أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٢٠٧)-৪০৯
www.motaher21.net
ُ وَلَا تَتَّبِعُواْ أَهْوَاء قَوْمٍ
এমন কওমের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না,
and do not follow the vain desires …
সুরা: আল্ মায়িদাহ
আয়াত নং :-৭৬-৭৭
قُلْ أَتَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا ۚ وَاللَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
বল, ‘তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করবে, যা তোমাদের জন্য কোন ক্ষতি ও উপকারের ক্ষমতা রাখে না? আর আল্লাহ, তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’।
আয়াত:-৭৭
قُلْ يٰٓأَهْلَ الْكِتٰبِ لَا تَغْلُوا فِى دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعُوٓا أَهْوَآءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِن قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَن سَوَآءِ السَّبِيلِ
বল, ‘হে কিতাবীরা, সত্য ছাড়া তোমরা তোমাদের ধর্মের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করো না এবং এমন কওমের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, আর অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সোজা পথ বিচ্যুত হয়েছে।
৭৬-৭৭ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১০১) যেসব গোমরাহ জাতি থেকে খৃস্টানরা ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস ও বাতিল পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল এখানে তাদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বিশেষ করে এখানে গ্রীক দার্শনিকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের চিন্তধারায় প্রভাবিত হয়ে খৃস্টানরা সেই সিরাতে মুস্তাকীম-সরল সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, সেদিক প্রথমত তাদেরকে পরিচালিত করা হয়েছিল। হযরত ঈসার প্রথম দিকের অনুসারীরা যে আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করতেন তা বেশীর ভাগ তাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞানলব্ধ সত্য ছিল এবং তাদের নেতা ও পথপ্রদর্শক তাদেরকে সেগুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালের খৃস্টানরা একদিকে ঈসার প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শনের প্রশ্নে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে এবং অন্যদিকে প্রতিবেশী জাতিসমূহের অলীক ধ্যান-ধারণা ও দর্শনে প্রভাবিত হয়ে নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের বানোয়াট দার্শনিক ব্যাখ্যা দিতে শুরু করে। এভাবে তারা একটি সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম তৈরী করে ফেলে। এ নতুন ধর্মের সাথে হযরত ঈসার আসল শিক্ষাবলীর দূরতম কোন সম্পর্কও ছিল না। এ ব্যাপারে একজন খৃস্টান ধর্মতত্ববিদ রেভারেণ্ড চার্লস এণ্ডারসন স্কটের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার চতুর্দশ সংস্করণে “ঈসা মসীহ” (JESUS CHRIST) শিরোনামে তিনি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাতে তিনি লিখেছেনঃ
“প্রথম তিনটি ইনজীলে (মথি, মার্ক ও লুক) এমন কোন জিনিস নেই যা থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, এ তিনটি ইনজীলের লেখকরা ঈসাকে মানুষ ছাড়া অন্য কিছু মনে করতেন। তাদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ যিনি বিশেষভাবে আল্লাহর আত্মা থেকে সঞ্জীবিত হয়েছিলেন এবং আল্লাহর সাথে এমন একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রাখতেন যে জন্য তাঁকে যদি আল্লাহর পুত্র বলা হয় তাহলে তা ন্যায়সঙ্গত হবে। মথি নিজে তাঁর উল্লেখ করেছেন কাঠ মিস্ত্রীর পুত্র হিসেবে। এক জায়গায় তিনি বলছেন, পিতর তাঁকে “মসীহ” মেনে নেবার পর ‘তাঁকে আলাদা একদিকে ডেকে নিয়ে ভৎর্সনা করতে লাগলেন।’ (মথি ১৬, ২২) লুক-এ আমরা দেখছি ক্রুশবিদ্ধ হবার ঘটনার পর হযরত ঈসার দু’জন শাগরিদ ইম্মায়ু নামক গ্রামের দিকে যাবার সময় নিম্নোক্তভাবে এর উল্লেখ করেছেন “তিনি আল্লাহর ও সকল লোকের সাক্ষাতে কাজে ও কথায় পরাক্রমী নবী ছিলেন।” (লুক ২৪, ১৯) একথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যদিও মার্কের রচনার পূর্বেই খৃস্টানদের মধ্যে ঈসার জন্য ‘প্রভু’ (Lor) শব্দটির ব্যবহার সাধারণভাবে প্রচলিত হয়ে পড়েছিল তবুও মার্কের ইনজীলে ঈসাকে কোথাও এ শব্দের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়নি এবং মথির ইনজিলেও নয়। অন্যদিকে এ দু’টি পুস্তকে এ শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে আল্লাহর জন্য। ঈসার বিপদের ঘটনা যেভাবে বর্ণনা করা দরকার ঠিক তেমনি জোরে শোরে তিনটি ইনজীলেই বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু মার্কের ‘মুক্তিপণ’ সম্বলিত বাণী (মার্ক ১০:৪৫) ও শেষ উপদেশের সময়ের কয়েকটি শব্দ বাদ দিলে এ ইনজিলগুলোর কোথাও এ ঘটনার এমন অর্থ গ্রহণ করা হয়নি যা পরবর্তীকালে গ্রহণ করা হয়েছে। এমন কি ঈসার মৃত্যুর সাথে মানুষের পাপ মোচনের কোন সম্পর্ক ছিল, এ মর্মে কোথাও সামান্যতম ইঙ্গিতও করা হয়নি।”
পরবর্তী পর্যাযে তিনি আরো লিখেছেনঃ
“ইনজীলগুলোর বিভিন্ন বাক্য থেকে একথা প্রমাণ হয় যে, ঈসা নিজেকে একজন নবী হিসেবে পেশ করতেন। যেমন, ‘আমাকে আজ, কাল ও পরশু অবশ্যি নিজের পথে চলতে হবে। কারণ জেরুসালেমের বাইরে কোন নবী মারা যাবে–এমনটি হতে পারে না। ’ (লুক ১৩:৩৩) -তিনি অধিকাংশ সময় নিজেকে ‘আদম সন্তান’ বলে উল্লেখ করেছেন। …… ঈসা কোথাও নিজেকে আল্লাহর পুত্র বলেননি। তাঁর সমকালীন অন্য কেউ যখন তাঁর সম্পর্কে এ শব্দটি ব্যবহার করেন তখন সম্ভবত তার মমার্থ এটাই হয় যে, তিনি তাঁকে ‘মসীহ’ মনে করেন তবে তিনি নিজেকে ব্যাপক অর্থে ‘পুত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। ……… এছাড়া আল্লাহর সাথে নিজের সম্পর্ক বর্ণনা করার জন্যও তিনি ‘পিতা’ শব্দটিকেও এ ব্যাপক অর্থেই ব্যবহার করেছেন। ……আল্লাহর সাথে কেবল তাঁর একার এ সম্পর্ক আছে বলে তিনি মনে করতেন না। বরং প্রাথমিক যুগে অন্যান্য মানুষেরও আল্লাহর সাথে এ ধরনের বিশেষ গভীর সম্পর্ক ছিল এবং এ ব্যাপারে তিনি তাদেরকে নিজের সাথী মনে করতেন। তবে পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা এবং মানবিক প্রকৃতির গভীর অধ্যয়ন তাঁকে একথা বুঝতে বাধ্য করে যে, এ ব্যাপারে তিনি একা।” প্রবন্ধকার সামনে অগ্রসর হয়ে আরো লিখেছেনঃ “পুন্তেকুসতের ঈদের সময় পিতরের এ কথাগুলো-‘একজন মানুষ যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ছিলেন’-ঈসাকে এমনভাবে পেশ করে যেমন তাঁর সমকালীনরা তাঁকে জানতো ও বুঝতো। …. ইনজীলগুলো থেকে আমরা জানতে পারি, শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত ঈসা সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভের পর্যায় অতিক্রম করেন। তাঁর ক্ষুধা ও পিপাসা লাগতো। তিনি ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হতেন এবং ঘুমিয়ে পড়তেন। তিনি বিস্ময়াবিষ্ট হতে পারতেন এবং তার ভালমন্দ জিজ্ঞেস করার মুখাপেক্ষী হতেন। তিনি দুঃখ সয়েছেন এবং মরে গেছেন। তিনি কেবল সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা হবার দাবীই করেননি বরং সুস্পষ্ট ভাষায় এগুলো অস্বীকার করেছেন। …. আসলে যদি দাবী করা হয় যে, তিনি সর্বত্র উপস্থিত ও সর্বদ্রষ্টা, তাহলে ইনজীল থেকে আমরা যে ধারণা পাই এটা হবে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং তাঁর পরীক্ষার ঘটনা এবং গিতাসমনী ও খোপড়ী নামক স্থানে যা কিছু ঘটেছিল সেগুলোকে সম্পূর্ণ অবাস্তব বলে ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এ দাবীর সাথে সেগুলোর কোন একটিরও কোন সামঞ্জস্য দেখানো যেতে পারে না। একথা অবশ্যি মানতে হবে, মসীহ্ যখন এ সমস্ত অবস্থার চড়াই উতরাই অতিক্রম করেছেন তখন তিনি মানবিক জ্ঞানের সাধারণ সীমাবদ্ধতার অধিকারী ছিলেন। এ সীমাবদ্ধতার মধ্যে কোন ব্যতিক্রম থেকে থাকলে তা কেবল এতটুক হতে পারে যা নবী সুলভ অন্তর্দৃষ্টি ও আল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহাতীত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া মসীহকে সর্বশক্তিমান মনে করার অবকাশ ইনজীলে আরো কম। ইনজীলের কোথাও এতটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যাবে না যে, ঈসা আল্লাহর মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই স্বাধীনভাবে সমস্ত কাজ করতেন। বরং উল্টো তাঁর বারবার দোয়া চাওয়ার অভ্যাস থেকে এবং এ বিপদটির হাত থেকে দোয়া ছাড়া আর কোন উপায়ে রেহাই পাওয়া যাবে না”-এ ধরনের বাক্য থেকে একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করে নেয়া হয় যে, তাঁর সত্তা আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। যদিও খৃস্টীয় গীর্জাসমূহ যখন থেকে ঈসাকে ‘ইলাহ’ ও ‘আল্লাহ’ মনে করতে শুরু করেছে, তার পূর্বে ইনজীল গ্রন্থসমূহ সংকলন ও লিপিবদ্ধ করার কাজ সম্পূর্ণ হতে পারেনি, তবুও এ প্রমাণ পত্রগুলোতে একদিকে ঈসা যে যথার্থই একজন মানুষ, তার সাক্ষ্য সংরক্ষিত রয়ে গেছে এবং অন্যদিকে এগুলোর মধ্যে ঈসা নিজেকে আল্লাহ মনে করতেন, এমন কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়টি ইনজীলগুলোর ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।” অতঃপর এ প্রবন্ধকার আরো লিখেছেনঃ “আসমানে উঠিয়ে নেবার ঘটনার সময় এ উঠিয়ে নেবার মাধ্যমে ঈসাকে পূর্ণ ক্ষমতা সহকারে প্রকাশ্যে ‘আল্লাহর পুত্রের’ মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে, একথা সেন্টপলই ঘোষণা করেছিলেন। এ ‘আল্লাহর পুত্র’ শব্দটির মধ্যে নিশ্চিতভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পুত্র হবার একটি ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে এবং সেন্টপল অন্য এক জায়গায় ঈসাকে ‘আল্লাহর নিজের পুত্র’ বলে সেই ইঙ্গিতটিকে সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। মসীহের জন্য ‘বিধাতা বা প্রভু’ বা ঈশ্বর শব্দটির আসল ধর্মীয় অর্থে ব্যবহার প্রথমে কে করেছিলেন, প্রথম খৃস্টীয় দলটি, না সেন্টপল, এ বিষয়ের মীমাংসা করা এখন আর সম্ভবপর নয়। সম্ভবত প্রথমোক্ত দলটিই এর উদ্ভাবক। কিন্তু নিঃসন্দেহে সেন্টপলই এ সম্বোধনটির সর্বপ্রথম পূর্ণ অর্থে ব্যবহার শুরু করেন। তারপর ‘ঈসা মসীহ’ সম্পর্কে তিনি এমন অনেক চিন্তাধারা ও পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ করেন যেগুলো প্রাচীন পবিত্র গ্রন্থাদিতে একমাত্র ‘ঈশ্বর ইহুওয়া’ (আল্লাহ তাআলা’র) জন্য বলা হয়েছে। এভাবে নিজের বক্তব্যকে তিনি আরো বেশী সুস্পষ্ট করে তোলেন। এ সঙ্গে মসীহকে তিনি আল্লাহর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে সমপর্যায়ভুক্ত করেন এবং ব্যাপক ও সাধারণ অর্থে তাঁকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করেন। তবুও বিভিন্ন দিক থেকে আল্লাহর সমপর্যায়ভুক্ত করে দেবার পরও সেন্টপল তাঁকে চূড়ান্তভাবে আল্লাহ বলতে বিরত থাকেন।”
ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার আর একজন প্রবন্ধকার রেভারেণ্ড জর্জ উইলিয়াম ফক্স তাঁর ‘খৃষ্টবাদ’ (Christianity) শীর্ষক প্রবন্ধে খৃস্টীয় গীর্জার মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখছেনঃ “ত্রিত্ববাদী বিশ্বাসের চিন্তাগত কাঠামো গ্রীক দেশীয়। এর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে ইহুদী শিক্ষা। এদিক দিয়ে বিচার করলে এটি আমাদের জন্য একটি অদ্ভুত ধরনের যৌগিক। ধর্মীয় চিন্তাধারা বাইবেল থেকে উৎসারিত কিন্তু তা ঢেলে সাজানো হয়েছে এক অপরিচিত দর্শনের আকারে। পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার পরিভাষা ইহুদী সূত্রে লাভ করা হয়েছে। শেষ পরিভাষাটি যীশু (ঈসা) নিজে খুব কমই কখনো কখনো ব্যবহার করেছিলেন। আর পল নিজেও এটিকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তাতে এর অর্থ সম্পূর্ণ অস্পষ্ট ছিল। তবুও ইহুদী সাহিত্যে এ শব্দটি ব্যক্তিত্বের রূপ গ্রহণ করার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কাজেই এ বিশ্বাসটির মৌল উপাদান ইহুদীবাদ থেকে গৃহীত (যদিও এ যৌগিকের অন্তর্ভুক্ত হবার আগেই এটি গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল) এবং বিষয়টি নির্ভেজাল গ্রীকদেশীয়। যে প্রশ্নটির ভিত্তিতে এ বিশ্বাস গড়ে ওঠে সেটি কোন নৈতিক বা ধর্মীয় প্রশ্ন ছিল না। বরং সেটি ছিল আগাগোড়া একটি দার্শনিক প্রশ্ন। অর্থাৎ এ তিনটি পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা সত্তার মধ্যে সম্পর্কের স্বরূপ কি? গীর্জা এ প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছে তা নিকিয়া কাউন্সিলে নির্ধারিত আকীদার মধ্যে সংযুক্ত হয়েছে। সেটি দেখার পর পরিষ্কার জানা যায় ওটা পুরোপুরি গ্রীক চিন্তারই সমষ্টি।
এ প্রসঙ্গে ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ‘চার্চের ইতিহাস’(Church History) শিরোনামে লিখিত অন্য একটি নিবন্ধের নিম্নোক্ত বক্তব্যটিও উল্লেখযোগ্যঃ “খৃস্টীয় তৃতীয় শতক শেষ হবার আগে মসীহকে সাধারণভাবে ‘বাণী’র দৈহিক প্রকাশ হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছিল। তবুও অধিকাংশ খৃস্টান মসীহর ‘ইলাহ’ হওয়ার স্বীকৃতি দেয়নি। চতুর্থ শতকে এ বিষয়টির ওপর তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে গীর্জার ভিত্ নড়ে উঠেছিল। অবশেষে ৩২৫ খৃষ্টাব্দে নিকিয়া কাউন্সিল মসীহকে সরকারীভাবে যথারীতি ইলাহ বা ঈশ্বর হিসেবে ঘোষণা করে। সে সাথে এটিকে খৃস্টীয় আকীদা বলে গণ্য করে এবং সুনির্দিষ্ট শব্দাবলী সমন্বয়ে সেটি রচনা করে। এরপরও কিছুকাল পর্যন্ত বিতর্ক চলতে থাকে। কিন্তু শেষ বিজয় হয় নিকিয়া কাউন্সিলের সিদ্ধান্তেরই। পূর্বে ও পশ্চিমে এ সিদ্ধান্তকে যেভাবে মেনে নেয়া হয় তাতে যেন একথা স্বীকৃতি লাভ করে যে, নির্ভুল আকীদা সম্পন্ন খৃস্টান হতে হলে তাকে অবশ্যি এর ওপর ঈমান আনতে হবে। পুত্রকে ‘ইলাহ’ বলে মেনে নেবার সাথে সাথে ‘পবিত্র আত্মাকে’ ও ইলাহ বলে মেনে নেয়া হয়। তাকে ধর্মান্তর গ্রহণের মন্ত্র এবং প্রচলিত ঐতিহ্যসমূহের মধ্যে পিতা ও পুত্রের সাথে এক সারিতে জায়গা দেয়া হয়। এভাবে নিকিয়ায় মসীহর যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তার ফলে ত্রিত্ববাদ খৃষ্ট ধর্মের অবিচ্ছিন্ন অংগ গণ্য হয়েছে। তারপর “পুত্রের ‘ইলাহ’ হবার তত্ত্বটি ঈসার ব্যক্তিসত্তায় রূপায়িত হয়েছিল”-এ দাবী আর একটি সমস্যার সৃষ্টি করে। চতুর্থ শতক এবং তার পরেও দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। বিষয়টি ছিল ঈসার ব্যক্তিত্বে ঈশ্বরত্ব ও মনুষ্যত্বের মধ্যে কি সম্পর্ক ছিল? ৪৫১ খৃষ্টাব্দে ক্যালসিডন কাউন্সিলে এর যে মীমাংসা হয়েছিল তা ছিল এই যে, ঈসার ব্যক্তিসত্তায় দু’টি পূর্ণাঙ্গ প্রকৃতি একত্র হয়েছে। একটি ঐশ্বরিক প্রকৃতি এবং অন্যটি মানবিক প্রকৃতি। উভয়টি একত্রে সংযুক্ত হবার পরও কোন প্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ছাড়াই প্রত্যেকের পৃথক বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত রয়েছে। ৬৮০ খৃষ্টাব্দে কনষ্ট্যান্টিনোপলে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কাউন্সিলে এর ওপর কেবল মাত্র এতটুকু বৃদ্ধি করা হয় যে, এ দু’টি প্রকৃতি নিজ নিজ পৃথক ইচ্ছারও অধিকারী। অর্থাৎ ঈসা একই সঙ্গে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ইচ্ছার ধারক। …..এ অন্তরবর্তীকালে পশ্চিমী চার্চ ‘গুনাহ’ ও ‘অনুগ্রহ’ বিষয় দু’টির প্রতিও বিশেষ নজর দেয়। ‘নাজাত’ বা ‘মুক্তি’র ব্যাপারে আল্লাহর ভূমিকা কি এবং বান্দার ভূমিকা কি-এ প্রশ্নটি নিয়ে সেখানে দীর্ঘকাল আলোচনা চলতে থাকে। অবশেষে ৫২৯ খৃস্টাব্দে উরিনজের দ্বিতীয় কাউন্সিলে…… এ মতবাদ গ্রহণ করা হয় যে, আদমের পৃথিবীতে নেমে আসার কারণে প্রত্যেকটি মানুষ এমন এক অবস্থার শিকার হয়েছে যার ফলে সে খৃস্ট ধর্মাবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে নব জীবন ধারণ না করা পর্যন্ত নাজাত বা মুক্তির দিকে এক পাও অগ্রসর হতে পারে না। আর এ নব জীবন শুরু করার পরও যতক্ষণ না আল্লাহর অনুগ্রহ সার্বক্ষণিকভাবে তার সহায়ক থাকে ততক্ষণ সে সততা ও নেকীর অবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে পারে না। আল্লাহর অনুগ্রহের এ সার্বক্ষণিক সাহায্য সে একমাত্র ক্যাথলিক চার্চের মাধ্যমেই লাভ করতে পারে।”
খৃস্টীয় আলেমগণের এসব বর্ণনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, প্রথম দিকে যে জিনিসটি খৃস্টীয় সমাজকে গোমরাহ করেছিল সেটি ছিল ভক্তি ও ভালবাসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি। এ বাড়াবাড়ির কারণে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্য ‘ঈশ্বর বা ইলাহ ‘আল্লাহর পুত্র’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়। আল্লাহর গুণাবলী তাঁর সাথে সংযুক্ত করা হয় এবং তথাকথিত কাফফারা বা প্রায়শ্চিত্ত সংক্রান্ত আকীদা উদ্ভাবন করা হয়। অথচ হযরত ঈসার শিক্ষাবলীতে এসব বিষয়ের কোন সামান্যতম অবকাশও ছিল না। তারপর খৃস্টবাদীদের গায়ে যখন দর্শনের বাতাস লাগলো তখন তারা এ প্রাথমিক গোমরাহী অনুধাবন করে তার খপ্পর থেকে বাঁচার চেষ্টা না করে উল্টো নিজেদের পূর্ববর্তী নেতৃবৃন্দের ভুলগুলোকেই মেনে চলার জন্য সেগুলোর ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলো এবং ঈসা আলাইহিস সালামের আসল শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ না করে নিছক দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রের সহায়তায় আকীদার পর আকীদা উদ্ভাবন করে চললো। খৃস্টবাদীদের এ গোমরাহীর বিরুদ্ধেই কুরআনের এ আয়াতগুলোতে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
যারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত নিজেদের তৈরি মূর্তি ও প্রতিমার ইবাদত করে আল্লাহ তা‘আলা সেসব মুশরিকদেরকে ভর্ৎসনা করে বলেন যে, তোমরা এমন সব বাতিল মা‘বূদের ইবাদত কর যারা তোমাদের কোন উপকার বা অপকারের ক্ষমতা রাখে না। তারা তো তোমাদের কোন অভিযোগও শুনতে পায় না। বরং আল্লাহ তা‘আলা সত্যিকার মা‘বূদ যিনি সবকিছু শুনেন এবং জানেন।
পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদেরকে অন্যায়ভাবে তাদের দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তারা নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে তাকে আল্লাহ তা‘আলার মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা সৎ লোকেদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে কবরগুলোকে ইবাদাতের স্থান বানিয়ে নিয়েছে। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
لَا تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَي ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللّٰهِ، وَرَسُولُهُ
তোমরা আমার সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন খ্রিস্টানগণ ঈসা (আঃ)-কে নিয়ে করেছে। আমি একজন আল্লাহর বান্দা। অতএব আমাকে আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল বলে সম্বোধন কর। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৪৫)
দীন ও সৎ লোকেদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে অধিকাংশ লোক শির্কে লিপ্ত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তোমরা বাড়াবাড়ি করা থেকে দূরে থাক, কেননা বাড়াবাড়ি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে। (ইবনু মাযাহ হা: ৩০২৯, সহীহ) তাই সৎ লোকেদের নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে তাদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে দীনের ব্যাপারে তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যাদের ইবাদত করা হয় তারা সব বাতিল মা‘বূদ। তারা মানুষের কোন ভাল-মন্দের মালিক নয়।
২. দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করা নিষেধ।
৩. যারা নিজে পথভ্রষ্ট ও অন্যদেরকে পথভ্রষ্ট করে তাদের অনুসরণ করা যাবে না।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Al Mayadah
Verse:- 76-77
وَلَا تَتَّبِعُواْ أَهْوَاء قَوْمٍ
and do not follow the vain desires …
The Prohibition of Shirk (Polytheism) and Exaggeration in the Religion
Allah admonishes those who take up rivals with Him and worship the idols, monuments and false deities. Allah states that such false deities do not deserve any degree of Divinity.
Allah said,
قُلْ
Say,
O Muhammad, to those from among the Children of Adam, such as the Christians, who worship other than Allah,
أَتَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللّهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا
How do you worship besides Allah something which has no power either to harm or to benefit you!
meaning, which cannot prevent harm for you nor bring about your benefit.
وَاللّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
But it is Allah Who is the All-Hearer, All-Knower.
He hears what His servants say and has knowledge of all things. Therefore, how did you worship inanimate objects that do not hear, see or know anything – having no power to bring harm or benefit to themselves let alone others – instead of worshipping Allah.
Allah then said
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُواْ فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ
Say:”O People of the Scripture! Exceed not the limits in your religion beyond the truth,
Meaning:Do not exceed the limits concerning the truth and exaggeration in praising whom you were commanded to honor. You exaggerated in his case and elevated him from the rank of Prophet to the rank of a god. You did this with `Isa, who was a Prophet, yet you claimed that he is god besides Allah.
وَلَا تَتَّبِعُواْ أَهْوَاء قَوْمٍ قَدْ ضَلُّواْ مِن قَبْلُ
and do not follow the vain desires of people who went astray before…
This error occurred because you followed your teachers, the advocates of misguidance who came before your time and who,
وَأَضَلُّواْ كَثِيرًا وَضَلُّواْ عَن سَوَاء السَّبِيلِ
and who misled many, and strayed (themselves) from the right path.
deviated from the straight path, to the path of misguidance and deviation.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
৭৬-৭৭ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহকে ছেড়ে বাতিল মা’রূদগুলোর ইবাদত করতে নিষেধ করা হচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা নবী (সঃ)-কে বলছেন- এসব লোককে বলে দাও–যারা তোমাদের কোন ক্ষতি করার এবং উপকার করার কোনই ক্ষমতা রাখে না, তাদের তোমরা কেন পূজা করছো? যিনি সবকিছু শুনেন ও সবকিছুর খবর রাখেন, সেই আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে যাদের শুনবার, দেখবার এবং উপকার ও অপকার করবার কোনই ক্ষমতা নেই, তাদের অনুসরণ করা কতই না নির্বুদ্ধিতার কাজ! হে আহলে কিতাব! তোমরা হক ও সত্যের সীমা ছাড়িয়ে যেয়ো না। যার যতটুকু সম্মান করার নির্দেশ রয়েছে তার ততটুকুই সম্মান কর। মানুষের মধ্যে যাদেরকে আল্লাহ নবুওয়াত দান করেছেন তাদেরকে নবুওয়াতের মর্যাদা থেকে বাড়িয়ে আল্লাহর মর্যাদায় পৌছিয়ে দিয়ো না। যেমন তোমরা মাসীহ (আঃ)-এর ব্যাপার ভুল করছে। এর একমাত্র কারণ এটাই যে, তোমরা তোমাদের পীর, মুরশিদ, উস্তাদ এবং ইমামদের পিছনে লেগে পড়েছে। তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট এবং অনুসারীদেরকেও করেছে পথভ্রষ্ট। বহু দিন হতে সরল ও ন্যায়ের পথকে ছেড়ে দিয়েছে এবং ভ্রান্তি ও বিদআতের মধ্যে জড়িত হয়ে পড়েছে। ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, তাদের মধ্যে একটি লোক ধর্মের খুবই পাবন্দ ছিল। কিছুদিন পর শয়তান তাকে পথভ্রষ্ট করে দেয়। সে তাকে বলে, “আগের লোকেরা যা করে গেছে তুমিও তো তাই করছে। এতে কি হবে? এর দ্বারা না জনগণের মধ্যে তোমার কোন মর্যাদা লাভ হবে, না তোমার কোন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। বরং একটা নতুন কিছু আবিষ্কার কর এবং জনগণের মধ্যে তা ছড়িয়ে দাও। তাহলে দেখতে পাবে যে, তোমার খ্যাতি কিরূপে ছড়িয়ে পড়ছে এবং কিভাবে স্থানে স্থানে তোমার সম্পর্কে আলোচনা চলছে।” সুতরাং সে তার কথা মত তা-ই করলো। তার ঐ বিদআতগুলো জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এবং বহু যুগ পর্যন্ত লোকেরা তার অন্ধ অনুকরণ করতে থাকলো। এখন হতে সে খুবই লজ্জিত হলো এবং সালতানাত ও রাজত্ব পরিত্যাগ করলো। তারপর নির্জনে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়লো। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে জানিয়ে দিলেন-“তুমি যদি শুধু আমারই ব্যাপারে ভুল ও অপরাধ করতে তবে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতাম। কিন্তু তুমি সাধারণ লোকের আমল নষ্ট করে দিয়েছে এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ভ্রান্তির পথে লাগিয়ে দিয়েছে। সেই পথে চলতে চলতে তারা মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের পাপের বোঝা তোমার উপর থেকে কিরূপে সরতে পারে? সুতরাং তোমার তাওবা কবুল করা হবে না।” এ ধরনের লোকদের ব্যাপারে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এটাই মুশরিকদের নির্বোধ হওয়ার পরিচয় যে, তারা তাদেরই মধ্য হতে একজনকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে, যে কারো কোন উপকার বা অপকার সাধন করতে পারে না। আর কারো উপকার বা অপকার সাধন করা তো দূরের কথা, সে না কারো কথা শুনতে পায়, আর না কারো অবস্থা সর্ম্পকে অবগত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। বরং এই শক্তি কেবলমাত্র আল্লাহর মধ্যেই আছে। আর এই জন্যই তিনি হচ্ছেন একমাত্র বিপত্তারণ ও ফরিয়াদ শ্রবণকারী।
[২] অর্থাৎ, সত্যের অনুসরণ করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম করো না। যাঁর সম্মান প্রদর্শন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করে তাঁকে আল্লাহর আসনে অধিষ্ঠিত করো না। যেমন ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে তোমরা করেছ। অতিরঞ্জন সর্বযুগে শিরক ও ভ্রষ্টতার সব থেকে বড় উপকরণ হিসাবে দেখা গেছে। মানুষের মনে যাঁর প্রতি নিতান্ত বিশ্বাস ও ভালোবাসা আছে, সে তাঁর ব্যাপারে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করে থাকে। তিনি যদি ইমাম বা ধর্মীয় নেতা হন, তাহলে তাঁকে নবীদের মত নিষ্পাপ মনে করা এবং নবীদেরকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা তো সাধারণ ব্যাপার। দুর্ভাগ্যবশতঃ মুসলিমরাও এই অতিরঞ্জন থেকে মুক্ত নয়। তারাও কিছু ইমাম ও উলামার ব্যাপারে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করেছে যে, তাঁদের রায় ও উক্তি এমনকি তাঁদের প্রতি সম্পৃক্ত ফতোয়া এবং ফিকহকেও রসূল (সাঃ)-এর হাদীসের উপর অগ্রাধিকার প্রদান করেছে!
[৩] অর্থাৎ, পূর্ববর্তী লোকেদের পিছে পড়ো না, যারা এক নবীকে মা’বূদ বা উপাস্য বানিয়ে নিয়ে নিজেরা ভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরকেও ভ্রষ্ট করেছে।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] আলোচ্য আয়াতে (لَا تَغْلُوْا فِيْ دِيْنِكُمْ) বলার সাথে সাথে (غَيْرَ الْحَقِّ) বলা হয়েছে। এর অর্থ এই যে, অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না। তাফসীরবিদদের মতে এ শব্দটি তাকীদ অর্থাৎ বিষয়বস্তুকে জোরদার করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা, দ্বীনে বাড়াবাড়ি সর্বাবস্থায়ই অন্যায়। এটা ন্যায় হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেন, এখানে (غَيْرَ الْحَقِّ) কথাটি (دِيْن) এর গুণ হিসেবে এসেছে। সুতরাং এর অর্থ হবে, তোমরা তোমাদের দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ, তোমাদের দ্বীনটি হকের বিপরীত অবস্থানে রয়েছে। [তাবারী]
[২] (غُلُوّ) শব্দের অর্থ সীমা অতিক্রম করা দ্বীনের সীমা অতিক্রম করার অর্থ এই যে, বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে দ্বীন যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা লংঘন করা। উদাহরণতঃ নবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সীমা এই যে, আল্লাহর সৃষ্টজীবের মধ্যে তাদেরকে সর্বোত্তম মনে করতে হবে। এ সীমা অতিক্রম করে তাদেরকে আল্লাহ কিংবা আল্লাহর পুত্র বলে দেয়া হচ্ছে বিশ্বাসগত সীমা লংঘন। নবীদের প্রতি মিথ্যারোপ করা এবং হত্যা করতেও কুষ্ঠিত না হওয়া অথবা তাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ কিংবা আল্লাহর পুত্র বলে দেয়া বনী-ইসরাঈলের এ পরস্পর বিরোধী দু’টি কাজই হচ্ছে মূর্খতাপ্রসূত বাড়াবাড়ি। মূর্খ ব্যক্তি কখনো মিথ্যাচার অথবা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে পারে না। হয় সে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়, না হয় সীমালংঘনে। তাই আয়াতে বনী-ইসরাঈলদেরকে এ ধরনের বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর]
[৩] আলোচ্য আয়াতের শেষভাগে বর্তমান কালের বনী-ইসরাঈলদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তোমরা ঐ সম্প্রদায়ের অনুসরণ করো না, যারা তোমাদের পূর্বে নিজের পথভ্রষ্ট হয়েছিল এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করেছিল। অতঃপর তাদের পথভ্রষ্টতার স্বরূপ ও কারণ বর্ণনা করে বলা হয়েছে, তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল, যা ছিল বাড়াবাড়ি ও ক্রটির মাঝখানে মধ্যবর্তী পথ। এর দ্বারা হয় তারা নিজেরাই ভ্রান্ত পথে অগ্রসর হয়েছিল, না হয় তাদেরকে অন্যরা ভ্রান্তপথে পরিচালিত করেছিল। [তাবারী, ফাতহুল কাদীর]