ওলট-পালট হয়ে যাবে। কিন্তু মুফাসসিরগণের একটি বড় দলের মতে যে কম্পনের মাধ্যমে কিয়ামতের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে অর্থাৎ যখন আগের পিছের সমস্ত মানুষ পুনর্বার জীবিত হয়ে উঠবে, এটি সেই কম্পন। এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি বেশী নির্ভুল। কারণ পরবর্তী সমস্ত আলোচনায় এই বিষয়টির প্রকাশ ঘটেছে।
সুরা: আয-যিলযাল
আয়াত নং :-2
টিকা নং:2,
وَ اَخْرَجَتِ الْاَرْضُ اَثْقَالَهَاۙ
পৃথিবী তার ভেতরের সমস্ত ভার বাইরে বের করে দেবে।২
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:২) এই বিষয়টি সূরা ইনশিকাকের ৪ আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে
وَأَلْقَتْ مَا فِيهَا وَتَخَلَّتْ
“আর যা কিছু তার মধ্যে রয়েছে তা বাইরে নিক্ষেপ করে দিয়ে খালি হয়ে যাবে।” এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে।
এক, মরা মানুষ মাটির বুকে যেখানে যে অবস্থায় যে আকৃতিতে আছে তাদের সবাইকে বের করে এনে সে বাইরে ফেলে দেবে। আর পরবর্তী বাক্য থেকে একথা প্রকাশ হচ্ছে যে, সে সময় তাদের সমস্ত শরীরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অংশগুলো এক জায়গায় জমা হয়ে নতুন করে আবার সেই একই আকৃতি সহকারে জীবিত হয়ে উঠবে যেমন সে তার প্রথম জীবনের অবস্থায় ছিল।
দুই, এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, কেবলমাত্র মরা মানুষদেরকে সে বাইরে নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হবে না বরং তাদের প্রথম জীবনের সমস্ত কথা ও কাজ এবং যাবতীয় আচার-আচরণের রেকর্ড ও সাক্ষ্য-প্রমাণের যে বিশাল স্তুপ তার গর্ভে চাপা পড়ে আছে সেগুলোকেও বের করে বাইরে ফেলে দেবে। পরবর্তী বাক্যটিতে একথারই প্রকাশ ঘটেছে। তাতে বলা হয়েছে, যমীন তার ওপর যা কিছু ঘটেছে তা বর্ণনা করবে।
তিন, কোন কোন মুফাসসির এর তৃতীয় একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন। সেটি হচ্ছে, সোনা, রূপা, মণিমাণিক্য এবং অন্যান্য যেসব মূল্যবান সম্পদ ভূ-গর্ভে সঞ্চিত রয়েছে সেগুলোর বিশাল বিশাল স্তুপ ও সেদিন যমীন উগড়ে দেবে। মানুষ দেখবে, এগুলোর জন্য তারা দুনিয়ায় প্রাণ দিতো। এগুলো কবজা করার জন্য তারা পরস্পর হানাহানি ও কাটাকাটি করতো। হকদারদের হক মেরে নিতো। চুরি ডাকাতি করতো, জলে-স্থলে দস্যুতা করতো। যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো এবং এক একটি সম্প্রদায় ও জাতিকে ধ্বংস করে দিতো। আজ এসব কিছু তাদের সামনে উপস্থিত। অথচ এগুলো এখন আর তাদের কোনো কাজে লাগবে না বরং উল্টো তাদের জন্য আযাবের সরঞ্জাম হয়ে রয়েছে।
সুরা: আয-যিলযাল
আয়াত নং :-3
টিকা নং:3,
وَ قَالَ الْاِنْسَانُ مَا لَهَاۚ
আর মানুষ বলবে, এর কি হয়েছে?৩
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৩) মানুষ অর্থ প্রত্যেকটি মানুষ হতে পারে। কারণ পুনরায় জীবন লাভ করে চেতনা ফিরে পাবার সাথে সাথেই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রথম প্রতিক্রিয়া এটিই হবে যে, এসব কি হচ্ছে? এটা যে হাশরের দিন একথা সে পরে বুঝতে পারবে। আবার মানুষ অর্থ আখেরাত অস্বীকারকারী মানুষ ও হতে পারো। কারণ যে বিষয়কে অসম্ভব মনে করতো তা তার সামনে ঘটে যেতে থাকবে এবং সে এসব দেখে অবাক ও পেরেশান হবে। তবে ঈমানদারদের মনে এ ধরনের বিস্ময় ও পেরেশানি থাকবে না। কারণ তখন তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও প্রত্যয় অনুযায়ীই সবকিছু হতে থাকবে। সূরা ইয়াসিনের ৫২ আয়াতটি এই দ্বিতীয় অর্থটি কতকটা সমর্থন করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে সময় আখেরাত অস্বীকারকারীরা বলবেঃ مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَرْقَدِنَا “কে আমাদের শয়নাগার থেকে আমাদের উঠালো? ” এর জবাব আসবেঃ هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ “এটি সেই জিনিস যার ওয়াদা করুণাময় করেছিলেন এবং আল্লাহর পাঠানো রসূলগণ সত্য বলেছিলেন।” ঈমানদাররাই যে কাফেরদেরকে এই জবাব দেবে, এ ব্যাপারে এই আয়াতটি সুস্পষ্ট নয়। কারণ আয়াতে একথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তবে ঈমানদারদের পক্ষ থেকে তারা এই জবাব পাবে, এ সম্ভাবনা অবশ্যি এখানে আছে।
সুরা: আয-যিলযাল
আয়াত নং :-4
টিকা নং:4,
یَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ اَخْبَارَهَاۙ
সেদিন সে তার নিজের (ওপর যা কিছু ঘটেছে সেই) সব অবস্থা বর্ণনা করবে।৪
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৪) হযরত আবু হুরাইরা (রা.) রেওয়ায়াত করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ এ আয়াতটি পড়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “জানো তার সেই অবস্থা কি? ” লোকেরা জবাব দেয়, আল্লাহ ও তাঁর রসূল ভালো জানেন। রসূল ﷺ বলেনঃ “সেই অবস্থা হচ্ছে, যমীনের পিঠে প্রত্যেক মানব মানবী যে কাজ করবে সে তার সাক্ষ্য দেবে। সে বলবে, এই ব্যক্তি অমুক দিন অমুক কাজ করেছিল। এই হচ্ছে সেই অবস্থা, যা যমীন বর্ণনা করবে।” (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে জারীর, আবদ ইবনে হুমাইদ, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া এবং বায়হাকী ফিশশু’আব) হযরত রাবআহ আল খারাশী রেওয়ায়াত করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “যমীন থেকে তোমরা নিজেদেরকে রক্ষা করে চলবে। কারণ এ হচ্ছে তোমাদের মূল ভিত্তি। আর এমনকোন ব্যক্তি নেই যে এর ওপর ভালো মন্দ কোনো কাজ করে এবং সে তার খবর দেয় না।” (মু ’জামুত তাবরানী) হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন যমীন এমন প্রতিটি কাজ নিয়ে আসবে। যা তার পিঠের ওপর করা হয়েছে।” তারপর তিনি এই আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। (ইবনে মারদুইয়া, বায়হাকী) হযরত আলী (রা.) সংক্রান্ত জীবনীগ্রন্থে লিখিত হয়েছেঃ বায়তুলমালের সমুদয় সম্পদ যখন তিনি হকদারদের মধ্যে বণ্টন করে সব খালি করে দিতেন তখন সেখানে দু’রাকাত নফল নামায পড়তেন। তারপর বলতেনঃ “তোকে সাক্ষ্য দিতে হবে, আমি তোকে সত্য সহকারে ভরেছি এবং সত্য সহকারে খালি করেছি।”
যমীনের ওপর যা কিছু ঘটে গেছে তার সবকিছু সে কিয়ামতের দিন বলে দেবে, যমীন সম্পর্কে একথাটি প্রাচীন যুগে মানুষকে অবাক করে দিয়ে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। কারণ তারা মনে করে থাকবে, যমীন আবার কেমন করে কথা বলবে? কিন্তু আজ পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত নতুন নতুন জ্ঞান-গবেষণা, আবিষ্কার–উদ্ভাবন এবং সিনেমা, লাউড স্পীকার, রেডিও, টেলিভিশন, টেপ রেকর্ডার ও ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদির আবিষ্কারের এ যুগে যমীন তার নিজের অবস্থা ও নিজের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী কিভাবে বর্ণনা করবে একথা অনুধাবন করা মোটেই কঠিন নয়। মানুষ তার মুখ থেকে যা কিছু উচ্চারণ করে তার পূর্ণঅবয়ব বাতাসে, রেডিও তরঙ্গে, ঘরের দেয়ালে, মেঝে ও ছাদের প্রতি অণু-পরমাণুতে এবং কোন পথে, ময়দানে বা ক্ষেতে কোন কথা বলে থাকলে সেখানকার প্রতিটি অণু কণিকায় তা গেঁথে আছে। আল্লাহ যখনি চাইবেন একথাগুলোকে এসব জিনিসের মাধ্যমে তখনই হুবহু ঠিক তেমনিভাবে শুনিয়ে দিতে পারবেন যেভাবে সেগুলো একদিন মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। সে সময় মানুষ নিজের কানেই নিজের এই আওয়াজ শুনে নেবে। তার পরিচিতিজনেরাও তার এই আওয়াজ চিনে নেবে এবং তারা একে তারই কন্ঠধ্বনি ও বাকভঙ্গীমা বলে সণাক্ত করবে। তারপর মানুষ যমীনের যেখানেই যে অবস্থায় যেকোনো কাজ করেছে তার প্রতিটি নড়াচড়া ও অঙ্গভঙ্গীর প্রতিচ্ছবি তার চারপাশের সমস্ত বস্তুতে পড়েছে এবং সেগুলোর মধ্যে সেসব চিত্রায়িত হয়ে রয়েছে। একেবারে নিকষ কালো আঁধারের বুকে সে কোনো কাজ করে থাকলেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীন এমনসব রশ্মি রয়েছে যেগুলোর কাছে আলো-আঁধার সমান, তারা সকল অবস্থায় তার ছবি তুলতে পারে। এসব ছবি কিয়ামতের দিন একটি সচল ফিল্মের মতো মানুষের সামনে এসে যাবে এবং সারাজীবন সে কোথায় কি করেছে তা তাকে দেখিয়ে দেবে।
আসলে প্রত্যেক মানুষের কর্মকাণ্ড আল্লাহ সরাসরি জানলেও আখেরাতে যখন তিনি আদালত কায়েম করবেন তখন সেখানে যাকেই শাস্তি দেবেন ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দাবী পুরোপুরি পালন করেই শাস্তি দেবেন। তাঁর আদালতে প্রত্যেকটি অপরাধী মানুষের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হবে তার সপক্ষে এমনসব অকুটিল সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করা হবে যার ফলে তার অপরাধী হবার ব্যাপারে কারো কোন কথা বলার অবকাশ থাকবে না। সর্বপ্রথম পেশ করা হবে তার আমলনামা। সবসময় তার সাথে লেগে থাকা কেরামান কাতেবীন ফেরেশতাদ্বয় তার প্রত্যেকটি কথা ও কাজ রের্কড করছেন। ( সূরা কাফ-১৭ আয়াত , সূরা ইনফিতার ১০-১২ আয়াত) । এ আমলনামা তার হাতে দিয়ে দেয়া হবে। তাকে বলা হবে, তোমার জীবনের এই কার্যবিবরণী পড়ো। নিজের হিসেবে নেবার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট। ( বনি ইসরাঈল ১৪ ) মানুষ তা পড়ে অবাক হয়ে যাবে। কারণ ছোট বড় এমন কোন বিষয় নেই যা তাতে যথাযথভাবে সংযোজিত হয়নি। ( আল কাহাফ ৪৯ ) এরপর হচ্ছে মানুষের নিজের শরীর। দুনিয়ায় এই শরীরের সাহায্যে সে সমস্ত কাজ করেছে। আল্লাহর আদালতে তার জিহবা সাক্ষ্য দেবে, সে দুনিয়ায় কি কি কথা বলেছে, তার নিজের হাত পা সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে দিয়ে সে কোন্ কোন্ কাজ করিয়েছে। ( আন নূর ২৪ ) তার চোখজোড়া সাক্ষ্য দেবে। তার কান সাক্ষ্য দেবে, তার সাহায্যে সে কি কি কথা শুনেছে। তার শরীরের গায়ে লেপ্টে থাকা চামড়া তার যাবতীয় কাজের সাক্ষ্য দেবে। সে পেরেশান হয়ে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলবে, তোমরাও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছো? তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জবাব দেবে, আজ যে আল্লাহর হুকুমে সমস্ত জিনিস চলছে তাঁরই হুকুমে আমরাও চলছি। (হা-মীম সাজদাহ ২০ থেকে ২২ ) এরপরে আছে আরো অতিরিক্ত সাক্ষ্য। এই সাক্ষ্যগুলো পেশ করা হবে যমীন ও তার চারপাশের সমগ্র পরিবেশ থেকে। সেখানে নিজের আওয়াজ মানুষ নিজের কানে শুনবে। নিজের প্রতিটি কাজকর্মের প্রতিচ্ছবি নিজের চোখেই দেখবে। এর চাইতেও অগ্রসর হয়ে দেখা যাবে, মানুষের মনে যেসব চিন্তা, ইচ্ছা, সংকল্প ও উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল এবং যেসব নিয়তের মাধ্যমে সে নিজের সমস্ত কাজ করেছিল তাও সব সামনে এনে রেখে দেয়া হবে। যেমন সামনে সূরা আদিয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। এ কারণে এবং এ ধরনের চূড়ান্ত ও জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সামনে এসে যাবার পর মানুষ অবাক ও নির্বাক হয়ে যাবে। নিজের পক্ষ থেকে ওজর পেশ করার কোন সুযোগই তার থাকবে না। (আল মুরসালাত ৩৫-৩৬ )
সুরা: আয-যিলযাল
আয়াত নং :-6
টিকা নং:5, 6,
یَوْمَئِذٍ یَّصْدُرُ النَّاسُ اَشْتَاتًا١ۙ۬ لِّیُرَوْا اَعْمَالَهُمْؕ
সেদিন লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় ফিরে আসবে,৫ যাতে তাদের কৃতকর্ম তাদেরকে দেখানো যায়।৬
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৫) এর দু’টো অর্থ হতে পারে।
এক, প্রত্যেক ব্যক্তি একাকী তার ব্যক্তিগত অবস্থায় অবস্থান করবে। পরিবার, গোষ্ঠী, জোট, দল, সম্প্রদায় ও জাতি সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানেও একথা বলা হয়েছে। যেমন সূরা আন’আমে রয়েছে, সেদিন মহান আল্লাহ লোকদের বলবেনঃ “নাও, এখন তুমি এমনিতেই একাকী আমার সামনে হাজির হয়ে গেছো, যেমন আমি প্রথমবার তোমাকে সৃষ্টি করেছিলাম।” ( ৯৪ আয়াত ) আর সূরা মারয়ামে বলা হয়েছেঃ “একাকী আমার কাছে আসবে।” ( ৮০ আয়াত ) আরো বলা হয়েছেঃ “তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে একাকী হাযির হবে।” ( ৯৫ আয়াত )
দুই, এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, বিগত হাজার হাজার বছরে সমস্ত মানুষ যে যেখানে মরেছিল সেখান থেকে অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে চলে আসতে থাকবে। যেমন সূরা নাবায় বলা হয়েছেঃ “যে দিন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তোমার দলে দলে এসে যাবে। ( ১৮ আয়াত ) এছাড়া বিভিন্ন তাফসীরকার এর যে অর্থ বর্ণনা করেছেন তার অবকাশ এখানে উল্লেখিত “আশতাতান” (أَشْتَاتًا) শব্দের মধ্যে নেই। তাই আমার মতে সেগুলো এই শব্দটির অর্থগত সীমাচৌহদ্দীর বাইরে অবস্থান করছে। যদিও বক্তব্য হিসেবে সেগুলো সঠিক এবং কুরআন ও হাদীস বর্ণিত কিয়ামতের অবস্থা ও ঘটনাবলীর সাথে সামঞ্জস্য রাখে।
টিকা:৬) এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, তাদের আমল তাদেরকে দেখানো হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকে দুনিয়ায় কি কাজ করে এসেছে তা তাকে বলা হবে। দুই, তাদেরকে তাদের কাজের প্রতিফল দেখানো হবে। যদিও لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ বাক্যটির জন্য এই দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করা যেতে পারে তবুও যেহেতু আল্লাহ এখানে لِيُرَوْا جزاء أَعْمَالَهُمْ (তাদের কাজের প্রতিফল দেখাবার জন্য) না বলে বলেছেন لِيُرَوْا أَعْمَالَهُمْ (তাদের কাজগুলো দেখানো হবে) তাই সঙ্গতভাবেই প্রথম অর্থটি এখানে অগ্রাধিকার পাবে। বিশেষ করে যখন কুরআন মজীদের বিভিন্নস্থানে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কাফের ও মু’মিন, সৎকর্মশীল ও ফাসেক, আল্লাহর হুকুমের অনুগত ও নাফরমান সবাইকে অবশ্যি তাদের আমলনামা দেয়া হবে। (উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা আল হাক্কার ১৯ ও ২৫ এবং সূরা আল ইনশিকাকের ৭-১০ আয়াত ) একথা সুস্পষ্ট, কাউকে তার কার্যাবলী দেখিয়ে দেয়া এবং তার আমলনামা তার নিজের হাতে সোপর্দ করার মধ্যে কোন তফাত নেই। তাছাড়া যমীন যখন তার ওপর অনুষ্ঠিত ঘটনাবলী পেশ করবে তখন হক ও বাতিলের যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ শুরু থেকে চলে আসছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে, তার সম্পূর্ণ চিত্রও সবার সামনে এসে যাবে। সেখানে সবাই দেখবে, সত্যের জন্য যারা কাজ করেছিল তারা কি কি কাজ করেছে এবং মিথ্যার সমর্থকরা তাদের মোকাবেলায় কি কি কাজ করেছে। হিদায়াতের পথে আহ্বানকারী ও গোমরাহী বিস্তারকারীদের সমস্ত শুনবে, এটা কোন অসম্ভব কথা নয়। উভয় পক্ষের সমগ্র রচনা ও সাহিত্যের রেকর্ড অবিকল সবার সামনে এনে রেখে দেয়া হবে। হকপন্থীদের ওপর বাতিল পন্থীদের জুলুম এবং উভয় পক্ষের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সমূহের দৃশ্যাবলী হাশরের ময়দানে উপস্থিত লোকেরা নিজেদের চোখেই দেখে নেবে।
সুরা: আয-যিলযাল
আয়াত নং :-8
টিকা নং:7,
وَ مَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا یَّرَهٗ۠
এবং যে অতি অল্প পরিমাণ খারাপ কাজ করবে সে তা দেখে নেবে।৭
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:৭) এটি হচ্ছে এর একটি সহজ-সরল অর্থ। আবার একথা সম্পূর্ণ সত্য যে, মানুষের অনু পরিমাণ নেকী বা পাপ এমন হবে না যা তার আমলনামায় লিখিত হবে না। তাকে সে অবশ্য দেখে নেবে। কিন্তু দেখে নেবার মানে যদি এই হয় যে, তার পুরস্কার ও শাস্তি দেখে নেবে, তাহলে এর এ অর্থ নেয়া ভুল হবে যে আখেরাতে প্রত্যেকটি সামান্যতম নেকীর পুরস্কার এবং প্রত্যেকটি সামান্যতম পাপের শাস্তি প্রত্যেক ব্যক্তিকে দেয়া হবে। আরকোন ব্যক্তিও সেখানে নিজের কোন নেকীর পুরস্কার থেকে বঞ্চিত এবং পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না। কারণ তাই যদি হয় তাহলে প্রথমত এর মানে হবে, প্রত্যেকটি খারাপ কাজের শাস্তি এবং প্রত্যেকটি ভালো কাজের পুরস্কার আলাদা আলাদা দেয়া হবে। দ্বিতীয়ত এর মানে এও হবে, কোন উচ্চ পর্যায়ের সৎ ও মু’মিন কোন ক্ষুদ্রতম গোনাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না। আর কোন জঘন্যতম কাফের, জালেম এবং পাপীও কোন ক্ষুদ্রতম সৎকাজের পুরস্কার না পেয়ে যাবে না। এ দু’টি অর্থ কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিরোধী এবং বুদ্ধিও একে ইনসাফের দাবী বলে মেনে নিতে পারে না। বুদ্ধির দৃষ্টিতে বিচার করলে একথা কেমন করে বোধগম্য হতে পারে যে, আপনার একজন কর্মচারী আপনার একান্ত অনুগত, বিশ্বস্ত ও নিবেদিত প্রাণ কিন্তু তার কোন সামান্যতম ত্রুটির আপনি মাফ করেন না? তার প্রতিটি সেবা-কর্মের পুরস্কার দেবার সাথে সাথে তার প্রতিটি ত্রুটির জন্যও আপনে গুণে গুণে তাকে শাস্তিও দেবেন? ঠিক তেমনি বুদ্ধির দৃষ্টিতে একথাও দুর্বোধ্য যে, আপনার অর্থ ও সাহায্য-সহযোগীতায় লালিত পালিত কোন ব্যক্তি যার প্রতি রয়েছে আপনার অসংখ্য অনুগ্রহ, সে আপনার সাথে বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং অনুগ্রহের জবাবে হামেশা নিমকহারামী করতে থাকে। কিন্তু আপনি তার সামগ্রিক কার্যক্রম ও দৃষ্টিভঙ্গী উপেক্ষা করে তার প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য তাকে পৃথক শাস্তি এবং তার ছোট-খাটো কোন সেবামূলক কাজের জন্য হয়তো সে কখনো আপনাকে খাবার জন্য এক গ্লাস পানি এনে দিয়েছিল বা কখনো আপনাকে পাখা দিয়ে বাতাস করে ছিল—আপনি তাকে আলাদাভাবে পুরস্কৃত করবেন আর কুরআন ও হাদীসের ব্যাপারে বলা যেতে পারে, সেখানে সুস্পষ্টভাবে মু’মিন, মোনাফেক, কাফের, সৎ মু’মিন, গোনাহগার মু’মিন, জালেম ও ফাসেক মু’মিন, নিছক কাফের এবং জালেম ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাফের ইত্যাদি বিভিন্নধরনের লোকদের পুরস্কার ও শাস্তির জন্য একটি বিস্তারিত আইন বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই পুরস্কার ও শাস্তি মানুষের সমগ্র জীবনের ওপর পরিব্যাপ্ত।
এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদ নীতিগতভাবে কয়েকটি কথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বর্ণনা করেঃ
একঃ কাফের, মুশরিক ও মোনাফেকের কর্মকাণ্ড (অর্থাৎ এমনসব কর্মকাণ্ড যেগুলোকে নেকী মনে করা হয়) নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আখেরাতে তারা এর কোন প্রতিদান পাবে না। এগুলোর যা প্রতিদান, তা তারা দুনিয়াতেই পেয়ে যাবে। এ জন্য উদাহরণস্বরূপ দেখুন আল আরাফ ১৪৭ , আত তাওবা ১৭ , ৬৭-৬৯ , হুদ ১৫-১৬ , ইবরাহীম ১৮ , আল কাহফ ১০৪-১০৫ , আন নূর ৩৯ , আল ফুরকান ২৩ , আল আহযাব ১৯ , আয যুমার ৬৫ এবং আল আহকাফ ২০ আয়াত )
দুইঃ পাপের শাস্তি ততটুকু দেয়া হবে যতটুকু পাপ করা হয়। কিন্তু নেকীর পুরস্কার মূল কাজের তুলনায় বেশী দেয়া হবে। বরং কোথাও বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজের ইচ্ছেমতো নেকীর প্রতিদান বাড়িয়ে দেবেন। দেখুন আল বাকারাহ ২৬১, আল আনআম ১৬০ , ইউনুস ২৬-২৭ , আন নূর ৩৮ , আল কাসাস ৮৪ , সাবা ৩৭ এবং আল মু’মিন ৪০ আয়াত ।
তিনঃ মু’মিন যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকে তাহলে তার ছোট গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে। দেখুন আন নিসা ৩১ , আশ শূরা ৩৭ এবং আন নাজম ৩২ আয়াত।
চারঃ সৎ মু’মিনের কাছ থেকে হালকা হিসেব নেয়া হবে। তার গোনাহগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। তার ভালো ও উত্তম আমলগুলোর দৃষ্টিতে বিচার করে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। দেখুন আনকাবুত ৭ , আযযুমার ৩৫ , আল আহকাফ ১৬ এবং আল ইনশিকাক ৮ আয়াত।
হাদীসের বক্তব্য এ বিষয়টিকে একেবারে পরিষ্কার করে দেয়। ইতিপূর্বে সূরা ইনশিকাকের ব্যাখ্যার কিছু হাদীস উল্লেখ করেছি। কিয়ামতের দিন হালকা ও কড়া হিসেবের বিষয়টিকে বুঝাবার জন্য রসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাখ্যা করেছেন। (এ জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ইনশিকাক ৬ টীকা) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আহার করেছিলেন এমন সময় এই আয়াতটি নাযিল হয়। হযরত আবু বকর (রা.) খাবার থেকে হাত গুঁটিয়ে নেন। তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রসূল! যে অণু পরিমাণ খারাপ কাজ আমি করেছি তার ফলও কি আমি দেখে নেবো? ” জবাব দেনঃ “হে আবু বকর! দুনিয়ায় যেসব বিষয়েরই তুমি সম্মুখীন হও তার মধ্যে যেগুলো তোমার অপছন্দনীয় ও অপ্রীতিকর ঠেকে সেগুলোই তুমি যেসব অণু পরিমাণ অসৎকাজ করেছো তার বদলা এবং সেসব অণু পরিমাণ নেকীর কাজই তুমি করো সেগুলো আল্লাহ আখেরাতে তোমার জন্য সংরক্ষণ করে রাখছেন।” (ইবনে জারীর, ইবনে আবী হতেম, তাবারনী ফিল আওসাত, বাইহাকী ফিশ শু’আব, ইবনুল মুনযির, হাকেম, ইবনে মারদুইয়া ও আবদ ইবনে হুমাইদ) এই আয়াতটি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ ﷺ হযরত আবু আইউব আনসারীকেও বলেছিলেনঃ “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই নেকী করবে তার পুরষ্কার সে পাবে আখেরাতে। আর যে ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ করবে বিপদ-আপদ ও রোগের আকারে এই দুনিয়ায় তার শাস্তি পেয়ে যাবে।” (ইবনে মারদুইয়া)। কাতাদাহ হযরত আনাসের (রা.) বরাত দিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত বাণীটি উদ্ধৃত করেছেনঃ “আল্লাহ মু’মিনের প্রতি জুলুম করেন না। দুনিয়ায় তার নেকীর প্রতিদানে তাকে রিযিক দান করেন এবং আখেরাতে আবার এর পুরস্কার দেবেন। আর কাফেরের ব্যাপারে দুনিয়ায় তার সৎকাজের প্রতিদান দিয়ে দেন, তারপর যখন কিয়ামত হবে তখন তার খাতায় কোন নেকী লেখা থাকবে না।” (ইবনে জারীর) মাসরূক হযরত আয়েশা (রা.) থেকে রেওয়ায়াত করেছেনঃ তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, “আবদুল্লাহ ইবনে জুদ’আন জাহেলীযুগে আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করতো, মিসকিনকে আহার করাতো, মেহমানদের আপ্যায়ন করাতো, বন্দিদের মুক্তি দান করতো। আখেরাতে এগুলো কি তার জন্য উপকারী হবে? ”রসূলুল্লাহ ﷺ জবাব দেন “না, সে মরার সময় পর্যন্ত একবারও বলেনি,
رَبِّ اغْفِرْلِى خَطِيْئَتِىْ يَوْمَ الدِّيْنِ
(হে আমার রব! শেষ বিচারের দিন আমার ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করে দিয়ো।)”(ইবনে জারীর) অন্যান্য আরো কিছু লোকের ব্যাপারেও রসূলুল্লাহ ﷺ এই একই জবাব দেন। তারা জাহেলী যুগে সৎকাজ করতো কিন্তু কাফের ও মুশরিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কোন বাণী থেকে জানা যায়, কাফেরের সৎকাজ তাকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না ঠিকই তবে জালেম ফাসেক ব্যভিচারী কাফেরকে জাহান্নামে যে ধরনের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে তার শাস্তি তেমনি পর্যায়ের হবে না। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ হাতেম তাঈ এর দানশীলতার কারণে তাকে হালকা আযাব দেয়া হবে। (রূহুল মা’আনী)
তবুও এ আয়াতটি মানুষকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ব্যাপারে সজাগ করে দেয়। সেটি হচ্ছে, প্রত্যেকটি সামান্যতম ও নগণ্যতম সৎকাজেরও একটি ওজন ও মূল্য রয়েছে এবং অনুরূপ অবস্থা অসৎকাজেরও। অর্থাৎ অসৎকাজ যত ছোটই হোক না কেন অবশ্যি তার হিসেব হবে এবং তা কোন ক্রমেই উপেক্ষা করার মতো নয়। তাই কোন ছোট সৎকাজকে ছোট মনে না করা উচিত। কারণ এই ধরনের অনেকগুলো ছোট গোনাহ একত্র হয়ে একটি বিরাট গোনাহের স্তুপ জমে উঠতে পারে। একথাটিই রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর হাদীসে ব্যক্ত করেছেন। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আদী ইবনে হাতেম (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো-তা এক টুকরা খেজুর দান করার বা একটি ভালো কথা বলার বিনিময়েই হোক না কেন।” হযরত আদী ইবনে হাতেম থেকে সহীহ রেওয়ায়াতের মাধ্যমে আরো বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “কোন সৎকাজকেও সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, যদিও তা কোন পানি পানেচ্ছু ব্যক্তির পাত্রে এক মগ পানি ঢেলে দেয়াই হয় অথবা তোমার কোন ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাত করাই হয়।” বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে একটি রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ মেয়েদেরকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ “হে মুসলিম মেয়েরা! কোন প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীনীর বাড়িতে কোন জিনিস পাঠানোকে সামান্য ও নগণ্য মনে করো না, তা ছাগলের পায়ের একটি খুর হলেও।” মুসনাদে আহমাদ, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ-এ হযরত আয়েশার (রা.) একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “হে আয়েশা! যেসব গোনাহকে ছোট মনে করা হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকো। কারণ আল্লাহর দরবারে সেগুলো সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “সাবধান, ছোট গোনাহসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষা কর। কারণ সেগুলো সব মানুষের ওপর একত্র হয়ে তাকে ধ্বংস করে দেবে।” (গোনাহ কবীরা ও গোনাহ সগীরার পার্থক্য বুঝার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নিসা ৫৩ টীকা ও আন নাজম ৩২ টীকা )।
ফী জিলালিল কুরআন:-
যখন পৃথিবীকে ভীষণভাবে দোলানো হবে এবং পৃথিবী নিজের ভেতরকার সমস্ত বোঝা বাইরে নিক্ষেপ করবে এবং মানুষ বলে উঠবে, পৃথিবীর কী হয়েছে? সেদিন পৃথিবী নিজেই নিজের অবস্থা বলে দেবে। কেননা তোমার প্রভু তাকে এরূপ করার নির্দেশ দিয়েছেন ।’ এটি কেয়ামতের দিনের বিবরণ । এ সময়ে স্থিতিশীল পৃথিবী প্রকম্পিত হবে এবং তার ভেতরে যতো ভারী বস্তু যথা বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ ও খনিজ দ্রব্যাদি, যা সে দীর্ঘকাল যাবত বহন করে চলেছে, তা ছুঁড়ে ফেলে দেবে এবং দীর্ঘকালের ভারমুক্ত হয়ে সে হালকা হয়ে যাবে। এটি এমন একটি দৃশ্য যা এই সূরার শ্রোতাদের মনে হতে থাকে যেন পায়ের নীচে সব কিছু টলটলায়মান, কোনো মতেই যেন স্থির হয়ে দাড়াতে পারছে না। তাদের পায়ের নিচে মাটি যেন দুরুদুরু করে কাপছে ও দুলছে। এটি এমন একটি অবস্থার প্রতিচ্ছবি, যা মনকে পৃথিবীর সকল সংলগ্নকারী জিনিসের সংলগ্নতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তাকে স্থায়ী ও স্থিতিশীল মনে করে। কোরআনে অংকিত এ ধরনের দৃশ্যপটসমূহের এটা হচ্ছে প্রথম প্রতিক্রিয়া । কোরআন এ ধরনের দৃশ্যপটকে শুধু অংকিতই করে না, বরং তার ভেতরে এমন একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে, যা শোনামাত্রই শ্রোতার স্নায়ুতন্ত্রীতে স্থানাস্তরিত হবার উপক্রম হয়। আর এই নিদর্শন আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন দৃশ্যপটের সমান্তরালে মানুষ কে এবং তার প্রতিক্রিয়াকেও চিত্রিত করা হয়। এই দৃশ্য দেখেই ‘মানুষ বলে পৃথিবীর কী হয়েছে?’ এটি এমন এক হতবুদ্ধি, হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমুঢ় ব্যক্তির জিজ্ঞাসা, যে তার কল্পনা বহির্ভূত একটা জিনিস দেখতে পাচ্ছে, যা সে বুঝতে পারছে না, তার মুখোমুখি হচ্ছে এবং যা দেখে চুপ করে এবং ধৈর্য ধারণ করে থাকা যায় না তা দেখতে পাচ্ছে। ‘তার কী হয়েছে?’ অর্থাৎ কি কারণে সে কাপছে? যেন এ কথা বলার সময় সে নিজেও পৃথিবীর সাথে সাথে দুলছে এবং তাকে ধরে রাখতেও সহায়তা দিতে পারে এমন যে কোন বস্তু আঁকড়ে ধরার সে চেষ্টা করছে। কেননা তার আশপাশের সবকিছু প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত ও আলোড়িত হচ্ছে। মানুষ ইতিপূর্বে অনেক ভূমিকম্প এবং অনেক আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ দেখেছে। আর সে সব দুর্ঘটনা দেখে ভয় ও আতংক ভুগেছে এবং অনেক ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু সে কেয়ামতের দিনের বিস্ফোরণের কোনো সাদৃশ্যই দেখবে না। এটা একটা অভিনব জিনিস, যা সে আগে কখনো দেখেনি, যার কোনো রহস্য সে বুঝতে পারবে না, যার কোনো, নযীর সে দেখবে না। তা এমন এক বিভীষিকা, যা সেই দিনই প্রথম সংঘটিত হবে । ‘ যেদিন পৃথিবী তার সকল খবর বলবে’ অর্থাৎ যেদিন এই ভুমিকম্প হবে এবং তার সামনে মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে, সেদিন পৃথিবী নিজের সকল তথ্য ফাস করবে, ‘তার প্রভু তাকে এরূপ করতে বলেছেন।’ অর্থাৎ তাকে দুলতে, কাপতে এবং ভেতরের সকল বোঝা ছুঁড়ে ফেলতে বলেছেন। তাই সে তার নির্দেশ পালন করেছে । ‘সে তার প্রভুর নির্দেশ পালন করবে এবং সেইটি তার জন্য উপযুক্ত ।’ সে তার খবর জানাবে । বস্তুত এই ভয়ংকর পরিস্থিতি স্বয়ং একটি বর্ণনা বিশেষ, যা পৃথিবী কর্তৃক নেপথ্য থেকে আল্লাহর আদেশ ও ওহীপ্রাপ্তির সুস্পষ্ট প্রমাণ । এখানে ‘ মানুষ’ হতচকিত ও বন্দী । সূরার বক্তব্য আতংক, ভীতি, উদ্বেগ, উৎকষ্ঠা ও আলোড়ন প্রতিফলিত করে । মানুষ ভীতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞাসা করবে ‘তার কী হয়েছে?’ অর্থাৎ তাকে হাশর, হিসাব-নিকাশ, ওযন ও কর্মফলের সম্মুখীন হতে হচ্ছে কেন? ব্যাপার কি? ‘যেদিন মানুষ আত্মপ্রকাশ করবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়, যাতে তাদের আমলনামা দেখানো হয় ।’ এক পলকের ভেতরেই আমরা দেখতে পাই কবর থেকে উত্থানের দৃশ্য । ‘সেদিন মানুষ আত্মপ্রকাশ করবে বিচ্ছিন্নভাবে ।’ অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকেরা বিচ্ছিন্নতাবে উঠে এসে হাযির হবে। ‘যেন তারা বিক্ষিপ্তি পংগপাল ।’ এটাও মানুষের জন্য একটি অভিনব ও অচিন্তনীয় দৃশ্য ৷ পূর্ব ও পরের সমস্ত সৃষ্টি সর্বদিক থেকে জীবিত হয়ে উঠে আসবে । ‘যেদিন পৃথিবী দ্রুতগতিতে তাদের ওপর থেকে সরে পড়বে ।’ যখনই দৃষ্টি প্রসারিত হবে, তারা একটি আকৃতি দেখবে এবং তৎক্ষণাৎ দ্রুতগতিতে সেদিকে চলতে আরম্ভ করবে । আশেপাশে কোনো দিকে তারা দৃষ্টিপাত করার ফুরসত পাবে না। ঘাড় লম্বা করে চোখ বিস্ফারিত করে ‘আহ্বানকারীর দিকে ছুটবে ।’ সেদিন প্রত্যেকের এমন ঝামেলা থাকবে যে, অন্যের দিকে সে নযর দিতে পারবে না। কেয়ামতের এই দৃশ্যের বর্ণনা দিতে মানবীয় ভাষা অপারগ ৷ এক কথায় বলা যায়, দৃশ্যটা ভয়াবহ, আতংকজনক, বীভৎস ও বিব্রতকর। এসব শব্দ এবং আরো যতো শব্দ অভিধানে আছে, এ পরিস্থিতির বর্ণনা দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। “সেদিন মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ করবে, যাতে তাদের আমলনামা দেখতে পায় ।” এটা হচ্ছে আরো কঠিন ও ভয়াবহ পরিস্থিতি । যেখানে আমলনামা দেখানো হবে, তারা সেদিকেই যাবে, যাতে তারা আমলনামা দেখতে পায় এবং কর্মফল লাভ করে । নিজের কাজের মুখোমুখি দাড়ানো মানুষের জন্য অনেক সময় তার প্রতিফল ভোগ করার চেয়েও নির্মম ও বিব্রতকর হয়ে থাকে। মানুষ যখন নিজের বিবেকের দংশনে ও অনুশোচনায় জর্জরিত হয়, তখন নিজের ঘৃণ্য অপকর্ম একাকী দেখেও তার বিরক্তি লাগে। আর মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ ও সমগ্র সৃষ্টিজগতের সামনে নিজের কাতোর মুখোমুখি হওয়া তো আরো মারাত্মক ব্যাপার । শুধু আমলনামার সম্মুখীন হওয়া বা দেখাও একটা ভয়ংকর শাস্তি। ‘ আর যে কণা পরিমাণও খারাপ কাজ করবে, তাও সে দেখতে পাবে ।’ প্রাচীন তাফসীরকাররা বলতেন ‘যাররা’ অর্থ মশা ৷ আবার কেউ কেউ বলতেন, সূর্যরশ্মিতে প্রতিভাত হয় এমন ধূলিকণা কেননা তখনকার সময়ে এগুলোই ক্ষুদ্রতম বস্তু হিসাবে ‘যাররা’র প্রতিশব্দ গণ্য হতো । তবে এখন আমরা জানি যে, ‘যাররা’ এমন জিনিস, যা সূর্যালোকে দৃশ্যগোচর ধূলিকণার চেয়েও অনেক ক্ষুদ্র। ধুলিকণা তো খালি চোখে দেখা যায় কিন্তু ‘যাররা’ বা পরমাণুকে বৃহত্তম অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় না। বৈজ্ঞানিকদের মস্তিষ্কে তা ‘স্বপ্ন’ মাত্র। আজ পর্যন্ত কেউ একে খালি চোখেও দেখেনি, অণুবীক্ষণ দিয়েও দেখেনি, যা কিছু দেখেছে, তা হচ্ছে পরমাণুর আলামত মাত্র এত ক্ষুদ্র পরিমাণ ভালো বা মন্দ কাজের ফলও মানুষকে ভোগ করতে হবে। সুতরাং মানুষের ছোট বা বড় কোনো কাজকেই তুচ্ছ মনে করা উচিত নয়। এ তো ছোট জিনিস। এর হিসাবও নেই, ওযনও নেই । এরূপ বলাটা আদৌ ঠিক নয়। সেই সুক্ষতম দাড়িপাল্লা যেমন পরমাণুকে মাপতে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে কিংবা শূন্যে উঠে যায়, ঠিক তেমনি নিজের ক্ষুদ্রতম আমলের সামনে গিয়েও মানুষের অনুভূতি শক্তি কেঁপে উঠবে। মোমেনের অন্তর ছাড়া আর কোন কিছুর সাথে এই দাড়িপাল্লার তুলনা হয় না। কেননা এই অন্তর অণু পরিমাণ ভালো বা মন্দ কাজকেও অনুভব করে। অথচ পৃথিবীতে এমন হৃদয়ও আছে যা পাহাড় সমান পাপ দেখেও কাপে না। সে সব হৃদয় পাহাড়ের চেয়ে বড়, ভালো ও কল্যাণের কাজকে নষ্ট করে দিয়েও তার মধ্যে কিছুমাত্র প্রতিক্রিয়া হয় না। পৃথিবীতে সে সব হৃদয় অসাড়, অনুভুতিহীন, হিসাবের দিন নিজের বোঝার নিচে পিষ্ট হবে এই হৃদয়গুলো ।