(Book# 114/١٩٦)-৩৯৭ www.motaher21.net وَ مَنْ لَّمْ یَحْكُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক। And whosoever does not judge by what Allah has revealed, such are the rebellious. সুরা: আল্ মায়িদাহ আয়াত নং :-৪৬-৪৭

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/١٩٦)-৩৯৭
www.motaher21.net

وَ مَنْ لَّمْ یَحْكُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ
আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক।

And whosoever does not judge by what Allah has revealed, such are the rebellious.

সুরা: আল্ মায়িদাহ
আয়াত নং :-৪৬-৪৭
وَ قَفَّیْنَا عَلٰۤى اٰثَارِهِمْ بِعِیْسَى ابْنِ مَرْیَمَ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ مِنَ التَّوْرٰىةِ۪ وَ اٰتَیْنٰهُ الْاِنْجِیْلَ فِیْهِ هُدًى وَّ نُوْرٌۙ وَّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ مِنَ التَّوْرٰىةِ وَ هُدًى وَّ مَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِیْنَؕ

তারপর ঐ নবীদের পরে মারয়ামপুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছি। তাওরাতের মধ্য থেকে যা কিছু তার সামনে ছিল সে তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল। আর তাকে ইনজিল দিয়েছি। তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো এবং তাও তাওরাতের মধ্যে থেকে যা কিছু সে সময় বর্তমান ছিল তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল আর তা ছিল আল্লাহভীরুদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ।

আয়াত:- ৪৮

وَ لْیَحْكُمْ اَهْلُ الْاِنْجِیْلِ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فِیْهِؕ وَ مَنْ لَّمْ یَحْكُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ

আমার নির্দেশ ছিল, ইনজীলে আল্লাহ‌ যে আইন নাযিল করেছেন ইনজীল অনুসারীরা যেন সে মোতাবেক ফায়সালা করে। আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

টিকা:৭৬) অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম কোন নতুন ধর্ম নিয়ে আসেননি। বরং ইতিপূর্বেকার বিভিন্ন পয়গম্বরের দ্বীনই ছিল তাঁর দ্বীন এবং মানুষকে তিনি এ দ্বীনেরই দাওয়াত দিতেন। তাওরাতের আসল শিক্ষাবলীর যে অংশ তাঁর যুগে সংরক্ষিত ছিল তাকে তিনি নিজেও মানতেন এবং ইনজীলও তার সত্যতা প্রমাণ করতো (মথি ৫:১৭-১৮ দেখুন)। কুরআন বারবার এ কথাটি ঘোষণা করেছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকায় যত নবী এসেছেন তাদের একজনও পূর্ববর্তী নবীদের প্রতিবাদ করার এবং তাদের কার্যাবলীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিজের নতুন ধর্ম প্রবর্তন করার জন্য আসেননি। বরং প্রত্যেক নবী তাঁর পূর্ববর্তী নবীদের সত্যতার সাক্ষ্য দিতেন এবং পূর্ববর্তী নবীগণ নিজেদের পবিত্র উত্তরাধিকার হিসেবে যেসব কাজ রেখে যেতেন সেগুলোর পরিবৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনের জন্য আসতেন। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোর প্রতিবাদ করার জন্য আল্লাহ কখনো নিজের কোন কিতাব পাঠাননি। বরং তাঁর প্রত্যেকটি কিতাব ইতিপূর্বে প্রেরিত সমস্ত কিতাবের সমর্থক ও তার সত্যতা প্রমাণকারী হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

টিকা:৭৭) যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এখানে তিনটি বিধান দিয়েছেন। এক, তারা কাফের। দুই, তারা জালেম। তিন, তারা ফাসেক। এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম ও তার নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফায়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটি কুফরী। দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতির বিরোধী। কারণ, আল্লাহ যথার্থ ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতি অনুযায়ীই হুকুম দিয়েছিলেন। কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফয়সালা করলো তখন সে আসলে জুলুম করলো। তৃতীয়ত বান্দা হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করলো তখনই সে আসলে বন্দেগী ও আনুগত্যের গণ্ডীর বাইরে পা রাখলো। আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসেকী। এ কুফরী, জুলুম ও ফাসেকী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিক দিয়ে অনিবার্যভাবেই পুরোপুরি আল্লাহর হুকুম অমান্যেরই বাস্তব রূপ। যেখানে আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হবে সেখানে এ তিনটি বিষয় থাকবে না, এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার যেমন পর্যায়ভেদ আছে তেমনি এ তিনটি বিষয়েরও পর্যায়ভেদ আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে ভুল এবং নিজের বা অন্য কোন মানুষের হুকুমকে সঠিক মনে করে আল্লাহর হুকুম বিরোধী ফায়সালা করে সে পুরোপুরি কাফের, জালেম ও ফাসেক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফয়সালা করে সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভূত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, জুলুম ও ফাসেকীর সাথে মিশিয়ে ফেলছে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সে সকল ব্যাপারেই কাফের, ফাসেক ও জালেম। আর যে ব্যক্তি কিছু ব্যাপারে অনুগত এবং কিছু ব্যাপারে অবাধ্য তার জীবনে ঈমান ও ইসলাম এবং কুফরী, জুলুম ও ফাসেকীর মিশ্রণ ঠিক তেমনি হারে অবস্থান করছে যে হারে সে আনুগত্য ও অবাধ্যতাকে এক সাথে মিশিয়ে রেখেছে। কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াতগুলোকে আহলি কিতাবদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত বলে গণ্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কালামের শব্দের মধ্যে এ ধরনের ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ নেই। হযরত হুযাইফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্যই এ ধরনের ব্যাখ্যার সঠিক ও সর্বোত্তম জবাব। তাঁকে একজন বলেছিল, এ আয়াত তিনটি তো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। সে বুঝাতে চাচ্ছিল যে, ইহুদীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা হুকুমের বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে-ই কাফের, জালেম ও ফাসেক। একথা শুনে হযরত হুযাইফা বলে ওঠেনঃ

نعم الاخوة لكم بنو اسرائيل ان كانت لهم كل مرةولكم كل حلوة كلا والله لتسلكن طريقهم قدر الشراك-

“এ বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী তোমাদের কেমন চমৎকার ভাই, তিতোগুলো সব তাদের জন্য আর মিঠাগুলো সব তোমাদের জন্য! কখ্খনো নয়, আল্লাহর কসম তাদেরই পথে তোমরা কদম মিলিয়ে চলবে।”

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Al Mayadah
Verse:- 46-47

وَ مَنْ لَّمْ یَحْكُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفٰسِقُوْنَ
And whosoever does not judge by what Allah has revealed, such are the rebellious.

Allah Mentions `Isa and Praises the Injil

Allah said,

وَقَفَّيْنَا

and We sent…,

meaning, We sent.

عَلَى اثَارِهِم

in their footsteps,

meaning the Prophets of the Children of Israel.

بِعَيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ

`Isa, son of Maryam, confirming the Tawrah that had come before him,

meaning, he believed in it and ruled by it.

وَاتَيْنَاهُ الاِنجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ

and We gave him the Injil, in which was guidance and light,

a guidance that directs to the truth and a light that removes the doubts and solves disputes,

وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ

and confirmation of the Tawrah that had come before it,

meaning, he adhered to the Tawrah, except for the few instances that clarified the truth where the Children of Israel differed.

Allah states in another Ayah that `Isa said to the Children of Israel,

وَلاُِحِلَّ لَكُم بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ

and to make lawful to you part of what was forbidden to you. (3:50)

So the scholars say that the Injil abrogated some of the rulings of the Tawrah.

Allah’s statement,

وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِّلْمُتَّقِينَ

a guidance and an admonition for those who have Taqwa.

means, We made the Injil guidance and an admonition that prohibits committing sins and errors, for those who have Taqwa of Allah and fear His warning and torment.

Allah said next:-

وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الاِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فِيهِ

Let the people of the Injil judge by what Allah has revealed therein.

meaning, so that He judges the people of the Injil by it in their time.

Or, the Ayah means, so that they believe in all that is in it and adhere to all its commands, including the good news about the coming of Muhammad and the command to believe in and follow him when he is sent.

Allah said in other Ayat,

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّىَ تُقِيمُواْ التَّوْرَاةَ وَالاِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ

Say “O People of the Scripture! You have nothing (guidance) until you act according to the Tawrah, the Injil, and what has been sent down to you from your Lord.” (5:68)

and,

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الاُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِندَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ

Those who follow the Messenger, the Prophet who can neither read nor write whom they find written with them in the Tawrah… until,
الْمُفْلِحُونَ
successful. (7:157)

Here, Allah said,

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـيِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

And whosoever does not judge by what Allah has revealed, such are the rebellious.

meaning, the rebellious and disobedient of Allah who prefer falsehood and abandon truth.

We mentioned before that this Ayah was revealed about the Christians, and this is evident from the context of the Ayah.

তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-
৪৬-৪৭ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ পাক বলেনঃ আমি ঈসা (আঃ)-কে বানী ইসরাঈলের শেষ নবী করে পাঠিয়েছিলাম। সে তাওরাতকে বিশ্বাস করতো এবং ওর নির্দেশ অনুযায়ী লোকদের মধ্যে ফায়সালা করতো। আমি তাকে স্বীয় কিতাব ইঞ্জীল প্রদান করেছিলাম। তাতে সত্যের হিদায়াত ছিল, আর ছিল কাঠিন্য ও জটিলতার ব্যাখ্যা এবং পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর অনুকরণ। তবে কতগুলো মাসআলার তাতে স্পষ্ট ফায়সালা ছিল, যেগুলোতে ইয়াহূদীরা মতভেদ সৃষ্টি করেছিল। যেমন কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় রয়েছে যে, হযরত ঈসা (আঃ) বলেছিলেনঃ “আমি এমন কতগুলো জিনিস তোমাদের জন্য হালাল করবো যেগুলোতোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছিল। এ জন্যেই আলেমদের প্রসিদ্ধ উক্তি রয়েছে যে, ইঞ্জীল তাওরাতের কতক হুকুম মানসূখ করে দিয়েছে। ইঞ্জীল দ্বারা পুণ্যবান লোকেরা হেদায়াত, ওয়ায ও উপদেশ লাভ করতো এবং এর ফলে তারা পুণ্য লাভের প্রতি আগ্রহী হতো অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতো। অল য়্যাহকুম আহলুল ইঞ্জীলে’ এখানে ‘আহলাল ইঞ্জীলে’ও পড়া হয়েছে। এ অবস্থায় (আরবী) শব্দটি ‘ (আরবী) -এর অর্থে হবে। তখন ভাবার্থ হবে-আমি ঈসা (আঃ)-কে ইঞ্জীল এ জন্যেই প্রদান করেছি যে, যেন সে তার যুগের তার অনুসারীদেরকে ওটা অনুযায়ীই পরিচালিত করে। আর যদি মাশহর কিরআত (আরবী) অনুযায়ী – (আরবী) কে আমরের (আরবী) মনে করা হয় তবে তখন অর্থ হবে- তাদের উচিত যে, তারা ইঞ্জীলের সমস্ত আহকামের উপর ঈমান আনে এবং ওটা অনুযায়ী ফায়সালা করে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছে- (আরবী) অর্থাৎ “ বল হে আহলে কিতাব! যে পর্যন্ত তোমরা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং যা আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ করা হয়েছে এগুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত না হবে সে পর্যন্ত তোমরা কিছুরই উপর নও। (৫:৬৮) আর এক জায়গায় আছে (আরবী) অর্থাৎ “যারা এ রাসূল, নবী উম্মী (সঃ)-এর অনুসরণ করে যার গুণাবলী তারা তাদেরই নিকট গচ্ছিত কিতাব তাওরাতে পেয়ে থাকে তারাই সফলকাম।” (৭:১৫৭) যারা আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (সঃ)-এর নির্দেশমত ফায়সালা করে। তারা আল্লাহর আনুগত্য হতে বেরিয়ে পড়েছে, সত্যকে পরিত্যাগ করেছে, বাতিলের উপর আমল করেছে। আয়াতটির গতি দ্বারা প্রকাশ পাচ্ছে যে, এটা খ্রষ্টানদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আর পূর্বে এ বর্ণনা দেয়াও হয়েছে।

তাফসীরে আবুবকর ‌যাকারিয়া‌ বলেছেন:-

[১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “আমি মারইয়াম-পুত্র ঈসার সবচেয়ে বেশী নিকটতম। নবীগণ একে অন্যের বৈমাত্রেয় ভাই; আমার এবং তার মধ্যে কোন নবী নেই।” [বুখারীঃ ৩৪৪২]

[২] আল্লামা শানকীতী বলেন, এ আয়াতে কি বিধান ইঞ্জীলে দেয়া হয়েছে, সেটার বর্ণনা আসে নি। অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে সেটা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুসংবাদ। তার উপর ঈমান ও তার আনুগত্যের আবশ্যকতা। যেমন আল্লাহ বলেন, “আর স্মরণ করুন, যখন মারইয়াম-পুত্র ঈসা বলেছিলেন, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব থেকে তোমাদের কাছে যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সত্যায়নকারী এবং আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসূল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা”। [সূরা আস-সাফ: ৬] আরও বলেন “যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জলে লিপিবদ্ধ পায়” [সূরা আল-আরাফ: ১৫৭] ইত্যাদি [আদওয়াউল বায়ান]।

[৩] আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা একদিক থেকে তা তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত, অপরদিকে তা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহকে একমাত্র আইনদাতা হিসাবে না মানলে তাওহীদুর রুবুবিয়্যাতে শির্ক করা হয়। অপরদিকে আল্লাহ্‌র আইনকে না মেনে অন্য কারো আইনে বিচার-ফয়সালা করলে তাতে তাওহীদুল উলুহিয়াতে শির্ক করা হয়। অনুরূপভাবে, আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইনের বিচার-ফয়সালা মনে-প্রাণে মেনে নেয়াও তাওহীদুল উলুহিয়াতে শির্ক করা হয়। সুতরাং এ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, আইনদাতা হিসেবে আল্লাহকে মেনে নেয়া এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা তাওহীদের অংশ। [মাজমু ফাতাওয়া ও রাসাইলে ইবন উসাইমীন ২/১৪০-১৪৪ ও ৬/১৫৮-১৬২]

লক্ষণীয় যে, ৪৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই কাফির”। পরবর্তী ৪৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই যালিম”। এর পরবর্তী ৪৭নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, “আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই ফাসিক”। মোটকথা: যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী বিধান দেয় না। তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহর আইনে বিচার-ফয়সালা না করলে যালিম বা ফাসিক হওয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক হলেও, এর মাধ্যমে সর্বাবস্থায়ই কি বড় শির্ক বা বড় কুফরী হবে?

মূলতঃ আল্লাহর আইন অনুসারে না চলার কয়েকটি পর্যায় হতে পারেঃ [১] আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইনে বিচার-ফয়সালা পরিচালনা জায়েয মনে করা। [২] আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কোন আইন দ্বারা শাসন কার্য পরিচালনা উত্তম মনে করা। [৩] আল্লাহর আইন ও অন্য কোন আইন শাসনকার্য ও বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের মনে করা। [৪] আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য কোন আইন প্রতিষ্ঠা করা। উপরোক্ত যে কোন একটি কেউ করলে সে সর্বসম্মতভাবে কাফের হয়ে যাবে। কিন্তু এর বাইরেও আরো কিছু পর্যায় রয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহর আইনে বিচার না করা বা অন্য আইনের কাছে বিচার চাওয়ার কারণে গোনাহগার হলেও পুরোপুরি মুশরিক হয়ে যায় না। যেমন, (এক) কেউ আল্লাহ্‌র আইনে বিচার-ফয়সালা করা ফরয বলে মেনে নেয়ার পরে নিজের প্রবৃত্তি বা ঘুষের আশ্রয় নিয়ে অন্য কোন আইনে বিচার-ফয়সালা করে, তখন সে যালিম বা ফাসিক হিসেবে বিবেচিত হবে। (দুই) কেউ মানুষের উপর যুলুম করার মানসে আল্লাহ্‌র আইন ব্যতীত বিচার করে, আল্লাহ্‌র আইন বাস্তবায়ন করার সুযোগ না থাকে এবং বিচারের অভাবে মানুষের হক নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। তখন সে ফাসিক বলে বিবেচিত হবে। শেষোক্ত দুটি বড় শির্ক কিংবা বড় কুফরীর পর্যায়ে পড়ে না। যারা এ কাজ করবে, তারা ছোট শির্ক বা ছোট কুফরী করেছে বলে গন্য হবে। [বিস্তারিত দেখুন, আদওয়াউল বায়ান; মাজমু ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়্যাহ ২৭/৫৮-৫৯ মিনহাজুস সুন্নাহ ৫/১৩০-১৩২]

তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ, পূর্ববর্তী নবীগণের পর পরই ঈসা (আঃ)-কে (আল্লাহ রসূল রূপে) তাওরাতের সত্যায়ন করার জন্য প্রেরণ করেন, মিথ্যায়ন করার জন্য নয়। যা এই কথাই প্রমাণ করে যে, ঈসা (আঃ)ও সত্য রসূল ছিলেন এবং ঐ আল্লাহরই প্রেরিত ছিলেন, যিনি মূসা (আঃ)-এর উপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইয়াহুদীরা ঈসা (আঃ)-কে মিথ্যাবাদী মনে করে; এমনকি তাঁকে কাফের মনে করে, তাঁকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছজ্ঞান করে!

[২] অর্থাৎ, যেমন তাওরাত তার সময়ের লোকদের জন্য পথ প্রদর্শকরূপে ছিল অনুরূপভাবে ইঞ্জীল অবতীর্ণ হওয়ার পর সেই মর্যাদার অধিকারী ইঞ্জীল হয়ে যায় এবং তারপর কুরআন অবতীর্ণ হলে তাওরাত ইঞ্জীল ও অন্যান্য আসমানী গ্রন্থের বিধান রহিত হয়ে যায় এবং হিদায়াত ও মুক্তির পথ নির্দেশনা রূপে শুধুমাত্র কুরআন কারীম বিদ্যমান থাকে। আর এর পরই মহান আল্লাহ আসমানী গ্রন্থের ধারাবাহিকতা বন্ধ করে দেন। সুতরাং এ যেন এ কথারই ঘোষণা যে, কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি শুধুমাত্র কুরআনের অনুসরণেই বিদ্যমান। যে এ গ্রন্থের সাথে সম্পর্ক রাখে, সে সফলকাম ও বিজয়ী হবে। আর যে এর সাথে সম্পর্ক ছেদন করে, সে অকৃতকার্য ও হতভাগায় পরিণত হবে। অতএব বুঝা গেল যে, ‘সব ধর্ম সমান’-এর দর্শন নিতান্তই ভুল। কেননা হক (সত্য) সমস্ত যুগে একটাই হয়; একাধিক নয়। আর হক ব্যতীত সবই বাতিল (ভ্রষ্ট)। তাওরাত তার যুগে সঠিক বা হক ছিল এবং তারপর ইঞ্জীলও তার যুগে সঠিক ও হক ছিল। ইঞ্জীল অবতীর্ণ হওয়ার পর তাওরাতের উপর আমল বৈধ ছিল না। অতঃপর যখন কুরআন অবতীর্ণ হল, তখন ইঞ্জীল রহিত হয়ে গেল; তার উপর আমল করা বৈধ নয়। বলা বাহুল্য, একমাত্র বিধান ও (ইহ-পরকালে) মানুষের মুক্তির উপায় কুরআনই। কুরআনের উপর ঈমান ও আমল ব্যতীত মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। (বিস্তারিত সূরা বাক্বারার ২:৬২ নম্বর আয়াতের টীকায় দেখুন।)
(৩) يَهُود (ইয়াহুদ) হয় هَوَادَة (যার অর্থ, ভালবাসা) ধাতু থেকে গঠিত অথবা تَهَوّد (যার অর্থ, তাওবা করা) ধাতু থেকে গঠিত। অর্থাৎ, তাদের এই নামকরণ প্রকৃতপক্ষে তাওবা করার কারণে অথবা একে অপরকে ভালবাসার কারণে হয়েছে। এ ছাড়া মূসা (আঃ)-এর অনুসারীদেরকে ‘ইয়াহুদী’ বলা হয়।

(৪) نَصَارَى (নাসারা) نَصرَان এর বহুবচন। যেমন, سكَارَى سَكرَان এর বহুবচন। এর মূল ধাতু হল نصر (যার অর্থ সাহায্য-সহযোগিতা)। আপোসে একে অপরের সাহায্য করার কারণে তাদের এই নামকরণ হয়েছে। ওদেরকে ‘আনসার’ও বলা হয়। যেমন তারা ঈসা (আঃ)-কে বলেছিল, {نَحْنُ اَنْصَارُ اللهِ} ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদেরকে নাসারা (খ্রিষ্টান) বলা হয় এবং তাদেরকে ঈসায়ীও বলা হয়।

(৫) صَابِئِين صَابِئ- এর বহুবচন। এরা সেই লোক, যারা শুরুতে নিঃসন্দেহে কোন সত্য দ্বীনের অনুসারী ছিল। (আর এই জন্যই ক্বুরআনে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি তাদেরকে উল্লেখ করা হয়েছে।) পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে ফিরিশ্তা ও তারকা পূজার প্রচলন শুরু হয়। অথবা তারা কোন দ্বীনকেই মানত না। এই কারণেই যাদের কোন দ্বীন-ধর্ম নেই তাদেরকে ‘স্বাবী’ (বা স্বাবেয়ী) বলা হয়।

(৬) আধুনিক অনেক মুফাসসির (?) এই আয়াতের (সঠিক) অর্থ অনুধাবন করতে ভুল করে থাকে এবং এ থেকে ধর্ম-ঐক্য (সকল ধর্ম সমান) হওয়ার দর্শন আওড়ানোর ঘৃণিত প্রয়াস চালায়। অর্থাৎ, তারা মনে করে যে, রিসালাতে মুহাম্মাদ (মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রসূল হওয়ার) উপর ঈমান আনা জরুরী নয়, বরং যে কেউ যে কোন ধর্মকে মানবে, সেই অনুযায়ী বিশ্বাস রাখবে এবং সৎকর্ম করবে, সে মুক্তি পেয়ে যাবে। এ দর্শন অতীব বিভ্রান্তিকর দর্শন। বলা বাহুল্য, আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা হল, যখন মহান আল্লাহ পূর্বোক্ত আয়াতে ইয়াহুদীদের মন্দ কর্মসমূহ এবং তাদের অবাধ্যতার কারণে শাস্তিযোগ্য হওয়ার কথা উল্লেখ করেন, তখন মানুষের মনে এই প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়া সবাভাবিক ছিল যে, এই ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা সত্যনিষ্ঠ, আল্লাহর কিতাবের অনুসারী এবং যারা নবীর আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেছে, তাদের সাথে আল্লাহ তাআলা কি আচরণ করেছেন? অথবা কি আচরণ করবেন? মহান আল্লাহ এই কথাটাই পরিষ্কার করে দিলেন যে, ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান এবং স্বাবেয়ীদের মধ্যে যারাই স্ব স্ব যুগে আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তারা সকলেই আখেরাতে মুক্তিলাভ করবে। অনুরূপ বর্তমানে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রিসালাতের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী মুসলিমও যদি সঠিক পন্থায় আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমান এনে সৎকর্মের প্রতি যত্ন নেয়, তবে সেও অবশ্যই অবশ্যই আখেরাতের চিরন্তন নিয়ামত লাভ করার অধিকারী হবে। আখেরাতে মুক্তির ব্যাপারে কারো সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হবে না। সেখানে নিরপেক্ষ ও ন্যায় বিচার হবে। চাহে সে মুসলিম হোক অথবা শেষ নবীর পূর্বে অতিবাহিত কোন ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান বা স্বাবেয়ী ইত্যাদি যেই হোক না কেন। এই কথার সমর্থন কোন কোন ‘মুরসাল আসার’ (ছিন্ন সনদে বর্ণিত সাহাবীর উক্তি) থেকে পাওয়া যায়। যেমন মুজাহিদ সালমান ফারেসী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (সালমান ফারেসী) বলেছেন, আমি নবী করীম (সাঃ)-কে আমার কিছু ধার্মিক সাথীর কথা জিজ্ঞাসা করলাম, যারা ইবাদতকারী ও নামাযী ছিল। (অর্থাৎ, মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রিসালাতের পূর্বে তারা তাদের দ্বীনের সত্যিকার অনুসারী ছিল।) এই জিজ্ঞাসার উত্তরে এই আয়াত নাযিল হয়, {إِنَّ الَّذِيْنَ آَمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوْا} (ইবনে কাসীর) ক্বুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারাও এর সমর্থন হয়। যেমন, {إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْأِسْلامُ} “নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট দ্বীন একমাত্র ইসলাম।” (সুরা আলে ইমরান ৩:: ১৯)

{وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْأِسْلامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ} (সুরা আলে ইমরান ৩:: ৮৫) “যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম অনুসন্ধান করে, কস্মিনকালে তা তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না।” বহু হাদীসেও নবী করীম (সাঃ) পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, এখন আমার রিসালাতের উপর ঈমান আনা ব্যতীত কোন ব্যক্তির মুক্তি হতে পারে না। যেমন, তিনি বলেছেন, “যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে সেই আল্লাহর শপথ! এই উম্মতের যে কেউ আমার (রিসালাতের) কথা শুনবে, তাতে সে ইয়াহুদী হোক অথবা খ্রিষ্টান, তারপর সে যদি আমার উপর ঈমান না আনে, তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ ঈমান, পরিচ্ছেদঃ মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবূওয়াতের উপর ঈমান আনা ওয়াজিব) অর্থাৎ, ‘সকল ধর্ম সমান’ এই বিভ্রান্তিকর ধারণা যেমন বহু ক্বুরআনী আয়াতের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করারই ফল, তেমনি এর মাধ্যমে হাদীস ছাড়াই ক্বুরআন বুঝার ঘৃণিত প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছে। সুতরাং এ কথা সঠিক যে, সহীহ হাদীস ছাড়া ক্বুরআন বুঝা যেতে পারে না।

[৭] ঈসা (আঃ)-এর নবুঅত কালে আহলে ইঞ্জীলদেরকে এই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুঅত প্রাপ্তির পর ঈসা (আঃ)-এর নবুঅতের যুগ শেষ হয়ে যায়; অনুরূপ ইঞ্জীলের অনুসরণের নির্দেশও। বর্তমানে ঐ ব্যক্তি ঈমানদার বা মু’মিন বলে বিবেচিত হবে, যে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রিসালাতের উপর ঈমান আনবে এবং কুরআনের অনুসরণ করবে।

Leave a Reply