(Book# 656) [ قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَاء نَفْسِي বলুন, ‘নিজে থেকে এটা বদলানো আমার কাজ ন’ Say:”It is not for me to change it on my own accord;] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 656)
[ قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَاء نَفْسِي
বলুন, ‘নিজে থেকে এটা বদলানো আমার কাজ ন’
Say:”It is not for me to change it on my own accord;]
www.motaher21.net

সুরা: ইউনুস
সুরা:১০
১৫-১৮ নং আয়াত:-
قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَاء نَفْسِي
বলুন, ‘নিজে থেকে এটা বদলানো আমার কাজ ন’
Say:”It is not for me to change it on my own accord;

وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ اٰیَاتُنَا بَیِّنٰتٍ ۙ قَالَ الَّذِیۡنَ لَا یَرۡجُوۡنَ لِقَآءَنَا ائۡتِ بِقُرۡاٰنٍ غَیۡرِ ہٰذَاۤ اَوۡ بَدِّلۡہُ ؕ قُلۡ مَا یَکُوۡنُ لِیۡۤ اَنۡ اُبَدِّلَہٗ مِنۡ تِلۡقَآیِٔ نَفۡسِیۡ ۚ اِنۡ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی اِلَیَّ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اِنۡ عَصَیۡتُ رَبِّیۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۱۵﴾

আর যখন আমাদের আয়াত, যা সুস্পষ্ট, তাদের কাছে পাঠ করা হয় তখন যারা আমাদের সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না তারা বলে, ‘অন্য এক কুরআন আন এটা ছাড়া, বা এটাকে বদলাও।‘ বলুন, ‘নিজে থেকে এটা বদলানো আমার কাজ নয় আমার প্রতি যা ওহী হয়, আমি শুধু তারই অনুসরণ করি । আমি আমার রবের অবাধ্যতা করলে অবশ্যই মহা দিনের শাস্তির আশংকা করি।
And when Our verses are recited to them as clear evidences, those who do not expect the meeting with Us say, “Bring us a Qur’an other than this or change it.” Say, [O Muhammad], “It is not for me to change it on my own accord. I only follow what is revealed to me. Indeed I fear, if I should disobey my Lord, the punishment of a tremendous Day.”

قُلۡ لَّوۡ شَآءَ اللّٰہُ مَا تَلَوۡتُہٗ عَلَیۡکُمۡ وَ لَاۤ اَدۡرٰىکُمۡ بِہٖ ۫ۖ فَقَدۡ لَبِثۡتُ فِیۡکُمۡ عُمُرًا مِّنۡ قَبۡلِہٖ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۱۶﴾
বল, ‘আল্লাহর ইচ্ছা হলে আমি তোমাদের কাছে এটা পাঠ করতাম না এবং আল্লাহ তোমাদেরকে ওটা জানাতেন না। আমি এর পূর্বেও তো জীবনের এক দীর্ঘ সময় তোমাদের মধ্যে অতিবাহিত করেছি; তবুও কি তোমরা বুঝতে পার না?’
Say, “If Allah had willed, I would not have recited it to you, nor would He have made it known to you, for I had remained among you a lifetime before it. Then will you not reason?”

فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِاٰیٰتِہٖ ؕ اِنَّہٗ لَا یُفۡلِحُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ ﴿۱۷﴾
অতএব সে ব্যক্তির চেয়ে অধিক অত্যাচারী কে হবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা তাঁর আয়াতসমূহকে মিথ্যা মনে করে? নিঃসন্দেহে এমন অপরাধিগণ সফলকাম হবে না।
So who is more unjust than he who invents a lie about Allah or denies His signs? Indeed, the criminals will not succeed.

وَ یَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مَا لَا یَضُرُّہُمۡ وَ لَا یَنۡفَعُہُمۡ وَ یَقُوۡلُوۡنَ ہٰۤؤُلَآءِ شُفَعَآؤُنَا عِنۡدَ اللّٰہِ ؕ قُلۡ اَتُنَبِّـُٔوۡنَ اللّٰہَ بِمَا لَا یَعۡلَمُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ لَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ سُبۡحٰنَہٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۱۸﴾
আর তারা আল্লাহ্‌ ছাড়া এমন কিছুর ‘ইবাদাত করছে যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহ্‌র কাছে আমাদের সুপারিশকারী।‘ বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহ্‌কে আসমানসমূহ ও যমীনের এমন কিছুর সংবাদ দেবে যা তিনি জানেন না ? তিনি মহান, ‘পবিত্র এবং তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধে।
And they worship other than Allah that which neither harms them nor benefits them, and they say, “These are our intercessors with Allah ” Say, “Do you inform Allah of something He does not know in the heavens or on the earth?” Exalted is He and high above what they associate with Him.

১৫-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসকারীদের একটি ভ্রান্ত ধারণা ও অন্যায় আবদারের জবাব দিয়েছেন। এসব লোকেরা না জানত আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে, না ওয়াহী ও রিসালাত সম্পর্কে। তারা নাবী-রাসূলগণের আনীত কিতাবকে সাধারণ কিতাবের মত মনে করত। রাসূলগণ যখনই কোন আয়াত তেলাওয়াত করতেন তখন তা তাদের মনোঃপুত না হলে সে বিষয় তারা মানত না। তারা রাসূলগণকে বলত, এ কুরআন যেহেতু তুমি নিয়ে এসেছ সেহেতু তুমি এটি পরিবর্তন করে অন্য কুরআন নিয়ে আস অথবা এই কুরআনে যা হালাল রয়েছে তা হারাম কর আর যা হারাম রয়েছে তা হালাল কর। অন্যথায় আমরা তা মানব না। অথচ তারা এ কথাও জানত যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন কিছু লিখতে, পড়তে জানতেন না। আর তাঁর দ্বারা এটা পরিবর্তনও সম্ভব নয়।

কারণ প্রথমত, তিনি হচ্ছেন একজন উম্মী নাবী, দ্বিতীয় এতে যদি কোন কিছু পরিবর্তন করা হয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকেও আখিরাতে কঠিন শাস্তি দেবেন। সুতরাং এ সমস্ত কথা জেনে শুনেও তারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, রাসূলদের প্রতি মিথ্যা আরোপ করত, তারা আখিরাতে আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাতকে অস্বীকার করত, পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করত। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন বাতিল মা‘বূদদের উপাসনা করত। তারা রাসূলের তাওহীদের দাওয়াতকে মানত না। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত লাভের পূর্বে তাদের মধ্যে প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছর অতিবাহিত করেছেন। তারা তার সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা সম্পর্কেও অবগত ছিল। যেমন

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(أَمْ لَمْ يَعْرِفُوْا رَسُوْلَهُمْ فَهُمْ لَه۫ مُنْكِرُوْنَ)‏

“অথবা তারা কি তাদের রাসূলকে চিনে না যার ফলে তাকে অস্বীকার করে?” (সূরা মূ‘মিনুন ২৩:৬৯)

হিরাকল আবূ সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিল: তোমাদের কাছে তিনি মিথ্যা বলেছেন, এরূপ কোন প্রমাণ আছে? আবূ সুফিয়ান উত্তরে বললেন, না। আবূ সুফিয়ান তখন কাফিরদের নেতা ও সরদার, তারপরেও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সত্যবাদিতার কথা স্বীকার করতেই হল। হিরাকল মন্তব্য করে বলেছিল: মানুুষের ব্যাপারে যিনি কখনো মিথ্যা বলেননি, আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে তিনি কিভাবে মিথ্যা বলতে পারেন? (সহীহ বুখারী হা: ৭)

তারা এ সমস্ত কথা জানা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এই কুরআন পরিবর্তন করতে বলত, অথচ তা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(وَإِذَا بَدَّلْنَآ اٰيَةً مَّكَانَ اٰيَةٍ لا وَّاللّٰهُ أَعْلَمُ بِمَا يُنَزِّلُ)

“আমি যখন এক আয়াতের পরিবর্তে অন্য এক আয়াত উপস্থিত করি আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন তা তিনিই ভাল জানেন।” (সূরা নাহল ১৬:১০১)

সুতরাং যারা সত্য জানার পরেও আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যারোপ করবে অথবা আল্লাহ তা‘আলার কোন আয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে তাদের চেয়ে অধিক জালিম আর কেউ হতে পারে না।

আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী মুশরিকরা এমন জিনিসের উপাসনা করে যা তাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং অপকারও করতে পারে না। তারা এমন উপাস্য যে, যারা তাদের নিজেদেরই কোন কিছু রদবদল করতে পারে না, অথচ তাদের ধারণা যে, আমরা যদি তাদের ইবাদত করি তাহলে তারা আমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার দরবারে শাফা‘আত করবে। অথচ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ব্যতীত কেউ তাঁর সামনে সেদিন কথাই বলতে পারবে না। এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার ২৫৫ নং আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং তারা যে বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যান্য বাতিল মা‘বূদের ইবাদত করে সে বিশ্বাস ও কর্ম কোন উপকারে আসবে না। বরং তারা ও তাদের মা‘বূদেরা সবাই জাহান্নামে যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষনীয় বিষয়:

১. নাবী, রাসূল ও রিসালাত সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা পোষণ করতে হবে।
২. আখিরাতের সাক্ষাতকে অস্বীকার করা যাবে না।
৩. যে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে সে সবচেয়ে বড় অত্যাচারী।
৪. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কারো ইবাদত করা যাবে না।
৫. আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ব্যতীত কেউ শাফা‘য়াত করতে পারবে না।
৬. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ ক্ষতি ও উপকার করার মালিক নেই।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

তাদের এ বক্তব্য প্রথমত এ ধারণার ভিত্তিতে উচ্চারিত হয়েছিল যে, মুহাম্মাদ ﷺ যা কিছু পেশ করেছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয় বরং তাঁর নিজের চিন্তার ফসল এবং শুধুমাত্র নিজের কথার গুরুত্ব বাড়াবার জন্য তিনি তাকে আল্লাহর কথা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, তারা বলতে চাচ্ছিল, তুমি এসব তাওহীদ, আখেরাত ও নৈতিক বিধি নিষেধের আলোচনার অবতারণা করছো কেন? যদি জাতির পথ-নির্দেশনা তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে এমন জিনিস পেশ করো যার ফলে জাতি লাভবান হয় এবং সে বৈষয়িক উন্নতি লাভ করতে পারে। তবুও যদি তুমি নিজের এ দাওয়াতকে একদম বদলাতে না চাও তাহলে কমপক্ষে এর মধ্যে এতটুকু নমনীয়তা সৃষ্টি করো যার ফলে আমাদের ও তোমার মধ্যে দরকষাকষির ভিত্তিতে সমঝোতা হতে পারে। আমরা তোমার কথা কিছু নেবো এবং তুমি আমাদের কথা কিছু মেনে নেবে। তোমার তাওহীদের মধ্যে আমাদের শিরকের জন্য কিছু জায়গা দিতে হবে তোমার আল্লাহ‌ প্রীতির মধ্যে আমাদের দুনিয়া প্রীতির সহাবস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তোমার পরকাল বিশ্বাসের মধ্যে আমাদের এ ধরনের বিশ্বাসের কিছু অবকাশ রাখতে হবে যে, দুনিয়ায় আমরা যা চাই তা করতে থাকবো কিন্তু আখেরাতে কোন না কোনভাবে অবশ্যই আমরা মুক্তি পেয়ে যাবো। তাছাড়া তুমি যে কঠোরতম ও অনমনীয় নৈতিক মূলনীতিগুলোর প্রচার করে থাক, তা আমাদের কাছে গ্রহণীয় নয়। এর মধ্যে আমাদের সংকীর্ণ গোত্রস্বার্থ, রসম-রেওয়াজ, ব্যক্তিগত ও জাতীয় স্বার্থ এবং আমাদের প্রবৃত্তির আশা-আকাংখার জন্যও কিছুটা অবকাশ থাকা উচিত। আমাদের ও তোমার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ইসলামের দাবীসমূহের একটি ন্যায়সঙ্গত পরিসর স্থিরীকৃত হয়ে যাওয়াটি কি বাঞ্চনীয় নয়? সেই পরিসরে আমরা আল্লাহর হক আদায় করে দেবো। এরপর আমাদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেতে হবে। আমরা যেভাবে চাইবো বৈষয়িক কাজ কারবার চালিয়ে যেতে থাকবো। কিন্তু তুমি তো সমগ্র জীবন ও সমস্ত কাজ-কারবারকে তাওহীদ ও আখেরাত বিশ্বাস এবং শরীয়াতের বিধানের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীন করার সর্বনাশা নীতি গ্রহণ করেছো।

* এটি হচ্ছে ওপরের দু’টি কথার জবাব। এখানে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, আমি এ কিতাবের রচয়িতা নই বরং অহীর মাধ্যমে এটি আমার কাছে এসেছে এবং এর মধ্যে কোন রকম রদ বদলের অধিকারও আমার নেই। আর তাছাড়া এ ব্যাপারে কোন প্রকার সমঝোতার সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই। যদি গ্রহণ করতে হয় তাহলে এ সমগ্র দ্বীনকে হুবহু গ্রহণ করতে হবে, নয়তো পুরোপুরি রদ করে দিতে হবে।

* কুরআনের বাণীগুলো মুহাম্মাদ ﷺ নিজে তৈরী করে আল্লাহর বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, এ মর্মে তারা যে অপবাদ রটাচ্ছিল এটা তার একটি দাঁতভাঙ্গা জবাব ও তার প্রতিবাদে একটি অকাট্য যুক্তি। এই সাথে মুহাম্মাদ ﷺ যে নিজে এ কিতাবের রচয়িতা নন বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে এটি তাঁর ওপর নাযিল হচ্ছে, তাঁর এ দাবীর সপক্ষেও এটি একটি জোরালো যুক্তি। অন্য যুক্তি-প্রমাণগুলো তবুওতো তুলনামূলক ভাবে দূরবর্তী বিষয় ছিল কিন্তু মুহাম্মাদ ﷺ জীবনের তো তাদের সামনের জিনিস ছিল। নবুওয়াত লাভের আগে পুরো চল্লিশটি বছর তিনি তাদের মধ্যে অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি তাদের শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের চোখের সামনে তাঁর শিশুকাল অতিক্রম হয়। সেখানেই বড় হন। যৌবনে পর্দাপণ করেন তারপর পৌঢ়ত্বের পৌঁছেন। থাকা-খাওয়া, ওঠাবসা, লেনদেন, বিয়ে শাদী ইত্যাদি সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক তাদের সাথেই ছিল এবং তাঁর জীবনের কোন দিক তাদের কাছে গোপন ছিল না। এমন ধরনের সুপরিচিত ও চোখে দেখা জিনিসের চাইতে ভালো সাক্ষ্য আর কি হতে পারে?

তাঁর এ জীবনধারার মধ্যে দু’টি বিষয় একেবারেই সুস্পষ্ট ছিল। মক্কার প্রত্যেকটি লোকই তা জানতো।

এক, নবুওয়াত লাভ করার আগে তাঁর জীবনের পুরো চল্লিশটি বছরে তিনি এমন কোন শিক্ষা, সাহচর্য ও প্রশিক্ষণ লাভ করেননি এবং তা থেকে এমন তথ্যাদি সংগ্রহ করেননি যার ফলে একদিন হঠাৎ নবুওয়াতের দাবী করার সাথে সাথেই তার কণ্ঠ থেকে এ তথ্যাবলীর ঝরনাধারা নিঃসৃত হতে আরম্ভ করেছে। কুরআনের এসব সূরায় এখন একের পর এক যেসব বিষয় আলোচিত হচ্ছিল এবং যেসব চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটেছিল এর আগে কখনো তাঁকে এ ধরনের সমস্যার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে, এ বিষয়য়াবীল ওপর আলোচনা করতে এবং এ ধরনের অভিমত প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। এমনকি এ পুরো চল্লিশ বছরের মধ্যে কখনো তাঁর কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং কোন নিকটতম আত্মীয়ও তাঁর কথাবার্তা ও আচার আচরণে এমন কোন জিনিস অনুভব করেনি যাকে তিনি হঠাৎ চল্লিশ বছরে পদার্পণ করে যে মহান দাওয়াতের সূচনা করেন তার ভূমিকা বা পূর্বাভাস বলা যেতে পারে। কুরআন যে তার নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত নয় বরং বাহির থেকে তাঁর মধ্যে আগত এটাই ছিল তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। কারণ জীবনের কোন পর্যায়েও মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি তার জন্য এমন কোন জিনিস পেশ করতে পারে না যারা উন্নতি ও বিকাশের সুস্পষ্ট আলামত তার পূর্ববর্তী পর্যায়গুলোয় পাওয়া যায় না। এ কারণে মক্কার কিছু চতুর লোক যখন নিজেরাই কুরআনকে রসূলের মস্তিষ্কেপ্রসূত গণ্য করাকে একেবারেই একটি বাজে ও ভূয়া দোষারোপ বলে উপলব্ধি করলো তখন শেষ পর্যন্ত তারা বলতে শুরু করলো, অন্য কেউ মুহাম্মাদকে একথা শিখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এ দ্বিতীয় কথাটি প্রথম কথাটির চাইতেও বেশী বাজে ও ভূয়া ছিল। কারণ শুধু মক্কায়ই নয়, সারা আরব দেশেও এমন একজন লোক ছিল না যার দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলা যেতে পারতো যে, ইনিই এ বাণীর রচয়িতা বা রচয়িতা হতে পারে। এহেন যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি কোন সমাজে আত্মগোপন করে থাকার মত নয়।

দ্বিতীয় যে কথাটি তাঁর পূর্ববর্তী জীবনে একদম সুস্পষ্ট ছিল সেটি ছিল এই যে, মিথ্যা, প্রতারণা, জালিয়াতী, ধোঁকা, শঠতা, ছলনা এবং এ ধরনের অন্যান্য অসৎ গুণাবলীর কোন সামান্যমত গন্ধও তাঁর চরিত্রে পাওয়া যেতো না। গোটা আরব সমাজে এমন এক ব্যক্তিও ছিল না যে একথা বলতে পারতো যে, এ চল্লিশ বছরের সহাবস্থানের সময় তাঁর ব্যাপারে এমন কোন আচরণের অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। পক্ষান্তরে তাঁর সাথে যাদেরই যোগাযোগ হয়েছে তারাই তাঁকে একজন অত্যন্ত সাচ্চা, নিষ্কলঙ্ক ও বিশ্বস্ত (আমানতদার) ব্যক্তি হিসেবেই জেনেছে। নবুওয়াত লাভের মাত্র পাঁচ বছর আগের কথা। কাবা পুনর্নির্মাণের সময় কুরাইশদের বিভিন্ন পরিবার হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) সংস্থাপনের প্রশ্নে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল। পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে স্থিরিকৃত হয়েছিল, পরদিন সকালে সবার আগে যে ব্যক্তি কাবাঘরে প্রবেশ করবে তাকেই শালিস মানা হবে। পরদিন সেখানে সবার আগে প্রবেশ করেন মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁকে দেখেই সবাই সমস্বরে বলে ওঠেঃ هذا الامين , رضينا , هذا محمد “এই সেই সাচ্চা ও সৎ ব্যক্তি। আমরা এর ফায়সালায় রাযী। এতো মুহাম্মাদ।” এভাবে তাঁকে নবী হিসেবে নিযুক্ত করার আগেই আল্লাহ‌ সমগ্র কুরাইশ গোত্র থেকে তাদের ভরা মজলিসে তাঁর “আমীন” হবার সাক্ষী নিয়েছিলেন। এখন যে ব্যক্তি তার সারা জীবন কোন ক্ষুদ্রতম ব্যাপারেও মিথ্যা, প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেননি তিনি অকস্মাৎ এতবড় মিথ্যা, জালিয়াতী ও প্রতারণার জাল বিস্তার করে এগিয়ে আসবেন কেন? তিনি নিজের মনে মনে কিছু বানী রচনা করে নেবেন এবং সর্বাত্মক বলিষ্ঠতা সহকারে চ্যালেঞ্জ দিয়ে সেগুলোকে আল্লাহর বাণী বলে প্রচার করবেন, এ ধরনের কোন সন্দেহ পোষণ করার অবকাশই বা সেখানে কোথায়?

এ কারণে মহান আল্লাহ‌ নবী (সা.) কে বলেছেন, তাদের এ নিরর্থক দোষারোপের জবাবে তাদেরকে বলোঃ হে আল্লাহর বান্দারা! নিজেদের বিবেক বুদ্ধিকে কিছু কাজে লাগাও। আমি তো বহিরাগত কোন অপরিচিত আগন্তুক নই। তোমাদের মাঝে জীবনের একটি বিরাট সময় আমি অতিবাহিত করেছি। আমার অতীত জীবনের কার্যাবলী দেখার পর তোমরা কেমন করে আমার কাছে থেকে আশা করতে পারো যে, আমি আল্লাহর হুকুম ও তাঁর শিক্ষা ছাড়াই এ কুরআন তোমাদের সামনে পেশ করতে পারি? (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা কাসাস ১০৯ টীকা)।

[ একথাটি মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা হচ্ছে। মূসা আলাইহিস সালাম এ কথা মোটেই জানতেন না যে, তাঁকে নবী করা হচ্ছে এবং বিরাট দায়িত্ব সম্পাদনে নিযুক্ত করা হচ্ছে। তিনি কখনো কল্পনায়ও এ ইচ্ছা বা আশা পোষণ করা তো দূরের কথা কখনো এ বিষয়টি কামনাও করেননি। হঠাৎ পথ চলার সময় তাঁকে ডেকে নেয়া হয় এবং নবীর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে তাঁর থেকে বিস্ময়কর কাজ নেয়া হয়, যার সাথে তার পূর্ববর্তী জীবনের কাজের কোন সাদৃশ্যই ছিল না। ঠিক একই ঘটনা ঘটে মুহাম্মাদ সল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথেও। মক্কার লোকেরা নিজেরাই জানতো, হেরা গিরিগুহা থেকে যেদিন তিনি নবুওয়াতের পয়গাম নিয়ে নেমে আসেন তার মাত্র একদিন আগে পর্যন্ত তাঁর জীবন কি ছিল, তিনি কি কাজ করতেন, কেমন কথাবার্তা বলতেন, তাঁর কথাবার্তার বিষয়বস্তু কি হতো, কোন্ বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল এবং তাঁর তৎপরতা ছিলো কোন্ ধরণের। তাঁর এ সমগ্র জীবন অবশ্যই সত্যতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ও পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতায় পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে পরিপূর্ণ ভদ্রতা, শালীনতা, শান্তিপ্রিয়তা, প্রতিশ্রুতি পালন, অধিকার প্রদান ও জনসেবার ভাবধারা অসাধারণ উজ্জ্বল্যে দেদীপ্যমান ছিল। কিন্তু সেখানে এমন কোন জিনিস ছিল না যার ভিত্তিতে কেউ এ কথা কল্পনাও করতে পারে যে, এ সদাচারী লোকটি আগামীকাল নবুওয়াতের দাবী নিয়ে এগিয়ে আসবেন। তাঁর সাথে যারা নিকটতম সম্পর্ক রাখতো এবং তাঁর আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে একজনও একথা বলতে পারেনি যে, তিনি পূর্ব থেকেই নবী হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হেরা গিরিগূহার সেই বৈপ্লবিক মূহুর্তের পরে অকস্মাৎ যেসব বিষয়বস্তু, সমস্যাবলী ও প্রসঙ্গ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য বিবৃতি ও ভাষণ দান শুরু হয়ে যায় ইতিপূর্বে কেউ তাঁর কন্ঠ থেকে কখনো তার একটি বর্ণও শোনেনি। কুরআনের আকারে অকস্মাৎ তাঁর মুখ থেকে যে বিশেষ ভাষা, শব্দ ও পরিভাষা লোকেরা শুনতে থাকে ইতিপূর্বে কখনো তারা তা শোনেনি। ইতিপূর্বে কখনো তিনি কোথাও বক্তৃতা ও ওয়াজ-নসিহত করতে দাঁড়াননি। কখনো দাওয়াত দিতে ও আন্দোলনের বাণী নিয়ে এগিয়ে আসেননি। বরং কখনো তাঁর কোন কর্মতৎপরতা থেকে এ ধারণাই জন্মাতে পারেনি যে, তিনি সামাজিক সমস্যা সমাধান অথবা ধর্মীয় সংশোধন কিংবা নৈতিক ও চারিত্রিক সংস্কার সাধনের জন্য কোন কাজ শুরু করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এ বৈপ্লবিক মুহূর্ত সমাগত হবার একদিন আগেও তাঁর জীবন ছিল একজন ব্যবসায়ীর জীবন। সাদামাটা ও বৈধ পথে রুজি-রোজগার করা, নিজের সন্তান-পরিজনদের সাথে হাসিখুশির জীবন-যাপন করা, অতিথি আপ্যায়ন করা, দুঃখী-দরিদ্রদের সাহায্য সেবা করা এবং আত্নীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার আর কখনো কখনো ইবাদাত করার জন্য একান্তে বসে যাওয়া— এই ছিল তাঁর স্বাভাবিক জীবন। এ ধরণের একজন লোকের হঠাৎ একদিন বিশ্ব কাঁপানো বাগ্মীতা নিয়ে ময়দানে নেমে আসা, একটি বিপ্লবাত্মক দাওয়াতের কাজ শুরু করে দেয়া, একটি অভিনব সাহিত্য সৃষ্টি করা এবং একটি স্বতন্ত্র জীবন দর্শন, চিন্তাধারা, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিধান নিয়ে সামনে এগিয়ে আসা, এতবড় একটি পরিবর্তন, যা মানবিক মনস্তত্বের দৃষ্টিতে কোন প্রকার কৃত্রিমতা, প্রস্তুতি ও ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার মাধ্যমে কখনোই আত্নপ্রকাশ করতে পারে না। কারণ এ ধরণের প্রত্যেকটি প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি অবশ্যই পর্যায়ক্রমিক ক্রমোন্নতির স্তর অতিক্রম করে এবং যাদের মধ্যে মানুষ রাত্রি-দিন জীবন-যাপন করে এ পর্যায় ও স্তর কখনো তাদের চোখের আড়ালে থাকতে পারে না। নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন যদি এ পর্যায়গুলো অতিক্রম করে থাকতো তাহলে মক্কার হাজার হাজার লোক বলতো, আমরা না আগেই বলেছিলাম এ ব্যক্তি একদিন কোন বড় আকারের দাবী করে বসবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মক্কার কাফেররা তাঁর বিরুদ্ধে সব ধরণের অভিযোগ আনলেও এ অভিযোগটি তাদের একজনও উত্থাপন করেননি। তারপর তিনি নিজেও নবুওয়াতের প্রত্যাশী ছিলেন না। অথবা তা কামনা করতেন না এবং সেজন্য অপেক্ষাও করছিলেন না। বরং সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে অকস্মাত তিনি এ বিষয়টির মুখোমুখি হলেন। বিভিন্ন হাদীসে অহীর সূত্রপাতের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে যে ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। জিব্রীলের সাথে প্রথম সাক্ষাত এবং সূরা আলাকের প্রাথমিক আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর তিনি হেরা গূহা থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গৃহে পৌঁছেছিলেন। গৃহের লোকদের বলেছিলেন, “আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও।” কিছুক্ষণ পরে ভীতির অবস্থা কিছুটা দূর হয়ে গেলে নিজের জীবন সঙ্গীনিকে সব অবস্থা খুলে বললেন। এ প্রসঙ্গে তাঁকে বললেন, “আমি নিজের প্রাণের ভয় করছি।” স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন, “মোটেই না, আল্লাহ‌ আপনাকে কখনো কষ্ট দেবেন না। আপনি আত্নীয়দের হক আদায় করেন। অসহায়কে সাহায্য করেন। অভাবী দরিদ্রকে সহায়তা দেন। অতিথি আপ্যায়ন করেন। প্রত্যেক ভালো কাজে সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকেন।” তারপর তিনি তাঁকে নিয়ে নিজের চাচাতো ভাই ও আহলে কিতাবদের একজন অভিজ্ঞ আলেম ও সদাচারী ব্যক্তি ওয়ারাকাহ ইবনে নওফালের কাছে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে পুরো ঘটনা শোনার পর ওয়ারাকাহ বললেন, “আপনার কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি ছিলেন সেই একই আসমানী দূত বা নামূস (বিশেষ কাজে নিযুক্ত নির্দিষ্ট ফেরেশতা) যিনি মূসার (আ) কাছে এসেছিলেন। হায়! যদি আমি যুবক হতাম এবং সে সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম যখন আপনার সম্প্রদায় আপনাকে বহিস্কার করবে।” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কি আমাকে বের করে দেবে?” জবাব দিলেন, “হ্যাঁ আজ পর্যন্ত এক ব্যক্তিও এমন অতিক্রান্ত হননি, যিনি এ ধরণের বাণী বহন করে এনেছেন এবং লোকেরা তাঁর দুশমনে পরিণত হয়নি।

এ সমগ্র ঘটনাটি এমন একটি অবস্থার ছবি তুলে ধরে, যা একজন সরল মানুষ একটি অপ্রত্যাশিত ও চরম অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে তার জীবনে দেখা দিতে পারে। যদি নবী ﷺ প্রথম থেকেই নবী হবার চিন্তা করতেন, নিজের সম্পর্কে চিন্তা করতেন যে, তাঁর মতো মানুষের নবী হওয়া উচিত এবং কবে কোন ফেরেশতা তাঁর কাছে পয়গাম নিয়ে আসবে তারই প্রতীক্ষায় ধ্যান সাধনা করে নিজের মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেন, তাহলে হেরা গূহার ঘটনাটি সংঘটিত হবার সাথে সাথেই তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন এবং বলিষ্ঠ মনোবল নিয়ে বিরাট দাবী সহকারে পাহাড় থেকে নামতেন, তারপর সোজা নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে পৌঁছে নিজের নবুওয়াতের ঘোষণা দিতেন। কিন্তু এখানে এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা পরিদৃষ্ট হয়। তিনি যা কিছু দেখেন তাতে বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে পৌঁছেন। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। মনটা একটু শান্ত হলে চুপি চুপি স্ত্রীকে বলেন, আজ গুহার নিসঙ্গতায় এ ধরণের একটি ঘটনা ঘটে গেছে। জানি না কি হবে। আমার প্রাণ নিরাপদ নয় মনে হচ্ছে। নবুওয়াত প্রার্থীর অবস্থা থেকে এ অবস্থা কত ভিন্নতর।

তারপর স্বামীর জীবন, তাঁর অবস্থা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে স্ত্রীর চেয়ে বেশি আর কে জানতে পারে? যদি তিনি পূর্বাহ্ণেই এ অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকতেন যে, তাঁর স্বামী হচ্ছেন নবুওয়াতের প্রার্থী, তিনি সর্বক্ষণ ফেরেশতাদের আগমনের প্রতীক্ষা করছেন, তাহলে তার জবাব কখনো হযরত খাদিজার (রা.) জবাবের অনুরূপ হতো না। বরং তিনি বলতেনঃ হে স্বামী! ভয় পাও কেন? দীর্ঘদিন থেকে যে জিনিসের প্রত্যাশী ছিলে তা পেয়ে গেছো। চলো, এবার পীর গিরির দোকান পাঠ সাজাও। আমি মানত, নাজরানা ইত্যাদি সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু পনের বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি স্বামীর জীবনের যে চেহারা দেখেছিলেন তার ভিত্তিতে একথা বুঝতে তার এক মুহূর্তও দেরী হয়নি যে, এমন সৎ, ত্যাগী ও নির্লোভ ব্যক্তির কাছে শয়তান আসতে পারে না, আল্লাহ‌ তাঁকে কোন বড় পরীক্ষার সম্মুখীনও করতে পারেন না বরং তিনি যা কিছু দেখেছেন তা নির্জলা সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

ওয়ারকাহ ইবনে নওফালের ব্যাপারেও একই কথা। তিনি কোন বাইরের লোক ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন নবী করীম ﷺ এর ভ্রাতৃসমাজের অন্তর্ভুক্ত এবং নিকটতম আত্মীয়তার প্রেক্ষিতে তাঁর শ্যালক। তারপর একজন ঈসায়ী আলেম হবার ফলে নবুওয়াত, কিতাব ও অহীকে কৃত্রিমতা ও বানোয়াট থেকে বাছাই করার ক্ষমতা রাখতেন। বয়সে অনেক বড় হবার কারণে নবীর ﷺ শৈশব থেকে সে সময় পর্যন্ত সমগ্র জীবন তার সামনে ছিল। তিনিও তাঁর মুখ থেকে হেরা গূহার সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক শোনার পর সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠেন, এ আগমনকারী নিশ্চিতভাবেই সেই একই ফেরেশতা হবেন যিনি হযরত মূসার (আ) কাছে অহী নিয়ে আসতেন। কারণ হযরত মুসা (আ) সাথে যা ঘটেছিল এখানেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ একজন অত্যন্ত পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী সহজ-সরল মানুষ, মাথায় কোন প্রকার পূর্ব চিন্তা বা পরিকল্পনা নেই, নবুওয়াতের চিন্তায় ডুবে থাকা তো দূরের কথা তা অর্জন করার কল্পনাও কোনদিন তাঁর মনে জাগেনি এবং অকস্মাৎ তিনি পূর্ণ সচেতন অবস্থায় প্রকাশ্যে এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। এ জিনিসটি তাঁকে দুই আর দু’ইয়ে চারের মতো নির্দ্ধিধায় নিশ্চতভাবেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়ে দেয় যে, এখানে কোন প্রবৃত্তির প্ররোচনা বা শয়তানী ছল চাতুরী নেই। বরং এ সত্যাশ্রয়ী মানুষটি নিজের কোন প্রকার ইচ্ছা-আকাংখা ছাড়াই যা কিছু দেখেছেন তা আসলে প্রকৃত সত্যদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।

এটি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের এমন একটি সুস্পষ্ট ও জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ যে, একজন সত্যপ্রিয় মানুষের পক্ষে তা প্রমাণ করা কঠিন। তাই কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় এ জিনিসটিকে নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। যেমন সূরা ইউনূসে বলা হয়েছেঃ

قُلْ لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَاكُمْ بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِنْ قَبْلِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

“হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, যদি আল্লাহ‌ এটা না চাইতেন, তাহলে আমি কখনো এ কুরআন তোমাদের শুনাতাম না বরং এর খবরও তোমাদের দিতাম না। ইতিপূর্বে আমি তোমাদের মধ্যে আমার জীবনের দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছি, তোমরা কি এতটুকু কথাও বোঝো না?” (ইউনূসঃ ১৬ আয়াত) আর সূরা আশ্‌-শূরায় বলা হয়েছে,

مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا

“হে নবী! তুমি তো জানতেও না কিতাব কি এবং ঈমান কি। কিন্তু আমি এ অহীকে একটি আলোয় পরিণত করে দিয়েছি। যার সাহায্যে আমি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চাই তাকে পথ দেখাই।” (আশ্‌-শূরাঃ ৫২ আয়াত)

[আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনূস ২১ , আনকাবুত ৮৮-৯২ এবং শূরা ৮৪ টীকা।]
* যদি এ আয়াতগুলো আল্লাহর না হয়ে থাকে এবং আমি নিজে এগুলো রচনা করে আল্লাহর আয়াত বলে পেশ করে থাকি, তাহলে আমার চাইতে বড় জালেম আর কেউ নেই। আর যদি এগুলো সত্যিই আল্লাহর আয়াত হয়ে থাকে এবং তোমরা এগুলো অস্বীকার করে থাকো তাহলে তোমাদের চাইতে বড় জালেম আর কেউ নেই।

* কোন কোন অজ্ঞ লোক “সফলকাম” বলতে দীর্ঘজীবন বা বৈষয়িক সমৃদ্ধি অথবা পার্থিব উন্নতি অর্থ গ্রহণ করেন। তারপর এ আয়াত থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চান যে, নবুওয়াতের দাবী করার পর যে ব্যক্তি বেঁচে থাকে, দুনিয়ায় উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে অথবা তার দাওয়াত সম্প্রসারিত হতে থাকে, তাকে সত্য নবী বলে মেনে নেয়া উচিত। কারণ সে সফলকাম হয়েছে। যদি সে সত্য নবী না হতো তাহলে মিথ্যা দাবী করার সাথে সাথেই তাকে হত্যা করা হতো অথবা অনাহারে মেনে ফেলা হতো এবং দুনিয়ায় তার কথা ছড়াতেই পারতো না। কিন্তু এ ধরনের নির্বুদ্ধতাসুলভ যুক্তি একমাত্র সেই ব্যক্তিই প্রদর্শন করতে পারে, যে কুরআনী পরিভাষা “সফলকাম”-এর অর্থ জানে না এবং অবকাশ দানের বিধান সম্পর্কেও জ্ঞাত নয়। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ‌ অপরাধীদের জন্য এ বিধান নির্ধারিত করেছেন। এ সঙ্গে এ বর্ণনার মধ্যে এ বাক্যটি কোন্ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তাও বুঝে না। প্রথমত “অপরাধী সফলকাম হতে পারে না” একথাটি এ আলোচনার ক্ষেত্রে এভাবে বলা হয়নি যে, এটিকে কারোর নবুওয়াতের দাবী যাচাই করার মাপকাঠিতে পরিণত করা হবে এবং সাধারণ জনসমাজ যাচাই পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছবে যে, যে নবুওইয়াতের দাবীদার “সফলকাম” হচ্ছে তার দাবী মেনে নেয়া হবে এবং যে “সফলকাম” হচ্ছে না তার দাবী অস্বীকার করা হবে। বরং এখানে একথাটি এ অর্থে বলা হয়েছে যে, “আমি নিশ্চয়তা সহকারে জানি অপরাধীরা সফলকাম হতে পারে না। তাই আমি নিজে নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করার অপরাধ করতে পারি না। তবে তোমাদের ব্যাপারে আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তোমরা সত্য নবীকে অস্বীকার করার অপরাধ করছো। কাজেই তোমরা সফলকাম হবে না।” কোন ব্যক্তি আমাদের এ বক্তব্যের জবাবে সূরা আল হাক্কার ৪৪ থেকে ৪৭ পর্যন্ত আয়াত কটি পেশ করতে পারেন। তাতে বলা হয়েছেঃ

وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ – لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ – ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ

“যদি মুহাম্মাদ নিজে কোন মনগড়া কথা আমার নামে বলতো তাহলে আমি তার হাত ধরে ফেলতাম এবং তার হৃদপিণ্ডের রগ কেটে দিতাম।”

কিন্তু এ আয়াতে যে কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তিকে যথার্থই আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী নিযুক্ত করা হয়েছে সে যদি মিথ্যা কথা বানিয়ে অহী হিসেবে পেশ করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পাকড়াও করা হবে। এ থেকে যে স্বকথিত নবীকে পাকড়াও করা হচ্ছে না সে নিশ্চয়ই সাচ্চা নবী, এ সিদ্ধান্ত টানা একটি সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহর অবকাশ দান ও ঢিল দেয়ার আইনের ব্যাপারে এ আয়াত থেকে যে ব্যতিক্রম প্রমাণ হচ্ছে তা কেবল সাচ্চা নবীর জন্য। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদারও এ ব্যতিক্রমের আওতাভুক্ত-এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন সুযোগই এখানে নেই। সবাই জানে, সরকারী কর্মচারীদের জন্য সরকার যে আইন তৈরী করেছে তা কেবল তাদের ওপরই প্রযোজ্য হবে যারা যথার্থই সরকারী কর্মচারী। আর যারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নিজেদেরকে সরকারী কর্মচারী হিসেবে পেশ করে তাদের ওপর সরকারী কর্মচারী আইন কার্যকর হবে না। বরং ফৌজদারী আইন অনুযায়ী সাধারণ বদমায়েশ ও অপরাধীদের সাথে যে ব্যবহার করা হয় তাদের সাথেও সেই একই ব্যবহার করা হবে। এছাড়াও সূরা আল হাক্কার এ আয়াতে যা কিছু বলা হয়েছে সেখানেও নবী যাচাই করার কোন মানদণ্ড বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। সেখানে এ উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা হয়নি যে, কোন অদৃশ্য হাত এসে যদি অকস্মাৎ নবুওয়াতের দাবীদারের হৃদপিণ্ডের রগ কেটে দেয় তাহলে মনে করবে সে মিথ্যা নবী অন্যথায় তাকে সাচ্চা বলে মনে নেবে। নবীর সাচ্চা বা মিথ্যা হবার ব্যাপারটি যদি তার চরিত্র, কর্মকাণ্ড এবং তার উপস্থাপিত দাওয়াতের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব না হয় তবেই এ ধরনের অযৌক্তিক মানদণ্ড উপস্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।

* কোন জিনিসের আল্লাহর জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার মানেই হচ্ছে এই যে, সেটির আদতে কোন অস্তিত্বই নেই। কারণ, যা কিছুর অস্তিত্ব আছে সবই আল্লাহর জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই আল্লাহ‌ তো জানেন না আকাশে ও পৃথিবীতে তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে কোন সুপারিশকারী আছে, এটি আসলে সুপারিশকারীদের অস্তিত্বহীনতার ব্যাপারে একটি কৌতুকপ্রদ বর্ণনা পদ্ধতি। অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীতে যখন কোন সুপারিশকারী আছে বলে আল্লাহর জানা নেই এখন তোমরা কোন্ সুপারিশকারীদের কথা বলছো?

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

১৫-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:

মুশরিক কুরায়েশদের মধ্যে যারা উদ্ধত কাফির ছিল এবং যারা সব কথাই অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতো, আল্লাহ তা’আলা তাদেরই সংবাদ দিচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন তাদেরকে আল্লাহর কিতাব শুনিয়ে দেন এবং তাদের সামনে সুস্পষ্ট দলীল পেশ করেন তখন তারা বলে- এই কুরআন ছাড়া অন্য কোন কুরআন নিয়ে এসো, যা অন্য ধারায় লিখিত। এখন আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে ইরশাদ করছেন- তুমি তাদেরকে বলে দাও, আচ্ছা বলতো আমার কি অধিকার আছে যে, আমি নিজের পক্ষ থেকে কুরআনকে পরিবর্তন করতে পারি? আমি তো শুধু আল্লাহর একজন আদিষ্ট বান্দা এবং তার বার্তাবাহক। এসব যা কিছু আমি তোমাদের সামনে পেশ করছি, সব কিছুই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুযায়ী হচ্ছে। আমার উপর যা কিছু অহী করা হচ্ছে, আমি শুধু ওগুলোই বলছি। আমি যদি আল্লাহর অবাধ্য হয়ে যাই তবে আমি কিয়ামতের কঠিন শাস্তির ভয় করি। এগুলো যে আমার নিজের রচিত নয়, তার স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, আমি যদি এটা (এই কুরআন) রচনা করতে পারতাম তবে তোমরাও পারতে। কিন্তু তোমরা তো রচনা করতে সক্ষম নও। তাহলে আমি কিরূপে সক্ষম হতে পারি? সুতরাং এটা সুস্পষ্ট কথা যে, এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কালাম হতে পারে না। তাছাড়া তোমরা আমার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার কথা তখন থেকে অবগত আছ যখন থেকে আমি তোমাদেরই কওমের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি। আর যখন থেকে আমি তোমাদের কাছে রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি তখন থেকেও তোমরা আমার সত্যবাদিতা ও ঈমানদারীর উপর কোন কটাক্ষ করতে পার না। এ জন্যেই আল্লাহ পাক বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাও আমি এক দীর্ঘজীবন তোমাদের সাথে অতিবাহিত করেছি। তোমাদের কি এতটুকুও জ্ঞান নেই যে, তোমরা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পার? এজন্যেই যখন রোমক সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ান (রাঃ) ও তাঁর সঙ্গীদেরকে নতুন নবী (সঃ)-এর অবস্থা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে প্রশ্ন করেনঃ “তোমাদের কাছে তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেছেন এরূপ কোন প্রমাণ আছে কি?” আবু সুফিয়ান উত্তরে বলেনঃ “না।” আবু সুফিয়ান (রাঃ) তো ঐ সময় কাফিরদের সরদার ও মুশরিকদের নেতা ছিলেন । তথাপি তাঁকে এই নবী (সঃ)-এর সত্যবাদিতার কথা স্বীকার করতেই হয়। সে সময় হিরাক্লিয়াস মন্তব্য করেছিলেনঃ “মানুষের ব্যাপারে যিনি কখনও মিথ্যা কথা বলেননি, আল্লাহর ব্যাপারে কিরূপে তিনি মিথ্যা কথা বলতে পারেন।

জা’ফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশীর সামনে বলেছিলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা আমাদের নিকট এমন একজন রাসূল (সঃ) পাঠিয়েছেন যার স্বভাবগত সত্যবাদিতা, বংশগত মর্যাদা এবং আমানতদারী। সম্পর্কে আমরা পূর্ণ ওয়াকিফহাল। নবুওয়াতের পূর্বে সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর তিনি আমাদের সাথে অবস্থান করেছেন।” সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (রাঃ) তেতাল্লিশ বছর পর্যন্ত বলেছেন। তবে প্রথম উক্তিটিই সঠিকতর।

* আল্লাহ তা’আলা বলেন, ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় অত্যাচারী ও অবাধ্য আর কে হতে পারে যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে, তার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলে এবং ঝুটমুট এই দাবী করে বসে যে, সে আল্লাহ হতে প্রেরিত? এই ব্যক্তি অপেক্ষা বড় অপরাধী ও গুনাহগার আর কেউ হতে পারে কি? এ কথা তো কোন স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন ও বোকা লোকের কাছেও গোপনীয় নয়। তাহলে বুদ্ধিমান ও নবীদের কাছে কিভাবে এটা গোপন থাকতে পারে। যে ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে সে সত্যবাদী হাক বা মিথ্যাবাদী হাক, আল্লাহ তার সুকর্ম ও কুকর্মের উপর দলীল কায়েম করে থাকেন যা সূর্যের চেয়েও অধিক প্রকাশমান। সুতরাং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সঃ) ও মুসাইলামা কাযযাবকে দেখেছে সে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক এভাবেই করতে পারবে যেভাবে দিনের আলো ও রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। এখন দু’জনের স্বভাব-চরিত্র, কার্যাবলী এবং কথাবার্তার মধ্যে তুলনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কথা ও কাজের মধ্যে কি পরিমাণ সততা ও সত্যবাদিতা ছিল, আর মুসাইলামা কাযযাব সাজাহ এবং আসওয়াদ আনসারীর মধ্যে কি পরিমাণ মিথ্যা ও বেঈমানী ছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন মদীনায় আগমন করেন তখন জনগণ তার আগমনে খুবই খুশী ছিল। তার আগমনে যারা খুশী হয়েছিল আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। আমি যখন প্রথমবার তাঁকে দেখি তখনই আমার অন্তর এই সাক্ষ্য দেয় যে, কোন মিথ্যাবাদী লোকের চেহারা এমন নূরানী (আলোকময়) কখনই হতে পারে না। আমি সর্বপ্রথম তার মুখে যে কথা শুনি তা ছিল নিম্নরূপঃ

“হে লোক সকল! তোমরা পরস্পর একে অপরকে সালাম করবে, তার সফলতার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, গরীব ও ক্ষুধার্তদেরকে পেট পুরে খাওয়াবে, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখবে এবং রাত্রে উঠে সালাত আদায় করবে যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে, তাহলে তোমরা নিঃসন্দেহে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”

যমান ইবনে সা’লাবা (রাঃ) তাঁর গোত্র বানু সাদ ইবনে বকরের পক্ষ হতে প্রতিনিধি হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন এবং তাকে বলেনঃ “আচ্ছা বলুন তো, এই আকাশকে কে এমন উঁচু করে সৃষ্টি করেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “আল্লাহ।” এরপর লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করেনঃ “ কে এই পাহাড়কে এমনভাবে যমীনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন?” উত্তরে নবী (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ।” লোকটি আবার প্রশ্ন করেনঃ “এই যমীনকে কে বিছিয়ে রেখেছেন?” নবী (সঃ) জবাবে বলেনঃ “আল্লাহ।” লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করেনঃ “আপনাকে ঐ সত্তার কসম দিয়ে বলছি যিনি ঐ উঁচু আকাশ বানিয়েছেন, এই বড় বড় পাহাড়গুলো যমীনে গেড়ে দিয়েছেন এবং এতো বড় ও প্রশস্ত যমীন ছড়িয়ে দিয়েছেন, তিনিই কি আপনাকে সমস্ত মানুষের জন্যে রাসূল করে পাঠিয়েছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “হ্যা, ঐ আল্লাহরই কসম যে, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন।” অতঃপর লোকটি নবী (সঃ)-কে আল্লাহর কসম দিয়ে সালাত, যাকাত, হজ্ব এবং সাওমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং নবীও (সঃ) আল্লাহর কসম খেয়ে খেয়ে উত্তর দিতে থাকেন। তখন লোকটি নবী (সঃ)-কে বলেনঃ “আপনি সত্য বলেছেন। যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন সেই সত্তার কসম করে বলছি যে, আমি এর উপর বেশীও করবো না কমও করবো না। বরং সঠিকভাবে এর উপরই আমল করবো।” সুতরাং এই পরিমাণ আমলই তার জন্যে যথেষ্ট হয়ে যায় এবং তিনি নবী (সঃ)-এর সত্যতার উপর ঈমান আনয়ন করেন। কেননা, তিনি দলীল প্রমাণাদি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হাসসান ইবনে সাবিত (রাঃ) বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘যদি তাঁর কাছে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণাদি নাও থাকতো তথাপি তার চেহারার পবিত্রতা, সরলতা এবং অকপটতা স্বয়ং তাঁর সততা ও সত্যবাদিতার দলীল ছিল।”

কিন্তু মুসাইলামা কাযাবকে চক্ষুষ্মনদের যে কেউ দেখেছেন, তিনিই তার অশ্লীল কথন, দুষ্কার্য এবং তার নবুওয়াতের দাবীর ভন্ডামি দেখে যা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে, এই ফলাফল পেয়ে গেছেন যে, সে কিরূপ নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ছিল! আল্লাহ তা’আলার এই উক্তি (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ (এইরূপ যে) তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নেই; তিনি চিরঞ্জীব, সংরক্ষণকারী । না তন্দ্রা তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারে, আর না নিদ্রা।” (২:২৫৫) আর মুসাইলামার উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে ব্যাঙসমূহের সন্তান ব্যাঙ! তুমি আর কত ঘেনর ঘেনর করবে? তুমি এর দ্বারা পানিও ঘোলা করতে পারবে না এবং পানি পানকারীও পান করা থেকে বিরত থাকবে না।” ঐ যালিমের আর একটা অহী হচ্ছে, (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ তাআলা গর্ভবতী নারীর উপর বড় রকমের ইহসান করেছেন যে, অন্ত্রের মধ্য হতে একটি জীবন্ত আত্মা বের করেছেন। তার আরো উক্তি হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ “হাতী, হাতী কি? তুমি কি জান হাতী কি? ওর রয়েছে ছোট লেজ ও লম্বা শুড়। আরো বলেছে- (আরবী) অর্থাৎ “আটা খমীরকারিণীদের শপথ! রুটী তৈরীকারিণীদের শপথ! তরকারী ও ঘিয়ে খাবারের গ্রাস ডুবিয়ে ভক্ষণকারিণীদের শপথ! কুরায়েশরা খুবই সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। এখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র অহী এবং ঐ মিথ্যাবাদীর বাজে ও অশ্লীল কথার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, শিশুরাও তার কথা শুনে বিদ্রুপ করবে। এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা তাকে লাঞ্ছিত করেছেন এবং হাদীকার দিন তাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তার সঙ্গী সাথীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং তার উপর লা’নত বর্ষিত হয়। তার লোকেরা তাওবা করে সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-এর নিকট আগমন করে এবং ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ঐ সময় তিনি তাদেরকে বলেনঃ “মুসাইলামার কোন কুরআন শুনাও তো দেখি।” তখন তারা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু তিনি নাছোড় হয়ে যান এবং তাদেরকে বলেনঃ “অবশ্যই তোমাদেরকে শোনাতে হবে, যাতে অন্যেরাও শুনে নেয় এবং তারা এই কথাগুলো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অহীর সাথে তুলনা করে অহীর শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।” তখন তারা মুসাইলামার ঐ কথাগুলো শুনিয়ে দেয় যা আমরা উপরে নকল করেছি। তখন আবু বকর (রাঃ) তাদেরকে বলেনঃ “ওরে হতভাগ্যের দল! তোমাদের জ্ঞান ও বিবেক কোন দিকে গিয়েছিল? আল্লাহর শপথ! এরূপ কথা তো কোন নির্বোধের মুখ দিয়েও বের হবে না।”

কথিত আছে যে, অজ্ঞতার যুগে আমর ইবনুল আস (রাঃ) মুসাইলামার নিকট গমন করেন। সে তার বন্ধু ছিল। তখন পর্যন্ত আমর ইবনুল আস (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেননি। মুসাইলামা তাঁকে জিজ্ঞেস করেঃ “হে আমর! আপনাদের লোকের উপর (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সঃ-এর উপর) এখন কি অহী অবতীর্ণ হয়েছে?” উত্তরে ইবনুল আস (রাঃ) বলেনঃ “আমি তাঁর সঙ্গীদেরকে এক ব্যাপক অথচ সংক্ষিপ্ত সূরা পাঠ করতে শুনেছি।” সে জিজ্ঞেস করলোঃ “ সেটা কি?” আমর (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ (আরবী) (শেষ পর্যন্ত)! মুসাইলামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললোঃ “আমার উপরও এমনি এক অহী অবতীর্ণ হয়েছে।” আমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সেটা কি? সে জবাবে বললোঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে অবর, হে অবর (এক প্রকার জন্তু) তোমার দু’টি কান ও একটি বক্ষ প্রতীয়মান হচ্ছে, এ ছাড়া তোমার সারা দেহই বাজে।” অতঃপর সে আমার (রাঃ)-কে বললোঃ “হে আমর (রাঃ)! আমার অহী কেমন মনে হলো?” আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আপনিতো নিজেও জানছেন যে, আপনার অহী যে মিথ্যা এতে আমার কোনই সন্দেহ নেই।” যখন একজন মুশরিকেরও এই অবস্থা যে, নবী (সঃ)-এর সত্যবাদী হওয়া ও মুসাইলামার মিথ্যাবাদী হওয়া তার কাছেও গোপনীয় নয়, তখন চক্ষুষ্মনদের কাছে এটা কিরূপে গোপন থাকতে পারে? তাই আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বড় অত্যাচারী আর কে হতে পারে যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলে- আমার উপর অহী করা হয়েছে, অথচ তার উপর কিছুই অহী করা হয়নি, আর বলে- আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন অনুরূপ আমিও অবতীর্ণ করতে পারি?” (৬:৯৩) আর এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সুতরাং ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক অত্যাচারী কে হবে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে, অথবা তার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? নিশ্চয়ই এমন পাপাচারীদের কিছুতেই মঙ্গল হবে না। অনুরূপভাবে ঐ ব্যক্তিও বড় অত্যাচারী যে ব্যক্তি ঐ সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, যে সত্য রাসূলগণ আনয়ন করেছেন এবং ওর উপর দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছেঃ “আল্লাহর নিকট ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বড় যালিম ও দুর্ভাগা যে ব্যক্তি কোন নবীকে হত্যা করেছে অথবা কোন নবী তাকে হত্যা করেছেন।”

* (আরবী) আল্লাহ পাকের এই উক্তির ভাবার্থ এই যে, আল্লাহ তাআলা কাউকেও শাস্তি দেন না যে পর্যন্ত তিনি তার কাছে নবী পাঠিয়ে দলীল ও হুজ্জত কায়েম করেন। আল্লাহ তা’আলা তো মাখলুককে একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবিত রেখে পরে মৃত্যু দান করে থাকেন। আর যে ব্যাপারে তারা পরস্পর মতভেদ করছিল, কিয়ামতের দিন তিনি তার ফায়সালা করে দিবেন। সেই দিনই মুমিনরা সফলকাম হবে, আর কাফিররা হবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-

* [১] অর্থাৎ, এমন আয়াত যার দ্বারা আল্লাহর উপাস্যতত্ত্ব ও একতত্ত্ববাদকে বুঝা যায়।

[২] অর্থ এই যে, এই কুরআন মাজীদের পরিবর্তে অন্য কুরআন আনয়ন কর অথবা এই কুরআনে আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবর্তন সাধন কর।

[৩] অর্থাৎ, দুটো প্রস্তাবই মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যেহেতু এতে আমার কোন এখতিয়ার নেই।

[৪] এটা পূর্ব কথার তাকীদ। আমি তো শুধু সেই কথার অনুসারী, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার প্রতি অবতীর্ণ হয়। তাতে কিছু রদবদল বা কমবেশি করলে কিয়ামতের দিনের শাস্তি থেকে আমি রক্ষা পাব না।

* [১] অর্থাৎ সমস্ত কিছু আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভর; তিনি চাইলে আমি তোমাদেরকে তা না পড়ে শুনাতাম, আর না তোমরা তা জানতে পারতে। অনেকে أَدْرَاكُمْ এর অর্থ أَعْلَمَكُمْ بِهِ عَلَى لِسَانِيْ অর্থাৎ, আর না তিনি তোমাদেরকে আমার মুখ দ্বারা এই কুরআন জানাতেন।

[২] অর্থাৎ, তোমরা তো জান যে, নবুঅত দাবী করার পূর্বে দীর্ঘ চল্লিশ বছর আমি তোমাদের মাঝে অতিবাহিত করেছি। আমি কি তখন কোন শিক্ষকের নিকট কিছু শিক্ষা নিয়েছিলাম? অনুরূপ তোমরা আমার আমানতদার ও সত্যবাদী হওয়ার কথাও স্বীকার করতে। এখন কি সম্ভব যে, আমি আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করতে আরম্ভ করব? উক্ত দুটি কথার অর্থ এই যে, এই কুরআন একমাত্র আল্লাহরই অবতীর্ণকৃত গ্রন্থ। আমি না কারোর নিকট শ্রবণ করে বা শিখে তা বর্ণনা করেছি, আর না এমনিই মিছামিছি আমি তা আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করেছি।

* [১] অর্থাৎ, আল্লাহর ইবাদত অতিক্রম করে, পূর্ণভাবে আল্লাহর ইবাদত বর্জন করে নয়। কারণ মুশরিকরা আল্লাহর ইবাদত করত এবং তার সাথে সাথে গায়রুল্লাহরও ইবাদত করত।

[২] অথচ প্রকৃত উপাস্যের যোগ্যতা এই থাকবে যে, তিনি তাঁর অনুগতদেরকে উত্তম প্রতিদান এবং তাঁর অবাধ্যদেরকে শাস্তি প্রদানে ক্ষমতাবান হবেন।

[৩] অর্থাৎ, তাদের সুপারিশে আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রয়োজন পূরণ করেন। আমাদের দুরবস্থা দূর করে দেন এবং শত্রুদের সুখ নষ্ট করে দেন। অর্থাৎ, মুশরিকরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা করত, তাদেরকে উপকার ও অপকারে স্বেচ্ছাধীন (এবং স্বতন্ত্র উপাস্য) ভাবত না, বরং আল্লাহ ও নিজেদের মাঝে মাধ্যম বা অসীলা ভাবত।

[৪] অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা জানেন না যে, তাঁর কেউ অংশীদার আছে, বা তাঁর দরবারে সুপারিশকারীও হবে? ঠিক যেন মুশরিকরা আল্লাহ তাআলাকে জানাতে চায় যে, তুমি জান না। আমরা তোমাকে জানাচ্ছি যে, তোমার অংশীদারও আছে এবং এমন সুপারিশকারীও আছে, যারা তার বিশ্বাসীদের জন্য সুপারিশ করবে!

[৫] আল্লাহ তাআলা বলেন, মুশরিকদের এসব কথা ভিত্তিহীন, আল্লাহ তাআলা এ সকল কথা থেকে পবিত্র এবং বহু ঊর্ধ্বে।

তাফসীরে আবুবকর জাকারিয়া বলেছেন:-

* [১] এ আয়াতে আখেরাত অস্বীকারকারীদের একটি ভ্রান্ত ধারণা এবং অন্যায় আবদারের খণ্ডন করা হয়েছে। এসব লোক আল্লাহ তা’আলার ওহী ও রেসালাত সম্পর্কিত কোন পরিচয় জানত না। যে কুরআনুল কারম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে পৌছেছে, তার সম্পর্কে এদের ধারণা ছিল এই যে, এটি স্বয়ং তারই কালাম, তারই রচনা। এ ধারণার প্রেক্ষিতেই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে দাবী জানায় যে, কুরআন এটি তো আমাদের বিশ্বাসের বিরোধী; যে মূর্তি-বিগ্রহকে আমাদের পিতা-পিতামহ সততঃ সম্মান করে এসেছে, কুরআন সে সমুদয়কে বাতিল ও পরিতাজ্য সাব্যস্ত করে। তদুপরি কুরআন আমাদের বলে যে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হতে হবে এবং সেখানে হিসাব-নিকাশ হবে। এসব বিষয় আমাদের বুঝে আসে না। আমরা এসব মানতে রায়ী নই। সুতরাং হয় আপনি এ কুরআনের পরিবর্তে অন্য কুরআন তৈরী করে দিন যাতে এসব বিষয় থাকবে না, আর না হয় অন্ততঃ এতেই সংশোধন করে সে বিষয়গুলো বাদ দিয়ে দিন। [দেখুন, বাগভী; কুরতুবী ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] তারা আরও চাচ্ছিল যে, হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে দিন। [তাবারী; কুরতুবী] আল্লাহ্ তা’আলা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে হেদায়াত দান করেছেন যে, আপনি তাদের বলে দিনঃ এটি আমার কালামও নয় এবং নিজের ইচ্ছামত আমি এতে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধনও করতে পারি না। আমি তো শুধুমাত্র আল্লাহর ওহীর তাবেদার। আমি আমার ইচ্ছামত এতে যদি সামান্যতম পরিবর্তনও করি, তাহলে অতি কঠিন গোনাহগার হয়ে পড়ব এবং নাফরমানদের জন্য যে আযাব নির্ধারিত রয়েছে, আমি তার ভয় করি। কাজেই আমার পক্ষে এমনটি অসম্ভব। [ফাতহুল কাদীর]

[২] এটি হচ্ছে ওপরের দুটি কথার জবাব। এখানে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, আমি এ কিতাবের রচয়িতা নই বরং অহীর মাধ্যমে এটি আমার কাছে এসেছে এবং এর মধ্যে কোন রকম রদবদলের অধিকারও আমার নেই। আর তাছাড়া এ ব্যাপারে কোন প্রকার সমঝোতার সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই। যদি গ্রহণ করতে হয় তাহলে এ সমগ্র দ্বীনকে হুবহু গ্রহণ করতে হবে, নয়তো পুরোপুরি রদ করে দিতে হবে।

* [১] এ সময়টুকু ছিল, চল্লিশ বৎসর। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ “আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চল্লিশ বৎসর বয়সে নবুওয়াত দেন”। [বুখারীঃ ৩৫৪৮, মুসলিমঃ ২৩৪৭]

[২] মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নিজে এ কিতাবের রচয়িতা নন বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে অহীর মাধ্যমে এটি তার ওপর নাযিল হচ্ছে, তার এ দাবীর সপক্ষে এটি একটি জোরালো যুক্তি। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন তো তাদের মাঝেই ছিল। নবুওয়াত লাভের আগে পুরো চল্লিশটি বছর তিনি তাদের মধ্যে অতিবাহিত করেছিলেন। কোন লেখা পড়া জানতেন না। [কুরতুবী] তিনি তাদের শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের চোখের সামনে তাঁর শিশুকাল অতিক্রান্ত হয়। সেখানেই বড় হন। যৌবনে পদার্পণ করেন তারপর প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেন। থাকাখাওয়া, ওঠাবসা, লেনদেন, বিয়ে শাদী ইত্যাদি সব ধরনের সামাজিক সম্পর্ক তাদের সাথেই ছিল এবং তার জীবনের কোন দিক তাদের কাছে গোপন ছিল না। তার এ জীবনধারার মধ্যে দুটি বিষয় একেবারেই সুস্পষ্ট ছিল। মক্কার প্রত্যেকটি লোকই তা জানতো। এক, নবুওয়াত লাভ করার আগে তার জীবনের পুরো চল্লিশটি বছরে তিনি এমন কোন শিক্ষা, সাহচর্য ও প্রশিক্ষণ লাভ করেননি এবং তা থেকে এমন তথ্যাদি সংগ্রহ করেননি যার ফলে একদিন হঠাৎ নবুওয়াতের দাবী করার সাথে সাথেই তার কণ্ঠ থেকে এ তথ্যাবলীর ঝর্ণাধারা নিঃসৃত হতে আরম্ভ করেছে। দ্বিতীয় যে কথাটি তাঁর পূর্ববতী জীবনে সুস্পষ্ট ছিল সেটি এই যে, নবুওয়াত লাভের পূর্ব থেকেই তিনি সততা ও আমানতদারীতে প্রসিদ্ধ ছিলেন। [কুরতুবী] মিথ্যা, প্রতারণা, জালিয়াতী, ধোঁকা, শঠতা, ছলনা এবং এ ধরনের অন্যান্য অসৎগুণাবলীর কোন সামান্যতম গন্ধও তাঁর চরিত্রে পাওয়া যেতো না। মূলতঃ এটা এমন একটি দিক যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের অত্যন্ত সুস্পষ্ট দলীল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তোমরা কি তাকে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) এ-ধরনের (অর্থাৎ নবুওয়তের) দাবীর পূর্বে কখনো মিথ্যা বলার অপবাদ দিতে? আবু সুফিয়ান তখন বলেছিল, না– অথচ আবু সুফিয়ান ঐ সময় কাফেরদের সর্দার ছিল। তারপরও সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে হক কথা বলতে বাধ্য হয়েছিল। আর জানা কথা যে, শক্রদের মুখ থেকে যে প্রশংসা বের হয় তা যথার্থ প্রশংসা। মোট কথাঃ তখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস বলেছিলেনঃ “আমি এটা অবশ্যই বুঝি যে, সে মানুষের সাথে মিথ্যা কথা ত্যাগ করেছে তারপর সে আল্লাহর উপর মিথ্যা কথা বলবে এটা কখনো হতে পারে না” [বুখারীঃ ৭, মুসলিমঃ ১৭৭৩] অনুরূপভবে জাফর ইবনে আবি তালেবও আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজাসির দরবারে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে বলেছেন যে, “আল্লাহ আমাদের মধ্যে এমন একজন রাসূলকে পাঠিয়েছেন যার গুণাগুণ বংশ পরিচয় ও আমানতদারী সম্পর্কে আমাদের সবাই জানে”। [মুসনাদে আহমাদ: ১/২০১]

* [১] অর্থাৎ তার চাইতে বড় যালেম আর কেউ নেই যে আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে এবং তাঁর বাণী পরিবর্তন করে। আর তিনি যা নাযিল করেছেন তার সাথে কোন কিছু যোগ করে দেয়। অনুরূপভাবে তোমাদের থেকে বড় যালেমও আর কেউ হবে না যদি তোমরা কুরআনকে অস্বীকার কর এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দাও এবং বল যে, এটা আল্লাহর কালাম নয়। এটাই আল্লাহ তা’আলা তার রাসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তিনি তাদেরকে এটা জানিয়ে দেন। [কুরতুবী]

[২] অর্থাৎ যারা আল্লাহর উপর মিথ্যাচার করে তারা কখনো সফলকাম হবে না। তাদের কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে মিথ্যা হিসেবে বিবেচিত হবেই। মূলত: নবী সত্য বা মিথ্যা এটা জানার বিভিন্ন পদ্ধতি বিদ্যমান। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দু’জনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কথাবার্তা, চাল-চলন ইত্যাদি তুলনা করা। বিবেকবান মাত্রই এ কাজটি সহজে করতে পারে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুসাইলামা কাৰ্য্যাবের কোন তুলনা কি চলে? আমর ইবনে আস একবার মুসাইলামার কাছে গেল। মুসাইলামা তার পুরাতন বন্ধু ছিল। আমর তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। তখন মুসাইলামা তাকে জিজ্ঞাসা করলঃ হে আমর! তোমাদের লোকের (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর) উপর এ সময়ে কি নাযিল হয়েছে? আমর ইবনে “আস জবাবে বললঃ আমি তার সাথীদের একটি সূরা পড়তে শুনেছি। মুসাইলামা বল্লঃ সেটা কি? আমর বললঃ

(وَ الۡعَصۡرِ ۙ﴿۱﴾ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَفِیۡ خُسۡرٍ ۙ﴿۲﴾ اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡحَقِّ ۬ۙ وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ ﴿۳﴾)

সূরাটি শুনে মুসাইলামা কিছুক্ষণ চিন্তা করতে থাকলো, তারপর বললোঃ আমার উপরও অনুরূপ নাযিল করা হয়েছে। আমর বললোঃ সেটা কি? সে বললঃ

(يَاوَبَر، اِنَّمَا اَنْتَ اُذُنَانِ وَصَدَدُ، وَسَائِرُكَ حَقَرٌ نَقَرٌ) ,

তারপর মুসাইলামা বাহাদুরী নেয়ার আশায় আমরের দিকে তাকিয়ে বললোঃ আমর! কেমন লাগলো? তখন আমর বললোঃ আল্লাহর শপথ করে বলছি, তুমি অবশ্যই এটা জানো যে, আমি জানি, তুমি মিথ্যা বলছ”। [ইবন কাসীর; ইবন রাজাব, জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম: ১১২] এটাই যদি একজন কাফেরের বিশ্লেষণ তাহলে মুমিন কত সহজেই সত্য নবী ও মিথ্যা নবীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে তা বলাই বাহুল্য। অপরদিকে আমরা সত্য নবীর ব্যাপারেও তার সততার সাক্ষ্য খুব সহজভাবেই দেখতে পাই। আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বলেনঃ “যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমণ করলেন তখন লোকেরা চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসলো। আমিও তাদের সাথে আসার পর যখন আমি তাকে দেখলাম তখনি বুঝতে পারলাম যে, তার চেহারা কোন মিথু্যক লোকের চেহারা নয়। তখন আমি প্রথম যে কথা কয়টি শুনেছিলাম তা হলোঃ হে মানব সম্প্রদায়! সালামের প্রসার কর, খাবার খাওয়াও, আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখো এবং রাতে মানুষেরা যখন ঘুমন্ত থাকে তখন সালাত আদায় কর, ফলে তোমরা প্রশাস্তির সাথে বা সালামের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে”। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৪২৮৩]

*আল্লাহ তা’আলাই সর্বজ্ঞানী। আসমান ও যমীনে যা আছে তার জ্ঞান সেটাকে ঘিরে আছে। তিনি তোমাদের জানাচ্ছেন যে, তার কোন শরীক নেই, তার সাথে কোন ইলাহ নেই। আর হে মুশরিক সম্প্রদায়! তোমরা মনে করছ যে, তাঁর শরীক পাওয়া যায়? তোমরা কি তাঁকে এমন বিষয়ের সংবাদ দিচ্ছ যা তাঁর কাছে গোপন রয়েছে এবং তোমরা জেনে নিয়েছ? এটা নিঃসন্দেহে বড় অসার কথা। এ মূৰ্খ লোকগুলো কি রাববুল আলামীনের চেয়ে বেশী জানে? এ বিষয়টি সম্পর্কে সামান্য চিন্তা করলেই এর অসারতা ধরা পড়ে [সা’দী] কারণ, কোন জিনিসের আল্লাহর জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার মানেই হচ্ছে এই যে, সেটির কোন অস্তিত্বই নেই। কারণ, যা কিছুর অস্তিত্ব আছে সবই আল্লাহর জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই আল্লাহ তো জানেন না আকাশে ও পৃথিবীতে তাঁর কোন শরীক আছে। অনুরূপভাবে তিনি জানেন না তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে কোন সুপারিশকারী আছে, এটি সুপারিশকারীদের অস্তিত্বহীনতার ব্যাপারে একটি চমৎকার বর্ণনা পদ্ধতি। অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীতে যখন কোন সুপারিশকারী আছে বলে আল্লাহর জানা নেই এখন তোমরা কোন সুপারিশকারীদের কথা বলছ? [ফাতহুল কাদীর] অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা এ কথাটি বলেছেন। তিনি বলেন, “আর তারা আল্লাহর বহু শরীক সাব্যস্ত করেছে। বলুন, তাদের পরিচয় দাও। নাকি তোমরা যমীনের মধ্যে এমন কিছুর সংবাদ দিতে চাও যা তিনি জানেন না?” [সূরা আর-রাদ: ৩৩]

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Yunus
Sura: 10
Verses :- 15-18

قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَاء نَفْسِي

Say:”It is not for me to change it on my own accord;

Obstinance of the Chiefs of the Quraysh

Allah tells;

وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ ايَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالَ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءنَا ايْتِ بِقُرْانٍ غَيْرِ هَـذَا أَوْ بَدِّلْهُ

And when Our clear Ayat are recited unto them, those who hope not for their meeting with Us, say:”Bring us a Qur’an other than this, or change it.”

Allah tells us about the obstinance of the disbelievers of the Quraysh, who were opposed to the message and denied Allah. When the Messenger read to them from the Book of Allah and His clear evidence they said to him:”Bring a Qur’an other than this.” They wanted the Prophet to take back this Book and bring them another book of a different style or change it to a different form. So Allah said to His Prophet:

قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِن تِلْقَاء نَفْسِي

Say:”It is not for me to change it on my own accord;

This means that it is not up to me to do such a thing. I am but a servant who receives commands. I am a Messenger conveying from Allah.

إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

I only follow that which is revealed unto me. Verily, I fear the torment of the Great Day (the Day of Resurrection) if I were to disobey my Lord.
The Evidence of the Truthfulness of the Qur’an

Muhammad (peace be upon him) then argued with supporting evidence to the truthfulness of what he had brought them:

Allah tells;

قُل لَّوْ شَاء اللّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلَا أَدْرَاكُم بِهِ

Say:”If Allah had so willed, I should not have recited it to you nor would He have made it known to you…”

This indicates that he brought this only with the permission and will of Allah for him to do so. The proof of this was that he had not fabricated it himself and that they were incapable of refuting it, and that they should be fully aware of his truthfulness and honesty since he grew up among them, until Allah sent the Message to him.

The Prophet was never criticized for anything or held in contempt. So he said,

فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِّن قَبْلِهِ أَفَلَ تَعْقِلُونَ

Verily, I have stayed among you a lifetime before this. Have you then no sense!

Which meant “don’t you have brains with which you may distinguish the truth from falsehood!”

When Heraclius, the Roman king, asked Abu Sufyan and those who were in his company about the Prophet,

he said:”Have you ever accused him of telling lies before his claim?”

Abu Sufyan replied:”No.”

Abu Sufyan was then the head of the disbelievers and the leader of the idolators, but he still admitted the truth. This is a clear and irrefutable testimony since it came from the enemy.

Heraclius then said:”I wondered how a person who does not tell a lie about others could ever tell a lie about Allah.”

Jafar bin Abu Talib said to An-Najashi, the king of Ethiopia:”Allah has sent to us a Messenger that we know his truthfulness, ancestral lineage, and honesty. He stayed among us before the Prophethood for forty years.

Allah says;

فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِأيَاتِهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الْمُجْرِمُونَ

So who does more wrong than he who forges a lie against Allah or denies His Ayat! Surely, the criminals will never be successful!

Allah says that no one is more wrong, unjust and arrogant than he who invented a lie against Allah, forged claims about Allah, or claimed that Allah has sent a message to him but his claim was not true.

No one is more of a criminal or has committed greater wrong than such a person. Liars cannot be confused with Prophets. Anyone who claims such a thing, whether lying or telling the truth, will necessarily be supported by Allah with proofs and signs of his falsehood or truthfulness. The difference between Muhammad and Musaylamah the liar, was clearer to those who met both of them than the difference between forenoon and midnight when it is extremely dark. Those who are clear-sighted can distinguish via signs and proofs between the truthfulness of Muhammad and the falsehood of Musaylamah the liar!

Sajah and Al-Aswad Al-`Ansi. Abdullah bin Salam said:

“When Allah’s Messenger arrived at Al-Madinah, people were scared away and I was one of them. But when I saw him, I realized that his face could never be the face of a liar.

The first thing I heard from him was his statement:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَفْشُوا السَّلَامَ وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصِلُوا الاْاَرْحَامَ وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامُ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلَام

O people, spread the greetings of peace, feed others, be dutiful to your relatives and offer prayers in the night when others are asleep so that you will enter Paradise in peace.”

When Dimam bin Tha`labah came to Allah’s Messenger and asked him in the presence of his people — Banu Sa`d bin Bakr:

“Who raised this heaven?”

He replied, (Allah).

He asked:”And who erected these mountains?”

He replied, (Allah).

He asked:”Who spread out this earth?”

He replied, (Allah).

Then he asked:”I ask you in the name of the One, Who raised the heavens, erected the mountains, and spread out this earth, has Allah sent you as a Messenger to all mankind”

He said,
اَللَّهُمَّ نَعَم
(By Allah, Yes)!

Then Dimam asked him about Salah, Zakah, Hajj and fasting. With every question he swore by Allah and with every response the Prophet swore also.

Dimam then said:”You indeed are telling the truth. By the One Who sent you with the truth I will not increase or decrease from what you have told me.”

This man was content with the few responses of the Prophet. He was convinced of the Prophet’s truthfulness by the signs that he saw and witnessed.

It was narrated that;

Amr bin Al-`As went to Musaylamah. Amr was not a Muslim at that time and he was a friend of Musaylamah. Musaylamah said:”Woe unto you `Amr. What was revealed unto your friend — meaning Allah’s Messenger — during this period”

Amr replied:”I heard his companions reading a short but great Surah.”

He asked, “And what was that”

He recited:

وَالْعَصْرِ

إِنَّ الاِنسَـنَ لَفِى خُسْرٍ

By Al-`Asr (the time). Verily, man is in loss. (103:1-2) until the end of the Surah.

Musaylamah thought for a while and then said:”Something similar to that was also revealed to me.”

Amr asked:”And what is it?”

He then recited:”O Wabr, O Wabr! You are only two ears and a breast. The rest of you is hollow.’ What do you think, Amr?”

Amr then said:”By Allah, you know that I know that you are a liar.”

This was a statement made by an idolator in judgment of Musaylamah. He knew Muhammad and his truthfulness. He also knew Musaylamah and his tendency toward falsehood and lying. People who think and have insight know even better.

Allah said:

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِباً أَوْ قَالَ أُوْحِى إِلَىَّ وَلَمْ يُوحَ إِلَيْهِ شَىْءٌ وَمَن قَالَ سَأُنزِلُ مِثْلَ مَأ أَنَزلَ اللَّهُ

And who does more aggression and wrong than he who invents a lie against Allah or rejects His Ayat. (6:21)

فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِأيَاتِهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الْمُجْرِمُونَ

So who does more wrong than he who forges a lie against Allah or denies His Ayat Surely, the criminals will never be successful!

No one is more unjust than he who belies the truth which the Messengers have brought supported with evidence and proof.

What do the Idolators believe about Their Gods

Allah says;

وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـوُلاء شُفَعَاوُنَا عِندَ اللّهِ

And they worship besides Allah things that harm them not, nor profit them, and they say:”These are our intercessors with Allah.”

Allah reproaches the idolators that worshipped others beside Allah, thinking that those gods would intercede for them before Allah. Allah states that these gods do not harm or benefit. They don’t have any authority over anything, nor do they own anything. These gods can never do what the idolators had claimed about them.

That is why Allah said:

قُلْ أَتُنَبِّيُونَ اللّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الَارْضِ

Say:`Do you inform Allah of that which He knows not in the heavens and on the earth!’

Ibn Jarir said:

“This means, `Are you telling Allah about what may not happen in the heavens and earth.’

Allah then announced that His Glorious Self is far above their Shirk and Kufr by saying:

سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

Glorified and Exalted is He above all that which they associate as partners (with Him)!
Shirk is New

Allah tells;

وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلاَّ أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُواْ وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِن رَّبِّكَ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ فِيمَا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ.

Leave a Reply