أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٨٣)-২৮৬
www.motaher21.net
ثُمَّ أَنزَلَ عَلَيْكُم مِّنۢ بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً
অতঃপর কষ্টের পর আল্লাহ তোমাদের প্রতি শান্তি-তন্দ্রা প্রেরণ করলেন,
Then after the distress, He sent down security for you.
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-১৫৪-১৫৫
ثُمَّ اَنْزَلَ عَلَیْكُمْ مِّنْۢ بَعْدِ الْغَمِّ اَمَنَةً نُّعَاسًا یَّغْشٰى طَآئِفَةً مِّنْكُمْۙ وَ طَآئِفَةٌ قَدْ اَهَمَّتْهُمْ اَنْفُسُهُمْ یَظُنُّوْنَ بِاللّٰهِ غَیْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِیَّةِؕ یَقُوْلُوْنَ هَلْ لَّنَا مِنَ الْاَمْرِ مِنْ شَیْءٍؕ قُلْ اِنَّ الْاَمْرَ كُلَّهٗ لِلّٰهِؕ یُخْفُوْنَ فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ مَّا لَا یُبْدُوْنَ لَكَؕ یَقُوْلُوْنَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْاَمْرِ شَیْءٌ مَّا قُتِلْنَا هٰهُنَاؕ قُلْ لَّوْ كُنْتُمْ فِیْ بُیُوْتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِیْنَ كُتِبَ عَلَیْهِمُ الْقَتْلُ اِلٰى مَضَاجِعِهِمْۚ وَ لِیَبْتَلِیَ اللّٰهُ مَا فِیْ صُدُوْرِكُمْ وَ لِیُمَحِّصَ مَا فِیْ قُلُوْبِكُمْؕ وَ اللّٰهُ عَلِیْمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ
এ দুঃখের পর আল্লাহ তোমাদের কিছু লোককে আবার এমন প্রশান্তি দান করলেন যে, তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।১১২ কিন্তু আর একটি দল, নিজের স্বার্থই ছিল যার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ, আল্লাহ সম্পর্কে নানান ধরনের জাহেলী ধারণা পোষণ করতে থাকলো, যা ছিল একেবারেই সত্য বিরোধী। তারা এখন বলেছে, “এই কাজ পরিচালনার ব্যাপারে আমাদেরও কি কোন অংশ আছে?” তাদেরকে বলে দাও, “(কারো কোন অংশ নেই, ) এ কাজেই সমস্ত ইখতিয়ার রয়েছে এক মাত্র আল্লাহর হাতে।” আসলে এরা নিজেদের মনের মধ্যে যে কথা লুকিয়ে রেখেছে তা তোমাদের সামনে প্রকাশ করে না। এদের আসল বক্তব্য হচ্ছে, “যদি (নেতৃত্ব) ক্ষমতায় আমাদের কোন অংশ থাকতো, তাহলে আমরা মারা পড়তাম না।” ওদেরকে বলে দাও, “যদি তোমরা নিজেদের গৃহে অবস্থান করতে তাহলেও যাদের মৃত্যু লেখা হয়ে গিয়েছিল, তারা নিজেরাই নিজেদের বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে আসতো।” আর এই যে বিষয়টি সংঘটিত হলো, এটি এ জন্য ছিল যে, তোমাদের বুকের মধ্যে যা কিছু গোপন রয়েছে আল্লাহ তা পরীক্ষা করে নেবেন এবং তোমাদের মনের মধ্যে যে গলদ রয়েছে তা দূর করে দেবেন। আল্লাহ মনের অবস্থা খুব ভালো করেই জানেন।
إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَلَّوْا۟ مِنكُمْ يَوْمَ ٱلْتَقَى ٱلْجَمْعَانِ إِنَّمَا ٱسْتَزَلَّهُمُ ٱلشَّيْطَٰنُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا۟ۖ وَلَقَدْ عَفَا ٱللَّهُ عَنْهُمْۗ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ
দু’দল পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার দিন তোমাদের মধ্যে যারা পলায়নপর হয়েছিল, তোমাদের কোন কোন অতীত কার্যকলাপের জন্য শয়ত্বান তাদের পদস্খলন ঘটিয়েছিল এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেছেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, অতি সহনশীল।
১৫৪-১৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের উপর সেই দুঃখ ও চিন্তার সময় যে অনুগ্রহ করেছিলেন এখানে তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তিনি তাদেরকে তন্দ্রাভিভূত করেছিলেন। অস্ত্র-শস্ত্র হাতে রয়েছে এবং শত্রু সম্মুখে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু অন্তরে এত শান্তি রয়েছে যে, চক্ষু তন্দ্রায় ঢলে পড়েছে”যা শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষণ। যেমন সূরা-ই-আনফালের মধ্যে বদরের ঘটনায় রয়েছে (আরবী) অর্থাৎ তার পক্ষ হতে শান্তিরূপে যখন তন্দ্রা তোমাদেরকে আচ্ছন্ন করে। (৮:১১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ ‘যুদ্ধের সময় যে তন্দ্রা আসে তা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এসে থাকে এবং নামাযের সময় যে তন্দ্রা আসে তা শয়তানের পক্ষ হতে আসে।’ হযরত আবু তালহা (রাঃ) বলেনঃ ‘উহুদের যুদ্ধের দিন আমার চক্ষে এত বেশী তন্দ্রা এসেছিল যে, আমার হাত হতে তরবারী বারবার ছুটে গিয়েছিল। তিনি আরও বলেনঃ ‘আমি চক্ষু উঠিয়ে দেখি যে, প্রায় সবারই ঐরূপ অবস্থাই ছিল। তবে অবশ্যই একটি দল এরূপও ছিল যাদের অন্তর ছিল কপটতায় পরিপূর্ণ এবং তারা ছিল সদা ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের কুধারণা শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। অতএব বিশ্বস্ত আল্লাহর উপর নির্ভরশীল এবং সত্যপন্থী লোকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ পাক অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তারা অবশ্যই সফলকাম হবে। কিন্তু কপট সন্দেহ পোষণকারী এবং টলমলে ঈমানের লোকদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিস্ময়কর। তাদের প্রাণ শাস্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। তারা সদা হায় হায় করছিল এবং তাদের অন্তরে বিভিন্ন প্রকারের কুমন্ত্রণা ঢুকে পড়েছিল। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তারা মরতে চলেছে। তাদের অন্তরে বিশ্বাসও বদ্ধমূল হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং মুমিনগণ আর দুনিয়ায় থাকবে না। কাজেই বাঁচার কোন উপায় নেই। প্রকৃতপক্ষে মুনাফিকদের অবস্থা এই হয় যে, যেখানেই তারা সামান্য নিম্নভূমি দেখে, তাদের নৈরাশ্যের ঘনঘটা তাদেরকে ঘিরে নেয়। পক্ষান্তরে ঈমানদারগণ মন্দ হতে মন্দতম অবস্থাতেও আল্লাহ তা’আলার প্রতি ভাল ধারণাই রাখেন। মুনাফিকদের মনের ধারণা ছিল এই যে, যদি তাদের কোন অধিকার থাকতো তবে তারা সেদিনের মৃত্যু হতে রক্ষা পেয়ে যেতো এবং তারা গোপনে ওটা বলতোও বটে। হযরত যুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ ‘ঐ কঠিন ভয়ের সময়েও আমাদেরকে এত ঘুম পেয়ে বসে যে, আমাদের চিবুকগুলো বক্ষের সাথে লেগে যায়। আমি আমার সে অবস্থাতেই মু’তাব ইবনে কুশায়েরের নিম্নের উক্তি শুনতে পাইঃ যদি আমার সামান্য কিছু অধিকার থাকতো তবে এখানে নিহত হতাম না। আল্লাহ তা’আলা তাদেরকেই বলছেনঃ মৃত্যু তো আল্লাহ কর্তৃক ভাগ্যে লিখিত রয়েছে। মৃত্যুর সময় পরিবর্তিত হতে পারে না। তোমরা যদি বাড়ীতেও অবস্থান করতে, তথাপি এখানে যার ভাগ্যে মৃত্যু লিখা রয়েছে সে অবশ্যই বাড়ী ছেড়ে এখানে চলে আসতো। ফলে আল্লাহ কর্তৃক ভাগ্য লিখন পূর্ণ হয়ে যেতো। এ সময়টি এ জন্যেই ছিল যে, যেন আল্লাহ তোমাদের অন্তরের গোপন কথা প্রকাশ করে দেন। এ পরীক্ষা দ্বারা ভাল-মন্দ, সৎ ও অসতের মধ্যে প্রভেদ হয়ে গেল। যে আল্লাহ তাআলা অন্তরের গোপন কথা অবগত আছেন তিনি এ সামান্য ঘটনা দ্বারা মুনাফিকদেরকে প্রকাশ করে দিলেন এবং মুসলামনদেরও স্পষ্ট পরীক্ষা হয়ে গেল। এখন আল্লাহ পাক খাটি মুসলমানদের পদস্খলনের বর্ণনা দিচ্ছেন যা মানবীয় দুর্বলতার কারণে তাদের দ্বারা সাধিত হয়েছিল। শয়তানই তাদের এ পদস্খলন ঘটিয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল তাদের কর্মেরই ফল। তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অবাধ্যও হতো না এবং তাদের পদগুলো টলমলও করতো না। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ক্ষমার যোগ্য মনে করতঃ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ পাকের কাজই হচ্ছে ক্ষমা করে দেয়া। এর দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, হযরত উসমান (রাঃ) প্রভৃতির ঐ অপরাধকে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন। মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, হযরত ওলীদ ইবনে উকবা (রাঃ) একদা হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)-কে বলেনঃ ‘শেষ পর্যন্ত আপনি আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ)-এর উপর এত চটে রয়েছেন কেন?’ তিনি তাকে বললেনঃ হযরত উসমান (রাঃ)-কে তুমি বল- আপনি কি উহুদের যুদ্ধের সময় পলায়ন করেননি? বদরের যুদ্ধে অনুপস্থিত থাকেননি এবং হযরত উমার (রাঃ)-এর পন্থা পরিত্যাগ করেননি?”
হযরত ওলীদ (রাঃ) গিয়ে হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট এ ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তখন হযরত উসমান (রাঃ)এর উত্তরে বলেন (আরবী) অর্থাৎ (উহুদ যুদ্ধের অপরাধের জন্যে আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যই ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং সে জন্যে আর দোষারোপ কেন? বদরের যুদ্ধের সময় আমার সহধর্মিণী এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কন্যা হযরত রুকাইয়াহ রোগাক্রান্ত হওয়ায় তার রোগ দেখাশুনার কাজে ব্যস্ত থাকি। সে ঐ রোগেই মারা যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে গনীমতের মালের পূর্ণ অংশ দিয়েছিলেন। এটা স্পষ্ট কথা যে, একমাত্র সে ব্যক্তিই যুদ্ধলব্ধ মাল পেয়ে থাকে যে যুদ্ধক্ষেত্রে বিদ্যমান থাকে। সুতরাং বদরের যুদ্ধে আমার উপস্থিত থাকাই সাব্যস্ত হয়েছে। এখন বাকী থাকলো হযরত উমার (রাঃ)-এর পন্থা, ওটার ক্ষমতা আমারও নেই এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফেরও (রাঃ) নেই। যাও তার নিকট এ সংবাদ পৌছিয়ে দাও।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
ইসলামী সেনাদলের কিছু কিছু লোক এ সময় এই একটি নতুন ও অদ্ভুত ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। হযরত আবু তালহা এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের একজন ছিলেন। তিনি নিজে বর্ণনা করছেন, এ অবস্থায় আমাদের ওপর তন্দ্রাভাব এমনভাবে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল যে, আমাদের হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ছিল।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ এ কঠিন বিপদের সময় তাদের উপর তন্দ্রা নেমে এসে তাদেরকে প্রশান্ত করে দিচ্ছিল। আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা ওহুদের দিন কাতারবন্দী অবস্থাতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। এমনকি আমাদের হাত থেকে তরবারী পড়ে যাচ্ছিল আর আমি বারবার তা উঠিয়ে নিচ্ছিলাম। [বুখারী ৪৫৬২]
আর এটাই আল্লাহ্র বাণী “তারপর দুঃখের পর তিনি তোমাদেরকে প্রদান করলেন তন্দ্রারূপে প্রশান্তি, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল, এবং একদল জাহিলী যুগের অজ্ঞের ন্যায় আল্লাহ সম্বন্ধে অবাস্তব ধারণা করে নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল” এর তাৎপর্য। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যুদ্ধের মধ্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়া আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, আর সালাতের মধ্যে শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। [ইবন আবী হাতেম; আত-তাফসীরুস সহীহ]
[২] এখানে আরেক দল বলে মুনাফিকদের বুঝানো হয়েছে। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তারা সবচেয়ে ভীতু ও কাপুরুষ ও হকের বিপরীতে অবস্থানকারী সম্প্রদায় ছিল। [তাবারী] আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: উহুদের যুদ্ধের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম, আল্লাহ আমাদের উপর ঘুম পাঠালেন, আমাদের প্রত্যেকের থুতনি বুকে লেগে যাচ্ছিল। আল্লাহ্র শপথ আমি যেন মু’আত্তাব ইবনে কুসাইরের কথা স্বপ্নের মাঝে শুনছিলাম। সে বলছিলঃ ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না’ এ ব্যাপারেই আল্লাহ্র উপরোক্ত বাণী নাযিল হয়। [আল-আহাদিসুল মুখতারাহঃ ৩/৬০, ৮৬৪]
[৩] সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ও বিশ্বাস এই যে, যদিও সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নিস্পাপ নন, তাদের দ্বারা বড় কোন পাপ সংঘটিত হয়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু তা সত্ত্বেও উম্মতের জন্য তাদের কোন দোষচর্চা কিংবা দোষ আরোপ করা জায়েয নয়। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের এত বড় পদস্থলন ও অপরাধ মার্জনা করে তাদের প্রতি দয়া ও করুণাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন এবং তাদের
(رَّضِيَ اللّٰهُ عَنْھُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ)
অর্থাৎ “তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহ্র উপর সন্তুষ্ট” [সূরা আত-তাওবাহঃ ১০০, সূরা আল-মুজাদালাহঃ ২২]
-এ মহাসম্মানজনক মর্যাদায় ভূষিত করেছেন, তখন তাদেরকে কোন প্রকার অশালীন উক্তিতে স্মরণ করার কোন অধিকার অপর কারো পক্ষে কেমন করে থাকতে পারে? সে জন্যই এক সময় কোন এক সাহাবী যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী সম্পর্কে ওহুদ যুদ্ধের এই ঘটনার আলোচনায় বলেছেন যে, এরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বললেনঃ আল্লাহ নিজে যে বিষয়ের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে সমালোচনা করার কোন অধিকার কারো নেই। [দেখুন, বুখারী ৪০৬৬]
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আহলে-সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা হলো সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যেসব মতবিরোধ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছে, সে সম্পর্কে কারো প্রতি কোন আপত্তি উত্থাপন কিংবা প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা । কারণ, ইতিহাসে যেসব বর্ণনায় তাদের ক্রটি-বিচূতিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মিথ্যা ও ভ্রান্ত; যা শক্ররা রটিয়েছে। আর কোন কোন ব্যাপার রয়েছে যে গুলোতে কম-বেশী করা হয়েছে এবং যেগুলো প্রকৃতই শুদ্ধ সেগুলোও একান্তই সাহাবীগণের স্ব স্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে বিধায় তাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করা সমীচীন নয়। বস্তুতঃ ঘটনা বিশেষের মধ্যে যদি তারা সীমালঙ্ঘন করেও থাকেন, তবুও আল্লাহ তা’আলার রীতি হলো
(اِنَّ الْحَسَنٰتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّاٰتِ)
সৎকাজের মাধ্যমে অসৎ কর্মের কাফফারা হয়ে যায়। বলাবাহুল্য সাহাবায়ে কেরামের সৎকর্মের সমান অন্য কারো কর্মই হতে পারে না। কাজেই তারা আল্লাহ্ তা’আলার ক্ষমার যতটুকু যোগ্য, তেমন অন্য কেউ নয়। সে জন্যই তাদের আমল সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার অন্য কারো নেই। তাদের ব্যাপারে কটুক্তি বা অশালীন মন্তব্য করার অধিকারও অন্য কারো নেই। [আল-আকিদাতুল ওয়াসেতিয়্যা]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] উল্লিখিত চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির পর আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের উপর পুনরায় অনুগ্রহ করলেন এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধের ময়দানে অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁদের উপর তন্দ্রার ভাব সৃষ্টি করে দিলেন। আর এই তন্দ্রা (ঢুল) ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে প্রশান্তি এবং সাহায্যের দলীল। আবূ ত্বালহা (রাঃ) বলেন, আমিও তাঁদের একজন, যাঁদের উপর উহুদের দিন তন্দ্রার ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। এমন কি আমার তরবারি কয়েকবার আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, আর আমি ধরে নিয়েছিলাম। (সহীহ বুখারী) نُعَاسًا হল أَمَنَةً শব্দের বদল (পরিবর্ত শব্দ)। طَائِفَةٌ একবচন এবং বহুবচন উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়। (ফাতহুল ক্বাদীর)
[২] এ থেকে মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে তারা কেবল নিজেদের প্রাণ নিয়েই চিন্তিত ছিল।
[৩] যেমন ভাবত যে, নবী করীম (সাঃ)-এর সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই মিথ্যা। তিনি যে দ্বীনের প্রতি আহবান করেন, তার ভবিষ্যৎ আশঙ্কাজনক। তিনি তো আল্লাহর সহযোগিতা থেকেই বঞ্চিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
[৪] অর্থাৎ, আমাদের জন্য কি আল্লাহর পক্ষ হতে আর কোন বিজয় ও সহযোগিতার সম্ভাবনা আছে? অথবা আমাদের কি কোন কথা চলতে পারে এবং মেনে নেওয়া যেতে পারে?
[৫] তোমাদের কিংবা শত্রুদের এখতিয়ারে কিছুই নেই। সাহায্য-সহযোগিতা তাঁর পক্ষ থেকেই আসবে, সফলতা তিনিই দান করবেন এবং আদেশ-নিষেধ কেবল তাঁরই চলবে।
[৬] নিজেদের অন্তরে মুনাফিক্বী গোপন রেখে ভাব এমন দেখাত যে, তারা পথ নির্দেশের মুখাপেক্ষী।
[৭] এটা তারা আপোসে বলাবলি করত অথবা মনে মনে বলত।
[৮] মহান আল্লাহ বললেন, এই ধরনের কথার লাভ কি? যেভাবেই হোক না কেন, মৃত্যু তো আসবেই এবং তা সেই স্থানেই আসবে, যেখানে আল্লাহর পক্ষ হতে লিখে দেওয়া হয়েছে। যদি তোমরা নিজেদের বাড়িতে অবস্থান কর, আর তোমাদের মৃত্যু কোন যুদ্ধের ময়দানে লিখা থাকে, তাহলে আল্লাহ কর্তৃক এই ফায়সালা তোমাদেরকে সেখানেই টেনে নিয়ে যাবে।
[৯] (যুদ্ধের ময়দানে) যা কিছু ঘটেছে তার পিছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল, তোমাদের অন্তরে বিদ্যমান ঈমানকে পরীক্ষা করা (যাতে মুনাফিকরা তোমাদের থেকে পৃথক হয়ে যায়) এবং তোমাদের অন্তঃকরণকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে পবিত্র করা।
[১০] অর্থাৎ, খাঁটি মুসলিম কে এবং মুনাফিক হয়ে বাহ্যিকভাবে ইসলামের পোশাক কে পরে আছে, তা তো তিনি জানেন। জিহাদের বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে এটাও একটি কৌশল যে, এতে মু’মিন ও মুনাফিকের প্রকৃত রূপ বিকশিত হয়ে সামনে চলে আসে; ফলে সাধারণ মানুষও তাদেরকে দেখে ও চিনে নিতে পারে।
[১১] অর্থাৎ, উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের দ্বারা যে ভুল-ত্রুটি ঘটেছিল, তার কারণ ছিল তাঁদের পূর্বের কিছু দুর্বলতা। এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে শয়তান এই দিন তাদের পদস্খলন ঘটাতে সফলকাম হয়েছিল। যেমন কোন কোন সলফের উক্তি হল, ‘নেকীর প্রতিদান এটাও যে, তারপর আরো নেকী করার তাওফীক লাভ হয় এবং পাপের প্রতিফল এটাও যে, তারপর আরো পাপের পথ খুলে যায় এবং সুগম হয়।’
[১২] আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের ভুল-ত্রুটি এবং তার পরিণাম ও কৌশলগত দিক উল্লেখ করে নিজের পক্ষ হতে তাঁদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করছেন। এ থেকে প্রথমতঃ প্রমাণ হয় যে, তাঁরা আল্লাহর অতিশয় প্রিয় ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ সাধারণ মু’মিনদের সতর্ক করা হচ্ছে যে, সত্যবাদী সেই মু’মিনদেরকে যখন স্বয়ং আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন, তখন আর কারো জন্য এটা জায়েয নয় যে, সে তাঁদেরকে তিরস্কার করবে অথবা তাঁদের ব্যাপারে কোন অন্যায় মন্তব্য বা কটূক্তি করবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
অত্র আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা উহুদের ময়দানে মুসলিম মুজাহিদদের ওপর যে অনুগ্রহ করেছিলেন তার দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন।
মুসলিম মুজাহিদদের চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির পর আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর তন্দ্রাভাব সৃষ্টি করে দিলেন। এ তন্দ্রা ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রশান্তি এবং সাহায্য। আবূ তালহা (রাঃ) বলেন, আমিও তাদের মধ্যে একজন যাদের ওপর উহুদের দিন তন্দ্রা ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি আমার তরবারী কয়েকবার আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আর আমি তা ধরে রেখেছিলাম। (সহীহ বুখারী হা: ৪০৬৮)
(وَطَا۬ئِفَةٌ أخري)
‘অন্য আরেকটি দল’, এর দ্বারা মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, কঠিন পরিস্থিতিতে তারা কেবল নিজেদের প্রাণ নিয়েই চিন্তিত ছিল।
(ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ)
জাহিলী ধারণা, যেমন তারা ধারণা করত যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে দীনের প্রতি আহ্বান করেন, তার ভবিষ্যৎ আশঙ্কাজনক। তিনি তো আল্লাহ তা‘আলার সহযোগিতা থেকেই বঞ্চিত ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে।
জুবাইর (রাঃ) বলেন, যখন আমাদের কঠিন ভয় ছিল তখনও আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ওপর তন্দ্রা দিলেন। এ তন্দ্রার ফলে আমাদের প্রত্যেকেরই চিবুকগুলো বক্ষের সাথে লেগে যায়।
জুবাইর (রাঃ) বলেন, আমি সে অবস্থায় মুত‘আব বিন কুশাইবের নিম্নের উক্তি শুনতে পাই, যদি আমার সামান্য কিছু অধিকার থাকত তবে এখানে নিহত হতাম না। তখন এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:
(لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَّا قُتِلْنَا هٰهُنَا)
আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে দিলেন: বলে দাও! যদি তোমরা বাড়িতে অবস্থান কর আর যদি তোমাদের ভাগ্যে মৃত্যু অবধারিত থাকে তাহলে সেখানেই মৃত্যু পৌঁছবে।
(إِنَّ الَّذِيْنَ تَوَلَّوْا مِنْكُمْ يَوْمَ الْتَقَي الْجَمْعٰنِ)
“নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যারা দুদলের সম্মুখীন হবার দিন পশ্চাদবর্তিত হয়েছিল” দুদলের সম্মুখীন হবার দিন বলতে বদরের দিনকে বুঝানো হয়েছে।
উসমান বিন মাওহাব (রহঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: হাজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তি বাইতুল্লাহয় এসে সেখানে একদল লোককে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখে জিজ্ঞাসা করলেন: এ উপবিষ্ট লোকগুলো কারা? তারা বললেন: এরা হচ্ছেন কুরাইশ গোত্রের লোক। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করলেন: এ বৃদ্ধ লোকটি কে? তারা বললেন: ইনি হচ্ছেন ইবনু উমার (রাঃ)। তখন লোকটি তাঁর কাছে গিয়ে বললেন; আমি আপনাকে কিছু কথা জিজ্ঞাসা করব, আপনি আমাকে বলে দেবেন কি? এরপর লোকটি বললেন: আমি আপনাকে এ ঘরের রবের কসম দিয়ে বলছি উহুদের দিন উসমান বিন আফফান (রাঃ) পালিয়েছিলেন- এ কথা আপনি কি জানেন? তিনি বললেন: হ্যাঁ। লোকটি বললেন: তিনি বদরে অনুপস্থিত ছিলেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি- এ কথাও জানেন? তিনি বললেন হ্যাঁ। লোকটি বললেন: তিনি বাইআতে রিদওয়ানে অনুপস্থিত ছিলেন- এ কথা আপনি জানেন? তিনি বললেন: হ্যাঁ। বর্ণনাকারী বলেন: লোকটি তখন আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করল। তখন ইবনু উমার (রাঃ) বললেন: এসো, এখন আমি তোমাকে সব ব্যাপার জানিয়ে দিই এবং তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর বলে দিই। ১. উহুদের দিন তাঁর পালানো সম্বন্ধে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। ২. বদরের দিন অনুপস্থিতির কারণ হলো তাঁর স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যা অসুস্থ ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলেছিলেন: যারা বদরের যুদ্ধে উপস্থিত হয়েছে তাদের মত একজনের প্রতিদান ও গনীমত তুমিও পাবে। ৩. বাইয়াতে রিদওয়ানে অনুপস্থিতির কারণ হলো রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমানকে মক্কাবাসীর কাছে প্রেরণ করেছিলেন, যদি মক্কাবাসীর সাথে উসমানের চেয়ে কারো বেশি সম্পর্ক থাকত তাহলে তাকেই পাঠাতেন। বাইয়াতে রিদওয়ান হয়েছিলো উসমান (রাঃ) যাওয়ার পর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডান হাত বাম হাতের ওপর রেখে বললেন: এটা উসমানের হাত। ইবনু উমার (রাঃ) বললেন: এখন তুমি যেতে পার। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৬০)
সুতরাং বদরের যুদ্ধে পলায়নকারীদের মধ্যে উসমান (রাঃ) ছিলেন না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে শত্র“দের ওপর সর্বদা বিজয় দান করেন।
২. আল্লাহ তা‘আলা তার শত্র“দের অপমানিত করেন পরাজয়ের মাধ্যমে।
৩. তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখা আবশ্যক।
৪. আল্লাহ তা‘আলার প্রতিটি কাজ হিকমাতপূর্ণ।
৫. উসমান (রাঃ) এর ব্যাপারে কারো কোন খারাপ ধারণা রাখার সুযোগ নেই।