Book #114 ” এ জনপদে প্রবেশ করো,” ” Enter this town.” ادْخُلُوا هٰذِهِ الْقَرْيَةَ

Enter this town

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114) www.motaher21.net

ادْخُلُوا هٰذِهِ الْقَرْيَةَ

” এ জনপদে প্রবেশ করো,”

” Enter this town.”

সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-৫৮ ও ৫৯

وَ اِذْ قُلْنَا ادْخُلُوْا هٰذِهِ الْقَرْیَةَ فَكُلُوْا مِنْهَا حَیْثُ شِئْتُمْ رَغَدًا وَّ ادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَّ قُوْلُوْا حِطَّةٌ نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطٰیٰكُمْؕ وَ سَنَزِیْدُ الْمُحْسِنِیْنَ

আরো স্মরণ করো যখন আমরা বলেছিলাম, “তোমাদের সামনের এই জনপদে প্রবেশ করো এবং সেখানকার উৎপন্ন দ্রব্যাদি যেমন ইচ্ছা খাও মজা করে। কিন্তু জনপদের দুয়ারে সিজদাবনত হয়ে প্রবেশ করবে ‘হিত্তাতুন’ ‘হিত্তাতুন’ বলতে বলতে। আমরা তোমাদের ত্রুটিগুলো মাফ করে দেবো এবং সৎকর্মশীলদের প্রতি অত্যধিক অনুগ্রহ করবো।”

فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا قَوْلًا غَيْرَ الَّذِى قِيلَ لَهُمْ فَأَنزَلْنَا عَلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا رِجْزًا مِّنَ السَّمَآءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ

কিন্তু যারা অত্যাচার করেছিলো তারা তাদের যা বলা হয়েছিলো তার পরিবর্তে অন্য কথা বললো। কাজেই যালিমদের প্রতি আমি আকাশ থেকে শাস্তি প্রেরণ করলাম। কারণ তারা সত্য ত্যাগ করেছিলো।

৫৮ ও ৫৯ নং আয়াতের তাফসীর:

(هٰذِهِ الْقَرْيَة)

‘এ নগর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল “বায়তুল মুকাদ্দাস”, এ বিষয়ে যদিও অনেক মতানৈক্য পাওয়া যায় তবে এটাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১:২২৯)

(وَّادْخُلُوا الْبَابَ)

“দরজা দিয়ে প্রবেশ কর” এখানে দরজা দ্বারা উদ্দেশ্য বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা, যা বর্তমানে হিত্তার দরজা বলে পরিচিত। বানী ইসরাঈলের ইয়াহূদিদেরকে আল্লাহ তা‘আলা “আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন” একথা বলে বায়তুল মুকাদ্দাসের দরজা দিয়ে সিজদাবনত অবস্থায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা অবাধ্যতার বশীভূত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর শাস্তি অবতীর্ণ করেন।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন বানী ইসরাঈলকে বলা হল

(وَّادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَّقُوْلُوْا حِطَّةٌ)

তোমরা সিজদাবনত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায় দরজা দিয়ে প্রবেশ কর। তখন তারা তা পরিবর্তন করে জানুর ভরে অর্থাৎ দাম্ভিকভাবে এবং حِطَّةٌ (ক্ষমা প্রার্থনা) এর পরিবর্তে حبة في شعرة (যবের দানা) বলতে বলতে প্রবেশ করে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৯, সহীহ মুসলিম হা: ৩০১৫)

رجز অর্থ শাস্তি, এ শাস্তি কী ছিল সে ব্যাপারে কয়েকটি উক্তি পাওয়া যায়: যেমন আল্লাহ তা‘আলার গযব কঠিন ঠাণ্ডাজনিত কুয়াশা অথবা প্লেগ রোগ। প্লেগ রোগের সমর্থন হাদীসে পাওয়া যায়।

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: এ প্লেগ সে আযাব ও শাস্তির অংশ যা তোমাদের পূর্বে কোন জাতির ওপর নাযিল করা হয়েছিল। তোমাদের উপস্থিতিতে কোন স্থানে যদি এ প্লেগ মহামারী দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে বের হবে না এবং কোন স্থানে যদি এ মহামারী হয়েছে বলে শোন তাহলে সেখানে প্রবেশও করবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২২১৮)

আল্লাহ তা‘আলার কালাম পরিবর্তন করা ইয়াহূদিদের স্বভাব। যখন আল্লাহ তা‘আলা এক কথা বলতে বললেন তখন তারা সে কথা পরিবর্তন করে অন্য কথা বলল। আমরাও যেন আমাদের ঘৃণ্য স্বার্থ হাসিল করার জন্য অথবা নিজেদের দল ও মত প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস পরিবর্তন না করি। কুরআনে তো কোন পরিবর্তন করা যাবেই না, যথাসম্ভব রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস ও তাঁর মুখনিঃসৃত শব্দে বর্ণনা করা উচিত। কারণ জনৈক সাহাবী নাবী শব্দের স্থানে রাসূল বলেছেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে নাবী বলার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী হা: ২৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৭১০)

এখনো পর্যন্ত যথার্থ অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ জনপদটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে যে ঘটনা পরস্পরায় এর উল্লেখ হয়েছে তা এমন এক যুগের সাথে সম্পর্কিত যখন বনী ইসরাঈল সাইনা উপদ্বীপেই অবস্থান করছিল। তাতেই মনে হয়, উল্লেখিত জনপদটির অবস্থান এ উপদ্বীপের কোথাও হবে। কিন্তু এ জনপদটি ‘সিত্তীম’ও হতে পারে। সিত্তীম শহরটি ‘ইয়ারীহো’ –এর ঠিক বিপরীত দিকে জর্দান নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত ছিল। বাইবেলে উল্লেখিত হয়েছে, বনী ইসরাঈলরা মূসার (আ) জীবনের শেষ অধ্যায়ে এ শহরটি জয় করেছিল। সেখানে তারা ব্যাপক ব্যভিচার করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ভয়াবহ মহামারীর শিকারে পরিণত করেন এবং এতে চব্বিশ হাজার লোকের মৃত্যু হয়। (গণনা, ২৫ অনুচ্ছেদ, ১-৮ শ্লোক)

অর্থাৎ তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল। স্বেচ্ছাচারী যালেম বিজয়ীদের মতো অহংকার মদমত্ত হয়ে প্রবেশ করো না। বরং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও তাঁর ভয়ে ভীত বান্দাদের মতো বিনম্রভাবে প্রবেশ করো। যেমন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় বিনয়াবনত হয়ে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। ‘হিত্তাতুন’ শব্দটির দুই অর্থ হতে পারে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কাছে নিজের গোনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে প্রবেশ করো। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, ব্যাপক গণহত্যা ও লুটতরাজ করতে করতে প্রবেশ না করে বরং জনপদের অধিবাসীদের ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করে তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে করতে শহরে প্রবেশ করো।

সাহায্য প্রাপ্তির পর ইয়াহূদীরা কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে আল্লাহদ্রোহী হলো

মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলকে নিয়ে মিসরে আসেন এবং তাদেরকে পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, যা ছিলো তাদের পৈত্রিক ভূমি। সেখানে তাদেরকে আমালুকদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তারা কাপরুষতা প্রদর্শন করে, যার শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে তীহের মাঠে নিক্ষেপ করা হয়। যেমন সূরাহ্ মায়িদায় বর্ণিত হয়েছে। قَرْيَة-এর ভাবার্থ হচ্ছে বায়তুল মুকাদ্দাস। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/১৮১) সুদ্দী (রহঃ), রাবী‘ ইবনু আনাস (রহঃ) কাতাদাহ (রহঃ) এবং আবূ মুসলিম (রহঃ) প্রভৃতি মনীষীগণ এটাই বলেছেন। কুর’আন মাজীদে রয়েছে যে, মূসা (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেনঃ

﴿یٰقَوْمِ ادْخُلُوا الْاَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِیْ كَتَبَ اللّٰهُ لَكُمْ وَ لَا تَرْتَدُّوْا﴾

হে আমার সম্প্রদায়! এই পুণ্য ভূমিতে প্রবেশ করো যা মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন, আর পিছনের দিকে ফিরে যেয়ো না। (৫ নং সূরাহ্ মায়িদাহ, আয়াত নং ২১। আর রাযী ৩/৮২) কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা ‘আরীহা’ নামক জায়গাকে বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ মিসরের কথা বলেছেন। কিন্তু এর ভাবার্থ ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ হওয়াই সঠিক কথা। এটা ‘তীহ’ হতে বের হওয়ার পরের ঘটনা। চল্লিশ বছর ধরে এভাবে উ™£ান্তের জীবন যাপন শেষে ইউসা ইবনু নূন (আঃ)-এর নেতৃত্বে আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলকে কোন এক শুক্রবার ঊষা লগ্নে পুণ্যভূমি অধিকার করার আদেশ দেন। ঐ দিন সূর্যাস্তের সময়কাল কিছু বিলম্বিত করা হয়, যাতে ঐ দিনই বিজয় লাভ সম্ভব হয়। শুক্রবার সন্ধ্যার সময় আল্লাহ তা‘আলা স্থানটি মুসলিমের দ্বারা বিজিত করান।

বিজয়ের পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নতশিরে উক্ত শহরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেন। (তাফসীর তাবারী ২/১১৩) বর্ণনাকারী বলেন যে, এখানে সাজদার অর্থ বিনয় ও নম্রতা। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দরজাটি ছিলো কিবলার দিকে। এর নাম ছিলো বাবুল হিত্তাহ্, যা ছিলো জেরুযালেম। ইমাম রাযী (রহঃ) এ কথাও বলেছেন যে, দরজার অর্থ হচ্ছে এখানে কিবলার দিক।

সাজদার পরিবর্তে তারা পার্শ্বদেশের ভরে প্রবেশ করতে থাকে। মাথা নত করার পরিবর্তে উঁচু করে। حِطَّة শব্দের অর্থ হচ্ছে ক্ষমা। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এতে পাপের স্বীকারোক্তি রয়েছে। হাসান বাসরী (রহঃ) এবং কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছেঃ ‘হে মহান আল্লাহ! আমাদের ভুল ত্রটিগুলো দূর করে দিন।’

অতঃপর তাদের সাথে ওয়া‘দা করা হচ্ছে যে, যদি তারা এটাই বলতে বলতে শহরে প্রবেশ করে এবং বিজয়ের সময়েও বিনয় প্রকাশ করে মহান আল্লাহর নি‘য়ামত ও নিজেদের পাপের কথা স্বীকার করে এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে এটা তাঁর নিকট খুবই প্রিয় বলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। এর মধ্যেই এ নির্দেশ দেয়া হয়ঃ

﴿اِذَا جَآءَ نَصْرُ اللّٰهِ وَ الْفَتْحُۙ۝۱ وَ رَاَیْتَ النَّاسَ یَدْخُلُوْنَ فِیْ دِیْنِ اللّٰهِ اَفْوَاجًاۙ۝۲ فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ اسْتَغْفِرْهُ١ؔؕ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا﴾

যখন আসবে মহান আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং তুমি মানুষকে দলে দলে মহান আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার রবের কৃতজ্ঞতা বাচক পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং তাঁর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করো; তিনি তো সর্বাপেক্ষা অধিক অনুতাপ গ্রহণকারী। (১১০ নং সূরাহ্ আন্ নাস্র, আয়াত নং ১-৩)

সহীহুল বুখারীতে আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘বানী ইসরাঈলকে আদেশ করা হয়েছিলো যে, তারা যেন মাথা নত করে শহরে প্রবেশ করে। কিন্তু তারা তাদের পিছন দিক বাঁকা করে এবং মাথাকে সোজা রেখে প্রবেশ করলো। তাদেরকে বলা হয়েছিলোঃ তোমরা ‘হিত্ত্বা’ বলো অর্থাৎ আমাদের ভুল-ভ্রান্তির হওয়ায় ক্ষমা করুন। কিন্তু তারা এ আদেশকে অগ্রাহ্য করলো এবং বললো ‘হাব্বাতুন ফী সা‘রাতিন। ( ফাতহুল বারী ৮/১৪) এটা ছিলো তাদের চরম ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতার বহিঃপ্রকাশ। তাদের পাপ ও বিরোধিতার কারণে তারা মহান আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত হয় এবং শাস্তিপ্রাপ্ত হয়। একটি মারফূ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘মহামারী একটি শাস্তি। এটা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছিলো। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/১৮৬) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যখন তোমরা শুনবে, অমুক জায়গায় মহামারী আছে তখন তোমরা সেখানে যেয়ো না। (ফাতহুল বারী ১০/১৮৯, সহীহ মুসলিম ৪/১৭৩৯) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেনঃ বিপদাপদ, দুঃখ, রোগ ইত্যাদি শাস্তি স্বরূপ, যা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকেও দেয়া হয়েছিলো। (তাফসীর তাবারী ২/১১৬)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. শিক্ষা ও নসিহত প্রদানের লক্ষ্যে পূর্ববর্তীদের কাহিনী বর্ণনা করা বৈধ।
২. জুলুম, পাপাচার ও শরীয়তের নির্দেশাবলী নিয়ে টালবাহানা করার ভয়াবহ পরিণতি থেকে সতর্ক হওয়া উচিত।
৩. নিজের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে শরীয়তের বিধান পরিবর্তন করা হারাম।

সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-৬০

وَ اِذِ اسْتَسْقٰى مُوْسٰى لِقَوْمِهٖ فَقُلْنَا اضْرِبْ بِّعَصَاكَ الْحَجَرَؕ فَانْفَجَرَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَیْنًاؕ قَدْ عَلِمَ كُلُّ اُنَاسٍ مَّشْرَبَهُمْؕ كُلُوْا وَ اشْرَبُوْا مِنْ رِّزْقِ اللّٰهِ وَ لَا تَعْثَوْا فِی الْاَرْضِ مُفْسِدِیْنَ

স্মরণ করো, যখন মূসা তার জাতির জন্য পানির দোয়া করলো, তখন আমরা বললাম, অমুক পাথরের ওপর তোমার লাঠিটি মারো। এর ফলে সেখান থেকে বারোটি ঝর্ণাধারা উৎসারিত হলো। প্রত্যেক গোত্র তার পানি গ্রহণের স্থান জেনে নিল। (সে সময় এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, ) আল্লাহ‌ প্রদত্ত রিযিক খাও, পান করো এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।

৬০ নং আয়াতের তাফসীর:

বারোটি গোত্রের জন্য বারোটি ঝর্ণা দান

এখানে বানী ইসরাঈলকে আর একটি নি‘য়ামতের কথা স্মরণ করানো হচ্ছে যে, যখন তাদের নবী মূসা (আঃ) তাদের জন্য মহান আল্লাহর নিকট পানির প্রার্থনা জানালেন, তখন মহান আল্লাহ বারোটি প্রস্রবণ সেই পাথর হতে বের করলেন যা তাদের সাথে থাকতো এবং তাদের প্রত্যেক গোত্রের জন্য তিনি এক একটি ঝর্ণা প্রবাহিত করে দেন যা প্রত্যেক গোত্র জেনে নেয়। অতঃপর মহান আল্লাহ তাদেরকে বলেন যে, তারা যেন ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’ খেতে থাকে এবং ঐ ঝর্ণার পানি পান করতে থাকে, আর বিনা পরিশ্রমে প্রাপ্ত ঐ আহার্য ও পানীয় খেয়ে ও পান করে যেন তারা তাঁর ‘ইবাদত করতে থাকে, আর তারা যেন তাঁর অবাধ্য হয়ে দুনিয়ার বুকে ফাসাদ সৃষ্টি না করে, নচেৎ সেই নি‘য়ামত তাদের নিকট হতে কেড়ে নেয়া হবে।

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সেটা একটা চার কোণ বিশিষ্ট পাথর ছিলো যা তাদের সাথেই থাকতো। মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে মূসা (আঃ) তার ওপর লাঠি দ্বারা আঘাত করলে চার কোণা হতে তিনটি করে বারোটি ঝর্ণা বেরিয়ে আসে। পাথরটি বলদের মাথার মতো ছিলো যা বলদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হতো। তারা যেখানে যেখানে অবতরণ করতো, পাথরটি নামিয়ে রাখতো এবং লাঠির আঘাত করতেই এটা হতে ঝর্ণা বেরিয়ে আসতো। (তাফসীর তাবারী ২/১২০, তাফসীরে ইবনু আবী হাতিম, সুনান নাসাঈ)

‘আতিয়াতুল ‘আওফী (রহঃ) বলেন, বলদের মাথা সাদৃশ্য একটি পাথর তারা বলদের ওপর বহণ করে নিয়েছিলো। যখনই তারা কোন জায়গায় অবতরণ করতো মূসা (আঃ) লাঠি দ্বারা পাথরটিতে আঘাত করতেন আর সাথে সাথে বারোটি ঝর্ণা প্রবাহিত হতো। আবার যখন যাত্রা শুরু করতো বলদের ওপর বহন করে নিতো এবং পানি বন্ধ হয়ে যেতো।

‘আতাউল খুরাসানী (রহঃ) বলেন, বানী ইসরাঈলদের একটি পাথর ছিলো যা হারূন (আঃ) ধরে রাখতেন আর মূসা (আঃ) তাতে আঘাত করতেন। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, পাথরটি ছিলো তূর পর্বতের, যা তারা নিজেদের সাথে বহন করতো এবং কোথাও যাত্রা বিরতি করলে মূসা (আঃ) লাঠি দ্বারা তাতে আঘাত করতেন।

কেউ কেউ বলেন, পাথরটি ছিলো জান্নাতী পাথর, যা দশ হাত লম্বা ও দশ হাত প্রশস্ত ছিলো। তার দু’টি শাখা ছিলো যা রাতে অন্ধকারে ঝলমল করতো। আর তা একটি গাধার ওপর বহন করা হতো। অন্য একটি মত এটাও রয়েছে যে, ঐ পাথরটি আদম (আঃ) জান্নাত হতে লাভ করেছিলেন, যা হস্তান্তর হতে হতে এক সময় শু‘আইব (আঃ)-এর লাঠির সাথে পাথরটিও মূসা (আঃ)-এর হাতে অর্পণ করেন।

কেউ কেউ বলেন যে, এ পাথরটি সেই পাথর ছিলো যার ওপর মূসা (আঃ) গোসল করার সময় কাপড় খুলে রেখেছিলেন। অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) মূসা (আঃ)-কে পাথরটি উঠিয়ে নিতে বললেন এবং এটাও বললেন যে, এ পাথরের মধ্যে ঐশি শক্তি রয়েছে এবং আপনার জন্য এতে মু‘জিযাও নিহিত আছে। ফলে মূসা (আঃ) তা উঠিয়ে স্বীয় থলেতে রাখেন।

যাহহাক (রহঃ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর সূত্রে বলেন, বানী ইসরাঈলগণ তীহ ময়দানে থাকাবস্থায় পাথরটি বিদীর্ণ হয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হয়েছিলো। সুফইয়ান সাওরী (রহঃ) ইবনু আব্বাসের এর সূত্রে বলেন , পাথর ফেটে বারোটি ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়ার ঘটনাটি তীহ ময়দানেই ঘটেছিলো। প্রত্যেক গোত্রের লোকেরা তা হতে পানি পান করতো।

সূরাহ্ আ‘রাফেও এ ঘটনা বর্ণিত আছে। কিন্তু ঐ সূরাহ টি ‘মাক্কী’ বলে সেখানে তার বর্ণনা নাম পুরুষের সর্বনাম দ্বারা করা হয়েছে এবং মহান আল্লাহ যেসব অনুগ্রহ তাদের ওপর করেছিলেন, স্বীয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে তিনি তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আর এ সূরাহ টি ‘মাদানী’ বলে এখানে স্বয়ং তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। সূরাহ্ আ‘রাফে فَانْبَجَسَتْ বলেছেন এবং এখানে فَانْفَجَرَتْ বলেছেন। কেননা সেখানে প্রথম জারী হওয়ার অর্থ এবং এখানে শেষ অবস্থায় বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

সে পাথরটি এখনো সিনাই উপদ্বীপে রয়েছে। পর্যটকরা এখনো গিয়ে সেটি দেখেন। পাথরের গায়ে এখনো ঝর্ণার উৎস মুখের গর্তগুলো দেখা যায়। ১২টি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করার কারণ ছিল এই যে, বনী ইসরাঈলদেরও ১২টি গোত্র ছিল। প্রত্যেক গোত্রের জন্য আল্লাহ‌ একটি করে ঝর্ণা প্রবাহিত করেন। তাদের মধ্যে পানি নিয়ে কলহ সৃষ্টি না হয়, এ জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছিল।

সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-৬১

وَ اِذْ قُلْتُمْ یٰمُوْسٰى لَنْ نَّصْبِرَ عَلٰى طَعَامٍ وَّاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ یُخْرِ جْ لَنَا مِمَّا تُنْۢبِتُ الْاَرْضُ مِنْۢ بَقْلِهَا وَ قِثَّآئِهَا وَ فُوْمِهَا وَ عَدَسِهَا وَ بَصَلِهَاؕ قَالَ اَتَسْتَبْدِلُوْنَ الَّذِیْ هُوَ اَدْنٰى بِالَّذِیْ هُوَ خَیْرٌؕ اِهْبِطُوْا مِصْرًا فَاِنَّ لَكُمْ مَّا سَاَلْتُمْؕ وَ ضُرِبَتْ عَلَیْهِمُ الذِّلَّةُ وَ الْمَسْكَنَةُۗ وَ بَآءُوْ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰهِؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ كَانُوْا یَكْفُرُوْنَ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ وَ یَقْتُلُوْنَ النَّبِیّٖنَ بِغَیْرِ الْحَقِّؕ ذٰلِكَ بِمَا عَصَوْا وَّ كَانُوْا یَعْتَدُوْنَ۠

স্মরণ করো, যখন তোমরা বলেছিলে, “হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাবারের ওপর সবর করতে পারি না, তোমার রবের কাছে দোয়া করো যেন তিনি আমাদের জন্য শাক-সব্জি, গম, রসুন, পেঁয়াজ, ডাল ইত্যাদি কৃষিজাত দ্রব্যাদি উৎপন্ন করেন।” তখন মূসা বলেছিল, “তোমরা কি একটি উৎকৃষ্ট জিনিসের পরিবর্তে নিকৃষ্ট জিনিস নিতে চাও? তাহলে তোমরা কোন নগরে গিয়ে বসবাস করো, তোমরা যা কিছু চাও সেখানে পেয়ে যাবে।” অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছলো যার ফলে লাঞ্ছনা, অধঃপতন, দুরবস্থা ও অনটন তাদের ওপর চেপে বসলো এবং আল্লাহর গযব তাদেরকে ঘিরে ফেললো। এ ছিল তাদের আল্লাহর আয়াতের সাথে কুফরী করার এবং পয়গম্বরদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার ফল। এটি ছিল তাদের নাফরমানির এবং শরীয়াতের সীমালংঘনের ফল।

৬১ নং আয়াতের তাফসীর:

বানী ইসরাঈলরা মান্না-সালওয়ার পরিবর্তে নিকৃষ্ট খাদ্য পছন্দ করলো

এখানে বানী ইসরাঈলের অধৈর্য এবং মহান আল্লাহর নি‘য়ামতের অমর্যাদা করার কথা বর্ণিত হচ্ছে। তারা ‘মান্না’ ও ‘সালওয়ার’ মতো পবিত্র আহার্যের ওপরেও ধৈর্য ধারণ করতে পারেনি এবং তার পরিবর্তে নিকৃষ্ট বস্তুর জন্য প্রার্থনা জানায়। হাসান বাসরী (রহঃ) বানী ইসরাঈল সম্পর্কে বলেনঃ মহান আল্লাহ তাদেরকে যে খাদ্য প্রদান করেছিলো তা খেতে তারা ক্লান্ত বোধ করছিলো এবং অধৈর্য হয়ে পড়েছিলো। পূর্বে তারা চাষাবাদ করে যে ডাল, রসুন, পিঁয়াজ এবং অন্যান্য শব্জি উৎপাদন করে আহার করতো সেই কথা মনে পড়েছিলো। তাই তারা বললোঃ

﴿وَ اِذْ قُلْتُمْ یٰمُوْسٰى لَنْ نَّصْبِرَ عَلٰى طَعَامٍ وَّاحِدٍ فَادْعُ لَنَا رَبَّكَ یُخْرِجْ لَنَا مِمَّا تُنْۢبِتُ الْاَرْضُ مِنْۢ بَقْلِهَا وَ قِثَّآىِٕهَا وَ فُوْمِهَا وَ عَدَسِهَا وَ بَصَلِهَا١ؕ قَالَ اَتَسْتَبْدِلُوْنَ الَّذِیْ هُوَ اَدْنٰى بِالَّذِیْ هُوَ خَیْرٌ١ؕ اِهْبِطُوْا مِصْرًا فَاِنَّ لَكُمْ مَّا سَاَلْتُمْ﴾

‘আর যখন তোমরা বলেছিলেঃ হে মূসা! আমরা একইরূপ খাদ্যে ধৈর্য ধারণ করতে পারছিনা, অতএব তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের নিকট প্রার্থনা করো যেন তিনি আমাদের জন্মভূমিতে যা উৎপন্ন হয় তা হতে এর শাক-শব্জি, এর কাঁকুড়, এর গম, এর মসুর এবং এর পিয়াজ উৎপাদন করেন। সে বলেছিলোঃ যা উৎকৃষ্ট তোমরা কি তার সাথে যা নিকৃষ্ট তার বিনিময় করতে চাও? কোন নগরে উপনীত হও, তোমাদের প্রার্থিত দ্রব্যগুলো অবশ্যই প্রাপ্ত হবে।

মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিনা পরিশ্রমে পাওয়া খাদ্য-সম্ভাবের পরিবর্তে ইয়াহূদীরা নিকৃষ্ট খাদ্যের আকাঙ্খা করায় তাদেরকে ধিক্কার দেয়া হয়েছে। বিনা পরিশ্রমে খাঁটি সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রী তারা পরিহার করতে চাইলো।

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মূসা (আঃ) তাদেরকে বলেনঃ ‘তোমরা কোন এক শহরে চলে যাও।’ উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) এবং ইবনু মাস‘উদ (রাঃ)-এর কিরা’আতে مِصْرَ (মিস্রা) ও আছে এবং এর তাফসীরে মিসর শহর বুঝানো হয়েছে। مِصْرًا শব্দটি দ্বারাও নির্দিষ্ট ‘মিসর’ শহর ভাবার্থ নেয়া যেতে পারে। مِصْر-এর অর্থ সাধারণ শহর নেয়াই উত্তম। তাহলে ভাবার্থ দাঁড়াবে এইঃ ‘তোমরা যা চাচ্ছো তা খুব সহজ জিনিস। যে কোন শহরে গেলেই এটা পেয়ে যাবে। দু‘আরই বা প্রয়োজন কি? তাদের এ কথা শুধুমাত্র অহঙ্কার ও অবাধ্যতা হিসেবে ছিলো বলে তাদেরকে কোন উত্তর দেয়া হয়নি। মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

বানী ইসরাঈলকে লাঞ্ছনা ও দারিদ্রতা গ্রাস করলো

ভাবার্থ এই যে, তাদের ওপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্রতা চিরস্থায়ী করে দেয়া হয়। অপমান ও হীনতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। তাদের নিকট হতে কর আদায় করা হয়। তারা মুসলিমদের পদানত হয়। তাদেরকে উপবাস করতে হয় এবং ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিতে হয়। তাদের ওপর মহান আল্লাহর ক্রোধ ও অভিশাপ বর্ষিত হয়। মহান আল্লাহ তাদেরকে মুসলিমদের পদানত করেছেন। মাজুসী বা অগ্নি-উপাসকদেরকে যখন কর দিতে হতো তখন মুসলিমগণ আবির্ভূত হোন। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/১৯৫, ১৯৬) এ ছাড়া আবুল ‘আলিয়া (রহঃ), রাবী‘ ইবনু আনাস (রহঃ) এবং সুদ্দী (রহঃ) বলেছেন যে, এখানে ‘লাঞ্ছনা’ অর্থ দারিদ্রতা। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/১৯৬) ‘আতিয়াহ আল ‘আউফী (রহঃ) বলেন, লাঞ্ছনা বলা হয়েছে কর প্রদান করাকে। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/১৯৬) এ ছাড়া যাহ্হাক (রহঃ) এ আয়াতের বিশ্লেষণে বলেনঃ তারা মহান আল্লাহর ক্রোধ অর্জন করেছে। (তাফসীর তাবারী ২/১৩৮)

তাদের অহঙ্কার, অবাধ্যতা, সত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি, মহান আল্লাহর আয়াতসমূহের প্রতি অবিশ্বাস এবং নবীগণ ও তাঁদের অনুসারীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা ইত্যাদির কারণেই তাদের প্রতি এসব শাস্তি অবতীর্ণ হয়েছিলো। মহান আল্লাহর আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করা এবং তাঁর নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে?

‘তাকাব্বুর’ শব্দের অর্থ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, ‘তাকাব্বুরের’ অর্থ হচ্ছে সত্য গোপন করা এবং জনগণকে ঘৃণার চোখে দেখা। (হাদীস সহীহ। মুসলিম ১/১৪৭/৯৩, সুনান আবূ দাউদ-৪/১২৪/৬৫১, জামি‘ তিরমিযী- ৪/১৯৯৯, মুসনাদ আহমাদ ৪/১৩৪,৬৫১)

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ) ইবনু মাস‘উদ (রাঃ)-এর সূত্রে বলেন আমি গোপন বিষয়াদিতে পর্দা করতাম না এবং অমুক অমুক কাজেও। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে এসে মালিক ইবনু মারারাহ্ রাহভী (রাঃ)-কে তার কথার শেষ পর্যায়ে পেলাম। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আরয করছেনঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি একজন সুশ্রী লোক। আমি চাই না যে, কারো জুতার শুকতলাও আমার চেয়ে সুন্দর হোক। তাহলে কি এটাও অবাধ্যতা ও অহঙ্কার হবে?’ তিনি বললেনঃ ‘না, বরং অহঙ্কার ও অবাধ্যতা হচ্ছে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং জনগণকে ঘৃণা করা।’ (হাদীসটির সনদ মুনকাতি‘ বিচ্ছিন্ন। মুসনাদ আহমাদ ১/৩৮৫,৪২৮, আহমাদ শাকির বলেন হাদীসটির সনদ এ গবেষণার প্রয়োজন আছে)

আবূ দাউদ ত্বয়ালেসী ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ)-এর সূত্রে বলেন, বানী ইসরাঈলগণ প্রতিদিন তিনশত নবীকে হত্যা করে দিনের শেষ ভাগে বাজারে গিয়ে তাদের লেন- দেনের কাজে লেগে যেতো। (মুসনাদ আবূ দাউদ আত ত্বয়ালেসী)

ইমাম আহমাদ (রহঃ) ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কিয়ামত দিবসে যাদেরকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে তারা হলো ঐ সকল ব্যক্তি যারা কোন রাসূলকে হত্যা করেছে অথবা কোন রাসূল তাদেরকে হত্যা করেছে, পথভ্রষ্ট তারাই যারা অন্যায় বিচারকারী শাসক এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকলঙ্গকারী। (হাদীস সহীহ। মুসনাদ আহমাদ ১/৪০৭/৩৮৬৮) মহান আল্লাহ বলেন, ﴿ذٰلِكَ بِمَا عَصَوْا وَّكَانُوْا یَعْتَدُوْنَ﴾ বানী ইসরাঈলকে এভাবে শাস্তি দেয়ার আরো একটি কারণ ছিলো এই যে, তারা ছিলো অবাধ্য এবং সীমালঙ্ঘনকারী। তাদেরকে যে বিষয়ে নিষেধ করা হতো তা তারা মেনে চলতো না এবং যে বিষয়ে তাদের কাজের সীমা বলে দেয়া হতো সেই বিষয়ে তারা কম-বেশি করতো। মহান আল্লাহই এ বিষয়ে ভালো জানেন।

এর অর্থ এ নয় যে, বিনা শ্রমে লব্ধ মান্না ও সালওয়া বাদ দিয়ে তোমরা এমন জিনিস চাচ্ছো যে জন্য শারীরিক মেহনত করে কৃষি করতে হবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যে মহান উদ্দেশ্যে তোমাদের মরুচারিতায় লিপ্ত করা হয়েছে তার মোকাবিলায় খাদ্যের স্বাদ তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে তোমরা ঐ মহান উদ্দেশ্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়েছো কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য ঐ খাদ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে চাও না। (তুলনামুলক পর্যালোচনার জন্য দেখুন গণনা পুস্তক ১১ অনুচ্ছেদ, ৪-৯ শ্লোক)

আয়াতের সাথে কুফরী করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। যেমন, একঃ আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষাবলীর মধ্য থেকে যে কথাটিকে নিজেদের চিন্তা–ভাবনা, ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাংখার বিরোধী পেয়েছে তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। দুইঃ কোন বক্তব্যকে আল্লাহর বক্তব্য জানার পরও পূর্ণ দাম্ভিকতা, নির্লজ্জতা ও বিদ্রোহাত্মক মনোভাব সহকারে তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং আল্লাহর নির্দেশের কোন পরোয়া করেনি। তিনঃ আল্লাহর বাণীর অর্থ ও উদ্দেশ্য ভালোভাবে জানার ও বুঝার পরও নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী তার মধ্যে পরিবর্তন সাধন করেছে।

এই হচ্ছে ইহুদি জাতির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। কুরআনের উল্লেখিত আয়াতগুলোতে সংক্ষেপে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে জাতি নিজের ফাসেক ও দুশ্চরিত্র সম্পন্ন লোকদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে এবং সৎ ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী লোকদেরকে কারাগারে স্থান দিতে চায় আল্লাহ তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ না করলে আর কাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করবেন?

আয়াতে مِصْرَ ‘মিসর’শব্দ দ্বারা কোন্ জায়গা বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতানৈক্য পাওয়া যায়। কিন্তু সঠিক কথা হল: مصر দ্বারা উদ্দেশ্য যে কোন শহর। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস-সহ অন্যান্যরাও এ মতই পোষণ করেছেন।

(ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ)

‘আর তাদের ওপর লাঞ্ছনা……পতিত হল’এর ভাবার্থ হচ্ছে তাদের ওপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র স্থায়ী করে দেয়া হয়েছে। অপমান ও হীনতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: তাদেরকে লাঞ্ছিত করার অর্থ হল, হীন অবস্থায় স্বহস্তে মুসলিমদেরকে জিযিয়া প্রদান করা। আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: المسكنة এর অর্থ হল “দরিদ্রতা”। যহহাক (রহঃ) বলেন: “জিযিয়া”।

অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার আয়াতের সাথে কুফরী করার নেপথ্যে বানী ইসরাঈলকে তিন প্রকার শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে।

১. الذِّلَّةُ অপমান ও লাঞ্ছনা।
২. الْمَسْکَنَةُ দরিদ্রতা।
৩. بَا۬ءُوْ بِغَضَبٍ আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ ও ক্রোধ।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের একটি জঘন্য পাপের কথা উল্লেখ করেছেন যা অন্যান্য জাতিরা করতে সাহস পায়নি।

যখনই তাদের কাছে কোন নাবী-রাসূল এসেছেন তখনই তারা তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(یٰحَسْرَةً عَلَی الْعِبَادِﺈ مَا یَاْتِیْھِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ اِلَّا کَانُوْا بِھ۪ یَسْتَھْزِءُوْنَ)

“আফসোস সে বান্দাদের জন্য, যাদের কাছে কখনও এমন কোন রাসূল আসেনি, যাকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।”(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩০)

ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে একটি হাদীস রয়েছে যে,

إنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ قَتَلَهُ نَبِيٌّ, أَوْ قَتَلَ نَبِيًّا, وَإِمَامُ ضَلَالَةٍ, وَمُمَثِّلٌ مِنَ الْمُمَثِّلِينَ

কিয়ামাতের দিন যাদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তারা ওরাই যাদেরকে কোন নাবী হত্যা করেছেন অথবা তারা কোন নাবীকে হত্যা করেছে, অনুরূপ পথভ্রষ্ট নেতা এবং চিত্র শিল্পীরা। (মুসনাদ আহমাদ: ৩৮৬৮, সনদ হাসান)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলার আদেশ অমান্য করে চলার পরিণতি খুবই খারাপ।
২. উত্তম কিছু বর্জন করে অধম কিছু গ্রহণ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।
৩. নাবী-রাসূলদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা কুফরী কাজ।

 

 

 

Leave a Reply