أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٤٧)-৩৪৯
www.motaher21.net
وَإِذَا كُنتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلٰوةَ
যখন তুমি মুসলমানদের মধ্যে থাকো এবং (যুদ্ধাবস্থায়) তাদেরকে নামায পড়াবার জন্য দাঁড়াও তখন:-
When you (O Messenger Muhammad) are among them, and lead them in Salah:-
সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং:- ১০২
وَ اِذَا كُنْتَ فِیْهِمْ فَاَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلٰوةَ فَلْتَقُمْ طَآئِفَةٌ مِّنْهُمْ مَّعَكَ وَ لْیَاْخُذُوْۤا اَسْلِحَتَهُمْ فَاِذَا سَجَدُوْا فَلْیَكُوْنُوْا مِنْ وَّرَآئِكُمْ ۪ وَ لْتَاْتِ طَآئِفَةٌ اُخْرٰى لَمْ یُصَلُّوْا فَلْیُصَلُّوْا مَعَكَ وَ لْیَاْخُذُوْا حِذْرَهُمْ وَ اَسْلِحَتَهُمْۚ وَدَّ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا لَوْ تَغْفُلُوْنَ عَنْ اَسْلِحَتِكُمْ وَ اَمْتِعَتِكُمْ فَیَمِیْلُوْنَ عَلَیْكُمْ مَّیْلَةً وَّاحِدَةًؕ وَ لَا جُنَاحَ عَلَیْكُمْ اِنْ كَانَ بِكُمْ اَذًى مِّنْ مَّطَرٍ اَوْ كُنْتُمْ مَّرْضٰۤى اَنْ تَضَعُوْۤا اَسْلِحَتَكُمْۚ وَ خُذُوْا حِذْرَكُمْؕ اِنَّ اللّٰهَ اَعَدَّ لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابًا مُّهِیْنًا
আর হে নবী! যখন তুমি মুসলমানদের মধ্যে থাকো এবং (যুদ্ধাবস্থায়) তাদেরকে নামায পড়াবার জন্য দাঁড়াও তখন তাদের মধ্য থেকে একটি দলের তোমার সাথে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত এবং তারা অস্ত্রসস্ত্র সঙ্গে নেবে। তারপর তারা সিজদা করে নিলে পেছনে চলে যাবে এবং দ্বিতীয় দলটি, যারা এখনো নামায পড়েনি, তারা এসে তোমার সাথে নামায পড়বে। আর তারাও সতর্ক থাকবে এবং নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র বহন করবে। কারণ কাফেররা সুযোগের অপেক্ষায় আছে, তোমরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ও জিনিস পত্রের দিক থেকে সামান্য গাফেল হলেই তারা তোমাদের ওপর অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে যদি তোমরা বৃষ্টির কারণে কষ্ট অনুভব করো অথবা অসুস্থ থাকো, তাহলে অস্ত্র রেখে দিলে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু তবুও সতর্ক থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনাকর আযাবের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
১০২ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
শানে নুযূল:
আবূ আইয়াশ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: উসফান নামক স্থানে আমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম, আমরা মুশরিকদের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তখন খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিল মুশরিকদের নেতা। তারা আমাদের ও কেবলার মাঝে অবস্থান করছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নিয়ে যোহর সালাত আদায় করলেন। তখন মুশরিকরা বলল: তারা এমন এক অবস্থায় ছিল আমরা হামলা করতে পারতাম। তারপর তারা বলল: তাদের কাছে (মুসলিমদের) এমনটি সালাত আসবে যা তাদের সন্তান সন্ততি ও নিজেদের থেকে অধিক প্রিয়। তখন এ আয়াত নিয়ে জিবরীল (আঃ) যোহর ও আসর সালাতের মাঝে আসেন। (নাসাঈ হা: ১৫৪৯, ১৫৫০, সহীহ।
অত্র আয়াতে সালাতুল খাওফের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সহীহ হাদীসে সালাতুল খাওফের কয়েকটি নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে এ আয়াতে বর্ণিত নিয়মটি হল দু’দলের এক দল ইমামের সাথে অস্ত্রসহ এক রাকআত সালাত আদায় করে নেবে, অন্য দল শত্র“দের পাহারায় নিযুক্ত থাকবে। এ দল রাকআত আদায় করে নিলে পাহারারত দল এসে এক রাকাত আদায় করে নেবে। পরে আবার রেওয়াজ বদল করে উভয় দলের বাকি এক রাকআত আদায় করে প্রথম দল সালাম ফিরিয়ে চলে যাবে, ইমাম সালাম না ফিরিয়ে বসে থাকবে পরের দলের সাথে একত্রে সালাম ফেরাবেন।
(وَدَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْ تَغْفُلُوْنَ)
‘কাফিররা কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও’ অর্থাৎ তোমরা জিহাদ করা ও শত্র“দের বিরুদ্ধে সরঞ্জামাদী তৈরি করতে গাফেল থাক আর দুনিয়ার ভোগ সামগ্রী নিয়ে ব্যস্ত থাক যাতে শত্র“রা অতর্কিত হামলা চালিয়ে তোমাদের শেষ করে দিতে পারে। এটাই তাদের কামনা।
(وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ)
‘তোমাদের কোন দোষ নেই’ অর্থাৎ যদি বৃষ্টি, অসুস্থতা ও অন্য কোন শরয়ী কারণে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি নিতে হয় তাহলে কোন গুনাহ নেই। তবে যেন কোন অবস্থাতেই সতর্কতা থেকে গাফেল হওয়া চলবেনা। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এ আয়াতটি আবদুর রহমান আতিকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫৯৯)
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১৩৪) ইমাম আবু ইউসুফ ও হাসান বিন যিয়াদ এই শব্দাবলী থেকে এ ধারণা নিয়েছেন যে, “সালাতে খওফে”র (ভয়ের নামায) কেবলমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে একটি হুকুম দেয়া হয়েছে আবার সেই হুকুমটিই তাঁর পরে তার স্থলাভিষিক্তদের জন্যও আগের মতই কার্যকর রয়েছে, কুরআন মজীদে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কাজেই “সালাতে খওফ”কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নির্দিষ্ট করার কোন কারণ নেই। এছাড়াও অসংখ্য নেতৃস্থানীয় সাহাবী থেকেও একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরেও ‘ সালাতে খওফ’ পড়েছেন। এ প্রশ্নে কোন সাহাবীর মতবিরোধের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
টিকা:১৩৫) শত্রুর আক্রমণের ভয় আছে কিন্তু কার্যত লড়াই হচ্ছে না, এমন অবস্থায় ‘সালাতে খওফে’র (ভয়ের নামায) হুকুম দেয়া হয়েছে। আর কার্যত যখন লড়াই চলছে তেমন অবস্থায় হানাফীদের মতে নামায পিছিয়ে দেয়া হবে। ইমাম মালেক ও ইমাম সুফিয়ান সওরীর মতে রুকু’ ও সিজদা করা সম্ভব না হলে ইশারায় নামায পড়ে নিতে হবে। ইমাম শাফেঈর মতে, নামাযের মধ্যেও কিছুটা যুদ্ধ করা যেতে পারে। নবী ﷺ থেকে প্রমাণিত যে, তিনি খন্দকের যুদ্ধের সময় চার ওয়াক্তের নামায পড়েননি। তারপর সুযোগ পেয়েই তরতীব অনুযায়ী চার ওয়াক্তের নামায এক সাথে পড়ে নেন। অথচ খন্দকের যুদ্ধের আগেই ‘সালাতে খওফে’র হুকুম এসে গিয়েছিল।
টিকা:১৩৬) অনেকটা যুদ্ধের অবস্থার ওপর ‘সালাত খওফ’ পড়ার পদ্ধতি নির্ভর করে। নবী ﷺ বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে এ নামায পড়িয়েছেন। কাজেই যুদ্ধের অবস্থা বা পরিস্থিতি ঐ পদ্ধতিগুলোর মধ্য থেকে যেটির অনুমতি দেবে তৎকালীন ইসলামী দলের প্রধান সেই পদ্ধতিতেই নামায পড়াবেন।
এর একটি পদ্ধতি হচ্ছেঃ সেনাদলের একটি অংশ ইমামের সাথে নামায পড়বে এবং অন্য অংশটি তখন দুশমনের মোকাবিলা করতে থাকবে। যখন এক রাকআত পুরা হয়ে যাবে তখন প্রথম অংশটি সালাম ফিরে চলে যাবে এবং দ্বিতীয় অংশটি এসে ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাকআতটি পুরা করবে। এভাবে ইমামের দু’রাকআত এবং সৈন্যদের এক রাকআত নামায হবে।
দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছেঃ সেনাদলের এক অংশ ইমামের সাথে এক রাকআত পড়ে চলে যাবে তারপর দ্বিতীয় অংশটি এসে ইমামের পেছনে এক রাকআত পড়বে। এরপর উভয় অংশই পালাক্রমে এসে নিজেদের বাকি এক রাকআত একা একা পড়ে নেবে। এভাবে উভয় অংশের এক রাকআত পড়া হবে ইমামের পিছনে এবং এক রাকআত হবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে।
এর তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছেঃ ইমামের পেছনে সেনাদলের একটি অংশ দুই রাকআত পড়বে এবং তাশাহ্হুদের পর সালাম ফিরে চলে যাবে। সেনাদলের দ্বিতীয় অংশ ইমামের সাথে তৃতীয় রাকআতে শরীক হবে এবং তার সাথে আর এক রাকআত করে পড়ে সালাম ফিরবে। এভাবে ইমামের চার ও সেনাদলের দুই রাকআত হবে।
চতুর্থ পদ্ধতিটি হচ্ছেঃ সেনাদলের এক অংশ ইমামের সাথে এক রাকআত পড়বে এবং ইমাম যখন দ্বিতীয় রাকআতের জন্য দাঁড়াবে তখন মুকতাদীরা নিজেরাই একা একা দ্বিতীয় রাকআত তাশাহহুদ সহ পড়ে সালাম ফিরে চলে যাবে। তারপর দ্বিতীয় অংশটি এসে এমন অবস্থায় ইমামের সাথে শামিল হবে যে ইমাম তখনো দ্বিতীয় রাকআতে থাকবেন এবং এরা বাকি নামায ইমামের সাথে পড়ার পর এক রাকআত নিজেরা উঠে একা একা পড়ে নেবে। এ অবস্থায় ইমামকে দ্বিতীয় রাকআতে দীর্ঘতম কিয়াম করতে হবে।
ইবনে আব্বাস, জাবির ইবনে আবদুল্লাহু ও মুজাহিদ প্রথম পদ্ধতিটি সম্পর্কে রেওয়ায়াত করেছেন। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি সম্পর্কে রেওয়ায়াত করেছেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ। হানাফীগণ এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তৃতীয় পদ্ধতিটি রেওয়ায়াত করেছেন হাসান বসরী আবু বাকরাহ থেকে। আর চতুর্থ পদ্ধতিটিকে সামান্য একটু মতবিরোধ সহকারে ইমাম শাফেঈ ও ইমাম মালেক অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এর উৎস হচ্ছে সাহ্ল ইবনে আবী হাস্মার একটি রেওয়ায়াত।
এগুলো ছাড়া সালাতে খওফের আরো কয়েকটি পদ্ধতি আছে। ফিকাহর কিতাবগুলোয় এগুলোর আলোচনা পাওয়া যাবে।
টিকা:১৩৭) অর্থাৎ তোমাদের এই যে সতর্কতার হুকুম দেয়া হচ্ছে এটা নিছক একটা পার্থিব কৌশল। নয়তো আসলে জয়-পরাজয় তোমাদের কৌশলের ওপর নির্ভর করে না। বরং তা নির্ভর করে আল্লাহর ফায়সালার ওপর। তাই এই সতর্কতামূলক কৌশল ও পদক্ষেপগুলো কার্যকর করার সময় তোমাদের একথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে, যারা নিজেদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিবিয়ে দিতে চাচ্ছে আল্লাহ তাদের লাঞ্ছিত করবেন।
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
ভয়ের নামায কয়েক প্রকার এবং এর কয়েকটি অবস্থা আছে। কখনও এমন হয় যে, শত্রুরা কিবলার দিকে রয়েছে। কখনও তারা অন্য দিকে হয়। আবার নামাযও কখনও চার রাকআতের হয়। কখনও তিন রাকআতের হয়, যেমন মাগরিব। কখনও আবার দু’রাকআতের হয়, যেমন ফজর ও সফরের নামায। কখনও জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হয়, আবার কখনও শক্ররা এত মুখখামুখী হয়ে থাকে যে, জামাআতের সাথে নামায পড়া সম্ভবই হয় না। বরং পৃথক পৃথকভাবে কিবলার দিকে মুখ করে বা অন্য দিকে মুখ করে, পায়ে হেঁটে হেঁটে বা সোয়ারীর উপরে, যেভাবেই সম্ভব হয় পড়ে নেয়া হয়। বরং এমনও হয় এবং ওটা জায়েযও বটে যে, শত্রুদের উপর আক্রমণ চালাতেই থাকা হয়, তাদেরকে প্রতিরোধও করা হয়, আবার নামায আদায় করে যাওয়া হয়। আলেমগণ শুধু এক রাকআত নামায পড়ারও ফতওয়া দিয়েছেন। তাঁদের দলীল হচ্ছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসটি যা এর পূর্ববর্তী আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। আতা (রঃ), জাবির (রঃ), হাসান বসরী (রঃ), মুজাহিদ (রঃ), কাতাদাহ্ (রঃ), হাম্মাদ (রঃ), তাউস (রঃ), যহহাক (রঃ), মুহাম্মদ নাসর আল মারূযী (রঃ) এবং ইবনে হাযামেরও (রঃ) এটাই ফতওয়া। এ অবস্থায় যোহরের নামাযে এক রাকআতই রয়ে যায়।
হযরত ইসহাক ইবনে রাহউয়াই (রঃ) বলেন যে, এরূপ দৌড়াদৌড়ির সময় এক রাকআতই যথেষ্ট। ইশারা করেই পড়বে। যদি এটাও সম্ভব না হয় তবে একটা সিজদাহ করবে। এটাও অল্লাহর যিকির। অন্যেরা বলেন যে, শুধু একটি তাকবীরই যথেষ্ট। কিন্তু এটাও হতে পরে যে, একটি সিজদা ও একটি তাকবীরের ভাবার্থ হচ্ছে এক রাকআত নামায। এটা হচ্ছে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এবং তার সঙ্গীদের ফতওয়া। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ), হযরত কা’ব (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণেরও এটাই উক্তি। কিন্তু যেসব লোক শুধু একটি তাকবীরের কথা বলেছেন তারা ওটাকে পূর্ণ রাকআতের উপর প্রয়োগ করেন না, বরং ভাবার্থ তাকবীরই নিয়ে থাকেন। যেমন এটা হচ্ছে ইসহাক ইবনে রাহ্উয়াইর মাযহাব। আমীর আবদুল ওয়াহ্হাব ইবনে বাখৃত মাক্কীও (রঃ) ঐ দিকেই গিয়েছেন। এমনকি তিনি বলেন যে, যদি একটি তাকবীরের উপরও সক্ষম না হয় তবে স্বীয় নাফসের মধ্যেও ওটা ছেড়ে দেবে না। অর্থাৎ শুধু নিয়ত করে নেবে। আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে বেশী জানেন।
কোন কোন আলেম এরূপ বিশেষ সময়ে নামাযকে বিলম্বে পড়ারও অবকাশ দিয়েছেন। তাদের দলীল এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) পরিখার যুদ্ধে সূর্যাস্তের পর যোহর ও আসরের নামায আদায় করেছেন। তার পরে মাগরিব ও ইশার নামায পড়েছেন। এর পরে বানু কুরাইযার যুদ্ধে যাদেরকে প্রেরণ করেছিলেন তাদেরকে তিনি খুব জোর দিয়ে বলেছিলেনঃ “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন বানূ কুরাইযাদের নিকট পৌছার পূর্বে আসরের নামায না পড়ে। ঐ লোকগুলো পথে থাকতেই আসরের সময় হয়ে যায়। তখন কেউ কেউ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আমাদেরকে এ কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল শুধু এই যে, আমরা যেন তাড়াতাড়ি বানু কুরাইযার নিকট পৌছে যাই, তার উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে, পথে আসরের সময় হয়ে গেলেও আমরা নামায পড়বো না। সুতরাং পথেই তারা নামায আদায় করে নেন। অন্যেরা বানু কুরাইযার নিকট পৌঁছার পর আসরের নামায আদায় করেন। সে সময় সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। নবী (সঃ)-এর সামনে ওটা বর্ণনা করা হলে কোন দলকেই ধমক দিলেন না। আমরা কিতাবুস সীরাতে এর বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তথায় আমরা এটা প্রমাণ করেছি যে, ঐদলটিই বেশী সঠিক কাজ করেছিলেন যারা সময়মত নামায আদায় করেছিলেন। তবে দ্বিতীয় দলটির ওরও শরীয়ত সমর্থিত ওযরই ছিল। উদ্দেশ্যে এই যে, ঐ দলটি জিহাদের স্থলে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের দুর্গের উপর আক্রমণ অব্যাহত রেখে নামায বিলম্বে আদায় করেন। শত্রুদের ঐ দলটি ছিল অভিশপ্ত ইয়াহুদীর দল। তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল এবং সন্ধির শর্তের বিপরীত কাজ করেছিল। কিন্তু জমহুর বলেন যে, খাওফের নামাযের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর এসব রহিত হয়ে যায়। এটা ছিল এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের ঘটনা। খাওফের নামাযের নির্দেশ জারী হওয়ার পর জিহাদের সময় নামাযকে বিলম্বে পড়ার বৈধতা আর নেই। হযরত আবু সাঈদ (রঃ)-এর রিওয়ায়েত দ্বারাও এটাই প্রকাশিত হয়েছে, ইমাম শাফিঈ (রঃ) যা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সহীহ বুখারী শরীফে (আরবী) এ অধ্যায়ে রয়েছে যে, আওযায়ী (রঃ) বলেনঃ যদি বিজয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয় ও জামাআতের সঙ্গে নামায পড়া সম্ভবপর না হয় তবে প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় নামায পৃথক পৃথকভাবে ইশারার মাধ্যমে আদায় করবে। যদি ওটাও সম্ভব না হয় তবে বিলম্ব করবে যে পর্যন্ত না যুদ্ধ শেষ হয় অথবা নিরাপত্তা লাভ হয়। অতঃপর দু’রাকআত পড়ে নেবে। কিন্তু যদি নিরাপত্তা লাভ না হয় তবে এক রাকআত আদায় করতে হবে। শুধু তাকবীর পাঠ যথেষ্ট নয়। যদি এ অবস্থাই হয় তবে। নামায বিলম্বে পড়তে হবে, যে পর্যন্ত শান্তি ও নিরাপত্তা না আসে।’ হযরত মাকলেরও (রঃ) এটাই উক্তি।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেনঃ ‘তিসতার দুর্গের অবরোধের সময় আমি বিদ্যমান ছিলাম। সুবেহ-সাদিকের সময় ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়। আমরা ফজরের নামায পড়তে পারিনি, বরং যুদ্ধেই লিপ্ত ছিলাম। যখন আল্লাহ পাক আমাদেরকে দুর্গের উপর বিজয় দান করেন তখন সূর্য উপরে উঠে যাওয়ার পর আমরা ফজরের নামায আদায় করি। ঐ যুদ্ধে আমাদের ইমাম ছিলেন। হযরত আবূ মূসা (রাঃ)’। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘ঐ নামাযের বিনিময়ে সারা দুনিয়া এবং ওর সমুদয় জিনিসও আমাকে খুশি করতে পারে না।
এরপর ইমাম বুখারী (রঃ) পরিখার যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নামায বিলম্বে পড়ার বর্ণনা দেন। তারপর তিনি বান্ কুরাইযা যুক্ত ঘটনাটি এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিম্ন উক্তিটি আনয়ন করেনঃ “তোমরা বানু কুরাইযার নিকট পৌছার পূর্বে আসরের নামায আদায় করবে না। সম্ভবতঃ ইমাম বুখারী (রঃ) এটাই পছন্দ করেন যে, এরূপ তুমুল যুদ্ধে, ভয়াবহ বিপদ এবং আসন্ন বিজয়ের সময় নামায বিলম্বে আদায় করলে কোন দোষ নেই।
হযরত আবু মূসা (রাঃ)-এর নেতৃত্বে তিসতার দুর্গ বিজিত হওয়ার ঘটনাটি হযরত উমার ফারূক (রাঃ)-এর খিলাফতের যুগে সংঘটিত হয়। হযরত উমার (রাঃ) বা অন্য কোন সাহাবী যে এর প্রতিবাদ করেছেন এরূপ কোন বর্ণনা নকল করা হয়নি। এসব লোক একথাও বলেন যে, পরিখার যুদ্ধের সময়ও ‘খাওফের নামাযের আয়াতগুলো বিদ্যমান ছিল। কেননা, আয়াতগুলো ‘যাতুর রিকা’ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। আর এটা হচ্ছে পরিখার যুদ্ধের পূর্বের যুদ্ধ। এর উপর “সিয়ার’ ও ‘মাগাযীর’ জামহর-ই-উলামা একমত।
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ), ওয়াকেদী (রঃ), ওয়াকেদীর লেখক মুহাম্মাদ ইবনে সা’দ (রঃ) এবং খলীফা ইবনে খাইয়াত (রঃ) প্রমুখ মনীষীগণেরও এটাই উক্তি। তবে ইমাম বুখারী (রঃ) এবং আরও কয়েকজন মনীষীর উক্তি এই যে, যাতুর রিকা’র যুদ্ধ পরিখার যুদ্ধের পরে সংঘটিত হয়েছিল। এর প্রমাণ হচ্ছে হযরত আবু মূসা (রাঃ)-এর হাদীসটি এবং স্বয়ং তিনি খাইবারেই এসেছিলেন। আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। কিন্তু সব চাইতে বিস্ময়কর কথা এই যে, আল মুযানী (রঃ), কাযী আবু ইউসুফ (রঃ) এবং ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল ইবনে ‘আলিয়া (রঃ) বলেন যে, ‘সলাতুল খওফ’ (ভয়ের নামায) মানসুখ হয়ে গেছে। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) পরিখার যুদ্ধে নামায বিলম্বে পড়েছেন। এ উক্তি সম্পূর্ণ গারীব। যেহেতু পরিখার যুদ্ধের পরবর্তী সলাতুল খওফের’ হাদীসগুলো এ নামায রহিত না হওয়ার প্রমাণ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। ঐ দিনে নামায বিলম্বে আদায় করাকে মাকহুল (রঃ) এবং আওযায়ী (রঃ)-এর উক্তির উপর মাহমল করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। অর্থাৎ তাদের ঐ উক্তিটি যা তারা সহীহ বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন তা এই যে, আসন্ন বিজয়ের সময় নামায আদায় করা অসম্ভব হলে নামায বিলম্বে আদায় করা বৈধ।
আল্লাহ পাক স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেন-“যখন তুমি তাদের মধ্যে থাক তখন তাদের জন্যে নামায প্রতিষ্ঠিত কর।’ অর্থাৎ যখন তুমি ভয়ের নামাযে ইমাম হয়ে নামায পড়াবে। এটা প্রথম অবস্থার সময় নয়। কেননা, সে সময় তো মাত্র এক রাকআত নামায পড়তে হবে এবং ওটাও আবার পৃথক পৃথকভাবে হেঁটে হেঁটে, সোয়ারীর উপরে, কিবলার দিকে মুখ করে বা না করে, বরং যে দিকে মুখ করে পড়া সম্ভব সে দিকেই পড়তে হবে। যেমন এর হাদীস পূর্বে বর্ণিত হয়েছে।
এখন ইমাম ও জামাআতের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। এ আয়াতটি জামাআত ওয়াজিব হওয়ার প্রকৃষ্ট ও দৃঢ় দলীল। জামায়াতের কারণেই এত বড় সুবিধে দান করা হয়েছে। জামাআত ওয়াজিব না হলে এটা বৈধ করা হতো না। কেউ কেউ আবার এ আয়াত দ্বারা অন্য দলীলও গ্রহণ করেছেন। তারা বলেন যে, এ সম্বোধন যখন নবী (সঃ)-কে করা হচ্ছে তখন জানা যাচ্ছে যে, ‘সলাতুল খাওফ’ -এর হুকুম তাঁর পরে রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু এটা খুবই দুর্বল যুক্তি। এ যুক্তি ঐ রকমই যেমন যুক্তি ঐ লোকদের ছিল যারা খোলাফায়ে রাশেদীনকে যাকাত প্রদানে বিরত হয়েছিল এবং তারা কুরআন পাকের নিম্নেন আয়াতটিকে দলীল রূপে পেশ করেছিলঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি তাদের মাল হতে যাকাত গ্রহণ কর যদ্দ্বারা তুমি তাদেরকে পাক-পবিত্র করবে এবং তুমি তাদের জন্যে করুণার প্রার্থনা জানাও, নিশ্চয়ই তোমার প্রার্থনা তাদের জন্যে শান্তির কারণ হবে।’ (৯:১০৩) এ আয়াতকে কেন্দ্র করেই তারা বলেছিলঃ “আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পরে আর কাউকেও যাকাতের মাল প্রদান করবো না, বরং স্বহস্তে যাকে চাইবো তাকেই দেবো। আর শুধু তাকেই দেবো যার প্রার্থনা আমাদের জন্যে শান্তির কারণ হবে। কিন্তু ওটা তাদের বাজে যুক্তি ছিল। এ কারণেই সাহাবীগণ তাদের যুক্তি অগ্রাহ্য করেন এবং তাদেরকে যাকাত প্রদানে বাধ্য করেন। আর তাদের মধ্যে যারা এর পরেও যাকাত প্রদানে বিরত থাকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
এখন আমরা এ আয়াতটির ‘সিফাত’ বর্ণনা করার পূর্বে তার শান-ই-নমূল বর্ণনা করছি। তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে রয়েছে যে, বানূ নাজ্জারের একটি গোত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা তো প্রায়ই ভূ-পৃষ্ঠে পর্যটন করে থাকি। অতএব আমরা নামায কিরূপে আদায় করবো?’ তখন আল্লাহ তাআলা (আরবী) অর্থাৎ যখন তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে পর্যটন কর তখন তোমরা নামায কসর’ (সংক্ষেপ) করলে তোমাদের কোন দোষ নেই’-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। অতঃপর বছর ধরে আর কোন অহী অবতীর্ণ হয়নি।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক যুদ্ধে ছিলেন। তথায় তিনি যোহরের নামাযের জন্যে দাড়িয়ে যান। মুশরিকরা তখন পরস্পর বলাবলি করে, ‘খুব ভাল সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি মুসলমানদেরকে তাদের এ নামাযের অবস্থায় একযোগে অকস্মাৎ আক্রমণ করতে পারতাম।’ একথা শুনে অপর একজন বলে, ‘এ সুযোগ তো তোমরা আবার পাবে। ক্ষণেক পরেই তো তারা অপর একটি নামাযের (আসরের) জন্যে দাঁড়াবে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা আসরের নামাযের পূর্বেই এবং যোহরের পরে (আরবী) হতে পূর্ণ দু’টি আয়াত অবতীর্ণ করেন। ফলে কাফিররা বিফল মনোরথ হয়। এ বর্ণনাটি অত্যন্ত গারীব। বা দুর্বল হলেও ওকে দৃঢ়কারী অন্যান্য বর্ণনাও রয়েছে। হযরত আবু আইয়াশ (রাঃ) বলেন, ‘আসফান’ নামক স্থানে আমরা নবী করীম (সঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ) সে সময় কুফরীর অবস্থায় ছিলেন এবং তিনি ছিলেন মুশরিক সেনাবাহিনীর সেনাপতি। মুশরিকরা আমাদের সামনে কিবলামুখী হয়ে অবস্থান করছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে আমরা যোহরের নামায আদায় করি। মুশরিকরা তখন পরস্পর বলাবলি করেঃ ‘আমরা তো সুযোগ ছেড়ে দিলাম। সময় এমন ছিল যে, তারা নামাযে লিপ্ত ছিল, এ অবস্থায় আমরা তাদেরকে অতর্কিতভাবে আক্রমণ করতাম। তখন তাদের কয়েকজন জ্ঞানী ব্যক্তি বললো, ‘ভাল, কোন অসুবিধে নেই। এরপরে আর একটা নামাযের সময় আসছে এবং সে সময় নামায তাদের নিকট তাদের পুত্র ও স্বীয় প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়। অতঃপর যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে আল্লাহ তা’আলার হুকুমে হযরত জিবরাঈল (আঃ) (আরবী) আয়াতটি নিয়ে অবতীর্ণ হন। ফলে আসরের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে অস্ত্র গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। আমরা তখন অস্ত্র গ্রহণ করতঃ তাঁর পিছনে দু’টি সারি হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। অতঃপর তিনি রুকু করলে আমরা সবাই রুকূ করি। তারপর নবী (সঃ) সিজদা করেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর পিছনের প্রথম সারির লোকেরাও সিজদা করে এবং অন্য সারির লোকেরা তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। তারপর যখন এ লোকগুলো সিজদাকার্য সমাপ্ত করে দাঁড়িয়ে যায় তখন দ্বিতীয় সারির লোকগুলো সিজদায় চলে যায়। যখন এ দু’টি সারির লোকেরই সিজদা করা হয়ে যায় তখন প্রথম সারির লোকগুলো দ্বিতীয় সারির লোকদের স্থানে চলে যায়, আর দ্বিতীয় সারির লোকেরা প্রথম সারির লোকদের স্থানে চলে আসে। এরপর কিয়াম, রুকু’ এবং কাওমা সবই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গেই আদায় করে। তারপর যখন তিনি সিজদায় যান তখন প্রথম সারির লোকেরা তার সাথে সিজদা করে এবং দ্বিতীয় সারির লোকেরা দাড়িয়ে পাহারা দিতে থাকে। যখন প্রথম সারির লোকেরা সিজদা সেরে আত্তাহিয়্যাতে বসে পড়ে তখন দ্বিতীয় সারির লোকগুলো সিজদায় যায় এবং আত্তাহিয়াতে সবাই এক সঙ্গে হয়ে যায় এবং সালামও সকলেই নবী (সঃ)-এর সঙ্গে এক সাথেই ফিরায়।
‘সালাতুল খাওফ’ (ভয়ের নামায) রাসূলুল্লাহ (সঃ) একবার প্রথমে এ আসফান’ নামক স্থানে পড়েন এবং দ্বিতীয়বার বানূ সালিমের ভূমিতে পড়েন। এ হাদীসটি মুসনাদ-ই-আহমাদ, সুনান-ই-আবি দাউদ এবং সুনান-ই-নাসাঈর মধ্যেও রয়েছে। এর ইসনাদ বিশুদ্ধ এবং এর শাহেদও অনেক রয়েছে।
সহীহ বুখারীর মধ্যেও এ বর্ণনাটি সংক্ষিপ্তভাবে রয়েছে এবং তাতে আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী (সঃ) নামাযে দাঁড়িয়ে গেলে ললাকেরাও তার সাথে দাড়িয়ে যায়। তিনি তাকবীর বললে তারাও তাকবীর বলে। তিনি রুকু’ করলে লোকেরাও তাঁর সাথে রুকু করে। অতঃপর তিনি সিজদা করলে তারাও তাঁর সাথে সিজদা করে। তারপর তিনি দ্বিতীয় রাকআতের জন্যে দাড়িয়ে যান। তার সাথে তারাও দাড়িয়ে যান যারা তার সাথে। সিজদা করেছিল এবং তারপরে তারা তাদের ভাইদেরকে পাহারা দিতে থাকে। অতঃপর দ্বিতীয় দল চলে আসে তারা তার সাথে রুকু ও সিজদা করে। লোকেরা সবাই নামাযের মধ্যেই ছিল বটে, কিন্তু একে অপরকে পাহারাও দিচ্ছিল।
তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে রয়েছে যে, হযরত সুলাইমান ইবনে কায়েস ইয়াসকারী (রঃ) হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ নামায কসর করার হুকুম কখন অবতীর্ণ হয়েছে?’ তখন তিনি বলেন, ‘কুরাইশদের একটি যাত্রী দল সিরিয়া হতে আসছিল। আমরা তাদের দিকে গমন করি। আমরা নাখল নামক স্থানে পৌঁছলে একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পৌছে যায় এবং তাঁকে বলে, “হে মুহাম্মাদ ! আপনি কি আমাকে ভয় করেন না?’ তিনি বলেনঃ না।’ সে বলেঃ আপনাকে আমা হতে কে বাঁচাতে পারে?’ তিনি বলেনঃ “আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে নেবেন। অতঃপর তিনি তরবারী বের করে তাকে ধমক দেন ও ভয় প্রদর্শন করেন। তারপর তিনি তথা হতে প্রস্থানের নির্দেশ দেন এবং অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চলতে আরম্ভ করেন। অতঃপর আযান দেয়া হয় এবং সাহাবীগণ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। একদল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে নামায আদায় করছিলেন এবং অন্য দল পাহারা দিচ্ছিলেন। যে দলটি তাঁর সাথে মিলিত ছিলেন তাঁরা তাঁর সাথে দু’রাকআত পড়ে নেন। অতঃপর পিছনে সরে গিয়ে অন্য দলটির স্থানে চলে যান। এবং ঐদলটি তখন সম্মুখে অগ্রসর হয়ে প্রথম দলটির স্থানে দাঁড়িয়ে যান। তাদেরকেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) দু’রাকআত পড়িয়ে দেন এবং সালাম ফেরান। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চার রাকআত হয় এবং ঐ দু’দলের-দু’রাকআত করে হয়, আর আল্লাহ তা’আলা নামায সংক্ষেপ করার ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে রাখার হুকুম নাযিল করেন।’
মুসনাদ-ই-আহমাদের এ হাদীসেই রয়েছে যে, যে লোকটি তরবারী নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আক্রমণে উদ্যত হয়েছিল সে শত্রুগোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তার নাম ছিল গারাস ইবনে হারিস। যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহ তা’আলার নাম উচ্চারণ করেন তখন তার হাত হতে তরবারী পড়ে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সে তরবারী উঠিয়ে নেন। অতঃপর তাকে বলেনঃ এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে?’ সে তখন ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, আপনি আমার প্রতি সদয় হোন।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বলেনঃ তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল?’ সে বলেঃ না, তবে আমি এটা স্বীকার করছি যে, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবো না এবং যারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তাদেরও সহযোগিতা করবো না।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে ছেড়ে দেন। সে নিজের লোকদের নিকট গিয়ে বলে, আমি দুনিয়ার সর্বোত্তম লোকের নিকট হতে তোমাদের নিকট এসেছি। অন্য বর্ণনায় রয়েছে। যে, ইয়াযীদ আল ফাকীর (রঃ) হযরত জাবীর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘সফরে যে দু’রাকআত নামায রয়েছে ওটা কি ‘কসর’? তিনি উত্তরে বলেনঃ ওটা পূর্ণ নামায। কসর’ তো জিহাদের সময় মাত্র এক রাকআত।’ অতঃপর তিনি এভাবেই ‘সলাতুল খাওফ’-এরও বর্ণনা দেন। তাতে এও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সালামের সাথে পিছনের লোকগুলোও সালাম ফেরান, আর ঐ লোকগুলোও সালাম ফেরান। তাতে উভয় অংশের সৈন্যদের সাথে এক রাকআত করে নামায পড়ার বর্ণনা রয়েছে। সুতরাং সকলেরই এক রাকআত করে হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দু’রাকআত হয়।
অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, একটি দল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনে কাতারবন্দী হয়ে নামায পড়ছিলেন এবং অন্য দল শক্রর সম্মুখে ছিলেন। এক রাকআতের পর তার পিছনের লোকগুলো ঐ দলের স্থানে চলে যান এবং তাঁরা এখানে চলে আসেন। এ হাদীসটি বহু পুস্তকে বহু সনদসহ হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত রয়েছে। আর যে হাদীসটি হযরত সালিম (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন তাতে এও রয়েছে যে, পরে সাহাবীগণ দাড়িয়ে নিজে নিজে এক রাকআত করে আদায় করে নেন। ঐ হাদীসটিরও বহু সনদ ও বহু শব্দ রয়েছে। হাফিয আবু বকর ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) এ সমস্তই জমা করেছেন এবং ঐ রকমই ইবনে জারীরও (রঃ) জমা করেছেন। এটা আমরা ইনশাআল্লাহ কিতাবুল আহকামিল কাবীরে লিখবো।
কারও কারও মতে ভয়ের নামাযে অস্ত্র সঙ্গে রাখার নির্দেশ বাধ্যতামূলক। কেননা, আয়াতের প্রকাশ্য শব্দগুলো দ্বারা এটাই বুঝা যায়। ইমাম শাফিঈরও (রঃ) এটাই উক্তি। এ আয়াতেরই পরবর্তী বাক্য এ উক্তির অনুকূলে রয়েছে। তথায় বলা হয়েছে-“যদি তোমরা বৃষ্টিপাতে বিব্রত হয়ে অথবা পীড়িত অবস্থায় অস্ত্র-শস্ত্র পরিত্যাগ কর তবে এতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই।’
তারপর বলা হচ্ছে-‘তোমরা স্বীয় আত্মরক্ষিকা সঙ্গে গ্রহণ কর।’ অর্থাৎ এমন প্রস্তুত থাক যে, সময় আসলেই যেন বিনা কষ্ট ও অসুবিধেতেই অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হতে পার। আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের জন্যে অপমানজনক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] আয়াতে বর্ণিত সালাতটিকে বলা হয়, ‘সালাতুল খওফ’ বা ভয়-ভীতিকালীন নামায। এ আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ‘উসফান’ উপত্যকায় অবস্থান করছিলেন। রাসূল সাহাবাদের নিয়ে যোহরের সালাত আদায় করতে দেখে কাফেরদের কেউ কেউ বলে বসল যে, এ সময় যদি আক্রমণ করা যেতো তবে তাদেরকে জব্দ করা যেতো। তখন তাদের একজন বলল, এরপর তাদের আরেকটি সালাত রয়েছে, যা তাদের কাছে আরও প্রিয়। অর্থাৎ আসরের সালাত। তখন তাদের কেউ কেউ সে সময়ে মুসলিমদের উপর আক্রমণের ইচ্ছা পোষণ করলে, আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে ‘সালাতুল খাওফ’ পড়ার নিয়ম-পদ্ধতি বর্ণনা করে দেন। [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ ২/৪৬৩; মুসান্নাফ আবদির রাযযাক ২/৫০৫; মুসনাদে আহমাদ ৪/৫৯; আবুদাউদ ১২৩৬: নাসায়ী: ১৭৭; মুস্তাদরাকে হাকিম ২/৩০৮]
[২] আয়াতে বলা হয়েছেঃ আপনি যখন তাদের মধ্যে থাকেন-এতে এরূপ মনে করার অবকাশ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানের পর এখন ‘সালাতুল খওফ’- বা ভয়-ভীতিকালীন নামায- এর বিধান নেই। কেননা, তখনকার অবস্থা অনুযায়ী আয়াতে এ শর্ত বর্ণিত হয়েছে। নবী বিদ্যমান থাকলে ওযর ব্যতীত অন্য কেউ সালাতে ইমাম হতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এখন যে ইমাম হবেন, তিনিই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন এবং ‘সালাতুল খওফ’ পড়াবেন। সব ফেকাহবিদের মতে ‘সালাতুল খওফ’-এর বিধান এখনো অব্যাহত রয়েছে, রহিত হয়নি। মানুষের পক্ষ থেকে বিপদাশংকার কারণে ‘সালাতুল খওফ’ পড়া যেমন জায়েয, তেমনিভাবে যদি বাঘ-ভালুক কিংবা অজগর ইত্যাদির ভয় থাকে এবং সালাতের সময়ও সংকীর্ণ হয়, তাহলে তখনো সালাতুল খওফ পড়া জায়েয। আয়াতে উভয় দলের এক এক রাকা’আত পড়ার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় রাকাআতের নিয়ম হাদীসে উল্লেখিত রয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’ রাকা’আতের পর সালাম ফিরিয়েছেন। [বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, বুখারী: ৯৪২: মুসলিম: ৩০৫, ৩০৬; তিরমিযী: ৩০৩৫; আবু দাউদ: ১২৪২]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এই আয়াতে ‘স্বালাতুল খাউফ’ পড়ার অনুমতি বরং নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ‘স্বালাতুল খাউফ’এর অর্থ ভয়ের নামায। এ নামায তখন বিধেয় যখন মুসলিম ও কাফেরদের সৈন্য একে অপরের সাথে যুদ্ধের জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াবে এবং ক্ষণেকের অন্যমনস্কতা মুসলিমদের কঠিন বিপদের কারণ হতে পারে, এ রকম অবস্থায় যদি নামাযের সময় হয়ে যায়, তাহলে ‘স্বালাতুল খাউফ’ পড়ার নির্দেশ আছে। এই নামাযের বিভিন্ন নিয়ম হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, সৈন্য দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল শত্রুর মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে থাকল, যাতে কাফেরদলের আক্রমণ করার সাহস না হয় এবং অপর দল এসে নবী করীম (সাঃ)-এর পিছনে নামায পড়ল। এ দল নামায সমাপ্ত করে প্রথম স্থানে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে গেল এবং অপর দল নামাযের জন্য এসে গেল। কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি উভয় দলকে এক রাকআত করে নামায পড়ান। এইভাবে রসূল (সাঃ)-এর দু’রাকআত এবং সৈন্যদের এক রাকআত করে নামায হয়। কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি (সাঃ) তাদেরকে দুই রাকআত করে নামায পড়ান। এইভাবে রসূল (সাঃ)-এর চার রাকআত এবং সৈন্যদের দুই রাকআত করে হয়। কোন বর্ণনায় এসেছে, এক রাকআত পড়ে তাশাহহুদের মত বসে যান। সৈন্যরা নিজে থেকেই আর এক রাকআত পূর্ণ করে শত্রুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। অতঃপর অপর দল এসে রসূল (সাঃ)-এর পিছনে নামাযে দাঁড়ান। তিনি এদেরকেও এক রাক’আত নামায পড়িয়ে তাশাহহুদে বসে যান এবং সৈন্যদের দ্বিতীয় রাকআত পূর্ণ না করে নেওয়া পর্যন্ত বসে থাকেন। অতঃপর তাদের সাথে তিনি (সাঃ) সালাম ফিরান। এইভাবে রসূল (সাঃ)-এর এবং সৈন্যদের উভয় দলেরও দুই রাকআত করে হয়। (দ্রষ্টব্যঃ হাদীস গ্রন্থ)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সালাতুল খাওফ শরীয়তসিদ্ধ।
২. সালাতুল খাওফের নিয়ম-বিধি।
৩. শত্র“দের বিরুদ্ধে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।
৪. এ আয়াতের অন্যতম শিক্ষা হল জামা‘আতে সালাত আদায় করা আবশ্যক।