(Book# 114/٥٥)-২৫৭ www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/٥٥)-২৫৭
www.motaher21.net

وَدَّت طَّآئِفَةٌ مِّنْ أَهْلِ الْكِتٰبِ لَوْ يُضِلُّونَكُمْ

কিতাবধারীদের একদল চায় যাতে তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারে,

A party of the people of the Scripture wish to lead astray.

সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-৬৯-৭১

وَدَّت طَّآئِفَةٌ مِّنْ أَهْلِ الْكِتٰبِ لَوْ يُضِلُّونَكُمْ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ

কিতাবধারীদের একদল চায় যাতে তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারে, অথচ তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকেও পথভ্রষ্ট করে না, কিন্তু তারা উপলব্ধি করতে পারে না।

یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ لِمَ تَكْفُرُوْنَ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ وَ اَنْتُمْ تَشْهَدُوْنَ

হে আহলি কিতাব! কেন আল্লাহ‌র আয়াত অস্বীকার করছো, অথচ তোমরা নিজেরাই তা প্রত্যক্ষ করছো?

يٰٓأَهْلَ الْكِتٰبِ لِمَ تَلْبِسُونَ الْحَقَّ بِالْبٰطِلِ وَتَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ

হে কিতাবীরা! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত কর এবং সত্য গোপন কর, যখন তোমরা জান ?

৬৯-৭১ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] ঈমানদারদের প্রতি ইয়াহুদীরা যে হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করত এবং যার কারণে তারা মুসলিমদেরকে ভ্রষ্ট করতে চাইত, সে কথাই এই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, এইভাবে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ভ্রষ্টতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে; কিন্তু তারা টের পায় না।

[২] ‘জেনে-শুনে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার কর’ এর অর্থ, তোমরা নবী করীম (সাঃ)-এর সত্যবাদিতা ও সত্যতা সম্পর্কে জানো, তা সত্ত্বেও কেন কুফরী বা অস্বীকার কর?

[৩] এখানে ইয়াহুদীদের দু’টি অতি বড় অপরাধের প্রতি ইঙ্গিত করে তাদেরকে তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দান করা হচ্ছে। প্রথম অপরাধ হল, ন্যায়-অন্যায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে মিশ্রিত করণ; যাতে মানুষের কাছে সত্য ও মিথ্যা পরিষ্কার না হয়। দ্বিতীয় অপরাধ হল, সত্যকে গোপন করা। অর্থাৎ, নবী করীম (সাঃ)-এর যে নিদর্শন ও গুণাবলী তাওরাতে লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা মানুষ থেকে গোপন করা, যাতে কমসে-কম এই নিদর্শনাদির দিক থেকে যেন তাঁর সত্যতা প্রকাশ না হয়ে পড়ে। আর এই উভয় অপরাধ তারা জেনে-শুনেই করত। যার কারণে তারা বড়ই দুর্দশার শিকার হয়েছিল। তাদের অপরাধের কথা সূরা বাক্বারাতেও (২:৪২ আয়াতে) উল্লেখ হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, [وَلا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ] অর্থাৎ, “তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না।” ‘আহলে কিতাব’ (ঐশীগ্রন্থধারী) শব্দটি কোন কোন মুফাসসিরের নিকট ব্যাপক; যা ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান উভয়কেই শামিল। অর্থাৎ, তাদের উভয়কেই এই অপরাধ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন, ‘আহলে কিতাব’ বলতে ইয়াহুদীদের সেই কয়েকটি গোত্রকে বুঝানো হয়েছে, যারা মদীনায় বসবাস করত। যেমন, বানী ক্বুরাইযা, বানী নায্বীর এবং বানী ক্বাইনুক্বা। আর এই উক্তিকেই সঠিক বলে মনে হচ্ছে। কারণ, (বিভিন্ন কার্যকলাপের তাকীদে) মুসলিমদের সরাসরি সম্পর্ক এদের সাথেই ছিল এবং নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে বিরোধিতায় এরাই ছিল অগ্রণী।

তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-
এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “ঐ ইয়াহূদীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য কর যে, তারা কিভাবে মুসলমানদের প্রতি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে যাচ্ছে। তাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তারা কতইনা গোপন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে এবং তাদেরকে প্রতারিত করছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এসব অন্যায় কার্যের শাস্তি স্বয়ং তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। কিন্তু তারা তা মোটেই বুঝছে না।

অতঃপর তাদেরকে তাদের এ জঘন্য কার্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, তারা সত্য জেনে শুনে আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করছে। তাদের বদভ্যাস এও আছে যে, তারা পূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সত্য ও মিথ্যাকে মিলিয়ে দিচ্ছে। তাদের কিতাবসমূহে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর গুণাবলী বর্ণিত আছে, তারা তা গোপন করছে। মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করার যেসব পন্থা তারা বের করেছে তার মধ্যে একটি কথা আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করেছেন যে, তারা পরস্পর পরামর্শ করে- “তোমরা দিনের প্রথমাংশে ঈমান আনবে এবং মুসলমানদের সাথে নামায পড়বে এবং শেষাংশে কাফির হয়ে যাবে। তাহলে মূর্খদেরও এ ধারণা হবে যে, এরা এ ধর্মের ভেতর কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি পেয়েছে। বলেই এটা গ্রহণ করার পরেও তা হতে ফিরে গেল, কাজেই তারাও এ ধর্ম ত্যাগ করবে এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। মোটকথা তাদের এটা একটা কৌশল ছিল যে, দুর্বল ঈমানের লোকেরা ইসলাম হতে ফিরে যাবে এই জেনে যে, এ বিদ্বান লোকগুলো যখন ইসলাম গ্রহণের পরেও তা হতে ফিরে গেলো তাহলে অবশ্যই এ ধর্মের মধ্যে কিছু দোষত্রুটি রয়েছে। ঐ লোকগুলো বলতো‘তোমরা নিজেদের লোক ছাড়া মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করো না, তাদের নিকট নিজেদের গোপন তথ্য প্রকাশ করো না এবং নিজেদের গ্রন্থের কথা তাদেরকে বলো না, নচেৎ তারা ওর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহ তা’আলার নিকটও তাদের জন্যে ওটা আমাদের উপর দলীল হয়ে যাবে।’

তাফসীরে আবুবকর ‌যাকারিয়া‌ বলেছেন:-

[১] কাতাদা বলেন, এর অর্থ, হে কিতাবী সম্প্রদায়! কিভাবে তোমরা আল্লাহ্‌র আয়াতসমূহের সাথে কুফরী করতে পার, অথচ তোমরা সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আল্লাহ্‌র নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুণাগুণ তোমাদের কিতাবে রয়েছে। তারপর তোমরা তার সাথে কুফরী কর, তা অগ্রাহ্য কর এবং তার উপর ঈমান আনয়ন কর না। তোমরা তোমাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জীলে তাকে উম্মী নবী হিসেবে দেখতে পাও, যিনি আল্লাহ্‌র উপর এবং তার কালেমার উপর ঈমান রাখেন। [তাবারী]

[২] ইবনে আব্বাস বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনুছ ছাইফ, আদী ইবন যায়দ ও হারেস ইবন আওফ পরস্পর পরস্পরকে বললঃ আস, যা মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের উপর নাযিল হয়েছে আমরা সেটার উপর সকালবেলায় ঈমান আনয়ন করি এবং সন্ধ্যা বেলা সেটার সাথে কুফরী করি। যাতে করে মুসলিমরা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহে ঘুরপাক খেতে থাকে। ফলে আমরা যে রকম করেছি তারাও সে রকম করবে। আর এতে করেই তারা তাদের দ্বীন থেকে সরে আসবে। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতটি নাযিল করেন। [তাবারী]

কাতাদা রাহিমাহুল্লাহ এখানে ‘তোমরা কেন হককে বাতিলের বা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত কর’ এর অর্থ হচ্ছে, তোমরা কেন ইসলামের সাথে ইয়াহূদী মতবাদ ও খ্রীস্টানদের মতবাদকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেখছ? অথচ তোমরা ভাল করেই জান যে, যে দ্বীন ব্যতীত আর কোন কিছু আল্লাহ্‌ কবুল করবেন না, আর কোন প্রতিফল কেউ পাবে না, সেটি হচ্ছে ইসলাম। [তাবারী]

[৩] কাতাদা বলেন, জেনে-বুঝে সত্য গোপন করার অর্থ হচ্ছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিষয়টি তারা গোপন করছে। অথচ তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তাদের তাওরাত ও ইঞ্জীলে আলোচনা ও গুণাগুণ দেখতে পায়। যিনি সৎকাজের আদেশ করবেন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবেন। [তাবারী]

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

এ বাক্যটির আর একটি অনুবাদও হতে পারে। সেটি হচ্ছে, “তোমরা নিজেরা সাক্ষ্য দিচ্ছো” উভয় অবস্থাতেই মূল অর্থের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। আসলে নবী ﷺ এর পবিত্র জীবন, সাহাবায়ে কেরামের জীবনের ওপর তাঁর শিক্ষা ও অনুশীলনের বিস্ময়কর প্রভাব এবং কুরআনের উন্নতমানের বিষয়বস্তু এসবগুলোই মহান আল্লাহ‌র এমনই উজ্জ্বল নিদর্শন ছিল। যা দেখার পর নবী-রসূলদের অবস্থা ও আসমানী কিতাবসমূহের ধারা বিবরণীর সাথে পরিচিত ব্যক্তি মাত্রেরই নবী ﷺ এর নবুওয়াত সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার ছিল। কাজেই অনেক আহলি কিতাব (বিশেষ করে তাদের আলেম সমাজ) একথা জেনে নিয়েছিল যে, পূর্ববর্তী নবীগণ যে নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন মুহাম্মাদ ﷺ সেই নবী। এমন কি কখনো কখনো সত্যের প্রবল শক্তির চাপে বাধ্য হয়ে তারা নবী ﷺ এর সত্যতা ও তাঁর উপস্থাপিত শিক্ষাকে সত্য বলে স্বীকার করে নিতো। এ জন্যই কুরআন বার বার তাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছে যে, তোমরা নিজেরাই আল্লাহ‌র যেসব নিদর্শনের সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছো, সেগুলোকে তোমরা নিজেদের মানসিক দুষ্কৃতিপরায়ণতার কারণে ইচ্ছা করেই মিথ্যা বলছো কেন?

তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-

ঈমানদারদের সাথে ইয়াহূদীরা যে হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করত এবং যার কারণে তারা মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করতে চাইত, সে কথাই এ আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এভাবে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ভ্রষ্টতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না।

এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১০৯ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আহলে কিতাবগণ জেনেশুনে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহকে প্রত্যাখ্যান করত অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সত্যবাদিতা ও সততা সম্পর্কে জানত, তা সত্ত্বেও কুফরী করত।

অতঃপর ৭১ নং আয়াতে ইয়াহূদীদের দু’টি বড় অপরাধের কথা তুলে ধরা হয়েছে:

১. সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ করত; যাতে সাধারণ মানুষ সত্য ও মিথ্যা নির্ণয় করতে না পারে।

২. সত্যকে গোপন করত। অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যে সকল নিদর্শন ও গুণাবলী তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে তা মানুষ থেকে গোপন করত, যাতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সত্যতা প্রকাশ না পেয়ে যায়। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৪২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের উচিত এহেন ঘৃণিত আচরণ থেকে নিজেদের মুক্ত করা।

আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মুসলিমদের প্রধান শত্র“ ইয়াহূদীরা, তারপর মুশরিকরা।
২. মন্দ কর্মের পরিণতি নিজের ওপর বর্তায়।
৩. যে কোন ক্ষেত্রেই সত্য গোপন করা হারাম।
৪. সত্যের সাথে মিথ্যা সংমিশ্রণ করা মারাত্মক অপরাধ।

Leave a Reply