أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٤٢)-৩৪৪
www.motaher21.net
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَن يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَـًٔا ۚ
কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করা কোন বিশ্বাসীর জন্য সংগত নয়,
It is not for a believer to kill a believer except by mistake;
সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-৯২-৯৩
وَ مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ اَنْ یَّقْتُلَ مُؤْمِنًا اِلَّا خَطَــٴًـاۚ وَ مَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَــٴًـا فَتَحْرِیْرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَةٍ وَّ دِیَةٌ مُّسَلَّمَةٌ اِلٰۤى اَهْلِهٖۤ اِلَّاۤ اَنْ یَّصَّدَّقُوْاؕ فَاِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ عَدُوٍّ لَّكُمْ وَ هُوَ مُؤْمِنٌ فَتَحْرِیْرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَةٍؕ وَ اِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍۭ بَیْنَكُمْ وَ بَیْنَهُمْ مِّیْثَاقٌ فَدِیَةٌ مُّسَلَّمَةٌ اِلٰۤى اَهْلِهٖ وَ تَحْرِیْرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَةٍۚ فَمَنْ لَّمْ یَجِدْ فَصِیَامُ شَهْرَیْنِ مُتَتَابِعَیْنِ٘ تَوْبَةً مِّنَ اللّٰهِؕ وَ كَانَ اللّٰهُ عَلِیْمًا حَكِیْمًا
কোন মুমিনের কাজ নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা, তবে ভুলবশত হতে পারে। আর যে ব্যক্তি ভুলবশত কোন মুমিনকে হত্যা করে তার কাফ্ফারা হিসেবে একজন মুমিনকে গোলামী থেকে মুক্ত করে দিতে হবে এবং নিহত ব্যক্তির ওয়ারিসদেরকে রক্ত মূল্য দিতে হবে তবে যদি তারা রক্ত মূল্য মাফ করে দেয় তাহলে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু যদি ঐ নিহত মুসলিম ব্যক্তি এমন কোন জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে তাহলে একজন মুমিন গোলামকে মুক্ত করে দেয়াই হবে তার কাফ্ফারা। আর যদি সে এমন কোন অমুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে, তাহলে তার ওয়ারিসদেরকে রক্ত মূল্য দিতে হবে এবং একজন মুমিন গোলামকে মুক্ত করে দিতে হবে।আর যে ব্যক্তি কোন গোলাম পাবে না তাকে পরপর দু’মাস রোযা রাখতে হবে। এটিই হচ্ছে এই গোনাহের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে তাওবা করার পদ্ধতি। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানময়।
আয়াত :- ৯৪
وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهُۥ جَهَنَّمُ خٰلِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُۥ وَأَعَدَّ لَهُۥ عَذَابًا عَظِيمًا
আর যে ইচ্ছাকৃত কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর আল্লাহ তার উপর ক্রুদ্ধ হবেন, তাকে লা‘নত করবেন এবং তার জন্য বিশাল আযাব প্রস্তুত করে রাখবেন।
৯২-৯৩ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
ইরশাদ হচ্ছেঃ “কোন মুমিনের উচিত নয় যে, সে তার কোন মুমিন ভাইকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে মুসলমান সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তা’আলা ছাড়া কেউ মা’বুদ নেই এবং আমি তাঁর রাসূল, তার রক্ত হালাল নয়, কিন্তু তিনটির মধ্যে যে কোন একটি কারণে (হত্যা করা বৈধ)। (১) কাউকে হত্যা করা, (২) বিবাহিত অবস্থায় ব্যভিচার করা এবং (৩) ধর্ম ত্যাগ করে দল হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া। এ তিনটি কাজ কারও দ্বারা সংঘটিত হলে প্রজাদের মধ্যে কারও তাকে হত্যা করার অধিকার নেই বরং এটা হচ্ছে ইমাম বা তাঁর প্রতিনিধির অধিকার। এরপরে (আরবী) রয়েছে এবং এটা হচ্ছে (আরবী) যেমন নিম্নের কবিতায় রয়েছেঃ (আরবী) এ আয়াতের শান-ই-নকূলে একটি উক্তি এই বর্ণিত আছে যে, এটা আবু জেহেলের বৈপিত্রেয় ভাই আইয়াশ ইবনে আবু রাবীআর (রাঃ) ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। তাঁর মাতার নাম আসমা বিনতে মুখরামা। তিনি একটি লোককে হত্যা করেছিলেন। লোকটির নাম ছিল হাস ইবনে ইয়াযীদ আল গামেদী।
ঘটনা এই যে, হযরত আইয়াশ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর ভাই আবু জেহেলের সঙ্গে হাস ইবনে ইয়াযীদ যোগ দিয়ে তাকে শাস্তি প্রদান করে। ফলে তিনি মনে সংকল্প করেন যে, সুযোগ পেলেই হাস ইবনে ইয়াযীদকে হত্যা করবেন। কিছু দিন পর হাও মুসলমান হয়ে যায় এবং হিজরতও করে। হযরত আইয়াশ (রাঃ) কিন্তু এ খবর জানতেন না। মক্কা বিজয়ের দিন সে তার চোখে পড়ে যায় এবং এখনও সে কুফরীর উপরই রয়েছে এই মনে করে হঠাৎ তার উপর আক্রমণ করতঃ তাকে হত্যা করে ফেলেন। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
অন্য উক্তি এই যে, এ আয়াজটি হযরত আবু দারদা (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ঘটনা এই যে, তিনি একজন কাফিরের উপর তরবারী উঠিয়েছেন এমন সময় সে ঈমানের কালেমা পাঠ করে। কিন্তু হযরত আবু দারদা (রাঃ) তার উপর তরবারী বসিয়েই দেন এবং লোকটি নিহত হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে ঘটনাটি বর্ণিত হলে হযরত আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, সে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে কালেমা পড়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তুমি কি তার অন্তর ফেড়ে দেখেছিলে?’ এ ঘটনাটি বিশুদ্ধ হাদীসেও রয়েছে কিন্তু সেখনে অন্য সাহাবীর নাম আছে।
অতঃপর ভ্রমবশতঃ হত্যার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, কোন মুসলমান যদি অপর কোন মুসলমানকে ভ্রমবশতঃ হত্যা করে তবে দু’টো জিনিস ওয়াজিব হবে। প্রথম হচ্ছে একটি দাসকে মুক্ত করা এবং দ্বিতীয় হচ্ছে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা-বিনিময় প্রদান করা। ঐ দাসের ব্যাপারে আবার শর্ত এই যে, তাকে হতে হবে মুমিন। কাফির দাসকে মুক্ত করলে তা যথেষ্ট হবে না এবং ছোট নাবালক দাসও যথেষ্ট হবে না যে পর্যন্ত সে স্বেচ্ছায় ঈমান আনয়নের মত বয়স প্রাপ্ত না হবে।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর মনোনীত উক্তি এই যে, ঐ ছেলের বাপ-মা দু’জনই যদি মুসলমান হয় তবে যথেষ্ট হবে, নচেৎ হবে না। জমহূরের মাযহাব এই যে, মুসলমান হওয়া শর্ত, ছোট বা বড় হওয়ার কোন শর্ত নেই।
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, একজন আনসারী (রা) কৃষ্ণবর্ণের একটি দাসী নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! একটি মুসলমান দাস বা দাসী মুক্ত করার দায়িত্ব আমার উপর রয়েছে। যদি এ দাসীটিকে আপনি মুসলমান মনে করেন তবে আমি তাকে মুক্ত করে দেবো’। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন ঐ দাসীটিকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই?’ সে বলেঃ হ্যা।’ তিনি বলেনঃ তুমি কি এ সাক্ষ্যও দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল?’ সে বলে, “হ্যা।’ তিনি বলেনঃ মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর তোমার বিশ্বাস আছে কি? সে বলে, “হ্যা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন আনসারীকে বলেনঃ ‘তাকে আযাদ করে দাও।’ এ হাদীসের ইসনাদ বিশুদ্ধ এবং ঐ সাহাবী কে ছিলেন তা গুপ্ত থাকা সনদের পক্ষে ক্ষতিকর নয়।
এ বর্ণনাটি হাদীসের অরিও বহু পুস্তকে নিম্নরূপে বর্ণিত রয়েছেঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) দাসীটিকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘আল্লাহ কোথায় আছেন? সে বলে, ‘আকাশে।’ তিনি বলেনঃ “আমি কে? সে বলে, “আপনি আল্লাহ রাসূল (সঃ)’। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন সাহাবীকে বলেনঃ ‘তাকে আযাদ করে দাও, সে মুমিন। তাহলে ভ্রমবশতঃ হত্যার কারণে এক তো গোলাম আযাদ করা ওয়াজিব ও দ্বিতীয় হচ্ছে রক্তপণ আদায় করা ওয়াজিব যা নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনকে সমর্পণ করতে হবে। এটাই হচ্ছে তার হত্যার বিনিময়। এ রক্তপণ হচ্ছে একশটি উট এবং এগুলো হবে পাঁচ প্রকারের। (১) বয়স প্রথম বছর পেরিয়ে দ্বিতীয় বছরে পড়েছে এরূপ বিশটি উষ্ট্ৰী। (২) এ বয়সেরই বিশটি উষ্ট্র। (৩) দ্বিতীয় বছর পেরিয়ে তৃতীয় বছরে পড়েছে এরূপ বিশটি উষ্ট্ৰী। (৪) তৃতীয় বছর পেরিয়ে চতুর্থ বছরে পড়েছে এরূপ বিশটি উষ্ট্রী। (৫) চতুর্থ বছর পেরিয়ে পঞ্চম বছরে পড়েছে এরূপ বিশটি উষ্ট্রী। এটাই হচ্ছে ভ্রমে হত্যার বিনিময় যা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফায়সালা করেছেন। (সুনান ও মুসনাদ-ই-আহমাদ)
এ হাদীসটি হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে মাওকুফ রূপেও বর্ণিত আছে। হযরত আলী (রাঃ) এবং একটি জামাআত হতেও এটাই নকল করা হয়েছে। এও বলা হয়েছে যে, এ রক্তপণ চার প্রকারেও বন্টন করা হয়েছে। এ রক্তপণে হত্যাকারীর ‘আকেলার’ উপর ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ তার প্রকৃত উত্তরাধিকারীদের পরের নিকটতম আত্মীয়দের উপর ওয়াজিব হবে। ইমাম শাফিঈ (রঃ) বলেনঃ এ বিষয়ে আমি কোন বিপরীত মতপোষণকারী পাইনি যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) রক্তপণের ফায়সালা এ লোকদের উপর করেছেন। এটা-ই-খাসসাহ হতে অধিক। ইমাম শাফিঈ (রঃ) যে হাদীসগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন ঐগুলো অনেক রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুযাইল গোত্রের দু’টি মহিলা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়। একজন অপরজনকে একটি পাথর মেরে দেয়। সে গর্ভবতী ছিল। সন্তানও নষ্ট হয়ে যায় এবং সেও মারা যায়। ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে বর্ণিত হলে তিনি ফায়সালা দেন যে, এ শিশুর রক্তপণ হচ্ছে একটি প্রাণ, দাস বা দাসী এবং ঐ নিহত মহিলার রক্তপণ ওয়াজিব হবে হত্যাকারিণীর প্রকৃত উত্তরাধিকারীদের পরবর্তী আত্মীয়দের উপর। এর দ্বারা এও জানা গেল যে, যে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা ভুল বশতঃ হয়ে যায়, রক্তপণ হিসেবে তার হুকুম শুধু ভুল বশতঃ হত্যার মতই। কিন্তু ঐ অবস্থায় বন্টন হবে তিনের উপর। কেননা, সেখানে ইচ্ছাপূর্বক হত্যার সঙ্গেও সামঞ্জস্য রয়েছে।
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ)-কে একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে খুযাইমা গোত্রের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি তথায় গিয়ে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করলো বটে কিন্তু অজ্ঞতা বশতঃ (আরবী) অর্থাৎ আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম’-এ কথার পরিবর্তে (আরবী) অর্থাৎ আমরা বেদ্বীন হয়ে গেলাম এ কথা বললো। হযরত খালিদ (রাঃ) তাদেরকে হত্যা করতে আরম্ভ করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এ সংবাদ পৌছলে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে আরয করেনঃ “হে আল্লাহ! আমি খালিদ (রাঃ)-এর এ কার্যে আপনার নিকট অসন্তোষ প্রকাশ করছি এবং নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করছি।’
অতঃপর তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে খুযাইমা গোত্রের নিকট পাঠিয়ে দেন এবং তাদের নিহতদের রক্তপণ এবং আর্থিক সমস্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করেন। এর দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, ইমাম বা তাঁর প্রতিনিধির ভুলের বোঝা বায়তুলমালকেই বহন করতে হবে।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলেন-‘রক্তপণ ওয়াজিব বটে, কিন্তু যদি নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন স্বেচ্ছায় রক্তপণ ক্ষমা করে দেয় তবে তা করার অধিকার তাদের রয়েছে। তারা ওটা সাদকা হিসেবে ক্ষমা করে দিতে পারে। এরপর ঘোষণা করা হচ্ছে- নিহত ব্যক্তি যদি মুসলমান হয় কিন্তু তার আত্মীয়-স্বজন। অমুসলিম রাষ্ট্রের কাফির হয় তবে হত্যাকারীর দায়িত্বে রক্তপণ নেই। ঐ অবস্থায় তাকে শুধু গোলাম আযাদ করতে হবে। আর যদি নিহত ব্যক্তির অলী ও উত্তরাধিকারী এমন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, যাদের সঙ্গে তোমাদের সন্ধি ও চুক্তি রয়েছে, তবে রক্তপণ আদায় করতে হবে। আর যদি নিহত ব্যক্তি কাফির হয় তবে কারও মতে পূর্ণ রক্তপণ দিতে হবে, কারও মতে অধিক দিতে হবে এবং কারও মতে এক তৃতীয়াংশ দিতে হবে। এর বিস্তারিত বিবরণ আহকামের পুস্তকগুলোতে দ্রষ্টব্য। হত্যাকারীকে একজন মুমিন গোলাম আযাদ করতে হবে। দারিদ্রতা বশতঃ যদি কোন ব্যক্তি তাতে সক্ষম না হয় তবে তাকে ক্রমাগত দু’মাস রোযা রাখতে হবে। রোগ, হায়েয, নিফাস ইত্যাদির মত কোন শরীয়ত সম্মত ওযর ছাড়াই মধ্যে কোন একদিন যদি রোযা ছেড়ে দেয় তবে আবার নতুনভাবে রোযা শুরু করতে হবে। সফরের ব্যাপারে দুটি উক্তি রয়েছে। প্রথম উক্তি এই যে, এটাও একটি শরীয়ত সমর্থিত ওযর। দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এটা একটি শরীয়ত সমর্থিত ওযর নয়।
এরপরে বলা হচ্ছে- ভ্রমবশতঃ হত্যার তাওবার উপায় এই যে, গোলাম আযাদ করতে না পারলে ক্রমাগত দুমাস রোযা রাখতে হবে। যদি রোযা রাখতেও সক্ষম না হয় তবে ষাটটি মিসকীনকে খানা খেতে দেয়া তার উপর ওয়াজিব কি-না এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একটি উক্তি এই যে, রোযা রাখতে না পারলে ৬০টি মিসকীনকে খানা খেতে দিতে হবে। যেমন যিহারের কাফফারায় রয়েছে। সেখানে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এখানে স্পষ্টভাবে বর্ণনা না করার কারণ এই যে, এটা হচ্ছে ভীতি প্রদর্শনের স্থান। সুতরাং সহজ পন্থা যদি বলে দেয়া হতো তবে আতংক ও সন্ত্রাস এতটা প্রকাশ পেতো না। দ্বিতীয় উক্তি এই যে, রোযার পরে আর কিছুই নেই। যদি থাকতো তবে সাথে সাথেই বর্ণনা করে দেয়া হতো। প্রয়োজনের সময় হতে বর্ণনাকে পিছিয়ে দেয়া ঠিক নয়। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, বিজ্ঞানময়’ -এর তাফসীর ইতিপূর্বে কয়েক জায়গায় বর্ণিত হয়েছে।
ভ্রমবশতঃ হত্যার বর্ণনার পর এখন ইচ্ছাপূর্বক হত্যার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। এর কঠিন ভীতিযুক্ত শাস্তির কথা বলা হচ্ছে। এটা এমন একটা পাপ যাকে শিকের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘মুমিন তারাই যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে মা’বৃদরূপে খাড়া করে না এবং তারা কোন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না।’ (২৫:৬৮)
অন্য জায়গায় ঘোষিত হচ্ছেঃ (আরবী) (৬:১৫১) এখানেও আল্লাহ তা’আলা হারামকৃত কার্যাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে শির্ক ও হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে আরও বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম রক্তের ফায়সালা করা হবে। সুনান-ই-আবি দাউদে হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ মুমিন পুণ্যে ও মঙ্গলে বেড়ে চলে যে পর্যন্ত না সে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে। যখন সে এটা করে তখন সে ধ্বংস হয়ে যায়। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, আল্লাহ আ’আলার নিকট সারা জগতের পতন একজন মুসলমানের হত্যা অপেক্ষা হালকা।
অন্য হাদীসে রয়েছে যে, যদি সারা ভূপৃষ্ঠের ও আকাশের অধিবাসী একজন মুসলমানকে হত্যার কাজে একত্রিত হয় তবে আল্লাহ সকলকেই উল্টো মুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। আর একটি হাদীসে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে হত্যার ব্যাপারে অর্ধেক কথা দিয়েও সাহায্য করে, সে কিয়ামতের দিন ঐ অবস্থায় উঠবে যে, তার কপালে লিখা থাকবেঃ এ ব্যক্তি আল্লাহর করুণা হতে বঞ্চিত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি তো এই যে, যে ব্যক্তি মুমিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে তার তাওবা কবুলই হয় না। কুফাবাসী এ মাসআলায় মতভেদ করলে হযরত ইবনে যুবাইর (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) -কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। তখন তিনি বলেন (২৫:৬৮) -এটা শেষ আয়াত যাকে অন্য কোন আয়াত রহিত করেনি। তিনি আরও বলেনঃ (আরবী) -এ আয়াতটি মুশরিকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়।
অতএব যখন কোন লোক ইসলামের অবস্থায় শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়াই কোন মুসলমানকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম এবং তার তাওবা গ্রহণীয় হবে না। হযরত মুজাহিদ (রঃ) যখন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর এ বর্ণনাটি শ্রবণ করেন তখন বলেন, কিন্তু যে অনুতপ্ত হয়। হযরত সালেম ইবনে আবুল জাদ (রঃ) বলেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) যখন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন সে সময় একদা আমরা তাঁর নিকটে বসেছিলাম। এমন সময় একটি লোক এসে তাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিয়ে বলে, “যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে জেনে শুনে হত্যা করে তার সম্বন্ধে আপনি কি বলেন? তিনি বলেন, তার শাস্তি জাহান্নাম যার মধ্যে সে সদা অবস্থান করবে। আল্লাহ তাআলা তার উপর রাগান্বিত, তার উপর তার অভিসম্পাত রয়েছে এবং তার জন্যে রয়েছে ভীষণ শাস্তি।’ লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করে, যদি সে তাওবা করতঃ ভাল কাজ করে এবং হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়?’ তিনি বলেন, তার মা তার জন্যে ক্রন্দন করুক, তার তাওবা ও সুপথ প্রাপ্তি কোথায়? যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! আমি তোমাদের নবী (সঃ) হতে শুনেছি ও তার মা তার জন্যে কাঁদুক, যে কোন মুমিনকে জেনে শুনে হত্যা করেছে সে নিহত ব্যক্তি কিয়ামতের দিন তাকে স্বীয় ডান বা বাম হস্তে ধরে নিয়ে রহমানের আরশের সামনে আনবে এবং ডান হাতে বা বাম হাতে স্বীয় মস্তক ধারণ করবে। তার শিরায় শিরায় রক্ত টগবগ করবে এবং সে আল্লাহ তা’আলাকে বলবে হে আল্লাহ! সে আমাকে কেন হত্যা করেছিল তা তাকে জিজ্ঞেস করুন। যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়র পর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত একে রহিতকারী কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়নি।
অন্য বর্ণনায় এটুকু বেশীও রয়েছেঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)- এর ইন্তেকালের পর কোন অহী অবতীর্ণ হবে না।’ হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ), হযরত আবু সালমা ইবনে আবদুর রহমান (রাঃ), হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনে উমায়ের (রঃ), হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) এবং হযরত যহহাকও (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতের সঙ্গে রয়েছেন।
তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি স্বীয় হত্যাকারীকে ধরে আল্লাহ তা’আলার সামনে নিয়ে আসবে এবং অন্য হাতে স্বীয় মস্তক ধারণ করবে, অতঃপর বলবেঃ “ হে আমার প্রভু! সে আমাকে কেন হত্যা করেছিল তা তাকে জিজ্ঞেস করুন। তখন হত্যাকারী বলবে, আমি তাকে হত্যা করেছিলাম যেন আপনার মর্য য়। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “নিশ্চয়ই ওটা আমার জন্যে।
অন্য একজন নিহত ব্যক্তি তার হত্যাকারীকে ধরে নিয়ে আসবে এবং বলবেঃ “হে আমার প্রভু! এ লোকটি কেন আমাকে হত্যা করেছিল তা তাকে জিজ্ঞেস করুন।’ হত্যাকারী তখন বলবে, আমি তাকে হত্যা করেছিলাম যেন অমুকের সম্মান বৃদ্ধি পায়। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ ‘ওটা তার জন্যে নয়। তুমি তার পাপের বোঝা নিয়ে ফিরে যাও।’ অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, সত্তর বছরে সে ঐ গর্তের তলদেশে পৌছবে।
মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “খুব সম্ভব আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক পাপ মার্জনা করবেন, কিন্তু শুধু ঐ ব্যক্তিকে (ক্ষমা করবেন না) যে কুফরীর অবস্থায় মারা যায়, অথবা ঐ ব্যক্তিকে (মার্জনা করবেন না) যে কোন মুমিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে ।
তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে ইবনে যাকারিয়া (রঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি উম্মু দারদা (রাঃ) হতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি আবু দারদা (রাঃ) হতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “খুব সম্ভব আল্লাহ্ তা’আলা সমস্ত পাপ মার্জনা করবেন, কিন্তু (মার্জনা করবেন না) যে মুশরিক হয়ে মরেছে বা যে কোন মুমিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করেছে।” এ হাদীসটি দুর্বল। হযরত মু’আবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটিই রক্ষিত।
তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে, সে মহাসম্মানিত আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করে।’ এ হাদীসটি মুনকার এবং এর ইসনাদেও বহু সমালোচনা রয়েছে।
মুসনাদ-ই-আত্মাদে রয়েছে, হযরত হুমায়েদ (রঃ) বলেন, আমার নিকট হযরত আবুল আলিয়া আগমন করেন। সে সময় আমার নিকট আমার এক বন্ধুও ছিলেন। তিনি আমাদেরকে বলেন, “তোমরা দু’জন আমার অপেক্ষা বয়সে ছোট এবং আমার চেয়ে তোমাদের হাদীসও বেশী মনে রয়েছে, চল আমরা বাশার ইবনে আসেম (রঃ)-এর নিকট গমন করি। আমরা তথায় পৌছলে হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) হযরত বাশার (রঃ)-কে বলেনঃ ‘এদেরকেও ঐ হাদীসটি শুনিয়ে দিন। তিনি তখন হাদীসটি শুনাতে আরম্ভ করেন। হযরত উকবা ইবনে মালিক লাইসী (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি ছোট সেনাদল প্রেরণ করেন। তারা একটি গোত্রের উপর আক্রমণ চালায়। গোত্রের লোকগুলো পালিয়ে যায়। তাদের সাথে অন্য একটি লোকও পালিয়ে যাচ্ছিল। মুসলিম সৈন্যদের একজন তার পশ্চাদ্ধাবন করে এবং খোলা তরবারী নিয়ে তার নিকট পৌছে যায়। তখন লোকটি বলে, ‘আমি তো মুসলমান। মুসলিম সৈন্যটি তার কথার উপর কোনই গুরুত্ব না দিয়ে তাকে হতা করে ফেলে। এ সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং কঠোর উক্তি করেন। হত্যাকারীও এ সংবাদ পেয়ে যায়। একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় ঐ হত্যাকারী বলে, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লোকটি তো এ কথা শুধু প্রাণ রক্ষার উদ্দেশ্যেই বলেছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন এবং ভাষণ দিতেই থাকেন। লোকটি দ্বিতীয়বার ঐ কথাই বলে। কিন্তু এবারেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুখ ফিরিয়ে নেন। সে ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে তৃতীয়বার বলে, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লোকটি তো শুধু প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই এ কথা বলেছিল। এবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার প্রতি মননাযোগী হন এবং তার চেহারায় অসন্তোষের লক্ষণ প্রকাশ পায়, তিনি বলেনঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা মুমিনের হত্যাকারীর উপর অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ কথা তিনি তিনবার বলেন। এ বর্ণনাটি সুনান-ই-নাসাঈর মধ্যেও রয়েছে।
অতএব একটি মাযহাব তো হলো এই যে, জেনে শুনে হত্যাকারীর তাওবা গ্রহণীয় নয়। দ্বিতীয় মাযহাব এই যে, তাওবা তার ও আল্লাহ তা’আলার মাঝে রয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জমহরের মাযহাব এটাই যে, সে যদি তাওবা করে, আল্লাহ তা’আলার দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়, বিনয় প্রকাশ করে এবং সৎকার্যাবলী সম্পাদন করতে থাকে তবে আল্লাহ তাআলা তার তাওবা গ্রহণ করবেন এবং নিহত ব্যক্তিকে স্বীয় পক্ষ হতে বিনিময় প্রদান করতঃ সন্তুষ্ট করবেন। আল্লাহ তা’আলা : (আরবী) হতে (আরবী) (২৫:৬৮-৬৯) পর্যন্ত আয়াত গুলোর মধ্যে যা বলেছেন তা হচ্ছে (আরবী) এবং (আরবী) -এর মধ্যে রহিতকরণের সম্ভাবনাই নেই। আর ঐ আয়াতটি মুশরিকদের জন্যে এবং এ আয়াতকে মুমিনের জন্যে নির্দিষ্ট করা প্রকাশ্যের বিপরীত এবং কোন দলীলের মুখাপেক্ষী। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে ভাল জানেন।
আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ হে আমার ঐ বান্দারা যারা নিজেদের জীবনের উপর বাড়াবাড়ি করেছো, তোমরা আমার করুণা হতে নিরাশ হয়ো না।’ (৩৯:৫৩) এ আয়াতটি সাধারণ, সুতরাং কুফরী, শিরুক, নিফাক, হত্যা ইত্যাদি সমস্ত পাপই এর অন্তর্ভুক্ত। এসব পাপকার্যে লিপ্ত হবার পর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার দিকে প্রত্যাবর্তিত হয় এবং তাওবা করে, আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) (৪:৪৮)-এ আয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলা শিরুক ছাড়া অন্যান্য সমস্ত পাপ ইচ্ছে করলে ক্ষমা করে দেবেন। এটা তাঁর একটা বড় অনুকম্পা যে, তিনি এ সূরার মধ্যেই এখন আমরা যে আয়াতের তাফসীর করছি এর পূর্বে একবার স্বীয় সাধারণ ক্ষমার আয়াত বর্ণনা করেছেন। এ আয়াতের পরই অনুরূপভাবে স্বীয় সাধারণ ক্ষমার কথা পুনরায় ঘোষণা করেছেন যেন আশা দৃঢ় হয়।
এখানে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের ঐ হাদীসটিও উল্লেখযোগ্য যাতে রয়েছে যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে একজন লোক একশোটি লোককে হত্যা করেছিল। অতঃপর সে একজন আলেমকে জিজ্ঞেস করে, “আমার তাওবা গৃহীত হবে কি? তিনি উত্তরে বলেন, তোমার মধ্যে ও তোমার তাওবার মধ্যে কে প্রতিবন্ধক হবে?’ অতঃপর তিনি তাকে পুণ্যময় শহরে গিয়ে আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করতে বলেন। অতএব সে ঐ শহরে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়। পথে সে মৃত্যু মুখে পতিত হয় এবং রহমতের ফেরেশতা এসে তাকে নিয়ে যান। এ হাদীসটিকে পূর্ণভাবে কয়েক জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। বানী ইসরাঈলের মধ্যেই যখন ক্ষমার এ ব্যবস্থা রয়েছে তখন আমাদের মধ্যে তো সে ক্ষমার ব্যবস্থা বহুগুণে বেশী থাকা উচিত। কেননা, বানী ইসরাঈল এমন বহু অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল যা থেকে আল্লাহ পাক আমাদেরকে মুক্ত রেখেছেন। আর তিনি বিশ্ব শান্তির দূত ও নবীদের নেতা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে পাঠিয়ে এমন ধর্ম তিনি আমাদেরকে দান করেছেন যা আকাশেও শান্তিদায়ক এবং পৃথিবীতেও শান্তিদায়ক। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে সরল ও পরিষ্কার ধর্ম। কাজেই এখানে হত্যাকারীর তাওবার দরজা বন্ধ হবে কেন?
তাহলে এখানে হত্যাকারীর যে শাস্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার ভাবার্থ এই যে, তার শাস্তি হচ্ছে এই যদি আল্লাহ তা’আলা শাস্তি দেন। যেমন আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং পূর্বযুগীয় মনীষীদের একটি দল একথাই বলেন। এমনকি এ অর্থবোধক একটি হাদীসও তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সনদ হিসেবে হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়। অনুরূপভাবে প্রত্যেক শাস্তির ভয় প্রদর্শনের ভাবার্থ এই যে, ওর পিছনে যদি কোন সৎ আমল না থাকে তবে সে পাপের শাস্তি ওটাই হবে যে শাস্তির ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে ।
শাস্তির ভয় প্রদর্শনের ব্যাপারে আমাদের নিকট সঠিক ও উত্তম পন্থা এটাই। সত্য সম্বন্ধে আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন। আর হত্যাকারীর জাহান্নামী হওয়ার ব্যাপারেও এটা প্রযোজ্য যে, সে চিরদিন জাহান্নামে থাকবে না। তার জাহান্নামী হওয়া হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি অনুসারে তাওবা গৃহীত না হওয়ার কারণেই হোক বা জমহূরের উক্তি অনুযায়ী ওর পিছনে কোন সন্ধার্য থাকার কারণেই হোক।
এখানে (আরবী) শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে বহুদিন অবস্থান-চিরদিন অবস্থান নয়। যেমন হাদীস-ই-মুতাওয়াতির দ্বারা সাব্যস্ত আছে যে, জাহান্নাম থেকে ঐ ব্যক্তিও বের হবে যার অন্তরে সরিষার ছোট দানা পরিমাণও ঈমান রয়েছে। উপরে যে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যাতে বলা হয়েছেঃ “খুব সম্ভব আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক পাপই ক্ষমা করে দেবেন, কিন্তু (ক্ষমা করবেন না) যে কাফির হয়ে যাবে বা যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে জেনে শুনে হত্যা করবে।” এ হাদীসে (আরবী) শব্দটি হচ্ছে (আরবী) বা আশা উদ্দীপক। তাহলে এ দু’ অবস্থায় (কুফরী ও মুমিন হত্যা) যদিও আশা উঠে যায়, কিন্তু সংঘটন অর্থাৎ এরূপ ঘটে যাওয়া এ দুটোর মধ্যে একটিতে উঠে যায় না এবং সেটা হচ্ছে হত্যা। কেননা, শির্ক ও কুফরীর ক্ষমা না হওয়া তো কুরআন মাজীদের শব্দ দ্বারাই সাব্যস্ত হয়েছে। আর যে হাদীসগুলোর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, হত্যাকারী নিহত ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার নিকট ধরে আনবে সেগুলোও সম্পূর্ণরূপে সঠিক। এতে মানুষের অধিকার রয়েছে বলে তাওবা দ্বারা এ পাপ ক্ষমা হতে পারে না। বরং মানুষের হক তো তাওবার অবস্থাতেও হকদারকে পৌছিয়ে দিতে হবে। এতে যেমন হত্যা রয়েছে দ্রুপ চুরি, জবরদখল, অপবাদ এবং অনান্য হককুল ইবাদও রয়েছে। এগুলো তাওবা দ্বারা ক্ষমা না হওয়া ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। এ অবস্থায় তাওবার বিশুদ্ধতার জন্যে শর্ত হলো প্রাপকদের প্রাপ্যগুলো আদায় করে দেয়া। আর আদায় করা যখন অসম্ভব তখন কিয়ামতের দিন দাবীদারগণ দাবী অবশ্যই করবে। কিন্তু দাবী করলেই যে শাস্তি ঘটেই যাবে এটা জরুরী নয়। এও সম্ভব যে, হত্যাকারীর সমস্ত ভাল কাজের পুণ্য নিহত ব্যক্তিকে দেয়া হবে বা আংশিক পূণ্য দেয়া হবে এবং তাকে দেয়ার পরেও হয়তো হত্যাকারীর নিকট কিছু পণ্য থেকেও যাবে, আর ওর বিনিময়ে হয়তো আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আবার এটাও অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ তা’আলা স্বীয় পক্ষ হতে নিহত ব্যক্তিকে হর, প্রাসাদ, উচ্চ মর্যাদা এবং জান্নাত দিয়ে তার দাবী পূরণ করবেন এবং ওরই বিনিময়ে হয়তো সে তার হন্তাকে খুশী মনে ক্ষমা করে দেবে, ফলে আল্লাহ তাআলাও তাকে মাফ করবেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা সবচেয়ে ভাল জানেন। ইচ্ছাপূর্বক হত্যাকারীর জন্যে কিছু ইহলৌকিক নির্দেশ রয়েছে এবং কিছু পারলৌকিক নির্দেশ রয়েছে।
ইহজগতে তার উপর আল্লাহ তা’আলা নিহত ব্যক্তির অভিভাবককে প্রভুত্ব দান করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ যে ব্যক্তির অন্যায়ভাবে নিহত হয়েছে, আমি তার অভিভাবককে প্রভুত্ব দান করেছি।’ (১৭:৩৩) তার অধিকার রয়েছে যে, প্রতিশোধ নিতে পারে অর্থাৎ হত্যাকারীকেও হত্যা করাতে পারে কিংবা ক্ষমা করতে পারে, রক্তপণও আদায় করতে পারে। এর রক্তপণও খুব কঠিন। এটা তিন ভাগে বিভক্ত। (১) ত্রিশটি দিতে হবে ঐ উট যেগুলোর বয়স তিন বছর পার হয়ে চতুর্থ বছরে। পড়েছে। (২) ত্রিশটি দিতে হবে ঐ উট যেগুলো পঞ্চম বছরে পড়েছে। (৩) চল্লিশটি দিতে হবে গর্ভবতী উষ্ট্রী। এগুলো আহকামের পুস্তকসমূহে সাব্যস্ত রয়েছে। সজ্ঞানে হত্যাকারীর উপর গোলাম আযাদ করা বা একাধিক্রমে দু’মাস রোযা রাখা অথবা ষাটটি মিসকীনকে খানা খাওয়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে কি-না সে ব্যাপারে ইমামগণের মতভেদ রয়েছে।
ইমাম শাফিঈ (রঃ) ও তাঁর সহচরগণের ও আলেমদের একটি দলের উক্তি এই যে, ভ্রমবশতঃ হত্যায় যখন এ ব্যবস্থা রয়েছে তখন ইচ্ছাপূর্বক হত্যায় থাকাতে আরও যুক্তিযুক্ত। ঐগুলোর উপর উত্তর হিসেবে শরীয়ত অসম্মত, মিথ্যা শপথের কাফফারা পেশ করা হয়েছে এবং তাঁরা ইচ্ছাপূর্বক ছেড়ে দেয়া নামাযের কাযাকে তার ওযর বানিয়েছেন, যেমন ভুলের সময় তার উপর ইজমা রয়েছে।
ইমাম আহমাদ (রঃ)-এর সহচরগণ এবং অন্যান্যগণ বলেন যে, ইচ্ছাপূর্বক হত্যা কাফফারা হতে অনেক বড়। এজন্যেই তাতে কাফফারা নেই। অনুরূপভাবে মিথ্যা শপথ এবং ঐ দু’ অবস্থায়ও ইচ্ছাপূর্বক ছেড়ে দেয়া নামাযের মধ্যে পার্থক্য করণের তাঁদের কোন পথ নেই। কেননা, তারা ইচ্ছাপূর্বক ছেড়ে দেয়া নামাযের কাযা ওয়াজিব হওয়ার সমর্থক। পূর্বদলের একটি দলীল মুসনাদ-ই-আহমাদে বর্ণিত নিম্নের হাদীসটিও বটেঃ হযরত গারীফ ইবনে আইয়াশ আদদায়লামী (রঃ) বলেন, আমরা হযরত ওয়াসিলা ইবনে আসকা। (রাঃ)-এর নিকট এসে বলি, আমাদেরকে এমন একটি হাদীস শুনিয়ে দিন যাতে কোন কম বেশী থাকবে না।’ একথা শুনে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন-‘তোমরা যখন কুরআন কারীম নিয়ে পাঠ কর তখন তাতে কম বেশী কর না কি?’ তখন আমরা বলি, আমাদের উদ্দেশ্য এই যে, যা আপনি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছেন। তিনি তখন বলেন, আমরা আমাদের এমন একটি লোকের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট গিয়েছিলাম যে লোকটি হত্যার কারণে নিজেকে জাহান্নামী করে নিয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তার পক্ষ হতে একটি দাসকৈ মুক্ত কর। তার এক একটি অঙ্গের বিনিময়ে আল্লাহ ঐ লোকটির এক একটি অঙ্গ জাহান্নাম হতে মুক্ত করবেন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১২০) ওপরে যেসব মুনাফিক মুসলমানদেরকে হত্যা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এখানে তাদের কথা বলা হয়নি। বরং এখানে এমন মুসলমানদের কথা বলা হয়েছে যারা দারুল ইসলামের অধিবাসী অথবা দারুল হারব বা দারুল কুফরে অবস্থান করলেও ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের তৎপরতায় তাদের অংশগ্রহণের কোন প্রমাণ নেই। সে সময় এমন বহু লোকও ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করার পর নিজেদের যথার্থ অক্ষমতার কারণে ইসলামের শত্রু গোত্রদের মধ্যে অবস্থান করছিল। অনেক সময় এমন দুর্ঘটনা ঘটে যেতো, মুসলমানরা কোন ইসলাম দুশমন গোত্রের ওপর আক্রমণ চালাতো এবং সেখানে তাদের অজ্ঞতাবশত তাদের হাতে কোন মুসলমান মারা যেতো। তাই মহান আল্লাহ এখানে ভুলবশত মুসলমানের হাতে কোন মুসলমানের নিহত হবার বিষয় সম্পর্কিত বিধান বর্ণনা করেছেন।
টিকা:১২১) যেহেতু নিহত ব্যক্তি একজন মু’মিন, তাই একজন মু’মিন গোলামকে মুক্ত করে দেয়ায় তাকে হত্যা করার কাফ্ফারা গণ্য করা হয়েছে।
টিকা:১২২) নবী ﷺ রক্ত বিনিময়ের পরিমাণ এক শত উট, দুই শত গরু বা দুই হাজার ছাগল নির্ধারণ করেছেন।কোন ব্যক্তি যদি রক্তমূল্য হিসেবে অন্য কিছু দিতে চায় তাহলে এই জিনিসগুলোর বিক্রয়মূল্য ধরে তার পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে নগদ মুদ্রায় রক্তমূল্য দানকারীদের জন্য ৮ শত দীনার বা ৮ হাজার দিরহাম নির্ধারিত ছিল। হযরত উমর (রা.) তাঁর শাসনমলে বলেনঃ উটের দাম এখন বেড়ে গেছে। কাজেই এখন স্বর্ণমুদ্রায় এক হাজার দীনার বা রৌপ্যমুদ্রায় ১২ হাজার দিরহাম রক্ত মূল্য হিসেবে আদায় করতে হবে। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, রক্তমূল্যের এ পরিমাণটি জেনে বুঝে হত্যা করার জন্য নয় বরং ভুলবশত হত্যা করার জন্য নির্ধারিত হয়েছে।
টিকা:১২৩) এই আয়াতটির বিধানসমূহের সংক্ষিপ্তসার নীচে দেওয়া হলঃ একঃ নিহত ব্যক্তি যদি দারুল ইসলামের অধিবাসী হয় তাহলে তার হত্যাকারীকে রক্তমূল্য দিতে হবে এবং আল্লাহর কাছে নিজের গোনাহমাফীর জন্য একজন গোলামকেও মুক্ত করে দিতে হবে। দুইঃ যদি নিহত ব্যক্তি দারুল হারবের বাসিন্দা হয় তাহলে হত্যাকারী কেবলমাত্র গোলাম মুক্ত করে দেবে। তাকে কোন রক্তমূল্য দিতে হবে না। তিনঃ যদি নিহত ব্যক্তি এমন কোন দারুল কুফরের বাসিন্দা হয় যার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তি রয়েছে, তাহলে হত্যাকারী একজন গোলামকে মুক্ত করে দেবে এবং এছাড়াও রক্তমূল্যও দান করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে রক্তমূল্যের পরিমাণ তাই হবে, যা সে চুক্তিবদ্ধ জাতির একজন অমুসলিম অধিবাসীকে হত্যা করলে চুক্তি অনুযায়ী দিতে হয়।
টিকা:১২৪) অর্থাৎ একাদিক্রমে রোযা রাখতে হবে। মাঝখানে ফাঁক যাবে না। যদি কোন ব্যক্তি শরঈ ওযর ছাড়াই মাঝখানে একটি রোযাও ছেড়ে দেয় তাহলে তাকে আবার নতুন করে রোযা শুরু করতে হবে।
টিকা:১২৫) অর্থাৎ এটা ‘জরিমানা’ নয় বরং ‘তাওবা’ ও ‘কাফ্ফারা’। জরিমানায় লজ্জা, অনুতাপ ও আত্মসংশোধনের কোন অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি কার্যকর থাকে না। বরং সাধারণত অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে বাধ্য হয়েই জরিমানা আদায় করতে হয় এবং এরপরও ধূমায়িত অসন্তোষ ও তিক্ততার মনোভাব থেকেই যায়। বিপরীত পক্ষে মহান আল্লাহ চান, বান্দা এবাদাত-বন্দেগী, সৎকাজ ও অধিকার আদায় করার মাধ্যমে নিজের মন-মানসের ওপর থেকে নিজের ভুলের প্রভাব ধুয়ে মুছে ফেলবে এবং লজ্জা ও অনুতাপ সহকারে আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে। এভাবে সে কেবল এই গোনাহের ক্ষমা লাভ করবে না বরং এই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য সে এই ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি করা থেকেও নিজেকে সংরক্ষিত রাখতে পারবে। ‘ কাফ্ফারার’ শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, “গোপনকারী বস্তু”। কোন সৎকাজকে গোনাহের কাফ্ফারা গণ্য করার অর্থ হচ্ছে এই যে, এই নেকীটি ঐ গোনাহের ওপর ছেয়ে যায় এবং তাকে ঢেকে ফেলে। যেমন কোন দেয়ালের গায়ে দাগ লেগে গেলে চুনকাম করে দাগ মিটিয়ে দেয়া হয়।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] হত্যা সর্বমোট আট প্রকার। কেননা, নিহত ব্যক্তি হয়তো মুসলিম, কিংবা যিম্মী, অথবা চুক্তিবদ্ধ ও অভয়প্রাপ্ত, নতুবা দারুল হারবের কাফের হবে। এ চার অবস্থার কোন না কোন একটি হবেই। হত্যাকারী দু’প্রকারঃ হয় ইচ্ছাকৃত, না হয় ভুলবশতঃ। অতএব, মোট প্রকার হল আটটিঃ (এক) মুসলিমকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (দুই) মুসলিমকে ভুলবশতঃ হত্যা, (তিন) যিম্মীকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (চার) যিম্মীকে ভুলবশতঃ হত্যা, (পাঁচ) চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (ছয়) চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে ভুলবশতঃ হত্যা (সাত) হারবী কাফেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা এবং (আট) হারবী কাফেরকে ভুলবশতঃ হত্যা। প্রথম প্রকারের পার্থিব বিধান হচ্ছে, কিসাস ওয়াজিব হওয়া । যা সূরা বাকারায় উল্লেখ করা হয়েছে। [সূরা আল-বাকারাহ ১৭৮]
আর আখেরাতে এর পরিণতি সূরা আন-নিসা এর ৯৩ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ ভুলবশতঃ মুমিনকে হত্যার বর্ণনা আলোচ্য সূরা আন-নিসার ৯২ নং আয়াতে এসেছে। অর্থাৎ দিয়াত দিতে হবে। তৃতীয় প্রকার অর্থাৎ যিম্মীকে ইচ্ছাকৃত হত্যার হুকুম কি তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। চতুর্থ প্রকার অর্থাৎ যিম্মীকে ভুলবশতঃ হত্যার শাস্তি সূরা আন-নিসার ৯২ নং আয়াতের শেষে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সেটারও দিয়াত দিতে হবে। পঞ্চম প্রকার অর্থাৎ চুক্তিবদ্ধ কাফেরকে ইচ্ছাকৃত হত্যা। এর হুকুম সূরা আন-নিসার ৯০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। মূলত: তাদের এবং যিম্মীদের হুকুম একই। কেননা, ৯০ নং আয়াতে উল্লেখিত (مِيْثَاقٌ) তথা চুক্তি অস্থায়ী ও স্থায়ী উভয় প্রকারই হতে পারে। অতএব, যিম্মী ও অভয়প্রাপ্ত কাফের এর অন্তর্ভুক্ত। সপ্তম ও অষ্টম প্রকারের বিধান স্বয়ং জিহাদ আইনসিদ্ধ হওয়ার মাস’আলা থেকে জানা গেছে। কেননা, জিহাদে দারুল হরবের কাফেরদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই হত্যা করা হয়। অতএব, ভুলবশতঃ হত্যার বৈধতা আরো সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হবে।
[২] কিসাস ও দিয়াতের বিধান সংশ্লিষ্টতার দিক থেকে হত্যা কয়েক প্রকারঃ প্রথম প্রকার (عَمَدٌ) অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত হত্যা। এমন অস্ত্র দ্বারা, যা দ্বারা হত্যা করা যায়। এ ধরনের হত্যার শাস্তি হচ্ছে কিসাস । দ্বিতীয় প্রকার (شِبْهُ عَمَدٍ) অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত হত্যার সাথে যা সাদৃশ্যপূর্ণ। এর সংজ্ঞা এইঃ ইচ্ছা করেই হত্যা করা, কিন্তু এমন অস্ত্র দ্বারা নয়, যা দ্বারা অঙ্গচ্ছেদ হতে পারে। তৃতীয় প্রকার (خطأ) অর্থাৎ ভুলবশতঃ হত্যা। ইচ্ছা ও ধারণায় ভুল হওয়া। যেমন দূর থেকে মানুষকে শিকারী জন্তু কিংবা দারুল-হারবের কাফের মনে করে লক্ষ্য স্থির করতঃ গুলী করে ফেলা কিংবা লক্ষ্যচ্যুতি ঘটা। যেমন, জন্তুকে লক্ষ্য করেই তীর অথবা গুলী ছোড়া; কিন্তু তা কোন মানুষের গায়ে লেগে যাওয়া। এগুলো সব ভুলবশতঃ হত্যার অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভুল বলে ‘ইচ্ছা নয়’ বোঝানো হয়েছে। অতএব, দ্বিতীয় ও তৃতীয় উভয় প্রকার হত্যাই এর অন্তর্ভুক্ত। উভয় প্রকারের মধ্যে গোনাহ ও রক্ত-বিনিময় বিভিন্ন রকম। দ্বিতীয় প্রকারের রক্ত-বিনিময় হচ্ছে একশ’ উট। উটগুলো চার প্রকারের হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রকারে পাঁচটি করে উট থাকবে। তৃতীয় প্রকারের রক্ত-বিনিময়ও একশ’ উট। কিন্তু উটগুলো হবে পাঁচ প্রকারের। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রকারে বিশটি করে উট থাকবে। তবে রক্ত-বিনিময় মুদ্রার মাধ্যমে দিলে উভয় প্রকারে দশ হাজার দিরহাম অথবা এক হাজার দীনার দিতে হবে। ইচ্ছার কারণে দ্বিতীয় প্রকারের গোনাহ বেশী এবং তৃতীয় প্রকারের গোনাহ কম। অর্থাৎ শুধু অসাবধানতার গোনাহ হবে। কাফফারা অর্থাৎ ক্রীতদাস মুক্ত করা কিংবা রোযা রাখা স্বয়ং হত্যাকারীর করণীয় এবং রক্ত-বিনিময় হত্যাকারীর স্বজনদের যিম্মায় ওয়াজিব। শরীআতের পরিভাষায় তাদেরকে ‘আকেলাহ’ বলা হয়। এখানে প্রশ্ন করা উচিত হবে না যে, হত্যাকারীর অপরাধের বোঝা তার স্বজনদের উপর কেন চাপানো হয়? তারা তো নিরপরাধ। এর কারণ এই যে, হত্যাকারীর স্বজনরাও দোষী। তারা তাকে এ ধরণের উচ্ছৃংখল কাজ-কর্মে বাধা দেয়নি। রক্ত-বিনিময়ের ভয়ে ভবিষ্যতে তারা তার দেখাশোনা করতে ক্রটি করবে না। এর বাইরে অন্য এক প্রকার হত্যা রয়েছে। যাকে কোন কোন ফকীহ ভুলের পর্যায়ভুক্ত বলেছেন। যেমন, কেউ কূপ এমন স্থানে খনন করলো যে, একজন তাতে পড়ে মারা গেল। এর বিধান অবস্থাভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে।
[৩] আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ যখন সূরা আল-ফুরকানের এ আয়াত নাযিল হল “আর তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না। আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে”। [আয়াতঃ ৬৮]
তখন মক্কার মুশরিকরা বলতে লাগল, আমরা তো আল্লাহর হারাম করা আত্মাকে হত্যা করেছি, আল্লাহর সাথে অন্যান্য ইলাহকেও ডেকেছি এবং ব্যভিচারও করেছি। ফলে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন “তারা নয়, যারা তাওবা করে, ঈমান আনে” সুতরাং এই আয়াতটুকু ঐ সমস্ত লোকদের জন্য যাদের কথা পূর্বে এসেছে। কিন্তু সূরা আন-নিসার আয়াত “কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন”। এখানে ঐ লোককে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যে ইসলামকে ভালভাবে জানল, শরী’আতকে বুঝল, তারপর কোন মুমিনকে হত্যা করল- তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। [বুখারীঃ ৩৮৫৫, ৪৭৬৪-৪৭৬৬, মুসলিমঃ ৩০২৩]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা আরো বলেনঃ এটি সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একে কোন কিছু রহিত করেনি। [বুখারীঃ ৪৫৯০, মুসলিমঃ ৩০২৩]
এতে বুঝা যায় যে, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মত হল, যদি কেউ কোন মুমিনকে জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে, তবে তার শাস্তি জাহান্নাম অবধারিত। আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লম বলেছেনঃ একজন মুমিন ব্যক্তি তার দ্বীনের ব্যাপারে মুক্তির সুযোগের মধ্যে থাকে যতক্ষন সে কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে হত্যা না করে। [বুখারীঃ ৬৮৬২]
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলা মুমিনের হত্যাকারীর জন্য তাওবাহ্ কবুল করতে আমার নিকট অস্বীকার করেছেন’। [আল-আহাদীসুল মুখতারাহঃ ৬/১৬৩, নং-২১৬৪]
অন্য হাদীসে এসেছে, আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন দু’ মুসলিম তাদের অস্ত্র নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ব্যক্তি ও হত্যাকৃত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী। আবু বাকরাহ বলেন, আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর ব্যাপারটা তো স্পষ্ট, কিন্তু হত্যাকৃত ব্যক্তির কি অপরাধ? তিনি জবাব দিলেন যে, সে তার সাথীকে হত্যা করার লালস করছিল। [বুখারীঃ ৬৮৭৫, মুসলিমঃ ২৮৮৮]
হাদীসে আরো এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন প্রথম বিচার অনুষ্ঠিত হবে মানুষের রক্তক্ষরণ তথা হত্যার ব্যাপারে। [বুখারীঃ ৬৮৬৪, মুসলিমঃ ১৬৭৮]
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হত্যাকারী কিয়ামতের দিন এমনভাবে উপস্থিত হবে যে, হত্যাকৃত ব্যক্তি হত্যাকারীর মাথা ধরে রাখবে এবং বলবেঃ হে রব! আপনি একে প্রশ্ন করুন, কেন আমাকে হত্যা করেছে? [ইবন মাজাহঃ ২৬২১, মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৪০]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এখানে নেতিবাচক বাক্য নিষেধাজ্ঞার অর্থে ব্যবহার হয়েছে, যা হারাম প্রতিপাদন করে। অর্থাৎ, একজন মু’মিনের অপর মু’মিনকে হত্যা করা নিষেধ ও হারাম। যেমন, [وَمَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُؤْذُوا رَسُولَ اللهِ ] “আল্লাহর রসূলকে কষ্ট দেওয়া তোমাদের জন্য সঙ্গত নয়।” (আহযাবঃ ৫৩) অর্থাৎ, কষ্ট দেওয়া হারাম।
[২] ভুলের কারণ অনেক ধরনের হতে পারে। উদ্দেশ্য হল, নিয়ত ও ইচ্ছা হত্যা করার না হয়; অনিচ্ছায় ভুলক্রমে যদি হয়ে যায়, তাহলে সে কথা স্বতন্ত্র।
[৩] এখানে ভুলক্রমে হত্যা হয়ে গেলে তার জরিমানা কি, তা বলা হচ্ছে। দু’টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে, কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) ও ক্ষমা স্বরূপ। আর তা হল, একজন মুসলিম ক্রীতদাস স্বাধীন করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বান্দাদের অধিকার স্বরূপ। আর তা হল, ‘দিয়াত’ রক্তপণ আদায় করা। নিহত ব্যক্তির রক্তের বিনিময় স্বরূপ যে জিনিস তার (নিহতের) উত্তরাধিকারীদেরকে দেওয়া হয়, তাকে ‘দিয়াত’ (রক্তপণ) বলা হয়। এর পরিমাণ হাদীস অনুযায়ী ১০০টি উট অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য সোনা, রূপা বা দেশে প্রচলিত মুদ্রা।
দ্রষ্টব্যঃ স্মরণ থাকে যে, ইচ্ছাকৃত হত্যায় ‘কিসাস’ অথবা ‘দিয়াত মুগাল্লাযা’ হবে। আর ‘দিয়াত মুগাল্লাযা’র পরিমাণ ১০০টি উট যা বয়স ও তার (ভালো-মন্দ)গুণ অনুযায়ী তিন প্রকারের বা তিন মানের হবে। কিন্তু ভুলক্রমে হত্যায় কেবল ‘দিয়াত’ আছে, ‘কিসাস’ (রক্তের বিনিময়ে রক্ত) নেই। এই ‘দিয়াত’এর পরিমাণ ১০০টি উট যাতে কোন কড়া শর্ত নেই। তাছাড়া এই ‘দিয়াত’এর মূল্য সুনানে আবূ দাউদের হাদীসে ৮০০ দীনার অথবা ৮ হাজার দিরহাম এবং তিরমিযীর বর্ণনায় ১২ হাজার দিরহাম বলা হয়েছে। অনুরূপ উমার (রাঃ) তাঁর খেলাফত কালে ‘দিয়াত’এর মূল্যে কম-বেশী এবং বিভিন্ন মুদ্রা অনুযায়ী তা বিভিন্ন প্রকারের নির্দিষ্ট করেছিলেন। (ইরওয়াউল গালীল ৮ম খন্ড) যার অর্থ হল, ১০০টি উটের মূল দিয়াতের ভিত্তিতে তার মূল্য প্রত্যেক যুগ অনুসারে নির্ধারিত হবে। (বিস্তারিত জনার জন্য দ্রষ্টব্যঃ হাদীসের ভাষ্য ও ফিক্বাহ গ্রন্থাদি)
[৪] ক্ষমা করে দেওয়াকে সাদাকা বলে আখ্যায়িত করার উদ্দেশ্য হল, ক্ষমা করার প্রতি উৎসাহিত করা।
[৫] অর্থাৎ, এই অবস্থায় দিয়াত লাগবে না। এর কারণ কেউ কেউ এই বলেছেন যে, যেহেতু এর ওয়ারেস একজন কাফের যোদ্ধা, তাই সে মুসলিমের দিয়াতের অধিকারী হবে না। কেউ কেউ এর কারণ বলেছেন, এই মুসলিম ইসলাম গ্রহণ করার পর যেহেতু হিজরত করেনি, যার প্রতি সে সময় বড়ই তাকীদ করা হয়েছিল। সে এ ব্যাপারে গড়িমসি করেছে, তাই তার রক্তের মান অনেক কম। (ফাতহুল ক্বাদীর)
[৬] এটা আর এক তৃতীয় অবস্থা। পূর্বের অবস্থার ন্যায় এতেও কাফফারা এবং দিয়াত আছে। কেউ কেউ বলেছেন, যদি নিহত ব্যক্তি ‘মুআহিদ’ (চুক্তিবদ্ধ কাফির) হয়, তবে তার দিয়াত মুসলিমের দিয়াতের অর্ধেক হবে। কেননা, হাদীসে কাফেরের দিয়াত মুসলিমের দিয়াতের অর্ধেক বলা হয়েছে। কিন্তু অধিক সঠিক এটাই মনে হচ্ছে যে, এই তৃতীয় অবস্থাতেও মুসলিম নিহত ব্যক্তিরই বিধান বর্ণনা করা হচ্ছে।
[৭] অর্থাৎ, ক্রীতদাস স্বাধীন করার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে প্রথম এবং শেষের অবস্থায় দিয়াত আদায় করার সাথে সাথে ধারাবাহিকতার সাথে (কোন বিরতি ছাড়াই) একটানা দুই মাস রোযা রাখতে হবে। যদি তারই মাঝে কোন দিন রোযা ছেড়ে দেয়, তবে পুনরায় প্রথম থেকে আরম্ভ করা জরুরী হবে। তবে যদি কোন শরয়ী কারণে রোযা ছেড়ে থাকে, তাহলে পুনরায় প্রথম থেকে শুরু করার প্রয়োজন হবে না। যেমন, মাসিক, নিফাস অথবা এমন কঠিন রোগ যা রোযা রাখার জন্য বাধা হয়। (নিষিদ্ধ দিনসমূহ, যাতে রোযা রাখা নিষেধ আছে।) সফর শরয়ী ওজর কি না, এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। (ইবনে কাসীর)
[৮] এটা ইচ্ছাকৃত হত্যা করার শাস্তি। হত্যা তিন প্রকারেরঃ (ক) ভুলক্রমে হত্যা (যা পূর্বের আয়াতে উল্লেখ হয়েছে)। (খ) প্রায় ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা; (এমন জিনিস দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা, যা দিয়ে সাধারণতঃ হত্যা করা যায় না।) যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (গ) ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা। অর্থাৎ, হত্যা করার ইচ্ছা ও নিয়ত করে হত্যা করা এবং এর জন্য সেই অস্ত্রও ব্যবহার করা হয় যা দিয়ে বাস্তবিকই হত্যা করা হয়। যেমন, তরবারী, খঞ্জর ইত্যাদি। আয়াতে মু’মিনকে হত্যা করার অতীব কঠিন শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, তার শাস্তি হল সেই জাহান্নাম, যাতে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে। অনুরূপ সে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হবে এবং তাঁর অভিসম্পাত ও মহা শাস্তিও তার উপর আপতিত হবে। একই সাথে এতগুলো কঠিন শাস্তির কথা অন্য কোন পাপের ব্যাপারে বর্ণিত হয়নি। এ থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, একজন মু’মিনকে হত্যা করা কত বড় অপরাধ। হাদীসসমূহেও এ কাজের কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে এবং এর কঠোর শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।
[৯] মু’মিনের হত্যাকারীর তওবা কবুল হবে, নাকি হবে না? কোন কোন আলেম উল্লিখিত কঠোর শাস্তিগুলোর ভিত্তিতে তার তওবা কবুল না হওয়ার কথাই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কুরআন ও হাদীসে আলোচিত উক্তির আলোকে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, নিষ্ঠার সাথে তওবা করলে প্রত্যেক পাপই মাফ হতে পারে। [إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا ] (الفرقان: ৭০) অন্যান্য তওবার আয়াতসমূহও ব্যাপক। প্রত্যেক গুনাহ, ছোট হোক, বড় হোক অথবা অতি বড় যা-ই হোক না কেন, নিষ্ঠার সাথে তওবা করলে সবই মাফ হওয়া সম্ভব। এখানে তার শাস্তি জাহান্নামের কথা যে বর্ণিত হয়েছে, তার অর্থ হল, সে যদি তওবা না করে, তাহলে তার শাস্তি এটাই হবে, যা মহান আল্লাহ তার অপরাধের দরুন তাকে দিতে পারেন। অনুরূপ তওবা না করা অবস্থায় চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার অর্থ হল, তাতে সুদীর্ঘ কাল অবস্থান করতে হবে। কারণ, কাফের ও মুশরিকরাই কেবল জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। তাছাড়া হত্যার সম্পর্ক যদিও বান্দার অধিকারের সাথে, যা থেকে তওবার মাধ্যমেও দায়িত্বমুক্ত হওয়া যায় না, তবুও আল্লাহ তাআলা স্বীয় কৃপা ও অনুগ্রহে তার এমনভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেন যে, নিহিত ব্যক্তিও প্রতিদান পেয়ে যাবে এবং হত্যাকারীরও মাফ হয়ে যাবে। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল ক্বাদীর)
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
পূর্বে মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা করার পর এবার মু’মিনদের আলোচনা নিয়ে আসছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কোন মু’মিন অন্য কোন মু’মিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা সঙ্গত নয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা’বূদ নেই, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল ও বান্দা তবে তার রক্ত তিনটি কারণ ছাড়া বৈধ নয়। ১. হত্যার কারণে হত্যা করা। ২. বিবাহিত ব্যভিচারকারী এবং ৩. মুরতাদ। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৭৮)
তবে ভুলবশত যদি কোন মু’মিন কোন মু’মিনকে হত্যা করে তাহলে তার ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত বিধান জারী করেছেন:
১. ভুলবশত মু’মিনকে হত্যা করলে একজন ক্রীতদাস আযাদ ও নিহত পরিবারকে দিয়াত প্রদান করতে হবে। তবে নিহত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে মাফ করে দিলে আলাদা কথা। অর্থাৎ কোন কিছু তাকে দিতে হবে না।
২. নিহত ব্যক্তি শত্র“পক্ষের হলে এবং মু’মিন হলে একজন ক্রীতদাস আযাদ করতে হবে।
৩. আর যদি নিহত ব্যক্তি এমন গোত্রের হয় যাদের সাথে সন্ধি রয়েছে তাহলে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে দিয়াত ও মু’মিন ক্রীতদাস আযাদ করতে হবে।
যদি এতে কেউ সক্ষম না হয় তাহলে ধারাবাহিকভাবে দুই মাস সিয়াম পালন করতে হবে। যদি শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া মাঝে সিয়াম ভঙ্গ করে তাহলে পুনরায় প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
ভুলবশত হত্যা করার দিয়াত হল: ১০০টি উট।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভুলবশত হত্যার দিয়াত উল্লেখ করে বলেন: ২০টি (এক বছর পূর্ণ হয়েছে এমন) উটনী, ২০টি অনুরূপ উট, ২০টি (দু’ বছর পূর্ণ হয়েছে এমন) উটনী, ২০টি তিন বছর পূর্ণ হয়েছে এমন এবং ২০টি চার বছর পূর্ণ হয়েছে এমন উট। (আবূ দাঊদ হা: ৪৫৪৫, তিরমিযী হা: ১৩৮৬, নাসাঈ হা: ৪৮১৬, ইবনু মাযাহ হা: ২৯৩১, হাসান)
তার পরের আয়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে মু’মিনকে হত্যা করার পরিণতি কী সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(১) তার ঠিকানা জাহান্নাম। (২) সেখানে সে চিরকাল থাকবে। (৩) তার ওপর আল্লাহ তা‘আলার অভিশাপ। (৪) এবং আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
বিঃদ্রঃ যদি কেউ কোন মু’মিনকে হালাল মনে করে হত্যা করে তাহলে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।
কারণ তখন সে ইসলামের হারাম বিধানকে হালাল মনে করায় ইসলামের সীমা থেকে বের হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যদি হারাম জেনেও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তাহলে এ জন্য জাহান্নামে গেলেও তাতে চিরস্থায়ী থাকবে না। কারণ তখন সে কবীরা গুনায় লিপ্ত হয়েছে। আর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বীদাহ হল কবীরা গুনাহকারী ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে না।
আমরা জানি বানী ইসরাঈলের এক ব্যক্তি ১০০টি হত্যা করেও তাওবাহ করার কারণে জান্নাতে গিয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৭৪০)
তাই তাওবাহ করলে হত্যাকারীকে আল্লাহ তা‘আলা বিনা শাস্তিতে জান্নাতে দিতে পারেন আর নিহত ব্যক্তিকে এমন পুরস্কার দেবেন তা পেয়ে সে তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে। আর তাওবাহ না করে মারা গেলে তাতে সুদীর্ঘকাল জাহান্নামে থাকতে হবে। তারপর জান্নাতে যেতে পারবে শর্ত হল ঈমান থাকতে হবে এবং হালাল মনে করে হত্যা করতে পারবে না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ভুলবশত হত্যার মাসুল জানতে পারলাম।
২. স্বেচ্ছায় হত্যার পরিণাম কী তাও জানতে পারলাম।