أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٣٦٩)-৫৭২
www.motaher21.net
সুরা: আল্ – আনফাল।
সুরা:৮
২৭-২৮ নং আয়াত:-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ لَا تَخُونُوا
বিশ্বাসঘাতকতা করো না,
The prohibition of Betrayal .
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَخُوۡنُوا اللّٰہَ وَ الرَّسُوۡلَ وَ تَخُوۡنُوۡۤا اَمٰنٰتِکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۷﴾
وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَاۤ اَمۡوَالُکُمۡ وَ اَوۡلَادُکُمۡ فِتۡنَۃٌ ۙ وَّ اَنَّ اللّٰہَ عِنۡدَہٗۤ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ ﴿٪۲۸﴾
হে ঈমানদারগণ! জেনে বুঝে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না, নিজেদের আমানতসমূহের খেয়ানত করো না।
এবং জেনে রাখো, তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি আসলে পরীক্ষার সামগ্রী। আর আল্লাহর কাছে প্রতিদান দেবার জন্য অনেক কিছুই আছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। কিন্তু কোন বর্ণনাই ত্র“টি থেকে মুক্ত নয়; তাই এগুলো উল্লেখ ক রা হল না।
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সহীহাইনে খিয়ানত সম্পর্কে হাতিব বিন আবূ বালতা‘আহ (রাঃ)-এর একটি ঘটনা নিয়ে এসেছেন। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি কুরাইশদের নিকট একটি চিঠি লিখলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তোমাদের প্রতি হামলা করার মনস্থ করেছেন। এ বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জানিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পিছনে লোক পাঠিয়ে চিঠি নিয়ে আসলেন। হাতিবকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাজির করলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এসব কাজ করেছেন বলে স্বীকার করেন।
উমার (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি কি তার গর্দান উড়িয়ে দেব। কেননা সে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের সাথে খিয়ানত করেছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: তাকে ছেড়ে দাও, সে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: তোমরা যা ইচ্ছা তাই কর আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। (সহীহ বুখারী হা: ৩৯৮৩)
ইমাম ইবনু কাসীর (রাঃ) বলেন: সঠিক কথা হল আয়াতটি ব্যাপক, সকল খিয়ানতকারীর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে খিয়ানত করার অর্থ হল: আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যা নির্দেশ দিয়েছেন তা বর্জন করা আর যা নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত হওয়া। (তাফসীর মুয়াসসার, পৃঃ ১৮০)
(وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ)
‘তোমাদের পরস্পরের আমানত সম্পর্কেও বিশ্বাস ভঙ্গ করে না’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: আমানত হল সেসব আমল যা আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে করতে বলেছেন। (ইবনু কাসীর, ৪র্থ খ. পৃঃ ৪৫)
(وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ)
‘সন্তান-সন্ততি এক পরীক্ষাস্বরূপ’ অর্থাৎ সন্তান-সন্ততি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা করবেন। সন্তান দিয়েছেন এটা জানার জন্য কে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে, আর কে তাঁকে ভুলে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّمَآ أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ ط وَاللّٰهُ عِنْدَه۫ أَجْرٌ عَظِيْمٌ)
“নিশ্চয়ই তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা, আর আল্লাহরই নিকট রয়েছে মহা প্রতিদান।” (সূরা তাগাবুন ৬৪:১৫)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَآ أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللّٰهِ ج وَمَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَأُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ)
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন না করে; যারা এমন করবে (উদাসীন হবে) তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা মুনাফিকুন ৬৩:৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَّكُمْ فَاحْذَرُوْهُمْ)
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু, অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক হও।” (সূরা তাগাবুন ৬৪:১৪)
وَأَنَّ اللّٰهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ
‘আল্লাহরই নিকট মহাপুরস্কার রয়েছে।’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নিকট যে সাওয়াব ও জান্নাত রয়েছে তা এই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হতে বহুগুণে উত্তম। এগুলো কখনও কখনও শত্রুদের মত ক্ষতির কারণও বটে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য অকল্যাণকর। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: ঐ স্বত্ত্বার শপথ যার হতে আমার প্রাণ, ততক্ষণ তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তার পিতা-মাতা, সন্তান ও সমস্ত মানুষ থেকে আমি অধিক প্রিয় হব। (সহীহ বুখারী হা: ১৪)
সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ ভঙ্গ করা ও নিষেধাজ্ঞায় লিপ্ত হওয়া তাদের সাথে খিয়ানত করার শামিল। তাই একজন মু’মিন সর্বদা সতর্ক থাকবে তার দ্বারা যেন কোন প্রকার খিয়ানত না হয়। কারণ খিয়ানত করা ঈমানের লক্ষণ নয় বরং তা মুনাফিকের লক্ষণ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যে কোন প্রকার খিয়ানত করা হারাম। তবে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে খিয়ানত করা অধিক খারাপ।
২. আল্লাহ তা‘আলা সম্পদ ও সন্তান দ্বারা পরীক্ষা করেন।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Al-Anfal
Sura:8
Verses :- 27-28
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ لَا تَخُونُوا
The prohibition of Betrayal .
Reason behind revealing This Ayah, and the prohibition of Betrayal
Allah says;
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ لَا تَخُونُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُواْ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ
O you who believe! Betray not Allah and His Messenger, nor betray knowingly your Amanat (things entrusted to you).
The Two Sahihs mention the story of Hatib bin Abi Baltaah.
In the year of the victory of Makkah he wrote to the Quraysh alerting them that the Messenger of Allah intended to march towards them. Allah informed His Messenger of this, and he sent a Companion to retrieve the letter that Hatib sent, and then he summoned him. He admitted to what he did.
Umar bin Al-Khattab stood up and said, “O Allah’s Messenger! Should I cut off his head, for he has betrayed Allah, His Messenger and the believers?”
The Prophet said,
دَعْهُ فَإِنَّهُ قَدْ شَهِدَ بَدْرًا وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ اللهَ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ
اعْمَلُوا مَا شِيْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُم
Leave him! He participated in Badr. How do you know that Allah has not looked at those who participated in Badr and said, Do whatever you want, for I have forgiven you.
However, it appears that this Ayah is more general, even if it was revealed about a specific incident. Such rulings are dealt with by their indications, not the specific reasons behind revealing them, according to the majority of scholars.
Betrayal includes both minor and major sins, as well those that affect others. Ali bin Abi Talhah said that Ibn Abbas commented on the Ayah,
وَتَخُونُواْ أَمَانَاتِكُمْ
(nor betray your Amanat),
“The Amanah refers to the actions that Allah has entrusted the servants with, such as and including what He ordained. Therefore, Allah says here,
لَا تَخُونُواْ
(nor betray…), `do not abandon the obligations.”‘
Abdur-Rahman bin Zayd commented, “Allah forbade you from betraying Him and His Messenger, as hypocrites do.”
Allah said
وَاعْلَمُواْ أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ
And know that your possessions and your children are but a trial.
from Him to you. He grants these to you so that He knows which of you will be grateful and obedient to Him, or become busy with and dedicated to them instead of Him.
Allah said in other Ayat,
إِنَّمَأ أَمْوَلُكُمْ وَأَوْلَـدُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللَّهُ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ
Your wealth and your children are only a trial, whereas Allah! With Him is a great reward. (64:15)
وَنَبْلُوكُم بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً
And We shall make a trial of you with evil and with good. (21:35)
يأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُواْ لاأَ تُلْهِكُمْ أَمْوَلُكُمْ وَلاأَ أَوْلَـدُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَمَن يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُوْلَـيِكَ هُمُ الْخَـسِرُونَ
O you who believe! Let not your properties or your children divert you from the remembrance of Allah. And whosoever does that, then they are the losers. (63:9)
and,
يأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُواْ إِنَّ مِنْ أَزْوَجِكُمْ وَأَوْلـدِكُمْ عَدُوّاً لَّكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ
O you who believe! Verily, among your wives and your children there are enemies for you (who may stop you from the obedience of Allah); therefore beware of them! (64:14)
Allah said next,
وَأَنَّ اللّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ
And that surely with Allah is a mighty reward.
Therefore, Allah’s reward, favor and Paradise are better for you than wealth and children.
Certainly, among the wealth and children there might be enemies for you and much of them avail nothing. With Allah alone is the decision and sovereignty in this life and the Hereafter, and He gives tremendous rewards on the Day of Resurrection.
In the Sahih, there is a Hadith in which the Messenger of Allah said,
ثَلَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلَوَةَ الاِْيمَانِ
مَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا
وَمَنْ كَانَ يُحِبُّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلاَّ للهِ
وَمَنْ كَانَ أَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ إِلَى الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللهُ مِنْه
There are three qualities for which whomever has them, he will have tasted the sweetness of faith. They are:
whoever Allah and His Messenger are dearer to him than anyone else,
whoever loves a person for Allah’s sake alone, and
whoever prefers to be thrown in fire rather than revert to disbelief, after Allah has saved him from it.
Therefore, loving the Messenger of Allah comes before loving children, wealth and oneself.
In the Sahih, it is confirmed that he said,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَاا يُوْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ نَفْسِهِ وَأَهْلِهِ وَمَالِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِين
By He in Whose Hand is my soul! None of you will have faith unless I become dearer to him than himself, his family, his wealth and all people.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
২৭-২৮ নং আয়াতের তাফসীর:
এই আয়াতটি আবু লুবাবাহ ইবনে আবদিল মুনযির (রাঃ)-এর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে ইয়াহূদী বানু কুরাইযার নিকট প্রেরণ করেন যেন তারা রাসূল (সঃ)-এর হুকুমের শর্ত মেনে নিয়ে দুর্গ খালি করে দেয়। তারা তখন আবু লুবাবাহর কাছেই পরামর্শ চায়। তখন তিনি তাদেরকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেন এবং তিনি স্বীয় হাত দ্বারা স্বীয় গলার প্রতি ইশারা করেন অর্থাৎ ওটা হচ্ছে যবেহ্ বা হত্যা। এরপর আবু লুবাবাহ্ (রাঃ) বুঝতে পারেন যে, তিনি আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। অতঃপর তিনি শপথ করে বসেন যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর তাওবা কবুল না করা পর্যন্ত তিনি মরে যাবেন সেও ভাল কিন্তু খাদ্য খাবেন না। এরপর তিনি মদীনার মসজিদে এসে থামের সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলেন। নয় দিন এভাবেই কেটে যায়। ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়ে যান। শেষ পর্যন্ত রাসূল (সঃ) -এর উপর আল্লাহ তা’আলা তার তাওবা কবুলের আয়াত নাযিল করেন। জনগণ তঁাকে এই সুসংবাদ দেয়ার জন্যে তার কাছে আসে এবং থামের বন্ধন খুলে দেয়ার ইচ্ছা করেন। আবু লুবাবাহ (রাঃ) বলেনঃ “আমার বন্ধন শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ) খুলতে পারেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজে তার বন্ধন খুলে। দেন। ঐ সময় তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আমার সমস্ত ধন-সম্পদ সাদকা করে দিলাম।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তোমার জন্যে এক তৃতীয়াংশ সাদকা করাই যথেষ্ট হবে।” (এটা আব্দুর রাযযাক ইবনে আবি কাতাদা (রঃ) ও যুহরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রাঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি হযরত উসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। কেননা ফিত্না-ফাসাদ সষ্টি করে হত্যা করে দেয়া হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা।
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আবু সুফিয়ান (রাঃ) মক্কা থেকে বের হন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সংবাদ দেন যে, আবু সুফিয়ান (রাঃ) অমুক জায়গায় রয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “আবু সুফিয়ান অমুক জায়গায় রয়েছে। তাকে গ্রেফতার করার জন্যে বেরিয়ে পড়। কিন্তু এ কথা সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখতে হবে।” কিন্তু একজন মুনাফিক আবু সুফিয়ানকে লিখে পাঠায়ঃ, “মুহাম্মাদ (সঃ) ধরতে যাচ্ছেন, সুতরাং সাবধান হয়ে যাও।” তখন (আরবী) আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল। আয়াতের ধরন হিসেবেও এটা প্রমাণিত হয় না। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হাতিব ইবনে আবি বুলতাআ’র (রাঃ) ঘটনা নিম্নরূপ বর্ণিত আছেঃ তিনি কুরায়েশ কাফিরদেরকে নবী (সঃ)-এর পরিকল্পনা সম্পর্কে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে পত্র লিখেছিলেন। এটা ছিল মক্কা বিজয়ের সময়ের ঘটনা। আল্লাহ স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে এ সংবাদ জানিয়ে দেন। সুতরাং তিনি পত্র বাহকের পিছনে লোক পাঠিয়ে দেন এবং ঐ পত্র ধরা পড়ে যায়। হাতিব (রাঃ)-কে ডাকা হয়। তিনি স্বীয় অপরাধ স্বীকার করেন। হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলে উঠেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এর গর্দান উড়িয়ে দিন। কেননা, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ হে উমার (রাঃ)! যেতে দাও। কেননা, এ ব্যক্তি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তোমার কি জানা নেই যে, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেছেন- “তোমরা যা চাও তাই আমল কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম।” মোটকথা, সঠিক ব্যাপার এই যে, আয়াতটি সাধারণ। যদিও এটা সঠিক যে, আয়াতটির শানে নুকূল একটি বিশেষ কারণ। আর জমহুর আলেমের মতে শব্দের সাধারণত্বের দ্বারা উক্তি করা যেতে পারে, বিশেষ কারণ না থাকলে কোন আসে যায় না। খিয়ানতের সংজ্ঞার মধ্যে ছোট, বড়, সকর্মক ও অকর্মক সমস্ত পাপই মিলিত রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এখানে আমানত’ শব্দ দ্বারা ঐ সব আমলকে বুঝানো হয়েছে, যেগুলোকে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর ফরয করে রেখেছেন। ভাবার্থ হচ্ছে- ফরয ভেঙ্গে দিয়ো না, সুন্নাত তরক করো না এবং পাপকার্য থেকে দূরে থাকো।
উরওয়া ইবনে যুবাইর (রাঃ) বলেন যে, ভাবার্থ হচ্ছে- এমন কাজ করো না যে, সামনে তো কারো মর্জি মুতাবেক কথা বলবে, কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তার দুর্নাম করবে বা তার বিরোধিতা করবে। এটাই হচ্ছে প্রকৃত খিয়ানত। আমানত এর দ্বারাই শেষ হয়ে যায়। সুদ্দী বলেনঃ আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)-এর খিয়ানত এটাই যে, মানুষ পরস্পরের সাথে খিয়ানত করে। জনগণ নবী (সঃ)-এর কথা শুনতো এবং তা অন্যদেরকে বলে দিতো। এর ফলে ঐ সংবাদ মুশরিকদের কানেও পৌঁছে যেতো। এ জন্যেই নবী (সঃ) বলেছিলেন- “দু’জনের মধ্যকার কথা একটা আমানত। কথা যেখানে শুনবে সেখানেই রেখে দেয়া উচিত। কারো সামনে কারো কথার পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়, যদিও সে নিষেধ না করে থাকে।”
(আরবী) ফিৎনার অর্থ হচ্ছে আযমায়েশ বা পরীক্ষা। আল্লাহ সন্তান দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন যে, সন্তান পেয়ে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে কি-না এবং সন্তানদের দায়িত্ব পূর্ণভাবে পালন করছে। কি-না। কিংবা হয়তো সন্তানের প্রতি ভালবাসার কারণে আল্লাহ থেকে গাফেল থাকছে। যদি মানুষ এই পরীক্ষায় পূর্ণভাবে উত্তীর্ণ হতে পারে তবে আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে বড় পুরস্কার রয়েছে। আল্লাহ পাক বলেনঃ “আমি তোমাদেরকে অকল্যাণ ও কল্যাণ দ্বারা পরীক্ষা করবো।” আর এক জায়গায় বলেনঃ “হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে যেন তোমাদের মালধন ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর স্মরণ থেকে ভুলিয়ে না রাখে, আর যারা এরূপ করবে তারা হবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত।” আল্লাহ তা’আলা আর এক জায়গায় বলেনঃ “হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীরা এবং তোমাদের সন্তানরা তোমাদের শত্রু, সুতরাং তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।
(আরবী) অর্থাৎ আল্লাহর নিকটে যে সাওয়াব ও জান্নাত রয়েছে তা এই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হতে বহুগুণে উত্তম। এগুলো শক্রদের মত ক্ষতিকারক এবং এগুলোর অধিকাংশই মানুষের জন্যে কল্যাণকর নয়। আল্লাহ পাক দুনিয়া ও আখিরাতের মালিক। কিয়ামতের দিন তাঁর কাছে মহা পুরস্কার রয়েছে। হাদীসে রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “হে আদম সন্তান! তুমি আমাকে খোঁজ কর, পেয়ে যাবে। তুমি যদি আমাকে পেয়ে যাও তবে জানবে যে, সবকিছুই পেয়ে গেছে । আর যদি আমাকে হারিয়ে দাও তবে সবকিছুই হারিয়ে দিয়েছো। তোমার কাছে আমিই সর্বাপেক্ষা বেশী প্রিয় হওয়া উচিত।”
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তিনটি জিনিস যার মধ্যে রয়েছে সে ঈমানের আস্বাদ পেয়েছে। (১) যার কাছে সমস্ত জিনিস থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) প্রিয়। (২) যে ব্যক্তি কোন লোককে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই ভালবাসে। (৩) যে ব্যক্তির কাছে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াও অধিক পছন্দনীয় সেই কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া অপেক্ষা যা থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন) বরং সে রাসূল (সঃ)-এর মহব্বতকে ধনমাল ও সন্তান-সন্ততির উপরেও প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যেমন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! তোমাদের কেউই (পূর্ণ) মুমিন হতে পারে না যে পর্যন্ত না আমি তার কাছে তার নফস্ হতে, তার পরিবারবর্গ হতে, তার মাল হতে এবং সমস্ত লোক হতে বেশী প্রিয় হই।”
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অধিকারে খিয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) এই যে, জনসমাজে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করা তথা নির্জনে তার বিপরীত পাপে লিপ্ত হওয়া। অনুরূপভাবে এটিও খিয়ানত যে, ফারায়েযের মধ্যে কোন ফরয ছেড়ে দেওয়া ও নিষিদ্ধ জিনিষের মধ্যে কোন কিছু করা। পরস্পরের আমানতে খিয়ানত করতেও নিষেধ করা হয়েছে। নবী (সাঃ)ও আমানত রক্ষার ব্যাপারে খুব বেশি তাকীদ করেছেন। হাদীসে এসেছে যে, নবী (সাঃ) প্রায় খুতবায় এ কথাটি অবশ্যই বলতেন, “যে আমানত রক্ষা করে না তার ঈমান নেই, যে চুক্তি রক্ষা করে না, তার দ্বীন নেই।” (আহমাদ)
সাধারণতঃ সন্তান ও সম্পদ মানুষকে খিয়ানত করতে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হতে বাধ্য করে। সেই জন্য সে দুটিকে ফিতনা (পরীক্ষা) বলা হয়েছে। অর্থাৎ এর দ্বারা মানুষের পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে যে, তাদের ভালবাসায় আমানত ও আনুগত্যের হক পূর্ণরূপে আদায় করে কি না? যদি সে তা পূর্ণরূপে আদায় করে, তাহলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, অন্যথা সে অনুত্তীর্ণ ও অসফল বলে গণ্য হয়। এই অবস্থায় এই সম্পদ ও সন্তান তাঁর জন্য আল্লাহর শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
নিজেদের ‘আমানতসমূহ’ মানে কারোর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে যেসব দায়িত্ব তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। তার আনুগত্য করা ও অংগীকার পালনের দায়িত্বও হতে পারে। অথবা কোন সামাজিক চুক্তি পালন, দলের গোপনীয়তা রক্ষা করা বা ব্যক্তিগত ও দলীয় সম্পত্তি রক্ষা করার কিংবা এমন কোন পদের অঙ্গীকারও হতে পারে, যা কোন ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে দল তার হাতে সোপর্দ করে দেয়। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা আন নিসার ৮৮ টীকা )।
যে জিনিসটি সাধারণত মানুষের ঈমানী চেতনায় এবং নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং যে জন্য মানুষ প্রায়ই মুনাফেকী, বিশ্বাসঘাতকতা ও খেয়ানতে লিপ্ত হয় সেটি হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সন্তান-সন্ততির স্বার্থের প্রতি সীমাতিরিক্ত আগ্রহ। এ কারণে বলা হয়েছে, এ অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মোহে অন্ধ হয়ে তোমরা সাধারণত সত্য-সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাও। অথচ এগুলো তো আসলে দুনিয়ার পরীক্ষাগৃহে তোমাদের জন্য পরীক্ষার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। যাকে তোমরা পুত্র বা কন্যা বলে জানো, প্রকৃতপক্ষে সে তো পরীক্ষার একটি বিষয়। আর যাকে তোমরা সম্পত্তি বা ব্যবসা বলে থাকে, সেও প্রকৃতপক্ষে পরীক্ষার আর একটি বিষয় মাত্র। এ জিনিসগুলো তোমাদের হাতে সোপর্দ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমরা অধিকার ও দায়-দায়িত্বের প্রতি কতদূর লক্ষ্য রেখে কাজ করো, দায়িত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে আবেগতাড়িত হয়েও কতদূর সত্য ও সঠিক পথে চলা অব্যাহত রাখো এবং পার্থিব বস্তুর প্রেমাসক্ত নফসকে কতদূর নিয়ন্ত্রণে রেখে পুরোপুরি আল্লাহর বান্দায় পরিণত হও এবং আল্লাহ তাদের যতটুকু অধিকার নির্ধারণ করেছেন ততটুকু আদায়ও করতে থাকো, এগুলোর মাধ্যমে তা যাচাই করে দেখা হবে।