(Book# 114/١٢٣)-৩২৫ www.motaher21.net يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لَا تَقْرَبُوا…. হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিকটবর্তী হয়ো না…… O you who believe! don’t be to near….. সুরা: আন-নিসা আয়াত নং :-৪৩

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/١٢٣)-৩২৫
www.motaher21.net

يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لَا تَقْرَبُوا….

হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিকটবর্তী হয়ো না……
O you who believe! don’t be to near…..
সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-৪৩

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَقْرَبُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْتُمْ سُكٰرٰى حَتّٰى تَعْلَمُوْا مَا تَقُوْلُوْنَ وَ لَا جُنُبًا اِلَّا عَابِرِیْ سَبِیْلٍ حَتّٰى تَغْتَسِلُوْاؕ وَ اِنْ كُنْتُمْ مَّرْضٰۤى اَوْ عَلٰى سَفَرٍ اَوْ جَآءَ اَحَدٌ مِّنْكُمْ مِّنَ الْغَآئِطِ اَوْ لٰمَسْتُمُ النِّسَآءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَآءً فَتَیَمَّمُوْا صَعِیْدًا طَیِّبًا فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَ اَیْدِیْكُمْؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُوْرًا

হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের কাছে যেয়ো না। নামায সেই সময় পড়া উচিত যখন তোমরা যা বলছো তা জানতে পারো। অনুরূপভাবে অপবিত্র অবস্থায়ও গোসল না করা পর্যন্ত নামাযের কাছে যেয়ো না। তবে যদি পথ অতিক্রমকারী হও, তাহলে অবশ্যি স্বতন্ত্র কথা। আর যদি কখনো তোমরা অসুস্থ হয়ে পড়ো, সফরে থাকো বা তোমাদের কেউ মলমূত্র ত্যাগ করে আসে অথবা তোমরা নারী সম্ভোগ করে থাকো এবং এরপর পানি না পাও, তাহলে পাক–পবিত্র মাটির সাহায্য গ্রহণ করো এবং তা নিজেদের চেহারা ও হাতের ওপর বুলাও। নিঃসন্দেহে আল্লাহ‌ কোমলতা অবলম্বনকারী ও ক্ষমাশীল।

An-Nisa’ ৪:৪৩

৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-

আল্লাহ তাআলা স্বীয় ঈমানদার বান্দাদেরকে নেশার অবস্থায় নামায পড়তে নিষেধ করছেন। কেননা, সে সময় নামাযী নিজেই বুঝতে পারে না যে, সে কি বলছে? সঙ্গে সঙ্গে নামাযের স্থানে অর্থাৎ মসজিদে আসতে তাকেও নিষেধ করছেন এবং অবগাহনের পূর্বে অপবিত্র লোককেও নিষধ করছেন। হ্যাঁ, তবে এরূপ ব্যক্তি কোন কার্য বশতঃ যদি মসজিদের একটি দরজা দিয়ে গিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ফিরে আসে এবং তথায় অবস্থান না করে তবে এ যাতায়াত বৈধ।

নেশার অবস্থায় নামাযের নিকটে না যাওয়ার নির্দেশ মদ্য হারাম হওয়ার পূর্বে ছিল। যেমনঃ সূরা-ই-বাকারার (আরবী) (২:২১৯)-এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হাদীসে প্রকাশিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন এ আয়াতটি হযরত উমার (রাঃ)-এর সামনে পাঠ করেন তখন হযরত উমার (রাঃ) প্রার্থনা করেন-“হে আল্লাহ! মদ্য সম্বন্ধে আরও পরিষ্কারভাবে আয়াত অবতীর্ণ করুন।’ তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ নেশার অবস্থায় নামাযের নিটকবতী না হওয়ার আয়াতটি নাযিল হয়। এরপরে লোকেরা নামাযের সময় মদ্যপান পরিত্যাগ করে। এটা শুনে হযরত উমার (রাঃ) পুনরায় এ প্রার্থনাই করেন। তখন (আরবী) (৫:৯০-৯১) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। যার মধ্যে মদ্য হতে দূরে থাকার পরিষ্কার নির্দেশ বিদ্যমান রয়েছে। এটা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমরা বিরত থাকলাম।’ এ বর্ণনার একটি সনদে রয়েছে যে, যখন সূরা-ইনিসার এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং নেশার অবস্থায় নামায পড়তে নিষেধ করা হয় তখন প্রথা ছিল, যখন নামায আরম্ভ করা হতো তখন একটি লোক উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করতো-মাতাল ব্যক্তি যেন নামাযের নিকটবর্তী না হয়।

সুনান-ই-ইবনে মাজায় রয়েছে, হযরত সাদ (রাঃ) বলেন, “আমার ব্যাপারে চারটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। একজন আনসারী খাদ্য রান্না করতঃ বহু লোককে দাওয়াত দেন। আমরা ভোজনে পরিতৃপ্ত হই। অতঃপর আমরা মদ্যপান করে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। এরপরে আমরা পরস্পরের গৌরব প্রকাশ করতে থাকি। একটি লোক উটের চোয়ালের অস্থি উঠিয়ে হযরত সাদ (রাঃ)-কে মেরে দেয়, যার ফলে তাঁর নাক আহত হয় এবং ওর চিহ্ন থেকে যায়। সে সময় পর্যন্ত মদ্য হারাম হয়নি। অতঃপর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।’ এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমেও পূর্ণভাবে বর্ণিত হয়েছে।

মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) জনগণকে জিয়াফত করেন। জনগণ আহারের পর মদ্যপান করেন এবং জ্ঞানশূন্য হয়ে যান। এমন সময় নামাযের ওয়াক্ত এসে যায়। একজনকে ইমাম করা হয়। তিনি পাঠ করেনঃ (আরবী) সে সময় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং মত্ততাবস্থায় নামায পড়তে নিষেধ করা হয়। এ হাদীসটি জামেউত্ তিরমিযীর মধ্যেও রয়েছে এবং এটা হাসান। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত আলী (রাঃ), হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) এবং তৃতীয় একজন সাহাবী মদ্যপান করেন। হযরত আবদুর রহমান (রাঃ)-কে ইমাম বানান হয়। কুরআন কারীমের সূরা তিনি বিশৃংখলভাবে পাঠ করেন। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। সুনান-ই-আবি দাউদ এবং সুনান-ই-নাসাঈর মধ্যেও এ বর্ণনাটি রয়েছে।

তাফসীর-ই-ইবনে জারীরেও আর একটি বর্ণনা রয়েছে যে, হযরত আলী (রাঃ) ইমাম হন এবং যেভাবে পড়তে চেয়েছিলেন সেভাবে পড়তে পারেননি। তখন আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) ইমাম হয়েছিলেন এবং তিনি নিম্নরূপ পাঠ করেছিলেনঃ (আরবী) তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং ঐ অবস্থায় নামায পড়া হারাম ঘোষণা করা হয়।

হযরত ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, মদ্যের অবৈধতার পূর্বে মানুষ মাতাল অবস্থায় নামাযে দাড়িয়ে যেতেন। সুতরাং এ আয়াত দ্বারা তাদেরকে এরূপ করতে নিষেধ করে দেয়া হয়।’ (তাফসীর-ই-ইবনে জারীর) হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর তোক এ কাজ হতে বিরত থাকে।

অতঃপর সম্পূর্ণরূপে মদ্যের অবৈধতা ঘোষিত হয়। হযরত যহহাক (রঃ) বলেন যে, এখানে ভাবার্থ মদ্যের মত্ততা নয় বরং ভাবর্থ হচ্ছে দ্রিালুতা। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এখানে মদ্যের মত্ততা ভাবার্থ হওয়াই সঠিক কথা এবং এখানে নেশায় উন্মত্ত লোকদেরই সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এতটা নয় যে, শরীয়তের আহকাম তাদের উপর জারী হতেই পারে না। কেননা, নেশায় এরূপ মত্ততাবিশিষ্ট ব্যক্তিকে পাগলেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উসূল’ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ মনীষীদের উক্তি এই যে, সম্বোধন দ্বারা ঐ লোকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয় যারা কথা বুঝতে পারে। এমন উন্মত্ত ব্যক্তিদেরকে সম্বোধন করা যেতে পারে না যারা কিছুই বুঝে না যে, তাদেরকে কি বলা হচ্ছে। কেননা, সম্বোধন অনুধাবন করার শর্ত হচ্ছে তাকলীফের।

এও বলা হয়েছে যে, যদিও শব্দ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে-‘তোমরা মাতাল অবস্থায় নামায পড়ো না, কিন্তু ভাবার্থ হচ্ছে-তোমরা নেশার জিনিস পানাহারও করো না। কেননা, এটা কিরূপে সম্ভব যে, একজন মদ্যপায়ী পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিক সময়ে আদায় করতে পারে অথচ সে বরাবর মদ্য পান করতেই থাকে? এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলার রয়েছে। তাহলে এ নির্দেশও ঠিক ঐ নির্দেশরই মত যেখানে বলা হয়েছে- “হে মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যতটা ভয়ের তাঁর হক রয়েছে এবং তোমরা মুসলমান না হয়ে মরো না। এখানে ভাবার্থ এই যে, তোমারা সদা-সর্বদা এরূপ প্রস্তুতি গ্রহণ কর এবং এমন সৎ কার্যাবলী সব সময় সম্পাদন করতে থাক যে, যখন তোমরা মরণ বরণ করবে তখন যেন তোমাদের মৃত্যু ইসলামের উপরেই হয়।

তদ্রুপ এ আয়াতে যে নির্দেশ হচ্ছে- যে পর্যন্ত না তোমরা বুঝতে পার যে, তোমরা কি বলছ, এটা হচ্ছে নেশার সীমারেখা। অর্থাৎ নেশার অবস্থায় ঐ ব্যক্তিকে বুঝতে হবে যে নিজের কথাই বুঝতে পারে না। নেশায় উন্মত্ত ব্যক্তি কুরআন কারীম বিশৃংখলভাবে পাঠ করে থাকে। তার বুঝবার এবং চিন্তা গবেষণা করবার সুযোগ হয় না। সে নামাযে বিনয়ও প্রকাশ করতে পারে না।

মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ নামায পড়া অবস্থায় তোমাদের কারও তন্দ্রা এলে সে যেন ফিরে আসে এবং ঘুমিয়ে পড়ে যে পর্যন্ত না সে বুঝতে পারে যে সে কি বলছে।’ সহীহ বুখারী ও সুনান-ই-নাসাঈর মধ্যেও এ হাদীসটি রয়েছে। হাদীসের কতক শব্দ এও রয়েছেঃ ‘সে চায় ক্ষমা প্রার্থনা করতে কিন্তু হয়তো তার মুখ দিয়ে বিপরীত কথা বেরিয়ে যাবে।’ এবারে বলা হচ্ছে-‘অপবিত্র ব্যক্তিও যেন গোসল করার পূর্বে নামাযের নিকটবর্তী না হয়। হ্যাঁ, তবে অতিক্রম করা হিসেবে মসজিদের ভেতর দিয়ে গমন করা জায়েয। হযরত ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন যে, এরূপ অপবিত্র অবস্থায় মসজিদের ভেতরে যাওয়া জায়েয নয়। তবে মসজিদের একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় কোন দোষ নেই। মসজিদে বসতে পারবে না। আরও বহু সাহাবী ও তাবেঈর এটাই উক্তি।

হযরত ইয়াযীদ ইবনে আবু হাবীব বলেন যে,”কতগুলো আনসার যারা মসজিদের চতুর্দিকে বাস করতেন তাঁরা অপবিত্র হলে বাড়ীতে হয়তো পানি থাকতো না, আর তাদের ঘরের দরজা মসজিদের সাথে সংযুক্ত থাকতো, তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয় যে, তাঁরা ঐ অবস্থাতেই মসজিদ দিয়ে গমন করতে পারেন।

সহীহ বুখারী শরীফে তো একথা স্পষ্টভাবে রয়েছে যে, লোকদের ঘরের দরজা মসজিদেই ছিল। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় মরণ রোগের সময় বলেনঃ ‘মসজিদে যেসব লোকের দরজা রয়েছে সবগুলো বন্ধ করে দাও। শুধুমাত্র হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর দরজাটি রেখে দাও।’ এর দ্বারা এটাও জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তিকালের পর তার স্থলাভিষিক্ত হযরত আবু বকরই (রাঃ) হবেন এবং তার প্রায় সব সময় মসজিদে যাতায়াতের প্রয়োজন হবে যেন তিনি মুসমানদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ মীমাংসা করতে পারেন। এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) সমস্ত দরজা বন্ধ করে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর দরজা খুলে রাখতে নির্দেশ দেন। সুনানের কোন কোন হাদীসে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর পরিবর্তে হযরত আলী (রাঃ)-এর নাম রয়েছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল। সঠিক ওটাই যা সহীহতে রয়েছে।

এ আয়াত দ্বারা অধিকাংশ ইমাম দলীল গ্রহণ করেছেন যে, অপবিত্র লোকের মসজিদে অবস্থান নিষিদ্ধ। তবে গমন করা বৈধ। হায়ে্যু ও নিফাস্ বিশিষ্ট নারীদেরও এ হুকুম। কিন্তু কেউ কেউ বলেন যে, এরূপ নারীদের জন্যে মসজিদ দিয়ে গমনও বৈধ নয়। কেননা, এতে মসজিদে অপবিত্রতা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার অন্য কেউ বলেন যে, যদি এ ভয় না থাকে তবে তাদের গমনও বৈধ।

সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে বলেনঃ ‘আমাকে মসজিদ হতে মাদুরটি এনে দাও। তিনি তখন বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি হায়েযের অবস্থায় রয়েছি।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ হায়েয তো তোমার হাতে নেই।’ এর দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, ঋতুবতী নারী মসজিদে যাতায়াত করতে পারে। নিফাস বিশিষ্টা নারীরও এ হুকুম। এরা রাস্তায় চলা হিসেবে যাতায়াত করতে পারে।

সুনান-ই-আবু দাউদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘোষণা রয়েছেঃ আমি ঋতুবতী নারী ও অপবিত্র লোকদের জন্যে মসজিদকে হালাল করি না। ইমাম আবু মুসলিম খাত্তাবী (রঃ) বলেন, এ হাদীসটিকে একটি দল দুর্বল বলেছেন। কেননা, এর একজন বর্ণনাকারী আফলাত ইবনে খালীফাতুল আমেরী অপরিচিত। কিন্তু সুনান-ই-ইবনে মাজার মধ্যে এ বর্ণনাটি রয়েছে। তাতে আফলাতের স্থলে মা’দূম যিহূলী রয়েছে। প্রথম হাদীসটি হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে এবং এ দ্বিতীয় হাদীসটি হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। কিন্তু সঠিক নাম হযরত আয়েশারই (রাঃ) বটে।

জামেউত্ তিরযিমীর মধ্যে অন্য একটি হাদীস হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে আলী! এ মসজিদে অপবিত্র হওয়া তোমার ও আমার ছাড়া আর কারও জন্যে হালাল নয়। এ হাদীসটি সম্পূর্ণই দুর্বল এবং এটা কখনই সাব্যস্ত হতে পারে না। এতে সালিম নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যে পরিত্যাজ্য এবং তার শিক্ষক আতিয়্যাও দুর্বল। এ বিষয়ে আল্লাহ পাকই ভাল জানেন।

এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ভাবার্থ এই যে, অপবিত্র ব্যক্তি এ অবস্থায় গোসল না করে নামায পড়তে পারে না, কিন্তু যদি সফরে থাকে এবং পানি না পায় তবে পানি না পাওয়া পর্যন্ত পড়তে পারে।’ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (রঃ) এবং হযরত যহাক (রঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত হাসান বসরী (রঃ) হযরত যায়েদ (রঃ) এবং হযরত আবদুর রহমান (রঃ) হতেও এ রকমই বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন, “আমরা শুনতাম যে, এ হাদীসটি সফরের হুকুমে অবতীর্ণ হয়েছে।’ এ হাদীস দ্বারাও এ মাসআলার সাক্ষ্য হতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “পবিত্র মাটি হচ্ছে মুসলমানকে পবিত্রকারী যদিও দশ বছর পর্যন্ত পানি পাওয়া না যায়। যখন পানি পাওয়া যাবে তখন ওটাই ব্যবহার করবে, এটাই তোমার জন্যে উত্তম।’ (সুনান ও মুসনাদ-ই-আহমাদ)

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এ দু’টি উক্তির মধ্যে উত্তম হচ্ছে ঐ লোকদের উক্তি যারা বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে অতিক্রম করা হিসেবে মসজিদে গমন করা। কেননা, যে মুসাফির অপবিত্র অবস্থায় পানি পাবে না তার হুকুমতো পরে পরিষ্কারভাবে রয়েছে। সুতরং এখানেও যদি এ ভাবার্থই হয় তবে পরে আবার একে অন্য বাক্যে ফেরানোর কোন আবশ্যকতা থাকে না।

অতএব আয়াতের অর্থ এখন এই হলো যে, হে মুমিনগণ! তোমরা মাতাল অবস্থায় মসিজদে যেওনা যে পর্যন্ত তোমরা নিজেদের কথা নিজেরাই বুঝতে না পার। অনুরূপভাবে অপবিত্র অবস্থাতেও তোমরা মসজিদে যেওনা যে পর্যন্ত অবগাহন না কর। তবে রাস্তা অতিক্রম করা হিসেবে যাওয়া বৈধ। শব্দের অর্থ হচ্ছে আসা-যাওয়া অর্থাৎ অতিক্রম করা। এর। বা এসে থাকে। যখন কেউ নদী অতিক্রম করে তখন আরববাসীরা বলে, (আরবী) অর্থাৎ ‘অমুক নদী অতিক্রম করেছে।

অনুরূপভাবে যে শক্তিশালী উট সফরে পথ অতিক্রম করে তাকেও তারা বলে, (আরবী) অর্থাৎ উট ভ্ৰমণ পথ অতিক্রম করেছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) যে উক্তিটির পৃষ্ঠপোষকতা করেন, জমহুরেরও ঐ উক্তি। আর আয়াত দ্বারা বাহ্যতঃ এটাই প্রকাশ পাচ্ছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সে অসম্পূর্ণ অবস্থায় নামায পড়তে নিষেধ করছেন যা নামাযের উদ্দেশ্যের বিপরীত। অনুরূপভাবে নামাযের স্থানে এমন অবস্থায় আসতে বাধা দিচ্ছেন যা সে স্থানের শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার উল্টো। এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলার জ্ঞান ভাল রয়েছে।

তারপর যে আল্লাহ পাক বলেন-‘যে পর্যন্ত তোমরা গোসল না কর। এটা দলীল হচ্ছে ইমাম আবু হানিফা (রঃ), ইমাম মালিক (রঃ) এবং ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর যে, অপবিত্র ব্যক্তির মসজিদে অবস্থান নিষিদ্ধ, যে পর্যন্ত সে গোসল না করবে বা যদি পানি না পায় কিংবা পানি পায় কিন্তু তা ব্যবহারের ক্ষমতা না থাকে তবে তায়াম্মুম করে নেবে।

ইমাম আহমাদ (রঃ) বলেন যে, অপবিত্র ব্যক্তি যখন নামায পড়ে নেবে তখন তার জন্যে মসজিদে অবস্থান বৈধ। যেমন মুসনাদ-ই-আহমাদ এবং সুনান-ই-সাঈদ মানসূরে বর্ণিত আছে। হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীগণকে দেখেছি যে, তারা অপবিত্র হতেন এবং অযু করে মসজিদে বসে থাকতেন।’ এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এখন কোন কোন সময় তায়াম্মুম করা জায়েয তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। যে রোগের কারণে তায়াম্মুম জায়েয হয় ওটা হচ্ছে ঐ রোগ যে ঐ সময় পানি ব্যবহার করলে কোন অঙ্গ নষ্ট হওয়ার বা রোগের সময় বেড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। কোন কোন আলেম প্রত্যক রোগের জন্য তায়াম্মুমের অনুমতির ফতওয়া দিয়েছেন। কেননা আয়াত সাধারণ।

হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, একজন আনসারী রুগ্ন ছিলেন। না তিনি দাঁড়িয়ে অযু করতে পারেন, না তার কোন সেবক ছিলো যে তাঁকে পানি দেয়। তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এটা বর্ণনা করেন। সে সময় এ হুকুম অবতীর্ণ হয়। এ বর্ণনাটি মুরসাল।

তায়াম্মুমের বৈধতার দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে সফর। সে সফর দীর্ঘই হোক বা ক্ষুদ্র হোক। (আরবী) বলা হয় নরম ভূমিকে। এখানে ওর দ্বারা পায়খানাকে বুঝান হয়েছে। লা-মাসতুম শব্দের দ্বিতীয় পঠন হচ্ছে লামাসতুম। এর তাফসীরে দুটি উক্তি রয়েছে। একটি এই যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে সঙ্গম। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছে- (আরবী) অর্থাৎ যদি তোমরা সঙ্গমের পূর্বে স্ত্রীদেরকে তালাক প্রদান কর এবং তাদের মোহর নির্দিষ্ট কর তবে যা নির্দষ্ট করেছে তারা তার অর্ধেক পাবে।’ (২:২৩৭) অন্য আয়াতে রয়েছে- “হে মুমিনগণ! যখন তোমরা নারীদেরকে বিয়ে কর অতঃপর সঙ্গমের পূর্বে তালাক প্রদান কর তখন তাদের জন্যে ইদ্দত’ নেই। এখানেও (আরবী) রয়েছে। হযরত ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে (আরবী) (৫:৬)-এর ভাবার্থ সঙ্গম। হযরত আলী (রাঃ), হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত তাউস (রঃ), হযরত হাসান বসরী (রঃ), হযরত উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রাঃ), হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (রঃ), হযরত শা’বী (রঃ), হযরত কাতাদা (রঃ) হযরত মুকাতিল ইবনে হিব্বান (রঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে।

হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (রঃ) বলেন, একবার এ শব্দের উপর আলোচনা হলে কতগুলো মাওয়ালী বলেন যে, এটা সঙ্গম নয় এবং কতগুলো আরব বলেন যে, এটা সঙ্গম। আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট এটা বর্ণনা করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন-তুমি কাদের সঙ্গে ছিলে? আমি বলি- ‘আমি মাওয়ালীদের সঙ্গে ছিলাম। তিনি বলেন, মাওয়ালীগণ পরাজিত হয়েছে। (আরবী) এবং (আরবী) অর্থ হচ্ছে সঙ্গম। আল্লাহ তা’আলা এখানে কিনায়া করেছেন। অন্যান্য কয়েকজন মনীষী এর ভাবার্থ সাধারণ স্পর্শ করা নিয়েছেন।

নিজের শরীরের কোন অংশ স্ত্রীর শরীরের কোন অংশের সাথে মিলিয়ে নিলেই অযু ওয়াজিব হয়ে যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, ‘সঙ্গম ছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশ স্পর্শ করাকে (আরবী) বলা হয়। তিনি বলেন যে, চুম্বনও (আরবী)-এরই অন্তর্ভুক্ত এবং ওতেও অযু করা অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সঙ্গম করায়, হাত দ্বারা স্পর্শ করায় এবং চুম্বন করায় অযু করতে হয়।’ (আরবী)-এর ভাবার্থ স্পর্শ করা।

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) চুম্বন দেয়াতে অযু ফরয হওয়ার উক্তিকারী ছিলেন এবং ওটাকেও (আরবী)-এর অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন। হযরত উবাইদাহ (রাঃ), হযরত আবু উসমান (রাঃ), হযরত সাবিতা (রাঃ), হযরত ইবরাহীম (রাঃ) এবং হযরত যায়েদও (রাঃ) বলেন যে, (আরবী)-এর ভাবার্থ হচ্ছে সঙ্গম ছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশ স্পর্শ করা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘মানুষের স্বীয় স্ত্রীকে চুম্বন দেয়া এবং হাত দ্বারা স্পর্শ করা হচ্ছে (আরবী) এতে অযু ফরয হয়ে যাবে। (মুআত্তা-ই-মালিক)

দারেকুতনীর হাদীসের মধ্যে স্বয়ং হযরত উমার (রাঃ) হতেও এ রকমই বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় বর্ণনা এর বিপরীতও পাওয়া যায় যে, তিনি অযুর অবস্থায় ছিলেন এবং স্বীয় স্ত্রীকে চুম্বন দেন, অতঃপর অযু করেননি, ঐ অবস্থাতেই নামায আদায় করেন। সুতরাং এ দু’টি বর্ণনাকে সঠিক মেনে নেয়ার পর এ ফায়সালা করতেই হবে যে, তিনি অযুকে মুস্তাহাব মনে করতেন। আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

সাধারণ স্পর্শতেই অযু করতে হবে এ উক্তি হচ্ছে শাফিঈ (রঃ) এবং তাঁর সহচরের। ইমাম মালিক ও প্রসিদ্ধ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) হতেও এ উক্তিই বর্ণিত আছে। যারা এ উক্তি করেন তাঁরা বলেন যে, এখানে দু’টি কিরআত রয়েছে। একটি হচ্ছে লা-মাসতুম এবং অপরটি হচ্ছে লামাসতুম। আর কুরআন কারীমের মধ্যে হাত দ্বারা স্পর্শ করার উপরও শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে- (আরবী) (৬:৭) এটা স্পষ্টকথা যে, এখানে ভাবার্থ হচ্ছে হাত দ্বারা স্পর্শ করা। অনুরূপভাবে হযরত মায়েয ইবনে মালিক (রাঃ)-কে রাসূল (সঃ) বলেছিলেনঃ সম্ভবতঃ তুমি চুম্বন দিয়ে বা হাত দ্বারা স্পর্শ করে থাকবে। সেখানেও (আরবী) শব্দ রয়েছে এবং শুধু হাত লাগানোর অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

অন্য হাদীসে রয়েছে (আরবী) অর্থাৎ হাতের ব্যভিচার হচ্ছে হাত দ্বারা স্পর্শ করা।’ হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, এরূপ খুব কম দিনই অতিবাহিত হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট এসে আমাদেরকে চুম্বন দেননি বা হাত দ্বারা স্পর্শ করেননি।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবী) হতে নিষেধ করেছেন। এখানেও এর অর্থ হচ্ছে হাত দ্বারা স্পর্শ করার ক্রয়-বিক্রয়। অতএব হাদীসটিকে যেমন সঙ্গমের উপর প্রয়োগ করা হয় দ্রুপ হাত দ্বারা স্পর্শ করার উপরও প্রয়োগ করা হয়। কবি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ আমার হাত তার হাতের সাথে মিলিত হয়েছে, আমি ধন চাই।’

ইবনে আবি লাইলা হযরত মুআয (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐ লোকটির ব্যাপারে মীমাংসা কী হতে পারে যে একটি অপরিচিতা নারীর সঙ্গে শুধু ব্যভিচার ছাড়া ঐ সমস্ত কাজ করেছে যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে। তখন- (আরবী) (১১:১১৪) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। বর্ণনাকারী বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন লোকটিকে বলেন, অযু কর ও নামায আদায় কর। হযরত মুআয (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা কি একমাত্র তার জন্যে নির্দিষ্ট, না সমস্ত মুসলমানের জন্য সাধারণ? তিনি উত্তর দেনঃ “বরং এটা সমস্ত মুসলমানের জন্যে সাধারণ। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে যায়েদার হাদীস থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, এর সনদ সংযুক্ত নয়। ইমাম নাসাঈ (রঃ) হতে মুরসাল রূপে বর্ণনা করেন। মোটকথা, এটার উক্তিকারী এ হাদীসটি সম্বন্ধে বলেন, লোকটিকে অযু করার নির্দেশ দেয়ার কারণ এই যে, সে স্ত্রীলোকটিকে স্পর্শ করেছিল মাত্র সঙ্গম করেনি। এর উত্তর এই দেয়া যায় যে, প্রথমতঃ এটা মুনকাতা। ইবনে আবি লাইলা ও হযরত মু’আযের মধ্যে সাক্ষাত প্রমাণিত নয় ।

দ্বিতীয়তঃ হতে পারে যে, তাকে ফরয নামায আদায়ের জন্যে অযু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যেমন হযরত আবু বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যে বান্দা কোন পাপ করার পর অযু করে দু’ রাকআত নামায আদায় করে, আল্লাহ তা’আলা তার পাপ মার্জনা করে থাকেন। এ হাদীসটি পূর্ণভাবে সূরা আলে ইমরানের (আরবী) (৩:১৩৫)-এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন, এ উক্তি দুটির মধ্যে উত্তম হচ্ছে ঐ লোকদের উক্তি যারা বলেন যে, (আরবী)-এর ভাবার্থ হচ্ছে সঙ্গম, অন্য কিছু নয়। কেননা, সহীহ মারফু হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার কোন পত্নীকে চুম্বন দেন এবং অযু না করেই নামায আদায় করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) অযু করতেন, অতঃপর চুম্বন দিতেন এবং পরে অযু না করেই নামায আদায় করতেন।

হযরত হাবীব (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর কোন সহধর্মিণীকে চুম্বন করতেন, অতঃপর নামাযে যেতেন এবং অযু করতেন না। আমি বলি, সে স্ত্রী আপনিই হতেন। তখন তিনি মুচকি হেসে উঠেন। এর সনদে সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সনদে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, উপরের বর্ণনাকারী অর্থাৎ হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে শ্রবণকারী হচ্ছেন হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর (রাঃ)।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে- ‘অযুর পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে চুম্বন করতেন এবং পুনরায় অযু করতেন না। অন্য সনদে বর্ণিত আছে যে, তিনি চুম্বন করেন এবং পরে অযু না করেই নামায আদায় করেন।

হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) চুম্বন করতেন অথচ তিনি রোযার অবস্থায় থাকতেন এবং তাতে তার রোযাও নষ্ট হতো না ও তিনি নতুনভাবে অযুও করতেন না’। (তাফসীর-ই-ইবনে জারীর) হযরত যায়নাব সাহমিয়া’ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) চুম্বন দেয়ার পর অযু না করেই নামায আদায় করতেন।

এরপর আল্লাহ পাক বলেন-“যদি পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর।’ এর দ্বারা অধিকাংশ ধর্মশাস্ত্রবিদ দলীল গ্রহণ করেছেন যে, পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করার অনুমতি রয়েছে পানি অনুসন্ধানের পর। কুতুবে ফুরু’র মধ্যে অনুসন্ধানের অবস্থাও বর্ণনা করা হয়েছে।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে দেখেন যে, সে লোকদের সাথে নামায না পড়ে পৃথক হয়ে রয়েছে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘জনগণের সাথে তুমি নামায পড়লে না কেন? তুমি কি মুসলমান নও? লোকটি বলে, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি মুসলমান তো বটে, কিন্তু আমি অপবিত্র হয়ে গেছি এবং পানি পাইনি।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ঐ অবস্থায় তোমার জন্যে মাটি যথেষ্ট ছিল। (আরবী) শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ইচ্ছে করা।

আরবেরা বলে- (আরবী) অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা স্বীয় হিফাযতের সঙ্গে তোমার প্রতি ইচ্ছে পোষণ করুন। ইমরুল কায়েসের নিম্নের কবিতায়ও (আরবী) শব্দটি এ অর্থেই এসেছেঃ (আরবী) শব্দের অর্থ হচ্ছে ঐ জিনিস যা ভূপৃষ্ঠের উপর চড়ে গেছে। সুতরাং মাটি, বালু, গাছ প্রভৃতিও এর অন্তর্ভুক্ত।

বলা হয়েছে যে, যে জিনিস মাটির শ্রেণীভুক্ত, যেমন বালু, ইট এবং চুন ইত্যাদি। এটা ইমাম আবু হানীফা (রঃ)-এর মাযহাব। আবার শুধু মাটিকেও বলা হয়েছে এবং এটা হচ্ছে ইমাম শাফিঈ (রঃ) ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এবং তাঁদের সহচরদের উক্তি। এর প্রথম দলীল তো কুরআন কারীমের এ শব্দগুলো (আরবী) অর্থাৎ সুতরাং ওটা পিচ্ছিল মাটি হয়ে যাবে।’ (১৮:৪০) দ্বিতীয় দলীল হচ্ছে সহীহ মুসলিমের নিম্নে হাদীসটিঃ

হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাদেরকে সমস্ত মানুষের উপর তিনটি মর্যাদা দেয়া হয়েছে (১) আমাদের সারিগুলো ফেরেশতাদের সারির মত করা হয়েছে (২) আমাদের জন্যে সমস্ত ভূমিকে মসজিদ করা হয়েছে এবং (৩) ভূপৃষ্ঠের মৃত্তিকাকে আমাদের জন্যে পবিত্র ও পবিত্রকারী বানানো হয়েছে যখন আমরা পানি না পাই।

হাদীসের শব্দগুলোর মধ্যে (আরবী) শব্দ রয়েছে এবং অন্য সনদে (আরবী)-এর স্থলে (আরবী) শব্দ বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এ হাদীসে কৃপা প্রকাশের সময় মাটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যদি অন্য কোন জিনিস অযুর স্থলবর্তী হতো তবে সাথে সাথে ওরও উল্লেখ করতেন। এখানে (আরবী) শব্দটির অর্থের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, ওর ভাবার্থ হচ্ছে হালাল এবং কারও কারও মতে ওর ভাবার্থ হচ্ছে পবিত্র।

যেমন হাদীস শরীফ রয়েছে, হররত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “পবিত্র মাটি হচ্ছে মুসলমানদের অযু, যদিও দশ বছর পর্যন্ত পানি পাওয়া না যায়। অতঃপর যখন পানি পাওয়া যাবে তখন সে যেন তা তার শরীরে বুলিয়ে দেয়। এটাই তার জন্যে উত্তম।’ ইমাম তিরমিযী (রঃ) একে হাসান সহীহ বলেছেন। হাফিয আবুল হাসান কাত্তানও (রঃ) একে বিশুদ্ধ বলেছেন। সবচেয়ে পবিত্র মাটি হচ্ছে ক্ষেত্র ভূমির মাটি। এমন কি তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে একে মার’ রূপে আনা হয়েছে। এরপর বলা হচ্ছে-‘ঐ মাটি স্বীয় মুখমণ্ডলে ও হাতে ঘর্ষণ কর।’ তায়াম্মুম হচ্ছে অযুর স্থলবর্তী। এটা শুধুমাত্র পবিত্রতা লাভের জন্যে সমস্ত শরীরে ঘর্ষণের জন্যে নয়। সুতরাং শুধু মুখে ও হাতে ঘর্ষণ করলেই যথেষ্ট হবে। এর উপর ইজমা হয়েছে। কিন্তু তায়াম্মুম করার নিয়মে মতবিরোধ রয়েছে।

নতুন শাফিঈ মাযহাব এই যে, দু’বার করে মুখ এবং দু’খানা হাত কনুই পর্যন্ত মাসাহ্ করা ওয়াজিব। কেননা, (আরবী)-এর প্রয়োগ কাদের নিম্নাংশ পর্যন্ত ও হাতের কনুই পর্যন্ত এর উপর হয়ে থাকে। যেমন অযুর আয়াতে রয়েছে। আর এ শব্দেরই প্রয়োগ হয়ে থাকে এবং ভাবার্থ শুধু হস্তদ্বয়ের তালু হয়ে থাকে। যেমন চোরের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন- (আরবী) (৫৩৮) এখানে তায়াম্মুমের হুকুমে হাতের বর্ণনা হচ্ছে সাধারণ এবং অযুর হুকুমে হচ্ছে শর্তযুক্ত। এজন্যেই মুতলাক’-কে ‘মুকাইয়াদ’ -এর হুকুমে উঠান হবে। কেননা, অযুর মধ্যে ব্যাপক পবিত্রতা বিদ্যমান রয়েছে। কেউ কেউ এর দলীলরূপে দারেকুতনী (রঃ)-এর বর্ণনাকে গ্রহণ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘তায়াম্মুত হচ্ছে দু’বার (হাত) মারা। একবার হাত মেরে মুখের উপর ঘর্ষণ করা এবং আর একবার হাত মেরে দু হাতকে কনুই পর্যন্ত ঘর্ষণ করা। কিন্তু হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়। কেননা, এর ইসনাদে দুর্বলতা রয়েছে। হাদীসটি প্রমাণিত নয়।

সুনান-ই-আবূ দাউদের একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় হস্ত একটি দেয়ালের উপর মারেন এবং মুখমণ্ডলে ঘর্ষণ করেন, দ্বিতীয়বার হাত মেরে স্বীয় হস্তদ্বয়ের উপর ঘর্ষণ করেন। কিন্তু এর ইসনাদে মুহাম্মাদ ইবনে সাবিত আবদী দুর্বল। কোন কোন হাফি-ই-হাদীস তাকে দুর্বল বলেছেন। এ হাদীসটিই কোন কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তারা মারফু করেন না, বরং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-এর কাজ বলে থাকেন। ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম আবু যারআ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে আ’দীর (রঃ) সিদ্ধান্ত এই যে, এ হাদীসটি মাওকুফই বটে। ইমাম বায়হাকী (রঃ) বলেন যে, এ হাদীসকে মার’ বলা মুনকার।

নিম্নের হাদীসটিও ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর দলীল। হযরত ইবনুস্ সাম্মা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তায়াম্মুম করেন এবং স্বীয় মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয়ের উপর হাত ফিরিয়ে দেন। হযরত আবূ জাহাম (রাঃ) বলেন, “আমি দেখি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রস্রাব করছেন। আমি তাঁকে সালাম দেই কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন না। তিনি দেয়ালের নিকট গিয়ে তার উভয় হস্তদ্বয় মারেন এবং হস্তদ্বয় কনুই পর্যন্ত ঘর্ষণ করেন। অতঃপর তিনি আমার সালামের উত্তর দেন।’ (তাফসীর-ই-ইবনে জারীর) এতো ছিল ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর নতুন মাযহাব। তার প্রাচীন মাযহাব এই যে, তায়াম্মুমে মার তো দু’টোই, কিন্তু দ্বিতীয় মারে হাতকে কজি পর্যন্ত ঘর্ষণ করতে হবে।

তৃতীয় উক্তি এই যে, শুধু একটি বার মার অর্থাৎ শুধু একবার হস্তদ্বয় মাটির উপর মেরে নেয়াই যথেষ্ট। ধূলিযুক্ত হাতকে মুখের উপর এবং হস্তদ্বয়ের কজি পর্যন্ত ফিরিয়ে নেবে।

মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, একটি লোক আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ফারূক (রাঃ)-এর নিকট আগমন করে বলে-“আমি অপবিত্র হয়ে গেছি এবং পানি পাইনি। আমাকে কি করতে হবে?’ তিনি বলেন, ‘নামায পড়তে হবে না। তাঁর দরবারে হযরত আম্মারও (রাঃ) বিদ্যমান ছিলেন। তিনি বলেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার কি স্মরণ নেই যে, আমরা এক সেনাদলে ছিলাম। আমি ও আপনি দু’জন অপবিত্র হয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের নিকট পানি ছিল না। আপনি তো নামায পড়েননি। আর আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নামায আদায় করেছিলাম। ফিরে এসে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হই এবং আমি তাঁর নিকট উক্ত ঘটনা বর্ণনা করি। তখন তিনি হেসে উঠেন ও বলেনঃ “তুমি এরূপ করলেই যথেষ্ট হতো। অতঃপর তিনি মাটিতে হাত মারেন এবং ফু দিয়ে স্বীয় মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয়ে হাত ফিরিয়ে নেন।

মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘তায়াম্মুমে একবারই হাত মারতে হয় যা মুখমণ্ডলের জন্যে ও হস্তদ্বয়ের তালুর জন্যে। মুসনাদ-ই-আহমাদেরই আর একটি হাদীসে রয়েছে, হযরত শাকীক (রঃ) বলেন, ‘আমি হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) ও হযরত আবু মূসা (রাঃ)-এর সঙ্গে বসেছিলাম। হযরত আবু ইয়ালা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে বলেন, ‘যদি কেউ পানি না পায় তবে সে যেন নামায না পড়ে।’ একথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ বলেন, “হযরত আম্মার (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে যা বলেছিলেন তা কি আপনার স্মরণ নেই? তিনি হযরত উমর (রাঃ)-কে বলেছিলেনআপনার কি স্মরণ নেই যে, আমাকে ও আপনাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) উটে চড়িয়ে (কোন এক জায়গায়) পাঠিয়েছিলেন। তথায় আমি অপবিত্র হয়ে যাই এবং মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নামায পড়ে লই। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ফিরে এসে তাঁকে এ সংবাদ দেই। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেসে উঠে বলেনঃ ‘তুমি এরূপ করলেই যথেষ্ট হতো। অতঃপর তিনি স্বীয় হস্তদ্বয় ভূমির উপর মারেন এবং হস্তের তালুদ্বয় এক সাথে ঘর্ষণ করেন ও মুখমণ্ডলে একবার হাত ফিরিয়ে নেন। মার একবারই ছিল।’ হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এতে কিন্তু হযরত উমার (রাঃ) সন্তুষ্ট হননি।’ একথা শুনে হযরত আবু মূসা (রাঃ) বলেন, তাহলে সূরা-ই-নিসার এ আয়াতটিকে কি করবেন যাতে রয়েছে-‘পানি না পেলে পবিত্র মাটির ইচ্ছে কর।’ হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) এর উত্তর দিতে পারেননি এবং বলেন, জেনে রাখুন যে, যদি আমরা জনগণকে তায়াম্মুমের অনুমতি দিয়ে দেই তবে খুব সম্ভব পানি যখন তাদের কাছে খুব ঠাণ্ডা অনুভূত হবে তখন তারা তায়াম্মুম করতে আরম্ভ করবে।’

সুরা মায়েদায় ঘোষিত হয়েছে- (আরবী) অর্থাৎ ‘ওটা তোমাদের মুখমণ্ডলে ও তোমাদের হাতে ঘর্ষণ কর।’ (৫:৬) এটা দ্বারা হযরত ইমাম শাফিঈ (রঃ) দলীল গ্রহণ করেছেন যে, তায়াম্মুম পবিত্র মাটি দ্বারা হওয়া ও ওটা ধূলিযুক্ত হওয়া যাতে ধূলি হাতে লেগে যায় এবং মুখ ও হাতের উপর ঘর্ষণ করা যায়, এটা জরুরী। যেমন হযরত আবূ জাহাম (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে বর্ণনা করা রয়েছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে প্রস্রাব করতে দেখেন এবং সালাম করেন। তাতে এও রয়েছে যে, ঐ কার্য শেষ করে রাসূলুল্লাহ (সঃ) দেয়ালের পার্শ্বে যান এবং স্বীয় লাঠি দ্বারা কিছু মাটি উঠিয়ে নিয়ে ওটা হাতে মেরে তায়াম্মুম করেন।

এরপর ঘোষিত হচ্ছে আল্লাহ তোমাদের উপর তোমাদের ধর্মে সংকীর্ণতা ও কাঠিন্য আনয়ন করতে চান না, বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান। এ জন্যেই পানি না পাওয়ার সময় মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করাকে তোমাদের জন্যে বৈধ করেছেন এবং তোমাদের উপর স্বীয় নি’আমত দান করেছেন, যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। সুতরাং এ উম্মত এ নিআমতের সঙ্গে নির্দিষ্ট। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমাকে এমন পাঁচটি জিনিস দেয়া হয়েছে যা পূর্বে কাউকেও দেয়া হয়নি। (১) এক মাসের পথ পর্যন্ত প্রভাব দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। (২) আমার জন্যে সমস্ত ভূমিকে মসজিদ ও পবিত্রকারী বানানো হয়েছে। আমার উম্মতের যে কোন জায়গায় নামাযের সময় এসে যাবে সেখাইে নামায পড়ে নেবে। তার মসজিদও তার অযু সেখানেই তার নিকট বিদ্যমান রয়েছে। (৩) আমার জন্যে যুদ্ধলব্ধ মালকে হালাল করা হয়েছে যা আমার পূর্বে কারও জন্যে হালাল করা হয়নি। (৪) আমাকে সুপারিশ করার অধিকার দেয়া হয়েছে। (৫) সমস্ত নবী (আঃ)-কে শুধুমাত্র নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিকট পাঠানো হতো। কিন্তু আমি সারা দুনিয়ার নিকট প্রেরিত হয়েছি।’

সহীহ মুসলিমের উদ্ধৃতি দিয়ে ঐ হাদীসেও বর্ণনা করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “সমস্ত লোকের উপর আমাদেরকে তিনটি ফযীলত দেয়া হয়েছে। (১) আমাদের সারিগুলো ফেরেশতাদের সারির মত বানানো হয়েছে। (২) আমাদের জন্য সারা ভূমিকে মসজিদ বানানো হয়েছে। (৩) পানি পাওয়া না গেলে ওর মাটিকে অযু বানানো হয়েছে। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিচ্ছেন-পানি না পাওয়ার সময় স্বীয় মুখমণ্ডল ও হাতের উপর মাসেহ্ কর, তিনি মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল। তার মার্জনা ও ক্ষমার অবস্থা এই যে, পানি না পাওয়ার সময় তায়াম্মুমকে শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত করতঃ ঐভাবে নামায আদায় করার অনুমতি দান করেছেন। তিনি এ অনুমতি না দিলে তোমরা কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে যেতে। কেননা, এ পবিত্র আয়াতে নামাযকে অসম্পূর্ণ অবস্থায় আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন নেশার অবস্থায় বা অপবিত্র অবস্থায় কিংবা বে-অযু অবস্থায় নামায পড়াকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন যে পর্যন্ত সে নিজের কথা নিজেই বুঝতে না পারবে, নিয়মিতভাবে গোসল না করবে এবং শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী অযু না করবে। কিন্তু রোগের অবস্থায় ও পানি না পাওয়ার অবস্থায় তায়াম্মুমকে অযু ও গোসলের স্থলবর্তী করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা’আলার এ অনুগ্রহের জন্যে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্যেই।

এখন তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়ার ঘটনা বর্ণনা হচ্ছে। আমরা সূরা-ই-নিসার এ আয়াতের তাফসীরে এ ঘটনাটি যে বর্ণনা করছি, এর কারণ এই যে, সূরা-ই-মায়েদার তায়াম্মুমের আয়াতটি এ আয়াতের পর অবতীর্ণ হয়। এর প্রমাণ এই যে, স্পষ্টতঃ এটিই হচ্ছে মদ্য নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বের আয়াত এবং মদ্য হারাম হয় উহুদ যুদ্ধের কিছুদিন পর, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বান্ নাযীরের ইয়াহূদীদেরকে অবরোধ করে রেখেছিলেন। আর কুরআন শরীফের যে সূরাগুলো শেষের দিকে অবতীর্ণ হয়, সূরা-ই-মায়েদাহ ঐগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষ করে এ সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো শেষের দিকে অবতীর্ণ হয়। সুতরাং তায়াম্মুমের শান-ই-নমূল এখানে বর্ণনা করাই যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ তাআলার উত্তম তাওফীক দানের উপরই নির্ভর করছি।

মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে হযরত আসমা (রাঃ)-এর নিকট হতে একটি হার ধার করেছিলেন। উক্ত হারটি সফরে কোন জায়গায় হারিয়ে যায়। হারটি অনুসন্ধানের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোক পাঠিয়ে দেন। হার পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ওটা খুঁজতে খুঁজতে নামাযের ওয়াক্ত এসে যায়। তাদের নিকট পানি ছিল না। তারা বিনা অযুতেই নামায আদায় করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে ওটা বর্ণনা করেন। সে সময় তায়াম্মুমের হুকুম অবতীর্ণ হয়। হযরত উসায়েদ ইবনে হুজায়ের (রাঃ) তখন হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে বলেন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। আল্লাহর শপথ! আপনার উপর যে বিপদ এসে থাকে তার পরিণাম মুসলমানদের জন্য মঙ্গলজনকই হয়।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে কোন এক সফরে বের হই। যখন আমরা বায়দা অথবা যাতুল জায়েশ’ নামক স্থানে ছিলাম তখন আমার হারটি ভেঙ্গে কোথায় পড়ে যায়। হারটি খুঁজবার জন্য যাত্রীদলসহ রাসূলুল্লাহ (সঃ) তথায় থেমে যান। তখন না আমাদের নিকট পানি ছিল, না ঐ প্রান্তরের কোন জায়গায় পানি ছিল। জনগণ আমার পিতা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন-“দেখুন আমরা তাঁর কারণে কি বিপদেই না পড়েছি!’ অতএব আমার পিতা আমার নিকট আগমন করেন। সে সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার উরুর উপর স্বীয় মস্তক রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এসেই তিনি আমাকে বলেন, “তুমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ও জনগণকে এখানে থামিয়ে দিয়েছে। এখন না তাদের নিকট পানি রয়েছে, না কোন জায়গায় পানি দেখা যাচ্ছে?’ মোটকথা তিনি আমাকে খুব শাসন গর্জন করেন এবং আল্লাহ জানেন কত কি তিনি আমাকে বলেছেন। এমনকি স্বীয় হস্ত দ্বারা আমার পার্শ্ব দেশে প্রহার করতেও থাকেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে বলে আমি সামান্য নড়াচড়াও করিনি। সারা রাত্রি কেটে যায়। সকালে রাসূলুল্লাহ (সঃ) জেগে উঠেন। কিন্তু পানি ছিল না। সে সময় আল্লাহ তা’আলা তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করেন। তখন সমস্ত লোক তায়াম্মুম করেন। হযরত উসায়েদ ইবনে হুজায়ের (রাঃ) তখন বলেনঃ “হে আবু বকরের পরিবারবর্গ! এ বরকত আপনাদের প্রথম নয়। তখন যে উটে আমি আরোহণ করেছিলাম ঐ উটটি উঠালে ওর নীচে আমার হার পেয়ে যাই।’ (সহীহ বুখারী)

মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে, হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় পত্নী হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে যাতুল জায়েশ’ এর মধ্য দিয়ে গমন করছিলেন। তথায় হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ইয়ামানী হারটি ভেঙ্গে কোথায় পড়ে যায়। ঐ হারটি খুঁজবার জন্য জনগণ তথায় থেমে যান। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও তাঁর সঙ্গীয় মুসলমানগণ সারা রাত্রি তথায় কাটিয়ে দেন। সকালে উঠে দেখেন যে, পানি মোটেই নেই। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-এর উপর পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে পবিত্রতা লাভ করার অনুমতি দানের আয়াত অবতীর্ণ করেন। মুসলমানগণ রাসূলুলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে উঠে মাটির উপর হাত মারেন এবং হাতে যে মাটি লাগে তা ঝেড়ে না ফেলেই স্বীয় চেহারার উপর ও হস্তদ্বয়ের উপর কাঁধ পর্যন্ত ও হাতের নীচ হতে বগল পর্যন্ত ঘর্ষণ করেন।

ইবনে জারীর (রঃ)-এর বর্ণনায় রয়েছে যে, এর পূর্বে তো হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর উপর ভীষণ রাগন্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তায়াম্মুমের অনুমতির হুকুম অবতীর্ণ হওয়ার সংবাদ শুনে আনন্দিত চিত্তে স্বীয় কন্যার নিকট আগমন করেন এবং বলেন, তুমি বড়ই কল্যাণময়ী। মুসলমানেরা এত বড় অবকাশ পেয়েছে।

অতঃপর মুসলমানগণ একবার হাত মেরে চেহারা ঘর্ষণ করেন এবং দ্বিতীয়বার হাত মেরে কনুই পর্যন্ত ও বগল পর্যন্ত হস্তদ্বয় ঘর্ষণ করেন।

তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর বর্ণনায় রয়েছে, হযরত আসলা’ ইবনে সুরাইক (রাঃ) বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর উষ্ট্ৰীটি চালনা করছিলাম যার উপর তিনি আরোহিত ছিলেন। তখন ছিল শীতকাল, রাত্রে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছিল, সে সময় আমি অপবিত্র হয়ে পড়ি। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যাত্রার ইচ্ছে করেছেন। ঐ অবস্থায় আমি তার উস্ত্রী ছালনা করতে অপছন্দ করি। সাথে সাথে আমার এটাও ধারণা হয় যে, ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলে আমি মরেই যাবো বা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বো। আমি চুপে চুপে একজন আনসারীকে (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর উষ্ট্ৰীটির লাগাম ধরতে বলি। সুতরাং তিনি লাগাম ধরে চলতে থাকেন, আর আমি আগুন জ্বেলে পানি গরম করতঃ গোসল করে লই। তারপর দৌড়ে গিয়ে যাত্রীদলের নিকট পৌছি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে বলেনঃ ‘আসল’ ব্যাপার কি? উষ্ট্ৰীটির চলন কেমন যেন বিগড়ে গেছে?’ আমি বলি, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এতক্ষণ আমি উষ্ট্ৰী চালাইনি। বরং অমুক আনসার (রাঃ) চালনা করছিলেন। তিনি তখন বলেনঃ “এর কারণ কি?’ আমি তখন সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করি। তখন আল্লাহ তাআলা হতে (আরবী) পর্যন্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন। এ বর্ণনাটি অন্য সনদেও বর্ণিত আছে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

এটি মদ সম্পর্কে দ্বিতীয় নির্দেশ। প্রথম নির্দেশটি সূরা বাকারার ২১৯ আয়াতে দেয়া হয়েছে। সেখানে কেবল একথা বলেই শেষ করা হয়েছিল যে, মদ খারাপ জিনিস। আল্লাহ‌ এটি পছন্দ করেন না। একথা বলার পর মুসলমানদের একটি দল মদ পরিহার করেছিল। কিন্তু তখনো অনেক লোক আগের মতোই মদ পান করে চলছিল। এমনকি অনেক সময় নেশায় মাতাল অবস্থায় তারা নামাযে শামিল হয়ে যেতো এবং নামাযে যা পড়ার তা ছাড়া অন্য কিছু পড়ে ফেলতো। সম্ভবত চতুর্থ হিজরীর গোড়ার দিকে এই দ্বিতীয় নির্দেশটি নাযিল হয়। এখানে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। লোকদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তারা নিজেদের মদপানের সময় বদলে ফেলে। যখন নেশা থাকা অবস্থায় নামাযের সময় হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকতো তখন তারা মদপান থেকে বিরত থাকতো। এর কিছুকাল পরে মদপানের বিরুদ্ধে চরম নিষেধাজ্ঞা আসে। মদপান হারাম হবার এ নির্দেশটি এসেছে সূরা মায়েদার ৯০-৯১ আয়াতে। এখানে একথাও প্রণিধানযোগ্য যে, আয়াতে ‘সুকর’ এবং ‘নেশা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এ নির্দেশটি কেবল মদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না বরং প্রত্যেকটি নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুর সাথেই এর সম্পর্ক। এ নির্দেশটি আজও পুরোপুরি কার্যকর। একদিকে নেশাকর বস্তু ব্যবহার করা হারাম এবং অন্যদিকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়া দ্বিগুণ এবং আরও অনেক বড় গোনাহ।

এ জন্যই নবী ﷺ নির্দেশ দিয়েছেন, যখন ব্যক্তির ওপর ঘুমের আক্রমণ হয় এবং নামায পড়তে গিয়ে সে বারবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তখন তার নামায রেখে ঘুমিয়ে পড়া দরকার। কোন কোন লোক এই আয়াত থেকে এই মর্মে প্রমাণ পেশ করেছেন যে, যে ব্যক্তি নামাযে পঠিত আরবী ইবারতের অর্থ বোঝে না তার নামায হবে না। কিন্তু এটা আসলে একটা অযথা কাঠিন্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কুরআনের শব্দাবলীও এর সমর্থন করে না। কুরআনে ‘হাত্তা তাফ্‌কাহু’ বা ‘হাত্তা তাফহামু মা তাকূলূন’ (অর্থাৎ যতক্ষণ তোমরা যা বলো তা তোমরা হৃদয়ঙ্গম না করো অথবা বুঝতে না পারো) বলা হয় নি। বরং বলা হয়েছে, ‘হাত্তা তা’লামূ মা তাকূলূন’। অর্থাৎ নামাযে এক ব্যক্তিকে এতটুকুন সজাগ থাকতে হবে যে, সে নিজের মুখে কি কথা বলছে, তা তাকে অবশ্যি জানতে হবে। সে নামায পড়তে দাঁড়িয়ে যেন গজল গাইতে শুরু না করে দেয়।

কুরআনে উল্লেখিত মূল শব্দ হচ্ছে, ‘জুনুবান’। এর মানে হচ্ছে, দূর হয়ে যাওয়া, দূরত্ব ও সম্পর্কহীনতা। এ থেকে ‘আজনবী’ (অপরিচিত) শব্দটি বের হয়েছে। শরীয়াতের পরিভাষায় জুনুব বা জানাবাত অর্থ হচ্ছে, যৌন প্রয়োজন পূর্ণ করার এবং স্বপ্নের মধ্যে বীর্যপাত হবার ফলে যে, ‘নাজাসাত’ বা নাপাকী সৃষ্টি হয়। কারণ এর ফলে মানুষ তাহারাত বা পবিত্রতা শূন্য হয়ে পড়ে।

ফকীহ ও মুফাস্‌সিরগণের একটি দল এই আয়াতের অর্থ এভাবে গ্রহণ করেছেন যে, জুনুব (নাপাক) অবস্থায় মসজিদে না যাওয়া উচিত। তবে কোন কাজে মসজিদের মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে যেতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আনাস ইবনে মালিক, হাসান বসরী, ইবরাহীম নাখঈ প্রমুখ ফকীহগণ এই মত অবলম্বন করেছেন। অন্য এক দলের মতে এর অর্থ হচ্ছে সফর। অর্থাৎ যদি কেউ সফরে থাকে এবং এ অবস্থায় সে জুনুবী হয়ে পড়ে তাহলে তায়াম্মুম করতে পারে। আর মসজিদের ব্যাপারে তাদের মত হচ্ছে এই যে, জুনুবীর জন্য অযু করে মসজিদে বসে থাকা জায়েয। এই মত অবলম্বন করেছেন হযরত আলী, ইবনে আব্বাস, সাঈদ ইবনে জুবাইর এবং অন্যান্য কতিপয় ফকীহ। যদিও এ ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, কোন ব্যক্তি যদি সফল অবস্থায় জুনুবী হয়ে পড়ে এবং তার পক্ষে গোসল করা সম্ভবপর না হয়, তাহলে সে তায়াম্মুম করে নামায পড়তে পারে। কিন্তু প্রথম দলটি এ বিষয়টি গ্রহণ করে হাদীস থেকে আর দ্বিতীয় দলটি এর ভিত্তি রাখেন কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াতের ওপর।

এখানে কুরআনের মূল শব্দ হচ্ছে ‘লামাস’। ‘লামাস’ অর্থ স্পর্শ করা। ফকীহগণ এই ‘স্পর্শ করা’ শব্দটির অর্থ গ্রহণের ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন। হযরত আলী, ইবনে আব্বাস, আবু মূসা আশআরী, উবাই ইবনে কা’ব, সাইদ ইবনে জুবাইর, হাসান বসরী এবং বিভিন্ন ইমামদের মতে এর অর্থ হচ্ছে সহবাস। ইমাম আবু হানীফা, তাঁর শাগরিদবৃন্দ ও ইমাম সুফিয়ান সওরীও এই মতটি অবলম্বন করেছেন। এর বিপরীত মত গ্রহণ করেছেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর। এছাড়াও কোন কোন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, হযরত উমর ইবনে খাত্তাবেরও এই অভিমত ছিল। অর্থাৎ তিনি এর অর্থ কেবল মাত্র ‘স্পর্শ করা’ বা ‘হাত লাগানো’ নিয়েছেন। ইমাম শাফেঈও এ মতটি গ্রহণ করেছেন। আবার কোন কোন ইমাম মাঝামাঝি পথও অবলম্বন করেছেন। যেমন ইমাম মালেকের মতে, যদি নারী বা পুরুষ পরস্পরকে স্পর্শ করে যৌন আবেগ সহকারে, তাহলে তাদের অযু ভেঙে যাবে এবং নামাযের জন্য নতুন করে অযু করতে হবে। কিন্তু যৌন আবেগের তাড়না ছাড়াই যদি তাদের দেহ পরস্পরকে স্পর্শ করে তাহলে এতে কোন ক্ষতি নেই।

এই নির্দেশটির বিস্তারিত অবস্থা হচ্ছে এই যে, যদি কোন ব্যক্তি অযুবিহীন অবস্থায় থাকে অথবা তার গোসলের প্রয়োজন হয় এবং পানি না পাওয়া যায়, তাহলে সে তায়াম্মুম করে নামায পড়তে পারে। যদি সে অসুস্থ হয় এবং গোসল বা অযু করলে তার জন্য ক্ষতিরআশঙ্কা থাকে, তাহলে পানি থাকা সত্ত্বেও সে তায়াম্মুমের অনুমতির সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।

তায়াম্মুম অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছা বা সংকল্প করা। অর্থাৎ যদি পানি না পাওয়া যায় অথবা পাওয়া গেলেও তার ব্যবহার সম্ভব না হয়, তাহলে পাক-পবিত্র মাটি ব্যবহার করার সংকল্প করা।

তায়াম্মুমের পদ্ধতির ব্যাপারে ফকীহদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। একটি দলের মতে এর পদ্ধতি হচ্ছে, একবার মাটির ওপর দুই হাত ঘসে নিয়ে মুখ মণ্ডলের ওপর বুলিয়ে নিতে হবে। দ্বিতীয়বার দুই হাত ঘসে নিয়ে তা দুই হাতের কুনই পর্যন্ত বুলিয়ে নিতে হবে। এটিই ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক এবং অধিকাংশ ফকীহের মাযহাব। আর সাহাবা ও তাবেঈদের মধ্যে থেকে হযরত আলী, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, হাসান বসরী, শা’বী সালেম ইবনে আবদুল্লাহ এবং আরো অনেকে এই মত পোষন করতেন। দ্বিতীয় দলের মতে, মাটিতে কেবলমাত্র একবার হাত ঘসে নেয়াই যথেষ্ট, সেই হাত মুখমণ্ডলের ওপর বুলানো যাবে এবং তারপর কব্জি পর্যন্ত দুই হাতের ওপরও বুলানো যাবে। কনুই পর্যন্ত বুলাবার প্রয়োজন হবে না। এটি আতা, মাকহূল, আওযাঈ ও আহমাদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ ফকীহগণের মাযহাব। সাধারণত আহলে হাদীসগণও এই মতের প্রবক্তা।

তায়াম্মুমের জন্য মাটিতে হাত ঘসা অপরিহার্য নয়। যে জায়গার ওপর ধূলো পড়ে আছে এবং শুকনো মাটি সম্বলিত যেকোনো জায়গায় হাত ঘসে নেয়া এজন্য যথেষ্ট বিবেচিত হবে।

অনেকে প্রশ্ন করেন, এভাবে মাটিতে হাত ঘসে সেই হাত চেহারা ও হাতের ওপর বুলালে তাহারাত তথা পাক-পবিত্রতা অর্জিত হয় কিভাবে? কিন্তু আসলে এটি মানুষের মধ্যে তাহারাতের অনুভূতি এবং নামাযের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্বিক কৌশল বিশেষ। এতে যে লাভটুকু অর্জিত হয় তা হচ্ছেঃ দীর্ঘদিন পর্যন্ত পানি ব্যবহার সমর্থ্য না হলেও মানুষের মধ্যে তাহারাতের অনুভূতি জাগ্রত থাকবে। শরীয়াত পাক-পবিত্রতার যে আইন প্রবর্তন করেছে সে বরাবর তা মেনে চলবে। তার মন থেকে নামায পড়ার যোগ্য হবার অবস্থা ও নামায পড়ার যোগ্য না হবার অবস্থায় মধ্যকার পার্থক্যবোধ কখনো বিলুপ্ত হবে না।

তাফসীরে আবুবকর ‌যাকারিয়া‌ বলেছেন:-
[১] আল্লাহ রাববুল আলামীন ইসলামী শরীআতকে একটি বৈশিষ্ট্য এই দান করেছেন যে, এর প্রতিটি বিধি-বিধানকে তিনি সরল ও সহজ করেছেন। তারই এক বিশেষ দিক হচ্ছে এই যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন যাদের মন-মানসকে একান্ত নিষ্পাপ করে তৈরী করেছিলেন এমন বিশেষ বিশেষ কিছু লোক ছাড়া মদ্যপান ছিল সমগ্র আরববাসীর পুরাতন অভ্যাস। কিন্তু বিশেষ বিশেষ লোকেরা কখনো এই দুষ্ট বস্তুর ধারে কাছেও যেতেন না। যেমন, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও কখনো মদ স্পর্শ করেননি। এছাড়া বলতে গেলে সমগ্র জাতিই ছিল এ বদ অভ্যাসে লিপ্ত। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কোন বস্তু একবার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে মানুষের পক্ষে তা পরিহার করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মদ্যপান কিংবা অন্যান্য নেশাজনিত অভ্যাস মানুষকে এমনভাবে কাবু করে বসে যে, তা থেকে বেরিয়ে আসাকে সে মৃত্যুর শামিল মনে করতে থাকে। আল্লাহ তা’আলার নিকট মদ্যপান ও নেশা করা ছিল হারাম। বিশেষতঃ ইসলাম গ্রহণ করার পর মুসলিমদেরকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষা করা ছিল আল্লাহ তা’আলার অভিপ্রায়। কিন্তু সহসা একে হারাম করে দেয়া হলে, মানুষের পক্ষে এ নির্দেশ পালন করা একান্তই কঠিন হত। কাজেই প্রথমে এর উপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল এবং এর অশুভ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্কীকরণের মাধ্যমে মানুষের মন-মস্তিস্ককে একে পরিহার করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হল। সুতরাং আলোচ্য আয়াতে শুধুমাত্র এ হুকুমই দেয়া হয়েছে যে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের ধারে কাছেও যেও না। যার মর্ম ছিল এই যে, সালাতের সময় সালাতের প্রতি মনোনিবেশ করা ফরয। এ সময় মদ্যপান করা যাবে না। এতে মুসলিমগণ উপলব্ধি করলেন যে, এটা এমন এক মন্দ বস্তু যা মানুষকে সালাতে বাধা দান করে। কাজেই দেখা গেল অনেকে এ নির্দেশ আসার সাথে সাথেই মদ্যপান পরিহার করলেন এবং অনেকে এর মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে আরম্ভ করলেন। শেষ পর্যন্ত সূরা আল-মায়েদার আয়াতে মদের অপবিত্রতা ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ নাযিল হল এবং যে কোন অবস্থায় মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে হারাম হয়ে গেল।

[২] আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ মদ হারাম হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে এক আনসার দাওয়াত দিল। দাওয়াত শেষে আব্দুর রহমান ইবন আউফ এগিয়ে গিয়ে মাগরিবের সালাতের ইমামতি করলেন। তিনি সূরা আল-কাফেরুন তেলাওয়াত করতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেললেন। ফলে এ আয়াত নাযিল হয় যাতে মদ খাওয়ার পর বিবেকের সুস্থতা না ফেরা পর্যন্ত সালাত আদায় করতে নিষেধ করা হয়েছে। [আল-আহাদীসুল মুখতারাহঃ ২/১৮৮ নং- ৫৬৭, অনুরূপ ২/১৮৭ নং ৫৬৬; আবু দাউদঃ ৩৬৭১; তিরমিযী: ৩০২৬]

[৩] অপবিত্র অবস্থা থেকে গোসল করার নিয়ম বর্ণনায় হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জানাবতের গোসল করতেন, তখন প্রথমে দু হাত ধুয়ে নিতেন। তারপর সালাতের অজুর মত অজু করতেন। তারপর পানিতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে তা দিয়ে মাথার চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছাতেন। তারপর তার মাথায় তিন ক্রোশ পানি দিতেন এবং সারা শরীরে পানি প্রবাহিত করতেন। বুখারী: ২৪৮]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পা ধোয়া ব্যতীত সালাতের অজুর মত অজু করলেন, তার লজ্জাস্থান ধৌত করলেন, যে সমস্ত ময়লা লেগেছিল তাও ধৌত করলেন, তারপর তার নিজের শরীরে পানি প্রবাহিত করলেন। তারপর দু’ পা সরিয়ে নিয়ে ধৌত করলেন। এটাই ছিল তার অপবিত্রতা থেকে গোসল করার পদ্ধতি। [বুখারী: ২৪৯]

[৪] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, এক সফরে তিনি তার বোন আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে একটি হার ধার করে নিয়েছিলেন। তিনি সেটা হারিয়ে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা খুঁজতে এক ব্যক্তিকে পাঠান এবং তিনি তা খুঁজে পান। ইত্যবসরে সালাতের ওয়াক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তাদের নিকট পানি ছিল না। লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অভিযোগ করল। তখন তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হয়। উসাইদ ইবনে হোদাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। যখনি কোন অপছন্দনীয় ব্যাপার আপনার উপর ঘটে গেছে, তখনি তা আপনার এবং উম্মতে মুসলিমার জন্য কল্যাণের কারণ হয়েছে। [বুখারীঃ ৩৩৬, মুসলিমঃ ৩৬৭] মূলতঃ তায়াম্মুমের হুকুম একটি পুরস্কার- যা এ উম্মতেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলার কতই না অনুগ্রহ যে, তিনি অযু-গোসল প্রভৃতি পবিত্রতার নিমিত্ত এক বস্তুকে পানির স্থলাভিষিক্ত করে দিয়েছেন, যার প্রাপ্তি পানি অপেক্ষাও সহজ। বলাবাহুল্য, ভূমি ও মাটি সর্বত্রই বিদ্যমান। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, এ সহজ ব্যবস্থাটি একমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদীকেই দান করা হয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এই নির্দেশ ছিল ঐ সময়ে, যখন মদ হারাম হওয়ার কথা তখনো নাযিল হয়নি। কোন এক খাবার দাওয়াতে মদ পানের পর নামাযে দাঁড়ালে নেশার ঘোরে ইমাম সাহেব কুরআন পড়তে ভুল করেন। (বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্যঃ তিরমিযী, তাফসীর সূরা নিসা) ফলে এই আয়াত অবতীর্ণ করে বলা হয় যে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়ো না। অর্থাৎ, তখন কেবল নামাযের নিকটবর্তী সময়ে মদপান করতে নিষেধ করা হয়। মদপানের পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ও তার হারাম হওয়ার নির্দেশ পরে নাযিল হয়। (এটা হল মদের ব্যাপারে দ্বিতীয় নির্দেশ যা শর্ত-সাপেক্ষ।)

[২] এর অর্থ এই নয় যে, পথে বা সফরে থাকা অবস্থায় পানি না পাওয়া গেলে অপবিত্র অবস্থাতেই নামায পড়ে নাও (যেমন অনেকে মনে করে), বরং অধিকাংশ উলামাদের নিকট এর অর্থ হল, অপবিত্র অবস্থায় তোমরা মসজিদে বসো না, তবে মসজিদ হয়ে কোথাও যাওয়ার দরকার হলে যেতে পার। কোন কোন সাহাবীর ঘর এমন ছিল যে, সেখানে মসজিদের সীমানা হয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁদের কোন উপায় ছিল না। আর এই কারণেই মসজিদ-সীমানার ভিতর হয়ে অতিক্রম করে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। (ইবনে কাসীর) মুসাফিরের বিধান তো পরে আসবে।

[৩] অর্থাৎ, অপবিত্র অবস্থাতেও নামায পড়বে না। কারণ, নামাযের জন্য পবিত্রতা অত্যাবশ্যক।

[৪] এখানের যাদের জন্য তায়াম্মুম বিধেয়, তাদের কথা বলা হচ্ছেঃ (ক) অসুস্থ ব্যক্তি বলতে এমন রোগীকে বুঝানো হয়েছে, যে ওযু করলে ক্ষতি অথবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা করে। (খ) সফর বা মুসাফির সাধারণ শব্দ তাতে সফর লম্বা হোক বা সংক্ষিপ্ত; পানি না পেলে তায়াম্মুম করার অনুমতি আছে। পানি না পাওয়া গেলে তায়াম্মুম করার অনুমতি তো গৃহবাসী (অমুসাফির)-এরও আছে, কিন্তু রোগী ও মুসাফিরের এই ধরনের প্রয়োজন সাধারণতঃ বেশী দেখা দেয়, তাই বিশেষ করে তাদের জন্য এই অনুমতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। (গ) পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন পূরণকারী এবং (ঘ) স্ত্রীর সাথে সহবাসকারীও যদি পানি না পায়, তাহলে তাদের জন্যও তায়াম্মুম করে নামায পড়ার অনুমতি আছে। আর তায়াম্মুম করার নিয়ম হল, পবিত্র মাটিতে একবার হাত দু’টিকে মেরে উভয় হাতকে কবজি পর্যন্ত বুলিয়ে নিয়ে (কনুই পর্যন্ত নয়) মুখে বুলিয়ে নিবে। নবী করীম (সাঃ) তায়াম্মুম সম্পর্কে বলেছেন, “উভয় হাত এবং মুখমন্ডলের জন্য একবার মাটিতে মারতে হবে।” (মুসনাদ আহমাদ ৪/২৬৩) [صَعِيْدًا طَيِّبًا] এর অর্থ হল, পবিত্র মাটি। মাটি থেকে উৎপন্ন প্রতিটি জিনিস নয়, যেমন অনেকে মনে করে। হাদীসে এটা আরো পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছেঃ((جُعِلَتْ تُرْبَتُهَا لَنَا طَهُوْرًا إِذَا لَمْ نَجِدِ المَاءَ)) “পানি না পাওয়া গেলে যমীনের মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” (মুসলিম ৫২২নং)

তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মু’মিন বান্দাদেরকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাত ও সালাতের স্থান মাসজিদের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। এ বিধান ছিল মদ হারাম হবার পূর্বে। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি মদ তিনটি পর্যায়ে হারাম হয়েছে। এটি ছিল দ্বিতীয় পর্যায়।

এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে সূরা বাক্বারার ২১৯ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে অপবিত্র অবস্থায় সালাত ও মাসজিদের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। তবে কেউ যদি মাসজিদের এক দরজা থেকে অন্য দরজায় যেতে বাধ্য হয় মাসজিদে অবস্থান ব্যতীত তাহলে তার জন্য তা বৈধ।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা তায়াম্মুমের বিধান ও যাদের জন্য তা শরীয়তসিদ্ধ করে দিয়েছেন তাদের বর্ণনা দিচ্ছেন। শরীয়ত কর্তৃক তায়াম্মুমের অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নিম্নরূপ:

১. অসুস্থ ব্যক্তি, যিনি আশঙ্কা করেন যে, পানি ব্যবহার করলে অসুস্থতা বৃদ্ধি পাবে।

২. মুসাফির, দূরে সফর করুক বা কাছেই সফর করুক যদি পানি না পায় তাহলে তিনি তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করতে পারেন।

যদি পানি না থাকে বাড়িতে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের জন্যও তায়াম্মুম শরীয়াতসিদ্ধ। এখানে রোগী ও মুসাফিরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল সাধারণত এদের প্রয়োজন বেশি দেখা দেয়।

৩. পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন পূরণকারী পানি না পেলে তায়াম্মুম করবে।

৪. স্ত্রীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক করার পরও যদি সালাতের সময় হয়ে যায় কিন্তু পানি না পায় তাহলে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করবে। তারপরেও সালাত বিলম্ব করা বা ছেড়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।

তারপর তায়াম্মুমের পদ্ধতি বলা হচ্ছে। প্রথমে উভয় হাত মাটিতে একবার মেরে মুখমণ্ডল মাসেহ করবে তারপর উভয় হাতের কব্জী পর্যন্ত মাসেহ করবে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমার জন্য এরূপ করাই যথেষ্ট ছিল- এই বলে তিনি দু’হাত মাটিতে মারলেন এবং উভয় হাতে ফুঁ দিলেন (যাতে বেশি বালু থাকলে পড়ে যায়) তারপর উভয় হাত দ্বারা তার চেহারা ও হাতের কব্জী পর্যন্ত মাসেহ করলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৮)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবারই মাটিতে দু’হাত মেরেছেন, দু’বার না। দু’বার মাটিতে হাত মারা এবং কনুই পর্যন্ত মাসেহ করার হাদীস দুর্বল। (দারাকুতনী: ১/১৮০)

ইমাম বুখারী অধ্যায় রচনা করেছেন:

باب التيمم ضربة

“তায়াম্মুমের জন্য মাটিতে হাত মারা একবার”-এর অধ্যায়। صعيدا طيبا “পবিত্র মাটি” পৃথিবীর সমস্ত মাটি মুসলিমদের জন্য সালাত ও তায়াম্মুমের জন্য পবিত্র। তবে হাদীসে যে স্থানগুলোর কথা বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলো ব্যতীত।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমার জন্য পৃথিবীর মাটি সালাতের জায়গা। অতএব পুরুষদের জন্য কোন অবস্থাতেই সালাত বর্জনের সুযোগ নেই, মহিলাদের জন্যও না, তবে বিশেষ কয়েক দিন ব্যতীত। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩৫)

আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. অপবিত্র অবস্থায় সালাত আদায় ও মাসজিদে অবস্থান হারাম। তবে কেউ মাসজিদের এক দরজা হতে অন্য দরজা দিয়ে গমন করতে বাধ্য হলে তা জায়েয।
২. তায়াম্মুমের বিধান জানতে পারলাম।
৩. তায়াম্মুমের জন্য হাত মাটিতে মারতে হবে মাত্র একবার।
৪. গোসল ফরয হলে যথাযসম্ভব তা তাড়াতাড়ি সেরে নেয়া উত্তম।
৫. পানি না পেলে অপবিত্র অবস্থাতেই তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করে নেয়া বৈধ।

Leave a Reply