أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২১৬/হে মানুষ:-২৩)
[# وَ الۡعَصۡرِ ۙ
সময়ের কসম।]
সুরা: ১০৩:সুরা: আল-আসর
পারা:৩০
১-৩ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1216/O Ye Mankind:-23]
[ # By time,:-]
Surah.103: Al-Asr
Para:30 Ayat:- 1-3Motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১২১৬/হে মানুষ:-২৩)
[# وَ الۡعَصۡرِ ۙ
সময়ের কসম।]
সুরা: ১০৩:সুরা: আল-আসর
পারা:৩০
১-৩ নং আয়াতের বেখ্যা :-
#তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন:-
#তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:-
সুরা: আল-আসর
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
* ভূমিকা:১০৩
(১০৩-আসর) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতের “আল আসর” (الْعَصْرِ) শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
(১০৩-আসর) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
মুজাহিদ, কাতাদাহ ও মুকাতিল একে মাদানী বলেছেন। কিন্তু মুফাস্সিরগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একে মক্কী সূরা হিসেবে গণ্য করেছেন। আর এই সূরার বিষয়বস্তু সাক্ষ্য দেয়, এটি মক্কী যুগেরও প্রাথমিক পর্যায়ে নাযিল হয়ে থাকবে। সে সময় ইসলামের শিক্ষাকে সংক্ষিপ্ত ও অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী বাক্যের সাহায্যে বর্ণনা করা হতো। এভাবে শ্রোতা একবার শুনার পর ভুলে যেতে চাইলেও তা আর ভুলতে পারতো না এবং আপনা আপনি লোকদের মুখে তা উচ্চারিত হতে থাকতো।
(১০৩-আসর) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এ সূরাটি ব্যাপক অর্থবোধক সংক্ষিপ্ত বাক্য সমন্বিত বাণীর একটি অতুলনীয় নমুনা। কয়েকটা মাপাজোকা শব্দের মধ্যে গভীর অর্থের এমন এক ভাণ্ডার রেখে দেয়া হয়েছে যা বর্ণনা করার জন্য একটি বিরাট গ্রন্থও যথেষ্ট নয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের এবং তার ধ্বংস ও সর্বনাশের পথ বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম শাফেঈ যথার্থই বলেছেন, লোকেরা যদি এই সূরাটি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এই একটি সূরাই তাদের হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট। সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূরা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হিসন দারেমী আবু মাদ্বীনার বর্ণনা অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তি যখন পরস্পর মিলিত হতেন তখন তারা একজন অপরজনকে সূরা আসর না শুনানো পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিদায় নিতেন না। (তাবারানী)
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : মাত্র তিনটি আয়াতের সমাহার এই ক্ষুদ্র সূরাটিতে মানব জীবনের জন্যে একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান বিদ্যমান । এ জীবন বিধানের রূপরেখা, অবিকল ইসলাম যেমন মানব জীবনের জন্যে হওয়া উচিত বলে প্রত্যাশা করে, তেমনি। অত্যন্ত স্পষ্ট, নিখুঁত ও সূক্ষভাবে ঈমানী ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার বৈশিষ্টগুলোকে তার সর্বব্যাপী ও বিরাট মূলতত্ত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে এই সূরায় । সত্যি বলতে কি, এ সূরাটি তার শেষ আয়াতে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি শব্দের মধ্য দিয়ে গোটা ইসলামী শাসনতন্ত্র ও সংবিধান রচনা ও প্রতিষ্ঠিত করেছে, মুসলিম উম্মাহর জাতিসত্ত্বার বর্ণনা দিয়েছে, তার প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছে । এটি এমন এক অলৌকিক কীর্তি, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সম্পাদন করতে সক্ষম নয়। যে মহাসত্যক এই সুরা সামগ্রিকভাবে তুলে ধরে, তাহলো সকল যুগে ও সর্বকালে মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে একটিমাত্র জীবন যাপন পদ্ধতি ছিলো এবং আছে, যা লাভজনক ও উপকারী এবং যা মানুষের মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে। যে জীবন যাপন পদ্ধতির সীমারেখা এই সূরায় অংকিত হয়েছে এবং যে জীবন ব্যবস্থার রূপ কাঠামো এই সূরায় দেয়া হয়েছে, সেটিই উল্লেখিত জীবন ব্যবস্থা । এর বাইরে যতো রকমের জীবনাচার ও জীবন পদ্ধতি আছে, তার সবই সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক ।
সুরা: আল-আসর
আয়াত নং :-1
وَ الْعَصْرِۙ
সময়ের কসম।
সুরা: আল-আসর
আয়াত নং :-2
اِنَّ الْاِنْسَانَ لَفِیْ خُسْرٍۙ
নিশ্চয়ই মানুষ আসলে বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে।
সুরা: আল-আসর
আয়াত নং :-3
টিকা নং:1,
اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوْا بِالْحَقِّ١ۙ۬ وَ تَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ۠
তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং একজন অন্যজনকে হক কথার ও সবর করার উপদেশ দিতে থেকেছে।১
তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:
টিকা:১) এ সূরায় একথার ওপর সময়ের কসম খাওয়া হয়েছে যে, মানুষ বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে এবং এই ক্ষতি থেকে একমাত্র তারাই রক্ষা পেয়েছে যারা চারটি গুণাবলীর অধিকারীঃ (১) ঈমান, (২) সৎকাজ, (৩) পরস্পরকে হকের উপদেশ দেয়া এবং (৪) একে অন্যকে সবর করার উপদেশ দেয়া। আল্লাহর এই বাণীর অর্থ সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য এখন এখানে প্রতিটি অংশের ওপর পৃথকভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
কসম সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমি বহুবার সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছি। আল্লাহ সৃষ্টিকুলের কোন বস্তুর শ্রেষ্ঠত্ব, অভিনবত্ব ও বিস্ময়করতার জন্য কখনো তার কসম খাননি। বরং যে বিষয়টি প্রমাণ করা উদ্দেশ্যে এই বস্তুটি তার সত্যতা প্রমাণ করে বলেই তার কসম খেয়েছেন। কাজেই সময়ের কসমের অর্থ হচ্ছে, যাদের মধ্যে উল্লেখিত চারটি গুণাবলী রয়েছে তারা ছাড়া বাকি সমস্ত মানুষ বিরাট ক্ষতির মধ্যে অবস্থান করছে, সময় এর সাক্ষী।
সময় মানে বিগত সময়— অতীত কালও হতে পারে আবার চলতি সময়ও। এই চলতি বা বর্তমান কাল আসলে কোন দীর্ঘ সময়ের নাম নয়। বর্তমান কাল প্রতি মুহূর্তে বিগত হচ্ছে এবং অতীতে পরিণত হচ্ছে। আবার ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে প্রতিটি মুহূর্ত বের হয়ে এসে বর্তমানে পরিণত হচ্ছে এবং বর্তমান থেকে আবার তা অতীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখানে যেহেতু কোন বিশেষত্ব ছাড়াই শুধু সময়ের কসম খাওয়া হয়েছে, তাই দুই ধরনের সময় বা কাল এর অন্তর্ভুক্ত হয়। অতীত কালের কসম খাওয়ার মানে হচ্ছেঃ মানুষের ইতিহাস এর সাক্ষ্য দিচ্ছে, যারাই এই গুণাবলী বিবর্জিত ছিল তারাই পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর বর্তমান কালের কসম খাওয়ার অর্থ বুঝতে হলে প্রথমে একথাটি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, বর্তমানে যে সময়টি অতিবাহিত হচ্ছে সেটি আসলে এমন একটি সময় যা প্রত্যেক ব্যক্তি ও জাতিকে দুনিয়ায় কাজ করার জন্য দেয়া হয়েছে। পরীক্ষার হলে একজন ছাত্রকে প্রশ্নপত্রের জবাব দেবার জন্য যে সময় দেয়া হয়ে থাকে তার তুলনা করা যেতে পারে। নিজের ঘড়িতে কিছুক্ষণের জন্য সেকেন্ডের কাঁটার চলার গতি লক্ষ্য করলে এই সময়ের দ্রুত গতিতে অতিবাহিত হবার বিষয়টি উপলব্ধি করা যাবে। অথচ একটি সেকেণ্ডও সময়ের একটি বিরাট অংশ। একমাত্র একটি সেকেণ্ড আলো এক লাখ ছিয়াশী হাজার মাইলের পথ অতিক্রম করে। এখনো আমরা না জানতে পারলেও আল্লাহর রাজ্যে এমন অনেক জিনিসও থাকতে পারে যা এর চাইতেও দ্রুত গতি সম্পন্ন। তবুও ঘড়িকে সেকেণ্ডের কাঁটার চলার যে গতি আমরা দেখি সময়ের চলার গতি যদি তাই ধরে নেয়া হয় এবং যা কিছু ভালো-মন্দ কাজ আমরা করি আর যেসব কাজেও আমরা ব্যস্ত থাকি সবকিছুই দুনিয়ায় আমাদের কাজ করার জন্য যে সীমিত জীবন কাল দেয়া হয়েছে তার মধ্যেই সংঘটিত হয়, এ ব্যাপারটি নিয়ে যদি আমরা চিন্তা-ভাবনা করি তাহলে আমরা অনুভব করতে পারি যে, এই দ্রুত অতিবাহিত সময়ই হচ্ছে আমাদের আসল মূলধন। ইমাম রাযী এই পর্যায়ে একজন মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “একজন বরফওয়ালার কাছে থেকে আমি সূরা আসরের অর্থ বুঝেছি। সে বাজারে জোর গলায় হেঁকে চলছিল— দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি গলে যাচ্ছে। দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি গলে যাচ্ছে। তার একথা শুনে আমি বললাম, এটিই হচ্ছে আসলে الْعَصْرِ – إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ বাক্যের অর্থ। মানুষকে যে আয়ুষ্কাল দেয়া হয়েছে তা বরফ হয়ে যাবার মতো দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একে যদি নষ্ট করে ফেলা হয় অথবা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তাহলে সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতি।” কাজেই চলমান সময়ের কসম খেয়ে এই সূরায় যে কথা বলা হয়েছে তার অর্থ এই যে, এই দ্রুত গতিশীল সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই চারটি গুণাবলী শূন্য হয়ে মানুষ যে কাজেই নিজের জীবন কাল অতিবাহিত করে তার সবটুকুই ক্ষতির সওদা বৈ কিছুই নয়। এই চারটি গুণে গুণান্বিত হয়ে যারা দুনিয়ায় কাজ করে একমাত্র তারাই লাভবান হয়। এটি ঠিক তেমনি ধরনের একটি কথা যেমন একজন ছাত্র পরীক্ষার হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রশ্নপত্রের জবাব দেবার পরিবর্তে অন্য কাজে সময় নষ্ট করছে তাকে আমরা হলের দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলিঃ এই দ্রুত গতিশীল সময় বলে দিচ্ছে, তুমি নিজের ক্ষতি করছো। যে ছাত্র এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের প্রশ্নপত্রের জবাব দেবার কাজে ব্যয় করছে একমাত্র সেই লাভবান।
মানুষ শব্দটি একবচন। কিন্তু পরের বাক্যে চারটি গুণ সম্পন্ন লোকদেরকে তার থেকে আলাদা করে নেয়া হয়েছে। এ কারণে একথটি অবশ্যি মানতে হবে যে, এখানে মানুষ শব্দটি জাতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তি, জাতি ও সমগ্র মানব সম্প্রদায় এর মধ্যে সমানভাবে শামিল। কাজেই উপরোল্লিখিত চারটি গুণাবলী কোন ব্যক্তি, জাতি বা সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ যার-ই মধ্যে থাকবে না সে-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এই বিধানটি সর্বাবস্থায় সত্য প্রমাণিত হবে। এটি ঠিক তেমনি ধরনের ব্যাপার যেমন আমরা বলি, বিষ মানুষের জন্য ধ্বংসকর। এক্ষেত্রে এর অর্থ হবে, বিষ সর্বাবস্থায় ধ্বংসকর হবে, এক ব্যক্তি খেলেও, একটি জাতি খেলেও বা সারা দুনিয়ার মানুষেরা সবাই মিলে খেলেও বিষের ধ্বংসকর ও সংহারক গুণ অপরিবর্তনীয়। এক ব্যক্তি বিষ খেয়েছে বা একটি জাতি বিষ খেয়েছে অথবা সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ বিষ খাবার ব্যাপারে একমত হয়ে গেছে, এ দৃষ্টিতে তার মধ্যে গুণগত কোন ফারাক দেখা যাবে না। অনুরূপভাবে মানুষের জন্য সূরায় উল্লেখিত চারটি গুণাবলী শূন্য হওয়া যে ক্ষতির কারণ, এটিও একটি অকাট্য সত্য। এক ব্যক্তি এই গুণাবলী শূন্য হোক অথবা কোন জাতি বা সারা দুনিয়ার মানুষেরা কুফরী করা, অসৎকাজ করা এবং পরস্পরকে বাতিল কাজে উৎসাহিত করা ও নফসের বন্দেগী করার উপদেশ দেবার ব্যাপারে একমত হয়ে যাক তাতে এই সার্বজনীন মূলনীতিতে কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয় না।
এখন দেখা যাক ‘ক্ষতি’ শব্দটি কুরআন মজীদে কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আভিধানিক অর্থে ক্ষতি হচ্ছে লাভের বিপরীত শব্দ। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এ শব্দটির ব্যবহার এমন সময় হয় যখন কোন একটি সময় লোকসান হয়। পুরা ব্যবসাটায় যখন লোকসান হতে থাকে তখনো এর ব্যবহার হয়। আবার সমস্ত পুঁজি লোকসান দিয়ে যখন কোন ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যায় তখনো এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কুরআন মজীদ এই একই শব্দকে নিজের বিশেষ পরিভাষায় পরিণত করে কল্যাণ ও সফলতার বিপরীত অর্থে ব্যবহার করছে। কুরআনের সাফল্যের ধারণা যেমন নিছক পার্থিব সমৃদ্ধির সমার্থক নয় বরং দুনিয়া থেকে নিয়ে আখেরাত পর্যন্ত মানুষের প্রকৃত ও যথার্থ সাফল্য এর অন্তর্ভুক্ত, অনুরূপভাবে তার ক্ষতির ধারণাও নিছক পার্থিব ব্যর্থতা ও দুরবস্থার সমার্থক নয় বরং দুনিয়া থেকে নিয়ে আখেরাত পর্যন্ত মানুষের সমস্ত যথার্থ ব্যর্থতা ও অসাফল্য এর আওতাভুক্ত হয়ে যায়। সাফল্য ও ক্ষতির কুরআনী ধারণার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে আমি বিভিন্ন স্থানে করে এসেছি। তাই এখানে আবার তার পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন দেখি না। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল ‘আ’রাফ ৯ টীকা , আল আনফাল ৩০ টীকা , ইউনুস ২৩ টীকা , বনি ইসরাঈল ১০২ টীকা , আল হাজ্জ ১৭ টীকা , আল মু’মিনূন ১ , ২ , ১১ ও ৫০ টীকা এবং লোকমান ৪ টীকা , আয্ যুমার ৩৪ টীকা। ) এই সঙ্গে একথাটিও ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, যদিও কুরআনের দৃষ্টিতে আখেরাতে মানুষের সাফল্যই তার আসল সাফল্য এবং আখেরাতে তার ব্যর্থতাই আসল ব্যর্থতা তবুও এই দুনিয়ায় মানুষ যেসব জিনিসকে সাফল্য নামে অভিহিত করেছে তা আসলে সাফল্য নয় বরং এই দুনিয়াতেই তার পরিণাম ক্ষতির আকারে দেখা দিয়েছে এবং যে জিনিসকে মানুষ ক্ষতি মনে করেছে তা আসলে ক্ষতি নয় বরং এই দুনিয়াতেই তা সাফল্যে পরিণত হয়েছে। কুরআন মজীদে বিভিন্ন স্থানে এই সত্যটি বর্ণনা করা হয়েছে। যথার্থ স্থানে আমি এর ব্যাখ্যা করে এসেছি। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন আন নামল ৯৯ টীকা , মারয়াম ৫৩ টীকা , ত্বা-হা ১০৫ টীকা ) কাজেই কুরআন যখন পূর্ণ বলিষ্ঠতার সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঘোষণা দিচ্ছে, “আসলে মানুষ বিরাট ক্ষতির মধ্যে অবস্থান করছে” তখন এর অর্থ হয় দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানের ক্ষতি। আর যখন সে বলে, এই ক্ষতির হাত থেকে একমাত্র তারাই রেহাই পেয়েছে যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত চারটি গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছে, তখন এর অর্থ হয় ইহাকাল ও পরকাল উভয় জগতে ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাওয়া এবং সাফল্য লাভ করা। এখন এই সূরার দৃষ্টিতে যে চারটি গুণাবলীর উপস্থিতিতে মানুষ ক্ষতিমুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে সে সম্পর্কিত আলোচনায় আসা যাক।
এর প্রথম গুণটি হচ্ছে ঈমান। যদিও এ শব্দটি কুরআন মজীদের কোন কোন স্থানে নিছক মৌখিক স্বীকারোক্তির অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে (যেমন আন নিসা ১৩৭ আয়াত , আল মায়েদাহ ৫৪ আয়াত , আল আনফাল ২০ ও ২৭ আয়াত, আত তাওবা ৩৮ আয়াত এবং আসসাফ ২ আয়াত ) তবুও আসল ব্যবহার হয়েছে সাচ্চা দিলে মেনে নেয়া ও বিশ্বাস করা অর্থে। আরবী ভাষায়ও এই শব্দটি এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক দৃষ্টিতে أَمَنَ لَهُ তার অর্থ হয় صَدَّقَهُ وَاعْتَمَدَ عَلَيْهِ (তাকে সত্য বলেছে ও তার প্রতি আস্থা করেছে) আর أَمَنَ بِهِ এর অর্থ হয় اَيْقَنَ بِهِ (তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে)। কুরআন যে ঈমানকে প্রকৃত ঈমান বলে গণ্য করে নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে তাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছেঃ
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا
“মু’মিন তো আসলে তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনে আর তারপর সংশয়ে লিপ্ত হয় না।” ( আল হুজুরাত ১৫ )
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا
“যারা বলেছে, আল্লাহ আমাদের রব আর তারপর তার ওপর অবিচল হয়ে গেছে।” ( হা-মীম আস সাজদাহ ৩০ )
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ
“আসলে তারাই মু’মিন, আল্লাহর কথা উচ্চারিত হলে যাদের দিল কেঁপে ওঠে। ( আনফাল ২ )
والَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ (البقرة : 165)
“যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ও অত্যন্ত মজবুতির সাথে ভালোবাসে।” ( বাক্বারা-১৬৫ )
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
“কাজেই, না (হে নবী!) তোমার রবের কসম, তারা কখনোই মু’মিন নয়, যতক্ষণ না তাদের পারস্পরিক বিরোধে তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে না মেনে নেয়। তারপর যা কিছু তুমি ফায়সালা করো সে ব্যাপারে তারা মনে কোন প্রকার সংকীর্ণতা অনুভব করে না বরং মনে প্রাণে মেনে নেয়।” ( আন নিসা ৬৫ )
নিম্নোক্ত আয়াতটিতে ঈমানের মৌখিক স্বীকারোক্তি ও প্রকৃত ঈমানের মধ্যে পার্থক্য আরো বেশী করে প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে আসল লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃত ঈমান, মৌখিক স্বীকারোক্তি নয়ঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনো।” ( আন নিসা ১৩৬ )
এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, ঈমান আনা বলতে কিসের ওপর ঈমান আনা বুঝাচ্ছে? এর জবাবে বলা যায়, কুরআন মজীদে একথাটি একবারে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমত আল্লাহকে মানা। নিছক তাঁর অস্তিত্ব মেনে নেয়া নয়। বরং তাঁকে এমনভাবে মানা যাতে বুঝা যায় যে, তিনি একমাত্র প্রভু ও ইলাহ। তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বে কোন অংশীদার নেই। একমাত্র তিনিই মানুষের ইবাদাত, বন্দেগী ও আনুগত্য লাভের অধিকারী। তিনিই ভাগ্য গড়েন ও ভাঙেন। বান্দার একমাত্র তাঁরই কাছে প্রার্থনা এবং তাঁরই ওপর নির্ভর করা উচিত। তিনিই হুকুম দেন ও তিনিই নিষেধ করেন। তিনি যে কাজের হুকুম দেন তা করা ও যে কাজ থেকে বিরত রাখতে চান তা না করা বান্দার ওপর ফরয। তিনি সবকিছু দেখেন ও শোনেন। মানুষের কোন কাজ তাঁর দৃষ্টির আড়ালে থাকাতো দূরের কথা, যে উদ্দেশ্যে ও নিয়তের ভিত্তিতে মানুষে কাজটি করে তাও তাঁর অগোচরে থাকে না। দ্বিতীয়ত রসূলকে মানা। তাঁকে আল্লাহর নিযুক্ত পথপ্রদর্শক ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবে মানা। তিনি যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দিয়েছেন, তা সবই সত্য এবং অবশ্যি গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়া। ফেরেশতা, অন্যান্য নবীগণ, আল্লাহর কিতাবসমূহ এবং কুরআনের প্রতি ঈমান আনাও এই রসূলের প্রতি ঈমান আনার অন্তর্ভুক্ত। কারণ আল্লাহর রসূলই এই শিক্ষাগুলো দিয়েছেন। তৃতীয়ত আখেরাতকে মানা। মানুষের এই বর্তমান জীবনটিই প্রথম ও শেষ নয়, বরং মৃত্যুর পর মানুষকে পুনরায় জীবিত হয়ে উঠতে হবে, নিজের এই দুনিয়ার জীবনে সে যা কিছু কাজ করেছে আল্লাহর সামনে তার জবাবদিহি করতে হবে এবং হিসেব-নিকেশে যেসব লোক সৎ গণ্য হবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে এবং যারা অসৎ গণ্য হবে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে, এই অর্থে আখেরাতকে মেনে নেয়া। ঈমান, নৈতিক চরিত্র ও জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের জন্য এটি একটি মজবুত বুনিয়াদ সরবরাহ করে। এর ওপর একটি পাক-পবিত্র জীবনের ইমারত গড়ে উঠতে পারে। নয়তো যেখানে আদতে ঈমানের অস্তিত্বই নেই সেখানে মানুষের জীবন যতই সৌন্দর্য বিভূষিত হোক না কেন তার অবস্থা একটি নোঙ্গরবিহীন জাহাজের মতো। এই জাহাজ ঢেউয়ের সাথে ভেসে যেতে থাকে এবং কোথাও স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
ঈমানের পরে মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটি অপরিহার্য সেটি হচ্ছে সৎকাজ। কুরআনের পরিভাষায় একে বলা হয় সালেহাত। (صَّالِحَاتِ) সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কোন ধরনের সৎকাজ ও সৎবৃত্তি এর বাইরে থাকে না। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিতে যে কাজের মূলে ঈমান নেই এবং যা আল্লাহ ও তাঁর রসূল প্রদত্ত হেদায়াতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়নি তা কখনো ‘সালেহাত’ তথা সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাই কুরআন মজীদের সর্বত্র সৎকাজের আগে ঈমানের কথা বলা হয়েছে এবং এই সূরায়ও ঈমানের পরেই এর কথা বলা হয়েছে। কুরআনের কোন এক জায়গায়ও ঈমান ছাড়া সৎকাজের কথা বলা হয়নি এবং কোথাও ঈমান বিহীন কোন কাজের পুরস্কার দেবার আশ্বাসও দেয়া হয়নি। অন্যদিকে মানুষ নিজের কাজের সাহায্যে যে ঈমানের সত্যতা প্রমাণ পেশ করে সেটিই হয় নির্ভরযোগ্য ও কল্যাণকর ঈমান। অন্যথায় সৎকাজ বিহীন ঈমান একটি দাবী ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ এই দাবী সত্ত্বেও যখন আল্লাহ ও তাঁর রসূল নির্দেশিত পথ ছেড়ে অন্যপথে চলে তখন আসলে সে নিজেই তার এই দাবীর প্রতিবাদ করে। ঈমান ও সৎকাজের সম্পর্ক বীজ ও বৃক্ষের মতো। বীজ মাটির মধ্যে না থাকা পর্যন্ত কোন বৃক্ষ জন্মাতে পারে না। কিন্তু যদি বীজ মাটির মধ্যে থাকে এবং কোন বৃক্ষ না জন্মায় তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় মাটির বুকে বীজের সমাধি রচিত হয়ে গেছে। এজন্য কুরআন মজীদে যতগুলো সুসংবাদ দেয়া হয়েছে তা এমন সব লোকদেরকে দেয়া হয়েছে যারা ঈমান এনে সৎকাজ করে। এই সূরায়ও একথাটিই বলা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটির অপরিহার্য প্রয়োজন সেটি হচ্ছে ঈমান আনার পর সৎকাজ করা। অন্য কথায়, সৎকাজ ছাড়া নিছক ঈমান মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না।
উপরোক্ত গুণগুলো তো ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে থাকতে হবে। এরপর এ সূরাটি আরো দু’টি বাড়তি গুণের কথা বলে। ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য এ গুণ দু’টি থাকা জরুরী। এ গুণ দু’টি হচ্ছে, যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের পরস্পরকে হক কথা বলার ও হক কাজ করার এবং ধৈর্যের পথ অবলম্বন করার উপদেশ দিতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রথমত ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের পৃথক পৃথক ব্যক্তি হিসেবে অবস্থান না করা উচিত। বরং তাদের সম্মিলিত একটি মু’মিন ও সৎ সমাজদেহ গড়ে উঠতে হবে। দ্বিতীয়ত এই সমাজ যাতে বিকৃত না হয়ে যায় সে দায়িত্ব সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে উপলব্ধি করতে হবে। এজন্য এই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যকে হক পথ অবলম্বন ও সবর করার উপদেশ দেবে, এটা তাদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
হক শব্দটি বাতিলের বিপরীত। সাধারণত এ শব্দটি দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একঃ সঠিক, নির্ভুল, সত্য, ন্যায় ও ইনসাফ অনুসারী এবং আকীদা ও ঈমান বা পার্থিব বিষয়াদির সাথে সম্পর্কিত প্রকৃত সত্য অনুসারী কথা। দুইঃ আল্লাহর, বান্দার বা নিজের যে হকটি আদায় করা মানুষের জন্য ওয়াজিব হয়ে থাকে। কাজেই পরস্পরকে হকের উপদেশ দেবার অর্থ হচ্ছে, ঈমানদারদের এই সামাজটি এমনি অনুভূতিহীন নয় যে, এখানে বাতিল মাথা উঁচু করতে এবং হকের বিরুদ্ধে কাজ করে যেতে থাকলেও লোকেরা তার নীরব দর্শক হয় মাত্র। বরং যখন ও যেখানেই বাতিল মাথা উঁচু করে তখনই সেখানে হকের আওয়াজ বুলন্দকারীরা তার মোকাবেলায় এগিয়ে আসে, এই সমাজে এই প্রাণশক্তি সর্বক্ষণ প্রবাহিত থাকে। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই কেবল সত্যপ্রীতি ও সত্যনীতি ও ন্যায়-নিষ্ঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে না এবং হকদারদের হক আদায় করেই ক্ষান্ত হয় না বরং অন্যদেরকে এই কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করার উপদেশ দেয়। এই জিনিসটিই সমাজকে নৈতিক পতন ও অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার জামানত দেয়। যদি কোন সমাজে এই প্রাণ শক্তি না থাকে তাহলে সে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। যারা নিজেদের জায়গায় হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিন্তু নিজেদের সমাজে হককে বিধ্বস্ত হতে দেখে নিরব থাকবে তারাও একদিন এই ক্ষতিতে লিপ্ত হবে। একথাটিই সূরা মায়েদায় বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ হযরত দাউদ ও হযরত ঈসা ইবনে মারয়ামের মুখ দিয়ে বনি ইসরাঈলদের ওপর লানত করা হয়েছে। আর এই লানতের কারণ ছিল এই যে, তাদের সামজে গোনাহ ও জুলুম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং লোকেরা পরস্পরকে খারাপ কাজে বাধা দেয়া থেকে বিরত থেকেছিল ( ৭৮-৭৯ আয়াত ) আবার একথাটি সূরা আ’রাফে এভাবে বলা হয়েছেঃ বনী ইসরাঈলরা যখন প্রকাশ্যে শনিবারের বিধান অমান্য করে মাছ ধরতে শুরু করে তখন তাদের ওপর আযাব নাযিল করা হয় এবং সেই আযাব থেকে একমাত্র তাদেরকেই বাঁচানো হয় যারা লোকেদেরকে এই গোনাহর কাজে বাধা দেবার চেষ্টা করতো। ( ১৬৩-১৬৬ আয়াত) সূরা আনফালে আবার একথাটি এভাবে বলা হয়েছেঃ সেই ফিত্নাটি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করো যার ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষভাবে শুধুমাত্র সেসব লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না যারা তোমাদের মধ্যে গোনাহ করেছে। ( ২৫ আয়াত ) এজন্যই সৎকাজের আদেশ করা এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখাকে উম্মাতে মুসলিমার দায়িত্ব ও কর্তব্য গণ্য করা হয়েছে। ( আলে ইমরান ১০৪ ) সেই উম্মাতকে সর্বোত্তম উম্মাত বলা হয়েছে, যারা এই দায়িত্ব পালন করে। ( আলে ইমরান ১১০)
হকের নসিহত করার সাথে সাথে দ্বিতীয় যে জিনিসটিকে ঈমানদারগণকে ও তাদের সমাজের ক্ষতি থেকে বাচাঁর জন্য অপরির্হায শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, এই সমাজের ব্যক্তিবর্গ পরস্পরকে সবর করার উপদেশ দিতে থাকবে। অর্থাৎ হককে সমর্থন করতে ও তার অনুসারী হতে গিয়ে যেসব সমস্যা ও বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং এ পথে যেসব কষ্ট, পরিশ্রম, বিপদ-আপদ, ক্ষতি ও বঞ্চনা মানুষকে নিরন্তর পীড়িত করে তার মোকাবেলায় তারা পরস্পরকে অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। সবরের সাথে কিছু বরদাশত করার জন্য তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যকে সাহস যোগাতে থাকবে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আদ্ দাহর ১৬ টীকা এবং আল বালাদ ১৪ টীকা )।
ফী জিলালিল কুরআন:
“মহাকালের শপথ, মানুষমাত্রই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা নয়, যারা ঈমান এনেছে,সৎ কাজ করেছে, সত্যের সপক্ষে মানুষকে উপদেশ দিয়েছে এবং ধৈর্যের সপক্ষে উপদেশ দিয়েছে ।” সেই জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে ঈমান, সৎকাজ, সত্যের উপদেশ ও ধৈর্যের উপদেশ-এই চারের সমষ্টি । বৈশিষ্টমণ্ডিত ঈমান : এখানে আমরা ঈমানের ফেকাহ শাস্ত্রীয় সংজ্ঞা দিচ্ছি না। আমরা ঈমানের স্বরূপ ও মানব জীবনে তার মূল্য ও গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করছি। যে মহান স্রষ্টা খোদ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তার থেকেই গোটা সৃষ্টির উৎপত্তি হয়েছে। এ কারণেই সেই উৎস থেকে উৎসারিত অন্যান্য সৃষ্টিজগতের সাথে, এই জগতকে পরিচালনাকারী ফেরেশতা ও আল্লাহ্র অনুগত অন্যান্য শক্তির সাথে এবং এই জগতে সঞ্চিত শক্তিসমূহের সাথে তাকে সম্পর্ক ও সংযোগ স্থাপন করতে ও রক্ষা করতে হবে। আর এ কারণে তাকে তার নিজ সত্ত্বার ক্ষুদ্র গন্ডী থেকে বেরিয়ে জগতের বিশাল প্রান্তরে স্থান নিতে হবে । তার দুর্বল শক্তির সংকীর্ণ সীমানার ভেতর থেকে বেরিয়ে অজানা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের যাত্রা করতে হবে। তার ক্ষুদ্র জীবনের গন্ডী থেকে বেরিয়ে অনন্তকালীন জীবনের দিকে যাত্রা করতে হবে-যে জীবনের সীমা পরিসীমা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। (লেখকের ‘ইসলাম ও বিশ্বশান্তি’ নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) । এই সংযোগ ও সম্পর্ক মানুষকে শক্তি, সামর্থ ও স্থিতি দান করে, তাছাড়াও তাকে জগত কিছু সম্পদ ও সৌন্দর্য প্রদান করে থাকে। অনুরূপভাবে তার আত্মা আল্লাহর কিছু সৃষ্টির আত্মার সহানুভূতি লাভ করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে, ইহকালীন জীবন আসলে মানুষের জন্যে প্রতিষ্ঠিত একটি খোদায়ী মেলায় পরিভ্রমণের শামিল। পৃথিবীর সর্বত্র ও সর্বক্ষণ এই মেলা বিদ্যমান । এই জীবন একটা বিরাট সৌভাগ্য, একটা নির্মল আনন্দ এবং জীবন ও জগতের সাথে সখ্য ঠিক যেমন বন্ধুর সাথে বন্ধুর সখ্য হয়ে থাকে । এই সখ্য ও মৈত্রী এমন একটি দুর্লভ প্রাপ্তি যার সমতুল্য আর কোনো প্রাপ্তি নেই এবং এর অভাব এমন শূন্যতা ও ক্ষতি, যার সমতুল্য আর কোনো ক্ষতি নেই। ঈমানের বৈশিষ্ট্যগুলো খোদ্ মানবতারই বৈশিষ্ট্য। এগুলো খুবই সম্মানিত ও মর্যাদাবান । প্রথম বৈশিষ্ট্য : ঈমানের বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য জিনিস হলো এক আল্লাহর এবাদত ৷ এটি মানুষকে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যান্য সত্ত্বার দাসত্ব থেকে উর্ধে উন্নীত করে। তাকে সকল সৃষ্টির সাথে সমতা দান করে। কাজেই সে কাউকে কুর্নিশ করে না। আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নোয়ায় না। এখান থেকেই শুরু হয় মানুষের সত্যিকার স্বাধীনতার জয়যাত্রা । এ জয়যাত্রা শুরু হয় তার বিবেক থেকে এবং জগতের বাস্তব সত্য থেকে । একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই, আর কোনো মাবুদ নেই । সুতরাং এই চিন্তাধারা থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বতস্ফূর্ত উৎপত্তি ঘটে। কেননা এটাই একমাত্র যৌক্তিক সত্য । দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য : দ্বিতীয়টি হচ্ছে আল্লাহই একমাত্র প্রতিপালক- মনে এই বিশ্বাস ও বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন । তার সত্তার এই দিকটি থেকেই মানুষ নিজের মতাদর্শ, চিন্তাধারা, মূল্যবোধ, মানদণ্ড, আইন ও বিধান এবং আল্লাহর সাথে, সৃষ্টির সাথে ও মানুষের সাথে তার সম্পর্ক কী হবে, তা গ্রহণ করে। সুতরাং জীবন থেকে স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদ ও স্বেচ্ছাচারিতা উৎখাত হয়ে যায়। তার জায়গায় স্থান নেয় আইন ও ন্যায়নীতি । মোমেনের চিন্তা-চেতনায় স্বীয় আদর্শ ও জীবন ব্যবস্থার মূল্য বেড়ে যায়, তার মর্যাদা জাহেলী চিন্তাধারা ও মূল্যবোধের ওপরে এবং পার্থিব সম্পর্ক-সম্বন্ধ থেকে উদ্ভূত মূল্যবোধের ওপরে উন্নীত হয়, যদিও সে হয় একজন একক ব্যক্তি। কেননা সে জাহেলিয়াতের মোকাবেলা করে সরাসরি আল্লাহ তায়ালা থেকে প্রাপ্ত চিন্তাধারা, আদর্শ, মূল্যবোধ ও বিচার-বিবেচনার বলে । কাজেই সে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাপেক্ষা শক্তিমান এবং সকলের সম্মান ও আনুগত্যের পাত্র হয়ে থাকে। তৃতীয় বেশিষ্ট্য : তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্কের স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা এবং প্রভুত্বের স্থান ও দাসত্বের স্থান যথাযথভাবে প্রকাশিত হওয়া । এরই বদৌলতে এই নশ্বর সৃষ্টি অর্থাৎ মানুষ অমর ও অক্ষয় সত্যের সাথে সরাসরি ও কোনো জটিলতা ছাড়াই সংযুক্ত হয়। এরই কল্যাণে তার হৃদয় জ্যোতির্ময় হয়, আত্মা পরিতৃপ্ত হয়, হৃদয় ও আত্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধ হয়। সেই সাথে সন্দেহ ও সংশয়ের উচ্ছেদ ঘটে, ভীতি উদ্বেগের, উত্তেজনা ও অরাজকতার উচ্ছেদ ঘটে ও সমাপ্তি হয় পৃথিবীতে অনধিকার অহমিকা ও অহংকারের এবং আল্লাহর বান্দাদের ওপর অবৈধভাবে ও প্রতারণার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার। চতুর্থ বৈশিষ্ট্য : চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধানের ওপর অচল-অটলভাবে টিকে থাকা । সুতরাং কল্যাণ কোনো ক্ষণস্থায়ী ও সাময়িক জিনিস বা দুর্ঘটনা হিসাবে আসে না, বরং বিভিন্ন উপাদান থেকে তার জন্ম হয়, একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও গম্ভব্য অভিমুখে তা চলে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত বান্দারা সহযোগিতা করে। কাজেই মুসলিম দল বা সমাজের একটি ঐক্যবদ্ধ স্বচ্ছ লক্ষ্য থাকে, একটি সুনির্দিষ্ট পতাকা থাকে, আর পরবর্তী প্রজন্মগুলো এই অটুট বন্ধনের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। পঞ্চম বৈশিষ্ট্য : পঞ্চম বৈশিষ্ট হচ্ছে, আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদার অধিকারী হওয়ার প্রত্যয় । নিজেকে নিজের বিবেচনায়ও সে উন্নত রাখে । আর আল্লাহ্ তায়ালা যে উচ্চ মর্যাদায় তাকে আসীন করেছেন, তা থেকে সে নিজেকে নিচে নামায় না। এ জন্যে তার বিবেকে পর্যাপ্তলজ্জা ও শালীনতাবোধ জন্যে বস্তুত মানুষ নিজের ব্যাপারে যতো উচ্চ ধারণা পোষণ করে, এটি তার মধ্যে উচ্চতম। সে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান । ইসলাম ছাড়া অন্য সকল মতাদর্শ মানুষকে তার নিজের দৃষ্টিতেই হীন ও ইতর বানিয়ে দেয়, তাকে অত্যন্ত তুচ্ছ জাত বলে দেখায় এবং তার মধ্যে ও ফেরেশতাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে । এটা আসলে এমন ধারণা বা বিশ্বাস, যা তাকে নিম্নস্তরের সৃষ্টিতে পরিণত করে, যদিও একথা তারা স্পষ্ট করে বলে না। এ বর্ণনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ডারউইনবাদ, ফ্রয়েডবাদ ও মার্কসবাদ মানব জাতির ওপর আপতিত জঘন্যতম আপদও অপবাদ । এ সব মতবাদ মানুষকে এই ধারণা দেয় যে, প্রত্যেক নীচতা, হীনতা, নোংরামি ও দুষ্কৃতি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত জিনিস । এতে অস্বাভাবিক ও নতুনত্ব কিছুই নেই। এতে লজ্জারও কিছু নেই । অথচ আসলে তা মানবতার বিরুদ্ধে একটা নিন্দনীয় নিকৃষ্ট অপরাধ । আর আবেগের পরিচ্ছন্নতা এই অনুভূতির প্রত্যক্ষ ফল যে, আল্লাহর কাছে মানুষ সম্মানিত ও মর্যাদাবান । তিনি বিবেকের তদারকী করেন এবং তার সকল গুপ্ত তত্ত্ব সম্পর্কে অবগত ৷ যে সরল সোজা মানুষ এখনো ফ্রয়েড ও কার্লমার্কস প্রমুখের মতবাদ দ্বারা বিকৃত হয়নি, সে তার অন্তরে লুকানো কোনো খারাপ ইচ্ছা সম্পর্কে অন্য কোনো মানুষ অবগত হোক, তা কখনো পছন্দ করবে না। মোমেন অনুভব করে যে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর প্রতিটি মুহুর্তে দৃষ্টি রাখছেন। তাই সে মনে করে যে, তার চিন্তা ও অনুভূতিকে পবিত্র রাখাই সমীচীন । ঈমানের নৈতিক চেতনা হচ্ছে স্লেহময়, পরম ধৈর্যশীল মাবুদ রয়েছেন, যিনি অন্যায়কে ঘৃণা ও ন্যায়কে পছন্দ করেন এবং চোখের কুদৃষ্টি ও অন্তরে লুকানো ইচ্ছা পর্যন্ত জানেন ৷ সে কথা বিশ্বাস করলেই মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনা জন্মে। স্বাধীন ইচ্ছা ও সামষ্টিক তদারকী থেকেও একটি গুণের জন্ম হয়। মোমেনের অনুভূতিতে আমরা এ গুণটি সৃষ্টির চেষ্টা করে থাকি। এটি হচ্ছে সতর্কতা, স্পর্শকাতরতা, জাগৃতি, গাম্ভীর্য ও আন্তরিকতা এবং প্রজ্ঞা ও কুশলতা । এটি সুধু ব্যক্তিগত গুণ নয়। এটি একটি সামষ্টিক গুণও বটে। এটি নিজের একটি কল্যাণময় গুণ, তদুপরি গোটা মানব জাতির জন্যেও এবং আল্লাহর কাছেও এর গুরুত্ব রয়েছে। যখনই মোমেন কোনো কাজের উদ্যোগ নেয়, তখনই এই গুণাবলী অনুভব করে। ফলে নিজের কাছেও সে বড় এবং পা বাড়ানোর আগেই তার কী ফল হবে আন্দাজ করতে পারে। সৃষ্টিজগতে এই গুণটির যথেষ্ট মূল্য রয়েছে এবং এ জগতে এর অনেক ফলাফলও আছে । পার্থিব সম্পদ লিপ্সার উর্ধে ওঠাও ঈমানের একটি বৈশিষ্ট্য । এ বৈশিষ্ট্য অর্জিত হলে মানুষ আল্লাহর কাছে যে সম্পদ আছে, যা অধিকতর শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী, তাকেই অগ্রাধিকার দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘সে সব জিনিস নিয়েই প্রতিযোগিতা করা উচিত ।’ আল্লাহর কাছে যে নেয়ামত রয়েছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করলে মানুষের চরিত্র উন্নত, মহৎ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়। মোমেন যে ময়দানে কাজ করে তার ব্যাপকতাও উক্ত চারিত্রিক গুণ সৃষ্টিতে সাহায্য করে থাকে । তার এই ময়দানের সীমানা হচ্ছে দুনিয়া ও আখেরাত এবং পৃথিবী ও উচ্চ দায়িত্বশীল ফেরেশতাদের জগত জুড়ে বিস্তৃত । এ প্রতিযোগিতা চেষ্টা-সাধনার ফলাফল নিয়ে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা এবং ত্বরিত ফলাফল লাভের যে আকাংখা মানুষের মনে থাকে, তাকে প্রশমিত করে আখেরাতের নেয়ামত লাভের প্রতিযোগিতা ৷ কেননা মোমেন সৎ কাজ শুধু এ জন্যে করে যে, তা সৎ কাজ এবং আল্লাহ তায়ালা তা চান । সৎ কাজের উপকারিতা ও কল্যাণকারিতা তার সীমিত ব্যক্তিগত জীবনে চাক্ষুষ সত্য হয়ে প্রকাশিত না হলেও তার কোনো ক্ষতি নেই! কেননা যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সে সৎ কাজ করে, যিনি মারা যান না, ভুলেন না এবং তার কোনো কাজ সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ থাকেন. না। পৃথিবী প্রতিদানের জায়গা নয়। পার্থিব জীবন মানুষের জীবনের চূড়ান্ত ও সর্বশেষ স্তর নয়। এই জ্ঞান ও ঈমানই সেই উৎস, যা থেকে সে সৎ কাজ অব্যাহত রাখার মনোবল ও প্রেরণা লাভ করে। এ উৎস কখনো শূন্য হয় না বা ফুরিয়ে যায় না। এ উৎসই সৎ ও কল্যাণকর কাজকে একটা অব্যাহত ও স্থিতিশীল রীতি হিসাবে বহাল রাখার নিশ্চয়তা দেয়। সৎকাজ নিছক সাময়িক ও মৌসুমী ব্যাপারে পরিণত হয় না কিংবা তা কোনো বিচ্ছিন্ন ও আকস্মিক ঘটনা হয় না। এ জন্যেই মোমেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রচন্ড শক্তি অর্জন করে, চাই সে অন্যায় কোনো খোদাদ্রোহী স্বৈর শক্তির পরিচালিত যুলুম ও সীমালংঘনের আকারে দেখা দিক, অথবা কোন জাহেলী দৃষ্টিভংগির চাপের আকারেই হোক, অথবা মোমেনের নিজের সৎ ইচ্ছার ওপর তার প্রবৃত্তির অন্যায় ঝোক ও কামনা-বাসনার চাপের আকারেই হোক বা সেই কামনা-বাসনার বিস্ফোরণ ঘটার আকারেই হোক প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার যে প্রবল চাপ মানুষের ভেতরে সর্বপ্রথম জন্ম নেয়, তা তার এই অনুভুতি থেকে জন্ম নেয় যে, এই সীমিত আয়ুঙ্কালে সে দুনিয়ার সকল আনন্দদায়ক ও মজাদার জিনিস উপভোগ করার এবং তার সকল আশা পূরণের সময় পাবে না। অনুরূপভাবে, এ অনুভূতি থেকেও তা জন্ম নেয় যে, তার সকল সৎ কাজের সুদূরপ্রসারী সুফল সে এই জীবনে দেখার সময় পাবে না এবং বাতিলের ওপর সত্যের বিজয় দেখার সুযোগ পাবে না। ঈমান এই অনুভূতির মৌলিক ও পরিপূর্ণ চিকিৎসা করে । (সূরা ‘আল বুরুজের’ তাফসীর দেখুন) বস্তুত ঈমান হলো জীবনের প্রধান শেকড় ও উৎসমূল। ৷ সততা ও কল্যাণের সকল শাখা-প্রশাখার স্ফুরণ ঘটে এখান থেকেই । এর প্রত্যেক ফলমুল এরই সাথে সংযুক্ত ৷ এর সাথে যে শাখার সংযোগ থাকে না, তা গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে৷ সে শাখা অনিবার্যভাবে শুকিয়ে যাবে ও মরে যাবে । শেকড়ের সাথে যে ফলের সংযোগ নেই, তা শয়তানী ফল, তা কখনো স্থায়ী হয় না। ঈমানই হলো সেই কেন্দ্রীয় অক্ষশক্তি, যার সাথে জীবনের সকল উর্ধগামী সূত্রসমূহ আবদ্ধ । ঈমান না থাকলে জীবনের সকল তৎপরতা, সকল সম্বদ্ধসূত্র বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য । কোনো কিছুই তা বাধতে বা আটকাতে পারবে না। প্রবৃত্তির খেয়ালখুশীর সাথে তা নিরুদ্দেশের পথে ভেসে যাবে। ঈমানই হলো সেই মূলনীতি, যা সব কার্যকলাপকে এক সূত্রে গ্রথিত করে, একটা সুসমস্বিত ও সহায়ক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করে এবং একটা একক পথে ও একক আন্দোলনে বিলীন করে দেয়। এর একটা সুপরিচিত পরিচালিকা ও প্রেরণাদায়ক শক্তি এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে । এ জন্যে ঈমানী উৎসের সাথে সংস্রবহীন যে কোনো কাজকে কোরআন নিষ্ফল ও বৃথা গণ্য করে। ইসলামী আদর্শ এ ব্যাপারে দ্যর্থহীন ও অকাট্য সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। সূরা ইব্রাহীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা তাদের প্রতিপালকের সাথে কুফরী করেছে, তাদের সমস্ত সৎ কাজ সেই ছাইয়ের মত হবে, যা কোনো ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ দিনে বাতাসে প্রচন্ড গতিতে উড়িয়ে নিয়ে যায়। কাফেরদের অর্জিত কোনো সৎ কাজই তাদের উপকারে আসবে না ।’ সূরা আল মূরে বলা হয়েছে “যারা কুফরী করেছে, তাদের সংকর্মসমূহ মরুভূমিতে বিরাজিত মরীচিকার মতো হবে, পিপাসিত ব্যক্তি তাকে পানি মনে করে। পরিশেষে যখন সে তার কাছে উপনীত হয়, তখন সেখানে কোনো বস্তুই পায় না।’ কোরআনের এ সব ঘোষণা অকাট্য ভাষায় ঈমানবিহীন যাবতীয় সৎকর্মকে মূল্যহীন, বাতিল ও নিষ্ফল বলে রায় দিয়েছে। কেননা ঈমানই আমলের জন্যে বিশ্বস্রষ্টার সাথে সংযুক্তকারী সংযোগসূত্র এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সমন্বয় বিধানকারী লক্ষ্য সংগ্রহ করে দেয়। যে আকীদা-বিশ্বাস সকল জিনিসকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করে ও তার ওপর নির্ভরশীল করে, তার ক্ষেত্রে কোরআনের উক্ত রায় সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত । যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সংস্রবহীন হয়, সে তার কাজের প্রকৃত তাৎপর্যই হারিয়ে ফেলে ৷ ( সূরা ‘যিলযালের’ আয়াত যে ব্যক্তি কণা পরিমাণও কোনো ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে, আর যে ব্যক্তি কণা পরিমাণও খারাপ কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে ।’ এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ বলেন, ‘কোনো কোনো গ্রন্থকার লিখেছেন যে, এ ব্যাপারে সকল মুসলিম আলেমের এজমা (মতৈক্য) হয়েছে যে, কাফেরদের কোনো সৎ কাজই আখেরাতে ফলদায়ক হবেনা এবং তার কোনো অপকর্মের শাস্তিই লাঘব করা হবে না। কিন্তু এই এজমার কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিষয়টি এজমা থেকে আসেনি, বরং .. এ ঘোষণা থেকে এসেছে যা স্বয়ং স্বপ্রামাণিত সত্য এবং এটা অন্য কোনো প্রমাণের মুখাপেক্ষী নয়।) এ কথা অকাট্য সত্য যে, ঈমান প্রাকৃতিক বিধি ব্যবস্থার বিশুদ্ধতার পক্ষে এবং মানুষের সৃষ্টির অর্থহীনতার পক্ষে একটি প্রমাণ স্বরূপ। ঈমান এ কথার সত্যতাও প্রমাণ করে যে, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি এবং গোটা বিশ্বনিখিলের মাঝে পরিপূর্ণ সমন্বয় বিরাজ করছে এবং মানুষ ও তার পার্শ্ববর্তী সৃষ্টিজগতের মধ্যে রয়েছে পরিপূর্ণ সংহতি, একাত্মতা ও ঐকতান ৷ কেননা মানুষ এ বিশ্বেরই অধিবাসী ৷ তার সত্ত্বা যদি সুস্থ ও নিখুঁত থাকে, তাহলে তার মধ্যেও এই বিশ্ব নিখিলের মধ্যে একাত্মতা ও ঐকতান বিরাজ না করে পারে না। আর এই ঐকতান ঈমানের রূপ না নিয়েও পারে না। কেননা খোদ্ এই বিশ্ব নিখিলের মধ্যেই এমন সব সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে, যা এই সুশৃংখল বিশ্বকে কোনো নমুনা ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজ উদ্ভাবিত নকশা অনুসারে সৃষ্টিকারী এক সর্বশক্তিমান সত্ত্বার সন্ধান দেয়। মানুষ ও বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্যে যখন এই সমন্বয় ও সমতা অনুপস্থিত বা বিকল হয়ে যাবে, তখন তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রমাণ করবে যে, এই গ্রাহকযন্ত্রটি অর্থাৎ মানবীয় সত্ত্বার ভেতরেই ত্রুটি ও বৈকল্য বিদ্যমান। এটা এমন এক বৈকল্যের উপস্থিতি নির্দেশ করে, যার পরিণাম ব্যর্থতা ও সর্বনাশ ছাড়া আর কিছু নয়, আর সেই বৈকল্য ও ত্রুটি সহকারে কোনো কাজই শুদ্ধ হতে পারে না-তা বহিরাবরণে যতোই তার বিশুদ্ধতার প্রলেপ থাক না কেন। আর মোমেনের ভুবন এতো প্রশস্ত, এতো ব্যাপক, এতো সুপরিসর, এতো উচ্চ, এতো সুন্দর ও এতো সুখ ও সৌভাগ্যমন্ডিত যে, তার পাশে কাফেরদের ভুবন অত্যন্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বিদঘুটে, অশান্ত দুর্ভাগ্য জর্জরিত বৃথা ও ক্ষতিগ্রস্ত ‘সালেহ’ হচ্ছে ঈমানের স্বাভাবিক, সহজাত ও স্বয়ংক্রিয় ফল । সংকর্ম হচ্ছে সেই স্বয়ংক্রিয় গতি বা তৎপরতা যা অন্তরে ঈমানের বীজ উপ্ত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায়। বস্তুত ঈমান হচ্ছে এমন একটি ইতিবাচক চলমান জিনিস, যা মানুষের মনমগযে স্থান লাভ করা মাত্রই তার বাস্তব জীবনে সৎকাজের আকারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৎপর ও সচল হয়ে ওঠে ৷ ইসলামের পরিভাষায় ঈমান এ জিনিসেরই নাম। ঈমান নিশ্চল ও নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকতে পারে না। শুধু মোমেনের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকবে এবং তার বাস্তব জীবনে জীবন্ত রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে না-এটাও অসম্ভব ৷ যে ঈমান এই স্বয়ংক্রিয় পন্থায় সঞ্চালিত হয় না তা নষ্ট, বিকৃত অথবা মৃত ৷ ঈমান ফলের মতো ৷ সে তার সৌরভকে আটকে রাখতে পারে না। আপনা থেকেই সুগন্ধ ছড়ায়। আর যদি সুগন্ধ না ছড়ায়, তবে বুঝতে হবে, ফুলের অস্তিত্ব নেই। এখান থেকেই বুঝা যায় ঈমানের মূল্য কতখানি বা ঈমানের প্রকৃত স্বরূপ কী? ঈমান আল্লাহমুখী গতিশীলতা, তৎপরতা, গঠন ও নির্মাণের সমষ্টি । শুধুমাত্র মন-মগযে ও বিবেকে লুকানো, সংকুচিত, নেতিবাচক জিনিসের নাম নয়। শুধুমাত্র এমন মহৎ উদ্দেশ্য, মনোবাসনা ও পবিত্র নিয়তকে ঈমান বলে না, যা কখনো কাজে পরিণত হয় না। এ হচ্ছে ইসলামের অন্যতম স্বভাব বা প্রকৃতি । ইসলামের এই স্বভাব-প্রকৃতি থেকেই উৎপত্তি হয় জীবনের সর্ব বৃহৎ নির্মাণ-ক্ষমতার। ঈমান যতক্ষণ আল্লাহর নাযিল করা জীবন বিধানের সাথে সংযোগকে বুঝাবে, ততোক্ষণ উপরোক্ত তত্ত্ব বোধগম্য থাকবে। আর আল্লাহর এই বিধান হচ্ছে সৃষ্টিজগতের অভ্যন্তরে সক্রিয় একটা চিরস্থায়ী ও সুষমামন্ডিত আন্দোলন ও তৎপরতা । এ তৎপরতা একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিচালিত । এর একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে । মানব জাতিকে ঈমানের পথে পরিচালিত করা মূলত বিশ্ব প্রকৃতির স্বভাবসুলভ গতি ও তৎপরতার নিয়মবিধিকেই বাস্তবায়িত করার পথ প্রদর্শনের নামান্তর । সৃষ্টিজগতের সেই স্বাভাবিক গতি ও তৎপরতা হচ্ছে কল্যাণমূলক, গঠনমূলক ও পরিচ্ছন্ন তৎপরতা । আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া জীবন বিধানের সাথে তা সামঞ্জস্যশীল ও মানানসই । মুসলিম জাতির লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি : এরপর সত্য ও ন্যায়ের উপদেশ দান এবং ধৈর্যের উপদেশ দান, এই দুটি বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রয়োজন । এর ভেতর দিয়ে মুসলিম জাতির ভাবমূর্তি উচ্চকিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে এমন ইসলামী দল বা সংগঠনেরও ভাবমূর্তি স্পষ্ট হচ্ছে, যার বিশেষ ধরনের কাঠামো, বিশেষ ধরনের সংযোগ কর্মসূচী এবং একটা ঐক্যবদ্ধ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে, এমন একটি দলের রূপ কাঠামো তুলে ধরা হচ্ছে, যে দল নিজের স্বভাব, প্রকৃতিকে যেমন বোঝে, তেমনি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি সে সম্পর্কেও সচেতন ৷ যে দল তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয় ঈমান ও সৎ কাজের প্রকৃত পরিচয় জানে এবং এও জানে যে, ঈমান ও সৎ কর্মের দিকে মানুষকে পরিচালিত করা ও নেতৃত্ব দান করাও তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। আর এ সব বিষয়ে সচেতন বলেই এই সংগঠন নিজের অভ্যন্তরে এরূপ উপদেশের সার্বক্ষণিক আদান-প্রদান চালু রাখে, যাতে সে তার বৃহত্তম দায়িত্ব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ময়দানে নামতে পারে। সুতরাং ‘পরস্পরকে উপদেশ প্রদান ।’ (তাওয়াসাও) বা উপদেশের আদান-প্রদান শব্দটি এই শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য এবং উপদেশ আদান-প্রদানের স্বাভাবিক রূপ ও বাস্তব রূপ এইসব কিছু মিলে মুসলিম উম্মাহ বা ইসলামী সংগঠন বা ইসলামী সমাজের যথার্থ স্বরূপ ও ভাবমূর্তি তুলে ধরে। সেই ভাবমূর্তি এরূপ যে, মুসলিম উম্মাহ, জাতি, সমাজ, দল বা সংগঠন, যাই হোক না কেন, তার সদস্যরা পরস্পরের প্রতি ঘনিষ্ঠ, একাত্ম, কল্যাণকামী, সৎকর্মশীল, বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান এবং সেই সংগঠন পৃথিবীতে সত্য, ন্যায়নীতি ও সততার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত । মনোনীত উম্মাহ হওয়ার জন্যে একটি সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবমূর্তি । ইসলাম চায় মুসলিম জাতি এরকমই হোক । সে চায়, মুসলিম উম্মাহ এরকমই কল্যাণকামী, শক্তিমান, বুদ্ধিমান, সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের প্রহরী হোক। পরস্পরকে সম্প্রীতি, সহযোগিতা, সহানুভূতি ও সৌত্রাতৃত্বের মধ্য দিয়ে সত্য, সততা, ও ধৈর্যের সদুপদেশ দানকারী হোক, যেমনটি কোরআনের “তাওয়াসাও” শব্দটি থেকে প্রতিবিম্বিত হয়। বস্তুত সত্য ও সততার উপদেশের আদান প্রদান একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজ । সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কঠিন এবং এর পথে বাধাগুলো হচ্ছে প্রকৃতির কামনা-বাসনা, স্বার্থপ্রণোদিত যুক্তি, পরিবেশগত ধ্যান-ধারণা, স্বৈরাচারী শক্তির আগ্রাসী ও বলপ্রয়োগের মনোবৃত্তি ও যালেমদের যুলুম ‘তাওয়াসাও’ বা উপদেশের আদান-প্রদান বলতে বুঝায় স্মরণ করিয়ে দেয়া, উদ্বুদ্ধ করা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে ত্যাগ স্বীকারের চেতনা উজ্জীবন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ভ্রাতৃসুলভ সহযোগিতা করা৷ এ জিনিসটি মূলত ব্যক্তিগত গুণাবলীর সামষ্টিক রূপ। যখন এগুলো একত্রে কর্মতৎপর হয়, তখন এর শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । কারণ সত্য ও ন্যায়ের প্রত্যেক প্রহরীর মনে এই অনুভূতি থাকে যে, তার সাথে আরো অনেকে আছে, যারা তাকে সদুপদেশ দেয়, উৎসাহ যোগায়, সহযোগিতা দেয়, ভালোবাসে এবং অবজ্ঞা বা অসম্মান করে না। বস্তুত এই সত্য দ্বীন ঠিক এই ধরনের একটি দলের সক্রিয় উদ্যোগ ও প্রহরা ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷ যার কর্মীরা পরস্পরের সহযোগী, সমব্যথী, সমমনা, একাত্ম, সুসংগঠিত, পরস্পরকে উপদেশ দানকারী ও নিরাপত্তা দানকারী হয়। একইভাবে ধৈর্যের জন্যে উপদেশ বিনিময়ও একটি অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার ৷ ঈমান ও সংকর্ম চালু রাখা এবং সত্য ও ন্যায়ের সংরক্ষণ ব্যক্তি ও সমাজের জন্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ ৷ আর এ জন্যে ধৈর্য অপরিহার্য । নিজের প্রবৃত্তির সাথে জেহাদ এবং অপরের সাথে জেহাদ, উভয় জেহাদের জন্যেই ধৈর্য প্রয়োজন । বাতিলের অগ্রগতি ও দুষ্ট লোকদের আংগুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখেও ধৈর্য ধারণ করা প্রয়োজন ৷ সত্যের পথের দীর্ঘতা ও বিভিন্ন স্তর পার হতে বিলম্ব ঘটার ক্ষেত্রেও ধৈর্যের প্রয়োজন । সত্যের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর অসারতা ও দুঃসময়ের অবসানে বিলম্বেও সহিষ্ণুতা প্রয়োজন । ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার উপদেশ আদান-প্রদানে কর্মক্ষমতা বাড়ে । কেননা এতে লক্ষ্যের ঐক্য, দৃষ্টিভংগির ঐক্য, সকল মোমেনের সমর্থন ও সহায়তা,তাদের দৃঢ় সংকল্প, ভালোবাসা ও ক্রমাগত চেষ্টা সাধনার যোগ্যতারূপী সম্পদ অর্জিত হয়, অনুরূপভাবে ইসলামী সমাজ বা সংগঠনের বহু প্রয়োজনীয় মহৎ গুণ ধৈর্যের উপদেশ দানের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়। যে পরিবেশে সেইসব গুণের প্রসার ঘটে, ইসলামের সত্যিকার রূপ সেই পরিবেশেই বিকশিত ও প্রকাশিত হয়। তাই ধৈর্যের উপদেশের ব্যাপক আদান-প্রদান ছাড়া ব্যর্থতা অনিবার্য। মুসলমানদের অধপতনে মানবজাতি যে ক্ষতির সম্মুখীন : পবিত্র কোরআন এই সূরায় ব্যর্থতা ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে যে সংবিধান দিয়েছে, সেই সংবিধানের নিরিখে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, ব্যর্থতা আজ সারা পৃথিবীতে সমগ্র মানব জাতিকে গ্রাস করেছে। এই ব্যর্থতা থেকে পৃথিবীর কোনো অংশই নিস্তার পায়নি । এই দুনিয়াতে মানবজাতি যে যুলুমের শিকার, তা দেখলে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়। মানবজাতি যেভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কল্যাণময় জীবন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে চলেছে, আর তার পাশাপাশি পৃথিবী থেকে সত্যপন্থী কল্যাণকামী ইসলামী সরকারের অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে যেভাবে অধিকতর বিপজ্জনক করে তুলেছে, তা যথার্থই ভীতিপ্রদ ৷ এছাড়া আরো বিপজ্জনক ব্যাপার এই যে, মুসলমানরা বা সঠিকভাবে বলতে গেলে মুসলিম দাবীদাররাই আজ এই কল্যাণময় সত্য দ্বীন থেকে সবচেয়ে বেশী দূরত্বে অবস্থিত ৷ আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে যে জীবন বিধান মনোনীত করেছেন, তাকে তারাই সবচেয়ে বেশী অবজ্ঞা করে চলেছে। মুসলিম উম্মাহর জন্যে আল্লাহ্ তায়ালা যে সংবিধান রচনা করে দিয়েছেন, ব্যর্থতা ও ক্ষতি থেকে মুক্তি লাভের জন্যে যে একমাত্র পথটি দেখিয়েছেন, তাকে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশী উপেক্ষা করে চলেছে। আর পৃথিবীর যে স্থানগুলো থেকে এই কল্যাণময় ব্যবস্থা সর্বপ্রথম ফুটে বেরিয়েছিলো, সে সব স্থানের অধিবাসীরা তাদের পতাকা বেশী করে পরিত্যাগ করেছে৷ অথচ ওই ঈমানী পতাকা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই তাদের জন্যে উড্ডীন করেছিলেন। অথচ সব অঞ্চলের জনগণ নিজেদেরকে এমন সব জাতিগত পতাকার সাথে সংযুক্ত করতে শুরু করেছে, যে পতাকার অধীনে ওইসব অঞ্চল তাদের ইতিহাসে কখনো কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারেনি এমনকি সেসব অঞ্চল সে পতাকার অধীনে কখনো কোন সুনাম ও সুখ্যাতি লাভ করেনি। বরং একমাত্র ইসলাম এসেই তাদের জন্যে একক, লা-শরীক আল্লাহর মনোনীত পতাকা এবং একক লা-শরীক আল্লাহর নামাংকিত পতাকা উত্তোলন করেছে। সে পতাকা ছিলো আল্লাহর প্রতীক দ্বারা চিহ্নিত । সেই পতাকার অধীনেই আরব জাতি বিজয় অর্জন করে, শুধু আরব ইতিহাসে নয় বরং সমগ্র মানবেতিহাসে এই পতাকাই সর্বপ্রথম মানবজাতিকে কল্যাণময়, শক্তিমান, বিচক্ষণ ও স্বাধীন নেতৃত্ব উপহার দেয়। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী মুসলিম জাতির অধপতনে বিশ্বের কি ক্ষতি হয়েছে নামক অনবদ্য গ্রন্থে সমগ্র ইতিহাসের এই নযীরবিহীন কল্যাণকামী নেতৃত্ব সম্পর্কে ইসলামী শাসনের যুগ, মুসলিম শাসকগণ ও তাদের বৈশিষ্ট শিরোনামে বলেন, ‘মুসলমানরা বিজয়ী হয়, বিশ্বের নেতৃত্ব হস্তগত করে এবং বিকারগ্রস্ত ও দুর্নীতিবাজ জাতিগুলোকে মানবজাতির নেতৃত্ব থেকে উৎখাত করে। এই নেতৃত্বকে তারা অন্যায়ভাবে কবযা করেছিলো এবং তার অপব্যবহার করেছিলো । মুসলমানরাই মানব জাতিকে ভারসাম্যপূর্ণ ও ইনসাফপূর্ণ শাসন উপহার দিয়েছিলো । বিশ্ব-নেতৃত্বের জন্যে প্রয়োজনীয় যাবতীয় গুণাবলী তাদেরই ছিলো । নিজেদের নেতৃত্বে ও তদারকীতে তারা বিশ্বের সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ নিশ্চিত করেছিলো । সেই গুণগুলো ছিলো নিম্মরূপ, প্রথমত তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কিতাব ও শরীয়তের অধিকারী ছিলো ৷ তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো আইন রচনা করেনি। কেননা মানব রচিত আইন অজ্ঞতা, ভুলভ্রান্তি ও যুলুমের উৎস। মুসলিম শাসকরা নিজেদের ব্যবহারে, রাজনীতিতে ও মানুষের সাথে লেনদেনে উচ্ছৃংখল ও এলোমেলো আচরণ করতেন না। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মানুষের সাথে আচরণের জন্যে আলো এবং মানুষকে শাসন করার জন্যে শরীয়তী বিধান দিয়েছিলেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন যে,’ মৃত ব্যক্তিকে আমি জীবিত করেছি এবং মানুষের ভেতরে চলাফেরার জন্যে আলো দিয়েছি, সে কি সেই ব্যক্তির মতো, যার উদাহরণ অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে এবং সেখান থেকে বের হবে না?’ আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন, ‘হে মোমেনরা! তোমরা ন্যায়বিচারের সাক্ষী হয়ে আল্লাহর জন্যে স্থায়ীভাবে দন্ডায়মান হও। কোনো বিশেষ দলের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ ত্যাগ করতে প্ররোচিত না করে। ন্যায়বিচার করো। আল্লাহভীতির সাথে এর ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক রয়েছে। আর আল্লাহকে ভয় করো নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল আছেন ।’ দ্বিতীয়ত নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধির ব্যবস্থা না করে তারা নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেনি, যেমনটি অধিকাংশ জাতি, ব্যক্তি ও শাসকরা অতীতেও করেছে বর্তমানেও করেছে ও ভবিষ্যতেও করবে । তারা দীর্ঘদিন মোহাম্মদ (স.)-এর হাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে, তাঁর সূক্ষ নিখুত তদারকী,পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের সুযোগ পেয়েছে এবং তার কাছ থেকে দুনিয়ার স্বার্থ বর্জন, পরহেযগারী, আমানতদারী, অন্যকে অগ্রাধিকার দান, আল্লাহর ভয় এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের প্রার্থী ও প্রত্যাশী না হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করেছিলো ৷ রসূল (স.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম, এই কাজের দায়িত্ব আমরা যে চায় তাকেও দেই না, যে এর আকাংখা পোষণ করে তাকেও দেই না।’ (বোখারী ও মুসলিম) ৷ আর এ কথা তো তাদের কানে দিন-রাত অনুরণিত হয়ে থাকে যে, ‘আখেরাতের সেই ঘর (জান্নাত) আমি সেইসব লোকের জন্যেই নির্দিষ্ট করে রেখেছি, যারা পৃথিবীতে নিজেদের বড়াই যাহির করতে চায় না এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করতেও ইচ্ছুক নয়। আর পরিণামের চুড়ান্ত কল্যাণ শুধু পরহেযগার লোকদের জন্যেই ।’ আমীরত্বের পদের জন্যে প্রার্থী হওয়া, তদবীর সুপারিশ করা, প্রচারণা চালানো এবং তার জন্যে টাকা ব্যয় করা তো দূরের কথা, পদ ও চাকরীর জন্যে তারা ধরনাও দিতেন না। এতদসত্ত্বেও যখন জনগণের কোনো দায়িত্ব তাদের কাছে ন্যস্ত হতো, তখন সেটিকে তারা স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করতেন না কিংবা ইতিপূর্বে যে সম্পদ ও চেষ্টা-সাধনা তারা ইসলামের জন্যে ব্যয় করেছেন, তার মূল্য গ্রহণ করার জন্যেও তারা কোন চেষ্টা করেননি। তারা এই পদমর্যাদাকে আমানত হিসাবে এবং আল্লাহর পরীক্ষা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তারা জানেন যে, তাদের প্রতিপালক তাদেরকে (হিসাব না দিয়ে) এক পাও নড়তে দেবেন না এবং ছোট-বড় প্রতিটি কাজের জন্যে তারা জবাবদিহি করতে বাধ্য । তারা সব সময় আল্লাহর এই বাণী স্মরণ রাখে যে, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন আমানতগুলোকে যারা তার উপযুক্ত, তাদের কাছে সমর্পণ করবে, আর মানুষের ভেতরে যখন বিচার শাসন করবে, তখন ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বিচার-শাসন করবে ।’ তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীর প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন এবং তোমাদের কিছু লোককে অপর কিছু লোকের ওপর মর্যাদা দান করেছেন, যাতে তোমাদেরকে দেয়া সম্পদের ব্যাপারে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন ।’ তৃতীয়ত, তারা কোনো গোষ্ঠীবিশেষ ও জাতি বিশেষের সেবক ও দূত ছিলেন না যে, শুধু সেই বিশেষ গোষ্ঠী বা জাতির কল্যাণ ও সুবিধার জন্যেই তারা চেষ্টা করবেন! তারা নিজেদের জাতিকে দুনিয়ার সকল জাতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন না৷ তারা নিজেদের সম্পর্কে এরূপ ধারণা করতেন না যে, তাদের সৃষ্টিই হয়েছে শাসক হবার জন্যে এবং অন্য জাতিগুলোর সৃষ্টিই হয়েছে মুসলমানদের পদানত হয়ে থাকার জন্যে । তারা কোনো আরব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেননি, যাতে তার মাধ্যমে নিজেদের সুখ-সমৃদ্ধি ও ফুলে-ফেঁপে ওঠার ব্যবস্থা হয়, অহংকার ও গর্বে মেতে ওঠার সুযোগ হয় এবং জনগণ পারস্য ও রোমের পরিবর্তে আরব সাম্রাজ্যের গোলাম হয়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো মানুষকে সৃষ্টির গোলামী থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর গোলাম বানানো । মুসলমানদের দূত রাবয়ী বিন আমের পারস্য সম্রাট ইয়াজদগারের দরবারে বলেছিলেন, ‘আমরা এসেছি মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে শুধুমাত্র আল্লাহর দাসত্বের আওতাভুক্ত করার জন্যে, পথিবীর সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে প্রশস্ততায় আনার জন্যে এবং বিভিন্ন ধর্মের যুলুম থেকে ইসলামের ন্যায়বিচারের অধীনে আনার জন্যে !’ (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া)। বস্তুত মুসলমানদের চোখে সকল জাতি ও সকল মানুষ সমান ছিলো ৷ সকল মানুষ আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্ট। কোনো অনারবের ওপর আরবের এবং কোনো আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘হে মানুষেরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও উপজাতি রূপে বানিয়েছি, যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পার । নিশ্চয়ই তোমাদের ভেতরে যে সবচেয়ে বেশী পরহেযগার, সেই সবচেয়ে বেশী সম্মানিত ।’ ”মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আস-এর ছেলে যখন জনৈক মিসরীয় নাগরিককে প্রহার করে গর্বের সাথে বলেছিলো, ‘এ প্রহার দুই সম্ভ্রান্ত নারী ও পুরুষের পুত্রের পক্ষ থেকে মেনে নাও,’ তখন হযরত ওমর তার কাছ থেকে প্রতিশোধ আদায় করলেন এবং বললেন, ‘জনগণ তো তাদের মায়ের গর্ভ থেকে স্বাধীন ভাবেই জন্মেছিলো, তোমরা আবার কখন তাদেরকে গোলামে পরিণত করলে?” বস্তুত মুসলিম শাসকরা তাদের জ্ঞান, ধর্ম ও সভ্যতা এবং মর্যাদা দানে তারা কোনো বংশ, বর্ণ ও জন্মভূমির ভেদাভেদ করেননি । তারা ছিলেন মেঘমালার মতো । সকল দেশের ওপর সংগঠিত হয়ে এসেছেন, সকল মানুষকে সমভাবে অনুগ্রহ বিতরণ করেছেন, উপত্যকা ও মরুভূমির লোকেরা তাদের প্রশংসা করেছে, কিন্তু তা দ্বারা বিভিন্ন মানুষ ও বিভিন্ন দেশ উপকৃত হয়েছে নিজ নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে ৷ তাদেরই নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে বিভিন্ন জাতি, এমনকি ইতিপূর্বে যারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়েছে তারাও-ধর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সত্যতা ও শাসন ক্ষমতায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে এবং নতুন বিশ্ব গড়ার ব্যাপারে আরবদের সহযোগিতা করেছে। এমনকি বিভিন্ন শাসিত অনারব জাতির লোকেরা স্বয়ং শাসক আরব জাতির চেয়েও কোনো কোনো বিষয়ে অধিকতর দক্ষতা অর্জন করেছে। কেউ কেউ আরবদের মাথার মুকুটও হয়ে গেছে এবং মুসলিম জাতির সার্বজনীন নেতা,ইমাম, ফকীহ ও মোহাদ্দেস হয়েছে। চতুর্থত মানুষ দেহ ও আত্মার সমষ্টি । তার মন আছে, জ্ঞান মস্তিষ্ক আছে, অংগপ্রত্যংগ আছে এবং রকমারি আবেগ-অনুভূতি আছে। তার এই সকল শক্তি সমানুপাতিক হারে ও সুসমস্বিতভাবে বিকাশ লাভ না করলে এবং উপযুক্ত খাদ্য ও পুষ্টি না পেলে মানুষ সুখী ও হতে পারে না এবং সে সামগ্জস্যপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে উন্নতি করতে পারে না। একটি ন্যায়সংগত সভ্যতার প্রতিষ্ঠা তখনই সম্ভব, যখন ধর্মীয়, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তির ও শারীরিক সর্বক্ষেত্রে মধ্যম ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মানুষ তার অধীনে তার মানবীয় পূর্ণতা সহজেই অর্জন করতে পারবে। অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ কাজটি তখনই সম্ভব, যখন সামাজিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এমন লোকদের হাতে থাকবে, যারা আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুতান্ত্রিকতা উভয়টিতেই বিশ্বাসী হবে, যারা ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনে পরিপূর্ণ আদর্শ হবে, সুস্পষ্ট বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী হবে এবং কার্যকর ও লাভজনক জ্ঞানের অধিকারী হবে । অতপর “খেলাফতে রাশেদার যুগ ন্যায়নিষ্ঠ সভ্যতার আদর্শ’ শিরোনামে তিনি বলেনঃ ‘খেলাফতে রাশেদা এ রকমই ছিলো । সমগ্র ইতিহাসে আমরা খেলাফতে রাশেদার চেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে সুন্দর, সমৃদ্ধ ও পূর্ণাংগ কোনো যুগ খুঁজে পাই না। আধ্যাত্মিকতা নৈতিকতা, ধর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বস্তুগত উপায়-উপকরণ এই সব কিছুই পূর্ণাংগ মানুষ এবং ন্যায়নিষ্ঠ সত্যতা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। এই সরকার ছিলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সরকার এবং তৎকালে সকল রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সেরা শক্তি । সে সময় উচ্চতম নৈতিক মানের প্রাধান্য সাধারণ মানুষের জীবনে ও শাসন ব্যবস্থায় সমভাবে বিদ্যমান ছিলো ৷ নৈতিক চরিত্রের উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসায়-বাণিজ্যে ও শিল্পেরও উন্নয়ন সাধিত হচ্ছিলো । আর দেশ জয় ও সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে একই পর্যায়ের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির কাজ চলতো । ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের আয়তন ও লোকসংখ্যা অনুপাতে অপরাধের মাত্রা কমে গিয়েছিলো, যদিও অপরাধের উপকরণাদি নেহাৎ কম ছিলো না ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, ব্যক্তির সাথে সমাজের এবং সমাজের সাথে ব্যক্তির চমৎকার সুসম্পর্ক বিরাজ করতো । আর এটা এমন একটা পূর্ণাংগ স্তর, যার চেয়ে উন্নত স্তর, সুন্দর অবস্থা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ইসলামী সংবিধানের অধীনে মানবজাতির যে সুখসময় যুগটা কেটেছে, এখানে তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো সূরা ‘আল আসরে’ এই সংবিধানের মূলনীতিসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। মানবজাতি এ সুখময় যুগটা কাটাতে পেরেছিলো সেই ঈমানী পতাকার নিচে সমবেত হয়ে, যা বহন করেছিলো ঈমান, সংসর্গ, সততা ও সত্যের জন্যে পারস্পরিক উপদেশের আদান-প্রদান এবং ধৈর্যের জন্যে পারস্পরিক উপদেশের আদান-প্রদানকারী একটি ইসলামী সংগঠন। সেই সুখময় যুগ ও পরিবেশের সাথে আজকের সর্বব্যাপী ক্ষয়ক্ষতির কি তুলনা হতে পারে, যা দ্বারা মানবসমাজ পৃথিবীর সর্বত্র জর্জরিত, যা ন্যায় ও অন্যায় এবং সততা ও অসততার সংঘাতের মধ্য দিয়ে মানব জাতিকে প্রতিনিয়ত সর্বস্বান্ত করছে। কি যুক্তি থাকতে পারে আজকের মানবসমাজ কর্তৃক তৎকালীন আরবজাতির সাধিত বিরাট জনকল্যাণমুখী কীর্তিকে অন্ধ বিদ্বেষের তাড়নায় অস্বীকার ও উপেক্ষা করার পেছনে? সেদিন আরব জাতি ইসলামের পতাকা উড়িয়ে এই অকল্পনীয় কীর্তি সমাধা করতে পেরেছিলো বলেই তার হাতে এসেছিলো মানবজাতির নেতৃত্বের চাবিকাঠি ৷ তারপর যেই সে পতাকা নামালো, অমনি তার স্থান হলো কাফেলার একেবারে পেছনের কাতারে । তারপর গোটা কাফেলাই ধ্বংস ও পতনের শিকার হলো । আর সকল পতাকা হয়ে গেলো শয়তানের পতাকা । একটি পতাকাও আল্লাহর রইলো না। সকল ঝান্ডা উড়তে লাগলো বাতিলের পক্ষে । একটি ঝান্ডাও সত্যের পক্ষে উড্ডীন থাকলো না। সকল পতাকা রইলো অন্ধত্ব ও গোমরাহীর পক্ষে । হেদায়াত ও আলোর পক্ষে কোনো পতাকা রইলো না৷ সকল পতাকা রইলো ক্ষতি ও ধ্বংসের । সফলতা ও কল্যাণের কোনো পতাকা রইলো না। অথচ আল্লাহর পতাকা এখনো বিদ্যমান । শুধু অপেক্ষায় আছে কোন হাত তা বহন করার জন্যে এগিয়ে আসে তা দেখার জন্যে । আর কোন জাতি তার অধীনে হেদায়াত, কল্যাণ, সততা ও মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের অভিযানে অভিযাত্রী হতে ইচ্ছুক । পৃথিবীতে লাভ ও ক্ষতির এই হচ্ছে অবস্থা । তবে আখেরাতের লাভক্ষতির তুলনায় দুনিয়ার লাভক্ষতি নিতান্তই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র ব্যাপার। আখেরাতের লাভ ও সাফল্য সম্পূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক। সেখানে ক্ষতি হলে তাও ন্যায়ভিত্তিক ৷ সেখানে লাভ বা ক্ষতি যেটাই হোক, দীর্ঘমেয়াদী, চিরস্থায়ী এবং বাস্তব। সেখানকার লাভ অর্থই বেহেশৃত ও আল্লাহর সম্তোষ লাভ। আর ক্ষতি মানেই বেহেশ্ত ও আল্লাহ সন্তোষ খোয়ানো ৷ সেখানে মানুষ হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের পূর্ণতা ও মর্যাদা লাভ করবে, নচেৎ সর্বনিম্ন পর্যায়ের অবমাননা ভোগ করবে, ফলে তার মনুষ্যত্বের এত অধোপতন ঘটবে যে, মানুষ মর্যাদার দিক দিয়ে পাথরের পর্যায়ে নেমে যাবে, কিন্তু শান্তির দিক দিয়ে সে পাথরের চেয়েও নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ পাথর যতটুকু শাস্তি ভোগ করতে পারবে, সে তাও পারবে না। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন মানুষ নিজের কৃতকর্মের দিকে তাকাবে । আর কাফের বলবে, আহা! আমি যদি পাথর হয়ে যেতাম ! এই সূরাটি মানুষের জীবন-পথ নির্ণয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সে বলেছে একমাত্র ঈমান, সৎ কাজ, সত্যের উপদেশ আদান-প্রদান ও ধৈর্যের উপদেশ আদান-প্রদানেই সফলতা ৷ এছাড়া আর সব কিছুতেই ব্যর্থতা ও ক্ষতি । পথ মাত্র একটাই ৷ একাধিক নয়। ঈমান, সততা ও ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা, যা সততা ও সত্যের উপদেশ প্রদান করবে এবং ধৈর্যের মাধ্যমে সত্যকে সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দেবে। এ পথ একই পথ ৷ এ কারণে রসূল (স.)-এর আমলে দু’ব্যক্তি একত্রে মিলিত হলে তারা বিচ্ছিন্ন হবার আগে একে অপরকে সূরা আল আসর পড়ে শুনাতে ভুল করতো না। এটা শুনানোর পরেই পরস্পরকে বিদায়ী সালাম করতো । তারা আল্লাহর এই সংবিধান মেনে চলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো। ঈমান ও সৎ কাজে অংগীকারাবদ্ধ ছিলো । সত্যের উপদেশ ও ধৈর্যের উপদেশ আদান-প্রদানে সংকল্পবদ্ধ ছিলো । এই সংবিধানকে রক্ষা করতে তারা বদ্ধপরিকর ছিলো ৷ এই সংবিধান পালনকারী উম্মাহর সদস্য থাকতে চুক্তিবদ্ধ ছিলো ।
# তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
নামকরণ ও গুরুত্ব:
العصر শব্দের অর্থ সময়, কাল, যুগ ইত্যাদি। সূূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত العصر শব্দ থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ বিন হাফস (রাঃ) বলেন : দুজন সাহাবীর অভ্যাস ছিল যে, যখন তারা পরস্পর সাক্ষাৎ করত তখন একজন এ সূরাটি পড়তেন এবং অপরজন শুনতেন। তারপর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিতেন। (বায়হাকী হা. ৯০৫৮, সনদ সহীহ)
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এ সূরার গুরুত্ব বুঝাতে বলেছেন :
لو ما انزل الله علي الخلق إلا هذه السورة لكقته
সৃষ্টি জীবের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এ সূরা ছাড়া অন্য কিছু অবতীর্ণ না করলেও তা যথেষ্ট হত। (ইবনু কাসীর)
ঐতিহাসিকগণ বলেছেন :
আমর ইবনুল আস (রাঃ) মুসলিম হওয়ার পূর্বে একবার ভণ্ডনাবী মুসায়লামা কাযযাবের কাছে গিয়েছিলেন। তখন মুসায়লামা তাকে বলেন : তোমাদের নাবীর ওপর সম্প্রতি কী নাযিল হয়েছে? তিনি বললেন : তাঁর ওপরে অতি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। মুসায়লামা কাযযাব বলল : সেটা কি? তখন আমর ইবনুল আস (রাঃ) তাকে সূরা আছর শুনিয়ে দিলেন। অতঃপর ভণ্ডনাবী মুসায়লামা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল : আমার কাছেও এরূপ সূরা নাযিল হয়েছে। আমর ইবনুল আ‘স (রাঃ) বললেন : সেটা কী? তখন মুসায়লামা বলল : হে ওয়াবর (বিড়াল জাতীয় ছোট প্রাণী)! তোমার কাছে কেবল দু’টি বড় কান ও সীনা। আর তোমার বাকী সবই ফালতু। অতঃপর মুসায়লামা জিজ্ঞাসা করল : কেমন লাগল? জবাবে আমর ইবনুল আস (রাঃ) বললেন : আল্লাহ তা‘আলার শপথ! তুমি ভালভাবেই জানো যে, আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ। (ইবনু কাসীর)
তাফসীর:
الْعَصْرِ আছর দ্বারা উদ্দেশ্য কী এ নিয়ে মুফাসসিরদের মাঝে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম হলো :
১. ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেন, ইয়াহইয়া বলেন : আছর হলো যুগ আল্লাহ তা‘আলা যুগের শপথ করেছেন। (সহীহ বুখারী)
২. হাসান বাসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : আসর দ্বারা উদ্দেশ্য : সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে যাওয়া ও অস্ত যাওয়ার মধ্যবর্তী সময় (অর্থাৎ আসরের সময়)।
৩. প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলেন : আসর দ্বারা উদ্দেশ্য আছরের সালাত। কেননা এটা এমন একটি সালাত যা সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এ আসরের শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ যতক্ষণ মানুষ জীবিত থাকে ততক্ষণ দুনিয়ার পেছনে পড়ে দীন ও আখিরাত সম্পর্কে গাফেল হয়ে নিজেকে জাহান্নামের দিকে ঢেলে দেয়। এ ক্ষতিগ্রস্তের বিভিন্ন স্তর রয়েছে : কেউ সর্বস্ব ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন যার ইহকাল ও আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার কেউ কোন দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, তাই আল্লাহ তা‘আলা সব মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত বলে সম্বোধন করেছেন, তবে যারা চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তারা ব্যতীত। (১) যারা প্রকৃত ঈমানদার,
(২) যারা সৎ আমলকারী,
(৩) যারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করে,
(৪) দীনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট ও মসিবতে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়। সু
তরাং যারা এ চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তারা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে মুক্ত। আমাদের উচিত এ চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে সকল প্রকার ক্ষতি থেকে মুক্ত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা অর্জন করা।
সূরা হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সূরাটির গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হলাম।
২. চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মু’মিন ছাড়া প্রত্যেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।
৩. মানুষ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন বস্তুর নামে শপথ করতে পারবে না।
৪. নিজে সৎ আমল করতে হবে, সেই সাথে অন্যদেরও সৎ আমলের দিকে আহ্বান করতে হবে। শুধু নিজে সৎ আমল করব, অন্যকে আহবান করব না তা যেমন অনুচিত তেমনি অন্যকে সৎ আমলের দিকে আহ্বান করব, কিন্তু নিজে করব না তা-ও অনুচিত।
# তাফসীরে ইবনে কাছীর:-
বর্ণিত আছে যে, হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) মুসলমান হওয়ার পূর্বে একবার মুসাইলামা কাযযাবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ঐ সময় মুসাইলামা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করেছিল। হযরত আমর (রাঃ)-কে সে জিজ্ঞাসা করলোঃ “এখন কি তোমাদের রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর কোন অহী অবতীর্ণ হয়েছে?” হযরত আমর (রাঃ) জবাবে বলেনঃ “একটি সংক্ষিপ্ত, অলংকার পূর্ণ সূরা নাযিল হয়েছে।মুসাইলামা জিজ্ঞেস করলোঃ “সেটি কি?” হযরত আমর (রাঃ) তখন (আরবি) সূরাটি পাঠ করে শুনালেন। মুসাইলামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললোঃ “জেনে রেখো, আমার উপরও এরকম সূরা নাযিল হয়েছে। হযরত আমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “সেটি কি?” সে তখন বললোঃ (আরবি)
তারপর জিজ্ঞেস করলোঃ “হে আমর (রাঃ)! বল, তোমার অভিমত কি?” তখন হযরত আমর (রাঃ) বললেনঃ “তুমি তো নিজেই জান যে, তোমার মিথ্যা ও ভণ্ডামী সম্পর্কে আমি অবহিত রয়েছি।” হলো বিড়ালের মত আকৃতি বিশিষ্ট একটা পশু। তার কান দুটি ও বুক কিছুটা প্রশস্ত ও বড়। দেহের অন্যান্য অংশ খুবই নিকৃষ্ট ও বাজে। ভণ্ড, দুবৃত্ত ও মিথ্যাবাদী মুসাইলামা এ রকম বাজে কথাকে আল্লাহ পাকের পবিত্র কালামের সাথে তুলনা করতে চেয়েছিল। তার এ ধরনের ঘৃণ্য ভণ্ডামী দেখে আরবের মূর্তি পূজকরাও তাকে মিথ্যাবাদী এবং ফালতু বলে সহজেই বুঝে নিয়েছিল।
দু’জন সাহাবীর অভ্যাস ছিল এই যে, যখন তাঁদের পরস্পর সাক্ষাৎ হতো তখন একজন এ সূরাটি পড়তেন এবং অপরজন শুনতেন। তারপর পরস্পর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিতেন।
হযরত ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন যে, মানুষ যদি এই একটি মাত্র সুরা চিন্তা ভাবনা ও মনোযোগের সাথে পাঠ করে এবং অনুধাবন করে তবে এই একটি সূরাই যথেষ্ট।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর
‘আসর এর অর্থ হলো কাল বা সময়, যেই কাল বা সময়ে মানুষ পাপ পূণ্যের কাজ করে। হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) বলেন যে, আসর এর অর্থ হলো আসরের নামায বা আসরের নামাযের সময়। কিন্তু প্রথমোক্ত উক্তিটিই মাশহুর বা প্রসিদ্ধ। এই কসমের পর আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ নিশ্চয়ই মানুষ অত্যন্ত ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু যারা ঈমান আনে ও ভাল কাজ করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় অর্থাৎ নিজে সৎকাজ করে ও অন্যকে সৎকাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে, আর বিপদে-আপদে নিজে ধৈর্য ধারণ করে ও অন্যকেও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়, জনগণ কষ্ট দিলে ক্ষমার মাধ্যমে ধৈর্যের পরিচয় দেয় এবং ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে গিয়ে যে বাধাবিঘ্ন ও বিপদের সম্মুখীন হয় তাতেও ধৈর্য ধারণ করে, তারা এই সুস্পষ্ট ক্ষতি থেকে মুক্তি পাওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1216/O Ye Mankind:-23]
[ # By time,:-]
Surah.103: Al-Asr
Para:30 Ayat:- 1-3
www.motaher21.net
103:1
وَ الۡعَصۡرِ ۙ﴿۱﴾
By time,
Allah Says:
وَالْعَصْرِ
إِنَّ الاِْنسَانَ لَفِي خُسْرٍ
103:2
اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَفِیۡ خُسۡرٍ ۙ﴿۲﴾
Indeed, mankind is in loss,
By Al-`Asr. , Verily, man is in loss.
Al-`Asr is the time in which the movements of the Children of Adam occur, whether good or evil.
Malik narrated from Zayd bin Aslam that he said, “It is the evening.”
However, the first view is the popular opinion. Thus, Allah swears by this, that man is in
خُسْرٍ
(Khusr), which means in loss and destruction
103:3
اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡحَقِّ ۬ۙ وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ ٪﴿۳﴾
Except for those who have believed and done righteous deeds and advised each other to truth and advised each other to patience.
إِلاَّ الَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّـلِحَـتِ
Except those who believe and do righteous good deeds.
So Allah makes an exception, among the species of man being in loss, for those who believe in their hearts and work righteous deeds with their limbs.
وَتَوَاصَوْاْ بِالْحَقِّ
And recommend one another to the truth,
This is to perform acts of obedience and avoid the forbidden things.
وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
And recommend one another to patience.
meaning, with the plots, the evils, and the harms of those who harm people due to their commanding them to do good and forbidding them from evil.
This is the end of the Tafsir of Surah Al-`Asr, and all praise and thanks are due to Allah
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran