أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 659)
[ فَلَمَّا أَنجَاهُمْ
অতঃপর যখনই আল্লাহ তাদেরকে উদ্ধার করেন,
When He delivers them,]
www.motaher21.net
সুরা: ইউনুস
সুরা:১০
২১-২৩ নং আয়াত:-
فَلَمَّا أَنجَاهُمْ
অতঃপর যখনই আল্লাহ তাদেরকে উদ্ধার করেন,
When He delivers them,
وَ اِذَاۤ اَذَقۡنَا النَّاسَ رَحۡمَۃً مِّنۡۢ بَعۡدِ ضَرَّآءَ مَسَّتۡہُمۡ اِذَا لَہُمۡ مَّکۡرٌ فِیۡۤ اٰیَاتِنَا ؕ قُلِ اللّٰہُ اَسۡرَعُ مَکۡرًا ؕ اِنَّ رُسُلَنَا یَکۡتُبُوۡنَ مَا تَمۡکُرُوۡنَ ﴿۲۱﴾
আর দুঃখ দৈন্য তাদেরকে স্পর্শ করার পর যখন আমরা মানুষকে অনুগ্রহের আস্বাদন করাই তারা তখনই আমাদের আয়াতসমূহের বিরুদ্ধে অপকৌশল করে । বলুন, ‘আল্লাহ্ কৌশল অবলম্বনে আরো বেশি দ্রুততর ।‘ নিশ্চয় তোমরা যে অপকৌশল কর তা আমাদের ফিরিশতারা লিখে রাখে।
And when We give the people a taste of mercy after adversity has touched them, at once they conspire against Our verses. Say, ” Allah is swifter in strategy.” Indeed, Our messengers record that which you conspire.
ہُوَ الَّذِیۡ یُسَیِّرُکُمۡ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ حَتّٰۤی اِذَا کُنۡتُمۡ فِی الۡفُلۡکِ ۚ وَ جَرَیۡنَ بِہِمۡ بِرِیۡحٍ طَیِّبَۃٍ وَّ فَرِحُوۡا بِہَا جَآءَتۡہَا رِیۡحٌ عَاصِفٌ وَّ جَآءَہُمُ الۡمَوۡجُ مِنۡ کُلِّ مَکَانٍ وَّ ظَنُّوۡۤا اَنَّہُمۡ اُحِیۡطَ بِہِمۡ ۙ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ لَئِنۡ اَنۡجَیۡتَنَا مِنۡ ہٰذِہٖ لَنَکُوۡنَنَّ مِنَ الشّٰکِرِیۡنَ ﴿۲۲﴾
তিনিই তোমাদেরকে জলে স্থলে ভ্রমণ করান। এমনকি তোমরা যখন নৌযানে আরোহন কর এবং সেগুলো আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাসে বেরিয়ে যায় এবং তারা তাতে আনন্দিত হয়, তারপর যখন দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে এবং চারদিকে থেকে উত্তাল তরঙ্গমালা ধেয়ে আসে, আর তারা নিশ্চিত ধারণা করে যে, এবার তারা ঘেরাও হয়ে পড়েছে, তখন তারা আল্লাহ্কে তাঁর জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে ডেকে বলেঃ ‘আপনি আমাদের এ থেকে বাঁচালে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।’
It is He who enables you to travel on land and sea until, when you are in ships and they sail with them by a good wind and they rejoice therein, there comes a storm wind and the waves come upon them from everywhere and they assume that they are surrounded, supplicating Allah, sincere to Him in religion, “If You should save us from this, we will surely be among the thankful.”
فَلَمَّاۤ اَنۡجٰہُمۡ اِذَا ہُمۡ یَبۡغُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ ؕ یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّمَا بَغۡیُکُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ ۙ مَّتَاعَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۫ ثُمَّ اِلَیۡنَا مَرۡجِعُکُمۡ فَنُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲۳﴾
অতঃপর যখনই আল্লাহ তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা ভূ-পৃষ্ঠে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহাচরণ করতে থাকে। হে লোক সকল! (শুনে রাখ) তোমাদের বিদ্রোহাচরণ তোমাদেরই (জন্য ক্ষতিকর) হবে, (এ হল) পার্থিব জীবনের উপভোগ্য, তারপর আমারই দিকে তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তোমাদের যাবতীয় কৃতকর্ম জানিয়ে দেব।
But when He saves them, at once they commit injustice upon the earth without right. O mankind, your injustice is only against yourselves, [being merely] the enjoyment of worldly life. Then to Us is your return, and We will inform you of what you used to do.
২১-২৩ নং আয়াতের তাফসীর: –
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন-বিপদ আপদের স্বাদ গ্রহণ করার পর মানুষ যখন আমার রহমত প্রাপ্ত হয়, যেমন দারিদ্রের পরে স্বচ্ছলতা, দুর্ভিক্ষের পরে উত্তম উৎপাদন, মুষলধারে বৃষ্টি ইত্যাদি, তখন সে হাসি-তামাশা করতে শুরু করে এবং আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। আর যখন মানুষকে বিপদ আপদে ঘিরে ফেলে তখন সে উঠতে, বসতে, শুইতে, জাগতে সর্বাবস্থাতেই প্রার্থনায় লেগে পড়ে।
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা ফজরের সালাত পড়ান। বর্ষার রাত্রি ছিল। তিনি বললেনঃ “আজকে রাত্রে আল্লাহ তা’আলা কি বলেছেন তা তোমরা জান কি?” সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) খুব ভাল জানেন।” তখন তিনি বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ “আজ আমার মুমিন বান্দাও সকাল করেছে এবং কাফির বান্দাও সকাল করেছে (অর্থাৎ সবাই সকালে উঠেছে)। কিন্তু যে বান্দা বলেছে যে, এই বৃষ্টির কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ ও করুণা, সে আমার উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তারকার প্রভাবকে অস্বীকারকারী। পক্ষান্তরে যে বান্দা এই বিশ্বাস রাখে যে, এই বৃষ্টির কারণ হচ্ছে নক্ষত্রের প্রভাব, সে আমাকে অস্বীকারকারী এবং নক্ষত্রের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী।”
আল্লাহপাকের উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ হে রাসূল (সঃ)! তুমি এই। কাফিরদেরকে বলে দাও আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার কর্মকৌশল বড়ই কার্যকরী হয়ে থাকে। হে পাপীদের দল! তোমরা কি ধারণা করছো যে, তোমাদেরকে তোমাদের কুফরীর কারণে কোন শাস্তি দেয়া হবে না? প্রকৃতপক্ষে তোমাদেরকে ঢিল দিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর যখন তোমাদের উদাসীনতা শেষ সীমায় পৌছে যাবে তখন আকস্মিকভাবে তোমাদেরকে পাকড়াও করা হবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমার ফেরেশতারা তাদের কাজ কর্ম লিখতে থাকে। অতঃপর তারা তা আলেমুল গায়েব আল্লাহর নিকট পেশ করে তাকে। তারপর তিনি প্রত্যেক বড় ও ছোট পাপের শাস্তি প্রদান করেন।
এরপর মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্যে স্থলভাগ ও জলভাগের ভ্রমণ সহজ করে দিয়েছেন এবং পানির মধ্যেও তিনি তোমাদেরকে তার আশ্রয় ও হিফাজতে নিয়ে নিয়েছেন। যখন তোমরা নৌকায় আরোহণ কর এবং বাতাস নৌকা চালাতে শুরু করে, তখন তোমরা বাতাসের নিম্নগতি ও দ্রুত চালিত হওয়ার কারণে খুবই খুশী হয়ে থাকো। হঠাৎ তোমাদের উপর এক প্রচণ্ড ও প্রতিকূল বাতাস এসে পড়ে এবং প্রত্যেক দিক থেকে তোমাদের উপর তরঙ্গমালা ধেয়ে আসে। ঐ সময় তোমাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তোমরা খাটি বিশ্বাসের সাথে একমাত্র আল্লাহকেই ডাকতে থাকো। ঐ সময় না তোমাদের কোন প্রতিমার কথা স্মরণ হয়, না স্মরণ হয় লাত, হুবল ইত্যাদি কোন মূর্তির কথা। বরং তখন শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলাকেই সম্বোধন করে থাকো। অতঃপর মহান আল্লাহ যখন তোমাদেরকে নিরাপদে সমুদ্রের তীরে পৌছিয়ে দেন তখন পুনরায় তোমরা তার থেকে বিমুখ হয়ে যাও। সত্যি, মানুষ কতই না অকৃতজ্ঞ!
এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা বড়ই আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ তা’আলাকে ডেকে বলে- হে আল্লাহ! যদি আপনি আমাদেরকে এই বিপদ হতে রক্ষা করেন তবে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে যাবো। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন তখন তারা দেশে অন্যায় ও অবিচার করতে শুরু করে দেয়। দেখে মনে হয় যেন তারা কখনও বিপদে পড়েইনি।
ইরশাদ হচ্ছে ….. (আরবী) অর্থাৎ “হে লোক। সকল! জেনে রেখো যে, তোমাদের বিদ্রোহাচরণ তোমাদেরই প্রাণের জন্যে বিপদের কারণ হবে, এতে অন্য কারো ক্ষতি হবে না। যেমন হাদীসে এসেছেঃ “(আল্লাহর বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ ঘোষণা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরণ, এ দুটো এমনই পাপ যে, এ কারণে পরকালে শাস্তি হবেই, এমনকি দুনিয়াতেও সত্বর এর শাস্তি হয়ে যাবে।”
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ … (আরবী) অর্থাৎ “এই পার্থিব জগতে তোমরা কিছুকাল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করবে বটে, কিন্তু এর পরেই তোমাদেরকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। (আরবী) অর্থাৎ “যখন তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে তখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের সমস্ত আমল সম্পর্কে অবহিত করবো এবং ওগুলোর পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে।” যে ভাল প্রতিদান পাবে সে তত মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। আর যে শাস্তি পাবে সে নিজের নফসের উপর ভৎসনা করবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২১-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা অধিকাংশ মানুষের একটি বদ স্বভাবের সংবাদ দিচ্ছেন যে, যখন মানুষ বিপদে পড়ে, দুঃখ-কষ্ট তাকে স্পর্শ করে, অভাব-অনটন দেখা দেয় ইত্যাদি যত আপদ-বিপদ রয়েছে এসব আপদ-বিপদ থেকে তিনি মুক্তি দান করেন, যেমন দুঃখের পর সুখ দান করেন, অভাবের পর সচ্ছলতা দান করেন, অসুখ-বিসুখের পর সুস্থতা দান করেন তখন মানুষ এসব নেয়ামত পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনের বিরুদ্ধে অপকৌশল করে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার এসব নেয়ামতকে অস্বীকার করে, তাঁর নিদর্শন নিয়ে ঠাঁট্টা বিদ্রƒপ করে ও তাঁর সাথে কুফরী ও শির্ক করে। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সে সকল অপকৌশল গ্রহণকারীদেরকে জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন: বলে দাও আল্লাহ তা‘আলা তাদের থেকে অধিক ক্রিয়াশীল কৌশল গ্রহণ করতে সক্ষম। তিনি তাদেরকে পাকড়াও করার ক্ষমতা রাখেন, তিনি চাইলে অবিলম্বে তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার ফেরেশতাগণ তা লিপিবদ্ধ করে রাখছেন, যথাসময়ে তার উপযুক্ত প্রতিদান দিবেন। এই আয়াতের তাফসীর অত্র সূরার ১২ নং আয়াতের তাফসীরের সমার্থবোধক।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. এই আয়াতের একটি শিক্ষা হল যে, মানুষের কোন কাজই আল্লাহ তা‘আলার নিকট গোপন থাকে না, চাই তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।
২. অধিকাংশ মানুষ আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের অকৃতজ্ঞ।
২২-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:
মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও অনুগ্রহ যে, তিনি তাদেরকে জল ও স্থলের ভ্রমণ করা সহজ করে দিয়েছেন। স্থলভাগে অর্থাৎ তিনি মানুষকে পা দিয়েছেন যার দ্বারা চলাফেরা করে, যানবাহনে চড়ে ভ্রমণ করে সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমন করতে পারে। জলভাগে অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মানুষদেরকে নৌকা ও জলযান তৈরি করার জ্ঞান দান করেছেন। যা তৈরি করে মানুষ নদীতে বা সমুদ্রে ভ্রমণ করে, হাজার হাজার টন মালামাল বহন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায় অথচ সে পানিতে একটি লোহার বালাও ভাসমান থাকে না। জল পথে ভ্রমণকালে যখন رِيْحٌ طَيِّبَةٌ তথা এমন বাতাস বয়ে যায় যা নৌযানের অনুকূলে এবং নিম্নগতিসম্পন্ন্ তখন মানুষ খুব খুশী হয়। পক্ষান্তরে যখনই তাদের ওপর হঠাৎ এক প্রচণ্ড প্রতিকূল বায়ু এসে পড়ে এবং চতুর্দিক থেকে ঢেউ আসতে থাকে তখন তারা মনে করে যে, বিপদ তাদেরকে পাকড়াও করে নিয়েছে, এমতাবস্থায় তারা খাঁটি বিশ্বাসের সাথে কাকুতি মিনতি করে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকে এবং বলে আল্লাহ তা‘আলা এ বিপদ থেকে মুক্তি দিলে আর কোন দিন অন্যায় করব না, অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করব। তখন তারা কোন মূর্তিকেও ডাকে না এবং কোন বাতিল মা‘বূদকেও ডাকে না। কারণ তারাও জানে এ বিপদ থেকে তাদের বাতিল মা‘বূদেরা মুক্তি দিতে পারে না। তখন ঐ সকল শয়তানী চিন্তা-চেতনা দূর হয়ে যায়। এতে প্রথমত এ কথা বুঝা যায় মানুষের প্রকৃতিতে এক আল্লাহ তা‘আলার দিকে ফিরে যাবার প্রবণতা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষ পরিবেশে প্রভাবিত হয়ে সে প্রবণতা বা প্রকৃতিকে চাপা দিয়ে ফেলে, কিন্তু মসীবতের সময় উক্ত প্রবণতা মানব মনে স্বতঃবিকাশ লাভ করে। আরো বুঝা গেল যে তাওহীদ মানুষের প্রকৃতিগত মৌলিক বস্তু, যা থেকে মানুষের বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়। কারণ তাওহীদ থেকে বিচ্যুত থাকা, সহজাত প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত থাকার নামান্তর, যা সরাসরি ভ্রষ্টতা। দ্বিতীয়ত এ কথা বুঝা যায় যে মুশরিকরা যখন এরূপ বিপদে পড়ত তখন তারা তাদের তৈরি করা মা‘বূদদেরকে বাদ দিয়ে এক আল্লাহ তা‘আলার কাছে আহ্বান করত।
ইকরিমা বিন আবূ জাহল সম্পর্কে পাওয়া যায় মক্কা বিজয়ের পর তিনি মক্কা থেকে পালিয়ে যান। তিনি হাবশাহ যাবার জন্য এক নৌকায় বসেন। নৌকা সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে পড়লে নৌকার মাঝি যাত্রীগণকে বলল যে, এখন এক আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু’আ কর, কারণ তোমাদেরকে তিনি ছাড়া কেউ এ তুফান থেকে পরিত্রাণ দিতে পারেন না। ইকরিমা বলেন: আমি মনে মনে ভাবলাম যদি সমুদ্রের মাঝে পরিত্রাণ দাতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা হন তাহলে অবশ্যই স্থলভাগে পরিত্রাণদাতা একমাত্র তিনিই হবেন। আর মুহাম্মাদ তো সে কথাই বলে। সুতরাং তিনি স্থির করলেন যে, যদি এখান থেকে বেঁচে যাই তাহলে মুহাম্মাদের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করব। তিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে যান। (আবূ দাঊদ হা: ২৬৮৩, সিলসিলা সহীহাহ হা: ১৭২৩)
কিন্তু পরিতাপের বিষয়! উম্মাতে মুহাম্মাদীর কিছু মানুষ রয়েছে যারা শির্কে এমনভাবে ফেঁসে গেছে যে, বালা-মসিবত ও কষ্টের সময়ও তারা আল্লাহ তা‘আলার দিকে ফিরে যাওয়া বাদ দিয়ে মৃত বুযুর্গ ব্যক্তিদেরকেই ত্রাণকর্তা মনে করে এবং তাদের কাছেই সাহায্যের জন্য আহ্বান করে। সুতরাং সতর্ক হওয়া উচিত, যেখানে মক্কার মুশরিকরা বিপদে পড়লে এক আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকত আর আমাদের কিছু মানুষ আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে মাযার, বাবা, পীর ও দরগাহ শরীফে যায়। অতঃপর যখন তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা মুক্তি দেন তখনই তারা কুফরী করে বসে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فِي الْبَحْرِ ضَلَّ مَنْ تَدْعُوْنَ إِلَّآ إِيَّاهُ ج فَلَمَّا نَجَّاكُمْ إِلَي الْبَرِّ أَعْرَضْتُمْ ط وَكَانَ الْإٍنْسَانُ كَفُوْرًا)
“সমুদ্রে যখন তোমাদেরকে বিপদ স্পর্শ করে তখন কেবল তিনি ব্যতীত অপর যাদেরকে তোমরা আহ্বান করে থাক তারা অন্তর্হিত হয়ে যায়; অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে আনেন তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” (সূরা ইসরা ১৭:৬৭)
তারা অন্যায় অত্যাচারে লিপ্ত হয়, জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করে এবং আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলে না। তবে সকলের জেনে রাখা উচিত তাদের অন্যায় আচরণ, তাদের বিদ্রোহ তাদের ব্যতীত অন্য কারো কোন ক্ষতি করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, এ দু‘টো এমন পাপ যে, এ কারণে আখিরাতে শাস্তি হবেই, এমনকি দুনিয়াতেও এর জন্য শাস্তি দেয়া হবে। তাদের এসমস্ত কৃতকর্মের পরও তাদের সকলকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট ফিরে যেতে হবে আর তিনি তাদেরকে তাদের আমল সম্পর্কে বলে দেবেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল কিছুকে ছেড়ে দিয়ে একমাত্র উপাস্য হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাকেই আহ্বান করতে হবে, অন্য কারো উপাসনা করা যাবে না।
২. মানুষদেরকে আখিরাতে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবগত করা হবে।
৩. বিপদে-আপদে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই ডাকতে হবে, অন্য কারো কাছে চাইলে পাওয়া যাবে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
১১-১২ আয়াতে যে দুর্ভিক্ষের কথা বলা হয়েছে এখানে আবার তারই প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর মানে, তোমরা কোন্ মুখে নির্দশন চাইছো? এ কিছুদিন আগে তোমরা একটি দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে পতিত হয়েছিলে। তাতে তোমরা নিজেদের মাবুদদের থেকে নিরাশ হয়ে গিয়েছিলে। তোমরা এ মাবুদদেরকে আল্লাহর কাছে নিজেদের সুপারিশকারী বানিয়ে রেখেছিলে। এদের সম্পর্কে তোমরা বলে বেড়াতেঃ “অমুক বেদী-মূলে অর্ঘ পেশ করা মাত্রই ফল পাওয়া যায়” এবং “অমুক দরগায় সিন্নি দিলে নির্ঘাত উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়।” এবার তোমরা দেখে নিয়েছো, এসব তথাকথিত উপাস্য ও মাবুদদের হাতে কিছুই নেই। একমাত্র আল্লাহই সমস্ত ক্ষমতার মালিক। এ জন্যই তো তোমরা সর্বশেষ একমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করতে শুরু করেছিলে। মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের যে শিক্ষা দিচ্ছেন তার সত্যতার প্রতি তোমাদের মনে বিশ্বাস জন্মাতো, এ নিদর্শনটিই কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না? কিন্তু এ নিদর্শন দেখে তোমরা কি করছো? যখনই দুর্ভিক্ষের অবসান হয়েছে এবং আল্লাহর রহমতের বারি সিঞ্চনে তোমাদের বিপদ দূরীভূত হয়েছে তখনই তোমরা এ বিপদ আসার ও দূরীভূত হবার হাজারটা ব্যাখ্যা (চালাকী) করতে শুরু করেছো। এভাবে তোমরা তাওহীদকে মেনে নেয়া থেকে নিষ্কৃতি পেতে এবং নিজেদের শিরকের ওপর অবিচল থাকতে চাও। এখন যারা নিজেদের বিবেককে এভাবে নষ্ট করে দিয়েছে তাদেরকে কোন্ ধরনের নিদর্শন দেখানো হবে এবং তা দেখানোর ফায়দা বা কি হবে?
* আল্লাহর চালাকি মানে হচ্ছে, যদি তোমরা সত্যকে না মেনে নাও এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের মনোভাবের পরিবর্তন না করো তাহলে তিনি তোমাদের এ বিদ্রোহাত্মক নীতি অবলম্বন করে চলার সুযোগ করে দেবেন। তোমরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তিনি নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের রিযিক ও অনুগ্রহ দান করতে থাকবেন। এর ফলে তোমাদের জীবন সামগ্রী এভাবেই তোমাদের মোহান্ধ করে রাখবে। এ মোহান্ধতার মধ্যে তোমরা যা কিছু করবে আল্লাহর ফেরেশতারা নীরবে বসে বসে তা লিখে নিতে থাকবেন। এভাবে এক সময় অকম্মাত মৃত্যুর পয়গাম এসে যাবে। তখন নিজেদের কৃতকর্মের হিসাব দেবার জন্য তোমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে।
* প্রত্যেক মানুষের অন্তরে রয়েছে তাওহীদের সত্যতার নিশানী। যতদিন উপায়-উপকরণ অনুকূল থাকে ততদিন মানুষ আল্লাহকে ভুলে পার্থিব জীবন নিয়ে অহংকারে মত্ত হয়ে থাকে। আর উপায় উপকরণ প্রতিকূল হয়ে গেলে এবং এ সঙ্গে যেসব সহায়ের ভিত্তিতে সে পৃথিবীতে বেঁচেছিল সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেলে তারপর কট্টর মুশরিক ও নাস্তিকের মনেও এ সাক্ষ্য ধ্বনিত হতে থাকে যে, কার্যকারণের এ সমগ্র জগতের ওপর কোন আল্লাহর কর্তৃত্ব পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে, তিনি একক আল্লাহ এবং তিনি শক্তিশালী ও বিজয়ী (আনআম ২৯ টীকা দেখুন।)
**
আগের আয়াতে বলা হয়েছিল, তোমরা একটি নিদর্শন নিয়ে আসার দাবী জানাচ্ছো অথচ তোমাদের চারদিকে অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে প্রথম দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রাণীদের জীবনধারা পর্যবেক্ষন করার আহবান জানানো হয়েছিল। এরপর এখন আর একটি নিদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। এ নিদর্শনটি সত্য অস্বীকারকারীদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে। মানুষ কোন বড় রকমের বিপদের সম্মুখীন হলে অথবা মৃত্যু তার ভয়াবহ চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে এক আল্লাহর আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল তখন আর মানুষের চোখে পড়ে না। বড় বড় মুশরিকরা এ সময় নিজেদের উপাস্য দেবতাদের কথা ভুলে এক আল্লাহকে ডাকতে থাকে। কট্টর খোদাদ্রোহী নাস্তিকও এ সময় আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করে। এ নিশানীটিকে এখানে সত্যের নিদর্শন হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। কারণ আল্লাহ ভক্তি ও তাওহীদের সাক্ষ্য প্রত্যেক মানুষের নিজের মধ্যেই বিদ্যমান। এর ওপর গাফলতি ও অজ্ঞানতার যতই আবরণ পড়ুক না কেন তবুও তা কখনো না কখনো দৃষ্টি সমক্ষে জেগে ওঠে। আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা এ ধরণের নিশানী প্রত্যক্ষ করেই ঈমানের সম্পদ লাভে সক্ষম হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে মক্কা বিজিত হবার পর ইকরামা জেদ্দার দিকে পালিয়ে যান। একটি নৌকায় চড়ে তিনি হাবাশার (ইথিয়োপিয়ার) পথে যাত্রা করেন। পথে ভীষণ ঝড়-তুফানে তার নৌকা চরম বিপদের সম্মুখীন হয়। প্রথমে দেবদেবীদের দোহাই দেয়া শুরু হয়। কিন্তু এতে তুফানের ভয়াবহতা কমে না বরং আরো বেড়ে যেতেই থাকে। যাত্রীদের মনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, এবার নৌকা ডুবে যাবে। তখন সবাই বলতে থাকে, এখন আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ডাকলে চলবে না। একমাত্র তিনি চাইলে আমাদের বাঁচাতে পারেন। এ সময় ইকরামের চোখ খুলে যায়। তার মন বলে ওঠে, যদি এখানে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সাহায্যকারী না থেকে থাকে, তাহলে অন্য জায়গায়ই বা আর কেউ থাকবে কেন? একথাটাই তো আল্লাহর সেই নেক বান্দাটি আমাদের গত বিশ বছর থেকে বুঝাচ্ছেন আর আমরা খামখা তাঁর সাথে লড়াই করছি। এটি ছিল ইকরামার জীবনের সিদ্ধান্তকরী মুহূর্ত। সে মুহূর্তেই তিনি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করেন, যদি এ যাত্রায় আমি বেঁচে যাই, তাহলে সোজা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাবো এবং তাঁর হাতে আমার হাত দিয়ে দেবো। পরে তিনি নিজের এ অঙ্গীকার পূর্ণ করেন। ফিরে এসে তিনি কেবল মুসলমান হয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং অবশিষ্ট জীবন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করেই কাটান।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
* [১] মসীবতের পর নিয়ামত উপভোগ করার অর্থ হল, অভাব-অনটন, দুর্ভিক্ষ এবং কষ্ট ও মসীবতের পর পর্যাপ্ত পরিমাণে রুযী পাওয়া, জীবন-উপকরণের আতিশয্য ইত্যাদি।
[২] এর অর্থ এই যে, তারা আমার ঐ সকল নিয়ামতের কদর ও তার উপর আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে না; বরং কুফরী ও শিরক করে। অর্থাৎ এটা তাদের নোংরা ষড়যন্ত্র যা তারা আল্লাহর নিয়ামতের পরিবর্তে বেছে নেয়।
[৩] অর্থাৎ, আল্লাহ যে কৌশল অবলম্বন করেন, তা তাদের থেকে অনেক বেশি ত্রিুয়াশীল। আর তা এই যে, তিনি তাদেরকে পাকড়াও করার ক্ষমতা রাখেন, তিনি চাইলে অবিলম্বে তাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন। আর যদি তাঁর হিকমতে বিলম্ব করার প্রয়োজন হয়, তবে বিলম্বে পাকড়াও করেন। আরবী ভাষায় مكر গুপ্ত ষড়যন্ত্র ও কৌশলের সাথে কাজ করাকে বলে; তা ভালও হতে পারে, আবার মন্দও হতে পারে। এখানে আল্লাহর (আচমকা) শাস্তি ও পাকড়াওকে ‘দুরভিসন্ধি বা ষড়যন্ত্র’ বলা হয়েছে।
* [১] يُسَيِّرُكُمْ তিনি তোমাদেরকে ভ্রমণ করান বা চলা-ফেরা ও ভ্রমণ করার তওফীক দেন। ‘স্থলভাগে’ অর্থাৎ তিনি তোমাদেরকে পা দান করেছেন যার দ্বারা তোমরা চলাফেরা কর, যানবাহনের ব্যবস্থা করেছেন, যার উপর অরোহণ করে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ কর। ‘জলভাগে’ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে নৌকা ও জলজাহাজ তৈরী করার জ্ঞান দান করেছেন, তোমরা তা তৈরী করে তার মাধ্যমে সাগরে ভ্রমণ কর। (যে বস্তু দ্বারা তোমরা নৌযান তৈরী কর, তাকে পানির উপর ভাসার প্রকৃতি দান করেছেন।)
[২] أُحِيْطَ بِهِمْ এর অর্থ হল, যেরূপ শত্রু কোন সম্প্রদায় বা কোন শহরকে বেষ্টন করে বা ঘিরে ফেলে এবং সেই সম্প্রদায় শত্রুর দয়ার উপর নির্ভরশীল থাকে, অনুরূপ যখন তারা তুফান ও বড় বড় তরঙ্গের মাঝে বেষ্টিত হয়, তখন তারা মৃত্যুকে তাদের সম্মুখে দেখতে পায়।
[৩] অর্থাৎ তখন তারা দু’আতে গায়রুল্লাহকে শরীক করে না, যেমন তারা স্বাভাবিক অবস্থায় করে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় তারা বলে যে, এই বুযুর্গ ব্যক্তিরাও আল্লাহর খাস বান্দা, আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকেও এখতিয়ার দিয়ে রেখেছেন এবং তাঁদের দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চাই। কিন্তু যখন এই রূপ বালা-মসীবতে পড়ে, তখন ঐ সকল শয়তানী যুক্তি ভুলে যায় এবং শুধু আল্লাহকে স্মরণ করে ও একমাত্র তাঁকেই ডাকে। এতে প্রথমতঃ এই কথা বুঝা যায় যে, মানুষের প্রকৃতিতে এক আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ পরিবেশে প্রভাবিত হয়ে সেই প্রবণতা বা প্রকৃতিকে চাপা দিয়ে ফেলে; কিন্তু মসীবতের সময় উক্ত প্রবণতা মানব মনে স্বতঃ বিকাশ লাভ করে বা উক্ত তওহীদী প্রকৃতি ফিরে আসে। আরো বুঝা গেল যে, তওহীদ মানুষের প্রকৃতিগত মৌলিক বস্তু, যা থেকে মানুষের বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়। কারণ তওহীদ থেকে বিচ্যুত থাকা, সহজাত প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত থাকার নামান্তর; যা সরাসরি ভ্রষ্টতা। দ্বিতীয়তঃ এই কথা বুঝা যায় যে, মুশরিকরা যখন এরূপ মসীবতের সম্মুখীন হত, তখন তারা তাদের তৈরী করা উপাস্যদেরকে ছেড়ে একমাত্র আল্লাহকেই ডাকত। সুতরাং ইকরামা বিন আবু জাহল সর্ম্পকে পাওয়া যায় যে, মক্কা বিজয়ের পর তিনি মক্কা থেকে (কাফের অবস্থায়) পালিয়ে যান। তিনি হাবশাহ যাওয়ার জন্য এক নৌকায় বসেন। নৌকা সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে পড়লে নৌকার মাঝি যাত্রীগণকে বলল যে, এখন এক আল্লাহর নিকট দু’আ কর, কারণ তোমাদেরকে তিনি ছাড়া এই তুফান থেকে পরিত্রাণ দানকারী আর কেউ নেই। ইকরামা বলেন, আমি মনে মনে ভাবলাম, যদি সমুদ্রের মাঝে পরিত্রাণ দাতা একমাত্র আল্লাহ হন, তাহলে অবশ্যই স্থলভাগেও পরিত্রাণ দাতা একমাত্র তিনিই হবেন। আর মুহাম্মাদ তো সেই কথাই বলেন। সুতরাং তিনি স্থির করে নিলেন, যদি আমি এখান থেকে বেঁচে জীবিত ফিরে যেতে পারি, তাহলে মক্কা ফিরে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করব। সুতরাং তিনি নবী (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে মুসলমান হয়ে যান। (নাসাঈ, আবু দাউদ ২৬৮৩নং) কিন্তু পরিতাপের বিষয়! উম্মতে মুহাম্মাদীর কিছু মানুষ এমনভাবে শির্কে ফেঁসে আছে যে, বালা-মসীবত ও কষ্টের সময়েও তারা আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া বাদ দিয়ে মৃত বুযুর্গ ব্যক্তিদেরকেই ত্রাণকর্তা মনে করে এবং তাঁদেরকেই সাহায্যের জন্য আহবান করে! সুতরাং ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রা-জিঊন। فليبك على الإسلام من كان باكيًا।
* [১] এটা মানুষের সেই অকৃতজ্ঞ (নিমকহারাম) স্বভাবের বর্ণনা, যা ১২নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। তাছাড়া কুরআনের আরো বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআলা এর বর্ণনা দিয়েছেন।
[২] আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা অকৃতজ্ঞতা ও বিদ্রোহাচরণ করে নাও। তোমরা ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর জীবন উপভোগ করে পরিশেষে তোমাদেরকে আমার নিকটেই ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্মের দস্ত্তরমত শাস্তি দেব।
তাফসীরে আবুবকর জাকারিয়া বলেছেন:-
* [১] অর্থাৎ যখনই আল্লাহর রহমতে তোমাদের বিপদ দূরীভূত হয়েছে তখনই তোমরা এ বিপদ আসার ও দূরীভূত হবার হাজারটা ব্যাখ্যা (চালাকি) করতে শুরু করে থাকো। এখানে বিপদ বলে সার্বিক বিপদ হলেও কোন কোন মুফাসসিরের মতে, অনাবৃষ্টির পরে বৃষ্টি, খরার পরে সতেজতা আসা। [কুরতুবী; ইবন কাসীর] এটা যে আমার নিদর্শন সেটা স্বীকার করতে চাও না। বরং তোমরা আমাদের নিদর্শন নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে থাক। [কুরতুবী] তারা তখন হককে প্রতিহত করার জন্য বাতিল নিয়ে আসে। [সা’দী] এভাবে তারা তাওহীদকে মেনে নেয়া থেকে নিস্কৃতি পেতে এবং নিজেদের শির্কের ওপর অবিচল থাকতে চায়।
[২] আয়াতে আল্লাহর ক্ষেত্রেও (مكر) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী অভিধান অনুসারে (مكر) বলা হয় গোপন পরিকল্পনাকে, যা ভালও হতে পারে এবং মন্দও হতে পারে। এ ব্যাপারে সূরা বাকারার ১৫ নং আয়াতে বিস্তারিত টিকা দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও তোমরা যা কিছু করবে আল্লাহর ফেরেশতারা তা লিখে নিতে থাকবেন। এভাবে এক সময় অকস্মাৎ মৃত্যুর পয়গাম এসে যাবে। তখন নিজেদের কৃতকর্মের হিসাব দেবার জন্য তোমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তিনি তোমাদের ছোট বড় সবকিছুর প্রতিদান দিবেন। [ইবন কাসীর]
* [১] এর সমার্থে আরো আয়াত দেখুন, সূরা আল-ইসরাঃ ৬৭।
[২] অর্থাৎ তোমাদের অন্যায়-অনাচারের বিপদ তোমাদেরই উপর পড়ছে। এতে বুঝা যাচ্ছে, যুলুমের কারণে বিপদ অবশ্যম্ভাবী এবং দুনিয়াতেও তা ভোগ করতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ অন্যায়-অনাচার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি আখেরাতের পূর্বে দুনিয়াতেই আল্লাহর পক্ষ থেকেই প্রাপ্ত হওয়া উপযুক্ত। তদুপরি আখেরাতে তার শাস্তি তো রয়েছেই। [আবু দাউদঃ ৪৯০২, তিরমিযীঃ ২৫১১, ইবনে মাজাহঃ ৪২১১] অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ দু’টি গোনাহর শাস্তি তাড়াতাড়ি দেয়া হয়, দেরী করা হয় না। অন্যায়-অনাচার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা’। [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৬, বুখারী আদাবুল মুফরাদঃ ৮৯৫, হাকেম মুস্তাদরাকঃ ৪/১৭৭] তাছাড়া হাদীসে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “সীমালঙ্ঘন বা যুলুম করো না, আল্লাহ যুলুমকারীকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ বলেনঃ তোমাদের যুলুম তো তোমাদের নিজের নফস বা আত্মার উপরই”। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩৩৮]
[৩] এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক. তোমাদের সীমালঙ্ঘন তো দুনিয়ার ভোগ অর্জনের জন্যই। দুই সীমালঙ্ঘন করে তোমরা দুনিয়ার ভোগ অর্জন করতে পারবে। তিন. তোমাদের সীমালঙ্ঘনের মাধ্যমে কেবল দুনিয়ার জীবনের সময়টুকুতেই উপকৃত হতে পারবে। চার. তোমরা যে সীমালঙ্ঘন করছ তার উদাহরণ হচ্ছে দুনিয়ার জীবনে ভোগ অর্জনের মত। [ফাতহুল কাদীর]
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Yunus
Sura: 10
Verses :- 21-23
فَلَمَّا أَنجَاهُمْ
When He delivers them,
Man changes when He receives Mercy after Times of Distress
Allah tells;
وَإِذَا أَذَقْنَا النَّاسَ رَحْمَةً مِّن بَعْدِ ضَرَّاء مَسَّتْهُمْ
And when We let mankind taste mercy after some adversity has afflicted them,
Allah tells us that when He makes men feel His mercy after being afflicted with distress,
إِذَا لَهُم مَّكْرٌ فِي ايَاتِنَا
behold! They take to plotting against Our Ayat.
The coming of mercy after distress is like the coming of ease after hardship, fertility after aridity, and rain after drought.
Mujahid said that;
man’s attitude indicates a mockery and belying of blessings.
The meaning here is similar to Allah’s statement:
وَإِذَا مَسَّ الاِنسَـنَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنبِهِ أَوْ قَاعِدًا أَوْ قَأيِمًا
And when harm touches man, he invokes Us, lying on his side, or sitting or standing. (10:12)
Al-Bukhari recorded that;
Allah’s Messenger led the Subh (Dawn) prayer after it had rained during the night, then he said:
هَلْ تَدْرُونَ مَاذَا قَالَ رَبُّكُمُ اللَّيْلَةَ
Do you know what your Lord has said last night?
They replied, “Allah and His Messenger know better.”
He said:
قَالَ أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِي مُوْمِنٌ بِي وَكَافِرٌ
فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَاكَ مُوْمِنٌ بِي كَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَاكَ كَافِرٌ بِي مُوْمِنٌ بِالْكَوْكَب
Allah said; “This morning, some of My servants have become believers and some disbelievers in Me.
He who said:`We have had this rainfall due to the grace and mercy of Allah’ is a believer in Me and a disbeliever in the stars. And he who said `we have had this rainfall due to the rising of such and such star’ is a disbeliever in Me and a believer in the stars.
The Ayah:
قُلِ اللّهُ أَسْرَعُ مَكْرًا
Say:”Allah is more swift in planning!”
means that Allah is more capable of gradually seizing them with punishment, while granting them concession of a delay until the criminals think that they would not be punished. But in reality they are in periods of respite, then they will be taken suddenly.
إنَّ رُسُلَنَا يَكْتُبُونَ مَا تَمْكُرُونَ
Certainly, Our messengers (angels) record all of that which you plot.
The noble writers (meaning the angels who write the deeds) will write everything that they do and keep count of their deeds. Then they will present it before the All-Knowing of the seen and unseen worlds. The Lord will then reward them for the significant deeds and even the seemingly insignificant that may be as tiny as a spot on a date pit.
Allah further states.
هُوَ الَّذِي يُسَيِّرُكُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ
He it is Who enables you to travel through land and sea…
which means that He preserves you and maintains you with His care and watching.
حَتَّى إِذَا كُنتُمْ فِي الْفُلْكِ وَجَرَيْنَ بِهِم بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ وَفَرِحُواْ بِهَا
Till when you are in the ships, and they sail with them with a favorable wind, and they are glad therein…
meaning smoothly and calmly;
جَاءتْهَا
then comes (these ships),
رِيحٌ عَاصِفٌ
a stormy wind,
وَجَاءهُمُ الْمَوْجُ مِن كُلِّ مَكَانٍ
and the waves come to them from all sides,
وَظَنُّواْ أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ
and they think that they are encircled therein,
meaning that are going to be destroyed.
دَعَوُاْ اللّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ
Then they invoke Allah, making their faith pure for Him (alone),
meaning that in this situation they would not invoke an idol or statue besides Allah. They would single Him out alone for their supplications and prayers.
This is similar to Allah’s statement:
وَإِذَا مَسَّكُمُ الْضُّرُّ فِى الْبَحْرِ ضَلَّ مَن تَدْعُونَ إِلَا إِيَّاهُ فَلَمَّا نَجَّـكُمْ إِلَى الْبَرِّ أَعْرَضْتُمْ وَكَانَ الاِنْسَـنُ كَفُورًا
And when harm touches you upon the sea, those that you call upon vanish from you except Him (Allah alone). But when He brings you safe to land, you turn away (from Him). And man is ever ungrateful. (17:67)
And in this Surah, He says:
دَعَوُاْ اللّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ
لَيِنْ أَنجَيْتَنَا مِنْ هَـذِهِ
They invoke Allah, making their faith pure for Him (saying):”If You (Allah) deliver us from this (situation).”
لَنَكُونَنِّ مِنَ الشَّاكِرِينَ
“We shall truly, be of the grateful.”
This means that we will not ascribe others as partners with You. We will later worship You alone as we are praying to You here and now.
Allah states.
فَلَمَّا أَنجَاهُمْ
But when He delivers them,
from that distress,
إِذَا هُمْ يَبْغُونَ فِي الَارْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ
behold! They rebel (disobey Allah) in the earth wrongfully…
meaning:they returned as if they had never experienced any difficulties and had never promised Him anything.
So Allah said:
كَأَن لَّمْ يَدْعُنَأ إِلَى ضُرٍّ مَّسَّهُ
He passes on as if he had never invoked Us for a harm that touched him! (10:12)
Allah then said:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا بَغْيُكُمْ عَلَى أَنفُسِكُم
O mankind! Your rebellion (disobedience to Allah) is only against yourselves,
it is you yourselves that will taste the evil consequence of this transgression. You will not harm anyone else with it, as comes in the Hadith,
مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرَ أَنْ يُعَجِّلَ اللهُ عُقُوبَتَهُ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ اللهُ لِصَاحِبِهِ فِي الاْاخِرَةِ مِنَ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِم
There is no sin that is more worthy that Allah hasten punishment for in this world — on top of the punishment that Allah has in store for it in the Hereafter — than oppression and cutting the ties of the womb.
Allah’s statement:
مَّتَاعَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
a brief enjoyment of this worldly life…
means that you only have a short enjoyment in this low and abased worldly life.
ثُمَّ إِلَينَا مَرْجِعُكُمْ
then (in the end) unto Us is your return…
meaning your goal and final destination.
فَنُنَبِّيُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ
and We shall inform you of that which you used to do.
and We shall inform you of all your deeds. Then we shall recompense you for them.
So let him who finds good (in his record) praise Allah, and let him who finds other than that blame no one but himself.