(Book# 114/٣١٢)-৫১৫ www.motaher21.net সুরা: আল্‌ আরাফ সুরা:৭ ৫৯-৬২ নং আয়াত:- لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ Indeed, We sent Nuh to his people and he said: অবশ্যই আমরা নূহ্‌কে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে।

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/٣١٢)-৫১৫
www.motaher21.net
সুরা: আল্‌ আরাফ
সুরা:৭
৫৯-৬২ নং আয়াত:-
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ

Indeed, We sent Nuh to his people and he said:
অবশ্যই আমরা নূহ্‌কে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে।
لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِہٖ فَقَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰہٍ غَیۡرُہٗ ؕ اِنِّیۡۤ اَخَافُ عَلَیۡکُمۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۵۹﴾
অবশ্যই আমরা নূহ্‌কে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে। অতঃপর তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর মহাদিনের শাস্তির আশংকা করছি।’

قَالَ الۡمَلَاُ مِنۡ قَوۡمِہٖۤ اِنَّا لَنَرٰىکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۶۰﴾
তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা বলেছিল, ‘আমারা তো তোমাকে স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত দেখছি।’

قَالَ یٰقَوۡمِ لَیۡسَ بِیۡ ضَلٰلَۃٌ وَّ لٰکِنِّیۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۶۱﴾
তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার সম্পপ্রদায়! আমার মধ্যে কোন ভ্ৰষ্টতা নেই, বরং আমি তো সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে রাসূল।’
7:62
اُبَلِّغُکُمۡ رِسٰلٰتِ رَبِّیۡ وَ اَنۡصَحُ لَکُمۡ وَ اَعۡلَمُ مِنَ اللّٰہِ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶۲﴾
‘আমি আমার রবের রিসালাত (যা নিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তা) তোমাদের কাছে পৌছাচ্ছি এবং তোমাদের কল্যাণ কামনা করছি। আর তোমরা যা জান না আমি তা আল্লাহর কাছ থেকে জানি।’

৫৯-৬২ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজীদ বলেছেন;-
এ সূরার ৫৯ নং আয়াত থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত নাবীগণ দ্বীন প্রচারে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন তাদেরই কয়েকজনের আলোচনা নিয়ে আসা হয়েছে। এ সব আয়াত নাবীদের দাওয়াতী মূল মিশন, নিজ সম্প্রদায়ের অবাধ্যতা এবং সর্বশেষে তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে।

প্রথমেই আলোচনা করেছেন নূহ (আঃ)-এর কথা। তিনি উলূল আযম রাসূলগণের অন্যতম একজন। তিনি পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম রাসূল যাকে আদম (আঃ)-এর পর নতুন রিসালাত দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল।

নূহ (আঃ) ও আদম (আঃ)-এর মাঝে সময়ের ব্যবধান দশ শতাব্দিকাল। এর মধ্যবর্তী সময়ের প্রত্যেকেই ইসলামের ওপর ছিলেন।

ইবনু আব্বাস (রাঃ)-সহ অনেক মুফাসসির বলেন: প্রতিমা পূজার সূচনা এভাবে হয়েছিল যে, সৎ ও পূণ্যবান লোকগণ যখন মারা গেলেন তখন তাদের অনুসারীরা তাদের কবরের ওপর মাসজিদ নির্মাণ করে এবং তাদের ছবি তৈরি করে মাসজিদে রেখে দেয় যাতে ঐগুলো দেখে তাদের অবস্থা ও ইবাদতকে স্মরণ করতে পারে। আর এর ফলে যেন নিজেদেরকে তাদের মত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে। যখন কয়েক যুগ অতীত হয়ে গেল। তখন ঐ ছবিগুলোর পরিবর্তে তাদের মূর্তি তৈরি করা হল। কিছু দিন অতীত হবার পর ঐগুলোর ইবাদত করতে লাগল এবং সৎ ব্যক্তিদের নামে নামকরণ করতে লাগল। যেমন ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক, নাসর ইত্যাদি।

এভাবে যখন মূর্তিপূজা বেড়ে গেল তখন তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে নূহ (আঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রেরণ করলেন। নূহ (আঃ) দাওয়াত দিলেন এভাবে:

(يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللّٰهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلٰهٍ غَيْرُه۫)

‘হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ‘ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্যিকার ইলাহ নেই।’ (সূরা আ‘রাফ ৭:৫৯)

এ তাওহীদের দাওয়াত সকল নাবীই দিয়েছেন। যখন তাঁরা এ দাওয়াত দিতেন তখন লোকেরা তাদেরকে পাগল, পথভ্রষ্ট ইত্যাদি বলতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوآ إِنَّ هٰؤُلَا۬ءِ لَضَا۬لُّوْنَ)

“এবং যখন তাদেরকে দেখতো তখন বলত: নিশ্চয়ই এরা পথভ্রষ্ট।” (সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:৩২)

(عَلٰي رَجُلٍ مِّنْكُمْ)

‘তোমাদেরই একজনের মাধ্যমে’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের মধ্য থেকে একজন পুরুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এ বিষয়ে আশ্চর্য হওয়াকে তিনি নিন্দার সাথে উল্লেখ করেছেন।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এরূপ সব উম্মাতেরাই আশ্চর্য হয়েছে যে, আমি তাদের মধ্য হতেই একজন পুরুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(أَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا أَنْ أَوْحَيْنَآ إِلٰي رَجُلٍ مِّنْهُمْ أَنْ أَنْذِرِ النَّاسَ)

“মানুষের জন্য এটা কি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি তাদেরই একজনের নিকট ওয়াহী প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তুমি মানুষকে সতর্ক কর‎।” (সূরা ইউনুস ১০:২)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُّؤْمِنُوْا إِذْ جَا۬ءَهُمُ الْهُدٰي إِلَّآ أَنْ قَالُوْآ أَبَعَثَ اللّٰهُ بَشَرًا رَّسُوْلًا)

‘যখন তাদের নিকট আসে পথনির্দেশ তখন লোকেদেরকে ঈমান আনা হতে বিরত রাখে তাদের এ উক্তি, ‘আল্লাহ কি মানুষকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন?’ (সূরা ইসরা ১৭:৯৪)

অর্থাৎ আমাদের নাবীসহ সকল নাবীই মানুষ ছিলেন তারা কোন ফেরেশতা নন, নূরেরও তৈরি নন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَآ اَرْسَلْنَا قَبْلَکَ مِنَ الْمُرْسَلِیْنَ اِلَّآ اِنَّھُمْ لَیَاْکُلُوْنَ الطَّعَامَ وَیَمْشُوْنَ فِی الْاَسْوَاقِﺚ وَجَعَلْنَا بَعْضَکُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةًﺚ اَتَصْبِرُوْنَﺆ وَکَانَ رَبُّکَ بَصِیْرًا)

“তোমার পূর্বে আমি যে সকল রাসূল প্রেরণ করেছি তারা সকলেই তো আহার করত ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করত। হে মানুষ! আমি তোমাদের পরস্পরকে পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে কি? আর তোমার প্রতিপালক সমস্ত‎ কিছু দেখেন।” (সূরা ফুরকান ২৫:২০)

নূহ (আঃ) ৯৫০ বছর দাওয়াতী কাজ করার পর যখন অধিকাংশ লোকেরাই তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল তখন আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-এর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ব্যতীত সবাইকে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দিলেন। এ সম্পর্কে আলোচনা আরো সামনের সূরাগুলোতে আসবে ইনশা আল্লাহ।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. নাবীদের দাওয়াতী মূলমন্ত্র তাওহীদ।
২. মূর্তিপূজার সূচনা হয় নূহ (আঃ)-এর যুগ থেকে।
৩. সকল নাবীগণই ছিলেন স্বীয় সম্প্রদায় থেকে প্রেরিত একজন পুরুষ। কেউ-ই নূরের তৈরি ফেরেশতা নন।
৪. নাবীদের অবাধ্যতার পরিণতি ভয়াবহ।

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Al-Araf
Sura:7
Verses :- 59-62
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ

Indeed, We sent Nuh to his people and he said:
The Story of Nuh and His People

After Allah mentioned the story of Adam in the beginning of this Surah, He started mentioning the stories of the Prophets, the first then the latter of them.

Allah mentioned the story of Nuh, because he was the first Messenger Allah sent to the people of the earth after Adam. His name was Nuh bin Lamak bin Matushalakh bin Khanukh.

And Khanukh was, as they claim, the Prophet Idris. And Idris was the first person to write letters using pen, and he was the son of Barad bin Mahlil, bin Qanin bin Yanish bin Shith bin Adam, upon them all be peace.

This lineage is mentioned by Muhammad bin Ishaq and other Imams who document lineage.

Abdullah bin Abbas and several other scholars of Tafsir said that;

the first idol worship began when some righteous people died and their people built places of worship over their graves. They made images of them so that they could remember their righteousness and devotion, and thus, imitate them. When time passed, they made statues of them and later on worshipped these idols, naming them after the righteous people:Wadd, Suwa, Yaghuth, Ya`uq and Nasr.

After this practice became popular, Allah sent Nuh as a Messenger, all thanks are due to Him.

Allah tells;

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ

Indeed, We sent Nuh to his people and he said:

Nuh commanded his people to worship Allah alone without partners, saying,

يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ إِنِّيَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

“O my people! Worship Allah! You have no other god but Him. Certainly, I fear for you the torment of a Great Day!”

the torment of the Day of Resurrection, if you meet Allah while associating others with Him

قَالَ الْمَلُ مِن قَوْمِهِ

The leaders of his people said;

meaning, the general public, chiefs, commanders and great ones of his people said,

إِنَّا لَنَرَاكَ فِي ضَلَلٍ مُّبِينٍ

“Verily, we see you in plain error.”

because of your calling us to abandon the worship of these idols that we found our forefathers worshipping.

This, indeed, is the attitude of evil people, for they consider the righteous people to be following misguidance. Allah said in other Ayat,

وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُواْ إِنَّ هَـوُلَاءِ لَضَألُّونَ

And when they saw them, they said:”Verily, these have indeed gone astray!” (83:32)

and,

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُواْ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَوْ كَانَ خَيْراً مَّا سَبَقُونَأ إِلَيْهِ وَإِذْ لَمْ يَهْتَدُواْ بِهِ فَسَيَقُولُونَ هَـذَا إِفْكٌ قَدِيمٌ

And those who disbelieve say of those who believe:”Had it been a good thing, they (the weak and poor) would not have preceded us thereto!” And when they have not let themselves be guided by it (this Qur’an), they say:”This is an ancient lie!” (46:11)

There are several other Ayat on this subject.

قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي ضَلَلَةٌ وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ

(Nuh) said:”O my people! There is no error in me, but I am a Messenger from the Lord of all that exists!”

meaning, there is nothing wrong with me, but I am a Messenger from the Lord of all that exists, Lord and King of all things,

أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ اللّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

“I convey unto you the Messages of my Lord and give sincere advice to you. And I know from Allah what you know not.”

This is the attribute of a Messenger, that he conveys using plain, yet eloquent words, offers sincere advice and is knowledgeable about Allah; indeed, no other people can compete with the Prophets in this regard.

In his Sahih, Muslim recorded that the Messenger of Allah said to his Companions on the Day of Arafah, when their gathering was as large as it ever was,

أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّكُمْ مَسْوُولُونَ عَنِّي فَمَا أَنْتُمْ قَايِلُونَ

O people! You will be asked about me, so what will you say?

They said, “We testify that you have conveyed and delivered (the Message) and offered sincere advice.”

So he kept raising his finger to the sky and lowering it towards them, saying,

اللَّهُمَّ اشْهَدْ اللَّهُمَّ اشْهَد

O Allah! Bear witness, O Allah! Bear witness.

৫৯-৬২ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-

আল্লাহ তা’আলা এ সূরার প্রারম্ভে হযরত আদম (আঃ) এবং তাঁর সম্পর্কীয় ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। এখন তিনি নবীদের ঘটনা বর্ণনা করছেন। হযরত নূহ (আঃ)-এর ঘটনাই তিনি প্রথম শুরু করেছেন। কেননা, তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম রাসূল যাকে আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আঃ)-এর পরে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন নূহ ইবনে লামুক ইবনে মুতাওয়াশলাখ ইবনে উখনূখ। উখনূখের নামই ইদরীস। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, লিখন রীতি তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন উখনূখ ইবনে বুরদ ইবনে মাহ্লীল ইবনে কানীন ইবনে ইয়ানিশ ইবনে শীস ইবনে আদম (আঃ)। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, কোন নবী তাঁর কওমের পক্ষ থেকে দেয়া ততো কষ্ট সহ্য করেননি যতো কষ্ট হযরত নূহ (আঃ) সহ্য করেছেন। তবে হ্যা কোন কোন নবীকে হত্যা করাও হয়েছিল। ইয়াযীদ ইবনে কাশী (রঃ) বলেন যে, হযরত নূহ (আঃ) স্বীয় নফসের উপর অত্যধিক বিলাপ করতেন বলে তাঁকে ‘নূহ’ নামে অভিহিত করা হয়। হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত নূহের যুগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দশ শতাব্দীকাল অতিবাহিত হয়েছে। এসব যুগের সব লোকই ইসলামের নীতির উপর কায়েম ছিলেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও তফসীরের পণ্ডিতগণ বলেনঃ প্রতিমা পূজার সূচনা এইভাবে হয়েছিল যে, সৎ ও পুণ্যাত্মা লোকগণ যখন মারা গেলেন তখন তাঁদের অনুসারীরা তাদের কবরের উপর মসজিদ বানিয়ে নেয় এবং তাঁদের ফটো তৈরী করে মসজিদের মধ্যে রেখে দেয়, যাতে ঐগুলো দেখে তাদের অবস্থা ও ইবাদতকে স্মরণ করতে পারে। আর এর ফলে যেন নিজেদেরকে তাদের মত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে। যখন কয়েক যুগ অতিবাহিত হয়ে গেল তখন ঐ ফটোগুলোর পরিবর্তে তাঁদের মূর্তি তৈরী করা হলো। কিছুদিন পর তারা ঐ মূর্তিগুলোকে সম্মান দেখাতে লাগলো এবং ওগুলোর ইবাদত শুরু করে দিলো।

ঐ পুণ্যবান লোকদের নামে তারা ঐ মূর্তিগুলোর নাম রাখলো। যেমন ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক, নাসর ইত্যাদি। যখন এই মূর্তিমানের পূজা বেড়ে চললো তখন আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল হযরত নূহ (আঃ)-কে প্রেরণ করলেন। তিনি তাদেরকে এক ও শরীক বিহীন আল্লাহর ইবাদত করার হুকুম করলেন। তিনি বললেনঃ “হে আমার কওম! তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর । তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন মাবুদ নেই। আমি তোমাদের প্রতি ভীষণ দিনের শাস্তির আশংকা করছি।” অর্থাৎ আমি এই ভয় করছি যে, কিয়ামতের দিন যখন তোমরা মুশরিক অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।

তখন তাঁর কওমের মধ্যকার প্রধান ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা বললোঃ “নিশ্চয়ই আমরা আপনাকে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতার মধ্যে দেখছি।” অর্থাৎ আপনি আমাদেরকে এসব প্রতিমার ইবাদত করতে নিষেধ করছেন, অথচ আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এর উপরই পেয়েছি। এই ব্যাপারে তো আমরা আপনাকে বড়ই পথভ্রষ্ট মনে করছি।

আজকালকার ফাসিক-ফাজিরদের অবস্থাও অনুরূপ যে, তারা সঙ্কৰ্মশীলদের উপর পথভ্রষ্টতার অপবাদ দিয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এই দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা যখন সকর্মশীল লোকদেরকে দেখে তখন বলে যে, নিশ্চয়ই এরা অবশ্যই পথভ্রষ্ট।” (৮৩:৩২) কাফিররা মুমিনদেরকে বলে-“যদি তাদের কথা সত্য হতো তবে আমরা ইতিপূর্বেই এটা অবলম্বন করতাম।” আর যেহেতু তারা নিজেরা হিদায়াত প্রাপ্ত হয়নি, তাই তারা বলতে শুরু করলো- “এরা তো নিজেরাই পথভ্রষ্ট এবং এরা মিথ্যা বলছে।” এ ধরনের বহু আয়াত রয়েছে।

ইরশাদ হচ্ছে- “নূহ বললো, হে আমার জাতি! আমি কোন ভুলভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার মধ্যে লিপ্ত নই। বরং আমি সারা জাহানের প্রতিপালকের প্রেরিত একজন রাসূল। আমি আমার প্রতিপালকের পয়গাম তোমাদের কাছে পৌছিয়ে দিচ্ছি এবং তোমাদেরকে হিতোপদেশ দিচ্ছি। আর তোমরা যা জান না তা আমি আল্লাহর নিকট থেকে জেনে থাকি।” রাসূলদের শান বা মাহাত্ম এটাই হয় যে, চারুবাক, বাগ্মী, উপদেষ্টা এবং প্রচারক হয়ে থাকেন। আল্লাহর মাখলুকাতের মধ্যে অন্য কেউ এসব গুণে গুণান্বিত হয় না। যেমন সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে,

আরাফার দিন (৯ই যিলহজ্ব) রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে লোক সকল! আমার ব্যাপারে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে (অর্থাৎ আমি আমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছি কি-না তা তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে)। তখন তোমরা কি উত্তর দেবে?” তারা সমস্বরে উত্তর করলেনঃ “আমরা সাক্ষ্য দানে প্রস্তুত আছি যে, আপনি যথাযথভাবে প্রচারকার্য চালিয়েছেন এবং রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করেছেন।” তখন তিনি স্বীয় অঙ্গুলি আকাশের দিকে উঠালেন। অতঃপর তাঁদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। হে আল্লাহ! আপনি সক্ষী থাকুন।”

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
হযরত নূহ আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায় থেকে এ ঐতিহাসিক বিবরণের সূচনা করা হযেছে। কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তানদের যে সৎ ও সুস্থ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে যান, তাতে প্রথম বিকৃতি দেখা দেয় হযরত নূহের যুগে এবং এরই সংশোধন ও এ জীবন ব্যবস্থাকে আবার সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য মহান আল্লাহ‌ হযরত নূহকে পাঠান।

কুরআনের ইঙ্গিত ও বাইবেলের সুস্পষ্ট বর্ণনার পর একথা আজ নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে যে, বর্তমান ইরাকেই হযরত নূহের সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। বেবিলনের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের অভ্যন্তরে বাইবেলের চাইতেও যে প্রাচীন লিপি পাওয়া গেছে, তা থেকেও এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। কুরআনে ও তাওরাতে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, ঐ প্রাচীন লিপিতেও তদ্রুপ এক কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঘটনাটি মুসেল-এর আশেপাশে ঘটেছিল বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কুর্দিস্তান ও আর্মেনিয়া এলাকায় প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় যেসব কিংবদন্তী চলে আসছে তা থেকেও জানা যায় যে, প্লাবনের পর হযরত নূহের নৌকা এ এলাকার কোন এক স্থানে থেমেছিল। আজো মুসেলের উত্তরে ইবনে উমর দ্বীপের আশেপাশে এবং আর্মেনিয়া সীমান্তে “আরারাত” পাহাড়ের আশেপাশে নূহ আলাইহিস সালামের বিভিন্ন নিদর্শন চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ‘নখচীওয়ান’ শহরের অধিবাসীদের মধ্যে আজো এ প্রবাদ প্রচলিত যে, হযরত নুহ এ শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

নূহের প্লাবনের মত প্রায় একই ধরনের ঘটনার কথা গ্রীক, মিসর, ভারত ও চীনের প্রাচীন সাহিত্যেও পাওয়া যায়। এছাড়াও বার্মা, মালয়েশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, অষ্ট্রেলিয়া, নিউগিনি এবং আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায়ও এ একই ধরনের কিংবদন্তী প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এ ঘটনাটি এমন এক সময়ের সাথে সম্পর্কিত যখন সমগ্র মানব জাতির দুনিয়ার একই এলাকায় অবস্থান করতো, তারপর সেখান থেকে তাদের বংশধরেরা দুনিয়ার চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সকল জাতি তাদের উন্মেষকালীন ইতিহাসে একটি সর্বব্যাপী প্লাবনের ঘটনা নির্দেশ করেছে। অবশ্য কালের আবর্তনে এর যথার্থ বিস্তারিত তথ্যাদি তারা বিস্মৃত হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকে নিজের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী আসল ঘটনার গায়ে প্রলেপ লাগিয়ে এক একটা বিরাট কল্পকাহিনী তৈরী করে নিয়েছে।

টিকা:৪৮) কুরআন মজীদের এ স্থানে ও অন্যান্য স্থানে হযরত নূহ ও তাঁর সম্প্রদায়ের যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এ সম্প্রদায়টি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না, তাঁর সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞও ছিল না এবং তাঁর ইবাদাত করতেও তারা অস্বীকার করতো না। বরং তারা প্রকৃতপক্ষে যে গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল সেটি ছিল শিরক। অর্থাৎ তারা আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বে অন্যান্য সত্তাকেও শরীক করতো এবং ইবাদাত লাভের অধিকারে তাদেরকে তাঁর সাথে হিস্সাদার মনে করতো। তারপর এ মৌলিক গোমরাহী থেকে এ জাতির মধ্যে অসংখ্য ত্রুটি ও দুষ্কৃতির জন্ম নেয়। যেসব মনগড়া মাবুদকে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অংশীদার গণ্য করা হয়েছিল, তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জাতির মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্ম হয়। এ শ্রেণীটি সমস্ত ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসে। জাতিকে তারা উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রণীতে বিভক্ত করে। সমাজ জীবন জুলুম ও বিপর্যয়ে ভরপুর করে তোলে। নৈতিক উচ্ছৃংখলতা, চারিত্রিক নৈরাজ্য ও পাপাচারের মাধ্যমে মানবতার মূলে কুঠারাঘাত করে। এ অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য হযরত নূহ আলাইহিস সালাম অত্যন্ত সবর, সহিষ্ণুতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে দীর্ঘকাল প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালান। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তারা নিজেদের প্রতারনা জালে এমনভাবে আবদ্ধ করে নেয় যার ফলে সংশোধনের কোন কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। অবশেষে হযরত নূহ (আ) আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করেনঃ ‍‍”হে আল্লাহ! এ কাফেরদের একজনকেও পৃথিবীর বুকে জীবিত ছেড়ে দিয়ো না। কারণ এদের কাউকে জীবিত ছেড়ে দিলে এরা তোমার বান্দাদেরকে গোমরাহ করতে থাকবে এবং এদের বংশে যাদেরই জন্ম হবে তারাই হবে অসৎকর্মশীল, দুশ্চরিত্র ও বিশ্বাসঘাতক।” (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সুরা হুদ ৩ রুকূ , সূরা শূআরা ৬ রুকূ ও সমগ্র সূরা নূহ) ।

Leave a Reply