أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book # 852)
[You are not,by the favor of your Lord,a madman.]
www.motaher21.net
Assalamualaikum.
Dear brother, Here Surah Al-Kalam is shown with Tafsir Ibne Kasir.
Please read Full.
And requested for feedback.
Thanks
www.motaher21.net
English Tafsir:-
Tafsir Ibne Kasir said:-
68:2
مَاۤ اَنۡتَ بِنِعۡمَۃِ رَبِّکَ بِمَجۡنُوۡنٍ ۚ﴿۲﴾
English – Sahih International
You are not, [O Muhammad], by the favor of your Lord, a madman.
You, by the grace of your Lord, are not insane.
meaning — and all praise is due to Allah — `you are not crazy as the ignorant among your people claim. They are those who deny the guidance and the clear truth that you have come with. Therefore, they attribute madness to you because of it.’
وَإِنَّ لَكَ لَاإَجْرًا غَيْرَ مَمْنُونٍ
# 68:3
وَ اِنَّ لَکَ لَاَجۡرًا غَیۡرَ مَمۡنُوۡنٍ ۚ﴿۳﴾
English – Sahih International
And indeed, for you is a reward uninterrupted.
And verily, for you will be reward that is not Mamnun.
meaning, `for you is the great reward, and abundant blessings which will never be cut off or perish, because you conveyed the Message of your Lord to creation, and you were patient with their abuse.’
The meaning of
غَيْرَ مَمْنُونٍ
(not Mamnun) is that it will not be cut off.
This is similar to Allah’s statement,
عَطَأءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ
a gift without an end. (11:108)
and His statement,
فَلَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ
Then they shall have a reward without end. (95:6)
Mujahid said,
غَيْرَ مَمْنُونٍ
(Without Mamnun) means
“Without reckoning.”
And this refers back to what we have said before.
The Explanation of the Statement:”Verily, You are on an Exalted Character.”
Concerning Allah’s statement,
وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ
# 68:4
وَ اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ ﴿۴﴾
English – Sahih International
And indeed, you are of a great moral character.
And verily, you are on an exalted (standard of) character.
Al-`Awfi reported from Ibn `Abbas,
“Verily, you are on a great religion, and it is Islam.”
Likewise said Mujahid, Abu Malik, As-Suddi and Ar-Rabi` bin Anas. Ad-Dahhak and Ibn Zayd also said this.
Sa`id bin Abi `Arubah reported from Qatadah that he said concerning Allah’s statement,
وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ
(And verily, you are on an exalted (standard of) character).
“It has been mentioned to us that Sa`d bin Hisham asked `A’ishah about the character of the Messenger of Allah, so she replied:
`Have you not read the Qur’an’
Sa`d said:`Of course.’
Then she said:`Verily, the character of the Messenger of Allah was the Qur’an.”‘
Abdur-Razzaq recorded similar to this and Imam Muslim recorded it in his Sahih on the authority of Qatadah in its full length.
This means that he would act according to the commands and the prohibition in the Qur’an. His nature and character were patterned according to the Qur’an, and he abandoned his natural disposition (i.e., the carnal nature). So whatever the Qur’an commanded, he did it, and whatever it forbade, he avoided it.
Along with this, Allah gave him the exalted character, which included the qualities of modesty, kindness, bravery, pardoning, gentleness and every other good characteristic. This is like that which has been confirmed in the Two Sahihs that Anas said,
“I served the Messenger of Allah for ten years, and he never said a word of displeasure to me (Uff), nor did he ever say to me concerning something I had done:`Why did you do that’
And he never said to me concerning something I had not done:`Why didn’t you do this’
He had the best character, and I never touched any silk or anything else that was softer than the palm of the Messenger of Allah. And I never smelled any musk or perfume that had a better fragrance than the sweat of the Messenger of Allah.”
Imam Al-Bukhari recorded that Al-Bara’ said,
“The Messenger of Allah had the most handsome face of all the people, and he had the best behavior of all of the people. And he was not tall, nor was he short.”
The Hadiths concerning this matter are numerous. Abu `Isa At-Tirmidhi has a complete book on this subject called Kitab Ash-Shama’il.
Imam Ahmad recorded that A’ishah said,
– “The Messenger of Allah never struck a servant of his with his hand, nor did he ever hit a woman. He never hit anything with his hand, except for when he was fighting Jihad in the cause of Allah.
– And he was never given the option between two things except that the most beloved of the two to him was the easiest of them, as long as it did not involve sin. If it did involve sin, then he stayed farther away from sin than any of the people.
– He would not avenge himself concerning anything that was done to him, except if the limits of Allah were transgressed. Then, in that case he would avenge for the sake of Allah.”
Imam Ahmad also recorded from Abu Hurayrah that the Messenger of Allah said,
إِنَّمَا بُعِثْتُ لاُِتَمِّمَ صَالِحَ الاَْخْلَق
I have only been sent to perfect righteous behavior.
Ahmad was alone in recording this Hadith.
In reference to Allah’s statement,
فَسَتُبْصِرُ وَيُبْصِرُونَ
# 68:5
فَسَتُبۡصِرُ وَ یُبۡصِرُوۡنَ ۙ﴿۵﴾
English – Sahih International
So you will see and they will see
بِأَييِّكُمُ الْمَفْتُونُ
# 68:6
بِاَىیِّکُمُ الۡمَفۡتُوۡنُ ﴿۶﴾
English – Sahih International
Which of you is the afflicted [by a devil].
You will see, and they will see, which of you is afflicted with madness.
then it means, `you will know, O Muhammad — and those who oppose you and reject you, will know — who is insane and misguided among you.’
This is like Allah’s statement,
سَيَعْلَمُونَ غَداً مَّنِ الْكَذَّابُ الاٌّشِرُ
Tomorrow they will come to know who is the liar, the insolent one! (54:26)
Allah also says,
وَإِنَّأ أَوْ إِيَّاكُمْ لَعَلَى هُدًى أَوْ فِى ضَلَـلٍ مُّبِينٍ
And verily (either) we or you are rightly guided or in plain error. (34:24)
Ibn Jurayj reported from Ibn Abbas, it means
“You will know and they will know on the Day of Judgement.”
Al-`Awfi reported from Ibn `Abbas;
بِأَييِّكُمُ الْمَفْتُونُ
Which of you is Maftun (afflicted with madness) means which of you is crazy.
This was also said by Mujahid and others as well.
The literal meaning of Maftun is one who has been charmed or lured away from the truth and has strayed from it. Thus, the entire statement means,
`so you will know and they will know,’
or `you will be informed and they will be informed, as to which of you is afflicted with madness.’
And Allah knows best.
Then Allah says,
إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
# 68:7
اِنَّ رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ۪ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ ﴿۷﴾
English – Sahih International
Indeed, your Lord is most knowing of who has gone astray from His way, and He is most knowing of the [rightly] guided.
Verily, your Lord is the best Knower of him who has gone astray from His path, and He is the best Knower of those who are guided.
meaning, `He knows which of the two groups are truly guided among you, and He knows the party that is astray from the truth.
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৫২)[কে পাগল!?]
সুরা: আল্ কালাম
সুরা:৬৮
০২ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
مَاۤ اَنۡتَ بِنِعۡمَۃِ رَبِّکَ بِمَجۡنُوۡنٍ ۚ﴿۲
You are not, [O Muhammad], by the favor of your Lord, a madman.
তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে পাগল নও।
দয়াকরে পুরাটা তাপসীর পড়ুন।
তাহলে বুঝতে পারবে কে পাগল!!! ???
সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-২
[ مَاۤ اَنْتَ بِنِعْمَةِ رَبِّكَ بِمَجْنُوْنٍۚ
তোমার রবের অনুগ্রহে তুমি পাগল নও।]
আসসালামুয়ালাইকুম।
ভাই এখানে সুরা আল্ কালাম এর আলোচনা করা হয়েছে।
ইবনে কাছীর সহ ৪টি তাপসীর আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহর ওয়াস্তে পড়ুন।
এরপর মন্তব্য করুন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# একথাটির জন্যই কলম ও কিতাবের নামে শপথ করা হয়েছে। অর্থাৎ অহী লেখক ফেরেশতাদের হাত দিয়ে কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ হচ্ছে। কুরআন মজীদ ফেরেশতাদের হাতে লিপিবদ্ধ হওয়াই কাফেরদের এ অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, নাউযুবিল্লাহ, রসূলুল্লাহ ﷺ পাগল। নবুওয়াত দাবী করার পূর্বে মক্কাবাসীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কওমের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মনে করতো। তারা তাঁর দ্বীনদারী, আমানতদারী, বিবেক-বুদ্ধি ও দূরদর্শিতার ওপর আস্থাশীল ছিলো। কিন্তু তিনি তাদের সামনে কুরআন মজীদ পেশ করতে শুরু করলে তারা তাঁকে পাগল বলে অভিহিত করতে লাগলো। এর সোজা অর্থ হলো, রসূলের ﷺ প্রতি পাগল হওয়ার যে অপবাদ তারা আরোপ করতো তাদের দৃষ্টিতে তার মূল কারণ ছিলো কুরআন। তাই বলা হয়েছে, কুরআনই এ অপবাদের অসারতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। নাউযুবিল্লাহ! তিনি পাগল হয়ে গিয়েছেন একথা প্রমাণ করা তো দূরে থাক অতি উচ্চমানের বিশুদ্ধ ও অলংকারপূর্ণ ভাষায় এরূপ উন্নত বিষয়বস্তু পেশ করাই বরং একথা প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী বর্ষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো বাহ্যিকভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা হলেও মূল লক্ষ্য হলো কাফেরদেরকে তাদের অপবাদের জবাব দেয়া। অতএব, কারো মনে যেন এ সন্দেহ দানা না বাঁধে যে, এ আয়াতটি নবী ﷺ যে পাগল নন এ মর্মে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য নাযিল হয়েছে। নবী (সা.) নিজের সম্পর্কে এমন কোন সন্দেহ পোষণ করতেন না যা নিরসনের জন্য তাঁকে এরূপ সান্তনা দেয়ার প্রয়োজন ছিলো। বরং এর লক্ষ্য কাফেরদেরকে এতোটুকু জানিয়ে দেয়া যে, কুরআনের কারণে তোমরা কুরআন পেশকারীকে পাগল বলে আখ্যায়িত করছো। তোমাদের এ অভিযোগ যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন খোদ কুরআনই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
সুরা: আত-তূর
আয়াত নং :-২৯
فَذَكِّرْ فَمَاۤ اَنْتَ بِنِعْمَتِ رَبِّكَ بِكَاهِنٍ وَّ لَا مَجْنُوْنٍؕ
তাই হে নবী (সা.), তুমি উপদেশ দিতে থাক। আল্লাহর মেহেরবাণীতে তুমি গণকও নও, পাগলও নও।
# মক্কার কাফেররা জুলুম ও হঠকারিতার মাধ্যমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের মোকাবিলা করছিল। ওপরে আখেরাতের চিত্র পেশ করার পর এখন বক্তব্যের মোড় এখানে তাদের জুলুম ও হঠকারিতার দিকে ঘুরে যাচ্ছে। এখানে বাহ্যতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার মাধ্যমে মক্কার কাফেরদেরকেই এসব কথা শুনানো হচ্ছে। তিনি যখন তাদের সামনে কিয়ামত, হাশর-নশর, হিসেব-নিকেশ, শাস্তি ও পুরস্কার এবং জান্নাত ও জাহান্নামের কথা বলতেন আর এসব বিষয় সম্বলিত কুরআন মজীদের আয়াত শুনিয়ে দাবী করতেন, এসব খবর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার কাছে এসেছে, এ হচ্ছে আল্লাহর বাণী আল্লাহ তা’আলা অহীর মাধ্যমে এ বাণী নাযিল করেছেন তখন তাদের নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় পুরোহিত গোষ্ঠী এবং তাদের বখাটে লোকেরা তাঁর এ বক্তব্য যেমন কখনো সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে-চিন্তে দেখতো না, তেমনি এও চাইতো না যে, জনসাধারণ তাঁর বক্তব্যের প্রতি মনোযোগ দিক। তাই তারা কখনো বলতো তিনি গণক, কখনো বলতো তিনি পাগল, কখনো বলতো তিনি কবি, আবার কখনো বলতো তিনি নিজেই এসব অদ্ভূত কথা রচনা করেন এবং নিজের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর নাযিলকৃত অহী বলে পেশ করেন। তাদের ধারণা ছিল, এভাবে অপবাদ আরোপ করে মানুষের মনে তাঁর ব্যাপারে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দিতে পারবে এবং তাঁর সব কথা ব্যর্থ হয়ে যাবে। সূতরাং এখানে বলা হচ্ছে, হে নবী, বাস্তব অবস্থা তো তাই যা সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এসব কারণে এসব লোক যদি তোমাকে গণক এবং পাগল বলে তাহলে তার পরোয়া করো না। আল্লাহর বান্দাদেরকে তাদের গাফলতি সম্পর্ক সতর্ক এবং প্রকৃত সত্য সম্পর্কে সাবধান করার কাজ করতে থাকো। কারণ, আল্লাহর মেহেরবানীতে তুমি গণকও নও, পাগলও নও।
আরবী ভাষায় كاهن শব্দটি জোতিষী, ভবিষ্যৎ বক্তা ও জ্ঞানবান অর্থে ব্যবহৃত হয়। জাহেলী যুগে এটি একটি স্বতন্ত্র পেশা ছিল। গণকরা দাবী করতো এবং দুর্বল আকীদার লোকেরা মনে করতো যে, তারা নক্ষত্র বিশারদ বা আত্মা, শয়তান ও জিনদের সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ক আছে, যার মাধ্যমে তারা গায়েবী খবর জানতে পারে। কোন জিনিস হারিয়ে গেলে তা কোথায় পড়ে আছে তা তারা বলে দিতে পারে। কারো বাড়ীতে চুরি হলে কে চোর তা তারা বলে দিতে পারে। কেউ তার ভাগ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলে দিতে পারে তার ভাগ্যে কি লেখা আছে। মানুষ এসব উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের কাছে যেতো। তারা কিছু নযর-নিয়াজ নিয়ে তাদেরকে গায়েবী কথা বলে দিতো। মানুষ যাতে তাদের কাছে আসে এ উদ্দেশ্যে তারা নিজেরাও অনেক সময় বস্তিতে গিয়ে হাঁক ছেড়ে বেড়াতো। তাদের একটা বিশেষ ঢং হতো, যা দিয়ে তাদের চেনা যেতো। তাদের কথাবার্তাও সাধারণ বোলচাল থেকে ভিন্ন হতো। তারা বিশেষ ভংগীতে কিছুটা গানের সূরে ছন্দবদ্ধ কথা বলতো এবং সাধারণত এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা বলতো যা থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি তার মনের কথার সন্ধান করে নিতে পারে। জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কুরাইশ নেতারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তারা গণক হওয়ার অপবাদ আরোপ করেছিল। আর তা করেছিল শুধু এ কারণে যে, তিনি এমন সব বিষয়ে কথা বলতেন যা মানুষের দৃষ্টির আড়ালে ছিল, তাছাড়া তিনি দাবী করতেন যে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা এসে তার কাছে অহী নাযিল করে এবং আল্লাহর যে বাণী তিনি পেশ করেন তাও ছিল ছন্দায়িত। কিন্তু তাদের এ অপবাদের কারণে আরবের কোন মানুষই প্রতারিত হয়নি। কারণ গণকদের পেশা, তাদের চালচলন, তাদের কথাবার্তা এবং তাদের কারবার কারোই অজানা ছিল না। সবাই জানতো, তারা কি কাজ করে, কি উদ্দেশ্যে লোকজন তাদের কাছে যায়, কি কি কথা তারা তাদেরকে বলে, তাদের ছন্দবদ্ধ কথাগুলো কেমন হয় এবং তার বিষয়বস্তু কি থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এটা আদৌ কোন গণকের কাজ হতে পারে না যে, জাতির মধ্যে তৎকালে প্রচলিত আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী আকীদা-বিশ্বাস সে তুলে ধরবে, দিনরাত তার প্রচার প্রসারে জীবনপাত করবে এবং সেজন্য গোটা জাতির শত্রুতার ঝুঁকি নেবে। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে গণক হওয়ার এ অপবাদের নাম মাত্র সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুতরাং আরবের কোন নিরেট বোকা লোকও এতে প্রতারিত হয়নি।
অনুরূপভাবে মক্কার কাফেররা নিছক তাদের মনের সান্ত্বনার জন্য নবীকে ﷺ পাগল হওয়ার অপবাদ দিতো। যেমন বর্তমান যুগের কোন কোন বেশরম পাশ্চত্য লেখক ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের হিংসা চরিতার্থ করার জন্য দাবী করে যে, নবীর ﷺ ওপর মৃগি রোগের (Epilepsy) আক্রমণ হতো এবং আক্রান্ত অবস্থায় তাঁর মুখ থেকে যেসব কথা বের হতো লোকে তাকেই অহী মনে করতো। সে যুগের কোন জ্ঞানী লোকও এসব বেহুদা অপবাদকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি, এ যুগের কোন মানুষও কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে সাধিত বিস্ময়কর কীর্তিসমূহ দেখে একথা বিশ্বাস করতে পারে না যে, এসব কিছু মৃগী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফল।
# সুরা: আত-তূর
আয়াত নং :-৩২
اَمْ تَاْمُرُهُمْ اَحْلَامُهُمْ بِهٰذَاۤ اَمْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُوْنَۚ
তাদের বিবেক-বুদ্ধি কি তাদেরকে এসব কথা বলতে প্ররোচিত করে, না কি প্রকৃতপক্ষে তারা শত্রুতায় সীমালংঘনকারী লোক?
# এ দু’টি বাক্যে বিরোধীদের সমস্ত অপপ্রচার খণ্ডন করে দিয়ে তাদের মুখোশ সম্পূর্ণরূপে খুলে দেয়া হয়েছে। যুক্তির সারকথা হলো, কুরাইশদের এসব নেতা এ প্রবীণ ব্যক্তি বড় বড় জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান সেজে বসে আছে। কিন্তু তাদের জ্ঞানবুদ্ধি কি বলে, যে ব্যক্তি কবি নয় তাঁকে কবি বলো, গোটা জাতির লোক যাকে একজন জ্ঞানী বলে জানে তাঁকে পাগল বলো এবং গণনা বিদ্যার সাথে যার দূরতম সম্পর্কও নেই তাঁকে অযথা গণক বলে আখ্যায়িত করো। এরপরও যদি তারা জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নিতো তাহলে যে কোন একটি কথাই বলতো। অনেকগুলো পরস্পর বিরোধী উপাধি তো কাউকে একসাথে দেয়া যায় না। এক ব্যক্তি কবি, পাগল ও গণক একই সাথে কিভাবে হতে পারে? সে যদি পাগল হয়ে থাকে তাহলে গণক বা কবি হতে পারে না। গণক হলে কবি হতে পারে না এবং কবি হলে গণক হতে পারে না। কেননা, কবিতার ভাষা ও আলোচ্য বিষয় যা গণক বা জোতিষীদের ভাষা ও বিষয়বস্তু তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একই কথাকে যুগপৎ কাব্য ও গণকদের গণনা বলে আখ্যায়িত করা এমন কোন ব্যক্তির কাজ হতে পারে না, যে কাব্য ও গণনা বিদ্যার পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত। অতএব, এটা অত্যন্ত পরিষ্কার কথা যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে পরস্পর বিরোধী কথা ও মন্তব্য জ্ঞান-বুদ্ধির ভিত্তিতে নয়, বরং সরাসরি জিদ ও হঠকারীতার ভিত্তিতে করা হচ্ছে। জাতির এসব বড় বড় নেতা শুধু শত্রুতার আতিশয্যে অন্ধ হয়ে এমন সব ভিত্তিহীন অপবাদ আরোপ করছে যা কোন সুস্থ ও স্থির মস্তিষ্কের মানুষ গ্রহণযোগ্য মনে করতে পারে না। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, টীকা ১০৪ ; ইউনুস, টীকা ৩ ; বনী ইসরাইল, টীকা ৫৩ , ৫৪ ; আশ শু’আরা, টীকা ১৩০ , ১৩১ , ১৪০ , ১৪২ , ১৪৩ , ১৪৪ , )।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মুহাম্মদ(স.) সম্পর্কে কাফেরদের ধারণা : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তােমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ তুমি পাগল নও।’ এই ক্ষুদ্র আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একটা বিষয় প্রমাণ করতে এবং আরেকটি বিষয় খন্ডন করতে চান। প্রমাণ করতে চান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ তার নবীর ওপর রয়েছে। তােমার প্রতিপালক এই শব্দ দ্বয়ের প্রয়ােগে যে ঘনিষ্ঠতা ও প্রীতির ভাব প্রতিফলিত হয়, তা থেকেই। অনুগ্রহের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। আবার এই একই কথা দ্বারা এই মর্মেও আভাস পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তায়ালা তার যে বান্দাকে নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন, ঘনিষ্ঠ করেছেন ও আপন করে নিয়েছেন, তার ওপর একই সাথে অনুগ্রহও বিতরণ করবেন এবং তাকে পাগলও বানাবেন এটা হতে পারে না। রাসূল(স.)-এর জীবনেতিহাসের ক্ষেত্রে যে কোনাে পাঠকের কাছেই এটা একটা নিদারুণ বিস্ময়ের ব্যাপার যে, যে মােশরেকরা নবুওতের অনেক বছর আগে রসূল(স.)-কে তাদের ভেতরের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ বলে স্বীকার করতাে, এমনকি হাজরে আসওয়াদ সরানাের ব্যাপারে তারা তাকে শালিসও মেনেছিলাে, তারাই কিনা তাকে নবুওতের পর পাগল বলে সাব্যস্ত করলাে! তারা তাকে শুধু যে অধিকতর বুদ্ধিমান মনে করতাে তা নয় বরং আল আমীন অর্থাৎ বিশ্বাসী ও সৎ উপাধিও তারা তাকে দিয়েছিলাে। তারা তাঁর কাছে তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র ও টাকাকড়ি গচ্ছিত রাখতে, এমনকি এমন প্রচন্ড শত্রুতার মধ্যে হিজরতের দিনও তার কাছে অনেকের আমানত গতি ছিলাে। সে জন্যে হযরত আলী(রা)-কে রাসূল(স.)-এর হিজরতের পরেও কিছুদিন মক্কায় থাকতে হয়েছিলাে, যাতে তিনি রাসূল(স.)-এর পক্ষ থেকে সেসব গচ্ছিত জিনিস ফেরত দিতে পারেন। অথচ তখন তার সাথে মােশরেকদের ঘােরতর শত্রুতা চলছিলাে। মক্কার মােশরেকরা তার নবুওত লাভের আগে তাকে একটিও মিথ্যা কথা বলতে শােনেনি। রােম সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন রসূল(স.)-এর দূত আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন, তােমরা কি তাকে তার নবুওতের আগে মিথ্যাবাদিতার দায়ে অভিযুক্ত করতে। আবু সুফিয়ান এর জবাবে বললাে, না। অথচ সে ইসলাম গ্রহণের আগে রসূল(স.)-এর কট্টর দুশমন ছিলো । হিরাক্লিয়াস বললেন, তিনি যখন মানুষের সাথে মিথ্যা বলেন না, তখন আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবেন কেমন করে। যে ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত মানুষটিকে তারা নিজেদের ভেতরে সবচেয়ে বিচক্ষণ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী মনে করতাে, তার বিরুদ্ধে তারা কিভাবে এ জাতীয় অভিযোেগ আরােপ করলাে তা ভাবলে মানুষ মাত্রেই বিস্ময়ে স্তম্ভিত না হয়ে পারে না। ক্রোধ ও বিদ্বেষ তাদেরকে এতাে দূরে নিয়ে গিয়েছিলাে যে, জেনে শুনেও এমন ভুল কথা তারা বলতে পেরেছিলাে। আসলে হিংসা মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দেয়। আর স্বার্থপরতা মানুষকে যে কোনাে মিথ্যা অপবাদ আরােপ করতে প্ররােচিত করে। এতে সে মােটেই কুণ্ঠাবোধ করে না। অথচ অপবাদ আরােপকারী নিজের সম্পর্কে অন্য যে কোনাে লােকের আগে এ কথা জানে যে, সে নিজেই এক ভয়ংকর মিথ্যাবাদী এবং মহাপাপী। তাই পরম স্নেহ, মমত্ব ও শ্রদ্ধাবােধ সহকারে কাফেরদের সেই হিংসা এবং সেই মিথ্যা অপবাদের জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি পাগল নও।’ তারপর বলা হচ্ছে, “নিশ্চয় তােমার জন্যে রয়েছে চিরস্থায়ী প্রতিদান।’ গাইরি মামনুন শব্দের অর্থ হচ্ছে অব্যাহত, অপ্রতিহত ও অফুরন্ত। অর্থাৎ তোমার যে প্রতিপালক তােমাকে নবুওতের মতাে নেয়ামত দিয়েছেন, তার কাছে তােমার জন্যে অফুরন্ত প্রতিদান রয়েছে। এখানেও আপন করে নেয়ার ইংগীত স্পষ্ট। সকল রকমের বঞ্চনা, লাঞ্চনা, যুলুম ও মােশরেকদের আরােপিত অপবাদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রবােধ দান এ আয়াতের মূল বক্তব্য। বস্তুত যাকে তার প্রতিপালক পরম স্নেহ, সমাদর ও মর্যাদা সহকারে বলেন যে, তােমার প্রতিপালকের কাছে তােমার অফুরন্ত পুরস্কার রয়েছে, তার হারানাের কি থাকতে পারে।
# আলােচ্য এ সূরাতে প্রথমে কেন আযাবের কষাঘাত সম্পর্কে বলা হয়েছে আর কেনই বা দ্বিতীয় অধ্যায়ে গিয়ে প্রচুর নেয়ামতের ঘােষণা দান করা হয়েছে এবং কেনইবা সর্বপ্রকার উপায়ে তাদের অনুভূতিতে প্রকৃত সত্য বিষয়ের চেতনা দান করা হয়েছে তা পরিস্কার হয়ে গেলাে। বর্তমান প্রসংগে এসে তাই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ও তাৎক্ষণিকভাবে বান্দার সামনে সকল অবস্থার বাস্তব চিত্র এঁকে দেয়া হয়েছে। এর ফলে বান্দাহর সামনে বহু তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, তার পরপরই আবার তার অন্তরের গােপন কোনে নানাপ্রকার সন্দেহ-সংশয় উঁকি-ঝুকি মারা শুরু করেছে এবং এমন সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে সে জড়িয়ে গেছে যেখান থেকে বেরিয়ে আসা বড়ই কঠিন। তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলাতে গিয়ে এরশাদ করছেন, ‘অতপর উপদেশ দাও এবং স্মরণ করাও তাদেরকে তুমি তাে আর কোনাে জ্যোতির্বিদ বা গনক নও আর কোনাে পাগলও তুমি নও যে, যা মনে আসবে তাই বলবে…’ (আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে) আমরা আগেও আল্লাহ… কোনাে নিদর্শন মনে না করে) বলবে, এ তাে হচ্ছে, পুঞ্জিভূত একখন্ড মেঘ মাত্র! (আয়াত ২৮-৪৪) রসূলের ওপর মানুষকে শুধু স্মরণ করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব। ‘ফা-যাক্কির’-এ শব্দটি রসূলুল্লাহ(স.)-কে সম্বােধন করে বলা হয়েছে যাতে করে তার উপদেশদানের কারণে তারা প্রিয় নবী(স.)-এর সাথে বেয়াদবী করতে না পারে এবং তাকে মিথ্যা দোষারােপ না করে। আবার তারা একথাও কোনাে সময় বলেছে, সে একজন গনক বা জ্যোতির্বিদ, কখনও বলেছে পাগল। অবশ্য এ দুটি কথা তাদের কাছে একইরকম বলে মনে হয়, যেহেতু জ্যোতর্বিদরা শয়তানের কাছ থেকে কিছু কথা আহরণ করে। আর শয়তানও এই সুযোগে মানুষের বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে দেয়, যার কারণে তার মধ্যে কিছু পাগলামি দেখা দেয়। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে শয়তানই এই উভয় প্রকার দোষের জন্য দায়ী। সে হয়তাে বা জ্যোতির্বিদ একথা বলে তারা মহাগুণান্বিত নবী (স.)-এর ওপর এই ধরনের কথা প্রয়ােগ করতাে, অর্থাৎ কখনও বলতাে তিনি জ্যোতির্বিদ, কখনও বলতাে পাগল। এর কারণ অবশ্য এটিই যে কোরআনে করীমের অলৌকিক বাণীর সামনে তাদের বুদ্ধি খেই হারিয়ে ফেলতাে। তারা বুঝতেই পারতাে না যে কি বলবে। যে কথা তারা বলত, তাদের নিজেদের কাছেই তা খাপ খাওয়ার মতাে কথা মনে হতো না। তারা নিজেরাও ছিলাে কথার রাজা। আল্লাহর কাছ থেকে এ বাণী এসেছে তাদের মানসিক ব্যাধির কারণে তারা এ কথা যখন মানতে পারছিলো না তখন তারা এমন একটি কথা বলতে শুরু করলাে যা মানুষের বুদ্ধিতে ধরে না। এজন্যই তারা বলছিলাে, এটা জিনদের পক্ষ থেকে আসা কথা, অথবা তাদের সাহায্যে আসা অন্য কোনাে কথা। কাজেই যার কাছে এসেছে সে হয় এমন একজন জ্যোতির্বিদ যাকে শয়তান কিছু শিখিয়ে দিয়েছে, অথবা এমন একজন যাদুকর, যে নিয়মিত জিনদের সাহায্য পেয়ে থাকে, কিংবা একজন কবি, যে জিনদের পক্ষ থেকে আসা কোনাে কবিত্ব প্রতিভা হাসিল করেছে, নতুবা এমন একজন পাগল, যার ওপর শয়তান আছর করায় সে পাগল হয়ে গেছে এবং এইসব অদ্ভুত কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। মােশরেকদের এই কথাগুলাে ছিলাে অবশ্য অত্যন্ত বিশ্রী ও মারাত্মক। এ ব্যাপারে আল্লাহ রব্বুল আলামীন রসূলুল্লাহ(স.)-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এবং সেসব কথাকে তুচ্ছ জ্ঞান করার জন্য তাকে বিশেষভাবে নসীহত করছেন। কেননা তিনি তা নিজেই সাক্ষী যে, মােহাম্মদ(স.) তার প্রতিপালকের করুণা-ধন্য। যার কারণে তার ওপর আন্দায-অনুমানভিত্তিক জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করা বা পাগলামিতে পেয়ে বসার মতাে অবস্থা কিছুতেই আসতে পারে না। *প্রিয় নবীর ওপর কবিয়াল হবার অপবাদ : এরপর আল্লাহ তায়ালা তাদের যে কথা, ‘তিনি একজন কবি’-একে ঘৃণাভরে খন্ডন করছেন। তিনি বলছেন, ‘ওরা কি বলছে, সে একজন কবি, যার জন্য মৃত্যুকঠিন কোন দুর্ঘটনা আমরা কামনা করি।’ এ কথা তাে ওরা নিজেরা প্রিয় নবী(স.)-কে বলেছে, আবার ওরা একে অপরকে বলেছে, একটু ধৈর্য ধর এবং যা বলেছে তার ওপর টিকে থাকো, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যু না আসে, ব্যস মৃত্যু এসে গেলেই আমরা বেঁচে গেলাম। আমাদের জানে স্বস্তি এসে গেলাে। এজন্যই তো ওরা নবী(স.)-এর মৃত্যুকে তাদের সান্তুনার বিষয় বলে মনে করতাে, আর এরই কারণে আল্লাহ রব্বুল ইযযত এ হতভাগাদেরকে সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ(স.)-কে বিশেষভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন। এবং বলছেন, ‘বলাে, (হে রসূল), অপেক্ষা করো, আমিও তােমাদের সাথে আপেক্ষমান হয়ে আছি।’ আর শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে শেষ পরিণতিতে কার কি অবস্থা হবে, আর এই অপেক্ষা করায় কে সাহায্য-প্রাপ্ত হবে আর কে বিজয় লাভ করবে। কোরায়শ নেতারা খুবই ধৈর্যশীল ও বড়ই বুদ্ধিমান বলে পরিচিত ছিলাে এবং তাদের লােকজনকে খুবই বুদ্ধিমান বলে আখ্যায়িত করতো অথবা বলতাে তারা বিস্তর বুদ্ধির অধিকারী। একথা দ্বারা তারা ইংগিতে বুঝাতে চাইতাে যে, তারা গুরুত্বপূর্ণ যে কোনাে কাজ করার ব্যাপারে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের সাথে কাজ করে। তাই আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত কঠোরভাবে তাদের ধিক্কার দিচ্ছেন, কেননা ইসলাম সম্পর্কে তারা যে দৃষ্টিভংগি পােষণ করতাে তার মধ্যে কোনাে কৌশল, প্রজ্ঞা বা বুদ্ধির লক্ষণ ছিলাে না। এজন্য এ মােশরেকদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ঘৃণা ভরে বলছেন, মােহাম্মদ(স.)-কে কি এই সমস্ত নিকৃষ্ট গুণের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করা যায়, আর তার রেসালাত সম্পর্কে ওরা যে দৃষ্টিভংগি রাখে তা-ই কি তাদের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির পরিচয় বহনকারী? না তারা বিদ্রোহী, যালেম, তারা যুক্তি-বুদ্ধির কোনাে মূল্যই প্রকৃতপক্ষে দেয় না। এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের যুক্তি-বুদ্ধি কি তাদেরকে এইসব বাজে কথা বলতে বলে, না এই আচরণ করতে শেখায়? না, আসলে তারা এক বিদ্রোহী জাতি।’ ওপরের দুটি প্রশ্নের প্রথমটি হচ্ছে, এক তীব্র দংশনকারী প্রশ্ন এবং দ্বিতীয় প্রশ্নটির মধ্যে মারাত্মক মিথ্যা দোষারােপ করার কথা রয়েছে। এইভাবে রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিরুদ্ধে তাদের লম্বা কথা বলার অভ্যাস অত্যাধিক বেড়ে গিয়েছিলাে। তারা বহু মনগড়া কথা তৈরী করে বলতে থাকলাে। তাই এখানে আল্লাহ তায়ালা ঘৃণার সাথে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ওরা কি বলে, সে (মােহাম্মদ) নিজে (কোরআন) রচনা করে বলছে?’ তার মানে ওরা এটা বলতে চায়, যে কথা সে বলছে তা সাধারণভাবে মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এই কারণেই তাে আল্লাহ তায়ালা ঘৃণার সাথে ওদের কথাটি উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলছেন, ‘ওরা কি বলে নাকি সে নিজে রচনা করে করে বলছে?’ সাথে সাথে এই আজব কথাটি বলার কারণও আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করছেন, ‘বরং আসল ব্যাপার হচ্ছে, তারা কিছুতেই ঈমান আনবে না।’ এরই কারণে আল্লাহ তায়ালাও তাদের অন্তরকে ঈমানের চেতনা থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছেন। ঈমানের তাৎপর্য যাতে তারা না জানতে পারে তার জন্য তিনিই তাে তাদের মুখ দিয়ে এই ধরনের কথা বলাচ্ছেন। তারা যদি তাদের বুঝ শক্তিকে কাজে লাগাতাে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা জানতে পারতাে যে, অবশ্যই এটা মানুষের তৈরী করা কোনাে কথা নয় এবং একথাও চিন্তা করতাে, যে কথাটি তিনি বহন করে নিয়ে এসেছেন তিনি সেই মহান ব্যক্তি যিনি পরম সত্যবাদী এবং বিশ্বস্ত বলে খ্যাত।
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :
কলম (الْقَلَم) একটি বস্তু যা দ্বারা লেখা হয়। এখানে কলমের অর্থ সাধারণ কলমও হতে পারে। এতে ভাগ্যলিপির কলম এবং ফেরেশতা ও মানবের লেখার কলম অন্তর্ভুক্ত। এখানে বিশেষত ভাগ্যলিপির কলমও বোঝানো যেতে পারে। ‘উবাদা বিন সামেত (রাঃ) বলেন : আমার পিতার মৃত্যুর সময় তিনি আমাকে ডেকে বললেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। তারপর বললেন : তুমি লেখ। কলম বলল : কী লেখব? আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তুমি ভাগ্য লেখ এবং শেষ দিবস পর্যন্ত যা কিছু হবে তাও লেখ। (আহমাদ : ৫/৩১৭, তিরমিযী হা. ৩৩১৯, আবূ দাঊদ হা. ৪৭০০, সনদ সহীহ।) এ শব্দটি এ সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখ আছে বিধায় উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
১-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
ص، ق، ن এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাক্বারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এসব হুরূফের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী তা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। তবে সুদ্দী, কালবী ও মুজাহিদ (রহঃ) বলেন : নূন দ্বারা উদ্দেশ্য হল সেই মাছ যা সাত জমিনের নিচে রয়েছে।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : নূন শব্দটি ‘আর-রহমান’ শব্দের শেষ অক্ষর, সূরা ইউনুসে الر রয়েছে, সূরা মুমিনে حم রয়েছে, আর এখানে ‘ن’ উল্লেখ রয়েছে। সব মিলে الرحمن হয়েছে (কুরতুবী)।
القلم একটি বস্তু যা দ্বারা লেখা হয়। এটি শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম একটি উপকরণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(الَّذِيْ عَلَّمَ بِالْقَلَمِ)
“যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন” (সূরা আলাক ৯৬ : ৪)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা যে কলম সৃষ্টি করেছেন এখানে তার কসম করছেন। উবাদা বিন সামেত (রাঃ) বলেন : আমার পিতার মৃত্যুর সময় তিনি আমাকে ডেকে বললেন : আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। তারপর বললেন : তুমি লেখ। কলম বলল : কী লিখব? আল্লাহ তা‘আলা বললেন : তুমি ভাগ্য লেখ এবং শেষ দিবস পর্যন্ত যা কিছু হবে তাও লেখ। (আহমাদ ৫/৩১৭, তিরমিযী হা. ৩৩১৯, আবূ দাঊদ হা. ৪৭০০, সনদ সহীহ।)
কাতাদাহ বলেন : কলম বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ নেয়ামত। কেউ বলেছেন : আল্লাহ তা‘আলা সবার আগে কলম সৃষ্টি করার পর তা দ্বারা যা ভবিষ্যতে ঘটবে তা লাওহে মাহফূজে লিখে কলমকে আবার তাঁর নিকট আরশের ওপরে রেখে দিয়েছেন। তারপর দ্বিতীয় কলম সৃষ্টি করে জমিনে যা কিছু হবে তা লেখার নির্দেশ দিয়েছেন। (কুরতুবী)
مَا يَسْطُرُوْنَ অর্থাৎ ما يكتبون বা কলম যা লেখে। ইবনু আব্বাস বলেন : ফেরেশতারা আদম সন্তানের যে সকল আমল লেখে। আল্লাহ তা‘আলা এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের শপথের জবাবে বলছেন : নিশ্চয়ই হে মুহাম্মাদ! তোমার প্রভুর অনুগ্রহে তুমি পাগল নও। যেমন মক্কার কাফিররা বলে :
(وَقَالُوْا يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْ نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُوْنٌ)
“তারা বলে ‘ওহে যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে! তুমি নিশ্চয় উন্মাদ।” (সূরা হিজর ১৫ : ৬)
غَيْرَ مَمْنُوْنٍ
অর্থাৎ নিরবিচ্ছিন্ন, অশেষ। নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে যে সকল কষ্টের সম্মুখীন হয়েছো তার জন্য আখিরাতে অশেষ পুরস্কার প্রস্তুত আছে।
(خُلُقٍ عَظِيْمٍ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে অনুগ্রহ করে যে চরিত্র দান করেছেন তার দ্বারা আপনি অনেক মহৎ। ইবনু আব্বাস বলেন :
علي دين عظيم من الأديان
তুমি সকল ধর্মের মধ্যে মহান ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে ধর্ম হল ইসলাম। এর চেয়ে কোন ধর্ম আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রিয় নয় এবং অন্য কোন ধর্মে তিনি সন্তুষ্ট নন। (কুরতুবী) আমের (রাঃ) বলেন : আমি উম্মুল মু’মিনিন আয়িশাহ (রাঃ) কে বললাম : আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র সম্পর্কে অবগত করুন। তিনি বললেন : আপনি কি কুরআন পড়েননি? কারণ :
فَإِنَّ خُلُقَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّي اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ الْقُرْآنَ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র ছিল কুরআন। (সহীহ মুসলিম, আবূ দাঊদ, আহমাদ হা. ২৪৬৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা কেবল আমাদের নাবীর চরিত্রের ক্ষেত্রেই عَظِيْمٍ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, অন্য কোন নাবীর ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করেননি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجٰهِلِيْنَ)
“তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চল।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৯৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(لَقَدْ جَا۬ءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ)
“অবশ্যই তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছে। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মু’মিনদের প্রতি সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।” (সূরা তাওবাহ ৯ : ১২৮)
আনাস (রাঃ) বলেন : আমি দশ বছর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খেদমত করেছি, তিনি কোনদিন আমাকে বলেননি, হে আনাস! তুমি এ কাজ করলে কেন, আর এ কাজ করলে না কেন? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : নিশ্চয়ই আমি উত্তম চরিত্র পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি। (আহমাদ হা. ৮৯৫২, সহীহ) মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনটা ছিল কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
আবূ যার (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তুমি যেখানেই থাক আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর, কোন খারাপ কাজ হয়ে গেলে সাথে সাথে একটি ভাল কাজ কর, কেননা সে ভাল কাজ খারাপ কাজের অপরাধ মুছে দেবে। আর মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার কর।
আবূ দারদা (রাঃ) বলেন : নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কিয়ামতের দিন মুমিনের নেকীর পাল্লায় উত্তম চরিত্রের চেয়ে আর কিছুই ভারী হবে না। (তিরমিযী হা. ২০০২, সহীহ) এ ছাড়াও উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে।
(فَسَتُبْصِرُ وَيُبْصِرُوْنَ)
অর্থাৎ যখন সত্য প্রকাশিত হবে এবং কিছুই গোপন থাকবে না তখন তুমি মুহাম্মাদ জানতে পারবে এবং তারাও জানতে পারবে। প্রকৃত পক্ষে কে পথভ্রষ্ট-তুমি, না তারা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِنَّآ أَوْ إِيَّاكُمْ لَعَلٰي هُدًي أَوْ فِيْ ضَلَالٍ مُّبِيْنٍ)
“নিশ্চয়ই আমরা অথবা তোমরা সৎপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত কিংবা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পতিত।” (সূরা সাবা ৩৪ : ২৪) মূলত এখানে মক্কার কুরাইশ নেতাদের ধমক দেওয়া হয়েছে। কারণ এ সূরার সিংহভাগ ওয়ালিদ বিন মুগীরাহ, আবূ জাহল ও অন্যান্য কাফির নেতাদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।
الْمَفْتُوْنُ অর্থ : ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন المجنون বা পাগল। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেছেন : যে সত্যের ব্যাপারে ভ্রান্তিতে আছে এবং তা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। (ইবনু কাসীর)
সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসারী হিসাবে প্রত্যেক মুসলিমের উচিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র গ্রহণ করা। তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন।
২. মানুষের তাকদীর পূব থেকেই নির্ধারিত।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তম চরিত্রের অধিকারী যা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই সত্যায়ন করেছেন।
৪. আমাদের রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া উচিত।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৭ নং আয়াতের তাফসীর
‘নূন’ প্রভৃতি হুরূফে হিজার বিস্তারিত বর্ণনা সূরায়ে বাকারার শুরুতে গত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কথিত আছে যে, এখানে (আরবি) দ্বারা ঐ বড় মাছকে বুঝানো হয়েছে যা এক জগত পরিবেষ্টনকারী পানির উপর রয়েছে যা সপ্ত আকাশকে উঠিয়ে নিয়ে আছে। যেমন মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা কলম সৃষ্টি করেন এবং ওকে বলেনঃ “লিখো।” কলম বলেঃ “কি লিখবো?” উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তকদীর লিখে নাও।” সুতরাং ঐ দিন থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবার আছে সবগুলোই কলম লিখে ফেলে। তারপর আল্লাহ পাক মাছ সৃষ্টি করেন এবং পানির বাষ্প উত্থিত করেন যার দ্বারা আকাশ নির্মিত হয় এবং যমীনকে ঐ মাছের পিঠের উপর রাখা হয়। মাছ নড়ে ওঠে, ফলে যমীনও হেলতে দুলতে শুরু করে। তখন আল্লাহ তা’আলা যমীনে পাহাড় গেড়ে দেন। ফলে যমীন মযবূত হয়ে যায় এবং ওর নড়াচড়া করা বন্ধ হয়ে যায়।” অতঃপর হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (ইমাম ইবনে আবি হাতিম ও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন) ভাবার্থ এই যে, এখানে (আরবি) দ্বারা এই মাছকেই বুঝানো হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম কলম ও মাছ সষ্টি করেন। কলম জিজ্ঞেস করেঃ “কি লিখবো?” উত্তরে বলা হয়ঃ “কিয়ামত পর্যন্ত যতকিছু হবে সবই লিখে নাও।” অতঃপর তিনি (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেন) সুতরাং (আরবি) দ্বারা উদ্দেশ্য মাছ এবং (আরবি) দ্বারা উদ্দেশ্য এই কলম।
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন। তারপর নূন অর্থাৎ দোয়াত সৃষ্টি করেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা কলমকে বলেনঃ “লিখো।” কলম বলেঃ “কি লিখবো?” উত্তরে আল্লাহ বলেনঃ “যা কিছু হচ্ছে এবং যা কিছু হবে যেমন আমল, রিযিক, বয়স, মৃত্যু ইত্যাদি সবকিছুই লিখে নাও।” তখন কলম ওগুলো লিখে নেয়।” (এ হাদীসটি ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য এটাই। অতঃপর কলমের উপর মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত ওটা আর চলবে না। তারপর আল্লাহ তা’আলা জ্ঞান বা বিবেক সৃষ্টি করেন এবং ওকে বলেনঃ “আমার মর্যাদার শপথ! আমার বন্ধুদের মধ্যে আমি তোমাকে পূর্ণতায় পৌঁছিয়ে দিবো এবং আমার শক্রদের মধ্যে তোমাকে অপূর্ণ রাখবো।”
মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ এটা মশহুর ছিল যে, নূন দ্বারা ঐ মাছকে বুঝানো হয়েছে যা সপ্তম যমীনের নীচে রয়েছে। বাগাভী (রঃ) প্রমুখ তাফসীরকার বলেন যে, এই মাছের পিঠের উপর এক কংকরময় ভূমি রয়েছে যার পুরুত্ব আকাশ ও পৃথিবীর সমান। ওর উপর একটি বলদ রয়েছে যার চল্লিশ হাজার শিং রয়েছে। ওর পিঠের উপর সাতটি যমীন এবং ওগুলোর সমস্ত মাখলূক আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, কতক মুফাসসির এই হাদীসকেও এই অর্থের উপরই স্থাপন করেছেন যা মুসনাদে আহমাদ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে রয়েছে। তা এই যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মদীনায় আগমনের সংবাদ অবগত হন তখন তিনি তাঁর নিকট হাযির হন এবং কতকগুলো প্রশ্ন করেন। তিনি তাকে বলেনঃ “আমি আপনাকে এমন কতকগুলো প্রশ্ন করবো যেগুলো নবীগণ ছাড়া অন্য কেউ জানে না।” অতঃপর তিনি প্রশ্ন করেনঃ “কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন কি? জান্নাতীদের প্রথম খাদ্য কি? কি কারণে সন্তান কখনো পিতার দিকে আকর্ষিত হয় এবং কখনো মাতার দিকে আকর্ষিত হয়?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “এই কথাগুলো এখনই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বলে গেলেন।” তখন হযরত ইবনে সালাম (রাঃ) বলে উঠলেনঃ “ ফেরেশতাদের মধ্যেই তিনি এমন একজন ফেরেশতা যিনি ইয়াহূদীদের দুশমন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন হলো এমন এক আগুন বের হওয়া যা লোকদেরকে পূর্ব দিক হতে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাবে। আর জান্নাতীদের প্রথম খাদ্য হলো মাছের কলিজার অতিরিক্ততা। পুরুষের বীর্য স্ত্রীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করলে পুত্র সন্তান হয় এবং যখন স্ত্রীর বীর্য স্বামীর বীর্যের উপর প্রাধান্য লাভ করে তখন কন্যা সন্তান হয়।”
অন্য হাদীসে এটুকু বেশী আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম প্রশ্ন করেনঃ “এই খাদ্যের পরে জান্নাতীদেরকে কি খেতে দেয়া হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “জান্নাতী বলদ যবেহ করা হবে যা জান্নাতে চরে বেড়াতো।” তারপর জিজ্ঞেস করেনঃ “তাদেরকে কোন পানি পান করানো হবে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বলেনঃ “সালসাবীল’ নামক নহর হতে তাদেরকে পান করানো হবে।” একথাও বলা হয়েছে যে, (আরবি) দ্বারা আলোর তক্তা উদ্দেশ্য। একটি মুরসাল গারীব হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নূরের তক্তা এবং নূরের কলম যা চালিত হয়েছে। এমন সব জিনিসের উপর যেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে।”
ইবনে জুরায়েজ (রঃ) বলেনঃ আমাকে খবর দেয়া হয়েছে যে, ওটা এমন একটি নূরানী কলম যার দৈর্ঘ্য একশ বছরের পথ। একথাও বলা হয়েছে যে, (আরবি) দ্বারা দোয়াত এবং (আরবি) দ্বারা কলম কে বুঝানো হয়েছে। হাসান (রঃ) এবং কাতাদাহও (রঃ) একথাই বলেছেন। একটি অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল মার হাদীসেও এটা বর্ণিত হয়েছে। যা মুসনাদে ইবনে হাতিমে রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা (আরবি) অর্থাৎ দোয়াত সৃষ্টি করেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ দোয়াত ও কলম সৃষ্টি করেন। তারপর কলমকে বলেনঃ “লিখো।” কলম প্রশ্ন করেঃ “কি লিখবো?” আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বলেনঃ “কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে ওগুলো লিখো। যেমন আমল সমূহ, ভালই হোক আর মন্দই হোক, রিযিক, তা হালালই হোক অথবা হারামই হোক। তারপর এও লিখোঃ কোন জিনিস দুনিয়ায় কখন আসবে, কতদিন থাকবে এবং কখন বের হবে? আর আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের উপর রক্ষক ফেরেশতাদেরকে নিয়োগ করেছেন এবং কিতাবের জন্যে দারোগা নিযুক্ত করেছেন। রক্ষক ফেরেশতাগণ প্রতিদিনের আমল সম্পর্কে দারোগাকে জিজ্ঞেস করে লিখে নেন। যখন রিযিক শেষ হয়ে যায়, আয়ু পূর্ণ হয় এবং মৃত্যুর সময় এসে পড়ে তখন রক্ষক ফেরেশতাগণ দারোগা ফেরেশতাদের নিকট এসে জিজ্ঞেস করেনঃ “বলুন, আজকের আমল কি আছে?” তারা উত্তরে বলেনঃ “এই ব্যক্তির জন্যে এখন আমাদের কাছে কিছুই নেই।” একথা শুনে এই ফেরেশতাগণ নীচে নেমে আসেন এবং দেখেন যে, ঐ ব্যক্তি মারা গেছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এটা বর্ণনা করার পর বলেন, তোমরা তো আরব সম্প্রদায়, তোমরা কি কুরআন কারীমে রক্ষক ফেরেশতাদের সম্পর্কে পড় নি? বলা হয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ তোমরা যা আমল করতে তা আমরা লিখে রাখতাম।” ভাবার্থ হচ্ছেঃ তোমাদের আমলগুলো আমরা মূল হতে লিখে নিতাম। (৪৫:২৯)
এতো হলো (আরবি) শব্দ সম্পর্কে বর্ণনা। এখন (আরবি) শব্দ সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। বাহ্যতঃ এখানে (আরবি) দ্বারা সাধারণ কলম উদ্দেশ্য, যা দ্বারা লিখা হয়। যেমন আল্লাহ পাকের উক্তিঃ (আরবি)
অর্থাৎ “পাঠ কর, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন- শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতো না।” (৯৬:৩-৫)
এই কলমের কসম খেয়ে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা এটা অবহিত করছেন যে, তিনি মানুষকে লিখন শিক্ষা দিয়েছেন যার মাধ্যমে তারা ইলম বা জ্ঞান অর্জন করছে, এটাও তাঁর একটা বড় নিয়ামত। এজন্যেই এরপরই তিনি বলেনঃ এবং কসম তার যা তারা লিপিবদ্ধ করে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত কাতাদাহ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ভাবার্থ হচ্ছেঃ শপথ ঐ জিনিসের যা তারা লিখে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এও বর্ণিত আছে যে, এর ভাবার্থ হলোঃ শপথ ঐ জিনিসের যা তারা জানে। হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ফেরেশতাদের লিখনকে বুঝানো হয়েছে, যারা বান্দাদের আমল লিখে থাকেন। অন্যান্য তাফসীরকারগণ বলেন যে, এর দ্বারা ঐ কলমকে বুঝানো হয়েছে যা কুদরতীরূপে চালিত হয়েছে এবং আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে তকদীর লিপিবদ্ধ করেছে। তারা এর অনুকূলে ঐ হাদীস দু’টি পেশ করেছেন যা কলমের বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ঐ কলম উদ্দেশ্য যার দ্বারা যিকির লিখিত হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে পাগল নও, যেমন তোমার সম্প্রদায়ের মূখ ও সত্য অস্বীকারকারীরা তোমাকে বলে থাকে। বরং তোমার জন্যে অবশ্যই রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার। কেননা, তুমি রিসালাতের দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করেছে। এবং আমার পথে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেছে। তাই আমি তোমাকে বে-হিসাব পুরস্কার প্রদান করবো। তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবি) –এর অর্থ হলো (আরবি) অর্থাৎ মহান দ্বীন এবং তা হলো দ্বীন ইসলাম। মুজাহিদ (রঃ), আবূ মালিক (রঃ), সুদ্দী (রঃ) এবং রবী ইবনে আনাস (রঃ) একথাই বলেছেন। যহহাক (রঃ) এবং ইবনে যায়েদও (রঃ) এরূপই বলেছেন। আতিয়্যাহ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) দ্বারা (আরবি) বা উত্তম শিষ্টাচার বুঝানো হয়েছে।
হযরত কাতাদাহ্ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ “তাঁর চরিত্র হলো কুরআন (অর্থাৎ কুরআনেই তাঁর চরিত্রের বর্ণনা দেয়া হয়েছে)।
অন্য হাদীসে রয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “তুমি কি কুরআন পড়নি?” প্রশ্নকারী হযরত সাঈদ ইবনে হিশাম (রাঃ) বলেনঃ “হ্যাঁ, পড়েছি।” তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “কুরআন কারীমই তাঁর চরিত্র ছিল।” সহীহ্ মুসলিমে এ হাদীসটি পূর্ণরূপে বর্ণিত হয়েছে যা আমরা ইনশাআল্লাহ্ সূরা মুযযাম্মিলের তাফসীরে বর্ণনা করবো। বানু সাওয়াদ গোত্রের একটি লোক হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উপরোক্ত উত্তর দেন এবং (আরবি) –এ আয়াতটি পাঠ করেন। তখন ঐ লোকটি তাকে বলেনঃ “দু’ একটি ঘটনা বর্ণনা করুন!” তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “তাহলে শুননা! একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে আমি এবং হযরত হাফসা (রাঃ) উভয়েই খাদ্য রান্না করি। আমি আমার দাসীকে বলিঃ দেখো, যদি আমার খাদ্যের পূর্বে হাফসা (রাঃ)-এর খাদ্য এসে পড়ে তবে তুমি তা ফেলে দিবে। আমার দাসী তাই করে এবং খাদ্যের পাত্রটিও ভেঙ্গে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ছড়িয়ে পড়া বিক্ষিপ্ত খাদ্যগুলো একত্রিত করেন এবং বলেনঃ “এই পাত্রের পরিবর্তে একটি ভাল পাত্র তাকে তুমি দাও।” আল্লাহর শপথ! এ ছাড়া আর কোন শাসন গর্জন ও তিরস্কার ভৎসনা তিনি আমাকে করেননি।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
এ হাদীসটি যে কয়েক ধারায় বিভিন্ন শব্দে কয়েকটি কিতাবে বর্ণিত হয়েছে তার একটি ভাবার্থ তো এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রকৃতিতে জন্মগতভাবেই আল্লাহ তা’আলা পছন্দনীয় চরিত্র, উত্তম স্বভাব এবং পবিত্র অভ্যাস সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। সুতরাং এভাবেই কুরআন কারীমের উপর তাঁর আমল এমনই ছিল যে, তিনি যেন ছিলেন কুরআনের আহকামের মূর্তিমান আমলী নমুনা। প্রত্যেকটি হুকুম পালনে এবং প্রত্যেকটি নিষিদ্ধ বিষয় হতে বিরত থাকাতে তাঁর অবস্থা এই ছিল যে, কুরআনে যা কিছু রয়েছে তা যেন তাঁরই অভ্যাস ও মহৎ চরিত্রের বর্ণনা। হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ “দশ বছর ধরে আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে থেকেছি কিন্তু তিনি কোন এক দিনের তরেও আমাকে উহ (যন্ত্রণা প্রকাশক ধ্বনি) পর্যন্ত বলেননি। কোন করণীয় কাজ না করলেও এবং যা করণীয় নয় তা করে বসলেও তিনি আমাকে কোন শাসন গর্জন করা এবং ধমক দেয়া তো দূরের কথা এরূপ কেন হলো?’ এ কথাটিও বলেননি। তিনি সবারই চেয়ে বেশী চরিত্রবান ছিলেন। তাঁর হাতের তালুর চেয়ে বেশী নরম আমি কোন রেশম অথবা অন্য কোন জিনিস স্পর্শ করিনি। আর তার ঘর্ম অপেক্ষা বেশী সুগন্ধময় জিনিস আমি শুকিনি। মিশক আম্বরও না এবং আতরও না।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত বারা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) চেহারায় সবচেয়ে সুন্দর ছিলেন, ছিলেন সবচেয়ে চরিত্রবান। তাঁর পবিত্র দেহ খুব লম্বাও ছিল না এবং খুব খাটোও ছিল না। (সহীহ বুখারীতে এ হাদীসটি বর্ণিত) এ সম্পর্কে বহু হাদীস রয়েছে। ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী (রঃ) তাঁর কিতাবুশ শামায়েলে এ সম্পর্কীয় হাদীস বর্ণনা করেছেন।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) কখনো তাঁর হাত দ্বারা না তাঁর কোন দাসকে প্রহার করেছেন, না প্রহার করেছেন তাঁর কোন স্ত্রীকে এবং না প্রহার করেছেন অন্য কাউকেও। তবে হ্যাঁ, আল্লাহর পথে জিহাদ করেছেন (এবং ঐ জিহাদে কাউকে মেরেছেন) সেটা অন্য কথা। যখন তাঁকে দু’টি কাজের যে কোন একটিকে অবলম্বন করার অধিকার দেয়া হতো তখন তিনি সহজটি অবলম্বন করতেন। তবে সেটা গুনাহর কাজ হলে তিনি তা থেকে বহু দূরে থাকতেন। কখনো তিনি কারো নিকট হতে কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে কেউ আল্লাহর মর্যাদা ক্ষুন্ন করলে তিনি আল্লাহর আহকাম জারি করার জন্যে অবশ্যই তার নিকট হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন, কাজেই এটা ভিন্ন কথা।
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই আমি উত্তম ও পবিত্র চরিত্র পরিপূর্ণ বা বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যেই প্রেরিত হয়েছি। (অর্থাৎ নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করার জন্যেই প্রেরিত হয়েছি)।”
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ) শীঘ্রই তুমি দেখবে এবং তারাও দেখবে যে, তোমাদের মধ্যে কে বিকারগ্রস্ত। যেমন আল্লাহ পাক অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আগামীকল্য তারা জানবে, কে মিথ্যাবাদী, দাম্ভিক।” (৫৪:২৬) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমরা অথবা তোমরা অবশ্যই হিদায়াতের উপর কিংবা প্রকাশ্য বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছি।” (৩৪:২৪) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ অর্থাৎ এই হকীকত বা তত্ত্ব কিয়ামতের দিন খুলে যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেই এটাও বর্ণিত আছে যে, (আরবি) বলা হয় (আরবি) বা পাগলকে। হযরত মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ মনীষীও একথাই বলেন। হযরত কাতাদাহ (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তুমি শীঘ্রই জানতে পারবে কে বেশী শয়তানের নিকটবর্তী। (আরবি) এর বাহ্যিক অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি সত্য হতে সরে পড়ে এবং পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। (আরবি) এর উপর (আরবি) আনয়নের কারণ এই যে, যেন তা (আরবি) প্রমাণ করে। অর্থাৎ এর প্রকৃতরূপ ছিলঃ (আরবি) অর্থাৎ ‘শীঘ্রই তুমি জানবে এবং তারাও জানবে’ অথবা এইরূপ ছিলঃ (আরবি) অর্থাৎ ‘তোমাদের মধ্যে কে বিকারগ্রস্ত তা শীঘ্রই তুমিও খবর দিবে এবং তারাও খবর দিবে।’ এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ তোমার প্রতিপালক তো সম্যক অবগত আছেন কে তাঁর পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি সম্যক জানেন তাদেরকে যারা সৎপথ প্রাপ্ত। অর্থাৎ কারা সৎপথের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং কাদের পদস্খলন ঘটেছে তা আল্লাহ তা’আলা সম্যক অবগত।