أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/B/48) www.motaher21.net
أَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْجٰهِلِينَ
“আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আল্লাহ্র আশ্রয় চাই’।”
” I take Allah’s Refuge from being among Al-jahilun.”
সূরা- আল্ বাকারা
আয়াত ৬৭
وَإِذْ قَالَ مُوسٰى لِقَوْمِهِۦٓ إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تَذْبَحُوا بَقَرَةً ۖ قَالُوٓا أَتَتَّخِذُنَا هُزُوًا ۖ قَالَ أَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْجٰهِلِينَ
স্মরণ করো সে সময়ের কথা, যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বলেছিলো, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের একটি গরু যবেহ করার আদেশ দিচ্ছেন’; তারা বলেছিলো, ‘তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছো’? মূসা বললো, মহান আল্লাহ্র আশ্রয় নিচ্ছি, যাতে আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হই।
৬৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে তাদেরকে বলেন:
(إِنَّ اللّٰهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَذْبَحُوْا بَقَرَةً)
“নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন যে, তোমরা একটি গরু ‘যবেহ’কর।”একথা শুনে তারা বলল:
(أَتَتَّخِذُنَا هُزُوًا)
“তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ?” তখন মূসা (আঃ) বললেন:
(قَالَ أَعُوْذُ بِاللّٰهِ أَنْ أَكُوْنَ مِنَ الْجَاهِلِيْنَ)
“আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন আমি মূর্খদের অন্তর্গত না হই।”
তখন যদি তারা যেকোন একটি গরু যবাই করত তাহলেই যথেষ্ট হত। কিন্তু তারা কাঠিন্য অবলম্বন করল তখন আল্লাহ তা‘আলাও তাদের ওপর তা কঠিন করে দিলেন।
বানী ইসরাঈলের নিহত ব্যক্তি ও গাভীর ঘটনা
মহান আল্লাহ বলেন, হে বানী ইসরাঈলগণ! তোমরা আমার নি‘য়ামতের কথা স্মরণ করো, অর্থাৎ গরুর মাধ্যমে একজন নিহত লোককে জীবিত করে এবং তার হত্যাকারীর পরিচয় দান করে যে অনুগ্রহ করেছি তা স্মরণ করো। এটি একটি অলৌকিক ঘটনাই বটে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন ‘উবাইদা আস সালমানী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে এক ধনী বন্ধ্যা লোক ছিলো, তার কোন সন্তানাদি ছিলো না। তার উত্তরাধিকারী ছিলো তার এক ভ্রাতুস্পুত্র। উত্তরাধিকারী প্রাপ্তির আশায় সে তার পিতৃব্যকে হত্যা করে এবং রাতে তাদের গ্রামের একটি লোকের দরজার ওপরে রেখে আসে। সকালে গিয়ে ঐ লোকটির ওপর হত্যার অপবাদ দেয়। অবশেষে উভয় দলের লোকদের মধ্যে মারামারি ও খুনাখুনি হওয়ার উপক্রম হয়। এমন সময় তাদের জ্ঞানী লোকেরা তাদেরকে বলেনঃ ‘তোমাদের মধ্যে মহান আল্লাহর রাসূল মূসা (আঃ) বিদ্যমান থাকতে তোমরা কেন একে অপরকে হত্যা করবে? সুতরাং তারা মূসা (আঃ)-এর নিকট এসে ঘটনাটি বর্ণনা করে। তিনি তাদেরকে বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তোমাদেরকে একটি গরু যবেহ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।’ এ কথা শুনে তারা বললোঃ ‘আপনি কি আমাদের সাথে উপহাস করছেন? তিনি বলেনঃ ‘মূর্খদের ন্যায় কাজ করা হতে আমি মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।’ তারা যদি কোন একটি গরু যবেহ করতো তাহলেই যথেষ্ট হতো। কিন্তু তারা কাঠিন্য অবলম্বন করে, সুতরাং মহান আল্লাহ তাদের ওপর তা কঠিন করে দেন।
অতঃপর তারা মহান আল্লাহর বর্ণিত নির্ধারিত গরু একটি লোকের নিকট প্রাপ্ত হয়। একমাত্র তার নিকট ছাড়া ঐ রূপ গরু আর কারো কাছে ছিলো না। লোকটি বলেঃ ‘মহান আল্লাহর শপথ! এই গরুর চামড়া পূর্ণ স্বর্ণের কম মূল্যে আমি এটা বিক্রি করবো না।’ সুতরাং তারা ঐ মূল্যেই তা কিনে নেয় এবং যবেহ করে। তারপর তারা এর এক খণ্ড মাংস দ্বারা নিহত ব্যক্তির ওপর আঘাত করে। তখন মৃত লোকটি দাঁড়িয়ে যায়। লোকগুলো তাকে জিজ্ঞেস করেঃ তোমাকে কে হত্যা করেছে? সে বলেঃ আমার এই ভ্রাতুস্পুত্র। এ কথা বলেই সে পুনরায় মরে যায়। সুতরাং ভ্রাতুস্পুত্রকে মৃত ব্যক্তির কোন মাল দেয়া হলো না। অতঃপর সাব্যস্ত হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির সম্পদ লাভের অসৎ উদ্দেশে যদি কেউ তাকে হত্যা করে তাহলে মৃত ব্যক্তির সম্পদ থেকে ঐ হত্যাকারী কোন কিছুই প্রাপ্ত হবে না। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/১১৪) ইবনু জারীর (রহঃ)-ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহ ভালো জানেন। ‘আব্দ ইবনু হুমাইদ (রহঃ)ও স্বীয় তাফসীরে ইয়াযিদ ইবনু হারূন থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
আদম ইবনু ইয়াস স্বীয় তাফসীরে আবুল ‘আলিয়া (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, বানী ইসরাঈলদের মাঝে একজন ধনী লোক ছিলো, তার কোন সন্তানাদি ছিলো না। তবে তার একজন নিকটাত্মীয় ছিলো সে তার ওয়ারিস ছিলো। অতঃপর সে তাকে হত্যা করলো যাতে সে দ্রুত সম্পদ পেয়ে যায়। ফলে সে হত্যা করে মৃত ব্যক্তিকে লোকালয়পূর্ণ রাস্তায় রেখে যায়। অতঃপর সে মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে বলে যে, আমার নিকটাত্মীয়কে হত্যা করা হয়েছে আর এ বিষয়ে আমি খুব কিংকর্তব্যবিমুঢ়। আর এমতাবস্থায় আমি আপনাকে ব্যতীত এমন কাউকে পাচ্ছি না, যে আমার আত্মীয়ের হত্যাকারীর সন্ধান দিবে। তখন মূসা (আঃ) সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বললেন, মৃত ব্যক্তির হত্যাকারীর কোন সন্ধান তোমাদের কারো কাছে থাকলে সে যেন তা আমাদেরকে জানিয়ে দেয়। কিন্তু জনগণ কোন তথ্য দিতে পারলো না। ফলে হত্যা কারী নিজেই সামনে অগ্রসর হয়ে মূসা (আঃ)-কে সম্বোধন করে বললো আপনি তো একজন নবী কাজেই মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করলেই এর সমাধান পাওয়া যাবে। অতঃপর মহান আল্লাহ গাভী যবেহ করার নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ শোনে বানী ইসরাঈলরা খুবই বিস্মিত হলো এবং বললো ‘আপনি কি আমাদের সাথে উপহাস করছেন? তিনি বলেনঃ ‘মূর্খদের ন্যায় কাজ করা হতে আমি মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।’ তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো তা কীরূপ’? মূসা (আঃ) বললো, ‘মহান আল্লাহ বলছেন, তা এমন এক গরু যা বৃদ্ধও নয় এবং অল্প বয়স্কও নয় বরং মধ্য বয়সী। তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো, এর রং কী’? মূসা বললো, ‘মহান আল্লাহ বলছেন, তা হলুদ বর্ণের গরু, তার রং উজ্জ্বল গাঢ়, যা দর্শকদের আনন্দ দেয়’। তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো গরুটি কেমন? কারণ সব গরু আমাদের কাছে সমান। আর মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় আমরা পথের দিশা পাবো।’ মূসা (আঃ) বললো, ‘তিনি বলছেন, তা এমন এক গরু যা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি বরং সুস্থ ও নিখুঁত’। তারা বললো, ‘এখন তুমি সত্য প্রকাশ করেছো’। তারা তাকে যবেহ করলো যদিও তাদের জন্য সেটা প্রায় অসম্ভব ছিলো। (২ নং সূরাহ আল বাকারা, আয়াত-৬৮-৭১) তারা নির্দেশ পেয়ে যে কোন একটি গরু যবেহ করলেই যথেষ্ট হতো। কিন্তু তারা নিজেদের ওপর কঠোরতা করলো ফলে তাদের ওপর আরো কঠিন করে দেয়া হলো। তারা যদি একপর্যায়ে إنشاء الله لمهتدون وإنا ‘মহান আল্লাহ চাহেতো আমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হবো’ এ কথা না বলতো তাহলে তারা কখনো এর সমাধান করতে পারতো না। অতএব আমাদের কাছে এ মর্মে সংবাদ এসেছে যে, উল্লিখিত বিশেষণ সম্বলিত গাভী অনুসন্ধান করতে করতে ইয়াতীম লালন-পালনকারী একজন বৃদ্ধার নিকট পেলো। গাভীটি লোকদের নিকট খুবই দুর্লভ ছিলো। তাই বৃদ্ধা যখন জানতে পারলো যে, এই গাভীই তাদের একমাত্র অবলম্বন যা ক্রয় ব্যতীত তাদের অন্য কোন উপায় নেই, তখন সে তার মূল্য খুব বেশি চাইলো। ফলে তারা ফিরে এসে মূসা (আঃ)-এর কাছে বিষয়টি অবহিত করলো যে তারা অনেক অনুসন্ধানের পর একজন বৃদ্ধার কাছে পেয়েছে বটে কিন্তু মূল্য খুব বেশি চাচ্ছে। উত্তরে মূসা (আঃ) বললেন, মহান আল্লাহ তো প্রথমে তোমাদের ওপর হালকাভাবেই নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু তোমরা নিজেরা নিজেদের ওপর কঠোরতা করে নিয়েছো। কাজেই তারা যা চায় তা দিয়েই গাভীটি ক্রয় করে আনো। ফলে তারা তাই করলো এবং গাভীটি যবেহ করলো। অতঃপর মূসা (আঃ) গাভীটির একটি হাড় দিয়ে নিহত ব্যক্তিকে আঘাত করার নির্দেশ দিলেন। তারা তাই করলো। ফলে মৃত ব্যক্তি রূহ ফিরে পেয়ে তথা জীবিত হয়ে তার হত্যাকারীর নাম বলে আবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। অতঃপর হত্যাকারীকে গ্রেফতার করা হলো। আর সে ঐ ব্যক্তি ছিলো যে নিজেই হত্যা করে নিহত ব্যক্তির হত্যাকারী কে হতে পারে মর্মে মূসা (আঃ)-এর কাছে তথ্য জানতে গিয়েছিলো। তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে জনগণ তথা বানী ইসরাঈলের লোকেরা মন্দের তথা হত্যা কাজের প্রতিশোধ স্বরূপ হত্যাকারীকেও হত্যা করে।
গাভী সম্পর্কে কিছু বিবরণ
মুহাম্মাদ ইবনু জারীর (রহঃ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর সূত্রে গাভীটির বিবরণ দিয়ে বর্ণনা করেন যে, মূসা (আঃ)-এর যুগে বানী ইসরাঈলের মাঝে একজন বৃদ্ধ লোক ছিলো। যার অনেক সম্পদ ছিলো। আর তারই কিছু ভ্রাতুস্পুত্র ছিলো যারা ছিলো সহায়-সম্পদহীন অভাবী ব্যক্তিবর্গ। আর এদিকে ঐ অঢেল সম্পদের অধিকারী বৃদ্ধ লোকটির কোন সন্তান-সন্ততি না থাকায় তার ভ্রাতুস্পুত্রগণই ছিলো তার একমাত্র ওয়ারিস। অতএব তারা পরস্পরে বলতে লাগলো যে, আমাদের চাচা যদি মারা যেতো তাহলেই তো আমরা তার সম্পদগুলো প্রাপ্ত হয়ে অভাবমুক্ত হতে পারতাম। কিন্তু দিনের পর দিন অতিবাহিত হতে থাকলো অথচ বৃদ্ধ মৃত্যুবরণ না করায় একপর্যায়ে শায়তান এসে তাদেরকে পরামর্শ দিলো যে, তোমরা কি তোমাদের বৃদ্ধ চাচাকে হত্যা করবে না? তাহলেই তো তোমরা তার সম্পদ পেয়ে যাও এবং অপর শহর বাসীর ওপর হত্যার দোষ চাপিয়ে তারও তোমরা দিয়ত তথা মুক্তিপণ নিতে পারতে। আর এ কথা বলার কারণ হলো সেখানে দু’টি গ্রাম বা শহর ছিলো একটিতে বৃদ্ধলোকটিসহ তার আত্মীয়-স্বজন বাস করতো অন্যটিতে অপর লোকেরা বাস করতো। আর পূর্বে থেকেই নিয়ম চালু ছিলো যে নিহত ব্যক্তি যেই হোক না কেন যে গ্রাম বা শহরের নিকটবর্তী হবে তারাই মাকতুলের দিয়ত বা মুক্তিপণ পরিশোধ করবে।
অতএব শায়তান তাদেরকে প্ররোচিত করতে থাকলো আর এদিকে বৃদ্ধ চাচা মৃত্যু বরণ না করে সময় আরো দীর্ঘায়িত হতে লাগলো। ফলে তারা বৃদ্ধকে হত্যা করে অন্য গ্রামে বা শহরের প্রান্তে রেখে আসে। আর পরদিন সকাল বেলা মৃত ব্যক্তির ভাতিজাবর্গ উক্ত শহরের লোকদের উদ্দেশ্যে বলে যে, যেহেতু চাচার লাশ তোমাদের এলাকায় পাওয়া গিয়েছে তাই তোমরা এর দিয়ত বা মুক্তিপণ দাও। প্রতি উত্তরে উক্ত শহরবাসী বললো, আমরা মহান আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি, আমরা না তাকে হত্যা করেছি আর না তার হত্যাকারীকে আমরা চিনি। তাছাড়া শহরের গেট বন্ধ করার পর আমরা প্রভাত না হওয়া পর্যন্ত কখনো শহরের গেটে খোলাও হয়নি। অবশ্য জিবরাঈল আমীন সামী‘উল ‘আলীম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এসে থাকে। হয়তো তার মাধ্যমে এর সমাধান পাওয়া যাবে। এরপরই জিবরাঈল আমীন মূসা (আঃ)-কে বললেন, তুমি তাদেরকে বলো, اِنَّ اللّٰهَ یَاْمُرُكُمْ اَنْ تَذْبَحُوْا بَقَرَةً ‘মহান আল্লাহ তোমাদের একটি গরু যবেহ করার আদেশ দিচ্ছেন’। (হাদীসের সনদটি য‘ঈফ। তাফসীরে ত্বাবারী ১/১৮৫)
আর সুদ্দী (রহঃ) বলেন, পূর্ব যুগে একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন এবং তার একজন কন্যাও ছিলো। আর একজন অভাবী ভাতিজাও ছিলো। অতএব ভাতিজা চাচার মেয়েকে তার সাথে বিবাহ দেয়ার জন্যে অনুরোধ করলো। কিন্তু চাচা তার সাথে আপন কন্যাকে বিবাহ দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এতে যুবক ভাতিজা রেগে যায়। আর শপথ করে বলে যে, আমি অবশ্যই আমার চাচাকে হত্যা করবো এবং তার সমস্ত সম্পদ হস্তগত করবো। তার মেয়েকেও বিবাহ করবো এবং তার মুক্তিগণ গ্রহণ করে নিজেই তা ভক্ষণ করবো। অতএব যুবকটি তার চাচার নিকট এসে বানী ইসরাইলের বাণিজ্যিক কাফিলার কথা উল্লেখ করে বললো চাচা! আমার সাথে গিয়ে অমুক বাণিজ্যিক কাফিলার নিকট থেকে কিছু নিয়ে দিন। কেননা তারা আমাকে দিতে চাইবে না কিন্তু আপনাকে দেখলে তারা হয়তো না করবে না। ভ্রাতুস্পুত্রের প্রতি সদয় হয়ে চাচা কোন এক রাতে তার সাথে বের হয়ে যখন কাফিলার নিকট পৌছলো। তখন ভাতিজা চাচাকে হত্যা করে সেখানে ফেলে রেখে নিজ বাড়ীতে ফিরে আসে। অতঃপর পরদিন প্রত্যুষে চাচার সন্ধানে বের হয়ে কোথাও তাকে পেলো না, অবস্থা যেন এমন যে, সে কিছু জানেই না। একপর্যায়ে উক্ত বাণিজ্যিক কাফিলার নিকট গিয়ে সম্মিলিত জনগণ দেখতে পেয়ে বললো তোমরাই আমার চাচাকে হত্যা করেছো। অতএব তার দিয়াত বা মুক্তিপণ আমার নিকট হস্তান্তর করো। এই বলে সে ক্রন্দনরত অবস্থায় মুষ্ঠি ভর্তি করে মাথায় ছিটাচ্ছিল আর হায় চাচা! বলে বিলাপ করতেছিলো। অতঃপর বাণিজ্যিক কাফিলার লোকগণ বিষয়টি মূসা (আঃ)-এর নিকট অবহিত করলো। মূসা (আঃ) পূর্বের নিয়মানুযায়ী তাদেরকে দিয়াত বা মুক্তিপণ আদায় করতে বললেন। তারা বললো, হে মহান আল্লাহর রাসূল! প্রকৃত হত্যাকারী কে হতে পারে তা জানার জন্য আপনি মহান আল্লাহর দরবারে একটু আবেদন করুন। যাতে তার থেকেই দিয়াত আদায় করা যায়। মহান আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি মৃত ব্যক্তির দিয়ত পরিশোধ করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে এমনটি নয়। বরং আমরা লজ্জাবোধ করছি যে আজীবন আমাদেরকে দোষারোপ করা হবে। তখনই মহান বললেনঃ
﴿وَ اِذْ قَتَلْتُمْ نَفْسًا فَادّٰرَءْتُمْ فِیْهَا وَ اللّٰهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ﴾
‘স্মরণ করো! তোমরা যখন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে এবং একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করছিলে, তোমরা যা গোপন করছিলে মহান আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিলেন।’ (২ নং সূরাহ আল বাকারা, আয়াত-৭২) অতঃপর মূসা (আঃ) বললেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের একটি গাভী যবেহ করার আদেশ দিচ্ছেন’। তারা বললো আমরা তোমাকে আবেদন করলাম নিহত ব্যক্তি ও তার হত্যাকারী সম্পর্কে জানার জন্য। আর আপনি বলছেন তোমরা একটি গাভী যবেহ করো। নিহত ব্যক্তির সাথে গাভীর সম্পর্ক কি? আপনি কি আমাদের সাথে উপহাস করছেন? ‘মূসা (আঃ) বললো, মহান আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, যাতে আমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হই।’ ইবনু ‘আব্বাস (রহঃ) বলেন, তারা যদি যে কোন একটি গাভী যবেহ করতো তাহলেই যথেষ্ট হতো। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন করে মূসা (আঃ)-কে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো। ফলে মহান আল্লাহ তাদের ওপর কঠিন করে দিলেন। তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো তা কীরূপ’? মূসা (আঃ) বললো, ‘মহান আল্লাহ বলছেন, তা এমন এক গরু যা বৃদ্ধও নয় এবং অল্প বয়স্কও নয় বরং মধ্য বয়সী। তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো, ওর রং কী’? মূসা বললো, ‘মহান আল্লাহ বলছেন, তা হলুদ বর্ণের গরু, তার রং উজ্জ্বল গাঢ়, যা দর্শকদের আনন্দ দেয়’। তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো গরুটি কেমন? কারণ সব গরু আমাদের কাছে সমান। আর মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় আমরা পথের দিশা পাবো।’ মূসা বললো, ‘তিনি বলছেন, তা এমন এক গরু যা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি বরং সুস্থ ও নিখুঁত’। তারা বললো, ‘এখন তুমি সত্য প্রকাশ করেছো’। (২ নং সূরাহ আল বাকারা, আয়াত-৬৮-৭১) অতঃপর তারা অনুরূপ গাভী অনুসন্ধানে বের হয়ে তার কোনরূপ সন্ধান পেলো না।
এদিকে বানী ইসরাঈলদের মাঝে পিতার বাধ্য একজন নেককার লোক ছিলো। একবার তার পিতা মাথার নিচে টাকার বাক্সের চাবি রেখে ঘুমিয়ে গেলেন। ইত্যবসরে একজন মোতি বিক্রেতা এসে ছেলেটিকে বলে, আমার এই মোতিটি কি তুমি ৭০ (সত্তর) হাজার দিরহাম বা দিনার এর বিনিময়ে ক্রয় করবে? তখন পিতা মাতার বাধ্য ছেলেটি পিতাকে দেখিয়ে বললো আপনি একটু আমার পিতার জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আর তখন আমি এটা আপনার নিকট থেকে ৮০ (আঁশি) হাজার এর বিনিময়ে ক্রয় করবো। তখন অন্য একজন বললো তোমার পিতাকে ডাক দিয়ে জাগ্রত করো। এটা তোমাকে ৬০ হাজারের বিনিময়েই দিয়ে দিবো। বণিক লোকটি সর্বদা মূল্য কমাতে কমাতে ৩০ হাজারে পৌছলো। আর ছেলেটি পিতার জাগ্রত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে মূল্য বৃদ্ধি করে পরিশোধ করবে বলে অনুরোধ করতে করতে একপর্যায়ে তা এক লাখ দিবো বলে প্রতিশ্র“তি দেয়। কিন্তু বণিক লোকটি যখন আরো বাড়ারাড়ি করলো তখন ছেলেটি মহান আল্লাহর শপথ দিয়ে বললো আমি এখন আর তা কোন কিছুর বিনিময়েই ক্রয় করবো না এবং সে কিছুতেই পিতাকে জাগ্রত করতে রাযী হলো না। অবশেষে বণিক লোকটি অসন্তুষ্ট হয়ে মোতি নিয়ে ফিরে চলে যায়। ছেলেটি যে তার পিতার আরামের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে এবং তার সম্মান ও মর্যাদা বুঝেছে, এ কারণে মহান আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে এ গাভীটি দান করেন। বানী ইসরাইলের লোকেরা ওপরে বর্ণিত গুণ সম্বলিত গাভী খুঁজতে খুঁজতে পেরেশান হয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে পিতার বাধ্য এই ছেলেটির নিকট তারা পেলো। সুতরাং তারা তাকে বলে যে, তোমার এ গাভীটি অন্য একটি গাভীর বিনিময়ে আমাদের নিকট বিক্রি করে দাও। কিন্তু সে তাতে রাযী হলো না। তারা বললো তাহলে দু’টি গাভীর বিনিময়ে আমাদের নিকট বিক্রি করে দাও। কিন্তু সে তাতেও রাযী হলো না। এক পর্যায়ে তারা বৃদ্ধি করে বলতে বলতে ১০টি পর্যন্ত বললো তবুও ছেলেটি রাযী হলো না। তারা বললো আমরা এটা তোমার থেকে না নিয়ে ছাড়বো না। অতঃপর তারা ছেলেটিকে নিয়ে মূসা (আঃ)-এর নিকট গেলো এবং অভিযোগ করলো যে, হে মহান আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমরা উক্ত গুণের অধিকারী গাভীটি এই ছেলের নিকট পেয়েছি কিন্তু অনেক মূল্য বলা সত্ত্বেও সে দিতে রাযী হচ্ছে না। তখন মূসা (আঃ) বললেন, হে ছেলে তোমার গাভীটি তাদেরকে দিয়ে দাও। তখন ছেলেটি বললো হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার সম্পদের ব্যাপারে আমিই বেশি হকদার। মূসা (আঃ) বললেন, তুমি সত্যিই বলেছো। এরপর তিনি কাওমের লোকদেরকে বললেন তোমরা তোমাদের এই সাথীকে যে কোন মূল্যে রাযী করাও। প্রয়োজনে গাভীর ওযন পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে দাও। তাতেও সে সম্মত না হওয়ায় বৃদ্ধি করতে করতে এক পর্যায়ে দশ গুণ পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে তা ক্রয় করে। অতঃপর গাভীটি যবেহ করা হয় এবং এর গোশত খণ্ড দিয়ে নিহত ব্যক্তির শরীরে আঘাত করা হয়। তখন মহান আল্লাহর হুকুমে সে জীবিত হয়ে উঠে। আর তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তোমাকে হত্যা করেছিলো কে? সে উত্তরে বলে আমার এই ভ্রাতুস্পুত্র আমার সম্পদ অধিকারের জন্য ও আমার মেয়েকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে আমাকে হত্যা করেছিলো এটুকু বলার পরই সে পুনরায় মরে যায়। এখন হত্যাকারীকে চেনা যায় এবং এ হত্যার ফলে বানী ইসরাইলের মধ্যে ঝগড়া বিবাদের যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিলো তা প্রশমিত হয়। অতঃপর জনগণ মৃত ব্যক্তির ভ্রাতুস্পুত্রকে ধরে কিসাস স্বরূপ তাকে হত্যা করে। এ গল্পটি বিভিন্ন ভাবে বর্ণিত আছে, ¯পষ্ট ভাবে জানা যাচ্ছে যে, এটা বানী ইসরাইলের সে যুগের ঘটনা। আমরা একে সত্যও বলতে পারি না এবং মিথ্যাও বলতে পারি না। মহান আল্লাহ সর্ববিষয়ে ভালো জানেন।
৬৮নং আয়াতের
قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِىَ ۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ لَّا فَارِضٌ وَلَا بِكْرٌ عَوَانٌۢ بَيْنَ ذٰلِكَ ۖ فَافْعَلُوا مَا تُؤْمَرُونَ
তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো তা কীরূপ’? মূসা বললো, ‘মহান আল্লাহ বলছেন, তা এমন এক গরু যা বৃদ্ধও নয় এবং অল্প বয়স্কও নয় বরং মধ্য বয়সী। সুতরাং যা করতে আদিষ্ট হয়েছো, তা পালন করো’।
আয়াত ৬৯
قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا لَوْنُهَا ۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ صَفْرَآءُ فَاقِعٌ لَّوْنُهَا تَسُرُّ النّٰظِرِينَ
তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো, এর রং কী’? মূসা বললো, ‘মহান আল্লাহ বলছেন, তা হলুদ বর্ণের গরু, তার রং উজ্জ্বল গাঢ়, যা দর্শকদের আনন্দ দেয়’।
আয়াত ৭০
قَالُوا ادْعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِىَ إِنَّ الْبَقَرَ تَشٰبَهَ عَلَيْنَا وَإِنَّآ إِن شَآءَ اللَّهُ لَمُهْتَدُونَ
তারা বললো, ‘আমাদের জন্য তোমার প্রতিপালককে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে বলো গরুটি কেমন? কারণ সব গরু আমাদের কাছে সমান। আর মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিশ্চয় আমরা পথের দিশা পাবো।’
সূরা আল্ বাকারাহ
আয়াত ৭১
قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌ لَّا ذَلُولٌ تُثِيرُ الْأَرْضَ وَلَا تَسْقِى الْحَرْثَ مُسَلَّمَةٌ لَّا شِيَةَ فِيهَا ۚ قَالُوا الْـٰٔنَ جِئْتَ بِالْحَقِّ ۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُوا يَفْعَلُونَ
মূসা বললেন, ‘তিনি বলেছেন, সেটা এমন এক গাভি যা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি, সুস্থ ও নিখুঁত’। তারা বলল, ‘এখন তুমি সত্য নিয়ে এসেছ’। অবশেষে তারা সেটাকে যবেহ করলো, যদিও তারা তা করতে প্রস্তুত ছিলো না।
৬৮-৭১ নং আয়াতের তাফসীর-
তাদেরকে এই নির্দেশই দেওয়া হয়েছিল যে, তারা একটি গাভী যবেহ করবে। তারা যে কোন একটি গাভী যবেহ করলেই আল্লাহর আদেশ পালন হয়ে যেত। কিন্তু তারা আল্লাহর নির্দেশের উপর সোজাসুজি আমল করার পরিবর্তে খুঁটিনাটির পিছনে পড়ে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করতে শুরু করে দিল। ফলে আল্লাহ তাআলাও তাদের সে কাজকে পর্যায়ক্রমে তাদের জন্য কঠিন করে দিলেন। আর এই জন্যই দ্বীনের (খুঁটিনাটির) ব্যাপারে গভীরভাবে অনুসন্ধান চালাতে ও কঠিনতা অবলম্বন করতে নিষেধ করা হয়েছে। (প্রকাশ যে, এই গাভী যবেহর ঘটনার উল্লেখের ফলেই এই সূরার নাম ‘বাক্বারাহ’ রাখা হয়েছে।)
গাভীর ব্যাপারে ইয়াহূদীদের একগুয়েমীর জন্য মহান আল্লাহ তাদের কাজকে কঠিন করে দেন
অত্র আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ বানী ইসরাঈলের অবাধ্যতা, দুষ্টামি ও মহান আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে তাদের খুঁটিনাটি প্রশ্নের বর্ণনা দিচ্ছেন। তাদের উচিত ছিলো হুকুম পাওয়া মাত্রই তার ওপর ‘আমল করা। কিন্তু তা না করে তারা বার বার প্রশ্ন করতে থাকে। ইবনু জুরাইজ (রহঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
“إنما أمروا بأدنى بقرة، ولكنهم لما شددوا على أنفسهم شدد الله عليهم؛ وايم الله لو أنهم لم يستثنوا ما بينت لهم آخر الأبد”
‘নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যদি তারা যে কোন গরু যবেহ করতো তাহলে তাই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তারা ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকে এবং তার ফলে কাজে কাঠিন্য বৃদ্ধি পায়। এমন কি যদি তারা ‘ইনশা’আল্লাহ’ না বলতো তাহলে কখনো এ কাঠিন্য দূর হতো না এবং এটা তাদের কাছেও প্রকাশিত হতো না।’ (হাদীসটি য‘ঈফ। সনদ মু‘যাল পর্যায়ের)
তাদের প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা হয় যে, এটা বৃদ্ধও নয় বা একেবারে কম বয়সেরও নয়, বরং মধ্যম বয়সের। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ), আবুল আলিয়া (রহঃ), সুদ্দী (রহঃ), মুজাহিদ (রহঃ), ইকরামাহ (রহঃ), ‘আতীয়া আল ‘আউফী (রহঃ), ‘আতা আল খুরাসানী (রহঃ), ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বীহ (রহঃ), যাহ্হাক (রহঃ), হাসান বাসরী (রহঃ) এবং কাতাদাহও (রহঃ) অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/২১৬) যাহ্হাক (রহঃ) বলেন যে, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, ঐ গাভীটি না ছিলো অধিক বয়স্কা, আর না অল্প বয়স্কা। বরং এটি ছিলো ঐ বয়সের যখন তা থাকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী ও কর্মক্ষম। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/২১৭)
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে এর রং বর্ণনা করা হয় যে, এটা হলদে রংয়ের সুদৃশ্য একটি গাভী। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) গাভিটির রং হলদে বলেছেন। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/২২১)
ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বীহ (রহঃ) বলেনঃ ‘এর রং এতো গাঢ় ছিলো যে, মনে হতো যেন এটা থেকে সূর্যের কিরণ উত্থিত হচ্ছে।’ (তাফসীর তাবারী ২/২০২) তাওরাতে এর রং লাল বর্ণনা করা হয়েছে। সম্ভবতঃ যিনি একে ‘আরবীতে অনুবাদ করেছেন তিনিই ভুল করেছেন। মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন। ঐ রঙের ও ঐ বয়সের বহুগাভী তাদের চোখে পড়তো বলে তারা মূসা (আঃ)-কে বলে, হে মহান আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি মহান আল্লাহকে অন্য কোন নিদর্শনের কথা জিজ্ঞেস করুন, যাতে করে আমাদের সন্দেহ কেটে যায়। ইনশা’আল্লাহ আমরা আবারো রাস্তা পেয়ে যাবো। যদি তারা ইনশা’আল্লাহ না বলতো তবে কিয়ামত পর্যন্ত তারা এ রকম গাভীর ঠিকানা পেতো না। আর যদি তারা প্রশ্নই না করতো তবে তাদের প্রতি এতো কঠোরতা অবলম্বন করা হতো না বরং যে কোন গাভী যবেহ করলেই যথেষ্ট হতো। এ বিষয়টি একটি মারফূ‘ হাদীসে আছে কিন্তু তার সনদটি গারীব। সঠিক কথা এটাই যে এটা আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এর নিজস্ব কথা। মহান আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।
গাভীর বিশেষণ
অতঃপর গাভীটির বিশেষণ বর্ণনা করা হচ্ছে এই বলে যে, তা জমি চাষাবাদ করার কাজে অথবা পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়নি। এর শরীরে কোন দাগ নেই। এটা একই রংয়ের, অন্য কোন রংয়ের মিশ্রণ মোটেই নেই। এটা সুস্থ ও সবল। এখন অনিচ্ছাকৃতভাবেই তারা এর কুরবানী দিতে এগিয়ে গেলো। এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেন যে, তারা তা যবেহ করবে বলে মনে হচ্ছিলো না। (তাফসীর তাবারী ২/২১৯) বরং যবেহ না করার জন্যই তারা তালবাহানা করছিলো। এ ছাড়া ‘উবাইদাহ (রহঃ), মুজাহিদ (রহঃ), ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বীহ (রহঃ), আবুল ‘আলিয়া (রহঃ) এবং ‘আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনু আসলাম (রহঃ) বলেনঃ ইয়াহূদীরা ঐ গাভীটিকে অনেক মূল্য দিয়ে ক্রয় করেছিলো। (তাফসীর তাবারী ২/২২১) আবার কেউ কেউ বলেন যে তারা এর মূল্য শুনিয়ে ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলো কোন কোন বর্ণনায় আছে যে তার মূল্য লেগেছিলো মোট তিনটি স্বর্ণ মুদ্রা। কিন্তু এ বর্ণনাটি এবং গাভীর ওযন পরিমাণ স্বর্ণ দেয়ার বর্ণনাটি, এ দু’টোই ইসরাঈলী বর্ণনা। সঠিক কথা এই যে তাদের নির্দেশ পালনের ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু এভাবে প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ফলে এবং হত্যার মামলার কারণে তাদেরকে এটা মানতেই হয়েছিলো। মহান আল্লাহ সব চেয়ে বেশি জানেন। এ আয়াত দ্বারা এই মাস’আলার ওপর ও দালীল নেয়া যেতে পারে যে জন্তুকে না দেখে ও ধার দেয়া জায়িয। কেননা পূর্ণভাবে এর বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাটি দেয়া হয়েছে। যেমন ইমাম মালিক (রহঃ), ইমাম আওযা‘ঈ (রহঃ), ইমাম লায়স (রহঃ), ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ), ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ) ও জমহুর ‘উলামার এটাই অভিমত। এর দালীল রূপে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত নিম্নের হাদীসটিও আনা যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কোন স্ত্রী যেন তার স্বামীর সামনে অপর কোন স্ত্রী লোকের বৈশিষ্ট্য এমন ভাবে বর্ণনা না করে যেন তাকে দেখছে। অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভুলবশত হত্যা এবং স্বেচ্ছায় অনুরূপ হত্যা দিয়তের উট সমূহের বিশেষত্ব বর্ণনা করেছেন। তবে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ), ইমাম সাওরী (রহঃ) এবং অন্যান্য কূফীগণ বা-ই সালামকে সমর্থন করে না। তারা বলেন যে জন্তুসমূহের গুণাবলী ও অবস্থা পূর্ণভাবে বর্ণনা করা ছাড়া অবস্থা আয়ত্বে আসতে পারে না। এ ধরনের বর্ণনা ইবনু মাস‘উদ (রাঃ), হুযায়ফাহ ইবনু ইয়ামান (রাঃ) এবং আবদুর রহমান (রাঃ) প্রভৃতি মনীষীগণ হতে বর্ণিত হয়েছে।
এটাও হত্যা সম্পর্কীয় সেই ঘটনাই যার কারণে বানী-ইস্রাঈলকে গাভী যবেহ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং এইভাবেই আল্লাহ সেই হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছিলেন। অথচ ঐ হত্যা রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর অন্তরালে করা হয়েছিল। অর্থাৎ, নেকী বা বদী তোমরা যতই সংগোপনে কর না কেন, তা আল্লাহর জ্ঞান বহির্ভূত নয় এবং তিনি তা প্রকাশ করার শক্তিও রাখেন। কাজেই প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সব সময় ও সর্বত্র ভাল কাজই কর, যাতে কোন সময় যদি সে কাজ প্রকাশও হয়ে যায় এবং লোক জানাজানি হয়, তাহলে তাতে যেন তোমাদেরকে লজ্জিত হতে না হয়, বরং তাতে যেন তোমাদের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি লাভ করে। আর পাপের কাজ যতই গোপনে করা হোক না কেন, তা প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং তাতে মানুষ নিন্দিত, লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হয়ে থাকে।
সূরা আল-বাকারাহ
আয়াত ৭২
وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْسًا فَادّٰرَءْتُمْ فِيهَا ۖ وَاللَّهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ
স্মরণ করো! তোমরা যখন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে এবং একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করছিলে, তোমরা যা গোপন করছিলে মহান আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিলেন।
৭২ নং আয়াতের তাফসীর
নিহত ব্যক্তিকে পুনরায় জীবন দান
সহীহুল বুখারীতে اَلدَّارَءَتُمْ-এর অর্থ হয়েছে ‘তোমরা মতভেদ করলে।’ (ফাতহুল বারী ৬/৫০৬) মুজাহিদ (রহঃ) ‘আতা আল খুরাসানী (রহঃ) এবং যাহ্হাক (রহঃ) প্রভৃতি মনীষীগণ হতেও এটাই বর্ণিত আছে। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/২২৯) মুসীব ইবনু রাফি‘ (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি সাতটি ঘরের মধ্যে লুকিয়েও কোন কাজ করে, মহান আল্লাহ তার সাওয়াব প্রকাশ করে দিবেন। এ রকমই যদি কোন লোক সাতটি ঘরের মধ্যে ঢুকেও কোন খারাপ কাজ করে, মহান আল্লাহ ওটাও প্রকাশ করে দিবেন। অতঃপর ﴿وَاللّٰهُ مُخْرِجٌ مَّا كُنْتُمْ تَكْتُمُوْنَ﴾ এই আয়াতটি পাঠ করেন। এখানে ঐ চাচা ভাতিজারাই ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে, যে কারণে গরু যবেহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। বলা হচ্ছে যে, ওর কোন অংশ নিয়ে মৃত ব্যক্তির দেহে আঘাত করো, যদি বলা হয় যে ঐ অংশটি কোন অংশ ছিলো তাহলে বলা হবে যে, এর বর্ণনা না কুর’আন মাজীদে আছে, আর না কোন সহীহ হাদীসে আছে। এটা জানায় না কোন উপকার আছে, আর না জানায় কোন ক্ষতি আছে। যে জিনিসের কোন বর্ণনা নেই তার পিছনে না লেগে থাকার মধ্যেই শান্তি ও নিরাপত্তা রয়েছে। অতএব আমাদের মঙ্গল তাতেই রয়েছে যে, মহান আল্লাহ যা গুপ্ত রেখেছেন আমরাও যেন তা গুপ্ত রাখি।
ইবনু আবী হাতিম (রহঃ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে একটি সূত্র উল্লেখ করে বলেন যে, বানী ইসরাইলের লোকেরা চল্লিশ বছর যাবৎ অনুসন্ধানের পর একজন লোকের গরুও পালের মধ্যে তারা দেখতে পায়। যা তাদেরকে অবাক করে দেয়। তিনি বলেন, তারা একের পর এক তার বিনিময় নির্ধারণ করতে থাকলো কিন্তু গাভীর মালিক দিতে সম্মত না হওয়ায় এক পর্যায়ে তারা গাভীর চামড়াকে থলে বানিয়ে সেই থলে ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার শর্তে বিক্রি করে। অতঃপর তারা তা যবেহ করে কোন একটি হাড় দ্বারা নিহত ব্যক্তিকে আঘাত করতেই তার শীরাগুলো দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। তারপর জীবিত হলে তারা তাকে জিজ্ঞেস করলো কে তোমাকে হত্যা করেছে? উত্তরে সে বললো আমাকে অমুক হত্যা করেছে। (অত্র হাদীসের সনদে আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু যিয়াদ নামক একজন য‘ঈফ রাবী আছে। তাই হাদীসটি য‘ঈফ)
হাড়টির পরিচয়
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে হাড় দ্বারা তারা নিহত ব্যক্তিকে আঘাত করেছিলো তা ছিলো গাযরূবের হাড়। আর ইবনু সীরীন ‘উবায়দাহ (রাঃ)-এর সূত্রে বলেন যে, তা হাড় ছিলো না বরং কিছু গোশত ছিলো। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন তারা গোশতের টুকরা দ্বারা লাশের রানে আঘাত করার ফলে তা জীবিত হয়ে বলেছিলো যে আমাকে অমুক ব্যক্তি হত্যা করেছে। ইকরামাহ (রহঃ) বলেন তারা গাভীর রান দ্বারা আঘাত করলে তা উঠে দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে যে আমাকে অমুক হত্যা করেছে। কেউ বলেছেন তার জিহবা দ্বারা আঘাত করা হয়েছিলো। কেউ বলেছেন তার লেজের হাড় দ্বারা আঘাত করেছিলো।
মৃতকে জীবিত করার আরো কিছু প্রমাণসমূহ যা কিয়ামতের পর পুনরুত্থানের প্রতিই প্রমাণ বহণ করে
হাড়টি যে অংশেরই হোক না কেন তা দ্বারা স্পর্শ করা মাত্রই সে জীবিত হয়ে ওঠে এবং মহান আল্লাহ সেই ঝগড়ার ফায়সালা এর দ্বারাই সমাধান করেন। আর কিয়ামতের দিন মৃতরা যে জীবিত হয়ে উঠবে তার দালীলও এতেই বর্ণনা করেন। এ সূরার মধ্যে পাঁচ জায়গায় মৃত্যুর পর জীবিত হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। প্রথম হচ্ছে নিন্মের আয়াতটি ﴿ ثُمَّ بَعَثْنٰكُمْ مِّنْۢ بَعْدِ مَوْتِكُمْ﴾ (২ নং সূরাহ্ বাকারাহ, আয়াত নং ৫৬) দ্বিতীয় আলোচ্য ঘটনায়, তৃতীয় ঐ লোকদের যারা হাজার সংখ্যায় বের হয়েছিলো এবং একটি বিধ্বস্ত পল্লী তারা অতিক্রম করেছিলো। চতুর্থ ইব্রাহীম (আঃ)-এর চারটি পাখিকে মেরে ফেলার পর জীবিত হওয়ার মধ্যে এবং পঞ্চম হচ্ছে যমীনের মরে যাওয়ার পর বৃষ্টির সাহায্যে পুনর্জীবন দান করাকে মরণ ও জীবনের সাথে তুলনা করার মধ্যে।
আবূ দাঊদ তায়ালিসী (রহঃ)-এর একটি হাদীসে আছে যে, আবূ রাজীন আকিলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কিভাবে মহান আল্লাহ মৃতকে জীবিত করবেন?’ তিনি বলেনঃ
أما مررت بواد ممحل، ثم مررت به خضرا؟
‘তুমি কোন দিন বৃক্ষলতাহীন প্রান্তরের মধ্য দিয়ে চলেছো কি?’ তিনি বলেনঃ ‘হ্যাঁ।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘আবার কখনো ওকে সবুজ ও সতেজ দেখেছো কি?’ তিনি বলেনঃ ‘হ্যাঁ’। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ كذلك النشور‘এভাবেই মৃত্যুর পর জীবন লাভ ঘটবে। আর এ কথার পক্ষে প্রমাণ বহণ করে মহান আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীঃ
﴿وَاٰیَةٌ لَّهُمُ الْاَرْضُ الْمَیْتَةُ١ۖۚ اَحْیَیْنٰهَا وَ اَخْرَجْنَا مِنْهَا حَبًّا فَمِنْهُ یَاْكُلُوْنَ۳۳ وَ جَعَلْنَا فِیْهَا جَنّٰتٍ مِّنْ نَّخِیْلٍ وَّ اَعْنَابٍ وَّ فَجَّرْنَا فِیْهَا مِنَ الْعُیُوْنِۙ۳۴ لِیَاْكُلُوْا مِنْ ثَمَرِهٖ١ۙ وَ مَا عَمِلَتْهُ اَیْدِیْهِمْ١ؕ اَفَلَا یَشْكُرُوْنَ﴾
তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত ধরিত্রী, যাকে আমি সঞ্জীবিত করি এবং যা হতে উৎপন্ন করি শস্য, যা তারা আহার করে। তাতে আমি সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের উদ্যান এবং উৎসারিত করি প্রস্রবন, যাতে তারা আহার করতে পারে এর ফলমূল হতে, অথচ তাদের হস্ত এটা সৃষ্টি করেনি। তবুও কি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না? (৩৬ নং সূরাহ্ ইয়াসীন, আয়াত নং ৩৩-৩৫)
একটি মাস’আলাঃ কোন আহত ব্যক্তি যদি বলে যে, অমুক ব্যক্তি আমাকে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে হত্যা করেছে তবে তার একথাকে সত্য মনে করা হবে এ জিজ্ঞাস্য বিষয়ের ওপর এ আয়াত দ্বারা দালীল গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মাযহাবকে এর দ্বারা মযবূত করা হয়েছে। কেননা নিহত লোকটি জীবিত হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করায় সে যাকে তার হত্যা কারী বলে তাকে হত্যা করা হয় এবং নিহত ব্যক্তির কথাকেই বিশ্বাস করা হয় এটা ¯পষ্ট কথা যে মানুষ মুমূর্ষু অবস্থায় সাধারণত সত্য বলে থাকে এবং সে সময় তার ওপর কোন অপরাধ দেয়া হয় না।
আর এ কথাকে আনাস (রাঃ) এর হাদীসও প্রধান্য দেয় তথা সুদৃঢ় করে। যেমন তিনি বলেন যে এক ইয়াহূদী একজন দাসীর মাথা পাথরের ওপরে রেখে অন্য পাথর দ্বারা ভীষণ ভাবে প্রহার করে এবং তার অলংকার খুলে নেয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এ সংবাদ পৌঁছালে তিনি বলেনঃ ঐ দাসীকে জিজ্ঞেস করো যে তাকে কে মেরেছে? ফলে লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করে যে তোমাকে অমুক মেরেছে? অমুক মেরেছে? সে তার মাথার ইশারায় অস্বীকার করতে থাকে। অবশেষে প্রহারকারী ইয়াহূদীর নাম নেয়া হলে সে মাথার ইশারায় হ্যাঁ বোধক সম্মতি জানায়। সুতরাং ইয়াহূদীকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে বারবার জিজ্ঞেস করায় সে স্বীকার করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দেন যে, তার মাথাকেও এভাবেই দু’টি পাথরের মধ্য স্থলে রেখে দলিত করা হোক। ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মতে এটা উত্তেজনার কারণে হলে নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণকে শপথ করাতে হবে। কিন্তু জামহূরগণ এর বিরোধী এবং একজন মাত্র নিহত ব্যক্তির কথাকে এ ক্ষেত্রে দালীলরূপে গ্রহণ করে না।
৭৩ নং আয়াতের
فَقُلْنَا اضْرِبُوهُ بِبَعْضِهَا ۚ كَذٰلِكَ يُحْىِ اللَّهُ الْمَوْتٰى وَيُرِيكُمْ ءَايٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
আমি বললাম, ‘তার অর্থাৎ যবেহকৃত গরুর কোন অংশ দ্বারা একে আঘাত করো’। এভাবে মহান আল্লাহ মৃতকে জীবন দান করেন। আর তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শন দেখিয়ে থাকেন, যাতে তোমরা জ্ঞানলাভ করতে পারো।
৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:
শানকীতী বলেন, এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, বনী ইসরাইলের মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে সক্ষম হওয়ার অর্থই জন্মের পরে পুনরুত্থানের প্রমাণ সাব্যস্ত হওয়া। কেননা, যিনি একজনকে মৃত্যুর পরে জীবিত করতে সমর্থ, তিনি অবশ্যই সমস্ত জীবকে মৃত্যুর পর জীবিত করতে সক্ষম। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “তোমাদের সবার সৃষ্টি ও পুনরুত্থান একটি প্রাণীর সৃষ্টি ও পুনরুত্থানেরই অনুরূপ ” [সূরা লুকমান: ২৮]
উক্ত মৃত ব্যক্তিকে জীবিত ক’রে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন মানুষকে পুনরায় জীবিত করার স্বীয় ক্ষমতার প্রমাণ পেশ করছেন। কিয়ামতের দিন মৃতদেরকে পুনর্জীবিত করার ব্যাপারটা কিয়ামত অস্বীকারকারীদের নিকট সব সময় বিস্ময় ও আশ্চর্যের কারণ হয়ে রয়েছে। আর এই জন্যই মহান আল্লাহ এই বিষয়টাকে ক্বুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। সূরা বাক্বারাতেই মহান আল্লাহ এর পাঁচটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। প্রথম দৃষ্টান্ত {ثُمَّ بَعَثْنَاكُمْ مِنْ بَعْدِ مَوْتِكُمْ} ২:৫৬ নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত এই ঘটনা। তৃতীয় দৃষ্টান্ত দ্বিতীয় পারায় {مُوتُوا ثُمَّ أَحْيَاهُمْ} ২:২৪৩ নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। চতুর্থ দৃষ্টান্ত {فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِائَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ} ২:২৫৯ নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। আর পঞ্চম দৃষ্টান্ত এর পরের আয়াতে (২:২৬০) ইবরাহীম (আঃ)-এর চারটি পাখী সংক্রান্ত ব্যাপারে উল্লিখিত হয়েছে।
এ আয়াতে বানী ইসরাঈলকে লক্ষ করে বলা হচ্ছে যে, তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার এ নেয়ামতকে ভুলে না যায়, তিনি এমন এক স্বভাব বিরুদ্ধ ঘটনা ঘটালেন যার ফলে গরুর এক টুকরা গোশতের দ্বারা মৃত ব্যক্তির শরীরে আঘাত করায় সে জীবিত হয়ে যায় এবং সে তার হত্যাকারীর নাম বলে দেয়। ফলে একটি বড় বিবাদের নিস্পত্তি ঘটে। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
উল্লেখ্য যে, এ ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সতর্ক করলেন যে, “এরূপে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং স্বীয় নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করেন যাতে তোমরা হৃদয়ঙ্গম কর।”
সুতরাং আমাদের সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কর্ম আল্লাহ তা‘আলা জানেন ও দেখেন। তাঁকেই ভয় করে আমাদের সকল অপকর্ম বর্জন করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান দেন তা মাথা পেতে নেয়া অবশ্য কর্তব্য, আর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া হারাম।
২. শরয়ী বিধান পাওয়ার পর অহেতুক প্রশ্ন করা নিষেধ, এতে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হয়।
৩. ইনশা-আল্লাহ বলার উপকার জানলাম। যেমন শেষবারে ইয়াহূদী ইনশা-আল্লাহ না বললে হয়তো আদিষ্ট গরু খুঁজে পেত না।
৪. আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের উক্ত ব্যক্তিকে যেমন মৃত্যুর পর জীবিত করেছেন আমাদেরকেও তেমন মৃত্যুর পর জীবিত করবেন।