أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٢٢٦)-৪২৮
www.motaher21.net
সুরা: আল-আনয়াম
১-৩ নং আয়াত:-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى….
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি….
All Praise is Due to Allah for….
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Verses :- 1-3
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمٰتِ وَالنُّورَ ۖ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমীন এবং সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো। তারপর কাফিররা তাদের রবের সমতুল্য স্থির করে।
আয়াত:-২
هُوَ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ طِیْنٍ ثُمَّ قَضٰۤى اَجَلًاؕ وَ اَجَلٌ مُّسَمًّى عِنْدَهٗ ثُمَّ اَنْتُمْ تَمْتَرُوْنَ
তিনিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তারপর তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন জীবনের একটি সময়সীমা এবং আর একটি সময়সীমাও আছে, যা তাঁর কাছে স্থিরীকৃত, কিন্তু তোমরা কেবল সন্দেহেই লিপ্ত রয়েছে।
আয়াত:-৩
وَ هُوَ اللّٰهُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ فِی الْاَرْضِؕ یَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَ جَهْرَكُمْ وَ یَعْلَمُ مَا تَكْسِبُوْنَ
তিনিই এক আল্লাহ আকাশেও আছেন এবং পৃথিবীতেও, তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব অবস্থান জানেন এবং ভালো বা মন্দ যা-ই তোমাদের উপার্জন করো তাও তিনি ভালোভাবেই অবগত।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(০৬-আনয়াম) : নামকরণ:
এ সূরার ১৬ ও ১৭ রুকূ’তে কোন কোন আন’আমের (গৃহপালিত পশু) হারাম হওয়া এবং কোন কোনটির হালাল হওয়া সম্পর্কিত আরববাসীদের কাল্পনিক ও কুসংস্কারমূলক ধারণা বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে এ সূরাকে আল আন’আম নামকরণ করা হয়েছে।
(০৬-আনয়াম) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
ইবনে আব্বাসের বর্ণনা মতে এ সম্পূর্ণ সূরাটি একই সাথে মক্কায় নাযিল হয়েছিল। হযরত মূআয ইবনে জাবালের চাচাত বোন হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ বলেন, “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটনীর পিঠে সওয়ার থাকা অবস্থায় এ সূরাটি নাযিল হতে থাকে। তখন আমি তাঁর উটনীর লাগাম ধরে ছিলাম। বোঝার ভারে উটনীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যেন মনে হচ্ছিল এই বুঝি তার হাড়গোড় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।” হাদীসে একথাও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, যে রাতে এ সূরাটি নাযিল হয় সে রাতেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিকে লিপিবদ্ধও করান।এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে সুস্পষ্টভাবে মনে হয়, এ সূরাটি মক্কী যুগের শেষের দিকে নাযিল হয়ে থাকবে। হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদের রেওয়ায়াতটিও একথার সত্যতা প্রমাণ করে। কারণ তিনি ছিলেন আনসারদের অন্তর্ভুক্ত। হিজরতের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। যদি ইসলাম গ্রহণ করার আগে তিনি নিছক ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে হয়ে থাকবেন তাঁর মক্কায় অবস্থানের শেষ বছরে। এর আগে ইয়াসরেববাসীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত বেশী ঘনিষ্ঠ হয়নি যার ফলে তাদের একটি মহিলা তাঁর খেদমতে হাযির হয়ে যেতে পারে।
(০৬-আনয়াম) : নাযিলের উপলক্ষ / প্রেক্ষাপট :
সূরাটির নাযিল হওয়ার সময়-কাল নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর আমরা সহজেই এর প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারি। আল্লাহর রসূল যখন মানুষকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবার কাজ শুরু করেছিলেন তারপর থেকে বারোটি বছর অতীত হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশদের প্রতিবন্ধকতা, জুলুম ও নির্যাতন চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। ইসলাম গ্রহণকারীদের একটি অংশ তাদের অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ত্যাগ করেছিল। তারা হাবশায় (ইথিওপিয়া) অবস্থান করছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্য-সমর্থন করার জন্য আবু তালিব বা হযরত খাদীজা (রা.) কেউই বেঁচে ছিলেন না। ফলে সব রকমের পার্থিব সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি কঠোর প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রচার ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তাঁর ইসলাম প্রচারের প্রভাবে মক্কায় ও চারপাশের গোত্রীয় উপজাতিদের মধ্য থেকে সৎ লোকেরা একের পর এক ইসলাম গ্রহণ করে চলছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমগ্র জাতি ইসলামের অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানের গোঁয়ার্তুমি অব্যাহত রেখেছিল। কোথাও কোন ব্যক্তি ইসলামের দিকে সামান্যতম ঝোঁক প্রকাশ করলেও তার পেছনে ধাওয়া করা হতো। তাকে তিরস্কার, গালিগালাজ করা হতো। শারীরিক দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক, সামাজিক নিপীড়নে তাকে জর্জরিত করা হতো। এ অন্ধকার বিভীষিকাময় পরিবেশে একমাত্র ইয়াসরেবের দিক থেকে একটি হালকা আশার আলো দেখা দিয়েছিল। সেখানকার আওস ও খাযরাজ গোত্রের প্রভাবশালী লোকেরা এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাই’আত করে গিয়েছিলেন। সেখানে কোন প্রকার আভ্যন্তরীণ বাধা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয়েই ইসলাম প্রসার লাভ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এ ছোট্ট একটি প্রারম্ভিক বিন্দুর মধ্যে ভবিষ্যতের যে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল তা কোন স্থুলদর্শীর দৃষ্টিগ্রাহ্য হওয়া সম্ভবপর ছিল না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হতো, ইসলাম একটি দুর্বল আন্দোলন। এর পেছনে কোন বৈষয়িক ও বস্তুগত শক্তি নেই। এর আহবায়কের পেছনে তাঁর পরিবারের ও বংশের দুর্বল ও ক্ষীণ সাহায্য-সমর্থন ছাড়া আর কিছুই নেই। মুষ্টিমেয় অসহায় ও বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিই ইসলাম গ্রহণ করেছে। যেন মনে হয় নিজেদের জাতির বিশ্বাস, মত ও পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা সমাজ থেকে এমনভাবে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে যেমন গাছের মরা পাতা মাটির ওপর ঝরে পড়ে।
(০৬-আনয়াম) : আলোচ্য বিষয়:
এহেন পটভূমিতে এ ভাষণটি নাযিল হয়। এ হিসেবে এখানে আলোচ্য বিষয়গুলোকে প্রধান সাতটি শিরোনামে ভাগ করা যেতে পারেঃ
একঃ শির্ককে খণ্ডন করা ও তাওহীদ বিশ্বাসের দিকে আহবান জানানো।
দুইঃ আখেরাত বিশ্বাসের প্রচার এবং এ দুনিয়ার জীবনটাই সবকিছু, এ ভুল চিন্তার অপনোদন।
তিনঃ জাহেলীয়াতের যে সমস্ত ভ্রান্ত কাল্পনিক বিশ্বাস ও কুসংস্কারে লোকেরা ডুবে ছিল তার প্রতিবাদ করা।
চারঃ যেসব বড় বড় নৈতিক বিধানের ভিত্তিতে ইসলাম তার সমাজ কাঠামো গড়ে তুলতে চায় সেগুলো শিক্ষা দেয়া।
পাঁচঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দাওয়াতের বিরুদ্ধে উত্থাপিত লোকদের বিভিন্ন আপত্তি ও প্রশ্নের জবাব।
ছয়ঃ সুদীর্ঘ প্রচেষ্টা ও সাধনা সত্ত্বেও দাওয়াত ফলপ্রসূ না হবার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যে অস্থিরতা ও হতাশাজনক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছিল সে জন্য তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়া।
সাতঃ অস্বীকারকারী ও বিরোধী পক্ষকে তাদের গাফলতি, বিহ্বলতা ও অজ্ঞানতা প্রসূত আত্মহত্যার কারণে উপদেশ দেয়া, ভয় দেখানো ও সতর্ক করা।কিন্তু এখানে যে ভাষণ দেয়া হয়েছে তাতে এক একটি শিরোনামের আওতায় আলাদা আলাদাভাবে একই জায়গায় পূর্ণাঙ্গরূপে আলোচনা করার রীতি অনুসৃত হয়নি। বরং ভাষণ এগিয়ে চলেছে নদীর স্রোতের মতো মুক্ত অবাধ বেগে আর তার মাঝখানে এ শিরোনামগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ভেসে উঠেছে এবং প্রতিবারেই নতুন নতুন ভংগীতে এর ওপর আলোচনা করা হয়েছে।
(০৬-আনয়াম) : মক্কী সুরা সমূহের পটভূমি:
এখানে পাঠকের সামনে সর্বপ্রথম একটি বিস্তারিত মক্কী সূরা আসছে। তাই এ প্রসংগে মক্কী সূরাগুলোর ঐতিহাসিক পটভূমির একটি পূর্ণাঙ্গ বিশদ আলোচনা করে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। এ ধরনের আলোচনার পরে পরবর্তী পর্যায়ে যেসব মক্কী সূরা আসবে এবং তাদের ব্যাখ্যা প্রসংগে আমি যেসব কথা বলবো সেগুলো অনুধাবন করা সহজ হবে। মাদানী সূরাগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোর নাযিলের সময়কাল আমাদের জানা আছে অথবা সামান্য চেষ্টা-পরিশ্রম করলে তার সময়-কাল চিহ্নিত করে নেয়া যেতে পারে। এমনকি সেসব সূরার বহু সংখ্যক আয়াতের পর্যন্ত নাযিলের উপলক্ষ্য ও কারণ নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতে পাওয়া যায়। কিন্তু মক্কী সূরাগুলো সম্পর্কে এতটা বিস্তারিত তথ্য–উপকরণ আমাদের কাছে নেই। খুব কম সংখ্যক সূরা এমন রয়েছে যার নাযিলের সময়কাল ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কিত নির্ভুল ও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত পাওয়া যায়। কারণ মাদানী যুগের তুলনায় মক্কী যুগের ইতিহাসে খুটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা কম। তাই মক্কী সূরাগুলোর ব্যাপারে আমাদের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণের পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূরার বিষয়বস্তু, আলোচ্য বিষয় ও বর্ণনা পদ্ধতি এবং প্রত্যেক সূরার নাযিলের পটভূমি সংক্রান্ত সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট ইশারা-ইঙ্গিতের আকারে যে আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে তার ওপরই নির্ভর করতে হয়। একথা সুস্পষ্ট যে, এ ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে প্রত্যেকটি সূরা ও আয়াত সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে অংগুলি নির্দেশ করে একথা বলা যেতে পারে না যে, এটি অমুক তারিখে অমুক বছর বা অমুক উপলক্ষ্যে নাযিল হয়েছে। সর্বাধিক নির্ভুলভাবে বড় জোর এতটুকু বলা যেতে পারে যে, একদিকে আমরা মক্কী সূরাগুলোর ভেতরের সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের ইতিহাস পাশাপাশি রেখে এবং উভয়ের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে কোন্ সূরা কোন্ পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত ছিল সে সম্পর্কে একটি মত গঠন করতে পারি। গবেষণা ও অনুসন্ধানের এ পদ্ধতি অনুসরণ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা ইলামী দাওয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে একে চারটি প্রধান প্রধান ও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে বিভক্ত দেখতে পাইঃ প্রথম পর্যায়ঃ নবুওয়াত প্রাপ্তির সূচনা থেকে শুরু করে নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণা পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এ সময় গোপনে দাওয়াত দেবার কাজ চলে। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়। মক্কার সাধারণ লোকেরা এ সম্পর্কে তখনো কিছুই জানতো না। দ্বিতীয় পর্যায়ঃ নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণার পর থেকে জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন ও উৎপীড়নের সূচনাকাল পর্যন্ত প্রায় দু’বছর। এ সময় প্রথমে বিরোধিতা শুরু হয়। তারপর তা প্রতিরোধের রূপ নেয়। এরপর ঠাট্টা, বিদ্রুপ, উপহাস, দোষারোপ, গালিগালাজ, মিথ্যা প্রচারণা এবং জোটবদ্ধভাবে বিরোধিতা করার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমনকি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়ে যায়। যারা তুলনামূলকভাবে বেশী গরীব, দুর্বল ও আত্মীয় বান্ধবহীন ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে তারাই হয় সর্বাধিক নির্যাতনের শিকার।তৃতীয় পর্যায়ঃ চরম উৎপীড়নের সূচনা অর্থাৎ নবুওয়াতের ৫ম বছর থেকে নিয়ে আবু তালিব ও হযরত খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ইন্তিকাল তথা ১০ম বছর পর্যন্ত পাঁচ বছর সময়-কাল পর্যন্ত এ পর্যায়টি বিস্তৃত। এ সময়ে বিরোধীতা চরম আকার ধারণ করতে থাকে। মক্কার কাফেরদের জুলুম-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক মুসলমান আবিসিনিয়া হিজরত করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও অবশিষ্ট মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কট করা হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সমর্থক ও সংগী-সাথীদের নিয়ে আবু তালিব গিরিবর্তে অবরুদ্ধ হন। চতুর্থ পর্যায়ঃ নবুওয়াতের দশম বছর থেকে ত্রয়োদশ বছর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এটি ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাথীদের জন্য সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক সময়। তাঁর জন্য মক্কায় জীবন যাপন করা কঠিন করে দেয়া হয়েছিল। তায়েফে গেলেন। সেখানেও আশ্রয় পেলেন না। হজ্বের সময়ে আরবের প্রতিটি গোত্রকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ ও তাঁকে সাহায্য করার আবেদন জানালেন। কিন্তু কোথাও সাড়া পেলেন না। এদিকে মক্কাবাসীরা তাঁকে হত্যা করার, বন্দী করার বা নগর থেকে বিতাড়িত করার জন্য সলা-পরামর্শ করেই চলছিল। অবশেষে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আনসারদের হৃদয় দুয়ার ইসলামের জন্য খুলে গেলো। তাদের আহবানে তিনি মদীনায় হিজরত করলেন। এ সকল পর্যায়ে বিভিন্ন সময় কুরআন মজীদের যে সমস্ত আয়াত নাযিল হয় সেগুলোর প্রত্যেকটি তাদের বিষয়বস্তু ও বর্ণনা রীতির দিক দিয়ে পরস্পর থেকে বিভিন্ন। এক পর্যায়ের আয়াতের বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভংগী অন্য পর্যায়ের আয়াতের থেকে ভিন্নধর্মী। এদের বহু স্থানে এমন সব ইশারা-ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা থেকে তাদের পটভূমির অবস্থা ও ঘটনাবলীর ওপর সুস্পষ্ট আলোকপাত হয়। প্রত্যেক পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যের প্রভাব সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে নাযিলকৃত বাণীর মধ্যে বিপুলভাবে লক্ষণীয়। এসব আলামতের ওপর নির্ভর করে আমি পরবর্তী পর্যায়ে আলোচিত প্রত্যেকটি মক্কী সূরার ভূমিকায় সেটি মক্কী যুগের কোন পর্যায়ে নাযিল হয় তা জানিয়ে দেবো।
টিকা:১) মনে রাখতে হবে, এখানে আরবের মুশরিকদের সম্বোধন করে বলা হচ্ছে। আর এ মুশরিকরা একথা স্বীকার করতো যে, আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা। তিনি দিন ও রাতের উদ্ভব ঘটান। সূর্য ও চন্দ্রকে তিনিই অস্তিত্ব দান করেছেন। এ কাজগুলো লাত, উয্যা হোবল অথবা আর কোন দেবদেবী করেছে-এ ধরনের কোন বিশ্বাস তাদের কেউ পোষন করতো না। তাই তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছেঃ মুর্খরা! যখন তোমরা নিজেরাই একথা স্বীকার করে থাকো যে, পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা হচ্ছেন আল্লাহ এবং দিন-রাতের আবর্তন তিনিই করান তখন তোমরা আবার অন্যের সামনে সিজদা করো কেন? তাদেরকে নযরানা দাও, তাদের কাছে প্রার্থনা করো এবং নিজেদের অভাব-অভিযোগ পেশ করো কেন? এরা কারা? ( সূরা আল বাকারা ১৬৩ টীকা দেখুন)। আলোর মোকাবিলায় ‘অন্ধকার’ শব্দটিকে বহুবচনে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। কারণ, অন্ধকার বলা হয় আলোবিহীনতাকে আর আলোবিহীনতার রয়েছে অসংখ্য পর্যায়। তাই আলো এক বা একক এবং অন্ধকার একাধিক, বহু।
টিকা:২) মানব দেহের সমুদয় অংশ মাটি থেকে গৃহীত। এর সামান্যতম অংশও অ-মৃত্তিকা নয়। তাই বলা হয়েছে, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।
টিকা:৩) অর্থাৎ কিয়ামতের সময়। তখন আগের ও পরের সমস্ত মানুষকে আবার নতুন করে জীবিত করা হবে এবং নিজেদের সমস্ত কাজের হিসেব দেবার জন্য তারা তাদের রবের সামনে হাযির হয়ে যাবে।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
6. Al-An’aam
Verses:- 1-3
All Praise is Due to Allah for His Glorious Ability and Great Power
Allah praises Himself;
الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالَارْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ
All praise be to Allah, Who created the heavens and the earth, and originated the darkness and the light,
Allah praises and glorifies His Most Honorable Self for creating the heavens and earth, as a dwelling for His servants, and for making the darkness and the light to benefit them in the night and the day.
In this Ayah, Allah describes darkness in the plural, Zulumat (where Zulmah is singular for darkness), while describing the light in the singular, An-Nur, because An-Nur is more honored.
In other Ayat, Allah said,
ظِلَـلُهُ عَنِ الْيَمِينِ
To the right and to the lefts. (16:48)
Near the end of this Surah, Allah also said;
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ
And verily, this is my straight path, so follow it, and follow no (other) ways, for they will separate you away from His way. (6:153)
Allah said next,
ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ بِرَبِّهِم يَعْدِلُونَ
Yet those who disbelieve hold others as equal with their Lord.
meaning, in spite of all this, some of Allah’s servants disbelieve in Him and hold others as partners and rivals with Him. Some of Allah’s servants claimed a wife and a son for Allah, hallowed be He far above what they attribute to Him.
Allah’s statement
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن طِينٍ
He it is Who has created you from clay,
refers to the father of mankind, Adam, from whom mankind originated, multiplied in numbers and spread about, east and west.
Allah said,
ثُمَّ قَضَى أَجَلً وَأَجَلٌ مُّسمًّى عِندَهُ
Then has decreed a stated term. And there is with Him another determined term…
His saying;
ثُمَّ قَضَى أَجَلً
(Then has decreed a stated term),
refers to death,
while,
وَأَجَلٌ مُّسمًّى عِندَهُ
(And there is with Him another determined term…),
refers to the Hereafter,
according to Sa`id bin Jubayr who reported this from Ibn Abbas.
Similar statements were narrated from Mujahid, Ikrimah, Sa`id bin Jubayr, Al-Hasan, Qatadah, Ad-Dahhak, Zayd bin Aslam, Atiyah, As-Suddi, Muqatil bin Hayyan and others.
Ibn Abbas and Mujahid said that,
ثُمَّ قَضَى أَجَلً
(And then has decreed a stated term),
is the term of this earthly life,
while,
وَأَجَلٌ مُّسمًّى عِندَهُ
(And there is with Him another determined term),
refers to man’s extent of life until he dies as mentioned in Allah’s statement;
وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُم بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُم بِالنَّهَارِ
It is He, Who takes your souls by night (when you are asleep), and has knowledge of all that you have done by day, then He raises (wakes) you up again that a term appointed (life) be fulfilled. (6:60)
The meaning of Allah’s statement,
عِندَهُ
(With Him), is that;
none but Him knows when it will occur.
Allah said in other Ayat,
إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَأ إِلاَّ هُوَ
The knowledge thereof is with my Lord. None can reveal its time but He. (7:187)
and,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَـهَا
فِيمَ أَنتَ مِن ذِكْرَاهَا
إِلَى رَبِّكَ مُنتَهَـهَأ
They ask you about the Hour — when will be its appointed time! You have no knowledge to say anything about it. To your Lord belongs (the knowledge of) the term thereof. (79:42-44)
Allah said,
ثُمَّ أَنتُمْ تَمْتَرُونَ
Yet you doubt.
According to As-Suddi,
the coming of the (last) Hour.
Allah said next,
وَهُوَ اللّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الَارْضِ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ
And He is Allah in the heavens and the earth, He knows what you conceal and what you reveal, and He knows what you earn.
Meaning, it is He Who is called Allah, throughout the heavens and the earth, that is, it is He who is worshipped, singled out, whose divinity is believed in by the inhabitants of the heavens and the earth. They call Him Allah, and they supplicate to Him in fear and hope, except those who disbelieve among the Jinns and mankind.
In another Ayah, Allah said;
وَهُوَ الَّذِى فِى السَّمأءِ إِلَـهٌ وَفِى الاٌّرْضِ إِلَـهٌ
It is He Who is God in the heavens and the earth. (43:84)
meaning, He is the God of those in heaven and those on earth, and He knows all affairs, public and secret.
وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ
And He knows what you earn.
all the good and bad deeds that you perform.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
সূরায়ে আন’আম মক্কায় এক রাতের মধ্যেই সম্পূর্ণটা একই সাথে অবতীর্ণ হয়। সত্তর হাজার ফেরেশতা এই সূরাটি নিয়ে হাজির হন এবং তাসবীহ পাঠ করতে থাকেন। হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেনঃ নবী (সঃ) উষ্ট্রীর উপর সওয়ার ছিলেন। এমতাবস্থায় সূরায়ে আন’আম অবতীর্ণ হচ্ছিল। আমি তাঁর উষ্ট্ৰীটির লাগাম ধরে রেখেছিলাম। অহীর ভারে উষ্ট্রীটির পিঠ এমনভাবে কুঁজো হয়ে যাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল যেন ওর পিঠের হাড় ভেঙ্গে যাবে। ফেরেশতাগণ আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টন করে রেখেছিলেন। সূরায়ে আনআম অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাসবীহ পড়তে শুরু করেন এবং বলেনঃ “এই সূরার অনুসরণে ফেরেশতাগণ দিগন্ত পর্যন্ত পরিবেষ্টন করে রেখেছিলেন। তাঁদের (আরবী) -এই তাসবীহের গুঞ্জনে আসমান ও যমীন মুখরিত ছিল।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেও এই তাসবীহ পাঠ করছিলেন। তিনি বলেনঃ “সূরায়ে আনআম একবারেই অবতীর্ণ হয়েছে এবং এটা সত্তর হাজার ফেরেশতার তাসবীহ ও তাহমীদের গুঞ্জনের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে।”
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র সত্তার প্রশংসা করছেন যে, তিনিই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। যেন তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে প্রশংসা করার কথা শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি দিনে আলোককে এবং রাত্রে অন্ধকারকে তাঁর বান্দাদের জন্যে একটা উপকারী বস্তু বলে ঘোষণা দিচ্ছেন। এখানে (আরবী) শব্দটিকে একবচন এবং (আরবী) শব্দটিকে বহুবচনরূপে ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা, উৎকৃষ্ট জিনিসকে একবচন রূপেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলার উক্তি রয়েছেঃ (আরবী) এবং (আরবী) এখানে (আরবী) শব্দকে একবচন এবং (আরবী) শব্দকে বহুবচন আনা হয়েছে। আর নিজের রাস্তাকে (আরবী) বলে একবচন এনেছেন এবং ভুল রাস্তাগুলোকে (আরবী) বলে বহুবচন এনেছেন। মোটকথা, যদিও আল্লাহর কতকগুলো বান্দা কুফরীতে লিপ্ত হয়ে তার শরীক স্থাপন করেছে এবং তাঁর স্ত্রী ও সন্তান সাব্যস্ত করেছে (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক),তথাপি তিনি এ সবকিছু হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র।
(আরবী) -তিনি সেই প্রভু যিনি তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ তোমাদের পিতা হযরত আদম (আঃ)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং মাটিই তার গোশত ও চামড়ার আকার ধারণ করেছিল। অতঃপর তাঁরই মাধ্যমে মানবকে সৃষ্টি করে পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর হযরত আদম (আঃ) পূর্ণ শক্তি প্রাপ্ত হন এবং তাঁর মৃত্যুর নির্ধারিত সময়ে পৌছে যান। হযরত হাসান (রঃ)-এর মতে প্রথম (আরবী)। শব্দ দ্বারা মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সময় বুঝানো হয়েছে। আর দ্বিতীয় (আরবী) শব্দ দ্বারা মৃত্যুর পরে পুনর্জীবন পর্যন্ত সময়কে বুঝানো হয়েছে। (আরবী) হচ্ছে মানুষের চলন্ত বয়স এবং (আরবী) হচ্ছে সারা দুনিয়ার বয়স অর্থাৎ দুনিয়া লয়প্রাপ্ত হওয়া থেকে নিয়ে দারে আখিরাতের সময় আসা পর্যন্ত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, প্রথম (আরবী) দ্বারা দুনিয়ার সময়কাল এবং (আরবী) দ্বারা মানুষের জীবন হতে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে বুঝানো হয়েছে। এটা যেন আল্লাহ তা’আলার নিম্নের উক্তি হতেই গ্রহণ করা হয়েছেঃ
(আরবী) অর্থাৎ “তিনি রাত্রিকালে তোমাদেরকে মেরে ফেলেন। এবং দিবা ভাগে তোমরা যা কিছু কর তা তিনি সম্যক অবগত। আর রাত্রিকালে তো তোমরা কিছুই করতে পার না।” (৬:৬০) অর্থাৎ তোমরা সে সময় নিদ্রিত অবস্থায় থাক এবং সেটা হচ্ছে আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার রূপ। তারপরে তোমরা জেগে ওঠ, তখন যেন তোমরা তোমাদের সঙ্গী সাথীদের কাছে ফিরে আস। আর তাঁর (আরবী) -এই উক্তির অর্থ এই যে, ঐ সময়টা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। যেমন তিনি অন্য এক জায়গায় বলেছেনঃ “ওর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই কাছে। ওর সময় আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না।” অনুরূপভাবে আল্লাহ পাকের উক্তি “হে নবী (সঃ)! লোকেরা তোমাকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে যে, ওটা কখন সংঘটিত হবে? তাহলে তোমার ঐ সম্পর্কে কি জ্ঞান আছে? এ জ্ঞানতো একমাত্র আল্লাহরই রয়েছে” -এই উক্তির অর্থ এটাই। তারপর ওর নীচের আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “আকাশসমূহ ও পৃথিবীর আল্লাহ তিনিই, তিনি তোমাদের প্রকাশ্য কথা সম্পর্কেও জ্ঞান রাখেন এবং গোপন কথা সম্পর্কেও তার পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে, আর তোমরা যা কিছু করছো সেটাও তিনি সম্যক অবগত।” এই আয়াতের তাফসীরকারকগণ প্রথমে জাহমিয়া সম্প্রদায়ের উক্তির অস্বীকৃতির উপর একমত হয়েছেন। অতঃপর তাঁদের পরস্পরের মধ্যেও কিছুটা মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। জাহমিয়াদের উক্তি এই যে, এই আয়াত এই অর্থ বহন করছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জায়গাতেই স্বয়ং বিদ্যমান রয়েছেন। অর্থাৎ এই আকীদায় এই কথা গ্রহণ করা হচ্ছে যে, আল্লাহ পাক প্রত্যেক জিনেসের মধ্যে স্বয়ং বিদ্যমান রয়েছেন। সঠিক উক্তি এই যে, আসমান ও যমীনে একমাত্র আল্লাহকেই মান্য করা হয় এবং তাঁরই ইবাদত করা হয়। আকাশে যেসব ফেরেশতা রয়েছে ও যমীনে যেসব মানুষ রয়েছে সবাই তাঁকে মা’বুদ বলে স্বীকার করছে। তাঁকে তারা ‘আল্লাহ’ বলে ডাকতে রয়েছে। কিন্তু জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা কাফির তারা তাঁকে ভয় করে না। আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেছেনঃ “তিনিই আকাশসমহেরও আল্লাহ এবং যমীনেরও আল্লাহ।’ এই উক্তিরও ভাবার্থ এটাই যে, আসমানে যত কিছু রয়েছে এবং যমীনে যত কিছু রয়েছে সবারই তিনি আল্লাহ। অর্থ এটা নয় যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে ওগুলোই আল্লাহ। এর উপর ভিত্তি করেই নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তিনি তোমাদের গোপন কথাও জানেন এবং প্রকাশ্য কথাও জানেন।
দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে-আল্লাহ তিনিই যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত প্রকাশ্য ও গোপনীয় কথা জানেন এবং এটা তার (আরবী) -এই উক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর অন্তর্নিহিত অর্থ এটাই হচ্ছে যে, তিনিই আল্লাহ যিনি আকাশসমূহে. ও পৃথিবীতে তোমাদের সমস্ত কথা জানেন এবং তোমরা যা কিছু কর ওর সংবাদ তিনি রাখেন।
তৃতীয় উক্তি এই যে, (আরবী) -এটা বা (আরবী) পূর্ণ বিরতি। এর পরে পুনরায় (আরবী)-এর সূচনা হচ্ছে। অর্থাৎ (আরবী) হচ্ছে (আরবী) এবং (আরবী) হচ্ছে আর ইবনে জারীর (রঃ)-এর মত এটাই।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
সূরা সংক্রান্ত আলোচনাঃ
আয়াত সংখ্যাঃ ১৬৫ ৷
নামকরণঃ এ সূরারই ১৩৬, ১৩৯ ও ১৪২ নং আয়াতসমূহে উল্লেখিত “আল-আন’আম” শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আল-আন’আম শব্দের অর্থঃ গবাদি পশু।
সূরা নাযিলের প্রেক্ষাপটঃ
এ সূরা মক্কী সূরা বলেই প্রসিদ্ধ। কুরআনের ধারাবাহিকতা অনুসারে এটাই প্রথম মক্কী সূরা। এ সূরার মৌলিক আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত। মুফাসসিরগণের মধ্যে মুজাহিদ, কালবী, কাতাদাহ প্রমূখও প্রায় এ কথাই বলেন। আবু ইসহাক ইসফিরায়িনী বলেন, এ সূরাটিতে তাওহীদের সমস্ত মূলনীতি ও পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। [কুরতুবী, আত-তাফসীরুল মুনীর]
সূরার ফযিলতঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ সূরা আল-আন’আমের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, কয়েকখানি আয়াত বাদে গোটা সূরাটিই একযোগে মক্কায় নাযিল হয়েছে। জাবের, ইবন আব্বাস, আনাস ও ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সূরা আল-আন’আম নাযিল হচ্ছিল, তখন এত ফিরিশ্তা তার সাথে অবতরণ করেছিলেন যে, তাতে আকাশের প্রান্তদেশ ছেয়ে যায়। [ মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৭০; ২৪৩১]
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সূরা আল-আন’আম কুরআনের উৎকৃষ্ট অংশের অন্তর্গত। [সুনান দারমী ২/৫৪৫; ৩৪০১]
——————-
[১] এ সূরাটিকে ” (اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ) বাক্য দ্বারা আরম্ভ করা হয়েছে। এতে খবর দেয়া হয়েছে যে, সর্ববিধ প্রশংসা আল্লাহর জন্য। এ খবরের উদ্দেশ্য মানুষকে প্রশংসা শিক্ষা দেয়া। যেন বলা হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা তাঁর জন্যই যাবতীয় হামদ ও শোকর নির্দিষ্ট কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, আরও সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমীন। তাঁর সাথে কাউকেও সামান্যতম অংশীদারও করবে না। এ বিশেষ পদ্ধতি শিক্ষাদানের মধ্যে এদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পরিপূর্ণ হামদ বা প্রশংসা একমাত্র তাঁরই, যার কোন শরীক নেই। তাকে ব্যতীত আর যে সমস্ত উপাস্যের ইবাদাত করা হয়, তারা এ হামদ প্রাপ্য নয়। [তাবারী] সুতরাং কেউ প্রশংসা করুক বা না করুক, তিনি স্বীয় ওজুদ বা সত্তার পরাকাষ্ঠার দিক দিয়ে নিজেই প্রশংসনীয়। এ বাক্যের পর আসমান ও যমীন এবং অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ করে তার প্রশংসনীয় হওয়ার প্রমাণও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, যে সত্তা এহেন মহান শক্তি-সামর্থ্য ও বিজ্ঞবান, তিনিই হামদ বা প্রশংসার যোগ্য হতে পারেন। কাতাদা বলেন, এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা’আলা আসমানকে যমীনের পূর্বে, অন্ধকারকে আলোর পূর্বে এবং জান্নাতকে জাহান্নামের পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। [তাবারী]
[২] এ আয়াতে (سماوات) শব্দটিকে বহুবচনে এবং (ارض) শব্দটিকে একবচনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও অন্য এক আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আসমানের ন্যায় যমীনও সাতটি। [যেমন, সূরা আত-তালাক: ১২] এমনিভাবে (ظلمات) শব্দটিকে বহুবচনে এবং (نور) শব্দটিকে একবচনে উল্লেখ করার মাঝে ইঙ্গিত রয়েছে যে, (نور) বলে বিশুদ্ধ সরল পথ ব্যক্ত করা হয়েছে এবং তা মাত্র একটিই। আর (ظلمات) বলে ভ্রান্ত পথ ব্যক্ত করা হয়েছে, যা অসংখ্য। তাছাড়া (نور) বা আলো (ظلمات) বা অন্ধকার থেকে উত্তম [বাহরে মুহীত; ইবন কাসীর]
[৩] আলোচ্য আয়াতের উদ্দেশ্য একত্ববাদের স্বরূপ ও সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্ণনা করে জগতের ঐসব জাতিকে হুশিয়ার করা যারা মূলতঃ একত্ববাদে বিশ্বাসী নয় কিংবা বিশ্বাসী হওয়া সত্বেও একত্ববাদের তাৎপর্যকে পরিত্যাগ করে বসেছে। অগ্নি উপাসকদের মতে জগতের স্রষ্টা দু’জন – ইয়াৰ্যদান ও আহরামান। তারা ইয়াৰ্যদানকে মঙ্গলের স্রষ্টা এবং আহরামানকে অমঙ্গলের স্রষ্টা বলে বিশ্বাস করে। এ দুটিকেই তারা অন্ধকার ও আলো বলে ব্যক্ত করে। এমনিভাবে নাসারারা একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়ার সাথে সাথে ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর মাতা মারইয়াম আলাইহাস সালাম-কে আল্লাহ তা’আলার অংশীদার সাব্যস্ত করেছে। এরপর একত্ববাদের বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা ‘একে তিন’ এবং ‘তিনে এক’ এর অযৌক্তিক মতবাদের আশ্রয় নিয়েছে। আরবের মুশরিকরা প্রতিটি পাহাড়ের প্রতিটি বড় পাথরকেও তাদের উপাস্য বানিয়েছে। [আল-মানার] মোটকথা, যে মানবকে আল্লাহ্ তা’আলা আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা করেছিলেন, তারা যখন পথভ্রষ্ট হল, তখন চন্দ্র, সূর্য, তারকারাজি, আকাশ, পানি, বৃক্ষলতা এমনকি পোকা-মাকড়কেও সিজদার যোগ্য উপাস্য, রুযীদাতা ও বিপদ বিদূরণকারী সাব্যস্ত করে নিল। কুরআনুল কারীমের আলোচ্য আয়াত আল্লাহ তা’আলাকে যমীন ও আসমানের স্রষ্টা এবং অন্ধকার ও আলোর উদ্ভাবক বলে উপরোক্ত সব ভ্রান্ত বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করেছে। কেননা, অন্ধকার ও আলো, আসমান ও যমীন এবং এতে উৎপন্ন যাবতীয় বস্তু আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্ট। অতএব, এগুলোকে কেমন করে আল্লাহ্ তা’আলার অংশীদার করা যায়? যিনি সৃষ্টি করেন তিনি কি যারা সৃষ্টি করতে পারে না তাদের মত? সুতরাং কিভাবে ইবাদাতে ও সম্মানে তাঁর সমকক্ষ কাউকে দাঁড় করানো যায়? [ ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর]।
[৪] প্রথম আয়াতে বৃহৎ জগত অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের বৃহত্তম বস্তুগুলোকে আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্ট ও মুখাপেক্ষী বলে মানুষকে নির্ভুল একত্ববাদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অতঃপর দ্বিতীয় আয়াতে মানুষকে বলা হয়েছে যে, তোমার অস্তিত্ব স্বয়ং একটি ক্ষুদ্র জগৎবিশেষ। যদি এরই সূচনা, পরিণতি ও বাসস্থানের প্রতি লক্ষ্য করা হয়, তবে একত্ববাদ একটা বাস্তব সত্য হয়ে সামনে ফুটে উঠবে। আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহই সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃজন করেছেন ” আল্লাহ্ তা’আলা আদম আলাইহিস সালাম-কে একটি বিশেষ পরিমাণ মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। [ইবন কাসীর] সমগ্র পৃথিবীর অংশ এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ কারণেই আদম-সন্তানরা বর্ণ, আকার, চরিত্র ও অভ্যাসে বিভিন্ন। কেউ কৃষ্ণবর্ণ, কেউ শ্বেতবর্ণ, কেউ লালবর্ণ, কেউ কঠোর, কেউ নম্র, কেউ পবিত্র-স্বভাব বিশিষ্ট এবং কেউ অপবিত্র স্বভাবের হয়ে থাকে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা আদমকে এমন এক মুষ্টি মাটি থেকে তৈরী করেছেন যে মুষ্টি সমস্ত মাটি থেকে নেয়া হয়েছে। তাই আদম সন্তান মাটির মতই হয়েছে। তাদের মধ্যে লাল, সাদা, কালো, আবার এর মাঝামাঝি রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ নম্র, কেউ চিন্তাগ্রস্ত, কেউ মন্দ, কেউ ভাল, কেউ এর মাঝামাঝি পর্যায়ের রয়েছে।’ [আবুদাউদ: ৪৬৯৩]
[২] পূর্বে আদমসন্তানদের সৃষ্টির সূচনা বর্ণনা করা হয়েছে। এখন এর পরিণতির দুটি মঞ্জিল উল্লেখ করা হয়েছে। একটি মানবের ব্যক্তিগত পরিণতি, যাকে মৃত্যু বলা হয়। অপরটি সমগ্র মানবগোষ্ঠীর ও তার উপকারে নিয়োজিত সৃষ্টিজগত- সবার সামষ্টিক পরিণতি, যাকে কেয়ামত বলা হয়। প্রথমটির ব্যাপারে বলেছেন, (ثُمَّ قَضٰى اَجَلًا) অর্থাৎ মানব সৃষ্টির পর আল্লাহ্ তা’আলা তার স্থায়িত্ব ও আয়ূস্কালের জন্য একটি মেয়াদ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ মেয়াদের শেষ প্রান্তে পৌছার নাম মৃত্যু। এ মেয়াদ মানবের জানা না থাকলেও এর প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষ অবগত। কেননা, সে সর্বদা, সর্বত্র আশ-পাশের আদম-সন্তানদেরকে মারা যেতে দেখে। এরপর সমগ্র বিশ্বের পরিণতি অর্থাৎ কেয়ামতের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “আরো একটি মেয়াদ নির্দিষ্ট আছে, যা একমাত্র তাঁর কাছেই” অর্থাৎ আল্লাহই জানেন, এ মেয়াদের পূর্ণ জ্ঞান ফিরিশতাদের নেই এবং মানুষেরও নেই। সারকথা এই যে, প্রথম আয়াতে বৃহৎ জগত অর্থাৎ গোটা বিশ্বের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তা আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক সৃষ্ট ও নির্মিত। দ্বিতীয় আয়াতে এমনিভাবে ক্ষুদ্র জগৎ অর্থাৎ মানুষ যে আল্লাহর সৃষ্টজীব, তা বর্ণিত হয়েছে। এরপর মানুষকে শৈথিল থেকে জাগ্রত করার জন্য বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের একটি বিশেষ আইয়ূষ্কাল রয়েছে, যার পর তার মৃত্যু অবধারিত। প্রতিটি মানুষ এ বিষয়টি সর্বক্ষণ নিজের আশ-পাশে প্রত্যক্ষ করে। এটা যেহেতু সত্য, সেহেতু এরপরও আরেকটি সময় তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। যার ঘোষণা আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকতে পারে না। [ইবন কাসীর, সাদী, আল-মুনীর, ফাতহুল কাদীর, আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর] এ কারণে আয়াতের শেষভাগে কিয়ামতের উপযুক্ততা প্রকাশার্থে বলা হয়েছে
(ثُمَّ اَنْتُمْ تَمْتَرُوْنَ)
অর্থাৎ এহেন সুস্পষ্ট যুক্তি-প্রমাণ সত্বেও তোমরা কেয়ামত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ কর! এটা অনুচিত।
[৫] এ আয়াতের অনুবাদে কোন প্রকার ভুল বুঝার অবকাশ নেই। মহান আল্লাহ তাঁর আরশের উপরই রয়েছেন। আসমান ও যমীনের সর্বত্রই তাঁর দৃষ্টি, জ্ঞান ও ক্ষমতা রয়েছে। তিনি সর্বত্রই মা’বুদ। আয়াতের এক অর্থ এটাই। কোন কোন মুফাসসির অর্থ করেছেন, তিনিই আল্লাহ যিনি আসমান ও যমীনের যত গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু জানেন। আবার কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, এখানে আসমান বলে উর্ধ্বজগত বোঝানো হয়েছে। সেটা আরশও হতে পারে। সুতরাং আয়াতের অনুবাদ হবে, তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানে তথা আরশের উপর রয়েছেন, সেখানে থাকলেও যমীনের যত গোপন ও প্রকাশ্য বিষয়াদি রয়েছে সব কিছু জানেন। [তাবারী, বাগভী, কুরতুবী, ইবন কাসীর, ফাতহুল কাদীর]
[৬] এ আয়াতে প্রথম দু’আয়াতে বর্ণিত বিষয়বস্তুর ফলাফল বর্ণিত হয়েছে। তা এই যে, আল্লাহ তা’আলাই এমন এক সত্তা, যিনি আসমান ও যমীনে ইবাদাত ও আনুগত্যের যোগ্য এবং তিনিই তোমাদের প্রতিটি প্রকাশ্য ও গোপন অবস্থা এবং প্রতিটি উক্তি ও কর্ম সম্পর্কে পুরোপুরি পরিজ্ঞাত। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারও ইবাদাত করো না। তিনি যেহেতু তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবই জানেন সুতরাং তাঁর নাফরমানী করা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করো এবং এমন কাজ করবে, যা তোমাদেরকে তাঁর নৈকট্য প্রদান করবে, তাঁর রহমতের অধিকারী করবে। এমন কোন কাজ করো না, যাতে তার নৈকট্য থেকে দূরে সরে যাও। [সা’দী]
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
নামকরণ, অবতরণের স্থান ও প্রেক্ষাপট:
আন্‘আম শব্দের শাব্দিক অর্থ হল: গৃহপালিত পশু। অত্র সূরার ১৩৬, ১৩৮, ১৪২ নং আয়াতে (الأنعام) আল-আন্‘আম শব্দটি উল্লেখ রয়েছে বিধায় উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া এ সূরাতে গৃহপালিত পশু সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কারণ মক্কার মুশরিকরা কিছু পশু আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্ধারণ করত, কিছু নিজেদের জন্য হারাম করে নিত, আবার কিছু পশু নিজেদের নারী-পুরুষের মাঝে ব্যবধান করতঃ হারাম করে নিত।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সূরা আন্‘আম মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। (সনদ সহীহ, ইবনে কাসীর, ৩/২৭২)
আল্লামা সা‘লাবী (রহঃ) বলেন: সূরা আন্‘আম মক্কায় অবতীর্ণ হয়। তবে ছয়টি আয়াত মদীনায় অবতীর্ণ হয়। তা হল
(وَمَا قَدَرُوا اللّٰهَ حَقَّ قَدْرِه۪)
-সহ পরের দু’টি আয়াত এবং
(قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ) আয়াত সহ পরের দু’টি আয়াত। অর্থাৎ ৯১-৯৩ নং আয়াত ও ১৫১-১৫৩ নং আয়াত।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) ইবনু আব্বাস ও কাতাদাহ (রহঃ) থেকে একটি বর্ণনা নিয়ে এসেছেন তাতে তাঁরা বলেন: দু’টি আয়াত ব্যতীত সম্পূর্ণ সূরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। সে দু’টি আয়াত হল ৯১ ও ১৪১ নং। (ফাতহুল কাদীর, ২/১২৬)
এ সূরা অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট ও ফযীলত সম্পর্কে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় সকল বর্ণনাই দুর্বল। (ফাতহুল কাদীর, ২/১২৬) তবে ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, তিনি বলেন: আরবের অশিক্ষিত লোকেদের শিক্ষা দিতে যদি তুমি আনন্দ পাও তাহলে সূরা আন্‘আমের ১৩০ নং আয়াতের পরের আয়াতগুলো পড়। (সহীহ বুখারী হা: ৩৫২৪)
অত্র সূরার শুরুতে তাওহীদ, আল্লাহ তা‘আলার মর্যাদা, মাঝে ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রকৃত মা‘বূদ চেনার ঐতিহাসিক ঘটনা, হালাল-হারামের বিধান এবং শেষ দিকে মক্কার মুশরিকদের শির্কের ধরণ ও পদ্ধতি আর যেসব প্রাণী হারাম করা হয়েছে তা-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলী অত্র সূরায় স্থান পেয়েছে।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা সূরাটি শুরু করেছেন দু’ প্রকার তাওহীদ দ্বারা। প্রথমেই নিজের প্রশংসা করলেন যা তাওহীদে উলুহিয়্যাহ, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল সর্বাধিক প্রশংসার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। মানুষ একমাত্র তাঁর প্রশংসা করবে, কেননা প্রশংসা করা একটি ইবাদত। তবে ভাল ও সৎ কাজে মানুষেরও প্রশংসা করা যায়। সৎ কাজ ও একে অন্যের প্রতি দয়াদ্রতার জন্য মানুষের প্রশংসা করা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসার পরিপন্থী নয়। কারণ হাদীসে এসেছে:
مَنْ لَمْ يَشْكُرِ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرِ اللّٰهَ
“যে মানুষের প্রশংসা করল না সে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করল না।”(নাসায়ী হা: ১৯৫৫, সহীহ) কেননা ভাল কাজে মানুষের প্রশংসা করা মূলত আল্লাহ তা‘আলারই প্রশংসা করা। এতে আরো ইঙ্গিত রয়েছে: মানুষ আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করুক আর নাই করুক আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্বত্ত্বা ও গুণে প্রশংসনীয়। মানুষ তাঁর প্রশংসা করলে মর্যাদা বাড়বেও না, আর প্রশংসা না করলে মর্যাদা ক্ষুণœও হবে না। তিনি সকল প্রশংসনীয় গুণের একক অধিকারী।
তারপর আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী, অন্ধকার এবং আলো সৃষ্টির কথা বলেছেন যা তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ। অর্থাৎ সকল কিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, দ্বিতীয় কেউ নেই। তা ভাল হোক আর মন্দ হোক। আয়াতে الظُّلُمٰتِ ‘অন্ধকারসমূহ’ শব্দটি বহুবচন আর النُّوْرَ ‘আলো’ শব্দটি একবচন উল্লেখ করা হয়েছে। এ অন্ধকার ও আলোতে পঞ্চইন্দ্রিয় অনুধাবনযোগ্য দিন-রাত চন্দ্র-সূর্য ইত্যাদির সাথে আধ্যাত্মিক অন্ধকার ও আলো শামিল। যেমন অজ্ঞতা, শির্ক ও অন্যায়ের অন্ধকার। আর জ্ঞান, ঈমান, তাওহীদ ও আনুগত্যের আলো। এসব কিছু প্রমাণ করে স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনিই সকল ইবাদত পাওয়ার একমাত্র হকদার।
এত সুন্দরভাবে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও পরিচয় তুলে ধরার পরেও একশ্রেণির মানুষ আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করে এবং তাঁর সাথে অংশী স্থাপন করে। তারা বলে: আল্লাহ তা‘আলার নাকি স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এ থেকে পবিত্র ও মহান।
তারপর আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির উপাদান মাটির কথা স্মরণ করে দিচ্ছেন, আর আমরা তারই বংশধর। সে হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। তারপর সকলের একটি নির্দিষ্ট আয়ু (জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়) নির্ধারণ করে দিয়েছি, আর একটি সময় তথা কিয়ামতের নির্দিষ্ট সময় আল্লাহর কাছে আছে যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানেন না।” অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّيْ ج لَا يُجَلِّيْهَا لِوَقْتِهَآ إِلَّا هُوَ)
‘এ বিষয়ের জ্ঞান শুধু আমার প্রতিপালকেরই আছে। তিনিই যথাকালে সেটা প্রকাশ করবেন।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৭)
(وَهُوَ اللّٰهُ فِي السَّمٰوٰتِ وَفِي الْأَرْضِ)
‘আসমানসমূহ ও জমিনে তিনিই আল্লাহ’এ আয়াতের ব্যাপারে মুফাসসিরদের উক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সঠিক উক্তি হল: আকাশে যারা রয়েছে এবং জমিনে যারা রয়েছে সকলের মা‘বূদ আল্লাহ তা‘আলা।
এর প্রমাণে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَهُوَ الَّذِيْ فِي السَّمَا۬ءِ إِلٰهٌ وَّفِي الْأَرْضِ إِلٰه)
“তিনিই মা‘বূদ আকাশমণ্ডলীতে, তিনিই মা‘বূদ পৃথিবীতে।”(সূরা যুখরুফ ৪৩:৮৪)
ইমাম শাওকানী (রহঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন:
أي هو المعبود أو المالك أو المتصرف في السموات والأرض كما تقول زيد الخليفة في الشرق والغرب
আল্লাহ তা‘আলা আকাশে ও জমিনে একমাত্র মা‘বূদ অথবা মালিক অথবা ক্ষমতাশীল। যেমন বলা হয়, যায়েদ পূর্ব ও পশ্চিমের খলিফা। (ফাতহুল কাদীর, ২/১২৯)
তাফসীর মুয়াসসারে এ অংশের তাফসীর করা হয়েছে:
والله سبحانه هو الإ له المعبود بحق في السموات والأرض
আল্লাহ তা‘আলাই আকাশমণ্ডলী ও জমিনের সত্যিকার মা‘বূদ।
আল্লামা আব্দুর রহমান নাসির আস সা‘দী বলেন:
أي: وهو المألوه المعبود ، في السموات والأرض ، فأهل السماء والأرض ، متعبدون لربهم ، خاضعون لعظمته ، مستكينون لعزه وجلاله ، الملائكة المقربون ، والأنبياء ، والمرسلون ، والصديقون ، والشهداء ، والصالحون
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাই আকাশমণ্ডলী ও জমিনের একমাত্র মা‘বূদ। তাই আকাশে ও জমিনে যারা আছে সবাই তাদের রবের ইবাদত করে, তাঁর বড়ত্বের কাছে বিনয়ী হয় এবং তাঁর সম্মান ও মর্যাদার কাছে নতি স্বীকার করে নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ, নাবী, রাসূলগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদ ও সৎ কর্ম স¤পাদনকারীগণ। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৪১-২৪২)
তাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদাহ হল, আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে আছেন। সেখানে থেকে তাঁর দর্শন, জ্ঞান, শ্রবণ ও ক্ষমতার দ্বারা সর্বত্র রয়েছেন। তাঁর জ্ঞান, দর্শন, শ্রবণ ও ক্ষমতার বাইরে কিছুই নেই। গভীর অন্ধকার রাতে কালো পাথরের ওপর কালো পিপিলিকা চলাচল করলেও আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান ও দর্শনের বাইরে নয়।
সুতরাং জাহমিয়াগণ ও অন্যান্য যারা এ আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করে থাকে যে, “আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান” এ ধরণের বিশ্বাস ভুল এবং ভ্রান্ত আকীদাহ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল প্রশংসা পাওয়ার একমাত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা এক প্রকার ইবাদত।
২. স্রষ্টা কেবল তিনিই যিনি ইবাদত পাওয়ার যোগ্য, যিনি সৃষ্টি করতে পারেন না তিনি মা‘বূদ হতে পারে না।
৩. ভাল কাজের জন্য মানুষের প্রশংসা করা বৈধ তবে সীমা অতিক্রম করা যাবে না যাতে আল্লাহ তা‘আলার সমপর্যায়ে যেন না পৌঁছে যায়।
৪. আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মানুষের নির্দিষ্ট আয়ু নির্ধারণ করে দিয়েছেন যা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ জানে না।
৫. আল্লাহ তা‘আলা স্বস্বত্ত্বায় সর্বত্র বিরাজমান নন বরং তিনি স্বস্বত্ত্বায় আরশের ওপরে রয়েছেন।