أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١١٤)-৩১৬
www.motaher21.net
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لَا تَأْكُلُوٓا أَمْوٰلَكُم بَيْنَكُم بِالْبٰطِلِ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না,
O you who believe! Eat not up your property among yourselves unjustly.
সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-২৯-৩০
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِّنْكُمْ وَ لَا تَقْتُلُوْۤا اَنْفُسَكُمْؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ بِكُمْ رَحِیْمًا
হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলো না। লেনদেন হতে হবে পারস্পরিক রেজামন্দির ভিত্তিতে। আর নিজেকে হত্যা করো না। নিশ্চিত জানো, আল্লাহ তোমাদের প্রতি মেহেরবান।
(৩০)
وَمَن يَفْعَلْ ذٰلِكَ عُدْوٰنًا وَظُلْمًا فَسَوْفَ نُصْلِيهِ نَارًا ۚ وَكَانَ ذٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا
যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন ক’রে অন্যায়ভাবে এটা করবে, তাকে আমি অতিসত্বর অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
আল্লাহ তা’আলা তার ঈমানদার বান্দাদেরকে একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতে নিষেধ করছেন। সে উপার্জনের দ্বারাই হোক যা শরীয়তে হারাম, যেমন-সুদ খাওয়া, জুয়া খেলা বা এরকমই প্রত্যেক প্রকারের কৌশলের দ্বারাই হোক, যদিও এটাকে শরীয়তে বৈধ রাখা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার আল্লাহ তাআলা খুব ভালই জানেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হচ্ছে, একটি লোক কাপড় ক্রয় করছে এবং বলছে, আমার যদি পছন্দ হয় তবে রেখে দেব, নচেৎ কাপড় এবং একটি দিরহাম ফিরিয়ে দেব’। এর হুকুম কি? হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আয়াতটি পাঠ করেন। অর্থাৎ তাকে অন্যায়ভাবে মাল ভক্ষণকারীর অন্তর্ভুক্ত করেন। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি ‘মুহাকাম’ অর্থাৎ রহিত নয়। এটা কিয়ামত পর্যন্ত রহিত হতে পারে না। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন মুসলমানগণ একে অপরের মাল ভক্ষণ করা পরিত্যাগ করেন। যার ফলে (আরবী) (৪৮:১৭) আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তিজারাতান শব্দটিকে তিজারাতুনও পড়া হয়েছে। এটি (আরবী) যেমন বলা হচ্ছে-‘অবৈধতাযুক্ত কারণসমূহ দ্বারা মাল জমা করো না। কিন্তু শরীয়তের পন্থায় ব্যবসা দ্বারা লাভ করা বৈধ, যা ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্মতিক্রমে হয়ে থাকে। যেমন অন্য জায়গায় বলা হয়েছে-‘কোন নিস্পাপ প্রাণকে মেরো না। তবে হকের সঙ্গে হলে জায়েয আছে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছে-‘তথায় তারা প্রথম মৃত্যু ছাড়া আর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে না।
হযরত ইমাম শাফিঈ (রঃ) এ আয়াত হতে দলীল গ্রহণ করে বলেন, সম্মতি ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হয় না। কেননা, এটাই হচ্ছে সম্মতির পূর্ণ সনদ। শুধুমাত্র আদান-প্রদান কখনও সম্মতির উপর দলীল হতে পারে না।’ জমহুর এর বিপরীত মতপোষণ করেন। অন্যান্য তিনজন ইমামের উক্তি এই যে, মৌখিক কথা বার্তা যেমন সম্মতির প্রমাণ, দ্রুপ আদান-প্রদানও সম্মতির দলীল। কোন কোন মনীষী বলেন যে, কম মূল্যবান সাধারণ জিনিসে শুধু লেন-দেনই যথেষ্ট এবং এরকমই ব্যবসার সে নিয়ম থাকে। সহীহ মাযহাবে তো সতর্কতামূলক দৃষ্টিতে কথা বার্তায় স্বীকৃতি থাকা অন্য কথা। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ক্রয়-বিক্রয় হোক বা দান হোক, সব কিছুর মধ্যেই এ হুকুম রয়েছে। তাফসীর-ই-ইবনে জারীর (রঃ)-এর একটি মার’ হাদীসে রয়েছেঃ ব্যবসা হচ্ছে সম্মতি এবং ব্যবসার পরেই ইখতিয়ার রয়েছে। কোন মুসলমানের অন্য মুসলমানকে প্রতারিত করা বৈধ নয়।’ এ হাদীসটি ‘মুরসাল’। মজলিসের শেষ পর্যন্তও পূর্ণ সম্মতির অধিকার রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়েরই পৃথক না হওয়া পর্যন্ত ইখতিয়ার রয়েছে। এ হাদীস অনুসারেই ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম শাফিঈ (রঃ) এবং তার সহচরদের ফতওয়া রয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জমহুরেরও ফতওয়া এর উপরে ভিত্তি করেই। এ পূর্ণ সম্মতির মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের তিন দিন পরে ইখতিয়ার দেয়াও জড়িত রয়েছে যদিও সে ইখতিয়ার পূর্ণ এক বছরের জন্যেও হয়, যেমন গ্রামবাসী প্রভৃতি লোকদের মধ্যে রয়েছে।
ইমাম মালিক (রঃ)-এর প্রসিদ্ধ মাযহাব এটাই, যদিও তাঁর মতে শুধুমাত্র আদান-প্রদান দ্বারাই ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হয়ে থাকে। শাফিঈ মাযহাবেরও একটা উক্তি এটাই এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে, মানুষ ব্যবসায়ের জন্যে যে অল্প মূল্যের সাধারণ জিনিস রেখে থাকে তাতে শুধুমাত্র আদান-প্রদানই যথেষ্ট হবে। আসহাবের কারও কারও ইখতিয়ার এটাই, যেমন মুত্তাফাকুন আলাইহি।
এরপর বলা হচ্ছে-‘আল্লাহ তা’আলার হারাম কাজগুলো করে অবাধ্য হয়ে, আর অন্যায়ভাবে একে অপরের মাল ভক্ষণ করে তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করো না। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর অত্যন্ত দয়ালু। তাঁর প্রত্যেক আদেশ ও নিষেধ দয়ায় পরিপূর্ণ।
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আমর ইবনে আল আস (রাঃ)-কে ‘যাতুস্সালাসিলের’ যুদ্ধের বছরে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি বলেন, একদা কঠিন শীতের রাত্রে আমার স্বপ্নদোষ হয়, এমনকি গোসল করাতে আমি আমার জীবনের উপর ভয় করি। সুতরাং আমি তায়াম্মুম করে নিয়ে আমার জামাআতকে ফজরের নামায পড়িয়ে দেই। অতঃপর ফিরে এসে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হই। তাঁর নিকট আমি আমার এ ঘটনাটি বর্ণনা করি।
তিনি বলেনঃ তুমি কি তাহলে অপবিত্র অবস্থায় তোমার সঙ্গীদেরকে নামায পড়িয়েছ?’ আমি বলি, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কঠিন ঠাণ্ডা ছিল এবং আমার প্রাণের ভয় ছিল। অতঃপর আমার মনে পড়ে গেল যে, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন-“তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংস করো না।’ একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেসে উঠেন এবং আমাকে কিছুই বলেননি।
অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, লোকেরাই ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট বর্ণনা করেছিলেন এবং তিনি জিজ্ঞেস করায় হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) এ ওর পেশ করেছিলেন।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি কোন লোহা দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে কিয়ামত পর্যন্ত জাহান্নামের মধ্যে লোহা দ্বারা আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি জেনে-শুনে জীবন দেয়ার উদ্দেশ্যে বিষপান করবে, সে সদা-সর্বদার জন্যে জাহান্নামে বিষপান করতে থাকবে।’
আর একটি বর্ণনায় রয়েছেঃ ‘যে নিজেকে যে জিনিস দ্বারা হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সে জিনিস দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘোষণায় রয়েছেঃ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে একটি লোক আহত হয়। সে ছুরি দিয়ে স্বীয় হাত কেটে দেয়। রক্ত বন্ধ হয় না এবং তাতেই সে মারা যায়। তখন আল্লাহ পাক বলেন-“আমার বান্দা নিজেকে ধ্বংস করার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করেছে, সুতরাং আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি।’
এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেন-“যে কেউ অত্যাচার ও সীমা অতিক্রম করে একাজ করবে, অর্থাৎ হারাম জেনেও স্বীয় বীরত্বপণা দেখিয়ে ঐ কাজ করবে, সে জাহান্নামী হবে। সুতরাং প্রত্যেকেরই এ কঠিন ভীতি প্রদর্শন ব্যাপারে ভয় করা উচিত। অন্তরের পর্দা খুলে আল্লাহ তা’আলার এ নির্দেশ শ্রবণ করতঃ হারাম কাজ হতে (মানুষের) বিরত থাকা উচিত।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
“অন্যায়ভাবে” বলতে এখানে এমন সব পদ্ধতির কথা বুঝানো হয়েছে যা সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী এবং নৈতিক দিক দিয়েও শরীয়াতের দৃষ্টিতে নাজায়েয। “লেনদেন” মানে হচ্ছে, পরস্পরের মধ্যে স্বার্থ ও মুনাফার বিনিময় করা। যেমন ব্যবসায়, শিল্প ও কারিগরী ইত্যাদি ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সেখানে একজন অন্যজনের প্রয়োজন সরবরাহ করার জন্য পরিশ্রম করে এবং তার বিনিময় দান করে। পারস্পরিক রেজামন্দি অর্থ হচ্ছে, কোন বৈধ চাপ বা ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে লেনদেন হবে না। ঘুষ ও সুদের মধ্যে আপাত রেজামন্দি থাকে কিন্তু আসলে এই রেজামন্দির পেছনে থাকে অক্ষমতা। প্রতিপক্ষ নিজের অক্ষমতার কারণে বাধ্য ও অন্যন্যোপায় হয়ে চাপের মুখে ঘুষ ও সুদ দিতে রাজী হয়। জুয়ার মধ্যেও বাহ্যিক দৃষ্টিতে রেজামন্দিই মনে হয়। কিন্তু আসলে জুয়াতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি একমাত্র সে-ই বিজয়ী হবে এই ভ্রান্ত আশায় এতে অংশগ্রহণে রাজি হয়। পরাজয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ এতে অংশগ্রহণ করে না। প্রতারণা ও জালিয়াতির কারবারেও বাহ্যত রেজামন্দিই দেখা যায়। কিন্তু এখানেই রেজামন্দির পেছনে এই ভুল ধারণা কাজ করে যে, এর মধ্যে প্রতারনা ও জালিয়াতী নেই। দ্বিতীয় পক্ষ যদি জানতে পারে যে, প্রথম পক্ষ তার সাথে প্রতারণা ও জালিয়াতী করছে তাহলে সে কখনো এতে রাজি হবে না।
এ বাক্যটি আগের বাক্যের পরিশিষ্ট হতে পারে আবার একটি স্বতন্ত্র বাক্যও হতে পারে। একে যদি আগের বাক্যের পরিশিষ্ট মনে করা হয় তাহলে এর অর্থ হয়, অন্যের অর্থ-সম্পদ অবৈধ ভাবে আত্মসাত করা আসলে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করার নামান্তর। এর ফলে সমাজ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। এর অনিষ্টকর পরিণতি থেকে হারামখোর ব্যক্তি নিজেও রক্ষা পেতে পারে না এবং আখেরাতে এর কারণে মানুষ কঠিন শাস্তির অধিকারী হয়। আর যদি একে একটি স্বতন্ত্র বাক্য মনে করা হয় তাহলে এর দু’টি অর্থ হয়। এক, পরস্পরকে হত্যা করো না। দুই, আত্মহত্যা করো না। মহান আল্লাহ এক্ষেত্রে এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বাক্য এমনভাবে গঠন করেছেন যার ফলে এই তিনটি অর্থই এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে এবং তিনটি অর্থই সত্য।
অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের শুভাকাংখী। তিনি তোমাদের ভালো চান। তিনি তোমাদের এমন কাজ করতে নিষেধ করছেন যার মধ্যে তোমাদের নিজেদের ধ্বংস নিহিত রয়েছে। এটা তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ ও করুনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, পরস্পরের মধ্যে অন্যায় পন্থায় একের সম্পদ অন্যের পক্ষে ভোগ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে আরও বুঝা যায় যে, নিজস্ব সম্পদও অন্যায় পথে ব্যয় করা কিংবা অপব্যয় করা নিষিদ্ধ।
[২] আয়াতে উল্লেখিত ‘বাতিল’ শব্দটির তরজমা করা হয়েছে ‘অন্যায়ভাবে’। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য সাহাবীগণের মতে শরী’আতের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ এবং নাজায়েয সবগুলো পস্থাকেই বাতিল বলা হয়। যেমন, চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, বিশ্বাসভঙ্গ, ঘুষ, সুদ, জুয়া প্রভৃতি সকল প্রকার অন্যায় পন্থাই এ শব্দের অন্তর্ভুক্ত। [বাহরে মুহীত]
[৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিক্রির জন্য সন্তুষ্টি অপরিহার্য। [ইবন মাজাহঃ ২১৮৫] এ সন্তুষ্টি সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেচাকেনার ক্ষেত্রে আরও কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যেমন, “বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ে সওদা করার স্থান ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত (সওদা বাতিল করার) সুযোগের অধিকারী থাকবে। তবে- পৃথক হওয়ার পরও এ সুযোগ তাদের জন্য থাকবে-যারা খেয়ার বা সুযোগের অধিকার দেয়ার শর্তে সওদা করবে”। [বুখারী: ২১০৭]
[৪] এর দ্বারা বলে দেয়া হয়েছে যে, যেসব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পস্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ পন্থার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং হারাম ও বাতিল পন্থা। তেমনি যদি স্বাভাবিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও লেনদেনের মধ্যে উভয় পক্ষের আন্তরিক সন্তুষ্টি না থাকে, তবে সেরূপ ক্রয়-বিক্রয়ও বাতিল ও হারাম। কাতাদা বলেন, ব্যবসা আল্লাহর রিযক ও আল্লাহর হালালকৃত বিষয়, তবে শর্ত হচ্ছে, এটাকে সত্যবাদিতা ও সততার সাথে পরিচালনা করতে হবে। [তাবারী]
[৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে বলে যে, আমি অন্য কোন ধর্মের উপর। তাহলে সে ঐ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বনী আদম যার মালিক নয় এমন মানত গ্রহণযোগ্য নয়। যে কেউ দুনিয়াতে নিজেকে কোন কিছু দিয়ে হত্যা করবে, এটা দিয়েই তাকে কেয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে। যে কোন মুমিনকে লা’নত করল সে যেন তাকে হত্যা করল। অনুরূপভাবে যে কেউ কোন মুমিনকে কুফরীর অপবাদ দিল, সেও যেন তাকে হত্যা করল। [বুখারীঃ ৬০৪৭, মুসলিমঃ ১৭৬]
অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কেউ পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে চিরস্থায়ীভাবে পাহাড় থেকে পড়ার অনুরূপ শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে, সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে বিষ পানের আযাব ভোগ করতে থাকবে। আর যে কেউ কোন ধারাল কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে তা দ্বারা শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। [বুখারীঃ ৫৭৭৮, মুসলিমঃ ১৭৫]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] بِالْبَاطِلِ (অন্যায়ভাবে)এর মধ্যে ধোঁকা-প্রতারণা এবং জাল-জুয়াচুরি, ছল-চাতুরী ও ভেজাল মিশ্রিত করা সহ এমন সব ব্যবসা ও অর্থ উপার্জনের পদ্ধতিও শামিল, যা শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ। যেমন, জুয়া, সুদ ইত্যাদি। অনুরূপ নিষিদ্ধ হারাম জিনিসের ব্যবসা করাও অন্যায়ভাবে পরের মাল ভক্ষণ করার শামিল। যেমন, বিনা প্রয়োজনের ছবি তোলা, গান-বাজনা বা ফিল্ম তথা অশ্লীল ছবির ক্যাসেট, সিডি বা তার প্লেয়ার যন্ত্র ইত্যাদি তৈরী করা, বিক্রি করা এবং মেরামত করা সব কিছুই নাজায়েয।
[২] এর জন্যও শর্ত হল, এই আদান-প্রদান হালাল জিনিসের হতে হবে। হারাম জিনিসের ব্যবসা আপোসে সম্মতিক্রমে হলেও তা হারাম হবে। তাছাড়া আপোসের সম্মতিতে ‘খিয়ারে মজলিস’-এর বিষয়ও এসে যায়। অর্থাৎ, যতক্ষণ তারা একে অপর থেকে পৃথক না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় বানচাল করার অধিকার থাকবে। যেমন হাদীসে এসেছে, ((البَيْعَانِ بِالْخِيَارِ مَالَمْ يَتَفَرَّقاَ)) “ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ততক্ষণ পর্যন্ত (ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে) এখতিয়ার থাকে, যতক্ষণ না তারা একে অপর থেকে পৃথক হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
[৩] এর অর্থ আত্মহত্যাও হতে পারে, যা মহাপাপ। আর পাপ করাও হতে পারে, কেননা তাও ধ্বংসের কারণ হয়। আবার কোন মুসলিমকে হত্যা করাও হতে পারে। কারণ, সকল মুসলিম একটি দেহের মত। কাজেই কোন মুসলিমকে হত্যা করা মানেই নিজেকে হত্যা করা।
[৪] অর্থাৎ, জেনে-শুনে সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ কাজ করবে।
২৯ ও ৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদেরকে অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ গ্রাস করতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের দিন বলেন,
فَإِنْ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هٰذَا
(রাঃ) তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান আজকের দিনের মত হারাম। (সহীহ বুখারী হা: ৬৬৬৭) অর্থাৎ আজকের দিন যেমন রক্তপাত করা, যুদ্ধবিগ্রহ করা হারাম তেমনি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, অন্যের সম্পদ খাওয়া ও সম্মানহানি করা হারাম।
এ অন্যায়ে সকল অন্যায় শামিল। যেমন চুরি, ডাকাতি ছিনতাই, সুদ ইত্যাদি।
তবে একে অপরের সম্পদ খেতে পারবে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে। শর্ত হল ক্রয়-বিক্রয় উভয়ের সন্তুষ্টিতে হালাল বস্তুতে হালাল পন্থায় হতে হবে।
তাই সকল হারাম বস্তু- যেমন বিড়ি, সিগারেট, নেশাজাতিয় দ্রব্য ও পণ্য এবং গানের সিডি, অশ্লীল ছবি ছাড়াও আরো যত হারাম বস্তু ও হারাম বস্তুর মাধ্যম রয়েছে সেগুলোকে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা, সেগুলো উৎপাদন করা, সরবরাহ করা এবং সেসব কাজে সহযোগিতা করা ও চাকুরী করা হারাম।
কেননা এগুলোতে নিজের কায়িক শ্রম হালাল থাকলেও মূল বস্তু হারাম। তাই ব্যবসায় হতে হবে হালাল বস্তুতে এবং হালাল পন্থায় এবং উভয়ের সন্তুষ্টিতে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা অন্যায়ভাবে নিজেদেরকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تُلْقُوْا بِأَيْدِيْكُمْ إِلَي التَّهْلُكَةِ)
“এবং নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে প্রসারিত কর না”(সূরা বাকারাহ ২:১৯৫) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
(وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَيْءٍ فِي الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ)
দুনিয়াতে যে ব্যক্তি নিজেকে যে জিনিস দ্বারা হত্যা করবে কিয়ামাতের দিন তাকে সে জিনিস দ্বারা শাস্তি প্রদান করা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬০৪৮)
সুতরাং ইসলাম মানবাধিকারের সর্ববিধ বিধান নিশ্চিত করেছে। মুসলিম জাতি যদি ইসলামকে সঠিকভাবে মেনে চলে তাহলে অন্য কোন মানবাধিক সংস্থার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে না। ইসলামই তাদের জন্য যথেষ্ট।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের সম্পদ খাওয়া হারাম।
২. হালাল বস্তু ও পণ্যের ব্যবসায়-বাণিজ্য বৈধ।
৩. কোন মুসলিম ব্যক্তিকে বা নিজেকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হারাম।
৪. জান, মাল, সম্পদ ও সম্মান সকল অধিকার ইসলাম যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেছে।