أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٢٨١)-৪৮৩
www.motaher21.net
সুরা: আল-আনয়াম
সুরা:৬
১৫১-১৫৩ নং আয়াত:-
قُلۡ تَعَالَوۡا اَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّکُمۡ عَلَیۡکُم
লোকদেরকে বলঃ তোমরা এসো! তোমাদের রাব্ব তোমাদের প্রতি কি কি বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন তা আমি তোমাদেরকে পাঠ করে শোনাই;
Ten Commandments
Say:”Come, I will recite what your Lord has prohibited you from:- ”
قُلۡ تَعَالَوۡا اَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّکُمۡ عَلَیۡکُمۡ اَلَّا تُشۡرِکُوۡا بِہٖ شَیۡئًا وَّ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا ۚ وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَوۡلَادَکُمۡ مِّنۡ اِمۡلَاقٍ ؕ نَحۡنُ نَرۡزُقُکُمۡ وَ اِیَّاہُمۡ ۚ وَ لَا تَقۡرَبُوا الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ مِنۡہَا وَ مَا بَطَنَ ۚ وَ لَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۱۵۱﴾
লোকদেরকে বলঃ তোমরা এসো! তোমাদের রাব্ব তোমাদের প্রতি কি কি বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন তা আমি তোমাদেরকে পাঠ করে শোনাই; তা এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কেহকেই শরীক করবেনা, মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্রতার ভয়ে নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবেনা। কেননা আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবিকা দিই; আর অশ্লীল কাজ ও কথার নিকটেও যেওনা, তা প্রকাশ্যই হোক কিংবা গোপনীয়ই হোক, আর আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন – যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করনা। এসব বিষয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা অনুধাবন করতে পার।
وَ لَا تَقۡرَبُوۡا مَالَ الۡیَتِیۡمِ اِلَّا بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ حَتّٰی یَبۡلُغَ اَشُدَّہٗ ۚ وَ اَوۡفُوا الۡکَیۡلَ وَ الۡمِیۡزَانَ بِالۡقِسۡطِ ۚ لَا نُکَلِّفُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَہَا ۚ وَ اِذَا قُلۡتُمۡ فَاعۡدِلُوۡا وَ لَوۡ کَانَ ذَا قُرۡبٰی ۚ وَ بِعَہۡدِ اللّٰہِ اَوۡفُوۡا ؕ ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ ﴿۱۵۲﴾ۙ
আর ইয়াতীমরা বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্য ব্যতীত তাদের বিষয় সম্পত্তির কাছেও যেওনা, আর আদান-প্রদান, পরিমান-ওজন সঠিকভাবে করবে, আমি কারও উপর তার সাধ্যাতীত ভার (দায়িত্ব/কর্তব্য) অর্পন করিনা, আর তোমরা যখন কথা বলবে তখন স্বজনের বিরুদ্ধে হলেও ন্যায়ানুগ কথা বলবে, আর আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এসব বিষয় নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা তাঁর এ নির্দেশ ও উপদেশ গ্রহণ কর।
وَ اَنَّ ہٰذَا صِرَاطِیۡ مُسۡتَقِیۡمًا فَاتَّبِعُوۡہُ ۚ وَ لَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِکُمۡ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿۱۵۳﴾
আর নিশ্চয়ই এই পথই আমার সরল পথ; এই পথই তোমরা অনুসরণ করে চলবে, এই পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করবেনা, তাহলে তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে নিবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দিচ্ছেন, যেন তোমরা সতর্ক হও।
আয়াতে ১৫১-১৫৩ নাম্বার আলোচনা:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১২৭) অর্থাৎ তোমরা যেসব বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছো সেগুলো তোমাদের রবের পক্ষ থেকে আরোপিত বিধি-নিষেধ নয়। বরং মানুষের জীবনকে সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ করার জন্য আল্লাহ যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন এবং যেগুলো সর্বকালে ও সর্বদেশে আল্লাহর দেয়া শরীয়াতের মৌল বিষয় হিসেবে পরিচিত হয়ে এসেছে সেগুলোই হচ্ছে আসল বিধি-নিষেধ। (তুলনামূলক আলোচনার জন্য বাইবেলের যাত্রা পুস্তক ২০ অধ্যায় দেখুন)।
টিকা:১২৮) অর্থাৎ আল্লাহর সত্তায়, তাঁর গুণাবলীতে, তাঁর ক্ষমতা-ইখতিয়ারে বা তাঁর অধিকারে কোন ক্ষেত্রে কাউকে শরীক করো না।
আল্লাহর সত্তায় শরীক করার অর্থ হচ্ছে, ইলাহী সত্তার মৌল উপাদানে কাউকে অংশীদার করা। যেমন খৃস্টানদের ত্রিত্ববাদের আকীদা, আরব মুশরিকদের ফেরেশতাদের আল্লাহর কণ্যা গণ্য করা এবং অন্যান্য মুশরিকদের নিজেদের দেব-দেবীদেরকে এবং নিজেদের রাজ পরিবারগুলোকে আল্লাহ বংশধর বা দেবজ ব্যক্তিবর্গ হিসেবে গণ্য করা-এসবগুলোই আল্লাহর সত্তায় শরীক করার অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহর গুণাবলীতে শরীক করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহর জন্য যে অবস্থায় থাকে ঠিক তেমনি অবস্থায় সেগুলোকে বা তার কোনটিকে অন্য কারোর জন্য নির্ধারিত করা। যেমন কারোর সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করা যে, সমস্ত অদৃশ্য সত্য তার কাছে দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। অথবা সে সবকিছু দেখে ও সবকিছু শোনে। অথবা সে সব রকমের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা মুক্ত একটি পবিত্র সত্তা।
ক্ষমতা –ইখতিয়ারের ক্ষেত্রে শিরক করার অর্থ হচ্ছে, সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন ইলাহ হবার কারণে যে সমস্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত সেগুলোকে বা সেগুলোর মধ্য থেকে কোনটিকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর জন্য স্বীকার করে নেয়া। যেমন অতি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কাউকে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত করা, কারোর অভাব ও প্রয়োজন পূর্ণ করা, কাউকে সাহায্য করা, কারোর হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা, কারোর প্রার্থনা শোনা, ভাগ্য ভাঙ্গাগড়া করা। এছাড়া হারাম–হালাল ও জায়েয-নাজায়েযের সীমানা নির্ধারণ করা এবং মানব জীবনের জন্য আইন-বিধান রচনা করা। এসবই আল্লাহর বিশেষ ক্ষমতা ও ইখতিয়ার। এর মধ্য থেকে কোন একটিকেও আল্লাহ ছাড়া আর কারোর জন্য স্বীকার করা শিরক।
অধিকারের ক্ষেত্রে শিরক করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ হবার কারণে বান্দাদের ওপর আল্লাহর বিশেষ অধিকার রয়েছে। সে অধিকারসমূহ বা তার মধ্য থেকে কোন একটি অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারোর জন্য মেনে নেয়া। যেমন রুকূ ও সিজদা করা, বুকে হাত বেঁধে বা হাত জোড় করে দাঁড়ানো, সালামী দেয়া ও আস্তানা চুম্বন করা, নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ নযরানা ও কুরবানী পেশ করা, প্রয়োজন পূরণ ও সংকট দূর করার জন্য মানত করা, বিপদ-আপদে সাহায্যের জন্য আহবান করা এবং এভাবে পূজা-আর্চনা, সম্মান ও মর্যাদা দান করার জন্য অন্যান্য যাবতীয় পদ্ধতি একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত অধিকার। অনুরূপভাবে কাউকে এমন প্রিয় জ্ঞান করা যে, তার প্রতি ভালবাসার মোকাবিলায় অন্য সমস্ত ভালবাসাকে উৎসর্গ করে দেয়া হয় এবং কাউকে এমন ভয় করা যে, গোপনে ও প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় তার অসন্তোষকে ভীতির নজরে দেখা-এসবও একমাত্র আল্লাহর অধিকার। আল্লাহর শর্তহীন আনুগত্য করা, তাঁর নির্দেশকে ভুল ও নির্ভুলের মানদণ্ড মনে করা এবং এমন কোন আনুগত্যের শৃংখল নিজের গলায় পরিধান না করা যা আল্লাহর আনুগত্যের শৃংখলমুক্ত একটি স্বতন্ত্র আনুগত্য এবং যার নির্দেশের পেছনে আল্লাহর নির্দেশের সনদ নেই-এসবও আল্লাহর অধিকার। এ অধিকারগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একটি অধিকারও কাউকে দেয়া হলে, তাকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট নামগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি নাম না দিলেও তাকে আল্লাহর সাথে শরীক করা হবে।
টিকা:১২৯) আদব, সম্মান, আনুগত্য, সন্তুষ্টি বিধান, সেবা সবকিছুই সদ্ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের সর্বত্র পিতামাতার এ অধিকারকে তাওহীদের বিধানের পরপরই বর্ণনা করা হয়েছে। এ থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহর পর বান্দার অধিকারের দিক দিয়ে মানুষের ওপর তার পিতামাতার অধিকার সর্বাগ্রগণ্য।
টিকা:১৩০) এখানে আসল শব্দ হচ্ছেفَوَاحِشَ এ শব্দটি এমন সব কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যেগুলো সুস্পষ্ট খারাপ কাজ হিসেবে পরিচিত। কুরআনে ব্যভিচার, সমকাম (পুরুষ কামিতা), উলংগতা, মিথ্যা দোষারোপ এবং পিতার বিবাহিত স্ত্রীকে বিয়ে করাকে ফাহেশ কাজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হাদীসে চুরি ও মদপানের সাথে সাথে ভিক্ষাবৃত্তিকেও ফাহেশ ও অশ্লীল কাজের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। অনুরূপভাবে অন্যান্য সমস্ত নির্লজ্জতার কাজও ফাহেশের অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে এ ধরনের কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনভাবেই করা যাবে না।
টিকা:১৩১) অর্থাৎ মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রাণকে হারাম ও মর্যাদা সম্পন্ন ঘোষণা করা হয়েছে। তাকে ন্যায় ও সত্যের খাতিরে ছাড়া কোনক্রমেই ধ্বংস করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ “ন্যায়সঙ্গতভাবে” বা “ন্যায় ও সত্যের খাতিরে” এর অর্থ কি? কুরআনে আর তিনটি পর্যায় বর্ণিত হয়েছে এবং নবী ﷺ এর ওপর আরো দু’টি পর্যায় বৃদ্ধি করেছেন। কুরআনে বর্ণিত তিনটি পর্যায় হচ্ছেঃ
(১) যখন এক ব্যক্তি আর এক ব্যক্তিকে জেনে বুঝে হত্যা করার অপরাধ করে এবং হত্যাকারীর ওপর কিসাস বা রক্তপণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
(২) যখন কোন ব্যক্তি আল্লাহর সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় এবং তার সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
(৩) যখন কোন ব্যক্তি দারুল ইসলামের সীমানার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন ঘটাবার চেষ্টা করে।
হাদীসে বর্ণিত অন্য পর্যায় দু’টি হচ্ছেঃ
(৪)কোন ব্যক্তি বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও যিনা করলে।
(৫)কোন ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে গেলে এবং মুসলিম সমাজ ত্যাগ করলে। এ পাঁচটি পর্যায়ে ও অবস্থা ছাড়া অন্য কোন অবস্থায় একজন মানুষ আর একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে না। সে মু’মিন, যিম্মী বা সাধারণ কাফের যেই হোক না কেন, কোন ক্ষেত্রেই তার রক্ত হালাল নয়।
আয়াত:- ১৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
টিকা:১৩২) অর্থাৎ এমন পদ্ধতিতে, যা হবে সর্বাধিক নিঃস্বার্থপরতা, সদুদ্দেশ্য ও এতিমের প্রতি সদিচ্ছা ও কল্যাণকামিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং যার বিরুদ্ধে আল্লাহর অসন্তোষ বা মানুষের আপত্তি উত্থাপন করার কোন অবকাশই না থাকে।
টিকা:১৩৩) এটি যদিও আল্লাহর শরীয়াতের একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র নীতি তবুও এটি বর্ণনার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি নিজস্ব পরিসরে ওজন-পরিমাপ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে সততা ও ইনসাফের পরিচয় দেবার চেষ্টা করবে সে নিজের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। কিছু ভুল-চুক বা অজ্ঞাতসারে কমবেশী হয়ে গেলে সেজন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে না।
টিকা:১৩৪) “আল্লাহর অঙ্গীকার” বলতে এমন অঙ্গীকার বুঝায় যা মানুষ তার সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন ইলাহর তথা আল্লাহর সাথে করে। আবার এমন অঙ্গীকারও বুঝায় যা আল্লাহর নামে বান্দার সাথে করে। একটি মানব শিশু এ আল্লাহর যমীনে মানব সমাজে চোখ মেলে তাকাবার সাথে সাথেই আল্লাহ ও মানুষ এবং মানুষ ও মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে অঙ্গীকারের বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাও এ অঙ্গীকারের অন্তর্ভুক্ত। প্রথম অঙ্গীকার ও চুক্তি দু’টি হয় সচেতন ও ইচ্ছাকৃত। অন্যদিকে তৃতীয়টি হয় একটি প্রাকৃতিক ও স্বভাবজাত (Natural Contact) অঙ্গীকার ও চুক্তি। এ তৃতীয় চুক্তিটি সম্পাদনে মানুষের ইচ্ছা ও সংকল্পের কোন হাত না থাকলেও পরিপূর্ণ মর্যাদা সম্পন্ন হবার দিক দিয়ে প্রথম দু’টির তুলনায় এটি কোন অংশে খাটো নয়। আল্লাহ মানুষকে যে অস্তিত্ব দান করেছেন, তাকে যে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি দান করেছেন, তাকে দেহের অভ্যন্তরে যে যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা দান করেছেন, যমীনে তার জন্য সৃষ্ট উপায়-উপকরণ ও জীবিকা ব্যবহারের যে ব্যবস্থা করেছেন এবং প্রাকৃতিক বিধি-ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবন যাপনের যে সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হয় তা থেকে লাভবান হবার যে সুযোগ তাকে দিয়েছেন-এসবগুলোই স্বতস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকভাবে তার ওপর আল্লাহর কিছু অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে। অনুরূপভাবে মানব শিশুর একটি মানব জননীর পেটে তার রক্তে প্রতিপালিত হওয়া, একটি পিতার পরিশ্রমলব্ধ কুটীরে জন্মগ্রহণ করা এবং একটি সমাজবদ্ধ অঙ্গনে অসংখ্য সংগঠন সংস্থা থেকে বিভিন্ন প্রকারে সাহায্য-সহায়তা লাভ করার কারণে মর্যাদা ও গুরুত্বের ক্রমানুসারে তার ওপর বহু ব্যক্তি ও সমাজ সংস্থার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর সাথে মানুষের এবং মানুষের সাথে মানুষের কৃত এই অঙ্গীকার অবশ্যি কোন কাগজে লিখিত হয়নি ঠিকই কিন্তু তার সমগ্র সত্তা এ চুক্তি ও অঙ্গীকারের ফসল। এ চুক্তি ও অঙ্গীকারের দিকে সূরা বাকারার ২৭ আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ফাসেক হচ্ছে তারা যারা “আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করার পর তা ভেঙে ফেলে, আল্লাহ যাকে সংযুক্ত করার হুকুম দিয়েছেন তাকে কেটে ফেলে এবং যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে।” পরবর্তী পর্যায়ে সূরা আ’রাফের ১৭২ আয়াতেও এরই উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সৃষ্টির আদি পর্বে আল্লাহ আদমের পিঠ থেকে তার সন্তানদের বের করে তাদেরকে এ মর্মে সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন-আমি কি তোমাদের রব নই? এর জবাবে তারা স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ আমরা এর সাক্ষী।
সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-27
الَّذِیْنَ یَنْقُضُوْنَ عَهْدَ اللّٰهِ مِنْۢ بَعْدِ مِیْثَاقِهٖ۪ وَ یَقْطَعُوْنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنْ یُّوْصَلَ وَ یُفْسِدُوْنَ فِی الْاَرْضِؕ أُولَٰئِكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ
আর তিনি গোমরাহীর মধ্যে তাদেরকেই নিক্ষেপ করেন যারা ফাসেক, যারা আল্লাহর সাথে মজবুতভাবে অঙ্গীকার করার পর আবার তা ভেঙ্গে ফেলে, আল্লাহ যাকে জোড়ার হুকুম দিয়েছেন তাকে কেটে ফেলে এবং যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে চলে। আসলে এরাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
তাফসীর :
টিকা: 30
ফাসেক তাকে বলে যে নাফরমান এবং আল্লাহর আনুগত্যের সীমা অতিক্রম করে যায়।
টিকা: 31
বাদশাহ নিজের কর্মচারী ও প্রজাদের নামে যে ফরমান বা নির্দেশনামা জারী করেন আরবী ভাষায় প্রচলিত কথ্যরীতিতে তাকে বলা হয় ‘আহদ’ বা অঙ্গীকার। কারণ এই অঙ্গীকার মেনে চলা হয় প্রজাদের অপরিহার্য কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এখানে অঙ্গীকার শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহর অঙ্গীকার অর্থ হচ্ছে, তাঁর স্থায়ী ফরমান। এই ফরমানের দৃষ্টিতে বলা যায়, সমগ্র মানবজাতি একমাত্র তাঁরই বন্দেগী, আনুগত্য ও পূজা-উপাসনা করার জন্য আদিষ্ট ও নিযুক্ত হয়েছে। ‘মজবুতভাবে অঙ্গীকার করার পর’—কথাটি বলে আসলে হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টির সময় সমগ্র মানবাত্মার নিকট থেকে এ ফরমানটির আনুগত্য করার যে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা আরাফ-এর ১৭২ আয়াতে এই অঙ্গীকারের ওপর তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।
টিকা: 32
অর্থাৎ যেসব সম্পর্ককে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত করার ওপর মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণ নির্ভর করে এবং আল্লাহ যেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার হুকুম দিয়েছেন, তার ওপর এরা অস্ত্র চালায়। এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটির মধ্যে রয়েছে অর্থের অশেষ ব্যাপকতা। ফলে দু’টি মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে যে মানবিক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিশাল জগত তার সমগ্র অবয়বও এই অর্থের আওতাধীন এসে যায়। সম্পর্ক কেটে ফেলার অর্থ নিছক মানবিক সম্পর্কচ্ছেদ নয় বরং সঠিক ও বৈধ সম্পর্ক ছাড়া অন্য যত প্রকারের সম্পর্ক কায়েম করা হবে তা সবই এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ অবৈধ ও ভুল সম্পর্কের পরিণতি এবং সম্পর্কচ্ছেদের পরিণতি একই। অর্থাৎ এর পরিণতিতে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয় এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হয় ধ্বংসের মুখোমুখি।
টিকা: 33
এই তিনটি বাক্যের মধ্যে ফাসেকী ও ফাসেকের চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার সম্পর্ক এবং মানুষ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন বা বিকৃত করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে বিপর্যয়। আর যে ব্যক্তি এ বিপর্যয় সৃষ্টি করে সেই হচ্ছে ফাসেক।
সুরা: আল-আরাফ
আয়াত নং :-172
وَ اِذْ اَخَذَ رَبُّكَ مِنْۢ بَنِیْۤ اٰدَمَ مِنْ ظُهُوْرِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَ اَشْهَدَهُمْ عَلٰۤى اَنْفُسِهِمْ اَلَسْتُ بِرَبِّكُمْؕ-قَالُوْا بَلٰىۚۛ-شَهِدْنَاۚۛ-اَنْ تَقُوْلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّا كُنَّا عَنْ هٰذَا غٰفِلِیْنَۙ
আর হে নবী! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা, যখন তোমাদের রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমি কি তোমাদের রব নই?” তারা বলেছিল, “নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি।” এটা আমি এ জন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, “আমরা তো একথা জানতাম না।”
তাফসীর :
টিকা:১৩৩) পূর্ববর্তী আলোচনা যেখানে শেষ হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছিল, মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে বন্দেগী ও আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এখন সাধারণ মানুষকে সম্বোধন করে তাদেরকে জানানো হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে বনী ইসরাঈলের কোন বিশেষত্ব নেই বরং প্রকৃতপক্ষে তোমরা সবাই নিজেদের স্রষ্টার সাথে একটি অঙ্গীকারে আবদ্ধ এবং এ অঙ্গীকার তোমরা কতটুকু পালন করেছো সে ব্যাপারে তোমাদের একদিন জবাবদিহি করতে হবে।
টিকা:১৩৪) বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়, এটি আদম সৃষ্টির সময়কার একটি ঘটনা। সে সময় একদিকে যেমন ফেরেশতাদের একত্র করে প্রথম মানুষটিকে সিজদা করানো হয়েছিল এবং পৃথিবীতে মানুষের খিলাফতের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত আদমের যে অগণিত সংখ্যক বংশধর জন্মলাভ করবে, মহান আল্লাহ তাদের সবাইকে একই সঙ্গে সজীব ও সচেতন সত্তায় আবির্ভূত করে নিজের সামনে উপস্থিত করেছিলেন এবং তাদের কাছ থেকে তাঁর রব হবার ব্যাপারে সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্ভবত নবী ﷺ থেকে জ্ঞান লাভ করে যা কিছু বর্ণনা করেন তা এ বিষয়ের সবচেয়ে ভাল ব্যাখ্যা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তিনি বলেনঃ
“মহান আল্লাহ সবাইকে একত্র করেন। (এক এক ধরনের বা এক এক যুগের) লোকদেরকে আলাদা আলাদা দলে সংগঠিত করেন। তাদেরকে মানবিক আকৃতি ও বাকশক্তি দান করেন। তারপর তাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তাদেরকে নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলেঃ অবশ্যই তুমি আমাদের রব। তখন আল্লাহ বলেনঃ কিয়ামতের দিন যাতে তোমরা না বলতে পারো আমরা তো একথা জানতাম না, তাই আমি তোমাদের ওপর পৃথিবী ও আকাশ এবং তোমাদের পিতা আদমকে সাক্ষী করছি। ভালভাবে জেনে রাখো, আমি ছাড়া ইবাদাত লাভের যোগ্য আর কেউ নেই এবং আমি ছাড়া আর কোন রব নেই। তোমরা আমার সাথে আর কাউকে শরীক করো না। আমি তোমাদের কাছে আমার নবী পাঠাবো। আমার সাথে তোমরা যেসব অঙ্গীকার করছো তারা সেসব তোমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে। আর তোমাদের প্রতি আমার কিতাব নাযিল করবো। এ কথায় সমস্ত মানুষ বলে ওঠেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমিই আমাদের রব, তুমিই আমাদের মাবুদ, তুমি ছাড়া আমাদের আর কোন রব ও মাবুদ নেই।”
কেউ কেউ এ ব্যাপারটিকে নিছক রূপক বা উপমা হিসেবে বর্ণিত একটি ব্যাপার মনে করে থাকেন। তাদের মতে এখানে কুরআন মজীদ কেবল একথাই বুঝাতে চায় যে, আল্লাহর রব হবার বিষয়টির স্বীকৃতি মানবিক প্রকৃতির মধ্যে নিহিত রয়েছে এবং এ কথাটি এখানে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে, যেন এটি বাস্তব জগতে অনুষ্ঠিত একটি ঘটনা ছিল। কিন্তু এ ব্যাখ্যাকে আমি সঠিক মনে করি না। কুরআন ও হাদীসে এটিকে একটি বাস্তব ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর শুধু ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেই শেষ করে দেয়া হয়নি বরং এ সঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন অনাদিকালের এ অঙ্গীকারটিকে মানুষের বিরুদ্ধে একটি দলীল ও প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হবে। কাজেই একে নিছক একটি রূপক বর্ণনা গণ্য করার কোন কারণ আমি দেখি না। আমার মতে, বাস্তবে যেমন বিভিন্ন ঘটনা ঘটে থাকে ঠিক তেমনিভাবে এ ঘটনাটিও ঘটেছিল। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত যেসব মানুষকে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, তাদের সবাইকে বাস্তবে একই সঙ্গে জীবন, চেতনা ও বাকশক্তি দান করে নিজের সামনে হাযির করেছিলেন এবং বাস্তবে তাদেরকে এ সত্যটি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত করেছিলেন যে, তাঁর মহান, পবিত্র ও উন্নত সত্তা ছাড়া তাদের আর কোন রব ও ইলাহ নেই এবং তাঁর বন্দেগী ও হুকুমের আনুগত্য (ইসলাম) ছাড়া তাদের জন্য আর কোন সঠিক জীবন বিধান নেই। এ সম্মেলন অনুষ্ঠানকে কোন ব্যক্তি যদি অসম্ভব মনে করে থাকে, তাহলে এটি নিছক তার চিন্তার পরিসরের সংকীর্ণতার ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যথায় বাস্তবে মানব সন্তানের বর্তমান পর্যায়ক্রমিক জন্ম ও বিকাশ যতটা সম্ভব, সৃষ্টির আদিতে তার সামষ্টিক আবির্ভাব ও অন্তে তার সামষ্টিক পুনরুত্থান ও সমাবেশ ঠিক ততটাই সম্ভবপর। তাছাড়া মানুষের মত একটি সচেতন, বুদ্ধিমান ও স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন সৃষ্টিকে পৃথিবীতে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্তির প্রাক্কালে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে প্রকৃত সত্য জানিয়ে দেয়া এবং তার কাছ থেকে নিজের পক্ষে বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার নিয়ে নেয়াটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হচ্ছে। এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটা মোটেই বিস্ময়কর নয়। বরং এ ধরনের একটা ঘটনা না ঘটলেই অবাক হতে হতো।
সুরা আনআম :-১৫৩ নং আয়াত
টিকা:১৩৫) যে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক অঙ্গীকারের কথা উল্লেখিত হয়েছে তার অনিবার্য দাবী হচ্ছে এই যে, মানুষ তার রবের দেখানো পথে চলবে। কারণ তার রবের নির্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং আত্মম্ভরিতা, স্বেচ্ছাচার ও অন্যের দাসত্বের পথে পা বাড়ানো মানুষের পক্ষ থেকে সে অঙ্গীকারের প্রাথমিক বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে পরিগণিত হবে। এরপর প্রতি পদক্ষেপে তার ধারাগুলো লংঘিত হতে থাকবে। এছাড়াও মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ প্রদত্ত পথ নির্দেশ গ্রহণ করে তাঁর দেখানো পথে জীবন যাপন করে না ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে এ অত্যন্ত নাজুক, ব্যাপক ও জটিল দায়িত্ব পালন করা কোনক্রমেই সম্ভবপর হয় না। আল্লাহ প্রদত্ত এ পথ নির্দেশ গ্রহণ না করার ফলে মানুষকে দু’টি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
এক, অন্য পথ অবলম্বন করার কারণে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র পথ থেকে মানুষ অনিবার্যভাবে সরে যায়।
দুই, এ সঠিক পথ থেকে সরে যাওয়ার সাথে সাথেই অসংখ্য সরু সরু পথ সামনে এসে যায়। এ পথগুলোয় চলতে গিয়ে দিক ভ্রান্ত হয়ে সমগ্র মানব সমাজ বিক্ষিপ্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মানব সমাজের এ বিপর্যয় ও বিক্ষিপ্ততা তার উন্নতি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির সুখ স্বপ্নকে চিরতরে ধুলিস্মাত করে দেয়।
এ দু’টি ক্ষতিকে এখানে নিম্নোক্ত বাক্যের মধ্যে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ “অন্য পথে চলো না, কারণ তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে সরিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে।” (সূরা আল মায়েদার ৩৫ টীকাটিও দেখুন)।
[[টিকা:৩৫) অর্থাৎ সে ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ পেয়ে আবার তা হারিয়ে ফেলেছে এবং ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয়েছে। ‘সাওয়া-উস-সাবীলের’ অনুবাদ করা যেতে পারে ‘সরল-সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পথ। ’ কিন্তু এরপরও তার পুরোপুরি অর্থ প্রকাশিত হয় না। তাই আয়াতের অনুবাদের সময় হুবুহু মূল শব্দটিই রাখাহয়েছে।
এ শব্দটির গভীর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য প্রথমেই এ কথাটি হৃদয়ংগম করে নিতে হবে যে, মানুষের অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছ একটি ছোটখাটো জগত। এ খুদে জগতটি অসংখ্য শক্তি ও যোগ্যতায় পরিপূর্ণ। ইচ্ছা, আকাংখা, আবেগ, অনুভূতি ও বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা এখানে বাসা বেঁধে আছে। দেহ ও প্রবৃত্তির বিভিন্ন দাবী এবং আত্মা ও মানবিক প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকার চাহিদার ভীড় এখানে সর্বক্ষণ। তারপর ব্যক্তি মানুষেরা একত্র হয়ে যে সমাজ কাঠামো নির্মাণ করে সেখানেও ঘটে অসংখ্য জটিল সম্পর্কের সমন্বয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশের সাথে সাথে এ জটিলতাও বেড়ে যেতে থাকে। এরপর সারা দুনিয়ায় মানুষের চারদিকে জীবন ধারণের যেসব উপকরণ ছড়িয়ে আছে সেগুলো কাজে লাগাবার এবং মানবিক প্রয়োজনে ও মানব সভ্যতার বিনির্মাণে সেগুলো ব্যবহার করার প্রশ্নও ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে অসংখ্য ছোট বড় সমস্যার জন্ম দেয়।
মানুষ তার সহজাত দুর্বলতার কারণে জীবনের এ সমগ্র কর্মক্ষেত্রটির ওপর একই সময়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টি দিতে পারে না। তাই মানুষ নিজেই নিজের জীবনের জন্য এমন কোন পথ তৈরী করতে পারে না যেখানে তার সমস্ত শক্তির সাথে পুরোপুরি ইনসাফ করা যেতে পারে, যেখানে তার সমস্ত ইচ্ছা ও আশা-আকাংখা যথাযথভাবে পূর্ণ করা যায়, তার সমস্ত আবেগ, অনুভূতি ও প্রবণতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, একটি ন্যায়ানুগ সমতা রক্ষা করে তার ভেতরের ও বাইরের সমস্ত চাহিদা ও দাবী পূরণ করা যায়, তার সমাজ জীবনের সমস্ত সমস্যার প্রতি যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ করে তাদের সুষ্ঠু সমাধান বের করা যায় এবং জড় বস্তুগুলোকেও, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ন্যায়, ইনসাফ, সমতা, ভারসাম্য ও সত্যনিষ্ঠা সহকারে ব্যবহার করা যায়। মানুষ নিজেই যখন নিজের নেতা ও বিধাতায় পরিণত হয় তখন সত্যের বিভিন্ন দিকের মধ্য থেকে কোন একটি দিক, জীবনের প্রয়োজনের মধ্য থেকে কোন একটি প্রয়োজন, সমাধান প্রত্যাশী সমস্যাগুলোর কোন একটি সমস্যা তার মস্তিষ্ক ও চিন্তা জগতকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে, অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যাগুলোর সাথে সে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বে-ইনসাফী করতে থাকে। তখন তার এ সিদ্ধান্তকে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠিত করার ফলে জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সে ভারসাম্যহীনতার কোন এক প্রান্তের দিকে বাঁকাভাবে চলতে থাকে। তারপর এভাবে চলতে চলতে বক্রতার শেষ প্রান্তে পৌঁছার আগেই তা মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। ফলে যে সমস্ত দিক, প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে বে-ইনসাফী করা হয়েছিল তারা বিদ্রোহ শুরু করে দেয় এবং তাদের সাথে ইনসাফ করার জন্য তারা চাপ দিতে থাকে। কিন্তু এরপরও ইনসাফ হয় না। কারণ আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। অর্থাৎ আগের ভারসাম্যহীনতার কারণে যেগুলোকে সবচেয়ে বেশী দাবিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে কোন একটি মানুষের মস্তিষ্ক ও চিন্তা জগতকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং একটি বিশেষ দাবী অনুযায়ী একটি বিশেষ দিকে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এখানে আবার অন্যান্য দিক, প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে বে-ইনসাফী হতে থাকে। এভাবে সরল সোজা পথে চলা মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব হয় না। সবসময়ই সে ঢেউয়ের দোলায় দোদুল্যমান থাকে এবং ধ্বংসের এক কিনার থেকে আর এক কিনারে তাকে ঠেলে দেয়া হয়। মানুষ নিজের জীবন ক্ষেত্রে চলার জন্য যতগুলো পথ তৈরী করেছে সবই বক্র রেখার মতো। একটি ভুল প্রান্তে গিয়ে তার চলা শেষ হয়। আবার সেখান থেকে যখন চলা শুরু করে তখন কোন ভুল দিকেই এগিয়ে চলে।
এ অসংখ্য বক্র ও ভুল পথের মধ্য দিয়ে এমন একটি পথ চলে গেছে যার অবস্থান ঠিক মধ্যভাগে। এ পথে মানুষের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য, প্রবণতা, আশা-আকাংখা, আবেগ, অনুভূতি, তার দেহ ও আত্মার সমস্ত দাবী ও চাহিদা এবং তার জীবনের যাবতীয় সমস্যার সাথে পূর্ণ ইনসাফ করা হয়েছে। এ পথে কোন প্রকার বক্রতার লেশ মাত্র নেই। কোন দিকের প্রতি অযথা পক্ষপাতিত্ব ও তাকে সুযোগ-সুবিধা দান এবং কোন দিকের সাথে জুলুম ও বেইনসাফী করার প্রশ্নই এখানে নেই। মানুষের জীবনের সঠিক উন্নয়ন, ক্রমবিকাশ এবং তার সাফল্য ও অগ্রগতির জন্য এ ধরনের একটি পথ একান্ত অপরিহার্য। মানুষের মূল প্রকৃতি এ পথেরই সন্ধানে ফিরছে। এ সোজা সরল রাজপথটির অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকার কারণেই তার বিভিন্ন বক্র পথের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু নিজের চেষ্টায় এ রাজপথের সন্ধান লাভ করার ক্ষমতা মানুষের নেই। একমাত্র আল্লাহই তাকে এ পথের সন্ধান দিতে পারেন। মানুষকে এ পথের সন্ধান দেবার জন্যই আল্লাহ তাঁর রসূল পাঠিয়েছেন।
কুরআন এ পথকেই ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ ও ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ আখ্যা দিয়েছে। দুনিয়ার এ জীবন থেকে নিয়ে আখেরাতের জীবন পর্যন্ত অসংখ্য বক্র পথের মধ্য দিয়ে এ সরল সোজা রাজপথটি চলে গেছে। যে ব্যক্তি এ পথে অগ্রসর হয়েছে সে এ দুনিয়ায়ও সঠিক পথের যাত্রী এবং আখেরাতেও সফলকাম হয়েছে। আর যে ব্যক্তি এ পথ হারিয়ে ফেলেছে সে এখানে বিভ্রান্ত হয়েছে, ভুল পথে চলেছে এবং আখেরাতেও অনিবার্যভাবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। কারণ, জীবনের সমস্ত বক্র পথ জাহান্নামের দিকেই চলে গেছে।
আধুনিক যুগের কতিপয় অজ্ঞ দার্শনিক মানুষকে উপযুর্পরি এক প্রান্তিকতা থেকে আর এক প্রান্তিকতার দিকে ধেয়ে চলতে দেখে এ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া(ialectic Process) মানব জীবনের উন্নতি, অগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক পথ। নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে তারা এ ধারণা করে বসেছেন যে, প্রথমে একটি চরমপন্থী দাবী (Thesis) মানুষকে একদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপর এর প্রতিক্রিয়ায় একই পর্যায়ের আরেকটি চরম ভাবাপন্ন দাবী (Antithesis) তাকে আর এক প্রান্তে ঠেলে নিয়ে যায়। আর এরপর তাদের উভয়ের মিশ্রণে (Synthesis) জীবনের অগ্রগতি ও বিকাশের পথ তৈরী হয়। তাদের মতে এটিই হচ্ছে মানব জীবনের ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশের পথ। অথচ এটি মোটেই ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতির পথ নয়। বরং এ হচ্ছে দুর্ভাগ্যের ধাক্কা, যা মানুষের জীবনের সঠিক পথে পরিচালিত করার এবং তার যথার্থ ক্রমবিকাশের পথে বারবার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। প্রত্যেকটি চরমপন্থী ও প্রান্তিকতাবাদী জীবনকে কোন একটি লক্ষ্যের দিকে চালিত করে এবং তাকে টেনে নিয়ে চলে। এভাবে চলতে চলতে যখন সে ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ থেকে অনেক দূরে সরে যায় তখন জীবনেরই অপর কতকগুলো উপেক্ষিত সত্য, যাদের সাথে বেইনসাফী করা হচ্ছিল, তারাই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে। এ বিদ্রোহ একটি পাল্টা দাবীর আকারে আত্মপ্রকাশ করে তাকে উল্টো দিকে টানতে থাকে। ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ যত কাছে আসতে থাকে ততই এ সংঘর্ষশীল দাবীগুলোর মধ্যে আপোস হতে থাকে এবং তাদের মিশ্রণে এমন কিছু জিনিস অস্তিত্বলাভ করে যা মানুষের জীবনের জন্য উপকারী ও লাভজনক। কিন্তু যখন সেখানে ‘সাওয়া-উস-সাবীলের’ সন্ধান দেয়ার মতো আলো থাকে না এবং তার ওপর অবিচল থাকার মতো ঈমানেরও অস্তিত্ব থাকে না তখন এ পাল্টা দাবী জীবনকে সেই স্থানে টিকে থাকতে দেয় না বরং নিজের শক্তির জোরে তাকে বিপরীত প্রান্তিকতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত জীবনের অন্য কিছু সত্যকে অস্বীকার করার পর্ব শুরু হয়ে যায়। এর ফলে আর একটা বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এসব সংকীর্ণ দৃষ্টির অধিকারী দার্শনিকদের মধ্যে যদি কুরআনের আলো পৌঁছে গিয়ে থাকতো এবং তারা ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ কি জিনিস তা দেখতে পেতেন। তাহলে তারা জানতে পারতেন, এ ‘সাওয়া-উস-সাবীল’ই মানুষের জন্য একমাত্র সঠিক ও নির্ভুল পথ। বক্র রেখায় ক্রমাগত এক প্রান্তিকতা থেকে আর এক প্রান্তিকতায় ধাক্কা খেয়ে বেড়ানো মানব জীবনের ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশের কোন সঠিক ও নির্ভুল পথ নয়।]]
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Anam
Sura:6
Verses :- 151-153
قُلۡ تَعَالَوۡا اَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّکُمۡ عَلَیۡکُم
Ten Commandments
Say:”Come, I will recite what your Lord has prohibited you from:- ”
Ten Commandments
Dawud Al-Awdy narrated that, Ash-Sha`bi said that, Alqamah said that Ibn Mas`ud said,
“Whoever wishes to read the will and testament of the Messenger of Allah on which he placed his seal, let him read these Ayat,
قُلْ تَعَالَوْاْ أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْيًا
Say:”Come, I will recite what your Lord has prohibited you from:Join not anything in worship with Him…”) until,
لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
(…so that you may have Taqwa.” (6:153)
In his Mustadrak, Al-Hakim recorded that Ibn Abbas said,
“In Surah Al-An`am, there are clear Ayat, and they are the Mother of the Book (the Qur’an).”
He then recited,
قُلْ تَعَالَوْاْ أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ
Say:”Come, I will recite what your Lord has prohibited you from…”
Al-Hakim said,
“Its chain is Sahih, and they did not record it.”
In his Mustadrak Al-Hakim also recorded that Ubadah bin As-Samit said,
“The Messenger of Allah said,
أَيُّكُمْ يُبَايِعُنِي عَلَى ثَلَث
Who among you will give me his pledge to do three things.
He then recited the Ayah,
قُلْ تَعَالَوْاْ أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ
Say:”Come, I will recite what your Lord has prohibited you from…” until the end of the Ayat.
He then said,
فَمَنْ وَفَى فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ وَمَنِ انْتَقَصَ مِنْهُنَّ شَيْيًا فَأَدْرَكَهُ اللهُ بِهِ فِي الدُّنْيَا كَانَتْ عُقُوبَتهُ وَمَنْ أَخَّرَ إِلَى الاْخِرَةِ فَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْه
Whoever fulfills (this pledge), then his reward will be with Allah, but whoever fell into shortcomings and Allah punishes him for it in this life, then that will be his recompense. Whoever Allah delays (his reckoning) until the Hereafter, then his matter is with Allah. If He wills, He will punish him, and if He wills, He will forgive him.”
Al-Hakim said, “Its chain is Sahih and they did not record it.”
As for the explanation of this Ayah, Allah said to His Prophet and Messenger Muhammad:
Say, O Muhammad, to those idolators who worshipped other than Allah, forbade what Allah provided them with and killed their children, following their opinions and the lures of the devils,’
قُلْ
Say, (to them),
تَعَالَوْاْ
Come, (come here, come close),
أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ
I will recite what your Lord has prohibited you from.
meaning, I will inform you about what your Lord has forbidden for you in truth, not guessing or wishful thinking. Rather, it is revelation and an order from Him.
Shirk is Forbidden
Allah said,
أَلاَّ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْيًا
Join not anything in worship with Him;
this Allah has ordained, for He said at the end of the Ayah,
ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
(This He has commanded you that you may understand).
In the the Two Sahihs, it is recorded that Abu Dharr said that the Messenger of Allah said,
أَتَانِي جِبْرِيلُ فَبَشَّرَنِي أَنَّهُ مَنْ مَاتَ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْيًا مِنْ أُمَّتِكَ دَخَلَ الْجَنَّةَ
Jibril came to me and conveyed the good news that, “Whoever among your followers dies, worshipping none along with Allah, will enter Paradise.”
قُلْتُ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ
I said, “Even if he stole or committed illegal sexual intercourse!”
قَالَ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ
He said, “Even if he stole or committed illegal sexual intercourse.”
قُلْتُ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ
I said, “Even if he stole or committed illegal sexual intercourse!”
قَالَ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ
He said, “Even if he stole or committed illegal sexual intercourse.”
قُلْت وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ
I said, “Even if he stole or committed illegal sexual intercourse!”
قَالَ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ وَإِنْ شَرِبَ الْخَمْر
He said, “Even if he stole or committed illegal sexual intercourse or even if drank alcohol.”
Some of the Musnad and Sunan compilers recorded that Abu Dharr said that the Messenger of Allah said,
يَقُولُ تَعَالَى يَا ابْنَ ادَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي فَإِنِّي أَغْفِرُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ مِنْكَ وَلَا أُبَالِي وَلَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الاَْرْضِ خَطِييَةً أَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً مَا لَمْ تُشْرِكْ بِي شَيْيًا وَإِنْ أَخْطَأْتَ حَتَّى تَبْلُغَ خَطَاَياكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَك
Allah said, `O Son of Adam! As long as you supplicate to Me and hope of Me, I will forgive whatever you committed, and it will be easy for Me to do that. And even if you brought the earth’s fill of sins to Me, I will bring forth its fill of forgiveness, as long as you do not associate anything or anyone in worship with Me. And even if you err and your errors accumulate until they reach the boundaries of the sky and you then ask Me for forgiveness, I will forgive you.’
This subject is also mentioned in the Qur’an, for Allah said,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَن يَشَأءُ
Verily, Allah forgives not (the sin of) setting up partners (in worship) with Him, but He forgives whom He wills, sins other than that. (4:116)
Muslim recorded a Hadith in the Sahih that reads,
مَنْ مَاتَ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْيًا دَخَلَ الْجَنَّـة
Whoever dies associating none with Allah will enter Paradise.
There are many Ayat and Hadiths on this subject.
The Order for Kindness to Parents
Allah said next,
وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
be kind and dutiful to your parents;
meaning, Allah has commanded and ordered you to be kind to your parents.
Allah said in another Ayah,
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّـهُ وَبِالْوَلِدَيْنِ إِحْسَـناً
And your Lord has decreed that you worship none but Him. And that you be dutiful to your parents. (17:23)
Allah often mentions obeying Him and being dutiful to parents together.
Allah said,
وَوَصَّيْنَا الاِنْسَـنَ بِوَلِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِى عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِى وَلِوَلِدَيْكَ إِلَىَّ الْمَصِيرُ
وَإِن جَـهَدَاكَ عَلَى أَن تُشْرِكَ بِى مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَ تُطِعْهُمَا وَصَـحِبْهُمَا فِى الدُّنْيَا مَعْرُوفاً وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَىَّ ثُمَّ إِلَىَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّيُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
Give thanks to Me and to your parents. Unto Me is the final destination. But if they (both) strive with you to make you join in worship with Me others that of which you have no knowledge, then obey them not; but behave with them in this world kindly, and follow the path of him who turns to Me in repentance and in obedience. Then to Me will be your return, and I shall tell you what you used to do. (31:14-15)
Therefore, Allah ordered children to be dutiful and kind to their parents, even if they were idolators.
Allah also said,
وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَـقَ بَنِى إِسْرءِيلَ لَا تَعْبُدُونَ إِلاَّ اللَّهَ وَبِالْوَلِدَيْنِ إِحْسَانًا
And (remember) when We took a covenant from the Children of Israel, (saying):Worship none but Allah and be dutiful and kind to parents. (2:83)
There are several Ayat on this subject.
It is recorded in the Two Sahihs that Ibn Mas`ud said,
“I asked Allah’s Messenger about which deed is the best. He said,
الصَّلَةُ عَلَى وَقْتِهَا
The prayer, when it is performed on time.
I said, `Then.’
He said,
بِرُّ الْوَالِدَيْن
Being dutiful to parents.
I asked, `Then.’
He said,
الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ الله
Jihad in Allah’s cause.
Ibn Mas`ud said,
“The Messenger of Allah said these words to me, and had I asked him for more, he would have said more.”
Killing Children is Forbidden
Allah said,
وَلَا تَقْتُلُواْ أَوْلَادَكُم مِّنْ إمْلَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ
Kill not your children because of poverty, We shall provide sustenance for you and for them.
After Allah commanded kindness to parents and grandparents, He next ordered kindness to children and grandchildren. Allah said,
وَلَا تَقْتُلُواْ أَوْلَادَكُم مِّنْ إمْلَقٍ
(kill not your children because of poverty), because the idolators used to kill their children, obeying the lures of the devils. They used to bury their daughters alive for fear of shame, and sometimes kill their sons for fear of poverty.
It is recorded in the Two Sahihs that Abdullah bin Mas`ud said,
“I asked the Messenger of Allah, `Which sin is the biggest?’
He said,
أَنْ تَجْعَلَ للهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَك
To call a rival for Allah, while He Alone created you.
I said, `Then what?’
He said,
أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ خَشْيَةَ أَنْ يَطْعَمَ مَعَك
To kill your son for fear that he might share your food.
I said, `Then what?’
He said,
أَنْ تُزَانِي حَلِيلَةَ جَارِك
To commit adultery with your neighbor’s wife.
Then the Messenger of Allah recited the Ayah,
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَـهَا ءَاخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ
And those who invoke not any other god along with Allah, nor kill such person as Allah has forbidden, except for just cause, nor commit illegal sexual intercourse…” (25:68)
Allah’s statement,
مِّنْ إمْلَقٍ
(Because of Imlaq),
According to Ibn Abbas, Qatadah, As-Suddi and others,
refers to poverty.
The Ayah means, do not kill your children because you are poor.
Allah said in Surah Al-Isra’,
وَلَا تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلقٍ
(And do not kill your children for fear from Imlaq). (17:31) that is, do not kill your children for fear that you might become poor in the future. This is why Allah said,
نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُم
(We shall provide sustenance for them and for you) (17:31) thus mentioning the provision of the children first, meaning, do not fear poverty because of feeding your children. Certainly, their provision is provided by Allah.
Allah said,
نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ
(We provide sustenance for you and for them), thus starting with parents, because this is the appropriate subject here and Allah knows.
Allah said next,
وَلَا تَقْرَبُواْ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ
Come not near Al-Fawahish (immoral sins) whether committed openly or secretly.
Allah said in a similar Ayah,
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالاِثْمَ وَالْبَغْىَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُواْ بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَـناً وَأَن تَقُولُواْ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ
Say:”(But) the things that my Lord has indeed forbidden are Al-Fawahish (immoral sins) whether committed openly or secretly, sins (of all kinds), unrighteous oppression, joining partners (in worship) with Allah for which He has given no authority, and saying things about Allah of which you have no knowledge.” (7:33)
We also explained this meaning in the explanation of the Ayah,
وَذَرُواْ ظَاهِرَ الاِثْمِ وَبَاطِنَهُ
(Leave sin, open and secret), (6:120).
The Two Sahihs recorded that Ibn Mas`ud said that the Messenger of Allah said,
لَاا أَحَدٌ أَغْيَرَ مِنَ اللهِ مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ حَرَّمَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَن
None is more jealous than Allah. This is why He has forbidden the immoral sins committed openly or secretly.
Abdul-Malik bin Umayr said that Warrad narrated that Al-Mughirah said that Sa`d bin Ubadah said,
“If I see a man with my wife (committing adultery), I will kill him with the sword.”
When the matter came to the Messenger of Allah, he said,
أَتَعْجَبُونَ مِنْ غَيْرةِ سَعْدٍ فَوَاللهِ لَاَنَا أَغْيَرُ مِنْ سَعْدٍ وَاللهُ أَغْيَرُ مِنِّي مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ حَرَّمَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَن
Do you wonder at Sa`d’s jealousy By Allah, I am more jealous than Sa`d, and Allah is more jealous than I. This is why He has forbidden the immoral sins committed openly and in secret.
This Hadith is in the Two Sahihs.
The Prohibition of Unjustified Killing
Allah said,
وَلَا تَقْتُلُواْ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ
And kill not anyone whom Allah has forbidden, except for a just cause (according to Islamic law).
This part of the Ayah emphasizes this prohibition in specific, although it is included in the immoral sins committed openly and in secret.
In the Two Sahihs, it is recorded that Ibn Mas`ud said that the Messenger of Allah said,
لَاا يَحِلُّ دَمُ امْرِىءٍ مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لَاا إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ إِلاَّ بِإِحْدَى ثَلَاثٍ الثَّيِّبُ الزَّانِي وَالنَّفْسُ بِالنَّفْسِ وَالتَّارِكُ لِدِينِهِ الْمُفَارِقُ لِلْجَمَاعَة
The blood of a Muslim person who testifies that there is no deity worthy of worship except Allah and that I am the Messenger of Allah is prohibited, except for three offenses:a married person who commits illegal sexual intercourse, life for life, and whoever reverts from the religion and abandons the Jama`ah (the community of faithful believers).
There is a prohibition, a warning and a threat against killing the Mu`ahid, i.e., non-Muslims who have a treaty of peace with Muslims.
Al-Bukhari recorded that Abdullah bin `Amr said that the Prophet said,
مَنْ قَتَلَ مُعَاهِدًا لَمْ يَرَحْ رَايِحَةَ الْجَنَّةِ وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ أَرْبَعِينَ عَامًّا
Whoever killed a person having a treaty of protection with Muslims, shall not smell the scent of Paradise, though its scent is perceived from a distance of forty years.
Abu Hurayrah narrated that the Prophet said,
مَنْ قَتَلَ مُعَاهِدًا لَهُ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ فَقَدْ أَخْفَرَ بِذِمَّةِ اللهِ فَلَ يَرَحْ رَايِحَةَ الْجَنَّةِ وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ سَبْعِينَ خَرِيفًا
Whoever killed a person having a treaty of protection with the Muslims, and who enjoys the guarantee of Allah and His Messenger, he will have spoiled the guarantee of Allah (for him). He shall not smell the scent of Paradise though its smell is perceived from a distance of seventy years.
Ibn Majah and At-Tirmidhi recorded this Hadith, and At-Tirmidhi said, “Hasan Sahih.”
Allah’s statement,
ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
This He has commanded you that you may understand.
means, this is what He has commanded you that you may comprehend His commandments and prohibitions.
The Prohibition of Consuming the Orphan’s Property
Allah said;
وَلَا تَقْرَبُواْ مَالَ الْيَتِيمِ إِلاَّ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ
“And come not near to the orphan’s property, except to improve it, until he (or she) attains the age of full strength;
Ata bin As-Sa’ib said that Sa`id bin Jubayr said that Ibn Abbas said,
“When Allah revealed,
وَلَا تَقْرَبُواْ مَالَ الْيَتِيمِ إِلاَّ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
(And come not near to the orphan’s property, except to improve it). and,
إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا
(Verily, those who unjustly eat up the property of orphans) (4:10) those who were guardians of orphans separated their food from the orphans’ food and their drink from their drink. When any of that food or drink remained, they used to keep it for the orphan until he or she ate it or it spoiled. This became difficult for the companions and they talked about it to the Messenger of Allah, and Allah sent down the Ayah,
وَيَسْـَلُونَكَ عَنِ الْيَتَـمَى قُلْ إِصْلَحٌ لَّهُمْ خَيْرٌ وَإِن تُخَالِطُوهُمْ فَإِخْوَنُكُمْ
And they ask you about orphans. Say:”The best thing is to work honestly in their property, and if you mix your affairs with theirs, then they are your brothers.” (2:220)
Thereafter, they mixed their food and drink with food and drink of the orphans.”
Abu Dawud collected this statement.
Allah’s statement,
حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ
(until he (or she) attains the age of full strength);
According to Ash-Sha`bi, Malik and several others among the Salaf,
refers to reaching the age of adolescence.
The Command to Give Full Measure and Full Weight with Justice
Allah’s statement,
وَأَوْفُواْ الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ
and give full measure and full weight with justice.
is a command to establish justice while giving and taking.
Allah has also warned against abandoning this commandment, when He said,
وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِينَ
الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُواْ عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ
وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَّزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ
أَلا يَظُنُّ أُوْلَـيِكَ أَنَّهُمْ مَّبْعُوثُونَ
لِيَوْمٍ عَظِيمٍ
يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَـلَمِينَ
Woe to Al-Mutaffifin. Those who, when they have to receive by measure from men, demand full measure. And when they have to give by measure or weight to (other) men, give less than due. Do they not think that they will be resurrected (for reckoning). On a Great Day The Day when (all) mankind will stand before the Lord of all that exists. (83:1-6)
Allah destroyed an entire nation that was accustomed to giving less in weights and measures.
Allah said next,
لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلااَّ وُسْعَهَا
We burden not any person, but that which he can bear.
that is, whoever strives while pursuing his rights and giving other peoples’ full rights, then there is no sin on him if he commits an honest mistake after trying his best and striving to do what is right.
The Order for Just Testimony
Allah said;
وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُواْ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى
And whenever you give your word, say the truth even if a near relative is concerned.
This is similar to His statement,
يَـأَيُّهَأ الَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ للَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ
O you who believe! Stand out firmly for Allah as just witnesses. (5:8)
And there is a similar Ayah in Surah An-Nisa’.
So Allah commands justice in action and statement, with both near relatives and distant relatives. Indeed, Allah orders justice for everyone at all times and in all situations.
Fulfilling the Covenant of Allah is an Obligation
Allah said next,
وَبِعَهْدِ اللّهِ أَوْفُواْ
and fulfill the Covenant of Allah.
Ibn Jarir commented,
“Allah commands:Fulfill Allah’s commandments that He has ordered you. You will do so when you obey Him in what He commanded, refrain from what He prohibited and abide by His Book and the Sunnah of His Messenger. This constitutes fulfilling the covenant of Allah.
ذَلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
This He commands you, that you may remember.
Allah says here, that this is what He has ordered and commanded, and He stressed its importance for you,
لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
(…that you may remember), that you may be advised and thus refrain from what you used to do before this.
The Command to Follow Allah’s Straight Path and to Avoid All Other Paths
Allah says;
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ
ذَلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“And verily, this is My straight path, so follow it, and follow not (other) paths, for they will separate you away from His path. This He has ordained for you that you may have Taqwa.”
Ali bin Abi Talhah reported that Ibn Abbas commented on Allah’s statements,
وَلَا تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ
(And follow not (other) paths, for they will separate you away from His path.), and,
أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
(Saying) that you should establish religion and make no divisions in it), (42:13) and similar Ayat in the Qur’an,
“Allah commanded the believers to adhere to the Jama`ah and forbade them from causing divisions and disputes. He informed them that those before them were destroyed because of divisions and disputes in the religion of Allah.”
Similar was said by Mujahid and several others.
Imam Ahmad bin Hanbal recorded that Abdullah bin Mas`ud said,
“The Messenger of Allah drew a line with his hand (in the sand) and said,
هَذَا سَبِيلُ اللهِ مُسْتَقِيمًا
This is Allah’s path, leading straight.
He then drew lines to the right and left of that line and said,
هَذِهِ السُّبُلُ لَيْسَ مِنْهَا سَبِيلٌ إِلاَّ عَلَيْهِ شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْه
These are the other paths, on each path there is a devil who calls to it.
He then recited,
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ
And verily, this is My straight path, so follow it, and follow not (other) paths, for they will separate you away from His path.”
Al-Hakim also recorded this Hadith and said; “Its chain is Sahih, but they did not record it.”
Imam Ahmad and Abd bin Humayd recorded (and this is the wording of Ahmad) that Jabir said;
“We were sitting with the Prophet when he drew a line in front of him and said,
هَذَا سَبِيلُ الله
This is Allah’s path.
He also drew two lines to its right and two lines to its left and said,
هَذِهِ سُبُلُ الشَّيْطَان
These are the paths of Shaytan.
He then placed his hand on the middle path and recited this Ayah;
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ
ذَلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
And verily, this is My straight path, so follow it, and follow not (other) paths, for they will separate you away from His path. This He has ordained for you that you may have Taqwa.
Imam Ahmad, Ibn Majah, in the Book of the Sunnah in his Sunan, and Al-Bazzar collected this Hadith.
Ibn Jarir recorded that;
a man asked Ibn Mas`ud, “What is As-Sirat Al-Mustaqim (the straight path)?”
Ibn Mas`ud replied,
“Muhammad left us at its lower end and its other end is in Paradise. To the right of this Path are other paths, and to the left of it are other paths, and there are men (on these paths) calling those who pass by them. Whoever goes on the other paths will end up in the Fire. Whoever takes the Straight Path, will end up in Paradise.”
Ibn Mas`ud then recited the Ayah;
وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ
And verily, this is My straight path, so follow it, and follow not (other) paths, for they will separate you away from His path.'”
Imam Ahmad recorded that, An-Nawwas bin Sam`an said that the Messenger of Allah said,
ضَرَبَ اللهُ مَثَلً صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا وَعَنْ جَنْبَي الصِّرَاطِ سُورَانِ فِيهِمَا أَبْوَابٌ مُفَتَّحَةٌ
Allah has given a parable of the straight path, and on the two sides of this path, there are two walls containing door ways.
وَعَلَى الاَْبْوَابِ سُتُورٌ مُرْخَاةٌ وَعَلَى بَابِ الصِّرَاطِ دَاعٍ يَدْعُو يَا أَيَّهَا النَّاسُ هَلُمُّوا ادْخُلُوا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
On these door ways, there are curtains that are lowered down. on the gate of this path there is a caller heralding, `O people! come and enter the straight path all together and do not divide.’
وَدَاعٍ يَدْعُو مِنْ فَوْقِ الصِّرَاطِ فَإِذَا أَرَادَ الاِنْسَانُ أَنْ يَفْتَحَ شَيْيًا مِنْ تِلْكَ الاَْبْوَابِ قَالَ وَيْحَكَ لَا تَفْتَحْهُ فَإِنَّكَ إِنْ فَتَحْتَهُ تَلِجْهُ
There is also another caller that heralds from above the path, who says when a person wants to remove the curtain on any of these doors, `Woe to you! Do not open this door, for if you open it, you will enter it.
فَالصِّرَاطُ الاِسْلَامُ وَالسُّورَانِ حُدُودُ اللهِ وَالاْاَبْوَابُ الْمُفَتَّحَةُ مَحَارِمُ اللهِ وَذَلِكَ الدَّاعِي عَلَى رَأْسِ الصِّرَاطِ كِتَابُ اللهِ وَالدَّاعِي مِنْ فَوْقِ الصِّرَاطِ وَاعِظُ اللهِ فِي قَلْبِ كُلِّ مُسْلِم
The (straight) path is Islam, the two walls are Allah’s set limits, the open doors lead to Allah’s prohibitions, the caller on the gate of the path is Allah’s Book (the Qur’an), while the caller from above the path is Allah’s admonition in the heart of every Muslim.
At-Tirmidhi and An-Nasa’i also recorded this Hadith, and At-Tirmidhi said, “Hasan Gharib.”
Allah’s statement,
فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ
(so follow it, and follow not (other) paths…),
describes Allah’s path in the singular sense, because truth is one. Allah describes the other paths in the plural, because they are many and are divided.
Allah said in another Ayah,
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ ءامَنُواْ يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَـتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ أَوْلِيَأوُهُمُ الطَّـغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَـتِ أُوْلَـيِكَ أَصْحَـبُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَـلِدُونَ
Allah is the Wali (Protector or Guardian) of those who believe. He brings them out from darknesses into light. But as for those who disbelieve, their supporters are Taghut (false deities), they bring them out from light into darknesses. Those are the dwellers of the Fire, and they will abide therein forever. (2:257).
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর শেষ অসিয়তের প্রতি লক্ষ্য করতে চায় সে যেন উল্লিখিত আয়াতগুলো পাঠ করে । হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সূরায়ে আন’আমে কতগুলো আয়াত রয়েছে স্পষ্ট মর্ম বিশিষ্ট এবং ঐগুলোই হচ্ছে কিতাবের মূল। অতঃপর তিনি (আরবী) -এই আয়াতটি পাঠ করেন। হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কে আমাদের কাছে তিনটি কাজের দীক্ষা গ্রহণ করবে?’ অতঃপর তিনি উক্ত আয়াত পাঠ করলেন। পাঠ শেষ করে তিনি বললেনঃ “যে ব্যক্তি এই কথাগুলো যথাযথভাবে পালন করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে রয়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এগুলো পালনে অবহেলা করবে, খুব সম্ভব আল্লাহ তাকে দুনিয়াতেই শাস্তি প্রদান করবেন। আর যদি তিনি শাস্তিটাকে পরকাল পর্যন্ত উঠিয়ে রাখেন তবে তখন তাঁর মর্জির উপর নির্ভর করবে। ইচ্ছা করলে তিনি তাকে শাস্তি দিবেন, অথবা ক্ষমা করে দিবেন।” এর তাফসীর নিম্নরূপঃ আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেছেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ) ! এই মুশরিকদেরকে বলে দাও, যারা গায়রুল্লাহর উপাসনা করছে এবং আল্লাহর হালাল জিনিসকে হারাম করে নিচ্ছে, আর নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করছে। তাদেরকে শয়তান বিভ্রান্ত করেছে এবং তারা মনগড়া কথা বলছে, (তাদেরকে বলঃ) এসো, আমি তোমাদেরকে বলে দেই যে, আল্লাহ কোন্ জিনিসগুলোকে হারাম করেছেন। আমি এসব কথা ধারণা ও অনুমান করে বলছি না, বরং আল্লাহ আমার কাছে যে অহী করেছেন সেই অনুযায়ীই বলছি যে, তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকেও শরীক বানিয়ে নিও না। আয়াতের ভাষার ধরনে বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে (আরবী) শব্দটি উহ্য রয়েছে, অর্থাৎ (আরবী) এইরূপ রয়েছে। এজন্যেই আয়াতের শেষে রয়েছে (আরবী) অর্থাৎ এসব বিষয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা অনুধাবন করতে পার।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে এসে এ সংবাদ দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি শিরক না করা অবস্থায় মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” আমি বললামঃ যদিও সে ব্যভিচার করে অথবা চুরি করে তবুও কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ ‘হ্যা, যদিও সে ব্যভিচার করে অথবা চুরি করে। আমি তিনবার এই প্রশ্ন করি। প্রতিবারেই তিনি এই উত্তরই দেন এবং তৃতীয়বারে বলেনঃ “যদিও সে ব্যভিচার করে, অথবা চুরি করে এবং মদ্যপান করে (তবুও সে জান্নাতে প্রবেশ করবে)। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তিনবার প্রশ্নকারী ছিলেন স্বয়ং হযরত আবু যার (রাঃ)।
তৃতীয়বারে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবু যার (রাঃ)-কে বলেছিলেনঃ “হ্যাঁ, আবু যার (রাঃ)-এর নাক ধূলায় ধূসরিত হাক, যদিও সে ব্যভিচার করে থাকে বা চুরি করে থাকে (তবুও জান্নাতে যাবে)।” হযরত আবু যার (রাঃ) যখনই এ হাদীসটি শুনাতেন তখনই হাদীসটি পূর্ণরূপে বর্ণনা করার পর “আবু যার (রাঃ)-এর নাক ধূলায় ধূসরিত হাক” এ কথাটিও অবশ্যই বলতেন।
হযরত আবু যার (রাঃ) হতে আরও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন- “হে আদম সন্তান! যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমার কাছে দুআ করবে এবং আমার কাছে আশা করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাকে ক্ষমা করতে থাকবো যা কিছু গুনাহ তোমার দ্বারা হবে। আর আমি তোমার পাপরাশিকে মোটেই গ্রাহ্য করবো না। তুমি যদি আমার কাছে পৃথিবীপূর্ণ পাপরাশি নিয়ে আসো তবে আমি তোমাকে পৃথিবীপূর্ণ ক্ষমা প্রদান করবো, যদি তুমি আমার সাথে কাউকেও শরীক না করে থাক। যদি তোমার পাপরাশি আকাশ ভর্তিও হয় এবং তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর তবে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো।”
কুরআন কারীমে এর সাক্ষ্য মিলে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ শিবৃকের পাপ ক্ষমা করবেন না, অন্যসব পাপ তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন।” সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকেও শরীক না করে মারা গেল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ সম্পৰ্কীয় কুরআনের আয়াত এবং হাদীস বহু রয়েছে। হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “তোমরা শিরক করো না যদিও তোমাদেরকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয় বা শূলে চড়ানো হয় অথবা আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।” হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে সাতটি খাসলাতের বা অভ্যাসের অসিয়ত করেছিলেন। (তন্মধ্যে একটি এই যে,) তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকেও শরীক করবে না, যদিও তোমাদেরকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়, কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয় এবং শূলে চড়ানো হয়।” (হাদীসটি ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) ও ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ইরশাদ হচ্ছে- (আরবী) অর্থাৎ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। ভাবার্থ হচ্ছে-আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার সাথে সৎ ও উত্তম ব্যবহার করবে। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রভু তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করবে।” (১৭:২৩) আল্লাহ পাক সাধারণ ভাবে নিজের আনুগত্যের সাথে সাথে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। যেমন বলেছেনঃ “আমার এবং স্বীয় পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তোমাদেরকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। আর যদি তারা উভয়ে তোমাকে এ কথার চাপ দেয় যে, তুমি আমার সাথে কোন বস্তুকে শরীক সাব্যস্ত কর, যার (উপাস্য হওয়ার) পক্ষে তোমার কাছে কোন প্রমাণ নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং পার্থিব বিষয়ে সদ্ভাবে সাহচর্য করে যাবে, আর ঐ ব্যক্তির পথে চলবে যেই ব্যক্তি আমার দিকে রুজু হয় (ফিরে আসে), অনন্তর আমার দিকে তোমাদের ফিরে আসতে হবে । অতঃপর পিতা-মাতার মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের অবস্থা হিসেবে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ আল্লাহ প্রদান করলেন। আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ “আমি বানী ইসরাঈলের কাছে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম-তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে।” এ বিষয় সম্পৰ্কীয় বহু আয়াত রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, ইবনে মাসউদ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন আমলটি উত্তম?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “নামায সময় মত আদায় করা।” ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি জবাব দিলেনঃ “পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা।” আমি বললাম, তারপর কোন্টি? তিনি উত্তরে বলেনঃ “আল্লাহর পথে জিহাদ করা।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি যদি প্রশ্ন আরও বাড়াতাম তবে তিনি উত্তরও বাড়িয়ে দিতেন। হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে ইবনে সামিত (রাঃ)! তুমি তোমার পিতা-মাতার অনুগত হয়ে যাও। যদি তারা আমাদেরকে সারা দুনিয়া দিয়ে দাও’ একথাও বলে তবে সেটাও পালন কর।” এ হাদীসটির ইসনাদ দুর্বল। আল্লাহ তা’আলা সবচেয়ে ভাল জানেন।
(আরবী) দারিদ্রতার ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না, কেননা আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার্য দান করে থাকি।
পিতা-মাতাকে নির্দেশ দিচ্ছেন-তোমরা দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের ছেলে মেয়েদেরকে হত্যা করো না। শয়তানরা মুশরিকদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল বলে তারা নিজেদের সন্তানদেরকে জীবন্ত প্রোথিত করতো। তারা লজ্জার ভয়ে কন্যা সন্তানদেরকে জীবন্ত গেড়ে ফেলতো। আবার দারিদ্রতার ভয়ে কোন কোন পুত্র সন্তানকেও হত্যা করতো। এ জন্যেই সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন পাপটি সবচেয়ে বড়?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “তা হচ্ছে এই যে, তুমি আল্লাহর জন্যে শরীক স্থাপন করবে, অথচ তিনিই তোমাকে (এবং ঐ শরীককে) সৃষ্টি করেছেন!” ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বলেনঃ “তুমি তোমার সন্তানকে হত্যা করবে এই ভয়ে যে, সে তোমার সাথে আহার করবে।” আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ “তা এই যে, তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়বে। অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন মা’বুদের উপাসনা করে না এবং আল্লাহ যাকে (হত্যা করা) হারাম করে দিয়েছেন, তাকে হত্যা করে না শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতীত, এবং ব্যভিচার করে না।” (এটা ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে তাখরীজ করেছেন) (২৫:৬৮)
উপরে বর্ণিত ‘ফাকর’ বা দারিদ্রকে ‘ইমলোক’ বলা হয়। এ জন্যেই আল্লাহ পাক সূরায়ে বানী ইসরাঈলে বলেনঃ “জীবিকা তো আমিই তাদেরকে এবং তোমাদেরকে দিয়ে থাকি।” ওখানে জীবিকার শুরুতে শিশুদের নাম নেয়া হয়েছে। কেননা, সেখানে ব্যবস্থাপনায় তারাই উদ্দেশ্য ছিল অর্থাৎ তাদেরকে জীবিকা পৌছানোর কারণে তোমরা দরিদ্র হয়ে যাবে এই ভয়ে তাদেরকে হত্যা করো না। কারণ সকলেরই জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর উপর রয়েছে। কিন্তু এখানে যেহেতু দারিদ্র বিদ্যমান রয়েছে এ জন্যে এখানে বলেছেন, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবিকা দান করে থাকি। কারণ, এখানে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে তোমাদেরকে জীবিকা আমিই দান করেছি, সুতরাং নিজেদের জীবিকার ভয় করো না।
আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ তোমরা অশ্লীল কাজ ও কথার নিকটেও যেয়ো না, তা প্রকাশ্যেই হাক বা গোপনীয়ই থাক। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেছেনঃ “হে নবী (সঃ) ! তুমি বলে দাও-আমার প্রতিপালক প্রকাশ্য ও গোপনীয় সমস্ত অশ্লীলতাই নিষিদ্ধ। করেছেন, আর তোমরা অন্যায়, পাপ ও বিদ্রোহ থেকে বেঁচে থাক। আর বিরত থাক শিরক থেকে যার কোন সনদ নেই এবং এমন কিছু আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা থেকে দূরে থাক যা তোমরা জান না।” এর তাফসীর আল্লাহ পাকের (আরবী) -এই উক্তির মধ্যে করা হয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ অপেক্ষা লজ্জাশীল আর কেউ হতে পারে না। এ জন্যেই তিনি প্রকাশ্য ও গোপনীয় সমস্ত নির্লজ্জতাকে হারাম করে দিয়েছেন।” (ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, হযরত সা’দ ইবনে উবাদা (রাঃ) বলেছেনঃ “আমি যদি আমার স্ত্রীর। সাথে কোন পর পুরুষকে (ব্যভিচারে লিপ্ত) দেখতে পাই তবে অবশ্যই তাকে তরবারী দ্বারা হত্যা করে ফেলবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কানে এ সংবাদ পৌছলে তিনি বলেন, তোমরা কি সা’দ (রাঃ)-এর লজ্জাশীলতায় বিস্ময় বোধ করছো! আল্লাহর শপথ! আমি সা’দ (রাঃ) অপেক্ষা অধিক লজ্জাশীল এবং আল্লাহ আমার চেয়ে বেশী লজ্জাশীল। এ জন্যেই তিনি সমস্ত নির্লজ্জতাকে হারাম করে দিয়েছেন।
(আরবী) অর্থাৎ আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না। গুরুত্ব বুঝাবার জন্যেই আল্লাহ তাআলা পৃথকভাবে এর নিষেধাজ্ঞা আনয়ন করেছেন। নতুবা এটা প্রকাশ্য ও গোপনীয় নির্লজ্জতার নিষিদ্ধতারই অন্তর্ভুক্ত। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কোন মুসলমানের রক্ত হালাল নয় যে সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। তবে তিনটির যে কোন একটি কারণে হত্যা করা যায়। (১) বিবাহিত ব্যভিচারী, (২) প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ (অর্থাৎ হত্যার বিনিময়ে হত্যা) এবং (৩) দ্বীন পরিত্যাগকারী ও দলের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আনয়নকারী।” সহীহ মুসলিমের শব্দ নিম্নরূপ রয়েছে “যিনি ছাড়া কেউ উপাস্য নেই তাঁর শপথ! কোন মুসলমান ব্যক্তির রক্ত হালাল নয়” পরবর্তী ভাষা একইরূপ। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শব্দের মধ্যে পার্থক্য এই যে, সহীহ বুখারীতে রয়েছেঃ (আরবী) সহীহ মুসলিমে রয়েছেঃ (আরবী) পরবর্তী কথাগুলো একইরূপ) আর ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কোন মুসলমান লোকের রক্ত হালাল নয় তিনটির কোন একটি কারণ ছাড়া। (১) যদি কোন বিবাহিত পুরুষ বা স্ত্রী) লোক ব্যভিচার করে তবে তাকে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা হবে। (২) যদি কোন লোক কোন লোককে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করে তবে সেই হত্যার বিনিময়ে তাকে হত্যা করা হবে। (৩) যদি কোন লোক ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায় এবং আল্লাহ ও তার রাসূল (সঃ) -এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তবে তাকে হত্যা করা হবে অথবা শূলী দেয়া হবে কিংবা দেশান্তর করা হবে।”
আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান (রাঃ) যখন বিদ্রোহীগণ কর্তৃক পরিবেষ্টিত হন তখন তিনি তাদেরকে বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনটির কোন একটি কারণ ছাড়া কোন মুসলমান লোকের রক্ত হালাল নয়। (১) যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পর পুনরায় কাফির হয়ে গেল, (২) যে ব্যক্তি বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়লো এবং (৩) যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায় ভাবে হত্যা করলো। তাহলে আল্লাহর শপথ! আমি কখনও ব্যভিচার করিনি, অজ্ঞতার যুগেও না এবং ইসলামের যুগেও না। আমি কখনও এ ইচ্ছা পোষণ করিনি যে, ইসলাম গ্রহণের পর এ দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন গ্রহণ করবো। আর আমি কখনও কাউকে হত্যাও করিনি। সুতরাং তোমরা আমাকে কিসের উপর ভিত্তি করে হত্যা করতে চাচ্ছ ?” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমীযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমীযী (রঃ) বলেন যে, হাদীসটি হাসান) যে অমুসলিমের সাথে চুক্তি হয়ে যাবে এবং যে হারবীকে (অমুসলিম দেশের অমুসলিম) ইসলামী রাষ্ট্রে বাস করার জন্যে নিরাপত্তা দেয়া হবে, তাদেরকে হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এমন কি এ ব্যাপারে ধমক ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। ইমাম বুখারী (রঃ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি চুক্তিকৃত কোন লোককে হত্যা করবে সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ জান্নাতের সুগন্ধ চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এমন কোন চুক্তিকৃত ব্যক্তিকে হত্যা করবে যার নিরাপত্তার যিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হয়ে গেছেন, সে ব্যক্তি জান্নাতের খোশবু পর্যন্ত পাবে না। (হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) ও ইমাম তিরমীযী বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমীযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন) (আরবী) অর্থাৎ এসব বিষয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা অনুধাবন করতে পার।
যখন ইয়াতীমের মাল খেয়ো না’ -এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন যার বাড়ীতে কোন ইয়াতীম ছিল সে সেই ইয়াতীমের খাদ্য ও পানীয়কে নিজের খাদ্য ও পানীয় হতে পৃথক করে দেয় এই ভয়ে যে, না জানি ইয়াতীমের খাদ্য তার খাদ্যের সাথে মিশ্রিত হয়ে যাবে। এমন কি ইয়াতীমের আহার করার পর যা অবশিষ্ট থাকতো তা তারা তারই জন্যে উঠিয়ে রেখে দিতো, যেন সে আবার তা আহার করে। এর ফলে খাবার নষ্ট হয়ে যেতো। এটা ছিল উভয়ের জন্যেই অমঙ্গল। তারা তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এ সম্পর্কে আলোচনা করে। সেই সময় মহান আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সঃ)-এর কাছে অহী পাঠানঃ “লোকেরা তোমাকে ইয়াতীমদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তুমি তাদেরকে বলে দাও-তাদের মঙ্গল কামনাই হচ্ছে ভাল কাজ। সুতরাং যদি তোমরা তাদের সাথে একত্রিতভাবে খাও তবে তাতে কোন দোষ নেই, তারা তো তোমাদেরই ভাই, এটা ঐ পর্যন্ত চলবে যে পর্যন্ত তারা বালেগ বা বয়োঃপ্রাপ্ত না হয়।” সুদ্দী (রঃ) এর সময়কাল ত্রিশ বছর, চল্লিশ বছর এমন কি ষাট বছর পর্যন্তও নির্ধারণ করেছেন। এটা এখানকার আলোচ্য বিষয় নয় ।
(আরবী) অর্থাৎ আদান প্রদানে পরিমাণ ও ওযন তোমরা সঠিকভাবে করবে। মাপ ও ওযনে ইনসাফ করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং কঠোরভাবে শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ “নিরতিশয় সর্বনাশ রয়েছে মাপে কমদাতাদের। যখন তারা মানুষের নিকট থেকে মেপে নেয়, তখন পুরোপুরিই নেয়। আর যখন তাদেরকে মেপে কিংবা ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়। তাদের কি এ বিশ্বাস নেই যে, তাদেরকে এক অত্যন্ত কঠোর দিবসে উঠান হবে?” পূর্বে এক জাতি মাপে ও ওযনে বেঈমানী করার কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
(আরবী) আমি কারো উপর তার সাধ্যাতীত ভার (দায়িত্ব-কর্তব্য) অৰ্পণ করি না। যে ব্যক্তি হক আদায়ে পুরোপুরি চেষ্টা করলো, তথাপি পূর্ণ মাত্রায় আদায় করতে পারলো না, তার কোন দোষ নেই এবং এজন্যে তাকে জবাবদিহি করতে হবে না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ আয়াতের ব্যাপারে বলেন ঃ “যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ নিয়তে মাপলো বা ওযন করলো, আর আল্লাহ তো তার নিয়ত সম্পর্কে জানেনই, তাহলে তাকে পাকড়াও করা হবে না।” (আরবী) শব্দের ব্যাখ্যা এটাই।
(আরবী) যখন কথা বলবে তখন স্বজনের বিরুদ্ধে হলেও ন্যায়ানুগ বলবে । যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “হে মুমিনগণ! আল্লাহর জন্যে আদল ও ইনসাফের সাথে সাক্ষ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক।” অনুরূপভাবে সূরা নিসায় আল্লাহ তা’আলা কথায় ও কাজে ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন, নিকটবর্তীদের জন্যেই হাক বা দূরবর্তীদের জন্যেই হাক। আল্লাহ পাক প্রত্যেকের জন্যে, প্রত্যেক সময়ে এবং সর্বাবস্থায় ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইরশাদ হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করো। এটা পূরণ করার স্বরূপ হচ্ছে- তোমরা তাঁর আদেশ ও নিষেধ মেনে চল। এবং তাঁর কিতাব ও সুন্নাতে রাসূল (সঃ)-এর উপর আমল করো। এটাই হচ্ছে আল্লাহর সাথে কত অঙ্গীকার পূরণ করা।
(আরবী) আল্লাহ তোমাদেরকে এসব বিষয় নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা তাঁর এ নির্দেশ ও উপদেশ গ্রহণ কর এবং পূর্বের অন্যায় ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাক। কেউ কেউ শব্দের -কে দিয়ে পড়েছেন এবং কেউ কেউ করে পড়েছেন।
ইরশাদ হচ্ছে-তোমরা এদিক ওদিক অন্যান্য পথগুলোর উপর চলো না, নতুবা আল্লাহর পথ হতে সরে পড়বে। তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত রাখ এবং তাতে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করো না। এই প্রকারের আয়াতসমূহে আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যেন দল ছেড়ে না দেয় এবং দলে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে তারা যেন বেঁচে থাকে। পূর্ববর্তী লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে ঝগড়া-ফাসাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল এবং মতানৈক্য সৃষ্টি করেছিল। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) মাটিতে স্বহস্তে একটি রেখা টানেন। তারপর বলেনঃ “এটা হচ্ছে আল্লাহর সরল সোজা পথ।” অতঃপর তিনি ডানে ও বামে আরও কতগুলো রেখা টানেন এবং বলেনঃ “এগুলো হচ্ছে ঐসব রাস্তা যেগুলোর প্রত্যেকটির উপর একজন করে শয়তান বসে রয়েছে এবং ঐ দিকে (মানুষকে) আহ্বান করছে।” অতঃপর তিনি
এই আয়াতটি পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম হাকিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাকিম (রঃ) এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন। তারা দু’জন এটাকে তাখরীজ করেননি)
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী (সঃ)-এর কাছে উপবিষ্ট ছিলাম, এমন সময় তিনি এভাবে তাঁর সামনে একটা রেখা টানেন এবং বলেনঃ “এটা হচ্ছে আল্লাহর পথ।” অতঃপর ডানে ও বামে দু’টি করে রেখা টানেন এবং বলেনঃ “এগুলো হচ্ছে শয়তানের পথ।” তারপর মধ্যভাগের রেখার উপর স্বীয় হাতটি রাখেন এবং (আরবী) এই আয়াতটিই পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইবনে মাজাহ (রঃ) এবং বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত জাবির (রাঃ) হতেই বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি রেখা টানেন। তারপর ডান দিকে একটি রেখা টানেন এবং বামদিকে একটি রেখা টানেন। অতঃপর স্বীয় হস্ত মুবারক মধ্যবর্তী রেখাটির উপর রেখে (আরবী) -এই আয়াতটি পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবান ইবনে উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “সিরাতে মুস্তাকীম কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে তাঁর নিকটে স্থান দিয়েছিলেন এবং তার চক্ষু যেন জান্নাতের দিকে ছিল। তাঁর ডান দিকে একটা পথ ছিল এবং বাম দিকে একটা পথ ছিল। পথগুলোর উপর কতগুলো লোক অবস্থান করছিল এবং যারা তাদের পার্শ্ব দিয়ে গমন করছিল তাদেরকে তারা নিজেদের দিকে আহ্বান করছিল। সুতরাং যারা তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের পথ ধরলো তারা জাহান্নামে প্রবেশ করলো। আর যারা সরল সোজা পথ ধরলো তারা জান্নাতে প্রবেশ করলো।” অতঃপর (আরবী) –এই আয়াতটি পাঠ করলেন।
নাওয়াস ইবনে সামআন (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা সিরাতে মুস্তাকিমের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। এর দু’দিকে দু’টি প্রাচীর রয়েছে এবং তাতে খোলা দরজা রয়েছে। দরজাগুলোর উপর পর্দা লটকান। রয়েছে। সোজা রাস্তাটির দরজার উপর আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী একটি লোক বসে আছে এবং বলছেঃ “হে লোক সকল! তোমরা সবাই এই সরল সোজা পথে চলে এসো। এদিক ওদিক যেয়ো না।” আর একটি নাক রাস্তার উপর থেকে ডাক দিতে রয়েছে। যখনই কোন লোক ঐ দরজাগুলোর কোন একটি দরজা খোলার ইচ্ছা করছে তখনই সে তাকে বলছে- “সর্বনাশ! ওটা খোলো না। কারণ যদি তুমি দরজাটি খুলে দাও তবে তুমি ওর মধ্যে প্রবেশই করে যাবে।”
এখন এই সরল সোজা পথটি হচ্ছে ইসলাম। আর প্রাচীরগুলো হচ্ছে আল্লাহর হুদূদ। এই খোলা দরজাগুলো হচ্ছে আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ। রাস্তার মাথায় যে বসে আছে ওটা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। আর রাস্তার উপর থেকে যে ডাক দিচ্ছে সে হচ্ছে আল্লাহর উপদেশদাতা যা প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে রয়েছে। অন্তর যেন তাকে খারাপ কাজ থেকে বাধা দিচ্ছে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), তিরমীযী (রঃ) এবং নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কে আমার কাছে এই তিনটি আয়াতের উপর দীক্ষা গ্রহণ করতে পার?” অতঃপর তিনি (আরবী) এখান থেকে শুরু করে তিনটি আয়াত পাঠ করলেন। আয়াত তিনটির পাঠ শেষ করে বললেনঃ “যে ব্যক্তি এগুলোর হক আদায় করলো, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে নির্ধারিত হয়ে গেল। আর যে ব্যক্তি এগুলোর আমলে অবহেলা করলো, তাকে হয়তো আল্লাহ দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়ে দিবেন। আর যদি আল্লাহ তাকে শাস্তি প্রদানে বিলম্ব করেন তবে তিনি পরকালে ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিবেন অথবা ক্ষমা করে দিবেন।”
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
ঊনিশতম রুকূ’
[১] আগত আয়াতসমূহে সেসব বস্তু সম্পর্কে বলা হয়েছে, যেগুলোকে আল্লাহ্ তা’আলা হারাম করেছেন। বিশদ বর্ণনায় নয়টি বস্তুর উল্লেখ হয়েছে। এরপর দশম নির্দেশ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “এ দ্বীনই হচ্ছে আমার সরল পথ। এ পথের অনুসরণ কর”। এতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দ্বীন যে বিষয়কে হালাল বলেছে, তাকে হালাল এবং যে বিষয়কে হারাম বলেছে, তাকে হারাম মনে করবে- নিজের পক্ষ থেকে হালাল-হারামের ফতোয়া জারি করবে না। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনীত পথকে অনুসরনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাঁর পথ ব্যতীত আরও বহু পথ রয়েছে সেগুলো মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। সঠিক পথ একটি, আর বাতিল পথ অনেক। যারা আল্লাহর পথে চলবে আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। [সা’দী]
আগত আয়াতসমূহে যে দশটি বিষয় বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে, (১) আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে ইবাদাত ও আনুগত্যে অংশীদার স্থির করা, (২) পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার না করা, (৩) দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা করা, (৪) অশ্লীল কাজ করা, (৫) কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, (৬) ইয়াতীমের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা, (৭) ওজন ও মাপে কম দেয়া, (৮) সাক্ষ্য, ফয়সালা অথবা অন্যান্য কথাবার্তায় অবিচার করা, (৯) আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ না করা এবং (১০) আল্লাহ তা’আলার সোজা-সরল পথ ছেড়ে অন্য পথ অবলম্বন করা। মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ সূরা আলে ইমরানের মুহকাম আয়াতের বর্ণনায় এ আয়াতগুলোকেই বোঝানো হয়েছে। আদম ‘আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সমস্ত নবীগণের শরী’আতই এসব আয়াত সম্পর্কে একমত। কোন দ্বীন বা শরী’আতে এগুলোর কোনটিই মনসূখ বা রহিত হয়নি। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৩১৭] আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ যে বিষয়ের উপর ছিলেন সেটা জানতে চায় সে যেন সূরা আল-আন’আমের এ আয়াতগুলো পড়ে নেয়। [ইবন কাসীর]
[২] আয়াতগুলোর প্রথমেই বলা হয়েছে (تعَالوا) যার অর্থঃ ‘এস’। মূলতঃ উচ্চস্থানে দণ্ডায়মান হয়ে নিম্নের লোকদেরকে নিজের কাছে ডাকা অর্থে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। [কাশশাফ; কুরতুবী] এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ দাওয়াত কবুল করার মধ্যেই তাদের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য বিদ্যমান। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, আপনি তাদেরকে বলুন, এস, যাতে আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শোনাতে পারি যেগুলো আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। এটা প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত
বার্তা। এতে কারো কল্পনা, আন্দাজ ও অনুমানের কোন প্রভাব নেই [বাগভী] যাতে তোমরা এসব বিষয় থেকে আত্মরক্ষা করতে যত্নবান হও এবং অনর্থক নিজের পক্ষ থেকে আল্লাহর হালালকৃত বিষয়সমূহকে হারাম না কর। এ আয়াতে যদিও সরাসরি মক্কার মুশরিকদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি ব্যাপক হওয়ার কারণে সমগ্র মানব জাতিই এর আওতাধীন- মুমিন হোক কিংবা কাফের, আরব হোক কিংবা অনারব, উপস্থিত লোকজন হোক কিংবা অনাগত বংশধর। [দেখুন, তাফসীর আল-মানার]
[৩] সর্বপ্রথম মহাপাপ শির্ক, যা হারাম করা হয়েছেঃ
সযত্ন সম্বোধনের পর হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের তালিকায় সর্বপ্রথম বলা হয়েছেঃ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বা অংশীদার করো না। আরবের মুশরিকদের মত দেব-দেবীদেরকে বা মূর্তিকে ইলাহ বা উপাস্য মনে করো না। ইয়াহুদী ও নাসারাদের মত নবীগণকে আল্লাহ কিংবা আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করো না। অন্যদের মত ফিরিশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে আখ্যা দিও না। মূৰ্খ জনগণের মত নবী ও ওলীগণকে জ্ঞান ও শক্তি-সামর্থ্যে আল্লাহর সমতুল্য সাব্যস্ত করো না। আল্লাহর জন্য যে সমস্ত ইবাদাত করা হয়, তা অপর কাউকে দিও না; যেমন, দো’আ, যবেহ, মানত ইত্যাদি।
এখানে (شيئًا) এর অর্থ এরূপ হতে পারে যে, ‘জলী’ অর্থাৎ প্রকাশ্য শির্ক ও ‘খফী’ অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন শিক- এ প্রকারদ্বয়ের মধ্য থেকে কোনটিতেই লিপ্ত হয়ো না। প্রকাশ্য শির্কের অর্থ সবাই জানে যে, ইবাদাত-আনুগত্য অথবা অন্য বিশেষ গুণে অন্যকে আল্লাহ তা’আলার সমতুল্য অথবা তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করা। প্রচ্ছন্ন শির্ক এই যে, নিজ কাজ-কর্মে দ্বীনী ও পার্থিব উদ্দেশ্যসমূহে এবং লাভ-লোকসানে আল্লাহ তা’আলাকে কার্যনির্বাহী বলে বিশ্বাস করেও কার্যতঃ অন্যান্যকে কার্যনির্বাহী মনে করা এবং যাবতীয় প্রচেষ্টা অন্যদের সাথেই জড়িত রাখা। এছাড়া লোক দেখানো ইবাদাত করা, অন্যদেরকে দেখানোর জন্য সালাত ইত্যাদি ঠিকমত আদায় করা, নাম-যশ লাভের উদ্দেশ্যে দান-সদকা করা অথবা কার্যতঃ লাভ-লোকসানের মালিক আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সাব্যস্ত করা ইত্যাদিও প্রচ্ছন্ন শির্কের অন্তর্ভুক্ত। [দেখুন, আল-মানার; সা’দী; আশ-শিক ফীল কাদীম ওয়াল হাদীস, ১৬৮-১৮০; ১২৯৫-১৩১০]
[৪] দ্বিতীয় গোনাহ পিতা-মাতার সাথে অসদ্ব্যবহারঃ
আয়াতে বলা হয়েছেঃ “পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা”। উদ্দেশ্য এই যে, পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ো না। তাদেরকে কষ্ট দিও না; কিন্তু বিজ্ঞজনোচিত ভঙ্গিতে বলা হয়েছে যে, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। অন্য আয়াতে তাদের আনুগত্য ও সুখবিধানকে আল্লাহ তা’আলার ইবাদাতের সাথে সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, “আপনার রব নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে”। [সূরা আল-ইসরা: ২৩] অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, “আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং পিতা-মাতার। তারপর আমার দিকেই প্রত্যাবর্তন”। [সূরা লুকমান:১৪] অর্থাৎ বিপরীত করলে শাস্তি পাবে। তাছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সর্বোত্তম কাজ কোনটি’? তিনি উত্তরে বললেনঃ ‘সঠিক ওয়াক্তে সালাত আদায় করা’, তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ ‘এরপর কোনটি’? উত্তর হলঃ ‘পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার’। আবার প্রশ্ন করলেনঃ ‘এরপর কোনটি? উত্তর হলঃ ‘আল্লাহর পথে জিহাদ’। [বুখারীঃ ৫২৭, মুসলিমঃ ৮৫] আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বললেন, ‘লাঞ্ছিত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে’। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে লাঞ্ছিত হয়েছে’? তিনি বললেনঃ ‘যে ব্যক্তি পিতা-মাতাকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে নি’। [মুসলিমঃ ২৫৫১]
[৫] তৃতীয় হারাম- সন্তান হত্যাঃ
আয়াতে বর্ণিত তৃতীয় হারাম বিষয় হচ্ছে সন্তান হত্যা। এখানে পূর্বাপর সম্পর্ক এই যে, ইতোপূর্বে পিতা-মাতার হক বর্ণিত হয়েছে, যা সন্তানের কর্তব্য। এখন সন্তানের হক বর্ণিত হচ্ছে, যা পিতা-মাতার কর্তব্য। জাহেলিয়াত যুগে সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা কিংবা হত্যা করার ব্যাপারটি ছিল সন্তানের সাথে অসদ্ব্যবহারের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। আয়াতে তা নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছেঃ “দারিদ্র্যের কারণে স্বীয় সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমরা তোমাদেরকে এবং তাদেরকে- উভয়কেই জীবিকা দান করব”। জাহেলিয়াত যুগে এ নিকৃষ্টতম নির্দয়-পাষণ্ড প্রথা প্রচলিত ছিল যে, কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে কাউকে জামাতা করার লজ্জা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। মাঝে মাঝে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হবে মনে করে পাষণ্ডরা নিজ হাতে সন্তানদেরকে হত্যা করত। কুরআনুল কারীম এ কু-প্রথা রহিত করে দিয়েছে। [ইবন কাসীর]
(৬) চতুর্থ হারাম নির্লজ্জ কাজঃ
আয়াতে বর্ণিত চতুর্থ হারাম বিষয় হচ্ছে নির্লজ্জ কাজ। এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন, যে কোন রকম অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না”। (فواحش) শব্দের সাধারণ অর্থঃ অশ্লীলতা ও নির্লজ্জ কাজ। যাবতীয় বড় গোনাহ (فحش) ও (فحشاء) এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত। মোটকথা, এ আয়াত নির্লজ্জতার প্রকৃত অর্থের দিক দিয়ে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সমস্ত গোনাহকে এবং সাধারণের মধ্যে প্রসিদ্ধ অর্থের দিক দিয়ে ব্যভিচারের প্রকাশ্য ও গোপন সকল পন্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এ সম্পর্কে নির্দেশ এই যে, এগুলোর কাছেও যেও না। কাছে যাওয়ার অর্থ এরূপ মজলিশ ও স্থান থেকে বেঁচে থাকা যেখানে গেলে গোনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এরূপ কাজ থেকেও বেঁচে থাক, যা দ্বারা এসব গোনাহর পথ খুলে যায়। কারণ, যে লোক নিষিদ্ধ জায়গার আশেপাশে ঘোরাফেরা করে, সে তাতে প্রবেশ করার কাছাকাছি হয়ে যায়। [সা’দী] অন্য আয়াতেও বলা হয়েছে, “বলুন, নিশ্চয় আমার রব হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা। ” [সূরা আল-আ’রাফ: ৩৩] অনুরূপভাবে অন্যত্র এসেছে, “আর তোমরা প্রকাশ্য এবং প্রচ্ছন্ন পাপ বর্জন কর” [সূরা আল-আন’আমঃ ১২০] এ সব আয়াত একই অর্থবোধক। এসব আয়াতেই অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর চেয়ে বেশী আত্মাভিমানী কেউই নেই, সেজন্য তিনি প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য যাবতীয় অশ্লীলতা হারাম ঘোষণা করেছেন।‘ [বুখারী ৪৬৩৪; মুসলিম: ২৭৬০]
[৭] পঞ্চম হারাম বিষয় অন্যায় হত্যাঃ
এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ্ তা’আলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করো না, তবে ন্যায়ভাবে”। এ ন্যায়ভাবে’র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘তিনটি কারণ ছাড়া কোন মুসলিমের খুন হালাল নয়। (এক) বিবাহিত হওয়া সত্বেও ব্যভিচারে লিপ্ত হলে, (দুই) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে তার কেসাস হিসাবে তাকে হত্যা করা যাবে এবং (তিন) সত্যদ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে মুসলিমদের জামা’আত থেকে পৃথক হয়ে গেলে। [বুখারীঃ ৬৮৭৮, মুসলিমঃ ১৬৭৬]
বিনা কারণে মুসলিমকে হত্যা করা যেমন হারাম, তেমনিভাবে এমন কোন অমুসলিমকে হত্যা করাও হারাম, যে কোন ইসলামী দেশের প্রচলিত আইন মান্য করে বসবাস করে কিংবা যার সাথে মুসলিমের চুক্তি থাকে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন যিম্মী অমুসলিমকে হত্যা করে, সে আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। যে আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধী সত্তর বছরের দূরত্ব হতে পাওয়া যায়। [ইবন মাজাহ ২৬৮৭]
[১] ষষ্ঠ হারাম ইয়াতীমের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ করাঃ
এ আয়াতে ইয়াতীমের ধন-সম্পদ যে ভক্ষণ করা হারাম, সে সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “ইয়াতীমের মালের কাছেও যেও না; কিন্তু উত্তম পন্থায়, যে পর্যন্ত না সে বলেগ হয়ে যায়”। এখানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ইয়াতীম শিশুদের অভিভাবককে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তারা যেন ইয়াতীমদের সম্পদকে আগুন মনে করে এবং অবৈধভাবে তা খাওয়া ও নেয়ার ব্যাপারে নিকটবতীও না হয়। অন্য এক আয়াতে অনুরূপ ভাষায়ই বলা হয়েছে যে, “যারা ইয়াতীমদের মাল অন্যায় ও অবৈধভাবে ভক্ষণ করে, তারা নিজেদের পেটে আগুণ ভর্তি করে। ” [সূরা আন-নিসা:১০] তবে ইয়াতীমের মাল সংরক্ষণ করা এবং স্বভাবতঃ লোকসানের আশঙ্কা নেই- এরূপ কারবারে নিয়োগ করে তা বৃদ্ধি করা উত্তম ও জরুরী পন্থা। ইয়াতীমদের অভিভাবকদের এ পস্থা অবলম্বন করা উচিত। [কুরতুবী] আলোচ্য আয়াতে এরপর ইয়াতীমের মাল সংরক্ষণের সীমা বর্ণনা করা হয়েছে, “সে বয়োঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত”। অর্থাৎ বয়োঃপ্রাপ্ত হয়ে গেলে অভিভাবকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। অতঃপর তার মাল তার কাছে সমর্পণ করতে হবে। (اشُدَّ) শব্দের প্রকৃত অর্থ শক্তি। আলেমগণের মতে বয়োঃপ্রাপ্ত হলেই এর সূচনা হয়। বালক-বালিকার মধ্যে বয়োঃপ্রাপ্তির লক্ষণ দেখা দিলে, তাদের মধ্যে নিজের মালের রক্ষণা-বেক্ষণ এবং শুদ্ধ খাতে ব্যয় করার যোগ্যতা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। যোগ্যতা দেখলে বয়োঃপ্রাপ্তির সাথে সাথে তার ধন-সম্পদ তার হাতে সমর্পণ করতে হবে। [কুরতুবী]
[২] সপ্তম হারাম ওজন ও মাপে ক্রটি করাঃ
এ আয়াতে সপ্তম নির্দেশ ওজন ও মাপ ন্যায়ভাবে পূর্ণ করা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। ‘ন্যায়ভাবে’ বলার উদ্দেশ্য এই যে, যে ওজন করে দেবে, সে প্রতিপক্ষকে কম দেবে না এবং প্রতিপক্ষ নিজ প্রাপ্যের চাইতে বেশী নেবে না। দ্রব্য আদান-প্রদানে ওজন ও মাপে কম-বেশী করাকে কুরআন কঠোর হারাম সাব্যস্ত করেছে। যারা এর বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের জন্য সূরা আল-মুতাফফিফীনে কঠোর শাস্তিবাণী বর্ণিত হয়েছে। মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ ‘ওজন ও মাপ এমন একটি কাজ যে, এতে অন্যায় আচরণ করে তোমাদের পূর্বে অনেক উম্মত আল্লাহর আযাবে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে’। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; আদ-দুররুল মানসূর] আলোচ্য আয়াতে এরপর বলা হয়েছে, “আমরা কোন ব্যক্তিকে তার সাধ্যাতিরিক্ত কাজের নির্দেশ দেই না।”
এর অর্থ এরূপও হতে পারে যে, সাধ্যমত পুরোপুরি ওজন করো, তারপরও যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে ওজনে কমবেশী হয়ে যায়, তবে তা মাফ। কেননা, এটা তার শক্তি ও সাধ্যের বাইরে। [ কুরতুবী ইবন কাসীর; সা’দী]
[৩] অষ্টম নির্দেশ ন্যায় ও সুবিচারের বিপরীত করা হারামঃ
বলা হয়েছে, “তোমরা যখন কথা বলবে, তখন ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে, যদি সে আত্মীয়ও হয়”। এখানে বিশেষ কোন কথার উল্লেখ নাই। তাই সাধারণ মুফাসসিরীনগণের মতে সব রকম কথাই এর অন্তর্ভুক্ত। কোন ব্যাপারে সাক্ষ্য হোক কিংবা বিচারকের ফয়সালা হোক অথবা পারস্পরিক বিভিন্ন প্রকার কথাবার্তাই হোক- সব ক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় ন্যায় ও সত্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে কথা বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [কুরতুবী] মোকাদ্দমার সাক্ষ্য কিংবা ফয়সালার ক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্য কায়েম রাখার অর্থ এই যে, ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে যা জানা আছে, নিজের পক্ষ থেকে কমবেশী না করে তা পরিস্কার বলে দেয়া- অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কোন কথা না বলা এবং এতে কারো উপকার কিংবা কারো অপকারের ভ্রক্ষেপ না করা। মোকাদ্দমার ফয়সালার সাক্ষীদেরকে শরী’আতের নীতি অনুযায়ী যাচাই করার পর তাদের সাক্ষ্য ও অন্যান্য সূত্র দ্বারা যা প্রমাণিত হয়, তাই ফয়সালা করা। সাক্ষ্য ও ফয়সালায় কারো বন্ধুত্ব ও ভালবাসা এবং কারো শক্রতা ও বিরোধিতা সত্য বলার পথে অন্তরায় না হওয়া উচিত। আত্মীয়তা বা অনাত্মীয় যেই হোক না কেন ন্যায় ও সত্যকে কোন অবস্থাতেই হাতছাড়া না করা। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর; সা’দী; আইসারুত তাফাসীর, মুয়াসসার]
[৪] নবম নির্দেশঃ আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করাঃ
বলা হয়েছে, “আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ কর”। এ অঙ্গীকারের দাবী হল এই যে, পালনকর্তার কোন নির্দেশ অমান্য করা যাবে না। তিনি যে কাজের আদেশ দেন, তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি যে কাজে নিষেধ করেন, তার কাছেও যাওয়া যাবে না এবং সন্দেহযুক্ত কাজ থেকেও বাঁচতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলার পুরোপুরি আনুগত্য করতে হবে। এছাড়া এর অর্থ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত বিশেষ বিশেষ অঙ্গীকারও হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলদের মুখে যে সমস্ত অঙ্গীকারের ঘোষণা দিয়েছেন সেগুলো পূর্ণ করা। আল্লাহ বলেন, “হে বনী আদম! আমি কি তোমাদের থেকে এ অঙ্গীকার নেইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না, কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শক্র? [সূরা ইয়াসীন ৬০] আরও বলেন, “আর তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করো যখন পরস্পর অঙ্গীকার কর” [সূরা আন-নাহল: ৯১] অনুরূপভাবে মানুষের মধ্যকার পরস্পর যে সমস্ত অঙ্গীকার হয়ে থাকে সেগুলোই উদ্দেশ্য। [সা’দী] আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করবে”। [সূরা আল-বাকারাহ: ১৭৭] মোটকথা, এ নবম নির্দেশটি গণনার দিক দিয়ে নবম হলেও স্বরূপের দিক দিয়ে শরী’আতের যাবতীয় আদেশ নিষেধের মধ্যে পরিব্যপ্ত।
[১] দশম নির্দেশঃ
“ইসলামকে আঁকড়ে থাকবে”। বলা হচ্ছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনিত শরী’আতই হল আমার সরল পথ। অতএব, তোমরা এ পথে চল এবং অন্য কোন পথে চলো না। কেননা, সেসব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এখানে (هٰذا) শব্দ দ্বারা দ্বীনে ইসলাম অথবা কুরআনের প্রতি ইশারা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলামই যখন আমার পথ এবং এটাই যখন সরল পথ, তখন মনযিলে মকসূদের বা অভিষ্ট লক্ষ্যের সোজা পথ হাতে এসে গেছে। তাই এ পথেই চল।
[২] অর্থাৎ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের আসল পথ তো একটিই, জগতে যদিও মানুষ নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী অনেক পথ করে রেখেছে। তোমরা সেসব পথে চলো না। কেননা, সেগুলো বাস্তবে আল্লাহ পর্যন্ত পৌছে না। কাজেই যে এসব পথে চলবে সে আল্লাহ থেকে দূরেই সরে পড়বে। হাদীসে এসেছে, নাওয়াস ইবন সাম’আন আল-কিলাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ্ তা’আলা একটি উদাহরণ পেশ করেছেন; একটি সরল পথ, এ পথের দু’পাশে প্রাচীর রয়েছে, তাতে দরজাগুলো খোলা। আর প্রত্যেক দরজার উপর রয়েছে পর্দা। পথটির মাথায় এক আহবানকারী আহবান করছে, আর তার উপর আরেক আহবানকারী আহবান করছে যে, ‘আল্লাহ শান্তির আবাসের দিকে আহবান করেন এবং যাকে ইচ্ছে সরল পথে পরিচালিত করেন’। পথের দু’পাশের দরজাগুলো হল আল্লাহ্ তা’আলার সীমারেখা, যে কেউ আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করবে তার জন্য সে পর্দা তুলে নেয়া হবে। উপরের আহবানকারী হল তার রব আল্লাহর পক্ষ থেকে উপদেশ প্রদানকারী’। [তিরমিযী: ২৮৫৯] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি আলোচ্য আয়াত এবং সূরা আশ-শূরার ১৩ নং আয়াতসহ এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুর’আনের যাবতীয় আয়াত সম্পর্কে বলেন: আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদেরকে পৃথক ও আলাদা হতে নিষেধ করেছেন। তিনি তাদেরকে জানিয়েছেন যে, তাদের পূর্ববর্তীরা আল্লাহর দ্বীনে তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়ার কারণে ধ্বংস হয়েছিল। [তাবারী]
কুরআনুল কারীম ও রাসূলুল্লাহ ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে প্রেরণ করার আসল উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ নিজ নিজ ধ্যান-ধারণা, ইচ্ছা ও পছন্দকে কুরআন ও সুন্নাহর ছাঁচে ঢেলে নিক এবং স্বীয় জীবনকে এরই অনুসারী করে নিক। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে এই যে, মানুষ কুরআন ও সুন্নাহকে নিজ নিজ ধ্যান-ধারণা ও পছন্দের ছাঁচে ঢেলে নিতে চাচ্ছে। কোন আয়াত কিংবা হাদীসকে নিজের মতলব বা ধারণার বিপরীতে দেখলে তারা তার মনগড়া ব্যাখ্যা করে স্বীয় প্রবৃত্তির পক্ষে নিয়ে যায়। এখান থেকেই অন্যান্য বিদ’আত ও পথভ্রষ্টতার জন্ম। আয়াতে এসব পথ থেকে বেঁচে থাকতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
১৫১-১৫৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য তিনটি আয়াত কুরআনুল কারীমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। আয়াতগুলোতে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি হারাম বিধানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে-
( وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ)
অর্থাৎ এ বিধানই হচ্ছে আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। তাই ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন: যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শেষ অসীয়তের প্রতি লক্ষ করতে চায় সে যেন উল্লিখিত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে। (হাকিম ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৭৭, সহীহ)
ইবনু মাউসদ (রাঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার চেয়ে অধিক আত্মমর্যাদাশীল আর কেউ নেই। তাই তিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল খারাপ কাজ হারাম করেছেন। প্রশংসা করার চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক প্রিয় বস্তু আর কিছুই নেই। তাই তিনি নিজের প্রশংসা নিজেই করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৩৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৭৬০)
আয়াতগুলোর সূচনা করা হয়েছে এভাবে যে,
(قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ)
অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার দেয়া হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম হিসেবে মেনে নিয়েছ অথবা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে যা ইচ্ছা হালাল ও হারাম করে নিয়েছ সবাই এসো তোমাদেরকে পাঠ করে শুনাই যা আল্লাহ তা‘আলা হারাম করে দিয়েছেন। আয়াতে সকল মানবজাতি শামিল।
সর্বপ্রথম মহাপাপ যা হারাম করা হয়েছে তা হল:
(أَلَّا تُشْرِكُوْا بِه۪ شَيْئًا)
‘আল্লাহ তা‘আলার সাথে কোন কিছু শরীক করো না।’সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সম্পাদন করবে। মক্কার মুশরিকদের মত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে কাউকে ওসীলা বানাবে না, ইয়াহূদী খ্রিস্টানদের মত নাবীদেরকে আল্লাহ তা‘আলার পুত্র বানাবে না। অন্যদের মত ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা মনে করবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ, উলুহিয়্যাহ ও আসমায়ি ওয়াস সিফাত সকল ক্ষেত্রে তাঁর তাওহীদ বহাল রাখবে। কেননা শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
اَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الثَّلَاثَةُ مِنْهَا اَلْاِشْرَاكُ بِاللّٰهِ
কবীরা গুনাহর মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনটি তার মধ্যে প্রধান হল আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা।
আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে দিবেন। কিন্তু তিনি শির্কের গুনাহ ক্ষমা করবেন না।
দু’টি অপরাধ রয়েছে যা দুনিয়াতেও ক্ষতি করে, আখিরাতেও ক্ষতি করে।
প্রথম: শির্ক, যা মানুষের অতীত আমলকে বরবাদ করে জাহান্নামে নিয়ে যায় এবং আল্লাহ তা‘আলাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
দ্বিতীয়: বিদআত, যা করলে মানুষের সে আমল কবূল হয় না এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
দ্বিতীয়ত যে মহাপাপ হারাম করা হয়েছে তা হল: পিতা-মাতার সাথে অসদাচরণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا)
‘পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে’অর্থাৎ কথায়, কাজে ও আচরণে পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা ওয়াজিব। অসদাচরণ করা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَضٰي رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْآ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا)
“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত কর না ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।”(সূরা ইসরা ১৭:২৩)
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেন: সর্বোত্তম কাজ কোন্টি? তিনি বললেন: যথাসময়ে সালাত আদায় করা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন: এরপর কোন্টি? তিনি বললেন: পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা। প্রশ্ন করলেন: তারপর কোন্টি? তিনি বললেন: আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদ করা। (সহীহ বুখারী হা: ৫২৭)
এমনকি পিতা-মাতা মুশরিক হলেও সদাচরণ করতে হবে। কিন্তু শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ করতে বললে তা করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنْ جَاهَدٰكَ عَلٰٓي أَنْ تُشْرِكَ بِيْ مَا لَيْسَ لَكَ بِه۪ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوْفًا)
“আর যদি তোমার পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় যে, তুমি আমার সাথে এমন কিছু শির্ক কর, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তুমি তাদের কথা মানবে না কিন্তু দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর।” (সূরা লুকমান ৩১:১৫)
পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের ব্যাপারে অনেক আয়াত ও সহীহ হাদীস রয়েছে। মোটকথা পিতা-মাতার প্রতি সদারচণ এমন ফরয যা পালন করলে সহজে জান্নাতে যাওয়া যায়, আবার তাদের সাথে অসদারচণ এমন হারাম কর্ম যা সহজে জাহান্নামে নিয়ে যায়।
লক্ষণীয় যে, কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা যেখানেই নিজের অধিকারের কথা বলেছেন সেখানেই পিতা-মাতার অধিকারের কথা বলেছেন। এতেই অনুধাবন করা যায় যে, পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের গুরুত্ব কতটুকু।
তৃতীয় হারাম:
(وَلَا تَقْتُلُوْآ أَوْلَادَكُمْ مِّنْ إِمْلَاقٍ)
‘দারিদ্রের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না’অর্থাৎ খাদ্য ঘাটতির ভয়ে সন্তান হত্যা করা হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قَدْ خَسِرَ الَّذِيْنَ قَتَلُوْآ أَوْلَادَهُمْ سَفَهًام بِغَيْرِ عِلْمٍ)
“যারা নির্বুদ্ধিতার দরুন ও অজ্ঞতাবশত নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত।”(সূরা আন্‘আম ৬:১৪০)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কোন অপরাধ সবচেয়ে বড়? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তুমি আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করলে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি বললাম, তারপর কোন্টি? তিনি বললেন: তোমার সাথে খাবে এ ভয়ে সন্তান হত্যা করলে। অতঃপর আমি বললাম: তারপর কোন্টি? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমার প্রতিবেশির সাথে ব্যভিচার করলে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন:
(وَالَّذِيْنَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللّٰهِ إِلَهًا آخَر… )
(সহীহ বুখারী হা: ৬০০১)
এখানে সন্তান হত্যা বলতে সন্তান না নেয়ার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অধিক সন্তান না নেয়া। পরিবার বড় হলে সন্তানদের খাদ্য, বাসস্থান ও খরচাদি ইত্যাদি বহন করা কষ্টকর হবে। এসব কারণে সন্তান না গ্রহণ করা হারাম। রিযিকের মালিক আল্লাহ, দুনিয়াতে এমন কোন প্রাণী পাঠান না যার রিযিকের দায়িত্ব তিনি নেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَي اللّٰهِ رِزْقُهَا)
“পৃথিবীতে যত প্রাণী রয়েছে, সব কিছুর রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর কাছে।”(সূরা হুদ ১১:৬)
তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ও খাদ্যসহ ভরণপোষণের ভয়ে সন্তান হত্যা তথা বিনা কারণে সন্তান না নেয়া হারাম। তবে যদি মায়ের ও সন্তানের স্বাস্থের দিকে বিবেচনা করে প্রয়োজনে কিছু বিলম্ব করা হয় তাহলে তা দূষণীয় নয়।
চতুর্থ হারাম হল:
(وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ)
‘প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক অশ্লীল কাজের নিকটেও যাবে না।’খারাপ কাজ হল: প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যে সকল কাজ করা আল্লাহ তা‘আলা অপছন্দ করেন এবং সে কাজে লিপ্ত হবার জন্য জাহান্নাম বা কঠিন শাস্তির কথা বলেছেন। অর্থাৎ সকল কবীরা গুনাহ এর অন্তর্ভুক্ত।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّـيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوْا بِاللّٰهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِه۪ سُلْطٰنًا وَّأَنْ تَقُوْلُوْا عَلَي اللّٰهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ)
“বল: নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, আর পাপ ও অন্যায় বিরোধিতা এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করা যার কোন প্রমাণ তিনি প্রেরণ করেননি, এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না।(সূরা আ‘রাফ ৭:৩৩)
পঞ্চম হারাম হল, অন্যায়ভাবে হত্যা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللّٰهُ إِلَّا بِالْحَقِّ)
‘আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীরেকে তোমরা তাকে হত্যা করবে না।’অর্থাৎ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিনটির কোন একটি কারণ ছাড়া কোন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা হারাম।
১. বিবাহিত ব্যভিচারী, তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে।
২. কিসাস হিসেবে প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ।
৩. যে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে অর্থাৎ মুরতাদ। (আবূ দাঊদ ৪৩৫৩, নাসাঈ হা: ৪০৫৯, সহীহ)
এছাড়াও বুখারী ও মুসলিমে এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে।
এ আয়াতটিতে পাচঁটি হারাম বিষয়ের বর্ণনা দেয়ার পর বলা হয়েছে: ‘তোমাদেরকে তিনি এ নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা অনুধাবন কর।’
ষষ্ঠ হারাম হল ইয়াতীমের সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ করা:
(وَلَا تَقْرَبُوْا مَالَ الْيَتِيْمِ)
‘ইয়াতীম বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত উত্তম পন্থা ব্যতীত তোমরা তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হবে না।’সকলের সম্পদ অন্যায়ভাবে খাওয়া হারাম। বিশেষ করে ইয়াতীমের সম্পদ আরও হারাম। এ সম্পর্কে সূরা নিসা-এর শুরুতে আলোচনা হয়েছে।
সপ্তম হারাম ওজনে ও মাপে করা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيْزَانَ بِالْقِسْطِ)
‘এবং পরিমাণ ও ওজন ন্যায্যভাবে পুরোপুরি দেবে।’অর্থাৎ ওজনে ও পরিমাণে ন্যায়ভাবে পুরোপুরি প্রদান করা কর্তব্য। ওজনে ও পরিমাণে কম দেয়া হারাম, বেশি নেয়াও হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَ – الَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَي النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ – وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَّزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ)
“মন্দ পরিণাম তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের নিকট হতে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে, এবং যখন তাদের জন্য মেপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।”(সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১-৩)
ওজনে ও পরিমাণে কম দেয়া শুয়াইব (আঃ)-এর জাতির বৈশিষ্ট্য ছিল। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
অষ্টম নির্দেশ: ন্যায় ও সুবিচারের বিপরীত কাজ করা হারাম: আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
(وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوْا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبٰي)
‘যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায্য বলবে, স্বজনের সম্পর্কে হলেও’এখানে বিশেষ কোন কথার উল্লেখ করা হয়নি। তাই সকল কথা এতে শামিল, তা কোন সাক্ষ্যের ব্যাপারে হোক, কোন বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে হোক, কিংবা কোন লেনদেনের ব্যাপারে হোক। আল্লাহ তা‘আলা সকল ক্ষেত্রে এমনকি নিজের আত্মীয়-স্বজনের ক্ষেত্রে ন্যায় সাক্ষ্য আর সত্য কথা বলার নির্দেশ দিচ্ছেন। সুতরাং স্বজন-প্রীতি করা, পক্ষপাতিত্ব করা ও অন্যায়ভাবে কারো পক্ষে ফায়সালা দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।
নবম নির্দেশ: আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করা: বলা হয়েছে-
(وَبِعَهْدِ اللّٰهِ أَوْفُوْا)
‘এবং আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করবে’এ অঙ্গীকার বলতে হতে পারে সে অঙ্গীকার যা রূহ জগতে প্রত্যেক আত্মা থেকে আল্লাহ তা‘আলা নিয়েছিলেন যে,
(أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ)
আমি কি তোমাদের রব নই? তখন সবাই বলেছিল: بَلَي شَهِدْنَا হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমাদের রব। এ অঙ্গীকারের দাবী হল যে, পালনকর্তা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাকে মানতে হবে এবং সকল ইবাদত তাঁর জন্যই সম্পাদন করতে হবে।
অথবা আল্লাহ তা‘আলা ও বান্দার মাঝে এবং মানুষের পরস্পর সকল প্রকার অঙ্গীকার হতে পারে, যেমন সূরা মায়িদাহ’র শুরুতে তুলে ধরা হয়েছে।
দশম নির্দেশ:
(وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ)
‘আর নিশ্চয়ই এ পথই আমার সহজ-সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করবে’এ সঠিক পথ বলতে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। এ পথেরই অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। অন্যপথে চললে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। এসব বিধি-বিধান আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করে দিয়েছেন যেন মানুষ মুত্তাকী হতে পারে।
একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর হাত দিয়ে একটি লম্বা রেখা টানলেন এবং বললেন, এটা হল আল্লাহ তা‘আলার সরল পথ। আরো কিছু রেখা তার ডান ও বাম পাশে টানলেন এবং বললেন, এগুলো হল অন্য কিছু পথ যার ওপর শয়তান বসে আছে এবং সে এ পথগুলোর দিকে মানুষকে আহ্বান করে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এ
(وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا)
আয়াত তিলাওয়াত করলেন। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৪১৪২, সহীহ) এ সিরাতে মুসতাকীম হল, মুসলিম উম্মাহর মূল ভিত্তি। এ সরল পথ থেকে দূরে সরে পড়ার কারণে উম্মত বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
অতএব সেই সরল পথে ফিরে আসতে হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ মত সকল পথ ও মত বর্জন করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাধ্যমে ইসলাম মেনে চলতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বিষয় রেখে যাচ্ছি, যতদিন তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বিষয় হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাব কুরআন ও তাঁর নাবীর সুন্নাত হাদীস। (মুয়াত্তা মালিক হা: ৩৩৩৮)
অতএব উপরোক্ত হারাম বিষয়গুলো হতে বেঁচে থেকে কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী সিরাতে মুসতাকীমে প্রতিষ্ঠিত থাকা প্রতিটি মু’মিন-মুসলিমের একান্ত কর্তব্য।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. গুরুত্বপূর্ণ দশটি হারাম বিধান জানতে পারলাম।
২. পিতা-মাতার অধিকারের গুরুত্ব জানতে পারলাম।
৩. আল্লাহ তা‘আলা কারো সাধ্যাতীত বিধান প্রদান করেন না।
৪. নাজাত কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীসের পথেই রয়েছে, অন্য কোন পথে নয়।