أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٨٥)-৩৮৭
www.motaher21.net
لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوٓا
অবশ্যই তারা কুফরী করেছে যারা বলে,
Surely, in disbelief are they who say,
সুরা: আল্ মায়িদাহ
আয়াত নং :-১৭-১৮
لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوٓا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ ۚ قُلْ فَمَن يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْـًٔا إِنْ أَرَادَ أَن يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُۥ وَمَن فِى الْأَرْضِ جَمِيعًا ۗ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۚ يَخْلُقُ مَا يَشَآءُ ۚ وَاللَّهُ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
অবশ্যই তারা কুফরী করেছে যারা বলে ‘নিশ্চয় মারইয়াম পুত্র মাসীহই আল্লাহ’। বল, যদি আল্লাহ ধ্বংস করতে চান মারইয়াম পুত্র মাসীহকে ও তার মাকে এবং যমীনে যারা আছে তাদের সকলকে ‘তাহলে কে আল্লাহর বিপক্ষে কোন কিছুর ক্ষমতা রাখে? আর আসমানসমূহ, যমীন ও তাদের মধ্যবর্তী যা রয়েছে, তার রাজত্ব আল্লাহর জন্যই। তিনি যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করেন এবং আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصٰرٰى نَحْنُ أَبْنٰٓؤُا اللَّهِ وَأَحِبّٰٓؤُهُۥ ۚ قُلْ فَلِمَ يُعَذِّبُكُم بِذُنُوبِكُم ۖ بَلْ أَنتُم بَشَرٌ مِّمَّنْ خَلَقَ ۚ يَغْفِرُ لِمَن يَشَآءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَآءُ ۚ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۖ وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ
ইয়াহূদী ও নাসারারা বলে, ‘আমরা আল্লাহর পুত্র ও তার প্রিয়জন’। বল, ‘তবে কেন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের পাপের কারণে আযাব দেন? বরং তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত মানুষ, যাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছা আযাব দেন। আর আসমানসমূহ ও যমীন এবং তাদের মধ্যবর্তী যা আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহর এবং তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন’।
১৭-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের অসীম ক্ষমতা ও পূর্ণ সার্বভৌমত্বের মালিকানার কথা বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য হল: খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ আকীদাহ ও বিশ্বাসকে খণ্ডন করা। ঈসা (আঃ)-কে যারা আল্লাহ বলে বিশ্বাস করে তারা কাফির। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(لَقَدْ كَفَرَ الَّذِيْنَ قَالُوْآ إِنَّ اللّٰهَ ثَالِثُ ثَلٰثَةٍ)
“যারা বলে, ‘আল্লাহ তো তিনের মধ্যে একজন, তারা কুফরী করেছে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:৭৩)
আল্লাহ তা‘আলা যদি ঈসা ও তার মাতাকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করেন তাহলে কেউ কি বাঁচাতে পারবে? না পারবে না। তাহলে কিভাবে তারা আল্লাহ হতে পারে! এ জন্যই তিনি অত্র আয়াতের সাথেই সংযুক্ত করে বলেছেন: ‘আসমান ও জমিনের এবং এদের মধ্যে যা কিছু আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ অর্থাৎ আকাশ-জমিনের রাজত্ব তাঁর, তিনি যা ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি করতে পারেন। তিনি ইচ্ছা করলে কাউকে পিতা-মাতা ছাড়া সৃষ্টি করতে পারেন যেমন আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেছেন, আবার পিতা ছাড়াও সৃষ্টি করতে পারেন। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই বলে তিনি আল্লাহ বা আল্লাহর অংশ হয়ে যাবেন এমনটা নয়।
যুগে যুগে মানুষ কুফর, শির্ক ও গুমরাহীতে নিপতিত হবার বড় কারণ ছিল নাবী-রাসূল ও অলী-আওলিয়াদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা। তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে খ্রিস্টানরা ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ বানিয়ে ছিল, আর ইয়াহূদীরা উযাইর (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বানিয়ে ছিল। উম্মতে মুহাম্মাদীর এক শ্রেণির মানুষ অলী-আওলিয়াদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তাদেরকে আল্লাহর মর্যাদায় তুলে দিচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমরা বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাক, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তীরা বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়েছে। (ইবনু মাযাহ হা: ৩০২৯, সহীহ)
ইয়াহূদীরা উযায়েরকে আল্লাহ তা‘আলার পুত্র ও খ্রিস্টানরা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ বলে থাকে। মূলত এ দু’জনই আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র ও বান্দা এবং তাঁরা বান্দা পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেননি। যেমন সূরা নিসার ১৭২ নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। এমনকি তাঁরা কেউ নিজেদেরকে মা‘বূদ দাবী করেননি এবং নিজেদের ইবাদতের দিকে আহ্বান করেননি। এ সম্পর্কে অত্র সূরার ১১৬ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
(وَقَالَتِ الْيَهُوْدُ وَالنَّصٰرٰي نَحْنُ أَبْنٰ۬ؤُا اللّٰهِ وَأَحِبَّا۬ٓؤُه)
‘ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানগণ বলে, ‘আমরা আল্লাহর পুত্র ও তার প্রিয়পাত্র।’আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং তার উত্তর দিচ্ছেন: তাহলে কেন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের পাপের কারণে শাস্তি দেন। যদি প্রিয়পাত্রই হতে তাহলে তো শাস্তি দেয়ার প্রশ্নই আসে না।
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে এটা তাদের মিথ্যা দাবী। আল্লাহ তা‘আলা কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি এবং স্ত্রী হিসেবেও কাউকে গ্রহণ করেননি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یٰٓاَھْلَ الْکِتٰبِ لَا تَغْلُوْا فِیْ دِیْنِکُمْ وَلَا تَقُوْلُوْا عَلَی اللہِ اِلَّا الْحَقّ َ ﺚ اِنَّمَا الْمَسِیْحُ عِیْسَی ابْنُ مَرْیَمَ رَسُوْلُ اللہِ وَکَلِمَتُھ۫ ﺆ اَلْقٰٿھَآ اِلٰی مَرْیَمَ وَرُوْحٌ مِّنْھُﺑ فَاٰمِنُوْا بِاللہِ وَرُسُلِھ۪)
‘‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমাদের দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কর না ও আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বল না। মারইয়ামের ছেলে ‘ঈসা মসীহ তো আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মারইয়ামের নিকট প্রেরণ করেছিলেন ও তাঁর আদেশ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন।” (সূরা নিসা ৪:১৭১)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা হলেন ঈসা বা আল্লাহ তা‘আলা তিনজনের একজন বা আল্লাহ তা‘আলার সমতুল্য কোন গাউস, কুতুব, পীর-ফকির বা বাবা রয়েছে তারা কাফির।
২. ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের কর্তৃক তাদের আল্লাহ তা‘আলার পুত্র হবার দাবী মিথ্যা।
৩. সকল সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Al Mayadah
Verse:- 17-18
لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوٓا
Surely, in disbelief are they who say,
The Polytheism and Disbelief of the Christians
Allah says;
لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَألُواْ إِنَّ اللّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ
Surely, in disbelief are they who say that Allah is the Messiah, son of Maryam.
Allah states that the Christians are disbelievers because of their claim that `Isa, son of Maryam, one of Allah’s servants and creatures, is Allah. Allah is holier than what they attribute to Him.
Allah then reminds them of His perfect ability over everything and that everything is under His complete control and power,
قُلْ فَمَن يَمْلِكُ مِنَ اللّهِ شَيْيًا إِنْ أَرَادَ أَن يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَن فِي الَارْضِ جَمِيعًا
Say:”Who then has the least power against Allah, if He were to destroy the Messiah, son of Maryam, his mother, and all those who are on the earth together.”
Therefore, if Allah wills to do that, who would be able to stop Him or prevent Him from doing it.
Allah then said,
وَلِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالَارْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا يَخْلُقُ مَا يَشَاء
And to Allah belongs the dominion of the heavens and the earth, and all that is between them. He creates what He wills.
All things in existence are Allah’s property and creation and He is able to do everything. He is never asked about what He does with His power, domain, justice and greatness so this refutes the Christian creed, may Allah’s continued curses be upon them until the Day of Resurrection.
وَاللّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
And Allah is able to do all things.
Refuting the People of the Book’s Claim that they are Allah’s Children
Allah then refutes the Christians’ and Jews’ false claims and lies.
وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى نَحْنُ أَبْنَاء اللّهِ وَأَحِبَّاوُهُ
And the Jews and the Christians say, “We are the children of Allah and His loved ones.”
They claim:”We are the followers of Allah’s Prophets, who are His children, whom He takes care of. He also loves us.”
The People of the Book claim in their Book that Allah said to His servant Israil, “You are my firstborn.”
But they explained this statement in an improper manner and altered its meaning. Some of the People of the Book who later became Muslims refuted this false statement saying, “This statement only indicates honor and respect, as is common in their speech at that time.”
The Christians claim that `Isa said to them, “I will go back to my father and your father,” meaning, my Lord and your Lord.
It is a fact that the Christians did not claim that they too are Allah’s sons as they claimed about `Isa. Rather this statement by `Isa only meant to indicate closeness with Allah.
This is why when they said that they are Allah’s children and loved ones, Allah refuted their claim,
قُلْ فَلِمَ يُعَذِّبُكُم بِذُنُوبِكُم
Say, “Why then does He punish you for your sins!”
meaning, if you were truly as you claim, Allah’s children and loved ones, then why did He prepare the Fire because of your disbelief, lies and false claims!
بَلْ أَنتُم بَشَرٌ مِّمَّنْ خَلَقَ
Nay, you are but human beings, of those He has created,
Allah states:you are just like the rest of the children of Adam, and Allah is the Lord of all His creation.
يَغْفِرُ لِمَن يَشَاء وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاء
He forgives whom He wills and punishes whom He wills.
Allah does what He wills, there is none who can escape His judgment, and He is swift in reckoning.
وَلِلّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالَارْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا
And to Allah belongs the dominion of the heavens and the earth and all that is between them;
Therefore, everything is Allah’s property and under His power and control.
وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ
and to Him is the return.
In the end, the return will be to Allah and He will judge between His servants as He will, and He is the Most Just Who is never wrong in His judgment.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
আল্লাহ তা’আলা খ্রীষ্টানদের কুফরের কথা বর্ণনা করছেন যে, তারা আল্লাহরই সৃষ্টকে তাঁরই মর্যাদা প্রদান করছে। অথচ আল্লাহ শিরক থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। সমস্ত বস্তুই তার অনুগত এবং প্রত্যেক বস্তুর উপর তিনি পূর্ণ ক্ষমতাবান। সবকিছুরই উপরই তার আধিপত্য রয়েছে। এমন কেউ নেই যে তাঁকে তাঁর ইচ্ছে থেকে বিরত রাখতে পারে। যদি তিনি মাসীহ (আঃ)-কে, তার মাকে এবং ভূ-পৃষ্ঠের সমস্ত সৃষ্টজীবকে ধ্বংস করে দেয়ার ইচ্ছা করেন। তবুও কারও শক্তি নেই যে, তার সামনে এগিয়ে আসে এবং তাকে বাধা প্রদান করে। সমস্ত প্রাণী ও সৃষ্ট বস্তুর উদ্ভাবক ও সৃষ্টিকর্তা তিনিই। সকলের মালিক ও অধিকর্তা তিনিই। তিনি যা চান তা-ই করেন। কোন জিনিসই তার ক্ষমতার বাইরে নেই। কেউই তার কাজের কোন হিসাব নিতে পারে না। তাঁর রাজত্ব ও সাম্রাজ্য খুবই প্রশস্ত। তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব খুবই উচ্চ। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত, তিনি মহাকারিগর। তিনি যেভাবে চান সেভাবেই ভাঙ্গেন ও গড়েন। তার শক্তির কোন সীমা নেই।
খ্রীষ্টানদের দাবী খণ্ডনের পর এখন ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান উভয়েরই দাবীকে খণ্ডন করছেন। তারা আল্লাহর উপর একটা মিথ্যা আরোপ এভাবে করেছে যে, তারা আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা) ও প্রিয় পাত্র। তারা নবীদের পুত্র এবং আল্লাহর আদরের সন্তান। তারা নিজেদের কিতাব থেকে নকল করে বলে যে, আল্লাহ তাআলা ইসরাঈল (আঃ)-কে বলেছিলেনঃ অতঃপর তারা এর ভুল ব্যাখ্যা করে ভাবার্থ বদলিয়ে দিয়ে বলে তিনি যখন আল্লাহর পুত্র হলেন তখন আমরাও তাঁর পুত্র ও প্রিয়পাত্র হলাম। অথচ তাদেরই মধ্যে যারা ছিল জ্ঞানী ও বিবেচক তারাও তাদেরকে বুঝিয়ে বলেছিল যে, এ শব্দগুলো দ্বারা হযরত ইসরাঈল (আঃ)-এর শুধু মর্যাদা ও সম্মানই প্রমাণিত হচ্ছে মাত্র। এর দ্বারা তাঁর আল্লাহর সাথে আত্মীয়তার বা রক্তের সম্পর্ক কোনক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ অর্থেরই আয়াত খ্রীষ্টানেরা নিজেদের কিতাব থেকে নকল করেছিল যে, হযরত ঈসা (আঃ) বলেছিলেনঃ (আরবী) -এর দ্বারাও প্রকৃত পিতাকে বুঝায় না, বরং তাদের পরিভাষায় আল্লাহর জন্যেও এরূপ শব্দ ব্যবহৃত হতো। অতএব, এর ভাবার্থ হবে-আমি আমার ও তোমাদের প্রভুর নিকট যাচ্ছি। আর এর দ্বারা এটাও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যে, এখানে এ আয়াতে যে সম্পর্ক হযরত ঈসা (আঃ)-এর রয়েছে ঐ সম্পর্কই তাঁর সমস্ত উম্মতের দিকেও রয়েছে। কিন্তু এ লোকগুলো নিজেদের ভুল আকীদায় আল্লাহর সাথে হযরত ঈসা (আঃ)-এর যে সম্পর্ক স্থাপন করতে, নিজেদের ব্যাপারে তা মনে করতো না। সুতরাং এ শব্দ শুধুমাত্র সম্মান ও মর্যাদার জন্যেই ছিল, অন্য কিছুর জন্যে ছিল না।
আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তর দিচ্ছেন-যদি এটা ঠিকই হয় তবে তোমাদের কুফর ও মিথ্যা আরোপের কারণে আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন কেন? কোন একজন সুফী একজন ফিকাহশাস্ত্রবিদকে জিজ্ঞেস করেনঃ “কুরআন মাজীদের মধ্যে কোন জায়গায় এটাও কি আছে যে, বন্ধু স্বীয় বন্ধুকে শাস্তি দেন না? তিনি এর কোন উত্তর দিতে সক্ষম হলেন না। সুফী তখন এ আয়াতটিই পাঠ করলেন। এই উক্তিটি খুবই উত্তম। আর এরই দলীল হচ্ছে মুসনাদের এ হাদীসটি যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের একটি দলকে সাথে নিয়ে পথ চলছিলেন। একটি ছোট ছেলে পথে খেলা করছিল। তার মা যখন দেখলো যে, একটি বিরাট দল ঐ পথ দিয়েই আসছেন তখন সে ভয় পেয়ে গেল যে, না জানি তারা তার ছেলেকে পদতলে পিষ্ট করে ফেলবেন। তাই সে “আমার ছেলে আমার ছেলে” বলতে বলতে দৌড়িয়ে আসলো এবং অতি তাড়াতাড়ি তার ছেলেকে কোলে উঠিয়ে নিলো। এই দেখে সাহাবীগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ মহিলাটি তো তার প্রিয় ছেলেটিকে কখনও আগুনে নিক্ষেপ করতে পারে না!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “ঠিক কথাই বটে। আল্লাহ তা’আলাও কখনও তার প্রিয় বান্দাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যাবেন না।”
ইয়াহুদীদের কথার উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ অন্যান্য মানুষের মত তোমারও মানুষই বটে। অন্যান্য লোকদের উপর তোমাদের কোনই প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের উপর মহা বিচারক এবং তিনিই হচ্ছেন তাদের মধ্যে সঠিক ফায়সালাকারী; তিনি যাকে ইচ্ছা মার্জনা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন। তার কোন হুকুমকেই কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না। তিনি সত্বরই বান্দাদের কৃতকর্মের হিসাব গ্রহণকারী। যমীন, আসমান এবং এতদুভয়ের সমুদয় মখলুক তারই অধিকারে রয়েছে। সবকিছুরই প্রভু তিনিই। সমস্তই তার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। তিনিই বান্দাদের ফায়সালা করবেন। তিনি অত্যাচারী নন, তিনি ন্যায় বিচারক। তিনি পুণ্যবানদেরকে শান্তি এবং অপরাধীদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন। নোমান ইবনে আ’সা, বাহর ইবনে উমার, শাস ইবনে আদী প্রমুখ ইয়াহুদীদের বড় বড় আলেমগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করে। তিনি তাদেরকে অনেক বুঝালেন। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে শাস্তির ভয় দেখালেন। তখন তারা বললো, “জনাব! আপনি আমাদেরকে কিসের ভয় দেখাচ্ছেন? আমরা তো আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়পাত্র।” খ্রীষ্টানেরাও এ কথা বলতো, তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তারা পরস্পরের মধ্যে বানিয়ে সানিয়ে এ কথাটিও ছড়িয়ে দিয়েছিল যে, আল্লাহ তাআলা হযরত ইসরাঈল (আঃ)-এর নিকট প্রত্যাদেশ করেছিলেন-তোমার প্রথম পুত্রটি আমার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত। তার সন্তানরা চল্লিশদিন পর্যন্ত জাহান্নামে থাকবে। এ সময়ের মধ্যে আগুন তাদেরকে পবিত্র করে দেবে এবং তাদের গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেবে। তারপর একজন ফেরেশতা ডাক দিয়ে বলবেনঃ “ইসরাঈল (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে যারই খত্না করা আছে সে যেন বেরিয়ে আসে।” কুরআন কারীমে তাদের যে উক্তিটি বর্ণিত আছে তার অর্থ এটাই যে, তারা বলেঃ “আমাদেরকে গণনাকৃত কয়েকটি দিন মাত্র জাহান্নামে থাকতে হবে।” (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) ও ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:৩৯) খৃস্টবাদীরা শুরুতেই ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যক্তিত্বকে মানবিক সত্তা ও ইলাহী সত্তার মিশ্রণ গণ্য করে যে ভুল করেছিল তার ফলে হযরত ঈসা যথার্থ রূপ গোলক ধাঁধাঁয় পরিণত হয়েছে। খৃস্টীয় আলেম সমাজ এ ধাঁধাঁর রহস্য উন্মোচনে যতই বাগাড়ম্বর ও কল্পনা-অনুমানের আশ্রয় নিয়েছেন। ততই জটিলতা বেড়ে গেছে। তাদের মধ্য থেকে যার চিন্তায় এ মিশ্র ব্যক্তিত্বের মানবিক সত্তার দিকটি বেশী প্রভাব বিস্তার করেছে তিনি ঈসাকে আল্লাহর পুত্র এবং তিন জন স্বতন্ত্র খোদার একজন হবার ওপর জোর দিয়েছেন। আর যার চিন্তায় ইলাহী সত্তার দিকটি বেশী প্রভাব বিস্তার করেছে, তিনি ঈসাকে আল্লাহর দৈহিক প্রকাশ গণ্য করে তাঁকে ইবাদাত করেছেন। আবার এ উভয় দলের মাঝামাঝি একটা পথ বের করতে যারা চেয়েছেন তারা নিজেদের সমস্ত শক্তি এমন সব শাব্দিক ব্যাখ্যা সংগ্রহে নিয়োগ করেছেন যাতে হযরত ঈসাকে মানুষও বলা যায় আবার এ সঙ্গে তাঁকে আল্লাহ মনে করাও যেতে পারে। আল্লাহ ও ঈসা পৃথক পৃথক থাকতে পারেন আবার একীভূতও হতে পারেন।
সূরা নিসা, বলেছেন:-
আয়াত নং :-১৭১
یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ لَا تَغْلُوْا فِیْ دِیْنِكُمْ وَ لَا تَقُوْلُوْا عَلَى اللّٰهِ اِلَّا الْحَقَّؕ اِنَّمَا الْمَسِیْحُ عِیْسَى ابْنُ مَرْیَمَ رَسُوْلُ اللّٰهِ وَ كَلِمَتُهٗۚ اَلْقٰىهَاۤ اِلٰى مَرْیَمَ وَ رُوْحٌ مِّنْهُ٘ فَاٰمِنُوْا بِاللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ ۚ۫ وَ لَا تَقُوْلُوْا ثَلٰثَةٌؕ اِنْتَهُوْا خَیْرًا لَّكُمْؕ اِنَّمَا اللّٰهُ اِلٰهٌ وَّاحِدٌؕ سُبْحٰنَهٗۤ اَنْ یَّكُوْنَ لَهٗ وَلَدٌۘ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الْاَرْضِؕ وَ كَفٰى بِاللّٰهِ وَكِیْلًا۠
হে আহলী কিতাব! নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না আর সত্য ছাড়া কোন কথা আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করো না। মারয়াম পুত্র ঈসা মসীহ আল্লাহর একজন রসূল ও একটি ফরমান ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যা আল্লাহ মারয়ামের দিকে পাঠিয়েছিলেন। আর সে একটি রূহ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে (যে মারয়ামের গর্ভে শিশুর রূপ ধারণ করেছিল) । কাজেই তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলদের প্রতি ঈমান আনো এবং “তিন” বলো না। নিবৃত্ত হও, এটা তোমাদের জন্যই ভালো। আল্লাহই তো একমাত্র ইলাহ। কেউ তার পুত্র হবে, তিনি এর অনেক উর্ধ্বে। পৃথিবী ও আকাশের সবকিছুই তার মালিকানাধীন এবং সে সবের প্রতিপালক ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি নিজেই যথেষ্ট।
টিকা:২১২) মূলে ‘কালেমা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। মারয়ামের প্রতি কালেমা (ফরমান) পাঠাবার অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা’আলা মারয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভাধারকে কোন পুরুষের শুক্রকীটের সহায়তা ছাড়াই গর্ভধারণ করার হুকুম দিলেন। ঈসা আলাইহিস সালামের বিনা বাপে জন্মগ্রহণ করার রহস্য সম্পর্কে খৃস্টানদের প্রথমে একথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা গ্রীক দর্শনের প্রভাবে ভুল পথ অবলম্বন করে। ফলে প্রথমে তারা কালেমা শব্দটিকে ‘কালাম’ বা ‘কথা’ (Logos)-এর সমার্থক মনে করে। তারপর এ কালাম ও কথা থেকে আল্লাহ তা’আলার নিজ সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট কালাম-গুণ অর্থাৎ আল্লাহর কথা বলা বুঝানো হয়েছে। অতঃপর ধারণা করা হয়েছে যে, আল্লাহর সত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট এ গুণটি মারয়াম আলাইহাস সালামের উদরে প্রবেশ করে একটি দেহাবয়ব ধারণ করে এবং তাই ঈসা মসীহের রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এভাবে খৃস্টানদের মধ্যে ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ মনে করার ভ্রান্ত আকীদার উদ্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে ভ্রান্ত বিশ্বাস শিকড় গেড়ে বসেছে যে সব, আল্লাহ নিজেই নিজেকে অথবা নিজের চিরন্তন গুনাবলী থেকে ‘কালাম’ ও ‘বাক’ গুণকে ঈসার রূপে প্রকাশ করেছেন।
টিকা:২১৩) এখানে ঈসা আলাইহিস সালামকে روح منه(আল্লাহর কাছ থেকে আসা রূহ) বলা হয়েছে। সূরা আল বাকারায় একথাটিকে নিম্নোক্তভাবে বলা হয়েছেঃايدنه بروح القدس(আমি পাক রূহের সাহায্যে ঈসাকে সাহায্য করেছি)। এই উভয় বাক্যের অর্থ হচ্ছেঃ আল্লাহ ঈসা আলাইহিস সালামকে পাক রূহ দান করেছিলেন। অন্যায় ও পাপাচারের সাথে এই পাক রূহের কোনদিন কোন পরিচয়ই হয়নি। আপাদমস্তক সত্য ও সততা এবং উন্নত নৈতিক চরিত্র ছিল এর বৈশিষ্ট। খৃস্টানদের কাছেও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের এই একই পরিচিতি দান করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এর মধ্যেও বাড়াবাড়ি করেছে।روح من اللهঅর্থাৎ আল্লাহর কাছ থেকে একটি রূহকে তারা বিকৃত করে সরাসরি আল্লাহ বানিয়ে নিয়েছে। আর “রূহুল কুদুস” (Holy Ghost) –কে ধরে নিয়েছে “আল্লাহর মুকাদ্দাস বা মহাপবিত্র রূহ”, যা ঈসার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল। এভাবে আল্লাহ ও ঈসার সাথে রূহুল কুদুসকে তৃতীয় একজন মাবুদ বানিয়ে নেয়া হয়েছিল। এটা ছিল খৃস্টানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাড়াবাড়ি এবং এর ফলে তারা গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মজার ব্যাপার এই যে, মথি লিখিত ইঞ্জীলে আজও এ বাক্যটি লেখা রয়েছেঃ ফেরেশতারা তাকে (অর্থাৎ ইউসুফ নাজ্জারকে) স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললো, “‘হে ইউসুফ ইবনে দাউদ! তোমার স্ত্রী মারয়ামকে তোমার কাছে নিয়ে আসতে ভয় পেয়ো না। কারণ তার পেটে যে রয়েছে সে রূহুল কুদুসের কুদরাতের সৃষ্টি হয়েছে।” (অধ্যায় ১: শ্লোক ২০)
টিকা:২১৫) অর্থাৎ তিন ইলাহের আকীদা তোমাদের মধ্যে তেমন যে কোন আকৃতিতে বিদ্যমান থাক না কেন তা পরিহার করো। আসলে খৃস্টানরা একই সঙ্গে একত্ববাদ ও ত্রিত্ববাদ উভয়টিই মানে। ইঞ্জীলগুলোতে মসহী আলাইহিস সালামের যে সমস্ত সুস্পষ্ট বাণী পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে কোন একজন খৃস্টানও একথা অস্বীকার করতে পারবে না যে, আল্লাহ এক এবং তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ইলাহ নেই। তাওহীদ যে দ্বীনের মূলকথা এটা স্বীকার না করে তাদের উপায় নেই। কিন্তু শুরুতেই তাদের মনে এই ভুল ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, আল্লাহর কালাম ঈসার রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং আল্লাহর রূহ তাঁর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। এই ভুল ধারণার কারণে তারা সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহর সাথে ঈসা মসীহ ও রূহুল কুদুসের (জিব্রীল) খোদায়ীকেও মেনে নেয়াকে অযথা নিজেদের জন্য অপরিহার্য গণ্য করেছেন। এভাবে জোরপূর্বক একটি আকীদা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নেবার কারণে একত্ববাদে বিশ্বাস আবার ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসের সাথে সাথে ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসের সাথে সাথে একত্ববাদে বিশ্বাসকে কিভাবে একই সঙ্গে মেনে চলা যায়, এটা যথার্থই তাদের জন্য রহস্যময় ও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রায় আঠার শো বছর থেকে খৃস্টান পণ্ডিতগণ নিজেদের সৃষ্টি এই জটিলতার গ্রন্থী উন্মোচন করার জন্য মাথা ঘামিয়ে চলেছেন। এরই বিভিন্ন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বহু দল উপদল গঠিত হয়েছে। এরই ভিত্তিতে অন্য দলকে কাফের বলে প্রচার করেছে। এই বিবাদের ফলে গীর্জার সংহতি বিনষ্ট হয়েছে এবং বিভিন্ন গীর্জা নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। তাদের আকায়েদ ও যুক্তি শাস্ত্রের সমস্ত শক্তি এরই পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। অথচ এ জটিল সমস্যাটি আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। তাঁর প্রেরিত ঈসা মসীহও এ সমস্যাটি সৃষ্টি করেননি। আবার আল্লাহকে তিন মেনে নিয়ে তাঁর একত্ববাদের গায়ে কোন আচঁড় না লাগানো কোনক্রমে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র তাদের বাড়াবাড়ির কারণেই এই জটিল সমস্যাটির উদ্ভব হয়েছে। কাজেই বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকাই এর একমাত্র সমাধান। এ জন্য তাদের পরিহার করতে হবে ঈসা মসীহ ও রূহুল কুদুসের ইলাহ ও মাবুদ হবার ধারণা। একমাত্র আল্লাহকেই একক ইলাহ হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং মসীহকে কেবলমাত্র তার পয়গাম্বর গণ্য করতে হবে, তার খোদায়ীতে তাকে কোনো প্রকার শরীক করা যাবে না।
টিকা:৪০) এ বাক্যের মধ্যে এ মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নিছক ঈসার অলৌকিক জন্ম, তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং দৃষ্টি ও অনুভূতি গ্রাহ্য অলৌকিক কার্যকলাপে বিভ্রান্ত হয়ে যারা ঈসাকে ‘আল্লাহ’ মনে করেছে তারা আসলে একান্তই অজ্ঞ। ঈসাতো আল্লাহর অসংখ্য অলৌকিক সৃষ্টির একটি নমুনা মাত্র। এটি দেখেই এসব দুর্বল দৃষ্টির অধিকারী লোকদের চোখ ঝল্সে গেছে। এদের দৃষ্টি যদি আর একটু প্রসারিত হতো তাহলে এরা দেখতে পেতো, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির এর চাইতে আরো অনেক বেশী বিস্ময়কর নমুনা পেশ করে যাচ্ছেন এবং তাঁর শক্তি কোন একটি বিশেষ সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নেই। কাজেই সৃষ্টির কোন বিস্ময়কর ক্ষমতা দেখে তাকে স্রষ্টা মনে করা বিরাট অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। বরং সৃষ্টির কৃতিত্ব ও বিস্ময়কর কার্যাবলীর মধ্যে যে ব্যক্তি স্রষ্টার অসীম ক্ষমতার নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে এবং তা থেকে ঈমানের আলো সংগ্রহ করে সে-ই যথার্থ বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] আলোচ্য আয়াতে নাসারাদের একটি উক্তির খণ্ডন করা হয়েছে- যা তাদের একদলের বিশ্বাসও ছিল। অর্থাৎ তাদের একদলের বিশ্বাস ছিল যে, ঈসা মসীহ হুবহু আল্লাহ। কিন্তু আয়াতে যে যুক্তি দ্বারা বিষয়টির খণ্ডন করা হয়েছে, তাতে নাসারাদের সব দলের একত্ববাদ বিরোধী ভ্রান্ত বিশ্বাসেরই খণ্ডন হয়ে যায়, তা মসীহ ‘আলাইহিস সালামের আল্লাহর সন্তান হওয়া সংক্রান্ত বিশ্বাসই হোক অথবা তিন ইলাহর অন্যতম ইলাহ হওয়ার বিশ্বাসই হোক। আল্লাহ তা’আলা বলছেন যে, যদি তিনি ঈসা ও তার মা মারইয়ামকে মারতে ইচ্ছা করেন, তবে কি এমন কেউ আছে যে তাদেরকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারে? তারা নিজেরাও সেটা করতে সক্ষম নয়। সুতরাং তারা কিভাবে ইলাহ হতে পারে? আল্লাহ তা’আলার সামনে মসীহ ‘আলাইহিস সালাম এতই অক্ষম যে, তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না এবং যে জননীর খেদমত ও হেফাযত তার কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়, সে জননীকেও রক্ষা করতে পারেন না। সুতরাং তিনিই কিভাবে ইলাহ হতে পারেন। আর তার মা যেহেতু মারা গেছেন সেহেতু কিভাবেই বা তিনি তিন ইলাহর অন্যতম ইলাহ বলে বিবেচিত হবেন? [তাফসীর মুয়াস্সার ও সা’দী]
[২] ‘তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন’ এ বাক্যে নাসারাদের পূর্বোক্ত ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণকে খণ্ডন করা হয়েছে। কেননা, মসীহকে আল্লাহ মনে করার আসল কারণ তাদের মতে এই ছিল যে, তিনি জগতের সাধারণ নিয়মের বিপরীতে পিতা ছাড়া শুধুমাত্র মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি মানুষ হলে নিয়মানুযায়ী পিতা-মাতা উভয়ের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করতেন। আলোচ্য বাক্যে এর উত্তর দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা যাকে ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা সৃষ্টি করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। যেমন অন্যত্র বলেছেন যে, “ঈসার উদাহরণ তো আদমের মত” [সূরা আলে-ইমরানঃ ৫৯] এ আয়াতেও উক্ত সন্দেহের নিরসন করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর সাধারণ নিয়মের বাইরে মসীহ ‘আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা তার ইলাহ হওয়ার প্রমাণ হতে পারে না। লক্ষণীয় যে, আদমকে আল্লাহ তা’আলা পিতা ও মাতা উভয়ের মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন। তিনিই স্রষ্টা, রব ও উপাসনার যোগ্য। অন্য কেউ তার অংশীদার নয়। [সা’দী; মুয়াস্সার; ইবন কাসীর]
[৩] অর্থাৎ যদি সত্যি-সত্যিই তোমারা আল্লাহর প্রিয়বান্দা হতে তবে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিতেন না। অথচ তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, তোমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা নও। আল্লাহ যে তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন এটা তোমরাও স্বীকার কর। তোমরা বলে থাক যে, ‘আমাদেরকে সামান্য কিছুদিনই কেবল অগ্নি স্পর্শ করবে’ [সূরা আল-বাকারাহ ৮০; সূরা আলে ইমরান ২৪]
আর যদি সত্যি সত্যিই তোমাদের কোন শাস্তি হবে না তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর না কেন? দুনিয়ার কষ্ট থেকে বেঁচে গিয়ে আখেরাতের স্থায়ী শান্তি যদি তোমাদের জন্যই নির্ধারিত থাকে, তবে তোমাদের উচিত মৃত্যু কামনা করা। অথচ তোমরা হাজার বছর বাঁচতে আগ্রহী। অন্য আয়াতে বলেন, বলুন, ‘যদি আল্লাহ্র কাছে আখেরাতের বাসস্থান অন্য লোক ছাড়া বিশেষভাবে শুধু তোমাদের জন্যই হয়, তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর- – – যদি সত্যবাদী হয়ে থাক’। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের কারণে তারা কখনো তা কামনা করবে না। [সূরা আল-বাকারাহ: ৯৪-৯৫]
আরও বলেন, বলুন, ‘হে ইয়াহুদী হয়ে যাওয়া লোকরা! যদি তোমরা মনে কর যে, তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য কোন মানবগোষ্ঠী নয়; তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। কিন্তু তারা তাদের হাত যা আগে পাঠিয়েছে (তাদের কৃতকর্ম) এর কারণে কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। [সূরা আল-জুম’আঃ ৬-৭]
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা তাঁর বন্ধুকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে দেন না’। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১০৪]
এক বর্ণনায় এসেছে, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নোমান ইবন আদ্বা, বাহরী ইবন আমর এবং শাস ইবন আদী এসে কথা বলল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানালেন, তাঁর শাস্তির ভয় দেখালেন। তখন তারা বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনি আমাদেরকে কিসের ভয় দেখান? আমরা তো কেবল আল্লাহর সন্তান-সন্তুতি ও তার প্রিয়জন! নাসারাদের মতই তারা বলল। তখন আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করলেন। [তাবারী]
[৪] সুদ্দী বলেন, এর অর্থ, যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ্ দুনিয়াতে হেদায়াত দেন, ফলে তাকে তিনি ক্ষমা করেন। আর যাকে ইচ্ছা কুফরীর উপর মৃত্যু দেন, ফলে তাকে তিনি শাস্তি দেন। [তাবারী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিজ অসীম ক্ষমতা ও পূর্ণ সার্বভৌমত্বের কথা বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য খ্রিষ্টানদের সেই আকীদা ও বিশ্বাসকে খন্ডন করা, যাতে তারা মনে করে যে, মসীহ (আঃ) স্বয়ং আল্লাহ। ‘মসীহ (আঃ) স্বয়ং আল্লাহ’ (যীশুই ঈশ্বর) এই আকীদায় বিশ্বাসী প্রথমে অল্প সংখ্যক লোক ছিল অর্থাৎ, খ্রিষ্টানদের একটি ফির্কাই ছিল, যারা ‘ইয়াকূবিয়াহ’ নামে পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে তাদের প্রায় সকল ফির্কাই কোন না কোন দিক দিয়ে ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ মনে করে থাকে। এই জন্য খ্রিষ্টধর্মে ত্রিত্ববাদ অথবা ট্রিনিটির বিশ্বাস মূল ভিত্তি হিসাবে গুরুত্ব লাভ করেছে। অথচ কুরআনে কারীমের এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কোন নবী বা রসূলকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা প্রকাশ্য কুফরী। খ্রিষ্টানরা মসীহ (আঃ)-কে আল্লাহ বানিয়ে এই কুফরী করেছে। যদি অন্য কোন ফির্কা বা দল অন্য কোন নবী বা রসূলকে মানুষ ও রসূল হওয়ার আসন থেকে উঠিয়ে আল্লাহর আসনে আসীন করে, তাহলে তারাও কুফরী করবে। (আমরা এই ভ্রান্ত আকীদা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।)
[২] ইয়াহুদীরা উযায়ের (আঃ)-কে এবং খ্রিষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে ‘আল্লাহর পুত্র বলে’ এবং তারা নিজেদেরকেও ‘আল্লাহর পুত্র ও তাঁর প্রিয়পাত্র’ বলে দাবী করে। অনেকে বলেন, এখানে একটি শব্দ ঊহ্য আছে, আর তা হচ্ছে أتباع أبناء الله অর্থাৎ, আমরা আল্লাহর পুত্রদ্বয় (উযায়ের ও ঈসা)এর অনুসারী। উল্লিখিত দুই অর্থের মধ্যে যে অর্থই নেওয়া হোক না কেন, তাতে তাদের গর্ব ও আস্ফালন এবং আল্লাহর উপর অনর্থক ভরসা প্রকাশ পায়; যা আল্লাহর নিকটে মূল্যহীন।
[৩] এই অংশে তাদের উল্লিখিত আস্ফালন ও গর্বকে ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, বস্তুতঃপক্ষে তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহর প্রিয়পাত্র ও অভীষ্ট হও, তাহলে তোমরা যা ইচ্ছা তাই কর। আল্লাহ তো সে ব্যাপারে তোমাদেরকে কোন জিজ্ঞাসাবাদই করবেন না। আর যদি তাই হয়, তাহলে তোমাদের কৃতপাপের কারণে কেন তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে আসছেন ও দিবেন? এর দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর দরবারে বিচার কেবল দাবীর ভিত্তিতে হয় না; আর তা কিয়ামতের দিনেও হবে না। বরং আল্লাহ ঈমান, পরহেযগারী ও সৎকর্ম দেখেন এবং দুনিয়াতেও তারই ভিত্তিতেই ফায়সালা করেন। আর কিয়ামতের দিনেও এই ভিত্তির উপরেই বিচার ফায়সালা করবেন।
[৪] তথাপি এই শাস্তি অথবা ক্ষমার ফায়সালা আল্লাহর সেই নিয়ম মোতাবেকই হবে; যা পরিষ্কারভাবে তিনি বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, মুমিনগণের জন্য ক্ষমা এবং কাফের ও ফাসেকদের জন্য শাস্তি। সমস্ত মানুষের বিচার এই সাধারণ নীতি অনুসারেই হবে। হে আহলে কিতাবগণ! তোমরাও তাঁরই সৃষ্ট মানুষ। তোমাদের ব্যাপারে বিচার-ফায়সালা অন্য মানুষ থেকে ভিন্নতর কেন হবে?