أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٢٣٠)-৪৩২
www.motaher21.net
সুরা: আল-আনয়াম
১৭-২১ নং আয়াত:-
يَعْرِفُونَهُۥ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَآءَهُم
তারা তাকে চিনে যেরূপ চিনে তাদের ছেলে-সন্তানদেরকে।
Recognize him, as they recognize their own children.
وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُۥٓ إِلَّا هُوَ ۖ وَإِن يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন দুর্দশা দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। আর যদি কোন কল্যাণ দ্বারা স্পর্শ করেন তবে তিনিই তো সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
আয়াত:-১৮
وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِۦ ۚ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ
আর তিনিই তাঁর বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান; আর তিনি প্রজ্ঞাময়, সম্যক অবহিত।
আয়াত:-১৯
قُلْ أَىُّ شَىْءٍ أَكْبَرُ شَهٰدَةً ۖ قُلِ اللَّهُ ۖ شَهِيدٌۢ بَيْنِى وَبَيْنَكُمْ ۚ وَأُوحِىَ إِلَىَّ هٰذَا الْقُرْءَانُ لِأُنذِرَكُم بِهِۦ وَمَنۢ بَلَغَ ۚ أَئِنَّكُمْ لَتَشْهَدُونَ أَنَّ مَعَ اللَّهِ ءَالِهَةً أُخْرٰى ۚ قُل لَّآ أَشْهَدُ ۚ قُلْ إِنَّمَا هُوَ إِلٰهٌ وٰحِدٌ وَإِنَّنِى بَرِىٓءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ
বল, ‘সাক্ষ্য হিসেবে সবচেয়ে বড় বস্তু কী?’ বল, ‘আল্লাহ সাক্ষী আমার ও তোমাদের মধ্যে। আর এ কুরআন আমার কাছে ওহী করে পাঠানো হয়েছে যেন তোমাদেরকে ও যার কাছে এটা পৌঁছবে তাদেরকে এর মাধ্যমে আমি সতর্ক করি। তোমরাই কি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে রয়েছে অন্যান্য উপাস্য? বল, ‘আমি সাক্ষ্য দেই না’। বল, ‘তিনি কেবল এক ইলাহ আর তোমরা যা শরীক কর আমি নিশ্চয়ই তা থেকে মুক্ত’।
আয়াত:-২০
الَّذِينَ ءَاتَيْنٰهُمُ الْكِتٰبَ يَعْرِفُونَهُۥ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَآءَهُمُ ۘ الَّذِينَ خَسِرُوٓا أَنفُسَهُمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ
যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে চিনে যেরূপ চিনে তাদের ছেলে-সন্তানদেরকে। যারা নিজদের ক্ষতি করেছে তারা ঈমান আনবে না।
আয়াত:-২১
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرٰى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِـَٔايٰتِهِۦٓ ۗ إِنَّهُۥ لَا يُفْلِحُ الظّٰلِمُونَ
আর তার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে অথবা তার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে? নিশ্চয়ই যালিমরা সফলকাম হয় না।
১৭-২১ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় তাঁর তাওহীদে রুবুবিয়্যাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যদি কোন অমঙ্গল করতে চান তাহলে তার প্রতিরোধকারী কেউ নেই। আবার যদি কল্যাণ করতে চান তাহলে তা বাধা দেয়ারও কেউ নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا يَفْتَحِ اللّٰهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَّحْمَةٍ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا ج وَمَا يُمْسِكْ لا فَلَا مُرْسِلَ لَه۫ مِنْۭ بَعْدِه وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ)
“আল্লাহ মানুষের জন্য যে রহমত উন্মুক্ত করে দেন তা কেউ প্রতিরোধ করতে পারে না; আর যা তিনি বন্ধ করে দেন তা বন্ধ করার পরে কেউ উন্মুক্ত করতে পারে না। তিনি প্র্রতাপশালী ও মহাপ্রজ্ঞাময়।”(সূরা ফাতির ৩৫:২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: হে আল্লাহ! তুমি যা দান করবে তার কোন বাধা দানকারী নেই আর যা দেবে না তার কোন দাতা নেই। কোন প্রভাবশালীর প্রভাব উপকারে আসবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৮৪৪)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবনু আব্বাস (রাঃ)-কে বলেন: হে বৎস! তুমি জেনে রেখ: সারা পৃথিবীর মানুষ যদি একত্রিত হয় তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য, আল্লাহ তা‘আলা তোমার তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তা ব্যতীত- তারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি সারা পৃথিবীর মানুষ একত্রিত হয় তোমার কোন উপকার করার জন্য, তোমার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যতটুকু উপকার লিখে রেখেছেন তার চেয়ে বেশি কোন উপকার করতে পারবে না। (তিরমিযী হা: ২৫৬১, সহীহ)
সুতরাং যদি আল্লাহ তা‘আলা রাসূলের কোন ক্ষতি করতে ইচ্ছা করেন আর তা যদি তিনি ছাড়া অন্য কেউ প্রতিরোধ করতে না পারেন, তাহলে তথাকথিত গাউস, কুতুব, পীর-ফকীর, ওলী-আউলিয়া এবং কবর-মাযারে শায়িত ব্যক্তিরা যাদের কাছে মানুষ কল্যাণ লাভ ও অকল্যাণ প্রতিরোধের জন্য আসা-যাওয়া করে তারা কতটুকু সক্ষম হবে? এ সবই শির্ক ছাড়া আর কিছুই নয়।
অতএব এসব বর্জন করে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সবার ধাবিত হওয়া উচিত।
(وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِه)
‘তিনি তাঁর বান্দাদের ওপর পরাক্রমশালী’অর্থাৎ সবাই আল্লাহ তা‘আলার কর্তৃত্বাধীন, নেতৃত্বাধীন ও ইচ্ছাধীন। সবাই তাঁর নিকট অক্ষম। কেউ তাঁর রাজত্ব ও ক্ষমতার বাইরে না।
(اَیُّ شَیْءٍ اَکْبَرُ شَھَادَةً)
‘সাক্ষ্যতে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয় কী?’ অর্থাৎ হে নাবী তুমি বল: আমি যা নিয়ে এসেছি তার সত্যতা প্রমাণের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষ্য থেকে কার সাক্ষ্য অধিক বড়? না, কারো সাক্ষ্য বড় হতে পারে না বরং আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষ্যই সবচেয়ে বড়। তিনি স্বয়ং আমার সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছেন- তিনি ছাড়া অন্য কোন মা‘বূদ নেই।
তোমরা যদিও সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ তা‘আলার সাথে আরো মা‘বূদ আছে কিন্তু আমি এ সাক্ষ্য দেই না। আমি সাক্ষ্য দেই আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র সত্যিকার মা‘বূদ আর তোমরা যা শরীক করছ আমি তা থেকে মুক্ত।
(يَعْرِفُوْنَه كَمَا يَعْرِفُوْنَ أَبْنَا۬ءَهُمْ)
“তারা তাকে সেরূপ চেনে যেরূপ চেনে তাদের সন্তানদেরকে”অর্থাৎ তারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঐরূপ চিনত যেরূপ তাদের সন্তানদেরকে চিনত। এ আয়াত সম্পর্কে সূরা বাকারার ১৪৬ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
অতএব মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক একমাত্র আল্লাহ। সকল অকল্যাণ ও অনিষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। এজন্য বিপদ-আপদে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই ডাকা কর্তব্য।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কল্যাণ দাতা ও অকল্যাণ দূরকারী একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. রাসূলগণও মানুষের ভাল-মন্দের কোন মলিক নন, তবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা ব্যতীত।
৩. আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ বা এককত্বের ব্যাপারে তাঁর সাক্ষীই সবচেয়ে বড় এবং যথেষ্ট।
৪. মুশরিকদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা ঈমানের অপরিহার্য দাবী।
৫. আহলে কিতাবগণ তাদের নাবী ও ধর্মীয় গ্রন্থের মাধ্যমে জানত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রাসূল।
৬. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মিথ্যারোপ করা সবচেয়ে বড় জুলুম।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Verses :- 17-21
يَعْرِفُونَهُۥ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَآءَهُم
Recognize him, as they recognize their own children.
Allah is the Irresistible, Able to Bring Benefit and Protect from Harm
Allah states that He Alone brings benefit or harm, and that He does what He wills with His creatures, none can resist His judgment or prevent what He decrees,
وَإِن يَمْسَسْكَ اللّهُ بِضُرٍّ فَلَ كَاشِفَ لَهُ إِلاَّ هُوَ
وَإِن يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدُيرٌ
And if Allah touches you with harm, none can remove it but He, and if He touches you with good, then He is able to do all things.
Similarly, Allah said,
مَّا يَفْتَحِ اللَّهُ لِلنَّاسِ مِن رَّحْمَةٍ فَلَ مُمْسِكَ لَهَا وَمَا يُمْسِكْ فَلَ مُرْسِلَ لَهُ مِن بَعْدِهِ
Whatever mercy, Allah may grant to mankind, none can withhold it, and whatever He may withhold, none can grant it thereafter. (35:2)
It is recorded in the Sahih that the Messenger of Allah used to supplicate,
اللَّهُمَّ لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَد
O Allah, there is none Who can avert what You grant or give what You deprive, and no fortune ever helps the fortunate against You.
This is why Allah said
وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ
And He is the Irresistible, above His servants,
meaning, to Him the necks are subservient, the tyrants humble before Him and He has complete control over all things. The creatures have all bowed to Allah and are humbled before His grace, honor, pride, greatness, highness and ability over all things. The creatures are insignificant before Him, for they are all under His irresistible decision and power,
وَهُوَ الْحَكِيمُ
and He is the All-Wise, (in all His actions),
الْخَبِيرُ
Well-Acquainted with all things.
Who places everything in its rightful place, grants and favors whomever deserves His favor.
Allah said next
قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهَادةً
Say:”What thing is the most great in witness!”
or what is the greatest witness,
قُلِ اللّهِ شَهِيدٌ بِيْنِي وَبَيْنَكُمْ
Say:”Allah (the Most Great!) is Witness between you and I.”
for He knows what I brought you and what you will answer me with,
وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْانُ لاُنذِرَكُم بِهِ وَمَن بَلَغَ
this Qur’an has been revealed to me that I may therewith warn you and whomsoever it may reach.
Therefore, this Qur’an is a warner for all those who hear of it.
In another Ayah, Allah said,
وَمَن يَكْفُرْ بِهِ مِنَ الاٌّحْزَابِ فَالنَّارُ مَوْعِدُهُ
But those of the sects that reject it, the Fire will be their promised meeting place. (11:17)
Ar-Rabi bin Anas said,
“Those who follow the Messenger of Allah ought to call to what the Messenger of Allah called to and warn against what he warned against.”
Allah said next,
أَيِنَّكُمْ لَتَشْهَدُونَ
“Can you verily bear witness…” (O idolators),
أَنَّ مَعَ اللّهِ الِهَةً أُخْرَى قُل لاَّ أَشْهَدُ
“that besides Allah there are other gods!” Say, “I bear no (such) witness!”
Similarly, in another Ayah, Allah said;
فَإِن شَهِدُواْ فَلَ تَشْهَدْ مَعَهُمْ
Then if they testify, testify not you with them. (6:150)
Allah said next,
قُلْ إِنَّمَا هُوَ إِلَـهٌ وَاحِدٌ وَإِنَّنِي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ
Say:”Only He is God, alone, and truly I am innocent of what you join in worship with Him.”
People of the Book Recognize the Prophet Just as They Recognize Their Own Children
Allah says
الَّذِينَ اتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءهُمُ
Those to whom We have given the Scripture recognize him, as they recognize their own children.
Allah says, the People of the Book know what you brought them, O Muhammad, as they know their own children. This is because they received good news from the previous Messengers and Prophets about the coming of Muhammad, his attributes, homeland, his migration, and the description of his Ummah.
Allah said next,
الَّذِينَ خَسِرُواْ أَنفُسَهُمْ
Those who have lost (destroyed) themselves,
and thus incurred the ultimate loss,
فَهُمْ لَا يُوْمِنُونَ
will not believe.
in this clear matter. A matter about which the previous Prophets gave good news, and a matter extolled about in ancient and modern times.
Allah said next
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِأيَاتِهِ
And who does more wrong than he who invents a lie against Allah or rejects His Ayat,
meaning, there is no person more unjust than he who lies about Allah and claims that Allah has sent him, while Allah did not send him. There is no person more unjust than he who denies Allah’s proofs, signs and evidences,
إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ
Verily, the wrongdoers shall never be successful.
Surely, both of these people will never acquire success, whoever falsely (claims that Allah sent him) and whoever refuses (Allah’s Ayat)
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
১৭-২১ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি লাভ ও ক্ষতির মালিক। তিনি তাঁর সষ্টির মধ্যে নিজের ইচ্ছামত ব্যবস্থাপনা চালিয়ে থাকেন। তাঁর নির্দেশকে না কেউ পিছনে সরাতে পারে, না তাঁর মীমাংসাকে কেউ বাধা প্রদান করতে পারে। যদি তিনি অকল্যাণ ও অমঙ্গলকে থামিয়ে দেন তবে সেটা কেউ চালু করতে পারে না। পক্ষান্তরে যদি তিনি কল্যাণ ও মঙ্গলকে চালু করেন তবে সেটাকে কেউ থামাতে পারে না। যেমন তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ মানুষকে যে রহমত দিতে চান ওটা কেউ বন্ধ করতে পারে না এবং যার থেকে তিনি তা বন্ধ রাখেন ওটা কেউ প্রদান করতে পারে না।” (৫২) সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ (আরবী) এই জন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তিনি সেই আল্লাহ যার জন্যে মানুষের মাথা নুয়ে পড়েছে, তিনি প্রত্যেক জিনিসের উপর জয়যুক্ত, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ সৰ্যাদার সামনে সব কিছুই নতি স্বীকার করেছে। তাঁর সমস্ত কাজ হিকমতে পরিপূর্ণ। তিনি বস্তুসমূহের স্থান সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তিনি কিছু প্রদান করলে ওর প্রাপককেই প্রদান করে থাকেন এবং কিছু বন্ধ রাখলে যে প্রাপক নয় তার থেকেই তা বন্ধ রাখেন।
তিনি বলেনঃ (আরবী) অথাৎ, হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, কার সাক্ষ্য সবচেয়ে বেশী গণ্য?
(আরবী) অর্থাৎ, হে নবী (সঃ)! তুমিই তাদেরকে উত্তরে বলে দাও আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহই হচ্ছেন সাক্ষী। আর এই কুরআন আমার নিকট অহীর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে, যেন আমি এর মাধ্যমে তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করি এবং তাকেও ভয় দেখাই যার নিকট এই কুরআনের বাণী পৌছবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ লোকদের মধ্যে যারা কুফুরী করবে, জাহান্নাম হবে তাদের ওয়াদাকৃত স্থান।” (১১:১৭) আর যার কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছবে সে যেন নবী (সঃ)-এর সাথেই সাক্ষাৎ করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার কাছে কুরআন পৌছে গেল তার কাছে যেন স্বয়ং আমিই তবলীগ করলাম।” নবী (সঃ) আরও বলেছেনঃ “আল্লাহর আয়াতগুলো পৌছিয়ে দাও। যার কাছে আল্লাহর কিতাবের কোন আয়াত পৌছে গেল তার কাছে তার হুকুম পৌছে গেল।” রাবী ইবনে আনাস বলেছেন, রাসূল (সঃ)-এর অনুসারীর এটা অবশ্য কর্তব্য যে, ইসলামের দাওয়াত সে এমনভাবে দেবে যেমনভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) দিয়েছিলেন এবং এমনভাবে ভয় প্রদর্শন করবে যেমনভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভয় প্রদর্শন করেছিলেন। ইরশাদ হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ হে মুশরিকরা, তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আল্লাহর সাথে অন্যান্য মা’বুদ রয়েছে? তুমি বলে দাও-এরূপ সাক্ষ্য আমি তো দিতে পারি না। যেমন অন্য জায়গায় তিনি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তারা সাক্ষ্য দিয়েই ফেলে তবে হে নবী (সঃ)! তুমি কিন্তু তাদের সাথে সাক্ষ্য দিয়ো না।” (৬:১৫০) আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! তুমি ঘোষণা করে দাও যে, তিনিই একমাত্র মা’বুদ, আর তোমরা যে শিরকে লিপ্ত রয়েছে, আমার সাথে ওর কোনই সম্পর্ক নেই।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা আহলে কিতাবদের সম্পর্কে বলছেন যে, তারা এই কুরআনকে এমন উত্তম রূপে জানে যেমন উত্তম রূপে জানে তারা নিজেদের পুত্রদেরকে। কেননা, তাদের কিতাবে পূর্ববর্তী নবীদের সংবাদ রয়েছে। তাঁরা সবাই মুহাম্মাদ (সঃ)-এর অস্তিত্ব লাভের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং তার গুণাবলী, তার দেশ, তার হিজরত, তাঁর উম্মতের গুণাবলী ইত্যাদি সম্পর্কে খবর দিয়ে গেছেন। এ জন্যই এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে তারা ঈমান আনবে । অথচ ব্যাপারটা খুবই পরিষ্কার যে, নবীগণ তাঁর সুসংবাদ দিয়েছেন এবং প্রাচীন যুগ থেকে তাঁর নবুওয়াত ও আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।
(আরবী) বলা হচ্ছে অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা দোষারোপ করে কিংবা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে? অর্থাৎ তার চেয়ে বড় যালিম আর কেউই হতে পারে না। এরপর ঘোষণা করা হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ এরূপ আল্লাহর উপর মিথ্যা দোষারোপকারী এবং আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকারকারী কখনই সাফল্য লাভ করতে পারবে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১১) অর্থাৎ এ মর্মে সাক্ষী যে, আমি তাঁর পক্ষ থেকে নিযুক্ত এবং যা কিছু বলছি তাঁরই নির্দেশ অনুসারে বলছি।
টিকা:১২) কোন বিষয়ের সাক্ষ্য দেবার জন্য কেবল আন্দাজ-অনুমান যথেষ্ট নয়। বরং এ জন্য প্রত্যক্ষ ও সুনিশ্চিত জ্ঞান থাকা অপরিহার্য যেন সে এহেন নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে বলতে পারে যে, হ্যাঁ, ব্যাপারটি ঠিক এরূপই। কাজেই এখানে প্রশ্নের অর্থ হচ্ছে, সত্যিই কি তোমরা নির্ভুলভাবে একথা জানো যে, এ বিশাল সৃষ্টিজগতে আল্লাহ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন প্রভু আছে, যে বন্দেগী ও পূজা-অর্চনা লাভের যোগ্য?
টিকা:১৩) অর্থাৎ যদি তোমরা নির্ভুল ও নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়া নিছক মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে চাও, তাহলে দিতে পারো কিন্তু আমি তো এ ধরনের সাক্ষ্য দিতে পারি না।
টিকা:১৪) অর্থাৎ যারা আসমানী কিতাবসমূহের জ্ঞান রাখে, তারা সন্দেহাতীতভাবে এ সত্যটি জানে ও উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ একক সত্তা এবং তাঁর প্রভুত্বের কর্তৃত্বে আর কেউ শরীক নয়। যেমন কারোর ছেলে অন্যান্য ছেলেদের ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে তাকে চিনে নেয়, ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান রাখে, সে ইলাহী, কর্তৃত্ব ও উপাস্য হবার ব্যাপারে মানুষের অসংখ্য আকীদা, বিশ্বাস ও মতবাদের মধ্য থেকে কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় ছাড়াই প্রকৃত সত্যটি সহজেই চিনে নেয়।
টিকা:১৫) অর্থাৎ এ মর্মে দাবী করে যে, প্রভুত্বের ব্যাপারে আরো অনেক সত্তা আল্লাহর সাথে শরীক। তাদের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার গুণাবলী এবং তারা মানুষের সামনে তাদের বন্দেগী লাভ করার জন্য নিজেদেরকে উপস্থাপন করার যোগ্যতা রাখে। তাছাড়া আল্লাহ অমুক সত্তাকে নিজের বিশেষ নিকটতম হিসেবে গণ্য করেছেন এবং তিনিই এ হুকুম দিয়েছেন অথবা কমপক্ষে তাদের সাথে ইলাহসুলভ গুণাবলী সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে সম্মত রয়েছেন এবং আল্লাহর সাথে বান্দার যে ধরনের আচার-আচরণ করা উচিত তাদের সাথেও সে ধরনের আচরণ করতে হবে-কারোর এ জাতীয় কথা বলাও আল্লাহর প্রতি এক ধরনের মিথ্যা দোষারোপ।
টিকা:১৬) আল্লাহর নিদর্শনাবলী বলতে এমন সব নিদর্শন বুঝানো হয়েছে যেগুলো মানুষের নিজের সত্তার মধ্যে এবং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে, নবী-রসূলগনের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যেগুলোর প্রকাশ ঘটেছে এবং যেগুলো আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে পেশ করা হয়েছে। এ সমস্ত নিদর্শন একটি মাত্র সত্যের প্রতিই মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সে সত্যটি হচ্ছে, এ সৃষ্টিজগতের বুকে যা কিছু অস্তিত্বমান তার মধ্যে বিধাতা ও মনিব মাত্র একজনই এবং বাকি সবাই প্রজা ও বান্দা। এখন যে ব্যক্তি এ সমস্ত নিদর্শনের মোকাবিলায় প্রকৃত ও যথার্থ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই, কোন জ্ঞান, প্রত্যক্ষ দর্শন ও কোন প্রকার অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই নিছক আন্দাজ-অনুমান বা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের ভিত্তিতে অন্যদের সাথে উপাস্য ও পূজনীয় হবার গুণাবলী সংযুক্ত করে এবং আল্লাহ যেসব অধিকার এককভাবে লাভ করেন, তাদেরকে সেগুলোর যোগ্য গণ্য করে, তাদের চেয়ে বড় জালেম আর কেউ হতে পারে না। তারা সুস্পষ্ট ও জাজ্জ্বল্যমান সত্যের প্রতি অবিচার ও জুলুম করছে। তারা নিজেদের নফসের ওপর জুলুম করছে। তারা এ ভ্রান্ত মতাদর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব-জাহানের যেসব জিনিসের সাথে সম্পর্ক ও সংযোগ স্থাপন করে এবং তাদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে তাদের প্রত্যেকের সাথে জুলুম করছে।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] এ আয়াতে ইসলামের একটি মৌলিক বিশ্বাস বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি লাভক্ষতির মালিক প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’আলা। সত্যিকারভাবে কোন ব্যক্তি কারো সামান্য উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না। আল্লাহ যদি কারও লাভ করতে চান তবে তা বন্ধ করার ক্ষমতা কারও নেই। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আর আল্লাহ যদি আপনার মংগল চান তবে তাঁর অনুগ্রহ প্রতিহত করার কেউ নেই। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তার কাছে সেটা পৌঁছান [সূরা ইউনুস ১০৭] এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম বাগভী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটে সওয়ার হয়ে আমাকে পিছনে বসিয়ে নিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেনঃ “হে বৎস’! আমি আরয করলামঃ আদেশ করুন, আমি হাযির আছি। তিনি বললেনঃ “তুমি আল্লাহর বিধি-বিধানকে হেফাযত করবে, আল্লাহ তোমাকে হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর বিধি-বিধানকে হেফাযত করো তাহলে আল্লাহকে সাহায্যের সাথে তোমার সামনে পাবে। তুমি শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখলে, বিপদের সময় তিনি তোমাকে স্মরণ রাখবেন। কোন কিছু চাইতে হলে তুমি আল্লাহর কাছেই চাও এবং সাহায্য চাইতে হলে আল্লাহর কাছেই চাও। জগতে যা কিছু হবে, ভাগ্যের লেখনী তা লিখে ফেলেছে। সমগ্র সৃষ্টজীব সম্মিলিতভাবে তোমার কোন উপকার করতে চাইলে যা তোমার তাকদিরে লিখা নেই তারা কখনো তা করতে পারবে না। পক্ষান্তরে যদি তারা সবাই মিলে তোমার এমন কোন ক্ষতি করতে চায়, যা তোমার ভাগ্যে নেই, তবে কখনোই তারা তা করতে সক্ষম হবে না। যদি তুমি বিশ্বাস সহকারে ধৈর্যধারণের মাধ্যমে আমল করতে পার তবে অবশ্যই তা করো। সক্ষম না হলে ধৈর্য ধর। কেননা, তুমি যা অপছন্দ করো তার বিপক্ষে ধৈর্য ধারণ করায় অনেক মঙ্গল রয়েছে। মনে রাখবে, আল্লাহর সাহায্য ধৈর্যের সাথে জড়িত-কষ্টের সাথে সুখ এবং অভাবের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য জড়িত। [মুসনাদে আহমাদ:১/৩০৭]
পরিতাপের বিষয়, কুরআনুল কারীমের এ সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আজীবনের শিক্ষা সত্ত্বেও মুসলিমরা এ ব্যাপারে পথ ভ্রান্ত। তারা আল্লাহ্ তা’আলার সব ক্ষমতা সৃষ্টজীবের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছে। আজ এমন মুসলিমের সংখ্যা নগণ্য নয়, যারা বিপদের সময় আল্লাহ্ তা’আলাকে স্মরণ করে না এবং তারা তাঁর কাছে দো’আ করার পরিবর্তে বিভিন্ন নামের দোহাই দেয় এবং তাদেরই সাহায্য কামনা করে। তারা আল্লাহ তা’আলার প্রতি লক্ষ্য করে না। কোন সৃষ্ট জীবকে অভাব পূরণের জন্য ডাকা এ কুরআনী নির্দেশের পরিপন্থী ও প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণার নামান্তর। আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদেরকে সরল পথে কায়েম রাখুন।
[২] অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলাই সবার উপর পরাক্রান্ত ও শক্তিমান এবং সবাই তাঁর ক্ষমতাধীন ও মুখাপেক্ষী। এ কারণেই দুনিয়ার জীবনে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন মহোত্তম ব্যক্তিগণও সব কাজে সাফল্য অর্জন করতে পারে না এবং তার সব মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় না; তিনি নৈকট্যশীল রাসূলই হোন কিংবা রাজা বাদশাহ। আর তিনি যা আদেশ, নিষেধ, সাওয়াব, শাস্তি, সৃষ্টি বা নির্ধারণ যাই করেন তাই প্রজ্ঞাময়। তিনি গোপন যাবতীয় কিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত। এ সবকিছুই তাঁর তাওহীদের প্রমাণ [সা‘দী ]
[৩] অর্থাৎ কোন জিনিসের সাক্ষ্য সাক্ষী হিসেবে বড় বলে বিবেচিত? বলুন, আল্লাহ। তিনিই সবচেয়ে বড় সাক্ষী। তাঁর সাক্ষ্যের মধ্যে কোন প্রকার ভুল-ত্রুটির সম্ভাবনা নেই। সুতরাং তিনিই আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষ্য যে, আমি রাসূল। [তাবারী, সা’দী]
[৪] এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক সেই ব্যক্তির জন্যই ভীতিপ্রদর্শনকারী যার কাছে এ কুরআনের আহবান পৌঁছেছে, সে যে-ই হোক না কেন। সুতরাং যার কাছেই এ আহবান পৌঁছবে সে তাতে ঈমান আনতে বাধ্য। যদি তা না করে তবে সে হবে জাহান্নামী। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত যে সর্বকাল ও সর্বজনব্যাপী তার প্রমাণ কুরআনের অন্য আয়াতেও এসেছে, “বলুন, “হে মানুষ! আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসূল” [সূরা আল-আরাফ: ১৫৮] আরও এসেছে, “আর আমরা তো আপনাকে কেবল সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি” [সূরা সাবা:২৮] আরও এসেছে, “কত বরকতময় তিনি ! যিনি তাঁর বান্দার উপর ফুরকান নাযিল করেছেন, সৃষ্টিকুলের জন্য সতর্ককারী হতে” [সূরা আল-ফুরকান-১]। আর যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনবে না, তাদের শাস্তি যে জাহান্নাম এ কথাও কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “অন্যান্য দলের যারা তাতে কুফরী করে, আগুনই তাদের প্রতিশ্রুত স্থান” [সূরা হুদ:১৭] [আদওয়াউল বায়ান]
[৫] এর অর্থ, যাদের উপর কিতাব নাযিল করেছি তারা ভালভাবেই জানে যে, ইলাহ মাত্র একজনই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য নবী ও রাসূল [তাবারী] অনুরূপভাবে তারা এটাও ভাল করে জানে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রিসালত, নবুওয়াত ও ওহীসহ যা নিয়ে এসেছেন তা সবই সত্য। [ ইবন কাসীর]
[৬] অর্থাৎ যারা তাদের সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ঈমান ও তাওহীদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, আল্লাহ তা’আলার নেয়ামত থেকে মাহরুম হয়েছে, তারা যে কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। [সা’দী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ, ইষ্টানিষ্টের মালিক এবং সারা জাহানে সর্বপ্রকারের কর্তৃত্বকারী কেবল আল্লাহই। তাঁর বিচার-ফায়সালাকে খন্ডাবার মত কেউ নেই। একটি হাদীসে এই বিষয়টাকে এইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, اللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ)) “হে আল্লাহ! তুমি যা দান কর, তা কেউ রোধ করতে পারে না। আর তুমি যা রোধ কর, তা কেউ দিতেও পারে না। আর ধনীদের ধন তোমার আযাব থেকে বাঁচতে কোন উপকারে আসবে না।” (বুখারীঃ ই’তিসাম অধ্যায়, মুসলিম, সালাত ও মাসাজিদ অধ্যায়) নবী করীম (সাঃ) প্রত্যেক ফরয নামাযের পর এই দু’আটি পাঠ করতেন।
[২] অর্থাৎ, সমস্ত মস্তক তাঁর সামনে অবনত। বড় বড় দুর্ধর্ষ তাঁর সামনে অক্ষম। তিনি সব কিছুর উপর বিজয়ী এবং সারা সৃষ্টি তাঁর অনুগত। তিনি তাঁর প্রতিটি কর্মে সুবিজ্ঞ সুকৌশলময় এবং প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে অবগত। অতএব তিনি ভালভাবেই জানেন যে, কে তাঁর অনুগ্রহ ও পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য এবং কে অযোগ্য।
[৩] অর্থাৎ, স্বয়ং আল্লাহই তাঁর একত্ব এবং প্রতিপালকত্বের সব চেয়ে বড় সাক্ষী। তাঁর থেকে বড় সাক্ষী আর কেউ নেই।
[৪] রবী’ ইবনে আনাস (রঃ) বলেন, এখন যার কাছেই এই কুরআন পৌঁছে যাবে, সে যদি রসূল (সাঃ)-এর সত্য অনুসারী হয়, তবে তার কর্তব্য হল, সেও লোকদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাবে, যেভাবে রসূল (সাঃ) আহবান জানিয়েছেন এবং ঐভাবে সতর্ক করবে, যেভাবে রসূল (সাঃ) সতর্ক করেছেন। (ইবনে কাসীর)
[৫] يَعْرِفُوْنَهُ তে সর্বনাম (তাকে)এর লক্ষ্যস্থল হল রসূল (সাঃ)। অর্থাৎ, কিতাবধারীরা রসূল (সাঃ)-কে ঐভাবেই চিনত, যেভাবে তারা তাদের ছেলেদেরকে চিনত। কারণ, রসূল (সাঃ)-এর নিদর্শনাবলী ও তাঁর পরিচয় তাদের কিতাবগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছিল এবং এই নিদর্শনাবলীর কারণে তারা তাঁর অপেক্ষাতেও ছিল। তাই এখন তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে না, তারা বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কেননা, তারা জানা সত্ত্বেও অস্বীকার করছে। فَإِنْ كُنْتَ لاََ تَدْرِيْ فَتِلْكَ مُصِيْبَة * وَإِنْ كُنْتَ تَدْرِيْ فَالْمُصِيْبَةُ أَعْظَمُ।
(যদি তোমার না জানা থাকে তবে এটা মুসীবত, কিন্তু যদি জানা থাকে তাহলে তো মুসীবত আরো বড়।)
[৬] অর্থাৎ, যেমন আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপকারী (অর্থাৎ, নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীদার) সবচেয়ে বড় যালেম, অনুরূপ সে ব্যক্তিও বড় যালেম, যে আল্লাহর নিদর্শনাবলী এবং তাঁর সত্য রসূলকে মিথ্যা মনে করে। নবী হওয়ার মিথ্যা দাবীদারদের উপর এত কঠোর হুমকি আসা সত্ত্বেও এটা বাস্তব যে, প্রত্যেক যুগে একাধিক ব্যক্তি নবী হওয়ার মিথ্যা দাবী উত্থাপন করেছে এবং এইভাবে নবী করীম (সাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীও বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “ত্রিশজন মিথ্যুক দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং তারা প্রত্যেকে দাবী করবে যে, সে নবী।” বিগত শতাব্দীতেও কাদিয়ানের (গুলাম আহমাদ নামক) এক ব্যক্তি নবী হওয়ার দাবী করেছিল। আর বর্তমানে তার অনুসারীরা তাকে সত্য নবী এবং কেউ কেউ ‘প্রতিশ্রুত মসীহ’ এই জন্য মনে করে যে, অল্প সংখ্যক কিছু লোক তাকে নবী বলে স্বীকার করে। অথচ কিছু মানুষের কোন মিথ্যুককে সত্যবাদী মনে করে নেওয়া, তার সত্যবাদী হওয়ার দলীল হতে পারে না। সত্যতার জন্য তো কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট দলীলের প্রয়োজন।
[৭] যেহেতু এরা উভয়েই যালেম, তাই না সে সফল হবে, যে মিথ্যা রচনা করে, আর না সে, যে মিথ্যাজ্ঞান করে। কাজেই প্রয়োজন হল প্রত্যেকেই যেন নিজেদের পরিণামের ব্যাপারে ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে।