Book# 114/C/58

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/C/58) www.motaher21.net

بِغٰفِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ

” সে সম্বন্ধে বে-খেয়াল নন।”

” Unaware of what you do.”

সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-৭৪

ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعْدِ ذٰلِكَ فَهِىَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ۚ وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهٰرُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَآءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغٰفِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ

এরপরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেলো, তা পাথর কিংবা তদপেক্ষা কঠিন। কতক পাথরও এমন আছে যে তা থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয় এবং কতক এরূপ যে, ফেটে যাওয়ার পর তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার কতক এমন যা মহান আল্লাহ্‌র ভয়ে ধ্বসে পড়ে এবং তোমরা যা করো মহান আল্লাহ সে সম্বন্ধে বে-খেয়াল নন।

৭৪ নং আয়াতের তাফসীর:

ইয়াহুদীদের কঠোরতা

মহান আল্লাহ্‌র এতো নিদর্শন তথা মৃতকে জীবিত করার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা সত্তেও বানী ইসরাঈলের লোকেরা যখন ঈমান আনলো না তাই অত্র আয়াতে বানী ইসরাঈলকে ধমক দিয়ে বলা হচ্ছে যে, ‘এরপরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেলো, তা পাথর কিংবা তদপেক্ষা কঠিন।’ অর্থাৎ বানী ইসরাঈলকে বলা হচ্ছে যে, এতো বড় বড় মু‘জিযাহ এবং মহান আল্লাহ্‌র ব্যাপক ক্ষমতার নিদর্শনাবলী দেখার পরও কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি তাদের অন্তর পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো? এ জন্যই মু’মিনগণকে এরকম শক্তমনা হতে নিষেধ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছেঃ

﴿اَلَمْ یَاْنِ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللّٰهِ وَ مَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ١ۙ وَ لَا یَكُوْنُوْا كَالَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَیْهِمُ الْاَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ١ؕ وَ كَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ﴾

‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি মহান আল্লাহ্‌র স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? আর পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদের মতো যেন তারা না হয়, বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তাদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী। (৫৭ নং সূরা হাদীদ, আয়াত নং ১৬)

আল-আউফী (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বর্ণনা করেছেন যে, ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ মৃত ব্যক্তিটিকে গাভীর গোস্তের টুকরা দ্বারা আঘাত করা হলে সে উঠে দাঁড়িয়ে যায় এবং জীবিত অবস্থায় সে যতোখানি সুস্থ-সবল ছিলো তার চেয়েও তাকে সতেজ মনে হয়েছিলো। তাকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ তোমাকে কে হত্যা করেছিলো? সে উত্তরে বললোঃ আমার ভাইয়ের ছেলে আমাকে হত্যা করেছে। এরপর সে আবার মারা যায়। লোকটি আবার মারা যাওয়ার পর তার ভাইয়ের ছেলে বললোঃ মহান আল্লাহ্‌র শপথ! আমি তাকে হত্যা করিনি। এভাবে সে সত্যকে অস্বীকার করলো, যদিও সবাই এ কথা জেনে গেছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ

﴿ثُمَّ قَسَتْ قُلُوْبُكُمْ مِّنْۢ بَعْدِ ذٰلِكَ فَهِیَ كَالْحِجَارَةِ اَوْ اَشَدُّ قَسْوَةً﴾

‘এরপরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেলো, তা পাথর কিংবা তদপেক্ষা কঠিন। (তাফসীর তাবারী ২/২৩৪)

কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বানী ইসরাঈলের অন্তর পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। কেননা পাথর হতেও তো ঝরণা প্রবাহিত হয়। কোন কোন পাথর ফেটে যায় এবং তা হতে পানি বের হয়, যদিও তা প্রবাহিত হওয়ার যোগ্য নয়। কোন কোন পাথর মহান আল্লাহ্‌র ভয়ে ওপর হতে নীচে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ঐ লোকদের অন্তর নসীহত বা উপদেশে কখনো নরম হয় না। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রহঃ) বলেন, ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ আয়াতের ভাবার্থ হলো এমন কিছু পাথর রয়েছে যা তোমাদের হৃদয়ের চেয়ে কোমল। তারা সত্যকে স্বীকার করে, যে সত্যের প্রতি তোমাদেরকে আহ্বান করা হয়েছে। (তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/২৩৩)

কঠিন বস্তু বা পাথরের মধ্যেও বোধশক্তি আছে

কোন কোন মুফাস্সির মনে করেন যে, রূপক অর্থে পাথরের সাথে সাদৃশ্য দেয়া হয়েছে। ওপরের বর্ণনা থেকে এটাও জানা যায় যে, পাথরের মধ্যে জ্ঞান-বিবেক আছে। কুর’আন মাজীদের অন্য স্থানে আছেঃ ‘সাত আসমান ও যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থলে যা কিছু আছে সবাই মহান আল্লাহ্‌র তাসবীহ্ পাঠ করে ও প্রশংসা করে। যেমন তিনি বলেনঃ

﴿اِنَّا عَرَضْنَا الْاَمَانَةَ عَلَى السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ وَ الْجِبَالِ فَاَبَیْنَ اَنْ یَّحْمِلْنَهَا وَ اَشْفَقْنَ مِنْهَا﴾

আমি তো আসমান, যমীন ও পবর্তমালার প্রতি এই আমানত অর্পণ করেছিলাম, তারা এটা বহন করতে অস্বীকার করলো এবং এতে শংকিত হলো। (৩৩ নং সূরা আহযাব, আয়াত নং ৭২)

﴿تُسَبِّحُ لَهُ السَّمٰوٰتُ السَّبْعُ وَ الْاَرْضُ وَ مَنْ فِیْهِنَّ﴾

সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং এদের অর্ন্তবর্তী সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। (১৭ নং সূরা ইসরাহ, আয়াত নং ৪৪) ওপরের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, সমস্ত জিনিস মহান আল্লাহ্‌র তাসবীহ্ বর্ণনা করে। অন্যস্থানে মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَّ النَّجْمُ وَ الشَّجَرُ یَسْجُدٰنِ﴾

তারকা ও বৃক্ষ উভয়ে মহান আল্লাহকে সিজদা করে। (৫৫ নং সূরা আর রাহমান, আয়াত নং ৬)

﴿اَوَ لَمْ یَرَوْا اِلٰى مَا خَلَقَ اللّٰهُ مِنْ شَیْءٍ یَّتَفَیَّؤُا ظِلٰلُهٗ﴾

তারা কি লক্ষ্য করে না মহান আল্লাহ্‌র সৃষ্ট বস্তুর প্রতি, যার ছায়া ডানে ও বামে ঢলে পড়ে মহান আল্লাহ্‌র প্রতি সিজদাবনত হয়ে? (১৬ নং সূরা নাহল, আয়াত নং ৪৮) অন্যত্র আছেঃ
﴿قَالَتَاۤ اَتَیْنَا طَآىِٕعِیْنَ﴾

তারা (যমীন ও আসমান) বললোঃ আমরা এলাম অনুগত হয়ে। (৪১ নং সূরা হা-মীম সাজদাহ, আয়াত নং ২১) অপর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿لَوْ اَنْزَلْنَا هٰذَا الْقُرْاٰنَ عَلٰى جَبَلٍ﴾

আমি যদি এই কুর’আন পর্বতের ওপর অবতীর্ণ করতাম। (৫৯ নং সূরা হাশর, আয়াত নং ২১) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরো বলেনঃ ﴿وَ قَالُوْا لِجُلُوْدِهِمْ لِمَ شَهِدْتُّمْ عَلَیْنَا١ؕ قَالُوْۤا اَنْطَقَنَا اللّٰهُ﴾

(জাহান্নামীরা) তাদের ত্বককে জিজ্ঞেস করবেঃ তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছো কেন? উত্তরে তারা বলবেঃ মহান আল্লাহ আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। (৪১ নং সূরা হা-মীম সাজদাহ, আয়াত নং ২১) একটি বিশুদ্ধ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উহুদ পাহাড় সম্পর্কে বলেনঃ إن هذا الجبل يحبنا ونحبه এ পাহাড়টি আমাদেরকে ভালোবাসে এবং আমরাও একে ভালোবাসি। (সহীহুল বুখারী ৭/৪৪২২, সহীহ মুসলিম ২/৫০৩/১০১১, ফাতহুল বারী ৬/৯৮) আর একটি হাদীসে আছে যে, যে খেজুর গাছের কাণ্ডের ওপর হেলান দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুৎবা দিতেন, যখন মিম্বার তৈরী করা হয় এবং কাণ্ডটিকে সরিয়ে ফেলা হয় তখন কাণ্ডটি অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে। (সহীহুল বুখারী ৬/৩৫৮৩, জামি‘ তিরমিযী- ২/৫০৫, সুনান নাসাঈ- ৩/১৩৯৫, সুনান ইবনে মাজাহ ১/১৪১৫, মুসনাদে আহমাদ ৫/৮৯, ৯৫, ১০৫) সহীহ মুসলিমে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

“إني لأعرف حجرًا بمكة كان يسلم علي قبل أن أبعث إني لأعرفه الآن”

‘আমি মাক্কার সেই পাথরটি এখনও চিনতে পারি যা আমাকে নবীরূপে প্রেরণের পূর্বে সালাম দিতো।’ পাথরটির আরো কিছু বিবরণ দিয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

أنه يشهد لمن استلمه بحق يوم القيامة

‘যে একে সত্যের সাথে চুম্বন করবে, কিয়ামতের দিন এটা তার ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ ১/২৬৬) এ ধরনের বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে যাদ্বারা এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এসব জিনিসের মধ্যে বিবেক ও অনুভূতি আছে এবং এগুলো প্রকৃত অর্থেই আছে, রূপক অর্থে নয়।

أَوْ শব্দটি সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এবং ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন যে, এটা ইচ্ছার স্বাধীনতার জন্য এসেছে। কারো কারো মতে এটার ভাবার্থ এই যে, কতক অন্তর পাথরের মতো শক্ত এবং কতক অন্তর তার চেয়েও বেশি শক্ত। মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَ لَا تُطِعْ مِنْهُمْ اٰثِمًا اَوْ كَفُوْرًا﴾

কোন পাপী অথবা কাফেরের আনুগত্য করো না। (৭৬ নং সূরা ইনসান/দাহর, আয়াত নং ২৪)
﴿عُذْرًا اَوْ نُذْرًا﴾

অনুশোচনা স্বরূপ অথবা সতর্কতা স্বরূপ। (৭৭ নং সূরা মুরসালাত, আয়াত নং ৬) অন্যান্য জ্ঞানীগণ বলেন যে, এখানে ‘অথবা’ শব্দটি ‘বরং’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অতএব এখানে অর্থ হবে, তোমাদের হৃদয় পাথরের মতো শক্ত, বরং এর চেয়েও শক্ত। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

﴿اِذَا فَرِیْقٌ مِّنْهُمْ یَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْیَةِ اللّٰهِ اَوْ اَشَدَّ خَشْیَةً﴾

‘তাদের একদল মহান আল্লাহকে যেরূপ ভয় করে তদ্রুপ মানুষকে ভয় করে, বরং তদপেক্ষাও অধিক। (৪ নং সূরা নিসা, আয়াত নং ৭৭)

﴿وَ اَرْسَلْنٰهُ اِلٰى مِائَةِ اَلْفٍ اَوْ یَزِیْدُوْنَ﴾

‘তাকে আমি লক্ষ বা লক্ষাধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম। (৩৭ নং সূরা সাফফাত, আয়াত নং ১৪৭)

﴿فَكَانَ قَابَ قَوْسَیْنِ اَوْ اَدْنٰى﴾

ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো, অথবা তারও কম। (৫৩ নং সূরা নাজম, আয়াত নং ৯)। কারো কারো মতে এর ভাবার্থ এই যে, তাদের হৃদয় পাথরের মতো কিংবা কঠোরতায় তার চেয়েও বেশি। (তাফসীর তাবারী ২/২৩৬) এটা নিম্নের আয়াতেরও অনুরূপঃ

﴿مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِی اسْتَوْقَدَ نَارًا﴾

এদের অবস্থা ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে অগ্নি প্রজ্জলিত করলো। (২ নং সূরা বাকারাহ, আয়াত নং ১৭)

﴿اَوْ كَصَیِّبٍ مِّنَ السَّمَآءِ﴾

অথবা আকাশ হতে ভারী বর্ষণের ন্যায়। (২ নং সূরা বাকারাহ, আয়াত নং ১৯) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ ﴿وَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْۤا اَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍۭ بِقِیْعَةٍ﴾

‘যারা কুফরী করে, তাদের ‘আমলসমূহ মরুভূমির মরীচিকা সাদৃশ্য। (২৪ নং সূরা নূর, আয়াত নং ৩৯) এর পরের আয়াতেও অনুরূপ বলা হয়েছেঃ ﴿اَوْ كَظُلُمٰتٍ فِیْ بَحْرٍ لُّجِّیٍّ﴾

অথবা (কাফেরদের কাজ) প্রমত্ত সমুদ্রের বুকে গভীর অন্ধকারের ন্যায়। (২৪ নং সূরা নূর, আয়াত নং ৪০)

তাফসীর ইবনে মিরদুওয়াই এর মধ্যে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

“لا تكثروا الكلام بغير ذكر الله، فإن كثرة الكلام بغير ذكر الله قسوة القلب، وإن أبعد الناس من الله القلب القاسي”.

মহান আল্লাহ্‌র যিকির ছাড়া বেশি কথা বলো না। এরকম বেশি কথা অন্তরকে শক্ত করে দেয়। আর শক্ত অন্তর বিশিষ্ট ব্যক্তি মহান আল্লাহ্‌র নিকট হতে বহু দূরে থাকে। (হাদীসটি য‘ঈফ। জামি‘ তিরমিযী- ৪/২৪১১, ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, হাদীসটি হাসান, গরীব। সুনান বায়হাকী- ৪/৪৯৫১, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক (রহঃ), ২/৮/৯৮৬। সিলসিলাহ আহাদীসিস যাঈফ) ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং এর একটি পন্থাকে গরীব বলেছেন।

মুসনাদ- ই- বাযযারের মধ্যে আনাস (রাঃ) হতে মারফূ‘ রূপে বর্ণিত আছে যেঃ

“أربع من الشقاء: جمود العين، وقسي القلب، وطول الأمل، والحرص على الدنيا”

চারটি জিনিস দুর্ভাগ্যের অন্তর্ভুক্ত তা হলো (১) মহান আল্লাহ্‌র ভয়ে চক্ষু দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত না হওয়া। (২) অন্তর শক্ত হয়ে যাওয়া। (৩) আশা বৃদ্ধি পাওয়া। (৪) লোভী হয়ে যাওয়া।

বানী ইসরাঈলরা আল্লাহ তা‘আলার এতসব নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার পরেও যখন আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি করল ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হল তখন তিনি তাদেরকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে এ কথা বললেন। তাদের অন্তর কঠিন হবার কারণ এখানে বর্ণিত না হলেও আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বর্ণনা করে বলেন:

(فَبِمَا نَقْضِھِمْ مِّیْثَاقَھُمْ لَعَنّٰھُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوْبَھُمْ قٰسِیَةًﺆ یُحَرِّفُوْنَ الْکَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِھ۪ﺫ وَنَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُکِّرُوْا بِھ۪ﺆ وَلَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلٰی خَا۬ئِنَةٍ مِّنْھُمْ اِلَّا قَلِیْلًا مِّنْھُمْ فَاعْفُ عَنْھُمْ وَاصْفَحْﺚ اِنَّ اللہَ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَﭜ)

“তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য আমি তাদেরকে লা‘নত করেছি ও তাদের হৃদয়কে কঠিন করে দিয়েছি; তারা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করেছে এবং তারা যা আদিষ্ট হয়েছিল তার এক অংশ ভুলে গিয়েছে। তুমি সর্বদা তাদের অল্পসংখ্যক ব্যতীত সকলকেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেখতে পাবে, সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা কর ও উপেক্ষা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ কর্মপরায়ণদেরকে ভালবাসেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১৩)

এ ঘটনা তুলে ধরার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে এরূপ কঠোর হৃদয়ের মানুষ হতে নিষেধ করেছেন।

অন্তরকে পাথরের চেয়ে কঠিন বলার কারণ হল, অনেক পাথর রয়েছে যা থেকে ঝর্ণা প্রবাহিত হয়। আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে তারা কাঁদে এমনকি আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহও তারা পাঠ করে। কিন্তু অন্তর যখন কঠিন হয় তখন আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে চক্ষু থেকে পানি ঝরে না, আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহও পাঠ করে না বরং আল্লাহ বিমুখ হয়ে যায়। অত্র আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, পাথর আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে, শুধু তাই নয় বরং আসমান ও জমিনের মাঝে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(تُسَبِّحُ لَھُ السَّمٰوٰتُ السَّبْعُ وَالْاَرْضُ وَمَنْ فِیْھِنَّﺚ وَاِنْ مِّنْ شَیْءٍ اِلَّا یُسَبِّحُ بِحَمْدِھ۪ وَلٰکِنْ لَّا تَفْقَھُوْنَ تَسْبِیْحَھُمْﺚ اِنَّھ۫ کَانَ حَلِیْمًا غَفُوْرًا)

“সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না; নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৪৪)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

إِنِّى لأَعْرِفُ حَجَرًا بِمَكَّةَ كَانَ يُسَلِّمُ عَلَىَّ قَبْلَ أَنْ أُبْعَثَ إِنِّى لأَعْرِفُهُ الآنَ

আমি মক্কার ঐ পাথরকে চিনি, যে আমার নবুওয়াতের পূর্বে আমাকে সালাম দিত। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৭৭, তিরমিযী হা: ৩৬২৪) উহুদ পাহাড় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

هَذَا جَبَلٌ يُحِبُّنَا وَنُحِبُّهُ

এ পাহাড়টি আমাদেরকে ভালবাসে এবং আমরাও তাকে ভালবাসি। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪২)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলাকে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করার কারণে বানী ইসরাঈলের অন্তর কঠিন করে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের ওপর লা‘নত করা হয়েছিল। আমাদেরকে তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
২. মু’মিনদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল তারা কোমল হৃদয়ের অধিকারী।
৩. আসমান ও জমিনের মাঝে যা কিছু আছে সব আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে।

৭৫ নং আয়াতে

اَفَتَطْمَعُوْنَ اَنْ یُّؤْمِنُوْا لَكُمْ وَ قَدْ كَانَ فَرِیْقٌ مِّنْهُمْ یَسْمَعُوْنَ كَلٰمَ اللّٰهِ ثُمَّ یُحَرِّفُوْنَهٗ مِنْۢ بَعْدِ مَا عَقَلُوْهُ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ

হে মুসলমানরা! তোমরা কি তাদের থেকে আশা করো তারা তোমাদের দাওয়াতের ওপর ঈমান আনবে?অথচ তাদের একটি দলের চিরাচরিত রীতি এই চলে আসছে যে, আল্লাহর কালাম শুনার পর খুব ভালো করে জেনে বুঝে সজ্ঞানে তার মধ্যে ‘তাহরীফ’ বা বিকৃতি সাধন করেছে।

৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে আল্লাহ্‌র বাণী অর্থ তাওরাত। ‘শ্রবণ করা অর্থ নবীদের মাধ্যমে শ্রবণ করা। ‘পরিবর্তন করা’ অর্থ কোন কোন বাক্য অথবা তার অর্থ অথবা উভয়টিকে বিকৃত করে ফেলা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমলে যেসব ইয়াহুদী ছিল, তাদের দ্বারা উল্লেখিত কোন কুকর্ম যদি সংঘটিত নাও হয়ে থাকে, তবুও পূর্ববতীদের এসব দুস্কর্মকে তারা অপছন্দ ও ঘৃণা করতো না। এ কারণে তারাও কার্যতঃ পূর্ববর্তীদেরই মত। কিন্তু কারা এবং কিভাবে তাদের কিতাবকে বিকৃত করত, তা এখানে বলা হয়নি। মুফাসসিরগণের মধ্যে মুজাহিদ বলেন, এ বিকৃত করা ও গোপন করার কাজটি তাদের আলেম সমাজই করত। আবুল আলীয়াহ বলেন, তারা তাদের কিতাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সমস্ত গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোকে স্থানচ্যুত করে বিকৃত করত। আত-তাফসীরুস সহীহ কাতাদাহ বলেন, আয়াতে বর্ণিত লোকগুলো হচ্ছে, ইয়াহুদরা। তারা আল্লাহ্‌র বাণী শুনত; তারপর সেগুলো বুঝে-শুনে বিকৃত করত। তারা আল্লাহ্‌র বিধানেও পরিবর্তন সাধন করত, হাদীসে এসেছে, ইয়াহুদীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বলল যে, তাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী ব্যভিচার করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমরা তাওরাতে “রাজম” বা প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে কি কিছু পাও? তারা বলল, আমরা তদেরকে শাস্তি হিসেবে তাদেরকে লজ্জিত করি এবং বেত্ৰাঘাত করা হবে। অর্থাৎ তারা ‘রাজম’ অস্বীকার করল। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বললেন, তোমরা মিথ্যা বলছ। তাওরাতে ‘রাজম’ এর কথা আছে। তখন তারা তাওরাত নিয়ে আসল এবং সেটা মেলে ধরল। তখন তাদের একজন রাজম’ এর আয়াতের উপর হাত রেখে এর আগে এবং পরের অংশ পড়ল। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বললেন, তুমি তোমার হাত উঠাও। সে তার হাত উঠালে দেখা গেল যে, সেখানে ‘রাজম’ এর আয়াত রয়েছে। তখন তারা বলল, মুহাম্মদ সত্য বলেছে। এতে ‘রাজম’ এর আয়াত রয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে রজম করার নির্দেশ দিলেন, অতঃপর রজম করা হলো। আব্দুল্লাহ বলেন, আমি দেখতে পেলাম যে লোকটি মহিলার উপর বাঁকা হয়ে তাকে পাথরের আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল। [বুখারী ৩৬৩৫]

এখানে মদীনার নওমুসলিমদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। তারা নিকটবর্তী কালে শেষ নবীর ওপর ঈমান এনেছিল। ইতিপূর্বে নবুওয়াত, শরীয়াত, কিতাব, ফেরেশতা, আখেরাত ইত্যাদি শব্দগুলো তাদের কানে পৌঁছে ছিল। এসব তারা শুনেছিল তাদের প্রতিবেশী ইহুদিদের কাছ থেকে। তারা ইহুদিদের মুখ থেকে আরো শুনেছিল যে, দুনিয়ায় আরো একজন নবী আসবেন। যারা তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে সারা দুনিয়ায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এই জানার ভিত্তিতে মদীনাবাসীরা নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের চর্চা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এখন তারা আশা করছিল, যারা আগে থেকে নবী ও আসমানী কিতাবের অনুসারী এবং যাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত খবরের বদৌলতে তারা ঈমানের মহামূল্যবান সম্পদের অধিকারী হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই তাদের সহযোগী হবে। বরং এ পথে তারা অগ্রগামী হবে। এই বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে মদীনার উদ্যোগী নওমুসলিমরা তাদের ইহুদি বন্ধু ও প্রতিবেশীদের কাছে যেতো এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতো। তারা এ দাওয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে মুনাফিক ও ইসলাম বিরোধীরা এ সুযোগ গ্রহণ করতো। তারা এ থেকে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করতো যে, ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক ও সংশয়পূর্ণ মনে হচ্ছে, নইলে মুহাম্মাদ ﷺ যদি সত্যিই নবী হতেন তাহলে ‘আহলি কিতাব’দের উলামা, মাশায়েখ ও পবিত্র বুযর্গগণ কি জেনে বুজে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানাতো এবং তারা কি অনর্থক এভাবে নিজেদের পরকাল নষ্ট করতো? তাই বনী ইসরাইলদের অতীত ইতিহাস বর্ণনা করার পর এবার সরল প্রাণ মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, অতীতে যারা এ ধরনের কীর্তিকলাপ করেছে তাদের ব্যাপারে তোমরা বেশী কিছু আশা করো না। অন্যথায় তোমাদের দাওয়াত তাদের পাষাণ অন্তরে ধাক্কা খেয়ে যখন ফিরে আসবে তখন তোমাদের মন ভেঙে পড়বে। এই ইহুদিরা শত শত বছর থেকে বিকৃত হয়ে আছে। আল্লাহর যে সমস্ত আয়াত শুনে তোমাদের দিল কেঁপে ওঠে সেগুলোকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে করতে তাদের কয়েক পুরুষ কেটে গেছে। আল্লাহর সত্য দ্বীনকে তারা নিজেদের ইচ্ছা ও চাহিদা মোতাবিক বিকৃত করেছে। এই বিকৃত দ্বীনের মাধ্যমেই তারা পরকালীন নাজাত লাভের প্রত্যাশী। সত্যের আওয়াজ বুলন্দ হবার সাথে সাথেই তারা সেদিকে দৌঁড়ে যাবে, তাদের সম্পর্কে এ ধারণা রাখা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

“একটি দল” বলতে তাদের উলামা ও শরীয়াতধারীদেরকে বুঝানো হয়েছে। এখানে তাওরাত, যাবুর ও অন্যান্য কিতাব, যেগুলো তারা নিজেদের নবীদের মাধ্যমে লাভ করেছিল, সেগুলোকেই বলা হয়েছে “আল্লাহর কালাম।” ‘তাহরীফ’ অর্থ হচ্ছে কোন কথাকে তার আসল অর্থ ও তাৎপর্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের ইচ্ছে মতো এমন কোন অর্থে ব্যবহার করা যা বক্তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপন্থী। তাছাড়া শব্দের মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করাকেও তাহরীফ বলে। বনী ইসরাঈলী আলেমগণ আল্লাহর কালামের মধ্যে এই দু’ধরনের তাহরীফ বা বিকৃতি সাধন করেছিল।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর জীবদ্দশায় ইয়াহুদীদের ঈমান ছিলো না

এই পথভ্রষ্ট ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের ঈমানের ব্যাপারে মহান আল্লাহ তাঁর মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ও সাহাবীগণ (রাঃ)-কে নিরাশ করে দিচ্ছেন যে, এসব লোক যখন এতো বড় বড় নিদর্শন দেখেও তাদের অন্তরকে শক্ত করে ফেলেছে এবং মহান আল্লাহ্‌র কালাম শুনে বুঝার পরেও ওকে পরিবর্তন করে ফেলেছে তখন তোমরা তাদের কাছে আর কিসের আশা করতে পারো? ঠিক এরকমই আয়াত অন্য জায়গায় আছেঃ

﴿فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِّیْثَاقَهُمْ لَعَنّٰهُمْ وَ جَعَلْنَا قُلُوْبَهُمْ قٰسِیَةً١ۚ یُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهٖ﴾

বস্তুত শুধু তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দরুণই আমি তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ হতে দূর করে দিলাম এবং অন্তরকে কঠোর করে দিয়েছি। তারা কালামকে অর্থাৎ তাওরাত এর স্থানসমূহ হতে পরিবর্তন করে দেয়। (৫ নং সূরা মায়িদাহ, আয়াত নং ১৩) ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে এখানে আল্লাহ তা‘আলা তার কালামকে শুনার কথা বলেছেন। এর দ্বারা মূসা (আঃ) এর ঐ সহচরদের বুঝনো হয়েছে, যারা মহান আল্লাহ্‌র কালাম নিজ কানে শোনার জন্য তার নিকট আবেদন করেছিলো। আর তারা পাক- সাফ হওয়ার পর সাওম রেখে মূসা (আঃ) এর সাথে তূর পাহাড়ে গিয়ে সিজদায় লুটে পড়লে মহান আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় কালাম শুনিয়েছিলেন। কিন্তু তারা ফিরে আসার পর মূসা (আঃ) যখন মহান আল্লাহ্‌র কালাম বানী ইসরাইলের মধ্যে বর্ণনা করতে আরম্ভ করেন, তখন তারা তা পরিবর্তন করতে শুরু করে। সুদ্দী (রহঃ)-এর অভিমত হলো তারা তাওরাতের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করেছিলো। সুদ্দী (রহঃ) এই অর্থটিই ইবনে ‘আব্বাস ও ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অপেক্ষা সাধারণ, যার মধ্যে তারাও শামিল হয়ে যাবে এবং এই বদ স্বভাবে অন্যান্য ইয়াহুদীরাও জড়িত থাকবে। যদিও ইবনে জারীর বাহ্যিক দিককেই পছন্দ করেছেন। কিন্তু এটা আবশ্যক নয় যে সরাসরি মহান আল্লাহ্‌র মুখ থেকেই তা শুনতে হবে। যেমনটি মূসা ইবনে ‘ইমরান (আঃ) সরাসরি মহান আল্লাহ্‌র কথা শুনেছেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَاِنْ اَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِیْنَ اسْتَجَارَكَ فَاَجِرْهُ حَتّٰى یَسْمَعَ كَلٰمَ اللّٰهِ﴾

‘মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দাও যাতে সে মহান আল্লাহ্‌র বাণী শোনার সুযোগ পায়।’ (৯ নং সূরা আত তাওবাহ, আয়াত ৬) এখানে যেমন মহান আল্লাহ্‌র কালাম নিজের কানে শুনা নয়, তেমনি এখানে মহান আল্লাহ্‌র কালাম অর্থ তাওরাত।

ثُمَّ یُحَرِّفُوْنَه مِنْۢ بَعْدِ مَا عَقَلُوْهُ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ আয়াতের তাফসীরে কাতাদাহ (রহঃ) বলেনঃ এই পরিবর্তন কারীরা হলো ইয়াহূদী সম্প্রদায়, যারা মহান আল্লাহ্‌র আদেশ শোনার পর জেনে শুনে তা পরিবর্তন করতো অথবা নতুন কিছু যোগ করতো। (তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/২৩৬) আর মুজাহিদ (রহঃ) বলেনঃ তারা তাদের গ্রন্থে পরিবর্তন করতো এবং কিছু কিছু গোপন রাখতো, এরা ছিলো তাদের ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী পণ্ডিতবর্গ। (তাফসীর তাবারী ২/২৪৫) ইবনে ওয়াহাব (রহঃ) বলেন যে, ইবনে যায়েদ (রহঃ) মন্তব্য করেছেনঃ ‘তারা মহান আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাতের পরিবর্তন করেছে যেমন হালালকে হারাম সাব্যস্ত করেছে এবং হারামকে হালাল করেছে এবং সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করেছে। যখন কোন ব্যক্তি সঠিক মীমাংসার জন্য ঘুষসহ আগমন করতো তখন তারা মহান আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করতো। কিন্তু যখন কোন ব্যক্তি অন্যায় দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে আসতো তখন তারা মহান আল্লাহ্‌র কিতাবকে বাদ দিয়ে বানোয়াট কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে ফাতাওয়া দিতো যে, সে সঠিক কাজই করেছে। যখন এমন কোন ব্যক্তি আসতো যে সত্যের অনুসন্ধানকারী নয় এবং ঘুষও প্রদান করতো না এবং তাকে মহান আল্লাহ্‌র কিতাব থেকে সঠিক কথা বলে সত্য ফাতাওয়া দিতো। এ কারণে মহান আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ তোমরা কি লোকদের সৎ কাজে আদেশ করছো এবং তোমাদের নিজেদের সম্বন্ধে বিস্মৃত হচ্ছো? অথচ তোমরা গ্রন্থ পাঠ করোঃ তাহলে কি তোমরা হৃদয়ঙ্গম করছো না?’ (২ নং সূরা বাকারাহ, আয়াত নং ৪৪। তাফসীর তাবারী ২/২৪৬)

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সত্য নবী জানা সত্ত্বেও ইয়াহুদীরা তাঁর প্রতি ঈমান আনেনি

মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿ وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قَالُوْۤا اٰمَنَّا١ۖۚ وَ اِذَا خَلَا بَعْضُهُمْ اِلٰى بَعْضٍ ﴾ এর ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রহঃ) বলেন যে, ইয়াহুদীরা বিশ্বাস করতো যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান আল্লাহ্‌র রাসূল, কিন্তু তিনি শুধু ‘আরবদের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। (তাফসীর তাবারী ২/২৫০) তারা মুসলিমদের সাথে মিলিত হয়ে বলতোঃ ‘তোমাদের নবী সত্য। তিনি সত্যই মহান আল্লাহ্‌র রাসূল।’ কিন্তু যখন তারা পরস্পরের বসতো তখন একে অপরকে বলতোঃ ‘তোমরা ‘আরববাসীকে এসব বলো না। কেননা এই সে নবী যে নবীর দোহাই দিয়ে তোমরা তাদের ওপর বিজয় কামনা করতে। অর্থাৎ তোমরা যে স্বীকার করছো যে, সে একজন সত্য নবী। আর তোমরা তোমাদের কিতাবেও এমনটি জেনেছো যে, শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনার জন্যে তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। আর এই নবী তাদেরকে সেই সংবাদই দিচ্ছে যার আমরা অপেক্ষা করছিলাম এবং আমাদের কিতাবেও তা পেয়েছি। অতএব এটা জানা সত্তেও তোমরা এই নবীকে অস্বীকার করো। কখনো তাকে নবী হিসেবে স্বীকার করো না। নচেৎ তারা তোমাদেরকেও তাদের ধর্মে টেনে নিবে এবং মহান আল্লাহ্‌র কাছেও তোমাদেরকে লা-জবাব করে দিবে। তোমরাতো মহান আল্লাহ্‌র কাছে এই প্রার্থনা করতে যে, তিনি যেন তোমাদের মাঝে সেই নবীকে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাঁকে তো তোমাদের পরিবর্তে ‘আরবদের মাঝেই প্রেরণ করা হয়েছে। এরই ফলে মহান আল্লাহ নিচের আয়াতটি অবতীর্ণ করে তাদের উত্তর দেনঃ اَوَ لَا یَعْلَمُوْنَ اَنَّ اللّٰهَ یَعْلَمُ مَا یُسِرُّوْنَ وَ مَا یُعْلِنُوْنَ ‘‘এই নির্বোধদের কি এতোটুকুও জ্ঞান নেই যে, মহান আল্লাহ তাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কথাই জানেন?

‘আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনু আসলাম একটি সূত্র উল্লেখ করে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “لا يدخلن علينا قصبة المدينة إلا مؤمن”

‘আমাদের কাছে যেন মু’মিন ছাড়া আর কেউ না আসে।’ (হাফিয ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন, ‘আব্দুর রহমান ইবনে যায়দ ইবনে আসলাম একজন য ‘ঈফ রাবী ‘। আর একটি কারণ হলো এর সনদটি বিচ্ছিন্ন) তখন কাফির ও ইয়াহূদীরা পর¯পর বলাবলি করলো যে, তোমরা মুসলিমদের কাছে গিয়ে বলো যে আমরা ঈমান এনেছি, আবার এখানে যখন আসবে তখন ঐ রূপই থাকবে যেমন পূর্বে ছিলে। সুতরাং ঐ সব লোক সকালে এসে ঈমানের দাবি করতো এবং সন্ধ্যায় গিয়ে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতো। মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ آمِنُوا بِالَّذِي أُنزلَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَجْهَ النَّهَارِ وَاكْفُرُوا آخِرَهُ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘কিতাবীদের একটি দল বলে মু’মিনদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে এর ওপর দিনের এক অংশে ঈমান আনো এবং ওপর অংশে কুফরী করো তা হলে স্বয়ং মু’মিনরাও ফিরে আসবে।’ (৩ নং সূরা আল ‘ইমরান, আয়াত নং ৭২) তারা এই প্রতারণা করার মাধ্যমে মুসলিমদের গোপন তথ্য জেনে নিয়ে তাদের দলের লোকদের নিকট তা সরবরাহ করতো। আর মুসলিমদেরকেও পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা পোষণ করতো। কিন্তু তাদের চতুরতায় কাজ হয়নি। কেননা মহান আল্লাহ তাদের এই গোপন কথা মু’মিনদেরকে জানিয়ে দেন। তারা মুসলিমদের কাছে এসে ইসলাম ও ঈমানের কথা প্রকাশ করলে তাঁরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করতেনঃ ‘তোমাদের কিতাবে কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শুভাগমন ইত্যাদির কথা নেই?’ তারা স্বীকার করতো। তারপর যখন তারা তাদের বড়দের কাছে যেতো তখন ঐ বড়রা তাদেরকে ধমক দিয়ে বলতোঃ أَتُحَدِّثُونَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ‘তোমরা কি নিজেদের কথা মুসলিমদেরকে বলে তোমাদের অস্ত্র তাদেরকে দিয়ে দিতে চাও?’

আবুল ‘আলিয়া (রহঃ) بما فتح الله এর তাফসীরে বলেন তা হলো, ‘তোমাদের কিতাবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গুণ সম্বলিত যা অবতারিত হয়েছে।’

আর কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, তারা বলতো যে, অচিরেই একজন নবী আগমন করবেন। অতঃপর তারা একজন অন্যজনের সাথে মিলিত হলে বলতো أَتُحَدِّثُونَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ‘তোমরা কি তাদের সাথে এমন বিষয়ে কথোপকথন করছো যা মহান আল্লাহ তোমাদেরকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন?’

মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বানু কুরাইযার ওপর আক্রমণের সময় ইয়াহুদীদের দুর্গের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বলেনঃ

“يا إخوان القردة والخنازير، ويا عبدة الطاغوت”

‘হে বানর, শূকর ও শয়তানের পূজারীদের ভ্রাতৃমণ্ডলী!’ তখন তারা পরস্পর বলাবলি করতে থাকেঃ ‘তিনি আমাদের ভিতরের কথা কি করে জানলেন। খবরদার! তোমাদের পরস্পরের সংবাদ তাদেরকে দিয়ো না, দিলে তা মহান আল্লাহ্‌র সামনে দালীল হয়ে যাবে।’ (হাদীস সহীহ। তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/২৪০। মুসতাদরাক হাকিম ৩/৩৪, ৩৫, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ৪/১১৮) তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘তোমরা গোপন করলেও আমার কাছে কোন কথা গোপন থাকে না।’

পথভ্রষ্ট ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের ঈমানের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও সাহাবীবর্গকে আশা রাখতে নিষেধ করেছেন। এসব লোক যখন বড় বড় নিদর্শন দেখেও অন্তর কঠিন করে ফেলেছে, আল্লাহ তা‘আলার কালাম শুনে বুঝার পরেও পরিবর্তন করে ফেলেছে তখন তাদের কাছে আর ঈমানের আশা করা যায় না। ঠিক এমনটিই আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন:

(فَبِمَا نَقْضِھِمْ مِّیْثَاقَھُمْ لَعَنّٰھُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوْبَھُمْ قٰسِیَةًﺆ یُحَرِّفُوْنَ الْکَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِھ۪ﺫ)

“তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য আমি তাদেরকে লা‘নত করেছি ও তাদের হৃদয় কঠিন করে দিয়েছি; তারা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করে।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১৩)

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের আরেকটি ঘৃণিত আচরণের কথা বলেছেন। তা হল যখন তারা মু’মিনদের সাথে মিলিত হয় তখন তারা ঈমানের কথা বলে আবার যখন ইয়াহূদী-মুনাফিকদের সাথে মিলিত হয় তখন তা অস্বীকার করে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সতর্ক করে বলে দিচ্ছেন, তারা যতই টালবাহানা করুক তারা জানে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা জানেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. হক গ্রহণ ও শ্রবণ করা থেকে ইয়াহূদী সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি দূরে থাকে।
২. সত্য জানার পরেও তা অস্বীকার করা খুবই নিন্দনীয়।
৩. যাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার গযব পতিত হয়েছে তাদের কাছ থেকে ঈমানের আশা না করাই উচিত।

সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-৭৬

وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قَالُوْۤا اٰمَنَّا ۚۖ وَ اِذَا خَلَا بَعْضُهُمْ اِلٰى بَعْضٍ قَالُوْۤا اَتُحَدِّثُوْنَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللّٰهُ عَلَیْكُمْ لِیُحَآجُّوْكُمْ بِهٖ عِنْدَ رَبِّكُمْؕ اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ

(মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহর ওপর) যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে সাক্ষাত হলে বলে, আমরাও তাঁকে মানি। আবার যখন পরস্পরের সাথে নিরিবিলিতে কথা হয় তখন বলে, তোমরা কি বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেলে? এদেরকে তোমরা এমন সব কথা বলে দিচ্ছো যা আল্লাহ‌ তোমাদের কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন, ফলে এরা তোমাদের রবের কাছে তোমাদের মোকাবিলায় তোমাদের একথাকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করবে?

৭৭ নং আয়াতে

أَوَلَا يَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ

তাদের কি জানা নেই যে, যা তারা গোপন রাখে অথবা প্রকাশ করে অবশ্যই মহান আল্লাহ তা জানেন?

৭৬-৭৭ নং আয়াতের তাফসীর:

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর জীবদ্দশায় ইয়াহুদীদের ঈমান ছিলো না

এই পথভ্রষ্ট ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের ঈমানের ব্যাপারে মহান আল্লাহ তাঁর মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ও সাহাবীগণ (রাঃ)-কে নিরাশ করে দিচ্ছেন যে, এসব লোক যখন এতো বড় বড় নিদর্শন দেখেও তাদের অন্তরকে শক্ত করে ফেলেছে এবং মহান আল্লাহ্‌র কালাম শুনে বুঝার পরেও ওকে পরিবর্তন করে ফেলেছে তখন তোমরা তাদের কাছে আর কিসের আশা করতে পারো? ঠিক এরকমই আয়াত অন্য জায়গায় আছেঃ

﴿فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِّیْثَاقَهُمْ لَعَنّٰهُمْ وَ جَعَلْنَا قُلُوْبَهُمْ قٰسِیَةً١ۚ یُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهٖ﴾

বস্তুত শুধু তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দরুণই আমি তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ হতে দূর করে দিলাম এবং অন্তরকে কঠোর করে দিয়েছি। তারা কালামকে অর্থাৎ তাওরাত এর স্থানসমূহ হতে পরিবর্তন করে দেয়। (৫ নং সূরা মায়িদাহ, আয়াত নং ১৩) ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে এখানে আল্লাহ তা‘আলা তার কালামকে শুনার কথা বলেছেন। এর দ্বারা মূসা (আঃ) এর ঐ সহচরদের বুঝনো হয়েছে, যারা মহান আল্লাহ্‌র কালাম নিজ কানে শোনার জন্য তার নিকট আবেদন করেছিলো। আর তারা পাক- সাফ হওয়ার পর সাওম রেখে মূসা (আঃ) এর সাথে তূর পাহাড়ে গিয়ে সিজদায় লুটে পড়লে মহান আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় কালাম শুনিয়েছিলেন। কিন্তু তারা ফিরে আসার পর মূসা (আঃ) যখন মহান আল্লাহ্‌র কালাম বানী ইসরাইলের মধ্যে বর্ণনা করতে আরম্ভ করেন, তখন তারা তা পরিবর্তন করতে শুরু করে। সুদ্দী (রহঃ)-এর অভিমত হলো তারা তাওরাতের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করেছিলো। সুদ্দী (রহঃ) এই অর্থটিই ইবনে ‘আব্বাস ও ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অপেক্ষা সাধারণ, যার মধ্যে তারাও শামিল হয়ে যাবে এবং এই বদ স্বভাবে অন্যান্য ইয়াহুদীরাও জড়িত থাকবে। যদিও ইবনে জারীর বাহ্যিক দিককেই পছন্দ করেছেন। কিন্তু এটা আবশ্যক নয় যে সরাসরি মহান আল্লাহ্‌র মুখ থেকেই তা শুনতে হবে। যেমনটি মূসা ইবনে ‘ইমরান (আঃ) সরাসরি মহান আল্লাহ্‌র কথা শুনেছেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَاِنْ اَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِیْنَ اسْتَجَارَكَ فَاَجِرْهُ حَتّٰى یَسْمَعَ كَلٰمَ اللّٰهِ﴾

‘মুশরিকদের কেউ যদি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে তাকে আশ্রয় দাও যাতে সে মহান আল্লাহ্‌র বাণী শোনার সুযোগ পায়।’ (৯ নং সূরা আত তাওবাহ, আয়াত ৬) এখানে যেমন মহান আল্লাহ্‌র কালাম নিজের কানে শুনা নয়, তেমনি এখানে মহান আল্লাহ্‌র কালাম অর্থ তাওরাত।

ثُمَّ یُحَرِّفُوْنَه مِنْۢ بَعْدِ مَا عَقَلُوْهُ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ আয়াতের তাফসীরে কাতাদাহ (রহঃ) বলেনঃ এই পরিবর্তন কারীরা হলো ইয়াহূদী সম্প্রদায়, যারা মহান আল্লাহ্‌র আদেশ শোনার পর জেনে শুনে তা পরিবর্তন করতো অথবা নতুন কিছু যোগ করতো। (তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/২৩৬) আর মুজাহিদ (রহঃ) বলেনঃ তারা তাদের গ্রন্থে পরিবর্তন করতো এবং কিছু কিছু গোপন রাখতো, এরা ছিলো তাদের ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী পণ্ডিতবর্গ। (তাফসীর তাবারী ২/২৪৫) ইবনে ওয়াহাব (রহঃ) বলেন যে, ইবনে যায়েদ (রহঃ) মন্তব্য করেছেনঃ ‘তারা মহান আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাতের পরিবর্তন করেছে যেমন হালালকে হারাম সাব্যস্ত করেছে এবং হারামকে হালাল করেছে এবং সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করেছে। যখন কোন ব্যক্তি সঠিক মীমাংসার জন্য ঘুষসহ আগমন করতো তখন তারা মহান আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করতো। কিন্তু যখন কোন ব্যক্তি অন্যায় দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে আসতো তখন তারা মহান আল্লাহ্‌র কিতাবকে বাদ দিয়ে বানোয়াট কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে ফাতাওয়া দিতো যে, সে সঠিক কাজই করেছে। যখন এমন কোন ব্যক্তি আসতো যে সত্যের অনুসন্ধানকারী নয় এবং ঘুষও প্রদান করতো না এবং তাকে মহান আল্লাহ্‌র কিতাব থেকে সঠিক কথা বলে সত্য ফাতাওয়া দিতো। এ কারণে মহান আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ তোমরা কি লোকদের সৎ কাজে আদেশ করছো এবং তোমাদের নিজেদের সম্বন্ধে বিস্মৃত হচ্ছো? অথচ তোমরা গ্রন্থ পাঠ করোঃ তাহলে কি তোমরা হৃদয়ঙ্গম করছো না?’ (২ নং সূরা বাকারাহ, আয়াত নং ৪৪। তাফসীর তাবারী ২/২৪৬)

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সত্য নবী জানা সত্ত্বেও ইয়াহুদীরা তাঁর প্রতি ঈমান আনেনি

মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿ وَ اِذَا لَقُوا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قَالُوْۤا اٰمَنَّا١ۖۚ وَ اِذَا خَلَا بَعْضُهُمْ اِلٰى بَعْضٍ ﴾ এর ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রহঃ) বলেন যে, ইয়াহুদীরা বিশ্বাস করতো যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান আল্লাহ্‌র রাসূল, কিন্তু তিনি শুধু ‘আরবদের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। (তাফসীর তাবারী ২/২৫০) তারা মুসলিমদের সাথে মিলিত হয়ে বলতোঃ ‘তোমাদের নবী সত্য। তিনি সত্যই মহান আল্লাহ্‌র রাসূল।’ কিন্তু যখন তারা পরস্পরের বসতো তখন একে অপরকে বলতোঃ ‘তোমরা ‘আরববাসীকে এসব বলো না। কেননা এই সে নবী যে নবীর দোহাই দিয়ে তোমরা তাদের ওপর বিজয় কামনা করতে। অর্থাৎ তোমরা যে স্বীকার করছো যে, সে একজন সত্য নবী। আর তোমরা তোমাদের কিতাবেও এমনটি জেনেছো যে, শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনার জন্যে তোমাদের থেকে প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে। আর এই নবী তাদেরকে সেই সংবাদই দিচ্ছে যার আমরা অপেক্ষা করছিলাম এবং আমাদের কিতাবেও তা পেয়েছি। অতএব এটা জানা সত্তেও তোমরা এই নবীকে অস্বীকার করো। কখনো তাকে নবী হিসেবে স্বীকার করো না। নচেৎ তারা তোমাদেরকেও তাদের ধর্মে টেনে নিবে এবং মহান আল্লাহ্‌র কাছেও তোমাদেরকে লা-জবাব করে দিবে। তোমরাতো মহান আল্লাহ্‌র কাছে এই প্রার্থনা করতে যে, তিনি যেন তোমাদের মাঝে সেই নবীকে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাঁকে তো তোমাদের পরিবর্তে ‘আরবদের মাঝেই প্রেরণ করা হয়েছে। এরই ফলে মহান আল্লাহ নিচের আয়াতটি অবতীর্ণ করে তাদের উত্তর দেনঃ اَوَ لَا یَعْلَمُوْنَ اَنَّ اللّٰهَ یَعْلَمُ مَا یُسِرُّوْنَ وَ مَا یُعْلِنُوْنَ ‘‘এই নির্বোধদের কি এতোটুকুও জ্ঞান নেই যে, মহান আল্লাহ তাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কথাই জানেন?

‘আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনু আসলাম একটি সূত্র উল্লেখ করে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “لا يدخلن علينا قصبة المدينة إلا مؤمن”

‘আমাদের কাছে যেন মু’মিন ছাড়া আর কেউ না আসে।’ (হাফিয ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন, ‘আব্দুর রহমান ইবনে যায়দ ইবনে আসলাম একজন য ‘ঈফ রাবী ‘। আর একটি কারণ হলো এর সনদটি বিচ্ছিন্ন) তখন কাফির ও ইয়াহূদীরা পর¯পর বলাবলি করলো যে, তোমরা মুসলিমদের কাছে গিয়ে বলো যে আমরা ঈমান এনেছি, আবার এখানে যখন আসবে তখন ঐ রূপই থাকবে যেমন পূর্বে ছিলে। সুতরাং ঐ সব লোক সকালে এসে ঈমানের দাবি করতো এবং সন্ধ্যায় গিয়ে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতো। মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ آمِنُوا بِالَّذِي أُنزلَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَجْهَ النَّهَارِ وَاكْفُرُوا آخِرَهُ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘কিতাবীদের একটি দল বলে মু’মিনদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে এর ওপর দিনের এক অংশে ঈমান আনো এবং ওপর অংশে কুফরী করো তা হলে স্বয়ং মু’মিনরাও ফিরে আসবে।’ (৩ নং সূরা আল ‘ইমরান, আয়াত নং ৭২) তারা এই প্রতারণা করার মাধ্যমে মুসলিমদের গোপন তথ্য জেনে নিয়ে তাদের দলের লোকদের নিকট তা সরবরাহ করতো। আর মুসলিমদেরকেও পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা পোষণ করতো। কিন্তু তাদের চতুরতায় কাজ হয়নি। কেননা মহান আল্লাহ তাদের এই গোপন কথা মু’মিনদেরকে জানিয়ে দেন। তারা মুসলিমদের কাছে এসে ইসলাম ও ঈমানের কথা প্রকাশ করলে তাঁরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করতেনঃ ‘তোমাদের কিতাবে কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শুভাগমন ইত্যাদির কথা নেই?’ তারা স্বীকার করতো। তারপর যখন তারা তাদের বড়দের কাছে যেতো তখন ঐ বড়রা তাদেরকে ধমক দিয়ে বলতোঃ أَتُحَدِّثُونَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ‘তোমরা কি নিজেদের কথা মুসলিমদেরকে বলে তোমাদের অস্ত্র তাদেরকে দিয়ে দিতে চাও?’

আবুল ‘আলিয়া (রহঃ) بما فتح الله এর তাফসীরে বলেন তা হলো, ‘তোমাদের কিতাবে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গুণ সম্বলিত যা অবতারিত হয়েছে।’

আর কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, তারা বলতো যে, অচিরেই একজন নবী আগমন করবেন। অতঃপর তারা একজন অন্যজনের সাথে মিলিত হলে বলতো أَتُحَدِّثُونَهُمْ بِمَا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ‘তোমরা কি তাদের সাথে এমন বিষয়ে কথোপকথন করছো যা মহান আল্লাহ তোমাদেরকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন?’

মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বানু কুরাইযার ওপর আক্রমণের সময় ইয়াহুদীদের দুর্গের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বলেনঃ

“يا إخوان القردة والخنازير، ويا عبدة الطاغوت”

‘হে বানর, শূকর ও শয়তানের পূজারীদের ভ্রাতৃমণ্ডলী!’ তখন তারা পরস্পর বলাবলি করতে থাকেঃ ‘তিনি আমাদের ভিতরের কথা কি করে জানলেন। খবরদার! তোমাদের পরস্পরের সংবাদ তাদেরকে দিয়ো না, দিলে তা মহান আল্লাহ্‌র সামনে দালীল হয়ে যাবে।’ (হাদীস সহীহ। তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/২৪০। মুসতাদরাক হাকিম ৩/৩৪, ৩৫, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ৪/১১৮) তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘তোমরা গোপন করলেও আমার কাছে কোন কথা গোপন থাকে না।’

অর্থাৎ তারা পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় বলতো, এই নবী সম্পর্কে তাওরাত ও অন্যান্য আসমানী গ্রন্থসমূহে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী উল্লিখিত হয়েছে অথবা আমাদের পবিত্র কিতাবসমূহে আমাদের বর্তমান মনোভাব ও কর্মনীতিকে অভিযুক্ত করার মতো যে সমস্ত আয়াত ও শিক্ষা রয়েছে, সেগুলো মুসলমানদের সামনে বিবৃত করো না। অন্যথায় তারা আল্লাহর সামনে এগুলোকে তোমাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে পেশ করবে। আল্লাহ সম্পর্কে নাদান ইহুদিদের বিশ্বাস এভাবেই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ তারা যেন মনে করতো, দুনিয়ায় যদি তারা আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত করে ও সত্য গোপন করে তাহলে এজন্য আখেরাতে তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা চলবে না। তাই পরবর্তী প্রাসঙ্গিক বাক্যে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, তোমরা কি আল্লাহকে বেখবর মনে করো?

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. হক গ্রহণ ও শ্রবণ করা থেকে ইয়াহূদী সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি দূরে থাকে।
২. সত্য জানার পরেও তা অস্বীকার করা খুবই নিন্দনীয়।
৩. যাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার গযব পতিত হয়েছে তাদের কাছ থেকে ঈমানের আশা না করাই উচিত।

Leave a Reply