أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٤١)-৩৪৩
www.motaher21.net
فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِيَتَيْنِ
মুনাফিকদের ব্যাপারে তোমাদের কী হল যে, তোমরা দু’ দল হয়ে গেলে?
What is the matter with you that you are divided into two parties about the hypocrites?
সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-৮৮-৯১
فَمَا لَكُمْ فِی الْمُنٰفِقِیْنَ فِئَتَیْنِ وَ اللّٰهُ اَرْكَسَهُمْ بِمَا كَسَبُوْاؕ اَتُرِیْدُوْنَ اَنْ تَهْدُوْا مَنْ اَضَلَّ اللّٰهُؕ وَ مَنْ یُّضْلِلِ اللّٰهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهٗ سَبِیْلًا
তারপর তোমাদের কী হয়েছে, মুনাফিকদের ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে দ্বিমত পাওয়া যাচ্ছে? অথচ যে দুষ্কৃতি তারা উপার্জন করেছে তার বদৌলতে আল্লাহ তাদেরকে উল্টো দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তোমরা কি চাও, আল্লাহ যাকে হিদায়াত দান করেননি তোমরা তাকে হিদায়াত করবে? অথচ আল্লাহ যাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তার জন্য তুমি কোন পথ পাবে না।
আয়াত:-৮৯
وَدُّوْا لَوْ تَكْفُرُوْنَ كَمَا كَفَرُوْا فَتَكُوْنُوْنَ سَوَآءً فَلَا تَتَّخِذُوْا مِنْهُمْ اَوْلِیَآءَ حَتّٰى یُهَاجِرُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِؕ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَخُذُوْهُمْ وَ اقْتُلُوْهُمْ حَیْثُ وَجَدْتُّمُوْهُمْ ۪ وَ لَا تَتَّخِذُوْا مِنْهُمْ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیْرًاۙ
তারা তো এটাই চায়, তারা নিজেরা যেমন কাফের হয়েছে তেমনি তোমরাও কাফের হয়ে যাও, যাতে তারা ও তোমরা সমান হয়ে যাও। কাজেই তাদের মধ্য থেকে কাউকেও নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যতক্ষণ না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে আসে। আর যদি তারা (হিজরত থেকে) বিরত থাকে, তাহলে তাদেরকে যেখানেই পাও ধরো এবং হত্যা করো১১৮ এবং তাদের মধ্য থেকে কাউকেও নিজেদের বন্ধু ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না।
আয়াত নং :-৯০
اِلَّا الَّذِیْنَ یَصِلُوْنَ اِلٰى قَوْمٍۭ بَیْنَكُمْ وَ بَیْنَهُمْ مِّیْثَاقٌ اَوْ جَآءُوْكُمْ حَصِرَتْ صُدُوْرُهُمْ اَنْ یُّقَاتِلُوْكُمْ اَوْ یُقَاتِلُوْا قَوْمَهُمْؕ وَ لَوْ شَآءَ اللّٰهُ لَسَلَّطَهُمْ عَلَیْكُمْ فَلَقٰتَلُوْكُمْۚ فَاِنِ اعْتَزَلُوْكُمْ فَلَمْ یُقَاتِلُوْكُمْ وَ اَلْقَوْا اِلَیْكُمُ السَّلَمَۙ فَمَا جَعَلَ اللّٰهُ لَكُمْ عَلَیْهِمْ سَبِیْلًا
অবশ্যি সেই সব মুনাফিক এই নির্দেশের আওতাভুক্ত নয়, যারা এমন কোন জাতির সাথে মিলিত হয়, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ।এভাবে সেই সব মুনাফিকও এর আওতাভুক্ত নয়, যারা তোমাদের কাছে আসে এবং যুদ্ধের ব্যাপারে অনুৎসাহিত, না তোমাদের বিরুদ্ধে লড়তে চায়, না নিজেদের জাতির বিরুদ্ধে। আল্লাহ চাইলে তাদেরকে তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিতেন এবং তারাও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন। কাজেই তারা যদি তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে আর তোমাদের দিকে সন্ধি ও সখ্যতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার কোন পথ রাখেননি।
আয়াত :- ৯১
سَتَجِدُونَ ءَاخَرِينَ يُرِيدُونَ أَن يَأْمَنُوكُمْ وَيَأْمَنُوا قَوْمَهُمْ كُلَّ مَا رُدُّوٓا إِلَى الْفِتْنَةِ أُرْكِسُوا فِيهَا ۚ فَإِن لَّمْ يَعْتَزِلُوكُمْ وَيُلْقُوٓا إِلَيْكُمُ السَّلَمَ وَيَكُفُّوٓا أَيْدِيَهُمْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ ۚ وَأُولٰٓئِكُمْ جَعَلْنَا لَكُمْ عَلَيْهِمْ سُلْطٰنًا مُّبِينًا
তোমরা অচিরেই অন্য লোককে পাবে, যারা তোমাদের কাছে নিরাপত্তা চাইবে এবং নিরাপত্তা চাইবে তাদের কওমের কাছে। যখনই তাদেরকে ফিতনার দিকে ফিরানো হয়, তারা সেখানে ফিরে যায়। সুতরাং যদি তারা তোমাদের থেকে সরে না যায় এবং তোমাদের কাছে সন্ধি প্রস্তাব উপস্থাপন না করে এবং নিজদের হাত গুটিয়ে না নেয়, তাহলে তাদেরকে পাকড়াও করবে এবং হত্যা করবে যেখানেই তাদের নাগাল পাবে। আর ওরাই তারা, যাদের বিরুদ্ধে আমি তোমাদেরকে সুস্পষ্ট ক্ষমতা দিয়েছি।
৮৮-৯১ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
শানে নুযূল:
যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উহুদের যুদ্ধের জন্য বের হলেন। কিছু মানুষ যুদ্ধ না করে ফিরে আসে। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীগণ দু’দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল বলে আমরা তাদেরকে হত্যা করব, আরেক দল বলে না, হত্যা করব না কেননা তারা মু’মিন। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়:
(فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنٰفِقِيْنَ فِئَتَيْنِ)
(সহীহ বুখারী হা: ১৮৮৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৭৭৬)
کَسَبُوْا (কৃতকর্ম) বলতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরোধিতা এবং জিহাদ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করা।
أركسهم সুদ্দী বলেন: أضلهم তাদেরকে পথ ভ্রষ্ট করবেন।
وَدُّوْا ‘তারা কামনা করে’ অর্থাৎ কাফিররা চায়- যদি তোমরা কুফরী করতে ফলে তাদের সমান হয়ে যেতে। এ সম্পর্কে সূরা বাকারায় আলোচনা করা হয়েছে।
(فَاِنْ تَوَلَّوْا) ‘যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়’ যদি জিহাদ ছেড়ে দেয়। ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও সুদ্দী (রহঃ) বলেন: যদি তারা কুফরী প্রকাশ করে, তাহলে যেখানে পাবে সেখানেই হত্যা করবে। তবে যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয়, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ তাদের বিধান তোমাদের বিধানের মত অথবা এমন লোক যারা তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় আসে যে, তাদের হৃদয় নিজেদের জাতির সাথে মিলে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বা তোমাদের সাথে মিলে নিজের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে বড় সংকীর্ণতা বোধ করে। অর্থাৎ না তোমাদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করে, না তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
(فَمَا جَعَلَ اللّٰهُ لَكُمْ عَلَيْهِمْ سَبِيْلًا)
‘তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা দেননি।’তারা যদি পৃথক হয়ে যায়, তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট সন্ধি প্রার্থনা করে তাহলে তোমরা তাদেরকে হত্যা করতে পারবে না। যতদিন তারা এ অবস্থায় বিদ্যমান থাকবে। এদের দৃষ্টান্ত সেই গোষ্ঠিও বটে, যাদের সম্পর্ক ছিল বানী হাশেমের সাথে। এরা বদর যুদ্ধে মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাতে তাদের কোনই ইচ্ছা ছিল না। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চাচা আব্বাস প্রভৃতি।
(سَتَجِدُوْنَ اٰخَرِيْنَ)
‘অচিরেই তোমরা এমন কিছু লোক পাবে’ এরা হল মুনাফিকদের অন্যতম আরেকটি দল। এরা মুসলিমদের কাছে এসে ইসলাম প্রকাশ করত যাতে মুসলিমদের হাত থেকে নিরাপদে থাকতে পারে। আবার যখন স্বীয় জাতির নিকট যেত, তখন তাদের সাথে শির্ক ও মূর্তি পূজায় লিপ্ত হত যাতে এদেরকে নিজেদের দলভুক্ত মনে করে। এভাবেই এরা উভয় স্বার্থ হাসিল করত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِذَا خَلَوْا إِلٰي شَيَاطِينِهِمْ قَالُوْآ إِنَّا مَعَكُمْ)
“যখন তারা নিজেদের শয়তানদের (কাফির বন্ধুদের) সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।“ (সূরা বাকারাহ ২:১৪)
الفتنة ‘ফেতনা’সুদ্দী (রহঃ) বলেন: এর দ্বারা উদ্দেশ্য শির্ক। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে তারা বিরত না থাকে এবং সন্ধিও না করে তাহলে তাদেরকে ধর আর হত্যা কর।
মোটকথা উপরে বর্ণিত তিন প্রকার মুনাফিক ব্যতীত যারা তোমাদের সাথে বাহ্যিক মিল রাখে কিন্তু সুযোগ পেলেই তোমাদের হত্যা করার সংকল্প রাখে তাদরেকে হত্যা করতে কোন বাধা নেই।
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
মুনাফিকদের কোন ব্যাপারে যে মুসলমানদের দু’ প্রকার মত হয়েছিল সে সম্বন্ধে মতভেদ রয়েছে। হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন উহুদ প্রান্তরে গমন করেন তখন তার সাথে মুনাফিকেরাও ছিল। তারা যুদ্ধের পূর্বেই ফিরে এসেছিল। তাদের ব্যাপারে কতক মুসলমান বলছিলেন যে, তাদেরকে হত্যা করে ফেলা উচিত। আবার অন্য কয়েকজন বলছিলেন যে, হত্যা করা হবে না, কেননা তারাও মুমিন। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘এটা পবিত্র শহর, এটা নিজেই মালিন্য এমনভাবে দূর করে দেবে যেমনভাবে ভাটি লোহাকে পরিষ্কার করে থাকে। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) উহুদ যুদ্ধের ঘটনা সম্বন্ধে বলেন যে, উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল এক হাজার। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সাল তিনশ লোককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছিল এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে সাতশ জন রয়ে গিয়েছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, মক্কায় এমন কতগুলো লোক ছিল যারা ইসলামের কালেমা পাঠ করেছিল। কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদেরকে সাহায্য করতো। তারা নিজেদের কোন বিশেষ প্রয়োজনে মক্কা হতে বের হয়। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীগণ তাদেরকে কোন বাধা প্রদান করবেন না। কেননা, প্রকাশ্যে তারা কালেমা পড়েছিল।
মদীনার মুসলমানগণ যখন এ সংবাদ জানতে পারেন তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেনঃ “এ কাপুরুষদের সাথে প্রথমে জিহাদ করা হোক। কেননা, এরা আমাদের শত্রুদের পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু কতক লোক বলেন, ‘সুবহানাল্লাহ! যারা আমাদের মতই কালেমা পড়ে তোমরা তাদের সাথেই যুদ্ধ করবে। শুধু এ কারণে যে, তারা হিজরত করেনি এবং নিজেদের ঘরবাড়ী ছাড়েনি? আমরা কিভাবে তাদের রক্ত ও মাল হালাল করতে পারি?
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে তাদের এ মতানৈক্য হয়েছিল। তিনি নীরব ছিলেন। সে সময় এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। (মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিম) হযরত সাদ ইবনে মুআয বলেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে যখন অপবাদ দেয়া হয়েছিল সে সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরের উপর দাড়িয়ে বলেনঃ “কে আছে যে আমাকে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের উৎপীড়ন হতে রক্ষা করে? সে সময় আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয় ঐ ব্যাপারেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। কিন্তু এ উক্তিটি গারীব। এ ছাড়া আরও উক্তি রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার কারণে ধ্বংস করেছেন। তাদের হিদায়াতের কোন পথ নেই। তারাতে চায় যে খাটি মুসলমানও তাদের মত পথভ্রষ্ট হয়ে যাক।
তাই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তাদের অন্তরে যখন তোমাদের প্রতি এত শত্রুতা রয়েছে তখন তোমাদেরকে নিষেধ করা হচ্ছে যে, যে পর্যন্ত তারা হিজরত না করে সে পর্যন্ত তোমরা তাদেরকে নিজের মনে করো না। তোমরা এটা মনে করো না যে, তারা তোমাদের বন্ধু ও সাহায্যকারী। বরং তারা নিজেরাই এর যোগ্য যে, নিয়মিতভাবে তাদের সাথে যুদ্ধ করা হবে। অতঃপর ওদের মধ্য হতে ঐ লোকদেরকে পৃথক করা হচ্ছে যারা কোন এমন সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে চলে যায় যাদের সঙ্গে মুসলমানদের সন্ধি ও চুক্তি রয়েছে। তখন তাদের হুকুম সন্ধিযুক্ত সম্প্রদায়ের মতই হবে।
সুরাকাহ্ ইবনে মালিক মুদলেজী বলে-বদর ও উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলমানেরা জয়যুক্ত হয় এবং আশে-পাশের লোকদের মধ্যে ইসলাম ভালভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন আমি জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার গোত্র বানূ মুদলিজের বিরুদ্ধে হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করার সংকল্প করেছেন। আমি তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে উপস্থি হয়ে আরয করি- আমি আপনাকে অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। তখন জনগণ বলেনঃ “চুপ কর।’ কিন্তু তিনি বলেনঃ ‘তাকে বলতে দাও। তুমি কি বলতে চাও, বল। আমি তখন বলি, আমি জানতে পেরেছি যে, আপনি আমার সম্প্রদায়ের দিকে সেনাবাহিনী পাঠাতে চাচ্ছেন। আমি চাই, আপনি তাদের সাথে এ শর্তে সন্ধি করুন যে, যদি কুরাইশরা ইসলাম গ্রহণ করে তবে তারাও মুসলমান হয়ে যাবে। আর যদি তারা মুসলমান না হয় তবে তাদের উপরও আপনি আক্রমণ করবেন না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ)-এর হাতখানা স্বীয় হাতের মধ্যে নিয়ে বলেনঃ তুমি এর সাথে যাও এবং এর কথা অনুসারে তার কওমের সাথে সন্ধি করে এসো। সুতরাং এ শর্তে সন্ধি হয়ে গেল যে, তারা ধর্মের শত্রুদেরকে কোন প্রকারের সাহায্য করবে না এবং যদি কুরাইশরা মুসলমান হয়ে যায় তবে তারাও মুসলমান হয়ে যাবে। তখন আল্লাহ তা’আলা (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। অর্থাৎ এরা চায় যে, তাদের মত তোমরাও কুফরী কর যেন তোমরা সমান হয়ে যাও। সুতরাং তাদের মধ্যে হতে কাউকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। এ বর্ণনাটি তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যেও রয়েছে। তাতে রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তখন (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। অর্থাৎ কিন্তু যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে সম্মিলিত হয় যে, তোমাদের মধ্যে ও তাদের মধ্যে চুক্তি রয়েছে। সুতরাং যারা তাদের সঙ্গে মিলিত হবে তারাও তাদের মতই পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে। কালামের শব্দের সাথে এরই বেশী সম্পর্ক রয়েছে।
সহীহ বুখারী শরীফে হুদায়বিয়ার সন্ধি ঘটনায় রয়েছে যে, এরপর যে চাইতো মদীনার মুসলমানদের সাথে মিলিত হতো এবং চুক্তিপত্রের কারণে। নিরাপত্তা লাভ করতো। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি এই যে, নিম্নের আয়াতটি এ হুকুমকে রহিত করে দেয়ঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘যখন হারাম মাসগুলো অতিক্রান্ত হয়ে যাবে তখন মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও সেখানেই হত্যা কর”। (৯:৫) এরপর অন্য একটি দলের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসা হয় বটে কিন্তু তারা সংকুচিত চিত্ত হয়ে হাযির হয়। তারা না তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে চায়, না তোমাদের সাথে মিলিত হয়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করা পছন্দ করে। বরং ত পক্ষীয় লোকে। তাদেরকে না তোমাদের শত্রু বলা যেতে পরে, না বন্ধু বলা যেতে পারে। সুতরাং এটাও আল্লাহ পাকের একটা অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে তোমাদের উপর শক্তিশালী করেননি। তিনি ইচ্ছে করলে তাদের ক্ষমতা দান করতেন এবং তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার স্পৃহা তাদের অন্তরে জাগিয়ে তুলতেন। সুতরাং যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হতে বিরত থাকে এবং তোমাদের নিকট সন্ধি প্রার্থনা করে তবে তোমাদের জন্যে তাদের সাথে যুদ্ধ করবার অনুমতি নেই।
বদরের যুদ্ধে বানু হাশিম গোত্রের কতগুলো লোক মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসেছিল। যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অন্তরে অপছন্দ করেছিল, তারাই ছিল এ প্রকারের লোক। যেমন হযরত আব্বাস (রাঃ) ইত্যাদি। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ)-কে হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁকে জীবিত গ্রেফতার করতে বলেছিলেন।
অতঃপর আর একটি দলের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে, যারা বাহ্যতঃ উপরোক্ত দলের মতই কিন্তু তাদের নিয়ত খুবই কুঞ্চিত, তারা মুনাফিক। এ মুনাফিকরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে ইসলাম প্রকাশ করতঃ স্বীয় জান ও মাল মুসলমানের হাত হতে রক্ষা করতো আর ওদিকে কাফিরদের সাথে মিলিত হয়ে তাদের বাতিল মাবুদের ইবাদত করতো এবং তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা প্রকাশ করতঃ তাদের সাথেই মিলেমিশে থাকতো যেন তাদের নিকটেও নিরাপদে থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এরা ছিল কাফির। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ যখন তারা শয়তানদের সন্নিকটে একাকী হয়, তখন বলে নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি।’ (২৪ ১৪) এখানেও বলা হচ্ছে-যখন তারা বিরোধের দিকে প্রত্যাবর্তিত হয় তখন তাতেই নিপতিত হয়। এখানেও শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে শিরক। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এ লোকগুলোও মক্কাবাসী ছিল। এখানে এসে তারা রিয়াকারী রূপে ইসলাম গ্রহণ করতো এবং মক্কায় ফিরে গিয়ে মূর্তিপূজা করতো। তাই তাদের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যদি তারা তোমাদের দিক হতে নিবৃত্ত না হয় ও সন্ধি প্রার্থনা না করে তবে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করো না, বরং তাদের সাথে যুদ্ধ কর, বন্দী কর এবং যেখানেই পাও হত্যা কর। তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে প্রকাশ্য আধিপত্য দান করেছেন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১:-
এখানে এমন সব মুনাফিক মুসলমানদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা মক্কায় ও আরবের অন্যান্য এলাকায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু হিজরত করে দারুল ইসলামে না এসে যথারীতি নিজেদের কাফের গোত্রের মধ্যে অবস্থান করছিল। তাদের কাফের গোত্র ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব কাজ করতো তারাও তাদের সাথে কমবেশী এসব কাজে কার্যত অংশ নিতো। তাদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করা যায়, এ বিষয়টি মুসলমানদের জন্য আসলে অত্যন্ত জটিল ছিল। কেউ কেউ বলছিল, যাই হোক না কেন, তারা তো মুসলমান, কালেমা পড়ে, নামায পড়ে, রোযা রাখে, কুরআন তেলাওয়াত করে। তাদের সাথে কাফেরদের মতো ব্যবহার কেমন করে করা যেতে পারে? এই রুকূ’তে মহান আল্লাহ মুসলমানদের মতবিরোধের চূড়ান্ত মীমাংসা করে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে। অন্যথায় কুরআনের কেবল এই জায়গায় নয় আরো বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে হিজরত না করার কারণে মুসলমানদেরকে মুনাফিকদের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে, সেখানে কুরআন মজীদের আসল বক্তব্য অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। আসলে নবী ﷺ যখন মদীনা তাইয়েবায় হিজরত করে আসেন এবং যখন আরব দেশে এমন একটি ছোট্ট ভূখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে একজন মু’মিন বান্দার জন্য তার দ্বীন ও ঈমানের দাবী পুরণ করা সম্ভবপর ছিল তখন যেখানে, যে এলাকায় ও যেসব গোত্রের মধ্যে ঈমানদারগণ কাফেরদের অধীনে ইসলামী জীবন যাপনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল, সেখান থেকে তাদের জন্য হিজরত করার ও মদীনার দারুল ইসলামে চলে আসার সাধারণ হুকুমনামা জারী করে দেয়া হয়েছিল। সে সময় তাদের হিজরত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র এজন্য হিজরত করছিল না যে, তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন ও নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থ তাদের কাছে ইসলামের তুলনায় বেশী প্রিয় ছিল, তাদের সবাইকে মুনাফিক গণ্য করা হয়। আর যারা যথার্থই একেবারে অক্ষম ছিল তাদেরকে ‘মুসতাদআফীন’ (দুর্বল) গণ্য করা হয়। যেমন পরবর্তী ১৪ রুকূ’তে বলা হয়েছে।
এখন একথা সুস্পষ্ট যে, দারুল কুফরে অবস্থানকারী কোন মুসলমানকে নিছক হিজরত না করার কারণে মুনাফিক কেবলমাত্র তখনি বলা যেতে পারে যখন দারুল ইসলামের পক্ষ থেকে এ ধরনের মুসলমানদেরকে সেখানে বসবাস করার আহবান জানানো হবে অথবা কমপক্ষে তাদের জন্য দারুল ইসলামের দরজা উন্মুক্ত থাকবে। এ অবস্থায় অবশ্যি যেসব মুসলমান দারুল কুফরকে দারুল ইসলামে পরিণত করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে না আবার অন্য দিকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হিজরাতও করবে না তারা সবাই মুনাফিক বলে গণ্য হবে। কিন্তু দারুল ইসলামের পক্ষ থেকে যদি আমন্ত্রণই না জানানো হয় এবং মুহাজিরদের জন্য তাদের দরজা যদি উন্মুক্তই না থাকে, তাহলে এ অবস্থায় শুধুমাত্র হিজরত না করলে কোন মুসলমান মুনাফিক হয়ে যাবে না। বরং এ অবস্থায় যখন সে কোন মুনাফিক সুলভ কাজ করবে কেবলমাত্র তখনই মুনাফিক গণ্য হবে।
টিকা: ২:-
যে দ্বিমুখী নীতি, সুবিধাবাদিতা এবং আখেরাতের ওপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেবার কর্মনীতি তারা অবলম্বন করেছে, তার বদৌলতে আল্লাহ তাদেরকে আবার সেদিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন যেদিক থেকে তারা এসেছিল। তারা কুফরী থেকে বের হয়ে ইসলামের দিকে এগিয়ে এসেছিল ঠিকই কিন্তু এই এলাকায় এসে অবস্থান করার এবং একমুখী ও একাগ্র হবার প্রয়োজন ছিল, ঈমান ও ইসলামের স্বার্থের সাথে সংঘর্ষশীল প্রতিটি স্বার্থ পরিহার করার প্রয়োজন ছিল এবং আখেরাতের ওপর এমন দৃঢ় বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল যার ভিত্তিতে মানুষ নিশ্চিন্তে নিজের দুনিয়ার স্বার্থ পরিহার করতে পারে। কিন্তু তা তারা অর্জন করতে পারেনি। তাই তারা যেদিক থেকে এসেছিল পেছন ফিরে আবার সেদিকেই চলে গেছে। কাজেই এখন তাদের ব্যাপারে মতবিরোধ করার আর কোন অবকাশ নেই।
টিকা: ৩:-
মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফের জাতিদের সাথে যেসব মুনাফিক মুসলমান সম্পর্ক রাখে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও শত্রুতামূলক কার্যকলাপে কার্যত অংশগ্রহণ করে, তাদের সম্পর্কে এই নির্দেশটি দেয়া হয়েছে।
টিকা: ৪:-
এখানে আওতাভুক্ত না করার যে নির্দেশটি জারি করা হয়েছে তার সম্পর্ক “তাদের মধ্য থেকে কাউকে নিজেদের বন্ধু ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না” বাক্যটির সাথে নয়। বরং এর সম্পর্ক হচ্ছে “তাদেরকে যেখানেই পাও ধরো এবং হত্যা কারো” বাক্যটির সাথে। এর অর্থ হচ্ছে, যেসব মুনফিককে হত্যা করা ওয়াজিব, তারা যদি এমন কোন জাতির এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয় যাদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তি রয়েছে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের সীমানায় প্রবেশ করে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা যাবে না। আর দারুল ইসলামের কোন মুসলমান কোন নিরপেক্ষ দেশের এলাকায় যদি এমন কোন মুনাফিককে পায় যাকে হত্যা করা ওয়াজিব এবং তাকে হত্যাও করে ফেলে, তাহলে এটাও কোনক্রমে বৈধ হবে না। এখানে আসলে মুনাফিকদের রক্তের প্রতি নয় বরং চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনই লক্ষ্য।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] যায়েদ ইবন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ওহুদের যুদ্ধে বের হলেন তখন তার সাথীদের মধ্য থেকে কিছু লোক ফিরে চলে আসলেন। তাদের ব্যাপারে সাহাবাগণ দ্বিমত পোষণ করলেন । কেউ বললেন হত্যা করব, কেউ বললেন হত্যা করব না। তখন এ আয়াত নাযিল হয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এই মদীনা নগরী কিছু মানুষকে দেশান্তর করে যেমনিভাবে আগুন দূর করে লোহার ময়লাকে। [বুখারীঃ ১৮৮৪, ৪০৫০, ৪৫৮৯, মুসলিমঃ ১৩৮৪, ২৭৭৬]
[২] এ আয়াতে যেভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা পথভ্রষ্ট করেছেন, তাদের জন্য পথের দিশা পাওয়ার কোন উপায়ই অবশিষ্ট নেই। অন্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা’আলা তা স্পষ্ট বলেছেন। আল্লাহ বলেন, “আর আল্লাহ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান তার জন্য আল্লাহর কাছে আপনার কিছুই করার নেই। এরাই হচ্ছে তারা যাদের হৃদয়কে আল্লাহ বিশুদ্ধ করতে চান না; তাদের জন্য আছে দুনিয়ায় লাঞ্ছনা আর আখেরাতে রয়েছে তাদের জন্য মহাশাস্তি” [সূরা আল-মায়িদাহ ৪১] অন্য আয়াতে এসেছে, “আল্লাহ যাদেরকে বিপথগামী করেন তাদের কোন পথপ্রদর্শক নেই” সূরা আল-আরাফ: ১৮৬]
[৩] হিজরত দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়- (১) দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করা, যেমন সাহাবায়ে কেরাম স্বদেশ মক্কা ছেড়ে মদীনা ও আবিসিনিয়ায় চলে যান।
(২) পাপ কাজ বর্জন করা। তন্মধ্যে প্রথম প্রকার হিজরত হচ্ছে নিজের দ্বীনকে বাঁচানোর জন্য। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফেরদের দেশ থেকে হিজরত করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয ছিল। এ কারণে যারা এ ফরয পরিত্যাগ করতো, তাদের সাথে আল্লাহ্ তা’আলা মুসলিমদের মত ব্যবহার করতে নিষেধ করে দেন। হিজরত সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছেঃ যতদিন তাওবা কবুল হওয়ার সময় থাকবে, ততদিন হিজরত বাকী থাকবে। [আবু দাউদঃ ২৪৭৯]
এর দ্বারা বোঝা যায় যে, বর্তমানেও যদি কোন দেশে মুসলিমরা তাদের ঈমান টিকিয়ে রাখতে সামর্থ না হয়, তাদেরকে সেখান থেকে হিজরত করতে হবে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকার হিজরত হচ্ছে, পাপকর্ম ত্যাগ করা। যেমন, এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘ঐ ব্যক্তি মুহাজির, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় বর্জন করে ‘মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৯৯]
এ হিজরত সর্বাবস্থায় একজন মুমিনের কর্তব্য। এর জন্য দেশ ত্যাগের প্রয়োজন পড়ে না।
[৪] উপরোক্ত ৮৮ থেকে ৯১ আয়াতসমূহে তিনটি দলের কথা বর্ণিত হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে দুটি বিধান উল্লেখিত হয়েছে। এসব দলের ঘটনাবলী নিমোস্কৃত বর্ণনাসমূহ থেকে জানা যাবে।
প্রথম বর্ণনাঃ তাফসীরকার মুজাহিদ বলেন, একবার কতিপয় মুশরিক মক্কা থেকে মদীনায় আগমন করে এবং প্রকাশ করে যে, তারা মুসলিম; হিজরত করে মদীনায় এসেছে। কিছুদিন পর তারা দ্বীনত্যাগী হয়ে যায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পণ্যদ্রব্য আনার অজুহাত পেশ করে পুনরায় মক্কা চলে যায়। এরপর তারা আর ফিরে আসেনি। এদের সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দেয়। কেউ কেউ বলল এরা কাফের, আর কেউ কেউ বলল এরা মুমিন। আল্লাহ্ তা’আলা ৮৮ ও ৮৯ নং আয়াতে এদের কাফের হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং এদেরকে হত্যা করার বিধান দিয়েছেন। [তাবারী] কাতাদা থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এরা ছিল তিহামার একটি গোত্র, তারা রাসূলকে বলল যে, আমরা আপনার সাথে যুদ্ধ করব না, আমাদের কাওমের সাথেও যুদ্ধ করব না। তারা রাসূল ও তাদের কাওমের যুগপৎ নিরাপত্তা চাচ্ছিল। তাদের অবস্থা বুঝে আল্লাহ তা’আলা তা মানতে অস্বীকার করেন। [ইবন আবী হাতেম; আত-তাফসীরুস সহীহ]
দ্বিতীয় বর্ণনাঃ হাসান বসরী বর্ণনা করেন যে, বদর ও ওহুদ যুদ্ধের পর সুরাকা ইবন মালেক মুদলাজী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা জানালো, আমাদের গোত্র বনী-মুদলাজের সাথে সন্ধি স্থাপন করুন। তিনি খালেদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সন্ধি সম্পন্ন করার জন্য সেখানে পাঠালেন। সন্ধির বিষয়বস্তু ছিল এইঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করবো না। কুরাইশরা মুসলিম হয়ে গেলে আমরাও মুসলিম হয়ে যাবো। যেসব গোত্র আমাদের সাথে একতাবদ্ধ হবে, তারাও এ চুক্তিতে আমাদের অংশীদার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ নং আয়াত নাযিল হয়।
তৃতীয় বর্ণনাঃ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত আছে যে, ৯১ নং আয়াতে আসাদ ও গাতফান গোত্রদ্বয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। তারা মদীনায় এসে বাহ্যতঃ নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করতো এবং স্বগোত্রের কাছে বলতো আমরা তো বানর ও বিচ্ছুদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তারাই আবার মুসলিমদের কাছে বলত, আমরা তোমাদের দ্বীনে আছি।
মোটকথা, এখানে তিন দল লোকের কথা উল্লেখিত হয়েছেঃ এক. মুসলিম হওয়ার জন্য যে সময় হিজরত করা শর্ত সাব্যস্ত হয়, সে সময় সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা হিজরত না করে কিংবা হিজরত করার পর দারুল ইসলাম ত্যাগ করে দারুল হারবে চলে যায়। দুই. যারা স্বয়ং মুসলিমদের সাথে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি করে কিংবা এরূপ চুক্তিকারীদের সাথে চুক্তি করে। তিন. যারা সাময়িকভাবে বিপদ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তিচুক্তি করে অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহবান জানানো হলে তাতে অংশগ্রহণ করে এবং চুক্তিতে কায়েম না থাকে।
প্রথম দল সাধারণ কাফেরদের মত। দ্বিতীয় দল হত্যা ও ধরপাকড়ের আওতা বহির্ভূত এবং তৃতীয় দল প্রথম দলের অনুরূপ শাস্তির যোগ্য। এসব আয়াতে মোট দু’টি বিধান উল্লেখিত হয়েছে; অর্থাৎ সন্ধিচুক্তি না থাকা কালে যুদ্ধ এবং সন্ধিচুক্তি থাকাকালে যুদ্ধ নয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এখানে জিজ্ঞাসা অস্বীকৃতি সূচক। অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে এই মুনাফিকদের ব্যাপারে কোন মতবিরোধ হওয়া উচিত ছিল না। আর মুনাফিকদের বলতে সেই মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা উহুদ যুদ্ধে মদীনা থেকে কিছু দূর গিয়ে এই বলে ফিরে চলে এসেছিল যে, আমাদের কথা গ্রহণ করা হয় নি। (বুখারীঃ সূরা নিসা, মুসলিমঃ মুনাফ্বীকীন অধ্যায়) এর বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে হয়েছে। সে সময় এই মুনাফিকদের নিয়ে মুসলিমদের দু’টি দল হয়েছিল। একটি দলের বক্তব্য ছিল, আমাদেরকে এই মুনাফিকদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করা দরকার। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় দল এটাকে বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী মনে করত।
[২] كَسَبُوا (কৃতকর্ম) বলতে রসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা এবং জিহাদ থেকে বিমুখতা অবলম্বন করা। أَرْكَسَهُمْ (বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন বা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন) অর্থাৎ, যে কুফরী ও ভ্রষ্টতা থেকে বের হওয়ার কথা, তার দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন অথবা তার কারণে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
[৩] যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন অর্থাৎ, অব্যাহত কুফরী ও ঔদ্ধত্যের কারণে যাদের অন্তঃকরণ মোহর করে দেন, তাদেরকে কেউ সুপথে আনতে পারবে না।
[৪] হিজরত (দ্বীনের জন্য স্বদেশত্যাগ) করলে প্রমাণিত হয় যে, এখন সে নিষ্ঠাবান মুসলিমে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা বৈধ।
[৫] তাতে তা ‘হিল্ল’ (যেখানে হত্যাকান্ড বৈধ সেখানে) হোক অথবা ‘হারাম’ (যেখানে হত্যাকান্ড বৈধ নয় সেখানে) হোক, যখন তোমরা তাদেরকে নিজেদের কাবুতে পেয়ে যাবে।
[৬] অর্থাৎ, যাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্য হতে দুই শ্রেণীর মানুষ এই নির্দেশ থেকে স্বতন্ত্র। একঃ এমন লোক যার সম্পর্ক এমন জাতির সাথে আছে, যাদের সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি হয়ে আছে অথবা সে এমন লোক যে তাদের আশ্রয়ে আছে, যাদের সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি হয়ে আছে। দুইঃ এমন লোক যারা তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় আসে যে, তাদের হৃদয় নিজেদের জাতির সাথে মিলে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অথবা তোমাদের সাথে মিলে নিজেদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে বড় সংকীর্ণতা বোধ করে। অর্থাৎ, না তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করতে পছন্দ করে, না তোমাদের বিরুদ্ধে।
[৭] অর্থাৎ, তাদেরকে যুদ্ধ করা থেকে বিরত রাখাটা আল্লাহরই অনুগ্রহের ব্যাপার। তা না হলে যদি মহান আল্লাহ তাদের অন্তরে স্বীয় জাতির পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করার খেয়াল সৃষ্টি করে দিতেন, তাহলে তারাও তোমাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করত। কাজেই সত্য-সত্যই যদি এরা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে, তাহলে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করো না।
[৮] ‘তোমাদের নিকট থেকে পৃথক হয়ে যায়, তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট সন্ধি প্রার্থনা করে’ এ সবের অর্থ একই। তাকীদ এবং অধিক স্পষ্টভাবে বর্ণনার জন্য তিন ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে মুসলিম তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। কারণ, যে পূর্ব থেকেই যুদ্ধ হতে পৃথক এবং তাদের এই পৃথকতায় মুসলিমদের লাভও রয়েছে; আর এই জন্য মহান আল্লাহ এটাকে অনুগ্রহ ও দয়া স্বরূপ উল্লেখ করেছেন, সুতরাং তাদেরকে ঘাঁটানো এবং তাদের ব্যাপারে অসতর্কতা অবলম্বন করা তাদের মধ্যে বিরোধিতা এবং বিদ্রোহের প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারে; যা মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত তারা উল্লিখিত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না। এর দৃষ্টান্ত সেই গোষ্ঠীও বটে, যাদের সম্পর্ক ছিল বানী-হাশেমের সাথে। এরা বদর যুদ্ধে মুশরিকদের সাথ দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার তাদের কোনই ইচ্ছা ছিল না। যেমন, রসূল (সাঃ)-এর চাচা আব্বাস (রাঃ) প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ যাঁরা তখন পর্যন্তও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই বাহ্যিকভাবে কাফেরদের তাঁবুতেই ছিলেন। আর এই জন্যই নবী করীম (সাঃ) আব্বাস (রাঃ)-কে হত্যা না করে কেবল বন্দী করেই ক্ষান্ত হন। سَلَمٌ (শান্তি) এখানে مُسَالَمَةٌ (শান্তিপ্রস্তাব) অর্থাৎ, সন্ধি করার অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
[৯] এরা হল তৃতীয় আর একটি দল, যারা ছিল মুনাফিক। এরা মুসলিমদের কাছে এসে ইসলামের প্রকাশ করত, যাতে তাদের (মুসলিমদের) হাত হতে নিরাপদে থাকে। আর যখন স্বীয় জাতির নিকট যেত, তখন তাদের সাথে শিরক ও মূর্তিপূজায় লিপ্ত হত, যাতে তারা এদেরকে নিজেদেরই দলভুক্ত মনে করে। এইভাবে তারা উভয় থেকেই স্বার্থ লাভ করত।
[১০] الفِتْنَة (ফিতনা)এর অর্থ শিরকও হতে পারে। أُرْكِسُوا فِيْهَا এই শিরকের মধ্যেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অথবা ‘ফিৎনা’র অর্থ যুদ্ধ। অর্থাৎ, যখন তাদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ফিরানো হত, তখন তারা সেদিকে আগ্রহের সাথে অগ্রসর হত।
[১১]يُلْقُوا এবং يَكُفُّوا এদের সংযোগ হল, يَعْتَزِلُوكُمْ এর সাথে। অর্থাৎ, সবই নেতিবাচক অর্থে। সবের সাথে لَم যোগ হবে।
[১২] এই কথার উপর যে, বাস্তবিকই তাদের হৃদয় মুনাফিক্বীতে এবং তোমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও হিংসায় পরিপূর্ণ। তাই তো তারা সামান্য প্রচেষ্টায় পুনরায় ফিৎনায় (শিরক অথবা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে) লিপ্ত হয়ে পড়ে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুনাফিকদের শ্রেণি বিন্যাস সম্পর্কে জানতে পারলাম।
২. মুনাফিকদের সাথে কিভাবে মুয়ামালাত করব তা জানতে পারলাম।
৩. মুনাফিকদেরকে কখন হত্যা করা যাবে তা জানতে পারলাম।