أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٨٤)-৩৮৬
www.motaher21.net
قَدْ جَآءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتٰبٌ مُّبِينٌ
অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে।
Explaining the Truth Through the Messenger and the Qur’an .
সুরা: আল্ মায়িদাহ
আয়াত নং :-১৫-১৬
5:15
يٰٓأَهْلَ الْكِتٰبِ قَدْ جَآءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتٰبِ وَيَعْفُوا عَن كَثِيرٍ ۚ قَدْ جَآءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتٰبٌ مُّبِينٌ
হে কিতাবীগণ, তোমাদের নিকট আমার রাসূল এসেছে, কিতাব থেকে যা তোমরা গোপন করতে, তার অনেক কিছু তোমাদের নিকট সে প্রকাশ করছে এবং অনেক কিছু ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে।
يَهْدِى بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوٰنَهُۥ سُبُلَ السَّلٰمِ وَيُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمٰتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِۦ وَيَهْدِيهِمْ إِلٰى صِرٰطٍ مُّسْتَقِيمٍ
এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন।
১৫-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
আহলে কিতাবদের থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ ও তাদের দ্বারা সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা আলোচনা করার পর তাদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেন: আমি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আরব, অনারব, আহলে কিতাব ও নিরক্ষর সকলের জন্য নাবী হিসেবে প্রেরণ করেছি। তাঁকে সুষ্পষ্ট প্রমাণ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে প্রেরণ করেছি। সুতরাং তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। তোমাদেরকে যে কিতাব দেয়া হয়েছে তা থেকে যা গোপন করেছ, তিনি তার অনেক বর্ণনা করে দেবেন, যেমন বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা ইত্যাদি। তবে অধিকাংশই ক্ষমা করে দেবেন। এটা হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও নবুওয়াতের সত্যতার অকাট্য প্রমাণ।
(نُوْرٌ وَّكِتٰبٌ مُّبِيْنٌ)
‘জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব’এখানে نُوْرٌ (আলো) ও وَّكِتٰبٌ مُّبِيْنٌ ( সুস্পষ্ট কিতাব) দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاٰمِنُوْا بِاللّٰهِ وَرَسُوْلِه۪ وَالنُّوْرِ الَّذِيْٓ أَنْزَلْنَا)
“অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং যে জ্যোতি আমি অবতীর্ণ করেছি তাতে বিশ্বাস স্থাপন কর।” (সূরা তাগাবুন ৬৪:৮, তাফসীরে সা‘দী, পৃঃ ২১৪)
এ জ্যোতিপূর্ণ কুরআন দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে হিদায়াত দান করেন যারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং শান্তির পথে চলে। অতএব যারা নূর দ্বারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বুঝায় তাদের ব্যাখ্যা ভুল। আর যারা বলে সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদের নূর সৃষ্টি করেছেন তাও মিথ্যা। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
أَوَّلُ مَاخَلَقَ اللّٰهُ الْقَلَمَ
আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। (তিরমিযী হা: ২১৫৫, আবূ দাঊদ হা: ৪৭০০, সহীহ )।
“আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম মুহাম্মাদের নূর সৃষ্টি করেছেন” এ মর্মে হাদীসটি বানোয়াট। (তালীকাতে মিশকাত ১/৩৪, মেরকাতুল মাফাতিহ ১/৩৮৭)
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন মাটির তৈরি রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তিনি আবদুল্লাহর ঔরসে আমিনার গর্ভে জন্ম লাভ করেছেন। শুধু পার্থক্য এই যে, তিনি রাসূল, তাঁর নিকট ওয়াহী আসে আর সাধারণ মানুষের নিকট ওয়াহী আসে না, যার ফলে তাঁর মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ إِنَّمَآ أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحٰٓي إِلَيَّ أَنَّمَآ إلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ)
“বল: ‘আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ্ কেবল এক ইলাহ্।”(সূরা কাহফ ১৮:১১০)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আহলে কিতাবদেরকে ইসলামের দিকে আল্লাহ তা‘আলা আহ্বান জানিয়েছেন।
২. আহলে কিতাবগণ অনেক শরয়ী বিধানকে গোপন করেছিল তা প্রকাশিত হয়েছে কুরআনে।
৩. নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা পৃথিবীর সকল মানব ও দানবের রাসূল, তাঁর প্রতি ঈমান আনা সকলের জন্য আবশ্যক।
৪. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মত আদম সন্তান ও মাটির তৈরি মানুষ।
৬. হিদায়াত প্রার্থীদের আল্লাহ তা‘আলা হিদায়াত দেন।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Al Mayadah
Verse:- 15-16
قَدْ جَآءَكُم مِّنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتٰبٌ مُّبِينٌ
Explaining the Truth Through the Messenger and the Qur’an .
Allah states that He sent His Messenger Muhammad with the guidance and the religion of truth to all the people of the earth, the Arabs and non-Arabs, lettered and unlettered.
Allah also states that He sent Muhammad with clear evidences and the distinction between truth and falsehood.
Allah said,
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
O People of the Scripture! Now has come to you Our Messenger explaining to you much of that which you used to hide from the Scripture and passing over much.
So the Prophet explained where they altered, distorted, changed and lied about Allah. He also ignored much of what they changed, since it would not bring about any benefit if it was explained.
In his Mustadrak, Al-Hakim recorded that Ibn Abbas said,
“He who disbelieves in stoning (the adulterer to death) will have inadvertently disbelieved in the Qur’an, for Allah said,
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ
(O People of the Scripture! Now has come to you Our Messenger explaining to you much of that which you used to hide from the Scripture) and stoning was among the things that they used to hide.”
Al-Hakim said, “Its chain is Sahih, and they did not record it.”
Allah next mentions the Glorious Qur’an that He sent down to His honorable Prophet,
يَهْدِي بِهِ اللّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَمِ
Indeed, there has come to you from Allah a light and a plain Book. Wherewith Allah guides all those who seek His pleasure to ways of peace.
meaning, ways of safety and righteousness,
وَيُخْرِجُهُم مِّنِ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ
and He brings them out of darkness by His permission unto light and guides them to a straight path.
He thus saves them from destruction and explains to them the best, most clear path. Therefore, He protects them from what they fear, and brings about the best of what they long for, all the while ridding them of misguidance and directing them to the best, most righteous state of being.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
১৫-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, তিনি স্বীয় উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে হিদায়াত ও দ্বীনে হকসহ সমস্ত মাখলুকের নিকট পাঠিয়েছেন। মুজিযা ও উজ্জ্বল প্রমাণাদি তাঁকে দান করেছেন। যে কথাগুলো ইয়াহূদ ও নাসারাগণ বদলিয়ে দিয়েছিল, ভুল ব্যাখ্যা করে অন্য অর্থ বানিয়ে নিয়েছিল, আল্লাহর সত্তার উপর অপবাদ দিয়েছিল, কিতাবুল্লাহর যে অংশটি তাদের জীবনের প্রতিকুল ছিল তা তারা গোপন করে দিয়েছিল। ঐ সব কিছুই এ রাসূল (সঃ) প্রকাশ করে দেন। তবে যেগুলো বর্ণনা করার কোন প্রয়োজন। নেই সেগুলো তিনি বর্ণনা করেন না। মুসতাদরিকে হাকিম গ্রন্থে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি রজম বা ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করার মাসআলাকে অস্বীকার করলো সে অজ্ঞতা বশতঃ কুরআন কারীমকে অস্বীকার করলো। কেননা,এ আয়াতে ঐ রজমকেই গোপন করার উল্লেখ রয়েছে। (ইবনে জারীর (রঃ) তাখরীজ করেছেন যে, ইয়াহূদীরা নবী (সঃ)-এর কাছে এসে রজম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পণ্ডিত কে?’ তারা ইঙ্গিতে ইবনে সুরিয়াকে দেখালো। তখন তিনি তাকে সেই আল্লাহর কসম দিলেন যিনি হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলেন এবং বানী ইসরাঈলের উপর তুর পাহাড় ও অঙ্গীকার তুলে ধরেছিলেন। তখন সে বললোঃ “যখন আমাদের মধ্যে ব্যভিচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো তখন ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে একশ চাবুক মারার ও মাথা মুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের উপর রজমের বিধান জারী করেন। সে সময় আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন)
এরপর মহান আল্লাহ কুরআন কারীম সম্পর্কে বলেন যে, তিনিই তাঁর প্রিয় নবী (সঃ)-এর উপর তার এ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যা সত্য সন্ধানীদেরকে শান্তির পথ দেখিয়ে দেয়, লোকদেরকে অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে নিয়ে আসে এবং তাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করে। এ কিতাবের কারণে আল্লাহর নিয়ামতসমূহ লাভ করা এবং তার শাস্তি হতে রক্ষা পাওয়া খুবই সহজ। এটা ভ্রান্তিকে বিদূরিতকারী এবং হিদায়াতকে প্রকাশকারী।
তাবসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:৩৭) অর্থাৎ তোমাদের অনেক চুরি ও খেয়ানত ফাঁস করে দিচ্ছেন, আল্লাহর সত্য দ্বীন কায়েম করার জন্য যেগুলো ফাঁস করে দেয়া অপরিহার্য। আর যেগুলো ফাঁস করে দেয়ার তেমন কোন যথার্থ প্রয়োজন নেই সেগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন।
টিকা:৩৮) শান্তি ও নিরাপত্তা মানে ভুল দেখা, ভুল আন্দাজ-অনুমান করা ও ভুল কাজ করা থেকে দূরে থাকা এবং এর ফলাফল থেকেও নিজেকে সংরক্ষিত রাখা। যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের জীবন থেকে আলো সংগ্রহ করে, চিন্তা ও কর্মের প্রতিটি চৌমাথায় পৌঁছে সে কিভাবে এ ভুলগুলো থেকে সংরক্ষিত থেকেছে তা বুঝতে পারে।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি তাদের মধ্যকার মতভেদপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পথ বলে দেবার পাশাপাশি তারা যে সমস্ত বিষয় গোপন করেছে সেগুলোর অনেকটাই প্রকাশ করে দেন। [ইবন কাসীর] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যে ব্যক্তি ‘রাজম’ তথা বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যার কথা অস্বীকার করবে, সে কুরআনের সাথে এমনভাবে কুফরী করল যে সে তা বুঝতেই পারছে না। আল্লাহ্ তা’আলার বাণী, ‘হে কিতাবীরা আমাদের রাসূল তোমাদের নিকট এসেছেন, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে তিনি সে সবের অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করছেন’। তারা যে সমস্ত জিনিস গোপন করেছিল, রজমের বিধান ছিল তার একটি। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৩৫৯]
[২] এ আয়াতে উল্লিখিত ‘নুর’ সম্পর্কে আলেমদের বিভিন্ন মন্তব্য রয়েছে। যা মূলত পরস্পর সম্পূরক, বিপরীত নয়। কারও কারও মতে, এখানে ‘নূর’ দ্বারা উদ্দেশ্য, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কারও কারও মতে, কিতাব বা কুরআন। বস্তুত রাসূল ও কিতাব একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই রাসূল ও কিতাব উভয় ক্ষেত্রেই ‘নুর’ বিশেষণ ব্যবহার হয়। এখানে নূর দ্বারা উদ্দেশ্য, ইসলামের দিকে আহবানকারী রাসূল, ইসলামের বিধানসম্বলিত কিতাব, অথবা রাসূল ও কিতাব উভয়ই । আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় রাসূল ও কিতাব উভয়কে নূর বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। যেমন সূরা আহযাবের ৪৫-৪৬ নং আয়াতে ‘নূর’ ধাতু থেকে উদগত কর্তাবাচক বিশেষ্য ‘মুনীর’ শব্দ দ্বারা রাসূলকে বিশেষিত করা হয়েছে। আবার একাধিক জায়গায় আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কিতাব কুরআনকে ‘নূর’ দ্বারা বিশেষিত করেছেন। যেমন, সূরা আশ-শূরাঃ ৫২; সূরা আল-আ’রাফ: ১৫৭; সূরা আত-তাগাবুন: ৮; সূরা আন-নিসা: ১৭৪৷
এসব জায়গায় ‘নূর’ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা তাঁর অহী তথা শুধু কুরআনুল কারীমকে বুঝিয়েছেন। অন্যত্র অনুরূপভাবে অন্যান্য নবীদের উপর নাযিলকৃত কিতাবকেও তিনি ‘নুর’ আখ্যা দিয়েছেন। যেমন, সূরা আল-আন’আমঃ ৯১; সূরা আল-মায়িদাহ ৪৪, ৪৬।
কুরআনের এসব আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আসমান থেকে নাযিলকৃত আল্লাহর সকল কিতাবই ‘নূর’। লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যেরূপ ‘নুর’ শব্দের কর্তাবাচক শব্দ ‘মুনীর’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, অনুরূপ বিশেষণ আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের জন্য ব্যবহার করেছেন। যেমন, সূরা আলে-ইমরান ১৮৫।
এ থেকে বুঝা যায় যে, রাসূল, নাযিলকৃত অহী এবং সকল আসমানী কিতাব ‘নূর’; যা বান্দাদের প্রতি তাদের রবের পক্ষ থেকে আগমন করেছে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তাকেই হিদায়াত করেন, যে তার সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, অর্থাৎ তার মনোনীত দ্বীনের আলোকে চলে। কুরআনের অন্যত্র এ ঘোষণা এসেছে, যেমন সূরা আল-মায়িদাহ ৩; সূরা আয-যুমার: ২২; সূরা আল-আনআমঃ ১২২৷
অতএব এ ‘নূর’ হচ্ছে অহীর নূর। এর মাধ্যমে বান্দা তার রবের ইবাদাত সম্পর্কে দিকনির্দেশনা লাভ করে। মানুষের সাথে সম্পর্কের নীতিমালা অর্জন করে। এ নূরই তার সঙ্গীতে পরিণত হয় এবং পথহারা অবস্থায় এ নুর দ্বারাই সে পথের সঠিক দিশা লাভ করে। মোদ্দাকথাঃ নূর অর্থ অহী, এ অহী যেহেতু রাসূলের উপর নাযিল হয়েছে, তাই কখনো তাকে নূর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে, কখনো কুরআনকে, কখনো তাওরাত ও ইঞ্জিলকে। অতএব আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী সম্বলিত রাসূল ও স্পষ্ট কিতাব আগমন করেছে।
[৩] সুদ্দী বলেন, শান্তির পথ হচ্ছে, আল্লাহর পথ যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য প্রবর্তন করেছেন এবং সেদিকে আহবান করেছেন। আর যা নিয়ে তিনি তাঁর রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন। সেটিই হচ্ছে, ইসলাম। কোন মানুষ থেকে তিনি এটা ব্যতীত আর কোন আমল গ্রহণ করবেন না। ইয়াহুদীবাদও নয়, খ্রিষ্টবাদও নয়, মাজুসীবাদও নয়। [তাবারী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ, তারা তাওরাত ও ইঞ্জীলের মধ্যে যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করেছে, রসূল (সাঃ) তা উদঘাটন করেছেন এবং যা তারা গোপন করেছিল, তা তিনি প্রকাশ করে দিয়েছেন। যেমন, বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর ছুঁড়ে মারার শাস্তিকে তারা গোপন করেছিল; যার বিস্তারিত বিবরণ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
[২] (نُورٌ وَّكِتَابٌ مُبِين) এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ‘নূর ও কিতাবুন মুবীন’ (জ্যোতি ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ) একই সাথে উল্লেখ করেছেন এবং এই দুইয়েরই উদ্দেশ্য হচ্ছে কুরআন কারীম। কেননা এই দুইয়ের মধ্যে وَ সংযোজক অব্যয়টি পাশাপাশি দুই বিশেষ্যের ভিন্নতা বুঝাতে ব্যবহূত হয়নি; বরং অর্থের ভিন্নতা বুঝাতে ব্যবহূত হয়েছে। এই অব্যয়টি আসলে ব্যাখ্যাকারী সংযোজক অব্যয়। যার স্পষ্ট প্রমাণ কুরআনের পরবর্তী আয়াত, যেখানে বলা হচ্ছে يَهدِي بِهِ الله অর্থাৎ তার দ্বারা আল্লাহ হিদায়াত করেন বা সুপথ দেখান। যদি نور ও كتاب আলাদা আলাদা জিনিস হত, তাহলে কুরআনের এই বাক্যটি এইরূপ হত, يَهدِي بِهِمَا الله অর্থাৎ, সর্বনামটি একবচন না হয়ে দ্বিবচন হত (ه) একবচন না হয়ে هما দ্বিবচন হত এবং অনুবাদ দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন’ না হয়ে) দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন’ হত। কুরআনের এই বাক্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে গেল যে, ‘নূর’ ও ‘কিতাবে মুবীন’ উভয় থেকে উদ্দেশ্য ‘কুরআন কারীম’। এ নয় যে, ‘নূর’ থেকে উদ্দেশ্য মুহাম্মাদ (সাঃ) আর ‘কিতাবে মুবীন’ থেকে উদ্দেশ্য কুরআন মাজীদ; যেমনটি বিদআত পন্থীদের ধারণা; যারা এই আকীদায় বিশ্বাসী যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর নূরের অংশ বিশেষ এবং যারা অস্বীকার করে যে, তিনি একজন মানুষ। (অথচ ‘নূর’ বলতে যে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে, তার প্রমাণ রয়েছে সূরা তাগাবুনের ৬৪:৮ নং আয়াতে। সেখানে মহান আল্লাহ বলেন, {فَآمِنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَالنُّورِ الَّذِي أَنزَلْنَا} অর্থাৎ, সুতরাং তোমরা ঈমান আনয়ন কর আল্লাহর প্রতি, তাঁর রসূলের প্রতি এবং সেই ‘নূর’ বা জ্যোতির প্রতি, যা আমি অবতীর্ণ করেছি।) অনুরূপ এই মনগড়া আকীদাকে সাব্যস্ত করার উদ্দেশ্যে তারা একটি হাদীসও বর্ণনা করে থাকে, “আল্লাহ সর্বপ্রথম নবী (সাঃ)-এর নূরকে সৃষ্টি করেন, তারপর তাঁর নূর থেকে সারা জগৎ সৃষ্টি করেন।” অথচ নির্ভরযোগ্য কোন হাদীসগ্রন্থে এই হাদীসটির উল্লেখ নেই। উপরন্তু এই হাদীসটি ঐ সহীহ হাদীসের পরিপন্থী, যাতে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, إن أول ماخلق الله القلم অর্থাৎ, সর্বপ্রথম আল্লাহ যা সৃষ্টি করেন, তা হল কলম। (তিরমিযী ও আবু দাউদ) (এ যুগের শ্রেষ্ঠ) মুহাদ্দিস আল্লামা আলবানী (রঃ) বলেন, হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ এবং এটি সেই প্রসিদ্ধ হাদীস বাতিল হওয়ার প্রকাশ্য প্রমাণ, যাতে বলা হয়েছে, “আল্লাহ সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেছেন হে জাবের!” (হাদীসটি বাতিল। দেখুনঃ তা’লীক্বাতে মিশকাত ১/৩৪)