(Book# 114/٣١٨)-৫২১ www.motaher21.net সুরা: আল্‌ আরাফ সুরা:৭ ৮৫-৯৩ নং আয়াত:- فَكَيْفَ اسَى عَلَى قَوْمٍ كَافِرِينَ সুতরাং আমি কাফির সম্প্রদায়ের জন্য কি করে আক্ষেপ করতে পারি? “Then how can I grieve over people who are disbelievers!”

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/٣١٨)-৫২১
www.motaher21.net
সুরা: আল্‌ আরাফ
সুরা:৭
৮৫-৯৩ নং আয়াত:-

فَكَيْفَ اسَى عَلَى قَوْمٍ كَافِرِينَ

সুতরাং আমি কাফির সম্প্রদায়ের জন্য কি করে আক্ষেপ করতে পারি?
“Then how can I grieve over people who are disbelievers!”

وَ اِلٰی مَدۡیَنَ اَخَاہُمۡ شُعَیۡبًا ؕ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰہَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰہٍ غَیۡرُہٗ ؕ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ بَیِّنَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ فَاَوۡفُوا الۡکَیۡلَ وَ الۡمِیۡزَانَ وَ لَا تَبۡخَسُوا النَّاسَ اَشۡیَآءَہُمۡ وَ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ بَعۡدَ اِصۡلَاحِہَا ؕ ذٰلِکُمۡ خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿ۚ۸۵﴾

আর আমি মাদইয়ানবাসীদের কাছে তাদেরই ভাই শু‘আইবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মা‘বূদ নেই। তোমাদের রবের পক্ষ হতে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট দলীল এসে গেছে। সুতরাং তোমরা ওযন ও পরিমাণ পূর্ণ মাত্রায় দিবে, মানুষকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবেনা। আর দুনিয়ায় শান্তি শৃংখলা স্থাপনের পর ঝগড়া ফাসাদ ও বিপর্যয় ঘটাবেনা, তোমরা বাস্তবিক পক্ষে ঈমানদার হলে এই পথই হল তোমাদের জন্য কল্যাণকর।

وَ لَا تَقۡعُدُوۡا بِکُلِّ صِرَاطٍ تُوۡعِدُوۡنَ وَ تَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ مَنۡ اٰمَنَ بِہٖ وَ تَبۡغُوۡنَہَا عِوَجًا ۚ وَ اذۡکُرُوۡۤا اِذۡ کُنۡتُمۡ قَلِیۡلًا فَکَثَّرَکُمۡ ۪ وَ انۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ﴿۸۶﴾
আর (জীবনের) প্রতিটি পথে এমনিভাবে দস্যি হয়ে যেওনা যে, ঈমানদার লোকদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আল্লাহর পথ হতে বিরত রাখতে থাকবে এবং সহজ সরল পথকে বক্র করায় ব্যস্ত থাকবে। ঐ অবস্থানটির কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা সংখ্যায় স্বল্প ছিলে, অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে দিলেন, আর এই জগতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণতি কি হয়েছে তা জ্ঞানচক্ষু খুলে লক্ষ্য কর।

وَ اِنۡ کَانَ طَآئِفَۃٌ مِّنۡکُمۡ اٰمَنُوۡا بِالَّذِیۡۤ اُرۡسِلۡتُ بِہٖ وَ طَآئِفَۃٌ لَّمۡ یُؤۡمِنُوۡا فَاصۡبِرُوۡا حَتّٰی یَحۡکُمَ اللّٰہُ بَیۡنَنَا ۚ وَ ہُوَ خَیۡرُ الۡحٰکِمِیۡنَ ﴿۸۷﴾
আমার নিকট যা (আল্লাহর পক্ষ হতে) প্রেরিত হয়েছে তা যদি তোমাদের কোন দল বিশ্বাস করে এবং কোন দল অবিশ্বাস করে তাহলে ধৈর্য ধারণ কর যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের মধ্যে চুড়ান্ত ফাইসালা করে দেন। তিনিই হলেন উত্তম ফাইসালাকারী।

قَالَ الۡمَلَاُ الَّذِیۡنَ اسۡتَکۡبَرُوۡا مِنۡ قَوۡمِہٖ لَنُخۡرِجَنَّکَ یٰشُعَیۡبُ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مَعَکَ مِنۡ قَرۡیَتِنَاۤ اَوۡ لَتَعُوۡدُنَّ فِیۡ مِلَّتِنَا ؕ قَالَ اَوَ لَوۡ کُنَّا کٰرِہِیۡنَ ﴿۟۸۸﴾
আর তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক ও অহংকারী প্রধানরা বলেছিলঃ হে শু‘আইব! আমরা অবশ্যই তোমাকে, তোমার সংগী সাথী মু’মিনদেরকে আমাদের জনপদ হতে বহিস্কার করব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসবে। সে বললঃ আমরা যদি তাতে রাযী না হই?
قَدِ افۡتَرَیۡنَا عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا اِنۡ عُدۡنَا فِیۡ مِلَّتِکُمۡ بَعۡدَ اِذۡ نَجّٰنَا اللّٰہُ مِنۡہَا ؕ وَ مَا یَکُوۡنُ لَنَاۤ اَنۡ نَّعُوۡدَ فِیۡہَاۤ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ رَبُّنَا ؕ وَسِعَ رَبُّنَا کُلَّ شَیۡءٍ عِلۡمًا ؕ عَلَی اللّٰہِ تَوَکَّلۡنَا ؕ رَبَّنَا افۡتَحۡ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَ قَوۡمِنَا بِالۡحَقِّ وَ اَنۡتَ خَیۡرُ الۡفٰتِحِیۡنَ ﴿۸۹﴾
তোমাদের ধর্মাদর্শ হতে আল্লাহ আমাদেরকে মুক্তি দেয়ার পর আমরা যদি তাতে আবার ফিরে যাই তাহলে নিশ্চিতভাবে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী হব! আমাদের রাব্ব আল্লাহ না চাইলে ওতে আবার ফিরে যাওয়া আমাদের পক্ষে কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। সবকিছুই আমাদের রবের জ্ঞানায়ত্ত, আমরা আল্লাহর উপরই নির্ভর করছি। হে আমাদের রাব্ব! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সঠিকভাবে ফাইসালা করে দিন, আপনিইতো সর্বোত্তম ফাইসালাকারী।
وَ قَالَ الۡمَلَاُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ قَوۡمِہٖ لَئِنِ اتَّبَعۡتُمۡ شُعَیۡبًا اِنَّکُمۡ اِذًا لَّخٰسِرُوۡنَ ﴿۹۰﴾

আর তাদের সম্প্রদায়ের কাফির সর্দাররা বললঃ তোমরা যদি শু‘আইবকে অনুসরণ কর তাহলে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

فَاَخَذَتۡہُمُ الرَّجۡفَۃُ فَاَصۡبَحُوۡا فِیۡ دَارِہِمۡ جٰثِمِیۡنَ ﴿ۚۖۛ۹۱﴾
অতঃপর ভূ-কম্পন তাদেরকে গ্রাস করল, ফলে তারা নিজেদের গৃহেই উপুড় হয়ে পড়ে রইল।

الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا شُعَیۡبًا کَاَنۡ لَّمۡ یَغۡنَوۡا فِیۡہَا ۚۛ اَلَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا شُعَیۡبًا کَانُوۡا ہُمُ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۹۲﴾
অবস্থা দেখে মনে হল, যারা শু‘আইবকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তারা যেন কখনও সেখানে বসবাস করেনি, শু‘আইবকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী লোকেরাই শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

فَتَوَلّٰی عَنۡہُمۡ وَ قَالَ یٰقَوۡمِ لَقَدۡ اَبۡلَغۡتُکُمۡ رِسٰلٰتِ رَبِّیۡ وَ نَصَحۡتُ لَکُمۡ ۚ فَکَیۡفَ اٰسٰی عَلٰی قَوۡمٍ کٰفِرِیۡنَ ﴿٪۹۳﴾
সে তাদের নিকট হতে এ কথা বলে বেরিয়ে এলোঃ হে আমার জাতি! আমি আমার রবের বার্তা তোমাদের নিকট পৌঁছিয়েছি এবং সৎ উপদেশ দিয়েছি। সুতরাং আমি কাফির সম্প্রদায়ের জন্য কি করে আক্ষেপ করতে পারি?

৮৫-৯৩ নং আয়াতের তাফসীরঃ
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-

আলোচ্য আয়াতগুলোতে প্রসিদ্ধ নাবী শু‘আইব (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় ৫৩টি আয়াতে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। লূত (আঃ)-এর অবাধ্য জাতিকে ধ্বংসের অনতিকাল পরে তাঁকে নবুওয়াত দিয়ে মাদইয়ানবাসীদের হিদায়াতের জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। মাদইয়ান হল লূত সাগরের নিকটবর্তী সিরিয়া ও হিজাযের সীমান্তবর্তী একটি জনপদের নাম। যা অদ্যাবধি পূর্ব জর্ডানের সামুদ্রিক বন্দর ‘মো‘আন’ (معان ) এর অদূরে বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রধান ছয়টি প্রাচীন জাতির মধ্যে ৫ম জাতি হল ‘আহলে মাদইয়ান’। আহলে মাদইয়ান-কে পবিত্র কুরআনের সূরা হিজর, শুআরা, সোয়াদ ও ক্বাফে ‘আসহাবুল আইকাহ’

(اصحاب الايكة)

বলা হয়েছে। যার অর্থ জঙ্গলের অধিবাসী। এটা বলার কারণ এই যে, এ অবাধ্য জাতি প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে নিজেদের বসতি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সেখানেই ধ্বংস করে দেন। এটাও বলা হয় যে, উক্ত জঙ্গলে ‘আইকা’ বলে একটা গাছকে তারা পূজা করত। যার আশপাশ জঙ্গল বেষ্টিত ছিল। খুব সুন্দর ও উত্তমভাবে কথা বলার কারণে শু‘আইব (আঃ)

(خطيب الانبياء)

‘খতীবুল আম্বিয়া’ বা নাবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বক্তা বলা হয়।

শু‘আইব (আঃ)-এর দাওয়াত:

বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর মাঝে যেমন বড় বড় অন্যায় ও কুকর্ম ছিল তেমনি শু‘আইব (আঃ)-এর জাাতির মাঝে অনেক অন্যায়, অবিচার ও জুলুম অত্যাচার ছিল। তারা আল্লাহ তা‘আলা ও মানুষ উভয়ের হক নষ্ট করত। তাই শু‘আইব (আঃ) প্রথমেই অন্যান্য নাবীদের মত জাতিকে এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার হক সম্পর্কে সচেতন করতঃ বাতিল মা‘বূদ বর্জন করতে গিয়ে বললেন,

(اعْبُدُوا اللہَ مَا لَکُمْ مِّنْ اِلٰھٍ غَیْرُھ۫)

‘তোমরা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন সত্য মা‘বূদ নেই’ আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের এরূপ নির্দেশের বাণী সূরা হূদের ৮৪ নং আয়াতেও উল্লেখ রয়েছে। তাদের এ বহুত্ববাদী ধর্মদর্শন থেকে আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের দিকে ফিরিয়ে আসতেই মূলত নাবী শু‘আইবকে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও তাদের অনেক সামাজিক অপরাধ ছিল সেগুলো থেকেও তিনি তাদেরকে বিরত থাকার দাওয়াত দেন, যেমন;-

(১) তারা মাপ ও ওজনে কম দিয়ে বান্দার হক নষ্ট করত। সেদিকে ইঙ্গিত করে শু‘আইব (আঃ) বলেন:

(فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيْزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَا۬ءَهُمْ)

‘তোমরা ওজন ও পরিমাপ পূর্ণ মাত্রায় দেবে, মানুষকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না’ আয়াতের প্রথমাংশে বিশেষভাবে মাপ ও ওজনে পূর্ণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শেষাংশে সর্বপ্রকার হকে ত্র“টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। সে হক মানুষের ধন-সম্পদ, ইযযত-আবরূ বা যেকোন বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট হোক না কেন। বস্তুত মাপ ও ওজনে কম দেয়া যেমন অপরাধ কারো সম্মান হানি করাও তেমন অপরাধ।

অতঃপর তিনি বললেন:

(وَلَا تُفْسِدُوْا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا)

‘শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের পর তোমরা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ইবাদত করা, মাপে কম দেয়া, মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করা ইত্যাদি ফাসাদ সৃষ্টি করা। আর যারা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করে তাদের অপরাধ অনুযায়ী উপযুক্ত শাস্তির কথা সূরা মায়িদার ৩৩ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

(২) তাদের আরেকটি অন্যতম অপরাধ ছিল তারা মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পথে বাধা ও ভয় প্রদান করত। মানুষকে ঈমান আনতে বাধা দিত; কেউ ঈমান আনলে তাকে হত্যা করার হুমকি দিত। সূরা হূদের ৮৭ নং আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাদের আরেকটি দুষ্কর্ম তুলে ধরে বলেন: তারা প্রচলিত স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার পার্শ্ব হতে সোনা ও রূপার কিছু অংশ কেটে রেখে সেগুলো বাজারে চালিত দিত। শু‘আইব (আঃ) তাদেরকে এসব কাজ থেকে বারণ করতেন।

(৩) তাদের অকৃতজ্ঞতার বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘আর ঐ অবস্থাটির কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা সংখ্যায় স্বল্প ছিলে, অতঃপর তিনি (আল্লাহ তা‘আলা) তোমাদের সংখ্যা বেশি করে দিলেন’ তোমরা ধন-সম্পদে হীন ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের প্রাচুর্য দান করেছেন। অথচ তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ না হয়ে নানাবিধ শির্ক ও কুফরীতে লিপ্ত হয়েছ। অতএব তোমরা সাবধান হও এবং তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি নূহ, আদ, সামূদ ও লূত এর ধ্বংসলীলার কথা স্বরণ কর। তাদের মর্মান্তিক পরিণাম ও অকল্পনীয় গযবের কথা মনে রেখে হিসাব-নিকাশ করে পা বাড়াও।

শু‘আইব (আঃ) তাদেরকে এ কথাও বললেন: আমি এ দাওয়াতের জন্য তোমাদের কাছে কোন অর্থ কড়ি চাই না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন:

(وَمَآ اَسْئَلُکُمْ عَلَیْھِ مِنْ اَجْرٍﺆ اِنْ اَجْرِیَ اِلَّا عَلٰی رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ)

“আমি তোমাদের নিকট এটার জন্য কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরস্কার তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকটই আছে।” (সূরা শু‘আরা ২৬:১৭৬) তাঁর এসব দাওয়াতের বাণী সূরা হূদের ৮৪-৯৫, শু‘আরার ১৭৬-১৯১ নং আয়াতের উল্লেখ রয়েছে।

দাওয়াতের ফলশ্র“তি:

শু‘আইব (আঃ)-এর নিঃস্বার্থ ও আন্তরিকতাপূর্ণ দাওয়াত তাঁর উদ্ধত জাতির নেতাদের হৃদয়ে রেখাপাত করল না। তারা বরং আরও উদ্ধত হয়ে তাঁর দরদ ভরা সুললিত বয়ান ও অপূর্ব চিত্তহারী বাগ্মীতার জবাবে পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির পাপিষ্ঠ নেতাদের ন্যায় নাবীকে প্রত্যাখ্যান করল এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ ও তাচ্ছিল্য করে বলল: ‘হে শু‘আয়ব! তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা যার ‘ইবাদত করত আমরা তা বর্জন করি অথবা আমরা আমাদের ধন-সম্পদ সম্পর্কে যা করি তাও? তুমি তো অবশ্যই সহিষ্ণু, ভাল মানুষ।’ (সূরা হূদ ১১:৮৭)

অর্থাৎ তুমি একজন জ্ঞানী ও দূরদর্শী হয়ে কিভাবে এ কথা বলতে পারলে যে, আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা দেব-বেদীর পূজা ও শির্কী প্রথা বর্জন করি। তাদের আপত্তি ছিল কেবল এখানে যে, সব কিছু ছেড়ে কেবল আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে এবং দুনিয়াবী ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। তারা ধর্মকে কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমিত মনে করত এবং ব্যবহারিক জীবনে তার কোন দখল দিতে প্রস্তুত ছিল না।

অবাধ্য জাতির এরূপ বিদ্রুপাত্মক ও রূঢ় মন্তব্যসমূহে বিচলিত না হয়ে অতীব ধৈর্য ও দরদের সাথে তিনি তাদের সম্বোধন করে বললেন: ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আমি যদি আমার প্রতিপালক প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি তাঁর নিকট হতে আমাকে উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করে থাকেন তবে কি করে আমি আমার কর্তব্য হতে বিরত থাকব? আমি তোমাদেরকে যা নিষেধ করি আমি নিজে তা করতে ইচ্ছা করি না। আমি আমার সাধ্যমত সংস্কার করতে চাই। আমার কার্যসাধন আল্লাহ তা‘আলারই সাহায্যে; আমি তাঁরই ওপর নির্ভর করি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী। ‘হে আমার সম্প্রদায়। আমার সাথে বিরোধ যেন কিছুতেই তোমাদেরকে এমন অপরাধ না করায় যাতে তোমাদের ওপর তার অনুরূপ বিপদ পতিত হয় যা পতিত হয়েছিল নূহের সম্প্রদায়ের ওপর অথবা হূদের সম্প্রদায়ের ওপর কিংবা সালিহের সম্প্রদায়ের ওপর; আর লূতের সম্প্রদায় তোমাদের হতে দূরে নয়। ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর‎ ও তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন কর‎; আমার প্রতিপালক পরম দয়ালু, ভালবাসা পোষণকারী।’ (সূরা হূদ ১১:৮৮-৯৩)
জবাবে তাদের দাম্ভিক নেতারা চূড়ান্তভাবে বলে দিল: ‘হে শু‘আইব! আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে অবশ্যই তাদেরকে আমাদের জনপদ হতে বহিষ্কার করব অথবা অবশ্যই তোমাদেরকে আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসতে হবে।’

তারা আরোও বলল: ‘তুমি তো জাদুগ্রস্ত‎দের অন্ত‎র্ভুক্ত; তুমি আমাদের মতোই একজন মানুষ, আমরা মনে করি, তুমি মিথ্যাবাদীদের অন্যতম। তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে আকাশের এক খণ্ড আমাদের ওপর ফেলে দাও।

তারা স্বজাতির উদ্দেশ্যে শু‘আইব (আঃ) সম্পর্কে সতর্ক করে বলল: ‘যদি তোমরা শু‘আইবকে অনুসরণ কর তবে তো তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

শু‘আইব (আঃ) তখন সত্য চির অম্লানের কথা জানিয়ে দিয়ে বললেন: ‘তোমাদের ধর্মাদর্শ হতে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে উদ্ধার করার পর যদি আমরা তাতে ফিরে যাই তাহলে তো আমরা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মিথ্যারোপ করব। আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা না করলে আর তাতে ফিরে যাওয়া আমাদের জন্য সমীচীন নয়।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করে বললেন: হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যভাবে মীমাংসা করে দাও এবং তুমিই শ্রেষ্ঠ মীমাংসাকারী।’

অবশেষে দাওয়াতের মাধ্যমে কোন কাজ না করতে পেরে শু‘আইব (আঃ) তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং সে কথা বলেছেন যে কথা সালেহ বলেছিলেন।

(فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ)

‘তাদেরকে একটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প এসে গ্রাস করে নিলো’ অর্থাৎ শু‘আইব (আঃ)-এর বদদু‘আর ফলে এবং তাদের কৃতকর্মের কারণে ধ্বংস তাদেরকে পাকড়াও করল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَمَّا جَا۬ءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا شُعَيْبًا وَّالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مَعَه۫ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا ج وَأَخَذَتِ الَّذِيْنَ ظَلَمُوا الصَّيْحَةُ فَأَصْبَحُوْا فِيْ دِيَارِهِمْ جٰثِمِيْنَ – كَأَنْ لَّمْ يَغْنَوْا فِيْهَا ط أَلَا بُعْدًا لِّمَدْيَنَ كَمَا بَعِدَتْ ثَمُوْدُ)

“যখন আমার নির্দেশ আসল তখন আমি শু‘আয়ব ও তার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করেছিলাম। অতঃপর যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল তাদেরকে এক বিকট গর্জন আঘাত করল, ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় পড়ে রইল, যেন তারা সেথায় কখনও বসবাস করেনি। জেনে রেখ!‎ ধ্বংসই ছিল মাদ্ইয়ানবাসীদের পরিণাম, যেভাবে ধ্বংস হয়েছিল সামূদ সম্প্রদায়।” (সূরা হূদ ১১:৯৪-৯৫)

অতএব নাবী-রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, মানুষের অধিকার নষ্ট করতঃ ওজনে কম দেয়া, খাদ্যে ভেজাল দেয়া ও ঈমান আনতে অন্যদেরকে বাধা এবং ভীতি প্রদান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এগুলো থেকে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. পূর্ববর্তী এসব নাবীদের অবাধ্য জাতির বর্ণনা তুলে ধরার প্রধান কারণ তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেরা সতর্ক হওয়া।
২. যুগে যুগে মানুষকে এক আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়া হলে একশ্রেণির মানুষ বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে সত্য বিমুখ হয়েছে।
৩. ওজনে ও মাপে কম দেয়া, মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার পথে চলতে বাধা দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
৪. প্রত্যেক জাতির অধিকাংশ প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা ঈমান আনার সৌভাগ্য পায়নি, বরং দুর্বলরাই ঈমান আনেছে এবং ক্ষমতাসীনরা দুর্বলদেরকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছে, ঈমানের পথে বাধা দিয়েছে।
৫. শির্ক-বিদ‘আত ও জুলুম অধ্যুষিত সমাজে তাওহীদের দাওয়াতের মাধ্যমে সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াকে দুনিয়াদার সমাজনেতারা ‘ফাসাদ’ ও ‘ক্ষতিকর’ মনে করলেও মূলতঃ সেটাই হল সমাজ সংস্কারের কাজ।
৬. বাতিলের সাথে আপোষ করে কোন দিন আল্লাহ তা‘আলার দীন কায়েম সম্ভব নয়, বাতিলকে বাতিল হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে।

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Al-Araf
Surah:-7

فَتَوَلَّى عَنْهُمْ وَقَالَ فَكَيْفَ اسَى عَلَى قَوْمٍ كَافِرِينَ

“Then how can I grieve over people who are disbelievers!”

Story of Shu`ayb, upon him be Peace, and the Land of Madyan

Allah says;

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا

And to (the people of) Madyan, (We sent) their brother Shu`ayb.

Muhammad bin Ishaq said,

“They (the people of Madyan) are the descendents of Madyan, son of Midyan, son of Ibrahim. Shu`ayb was the son of Mikil bin Yashjur. And in the Syrian language, his name was Yathrun (Jethro).”

I (Ibn Kathir) say,

Madyan was the name of the tribe and also a city that is close to Ma`an on route to the Hijaz (from Ash-Sham).

Allah said in another Ayah,

وَلَمَّا وَرَدَ مَأءَ مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِّنَ النَّاسِ يَسْقُونَ

And when he arrived at the water (a well) of Madyan he found there a group of men watering (their flocks). (28:23)

They are also the people of Al-Aykah (the Woods), as we will mention later on, Allah willing, and our trust is in Him.

قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ

He said:”O my people! Worship Allah! You have no other God but Him,”

and this is the call of all Messengers,

قَدْ جَاءتْكُم بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ

“Verily, a clear proof (sign) from your Lord has come unto you;”

meaning,

`Allah has presented the proof and evidences of the truth of what I brought you.’

He then advised and commanded them,

فَأَوْفُواْ الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُواْ النَّاسَ أَشْيَاءهُمْ

so give full measure and full weight and wrong not men in their things,

meaning, to refrain from cheating people in buying and selling.

They used to treacherously avoid giving full weight and measure.

Allah said in other Ayat,
وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِينَ
(Woe to Al-Mutaffifin (those who give less in measure and weight)… (83:1) until He said,
لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
(before the Lord of all that exists). (83:6)

وَلَا تُفْسِدُواْ فِي الَارْضِ بَعْدَ إِصْلَحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّوْمِنِينَ

and do not do mischief on the earth after it has been set in order, that will be better for you, if you are believers.

These Ayat contain a stern warning and sure promise that we ask Allah to save us from.

Shu`ayb was called `Speaker of the Prophets’, because of his eloquent words and eloquent advice, and Allah stated that Shu`ayb said

Prophet Shu`ayb forbade his people from setting up blockades on the roads, saying,

وَلَا تَقْعُدُواْ بِكُلِّ صِرَاطٍ تُوعِدُونَ

“And sit not on every road, threatening,”

According to As-Suddi,

threatening people with death if they do not give up their money, as they were bandits,

Ibn Abbas, Mujahid and several others commented:

the believers who come to Shu`ayb to follow him.”

The first meaning is better, because Prophet Shu`ayb first said to them,
بِكُلِّ صِرَاطٍ
(“on every road…”). He then mentioned the second meaning,

وَتَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللّهِ مَنْ امَنَ بِهِ وَتَبْغُونَهَا عِوَجًا

“and hindering from the path of Allah those who believe in Him, and seeking to make it crooked.”

meaning, you seek to make the path of Allah crooked and deviated.

وَاذْكُرُواْ إِذْ كُنتُمْ قَلِيلً فَكَثَّرَكُمْ

“And remember when you were but few, and He multiplied you.”

meaning, you were weak because you were few. But you later on became mighty because of your large numbers. Therefore, remember Allah’s favor.

وَانظُرُواْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ

“And see what was the end of the mischief-makers.”

from the previous nations and earlier generations. See the torment and punishment they suffered, because they disobeyed Allah and rejected His Messengers.

Shu`ayb continued

وَإِن كَانَ طَأيِفَةٌ مِّنكُمْ امَنُواْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ وَطَأيِفَةٌ لَّمْ يْوْمِنُواْ

“And if there is a party of you who believes in that with which I have been sent and a party who does not believe,”

that is, if you divided concerning me,

فَاصْبِرُواْ

“so be patient,”

that is, then wait and see,

حَتَّى يَحْكُمَ اللّهُ بَيْنَنَا

“until Allah judges between us,” (and you),

وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِين

“and He is the best of judges.”

Surely, Allah will award the best end to those who fear and obey Him and He will destroy the disbelievers
Allah describes the way the disbelievers answered His Prophet Shu`ayb and those who believed in him, by threatening them with expulsion from their village, or with forceful reversion to the disbeliever’s religion.

Allah tells,

قَالَ الْمَلُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُواْ مِن قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ امَنُواْ مَعَكَ مِن قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا

The chiefs of those who were arrogant among his people said:”We shall certainly drive you out, O Shu`ayb and those who have believed with you from our town, or else you (all) shall return to our religion.”

The chiefs spoke the words mentioned here to the Messenger Shu`ayb, but intended it for those who followed his religion too.

The statement,

قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ

He said:”Even though we hate it!”

means, would you force us to do that, even though we hate what you are calling us to

قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُم بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللّهُ مِنْهَا

“We should have invented a lie against Allah if we returned to your religion, after Allah has rescued us from it.

Certainly if we revert to your religion and accept your ways, we will have uttered a tremendous lie against Allah by calling partners as rivals to Him,

وَمَا يَكُونُ لَنَا أَن نَّعُودَ فِيهَا إِلاَّ أَن يَشَاء اللّهُ رَبُّنَا

And it is not for us to return to it unless Allah, our Lord, should will.

This part of the Ayah refers all matters to Allah’s will, and certainly, He has perfect knowledge of all matters and His observation encompasses all things,

وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا

Our Lord comprehends all things in His knowledge.

عَلَى اللّهِ تَوَكَّلْنَا

In Allah (Alone) we put our trust.

concerning all our affairs, what we practice of them and what we ignore,

رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ

Our Lord! Judge between us and our people in truth,

judge between us and our people and give us victory over them,

وَأَنتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ

for You are the best of those who give judgment.

and You are the Most Just Who never wrongs any in His judgment

Allah tells,

وَقَالَ الْمَلُ الَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قَوْمِهِ

The chiefs of those who disbelieved among his people said (to their people):

Allah describes the enormity of disbelief, rebellion, transgression and misguidance (of Shu`ayb’s people) and the defiance of truth encrypted in their hearts. They vowed, saying,

لَيِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْباً إِنَّكُمْ إِذاً لَّخَاسِرُونَ

“If you follow Shu`ayb, be sure then you will be the losers!”

Allah answered them,

فَأَخَذَتْهُمُ الرَّجْفَةُ فَأَصْبَحُواْ فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ
So the earthquake seized them and they lay (dead), prostrate in their homes.

Allah said that the earthquake shook them, as punishment for threatening to expel Shu`ayb and his followers.

Allah mentioned their end again in Surah Hud,

وَلَمَّا جَأءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا شُعَيْبًا وَالَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِّنَّا وَأَخَذَتِ الَّذِينَ ظَلَمُواْ الصَّيْحَةُ فَأَصْبَحُواْ فِى دِيَـرِهِمْ جَـثِمِينَ

And when Our commandment came, We saved Shu`ayb and those who believed with him by a mercy from Us. And the Sayhah (loud cry) seized the wrongdoers, and they lay (dead) prostrate in their homes. (11:94)

This Ayah mentions the Sayhah (cry) that struck them after they mocked Shu`ayb, saying,
أَصَلَتُكَ تَأْمُرُكَ
. (Does your Salah (prayer) command you…11:87), so it was befitting to mention here the cry that made them silence.

In Surah Ash-Shu`ara, Allah said,
فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمْ عَذَابُ يَوْمِ الظُّلَّةِ إِنَّهُ كَانَ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
But they belied him, so the torment of the Day of Shadow (a gloomy cloud) seized them. Indeed that was the torment of a Great Day. (26:189) because they challenged Shu`ayb,
فَأَسْقِطْ عَلَيْنَا كِسَفًا مِّنَ السَّمَاء
(“So cause a piece of the heaven to fall on us, if you are of the truthful!)” (26:187).

Therefore, Allah stated that each of these forms of punishment struck them on the Day of the Shadow.

First,
فَأَخَذَهُمْ عَذَابُ يَوْمِ الظُّلَّةِ
So the torment of the Day of Shadow (a gloomy cloud) seized them (26:189), when a gloomy cloud came over them (containing) fire, flames and a tremendous light.

Next, a cry from the sky descended on them and a tremor shook them from beneath. Consequently, their souls were captured, their lives were taken and their bodies became idle,
فَأَصْبَحُواْ فِي دَارِهِمْ جَاثِمِينَ
(and they lay (dead), prostrate in their homes).

Allah said next

الَّذِينَ كَذَّبُواْ شُعَيْبًا كَأَن لَّمْ يَغْنَوْاْ فِيهَا

Those who belied Shu`ayb, became as if they had never dwelt there (in their homes).

meaning, after the torment seized them, it looked as if they never dwelled in the land from which they wanted to expel their Messenger Shu`ayb and his followers.

Here, Allah refuted their earlier statement,

الَّذِينَ كَذَّبُواْ شُعَيْبًا كَانُواْ هُمُ الْخَاسِرِينَ

Those who belied Shu`ayb, they were the losers.

Allah tells;
Then he (Shu`ayb) turned from them and said:

Prophet Shu`ayb, peace be upon him, turned away from his people after the torment, punishment and destruction struck them, admonishing and censuring them by saying to them,

يَا قَوْمِ لَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَنَصَحْتُ لَكُمْ

“O my people! I have indeed conveyed my Lord’s Messages unto you and I have given you good advice.”

Shu`ayb said, I have conveyed to you what I was sent with, so I will not feel any sorrow for you since you disbelieved in what I brought you,

فَكَيْفَ اسَى عَلَى قَوْمٍ كَافِرِينَ

“Then how can I grieve over people who are disbelievers!”

তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-

সুরইয়ানী ভাষায় হযরত শুআইব (আ)-এর প্রকৃত নাম ছিল ইয়াসরূন। মাদিয়ান শব্দটি গোত্রের উপরেও প্রয়োগ করা হতো এবং শহরের অর্থেও ব্যবহৃত হতো। এটা মাআন’ নামক জায়গার নিকটে অবস্থিত, যা হিজাযের পথে রয়েছে। (বর্তমানে মাআন’ হচ্ছে জর্দানের পূর্বে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ শহর) যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “যখন সে (হযরত মূসা আঃ মাদিয়ানের ঝর্ণার কাছে পৌছালো তখন সেখানে এমন কতক লোককে পেলো যারা ঐ ঝর্ণা হতে পানি নিচ্ছিল। তারা হচ্ছে আসহাবুল আয়কাত, যার বর্ণনা ইনশাআল্লাহ অতিসত্বরই দেয়া হবে। ইরশাদ হচ্ছে- সে (শুআইব আঃ) বললো- হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহরই ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মা’বুদ নেই। সমস্ত রাসূলেরই তাবলীগ ও দাওয়াত এটাই ছিল। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হতে সুস্পষ্ট দলীল এসে গেছে।

হযরত শুআইব (আঃ) লোকদেরকে তাদের ব্যবহারিক জীবনের লেনদেন সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে বলেনঃ তোমরা নিজেদের ওজন ও পরিমাপ ঠিক রাখবে, লোকদের ক্ষতি করবে না। অন্যদের মালে তোমরা খিয়ানত করবে না। পরিমাপ ও ওজনে চুরি করে কম করতঃ কাউকেও প্রতারিত করবে না। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, “পরিমাপ ও ওজনে কমকারীদের জন্যে বড়ই ধ্বংস ও অকল্যাণ রয়েছে।” এটা হচ্ছে কঠিন ধমক ও হুমকি এবং ভীতি প্রদর্শন।

এরপর আল্লাহ তা’আলা হযরত শুআইব (আঃ) সম্পর্কে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি স্বীয় কওমকে উপদেশ দিতেন। তাঁকে ‘খতীবুল আম্বিয়া বা নবীদের ভাষণদাতা বলা হতো। কেননা, তিনি অত্যন্ত বাকপটুতার সাথে ভাষণ দিতে পারতেন এবং জনগণকে অতি চমৎকার ভাষায় উপদেশ দিতেন।

 

হযরত শুআইব (আঃ) জনগণকে ইন্দ্রিয়গতভাবে এবং মৌলিকভাবে ডাকাতি করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ তিনি তাদেরকে বলেছেন-তোমরা পথের উপর বসে জনগণকে ভীতিপ্রদর্শন করতঃ কিছু কেড়ে ও লুটপাট করে নিয়ো না এবং তাদের মাল তোমাদেরকে দিতে অস্বীকার করলে তোমরা তাদেরকে হত্যা করে ফেলার হুমকি দিয়ো না। এটা লুণ্ঠনকারীরা শুল্ক আদায়ের নাম দিয়ে লুণ্ঠন করতো আর যারা হিদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে হযরত শুআইব (আঃ)-এর কাছে আসতো তাদেরকে বাধা প্রদান করতো এবং আসতে দিতো না। এই দ্বিতীয়টি হচ্ছে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি । প্রথম উক্তিটিই হচ্ছে বেশী স্পষ্ট এবং রচনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা, সিরাতের অর্থ পথ। আর হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) যা বুঝেছেন তা তো মহান আল্লাহ অন্য আয়াতে স্বয়ং বলেছেনঃ “যারা ঈমান এনেছে, তোমরা তাদের পথে বসে যাচ্ছ এবং সৎলোকদেরকে আমার পথে আসতে বাধা প্রদান করতঃ ভুল পথে ফিরিয়ে দিচ্ছ।” (হযরত শুআইব আঃ স্বীয় কওমের লোকদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ) হে আমার কওমের লোকেরা! তোমরা সংখ্যায় কম ছিলে, এবং দুর্বল ছিলে অতঃপর আল্লাহ তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতঃ তোমাদের শক্তিশালী করেছেন, এ জন্যে তোমাদের তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কেননা, এটা তোমাদের প্রতি মহান আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ বটে। পূর্বযুগে পাপীদেরকে পাপের কারণে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। তারা বেপরোয়াভাবে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করতো। এ কারণে তাদের পরিণাম এইরূপ হয়েছিল। এর থেকে তোমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত যে, তোমরা এইরূপ কাজ করলে তোমাদের পরিণতিও ঐরূপই হবে। আমার প্রচারের মাধ্যমে যদি তোমাদের একটি দল ঈমান আনয়ন করে এবং অন্য দল ঈমান না আনে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর এবং ধৈর্যের সাথে কাজ কর যে পর্যন্ত না আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেন। তিনিই হচ্ছেন সর্বোত্তম ফায়সালাকারী। মুত্তাকীদেরই পরিণাম হবে ভাল এবং কাফিরদের জন্য ধ্বংস অনিবার্য।

কাফিররা তাদের নবী হযরত শোআ’ইব (আঃ)-এর সাথে এবং তার সময়ের মুসলমানদের সাথে যে দুর্ব্যবহার করেছিল এবং যেভাবে তাঁদেরকে হুমকি দিয়ে বলেছিল যে, হয় তারা তাদের জনপদ ছেড়ে চলে যাবেন, না হয় তাদের ধর্মে দীক্ষিত হবেন, আল্লাহ পাক এখানে এসব সংবাদই দিচ্ছেন। বাহ্যতঃ এই সম্বোধন রাসূলের প্রতি হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা তাঁর উম্মতের প্রতিই বটে। হযরত শশা’আইব (আঃ)-এর কওমের অহংকারী ও দাম্ভিক লোকেরা তাঁকে সম্বোধন করে বলেছিলঃ “হে শশাআ’ইব (আঃ)! আমরা তোমাকে ও তোমার সঙ্গীদেরকে জনপদ থেকে বের করে দেবো অথবা তোমাদেরকে আমাদের ধর্মে ফিরে আসতে হবে।” তখন হযরত শশাআ’ইব (আঃ) উত্তরে বললেনঃ “যদিও আমরা তাতে সম্মত না হই তবুও কি? যদি আমরা তোমাদের ধর্মে ফিরে যাই এবং তোমাদের মতাদর্শকে গ্রহণ করি তবে নিশ্চিতরূপে আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী হব যে, মূর্তিগুলোকে আমরা আল্লাহর শরীক বানিয়ে নিচ্ছি!” এই রূপে কাফিরদের অনুসরণ করার প্রতি ঘৃণা জন্মানো হচ্ছে। হযরত শোআইব (আঃ) বললেনঃ “এ কাজ আমাদের দ্বারা সম্পাদিত হতে পারে না যে, আমরা পুনরায় মুশরিক হয়ে যাবে। তবে, আল্লাহ যদি আমাদেরকে ফিরিয়ে দেন তাহলে সেটা অন্য কথা। কেননা, ভবিষ্যতের সমস্ত জ্ঞান তিনি পরিবেষ্টন করে রয়েছেন। আমরা যা অবলম্বন করি এবং যা অবলম্বন করি না সবকিছুতেই আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মধ্যে ও আমাদের কওমের মধ্যে সত্যকে প্রকাশ করে দিন এবং আমাদেরকে তাদের উপর জয়যুক্ত করুন। আপনি হচ্ছেন উত্তম ফায়সালাকারী।” (আরবী) এমন ন্যায়-বিচারককে বলা হয় যিনি অণু পরিমাণও অন্যায় ও যুলুম করেন না।

 

তাদের কুফরী, একগুয়েমী ও পথভ্রষ্টতা কত কঠিন হয়ে পড়েছিল এবং সত্যের বিরোধিতাকরণ তাদের অন্তরে কিরূপ প্রাকৃতিক রূপ ধারণ করেছিল, আল্লাহ তা’আলা এখানে সেই সংবাদই দিচ্ছেন। এ জন্যেই তারা পরস্পর শপথ করে করে বলেছিল-দেখ, যদি তোমরা শোআ’ইব (আঃ)-এর কথা মেনে নাও তাহলে বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তাদের এই দৃঢ় সংকল্পের পর আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, এই সংকল্পের কারণে তাদের প্রতি এমন এক ভূমিকম্প প্রেরিত হয়েছিল যার ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছিল । আর এই শাস্তি ছিল তাদের সেই কর্মের প্রতিফল যে, তারা বিনা কারণে শশাআ’ইব (আঃ)-কে এবং তার সঙ্গী-সাথীদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেছিল ও দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যেমন সূরায়ে হুদে বর্ণিত হয়েছে- “যখন আমার শাস্তি তাদের উপর এসে পড়লো তখন আমি শোআ’ইব (আঃ)-কে এবং তার সঙ্গী-সাথীদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে বাঁচিয়ে নিলাম, আর ঐ যালিমদেরকে এমন বজ্রধ্বনি পেয়ে বসলো যে, তারা নিজেদের গৃহে নতজানু অবস্থায় বিনাশ হয়ে গেল।” এই দুটি আয়াতের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ এই যে, যখন ঐ কাফিররা (আরবী) (১১:৮৭) বলে বিদ্রুপ করলো তখন এক ভীষণ বজ্রধ্বনি তাদেরকে চিরতরে নীরব করে দিল। সূরায়ে শুআরার মধ্যে আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করেছেন-“তারা যখন নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, তখন মেঘাচ্ছন্ন দিবসের শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করলো, এটা ছিল এক ভয়ানক দিবসের শাস্তি।” এর একমাত্র কারণ ছিল এই যে, তারা শাস্তি চেয়ে বলেছিল-“তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে আমাদের উপর আকাশের একটা খণ্ড ফেলে দাও।” তাই আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিলেন যে, তাদের উপর আসমানী আযাব পৌছে গেল। তাদের উপর তিনটি শাস্তি একত্রিত হলো। (১) আসমানী শাস্তি, তা এইভাবে যে, তাদের উপর মেঘ হতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও অগ্নিশিখা বর্ষিত হলো। (২) এক ভীষণ বজ্রধ্বনি হলো। (৩) এক ভীষণ ভূমিকম্প সৃষ্টি হলো, যার ফলে তাদের প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেল এবং তাদের আত্মবিহীন দেহ তাদের গৃহ-মধ্যে পড়ে রইলো। মনে হলো যেন তারা সেখানে কখনো বসবাসই করেনি। অথচ তারা তাদের নবীকে দেশ ছাড়া করেছিল। এখন আল্লাহ ঐ কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করছেন যে, যারা শশাআ’ইব (আঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল শেষ পর্যন্ত তারাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

কাফিররা যখন কোনক্রমেই মানল না তখন হযরত শোআ’ইব (আঃ) সেখান হতে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় তিনি তাদেরকে বললেনঃ “হে আমার কওমের লোকেরা! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ তা’আলার পয়গাম পৌছিয়ে দিয়েছি। আমি আমার দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করেছি। আমি সদা তোমাদের মঙ্গল কামনা করেছি। এতদসত্ত্বেও তোমরা আমার দ্বারা উপকার লাভ করলে না। সুতরাং তোমাদের মন্দ পরিণতি দেখে দুঃখ করতঃ আমি নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবো কেন? তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আর লাভ কি!”

তাফসীরে আবুবকর ‌যাকারিয়া‌ বলেছেন:-

এগারতম রুকূ’

[১] মাদইয়ানবাসীদের মূল এলাকাটি হেজাযের উত্তর পশ্চিমে এবং ফিলিস্তিনের দক্ষিণে লোহিত সাগর ও আকাবা উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত ছিল। প্রাচীন যুগে যে বাণিজ্যিক সড়কটি লোহিত সাগরের উপকূল ধরে ইয়েমেন থেকে মক্কা ও ইয়াম্বু হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং দ্বিতীয় যে বাণিজ্যিক সড়কটি ইরাক থেকে মিশরের দিকে চলে যেতো তাদের ঠিক সন্ধিস্থলে জাতির জনপদগুলো অবস্থিত ছিল। এ কারণে আরবের লোকেরা মাদইয়ান জাতি সম্পর্কে জানতো। কারণ তাদের ব্যবসাও এ পথে চলাচল করতো।

মাদইয়ানের বর্তমান নাম ‘আল বিদা’। এ এলাকাটি একটি প্রসিদ্ধ জনপদ। সৌদী আরবের শেষ প্রান্তে মিশরের সীমান্ত সংলগ্ন এ এলাকায় এখনো শু’আইব আলাইহিস সালামের জাতির বিভিন্ন চিহ্ন রয়ে গেছে। যা মাগায়েরে শু’আইব নামে খ্যাত। [ড. শাওকী আবু খালীল, আতলাসুল কুরআন, পৃ.৭২ ]

[২] শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম যে সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, কুরআনুল কারীমে কোথাও তাদেরকে ‘আহলে মাদইয়ান’ ও ‘আসহাবে মাদইয়ান’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কোথাও ‘আসহাবে আইকাহ’ নামে। ‘আইকাহ’ শব্দের অর্থ জঙ্গল ও বন। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ ‘আসহাবে মাদইয়ান’ ও ‘আসহাবে আইকাহ পৃথক পৃথক জাতি। তাদের বাসস্থানও ছিল ভিন্ন ভিন্ন এলাকায়। শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম প্রথমে এই জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। তারা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর অপর জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। উভয় জাতির উপর যে আযাব আসে, তার ভাষাও বিভিন্ন রূপ। আসহাবে মাদইয়ানের উপর কোথাও – এবং কোথাও (صيحة) এবং কোথাও (رجفة) এবং আসহাবে আইকাহর উপর কোথাও (ظلة) -এর আযাব উল্লেখ করা হয়েছে। (صيحة) শব্দের অর্থ বিকট চিৎকার এবং ভীষণ শব্দ। (رجفة) শব্দের অর্থ ভূমিকম্পন এবং (ظلة) শব্দের অর্থ ছায়াযুক্ত ছাদ, শামিয়ানা। আসহাবে আইকাহর উপর এভাবে আযাব নাযিল করা হয় যে, প্রথমে কয়েকদিন তাদের বস্তিতে ভীষণ গরম পড়ে। ফলে গোটা জাতি ছটফট করতে থাকে। অতঃপর নিকটস্থ একটি গভীর জঙ্গলের উপর গাঢ় মেঘমালা দেখা দেয়। ফলে জঙ্গলে ছায়া পড়ে এবং শীতল বাতাস বইতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে বস্তির সবাই জঙ্গলে জমায়েত হয়। এভাবে অপরাধীরা কোনরূপ গ্রেফতারী পরোয়ানা ও সিপাই-সান্ত্রীর প্রহরা ছাড়াই নিজ পায়ে হেঁটে বধ্যভূমিতে গিয়ে পৌছে। যখন সবাই সেখানে একত্রিত হয়, তখন মেঘমালা থেকে অগ্নি বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং নীচের দিকে শুরু হয় ভূমিকম্পন। ফলে সবাই নাস্তানাবুদ হয়ে যায়।

কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ ‘আসহাবে মাদইয়ান’ ও ‘আসহাবে আইকাহ’ একই সম্প্রদায়ের দুই নাম। পূর্বোল্লেখিত তিন প্রকার আযাবই তাদের উপর নাযিল হয়েছিল। প্রথমে মেঘমালা থেকে অগ্নি বর্ষিত হয়, অতঃপর বিকট চীৎকার শোনা যায় এবং সবশেষে ভূমিকম্পন হয়। ইবনে কাসীর এ তাফসীরেরই প্রবক্তা। [আশ-শিক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস, পৃ. ২৮৫-২৯৩]

মোটকথা, উভয় সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন হোক কিংবা একই সম্প্রদায়ের দু’নাম হোক শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম তাদের কাছে তাওহীদের বাণীই পৌছান। তারা শির্কের পাশাপাশি এমনকিছু কুকর্মে লিপ্ত ছিল, যা থেকে শু’আইব ‘আলাইহিস্ সালাম তাদেরকে নিষেধ করেন। তারা একদিকে আল্লাহর হক নষ্ট করছিল, অপরদিকে বান্দার হকও নষ্ট করছিল। তারা আল্লাহ তা’আলা ও তাদের নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে আল্লাহর হকের বিরুদ্ধাচরণ করছিল। এর সাথে ক্রয়-বিক্রয়ে মাপ ও ওজনে কম দিয়ে বান্দাদের হক নষ্ট করছিল। তদুপরি তারা রাস্তা ও সড়কের মুখে বসে থাকত এবং পথিকদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের ধন-সম্পদ লুটে নিত এবং শু’আইব ‘আলাইহিস সালামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধা দিত। তারা এভাবে ভূ-পৃষ্ঠে অনর্থ সৃষ্টি করছিল। এসব অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের হেদায়াতের জন্য শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম প্রেরিত হয়েছিলেন। শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম তাদের সংশোধনের জন্য তিনটি বিষয় বর্ণনা করেছেন। প্রথমতঃ তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ব্যতীত ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য আর কেউ নেই। একত্ববাদের এ দাওয়াতই সব নবী দিয়ে এসেছেন। এটিই সব বিশ্বাস ও কর্মের প্রাণ। এ সম্প্রদায়ও সৃষ্ট বস্তুর পূজায় লিপ্ত ছিল এবং আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী ও হক সম্পর্কে গাফেল হয়ে পড়েছিল। তাই তাদেরকে সর্বপ্রথম এ বাণী পৌছানো হয়েছে। আরো বলা হয়েছেঃ তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে। এখানে সুস্পষ্ট প্রমাণ’-এর অর্থ ঐসব মু’জিযা, যা শু’আইব ‘আলাইহিস সালামের হাতে প্রকাশ পেয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ কর এবং মানুষের দ্রব্যাদিতে কম দিয়ে তাদের ক্ষতি করো না। এতে প্রথমে একটি বিশেষ অপরাধ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় ওজনে কম দিয়ে করা হত। অতঃপর সর্ব প্রকার হকে ক্রটি করাকে ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা ধন-সম্পদ, ইযযত-আবরু অথবা অন্য যে কোন বস্তুর সাথেই সম্পর্কযুক্ত হোক না কেন। এ থেকে জানা গেল যে, মাপ ও ওজনে পাওনার চাইতে কম দেয়া যেমন হারাম, তেমনি অন্যান্য হকে ক্রটি করাও হারাম। কারো ইযযত-আবরু নষ্ট করা, কারো পদমর্যাদা অনুযায়ী তার সম্মান না করা, যাদের আনুগত্য জরুরী তাদের আনুগত্যে ক্রটি করা ইত্যাদি সবই এ অপরাধের অন্তর্ভুক্ত, যা শু’আইব ‘আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় করত। বিদায় হজের ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের ইযযত-আবরুকে তাদের রক্তের সমান সম্মানযোগ্য ও সংরক্ষণযোগ সাব্যস্ত করেছেন। তৃতীয়তঃ পৃথিবীর সংস্কার সাধিত হওয়ার পর তাতে অনর্থ ছড়িও না। অর্থাৎ পৃথিবীর বাহ্যিক সংস্কার হল, প্রত্যেকটি বস্তুকে যথার্থ স্থানে ব্যয় করা, এবং নির্ধারিত সীমার প্রতি লক্ষ্য রাখা। বস্তুতঃ তা ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল। আর আভ্যন্তরীণ সংস্কার হল আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখা এবং তা তাঁর নির্দেশাবলী পালনের উপর ভিত্তিশীল | এমনিভাবে পৃথিবীর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অনর্থ এসব নীতি পরিত্যাগ করার কারণেই দেখা দেয়। শু’আইব ‘আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় এসব নীতির প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করেছিল। ফলে পৃথিবীতে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সব রকম অনৰ্থ বিরাজমান ছিল। তাই তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের এসব কর্মকাণ্ড সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠে অনর্থ সৃষ্টি করবে। তাই এগুলো থেকে বেঁচে থাক।

অতঃপর বলা হয়েছেঃ যদি তোমরা আমার কথা মান্য কর, তবে তোমাদের জন্য উত্তম। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যদি তোমরা অবৈধ কাজ-কর্ম থেকে বিরত হও, তবে এতেই তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। দ্বীন ও আখেরাতের মঙ্গলের বর্ণনা নিস্প্রয়োজন। কারণ, এটি আল্লাহর আনুগত্যের সাথেই সর্বতোভাবে জড়িত। দুনিয়ার মঙ্গল এ জন্য যে, যখন সবাই জানতে পারবে যে, অমুক ব্যক্তি মাপ ও ওজনে এবং অন্যান্য হকের ব্যাপারে সত্যনিষ্ঠ, তখন বাজারে তার প্রভাব বিস্তৃত হবে এবং ব্যবসায়ে উন্নতি সাধিত হবে। এরপর তাদেরকে হুশিয়ার করার জন্য উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন উভয় পন্থা ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে উৎসাহ প্রদানের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলার নেয়ামত স্মরণ করানো হয়েছে যে, তোমরা পূর্বে সংখ্যা ও গণনার দিক দিয়ে কম ছিলে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের বংশ বৃদ্ধি করে তোমাদেরকে একটি বিরাট জাতিতে পরিণত করেছেন। অথবা তোমরা ধন-সম্পদের দিক দিয়ে কম ছিলে, আল্লাহ তা’আলা ঐশ্বৰ্য্য দান করে তোমাদের স্বনির্ভর করে দিয়েছেন। অতঃপর ভীতি প্রদর্শনার্থে বলা হয়েছেঃ পূর্ববর্তী অনর্থ সৃষ্টিকারী জাতিসমূহের পরিণামের প্রতি লক্ষ্য করকওমে নূহ, আদ, সামূদ ও কওমে লুতের উপর কি ভীষণ আযাব এসেছে। তোমরা ভেবে-চিন্তে কাজ কর। শু’আইব ‘আলাইহিস সালামের দাওয়াতের পর তার সম্প্রদায় দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। কিছু সংখ্যক মুসলিম হয়, এবং কিছু সংখ্যক কাফেরই থেকে যায়। কিন্তু বাহ্যিক দিক দিয়ে উভয় দল একই রূপ আরাম-আয়েশে দিনাতিপাত করতে থাকে। এতে তারা সন্দেহ প্রকাশ করে যে, কাফের হওয়া অপরাধ হলে অপরাধীরা অবশ্যই শাস্তি পেত। এ সন্দেহের উত্তরে বলা হয়েছেঃ তাড়াহুড়া কিসের? আল্লাহ তা’আলা স্বীয় সহনশীলতা ও কৃপাগুণে অপরাধীদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারা যখন চূড়ান্ত সীমায় পৌছে যায়, তখন সত্য ও মিথ্যার মীমাংসা করে দেয়া হয়। তোমাদের অবস্থাও তদ্রুপ। তোমরা যদি কুফর থেকে বিরত না হও, তবে অতি সত্বর কাফেরদের উপর চূড়ান্ত আযাব নাযিল হয়ে যাবে। জাতির অহংকারী সর্দারদের সাথে এ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনার পর যখন শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম বুঝতে পারলেন যে, তারা কোন কিছুতেই প্রভাবান্বিত হচ্ছে না, তখন তাদের সাথে কথা-বার্তা ছেড়ে আল্লাহ্ তা’আলার কাছে দোআ করলেনঃ হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের ও আমাদের জাতির মধ্যে সত্যভাবে ফয়সালা করে দিন, এবং আপনি শ্রেষ্ঠতম ফয়সালাকারী। প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম স্বীয় সম্প্রদায়ের কাফেরদেরকে ধ্বংস করার দোআ করেছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা এ দোআ কবুল করে ভুমিকম্পের মাধ্যমে তাদেরকে ধবংস করে দেন।

শু’আইব ‘আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের আযাবকে এখানে ভূমিকম্প বলা পাকড়াও করেছে। [সূরা আশ-শু’আরা: ১৮৯] ছায়া দিবসের অর্থ এই যে, প্রথমে তাদের উপর ঘন কাল মেঘের ছায়া পতিত হয়। তারা এর নীচে একত্রিত হয়ে গেলে এ মেঘ থেকেই তাদের উপর প্রস্তর অথবা অগ্নিবৃষ্টি বর্ষণ করা হয়। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উভয় আয়াতের সামঞ্জস্য প্রসঙ্গে বলেনঃ শু’আইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের উপর প্রথমে এমন ভীষণ গরম চাপিয়ে দেয়া হয়, যেন জাহান্নামের দরজা তাদের দিকে খুলে দেয়া হয়েছিল। ফলে তাদের শ্বাস রুদ্ধ হতে থাকে। ছায়া এমন কি পানিতেও তাদের জন্য শান্তি ছিল না। তারা অসহ্য গরমে অতিষ্ট হয়ে ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করে দেখল সেখনে আরো বেশী গরম। অতঃপর অস্থির হয়ে জঙ্গলের দিকে ধাবিত হল। সেখানে আল্লাহ তা’আলা একটি ঘন কাল মেঘ পাঠিয়ে দিলেন যার নীচে শীতল বাতাস বইছিল। তারা সবাই গরমে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে মেঘের নিচে এসে ভিড় করল। তখন মেঘমালা আগুনে রূপান্তরিত হয়ে তাদের উপর বর্ষিত হল এবং ভূমিকম্পও এল। ফলে তারা সবাই ভস্মস্তুপে পরিণত হল। এভাবে তাদের উপর ভূমিকম্প ও ছায়ার আযাব উভয়টিই আসে। [তাবারী, ৬/৯/৪; আশ-শির্ক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস পৃ. ২৯২-২৯৩]

স্বজাতির উপর আযাব আসতে দেখে শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম সঙ্গীদেরকে নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন। জাতির চরম অবাধ্যতায় নিরাশ হয়ে শু’আইব ‘আলাইহিস সালাম বদদোআ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু যখন আযাব এসে গেল তখন নবীসুলভ দয়ার কারণে তার অন্তর ব্যথিত হল। তাই নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে বললেনঃ আমি তোমাদের কাছে প্রতিপালকের নির্দেশ পৌছে দিয়েছিলাম এবং তোমাদের হিতাকাংখায় কোন ক্রটি করিনি; কিন্তু আমি কাফের সম্প্রদায়ের জন্য কতটুকু কি করতে পারি? এ জাতির বিস্তারিত ঘটনা ও পরিণতি জানার জন্য দেখুন, [ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১/৪৩৯]

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

টিকা:৬৯) মাদ্ইয়ানের (মাদায়েন) মূল এলাকাটি হিজাযের উত্তর পশ্চিমে এবং ফিলিস্তিনের দক্ষিণে লোহিত সাগর ও আকাবা উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত ছিল। তবে সাইনা (সিনাই) উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলেও এর কিছুটা অংশ বিস্তৃত ছিল। এখানকার অধিবাসীরা ছিল একটি বিরাট ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। প্রাচীন যুগে যে বাণিজ্যিক সড়কটি লোহিত সাগরের উপকূল ধরে ইয়ামান থেকে মক্কা ও ইয়াম্বু হয়ে সিরীয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং দ্বিতীয় যে বাণিজ্যিক সড়কটি ইরাক থেকে মিসরের দিকে চলে যেতো, তাদের ঠিক সন্ধিস্থলে এ জাতির জনপদগুলো অবস্থিত ছিল। এ কারণে আরবের ছোট বড় সবাই মাদ্ইয়ানী জাতি সম্পর্কে জানতো এবং এ জাতিটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও সারা আরবে এর খ্যাতি অপরিবর্তিত থাকে। কারণ আরববাসীদের বাণিজ্যিক কাফেলা মিসর ও ইরাক যাবার পথে দিন রাত এর ধ্বংসাবশেষের ভেতর দিয়েই চলাচল করতো।

মাদ্ইয়ানবাসীদের সম্পর্কে আর একটি প্রয়োজনীয় কথা ভালভাবে জেনে নিতে হবে। সেটি হচ্ছে, এ মাদ্ইয়ানের অধিবাসীরা হযরত ইবরাহীমের পুত্র মিদিয়ান-এর সাথে বিভিন্ন রকমের সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। মিদিয়ান ছিলেন হযরত ইবরাহীমের তৃতীয় স্ত্রী কাতুরা-এর গর্ভজাত সন্তান। প্রাচীন যুগের নিয়ম অনুযায়ী যারা কোন খ্যাতিমান পুরুষের সাথে সম্পর্কিত থাকতো তাদেরকে কালক্রমে ঐ ব্যক্তির সন্তান গণ্য করে অমুকের বংশধর বলা হতো। এ নিয়ম অনুযায়ী আরবের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ বনী ইসমাঈল হিসেবে পরিচিত লাভ করে। অন্যদিকে ইয়াকূবের (অন্য নাম ইসরাঈল) সন্তানদের হাতে ইসলাম গ্রহণকারীদের সবাই বনী ইসরাঈল নামে অভিহিত হয়। অনুরূপ ভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পুত্র মিদিয়ানের প্রভাবিত মাদ্ইয়ানের অধিবাসীগণ বনী মিদিয়ান নামে পরিচিত হয় এবং তাদের দেশের নামই হয়ে যায় মাদ্ইয়ান বা মিদিয়ান। এ ঐতিহাসিক তথ্যটি জানার পর এক্ষেত্রে ধারণা করার আর কোন কারণই থাকে না যে, এ জাতিটি সর্বপ্রথম হযরত শোআইব আলাইহিস সালামের মাধ্যমেই সত্য দ্বীন তথা ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিল। আসলে শুরুতে বনী ইসরাঈলদের মত এরাও ছিল মুসলমান। শো’য়াইব আলাইহিস সালামের আবির্ভাবকালে এদের অবস্থা ছিল একটি বিকৃত মুসলিম মিল্লাতের মত, যেমন মূসা আলাইহিস সালামের আবির্ভাবকালে ছিল বনী ইসরাঈলের অবস্থা। হযরত ইবরাহীমের পরে ছয় সাত শো বছর পর্যন্ত এরা মুশরিক ও চরিত্রহীন জাতিদের মধ্যে বসবাস করতে করতে শিরক ও নানা রকমের দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ সত্ত্বেও এদের ঈমানের দাবী ও সেজন্য অহংকার করার মনোবৃত্তি অপরিবর্তিত ছিল।

টিকা:৭০) এ থেকে জানা যায়, এ জাতির দু’টি বড় দোষ ছিল। একটি শিরক এবং অন্যটি ব্যবসায়িক লেনদেনে অসাধুতা। এ দু’টি দোষ সংশোধন করার জন্য হযরত শোআইব আলাইহিস সালামকে তাদের মধ্যে পাঠানো হয়েছিল।

টিকা:৭১) এ বাক্যটির যথাযথ ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে আরাফের ৪৪ ও ৪৫নং টীকায় করা হয়েছে। এখানে হযরত শোআইব তাঁর এ উক্তিটির মাধ্যমে আভাসে ইঙ্গিতে যে কথাটি বিশেষভাবে বলতে চেয়েছেন তা এই যে, পূর্ববর্তী নবীগণের বিধান ও পথনির্দেশনার ভিত্তিতে সত্য, দ্বীন ও সৎ চারিত্রিক গুণাবলীতে ভূষিত যে জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, এখন তোমরা নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও নৈতিক দুষ্কৃতির মাধ্যমে তাকে বিনষ্ট করে দিয়ো না।

টিকা:৭২) এ বাক্যটি থেকে পরিষ্কার জানা যায়, তারা নিজেরা ঈমানের দাবীদার ছিল। ওপরের আলোচনায় আমি এদিকে ইঙ্গিত করেছি। তারা আসলে ছিল গোমরাহ ও বিকৃত মুসলমান। বিশ্বাসগত ও চারিত্রিক বিপর্যয়ে লিপ্ত থাকলেও তারা কেবল ঈমানের দাবীই করতো না বরং এ জন্য তাদের গর্বও ছিল। তাই হযরত শোআইব বলেন, যদি তোমরা মু’মিন হও, তাহলে তোমাদের এ বিশ্বাসও থাকা উচিত যে, সততা ও বিশ্বস্ততার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত এবং যেসব দুনিয়া পূজারী লোক আল্লাহ‌ ও আখেরাতকে স্বীকার করে না, তোমাদের ভাল-মন্দের মানদণ্ড তাদের থেকে আলাদা হওয়া উচিত।

টিকা:৭৩) এ বাক্যটি ঠিক সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যে অর্থে আমরা ইনশাআল্লাহ বলে থাকি এবং যে সম্পর্কে সূরা কাহাফে (আয়াত ২৩-২৪) বলা হয়েছেঃ কোন জিনিস সম্পর্কে দাবী সহকারে একথা বলো না, আমি এমনটি করবো বরং এভাবে বলো, যদি আল্লাহ‌ চান তাহলে আমি এমনটি করবো। কারণ যে মু’মিন আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্ব এবং নিজের দাসত্ব, অধীনতা ও বশ্যতা সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধির অধিকারী হয়, সে কখনো নিজের শক্তির ওপর ভরসা করে এ দাবী করতে পারে না-আমি অমুক কাজটি করেই ছাড়বো অথবা অমুক কাজটি কখনো করবোই না। বরং সে এভাবে বলবে, আমার এ কাজ করার বা না করার ইচ্ছা আছে কিন্তু আমরা এ ইচ্ছা পূর্ণ হওয়া তো আমার মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, তিনি তাওফিক দান করলে আমি সফলকাম হবো অন্যথায় ব্যর্থ হয়ে যাবো।

টিকা:৭৪) এ ছোট বাক্যটির ওপর ভাসা ভাসা দৃষ্টি বুলিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এটি থমকে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার একটি স্থান। মাদ্ইয়ানের সরদাররা ও নেতারা আসলে যে কথা বলছিল এবং নিজের জাতিকেও বিশ্বাস করাতে চাইছিল তা এই যে, শোআইব যে সততা ও ঈমানদারীর দাওয়াত দিচ্ছেন এবং মানুষকে নৈতিকতা ও বিশ্বস্ততার যেসব স্বতন্ত্র মূলনীতির অনুসারী করতে চাচ্ছেন, সেগুলো মেনে নিলে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। আমরা যদি পূর্ণ সততার সাথে ব্যবসা করতে থাকি এবং কোন প্রকার প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে ঈমানদারীর সাথে পন্য বেচাকেনা করতে থাকি তাহলে আমাদের ব্যবসা কেমন করে চলবে? আমরা দুনিয়ার দু’টি সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক সড়কের সন্ধিস্থলে বাস করি এবং মিসর ও ইরাকের মতো দু’টি বিশাল সুসভ্য ও উন্নত রাষ্ট্রের সীমান্তে আমাদের জনপদ গড়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় আমরা যদি বাণিজ্যিক কাফেলার মালপত্র ছিনতাই করা বন্ধ করে দিয়ে শান্তিপ্রিয় হয়ে যাই তাহলে বর্তমান ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমরা এতদিন যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভ করে আসছিলাম তা একদম বন্ধ হয়ে যাবে এবং আশেপাশের বিভিন্ন জাতির ওপর আমাদের যে প্রতাপ ও আধিপত্য কায়েম আছে তাও খতম হয়ে যাবে। এ ব্যাপারটি কেবল শোআইব সম্প্রাদায়ের প্রধানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রত্যেক যুগের পথভ্রষ্ট লোকেরা সত্য, ন্যায়, সততা ও বিশ্বস্ততার নীতি অবলম্বন করার মধ্যে এমনি ধরনের বিপদেরআশঙ্কা করেছে। প্রত্যেক যুগের নৈরাজ্যবাদীরা একথাই চিন্তা করেছে যে, ব্যবসায়-বাণিজ্য, রাজনীতি এবং অন্যান্য পার্থিব বিষয়াবলী মিথ্যা, বেঈমানী ও দুর্নীতি ছাড়া চলতে পারে না। প্রত্যেক জায়গায় সত্যের দাওয়াতের মোকাবিলায় যেসব বড় বড় অজুহাত পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, যদি দুনিয়ার প্রচলিত পথ থেকে সরে গিয়ে এ দাওয়াতের অনুসরণ করা হয় তাহলে সমগ্র জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।

টিকা:৭৫) মাদইয়ানের এ ধ্বংসলীলা দীর্ঘকাল পর্যন্ত আশেপাশের বিভিন্ন জাতির মধ্যে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। তাই দেখা যায়, দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর অবতীর্ণ যবুরের এক স্থানে বলা হয়েছেঃ হে খোদা! অমুক অমুক জাতি তোমার বিরুদ্ধে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে, কাজেই তুমি তাদের সাথে ঠিক তেমনি ব্যবহার করো, যেমন মিদিয়ানের সাথে করেছিল। (৮৩: ৫-৯) ইয়াসঈয়াহ নবী এক স্থানে বনী ইসরাঈলকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলেন, আশূরীয়দেরকে ভয় করো না যদিও তারা তোমাদের জন্য মিসরীয়দের মতই জালেম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেশী দেরী হবে না, বাহিনীগণের প্রভু তাদের ওপর নিজের দণ্ড বর্ষণ করবেন এবং তাদের সেই একই পরিণতি হবে যেমন মিদিয়ানের হয়েছিল। ( যিশাইয় ১০: ২২-২৬) ।

টিকা:৭৬) এখানে যতগুলো কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, সবগুলোতে আসলে একজনের ঘটনা বর্ণনা করে তার মধ্যে অন্যজনের চেহারা দেখানোর রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। এখানকার প্রত্যেকটি কাহিনী সে সময় মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর জাতির মধ্যে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছিল তার সাথে পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রত্যেকটি কাহিনী ও ঘটনার এক পক্ষে একজন নবী আছেন। তাঁর শিক্ষা, দাওয়াত, উপদেশ ও কল্যাণকামিতা এবং তাঁর সমস্ত কথাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুরূপ। আর প্রত্যেকটি কাহিনীর দ্বিতীয় পক্ষে আছে সত্য প্রত্যাখানকারী, গোষ্ঠি, সম্প্রদায় ও জাতি। তাদের আকীদাগত বিভ্রান্তি, নৈতিক চরিত্রহীনতা, মূর্খতাজনিত হঠকারিতা, তাদের গোত্র প্রধানদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা এবং সত্য অস্বীকারকারী লোকদের নিজেদের গোমরাহীর ব্যাপারে একগুয়েমী ইত্যাদি সবকিছুই ঠিক তেমনি যেমন কুরাইশদের মধ্যে পাওয়া যেতো। আবার প্রত্যেকটি কাহিনীতে সত্য অস্বীকারকারী জাতিগুলোর যে পরিণাম দেখানো হয়েছে তার মাধ্যমে আসলে কুরাইশদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর পাঠানো নবীদের কথা না মানো এবং চরিত্র সংশোধনের যে সুযোগ তোমাদের দেয়া হচ্ছে অন্ধ জিদ ও গোয়ার্তুমীরবশবর্তী হয়ে তা হেলায় হারিয়ে বসো, তাহলে চিরদিন গোমরাহী ও ফিতনা-ফাসাদের ক্ষেত্রে জিদ ধরে বিভিন্ন জাতি যেমন পতন ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, তোমরাও তেমনি ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।

Leave a Reply