أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 733)
[ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا
খুঁটি ছাড়া, তোমরা তা দেখছ..
Without any pillars that you can see…]
www.motaher21.net
اَللّٰہُ الَّذِیۡ رَفَعَ السَّمٰوٰتِ بِغَیۡرِ عَمَدٍ تَرَوۡنَہَا ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ وَ سَخَّرَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ یَّجۡرِیۡ لِاَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ یُدَبِّرُ الۡاَمۡرَ یُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ بِلِقَآءِ رَبِّکُمۡ تُوۡقِنُوۡنَ ﴿۲﴾
আল্লাহ্, যিনি আসমানসমূহ উপরে স্থাপন করেছেন খুঁটি ছাড়া , তোমরা তা দেখছ । তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়মাধীন করেছেন ; প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলবে । তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন, আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন , যাতে তোমরা তোমাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাত সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার ।
It is Allah who erected the heavens without pillars that you [can] see; then He established Himself above the Throne and made subject the sun and the moon, each running [its course] for a specified term. He arranges [each] matter; He details the signs that you may, of the meeting with your Lord, be certain.
وَ ہُوَ الَّذِیۡ مَدَّ الۡاَرۡضَ وَ جَعَلَ فِیۡہَا رَوَاسِیَ وَ اَنۡہٰرًا ؕ وَ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ جَعَلَ فِیۡہَا زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ یُغۡشِی الَّیۡلَ النَّہَارَ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ ﴿۳﴾
তিনিই ভূতলকে বিস্তৃত করেছেন এবং ওতে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক প্রকারের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।তিনি দিনকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন; এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।
And it is He who spread the earth and placed therein firmly set mountains and rivers; and from all of the fruits He made therein two mates; He causes the night to cover the day. Indeed in that are signs for a people who give thought.
وَ فِی الۡاَرۡضِ قِطَعٌ مُّتَجٰوِرٰتٌ وَّ جَنّٰتٌ مِّنۡ اَعۡنَابٍ وَّ زَرۡعٌ وَّ نَخِیۡلٌ صِنۡوَانٌ وَّ غَیۡرُ صِنۡوَانٍ یُّسۡقٰی بِمَآءٍ وَّاحِدٍ ۟ وَ نُفَضِّلُ بَعۡضَہَا عَلٰی بَعۡضٍ فِی الۡاُکُلِ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ ﴿۴﴾
পৃথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূ-খন্ড; ওতে আছে আঙ্গুর-কানন, শস্যক্ষেত্র, একাধিক ফেঁকড়া-বিশিষ্ট অথবা ফেঁকড়াহীন খেজুর বৃক্ষ, যা একই পানিতে সিঞ্চিত হয়ে থাকে। ফল হিসাবে ওগুলির কতককে কতকের উপর আমি উৎকৃষ্টতা দিয়ে থাকি, অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।
And within the land are neighboring plots and gardens of grapevines and crops and palm trees, [growing] several from a root or otherwise, watered with one water; but We make some of them exceed others in [quality of] fruit. Indeed in that are signs for a people who reason.
সুরা: রাদ
সুরা:১৩
২-৪ নং আয়াত:-
بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا
খুঁটি ছাড়া, তোমরা তা দেখছ..
Without any pillars that you can see…
২-৪ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পরিপূর্ণ ক্ষমতার বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বিনা খুঁটিতে আকাশমণ্ডলী সুঊচ্চে স্থাপন করে রেখেছেন যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। এটা কি আল্লাহ তা‘আলা র কুদরত ও ক্ষমতার ওপর প্রমাণ বহন করে না? অবশ্যই বহন করে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(خَلَقَ السَّمٰوٰتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا وَأَلْقٰي فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيْدَ بِكُمْ)
“তিনি আসমান সৃষ্টি করেছেন স্তম্ভ ব্যতিরেকে, তোমরা তা দেখছ। তিনি পৃথিবীতে সুউচ্চ পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে।” (সূরা লুকমান ৩১:১০)
সুতরাং এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা, বড়ত্ব ও মর্যাদা প্রতীয়মান হয়। কেননা, এরূপ খুঁটি বিহীন কোন কিছুকে শূন্যের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তা কেবল মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার দ্বারাই সম্ভব। এখানে تَرَوْنَهَا এর দু‘টো অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, এর খুঁটি রয়েছে কিন্তু আমরা তা দেখতে পাই না। দ্বিতীয়ত হচ্ছে তাতে কোনই খুঁটি নেই। আর এই অর্থটিই কুরআনের আয়াতের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।
(وَيُمْسِكُ السَّمَا۬ءَ أَنْ تَقَعَ عَلَي الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِه۪)
“আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন যাতে তা পতিত না হয় পৃথিবীর উপর তাঁর অনুমতি ব্যতীত।” (সূরা হজ্জ্ব ২২:৬৫)
এই আয়াতও প্রমাণ করে আকাশের কোন খুঁটি নেই।
( ثُمَّ اسْتَوٰی عَلَی الْعَرْشِ)
‘অতঃপর তিনি ‘আরশে সমুন্নত হলেন’ আল্লাহ তা‘আলা স্বসত্তায় আরশের উপর রয়েছেন, কিভাবে রয়েছেন তা তিনিই ভাল জানেন, এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা নিষেধ। তবে অবশ্যই প্রত্যেক মু’মিনকে বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর রয়েছেন। যেমন
আল্লাহ তা‘আলার অবস্থান সম্পর্কে ইমাম মালেক (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন:
الاستواء معلوم، والكَيْف مجهول، والإِيمان به واجب، والسؤال عنه بدعة
আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপর রয়েছেন তা জানা কথা, কিভাবে আছেন তা অজ্ঞাত, এর প্রতি ঈমান আনা ওয়াজিব এবং কোন প্রশ্ন করা বিদ‘আত। (আযওয়াউল বায়ান ৭/২৯৫) এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফ এর ৫৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ)
‘সূর্য ও চন্দ্রকে (তোমাদের কল্যাণে) নিয়োজিত করেছেন’ অর্থাৎ সূর্য ও চন্দ্র মানুষের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সূর্যের আলো পেয়ে গাছ-পালা, তরুলতা, ফসল-ফলাদি ইত্যাদি জন্মাবে এবং সূর্য আলো দিয়ে দিনকে মানুষের কর্মের উপযোগী করে দিবে। আর চন্দ্রের স্নিগ্ধ আলো মানুষ উপভোগ করবে এবং দিন-তারিখ ও মাস গণনা করবে।
(کُلٌّ یَّجْرِیْ لِاَجَلٍ مُّسَمًّی)
‘প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আবর্তন করে’ এর দুটো অর্থ হতে পারে: প্রথমত: প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত চলবে বলতে কিয়ামত পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে। যেমন
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالشَّمْسُ تَجْرِيْ لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ط ذٰلِكَ تَقْدِيْرُ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ)
“আর সূর্য নিজ কক্ষ পথে চলতে থাকে। (স্থির হওয়া সময় পর্যন্ত) এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ।” (সূরা ইয়াছিন ৩৬:৩৮)
এখানে স্থির হওয়ার সময় বলতে কিয়ামতকে বুঝানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত চন্দ্র ও সূর্য উভয়েই নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তন করে। সূর্য নিজের চক্র এক বছরে এবং চন্দ্র এক মাসে পূর্ণ করে নেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَالْقَمَرَ قَدَّرْنٰهُ مَنَازِلَ)
“আমি চন্দ্রের জন্য নির্ধারণ করেছি বিভিন্ন কক্ষপথ।” (ইয়াসীন ৩৬:৩৯)
এখানে শুধু চন্দ্র ও সূর্যের কথা উল্লেখ করার কারণ এই যে, এ দুটো গ্রহই সর্ববৃহৎ, আর এ দুটোই মানুষের চোখে পড়ে সহজেই। এ দুটো যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা র অধীনস্থ তাহলে আর যে সব ছোট ছোট গ্রহ রয়েছে সেগুলো তো আল্লাহ তা‘আলার হুকুম মেনে চলতে আরো বাধ্য। আর এরা যখন আল্লাহ তা‘আলার হুকুম মেনে চলে তখন এরা মা‘বূদ হতে পারে না। মা‘বূদ তো তিনিই যিনি এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন
(وَّالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُوْمَ مُسَخَّرٰتٍم بِأَمْرِه۪)
“আর সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি, যা তাঁরই আজ্ঞাধীন।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৫৪)
যেহেতু এরা আল্লাহ তা‘আলার আজ্ঞাধীন তাই এদের ইবাদত বা উপাসনা করা যাবে না। কারণ উপাসনার যোগ্য সেই যে কারো হুকুম মেনে চলে না বরং সে অন্যকে হুকুম করে আর সবাই তাঁর হুকুম মেনে চলে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَا تَسْجُدُوْا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوْا لِلّٰهِ الَّذِيْ خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ)
“তোমরা সূর্যকে সিজদা কর না, চন্দ্রকেও নয়; সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর।” (হা-মীম-সাজদাহ ৪১:৩৭)
অনেক লোক অজান্তেই এ চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রের পূজা করে; যেমন নববর্ষের সূর্যকে বরণ করার জন্য সমুদ্রের উপকূলে গমন করে, সেদিন ভাল কিছু খায় ইত্যাদি। সেদিনে সূর্যকে বরণ করে নিলে এবং ভাল কিছু খেলে সারা বছর ভাল যাবে বলে মনে করা হয়। অথচ মানুষের ভাল-মন্দের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তাই যদি কিছু করতেই হয় তাহলে সূর্যকে বরণ না করে নতুন বছরের শুরুতে আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাওয়া উচিত, তিনি যেন সারা বছর ভালভাবে জীবন-যাপন করার তাওফীক দান করেন এবং বিগত বছরের অপরাধ স্বীকার করে আগামী বছরে তা সংশোধন করে নেয়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বেশি বেশি ভাল কাজ করা সেই সাথে সূর্য পূজা-সহ সকল প্রকার শির্ক ও কুসংস্কার থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এ বিষয়ে ইবরাহীম (عليه السلام) থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত যে, ইবরাহীম (عليه السلام) প্রথমে সঠিক মা‘বূদকে না চিনে চন্দ্র ও সূর্যকে মা‘বূদ মনে করেছিলেন কিন্তু সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে সব বর্জন করে সকল কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার দিকে অভিমুখী হলেন এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা শুরু করলেন। এ সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৭৬-৭৯ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(يُدَبِّرُ الْأَمْرَ) ‘তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন’ এর তাফসীর সূরা ইউনুস এর ৩ নং আয়াতে করা হয়েছে।
এতসব নিদর্শন বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হল, যাতে করে মানুষ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনে। কিয়ামত দিবসে তাঁর সাক্ষাৎকে স্বীকার করে ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা ঊর্ধ্বজগতের বর্ণনা দেয়ার পর এখানে নিম্নজগতের বর্ণনা দিয়েছেন যে, তিনিই জমিনকে বিস্তৃত করেছেন দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সহকারে। مَدَّ অর্থ বিস্তৃত করা। অর্থাৎ আকাশ-জমিন মিলিত ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আলাদা করে পৃথিবীকে বিস্তৃত করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَوَلَمْ يَرَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْآ أَنَّ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنٰهُمَا ط وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَا۬ءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ط أَفَلَا يُؤْمِنُوْنَ )
“যারা কুফরী করে তারা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে, অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম; এবং সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করলাম পানি হতে; তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?” (সূরা আম্বিয়া ২১:৩০)
উঁচু ও বিশাল পাহাড় তিনিই ভূ-পৃষ্ঠে স্থাপন করেছেন। নদী-নালা, সমুদ্র ও ঝর্ণার এমন ব্যবস্থাপনা রেখেছেন। যার দ্বারা মানুষ নিজেও উপকৃত হয় এবং ক্ষেত-খামারেও সেচন করে থাকে। এর ফলে জমিনে বিভিন্ন রং, বিভিন্ন স্বাদ ও আকারের ফল-ফলাদি উৎপন্ন হয়। এখানে (زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ) এর দু‘টো অর্থ হতে পারে। প্রথমত এর দ্বারা নর-মাদী দু‘টোই বানিয়েছেন এরকম অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমনটি আধুনিক বিজ্ঞানীরা সত্যায়ন করেছেন। আবার এর দ্বারা বিপরীতমুখী অর্থও গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন টক-মিষ্টি, ঠাণ্ডা-গরম, সুস্বাদু-বিস্বাদ, সাদা-কালো এই অর্থও গ্রহণ করা যেতে পারে।
তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। এরা পর্যায়ক্রমে আসা-যাওয়া করছে একটির আগমন ঘটছে এবং অপরটির প্রস্থান। এই সবগুলোই প্রমাণ করছে যে, সারা বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হচ্ছেন এক আল্লাহ তা‘আলা যিনি অদ্বিতীয় ও অংশীবিহীন। আর এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানী ও চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য। যদি কেউ এসব বিষয় নিয়ে সঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে সে নিশ্চিত সু-পথ প্রাপ্ত হবে।
قِطَعٌ -(وَفِي الْأَرْضِ قِطَعٌ مُتَجَاوِرَاتٌ)
অর্থ ভূ-খণ্ড, আর مُتَجَاوِرَاتٌ অর্থ পাশাপাশি, প্রতিবেশি। অর্থাৎ পৃথিবীতে যে ভূ-খণ্ড রয়েছে তা পরস্পর সংলগ্ন, একে অপরের পাশাপাশি ও নিকটবর্তী। তা সত্ত্বেও সর্বত্র একই রকম ফলমূল উৎপন্ন হয় না। কিছু জায়গা আছে যেখান আঙ্গুর হয়, আবার কিছু জায়গা আছে যেখান আঙ্গুর হয় না। এক দেশের খেজুর, ধান ও অন্যান্য ফলাদি আরেক দেশে হয় না। অথচ একটি পৃথিবী, একই আকাশ থেকে একই প্রকার বৃষ্টি হয়। কোন জমি খুবই উর্বর আবার কোন জমি অনুর্বর, আবার কোনটি এমন যাতে কোন ফসলই উৎপন্ন হয় না। এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে আল্লাহ তা‘আলাকে চেনার।
صِنْوَانٌ বলা হয় যার মূল একটি কিন্তু এর শাখা-প্রশাখা অনেকগুলো। যেমন, ডালিম, ডুমুর ইত্যাদি।
(وَغَيْرُ صِنْوَانٍ)
বলা হয় যার একটিই মূল থাকে এবং তাঁর থেকে কোন শাখা-প্রশাখা বের হয় না। যেমন তালগাছ, নারিকেল গাছ, খেজুর গাছ, সুপারি গাছ ইত্যাদি। সবগুলোর জন্য অর্থাৎ
صِنْوَانٌ ও وَغَيْرُ صِنْوَانٍ
এর জন্য একই পানি থেকে সেচ দেয়া হয় অর্থাৎ বর্ষার পানি এবং একই মাটি থেকে উৎপন্ন। অথচ স্বাদের দিক দিয়ে, ছোট-বড় হওয়ার দিক দিয়ে ফলের মধ্যে বড়ই পার্থক্য রয়েছে। এগুলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই করে থাকেন অন্য কেউ নয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আকাশের উচ্চতায় কোন খুঁটি প্রয়োজন হয়নি।
২. সূর্য-চন্দ্র প্রত্যেকের একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ রয়েছে।
৩. মৃত্যুর পর মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে।
৪. পৃথিবীতে যে সমস্ত পাহাড় রয়েছে তা জমিনের জন্য পেরেকস্বরূপ করা হয়েছে।
৫. প্রত্যেক প্রকারের ফল জোড়ায় জোড়ায় বিদ্যমান।
৬. একই মাটি থেকে একই পানির সিঞ্চনে বিভিন্ন প্রকারের ফল উৎপন্ন হয়।
৭. সকল কিছুর প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# অন্য কথায় আকাশসমূহকে অদৃশ্য ও অননুভূত স্তম্ভসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আপাতদৃষ্টে মহাশূন্যে এমন কোন জিনিস নেই, যা এ সীমাহীন মহাকাশ ও নক্ষত্র জগতকে ধরে রেখেছে। কিন্তু একটি অননুভূত শক্তি তাদের প্রত্যেককে তার নিজের স্থানে ও আবর্তন পথের ওপর আটকে রেখেছে এবং মহাকাশের এ বিশাল বিশাল নক্ষত্রগুলোকে পৃথিবীপৃষ্ঠে বা তাদের পরস্পরের ওপর পড়ে যেতে দিচ্ছে না।
# এর ব্যাখ্যার জন্য সূরা আ’রাফের ৪১ টীকা দেখুন। তবে সংক্ষেপে এখানে এতটুকু ইশারা যথেষ্ট মনে করি যে, আরশের (অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল) ওপর আল্লাহর সমাসীন হবার ব্যাপারটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে কুরআনে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহানকে কেবল সৃষ্টিই করেননি বরং তিনি নিজেই এ রাজ্যের শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করছেন। এ সুবিশাল জগতটি এমন কোন কারখানা নয়, যা নিজে নিজেই চলছে, যেমন অনেক মূর্খ ও অজ্ঞ লোক ধারণা করে থাকে। আর এ প্রাকৃতিক জগতটি বহু ইলাহর বিচরণক্ষেত্র নয়, অন্য এক দল অজ্ঞ ও মূর্খ যেমনটি মনে করে বসে আছে বরং এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এর সৃষ্টিকর্তা নিজেই এ ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন।
# এখানে এ বিষয়টি সামনে রাখতে হবে যে, এমন এক কওমকে এখানে সম্বোধন করা হচ্ছে যারা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না, তিনি যে সবকিছুর স্রষ্টা তাও অস্বীকার করতো না এবং এখানে যেসব কাজের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ সেগুলোর কর্তা এ ধারণাও পোষণ করতো না। তাই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই যে এ আকাশসমূহ স্থাপন করেছেন এবং তিনিই চন্দ্র সূর্যকে একটি নিয়মের অধীন করেছেন, একথার সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়োজন বোধ করা হয়নি। বরং যেহেতু শ্রোতা নিজে এ সত্যগুলোর বিশ্বাস করতো, তাই এগুলোকে অন্য একটি মহাসত্যের জন্য যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। সে মহাসত্যটি হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া মাবুদ গণ্য হবার অধিকার রাখে এমন দ্বিতীয় কোন সত্তা এ বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী নয়। প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, যে ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্বই মানে না এবং তিনি যে বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও শাসনকর্তা সে কথা একেবারেই অস্বীকার করে তার মোকাবিলায় এ যুক্তি কেমন করে কার্যকর হতে পারে? এর জবাবে বলা যায়, মুশরিকদের মোকবিলায় তাওহীদকে প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ যেসব যুক্তি দেন নাস্তিকদের মোকাবিলায় আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য সেই একই যুক্তি যথেষ্ট। তাওহীদের সমস্ত যুক্তির ভিত্তিভূমি হচ্ছে এই যে, পৃথিবী থেকে নিয়ে আকাশ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব-জাহান একটি পূর্ণাংগ কারখানা এবং এ সমগ্র কারখানাটি চলছে একটি মহাপরাক্রান্ত শক্তির অধীনে। এর মধ্যে সর্বত্র একটি সার্বভৌম কর্তৃত্ব, একটি নিখুঁত প্রজ্ঞা ও নির্ভুল জ্ঞানের লক্ষণ প্রতিভাত। এ লক্ষণ ও চিহ্নগুলো যেমন একথা প্রকাশ করে যে, এ ব্যবস্থার বহু পরিচালক নেই তেমনি একথাও প্রকাশ করে যে, এ ব্যবস্থার একজন পরিচালক অবশ্যই রয়েছেন। প্রতিষ্ঠান থাকবে অথচ তার পরিচালক থাকবে না, আইন থাকবে অথচ শাসক থাকবে না, প্রজ্ঞা নৈপূণ্য ও দক্ষতা বিরাজ করবে অথচ কোন প্রাজ্ঞ, দক্ষ নিপুণ সত্তা থাকবে না, জ্ঞান থাকবে অথচ জ্ঞানী থাকবে না, সর্বোপরি সৃষ্টি থাকবে অথচ তার স্রষ্টা থাকবে না-এমন উদ্ভট ধারণা কেবল সেই ব্যক্তিই করতে পারে যে চরম হঠকারী ও গোঁয়ার অথবা যার বুদ্ধি বিভ্রম ঘটেছে।
# এ অবস্থা কেবল মাত্র একথার সাক্ষ্য দিচ্ছে না যে, সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন এক সত্তা এর ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালাচ্ছে এবং একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী প্রজ্ঞা এর মধ্যে কাজ করছে বরং এর সমস্ত অংশ এবং এর মধ্যে কর্মরত সমস্ত শক্তিই এ সাক্ষ্যও দিচ্ছে যে, এর কোন জিনিসই স্থায়ী নয়। প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য একটি সময় নির্ধারিত রয়েছে। সেই সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে এবং সময় শেষ হয়ে গেলে খতম হয়ে যায়। এ সত্যটি যেমন এ কারখানার প্রত্যেকটি অংশের ব্যাপারে সঠিক তেমনি সমগ্র কারখানা বা স্থাপনাটির ব্যাপারেও সঠিক। এ প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামো জানিয়ে দিচ্ছে যে, এটি চিরন্তন ব্যবস্থা নয়, এর জন্যও কোন সময় অবশ্যি নির্ধারিত রয়েছে, যখন এ সময় খতম হয়ে যাবে তখন এর জায়গায় আর একটি জগত শুরু হয়ে যাবে। কাজেই যে কিয়ামতের আসার খবর দেয়া হয়েছে তার আসাটা অসম্ভব নয় বরং না আসাটাই অসম্ভব।
# রসূলুল্লাহ ﷺ যেসব সত্যের খবর দিচ্ছেন সেগুলোর যথার্থতা ও সত্যতা নিরূপক নিদর্শনাবলী। বিশ্ব-জাহানের সর্বত্র সেগুলোর পক্ষে সাক্ষ্য দেবার মতো নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। লোকেরা চোখ খুলে দেখলে দেখতে পাবে যে, কুরআনে যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেয়া হয়েছে, পৃথিবী ও আকাশে ছড়ানো অসংখ্য নিদর্শন সেগুলোর সত্যতা প্রমাণ করছে।
# ওপরে বিশ্ব-জাহানের যে নিদর্শনাবলীকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করা হয়েছে তাদের এ সাক্ষ্য তো একেবারেই সুস্পষ্ট যে, এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও পরিচালক একজনই কিন্তু মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন, আল্লাহ আদালতে মানুষের হাযির হওয়া এবং পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে রসূল্লাহ ﷺ যেসব খবর দিয়েছেন সেগুলোর সত্যতার সাক্ষ্যও এ নিদর্শনগুলোই দিচ্ছে। তবে এ সাক্ষ্য একটু অস্পষ্ট এবং সামান্য চিন্তা-ভাবনা করলে বোধগম্য হয়। তাই প্রথম সত্যটির ব্যাপারে সজাগ করে দেবার প্রয়োজনবোধ করা হয়নি। কারণ শ্রোতা শুধুমাত্র যুক্তি শুনেই বুঝতে পারে, এ থেকে কি কথা প্রমাণ হয়। তবে দ্বিতীয় সত্যটির ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। কারণ এ নিদর্শনগুলো সম্পর্কে চিন্ত-ভাবনা করলেই নিজের রবের দরবারে হাযির হবার ব্যাপারটির ওপর বিশ্বাস জন্মাতে পারে।
উপরোক্ত নিদর্শনগুলো থেকে আখেরাতের প্রমাণ দু’ভাবে পাওয়া যায়ঃ
একঃ যখন আমরা আকাশমণ্ডলীর গঠনাকৃতি এবং চন্দ্র ও সূর্যকে একটি নিয়মের অধীনে পরিচালনা করার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি তখনই আমাদের মন সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ এ বিশাল জ্যোতিষ্ক মণ্ডলী সৃষ্টি করেছেন এবং যাঁর অসীম শক্তি এ বিরাট বিরাট গ্রহ-নক্ষত্রকে মহাশূন্যে আবর্তিত করছে তাঁর মানব জাতিকে মৃত্যুর পর পুনর্বার সৃষ্টি করা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়।
দুইঃ এ মহাশূন্য ব্যবস্থা থেকে আমরা একথারও সাক্ষ্য লাভ করি যে, এর স্রষ্টা একজন সর্বজ্ঞ এ পরিপূর্ণ জ্ঞানবান সত্তা। তিনি মানব জাতিকে বুদ্ধিমান সচেতন এবং স্বাধীন চিন্তা কর্ম শক্তি সম্পন্ন সৃষ্টি হিসেবে তৈরী করার এবং নিজের যমীনের অসংখ্য বস্তুনিচয়ের ওপর তাদেরকে কর্তৃত্ব ক্ষমতা দান করার পর তাদের জীবনকালের বিভিন্ন কাজের হিসেব নেবেন না, তাদের মধ্যে যারা জালেম তাদেরকে জুলুম-অত্যাচারের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না এবং মজলুমদের ফরিয়াদ শুনবেন না, তাদের সৎলোকদেরকে সৎকাজের পুরস্কার এবং অসৎলোকদেরকে অসৎকাজের জন্য শাস্তি দেবেন না এবং তাদেরকে কখনো জিজ্ঞেসই করবেন না যে, আমি তোমাদের হাতে যে মূল্যবান আমানত সোপর্দ করেছিলাম তাকে তোমরা কিভাবে ব্যবহার করেছো-একথা তাঁর পূর্ণজ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে কখনো কল্পনাই করা যায় না। একজন অন্ধ ও কাণ্ডজ্ঞানহীন রাজা অবশ্যি নিজের রাজ্যের যাবতীয় কাজ-কারবার নিজের কর্মচারীদের হাতে সোপর্দ করে দিয়ে নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে গাফেল হয়ে যেতে পারেন কিন্তু একজন জ্ঞানী ও সচেতন রাজার কাছ থেকে কখনো এ ধরনের ভ্রান্তি, অসতর্কতা ও গাফলতি আশা করা যেতে পারে না।
আকাশ সম্পর্কে এ ধরনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ফলে পরকালীণ জীবন যে সম্ভবপর শুধু এ ধারণাই আমাদের মনে সৃষ্টি হয় না বরং তা যে একদিন অবশ্যি শুরু হবে এ ব্যাপারে সুদৃঢ় বিশ্বাস জন্মে।
# মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের পর পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এখানেও আল্লাহর শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শন থেকে পূর্বোক্ত দু’টি চিরন্তন সত্যের (তাওহীদ ও আখেরাত) স্বপক্ষে যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। ইতিপূর্বে পিছনের আয়াতগুলোতে মহাকাশ জগতের নিদর্শন সমূহ থেকে এরই সপক্ষে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছিল। এ দলীল-প্রমাণের সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে নিম্নরূপঃ
একঃ মহাকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর সাথে পৃথিবীর সম্পর্ক, পৃথিবীর সাথে সূর্য ও চন্দ্রের সম্পর্ক, পৃথিবীর অসংখ্য সৃষ্টির প্রয়োজনের সাথে পাহাড়-পর্বত ও নদী-সাগরের সম্পর্ক-এসব জিনিস এ মর্মে সুস্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, কোন পৃথক এক স্রষ্টা এদেরকে সৃষ্টি করেনি এবং বিভিন্ন স্বাধীন ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তা এদেরকে পরিচালনা করছে না। যদি এমনটি হতো তাহলে এসব জিনিসের মধ্যে এত বেশি পারস্পরিক সম্পর্ক সামঞ্জস্য ও একাত্মতা সৃষ্টি হতো না এবং তা স্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতেও পারতো না। পৃথক পৃথক স্রষ্ঠার জন্য এটা কেমন করে সম্ভবপর ছিল যে, তারা সবাই মিলে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টি ও পরিচালনার জন্য এমন পরিকল্পনা তৈরী করতেন, যার প্রত্যেকটি জিনিস পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত একটার সাথে আর একটা মিলে যেতে থাকতো এবং কখনো তাদের স্বার্থের মধ্যে কোন প্রকার সংঘাত হতো না?
দুইঃ পৃথিবীর এ বিশাল গ্রহটির মহাশূন্যে ঝুলে থাকা, এর উপরিভাগে এত বড় বড় পাহাড় জেগে ওঠা, এর বুকের ওপর এ বিশালকায় নদী ও সাগর গুলো প্রবাহিত হওয়া, এর মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের অসংখ্য বৃক্ষরাজির ফলে ফুলে সুশোভিত হওয়া এবং অত্যন্ত নিয়ম-শৃংখলাবদ্ধভাবে অনবরত রাত ও দিনের নিদর্শনের বিস্ময়করভাবে আবর্তিত হওয়া এসব জিনিস যে আল্লাহ এদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর শক্তিমত্তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এহেন অসীম শক্তিধর মহান সত্তাকে মানুষের মৃত্যুর পর পুনর্বার তাকে জীবন দান করতে অক্ষম মনে করা বুদ্ধি ও বিচক্ষনতার নয়, নিরেট নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ।
তিনঃ পৃথিবীর ভৌগোলিক রূপকাঠামো, তার ওপর পর্বতমালা সৃষ্টি, পাহাড় থেকে নদী ও ঝরণাধারা প্রবাহিত হবার ব্যবস্থা, সকল প্রকার ফলের মধ্যে দুধরণের ফল সৃষ্টি এবং রাতের পরে দিন ও দিনের পরে রাতকে নিয়মিতভাবে আনার মধ্যে যে সীমাহীন প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা সরবে সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে যে, যে আল্লাহ সৃষ্টির এ নকশা তৈরী করেছেন তিনি একজন পূর্ণ জ্ঞানী। এ সমস্ত জিনিসই এ সংবাদ পরিবেশন করে যে, এগুলো কোন সংকল্পবিহীন শক্তির কার্যক্রম এবং কোন উদ্দেশ্য বিহীন খেলোয়াড়ের খেলনা নয়। এর প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে একজন জ্ঞানীর জ্ঞান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিপক্ক প্রজ্ঞার সক্রিয়তা দৃষ্টিগোচর হয়। এসব কিছু দেখার পর শুধুমাত্র অজ্ঞ ও মূর্খই এ ধারণা করতে পারে যে, পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করে এবং তাকে এমন সংঘাতমুখর ঘটনাপ্রবাহ সৃষ্টির সুযোগ দিয়ে তিনি তাকে কোন প্রকার হিসেব নিকেশ ছাড়া এমনিই মাটিতে মিশিয়ে দেবেন।
# সারা পৃথিবীকে তিনি একই ধরনের একটি ভূখণ্ড বানিয়ে রেখে দেননি। বরং তার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য ভূখণ্ড। এ ভূখণ্ডগুলো পরস্পর সংলগ্ন থাকা সত্ত্বেও আকার-আকৃতি, রং, গঠন, উপাদান, বৈশিষ্ট্য, শক্তি ও যোগ্যতা এবং উৎপাদন ও রাসায়নিক বা খনিজ সম্পদে পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। এ বিভিন্ন ভূখণ্ডের সৃষ্টি এবং তাদের মধ্যে নানা প্রকার বিভিন্নতার অস্তিত্ব এত বিপুল পরিমাণ জ্ঞান ও কল্যাণে পরিপূর্ণ যে, তা গণনা করে শেষ করা যেতে পারে না। অন্যান্য সৃষ্টির কথা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মানুষের স্বার্থকে সামনে রেখে যদি দেখা যায় তাহলে অনুমান করা যেতে পারে যে, মানুষের বিভিন্ন স্বার্থ ও চাহিদা এবং পৃথিবীর এ ভূখণ্ডগুলোর বৈচিত্রের মধ্যে যে সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য পাওয়া যায় এবং এসবের বদৌলতে মানুষের সমাজ সংস্কৃতি বিকশিত ও সম্প্রসারিত হবার যে সুযোগ লাভ করে তা নিশ্চিতভাবেই কোন জ্ঞানী ও বিজ্ঞানময় সত্তার চিন্তা, তাঁর সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং বিজ্ঞতাপূর্ণ সংকল্পের ফলশ্রুতি। একে নিছক একটি আকস্মিক ঘটনা মনে করা বিরাট হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
# কিছু কিছু খেজুর গাছের মূল থেকে একটি খেজুর গাছ বের হয় আবার কিছু কিছুর মূল থেকে একাধিক গাছ বের হয়।
# এ আয়াতে আল্লাহর তাওহীদ এবং তাঁর শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শনাবলী দেখানো ছাড়া আরও একটি সত্যের দিকেও সূক্ষ্ম ইশারা করা হয়েছে। এ সত্যটি হচ্ছে, আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহানে কোথাও এক রকম অবস্থা রাখেননি। একই পৃথিবী কিন্তু এর ভূখণ্ডগুলোর প্রত্যেকের বর্ণ, আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। একই জমি ও একই পানি, কিন্তু তা থেকে বিভিন্ন প্রকার ফল ও ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। একই গাছ কিন্তু তার প্রত্যেকটি ফল একই জাতের হওয়া সত্ত্বেও তাদের আকৃতি, আয়তন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। একই মূল থেকে দু’টি ভিন্ন গাছ বের হচ্ছে এবং তাদের প্রত্যেকই নিজের একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যে ব্যক্তি এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে সে কখনো মানুষের স্বভাব, প্রকৃতি, ঝোঁক-প্রবণতা ও মেজাজের মধ্যে এতবেশী পার্থক্য দেখে পেরেশান হবে না। যেমন এ সূরার সামনের দিকে গিয়ে বলা হয়েছে, যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে সকল মানুষকে একই রকম তৈরী করতে পারতেন কিন্তু যে জ্ঞান ও কৌশলের ভিত্তিতে আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করেছেন তা সমতা, সাম্য ও একাত্মতা নয় বরং বৈচিত্র ও বিভিন্নতার প্রয়াসী। সবাইকে এক ধরনের করে সৃষ্টি করার পর তো এ অস্তিত্বের সমস্ত জীবন প্রবাহই অর্থহীন হয়ে যেতো।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# আল্লাহ তাআ’লা নিজের ক্ষমতার পূর্ণতা এবং সাম্রাজ্যের বিরাটত্বের খবর দিচ্ছেন যে, তিনি বিনা স্তম্ভে আকাশকে উর্ধে স্থাপন করেছেন। আকাশকে তিনি যমীন হতে কতই না উঁচুতে রেখেছেন! শুধু নিজের আদেশে ওটাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন যার শেষ সীমারেখার খবর কেউ রাখে না। দুনিয়ার আকাশ সারা যমীন এবং ওর চার পাশে পানি, বাতাস ইত্যাদি যা কিছু রয়েছে সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে রয়েছে। সব দিক থেকেই আসমান যমীন হতে সমানভাবে উঁচু রয়েছে। যমীন হতে আসমানের দুরত্ব হচ্ছে পাঁচ শ’ বছরের পথ। সবদিকেই ওটা এতোটা উঁচু। ওর পুরু ও ঘনত্বও পাঁচ শ’ বছরের ব্যবধানে আছে। আবার দ্বিতীয় আকাশ এই দুনিয়ার আকাশকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। প্রথম আকাশ হতে দ্বিতীয় আকাশের ব্যবধানও পাঁচ শ’ বছরের পথ। অনুরূপভাবে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আকাশও একে অপর হতে পাঁচ শ’ বছরের পথের দূরত্বে অবস্থিত। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ এমন যিনি সাতটি আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং অনুরূপ সংখ্যক যমীনও রয়েছে।” (৬৫: ১২)।
হাদীস শরীফে রয়েছে যে, সাতটি আকাশ এবং ওগুলির মাঝে যা কিছু রয়েছে সেগুলি কুরসীর তুলনায় এইরূপ যেইরূপ কোন প্রশস্ত ও বিরাট ময়দানে কোন একটা বৃত্ত। আর কুরসী আর্শের তুলনায় তদ্রুপ। আর্শের পরিমাপ মহা মহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা নেই। পূর্ববর্তী কোন কোন গুরুজনের বর্ণনা রয়েছে যে, আর্শ হতে যমীনের দূরত্ব পঞ্চাশ হাজার বছরের পথ।
কোন কোন মুফাসসির বলেন যে, আকাশের স্তম্ভ রয়েছে বটে, কিন্তু তা দেখা যায় না। কিন্তু আইয়াস ইবনু মুআ’বিয়া (রঃ) বলেন, আসমান যমীনের উপর গম্বুজের ন্যায় রয়েছে। অর্থাৎ তাতে কোন স্তম্ভ নেই। এই উক্তিটিই কুরআন কারীমের বাকরীতিরও যোগ্য বটে। এবং (আরবি) (২২: ৪ ৬৫) এই আয়াত দ্বারাও এটাই প্রতীয়মান হয়। সুতরাং (আরবি) এই কথা দ্বারা আকাশে স্তম্ভ না থাকার প্রতিই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আসমান বিনা স্তম্ভে এই পরিমাণ উঁচুতে রয়েছে এবং তোমরা তা স্বচক্ষে অবলোকন করছে। এটা হচ্ছে মহামহিমান্বিত আল্লাহর ব্যাপক ক্ষমতারই একটি নিদর্শন। উমাইয়া ইবনু সালাতের নিম্নের কবিতায় রয়েছে, যার কবিতা সম্পর্কে হাদীসে আছে, “তার কবিতা ঈমান এনেছে এবং তার অন্তর কুফরী করছে” আবার একথা ও বলা হয়েছে যে, এগুলি হচ্ছে হযরত যায়েদ ইবনু আমর ইবনু নুফাইলের (রাঃ) কবিতা। কবিতাগুলি নিম্নরূপঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আপনি সেই আল্লাহ যিনি স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে স্বীয় নবী মূসাকে (আঃ) হারুণ (আঃ) সহ রাসূল করে ফিরাউনের নিকট পাঠিয়েছিলেন। আপনি তাদেরকে বলেছিলেনঃ “তোমরা যাও এবং অবাধ্য ফিরাউনকে আল্লাহর দিকে আহবান করো এবং তাকে বললাঃ তুমি কি এই উঁচু আকাশকে বিনা স্তম্ভে নির্মাণ করেছো? তাতে সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি কি তুমিই সৃষ্টি করেছো? আর মাটি হতে ফসল উৎপাদনকারী এবং গাছে ফল সৃষ্টিকারী কি তুমি? ব্যাপক ক্ষমতাবান আল্লাহ তাআ’লার এই বিরাট বিরাট নিদর্শনাবলী কি গভীরভাবে চিন্তাকারী মানুষের জন্যে তার অস্তিত্বের দলীল নয়?”
‘অতঃপর আল্লাহ আর্শের উপর সমাসীন হলেন’ এর তাফসীর সুরায়ে আরাফে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে এটাও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি যেভাবে আছেন সে ভাবেই থাকবেন। অবস্থা, তুলনা, সাদৃশ্য ইত্যাদি থেকে আল্লাহর সত্ত্বা পবিত্র ও বহু উর্ধ্বে। সূর্য ও চন্দ্র তাঁরই নির্দেশক্রমে আবর্তিত হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত এরূপ ভাবেই আবর্তিত হতে থাকবে। যেমন-
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ ‘প্রত্যেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করে।’ বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ এ দু’টো এদের শেষ সময় পর্যন্ত অর্থাৎ কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তাআ’লা আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সূর্য ভ্রমণ করে ওর নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।” (৩৬: ৩৮) বলা হয়েছে যে, নির্দিষ্ট গন্তব্য দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আর্শের নীচে যা যমীনের নিম্নদেশের সাথে অন্য দিক থেকে মিলিত আছে। এটা এবং সমস্ত তারকা এখান পর্যন্ত পৌঁছে আর্শ থেকে আরো দূরে হয়ে যায়। কেননা, সঠিক কথা, যার উপর বহু দলীল প্রমাণ রয়েছে তা এই যে, ওটা গম্বুজ। পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত অবশিষ্ট আসমানের মতো ওটা পরিবেষ্টনকারী। কেননা ওর পায়া আছে এবং ওকে বহনকারী রয়েছেন। ঘূর্ণায়মান আকাশের ব্যাপারে এটা কল্পনায় আসতে পারে না। যে কেউই চিন্তা গবেষণা করবে সেই এটাকে সত্য বলে মেনে নেবে। কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান যাদের রয়েছে তাঁরা এই ফলাফলেই পৌঁছবেন। আল্লাহ তাআ’লার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা।
এখানে শুধুমাত্র সূর্য ও চন্দ্রের উল্লেখ করার কারণ এই যে, চলমান ৭ (সাতটি) গ্রহের মধ্যে এ দুটোই বড় ও উজ্জ্বল। সুতরাং এ দুটোই যখন নিয়মাধীন তখন অন্যগুলো তো নিয়মাধীন হওয়া স্বাভাবিক। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ ‘তোমরা সূর্য ও চন্দ্রকে সিজদা করো না। এর দ্বারা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ তোমরা অন্যান্য নক্ষত্রগুলোকেও সিজদা করো না। অন্য জায়গায় বিস্তারিত ভাবেও রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি তাঁর হুকুমের বাধ্য। সৃষ্টি ও হুকুম তাঁরই, তিনিই কল্যাণময় এবং তিনিই বিশ্বপ্রতিপালক।” (৭ :৫৪)।
আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ “তিনি নিদর্শন সমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।’ অর্থাৎ মানুষ যেন এ সব নির্দশন দেখে নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করতে পারে যে, আল্লাহ তাআ’লা তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার পর পুনরায় জীবিত করবেন এবং তাঁর কাছে তাদেরকে একত্রিত করা হবে।
# ৩-৪ নং আয়াতের তাফসীর
উর্ধ্বজগতের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তাআ’লা এখানে নিম্ন জগতের বর্ণনা দিয়েছেন। যমীনকে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বিস্তৃত করে আল্লাহ তাআ’লাই এটাকে বিছিয়ে দিয়েছেন। এতে দৃঢ় পাহাড় তিনিই স্থাপন করেছেন। এতে নদ-নদী ও প্রস্রবণ তিনিই প্রবাহিত করেছেন। এর ফলে বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন রং এর এবং বিভিন্ন স্বাদের ফল মূলের বৃক্ষাদি সিঞ্চিত হয়ে থাকে। জোড়ায় জোড়ায় ফলমূল তিনিই সৃষ্টি করেছেন। ওগুলির মধ্যে কোনটি মিষ্টি এবং কোনটি টক। দিবস ও রজনী পর্যায়ক্রমে আসা যাওয়া করছে। একটির আগমন ঘটছে এবং অপরটির প্রস্থান হচ্ছে। এইসব ব্যবস্থাপনা সেই ব্যাপক ক্ষমতাবান আল্লাহর দ্বারাই হচ্ছে। আল্লাহ তাআ’লার এইসব নিদর্শন, নিপুণতা এবং প্রমাণাদির উপর যে ব্যক্তি চিন্তাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে সে অবশ্যই সুপথ প্রাপ্ত হবে। যমীনের খণ্ডগুলি মিলিতভাবে রয়েছে। মহান আল্লাহর শক্তি দেখে বিস্মিত হতে হয় যে, পৃথিবীর এক খণ্ডে প্রচুর ফসল উৎপাদিত হয়, আবার আর একখণ্ডে কিছুই জন্মে না। কোন জায়গার মাটি লাল, কোন জায়গার মাটি সাদা, কোন মাটি কালো, কোনটি কংকরময়, কোনটা নরম, কোনটা শক্ত, কোনটা মিষ্টি, কোনটা তিক্ত, কোনটা বালুকাময় এবং কোনটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মোট কথা, এটাও সৃষ্টিকর্তার মহা শক্তির নিদর্শন, যা বলে দিচ্ছে যে, কার্য্য সম্পাদনকারী, স্বেচ্ছাচারী এবং সারা বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হচ্ছেন সেই একক, অদ্বিতীয় এবং অংশীবিহীন আল্লাহ। তিনিই হচ্ছেন সবকিছুরই সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া অন্য কেউ মা’বুদ নেই এবং কোন প্রতিপালকও নেই।
(আরবি) শব্দদ্বয়কে যদি (আরবি) শব্দের উপর বা সংযোগ ধরা হয় তবে পেশ দিয়ে পড়তে হবে। আর যদি (আরবি) শব্দের উপর সংযোগ ধরা হয় তবে (আরবি) ধরে যের দিয়ে পড়তে হবে। ইমামদের দল দু’ভাবেই পড়েছেন। (আরবি) বলা হয় ঐ গাছকে যার কয়েকটি গুঁড়ি ও শাখা হয়। যেমন ডালিম ডুমুর, এবং কোন কোন খেজুর গাছ। (আরবি) বলা হয় ঐ গাছকে যা এইরূপ হয় না বরং যার একটি মাত্র গুঁড়ি থাকে। এর থেকেই চাচাকে (আরবি) বলা হয়। হাদীসেও এটা এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমারকে (রাঃ) বলেনঃ “তোমার কি জানা নেই যে, চাচা পিতার মতই।”
হযরত বারা’ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, একটি মূল অর্থাৎ একটি গুঁড়ির মধ্যে কয়েকটি শাখা বিশিষ্ট খেজুরের গাছ থাকে, আবার একটি গুঁড়িতে একটিই থাকে। এটাই হচ্ছে (আরবি) ও (আরবি)। অন্যান্য গুরুজনদেরও এটাই উক্তি। সবগুলির জন্যে একই পানি। অর্থাৎ বর্ষার পানি। অথচ স্বাদের দিক দিয়ে এবং ছোট ও বড় হওয়ার দিক থেকে ফলের মধ্যে বড়ই পার্থক্য রয়েছে। কোনটা মিষ্টি ও কোনটা টক। জামে তিরমিযীর হাদীসেও এই ব্যাখ্যা রয়েছে। মোট কথা, বিভিন্ন দিক দিয়ে পার্থক্য আছে। যেমন প্রকারে পার্থক্য, রকমে পার্থক্য, রং এ পার্থক্য, গন্ধে পার্থক্য, স্বাদে পার্থক্য, পাতায় পার্থক্য এবং তরুতাজায় পার্থক্য। কোনটা অতি মিষ্টি এবং কোনটা অতি তিক্ত। কোনটি খুবই সুস্বাদু, আবার কোনটি অত্যন্ত বিস্বাদ। রং-এও পার্থক্য রয়েছে। কোনটা লাল, কোনটা সাদা এবং কোনটা কালো। অনুরূপভাবে সতেজতার দিক দিয়েও পার্থক্য রয়েছে। অথচ খাদ্য হিসেবে সবই এক। ব্যাপক ক্ষমতাবান আল্লাহ তাআ’লার এগুলি অলৌকিক শক্তি। সুতরাং বোধশক্তি সম্পন্ন লোকের জন্যে এগুলি শিক্ষণীয় বিষয়। এগুলি স্বেচ্ছাচারী আল্লাহ তাআ’লার মহাশক্তির পরিচয় বহন করে এবং এটাই ঘোষণা করে যে, তিনি যা চান তাই হয়। জ্ঞানীদের জন্যে এই নিদর্শনগুলিই যথেষ্ট।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] استَوَى عَلَى العَرش এর ভাবার্থ ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এর অর্থ মহান আল্লাহর আরশে অবস্থান করা। হাদীস বিশারদদের তরীকা এটাই যে, তাঁরা আল্লাহর কোন গুণের তা’বীল (অপব্যাখ্যা) করেন না, যেমন অন্যরা মহান আল্লাহর উক্ত গুণের এবং তাঁর অন্যান্য গুণের অপব্যাখ্যা করে থাকে। হাদীস বিশারদগণ এও বলেছেন যে, তাঁর গুণাবলীর কেমনত্বও বর্ণনা করা যাবে না এবং কোন কিছুর সাথে তুলনাও করা যাবে না। তিনি বলেন: ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ﴾ অর্থ, কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শূরা ৪২:১১)
[২] এর একটি অর্থ এই যে, ‘প্রত্যেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করবে।’ অর্থাৎ কিয়ামত অবধি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক চলতে থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ﴾ অর্থাৎ, সূর্য তার স্থির হওয়ার সময় পর্যন্ত চলছে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৩৮) দ্বিতীয় অর্থ এই যে, চন্দ্র এবং সূর্য উভয়েই নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তন করছে। সূর্য নিজের চক্র এক বছরে এবং চন্দ্র এক মাসে পূর্ণ করে নেয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ﴾ অর্থাৎ, চন্দ্রের জন্যে আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিনণ কক্ষপথ। (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৩৯) সাতটি বৃহৎ বৃহৎ গ্রহ রয়েছে, ওদের মধ্যে দু’টি হলো সূর্য এবং চন্দ্র। এখানে শুধু উক্ত দু’টি গ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন, কেননা এ দুটিই (মানুষের চক্ষুদৃষ্টিতে) সর্বাধিক বিশাল এবং মহত্বপূর্ণ। এ দুটিও যখন আল্লাহর নির্দেশাধীন, তাহলে অন্যগুলো নিশ্চিতরূপে তাঁর নির্দেশাধীন হবে। আর যখন এরা আল্লাহর হুকুমের অধীনে, তখন এরা মা’বূদ (উপাস্য) হতে পারে না। মা’বূদ তো তিনিই, যিনি এদেরকে অধীনস্থ করে রেখেছেন। তাই তিনি বলেন,﴿لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِله الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ﴾ অর্থাৎ, চন্দ্র-সূর্যকে সিজদা করো না, সেই আল্লাহকে সিজদা কর, যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করতে চাও। (সূরা ফুসস্বিলাত ৪১:৩৭) অন্যত্র বলেন, ﴿وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ﴾ অর্থাৎ, সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি সবই তাঁর হুকুমের অনুগত। (সূরা আ’রাফ ৭:৫৪)
# [১] পৃথিবীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুমান করা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন। উঁচু ও বিশাল পর্বতমালাকে ভূপৃষ্ঠে কীলক স্বরূপ গেড়ে দেওয়া হয়েছে। নদী-নালা, সমুদ্র ও ঝর্ণাদির এমন ব্যবস্থাপনা রেখেছেন, যার দ্বারা মানুষ নিজেও উপকৃত হয় এবং ক্ষেত-বাগানও সেচন করে থাকে। ফলে বিভিন্ন প্রকারের শস্য ও ফল উৎপাদন হয়, যাদের আকার-প্রকারও ভিন্ন এবং স্বাদও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
[২] এর একটি অর্থ এই যে, নর-মাদী দুটোই বানিয়েছেন, যেমনটি আধুনিক আবিষ্কর্তারাও এর সত্যায়ন করেছেন। (জোড়ায় জোড়ায়)এর দ্বিতীয় অর্থ বিপরীতমুখী, যেমনঃ মিষ্টি-টক, ঠান্ডা-গরম, কালো-সাদা এবং সুস্বাদ-বিস্বাদ, এ ধরণের পারস্পরিক বিপরীতধর্মী বস্তু সৃষ্টি করেছেন।
# [১] مُتَجَاوِرَاتٌ এক অপরের নিকটবর্তী ও পাশাপাশি। অর্থাৎ, ভূখন্ডের একটি ক্ষেত্র শস্য-শ্যামল ও উর্বর, যা অত্যধিক ফসল উৎপন্ন করে। আর তারই পাশাপাশি অনুর্বর ভূমি রয়েছে যাতে কোন প্রকারের ফসল উৎপন্ন হয় না।
[২] صِنْوَانٌ এর একটি অর্থ মিলিত এবং غَيْرُ صِنْوَانٍএর অর্থ পৃথক পৃথক করা হয়েছে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, صِنْوَانٌ একটি বৃক্ষ যার শাখা ও ফেঁকড়া রয়েছে যেমন ডালিম, ডুমুর এবং কোন কোন খেজুর গাছ। আর غَيْرُ صِنْوَانٍ যা উক্ত প্রকারের নয় বরং একটিই কান্ড বিশিষ্ট (যেমনঃ খেজুর, তাল, সুপারী ইত্যাদি)।
[৩] অর্থাৎ মাটিও এক, পানি ও আলো-বাতাসও এক; কিন্তু ফল ও শস্যাদি বিভিন্ন প্রকারের এবং স্বাদ ও আকার-প্রকারও এক অপর থেকে ভিন্ন।
তাফসীরে আবুবকর জাকারিয়া বলেছেন:-
# [১] আয়াতের এক অনুবাদ উপরে করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা আসমানসমূহকে কোন খুঁটি ব্যতীত উপরে উঠিয়েছেন, তোমরা সে আসমানসমূহকে দেখতে পাচ্ছ। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] অর্থাৎ আল্লাহ্ এমন এক সত্তা, যিনি আসমানসমূহকে সুবিস্তৃত ও বিশাল গম্বুজাকার খুঁটি ব্যতীত উচ্চে উন্নীত রেখেছেন যেমন তোমরা আসমানসমূহকে এ অবস্থায়ই দেখ। এ অর্থের স্বপক্ষে আমরা পবিত্র কুরআনের অন্যত্র দেখতে পাই সেখানে বলা হয়েছে, “আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন যাতে তা পড়ে না যায় পৃথিবীর উপর তাঁর অনুমতি ছাড়া।” [সূরা আল-হাজ্জঃ ৬৫] তবে আয়াতের অন্য এক অনুবাদ হলো, আল্লাহ্ তা’আলা আসমানসমূহকে অদৃশ্য ও অননুভূত স্তম্ভসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ অনুবাদটি ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, হাসান ও কাতাদা রাহেমাহুমুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] তবে ইবন কাসীর প্রথম তাফসীরকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
[২] কুরআনুল কারীমের কতিপয় আয়াতে আকাশ দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যেমন এ আয়াতে (تَرَوْنَهَا) বলা হয়েছে এবং অন্য এক আয়াতে
(وَاِلَى السَّمَاۗءِ كَيْفَ رُفِعَتْ)
[সূরা আল-গাশিয়াহঃ ১৮] বলা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় এটা এসেছে যে, যমীনের আশেপাশে যা আছে যেমনঃ বাতাস, পানি ইত্যাদি প্রথম আসমান এ সবগুলোকে সবদিক থেকে সমভাবে বেষ্টন করে আছে। যে কোন দিক থেকেই প্রথম আসমানের দিকে যাত্রা করা হউক না কেন তা পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বে রয়েছে। আবার প্রথম আসমান বা নিকটতম আসমানের পুরূত্বও পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বের মত। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় আসমানও প্রথম আসমানকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে আছে। এ দু’টোর দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বের মত। আবার দ্বিতীয় আসমানের পুরূত্বও পাঁচশত বছরের রাস্তার মত। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানও তদ্রুপ দূরত্ব ও পুরত্ব বিশিষ্ট। এ আসমানসমূহকে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নিজস্ব ক্ষমতাবলে কোন প্রকার বাহ্যিক খুঁটি ব্যতীতই ধারন করে রেখেছেন। সেগুলো একটির উপর আরেকটি পড়ে যাচ্ছেনা এটা একদিকে যেমন তাঁর মহা শক্তিধর ও ক্ষমতাবান হওয়া নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে অন্যদিকে আসমান ও যমীন যে কত প্রকাণ্ড সৃষ্টি তার এক প্রচ্ছন্ন ধারণা আমাদেরকে দেয়। [ইবন কাসীর] মহান আল্লাহ্ বলেন, “মানুষকে সৃষ্টি করা অপেক্ষা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি তো কঠিনতর, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা জানে না।” [সূরা গাফেরঃ ৫৭] অন্যত্র আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্ই সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং তাদের মত পৃথিবীও, তাদের মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ্ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন। [সূরা আত-ত্বালাকঃ ১২] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাত আসমান ও এর ভিতরে যা আছে এবং এর মাঝখানে যা আছে তা সবই কুরসীর মধ্যে যেন বিস্তীর্ণ যমীনের মধ্যে একটি আংটি আর কুরসী হলো মহান আরশের মধ্যে তদ্রুপ একটি আংটি স্বরূপ যা এক বিস্তীর্ণ যমীনে পড়ে আছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর আরশ তার পরিমাণ তো মহান আল্লাহ্ ছাড়া কেউ নির্ধারণ করে বলতে পারবে না। [তাবারী]
[৩] এর ব্যাখ্যা সূরা বাকারাহ এবং সূরা আল-আ’রাফে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে সংক্ষেপে এখানে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ্ আরশের উপর উঠার ব্যাপারটি তাঁর একটি বিশেষ গুণ। তিনি আরশের উপর উঠেছেন বলে আমরা স্বীকৃতি দেব। কিন্তু কিভাবে তিনি তা করেছেন তা আমাদের জ্ঞানের বাইরের বিষয়।
[৪] অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা সূর্য ও চন্দ্রকে আজ্ঞাধীন করেছেন। প্রত্যেকটিই একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলে। আজ্ঞাধীন করার অর্থ এই যে, উভয়কে তিনি সৃষ্টিকুলের উপকারের জন্য, তাঁর বান্দাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নিয়োজিত করেছেন, মূলত: প্রতিটি সৃষ্টিই স্রষ্টার আজ্ঞাধীন। [কুরতুবী] যে কাজে তাদেরকে আল্লাহ্ নিয়োজিত করেছেন তারা অহৰ্নিশ তা করে যাচ্ছে। হাজারো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে; কিন্তু কোন সময় তাদের গতি চুল পরিমাণও কম-বেশী হয়নি। তারা ক্লান্ত হয় না এবং কোন সময় নিজের নির্দিষ্ট কাজ ছেড়ে অন্য কাজে লিপ্ত হয় না। [কুরতুবী]
[৫] আয়াতে উল্লেখিত (أجل) শব্দটির মূল অর্থঃ সময়। তবে অন্যান্য অর্থেও এর ব্যবহার আছে। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ বর্ণনায় কয়েকটি মত রয়েছেঃ
এক, এখানে (اَجَلٍ مُّسَمًّى) বা সুনির্দিষ্ট মেয়াদ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, চাঁদ ও সূর্য কিয়ামত পর্যন্ত তাদের সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে চলতে থাকবে। যখন সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে, চাঁদকে নিষ্প্রভ করা হবে, তারকাসমূহ আলোহীন হয়ে পড়বে আর গ্রহ নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে, তখন পর্যন্ত এগুলো চলবে। যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ” [সূরা ইয়াসীনঃ ৩৮] এখানে গন্তব্য বলে সুনির্দিষ্ট সময়ও উদ্দেশ্য হতে পারে। [ইবন কাসীর; কুরতুবী]
দুই, কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতের অর্থ, আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক গ্রহের জন্যে একটি বিশেষ গতি ও বিশেষ কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তারা সব সময় নিজ নিজ কক্ষপথে নির্ধারিত গতিতে চলমান থাকে। চন্দ্র নিজ কক্ষপথ এক মাসে এবং সূর্য এক বছরে অতিক্রম করে। [কুরতুবী]
তিন, অথবা আয়াতের অর্থ, আল্লাহ্ সেগুলোকে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানের প্রতি ধাবিত করান। আর সে গন্তব্যস্থান হলো আরশের নীচে। এ ব্যাপারে সহীহ হাদীসে বিস্তারিত এসেছে সূরা ইয়াসীনে যার বর্ণনা আসবে। [ইবন কাসীর]
[৬] অর্থাৎ তিনি আয়াতসমূহকে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। এর মানে, আল্লাহ্ তা’আলা অপার শক্তির নিদর্শনাবলী তিনি বর্ণনা করছেন। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ তিনি বিস্তারিত প্রমাণ পেশ করছেন যে, যিনি পূর্ব বর্ণিত কাজগুলো করতে পারেন তিনি অবশ্যই মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় আনতে সক্ষম। [কুরতুবী] এগুলো আরও প্রমাণ করছে যে, তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ্ নেই। তিনি যখন ইচ্ছা তখনই তাঁর সৃষ্টিকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। [ইবন কাসীর]
(৭) অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টজগৎ ও তার বিস্ময়কর পরিচালন-ব্যবস্থা আল্লাহ্ তা’আলা এজন্য কায়েম করেছেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে আখেরাত ও কেয়ামতে বিশ্বাসী হও এবং সত্য বলে মেনে নাও। [বাগভী] কেননা, এ বিস্ময়কর ব্যবস্থা ও সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য করার পর আখেরাতে মানুষকে পুনর্বার সৃষ্টি করাকে আল্লাহ্র শক্তি বহির্ভূত মনে করা সম্ভব হবে না।
# [১] পূর্বের আয়াতে উপরস্থিত আসমানের নিদর্শনাবলী বর্ণনা করেছেন। আর এখানে নিচের বা যমীনের নিদর্শনাবলী বর্ণনা করছেন। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] তিনিই ভূমণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে ভারী পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন। ভূমণ্ডলের বিস্তৃতি তার গোলাকৃতির পরিপন্থী নয়। কেননা, গোলাকার বস্তু যদি অনেক বড় হয়, তবে তার প্রত্যেকটি অংশ একটি বিস্তৃত পৃষ্ঠের মতই দৃষ্টিগোচর হয়। [ফাতহুল কাদীর] কুরআনুল কারীম সাধারণ মানুষকে তাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী সম্বোধন করে। বাহ্যদর্শী ব্যক্তি পৃথিবীকে একটি বিস্তৃত পৃষ্ঠরূপে দেখে। তাই একে বিস্তৃত করা শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। এরপর পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখা ও অন্যান্য অনেক উপকারিতার জন্য এর উপর সুউচ্চ ও ভারী পাহাড় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এসব পাহাড় একদিকে ভূ-পৃষ্ঠের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং অন্যদিকে সমগ্র সৃষ্ট জীবকে পানি পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে। পানির বিরাট ভাণ্ডার পর্বত-শৃঙ্গে বরফ আকারে সঞ্চিত রাখা হয়। এর জন্য কোন চৌবাচ্চা নেই এবং তা তৈরি করারও প্রয়োজন নেই। অপবিত্র বা দূষিত হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। অতঃপর এ ফল্গুধারা থেকেই কোথাও প্রকাশ্য নদ-নদী ও খাল-বিল নির্গত হয় এবং কোথাও ভূগর্ভেই লুকিয়ে থাকে। অতঃপর কুপের মাধ্যমে এ ফল্গুধারার সন্ধান করে তা থেকে পানি উত্তোলন করা হয়।
[২] অর্থাৎ এ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নানাবিধ ফল-ফসল উৎপন্ন করছেন এবং প্রত্যেক ফল-ফসলের দু’প্রকার সৃষ্টি করছেনঃ লাল-হলুদ, টক-মিষ্টি। [বাগভী] তবে এর অর্থ দুই না হয়ে একাধিক হতে পারে যেগুলোর সংখ্যা কমপক্ষে দুই হবে। তাই বিষয়টি (زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ) শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি ফলই দু’ প্রকার হয়, রঙের দিক থেকে যেমন, সাদা-কালো, অথবা স্বাদের দিক থেকে যেমন, মিষ্টি-টক, অথবা আকৃতির দিক থেকে যেমন, বড়-ছোট, অথবা অবস্থাগত দিক থেকে যেমন, গরম ও ঠাণ্ডা। [ফাতহুল কাদীর] কারও কারও মতে, (زَوْجَيْنِ) এর অর্থ নর ও মাদী হওয়া [কুরতুবী]
[৩] আল্লাহ্ তা’আলাই রাত্রি দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। অর্থাৎ দিনের আলোর পর রাত্রি নিয়ে আসেন; যেমন কোন উজ্জ্বল বস্তুকে পর্দা দ্বারা আবৃত করে কালো করে দেয়া হয়। ফলে স্বচ্ছ শুভ্র উজ্জ্বল থাকার পর সেটা অন্ধকার কালোতে রূপান্তরিত হয়। [ফাতহুল কাদীর] আবার আরেক অর্থে, তিনি এ দু’টিকে এমন করেছেন যে, এর প্রত্যেকটি অপরটিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। [ইবন কাসীর] একটি যাওয়ার সাথে সাথে আরেকটি আসবেই। এভাবে আল্লাহ্ তা’আলা মানুষ ও তাদের বাসস্থান যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন তেমনি তিনি সময়ও নিয়ন্ত্রণ করেন।
[৪] উপরে বিশ্ব-জাহানের যে নিদর্শনাবলীকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করা হয়েছে সেগুলোতে কেউ চিন্তাভাবনা করলে অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রমাণ পাবে যে, এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও পরিচালক একজনই আর মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন, আল্লাহ্র আদালতে মানুষের হাযির হওয়া এবং পুরষ্কার ও শাস্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব খবর দিয়েছেন সেগুলো সবই সত্য। [বাগভী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
# [১] এখানে আল্লাহ্ তা’আলা নতুন করে অন্য আরেক প্রকার নিদর্শন পেশ করছেন। [ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ সারা পৃথিবীকে তিনি একই ধরনের একটি ভূখণ্ড বানিয়ে রেখে দেননি। বরং তার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য ভূখণ্ড, এ ভূখণ্ডগুলো পরস্পর সংলগ্ন থাকা সত্ত্বেও আকার-আকৃতি, রং, গঠন, উপাদান, বৈশিষ্ট্য, শক্তি ও যোগ্যতা এবং উৎপাদনে পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। এগুলোর কোনটি এমন যে, তাতে শস্য উৎপন্ন হয় আবার কোন কোনটি একেবারে অকেজো ভূমি যাতে কোন কিছুই উৎপন্ন হয়না অথচ এ দু’ধরনের ভূমিই পাশাপাশি অবস্থিত। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] এ বিভিন্ন ভূখণ্ডের সৃষ্টি এবং তাদের মধ্যে নানা প্রকার বিভিন্নতার অস্তিত্ব এত বিপুল পরিমান জ্ঞান ও কল্যাণে পরিপূর্ণ যে, তা গণনা করে শেষ করা যেতে পারে না। এ ভূখণ্ড লাল, অপরটি সাদা, কোনটি হলুদ, কোনটি কালো, কোনটি পাথুরে, কোনটি সমতল, কোনটি বালুময়, কোনটি দো-আঁশ, কোনটি মিহি, অথচ সবগুলোই পাশাপাশি। প্রতিটি তার গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আছে। এসব কিছুই প্রমাণ করছে যে, একজন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ক্ষমতাধর সত্তা রয়েছেন যিনি এগুলো করেছেন। তিনিই একমাত্র ইলাহ, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনিই একমাত্র রব, তিনি ব্যতীত আর কোন রব নেই। [ইবন কাসীর] তাছাড়া কোন কোন ভূমি পাশাপাশি নয় অথচ তাদের মধ্যে একই ধরণের শক্তি, যোগ্যতা পাওয়া যায়। এখানে ‘পাশাপাশি নয়’ এ কথাটি উহ্য থাকতে পারে। [ফাতহুল কাদীর]
[২] কিছু কিছু খেজুর গাছের মূল থেকে একটি খেজুর গাছ বের হয় আবার কিছু কিছুর মূল থেকে একাধিক গাছ বের হয়। [ফাতহুল কাদীর]
[৩] এ আয়াতে আল্লাহ্র তাওহীদ এবং তাঁর শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শনাবলী দেখানো ছাড়া আরো একটি সত্যের দিকেও সূক্ষ্ম ইশারা করা হয়েছে। এ সত্যটি হচ্ছে, আল্লাহ্ এ বিশ্ব-জাহানের কোথাও এক রকম অবস্থা রাখেননি। একই পৃথিবী কিন্তু এর ভূখণ্ডগুলোর প্রত্যেকের বর্ণ, আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। একই জমি ও একই পানি, কিন্তু তা থেকে বিভিন্ন প্রকার ফল ও ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। একই গাছ কিন্তু তার প্রত্যেকটি ফল একই জাতের হওয়া সত্বেও তাদের আকৃতি, আয়তন, স্বাদ, গন্ধ, রূপ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। একই মূল থেকে দু’টি ভিন্ন গাছ বের হচ্ছে এবং তাদের প্রত্যেকেই নিজের একক বৈশিষ্টের অধিকারী। যে ব্যক্তি এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে সে অবশ্যই এতে একজন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সত্তার কার্য সক্রিয় আছে দেখতে পাবে। যিনি তার অসীম ক্ষমতায় এগুলোর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেছেন সেভাবে সৃষ্টি করেছেন। এজন্যই আল্লাহ্ তা’আলা সবশেষে বলেছেন যে, নিশ্চয় বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য এতে রয়েছে প্রচুর নিদর্শন। [ইবন কাসীর]
[৪] বলা হচ্ছে, এই যে পরস্পর পাশাপাশি দু’টি ভূমিতে আল্লাহ্ তা’আলা বিভিন্ন প্রকার ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেন, তন্মধ্যে একই ফল একই জমিতে একই পানি দ্বারা উৎপন্ন করি তারপরও সেটার স্বাদ দু’রকমের হয়। একটি মিষ্ট অপরটি টক। একটি অত্যন্ত উন্নতমানের অপরটি অনুন্নত পর্যায়ের। একটি চিত্তাকর্ষক অপরটি তেমন নয়। এসব কিছুতে কেউ চিন্তা, গবেষণা ও বিবেক খাটালে যে কেউ অবশ্যই মেনে নিতে বাধ্য হবে যে, এর বিভিন্নতার প্রকৃত কারণ এক মহান প্রজ্ঞাময় সত্তার শক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, সাধারণত: যে কারণে ফল-ফলাদিতে পার্থক্য সূচিত হয় তা দু’টি। এক. উৎপন্নস্থানের ভিন্নতা, দুই. পানির গড়মিল। কিন্তু যদি জমি ও পানি একই প্রকার হয়, তারপর যদি সেটাতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা ও ফল পরিলক্ষিত হয় তবে বিবেকবান মাত্রই এটা বলতে বাধ্য হবে যে, এটা সেই অপার শক্তি ও আশ্চর্যজনক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। [ফাতহুল কাদীর]
মুজাহিদ বলেন, এটা মূলত: আদম সন্তানদের জন্য একটি উদাহরণ, তাদের মধ্যে নেককার ও বদকার হয়েছে অথচ তাদের পিতা একজনই। হাসান বসরী বলেন, এ উদাহরণটি আল্লাহ্ তা’আলা আদম সন্তানদের হৃদয়ের জন্য পেশ করেছেন। কারণ, যমীন মহান আল্লাহ্র হাতে একটি কাদামাটির পিণ্ড ছিল। তিনি সেটাকে বিছিয়ে দিলেন, ফলে সেটা পরস্পর পাশাপাশি টুকরায় পরিণত হলো, তারপর তাতে আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হলো, ফলে তা থেকে বের হলো, ফুল, গাছ, ফল ও উদ্ভিদ। আর এ মাটির কোনটি হল খারাপ, লবনাক্ত ও অস্বচ্ছ। অথচ এগুলো সবই একই পানি দিয়ে সিক্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে মানুষও আদম ‘আলাইহিস্ সালাম থেকে সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর আসমান থেকে তাদের জন্য স্মরণিকা (কিতাব) নাযিল হলো, কিছু অন্তর নরম হলো এবং বিনীত হলো, আর কিছু অন্তর কঠোর হলো এবং গাফেল হলো। হাসান বসরী বলেন, কুরআনের কাছে কেউ যখন বসে তখন সে সেখান থেকে বেশী বা কম কিছু না নিয়ে বের হয় না। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “আর আমরা নাযিল করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে” [সূরা আল-ইসরাঃ ৮২] এতে অবশ্যই বিবেকবানদের জন্য প্রচুর নিদর্শন রয়েছে। [বাগভী]
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Ar-Ra’d
Sura: 13
Verses :- 2-4
بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا
Without any pillars that you can see.
Clarifying Allah’s Perfect Ability
Allah tells;
اللّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ
Allah is He Who raised the heavens,
Allah mentions His perfect ability and infinite authority, since it is He Who has raised the heavens without pillars by His permission and order. He, by His leave, order and power, has elevated the heavens high above the earth, distant and far away from reach. The heaven nearest to the present world encompasses the earth from all directions, and is also high above it from every direction.
The distance between the first heaven and the earth is five hundred years from every direction, and its thickness is also five hundred years.
The second heaven surrounds the first heaven from every direction, encompassing everything that the latter carries, with a thickness also of five hundred years and a distance between them of five hundred years. The same is also true about the third, the fourth, the fifth, the sixth and the seventh heavens.
Allah said,
اللَّهُ الَّذِى خَلَقَ سَبْعَ سَمَـوَتٍ وَمِنَ الاٌّرْضِ مِثْلَهُنَّ
It is Allah who has created seven heavens and of the earth the like thereof. (65:12)
Allah said next,
بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا
..without any pillars that you can see.
meaning, `there are pillars, but you cannot see them,’
according to Ibn Abbas, Mujahid, Al-Hasan, Qatadah, and several other scholars.
Iyas bin Mu`awiyah said,
“The heaven is like a dome over the earth,”
meaning, without pillars.
Similar was reported from Qatadah, and this meaning is better for this part of the Ayah, especially since Allah said in another Ayah,
وَيُمْسِكُ السَّمَأءَ أَن تَقَعَ عَلَى الاٌّرْضِ إِلاَّ بِإِذْنِهِ
He withholds the heaven from falling on the earth except by His permission. (22:65)
Therefore, Allah’s statement,
تَرَوْنَهَا
(…that you can see), affirms that there are no pillars. Rather, the heaven is elevated (above the earth) without pillars, as you see.
This meaning best affirms Allah’s ability and power.
Al-Istawa’, Rising above the Throne
Allah said next,
ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ
Then, He rose above (Istawa) the Throne.
We explained the meaning of the Istawa’ in Surah Al-A`raf (7:54), and stated that it should be accepted as it is without altering, equating, annulling its meaning, or attempts to explain its true nature. Allah is glorified and praised from all that they attribute to Him.
Allah subjected the Sun and the Moon to rotate continuously
Allah said,
وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ
كُلٌّ يَجْرِي لَاجَلٍ مُّسَمًّى
He has subjected the sun and the moon, each running (its course) for a term appointed.
It was said that the sun and the moon continue their course until they cease doing so upon the commencement of the Final Hour, as Allah stated,
وَالشَّمْسُ تَجْرِى لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَـا
And the sun runs on its fixed course for a term (appointed). (36:38)
It was also said that the meaning is:
until they settle under the Throne of Allah after passing the other side of the earth. So when they, and the rest of the planetary bodies reach there, they are at the furthest distance from the Throne. Because according to the correct view, which the texts prove, it is shaped like a dome, under which is all of the creation. It is not circular like the celestial bodies, because it has pillars by which it is carried. This fact is clear to those who correctly understand the Ayat and authentic Hadiths. All the (praise is due to) Allah and all the favors are from Him.
Allah mentioned the sun and the moon here because they are among the brightest seven heavenly objects. Therefore, if Allah subjected these to His power, then it is clear that He has also subjected all other heavenly objects.
يُدَبِّرُ الَامْرَ
He manages and regulates all affairs;
Allah said in other Ayat,
لَا تَسْجُدُواْ لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُواْ لِلَّهِ الَّذِى خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
Prostrate yourselves not to the sun nor to the moon, but prostrate yourselves to Allah Who created them, if you (really) worship Him. (41:37)
and,
وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَتٍ بِأَمْرِهِ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالاٌّمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَـلَمِينَ
And (He created) the sun, the moon, the stars subjected to His command. Surely, His is the creation and commandment. Blessed is Allah, the Lord of all that exists! (7:54)
Allah’s statement next,
يُفَصِّلُ الايَاتِ لَعَلَّكُم بِلِقَاء رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ
He explains the Ayat in detail, that you may believe with certainty in the Meeting with your Lord.
means, He explains the signs and clear evidences that testify that there is no deity worthy of worship except Him. These evidences prove that He will resurrect creation if He wills, just as He started it.
Allah’s Signs on the Earth
After Allah mentioned the higher worlds, He started asserting His power, wisdom and control over the lower parts of the world.
Allah said,
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الَارْضَ
And it is He Who spread out the earth,
made it spacious in length and width.
وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا
and placed therein firm mountains and rivers,
Allah has placed on the earth firm mountains and made rivers, springs and water streams run through it, so that the various kinds of fruits and plants of every color, shape, taste and scent are watered with this water,
وَمِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ
and of every kind of fruit He made Zawjayn Ithnayn,
two types from every kind of fruit,
يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ
He brings the night as a cover over the day.
Allah made the day and night pursue each other, when one is about to depart, the other overcomes it, and vice versa. Allah controls time just as He controls space and matter,
إِنَّ فِي ذَلِكَ لَايَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
Verily, in these things, there are Ayat for people who reflect.
who reflect on Allah’s signs and the evidences of His wisdom.
Allah said.
وَفِي الَارْضِ قِطَعٌ مُّتَجَاوِرَاتٌ
And in the earth are neighboring tracts,
Meaning, next to each other, some of them are fertile and produce what benefits people, while others are dead, salty and do not produce anything.
This meaning was collected from Ibn Abbas, Mujahid, Sa`id bin Jubayr, Ad-Dahhak and several others.
This also covers the various colors and types of diverse areas on the earth; some red, some white, or yellow, or black, some are stony, or flat, or sandy, or thick, or thin, all made to neighbor each other while preserving their own qualities. All this indicates the existence of the Creator Who does what He wills, there is no deity or lord except Him.
Allah said next,
وَجَنَّاتٌ مِّنْ أَعْنَابٍ وَزَرْعٌ وَنَخِيلٌ
and gardens of vines, and green crops (fields), and date palms…
Allah’s statement, next,
صِنْوَانٌ وَغَيْرُ صِنْوَانٍ
Sinwanun wa (or) Ghayru Sinwan.
`Sinwan’ means,
growing into two or three from a single stem, such as figs, pomegranate and dates.
`Ghayru Sinwan’ means,
having one stem for every tree, as is the case with most plants.
From this meaning, the paternal uncle is called one’s `Sinw’ of his father.
There is an authentic Hadith that states that the Messenger of Allah said to Umar bin Al-Khattab,
أَمَا شَعَرْتَ أَنَّ عَمَّ الرَّجُلِ صِنْوُ أَبِيه
Do you not know that man’s paternal uncle is the Sinw of his father!
Allah said next,
يُسْقَى بِمَاء
وَاحِدٍ وَنُفَضِّلُ
بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ فِي الاُكُلِ
watered with the same water; yet some of them We make more excellent than others to eat.
Abu Hurayrah narrated that the Prophet commented on Allah’s statement,
وَنُفَضِّلُ
بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ فِي الاُكُلِ
(yet some of them We make more excellent than others to eat),
الدَّقَلُ وَالْفَارِسِيُّ وَالْحُلْوُ وَالْحَامِض
The Dagal, the Persian, the sweet, the bitter…”
At-Tirmidhi collected this Hadith and said, “Hasan Gharib.”
Therefore, there are differences between plants and fruits with regards to shape, color, taste, scent, blossoms and the shape of their leaves. There are plants that are very sweet or sour, bitter or mild, fresh; some plants have a combination of these attributes, and the taste then changes and becomes another taste, by Allah’s will. There is also some that are yellow in color, or red, or white, or black, or blue, and the same can be said about their flowers; and all these variances and complex diversities are watered by the same water.
Surely, in this there are signs for those who have sound reasoning, and surely, all this indicates the existence of the Creator Who does what He wills and Whose power made distinctions between various things and created them as He wills. So Allah said,
إِنَّ فِي ذَلِكَ لَايَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
Verily, in these things there are Ayat for the people who understand.