أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٢٢٢)-৪২৪
www.motaher21.net
إِذْ قَالَ اللَّهُ يٰعِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ اذْكُرْ نِعْمَتِى عَلَيْك
‘হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা, তোমার উপর আমার নি‘আমত স্মরণ কর,
Reminding `Isa of the Favors that Allah Granted him
সুরা: আল্ মায়িদাহ
আয়াত নং :-১১০-১১১
إِذْ قَالَ اللَّهُ يٰعِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ اذْكُرْ نِعْمَتِى عَلَيْكَ وَعَلٰى وٰلِدَتِكَ إِذْ أَيَّدتُّكَ بِرُوحِ الْقُدُسِ تُكَلِّمُ النَّاسَ فِى الْمَهْدِ وَكَهْلًا ۖ وَإِذْ عَلَّمْتُكَ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرٰىةَ وَالْإِنجِيلَ ۖ وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ الطِّينِ كَهَيْـَٔةِ الطَّيْرِ بِإِذْنِى فَتَنفُخُ فِيهَا فَتَكُونُ طَيْرًۢا بِإِذْنِى ۖ وَتُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ بِإِذْنِى ۖ وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوْتٰى بِإِذْنِى ۖ وَإِذْ كَفَفْتُ بَنِىٓ إِسْرٰٓءِيلَ عَنكَ إِذْ جِئْتَهُم بِالْبَيِّنٰتِ فَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ إِنْ هٰذَآ إِلَّا سِحْرٌ مُّبِينٌ
যখন আল্লাহ বলবেন,‘হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা, তোমার উপর ও তোমার মাতার উপর আমার নি‘আমত স্মরণ কর, যখন আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম পবিত্র আত্মা* দিয়ে, তুমি মানুষের সাথে কথা বলতে দোলনায় ও পরিণত বয়সে। আর যখন আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়েছিলাম কিতাব, হিকমাত, তাওরাত ও ইনজীল; আর যখন আমার আদেশে কাদামাটি থেকে পাখির আকৃতির মত গঠন করতে এবং তাতে ফুঁক দিতে, ফলে আমার আদেশে তা পাখি হয়ে যেত। আর তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতে এবং যখন আমার আদেশে তুমি মৃতকে জীবিত বের করতে। আর যখন তুমি স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে তখন আমি বনী ইসরাঈলকে তোমার থেকে ফিরিয়ে রেখেছিলাম। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলেছিল, এতো স্পষ্ট যাদু।
আয়াত:-১১১
وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّۦنَ أَنْ ءَامِنُوا بِى وَبِرَسُولِى قَالُوٓا ءَامَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ
আর যখন আমি হাওয়ারী* গণকে এ আদেশ দিয়েছিলাম যে, ‘আমার প্রতি তোমরা ঈমান আন ও আমার রাসূলের প্রতি’। তারা বলেছিল, ‘আমরা ঈমান আনলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা অবশ্যই মুসলিম’।
১১০-১১১ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
ঈসা (আঃ) ও তাঁর মায়ের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা যে অনুগ্রহ করেছেন এবং ঈসা (আঃ)-কে যেসকল মু‘জিযাহ প্রদান করেছিলেন সে-কথা স্মরণ করে দীনের পথে অটল থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ অন্তরে শুকরিয়া, মুখে স্বীকার এবং সে নেয়ামতের দাবী অনুপাতে আমল করা। এরপর আল্লাহ তা‘আলা একটি একটি করে নেয়ামত ও মু’জিযার বর্ণনা দিচ্ছেন, “যখন পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম এবং তুমি দোলনায় থাকা অবস্থায় অপরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে; তোমাকে কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছিলাম; তুমি আমার অনুমতিক্রমে কাদা দিয়ে পাখি সদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুঁ দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখি হয়ে যেত; তুমি আমার অনুমতিক্রমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগগ্রস্তকে নিরাময় করতে এবং আমার অনুমতিক্রমে তুমি মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমার হতে বানী ইসরাঈলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম” এ সম্পর্কে সূরা আলি-ইমরানের ৪৯ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান কতক অপরিপক্ক বিদ্বান ঈসা (আঃ) বিনা পিতায় জন্ম, আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে মৃতকে জীবিত করা, তিনি আকাশে আছেন, শেষ যুগে আসবেন ইত্যাদি অস্বীকার করে থাকেন। কোন সন্দেহ নেই, যে ব্যক্তি এরূপ বিশ্বাস করবে সে ব্যক্তি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ বিরোধী এবং সঠিক পথ থেকে ভ্রষ্ট।
(إِنْ هٰذَآ إِلَّا سِحْرٌ مُّبِيْنٌ)
‘এটা তো স্পষ্ট জাদু।’প্রত্যেক নাবীর বিরোধীরা আল্লাহ তা‘আলার নাবীদের হাতে নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনাবলী দেখে জাদু বলে প্রত্যাখ্যান করেছে যেমন প্রত্যাখ্যান করেছে ঈসা (আঃ)-এর জাতির কাফিররা। অথচ জাদু হচ্ছে ভেল্কিবাজির কলা-কৌশল। আর নাবীরা যা প্রদর্শন করেন তা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার অসীম শক্তির বহিঃপ্রকাশ, এতে নাবীদের কোন ইচ্ছা ও এখতিয়ার নেই।
আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ছাড়া কোন প্রকার অলৌকিক ঘটনা বা মু‘জিযাহ প্রকাশ করতে নাবীরা সক্ষম নন।
সুতরাং এখানে লক্ষণীয় যে, ঈসা (আঃ)-এর প্রত্যেক মু‘জিযাহর সাথে আল্লাহ তা‘আলা চারবার بإذني (আমার অনুমতিক্রমে) কথা বলেছেন। তাই মুশরিকরা যখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট কোন মু‘জিযাহ দেখতে চাইতো তখন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন,
سبحان ربي ما كنت إلا بشرا رسولا
আমার প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, আমিতো একজন মানুষ ও রাসূল মাত্র।
তাই নাবীদের মু‘জিযাহর সাথে জাদুর কোন সম্পর্ক নেই। আর মু‘জিযাহ নাবীর হাতে তৈরি কোন জিনিস নয় বরং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এক অলৌকিক শক্তি।
(وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَي الْحَوَارِيِّيْنَ)
‘আরও স্মরণ কর, আমি যখন ‘হাওয়ারীদেরকে এ আদেশ দিয়েছিলাম’অর্থাৎ ঈসা (আঃ)-এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম আরেকটি অনুগ্রহ ছিল, ঈসা (আঃ)-এর জন্য তাঁর জাতি থেকে ‘হাওয়ারী’ খাঁটি অনুসারী তৈরি করে দিয়েছিলেন যারা ঈসা (আঃ)-এর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। অবশ্য হাওয়ারীদের এ আনুগত্য প্রকাশের ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলা দান করেছিলেন।
حَوَارِيْ শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে উৎপত্তি। অর্থ দেয়ালে চুনকাম করার মত ধবধবে সাদা। পারিভাষিক অর্থে ঈসা (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হত।
কোন কোন তাফসীরবিদ বলেছেন, তাদের সংখ্যা ছিল ১২ জন। ঈসা (আঃ)্-এর অনুসারী ও সাহায্যকারী সহচরদেরকে ‘হাওয়ারী’ বলা হয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসারী ও সহচরদেরকে ‘সাহাবী’ বলা হয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: প্রত্যেক নাবীর একজন বিশেষ সাহায্যকারী (হাওয়ারী) ছিল। আমার বিশেষ সাহায্যকারী হল যুবাইর (রাঃ)। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৪১৫) আর ‘হাওয়ারীদের’ ওয়াহী বলতে নাবীদের প্রতি যে ওয়াহী করা হয় তা উদ্দেশ্য নয় বরং এখানে ওয়াহী বলতে ইলহামকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসীর মুয়াসসার, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ঈসা (আঃ)-কে নানাবিধ মু‘জিযাহ প্রদান করা হয়েছিল ।
২. মু‘জিযাহ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এক অলৌকিক শক্তি যা দ্বারা নাবীদেরকে সাহায্য করা হয়।
৩. নাবীরা যা করতেন তা আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতেই করতেন।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Al Mayadah
Verse:- 110-111
إِذْ قَالَ اللَّهُ يٰعِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ اذْكُرْ نِعْمَتِى عَلَيْك
Reminding `Isa of the Favors that Allah Granted him
Reminding `Isa of the Favors that Allah Granted him
Allah
إِذْ قَالَ اللّهُ يَا عِيسى ابْنَ مَرْيَمَ
(Remember) when Allah will say (on the Day of Resurrection):”O `Isa, son of Maryam!
Allah mentions how He blessed His servant and Messenger, `Isa, son of Maryam, and the miracles and extraordinary acts He granted him.
Allah said,
اذْكُرْ نِعْمَتِي عَلَيْكَ
Remember My favor to you,
when I created you from your mother, without male intervention, and made you a sign and clear proof of My perfect power over all things.
وَعَلَى وَالِدَتِكَ
And to your mother,
when I made you testify to her chastity and you thus absolved her from the sin that the unjust, ignorant liars accused her of.
إِذْ أَيَّدتُّكَ بِرُوحِ الْقُدُسِ
when I supported you with Ruh-il-Qudus,
the angel Jibril, and made you a Prophet, calling to Allah in the cradle and manhood. I made you speak in the cradle, and you testified that your mother was free from any immoral behavior, and you proclaimed that you worship Me. You also conveyed the news of My Message and invited them to worship Me.
تُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلً
so that you spoke to the people in the cradle and in maturity;
Meaning you called the people to Allah in childhood and in maturity.
And the word Tukallim means invited, because his speaking to people while a child is nothing strange by itself.
Allah’s statement,
وَإِذْ عَلَّمْتُكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
(And when I taught you the Book and the Hikmah,) the power of writing and understanding,
وَالتَّوْرَاةَ وَالاِنجِيلَ
(and the Tawrah,) which was revealed to Musa, son of `Imran, who spoke to Allah directly.
Allah’s statement,
وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ الطِّينِ كَهَيْيَةِ الطَّيْرِ بِإِذْنِي
and when you made out of the clay, as it were, the figure of a bird, by My permission,
means:`you shaped it in the figure of a bird by My permission, and it became a bird with My permission,
فَتَنفُخُ فِيهَا فَتَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِي
and you breathed into it, and it became a bird by My permission,
after you blew into it’. Then, it became a flying bird with a soul by Allah’s permission.
Allah said;
وَتُبْرِىءُ الَاكْمَهَ وَالَابْرَصَ بِإِذْنِي
and you healed those born blind, and the lepers by My permission,
This was explained before in Surah Al Imran and we do not need to repeat it here.
Allah’s statement,
وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوتَى بِإِذْنِي
And when you brought forth the dead by My permission,
meaning, you called them and they rose from their graves by Allah’s leave, power, intent and will. Allah said next,
وَإِذْ كَفَفْتُ بَنِي إِسْرَايِيلَ عَنكَ إِذْ جِيْتَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُواْ مِنْهُمْ إِنْ هَـذَا إِلاَّ سِحْرٌ مُّبِينٌ
and when I restrained the Children of Israel from you since you came unto them with clear proofs, and the disbelievers among them said:”This is nothing but evident magic.”
Meaning:`remember My favor, when I stopped the Children of Israel from harming you, when you brought them the clear proofs and evidence, testifying to your Prophethood and Message from Me to them. They rejected you and accused you of being a magician and tried to kill you by crucifixion, but I saved you, raised you to Me, purified you from their vulgarity and protected you from their harm.’ The wording of this Ayah indicates that `Isa will be reminded of these favors on the Day of Resurrection.
Allah used the past tense in these Ayat indicating that it is a forgone matter that will certainly occur.
This Ayah also contains some of the secrets of the Unseen that Allah revealed to His Messenger Muhammad.
Allah said
وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ امِنُواْ بِي وَبِرَسُولِي
And when I (Allah) Awhaytu Al-Hawariyyin to believe in Me and My Messenger.
This is also a reminder of Allah’s favor on `Isa, by making disciples and companions for him.
It is also said that Awhaytu in the Ayah means, `inspired’, just as in another Ayah, Allah said;
وَأَوْحَيْنَا إِلَى أُمِّ مُوسَى أَنْ أَرْضِعِيهِ
And We inspired the mother of Musa (saying):Suckle him… (28:7)
Allah said in other Ayat,
وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِى مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ
ثُمَّ كُلِى مِن كُلِّ الثَّمَرَتِ فَاسْلُكِى سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلً
And your Lord Awha (inspired) the bee, saying:”Take habitations in the mountains and in the trees and in what they erect. Then, eat of all fruits, and follow the ways of your Lord made easy (for you).” (16:68-69)
Al-Hasan Al-Basri commented about the Hawariyyun,
“Allah inspired them”,
As-Suddi said,
“`He put in their hearts,”
and the Hawariyyun said,
قَالُوَاْ امَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ
they said:`We believe. And bear witness that we are Muslims.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
১১০-১১১ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা’আলা ঐ সমুদয় মুজিযারূপ নিয়ামতের বর্ণনা দিচ্ছেন, যেগুলো ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)-এর উপর তিনি অবতীর্ণ করেছিলেন। তিনি হযরত ঈসা (আঃ)-কে সম্বোধন করে বলেন, হে ঈসা (আঃ)! আমি যে তোমাকে নিয়ামতগুলো প্রদান করেছি সেগুলো তুমি স্মরণ কর। আমি তোমাকে পিতা ব্যতিরেকেই সৃষ্টি করেছি এবং তোমার সত্তাকে আমার ক্ষমতার পরিপূর্ণতার একটা নিদর্শন করেছি। আর তোমার মায়ের উপরও ইহসান করেছি এইভাবে যে, তোমাকে তার পবিত্রতার দলীল বানিয়েছি এবং মূর্খ ও অত্যাচারী লোকেরা তার উপর যে নির্লজ্জতার অপবাদ দিয়েছিল তা থেকে তাকে রক্ষা করেছি। তোমাকে আমি রূহুল কুদুস অর্থাৎ জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে সাহায্য করেছি। আমি তোমাকে তোমার শৈশবে ও যৌবনে এমনিভাবে নবী ও আল্লাহর পথে আহ্বানকারী বানিয়েছি যে, তুমি দোলনা থেকেই কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে এবং তোমার মাতার পবিত্রতার সাক্ষ্য প্রদান করেছে, আর নিজেকে আল্লাহর দাস বলে স্বীকার করে নিয়েছো। শৈশব ও যৌবনেও মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌছিয়ে দিয়েছো। পৌঢ় বয়সে কথা বলা বিস্ময়কর নয় বটে কিন্তু দোলনা থেকে কথা কতইনা বিস্ময়কর ব্যাপার। আল্লাহ পাক তোমাকে কিতাবের তা’লীম দিয়েছেন এবং মূসা (আঃ)-এর উপর অবতারিত তাওরাতের লিখা ও পড়া শিক্ষা দিয়েছেন।
(আরবী) অর্থাৎ তুমি আমার আদেশে মাটি দ্বারা পাখীর আকৃতি সদৃশ একটি আকৃতি তৈরী করতে এবং ফুৎকার দিতে। তখন তা আমারই আদেশে জীবিত পাখী হয়ে উড়তে শুরু করতো।
(আরবী) সূরায়ে আলে ইমরানে এর উপর আলোচনা হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে আর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।
(আরবী) অর্থাৎ তুমি মৃতদেরকে ডাকতে তখন তারা আল্লাহর হুকুমে জীবিত হয়ে কবর হতে বেরিয়ে আসতো।
(আরবী) অর্থাৎ হে ঈসা (আঃ)! আমার ঐ নিয়ামতের কথা স্মরণ কর যে, যখন তুমি বানী ইসরাঈলের নিকট নবুওয়াতের দলীলসহ পৌছলে এবং তারা তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, তোমার উপর অপবাদ দিলো, তোমাকে যাদুকর বললো এবং তোমাকে হত্যা করার ও শূলি দেয়ার চেষ্টা করলো, তখন আমি তোমাকে তাদের থেকে বাঁচিয়ে নিলাম, এরপর তোমাকে আমার নিকট উঠিয়ে নিলাম। এটা এ কথাই প্রমাণ করে যে, হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর আল্লাহর এ অনুগ্রহ তাঁকে তাঁর নিকট উঠিয়ে নেয়ার পরের ঘটনা, কিংবা এটা কিয়ামতের দিন সংঘটিত হবে। কিন্তু ভবিষ্যতকালকে অতীত কালের রূপ দ্বারা তা’বীর করা হয়েছে। কেননা, আল্লাহ তাআলার কাছে অতীত কালের ন্যায় ভবিষ্যত কালও নিশ্চিতরূপে অনুষ্ঠিতব্য। এসব হচ্ছে অদৃশ্যের ঘটনা, যেগুলো সম্পর্কে মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ)-কে অবহিত করেছেন।
(আরবী) এটাও হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রতি আল্লাহ পাকের একটা অনুগ্রহ যে, তিনি তার জন্যে সঙ্গী-সাথী ও সাহায্যকারী ঠিক করে দিয়েছেন। এখানে অহীর অর্থ হচ্ছে অন্তরের মধ্যে কিছু ভরে দেয়া। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেছেন (আরবী) অর্থাৎ ‘আমি মূসা (আঃ)-এর মায়ের কাছে অহী পাঠিয়েছিলাম-মূসা (আঃ)-কে দুধ পান করাও।’ (২৮৪৭) এরূপ ইলহামকে সর্বসম্মতভাবে অহী বলা হয়েছে। আর এক জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- (আরবী) অর্থাৎ ‘আমি মৌমাছির নিকট অহী পাঠিয়েছিলাম-পাহাড়সমূহে তোমাদের ঘর তৈরী কর। (১৬:৬৮) এভাবে হাওয়ারীদের উপর আল্লাহ ইলহাম করেছিলেন, তখন তারা ইলহামকৃত হুকুম মান্য করেছিল! হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, মহা মহিমান্বিত আল্লাহ তাদের উপর ইলহাম করেছিলেন। সুদী (রঃ) বলেন যে, তিনি তাদের অন্তরে ওটা নিক্ষেপ করেছিলেন। এর ভাবার্থ এও হতে পারে-আমি তোমার মাধ্যমে তাদের কাছে অহী করেছিলাম এবং তাদেরকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের আহ্বান জানিয়েছিলাম। তখন তারা তা কবুল করে নিয়েছিল এবং বলেছিল (আরবী) (হে ঈসা আঃ!) আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা আত্মসমর্পণকারী হয়ে গেলাম।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১২৫) প্রথম প্রশ্নটি সকল রসূলকে সামগ্রিকভাবে করা হবে। তারপর প্রত্যেক রসূলের কাছ থেকে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষ্য নেয়া হবে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে একথাটি সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে যে প্রশ্ন করা হবে তা এখানে বিশষেভাবে উদ্ধৃত হয়েছে।
টিকা:১২৬) অর্থাৎ মৃত্যুর অবস্থা থেকে বের করে জীবনের অবস্থায় আনতেন।
টিকা:১২৭) অর্থাৎ হাওয়ারীদের তোমার প্রতি ঈমান আনাও ছিল আমার অনুগ্রহ ও সুযোগ দানেরই ফল। নয়তো যে জনবসতি তোমার দাওয়াতকে মিথ্যা বলে ঘোষণা দিয়েছিল সেখান থেকে নিজের শক্তির জোরে তোমাকে সত্য বলে স্বীকার করে, এমন একজন লোক বের করে আনার ক্ষমতাও তোমার ছিল না। প্রসঙ্গত এখানে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, হাওয়ারীদের আসল ধর্ম ছিল ইসলাম, খৃস্টবাদ নয়।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] আলোচ্য আয়াতসমূহে ঈসা ‘আলাইহিস সালামের ঐসব অনুগ্রহের বিষয় উল্লেখিত হয়েছে, যা বিশেষভাবে ঈসা আলাইহিস সালামকে মু’জিযার আকার দেয়া হয়। এতে একদিকে বিশেষ অনুগ্রহ ও অপরদিকে জবাবদিহির দৃশ্যের অবতারণা করে বনী-ইসরাঈলের ঐ জাতিদ্বয়কে হুশিয়ার করা হয়েছে, যাদের এক জাতি তাকে অপমানিত করে এবং নানা অপবাদ আরোপ করে কষ্ট দেয় এবং অন্য জাতি আল্লাহ’ কিংবা ‘আল্লাহর পুত্র’ আখ্যা দেয়। [আইসারুত তাফসীর]
[২] রুহুল কুদুস অর্থ, পবিত্র আত্মা। এর দ্বারা জীবরিল আলাইহিস সালামকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়ে থাকে। কুরআন ও সুন্নাহয় এ অর্থেই ‘রুহুল কুদুস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। [যেমন, সুরা বাকারাহ:৮৭, ২৫৩; সূরা মায়েদাহ ১১০; সূরা আন-নাহল: ১০২]
[৩] অর্থাৎ তারা যখন আপনাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন আমি তাদের হাত থেকে আপনাকে হেফাযত করে আপনাকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলাম। অথচ আপনি তাদের কাছে প্রকাশ্য মু’জিযা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। মুয়াসসার]
[৪] আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত হাওয়ারী দ্বারা ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদেরকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তাদের অন্তরে ঈমান ঢেলে দিয়েছিলেন, ফলে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছিল। এখানে ওহী শব্দ ব্যবহার হলেও এর অর্থ হচ্ছে, মনে ইলহাম করা বা ঢেলে দেয়া। [মুয়াসসার]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, জিবরীল (আঃ), যেমনটি সূরা বাকারার ২:৮৭নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে।
[২] দোলনায় থাকা শিশু অবস্থায় ঐ সময় কথা বলেছিলেন, যখন মারয়্যাম (আলাইহাস সালাম) তাঁর ঐ সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে নিজ গোত্রের লোকের নিকট আসেন এবং তারা শিশুটিকে দেখে আশ্চর্য হয় এবং তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন শিশু ঈসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে দুগ্ধপানকালীন অবস্থায় কথা বলেছিলেন। আর পরিণত বয়সে কথা বলার ভাবার্থ হল, নবুঅত প্রাপ্তির পর (আল্লাহর পথে তাওহীদের) দাওয়াত ও তবলীগের জন্য যা বলেছিলেন।
[৩] এর ব্যাখ্যা সূরা আলে ইমরানের ৩:৪৮ নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে।
[৪] এই মু’জিযাসমূহের বর্ণনাও সূরা আলে ইমরানের ৩:৪৯ নং আয়াতে পরিবেশিত হয়েছে।
[৫] এখানে ঐ ষড়যন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা ইয়াহুদীরা ঈসা (আঃ)-কে হত্যা ও ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য করেছিল। তখন আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
(দ্রষ্টব্যঃ সূরা আলে ইমরানের ৩:৫৪নং আয়াতের টীকা)
[৬] প্রত্যেক নবীর বিরোধীরা, আল্লাহর নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনাবলী দেখে তারা তাকে যাদুই বলেছে। অথচ যাদু হচ্ছে, ভেল্কিবাজির কলা-কৌশল। তার সাথে নবীদের কি সম্পর্ক থাকতে পারে? নবীগণের হাতে প্রকাশিত অলৌকিক জিনিস, আসলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কুদরতে ও অসীম শক্তির এক বহিঃপ্রকাশ ছিল। কেননা, তা আল্লাহরই আদেশক্রমে তাঁরই ইচ্ছা ও শক্তিতে প্রকাশ পেত। কোন নবীর ইচ্ছা ও এখতিয়ারে এ ছিল না যে, তিনি যখন ইচ্ছা করতেন, আল্লাহর বিনা ইচ্ছায় ও তাঁর নির্দেশ ব্যতীত কোন অলৌকিক জিনিস দেখাতে পারতেন। সুতরাং এখানে লক্ষণীয় যে, ঈসা (আঃ)-এর প্রত্যেক মু’জিযার সাথে আল্লাহ চারবার بإذني (আমার অনুমতিক্রমে) বলেছেন। তার মানে প্রত্যেক মু’জিযা আল্লাহর নির্দেশেই ঘটে থাকে। এই কারণেই মক্কার মুশরিকরা যখন নবী করীম (সাঃ)-কে বিভিন্ন মু’জিযা দেখানোর কথা বলেছিল — যার বিস্তারিত বর্ণনা সূরা বানী ইসরাঈলের ১৭:৯০-৯৩ আয়াতে রয়েছে — তখন তাদের উত্তরে নবী করীম (সাঃ) বলেছিলেন, (سُبْحَانَ رَبِّيْ هَلْ كُنْتُ إِلاَّ بَشَرًا رَّسُوْلا) আমার প্রতিপালক অতি পবিত্র (অর্থাৎ তিনি তো এ দুর্বলতা থেকে পবিত্র যে, তিনি এ ধরনের জিনিস দেখাতে পারবেন না, তিনি তো তা দেখাতে সক্ষম। কিন্তু তাঁর হিকমত তা চায় কি না? অথবা কখন তা চাইবে –এ সবই জ্ঞান তাঁরই কাছে। আর তিনি সেই মোতাবেক ফায়সালা করেন।) কিন্তু আমি তো একজন মানুষ ও তাঁর রসূল ব্যতীত অন্য কিছু নই। অর্থাৎ, নিজে থেকে এ ধরনের মু’জিযা দেখানোর শক্তি আমার নেই। বলা বাহুল্য, নবীদের মু’জিযার সাথে যাদুর কোন সম্পর্ক নেই। যদি এমনটিই হত, তাহলে যাদুকররা তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হত। কিন্তু মূসা (আঃ)-এর ঘটনাবলী থেকে প্রমাণিত হয় যে, বড় বড় যাদুকররা একত্রিত হয়েও মূসা (আঃ)-এর মু’জিযার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হয়নি। আর যখন তাদের নিকট মু’জিযা ও যাদুর মধ্যে পার্থক্য প্রকট হয়, তখন তারা মুসলমান হয়ে যায়।
[৭] حَوَاريين বলা হয়, ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী শিষ্যগণকে; যাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করে তাঁর সহচর ও সাহায্যকারী হিসাবে ছিলেন। তাঁদের সংখ্যা ১২ জন বলা হয়ে থাকে। ‘অহী’ বলতে এখানে ঐ অহী নয়, যা ফিরিশতা মারফৎ নবীগণের প্রতি অবতীর্ণ হত। এখানে ‘অহী’ বলতে ইলহামকে বুঝায়; যা আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু লোকের অন্তরে প্রক্ষিপ্ত হয়। যেমন মূসা (আঃ)-এর মাতা ও মারয়্যাম (‘আলাইহাস্ সালাম)-কে এই ধরনের ইলহাম করা হয়েছিল, যাকে কুরআন ‘অহী’ বলে আখ্যায়ন করেছে। এখান থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, যাঁরা ‘অহী’ শব্দ দ্বারা এ কথার প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, মূসা (আঃ)-এর মাতা ও মারয়্যাম (আলাইহাস সালাম) নবী ছিলেন; কেননা তাঁদের প্রতিও আল্লাহ অহী করেছেন, তাঁদের কথা সঠিক নয়। কারণ সে ‘অহী’ ইলহামের অহীই ছিল; যেমন হাওয়ারীদের প্রতি কৃত ‘অহী’ রিসালতের অহী ছিল না।