أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٣٨)-২৪০
www.motaher21.net
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفٰىٓ
নিশ্চয় আল্লাহ মনোনীত করেছেন।
Allah did choose..
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-৩৩
إِنَّ اللَّهَ اصْطَفٰىٓ ءَادَمَ وَنُوحًا وَءَالَ إِبْرٰهِيمَ وَءَالَ عِمْرٰنَ عَلَى الْعٰلَمِينَ
নিশ্চয় আল্লাহ আদম, নূহ, ইব্রাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে বিশ্বজগতে মনোনীত করেছেন।
৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
এখান থেকে দ্বিতীয় ভাষণটি শুরু হচ্ছে। নবম হিজরী সনে নাজরানের খৃস্টীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধি দল রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর দরবারে হাযির হবার পর এ অংশটি নাযিল হয়েছিল। হিজায ও ইয়ামনের মাঝখানে নাজরান এলাকা অবস্থিত। সে সময় এ এলাকায় ৭২টি জনপদ ছিল। বলা হয়ে থাকে, এই জনপদগুলো থেকে সে সময় এক লাখ বিশ হাজার যুদ্ধ করার যোগ্যতা সম্পন্ন জওয়ান বের হয়ে আসতে পারতো। এলাকার সমগ্র অধিবাসীই ছিল খৃস্টান। তিনজন দলনেতার অধীনে তারা শাসিত হতো। একজনকে বলা হতোঃ আকেব। তিনি ছিলেন জাতীয় প্রধান। দ্বিতীয়জনকে বলা হতো সাইয়েদ। তিনি জাতির তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো দেখাশুনো করতেন। তৃতীয়জনকে বলা হতোঃ উসকুফ্ (বিশপ)। তিনি ছিলেন ধর্মীয় বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত। নবী ﷺ এর মক্কা বিজয়ের পর যখন সমগ্র আরববাসীর মনে এ বিশ্বাস জন্মালো যে, দেশের ভবিষ্যৎ এখন মুহাম্মাদ ﷺ এর হাতে তখন আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে তার কাছে প্রতিনিধি দলের আগমন হতে লাগলো। এই সময় নাজরানের তিনজন দলনেতাও ৬০ জনের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে মদীনায় পৌঁছেন। তারা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল না। তখন প্রশ্ন ছিল, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে, না জিম্মী হয়ে থাকবে। এ সময় মহান আল্লাহ নবী ﷺ এর ওপর এ ভাষণটি নাযিল করেন। এর মাধ্যমে নাজরানের প্রতিনিধি দলের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করার ব্যবস্থা করা হয়।
ইমরান ছিল হযরত মূসা ও হারুনের পিতার নাম। বাইবেলে তাঁকে “আমরাম” বলা হয়েছে।
তাফসীরে আবু বকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] এখানে ইমরান বলতে মারইয়াম আলাইহাস সালামের পিতাকে বুঝানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মূসা ‘আলাইহিস সালাম এর পিতার নামও ইমরান ছিল। [মুসলিম: ১৬৫] তা এখানে উদ্দেশ্য নয়। পরবর্তী আয়াত থেকেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
[২] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এখানে ইবরাহীম, ইমরান, ইয়াসীন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারের মধ্যে যারা ঈমানদার কেবল তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। তাদেরকেই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বাণী ও রহমত বহনের জন্য মনোনীত করেছেন। এদের বংশধরদের মধ্যে যারা কাফের বা মুশরিক তাদের বোঝানো হয়নি। [তাবারী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
নবীদের বংশে ইমরান নামে দু’জনের আবির্ভাব ঘটেছিল। একজন হলেন মূসা এবং হারুন (আলাইহিমাস্ সালাম)-এর পিতা এবং দ্বিতীয়জন হলেন, মারয়্যাম (আলাইহাস্ সালাম)-এর পিতা। অধিকাংশ মুফাসসিরগণের নিকট এই আয়াতে দ্বিতীয় ইমরানকে বুঝানো হয়েছে। এই বংশ মারয়্যাম (আলাইহাস্ সালাম) ও তাঁর পুত্র ঈসা (আঃ)-এর কারণে সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। মারয়্যামের মায়ের নাম মুফাসসিরগণ হান্নাহ বিনতে ফাক্বূয লিখেছেন। (তাফসীরে ক্বুরত্ববী ও ইবনে কাসীর) এই আয়াতে মহান আল্লাহ ইমরানের বংশ ছাড়াও আরো তিনটি এমন বংশের কথা উল্লেখ করেছেন, যাদেরকে তিনি তাদের যুগে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম হলেন আদম (আঃ)। তাঁকে তিনি নিজ হাত দ্বারা সৃষ্টি করে তাঁর মধ্যে স্বীয় রূহ সঞ্চার করেন। ফিরিশতামন্ডলী দ্বারা তাঁকে সিজদা করান। সকল জিনিসের নাম তাঁকে শিখিয়ে দেন এবং তাঁকে জান্নাতে বাসস্থান দান করেন। অতঃপর তাঁকে সেখান থেকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। এতেও ছিল তাঁর বহু হিকমত। দ্বিতীয় হলেন, নূহ (আঃ)। তাঁকে এমন সময় নবী করে প্রেরণ করেন, যখন মানুষ আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিসমূহকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিল। তাঁকে তিনি সুদীর্ঘ আয়ু দান করেছিলেন। তিনি তাঁর জাতির মাঝে সাড়ে ন’শ’ বছর পর্যন্ত দ্বীনের তবলীগ করেছিলেন। কিন্তু অল্প কিছু লোক ছাড়া কেউ তাঁর প্রতি ঈমান আনেনি। শেষে তাঁর বদ্দুআয় ঈমানদার লোকগুলো ব্যতীত সমস্ত লোককে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশ যে বৈশিষ্ট্য লাভে ধন্য হয়েছিল তা হল, মহান আল্লাহ পর্যায়ক্রমে তাঁর বংশ থেকে নবী ও বাদশাহ প্রেরণ করেন। বলা বাহুল্য, অধিকাংশ নবী তাঁরই বংশ থেকে প্রেরিত হয়েছিলেন। এমন কি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)ও ছিলেন তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এরই বংশধর।
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-৩৪
ذُرِّیَّةًۢ بَعْضُهَا مِنْۢ بَعْضٍؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌۚ
এরা সবাই একই ধারায় অন্তর্গত ছিল, একজনের উদ্ভব ঘটেছিল অন্যজনের বংশ থেকে। আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন।
৩৪ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
অর্থাৎ এ মহামানবগণকে আল্লাহ তা’আলা সারা বিশ্বের উপর মনোনীত করেছেন। হযরত আদম (আঃ)-কে তিনি স্বহস্তে সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে স্বীয় রূহ প্রবেশ করিয়েছেন, তাঁকে সমস্ত জিনিসের নাম বলে দিয়েছেন, তাঁকে জান্নাতে বাস করিয়েছেন এবং স্বীয় নৈপুণ্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে আঁকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেন। যখন সারা জগত প্রতিমা পূজায় ছেয়ে যায় তখন হযরত নূহ (আঃ)-কে প্রথম রাসূল রূপে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। অতঃপর যখন তার গোত্র তাঁর অবাধ্য হয়ে যায় এবং তাঁর হিদায়াতের উপর আমল করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তখন তিনি রাতদিন প্রকাশ্য ও গোপনে তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার দিকে আহ্বান করতে থাকেন, কিন্তু তারা কোনমতেই তাঁর কথায় কর্ণপাত করে না। তখন আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ (আঃ)-এর অনুসারীগণ ছাড়া অন্য সকলকে স্বীয় পানির শাস্তি অর্থাৎ বিখ্যাত নূহের তুফানে’ ডুবিয়ে দেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশকে আল্লাহ তা’আলা মনোনয়ন দান করেন। তারশংশেই মানব জাতির নেতা এবং নবীদের (আঃ) সমাপ্তকারী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) জন্মগ্রহণ করেন। ইমরান (আঃ)-এর বংশকেও তিনি মনোনীত করেন। ইমরান হযরত ঈসা (আঃ)-এর জননী হযরত মারইয়াম (আঃ)-এর পিতার নাম। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রঃ)-এর উক্তি অনুসারে তার বংশলতা নিম্নরূপঃ ইমরান ইবনে হাশিম ইবনে মীশা ইবনে হিযকিয়া ইবনে ইবরাহীম ইবনে গারইয়া ইবনে নাওশ ইবনে আযর ইবনে বাহওয়া ইবনে মুকাসিত ইবনে আয়শা ইবনে আইয়াম ইবনে সুলায়মান (আঃ) ইবনে দাউদ (আঃ)। সুতরাং হযরত ঈসা (আঃ) হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর। এর বিস্তারিত বর্ণনা ইনশাআল্লাহ সূরা-ই-আনআমের তাফসীরে আসবে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
খৃস্টানদের ভ্রষ্টতার প্রধানতম কারণ এই যে, তারা হযরত ঈসাকে (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও নবী হবার পরিবর্তে তাঁকে আল্লাহর পুত্র ও আল্লাহর কর্তৃত্বে অংশীদার গণ্য করে। তাদের বিশ্বাসের এই মৌলিক গলদটি দূর করতে পারলে সঠিক ও নির্ভুল ইসলামের দিকে তাদের ফিরিয়ে আনা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাই এই ভাষণের ভূমিকা এভাবে ফাঁদা হয়েছেঃ আদম, নূহ, ইবরাহীমের বংশের ও ইমরানের বংশের সকল নবীই ছিলেন মানুষ। একজনের বংশে আর একজনের জন্ম হয়েছে। তাদের কেউ খোদা ছিলেন না। তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, আল্লাহ তাঁর দ্বীনের প্রচার ও দুনিয়াবাসীর সংশোধনের জন্য তাদেরকে মনোনীত করেছিলেন।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
আল্লাহ তা‘আলা আদম, নূহ, ইবরাহীমের (আঃ) বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে চয়ন করে তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন। আদম (আঃ)-কে স্বয়ং নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, ফেরেশতাদের দ্বারা সিজদাহ করিয়েছেন এবং জান্নাতে বসবাস করিয়েছেন।
নূহ (আঃ)-কে নবুওয়াত দান করেছেন। তিনি মানুষকে একাধারে ৯৫০ বছর এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছেন এবং মূর্তিপূজা ত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁকেসহ তাঁর অনুসারী এবং প্রত্যেক প্রাণীর জোড়াসহ রক্ষা করে বাকি সবাইকে বন্যায় ডুবিয়ে মেরেছিলেন।
ইবরাহীম (আঃ)-কে এবং তাঁর বংশে বিভিন্ন সময় নাবী-রাসূল (যেমন: ইসমাঈল, ইসহাক ও ইয়া‘কূব (আঃ) ইত্যাদি) হিসেবে প্রেরণ করে সম্মানিত করেছেন।
ইমরান নামে দু’জন ব্যক্তি ছিলেন: ১. মূসা (আঃ) ও হারুন (আঃ)-এর পিতা। ২. মারইয়াম (আলাইহাস সালাম)-এর পিতা। এখানে মারইয়াম (আলাইহাস সালাম)-এর পিতাকে বুঝানো হয়েছে। এরা সবাই পরস্পর বংশধর এবং দীনের ব্যাপারে একে অন্যের সম্পূরক ও সহযোগী।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. নাবী-রাসূলগণ আদম সন্তান হলেও সাধারণ মানুষ থেকে শ্রেষ্ঠতর।
২. সকল নাবীর দীনের মূল বিষয় ছিল আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও তাগুত বর্জন।
৩. নাবীগণ পরস্পর দীনী ভাই।