(Book# 779) সুরা: হিজর সুরা:১৫ ২৬-৫০ নং আয়াত:- [ وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি, And We did certainly create man.] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 779)
সুরা: হিজর
সুরা:১৫
২৬-৫০ নং আয়াত:-
[ وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি,
And We did certainly create man.]
www.motaher21.net
وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ ﴿ۚ۲۶﴾
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কালো পচা শুষ্ক ঠনঠনে মাটি হতে।
And We did certainly create man out of clay from an altered black mud.
وَ الۡجَآنَّ خَلَقۡنٰہُ مِنۡ قَبۡلُ مِنۡ نَّارِ السَّمُوۡمِ ﴿۲۷﴾
আর এর পূর্বে জীনকে সৃষ্টি করেছি ধূম্রহীন বিশুদ্ধ অগ্নি হতে।
And the jinn We created before from scorching fire.
وَ اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ ﴿۲۸﴾
স্মরণ কর; যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদেরকে বললেন, ‘আমি কালো পচা শুষ্ক ঠনঠনে মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করব।
And [mention, O Muhammad], when your Lord said to the angels, “I will create a human being out of clay from an altered black mud.
فَاِذَا سَوَّیۡتُہٗ وَ نَفَخۡتُ فِیۡہِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ فَقَعُوۡا لَہٗ سٰجِدِیۡنَ ﴿۲۹﴾
যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।’
And when I have proportioned him and breathed into him of My [created] soul, then fall down to him in prostration.”
فَسَجَدَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ کُلُّہُمۡ اَجۡمَعُوۡنَ ﴿ۙ۳۰﴾
তখন ফিরিশতাগণ সবাই একত্রে সিজদা করল।
So the angels prostrated – all of them entirely,
اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ اَبٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنَ مَعَ السّٰجِدِیۡنَ ﴿۳۱﴾
কিন্তু ইবলীস করল না। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল।
Except Iblees, he refused to be with those who prostrated.
قَالَ یٰۤـاِبۡلِیۡسُ مَا لَکَ اَلَّا تَکُوۡنَ مَعَ السّٰجِدِیۡنَ ﴿۳۲﴾
তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘হে ইবলীস! তোমার কি হল যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না?’
[ Allah ] said, O Iblees, what is [the matter] with you that you are not with those who prostrate?”
قَالَ لَمۡ اَکُنۡ لِّاَسۡجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقۡتَہٗ مِنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ ﴿۳۳﴾
সে (উত্তরে) বলল, ‘কালো পচা শুষ্ক ঠনঠনে মাটি হতে যে মানুষ তুমি সৃষ্টি করেছ, আমি তাকে সিজদা করবার নই।’
He said, “Never would I prostrate to a human whom You created out of clay from an altered black mud.”
قَالَ فَاخۡرُجۡ مِنۡہَا فَاِنَّکَ رَجِیۡمٌ ﴿ۙ۳۴﴾
তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘তাহলে তুমি এখান হতে বের হয়ে যাও। কারণ, নিশ্চয়ই তুমি অভিশপ্ত।
[ Allah ] said, “Then get out of it, for indeed, you are expelled.
وَّ اِنَّ عَلَیۡکَ اللَّعۡنَۃَ اِلٰی یَوۡمِ الدِّیۡنِ ﴿۳۵﴾
কর্মফল দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল অভিশাপ।’
And indeed, upon you is the curse until the Day of Recompense.”
قَالَ رَبِّ فَاَنۡظِرۡنِیۡۤ اِلٰی یَوۡمِ یُبۡعَثُوۡنَ ﴿۳۶﴾
সে (ইবলীস) বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও।’
He said,”My Lord, then reprieve me until the Day they are resurrected.”
قَالَ فَاِنَّکَ مِنَ الۡمُنۡظَرِیۡنَ ﴿ۙ۳۷﴾
তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘যাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছে তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হলে।
[ Allah ] said, “So indeed, you are of those reprieved
اِلٰی یَوۡمِ الۡوَقۡتِ الۡمَعۡلُوۡمِ ﴿۳۸﴾
অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।’
Until the Day of the time well-known.”
قَالَ رَبِّ بِمَاۤ اَغۡوَیۡتَنِیۡ لَاُزَیِّنَنَّ لَہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَاُغۡوِیَنَّہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿ۙ۳۹﴾
সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি যে আমাকে বিপদগামী করলে তার জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপ কর্মকে অবশ্যই শোভনীয় করে তুলব এবং আমি তাদের সকলকে অবশ্যই বিপথগামী করে ছাড়ব।
[Iblees] said, “My Lord, because You have put me in error, I will surely make [disobedience] attractive to them on earth, and I will mislead them all.
اِلَّا عِبَادَکَ مِنۡہُمُ الۡمُخۡلَصِیۡنَ ﴿۴۰﴾
তবে তাদের মধ্যে তোমার একনিষ্ঠ বান্দাগণ ছাড়া।’
Except, among them, Your chosen servants.”
قَالَ ہٰذَا صِرَاطٌ عَلَیَّ مُسۡتَقِیۡمٌ ﴿۴۱﴾
আল্লাহ্‌ বললেন, এটাই আমার কাছে পৌঁছার সরল পথ।
[ Allah ] said, “This is a path [of return] to Me [that is] straight.
اِنَّ عِبَادِیۡ لَیۡسَ لَکَ عَلَیۡہِمۡ سُلۡطٰنٌ اِلَّا مَنِ اتَّبَعَکَ مِنَ الۡغٰوِیۡنَ ﴿۴۲﴾
বিভ্রান্তদের মধ্য হতে যারা তোমার অনুসরণ করবে, তারা ছাড়া আমার (একনিষ্ঠ) বান্দাদের উপর তোমার কোন আধিপত্য থাকবে না।
Indeed, My servants – no authority will you have over them, except those who follow you of the deviators.
وَ اِنَّ جَہَنَّمَ لَمَوۡعِدُہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۟ۙ۴۳﴾
অবশ্যই (তোমার অনুসারীদের) তাদের সবারই প্রতিশ্রুত স্থান হবে জাহান্নাম।’
And indeed, Hell is the promised place for them all.
لَہَا سَبۡعَۃُ اَبۡوَابٍ ؕ لِکُلِّ بَابٍ مِّنۡہُمۡ جُزۡءٌ مَّقۡسُوۡمٌ ﴿٪۴۴﴾
ওর সাতটি দরজা আছে; প্রত্যেক দরজার জন্য তাদের মধ্য থেকে পৃথক পৃথক দল আছে।
It has seven gates; for every gate is of them a portion designated.”
اِنَّ الۡمُتَّقِیۡنَ فِیۡ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ ﴿ؕ۴۵﴾
নিশ্চয় সাবধানীরা বাস করবে উদ্যান ও প্রস্রবণসমূহে।
Indeed, the righteous will be within gardens and springs.
اُدۡخُلُوۡہَا بِسَلٰمٍ اٰمِنِیۡنَ ﴿۴۶﴾
তাদেরকে বলা হবে, ‘তোমরা শান্তিতে নিরাপত্তার সাথে এতে প্রবেশ কর।
[Having been told], “Enter it in peace, safe [and secure].”
وَ نَزَعۡنَا مَا فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ مِّنۡ غِلٍّ اِخۡوَانًا عَلٰی سُرُرٍ مُّتَقٰبِلِیۡنَ ﴿۴۷﴾
আমি তাদের অন্তরে যে ঈর্ষা থাকবে তা দূর করে দেব; তারা ভ্রাতৃভাবে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে আসনে অবস্থান করবে।
And We will remove whatever is in their breasts of resentment, [so they will be] brothers, on thrones facing each other.
لَا یَمَسُّہُمۡ فِیۡہَا نَصَبٌ وَّ مَا ہُمۡ مِّنۡہَا بِمُخۡرَجِیۡنَ ﴿۴۸﴾
সেথায় তাদেরকে অবসাদ স্পর্শ করবে না এবং তারা সেথা হতে বহিষ্কৃতও হবে না।
No fatigue will touch them therein, nor from it will they [ever] be removed.
نَبِّیٴۡ عِبَادِیۡۤ اَنِّیۡۤ اَنَا الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿ۙ۴۹﴾
আমার বান্দাদেরকে বলে দাও, ‘নিশ্চয় আমিই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[O Muhammad], inform My servants that it is I who am the Forgiving, the Merciful.

وَ اَنَّ عَذَابِیۡ ہُوَ الۡعَذَابُ الۡاَلِیۡمُ ﴿۵۰﴾
আর নিশ্চয় আমার শাস্তিই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি!
And that it is My punishment which is the painful punishment.

সুরা: হিজর
সুরা:১৫
২৬-৫০ নং আয়াত:-
[ وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি,
And We did certainly create man.]
www.motaher21.net

২৬-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
প্রথম দু’ আয়াতে মূলত মানুষ ও জিনকে কোন্ পদার্থ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে সে কথা বলা হয়েছে। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুস্ক ঠনঠনে মাটি থেকে আর জিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রখর শিখাযুক্ত অগ্নি হতে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ وَخَلَقَ الْجَآنَّ مِنْ مَّارِجٍ مِّنْ نَّارٍ)‏

“মানুষকে (আদমকে) তিনি সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির মত শুকনো মাটি হতে, আর জিনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নি শিখা হতে।” (সূরা আর রহমান: ৫৫:১৪-১৫)

অর্থাৎ মানুষ হল মাটির তৈরি জাতি আর জিন হল আগুনের তৈরি জাতি।

صَلْصَالٍ হল এমন মাটি যা শুকিয়ে গেলে তাতে ঠনঠন শব্দ হয়।

(حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ)

হল এমন মাটি যা দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার ফলে তার রং ও গন্ধ পরিবর্তন হয়ে গেছে। جن অর্থ ঢাকা, জিনেরা যেহেতু মানুষের চোখের আড়ালে থাকে তাই তাদেরকে الْجَآنَّ বা জিন বলা হয়। السَّمُوْمِ বলা হয় আগুন যার কোন ধোঁয়া নেই। مِنْ قَبْلُ বলতে মানুষের পূর্বে, অর্থাৎ মানুষের পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা প্রখর আগুন থেকে জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। হাদীসে এসেছে: ফেরেশতাদেরকে নূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে, জিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে শিখাযুক্ত আগুন হতে আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে যা তোমাদের সামনে বর্ণনা করা হল। (সহীহ বুখারী হা: ২৯৯৬)

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদমের সৃষ্টি সমাপ্ত করার পর সকল ফেরেশতাকে নির্দেশ দিলেন তাকে সিজদা করার জন্য। সকল ফেরেশতা সিজদা করেছে শুধুমাত্র ইবলীস তাকে সিজদা করেনি। এখানে সিজদা মূলত ইবাদত করার উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং আদমের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বুঝানোর জন্য এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ইবলীস সে অহংকার করল, সিজদা করতে অস্বীকার করল এবং যুক্তি পেশ করল যে, আমাকে আগুন দ্বারা তৈরি করা হয়েছে আর আদমকে মাটি দ্বারা, আগুনের কাজ ওপরে উঠা আর মাটির কাজ নিচে নামা। সুতরাং আমি তাকে সিজদা করতে পারি না।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্পর্কে বলেন:

(وَاِذْ قُلْنَا لِلْمَلٰ۬ئِکَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْٓا اِلَّآ اِبْلِیْسَﺚ اَبٰی وَاسْتَکْبَرَﺡ وَکَانَ مِنَ الْکٰفِرِیْنَ)‏

“আর (স্মরণ কর) আমি যখন ফেরেশতাগণকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলিস ব্যতীত সকলে সিজদা করেছিল। সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।” (সূরা বাক্বারাহ ২:৩৪)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(إِلَّآ إِبْلِيْسَ ط اِسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكٰفِرِيْنَ)‏

“কেবল ইবলীস ব্যতীত। সে অহঙ্কার করল এবং কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে গেল।” (সূরা সোয়াদ ৩৮:৭৪)

ইবলীসের যুক্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী:

(قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ ط قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ج خَلَقْتَنِيْ مِنْ نَّارٍ وَّخَلَقْتَه۫ مِنْ طِيْنٍ)

“তিনি (আল্লাহ) বললেন: ‘আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কিসে তোমাকে সিজদা দিতে বারণ করল?’ সে বলল: ‘আমি তার অপেক্ষা উত্তম; আপনি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কর্দম দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১২)

এরূপ সূরা সোয়াদের ৭৫-৭৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা ইবলীসকে যে জান্নাতে বসবাস করতে দিয়েছিলেন তার এই অবাধ্য হওয়ার কারণে তাকে সেই জান্নাত থেকে বের করে দিলেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(قَالَ فَاهْبِطْ مِنْهَا فَمَا يَكُوْنُ لَكَ أَنْ تَتَكَبَّرَ فِيْهَا فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصّٰغِرِيْنَ)‏

“তিনি বললেন: ‘এ স্থান হতে নেমে যাও, এখানে থেকে অহঙ্কার করবে, এটা হতে পারে না। সুতরাং বের হয়ে যাও, তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১৩) এবং আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর অভিশম্পাত করলেন।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَّإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِيْٓ إِلٰي يَوْمِ الدِّيْنِ)‏

“এবং তোমার প্রতি আমার অভিশাপ ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৭৮)

ইবলীস অভিশপ্ত হয়ে জান্নাত থেকে যখন বহিষ্কৃত হল তখন আল্লাহ তা‘আলার কাছে সে কিয়ামত পর্যন্ত জীবন আয়ুর অবকাশ দেয়ার জন্য প্রার্থনা করল। আল্লাহ তা‘আলা তাকে الْوَقْتِ الْمَعْلُوْمِ বা কিয়ামত পর্যন্ত জীবন আয়ুর অবকাশ দিলেন। ইবলীস শপথ করে বলেছিল, ‘‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে জন্য আমাকে বিপথগামী করেছেন সেজন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মকে অবশ্যই শোভন করে তুলব এবং আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করব।”

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِيْنَ)‏

“সে বলল: তোমার‎ ইযযতের শপথ! আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করবই।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৮২)

কিভাবে পথভ্রষ্ট করবে তা অন্যত্র বলা হয়েছে, সে মানুষের কাছে পাপ কাজসমূহকে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও চাকচিক্যময় করে তুলে ধরবে। ফলে মানুষ তাতে লিপ্ত হবে।

আল্লাহ তা‘আলা ইবলীসের কথা তুলে ধরে বলেন:

(ثُمَّ لَاٰتِيَنَّهُمْ مِّنْۭ بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَا۬ئِلِهِمْ ط وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شٰكِرِيْنَ)‏

“অতঃপর আমি তাদের নিকট আসবই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ , ডান ও বাম দিক হতে এবং তুমি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবে না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১৭)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:

(قَالَ أَرَأَيْتَكَ هٰذَا الَّذِيْ كَرَّمْتَ عَلَيَّ ز لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلٰي يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَه۫ٓ إِلَّا قَلِيْلًا)‏

“সে বলেছিল: আপনি কি বিবেচনা করেছেন, আপনি আমার ওপর এ ব্যক্তিকে মর্যাদা দান করলেন, কিয়ামতের দিন পর্যন্ত‎ যদি আমাকে অবকাশ দেন তাহলে আমি অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরগণকে অবশ্যই কর্তৃত্বাধীন করে ফেলব।’’ (সূরা ইসরা ১৭:৬২)

তবে যারা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা তারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে পথভ্রষ্ট হবে না।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ)‏

“কিন্তু তাদের মধ্যে যারা তোমার‎ একনিষ্ঠ বান্দা, তাদের ছাড়া।” (সূরা সোয়াদ ৩৮:৮৩)

সে কেবল যারা অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকবে তাদেরকেই পথভ্রষ্ট করবে, অন্যদেরকে নয়।

আল্লাহ তা‘আলার সৎ বান্দাদের ওপর তার কোনই কর্তৃত্ব থাকবেনা। এর অর্থ এই নয় যে, তাদের দ্বারা কোন পাপ কাজ হবে না। বরং উদ্দেশ্য হল তারা এমন কোন পাপ করবে না, যার পর তারা লজ্জিত হবে না বা তাওবা করবে না। কারণ সে পাপই মানুষের ধ্বংসের কারণ হয় যার পর মানুষ অনুতপ্ত হয় না এবং তাওবাও করে না। মানুষ পাপ করতে পারে এটাই স্বাভাবিক, তবে পাপ কাজ করার পর তাওবা করলে তাকে পাকড়াও করা হবে না। কোন ব্যক্তির ভুলবশত পাপ হয়ে যাওয়ার পর তাওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা তার চেয়ে বেশি খুশি হন যেমন মরুভূমিতে কারো খাদ্য ও পানীয়সহ বাহন হারিয়ে যাওয়ার পর তা ফিরে পেলে খুশি হয়।

আর যারা ইবলীসের অনুসরণ করবে তারাই হবে বিভ্রান্ত। আর তারাই জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

سَبْعَةُ أَبْوَابٍ

অর্থাৎ প্রত্যেক দরজা এক এক ধরনের বিশেষ লোকদের জন্য নির্দিষ্ট হবে। যেমন একটি হবে মুশকিরকদের জন্য, একটি হবে নাস্তিকদের জন্য, একটি হবে ধর্মদ্রোহীদের জন্য, একটি হবে ব্যভিচারীদের জন্য, একটি হবে সুদখোর ও চোর-ডাকাতদের জন্য, এরূপ আলাদা আলাদা হবে। অথবা সাতটি দরজা বলতে জাহান্নামের সাতটি স্তরকে বুঝানো হয়েছে। প্রথমটির নাম জাহান্নাম, তারপর লাযা, তারপর হুতামাহ, তারপর সায়ীর, তারপর সাকার, তারপর জাহীম, তারপর হাবিয়াহ। সবার উপরের স্তরটি আল্লাহ তা‘আলার একত্বে বিশ্বাসীদের জন্য হবে। তাদেরকে পাপ অনুপাতে কিছুদিন শাস্তি দিয়ে অথবা সুপারিশ করার পর বের করা হবে। দ্বিতীয়টি ইয়াহূদী, তৃতীয়টি খ্রিস্টান, চতুর্থটি সাবী, পঞ্চমটি অগ্নিপূজক, ষষ্ঠটি মুশরিকদের জন্য এবং সর্বনিম্ন স্তর সপ্তমটি মুনাফিকদের জন্য। (ফাতহুল কাদীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলার সৎ বান্দাগণ নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে থাকবে, সকল বিপদাপদ থেকে শান্তি এবং সকল প্রকার ভয় হতে নিরাপত্তায় থাকবে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

“যা তাদের প্রতিপালক তাদেরকে প্রদান করবেন; তা তারা গ্রহণ করবে। নিশ্চয়ই তারা ইতোপূর্বে সৎকর্মপরায়ণ ছিল। তারা রাতের সামান্য অংশই নিদ্রাবস্থায় অতিবাহিত করত। রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত। এবং তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক্ব।” (সূরা যারিআত ৫১:১৫-১৯)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

“মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে উদ্যান ও ঝর্ণার মাঝে, তারা পরিধান করবে মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং তারা মুখোমুখী হয়ে বসবে, এরূপই ঘটবে; তাদেরকে বিবাহ দিয়ে দেব বড় বড় চক্ষুবিশিষ্ট পরমা সুন্দরীদের সাথে। সেখানে তারা প্রশান্ত চিত্তে বিবিধ ফল-মূল আনতে বলবে। প্রথম মৃত্যুর পর তারা সেখানে আর মৃত্যু আস্বাদন করবে না। তিনি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করবেন তোমার প্রতিপালকের নিজ অনুগ্রহে। এটাই তো মহা সাফল্য।” (সূরা দুখান ৪৪:৫১-৫৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

“নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা থাকবে জান্নাতে ও ভোগ-বিলাসে, তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা দিবেন তারা তা উপভোগ করবে এবং তিনি তাদেরকে রক্ষা করবেন জাহান্নামের আযাব হতে তোমরা তৃপ্তির সাথে পানাহার কর, তোমরা যা করতে তার প্রতিদানস্বরূপ। তারা শ্রেণীবদ্ধভাবে সজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে; আমি তাদের বিয়ে দেব সুনয়না (বড় বড় চক্ষুবিশিষ্ট) হূরের সঙ্গে।” (সূরা তুর ৫২:১৭-২০) এছাড়া অসংখ্য আয়াত রয়েছে।

(وَنَزَعْنَا مَا فِيْ صُدُوْرِهِمْ مِّنْ غِلٍّ)
অর্থাৎ পৃথিবীতে তাদের মধ্যে যে হিংসে-বিদ্বেষ, ঘৃণা বা শত্র“তা ছিল, তা তাদের অন্তর থেকে বের করে নেয়া হবে। যার ফলে তাদের অন্তর হবে একে অপরের জন্য আয়নার মত স্বচ্ছ ও পরিস্কার।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَنَزَعْنَا مَا فِيْ صُدُوْرِهِمْ مِّنْ غِلٍّ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهٰرُ ج وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ هَدٰنَا لِهٰذَا)

“আমি তাদের অন্তর হতে হিংসে-বিদ্বেষ দূর করে দিব, তাদের পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী এবং তারা বলবে, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাদেরকে এর পথ দেখিয়েছেন।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৪৩)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: মু’মিনদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দানের পর জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থলে অবস্থিত পুলের উপর আটক করা হবে এবং দুনিয়ায় যে তারা একে অপরের উপর জুলুম করেছিল তারা একে অপর হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। অতঃপর তারা যখন হিংসে-বিদ্বেষ মুক্ত অন্তরের অধিকারী হয়ে যাবে তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫৩৫)

مُّتَقٰبِلِيْنَ অর্থাৎ জান্নাতীরা জান্নাতের খাটের ওপর মুখোমুখি হয়ে বসবে।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(عَلٰی سُرُرٍ مَّوْضُوْنَةٍﭞﺫ مُّتَّکِئِیْنَ عَلَیْھَا مُتَقٰبِلِیْنَﭟ یَطُوْفُ عَلَیْھِمْ وِلْدَانٌ مُّخَلَّدُوْنَﭠﺫ بِاَکْوَابٍ وَّاَبَارِیْقَﺃ وَکَاْسٍ مِّنْ مَّعِیْنٍﭡ)

“তারা থাকবে স্বর্ণখচিত আসনসমূহে, তার ওপরে হেলান দিয়ে পরস্পর মুখোমুখি হয়ে বসবে। তাদের সেবায় ঘোরাফেরা করবে চির কিশোরেরা। পানপাত্র, ঘটি ও শরাবে পরিপূর্ণ পেয়ালা নিয়ে, (এরা হাজির হবে।) (সূরা ওয়াকিয়া ৫৬:১৫-১৮)

জান্নাতে মু’মিনদের কোন কষ্ট থাকবে না, তারা সেখানে চিরস্থায়ীরূপে থাকবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(الَّذِيْٓ أَحَلَّنَا دَارَ الْمُقَامَةِ مِنْ فَضْلِه۪ ج لَا يَمَسُّنَا فِيْهَا نَصَبٌ وَّلَا يَمَسُّنَا فِيْهَا لُغُوْبٌ)‏

“যিনি স্বীয় অনুগ্রহে আমাদেরকে অনন্ত নির্বাসে স্থান দিয়েছেন, সেখানে আমাদেরকে কোন কষ্টও স্পর্শ করে না এবং সেথায় আমাদেরকে কোন ক্লান্তিও স্পর্শ করে না।” (সূরা ফাতির ৩৫:৩৫)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(اِنَّ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ کَانَتْ لَھُمْ جَنّٰتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا﮺ﺫ خٰلِدِیْنَ فِیْھَا لَا یَبْغُوْنَ عَنْھَا حِوَلًا﮻)‏

“নিশ্চয়ই‎ যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের আপ্যায়নের জন্য আছে ফিরদাউসের উদ্যান, সেথায় তারা স্থায়ী হবে, তা হতে স্থানান্ত‎র কামনা করবে না।” (সূরা কাহফ ১৮:১০৭-১০৮)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: জান্নাতীদেরকে বলা হবে যে, হে জান্নাতীগণ! তোমরা চিরকাল সুস্থ থাকবে, কখনো রোগাক্রান্ত হবে না; সর্বদা জীবিত থাকবে কখনো মৃত্যুবরণ করবে না; সর্বদা যুবকই থাকবে কখনো বৃদ্ধ হবে না; চিরকাল এখানেই থাকবে কখনো বের হবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ২৮৩৭)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন সকলকে জানিয়ে দেয়ার জন্য যে, আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমাশীল ও দয়ালু, আবার তিনি কঠিন শাস্তিদাতাও।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

لَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ مَا عِنْدَ اللّٰهِ مِنَ الْعُقُوبَةِ، مَا طَمِعَ بِجَنَّتِهِ أَحَدٌ، وَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ مَا عِنْدَ اللّٰهِ مِنَ الرَّحْمَةِ، مَا قَنَطَ مِنْ جَنَّتِهِ أَحَدٌ

মু’মিন যদি জানত আল্লাহর কাছে কত কঠিন শাস্তি রয়েছে তাহলে কেউ জান্নাতের আশা করত না। কাফির যদি জানত আল্লাহর কাছে কত রহমত রয়েছে তাহলে কেউ জান্নাত থেকে নিরাশ হত না। (সহীহ মুসলিম হা: ২৭৫৫)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَي قَلْبِ بَشَرٍ

আমি আমার বান্দার জন্য এমন কিছু তৈরি করে রেখেছি যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শোনেনি এমনকি কোন মানুষের অন্তরে কল্পনায় আসেনি। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৮২৪)

সুতরাং এ নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত তাদের জন্যই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলবে এবং সৎআমল করবে। সুতরাং আমাদের উচিত সর্বদা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলা এবং বেশি বেশি সৎ আমল করা।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে আর জিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে।
২. সর্বপ্রথম যুক্তি পেশ করেছিল ইবলীস।
৩. আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ মানার ব্যাপারে কোন প্রকার যুক্তি-তর্ক পেশ করা চলবে না।
৪. জাহান্নামের সাতটি দরজা রয়েছে।
৫. শয়তান মানুষের মাধ্যমে খারাপ কাজ করানোর জন্য সর্বদা ওঁৎ পেতে রয়েছে।
৬. ইবলীস থেকে আল্লাহ তা‘আলার সৎ বান্দাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।
৭. মুত্তাকিদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এমন নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত তৈরি করে রেখেছেন যা কল্পনাতীত।

তফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
#এখানে কুরআন পরিষ্কার করে একথা বলে দিচ্ছে যে, মানুষ বির্বতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পশুত্বের পর্যায় অতিক্রম করে মানবতার পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। ডারউইনের ক্রমবিবর্তনবাদে প্রভাবিত আধুনিক যুগের কুরআনের ব্যাখ্যাতাগণ একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। বরং কুরআন বলছে, সরাসরি মৃত্তিকার উপাদান থেকে তার সৃষ্টিকর্ম শুরু হয়। صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ (শুকনো ঠন্ঠনে পঁচা মাটি) শব্দাবলীর মাধ্যমে একথা ব্যক্ত করা হয়েছে। حَمَإٍ বলতে আরবী ভাষায় এমন ধরনের কালো কাদা মাটিকে বুঝায় যার মধ্যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়ে গেছে, যাকে আমরা নিজেদের ভাষায় পংক বা পাঁক বলে থাকি অথবা অন্য কথায় বলা যায়, যা মাটির গোলা বা মণ্ড হয়ে গেছে। مَسْنُونٍ শব্দের দুই অর্থ হয়। একটি অর্থ, পরিবর্তিত, অর্থাৎ এমন পচা, যার মধ্যে পচন ধরার ফলে চক্চকে ও তেলতেলে ভাব সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় অর্থ, চিত্রিত। অর্থাৎ যা একটা নির্দিষ্ট আকৃতি ও কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। صَلْصَالٍ বলা হয় এমন পচা কাদাকে যা শুকিয়ে যাওয়ার পর ঠন্ঠন্ করে বাজে। এ শব্দাবলী থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে, গাঁজানো কাদা মাটির গোলা বা মণ্ড থেকে প্রথমে একটি পুতুল বানানো হয় এবং পুতুলটি তৈরী হবার পর যখন শুকিয়ে যায় তখন তার মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেয়া হয়।
# سَّمُومِ বলা হয় গরম বাতাসকে। আর আগুনকে সামুমের সাথে সংযুক্ত করার ফলে এর অর্থ আগুনের পরিবর্তে হয় প্রখর উত্তাপ। কুরআনের যেসব জায়গায় জিনকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ আয়াত থেকে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হয়ে যায়। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা আর রহমান, টীকাঃ ১৪ – ১৫ – ১৬ )

# কুরআন মজীদে মানুষ সৃষ্টির যে প্রাথমিক পর্যায়সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে, কুরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানের বক্তব্য একত্রিত করে তার নিম্নবর্ণিত ক্রমিক বিন্যাস অবগত হওয়া যায়।

(১) তুরাব অর্থাৎ মাটি।

(২) ত্বীন অর্থাৎ পচা কর্দম যা মাটিতে পানি মিশিয়ে বানানো হয়।

(৩) ত্বীন লাযেব-আঠালো কাদামাটি। অর্থাৎ এমন কাদা, দীর্ঘদিন পড়ে থাকার কারণে যার মধ্যে আঠা সৃষ্টি হয়ে যায়।

(৪)حَمَإٍ مَسْنُونٍ যে কাদার মধ্যে গন্ধ সৃষ্টি হয়ে যায়।

(৫) صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ كَالْفَخَّارِ অর্থাৎ পচা কাদা যা শুকিয়ে যাওয়ার পরে মাটির শুকনো ঢিলার মত হয়ে যায়।

(৬) بشر মাটির এ শেষ পর্যায় থেকে যাকে বানানো হয়েছে, আল্লাহ‌ তা’আলা যার মধ্যে তাঁর বিশেষ রূহ ফূৎকার করেছেন, ফেরেশতাদের দিয়ে যাকে সিজদা করানো হয়েছিল এবং তার সমজাতীয় থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করা হয়েছিল। (৭) ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ তারপর পরবর্তী সময়ে নিকৃষ্ট পানির মত সংমিশ্রিত দেহ নির্যাস থেকে তার বংশ ধারা চালু করা হয়েছে। এ কথাটি বুঝাতে অন্য স্থানসমূহে نطفه শুক্র শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

মানব সৃষ্টির এ পর্যায়সমূহ অবগত হওয়ার জন্য কুরআন মজীদের নিম্নবর্ণিত আয়াতসমূহ পর্যায়ক্রমে পাঠ করুন।

كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ (ال عمران : 59) (সূরা আলে ইমরান আয়াত, ৫৯ )

إِنَّا خَلَقْنَاهُمْ مِنْ طِينٍ لَازِبٍ (الصفات : 11) (সূরা আস সাফ্ফাত আয়াত ১১ )بَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ (السجده : 7) (সূরা আস সিজদা আয়াত ৭ )

চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায় আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তার পরের পর্যায়গুলো নীচের আয়াত সমূহে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ – فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ (ص : 71-72) خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً (النساء: 1) ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ (السجده : ٨) فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ (الحج : ٥)

( সোয়াদ – ৭১-৭২ ), ( নিসা -১ )( সূরা আল হজ্জ আয়াত-৫ )।
# মূল আয়াতে مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। نار অর্থ এক বিশেষ ধরনের আগুন। কাঠ বা কয়লা জ্বালালো যে আগুন সৃষ্টি এটা সে আগুন নয়। আর مارج অর্থ ধোঁয়াবিহীন শিখা। এ কথার অর্থ হচ্ছে প্রথম মানুষকে যেভাবে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তারপর সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করার সময় তার মাটির সত্তা অস্থি-মাংসে তৈরী জীবন্ত মানুষের আকৃতি লাভ করেছে এবং পরবর্তী সময়ে শুক্রের সাহায্যে তার বংশধারা চালু আছে। অনুরূপ প্রথম জিনকে নিছক আগুনের শিখা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তার বংশধরদের থেকে পরবর্তী সময়ে জিনদের অধস্তন বংশধররা সৃষ্টি হয়ে চলেছে। মানব জাতির জন্য আদমের মর্যাদা যা, জ্বীন জাতির জন্য সেই প্রথম জিনের মর্যাদাও তাই। জীবন্ত মানুষ হয়ে যাওয়ার পর হযরত আদম এবং তার বংশ থেকে জন্ম লাভকারী মানুষের দেহের সেই মাটির সাথে যেমন কোন মিল থাকলো না যে মাটি দ্বারা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। যদিও এখনো আমাদের দেহে পুরোটাই মাটির অংশ দ্বারাই গঠিত। কিন্তু মাটির ঐ সব অংশ রক্ত-মাংসে রূপান্তরিত হয়েছে এবং প্রাণ সঞ্চরিত হওয়ার পর তা শুধু মাটির দেহ না থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিসে রূপান্তরিত হয়েছে। জিনদের ব্যাপারটিও তাই। তাদের সত্তাও মূলত আগুনের সত্তা। কিন্তু আমরা যেমন মাটির স্তুপ নই, অনূরূপ তারাও শুধু অগ্নি শিখা নয়।

এ আয়াত থেকে দু’টি বিষয় জানা যায়ঃ এক, জিনেরা, নিছক আত্মিক সত্তা নয়, বরং তাদেরও এক ধরনের জড় দেহ আছে। তবে তা যেহেতু নিরেট আগুনের উপাদানে গঠিত তাই তারা মাটির উপাদানে গঠিত মানুষের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। নীচে বর্ণিত এ আয়াতটি এ বিষয়ের প্রতিই ইঙ্গিত করেঃ

إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ

“শয়তান ও তার দলবল এমন অবস্থান থেকে তোমাদের দেখছে যেখানে তোমরা তাদের দেখতে পাও না” (আল আ’রাফ-২৭ )। অনুরূপভাবে জিনদের দ্রুত গতিসম্পন্ন হওয়া, অতি সহজেই বিভিন্ন আকার-আকৃতি গ্রহণ করা এবং যেখানে মাটির উপাদানে গঠিত বস্তুসমূহ প্রবেশ করতে পারে না, কিংবা প্রবেশ করলেও তা অনুভূত হয় বা দৃষ্টি গোচর হয়, সেখানে তাদের প্রবেশ অনুভূত বা দৃষ্টিগোচর না হওয়া-এসবই এ কারণে সম্ভব ও বোধগম্য যে, প্রকৃতই তারা আগুনের সৃষ্টি।

এ থেকে দ্বিতীয় যে বিষয়টি জানা যায় তা হচ্ছে, জিনরা মানুষ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সৃষ্টিই শুধু নয়, বরং তাদের সৃষ্টি উপাদানই মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদরাজি এবং চেতনা পদার্থসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা জিনদেরকে মানুষেরই একটি শ্রেনী বলে মনে করে এ আয়াত স্পষ্ট ভাষায় তাদের ভ্রান্তি প্রমাণ করছে। তারা এর ব্যাখ্যা করে বলেন, মাটি থেকে মানুষকে এবং আগুন থেকে জিনকে সৃষ্টি করার অর্থ প্রকৃত পক্ষে দুই শ্রেণীর মানুষের মেজাজের পার্থক্য বর্ণনা করা। এক প্রকারের মানুষ নম্র মেজাজের হয়ে থাকেন। সত্যিকার অর্থে তারাই মানুষ। আরেক প্রকারের মানুষের মেজাজ হয় অগ্নিষ্ফুলিঙ্গের মত গরম। তাদের মানুষ না বলে শয়তান বলাটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। তবে এ ধরনের ব্যাখ্যা প্রকৃতপক্ষে কুরআনের তাফসীর নয়, কুরআনের বিকৃতি সাধন করা। উপরে ১৪ নম্বর টীকায় আমরা দেখিয়েছি যে, কুরআন নিজেই মাটি দ্বারা মানুষের সৃষ্টির অর্থ কতটা স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে। বিস্তারিত এসব বিবরণ পড়ার পর কোন বিবেকবান ব্যক্তি কি এর এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে যে, এসব কথার উদ্দেশ্য শুধু উত্তম মানুষের নম্র মেজাজ হওয়ার প্রশংসা করা? তার পরেও সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষের মগজে একথা কি করে আসতে পারে যে, মানুষকে পঁচা আঠাল মাটির শুকনো ঢিলা থেকে সৃষ্টি করা এবং জিনদেরকে নিরেট অগ্নি শিখা থেকে সৃষ্টি করার অর্থ একই মানব জাতির দু’টি ভিন্ন ভিন্ন মেজাজের ব্যক্তিদের বা গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র নৈতিক গুণাবলীর পার্থ্যক্য বর্ণনা করা? (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা যারিয়াতের তাফসীর, টীকা-৫৩ )।
# এখানে ক্ষেত্র অনুসারে الاء শব্দের অর্থ “অসীম” ক্ষমতার বিস্ময়কর দিক সমূহই অধিক উপযোগী। তবে এর মধ্যে নিয়ামতের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। মাটি থেকে মানুষ এবং আগুনের শিখা থেকে জিনের মত বিস্ময়কর জীবকে অস্তিত্ব দান করা যেমন আল্লাহর অসীম ক্ষমতার বিস্ময়কর ব্যাপার। তেমনি এ দু’টি সৃষ্টির জন্য এটিও এক বিরাট নিয়ামত যে, আল্লাহ‌ তা’আলা তাদেরকে শুধু সৃষ্টিই করেননি, বরং প্রত্যেককে এমন আকার আকৃতি দান করেছেন, প্রত্যেকের মধ্যে এমন সব শক্তি ও যোগ্যতা দিয়েছেন যার সাহায্যে তারা পৃথিবীতে বড় বড় কাজ সম্পন্ন করার যোগ্য হয়েছে। জিনদের সম্পর্কে আমাদের কাছে বেশী তথ্য না থাকলেও মানুষ তো আমাদের সামনে বিদ্যমান। মানুষকে মানুষের মস্তিষ্ক দেয়ার পরে যদি মাছ, পাখি অথবা বানরের দেহ দান করা হতো তাহলে সেই দেহ নিয়ে কি সে ঐ মস্তিষ্কের উপযোগী কাজ করতে পারতো? তাহলে এটা কি আল্লাহর বিরাট নিয়ামত নয় যে, মানুষের মস্তিষ্কে তিনি যে সব শক্তি দিয়েছেন তা কাজে লাগানোর জন্য সর্বাধিক উপযোগী দেহও তাকে দান করেছেন? এক দিকে এ হাত, পা, চোখ, কান, জিহ্বা ও দীর্ঘ দেহ এবং অপরদিকে এ জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা, আবিষ্কার ও যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপনের ক্ষমতা, শৈল্পিক নৈপুন্য এবং কারিগরি যোগ্যতা পাশাপাশি রেখে বিচার করলে বুঝতে পারবেন এ সবের স্রষ্টা এসবের মধ্যে পূর্ণ মাত্রার যে সামঞ্জস্য বিধান করেছেন তা যদি না থাকতো তাহলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে পড়তো। এসব জিনিসই আবার আল্লাহ‌ তা’আলার মহত গুণাবলীর প্রতি ইঙ্গিত করে। জ্ঞান-বুদ্ধি, সৃষ্টি নৈপুন্য, অপরিসীম দয়া এবং পূর্ণমাত্রার সৃষ্টি ক্ষমতা ছাড়া মানুষ ও জিনের মত এমন জীব কি করে সৃষ্টি হতে পারতো? আকস্মিক দুর্ঘটনা এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মতৎপর অন্ধ ও বধির প্রাকৃতিক নিয়ম এরূপ অনুপম ও বিস্ময়কর সৃষ্টিকর্ম কি করে সম্পন্ন করতে পারে?
# এ থেকে জানা যায়, মানুষের মধ্যে যে রূহ ফুঁকে দেয়া হয় অর্থাৎ প্রাণ সঞ্চার করা হয় তা মূলত আল্লাহর গুণাবলীর একটি প্রতিচ্ছায়া। জীবন, জ্ঞান, শক্তি, সামর্থ্য, সংকল্প এবং অন্যান্য যতগুলো গুণ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়, যেগুলোর সমষ্টির নাম প্রাণ—-সেসবই আসলে আল্লাহরই গুণাবলীর একটি প্রতিচ্ছায়া। মানুষের মাটির দেহ-কাঠামোটির ওপর এ প্রতিচ্ছায়া ফেলা হয়। আর এ প্রতিচ্ছায়ার কারণেই মানুষ এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং ফেরেশতাগণসহ পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি তাকে সিজদা করেছে।

আসলে তো সৃষ্টির মধ্যে যেসব গুণের সন্ধান পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটিরই উৎস ও উৎপত্তিস্থল আল্লাহরই কোন না কোন গুণ। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ

جَعَلَ اللَّهُ الرَّحْمَةَ مِائَةَ جُزْءٍ ، فَأَمْسَكَ عِنْدَهُ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ جُزْءًا ، وَأَنْزَلَ فِى الأَرْضِ جُزْءًا وَاحِدًا ، فَمِنْ ذَلِكَ الْجُزْءِ يَتَرَاحَمُ الْخَلْقُ ، حَتَّى تَرْفَعَ الْفَرَسُ حَافِرَهَا عَنْ وَلَدِهَا خَشْيَةَ أَنْ تُصِيبَهُ(بخارى , مسلم)

“মহান আল্লাহ, রহমতকে একশো ভাগে বিভক্ত করেছেন। তারপর এর মধ্য থেকে ৯৯ টি অংশ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন এবং মাত্র একটি অংশ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন। এই একটি মাত্র অংশের বরকতেই সমুদয় সৃষ্টি পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহশীল হয়। এমনকি যদি একটি প্রাণী তার নিজের সন্তান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এজন্য তার ওপর থেকে নিজের নখর উঠিয়ে নেয় তাহলে এটিও আসলে এ রহমত গুণের প্রভাবেরই ফলশ্রুতি।”—(বুখারী ও মুসলিম)

কিন্তু আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিচ্ছায়া যে ধরনের পূর্ণতার সাথে মানুষের ওপর ফেলা হয় অন্য কোন প্রাণীর ওপর তেমনভাবে ফেলা হয়নি। এজন্যই অন্যান্য সৃষ্টির ওপর মানুষের এ প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব।

এটি একটি সূক্ষ্ম বিষয়। এটি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সামান্যতম ভ্রান্তি মানুষকে এমন বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে যার ফলে সে আল্লাহর গুণাবলীর একটি অংশ লাভ করাকে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার কোন অংশ লাভ করার সমার্থক মনে করতে পারে। অথচ আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার সামান্যতম অংশ লাভ করার কথাও কোন সৃষ্টির জন্য কল্পনাই করা যায় না।
# তুলনামূলক পর্যালোচনার জন্য সূরা বাকারার ৪ রুকূ’ , সূরা নিসার ১৮ রুকূ’ এবং সূরা আ’রাফের ২ রুকূ’ দেখুন। তাছাড়া এসব জায়গায় আমি যে টীকাগুলো লিখেছি সেগুলোও একটু সামনে রাখলে ভাল হয়।
# সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-30

وَ اِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓئِكَةِ اِنِّیْ جَاعِلٌ فِی الْاَرْضِ خَلِیْفَةً١ؕ قَالُوْۤا اَتَجْعَلُ فِیْهَا مَنْ یُّفْسِدُ فِیْهَا وَ یَسْفِكُ الدِّمَآءَ١ۚ وَ نَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَ نُقَدِّسُ لَكَ١ؕ قَالَ اِنِّیْۤ اَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ

আবার সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই।” তারা বললো, “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে? আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি।” আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না।”

তাফসীর :

# ওপরের রুকু’তে আল্লাহর বন্দেগী করার আহবান জানানো হয়েছিল। এ আহবানের ভিত্তিভূমি ছিল নিম্নরূপঃ আল্লাহ‌ তোমাদের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তাঁর হাতেই তোমাদের জীবন ও মৃত্যু। যে বিশ্ব-জগতে তোমরা বাস করছো তিনিই তার একচ্ছত্র অধিপতি ও সার্বভৌম শাসক। কাজেই তাঁর বন্দেগী ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি তোমাদের জন্য সঠিক নয়। এখন এই রুকূ’তে অন্য একটি ভিত্তি ভূমির ওপর ঐ একই আহবান জানানো হয়েছে। অর্থাৎ এই দুনিয়ায় আল্লাহ‌ তোমাদেরকে খলীফা পদে অভিষিক্ত করেছেন। খলীফা হবার কারণে কেবল তাঁর বন্দেগী করলেই তোমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না বরং এই সঙ্গে তাঁর পাঠানো হিদায়াত ও নির্দেশাবলী অনুযায়ী জীবন যাপনও করতে হবে। আর যদি তোমরা এমনটি না কর তোমাদের আদি শত্রু শয়তানের ইঙ্গিতে চলতে থাকো, তাহলে তোমরা নিকৃষ্ট পর্যায়ের বিদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং এ জন্য তোমাদের চরম পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।এ প্রসঙ্গে মানুষের স্বরূপও বিশ্ব-জগতে তার মর্যাদা ও ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসের এমন অধ্যায়ও উপস্থাপন করা হয়েছে যে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার দ্বিতীয় কোন মাধ্যম মানুষের করায়ত্ত নেই। এই অধ্যায়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত লাভ করা হয়েছে তা প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যায়ে মাটির তলদেশ খুড়ে বিক্ষিপ্ত অস্থি ও কংকাল একত্র করে আন্দাজ –অনুমানের ভিত্তিতে সেগুলোর মধ্যে সম্পর্কে স্থাপনের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে অনেক বেশী মূল্যবান।

# এখানে মূল আরবী শব্দ ‘মালাইকা’ হচ্ছে বহুবচন। একবচন ‘মালাক’। মালাক –এর আসল মানে “বাণীবাহক।” এরই শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে ‘যাকে পাঠানো হয়েছে’ বা ফেরেশতা। ফেরেশতা নিছক কিছু কায়াহীন, অস্তিত্বহীন শক্তির নাম নয়। বরং এরা সুস্পষ্ট কায়া ও স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকারী। আল্লাহ‌ তার এই বিশাল সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় তাদের খেদমত নিয়ে থাকেন। তাদেরকে আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যের কর্মচারী বলা যায়। আল্লাহর বিধান ও নির্দেশাবলী তারা প্রবর্তন করে থাকেন। মূর্খ লোকেরা ভুলক্রমে তাদেরকে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও কাজ-কারবারে অংশীদার মনে করে। কেউ কেউ তাদেরকে মনে করে আল্লাহর আত্মীয়। এ জন্য দেবতা বানিয়ে তাদের পূজা করে।

# যে ব্যক্তি কারো অধিকারের আওতাধীনে তারই অর্পিত ক্ষমতা-ইখতিয়ার ব্যবহার করে তাকে খলীফা বলে। খলীফা নিজে মালিক নয় বরং আসল মালিকের প্রতিনিধি। সে নিজে ক্ষমতার অধিকারী নয় বরং মালিক তাকে ক্ষমতার অধিকার দান করেছেন, তাই সে ক্ষমতা ব্যবহার করে। সে নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করার অধিকার রাখে না। বরং মালিকের ইচ্ছে পূরণ করাই হয় তার কাজ। যদি সে নিজেকে মালিক মনে করে বসে এবং তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাকে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে থাকে অথবা আসল মালিককে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে নিয়ে তারই ইচ্ছে পূরণ করতে এবং তার নির্দেশ পালন করতে থাকে, তাহলে এগুলো সবই বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে গণ্য হবে।

# এটা ফেরেশতাদের আপত্তি ছিল না। বরং এটা ছিল তাদের জিজ্ঞাসা। আল্লাহর কোন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করার অধিকারই ফেরেশতাদের ছিল না। ‘খলীফা’ শব্দটি থেকে তারা অবশ্যি এতটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, পরিকল্পনায় উল্লেখিত সৃষ্টজীবকে, দুনিয়ায় কিছু ক্ষমতা-ইখতিয়ার দান করা হবে। তবে বিশ্ব-জাহানের এ বিশাল সাম্রাজ্য আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের আওতাধীনে কোন স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন সৃষ্টজীব কিভাবে অবস্থান করতে পারে—একথা তারা বুঝতে পারছিল না। এই সাম্রাজ্যের কোন অংশে কাউকে যদি সামান্য কিছু স্বাধীন ক্ষমতা দান করা হয় তাহলে সেখানকার ব্যবস্থাপনা বিপর্যয়ের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে, একথা তারা বুঝতে চাইছিল।

# এই বাক্যে ফেরেশতারা একথা বলতে চায়নি যে, খিলাফত তাদেরকে দেয়া হোক কারণ তারাই এর হকদার। বরং তাদের বক্তব্যের অর্থ ছিলঃ “হে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ! আপনার হুকুম পালন করা হচ্ছে। আপনার মহান ইচ্ছা অনুযায়ী সমস্ত বিশ্ব-জাহানকে আমরা পাক পবিত্র করে রাখছি। আর এই সাথে আপনার প্রশংসাগীত গাওয়া ও স্তব-স্তুতি করা হচ্ছে। আমরা আপনার খাদেমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং আপনার তাসবীহ পড়ছি তাহলে এখন আর কিসের অভাব থেকে যায়? একজন খলীফার প্রয়োজন দেখা দিল কেন? এর কারণ আমরা বুঝতে পারছি না। (তাসবীহ শব্দটির দুই অর্থ হয়। এর একটি অর্থ যেমন পবিত্রতা বর্ণনা করা হয় তেমনি অন্য একটি অর্থ হয় তৎপরতার সাথে কাজ করা এবং মনোযোগ সহকারে প্রচেষ্টা চালানো। ঠিক এভাবেই তাকদীস শব্দটিরও দুই অর্থ হয়। এক, পবিত্রতার প্রকাশ ও বর্ণনা এবং দুই, পাক-পবিত্র করা।)

# এটি হচ্ছে ফেরেশতাদের দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব। বলা হয়েছে, খলীফা নিযুক্ত করার কারণ ও প্রয়োজন আমি জানি, তোমরা তা বুঝতে পারবে না। তোমরা নিজেদের যে সমস্ত কাজের কথা বলছো, সেগুলো যথেষ্ট নয়। বরং এর চাইতেও বেশী আরো কিছু আমি চাই। তাই পৃথিবীতে ক্ষমতা-ইখতিয়ার সম্পন্ন একটি জীব সৃষ্টি করার সংকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
# সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-119

وَّ لَاُضِلَّنَّهُمْ وَ لَاُمَنِّیَنَّهُمْ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُبَتِّكُنَّ اٰذَانَ الْاَنْعَامِ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُغَیِّرُنَّ خَلْقَ اللّٰهِ١ؕ وَ مَنْ یَّتَّخِذِ الشَّیْطٰنَ وَلِیًّا مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِیْنًاؕ

আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবো। তাদেরকে আশার ছলনায় বিভ্রান্ত করবো। আমি তাদেরকে হুকুম করবো এবং আমার হুকুমে তারা পশুর কান ছিঁড়বেই। আমি তাদেরকে হুকুম করবো এবং আমার হুকুমে তারা আল্লাহর সৃষ্টি আকৃতিতে রদবদল করে ছাড়বেই।” যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এই শয়তানকে বন্ধু ও অভিভাবক বানিয়েছে সে সুস্পষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

তাফসীর :

# আরববাসীদের বহুতর কুসংস্কারের মধ্যে একটির দিকে এখানে ইশারা করা হয়েছে। তাদের নিয়ম ছিল, উটনী পাঁচটি বা দশটি বাচ্চা প্রসব করার পর তার কান চিরে তাকে তারা নিজেদের দেবতার নামে ছেড়ে দিতো এবং তাকে কোন কাজে ব্যবহার করা হারাম মনে করতো। এভাবে যে উটের ঔরশে দশটি বাচ্চা জন্ম নিতো তাকেও দেবতার নামে উৎসর্গ করা হতো। পশুর কান চিরে দেয়া দেবতার নামে উৎসর্গ করার আলামত হিসেবে বিবেচিত হতো।

# আল্লাহর সৃষ্টি-আকৃতিতে রদবদল করার অর্থ বস্তুর সৃষ্টিকালীন কাঠামোও আকার-আকৃতির পরিবর্তন নয়। এ অর্থ গ্রহণ করলে তো সমগ্র মানব সভ্যতা-সংস্কৃতি শয়তানের অবৈধ হস্তক্ষেপের ফসল গণ্য হবে। কারণ আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুতে মানুষের হস্তক্ষেপের নামই হচ্ছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি। আসলে এখানে যে রদবদলকে শয়তানী কাজ বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে, কোন বস্তুকে আল্লাহ‌ যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেননি তাকে সেই কাজে লাগানো এবং যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন সে কাজে না লাগানো। অন্যকথায় বলা যায়, মানুষ নিজের ও বস্তুর প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেসব কাজ করে এবং প্রকৃতির প্রকৃত উদ্দেশ্য উপেক্ষা করে যেসব পন্থা অবলম্বন করে তা সবই এই আয়াতের প্রেক্ষিতে শয়তানের বিভ্রান্তিকর আন্দোলনের ফসল। যেমন লূত জাতির কাজ, জন্ম শাসন, বৈরাগ্যবাদ, ব্রহ্মচর্য, নারী-পুরুষের বন্ধাকরণ, পুরুষদেরকে খোজা বানানো, মেয়েদের ওপর প্রকৃতি যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে সে দায়িত্ব সম্পাদন করা থেকে তাদেরকে সরিয়ে রাখা এবং সমাজ-সংস্কৃতির এমনসব বিভাগে তাদের টেনে আনা যেগুলোর জন্য পুরুষদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব কাজ এবং শয়তানের শাগরিদরা দুনিয়ায় এ ধরনের আরো যেসব অসংখ্য কাজ করে বেড়াচ্ছে সেগুলো। আসলে এই অর্থ প্রকাশ করছে যে, তারা বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার নির্ধারিত বিধি-বিধান ভুল মনে করে এবং তার মধ্যে সংস্কার সাধন করতে চায়।
# সুরা: আল-আরাফ
আয়াত নং :-11

وَ لَقَدْ خَلَقْنٰكُمْ ثُمَّ صَوَّرْنٰكُمْ ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلٰٓئِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ١ۖۗ فَسَجَدُوْۤا اِلَّاۤ اِبْلِیْسَ١ؕ لَمْ یَكُنْ مِّنَ السّٰجِدِیْنَ

আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতি দান করলাম অতঃপর ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো। এ নির্দেশ অনুযায়ী সবাই সিজদা করলো। কিন্তু ইবলীস সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলো না।

তাফসীর :
# তূলনামূলক পাঠের জন্য সূরা বাকারার ৪ রুকূ দেখুন ( আয়াত ৩০ থেকে ৩৯ )।

সূরা বাকারায় যেসব শব্দ সমন্বয়ে সিজদার আদেশ উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে সন্দেহ হতে পারে যে, নিছক এক ব্যক্তি হিসেবেই আদম আলাইহিস সালামের সামনে ফেরেশতাদেরকে সিজদা করার হুকুম দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখান থেকে সে সন্দেহ দূর হয়ে যায়। এখানে যে বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা থেকে পরিষ্কার জানা যায়, আদম আলাইহিস সালামকে আদম হিসেবে নয় বরং মানব জাতির প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে সিজদা করানো হয়েছিল।

আর আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতিদান করলাম অতঃপর ফেরশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো” একথার অর্থ হচ্ছে আমি প্রথমে তোমাদের সৃষ্টির পরিকল্পনা প্রণয়ন করলাম, তোমাদের সৃষ্টির মৌলিক উপাদান তৈরী করলাম তারপর সেই উপাদানকে মানবিক আকৃতি দান করলাম অতঃপর আদম যখন একজন জীবিত মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো তখন তাকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদেরকে হুকুম দিলাম। কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানেও এ আয়াতটির এরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন সূরা “সোয়াদ” এর পঞ্চম রুকূ’তে বলা হয়েছেঃ

إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ – فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ

“সেই সময়ের কথা চিন্তা করো যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি মাটি থেকে একটা মানুষ তৈরী করবো। তারপর যখন আমি সেটি পুরোপুরি তৈরী করে ফেলবো এবং তার মধ্যে নিজের রূহ থেকে কিছু ফূঁকে দেবো তখন তোমরা সবাই তার সমানে সিজদাবনত হবে।”

এ আয়াতটিতে ঐ তিনটি পর্যায় বর্ণিত হয়েছে অন্য এক ভংগীমার। এখানে বলা হয়েছেঃ প্রথমে মাটি থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করা হবে, তারপর তার “তাসবীয়া” করা হবে অর্থাৎ তাকে আকার-আকৃতি দান করা হবে এবং তার দেহ-সৌষ্ঠব ও শক্তি-সমর্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হবে এবং সবশেষে নিজের রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দিয়ে আদমকে অস্তিত্ব দান করা হবে। এ বিষয়বস্তুটিকেই সূরা হিজর-এর তৃতীয় রুকূ’তে নিম্নলিখিত শব্দাবলীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছেঃ

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ – فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ

“আর সেই সময়টির কথা ভাবো যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি ছাঁচে ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করবো, তারপর যখন তাকে পুরোপুরি তৈরী করে ফেলবো এবং তার মধ্যে নিজের রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দেবো তখন তোমরা সবাই তার সামনে সিজদাবনত হবে।”

মানব সৃষ্টির এ সূচনা পর্বের বিস্তারিত অবস্থা অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন। মাটির পিণ্ড থেকে কিভাবে মানুষ বানানো হলো তারপর কিভাবে তাকে আকার আকৃতি দান ও তার মধ্যে ভারসাম্য কায়েম করা হলো এবং তার মধ্যে প্রাণ বায়ু ফুঁকে দেবার ধরনটিই বা কি ছিল এসবের পূর্ণ তাৎপর্য বিশ্লেষণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও একথা সুস্পষ্ট যে, বর্তমান যুগে ডারউইনের অনুসারীরা বিজ্ঞানের নামে যেসব মতবাদ পেশ করছে মানব সৃষ্টির সূচনা পর্বের অবস্থা সম্পর্কে কুরআন মজীদ তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অবস্থার বর্ণনা দিয়েছে। এসব মতবাদের দৃষ্টিতে মানুষ একটি সম্পূর্ণ অমানবিক বা অর্ধমানবিক অবস্থার বিভিন্ন স্তর থেকে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে মানবিক স্তরে উপনীত হয়েছে। আর এ ক্রমবিবর্তন ধারার সুদীর্ঘ পথে এমন কোন বিশেষ বিন্দু নেই যেখান থেকে অমানবিক অবস্থার ইতি ঘোষণা করে মানব জাতির সূচনা হয়েছে বলে দাবী করা যেতে পারে। বিপরীত পক্ষে কুরআন আমাদের জানাচ্ছে, মানব বংশধারার সূচনা হয়েছে নির্ভেজাল মানবিক অস্তিত্ব থেকেই। কোন অমানবিক ধারার সাথে তার ইতিহাসের কোন কালেও কোন সম্পর্ক ছিল না। প্রথম দিন থেকে তাকে মানুষ হিসেবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল। আল্লাহ‌ পরিপূর্ণ মানবিক চেতনা সহকারে পূর্ণআলোকে তার পার্থিব জীবনের সূচনা করেছিলেন।

মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে এ দু’টি ভিন্ন ধর্মী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ সম্পর্কে দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী চিন্তাধারার উদ্ভব হয়। একটি চিন্তাধারা মানুষকে জীব-জন্তু ও পশু জগতের একটি শাখা হিসেবে পেশ করে। তার জীবনের সমস্ত আইন কানুন এমনকি নৈতিক ও চারিত্রিক আইনের জন্যও মূলনীতির সন্ধান করা হয় ইতর প্রাণীসমূহের জীবন রীতিতে ও পশুদের জীবন ধারায়। তার জন্য পশুদের ন্যায় কর্মপদ্ধতি একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতি মনে হয়। সেখানে মানবিক কর্মপদ্ধতি ও পাশবিক কর্মপদ্ধতির মধ্যে বড় জোড় এতটুকু পার্থক্য দেখার প্রত্যাশা করা হয় যে, মানুষ যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা, শিল্প-সভ্যতা-সংস্কৃতির সূক্ষ্ম ও নিপুন কারুকার্য অবলম্বনে কাজ করে। পক্ষান্তরে, পশুরা কাজ করে ঐসবের সহায়তা ছাড়াই। বিপরীত পক্ষে অন্য চিন্তাধারাটি মানুষকে পশুর পরিবর্তে “মানুষ” হিসেবেই উপস্থাপন করে। সেখানে “মানুষ বাকশক্তি সম্পন্ন পশু” বা “সামাজিক ও সংস্কৃতিবান জন্তু” (Social animal) নয় বরং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। সেখানে বাকশক্তি বা সামাজিকতাবোধ তাকে অন্যান্য জীব ও প্রাণী থেকে আলাদা করে না। বরং তাকে আলাদা করে তার নৈতিক দায়িত্ব এবং ক্ষমতা ও ইখতিয়ার যা আল্লাহ‌ তাকে দান করেছেন এবং যার ভিত্তিতে তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। এভাবে এখানে মানুষ ও তার সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কিত দৃষ্টিকোণ পূর্ববর্তী দৃষ্টিকোণটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। এখানে মানুষের জন্য একটি জীবন দর্শন এবং অন্য একটি নৈতিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক জীবন ও আইন বিধানের প্রত্যাশা করা হবে। এ জীবন দর্শন ও নৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার মূলনীতি অনুসন্ধান করার জন্য মানুষের দৃষ্টি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিম্ন জগতের পরিবর্তে উর্ধ জগতের দিকে উঠতে থাকবে।

প্রশ্ন করা যেতে পারে, মানুষ সম্পর্কিত এ দ্বিতীয় ধারণাটি নৈতিক ও মস্ততাত্বিক দিক দিয়ে যতই উন্নত পর্যায়ের হোক না কেন, নিছক কল্পনার ওপর নির্ভর করে যুক্তি-তথ্য দ্বারা প্রমাণিত একটি মতবাদকে কেমন করে রদ করা যেতে পারে? কিন্তু যারা এ ধরনের প্রশ্ন করেন, তাদের কাছে আমার পাল্টা প্রশ্ন, সত্যিই কি ডারউইনের বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তথ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত? বিজ্ঞান সম্পর্কে নিছক ভাসা ভাসা ও স্থুল জ্ঞান রাখে এমন ধরনের লোকেরা অবশ্যি এ মতবাদকে একটি প্রমাণিত তাত্বিক সত্য মনে করার ভ্রান্তিতে লিপ্ত। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও অনুসন্ধান বিশারদরা জানেন, গুটিকয় শব্দ ও হাড়গোড়ের লম্বা চওড়া ফিরিস্তি সত্ত্বেও এখনো এটি একটি মতবাদের পর্যায়েই রয়ে গেছে এবং এর যেসব যুক্তি-তথ্যকে ভুলক্রমে প্রমাণ্য বলা হচ্ছে সেগুলো নিছক সম্ভাব্যতার যুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ সেগুলোর ভিত্তিতে বড় জোর এতটুকু বলা যেতে পারে যে, ডারউইনের বিবর্তনবাদের সম্ভাবনা ঠিক ততটুকুই যতটুকু সম্ভাবনা আছে সরাসরি সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে এক একটি শ্রেণীর পৃথক অস্তিত্ব লাভের।

# কিয়ামত পর্যন্ত তুমি অভিশপ্ত থাকবে। তারপর যখন প্রতিফল দিবস কায়েম হবে তখন তোমাকে তোমার নাফরমানির শাস্তি দেয়া হবে।

# যেভাবে তুমি এ নগণ্য ও হীন সৃষ্টিকে সিজ্দা করার হুকুম দিয়ে আমাকে তোমার হুকুম অমান্য করতে বাধ্য করেছো ঠিক তেমনিভাবে এ মানুষদের জন্য আমি দুনিয়াকে এমন চিত্তাকর্ষক ও মনোমুগ্ধকর জিনিসে পরিণত করে দেবো, যার ফলে তারা সবাই এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে তোমার নাফরমানী করতে থাকবে। অন্য কথায়, ইবলীসের উদ্দেশ্য ছিল, সে পৃথিবীর জীবন এবং তার সুখ-আনন্দ ও ক্ষণস্থায়ী আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসকে মানুষের জন্য এমন চমকপ্রদ ও সুদৃশ্য করে তুলবে যার ফলে সে খিলাফত ও তার দায়িত্বসমূহ এবং পরকালের জবাবদিহির কথা ভুলে যাবে, এমনকি আল্লাহকেও ভুলে যাবে অথবা স্মরণ রাখা সত্ত্বেও তাঁর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করবে।

# هَذَا صِرَاطٌ عَلَيَّ مُسْتَقِيمٌ বাক্যের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ আমি অনুবাদে অবলম্বন করেছি। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে একথা ঠিক, আমি এটা মেনে চলবো।

# এ বাক্যের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ আমি অনুবাদে অবলম্বন করেছি। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, আমার বান্দাদের (অর্থাৎ সাধারণ মানুষদের) ওপর তোমার কোন কর্তৃত্ব থাকবে না। তুমি তাদেরকে জবরদস্তি নাফরমান বানাতে পারবে না। তবে যারা নিজেরাই বিভ্রান্ত হবে এবং নিজেরাই তোমার অনুসরণ করতে চাইবে তাদেরকে তোমার পথে চলার জন্য ছেড়ে দেয়া হবে। তোমার পথ থেকে তাদেরকে আমি জোর করে বিরত রাখার চেষ্টা করবো না।

প্রথম অর্থের দিক দিয়ে বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হবেঃ বন্দেগীর পথই হচ্ছে আল্লাহর কাছে পৌঁছবার সোজা পথ। যারা এ পথ অবলম্বন করবে তাদের ওপর শয়তানের কোন কর্তৃত্ব চলবে না। আল্লাহ তাদেরকে নিজের জন্য একান্তভাবে গ্রহণ করে নেবেন। আর শয়তান নিজেও স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, তারা তার ফাঁদে পা দেবে না। তবে যারা নিজেরাই বন্দেগীর পথ থেকে সরে এসে নিজেদের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথ হারিয়ে ফেলবে তারা ইবলীসের শিকারে পরিণত হবে এবং ইবলীস তাদেরকে প্রতারিত করে যেদিক নিয়ে যেতে চাইবে তারা তার পেছনে সেদিকেই বিভ্রান্তের মত ছুটে বেড়াতে বেড়াতে দূরে— বহু দূরে চলে যাবে।

দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হবেঃ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য শয়তান তার যে কর্মপদ্ধতি বর্ণনা করেছে তা হচ্ছে এই যে, সে পৃথিবীর জীবনকে মানুষের জন্য সুদৃশ্য ও সুশোভিত করে তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে গাফিল ও বন্দেগীর পথ থেকে বিচ্যূত করে দেবে। আল্লাহ তার এই কর্মপদ্ধতির স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, এ শর্ত আমি মেনে নিয়েছি এবং এর আরো ব্যাখ্যা করে একথা সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, তোমাকে কেবল মাত্র ধোঁকা দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে, তাদের হাত ধরে জোর করে নিজের পথে টেনে নিয়ে যাবার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে না। আল্লাহ তাঁর যেসব বান্দাকে নিজের একনিষ্ঠ বান্দা করে নিয়েছেন শয়তান তাদের নাম নিজের খাতায় রাখেনি। এ থেকে এ ভুল ধারণা সৃষ্টি হচ্ছিল যে, সম্ভবত কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই আল্লাহ ইচ্ছা মতো যাকে চাইবেন নিজের একনিষ্ঠ বান্দা করে নেবেন এবং সে শয়তানের হাত থেকে বেঁচে যাবে। আল্লাহ একথা বলে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি নিজেই বিভ্রান্ত হবে সে-ই তোমার অনুসারী হবে। অন্য কথায়, যে বিভ্রান্ত হবে না সে তোমার অনুসরণ করবে না এবং সে-ই হবে আমার বিশেষ বান্দা, যাকে আমি একান্ত করে নেব।
# এখানে এ ঘটনাটি যে উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা হয়েছে তা অনুধাবন করার জন্য পূর্বাপর আলোচনা পরিষ্কারভাবে মনে রাখতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় রুকূ’র বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে একটি কথা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। সেটি হচ্ছেঃ এ বর্ণনাধারায় আদম ও ইবলীসের এ কাহিনী বর্ণনা করার পেছনে একটি উদ্দেশ্য কাজ করছে। অর্থাৎ কাফেরদেরকে এ সত্যটি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া এর উদ্দেশ্য যে, তোমরা নিজেদের আদি শত্রু শয়তানের ফাঁদে পড়ে গেছো এবং সে নিজের হিংসা চরিতার্থ করার জন্য তোমাদের যে হীনতার গর্তে নামিয়ে দিতে চায় তোমরা তার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছো। পক্ষান্তরে এ নবী তোমাদের এ ফাঁদ থেকে উদ্ধার করে উন্নতির সেই উচ্চ শিখরের দিকে নিয়ে যেতে চান যা আসলে মানুষ হিসেবে তোমাদের স্বাভাবিক অবস্থান স্থল। কিন্তু তোমরা অদ্ভূত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছো। নিজেদের শত্রুকে বন্ধু এবং কল্যাণকামীকে তোমরা শত্রু মনে করছো।

এ সঙ্গে এ সত্যটিও এ কাহিনীর মাধ্যমে তাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে যে, তোমাদের জন্য একটি মাত্র মুক্তির পথ রয়েছে এবং সেটি হচ্ছে আল্লাহর বন্দেগী করা। এ পথ পরিহার করে তোমরা যে পথেই চলবে তা হবে শয়তানের পথ এবং সে পথটি চলে গেছে সোজা জাহান্নামের দিকে।

এ কাহিনীর মাধ্যমে তৃতীয় যে কথাটি বুঝানো হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, তোমরা নিজেরাই নিজেদের এ ভুলের জন্য দায়ী। শয়তানের ভূমিকা এক্ষেত্রে এর বেশী আর কিছু নয় যে, সে দুনিয়ার বাহ্যিক জীবনোপকরণের সাহায্যে ধোঁকা দিয়ে তোমাদের আল্লাহর বন্দেগীর পথ থেকে বিচ্যূত করার চেষ্টা করে। তার ধোঁকায় পড়ে যাওয়া তোমাদের নিজেদের ত্রুটি। এর কোন দায়-দায়িত্ব তোমাদের নিজেদের ছাড়া আর কারোর ওপর বর্তায় না। (এ ব্যাপারে আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য সূরা ইবরাহীম ২২ আয়াত ও ৩১ টীকা দেখুন)
# যেসব গোমরাহী ও গোনাহের পথ পাড়ি দিয়ে মানুষ নিজের জন্য জাহান্নামের পথের দরজা খুলে নেয় সেগুলোর প্রেক্ষিতে জাহান্নামের এ দরজাগুলো নির্ধারিত হয়েছে। যেমন কেউ নাস্তিক্যবাদের পথ পাড়ি দিয়ে জাহান্নামের দিকে যায়। কেউ যায় শিরকের পথ পাড়ি দিয়ে, কেউ মুনাফিকীর পথ ধরে, কেউ প্রবৃত্তি পূজা, কেউ অশ্লীলতা ও ফাসেকী, কেউ জুলুম, নিপীড়ন ও নিগ্রহ, আবার কেউ ভ্রষ্টতার প্রচার ও কুফরীর প্রতিষ্ঠা এবং কেউ অশ্লীলতা ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের প্রচারের পথ ধরে জাহান্নামের দিকে যায়।
# যারা শয়তানের পদানুসরণ থেকে দূরে থেকেছে এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাঁর বন্দেগী ও দাসত্বের জীবন যাপন করেছে।
# সৎ লোকদের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝির কারণে দুনিয়ার জীবনে যদি কিছু মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করার সময় তা দূর হয়ে যাবে এবং পরস্পরের পক্ষ থেকে তাদের মন একেবারে পরিষ্কার করে দেয়া হবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য সূরা আ’রাফের ৩২ টীকা দেখুন)
# নিম্ন লিখিত হাদীস থেকে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেনঃ

يُقَالُ لأَهْلِ الْجَنَّةِ إِنَّ لَكُمْ أَنْ تَصِحُّوا ولا تمرضوا أَبَدًا, وان لكم ان تعيشوا فلا تموتوا ابدا , وَإِنَّ لَكُمْ أَنْ تَشِبُّوا فَلاَ تَهْرَمُوا أَبَدًا,, وان لكم ان تقيموا فلا تطعنوا ابدا-

অর্থাৎ “জান্নাতবাসীদেরকে বলে দেয়া হবে, এখন তোমরা সবসময় সুস্থ থাকবে, কখনো রোগাক্রান্ত হবে না। এখন তোমরা চিরকাল জীবিত থাকবে, কখনো মরবে না। এখন তোমরা চির যুবক থাকবে, কখনো বৃদ্ধ হবে না। এখন তোমরা হবে চির অবস্থানকারী, কখনো স্থান ত্যাগ করতে হবে না।”

এর আরো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এমন সব আয়াত ও হাদীস থেকে যেগুলোতে বলা হয়েছে জান্নাতে নিজের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের জন্য মানুষকে কোন শ্রম করতে হবে না। বিনা প্রচেষ্টায় ও পরিশ্রম ছাড়াই সে সবকিছু পেয়ে যাবে।

# ২৬-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:-
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন, এখানে দ্বারা শুষ্ক মাটিকে বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির মত শুষ্ক মৃত্তিকা হতে। আর তিনি জ্বিনকে সৃষ্টি করেছেন নিধূম অগ্নি শিখা হতে।” (৫৫:১৪-১৫) মুজাহিদ (রঃ)হতে এটাও বর্ণিত আছে, গন্ধযুক্ত (আরবি) মাটিকে বলাহয়। (আরবি) বলা হয় মসৃণকে। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এটা হচ্ছে সিক্ত মাটি। অন্যান্যেরা বলেন, ওটা হচ্ছে গন্ধযুক্ত ও ঠাসা মাটি।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “মানুষের পূর্বে আমি জ্বিনকে প্রখর শিখাযুক্ত অগ্নি থেকে সৃষ্টি করেছি।” (আরবি) বলা হয় আগুনের গরম তাপকে এবং (আরবি) বলা হয় দিনের গরমকে। এটাও বর্ণিত আছে যে, জ্বিনকে যে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে তার সত্তর ভাগের একভাগ হচ্ছে দুনিয়ার আগুনের তেজ। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, জ্বিনকে আগুনের হল্কা বা শিখা হতে অর্থাৎ অতি উত্তম আগুন হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমর ইবনু দীনার (রঃ) বলেন, জ্বিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে সূর্যের আগুন থেকে। সহীহ হাদীসে এসেছেঃ “ফেরেশতাদেরকে নূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জ্বিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে। শিখাযুক্ত অগ্নি হতে, আর আদমকে (আঃ) তা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে যা তোমাদের সামনে বর্ণিত হয়েছে।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে) এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে হযরত আদমের (আঃ) ফযীলত ও শরাফত এবং তাঁর সৃষ্টির উপাদানের পবিত্রতার বর্ণনা দেয়া।
#
আল্লাহ তাআলা বলছেন, হযরত আদমের (আঃ) সৃষ্টির পূর্বে ফেরেস্তাদের সামনে তিনি তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করেন। অতঃপর তাকে সৃষ্টি করতঃ তাঁদের সামনে তাঁর মর্য- একাশ করেন এবং তাঁদেরকে তাকে সিজদা করার নির্দেশ দেন। ইবলীস ছাড়া সবাই তাঁর এ নির্দেশ মেনে নেন। অভিশপ্ত ইবলীস তাঁকে সিজদা করতে অস্বীকার করে। সে কুফরী, হিংসা এবং অহংকার করে। সে স্পষ্টভাবে বলে দেয়ঃ “আমি হলাম আগুনের তৈরী এবং আদম (আঃ) হলো মাটির তৈরী। কাজেই আমি তার চেয়ে উত্তম। সুতরাং আপনি আমার উপর তাকে মর্যাদা দিলেও আমি তাকে সিজদা করতে পারি না। জেনে রাখুন যে, আমি তাকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত করে ছাড়বো।”

ইবনু জারীর (রঃ) এখানে একটি অতি বিস্ময়কর হাদীস বর্ণনা করেছেন। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে সৃষ্টি করার পর তাদেরকে বলেনঃ “মাটি দ্বারা আমি মানুষ সৃষ্টি করবো। যখন আমি তাকে সুঠাম করবো এবং তাতে আমার রূহ্ সঞ্চার করবো তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো।” তারা বললোঃ “আমরা এরূপ করবো না।” তৎক্ষণাৎ তিনি তাদের কাছে আগুনকে পাঠিয়ে দেন এবং তা তাদেরকে জ্বালিয়ে দেয়। তারপর তিনি অন্য ফেরেস্তা সৃষ্টি করেন এবং তাদেরকেও অনুরূপ কথা বলেন। তাঁরা জবাবে বলেনঃ “আমরা শুনলাম ও মানলাম।” কিন্তু ইবলীস প্রথম অস্বীকারকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং সে অস্বীকার করেই রইলো।” কিন্তু এটা হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হওয়া প্রমাণিত নয়। স্পষ্টতঃ এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এটা ইসরাঈলী রিওয়াইয়াত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
# অতঃপর আল্লাহ তাআলা নিজের শাসনের নির্দেশ জারী করলেন যা কখনো টলতে পারে না। তিনি ইবলীসকে নির্দেশ দিলেনঃ ‘তুমি এই উত্তম ও মর্যাদা সম্পন্ন দল থেকে দূর হয়ে যাও। তুমি অভিশপ্ত হয়ে গেলে। কিয়ামত পর্যন্ত তোমার উপর সব সময় লানত বর্ষিত হতে থাকবে। বর্ণিত আছে যে, তৎক্ষণাৎ তার আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং সে বিলাপ করতে শুরু করে। দুনিয়ার সমস্ত শোক ও বিলাপের সূচনা হয়েছে ইবলীসের ঐ বিলাপ থেকেই। সে বিতাড়িত ও অভিশপ্ত হয়ে ফিরতে থাকে এবং হিংসার আগুনে দগ্ধিভূত হয়ে আকাংখা প্রকাশ করে যে, তাকে যেন কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হয়। এটাকেই পুনরুত্থান দিবস বলা হয়েছে। তার আবেদন কবুল করা হয়। এবং তাকে অবকাশ দেয়া হয়।
# আল্লাহ তাআলা ইবলীসের অবাধ্যতা ও হঠকারিতার খবর দিতে গিয়ে। বলছেন যে, সে শপথ করে বলেঃ “হে আমার প্রতিপালক! যেহেতু আপনি আমাকে বিপথগামী করলেন সে হেতু আমি পৃথিবীতে বনি আদমের নিকট আপনার বিরোধিতা ও অবাধ্যতামূলক কাজকে শোভনীয় করে তুলবো এবং তাদেরকে উৎসাহিত করে আপনার বিরুদ্ধাচরণে জড়িয়ে ফেলবো। সকলকেই পথ ভষ্ট করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। তবে হ্যা যারা আপনার খাটি ও একনিষ্ট বান্দা তাদের উপর আমার কোন হাত থাকবে না। যেমন অন্য এক জায়গায় মহান আল্লাহ ইবলীসের উক্তি উদ্ধৃত করেনঃ “বলুন, তাকে (আদম, আঃ কে) যে আপনি আমার উপর মর্যাদা দান করলেন, কেন? কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যদি আমাকে অবকাশ দেন তা হলে আমি অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরদেরকে কর্তৃত্বাধীন করে ফেলবো।” উত্তরে আল্লাহ তাআলা তাকে ধমকের সুরে বলেনঃ “এটাই আমার নিকট পৌছার সরল পথ। অর্থাৎ তোমাদের সকলকে আমারই কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্মের বিনিময় প্রদান করবো। ভাল হলে ভাল বিনিময় হবে এবং মন্দ হলে মন্দ বিনিময় হবে। যেমন আল্লাহ তাআলার উক্তি রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালক অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।” (৮৯:১৪)।

(আরবি) শব্দটি একটি কিরআতে (আরবি) ও রয়েছে। যেমন অন্য একটি আয়াতে আছেঃ (আরবি) (৪৩:১৪) তখন এর অর্থ হবে বুলন্দ বা উচ্চ। কিন্তু প্রথম কিরআতটিই প্রসিদ্ধতর।

ঘোষিত হচ্ছেঃ ‘বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা ছাড়া আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকবে না। এটা হচ্ছে ‘ইসতিসনা মুনকাতা। ইয়াযীদ ইবনু কুসাইত (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবীদের মসজিদ তাঁদের গ্রামের বাইরে থাকতো যখন তারা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট থেকে কোন বিশেষ বিষয় জানতে চাইতেন তখন সেখানে গিয়ে তাঁরা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারণকৃত নামায আদায় করতেন। অতঃপর প্রার্থনা জানাতেন। একদিন একজন নবী তাঁর মসজিদে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় আল্লাহর শত্রু অর্থাৎ ইবলীস তাঁর ও তাঁর কিবলার মাঝে বসে পড়ে। তখন ঐ নবী তিন বার বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি বিতাড়িত শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।” তখন আল্লাহর শত্রু নবীকে বলেঃ “কি করে আপনি আমার (অনিষ্ট) থেকে মুক্তি পেয়ে থাকেন। সেই খবর আমাকে দিন।” নবী (আঃ) তখন তাকে বলেনঃ “তুমি বরং আমাকে খবর দাও কিভাবে তুমি বণী আদমের উপর জয়যুক্ত হয়ে থাকো।” শেষ পর্যন্ত একে অপরকে সঠিক খবর বলে দেয়ার চুক্তি হয়ে যায়। নবী (আঃ) তাকে বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ “নিশ্চয় বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তারা ছাড়া আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন কর্তত্ব থাকবে না।” তখন আল্লাহর দুশমন (ইবলীস) বলেঃ “এটা তো আমি আপনার জন্মেরও পূর্ব হতে জানি।” তার এ কথা শুনে নবী (আঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেনঃ “যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে তুমি আল্লাহর শরণাপন্ন হবে, তিনি তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আল্লাহর শপথ! তোমার আগমনের আভাস পাওয়া মাত্রই আমি আল্লাহ তাআলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকি।” আল্লাহর শত্রু তখন বলেঃ “আপনি সত্য বলেছেন। এর দ্বারাই আপনি আমার (কুমন্ত্রণা) হতে। মুক্তি পেয়ে থাকেন।” অতঃপর নবী (আঃ) তাকে বলেনঃ “এবার কিভাবে তুমি বনী আদমের উপর জয়যুক্ত হয়ে থাকো। সেই খবর আমাকে প্রদান। করো।” সে বলেঃ “আমি ক্রোধ ও কুপ্রবৃত্তির সময় তাকে পাকড়াও করে থাকি।” (এটা ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

আল্লাহ পাক বলেনঃ “অবশ্যই তোমার অনুসারীদের সবারই নির্ধারিত স্থান হবে জাহান্নাম। যেমন কুরআন কারীমে এ সম্পর্কে রয়েছেঃ “দলসমূহের কেউ এটাকে অমান্য করলে তার নির্ধারিত স্থান হবে জাহান্নাম।”

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “ওর (জাহান্নামের) সাতটি দরজা রয়েছে। নিজ নিজ প্রত্যেক দরজার জন্যে পৃথক পৃথক দল আছে। প্রত্যেক দরজা দিয়ে গমনকারী ইবলীসী দল নির্ধারিত রয়েছে নিজ নিজ আমল অনুযায়ী তাদের জন্যে দরজা বন্টন করা আছে।

হযরত আলী ইবনু আবি তালিব (রাঃ) তাঁর এক ভাষণে বলেনঃ “জাহান্নামের দরজাগুলি এইভাবে রয়েছে অর্থাৎ একের উপর একটি। ঐ গুলি রয়েছে সাতটি। একটির পর একটি করে সাতটি দরজা পূর্ণ হয়ে যাবে।” হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, সাতটি স্তর রয়েছে। ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) সাতটি দরজার নিম্নরূপ নাম বলেছেনঃ (১) জাহান্নাম, (২) লাযা, (৩) হুতামাহ (৪) সাঈর, (৫) সাকার, (৬) জাহীম এবং (৭) হাবীয়াহ। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। কাতাদা (রঃ) বলেন, এগুলি হবে আমল হিসেবে মনযিল। যেমন একটি দরজা ইয়াহূদীদের, একটি খৃস্টানদের, একটি সাবেঈদের, একটি মাজুসদের, একটি মুশরিকদের, একটি কাফিরদের, একটি মুনাফিকদের এবং একটি একত্ববাদীদের। কিন্তু একত্ববাদীদের মুক্তি লাভের আশা রয়েছে। আর বাকী সব নিরাশ হয়ে যাবে।

হযরত ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “জাহান্নামের সাতটি দরজা রয়েছে। ওগুলির মধ্যে একটি দরজা ঐ লোকদের জন্যে যারা আমার উম্মতের বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সামুরা ইবনু জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “আগুন জাহান্নামবাসীদের কারো কারো হাঁটু পর্যন্ত ধরবে, কারো ধরবে কোমর পর্যন্ত এবং কারো ধরবে কাঁধ পর্যন্ত। মোট কথা, এ সব তাদের আমল অনুপাতে হবে।
#
জাহান্নামবাসীদের বর্ণনা দেয়ার পর আল্লাহ তাআলা এখানে জান্নাতবাসীদের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন যে, জান্নাতবাসীরা এমন বাগানে অবস্থান করবে যেখানে প্রস্রবণ ও নদী প্রবাহিত হবে। সেখানে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে বলা হবেঃ “এখন তোমরা সমস্ত বিপদ আপদ থেকে বেঁচে গেছো। তোমরা সর্বপ্রকারের ভয়ভীতি ও দুশ্চিন্তা থেকে নিরাপত্তা লাভ করেছে। এখানে না আছে নিয়ামত নষ্ট হওয়ার ভয়, না আছে এখান থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আশংকা এবং না আছে কিছু কমে যাওয়ার ও ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাদের হতে ঈর্ষা দূর করবো। তার ভ্রাতৃভাবে পরম্পর মুখোমুখি হয়ে অবস্থান করবে। আবু উমামা (রাঃ) বলেন, জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্বেই আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তর হতে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দিবেন।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মু’মিনদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দানের পর জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থলে অবস্থিত পুলের উপর আটক করা হবে এবং দুনিয়ায় যে তারা একে অপরের উপর যুলুম করেছিল তার প্রতিশোধ তারা একে অপর হতে গ্রহণ করবে। অতঃপর তারা যখন হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত অন্তরের অধিকারী হয়ে যাবে তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে।”

ইবনু সীরীন (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আশতারা (নামক একটি লোক) হযরত আলীর (রাঃ) নিকট প্রবেশ করার অনুমতি প্রার্থনা করে। এ সময় তাঁর নিকট হযরত তালহার (রাঃ) পুত্র বসে ছিলেন। তাই কিছুক্ষণ বিলম্বের পর তাকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেন। তাঁর কাছে প্রবেশের পর সে বলেঃ “এঁর কারণেই বুঝি আমাকে আপনি আপনার নিকট প্রবেশের অনুমতি দানে বিলম্ব করেছেন।” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হা (এ কথা সত্য বটে)।” সে পুনরায় বলেঃ “আমার মনে হয় যদি আপনার কাছে হযরত উসমানের (রাঃ) পুত্র থাকতেন। তবে তাঁর কারণেও আমাকে আপনার কাছে প্রবেশের অনুমতি দান করতে অবশ্যই বিলম্ব করতেন?” হযরত আলী (রাঃ) জবাবে বলেনঃ “হাঁ, অবশ্যই। আমি তো আশা রাখি যে, আমি এবং হযরত উসমান (রাঃ) ঐ লোকদেরই অন্তর্ভূক্ত হবো যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি তাদের অন্তর হতে ঈর্ষা দূর করবো। তারা ভ্রাতৃভাবে পরপর মুখোমুখি হয়ে অবস্থান করবে। (এটা ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অন্য আর একটি রিওয়ায়েতে আছে যে, ইমারান ইবনু তালহা (রাঃ) উষ্ট্রির যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের থেকে মুক্ত হয়ে হযরত আলীর (রাঃ) নিকট আগমন করেন। হযরত আলী (রাঃ) তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানান এবং বলেনঃ “আমি আশা রাখি যে, আমি এবং তোমার আব্বা ঐ লোকদেরই অন্তর্ভূক্ত হবো যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি তাদের অন্তর হতে ঈর্ষা দূর করবো। তারা ভ্ৰাতৃভাবে পরম্পর মুখোমুখি হয়ে অবস্থান করবে।” অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, তাঁকে বলেনঃ “আল্লাহ তাআলার ন্যায় বিচার-এর চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে যে, যাকে আপনি কাল হত্যা করলেন তাঁরই আপনি ভাই হয়ে যাবেন।” হযরত আলী (রাঃ) তখন রাগান্বিত হয়ে বলেনঃ “এই আয়াত দ্বারা যদি আমার ও তালহার (রাঃ) মত লোককে বুঝানো হয়ে না থাকে তবে আর কাদেরকে বুঝানো হবে?”

অন্য একটি রিওয়ায়েতে আছে যে, হামাদান গোত্রের একটি লোক উপরোক্ত উক্তি করেছিল এবং হযরত আলী (রাঃ) তাকে এত জোরে ধমক দিয়েছিলেন যে, প্রাসাদ নড়ে উঠেছিল। আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, ঐ উক্তিকারীর নাম ছিল হারিস আওয়ার এবং হযরত আলী (রাঃ) তার একথায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর হাতে যা ছিল তা দিয়ে তিনি তাকে মাথায় আঘাত করেছিলেন। অতঃপর তিনি তাঁর উপরোক্ত উক্তি করেছিলেন। হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত যুবাইর (রাঃ) ইবনু জারমুয হযরত আলীর (রাঃ) দরবারে উপস্থিত হলে দীর্ঘ ক্ষণ পর তিনি তাকে তার কাছে যাওয়ার অনুমতি দেন। তাঁর কাছে এসে সে হযরত যুবাইর (রাঃ) ও তাঁর সাথীদের সম্পর্কে ‘বালওয়াঈ’ বলে কটুক্তি করলে তিনি তাকে। বলেনঃ “তোমার মুখে মাটি পড়ুক। আমি, তালহা (রাঃ) এবং যুবাইর (রাঃ) তো ইনশাআল্লাহ ঐ লোকদের অন্তর্ভূক্ত হবো যাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহর উক্তি রয়েছেঃ “আমি তাদের অন্তর হতে ঈর্ষা দূর করে দেবো। তারা ভ্ৰাতৃভাবে পরম্পর মুখোমুখি হয়ে অবস্থান করবে।”

অনুরূপভাবে হযরত হাসান বসরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর শপথ! (আরবি) এই আয়াতটি আমাদের বদরী সাহাবীদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে।”

কাসীরুন্নাওয়া বলেনঃ “আমি আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনু আলীর (রাঃ) । নিকট গমন করি এবং বলিঃ “আমার বন্ধু আপনারও বন্ধু, আমার সাথে মেলামেশাকারী আপনার সাথেও মেলামেশাকারী, আমার শত্রু আপনারও শত্রু এবং আমার সাথে যুদ্ধকারী আপনার সাথেই যুদ্ধকারী। আল্লাহর কসম! আমি হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ) হতে মুক্ত। আমার এ কথা শুনে তিনি বলেনঃ “যদি আমি এরূপ করি তবে আমার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট অরি কেউই থাকবে না। এ অবস্থায় আমার হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে। হে কাসীর! তুমি এই দুব্যক্তি অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমারের (রাঃ) প্রতি ভালবাসা রাখবে, এতে যদি পাপ হয় তবে, আমিই তা বহন করবো।” অতঃপর তিনি এই আয়াতের (আরবি) এ অংশটুকু পাঠ করলেন এবং বলেনঃ “এই আয়াতটি নিম্ন লিখিত দশজন লোকের ব্যাপারে অবর্তীণ হয়েছেঃ ১, “হযরত আবু বকর (রাঃ), ২. হযরত উমার (রাঃ), ৩. হযরত উসমান (রাঃ), ৪.হযরত আলী (রাঃ), ৫. হযরত তালহা (রাঃ), ৬. হযরত যুবাইর (রাঃ), ৭. হযরত আবদুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ), (৮, হযরত সা’দ ইবনু আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) , ৯. হযরত সাঈদ ইবনু যায়েদ (রাঃ) এবং ১০. হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ”। এঁরা মুখোমুখি হয়ে বসবেন যাতে কারো দিকে কারো পিঠ না হয়। এ ব্যাপারে মারফু হাদীস রয়েছে। হযরত যায়েদ ইবনু আবি আওফা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট বের হয়ে এসে (আরবি) এই আয়াতটি পাঠ করেন। অর্থাৎ একে অপরের দিকে তাকাতে থাকবে। সেখানে তাদের কোন দুঃখ-কষ্ট হবে না। (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমি যেন হযরত খাদীজা’কে (রাঃ) বেহেশতের সোনার একটি ঘরের সুসংবাদ প্রদান করি যেখানে কোন শোরগোল থাকবে না এবং কোন দুঃখ-কষ্টও থাকবে না।”

এই জান্নাতীদেরকে জান্নাত থেকে বের করা হবে না। যেমন হাদীসে এসেছে যে, জান্নাতীদেরকে বলা হবেঃ “হে জান্নাতীগণ! তোমরা চিরকাল সুস্থ থাকবে, কখনো রোগাক্রান্ত হবে না; সর্বদা জীবিত থাকবে, কখনো মৃত্যু বরণ করবে না, সর্বদা যুবকই থাকবে, কখনো বৃদ্ধ হবে না, চিরকাল এখানেই অবস্থান করবে, কখনো এখান হতে বের হবে না।” অন্য আয়াতে রয়েছেঃ “তারা তথায় চিরকাল অবস্থান করবে, স্থান পরিবর্তনের আকাংখা তারা করবে না।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ “(হে নবী (সঃ)! আমার বান্দাদেরকে খবর দিয়ে দাওঃ “নিশ্চয় আমি ক্ষমাশীল ও দয়ালু, আবার আমার শাস্তি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিও বটে।” এই ধরনের আরো আয়াত ইতিপূর্বে গত হয়েছে। এগুলি দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, মুমিনদেরকে (জান্নাতের শান্তির) আশার সাথে সাথে (জাহান্নামের শাস্তির) ভয়ও রাখতে হবে। হযরত মুসআব ইবনু সাবিত (রাঃ) বলেনঃ “(একদা) রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের এমন এক দল লোকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন যারা হাসতে ছিলেন। তখন তিনি তাঁদেরকে বললেনঃ “তোমরা জান্নাত ও জাহান্নামকে স্মরণ করো।” ঐ সময় উপরোক্ত আয়াত অর্থাৎ – অবতীর্ণ হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং এটা মুরসাল)

ইবনু আবি রাবাহ (রাঃ) নবীর (সঃ) সাহাবীদের এক ব্যক্তি হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) বানু শায়বার দরজা দিয়ে আমাদের নিকট আত্মপ্রকাশ করেন এবং বলেনঃ “আমি তো তোমাদেরকে হাসতে দেখছি।” এ কথা বলেই তিনি ফিরে যান এবং হাতীমের নিকট থেকে পুনরায় আমাদের নিকট আগমন করেন এবং বলেনঃ “যখন আমি বের হয়েছি তখনই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে এসে বলেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমার বান্দাদেরকে নিরাশ করছো কেন? আমার বান্দাদের সংবাদ দিয়ে দাওঃ নিশ্চয়ই আমি ক্ষমাশীল ও দয়ালু, আবার আমার শাস্তিও বেদনাদায়ক শাস্তি বটে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু জারীর বর্ণনা করেছেন)

অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি আল্লাহ তাআলার ক্ষমার পরিমাণ অবগত হতো তবে সে হারাম থেকে বেঁচে থাকা পরিত্যাগ করতো। পক্ষান্তরে যদি সে আল্লাহর শাস্তির পরিণাম অবগত হতো তবে সে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতো।”

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Al-Hijr
Sura: 15
Verses :- 26-50
[ وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ
And We did certainly create man.]
www.motaher21.net
The Substances from which Mankind and Jinns were created

Allah says:

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الاِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

وَالْجَأنَّ خَلَقْنَاهُ مِن قَبْلُ مِن نَّارِ السَّمُومِ
And indeed, We created man from dried (sounding) clay of altered mud. And the Jinn, We created earlier from the smokeless flame of fire.

Ibn Abbas, Mujahid and Qatadah said that;
Salsal means dry mud.

The apparent meaning is similar to the Ayah:

خَلَقَ الاِنسَـنَ مِن صَلْصَـلٍ كَالْفَخَّارِ

وَخَلَقَ الْجَأنَّ مِن مَّارِجٍ مِّن نَّارٍ

He created man (Adam) from sounding clay like the potter’s clay, And He created the Jinns from a smokeless flame of fire. (55:14-15)

It was also reported from Mujahid that,

صَلْصَالٍ
(dried (sounding) clay) means “putrid”,

but it is more appropriate to interpret an Ayah with another Ayah.

مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

of altered mud,

means the dried clay that comes from mud, which is soil.

“Altered” here means smooth.

وَالْجَأنَّ خَلَقْنَاهُ مِن قَبْلُ

And the Jinn, We created earlier,

means before creating humans.

مِن نَّارِ السَّمُومِ

from the smokeless flame of fire.

Ibn Abbas said,

“It is the smokeless flame that kills.”

Abu Dawud At-Tayalisi said that Shu`bah narrated to them from Abu Ishaq, who said:

“I visited `Umar Al-Asamm when he was sick, and he said:`Shall I not tell you a Hadith that I heard from Abdullah bin Mas`ud He said:

`This smokeless flame is one of the seventy parts of the smokeless fire from which the Jinn where created.

Then he recited,
وَالْجَأنَّ خَلَقْنَاهُ مِن قَبْلُ مِن نَّارِ السَّمُومِ
(And the Jinn, We created earlier from the smokeless flame of fire).”‘

The following is found in the Sahih,

خُلِقَتِ الْمَلَيِكَةُ مِنْ نُورٍ وَخُلِقَتِ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ ادَمُ مِمَّا وُصِفَ لَكُم

The angels were created from light, the Jinn were created from a smokeless flame of fire, and Adam was created from that which has been described to you.

The Ayah is intended to point out the noble nature, good essence and pure origin of Adam
.The creation of Adam, the Command to the Angels to prostrate to Him, and the Rebellion of Iblis

Allah tells:

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَيِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِّن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ

فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِي فَقَعُواْ لَهُ سَاجِدِينَ
فَسَجَدَ الْمَليِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ
إِلاَّ إِبْلِيسَ أَبَى أَن يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ
قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلاَّ تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ
And (remember) when your Lord said to the angels:”I am going to create a man (Adam) from dried (sounding) clay of altered mud. So, when I have fashioned him completely and breathed into him (Adam) of My spirit (the soul which I created for him,) then fall down, prostrating yourselves before him.”

So the angels prostrated themselves, all of them together. Except Iblis (Shaytan) – he refused to be among the prostrate.

(Allah) said:”O Iblis! What is your reason for not being among the prostrate!”

Allah informs us of how He mentioned Adam to His angels before He created him, and how He honored him by commanding the angels to prostrate to him. He mentions how His enemy Iblis, amidst all the angels, refused to prostrate to him out of envy, disbelief, stubbornness, arrogance, and false pride. This is why Iblis said:

قَالَ لَمْ أَكُن لاَِّسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ
(Iblis) said:I am not one to prostrate myself to a human, whom You created from dried (sounding) clay of altered mud.

this is like when he said,

أَنَاْ خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِين

I am better than him (Adam), You created me from Fire and him You created from clay. (7:12)

أَرَءَيْتَكَ هَـذَا الَّذِى كَرَّمْتَ عَلَىَّ

“Do you see this one whom You have honored above me…” (17:62).
The Expulsion of Iblis from Jannah, and His Reprieve until the Day of Resurrection

Allah tells:

قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ

وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَى يَوْمِ الدِّينِ

قَالَ رَبِّ فَأَنظِرْنِي إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ
قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ
إِلَى يَومِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ
(Allah) said:”Then leave, for verily, you are an outcast. And verily, the curse shall be upon you until the Day of Recompense.”

(Iblis) said:”O my Lord! Then give me respite until the Day they (the dead) will be resurrected.”

Allah said:”Then verily, you are of those reprieved, Until the Day of the time appointed.”

Allah tells us how He issued an unconditional command to Iblis to leave the position he held among the highest of heights.

He told him that he was an outcast, i.e., cursed, and that he would be follo

Leave a Reply