أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٤٩)-২৫১
www.motaher21.net
قَالَ مَنْ أَنصَارِىٓ إِلَى اللَّهِ ۖ
‘আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী হবে?’
” Who will be my helpers to Allah?”
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-৫২-৫৪
فَلَمَّاۤ اَحَسَّ عِیْسٰى مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ اَنْصَارِیْۤ اِلَى اللّٰهِؕ قَالَ الْحَوَارِیُّوْنَ نَحْنُ اَنْصَارُ اللّٰهِۚ اٰمَنَّا بِاللّٰهِۚ وَ اشْهَدْ بِاَنَّا مُسْلِمُوْنَ
যখন ঈসা অনুভব করলো, ইসরাঈল কুফরী ও অস্বীকার করতে উদ্যোগী হয়েছে, সে বললোঃ “কে হবে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ বললোঃ আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম (আল্লাহ্র সামনে আনুগত্যের শির নতকারী) ।
رَبَّنَآ ءَامَنَّا بِمَآ أَنزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشّٰهِدِينَ
‘হে আমার রব! আপনি যা নাযিল করেছেন তার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এ রাসূলের অনুসরণ করেছি। কাজেই আমাদেরকে সাক্ষ্যদানকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন। ’
وَمَكَرُوا۟ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيْرُ ٱلْمَٰكِرِينَ
এবং তারা কৌশল করেছিল এবং আল্লাহ্ও (জবাবে) কৌশল করেছিলেন, আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ।
৫২-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
অর্থাৎ যখন হযরত ঈসা (আঃ) তাদের একগুয়েমী ও বিবাদ প্রত্যক্ষ করলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তারা হঠকারিতা হতে ফিরে আসবে না তখন তিনি বললেন, আল্লাহর উপর আমার আনুগত্য স্বীকারকারী কেউ আছে কি? আবার ভাবার্থ এও বর্ণনা করা হয়েছে, এমন কেউ আছে কি যে আল্লাহর সাথে আমার সাহায্যকারী হতে পারে? কিন্তু প্রথম উক্তিটিই বেশী যুক্তিযুক্ত। বাহ্যতঃ এটা জানা যাচ্ছে যে, তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ তা’আলার দিকে মানুষকে আহ্বানের কাজে কেউ আমার হাত শক্তকারী আছে কি?’ যেমন আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করার পূর্বে হজ্বের মৌসুমে বলেছিলেন, কুরাইশরা তো আমাকে আল্লাহর কালাম প্রচারের কার্যে বাধা দিচ্ছে, এমতাবস্থায় এ কার্যের জন্যে আমাকে জায়গা দিতে পারে এমন কেউ আছে কি?’ মদীনাবাসী আনসারগণ এ সেবার কার্যে এগিয়ে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জায়গা দান করেন। তাঁরা তাঁকে যথেষ্ট সাহায্যও করেন এবং যখন তিনি তাদের নিকট গমন করেন তখন তারা পুরোপুরি তাঁর সহযোগিতা করেন এবং তাঁর প্রতি তুলনাবিহীন সহানুভূতি প্রদর্শন করেন। দুনিয়ার সাথে মোকাবিলায় তারা নিজেদের বক্ষকে নবী (সঃ)-এর জন্য ঢাল করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হিফাযতে, মঙ্গল কামনায় ও তার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার কাজে তাদের আপাদমস্তক নিমগ্ন থাকে। আল্লাহ তা’আলা তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করুন। অনুরূপভাবে হযরত ঈসা (আঃ)-এর এ আহ্বানেও কতক বানী ইসরাঈল সাড়া দেয়, তার উপর ঈমান আনয়ন করে এবং তাকে পূর্ণভাবে সাহায্য করে। আর তারা ঐ আলোকের অনুসরণ করে যা আল্লাহ তা’আলা হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করেছিলেন, অর্থাৎ ইঞ্জীল। এ লোকগুলো ধোপা ছিল এবং তাদের সাদা কাপড়ের কারণেই তাদেরকে হাওয়ারী’ বলা হতো। কেউ কেউ বলেন যে, তারা শিকারী ছিল। তবে সঠিক কথা এই যে, সাহায্যকারীকে ‘হাওয়ারী’ বলা হয়। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসে রয়েছে যে, খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “আমার জন্যে স্বীয় বক্ষকে ঢাল করতে পারে এরূপ কেউ আছে কি?’ এ শব্দ শুনামাত্রই হ্যরত যুবায়ের (রাঃ) প্রস্তুত হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সঃ) দ্বিতীয় বার একথাই বলেন, এবারেও হযরত যুবায়ের (রাঃ) অগ্রসর হন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ প্রত্যেক নবীরই ‘হাওয়ারী (সাহায্যকারী) থাকে এবং আমার ‘হাওয়ারী’ হচ্ছে হযরত যুবায়ের (রাঃ)।
এ লোকগুলো তাদের প্রার্থনায় বলে, “হে আমাদের প্রভু! সাক্ষীগণের মধ্যে আমাদের নাম লিখে নিন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে এর ভাবার্থ। হচ্ছে মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উম্মতের মধ্যে নাম লিখে নেয়া। এ তাফসীরের বর্ণনা সনদ হিসেবে খুবই উৎকৃষ্ট। অতঃপর বানী ইসরাঈলের ঐ অপবিত্র দলের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যারা হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রাণের শত্রু ছিল। তারা তাকে হত্যা করার ও শূলে চড়াবার ইচ্ছে করেছিল। সেই যুগের বাদশাহর কাছে তারা তাঁর দুর্নাম করতো। তারা বাদশাহকে বলতো, “এ লোকটি জনগণকে পথভ্রষ্ট করছে, দেশের মধ্যে বিদ্রোহের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করছে, মানুষকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এবং পিতা ও পুত্রের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি করছে। বরং তারা তাঁকে দুশ্চরিত্র, বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যাবাদী, প্রতারক প্রভৃতি বলে অপবাদ দিয়েছিল এমনকি তাঁকে ব্যভিচারিণীর পুত্র বলতেও তারা দ্বিধাবোধ করেনি। অবশেষে বাদশাহও তার জীবনের শত্রু হয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে বলে, তাকে ধরে এনে ভীষণ শাস্তি প্রদান করতঃ ফাঁসি দিয়ে দাও।
অতঃপর তিনি যে বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন সৈন্যগণ তাঁকে বন্দী করার উদ্দেশ্যে সে বাড়ী পরিবেষ্টন করে তার ঘরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাঁকে তাদের হাত হতে বাঁচিয়ে নেন এবং তাঁকে ঐ ঘরের ছিদ্র দিয়ে আকাশে উঠিয়ে নেন। আর তাঁর সঙ্গে সাদৃশ্য বিশিষ্ট একটি লোককে তথায় নিক্ষেপ করেন, যে সে ঘরেই অবস্থান করছিল। ঐ লোকগুলো রাত্রির অন্ধকারে তাকেই হযরত ঈসা (আঃ) মনে করে ধরে নিয়ে যায়। তাকে তারা কঠিন শাস্তি দেয় এবং তার মস্তকোপরি কাটার টুপি রেখে দিয়ে শূলে চড়িয়ে দেয়। এটাই ছিল তাদের সাথে মহান আল্লাহর কৌশল যে, তাদের ধারণায় তারা আল্লাহ তা’আলার নবী (আঃ)-কে ফাঁসি দিয়েছে, অথচ আল্লাহ পাক স্বীয় নবীকে মুক্তি দিয়েছেন। ঐ দুষ্কর্যের ফল তারা এই প্রাপ্ত হয়েছিল যে, চিরদিনের মত তাদের অন্তর কঠিন হয়ে যায়। তারা মিথ্যা ও অন্যায়ের উপরেই প্রতিষ্ঠিত থাকে। দুনিয়াতেও তারা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয় এবং পরকালেও তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। ওরই বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে যে, তারা ষড়যন্ত্র করলে হবে কি? আল্লাহ তা’আলার কৌশলের কাছে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে যাবে। তিনিই সবচেয়ে বড় কৌশলী।
তফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
‘হাওয়ারী’ শব্দটি আমাদের এখানে ‘আনসার’ শব্দের কাছাকাছি অর্থ বহন করে। বাইবেলে সাধারণভাবে হাওয়ারীর পরিবর্তে ‘শিষ্যবৃন্দ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন স্থানে তাদের ‘রসূল’ও বলা হয়েছে। কিন্তু রসূল এই অর্থে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে দ্বীন প্রচারের জন্য পাঠাতেন। আল্লাহ তাদেরকে রসূল হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, এই অর্থে রসূল বলা হয়নি।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে অংশ গ্রহণকে কুরআন মজীদের অধিকাংশ স্থানে “আল্লাহ্কে সাহায্য করা” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি অবশ্যি একটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয়। জীবনের যে পরিসরে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও সংকল্পের স্বাধীনতা দান করেছেন সেখানেই তিনি নিজের খোদায়ী শক্তি ব্যবহার করে কুফর বা ঈমান, বিদ্রোহ বা আনুগত্যের মধ্য থেকে কোন একটির পথ অবলম্বন করার জন্য মানুষকে বাধ্য করেননি। এর পরিবর্তে তিনি যুক্তি ও উপদেশের সাহায্য নিয়েছেন। এভাবে তিনি মানুষের কাছ থেকে এই স্বতষ্ফুর্ত স্বীকৃতি আদায় রতে চেয়েছেন যে, অস্বীকৃতি, নাফরমানী ও বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার জন্য নিজের স্রষ্টার দাসত্ব, আনুগত্য ও বন্দেগীর পথ অবলম্বন করাই প্রকৃত সত্য এবং এটিই তার সাফল্য ও নাজাতের পথ। এভাবে প্রচার, উপদেশ ও নসীহতের সাহায্যে মানুষকে সত্য সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করাই আল্লাহর কাজ। আর যেসব লোক এই কাজে আল্লাহকে সাহায্য করে তাদেরকেই আল্লাহর সাহায্যকারী গণ্য করা হয়। আল্লাহর কাছে মানুষের এটিই সর্বোচ্চ মর্যাদা। নামায, রোযা এবং অন্যান্য যাবতীয় ইবাদাত বন্দেগীতে মানুষ নিছক বান্দা ও গোলামদের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে সে আল্লাহর সাহায্যকারী ও সহযোগীর মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। এই দুনিয়ার রূহানী ও আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে অভিষিক্ত হবার এটিই উচ্চতম মর্যাদা ও মকাম।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] এ আয়াতের দুটি অর্থ হতে পারে। মুজাহিদ বলেনঃ এর অর্থ হল কে আমার অনুসরণ করবে আল্লাহ্র পথে? সুফিয়ান সাওরী বলেনঃ এর অর্থ কে আল্লাহ্র সাথে আমাকে সহযোগিতা করবে? মুজাহিদের কথা এখানে সবচেয়ে বেশী প্রণিধানযোগ্য। তবে সবচেয়ে স্পষ্ট মত হল, এর অর্থ কে আমাকে সাহায্য করবে আল্লাহ্র পথে আহবানের ক্ষেত্রে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের মৌসুমে ডেকে ডেকে বলতেনঃ ‘এমন কে আছে যে আমাকে আশ্রয় দেবে, যাতে করে আমি আমার প্রভুর বাণী প্রচার করতে পারি। কেননা, কুরাইশরা আমাকে আমার রবের বাণী প্রচারে বাধা দিচ্ছে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৩/৩৩৯-৩৪০]
[২] ঈসা ‘আলাইহিস সালামের খাঁটি ভক্তদের উপাধি ছিল হাওয়ারী- তাদের আন্তরিকতা ও মনের স্বচ্ছতার কারণে অথবা যেহেতু তারা সাদা পোষাক পরিধান করতেন এ জন্য তাদেরকে হাওয়ারী নামে অভিহিত করা হত। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্থীদের উপাধি ছিল সাহাবী। কোন কোন তাফসীরবিদ হাওয়ারীদের সংখ্যা দ্বাদশ উল্লেখ করেছেন। ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন সময় শুধু সাহায্যকারী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ অর্থেই এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘প্রত্যেক রাসূলের একজন হাওয়ারী অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে আমার হাওয়ারী হলেন যুবায়ের’
[বুখারীঃ ২৬৯১, মুসলিমঃ ২৪১৫]
[৩] আরবী ভাষায় ‘মাকর’ শব্দের অর্থ সুরক্ষা ও গোপন কৌশল। উত্তম লক্ষ্য অর্জনের জন্য মকর ভাল এবং মন্দ লক্ষ্য অর্জনের জন্য হলে তা মন্দও হতে পারে। এ আয়াতে কাফেরদের ‘মাকার’-এর বিপরীতে আল্লাহ্র পক্ষ থেকেও ‘মাকার’ করার কথা এ কারণেই যোগ করা সঠিক হয়েছে। বাংলা ভাষার বাচনভঙ্গিতে ‘মাকার’ শব্দটি শুধু ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল অর্থে ব্যবহৃত হয়। কাজেই এ নিয়ে আরবী বাচনভঙ্গিতে সন্দেহ করা উচিত নয়। আরবী অর্থের দিক দিয়েই এখানে আল্লাহ্কে ‘শ্রেষ্ঠতম কুশলী’ বলা হয়েছে। তাছাড়া (مَكْر) ও (خِدَاع) এবং এ জাতীয় শব্দসমূহের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা হলো, এগুলো যদি কাফেরদের (مَكْر) ও (خِدَاع) এর বিপরীতে ব্যবহৃত হয় তখন সেটি খারাপ গুণ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বরং কাফেরদের (مَكْر) ও (خِدَاع) এর বিপরীতে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে (مَكْر) ও (خِدَاع) করা একটি ইতিবাচক গুণ। [সিফাতুল্লাহিল ওয়ারিদা ফিল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, আস-সাক্কাফ] উদ্দেশ্য এই যে, ইয়াহুদীরা ঈসা ‘আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্র ও গোপন কৌশল অবলম্বন করতে আরম্ভ করে। তারা অনবরত বাদশাহর কাছে বলতে থাকে যে, লোকটি আল্লাদ্রোহী। সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করতে সচেষ্ট। এসব অভিযোগ শুনে বাদশাহ তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। ইয়াহুদীদের এ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলার সূক্ষ্ম ও গোপন কৌশলও স্বীয় পথে অগ্রসর হচ্ছিল। পরবর্তী আয়াতে এর বর্ণনা রয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ, এমন গভীর ষড়যন্ত্র এবং সন্দেহজনক আচরণ যার ভিত্তিই ছিল কুফরী তথা মাসীহ (আঃ)-এর রিসালাতকে অস্বীকার করার উপর।
[২] বহু নবী স্বীয় জাতির ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে বাহ্যিক উপায়-উপকরণের ভিত্তিতে তাদেরই মধ্যেকার বিবেকবান ব্যক্তিদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করেছেন। যেমন নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ও (ইসলামের) প্রাথমিক পর্যায়ে যখন কুরাইশরা তাঁর দাওয়াতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন তিনি হজ্জের মৌসুমে লোকদেরকে তাঁর সাথী ও সাহায্যকারী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। যাতে তিনি তাঁর প্রতিপালকের বাণী মানুষের নিকট পৌঁছাতে পারেন। আর তাঁর এই আহবানে সাড়া দিয়ে আনসারী সাহাবীগণ হিজরতের আগে ও পরে নবী কারীম (সাঃ)-কে সাহায্য করেছিলেন। অনুরূপ এখানে ঈসা (আঃ) সাহায্য চেয়েছেন। তবে এই সাহায্য এমন সাহায্য নয়, যা কোন উপায়-উপকরণ ছাড়াই আসে। (এবং যে সাহায্য করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নেই।) কারণ এ রকম সাহায্য সৃষ্টির কাছে চাওয়া শিরক। আর প্রত্যেক নবীর আগমন ঘটেছে শিরকের দরজা বন্ধ করার জন্যই, অতএব তাঁরা কিভাবে শির্ককীয় কাজ সম্পাদন করতে পারেন? কিন্তু কবরপূজারীদের ভ্রান্ত মতাদর্শ সত্যিই বড়ই দুঃখজনক যে, তারা মৃতদের নিকট সাহায্য চাওয়া বৈধতার প্রমাণে ঈসা (আঃ)-এর مَنْ أَنْصَارِيْ إِلَى اللهِ উক্তিকে পেশ করে। সুতরাং ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রা-জিঊন। আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াত দান করুন!
[৩] حَوَارِيُّوْنَ (হাওয়ারিয়্যুন) حَوَارِي (হাওয়ারী) শব্দের বহুবচন। যার অর্থ হল, সাহায্যকারী (শিষ্য)। যেমন, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেক নবীর একজন বিশেষ সাহায্যকারী ছিল। আমার বিশেষ সাহায্যকারী হল যুবায়ের।” (বুখারী ২৮৪৭, মুসলিম ২৪১৫নং)
[৪] ঈসা (আঃ)-এর যামানায় শাম (সিরিয়া) অঞ্চল রোমক শাসনের অন্তর্গত ছিল। এখানে রোমকদের পক্ষ থেকে যাকে শাসক নির্বাচিত করা হয়েছিল সে কাফের ছিল। ইয়াহুদীরা ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে এই শাসকের কান ভারী করল। যেমন, তিনি (নাঊযু বিল্লাহ) বিনা বাপের (জারজ সন্তান) এবং বড়ই ফাসাদী ইত্যাদি। শাসক তাদের দাবী অনুযায়ী তাঁকে শূলে চড়ানোর ফায়সালা গ্রহণ করে। কিন্তু মহান আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে সযত্নে আসমানে উঠিয়ে নেন, আর এরা তাঁর স্থানে তাঁরই মত দেখতে অন্য এক ব্যক্তিকে শূলে চড়িয়ে দেয় এবং মনে করে যে, তারা ঈসা (আঃ)-কে শূলে চড়িয়ে দিয়েছে। مَكْرٌ আরবী ভাষায় কোন কার্য সিদ্ধির জন্য সূক্ষ্ণ ও গোপনভাবে তদবির (বা কৌশল অবলম্বন) করাকে বলা হয়। আর এই অর্থেই এখানে মহান আল্লাহকে خَيْرُ المَاكِرِيْنَ (সর্বোত্তম কৌশলী) বলা হয়েছে। পরন্তু কৌশল মন্দও হতে পারে, যদি মন্দ উদ্দেশ্যে হয় (আর তখন তাকে চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র বলা হয়) এবং ভালও হতে পারে, যদি তা ভাল উদ্দেশ্যে হয়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
(الْحَوَارِيُّوْنَ) حَوَارِيْ
শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে উৎপত্তি। অর্থ দেয়ালে চুনকাম করার মত ধবধবে সাদা। পারিভাষিক অর্থে ঈসা (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হত। কোন কোন তাফসীরবিদ বলেন, তাদের সংখ্যা ছিল ১২ জন। ঈসা (আঃ)্-এর অনুসারী ও সাহায্যকারী সহচরদেরকে ‘হাওয়ারী’ বলা হয়। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: প্রত্যেক নাবীর একজন বিশেষ সাহায্যকারী (হাওয়ারী) ছিল। আমার বিশেষ সাহায্যকারী হল যুবাইর (রাঃ)। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৪১৫)
ঈসা (আঃ)-কে যখন হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে তুলে নেন। ঈসা (আঃ) এখনো জীবিত অবস্থায় আকাশে আছেন। কিয়ামতের পূর্বে মুহাম্মাদী শরীয়তের শাসক হিসেবে পৃথিবীর বুকে আগমন করবেন এবং বেশ কিছু দিন থাকার পর মৃত্যুবরণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! অচিরেই তোমাদের মাঝে ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে ঈসা বিন মারইয়াম (আঃ) অবতরণ করবেন। তিনি ক্রুশ চিহ্ন ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং জিযিয়া কর উঠিয়ে দিবেন। মানুষের ধন-সম্পদ তখন এতো বেড়ে যাবে যে, তা গ্রহণ করার মত কেউ থাকবে না। তখন আল্লাহ তা‘আলার জন্য একটি সিজদা দুনিয়া ও তার মাঝে যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৪৮, সহীহ মুসলিম হা:১৫৫)
(فَلَمَّآ أَحَسَّ عِيْسٰي)
যখন ঈসা (আঃ) বনু ইসরাঈলের স্বার্থবাদী নেতাদের বিরোধিতা ও চক্রান্ত বুঝতে পারলেন, তখন নিজের একনিষ্ঠ সাথীদের বাছাই করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন এবং সবাইকে একত্রিত করে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে আমার সত্যিকারের ভক্ত ও অনুসারী কারা? কারা আল্লাহ তা‘আলার ওয়াস্তে আমাকে দীনের দাওয়াতী কাজে সাহায্য করবে?
বস্তুতঃ শত্র“দের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ঈসা (আঃ) তাঁর অনুসারীগণের প্রতি উপরোক্ত আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে বারজন ভক্ত অনুসারী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। এরপর ঈসা (আঃ)-কে আকাশে তুলে নেয়া হলে তারাই ঈসায়ী ধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যদিও পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বহু দল-উপদল সৃষ্টি হয়েছে। আজও খ্রিস্টানরা রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্ট্যান্ট নামে প্রধান দু’দলে বিভক্ত।
(إِذْ قَالَ اللّٰهُ يٰعِيْسٰٓي إِنِّيْ مُتَوَفِّيْكَ)
‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন: হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মৃত্যু দেব’ ঈসা (আঃ)-এর যামানায় শাম (সিরিয়া) অঞ্চল রোমানদের শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে তাদের যে শাসক নির্বাচিত হয়েছিল সে কাফির ছিল। ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) যে বর্ণনা নিয়ে এসেছেন তাতে বলা হয়েছে, তিনি দামেস্কের বাদশা ছিলেন। সে বাদশা তারকাপূজক ছিল। (ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইয়াহূদীরা ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বানোয়াট কথাবার্তা বলে এ শাসকের কানভারী করল। যেমন, তিনি বিনা বাপের সন্তান, ফাসাদকারী, জনগণকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে ও জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করছে। শাসক তাদের দাবী অনুযায়ী তাকে শূলিতে চড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শাসকের নির্দেশে একটি ইয়াহূদী দল ঈসা (আঃ) যে ঘরে ছিলেন তা ঘেরাও করল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নেন এবং তাঁকে ঐ ঘরের ছিদ্র দিয়ে আকাশে তুলে নেন। আর তাঁর সদৃশ একজন লোককে তথায় নিক্ষেপ করে দেন যে সে ঘরেই অবস্থান করছিল। ঐ লোকগুলো রাত্রির অন্ধকারে তাকেই ঈসা (আঃ) মনে করে ধরে নিয়ে যায়। তাকে তারা কঠিন শাস্তি এবং তার মস্তকোপরি কাঁটার টুপি রেখে দিয়ে শূলে চড়িয়ে দেয়। এটাই ছিল তাদের সাথে মহান আল্লাহ তা‘আলার কৌশল। তাই আল্লাহ তা‘আলা বললেন:
(وَمَا قَتَلُوْهُ وَمَا صَلَبُوْهُ وَلٰكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ)
“অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রশবিদ্ধও করেনি; কিন্তু তাদের জন্য (একলোককে) সাদৃশ্য করে দেয়া হয়েছিল।” (সূরা নিসা ৪:১৫৭) সুতরাং ঈসা (আঃ)-কে ক্রশবিদ্ধ করতে পারেনি এবং হত্যাও করতে পারেনি। তিনি এখনো আকাশে জীবিত অবস্থায় রয়েছেন। শেষ যুগে তিনি আগমন করবেন, সকল দীন বাতিল করে ইসলামের প্রচার করবেন। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: নাবীগণ পরস্পর সৎ ভাই। তাদের মা ভিন্ন। র্ধম এক ও অভিন্ন। আর আমিই ঈসা বিন মারইয়াম (আঃ)-এর সব চাইতে নিকটবর্তী ব্যক্তি। কারণ, আমি ও তাঁর মাঝে আর কোন নাবী নেই। তিনি নিশ্চয়ই (কিয়ামতের পূর্বে) দুনিয়াতে অবতরণ করবেন। তোমরা যখন তাঁকে দেখবে অতিসত্বর চিনতে পারবে। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৯২৭০, সহীহ)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
প্রত্যেক নাবীর সহচর ছিল। আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহচর হল তাঁর সাহাবীগণ।
ঈসা (আঃ) এখনো আকাশে জীবিত আছেন; তিনি শেষ যামানায় দুনিয়াতে পুনরায় আগমন করবেন।
ঈসা (আঃ)-কে শূলিতে চড়ানো হয়নি এবং হত্যাও করেনি।