أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٧٤)-২৭৭
www.motaher21.net
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاس
তোমরাই শ্রেষ্ঠতম জাতি। মানবমন্ডলীর জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান হয়েছে,
You are the best of peoples ever raised up for mankind;
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-১১০-১১২
كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِؕ وَ لَوْ اٰمَنَ اَهْلُ الْكِتٰبِ لَكَانَ خَیْرًا لَّهُمْؕ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ اَكْثَرُهُمُ الْفٰسِقُوْنَ
এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। এই আহলি কিতাবরা ঈমান আনলে তাদের জন্যই ভালো হতো। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ঈমানদার পাওয়া যায়; কিন্তু তাদের অধিকাংশই নাফরমান।
لَن يَضُرُّوكُمْ إِلَّآ أَذًى ۖ وَإِن يُقٰتِلُوكُمْ يُوَلُّوكُمُ الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يُنصَرُونَ
সামান্য কষ্ট দেয়া ব্যতীত তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, আর যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে তোমাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে, অতঃপর তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না।
ضُرِبَتْ عَلَیْهِمُ الذِّلَّةُ اَیْنَ مَا ثُقِفُوْۤا اِلَّا بِحَبْلٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ حَبْلٍ مِّنَ النَّاسِ وَ بَآءُوْ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰهِ وَ ضُرِبَتْ عَلَیْهِمُ الْمَسْكَنَةُؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ كَانُوْا یَكْفُرُوْنَ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ وَ یَقْتُلُوْنَ الْاَنْۢبِیَآءَ بِغَیْرِ حَقٍّؕ ذٰلِكَ بِمَا عَصَوْا وَّ كَانُوْا یَعْتَدُوْنَۗ
এদের যেখানেই পাওয়া গেছে সেখানেই এদের ওপর লাঞ্ছনার মার পড়েছে। তবে কোথাও আল্লাহর দায়িত্বে বা মানুষের দায়িত্বে কিছু আশ্রয় মিলে গেলে তা অবশ্যি ভিন্ন কথা, আল্লাহর গযব এদেরকে ঘিরে ফেলেছে। এদের ওপর মুখাপেক্ষিতা ও পরাজয় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এসব কিছুর কারণ হচ্ছে এই যে, এরা আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করতে থেকেছে এবং নবীদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। এসব হচ্ছে এদের নাফরমানি ও বাড়াবাড়ির পরিণাম।
১১০-১১২ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
আল্লাহ তা’আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, মুহাম্মদ (সঃ)-এর উম্মত সমস্ত উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে, হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “তোমরা অন্যান্যদের তুলনায় সর্বোত্তম উম্মত। তোমরা মানুষের ঘাড় ধরে ধরে তাদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করছে। অন্যান্য ব্যাখ্যাদাতাগণও এ কথাই বলেন। ভাবার্থ হচ্ছে-‘তোমরা সমস্ত উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তোমরাই সবচেয়ে বেশী মুসলমানদের উপকার সাধনকারী। আবু লাহাবের কন্যা হযরত দুরা (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরের উপর ছিলেন এমন সময় একজন লোক তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার নিকট কোন্ ব্যক্তি উত্তম?’ তিনি বলেনঃ মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী কুরআন কারীমের পাঠক, সবচেয়ে বেশী ধর্মভীরু, সবচেয়ে বেশী সকার্যের আদেশ দানকারী, সর্বাপেক্ষা অধিক মন্দকার্যে বাধাদানকারী এবং সর্বাপেক্ষা বেশী আত্মীয়তার বন্ধন সংযুক্তকারী। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ইনি ঐ সহচরিণী যিনি মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। সঠিক কথা এই যে, এ আয়াতের মধ্যে সমস্ত উম্মত জড়িত রয়েছে। তবে অবশ্যই নিম্নের হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ সর্বোত্তম যুগ হচ্ছে আমার যুগ, তারপরে তার নিকটবর্তী যুগ এবং তারপরে তার পরবর্তী যুগ। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ তোমরা পূর্ববর্তী উম্মতদের সংখ্যা সত্তর পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলার নিকট তোমরা তাদের অপেক্ষা উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। এটি একটি প্রসিদ্ধ হাদীস। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের একটি বড় প্রমাণ হচ্ছে এ উম্মতের নবী (সঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব। তিনি সমস্ত মাখলুকের নেতা, সমস্ত রাসূল অপেক্ষা অধিক সম্মানিত। তার শরীয়ত এত পূর্ণ যে, এ রকম শরীয়ত আর কোন নবীর নেই। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এসব শ্রেষ্ঠত্ব একত্রকারী উম্মত ও সমস্ত উম্মত হতে শ্রেষ্ঠ হবে। এ শরীয়তের সামান্য আমলও অন্যান্য উম্মতের অধিক আমল অপেক্ষা উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি ঐ নিয়ামত প্রাপ্ত হয়েছি যা আমার পূর্বে কাউকেও দেয়া হয়নি। জনগণ জিজ্ঞেস করেনঃ ‘ঐ নিয়ামতগুলো কি?’ তিনি বলেনঃ (১) আমাকে প্রভাব প্রদান দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে। (২) আমাকে পৃথিবীর চাবি প্রদান করা হয়েছে। (৩) আমার নাম আহমাদ (সঃ) রাখা হয়েছে। (৪) আমার জন্যে মাটিকে পবিত্র করা হয়েছে। (৫) আমার উম্মতকে সমস্ত উম্মত অপেক্ষা বেশী শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। মুসনাদ-ই-আহমাদ এ হাদীসটির ইসনাদ উত্তম। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেনঃ আমি আবুল কাসিম (সঃ) হতে শুনেছি, তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা হযরত ঈসা (আঃ)-কে বলেছিলেন, “আমি তোমার পরে একটি উম্মত প্রতিষ্ঠিত করবো যারা শান্তির সময় প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এবং বিপদে পুণ্য যাঞা করবে ও ধৈর্য ধারণ করবে, অথচ তাদের সহিষ্ণুতা ও জ্ঞান থাকবে না। তিনি তখন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ সহিষ্ণুতা, দুরদর্শিতা এবং পূর্ণ জ্ঞান ছাড়া এটা কিরূপে সম্ভব?’ বিশ্ব প্রভু তখন বলেনঃ “আমি তাদেরকে সহনশীলতা ও জ্ঞান দান করবো। আমি এখানে এমন কতগুলো হাদীস বর্ণনা করতে চাই যেগুলোর বর্ণনা এখানে যথোপযুক্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের মুখমণ্ডল চৌদ্দ তারিখের চন্দ্রের ন্যায় দীপ্তিময় হবে। তারা হবে সবাই একই অন্তর বিশিষ্ট। আমি আল্লাহ আ’আলার নিকট আবেদন করি- “হে আমার প্রভু! এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করুন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ প্রত্যেকের সাথে আরও সত্তর হাজার।’ হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলতেনঃ “তাহলে তো এ সংখ্যার মধ্যে গ্রাম ও পল্লীবাসীও চলে আসবে। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমার প্রভু আমাকে শুভ সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর হাজার লোককে বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ হযরত উমার (রাঃ) একথা শুনে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আরও কিছু বেশী যা করলে ভাল হতো। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি আমার প্রভুর নিকট প্রার্থনা জানালে তিনি আমাকে সুসংবাদ দেন যে, প্রত্যেক হাজারের সঙ্গে আরও সত্তর হাজার করে হবে।’ হযরত উমার ফারূক (রাঃ) পুনরায় বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল(সঃ)! আরও বৃদ্ধির জন্যে প্রার্থনা করলে ভাল হতো।’ তিনি বলেনঃ ‘আবার প্রার্থনা জানালে প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে সত্তর হাজারের অঙ্গীকার করেন। হযরত উমার (রাঃ) পুনরায় আরয করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আরও কিছু চাইতেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি চেয়েছি এবং আরও এত বেশী লাভ করেছি।’ অতঃপর তিনি দু’ হাত প্রসারিত করে বলেনঃ “এরূপ।’ হাদীসের বর্ণনাকারী বলেন যে, এভাবে যখন আল্লাহ তাআলা একত্রিত করবেন তখন কত সংখ্যক মানুষ তাতে আসবে তা একমাত্র তিনিই জানেন। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) হযরত সাওবান (রাঃ) হিমসে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কুরত্ ছিলেন তথাকার আমীর। তিনি হযরত সাওবান (রাঃ)-কে দেখতে যেতে পারেননি। কিলাঙ্গ গোত্রের একটি লোক তাঁকে দেখতে যান। হযরত সাওবান (রাঃ) লোকটিকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘আপনি লেখা পড়া জানেন কি?’ লোকটি বলেনঃ হ্যা। তখন হযরত সাওবান (রাঃ) তাকে বলেনঃ ‘লিখুন, এ পত্রটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সেবক সাওবানের পক্ষ হতে আমীর আবদুল্লাহ ইবনে কুতকে দেয়া হচ্ছে। হাম্দ ও দরূদের পর প্রকাশ থাকে যে, যদি হযরত ঈসা (আঃ) অথবা হযরত মূসা (আঃ)-এর কোন খাদেম এখানে অবস্থান করতেন এবং রোগাক্রান্ত হতেন তবে আপনি অবশ্যই তাকে দেখতে যেতেন।’ অতঃপর তিনি লোকটিকে বলেনঃ ‘এ পত্রটি নিয়ে গিয়ে আমীরের নিকট পৌছিয়ে দেবেন।’ পূত্রটি হিমসের আমীরের নিকট পৌছলে তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন এবং তৎক্ষণাৎ হযরত সাওবান (রাঃ)-এর নিকট আগমন করেন। দীর্ঘক্ষণ বসে তাকে দেখার পর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে হযরত সাওবান (রাঃ) তার চাদর টেনে ধরেন এবং বলেনঃ একটি হাদীস শুনুন! আমি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র মুখ হতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ “আমার উম্মতের মধ্যে হতে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসেবে ও বিনা শাস্তি ভোগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। প্রত্যেক হাজারের সাথে আরও সত্তর হাজার করে হবে’। (মুসনাদ -ই-আহমাদ) এ হাদীসটিও বিশুদ্ধ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “একদা রাতে দীর্ঘক্ষণ ধরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে আলাপ আলোচনো করি। অতঃপর প্রত্যুষে তার খিদমতে হাযির হলে তিনি বলেনঃ “জেনে রেখো, আজ রাত্রে নবীগণ (আঃ)-এর নিজ নিজ উম্মতসহ আমাকে দেখানো হয়েছে। কোন কোন নবীর সাথে মাত্র তিনজন ছিলেন, কারও কারও সাথে ছিল ক্ষুদ্র একটি দল, কারও কারও সঙ্গে ছিল একটি জামা’আত এবং কারও কারও সাথে আবার একজনও ছিল না। যখন হযরত মূসা (আঃ) আগমন করেন তখন তার সাথে বহু লোক ছিল। এ দলটি আমার নিকট পছন্দনীয় হয়। আমি জিজ্ঞেস করিঃ ‘এটা কে?’ বলা হয়ঃ ইনি আপনার ভাই। হযরত মূসা (আঃ) এবং তাঁর সঙ্গীরা হচ্ছে বানী ইসরাঈল। আমি বলিঃ আমার উম্মত কোথায়? উত্তর হয়ঃ আপনার ডান দিকে লক্ষ্য করুন। অতঃপর আমি লক্ষ্য করে দেখি যে, অসংখ্য লোকের সমাগম হয়েছে, মনে হচ্ছে যেন পর্বতও ঢাকা পড়ে যাবে। আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন কি? আমি বলি- হে আমার প্রভু! আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। অতঃপর আমাকে বলা হয় ‘এদের সাথে আরও সত্তর হাজার করে রয়েছে যারা বিনা হিসেবে জান্নাতে চলে যাবে। তখন নবী (সঃ) বলেনঃ যদি সম্ভব হয় তবে এ সত্তর হাজারের অন্তর্গত হয়ে যাও। তা যদি সম্ভব না হয় তবে ওদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও যারা পর্বতসমূহ ঢেকে ফেলেছিল। আর তাও যদি সম্ভব না হয় তবে ঐ দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও যারা আকাশের প্রান্তে প্রান্তে অবস্থান করছিল। হযরত উক্কাসা ইবনে মুহসিন (রাঃ) দাঁড়িয়ে বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার জন্যে প্রার্থনা করুন। যেন আল্লাহ তা’আলা আমাকে এ সত্তর হাজারের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি প্রার্থনা করলে অন্য একজন সাহাবীও (রাঃ) দাড়িয়ে এ আরযই করেন। তখন তিনি বলেনঃ তোমার পূর্বে উক্কাস (রাঃ) অগ্রাধিকার লাভ করেছে।’ তখন আমরা পরস্পর বলাবিল করি যে, সম্ভবতঃ এ সত্তর হাজার লোকেরাই হবে যারা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করতঃ সারা জীবনে কখনও আল্লাহ তাআলার সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করেনি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের এ আলোচনা জানতে পেরে বলেনঃ “এরা ঐসব লোক যারা ঝাড় ফুক করিয়ে নেয় না, আগুন দ্বারা দাগিয়ে নেয় না এবং আল্লাহ তাআলার উপরই ভরসা রাখে।’ (মুসনাদ-ইআহমাদ) অন্য এক সনদে নিম্নের এটুকু বেশীও রয়েছে- যখন আমি আমার সম্মতি প্রকাশ করি তখন আমাকে বলা হয়- ‘এখন আপনার বাম দিকে লক্ষ্য করুন। আমি তখন লক্ষ্য করে দেখি যে, অসংখ্য জনসমাবেশ রয়েছে যারা আকাশ প্রান্তকে ঘিরে ফেলেছে। অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, এটা হজ্ব মওসুমের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমার উম্মতের এ আধিক্য আমার খুব পছন্দ হয়। তাদের দ্বারা সমস্ত পাহাড় পর্বত ও মাঠ প্রান্তর ভরপুর ছিল। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, হযরত উক্কাস (রাঃ)-এর পরে যে ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ছিলেন একজন আনসারী। (হাদীস তাবরানী) আর একটি বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে ৭০ হাজার বা সাত লক্ষ লোক জান্নাতে চলে যাবে। যারা একে অপরের হাত ধরে থাকবে। তারা সবাই এক সাথে জান্নাতে যাবে। চৌদ্দ তারিখের চাঁদের মত তাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও তাবরানী) হযরত হুসাইন ইবনে আবদুর রহমান (রঃ) বলেন, আমি হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর (রাঃ)-এর নিকট ছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “রাত্রে যে তারকাটি ভেঙ্গে পড়েছিল তা তোমরা কেউ দেখেছিলে কি?’ আমি বলিঃ হ্যাঁ, জনাব! আমি দেখেছি। আমি তখন নামাযে ছিলাম না। বরং আমাকে বিন্দুতে কেটে ছিল। তখন হযরত সাঈদ (রঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি তখন কি করেছিলে?’ আমি বলিঃ ফুঁক দিয়েছিলাম। তিনি বলেনঃ কেন? আমি বলিঃ হযরত শা’বী (রঃ) হযরত বুরাইদাহ্ ইবনে হাসীব (রঃ)-এর বর্ণনা হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, ন্যরবন্দী ও বিষাক্ত জন্তুর ব্যাপারে ঝাড়-ফুঁক করিয়ে নিতে হবে।’ তিনি বলেনঃ আচ্ছা বেশ! যার নিকট যা পৌছবে তার উপরেই সে আমল করবে। আমাকে তো হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) শুনিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উপরে উম্মতদেরকে পেশ করা হয়েছিল। কোন নবীর সাথে ছিল একটি দল। কারও সাথে ছিল একটি, কারও সাথে ছিল দু’টি এবং কারও কারও সাথে একটিও ছিল না। অতঃপর একটি বড় দল আমার দষ্টিগোচর হয়। আমি তখন মনে করি যে, এদলটি আমারই উম্মত। পরে আমি জানতে পারি যে, ওটা হযরত মূসা (আঃ)-এর উম্মত। আমাকে বলা হয়-“আকাশ প্রান্তের দিকে দৃষ্টিপাত কর। আমি তখন দেখি যে, তথায় অসংখ্য লোক রয়েছে। আমাকে বলা হয়-“এগুলো আপনারই উম্মত এবং ওদের সাথে আরও ৭০ হাজার রয়েছে যারা বিনা হিসেবে ও বিনা শাস্তিভোগে জান্নাতে চলে যাবে। এ হাদীসটি বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (সঃ). তো বাড়ী চলে যান, অপর সাহাবীগণ পরস্পর বলাবলি করেন যে, সম্ভবতঃ এরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীই হবেন। কোন একজন বলেন যে, না, এঁরা ইসলামের উপরে জন্মগ্রণকারী এবং ইসলামের উপরেই মৃত্যুবরণকারী, ইত্যাদি ইত্যাদি। অতঃপর নবী (সঃ) আগমন করেন এবং জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমরা কি সম্বন্ধে আলোচনা করছো? আমরা বর্ণনা করি। তিনি বলেনঃ না, বরং এরা ঐসব লোক যারা ঝাড়-ফুঁক করে না ও করিয়ে নেয় না, দাগিয়ে নেয় না এবং ভাবী শুভাশুভের লক্ষণের উপর বিশ্বাস করে না, বরং স্বীয় প্রভুর উপর ভরসা করে। হযরত উক্কাস (রাঃ) দুআর প্রার্থনা জানালে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার জন্যে প্রার্থনা জানিয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। অতঃপর অন্য এক ব্যক্তিও এ কথাই বললে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ ‘উক্কাসা অগ্রগামী হয়েছে।’ এ হাদীসটি সহীহ বুখারীর মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তথায় ঝাড় ফুঁক করিয়ে নেয় না এ কথাটি নেই। মুসলিমের মধ্যে এ কথাটিও রয়েছে। অন্য একটি সুদীর্ঘ হাদীসে রয়েছে যে, প্রথম দলটি তো মুক্তি পেয়ে যাবে, তাদের মুখমণ্ডল পুর্ণিমার চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল হবে, তাদের নিকট হিসাবও গ্রহণ করা হবে না। অতঃপর তাদের পরবর্তীগণ সবচেয়ে বেশী উজ্জ্বল তারকার ন্যায় দীপ্তিময় মুখমণ্ডল বিশিষ্ট হবে। (সহীহ মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘আমার সঙ্গে আমার প্রভুর অঙ্গীকার রয়েছে যে, আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসেবে ও বিনা শাস্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। প্রত্যেক হাজারের সঙ্গে আরও ৭০ হাজার হবে এবং আমার মহাসম্মানিত প্রভুর ললাপের (অঞ্জলি) তিন লোপ’। (হাফিজ আবু বকর ইবনে আসেমের কিতাবুস সুনান) এর ইসনাদ খুবই উত্তম। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে তার উম্মতের ৭০ হাজারের সংখ্যা শুনে হযরত ইয়াযিদ ইবনে আগনাস। (রাঃ) তাকে বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার উম্মতের সংখ্যার তুলনায় তো এ সংখ্যা খুবই কম। তখন তিনি বলেনঃ “প্রত্যেক হাজারের সঙ্গে আরও এক হাজার করে রয়েছে এবং এর পরে আল্লাহ তা’আলা তিন লোপ (করপুট) ভরে আরও দান করেন। এর ইসনাদও উত্তম। (কিতাবুস সুনান) অন্য একটি হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমার মহা মহিমান্বিত প্রভু আমার সঙ্গে অঙ্গীকার করেছেন যে, আমার উম্মতের মধ্য হতে ৭০ হাজার — বিনা হিসেবে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। অতঃপর এক এক হাজারের সুপারিশক্রমে আরও ৭০ হাজার করে মানুষ জান্নাতে চলে যবে। তারপর আমার প্রভু স্বীয় দু’ হাতের তিন লোপ ভরে আরও নিক্ষেপ করবেন। এটা শুনে হযরত উমার (রাঃ) খুশী হয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করেন এবং বলেনঃ তাদের সুপারিশ হবে স্বীয় বাপ-দাদা, পুত্র-কন্যা এবং বংশ ও গোত্রের পক্ষে। আল্লাহ করেন আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হই যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় লোপ ভরে শেষে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।’ (তাবরানী হাদীস) এ সনদের মধ্যেও কোন ক্রটি নেই। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাদীদ নামক স্থানে একটি হাদীস বর্ণনা করেন, যার মধ্যে তিনি এও বর্ণনা করেনঃ ‘এ ৭০ হাজার যারা বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আমার ধারণায় তারা আসতে আসতে তো তোমরা তোমাদের জন্যে, তোমাদের ছেলে মেয়েদের জন্যে এবং তোমাদের স্ত্রীদের জন্যে জান্নাতে স্থান নির্ধারিত করেই ফেলবে।’ (মুসনাদ-ই আহমাদ) এর সনদও মুসলিম (রঃ)-এর শর্তের উপর রয়েছে। অন্য আর একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলার অঙ্গীকার রয়েছে যে, আমার উম্মতের মধ্যে চার লক্ষ লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। হযরত আবু বকর (রাঃ) তখন বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আরও কিছু বেশী করুন।’ একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! এটাই যথেষ্ট মনে করুন।’ তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেন, কেন জনাব? আমরা যদি সবাই জান্নাতে চলে যাই তবে আপনার ক্ষতি কি?’ হযরত উমার (রাঃ) তখন বলেনঃ যদি আল্লাহ পাক চান তবে একই হাতে সমস্ত সৃষ্টজীবকে জান্নাতে নিক্ষেপ করবেন।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ “উমার (রাঃ) ঠিকই বলেছে।’ (মুসনাদ-ই-আবদুর রাযযাক) এ হাদীসটি অন্য সনদেও বর্ণনা করা হয়েছে, ওতে সংখ্যা রয়েছে এক লাখ। (ইসবাহানী) আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, যখন সাহাবীগণ ৭০ হাজার ও প্রত্যেকের সঙ্গে আরও ৭০ হাজার এবং আল্লাহ তা’আলার লোপ ভরে জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়ার বর্ণনা শুনেন তখন তারা বলতে থাকেন তাহলে এতদসত্তেও যে জাহান্নামে যাবে তার মত হতভাগা আর কে আছে?’ (আবু ইয়ালা) উপরের হাদীসটি অন্য একটি সনদেও বর্ণিত আছে, তাতে সংখ্যা রয়েছে তিন লাখ। অতঃপর হযরত উমার (রাঃ)-এর উক্তি এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর তাঁর উক্তির সত্যতা স্বীকারের বর্ণনা রয়েছে। (তাবারানী হাদীস গ্রন্থ) অন্য একটি বর্ণনায় জান্নাতে প্রবেশকারীদের বর্ণনা করতঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “আমার উম্মতের সমস্ত মুহাজির তো এ সংখ্যার মধ্যে এসে যাবে এবং অবশিষ্টগুলো হবে পল্লীবাসীদের দ্বারা পূর্ণ’। (মুহাম্মদ ইবনে সাহল) হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে হিসেব করা হলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় চার কোটি নব্বই হাজার। তাবরানীর হাদীসের মধ্যে আরও একটি হাসান হাদীস রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যার হাতে মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রাণ রয়েছে সেই সত্তার শপথ! তোমরা এক অন্ধকার রাত্রির মত অসংখ্য লোক একই সাথে জান্নাতের দিকে অগ্রসর হবে, জমীন তোমাদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে যাবে। সমস্ত ফেরেশতা সশব্দে বলে উঠবেন যে, মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সঙ্গে যে দল এসেছে তা সমস্ত নবীর দলসমূহ অপেক্ষা অনেক বেশী। হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি- শুধুমাত্র আমার অনুসারী উম্মত জান্নাতবাসীদের এক চতুর্থাংশ হবে। সাহাবীগণ খুশী হয়ে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করেন। পুনরায় তিনি বলেন, “আমি তো আশা রাখি যে, তোমরা জান্নাতবাসীর এক তৃতীয়াংশ হয়ে যাবে। আমরা। পুনরায় তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করি। আবার তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি যে, তোমরা অর্ধেক হয়ে যাবে। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেন, ‘তোমরা সমস্ত জান্নাতবাসীর এক চতুর্থাংশ হবে এতে সন্তুষ্ট নও?’ তারা সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তা’আলার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “তোমরা জান্নাতবাসীদের এক তৃতীয়াংশ হবে এতে কি তোমরা সন্তুষ্ট নও?’ তারা পুনরায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করতঃ তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তিনি তখন বলেন, “আমি তো আশা রাখি যে, তোমরা জান্নাতবাসীদের অর্ধেক হয়ে যাবে।’ (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম) তাবরানীর হাদীসের মধ্যে এ বর্ণনাটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, তোমরা কি চাও যে, জান্নাতবাসীদের এক চতুর্থাংশ তোমরা হবে এবং বাকী তিন চতুর্থাংশ অন্যান্য সমস্ত উম্মত হবে। সাহাবীগণ বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (সঃ) সবচেয়ে ভাল জানেন। তিনি বলেন, ‘আচ্ছা, যদি তোমরা এক তৃতীয়াংশ হও তবে? তারা বলেন, এটা খুব বেশী। তিনি বলেন, “আচ্ছা যদি তোমরা অর্ধেক হও তবে?’ তারা বলেন “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! তা হলে তো এটা আরও অনেক বেশী। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেন, “জেনে রেখো, সমস্ত জান্নাতবাসীর মোট একশ বিশটি সারি হবে। তন্মধ্যে শুধুমাত্র আমার এ উম্মতেরই হবে আশিটি সারি।’ মুসনাদ-ই-আহমাদেও রয়েছে যে, জান্নাত বাসীদের একশ বিশটি সারি হবে, তন্মধ্যে আশিটি সারি এ উম্মতেরই হবে। এ হাদীসটি তাবরানী, জামেউত তিরমিযী প্রভৃতির মধ্যে রয়েছে। তাবরানীর অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, যখন (আরবী) অর্থাৎ, একটি বিরাট দল হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং একটি বিরাট দল হবে পরবর্তীদের মধ্যে হতে। (৫৬:৩৯-৪০)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘তোমরা জান্নাতবাসীর এক চতুর্থাংশ, আবার বলেন, এক তৃতীয়াংশ, তার পরে বলেন, বরং অর্ধেক, সর্বশেষে বলেন, দুই তৃতীয়াংশ। সহীহ বুখারী শরীফে ও সহীহ মুসলিম শরীফ রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা পৃথিবীতে সর্বশেষে এসেছি এবং জান্নাতে সর্বপ্রথম প্রবেশ করবো। তাদেরকে আল্লাহর কিতাব পূর্বে দেয়া হয়েছে, আর আমাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে পরে। যে বিষয়ে তারা মতভেদ করেছে সে বিষয়ে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পন্থা অবলম্বনের তাওফীক প্রদান করেছেন। জুম’আর দিনও এরূপই যে, ইয়াহুদীরা আমাদের পিছনে রয়েছে, অর্থাৎ শনিবার এবং খ্রীষ্টানেরা তাদেরও পিছনে রয়েছে অর্থাৎ রবিবার। দারেকুতনীর মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ‘আমি যে পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ না করবো সে পর্যন্ত অন্যান্য নবীদের জন্যে জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। আর যে পর্যন্ত আমার উম্মত জান্নাতে প্রবেশ না করবে সে পর্যন্ত অন্যান্য উম্মতের জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এগুলোই ছিল ঐ সব হাদীস যেগুলোকে আমরা এখানে বর্ণনা করতে চেয়েছিলাম। উম্মতের উচিত যে, এখানে এ আয়াতের মধ্যে যতগুলো বিশেষণ রয়েছে সেগুলোর উপর যেন দৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ দান, মন্দ কাজ হতে বাধা প্রদান এবং আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান আনয়ন। হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) স্বীয় হজ্বে এ আয়াতটি পাঠ করতঃ বলেনঃ যদি তোমরা এ আয়াতের প্রশংসার মধ্যে আসতে চাও তবে এ সমুদয় গুণও নিজেদের ভেতর সৃষ্টি কর।’ ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন, “গ্রন্থ প্রাপ্তগণ ঐ সব কাজ পরিত্যাগ করেছিল বলেই আল্লাহ পাক স্বীয় কালামে তাদেরকে নিন্দে করেছেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা মানুষকে অন্যায় কর্ম হতে বিরত রাখতো না।” (৫:৭৯) যেহেতু উপরোক্ত আয়াতে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে, তাই পরে গ্রন্থধারীদের নিন্দে করা হচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-“এ লোকগুলোও যদি আমার শেষ নবী (সঃ)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতো তবে তারাও এ মর্যাদা লাভ করতো। কিন্তু তাদের অধিকাংশ অবিশ্বাস, দুষ্কার্য ও অবাধ্যতার উপরই প্রতিষ্ঠিত। তবে তাদের মধ্যে কতক লোক ঈমানদারও রয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে শুভ সংবাদ দিচ্ছেন- “তোমরা হতবুদ্ধি ও চিন্তিত হয়ে পড়ো না, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের বিরুদ্ধবাদীদের উপর জয়যুক্ত করবেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা খায়বারের যুদ্ধে তাদেরকে পর্যুদস্ত করেন এবং এর পূর্বে বানূ কাইনুকা, বানূ নাযীর এবং বান্ কুরাইযাকেও লাঞ্ছিত ও পরাভূত করেছিলেন। অনুরূপভাবে সিরিয়ার খ্ৰীষ্টানগণ সাহাবীদের আমলে পরাজিত হয়েছিল এবং সিরিয়া সম্পূর্ণরূপে তাদের হাত ছাড়া হয়ে যায় ও চিরদিনের জন্যে মুসলমানদের অধিকারে এসে পড়ে। তথায়। এক সত্যপন্থী দল হযরত ঈসা (আঃ)-এর আগমন পর্যন্ত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। হযরত ঈসা (আঃ) এসে ইসলাম ধর্ম এবং হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর শরীয়ত অনুযায়ী নির্দেশ দান করবেন এবং ক্রুশ ছিন্ন করবেন, শূকরকে হত্যা করবেন, জিযিয়া কর গ্রহণ করবেন না এবং শুধুমাত্র ইসলামই গ্রহণ করবেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলেন- “তাদের প্রতি লাঞ্ছনা ও হীনতা নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কোন জায়গাতেই তাদের নিরাপত্তা ও সম্মান নেই, তবে শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার আশ্রয় দানের দ্বারা নিরাপত্তা পেতে পারে। অর্থাৎ যদি তারা জিযিয়া প্রদান করে ও মুসলমান বাদশাহদের আনুগত্য স্বীকার করে তবে এক নিরাপত্তা পেতে পারে। কিংবা মুসলমানদের আশ্রয়দানের দ্বারা তারা নিরাপত্তা লাভ করতে পারে, অর্থাৎ যদি মুসলমানদের সাথে চুক্তি হয়ে যায় বা কোন মুসলমান যদি তাদেরকে আশ্রয় দান করে তবেও তারা নিরাপত্তা লাভ করতে পারে। যদি সে নিরাপত্তা কোন স্ত্রী লোক বা কোন ক্রীতদাসও দান করে তবুও তারা নিরাপত্তা লাভ করবে। আলেমদের একটি উক্তি এও রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে (আরবী) শব্দের অর্থ হচ্ছে অঙ্গীকার। তারা আল্লাহ তা’আলার ক্রোধে পতিত হয়েছে এবং দারিদ্রে আক্রান্ত হয়েছে। এটাও তাদের কুফর, নবীদেরকে হত্যা, অহংকার, হিংসা এবং অবাধ্যতারই প্রতিফল। এ কারণেই তাদের উপর চিরদিনের জন্যে লাঞ্ছনা, হীনতা এবং দৈন্য নিক্ষেপ করা হয়েছে। এটা হচ্ছে তাদের অবাধ্যতা এবং সত্যের সীমা অতিক্রমেরই প্রতিদান। আবু দাউদ এবং তায়ালেসীর মধ্যে রয়েছে যে, বানী ইসরাঈল এক এক দিনে তিনশ জন করে নবী হত্যা করতো এবং দিনের শেষভাগে বাজারে নিজ নিজ কাজে লেগে যেতো।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
ইতিপূর্বে সূরা বাকারার ১৭ রুকূ’ তে যে কথা বলা হয়েছিল এখানেও সেই একই বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বলা হচ্ছে, নিজেদের অযোগ্যতার কারণে বনী ইসরাঈলদেরকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের যে আসন থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে সেখানে এখন তোমাদেরকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ নৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপের দিক দিয়ে এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন সেগুলো তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে ন্যায় ও সৎবৃত্তির প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও অসৎবৃত্তির মূলোৎপাটন করার মনোভাব ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এই সঙ্গে তোমরা এক ও লা-শরীক আল্লাহকেও বিশ্বাসগত দিক দিয়ে এবং কার্যতও নিজেদের ইলাহ, রব ও সর্বময় প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছো। কাজেই এ কাজের দায়িত্ব এখন তোমাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা নিজেদের দায়িত্ব অনুধাবন করো এবং তোমাদের পূর্ববর্তীরা যেসব ভুল করে গেছে তা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখো। (সূরা বাকারার ১২৩ ও ১৪৪ টীকাও দেখুন)
এখানে আহলি কিতাব বলতে বনী ইসরাঈলকে বুঝানো হয়েছে।
অর্থাৎ দুনিয়ার কোথাও যদি তারা কিছুটা শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে থাকে তাহলে তা তাদের নিজেদের ক্ষমতা বলে অর্জিত হয়নি বরং অন্যের সহায়তা ও অনুগ্রহের ফল। কোথাও কোন মুসলিম সরকার আল্লাহর নামে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করেছে এবং কোথাও কোন অমুসলিম সরকার নিজস্বভাবে তাদেরকে সহায়তা দান করেছে। এভাবে কোন কোন সময় দুনিয়ার কোথাও তারা শক্তিশালী হবার সুযোগও লাভ করেছে। কিন্তু তাও নিজের বাহু বলে নয়, বরং নিছক অপরের অনুগ্রহে তথা পরের ধনে পোদ্দারী করার মতো।
[১] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘তোমরা সত্তরটি জাতিকে পূর্ণ করবে, তন্মধ্যে তোমরাই হলে আল্লাহ্র নিকট সবচেয়ে উত্তম এবং সবচেয়ে বেশী সম্মানিত’। [তিরমিযীঃ ৩০০১, ৪২৮৭] (অর্থাৎ তোমাদের পূর্বে বহু জাতি গত হয়েছে, যাদের সংখ্যা সত্তরটি। এর দ্বারা সংখ্যা বা আধিক্য বোঝানো উদ্দেশ্য। [মানাওয়ী, ফায়দুল কাদীর])
অপর হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “জান্নাতীদের কাতার হবে একশ’ বিশটি। তন্মধ্যে আশিটি কাতার হবে এই উম্মতের”। [তিরমিযীঃ ২৫৪৬, ইবনে মাজাহঃ ৪২৮৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৫৫]
অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, এ উম্মত হবে জান্নাতীদের অর্ধেক। [বুখারীঃ ৬৫২৮, মুসলিমঃ ২২১]
আরেক হাদীসে এসেছে, এ উম্মত সবার আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিমঃ ৮৫৫, ইবনে মাজাহঃ ১০৮৩]
[২] মুসলিম উম্মতকে ‘শ্রেষ্ঠতম সম্প্রদায়’ বলে ঘোষণা করার কারণসমূহ কুরআনুল কারীম একাধিক আয়াতে বর্ণনা করেছে। আলোচ্য ১১০ নং আয়াতে মুসলিম উম্মতের শ্রেষ্ঠতম সম্প্রদায় হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা মানব জাতির উপকারার্থে সমুত্থিত হয়েছে। আর তাদের প্রধান উপকার এই যে, মানব জাতির আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক সংশোধনের চেষ্টাই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের তুলনায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মাধ্যমে সৎকাজে আদেশ দান এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব অধিকতর পুর্ণত্বলাভ করেছে। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে ব্যাপক ঔদাসীন্যের দরুণ দ্বীনের অন্যান্য বিশেষ কার্যাবলীর ন্যায় সৎকাজে আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করার কর্তব্যটিও পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ উম্মতের মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত এমন একটি দল থাকবে- যারা ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ’ – এর কর্তব্য পুরোপুরি পালন করে যাবে। আবুল আলিয়া বলেন, এ উম্মতের চেয়ে বেশি কোন উম্মত ইসলামের আহবানে সাড়া দেয়নি, ফলে তাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। [ইবন আবী হাতেম] আয়াতে এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ বলার সাথে সাথে তাদের কর্ম কেমন হওয়া উচিত তা বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তারা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মা’রূফ বা সৎকাজ হচ্ছে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষী দেয়া, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেগুলোর স্বীকৃতি দেয়া এবং তার উপর কাফের মুশরিকদের সাথে জিহাদে থাকা। আর সবচেয়ে বড় মা’রূফ বা সৎকাজ হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র স্বীকৃতি আদায় করা। পক্ষান্তরে সবচেয়ে বড় মুনকার বা অসৎকাজ হচ্ছে, মিথ্যারোপ করা। [তাবারী]
[৩] এ বাক্যাংশে মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী উম্মতদের তুলনায় তাদের ঈমানের বিশেষ স্বাতন্ত্র থাকার কারণে বিশেষকরে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এই আয়াতে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ উম্মত গণ্য করা হয়েছে এবং তার কারণ কি তাও বলে দেওয়া হয়েছে। আর তা হল, ভাল কাজের আদেশ দেওয়া, মন্দ কাজে নিষেধ করা এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখা। অর্থাৎ, মুসলিম উম্মার মধ্যে যদি এই (ভাল কাজের আদেশ দেওয়া, মন্দ কাজে নিষেধ করা এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখার) বৈশিষ্ট্য থাকে, তবে তারা শ্রেষ্ঠ উম্মত। অন্যথা এই উপাধি থেকে তারা বঞ্চিত হবে। এরপর আহলে কিতাবের নিন্দাবাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হল, এই বিষয়টিকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেওয়া যে, যদি এই উম্মত ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা প্রদান না করে, তাহলে তারাও তাদের মত বিবেচিত হবে। কেননা আহলে কিতাবের গুণ হল,كَانُوا لا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ]] “তারা যে মন্দ কাজ করত, তা থেকে তারা একে অপরকে নিষেধ করত না।” (মায়েদাহঃ ৭৯) এখানে এই আয়াতে তাদের অধিকাংশ লোককে ফাসেক বলা হয়েছে। ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা প্রদান করার শরয়ী মান ‘ফারযে আইন’ (যা করা উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ফরয), নাকি ‘ফারযে কিফায়াহ’ (যা উম্মতের কিছু লোক সম্পাদন করলে সবার পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে, আর কেউ না করলে সকলেই গুনাহগার হবে।)? অধিকাংশ আলেমের মতে এটা ‘ফারযে কিফায়াহ’। অর্থাৎ, আলেমদের দায়িত্ব হল, তাঁরা এই ফরয আদায় করবেন। কারণ, শরীয়তের দৃষ্টিতে ভাল ও মন্দ নির্বাচনের সঠিক জ্ঞান তাঁদেরই আছে। তাঁরা যদি দ্বীনের দাওয়াত ও তবলীগের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে উম্মতের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের পক্ষ হতে এ ফরয আদায় হয়ে যাবে। যেমন, জিহাদও সাধারণ অবস্থায় ‘ফারযে কিফায়া’। অর্থাৎ, কোন একটি দল এ কাজ আদায় করলেই তা যথেষ্ট হবে। (অনেকের মতে উক্ত আদেশ ও নিষেধ করার কাজ নিজ নিজ জ্ঞান ও সাধ্য অনুযায়ী প্রত্যেকের উপর ফরয। আর এ কথাই সঠিক বলে মনে হয়। অল্লাহু আ’লাম। -সম্পাদক)
[২] যেমন, আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) ও অন্য কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য তাঁদের সংখ্যা খুবই স্বল্প ছিল। আর এই জন্যই ‘مِنْهُمْ’ এ مِن ‘হারফে তাব্ঈয’ তথা স্বল্পতা বুঝানোর জন্য ব্যবহূত হয়েছে।
[৩]أَذًى (কষ্ট দেওয়া) বলতে মৌখিকভাবে মিথ্যা অপবাদ রটানো। এর দ্বারা সাময়িকভাবে অবশ্যই কষ্ট হয়। তবে যুদ্ধের ময়দানে তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। হলও তা-ই। মদীনা থেকেও ইয়াহুদীদেরকে বের হতে হল। অতঃপর খায়বার জয় করলে সেখান থেকেও বের হল। অনুরূপ শাম (সিরিয়া) অঞ্চলে খ্রিষ্টানদেরকে মুসলিমদের হাতে পরাজিত হতে হয়। ক্রুসেড যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা এর প্রতিশোধ গ্রহণ করার প্রচেষ্টা চালায় এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করে নেয়। কিন্তু সুলতান সালাহুদ্দীন আয়্যূবী ৯০ বছর পর পুনরায় তা ফিরিয়ে আনেন। বর্তমানে মুসলিমদের ঈমানী দুর্বলতার ফল স্বরূপ এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের মিলিত চক্রান্ত ও প্রচেষ্টায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস আবারও মুসলিমদের হাতছাড়া হয়েছে। তবে অতি সত্বর এমন সময় আসবে যে, অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, বিশেষ করে ঈসা (আঃ)-এর অবতরণের পর খ্রিষ্টবাদের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং সহীহ হাদীসসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত হবে। (ইবনে কাসীর)
[৪] আল্লাহর গযবের ফল স্বরূপ ইয়াহুদীদের উপর যে লাঞ্ছনা ও দরিদ্রতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে সাময়িকভাবে বাঁচার দু’টি উপায় বলা হয়েছে। এক হল, তাদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ, হয় তারা ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা ইসলামী দেশে কর বা ট্যাক্স দিয়ে আশ্রিত হয়ে থাকা পছন্দ করবে। দ্বিতীয় হল, তারা মানুষের আশ্রয় লাভ করবে। আর এর দু’টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, (ক) ইসলামী দেশের সরকার নয়, বরং কোন সাধারণ মুসলিম তাদের আশ্রয় দেবে। আর এই অধিকার প্রত্যেক মুসলিমের আছে এবং দেশের সরকারকে তাকীদ করা হয়েছে যে, সে যেন কোন নিম্ন পর্যায়ের মুসলিমের দেওয়া আশ্রয়কেও প্রত্যাখ্যান না করে। (খ) তারা বড় কোন অমুসলিম শক্তির সহায়তা লাভ করবে। কারণ, ‘নাস’ (মানুষ) সাধারণ শব্দ যা মুসলিম ও অমুসলিম সকলকেই শামিল করে।
[৫] এ হল তাদের কুকর্ম, যার প্রতিফল স্বরূপ তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা উম্মাতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠত্বের সংবাদ দিয়েছেন। সকল উম্মাতের চেয়ে উম্মাতে মুহাম্মাদী শ্রেষ্ঠ তবে দু’টি শর্তে: ১. তারা মানুষকে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর নির্দেশ প্রদান করবে। ২. গায়রুল্লাহর ইবাদত ও শয়তানের কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে। যদি এ দু’টি শর্ত না থাকে তা হলে শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না।
সহীহ হাদীসের আলোকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠত্ব:
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, বিনা হিসেবে এবং বিনা আযাবে আমার উম্মাতের ৭০ হাজার লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে, বলা হল তারা কারা? তিনি বললেন: তারা হল যারা রোগ নিরাময়ের জন্য শেক দেবে না, ঝাড়ফুঁক নেবে না এবং পাখি উড়িয়ে ভাল-মন্দ নির্ণয় করে না। সর্বাবস্থায় তাদের রবের ওপর ভরসা করবে। (সহীহ বুখারী হা: ৫৩৭৮, ৫৪২০, সহীহ মুসলিম হা: ২১৮)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট না যে, তোমরা জান্নাতের এক চতুর্থাংশ হবে? (সাহাবাগণ বললেন) আমরা আল্লাহু আকবার বললাম, তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমারা কি এতে সন্তুষ্ট না যে, তোমরা জান্নাতের এক তৃতীয়াংশ হবে? (সাহাবাগণ বললেন:) আমরা আল্লাহু আকবার বললাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আশা করি তোমরা জান্নাতের অর্ধেক অধিবাসী হবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫২৮)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমরা দুনিয়াতে আগমনের দিক দিয়ে সবার শেষে আর জান্নাতে প্রবেশ করার দিক দিয়ে সবার প্রথম। (সহীহ বুখারী হা: ৮৯৬)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অন্যান্য নাবীদের থেকে আমাকে ছয়টি জিনিস দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি হল: পূর্বের নাবীদের নির্দিষ্ট কোন জাতির প্রতি প্রেরণ করা হয়েছিল আর আমাকে সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। (বুখারী হা: ৫২৩)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে: আমার উম্মাতকে সকল উম্মাতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে। (আহমাদ হা: ৭৬৩)
তারপর বলা হয়েছে যদি আহলে কিতাবগণ মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনত তা হলে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হত।
(لَنْ يَّضُرُّوْكُمْ)
কষ্ট বলতে মৌখিকভাবে মিথ্যা অপবাদ রটানো। এর দ্বারা সাময়িক কষ্ট অবশ্যই হয়। তবে যুদ্ধের ময়দানে তোমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। বাস্তবে তা-ই হয়েছিল। মদীনা থেকে ইয়াহূদীদেরকে বের করে দেয়া হয়েছিল। তারপর খায়বার জয় করা হলে সেখান থেকেও বের করে দেয়া হয়। শাম অঞ্চলে খ্রিস্টানদেরকে মুসলিমদের হাতে পরাজিত হতে হয়েছিল।
(ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ)
ইয়াহূদীদের ওপর যে লাঞ্ছনা ও দারিদ্রতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে সাময়িকভাবে বাঁচার উপায় দু’টি: ১. আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করবে, ২.অন্যথায় মুসলিম দেশে কর দিয়ে থাকবে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. উম্মাতে মুহাম্মাদী পূর্ববর্তী সকল উম্মতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাশীল।
২. এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হল, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান এনে সৎ কাজের প্রতি আহ্বান ও অসৎ কাজ হতে বিরত রাখা।
৩. আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে ইয়াহূদীদের ওপর বিজয়ের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন।
৪. ইয়াহূদীদের লাঞ্ছিত হবার অন্যতম কারণ হল, তারা আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে। নাবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং সীমালঙ্ঘন করে ও আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হয়ে থাকে।