Book#581

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/٣٧٨)-৫৮১
www.motaher21.net
সুরা: আল্‌ – আনফাল।
সুরা:৮
৪৭-৪৯ নং আয়াত:-
غَرَّ هَـوُلاء دِينُهُم
“এদের ধর্ম এদেরকে প্রতারিত করেছে।”
” These people (Muslims) are deceived by their religion.”

وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ خَرَجُوۡا مِنۡ دِیَارِہِمۡ بَطَرًا وَّ رِئَآءَ النَّاسِ وَ یَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ مُحِیۡطٌ ﴿۴۷﴾

وَ اِذۡ زَیَّنَ لَہُمُ الشَّیۡطٰنُ اَعۡمَالَہُمۡ وَ قَالَ لَا غَالِبَ لَکُمُ الۡیَوۡمَ مِنَ النَّاسِ وَ اِنِّیۡ جَارٌ لَّکُمۡ ۚ فَلَمَّا تَرَآءَتِ الۡفِئَتٰنِ نَکَصَ عَلٰی عَقِبَیۡہِ وَ قَالَ اِنِّیۡ بَرِیۡٓءٌ مِّنۡکُمۡ اِنِّیۡۤ اَرٰی مَا لَا تَرَوۡنَ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اللّٰہَ ؕ وَ اللّٰہُ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ﴿٪۴۸﴾
اِذۡ یَقُوۡلُ الۡمُنٰفِقُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ غَرَّہٰۤؤُ لَآءِ دِیۡنُہُمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ فَاِنَّ اللّٰہَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ ﴿۴۹﴾

তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা গর্বভরে ও লোক দেখানোর জন্য নিজ গৃহ হতে বের হয়েছিল এবং লোককে আল্লাহর পথ হতে বাধা দান করছিল। তাদের সকল কীর্তিকলাপই আল্লাহর জ্ঞানায়ত্তে রয়েছে।
স্মরণ কর, শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করেছিল এবং বলেছিল, আজ মানুষের মধ্যে কেউই তোমাদের উপর বিজয়ী হবে না, আর আমি অবশ্যই তোমাদের সহযোগী (প্রতিবেশী)। অতঃপর দু’ দল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হল, তখন সে পিছু হটে সরে পড়ল ও বলল, ‘নিশ্চয় তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। নিশ্চয় আমি তা দেখি, যা তোমরা দেখতে পাও না।নিশ্চয় আমি আল্লাহকে ভয় করি।’আর আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।
স্মরণ কর, যখন মুনাফিক্ব (কপট) ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলতে লাগল, ‘এদের ধর্ম এদেরকে প্রতারিত করেছে।’ আর যে আল্লাহর উপর নির্ভর করে, (সে বিজয়ী হয়।) নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-

আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে জিহাদের মাঠেও ইখলাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তাদের মত হয়ো না যারা হককে মিটিয়ে দেয়ার জন্য, মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ তা‘আলার পথে মানুষকে বাধা দেয়ার জন্য যুদ্ধে বের হয়।

অর্থাৎ মক্কার মুশরিকরা বদরের দিন এরূপ উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয়েছিল ফলে তাদের পরিণতি ভাল হয়নি।

(وَإِنِّيْ جَارٌ لَّكُمْ)

‘আমি তোমাদের পার্শ্বেই থাকব।’অর্থাৎ বদরের যুদ্ধের জন্য যখন মক্কার কাফিররা রওনা হল তখন বনু বকরের সাথে তাদের যে শত্রুতা ছিল তার কথা মনে পড়ে গেল। তাদের আশঙ্কা ছিল পিছন দিক থেকে বনু বকর তাদের ওপর হামলা করতে পারে। এমন সময় শয়তান বনু বকরের সরদার সূরাকা বিন মালিকের রূপ ধারণ করে তাদের কাছে আগমন করে বলে: আমি তোমাদের প্রতিবেশি হিসেবে আছি। অতএব তোমাদের কোন শঙ্কা নেই। (আর-রাহীকুল মাখতুম, বদর যুদ্ধ অংশ)

কিন্তু যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখন সে শয়তান পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে আর বলে তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তোমরা যা দেখতে পাও না আমি তো তা দেখি। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করি।

(إِذْ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُوْنَ)

‘স্মরণ কর‎ যখন, মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা বলে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন: উভয় বাহিনী যখন কাতার বন্দী হয়ে মুখোমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে মুশরিকদের চোখে কম দেখান। তখন মুশরিকরা মুসলিমদের বিদ্রƒপ করে এ কথা বলে। তাদের ধারণা মুসলিমরা অচিরেই পরাজয় বরণ করবে। এ ব্যাপারে তারা কোন সন্দেহ করত না। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)

সুতরাং একজন মু’মিন জিহাদের মাঠেও আল্লাহ তা‘আলাকে স্বরণ করবে এবং ইখলাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কোনক্রমেই সংখ্যাধিক্যের বড়াই করবে না এবং মানুষকে দেখানোর জন্য জিহাদ করবে না।

আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:

* মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করা ও অহঙ্কার করা হারাম।
* শয়তানের ওয়াদা মিথ্যা।
* মুনাফিকরা মু’মিনদের ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা রাখে।
* মু’মিনদের মাঝে পরস্পর বিবাদ হলে ঐক্য বিনষ্ট হয়।

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Al-Anfal
Sura:8
Verses :- 47-49
غَرَّ هَـوُلاء دِينُهُم
:”These people (Muslims) are deceived by their religion.”

The Idolators leave Makkah, heading for Badr

Allah says;

وَلَا تَكُونُواْ كَالَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَارِهِم بَطَرًا وَرِيَاء النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللّهِ

And be not like those who come out of their homes boastfully and to be seen of men, and hinder (men) from the path of Allah;

After Allah commanded the believers to fight in His cause sincerely and to be mindful of Him, He commanded not to imitate the idolators, who went out of their homes
بَطَرًا
(boastfully) to suppress the truth,
وَرِيَاء النَّاسِ
(and to be seen of men), boasting arrogantly with people.

When Abu Jahl was told that the caravan escaped safely, so they should return to Makkah, he commented, “No, by Allah! We will not go back until we proceed to the well of Badr, slaughter camels, drink alcohol and female singers sing to us. This way, the Arabs will always talk about our stance and what we did on that day.”

However, all of this came back to haunt Abu Jahl, because when they proceeded to the well of Badr, they brought themselves to death; and in the aftermath of Badr, they were thrown in the well of Badr, dead, disgraced, humiliated, despised and miserable in an everlasting, eternal torment. This is why Allah said here,

وَاللّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ

and Allah is Muhit (encompassing and thoroughly comprehending) all that they do.

He knows how and what they came for, and this is why He made them taste the worst punishment.

Ibn Abbas, Mujahid, Qatadah, Ad-Dahhak and As-Suddi commented on Allah’s statement,
وَلَا تَكُونُواْ كَالَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَارِهِم بَطَرًا وَرِيَاء النَّاسِ
(And be not like those who come out of their homes boastfully and to be seen of men),

“They were the idolators who fought against the Messenger of Allah at Badr.”

Muhammad bin Ka`b said,

“When the Quraysh left Makkah towards Badr, they brought female singers and drums along. Allah revealed this verse,

وَلَا تَكُونُواْ كَالَّذِينَ خَرَجُواْ مِن دِيَارِهِم بَطَرًا وَرِيَاء النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللّهِ وَاللّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ

And be not like those who come out of their homes boastfully and to be seen of men, and hinder (men) from the path of Allah; and Allah is Muhit (encompassing and thoroughly comprehending) all that they do.
Shaytan makes Evil seem fair and deceives the Idolators

Allah said next.

وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَّكُمْ

And (remember) when Shaytan made their (evil) deeds seem fair to them and said, “No one of mankind can overcome you today and verily, I am your neighbor.”
Shaytan, may Allah curse him, made the idolators’ purpose for marching seem fair to them. He made them think that no other people could defeat them that day. He also ruled out the possibility that their enemies, the tribe of Bani Bakr, would attack Makkah, saying, “I am your neighbor.”
Shaytan appeared to them in the shape of Suraqah bin Malik bin Ju`shum, the chief of Bani Mudlij, so that, as Allah described them,

يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ وَمَا يَعِدُهُمْ الشَّيْطَـنُ إِلاَّ غُرُوراً

He (Shaytan) makes promises to them, and arouses in them false desires; and Shaytan’s promises are nothing but deceptions. (4:120)

فَلَمَّا تَرَاءتِ الْفِيَتَانِ نَكَصَ عَلَى عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكُمْ

But when the two forces came in sight of each other, he ran away and said:”Verily, I have nothing to do with you.

Ibn Jurayj said that Ibn Abbas commented on this Ayah,

“On the day of Badr, Shaytan, as well as, his flag holder and soldiers, accompanied the idolators. He whispered to the hearts of the idolators, `None can defeat you today! I am your neighbor.’ When they met the Muslims and Shaytan witnessed the angels coming to their aid,
نَكَصَ عَلَى عَقِبَيْهِ
(he ran away), he went away in flight while proclaiming,
إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ
(Verily, I see what you see not).”

Ali bin Abi Talhah said, that Ibn Abbas said about this Ayah,
لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَّكُمْ
(No one of mankind can overcome you today and verily, I am your neighbor),

“Shaytan, as well as, his devil army and flag holders, came on the day of Badr in the shape of a Suraqah bin Malik bin Ju`shum, man from Bani Mudlij, Shaytan said to idolators, `None will defeat you this day, and I will help you.’

When the two armies stood face to face, the Messenger of Allah took a handful of sand and threw it at the faces of the idolators, causing them to retreat.

Jibril, peace be upon him, came towards Shaytan, but when Shaytan, while holding the hand of a Mushrik man, saw him, he withdrew his hand and ran away with his soldiers. That man asked him, `O Suraqah! You claimed that you are our neighbor!’ He said,

إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّيَ أَخَافُ اللّهَ وَاللّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ

Verily, I see what you see not. Verily, I fear Allah for Allah is severe in punishment.
Shaytan said this when he saw the angels.”
The Position of the Hypocrites in Badr

Allah said next.

إِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ غَرَّ هَـوُلاء دِينُهُمْ

When the hypocrites and those in whose hearts was a disease (of disbelief) said:”These people (Muslims) are deceived by their religion.”

Ali bin Abi Talhah said that Ibn Abbas commented,

“When the two armies drew closer to each other, Allah made the Muslims look few in the eyes of the idolators and the idolators look few in the eyes of the Muslims. The idolators said,
غَرَّ هَـوُلاء دِينُهُمْ
(These people (Muslims) are deceived by their religion), because they thought that Muslims were so few. They believed, without doubt, that they would defeat the Muslims. Allah said,
وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ فَإِنَّ اللّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
(But whoever puts his trust in Allah, then surely, Allah is All-Mighty, All-Wise).

Qatadah commented,

“They saw a group of believers who came in defense of Allah’s religion. We were informed that when he saw Muhammad and his Companions, Abu Jahl said, `By Allah! After this day, they will never worship Allah!’ He said this in viciousness and transgression.”

Amir Ash-Sha`bi said,

“Some people from Makkah were considering embracing Islam, but when they went with the idolators to Badr and saw how few the Muslims were, they said,
غَرَّ هَـوُلاء دِينُهُمْ
(These people (Muslims) are deceived by their religion).”

Allah said next,

وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ

But whoever puts his trust in Allah,

and relies on His grace,

فَإِنَّ اللّهَ عَزِيزٌ

then surely, Allah is All-Mighty,

and verily, those who take His side (in the dispute) are never overwhelmed, for His side is mighty, powerful and His authority is All-Great,

حَكِيمٌ

All-Wise.

in all His actions, for He places everything in its rightful place, giving victory to those who deserve it and defeat to those who deserve it.

তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-
৪৭-৪৯ নং আয়াতের তাফসীর:

জিহাদে অটল থাকা, ভাল নিয়ত রাখা এবং খুব বেশী বেশী আল্লাহর যি করার উপদেশ দানের পর আল্লাহ তাআলা এখানে মুসলিমদেরকে মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত হতে নিষেধ করছেন। তিনি বলেন, মুশরিকরা যেমন সত্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া এবং জনগণের মধ্যে নিজেদের বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে গর্বভরে চলছে, তোমরা তদ্রপ করো না। আবু জেহেলকে যখন বলা হয়েছিল“বাণিজ্যিক কাফেলাতো রক্ষা পেয়েছে, সুতরাং চলো, আমরা এখান থেকেই ফিরে যাই।” তখন সেই অভিশপ্ত লোকটি উত্তরে বলেছিলঃ “না, আল্লাহর কসম! আমরা ফিরে যাবো না। বরং আমরা বদরের পানির কাছে অবতরণ করবো, সেখানে মদ পান করবো, কাবাব খাবো এবং গান শুনবো, যেন জনগণের মাঝে আমাদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তাদের বাসনার উল্টো অবস্থা ঘটিয়ে দিলেন। ওখানেই তাদের মৃতদেহ পড়ে রইলো এবং সেখানেই লাঞ্ছনা ও অপমানের সাথে তাদের মৃতদেহগুলো গর্তের মধ্যে নিক্ষেপ করে দেয়া হলো। এজন্যেই আল্লাহ পাক বলেনঃ “আল্লাহ তাদের কার্যাবলী পরিবেষ্টনকারী।” তাদের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য তাঁর কাছে প্রকাশমান। এজন্যেই তিনি তাদেরকে জঘন্য প্রতিদান প্রদান করলেন। সুতরাং এখানে ঐ মুশরিকদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে যারা আল্লাহর রাসূল (সঃ) ও রাসূলদের মাথার মুকুটের সাথে বদর প্রান্তরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। (এটা কাতাদা (রঃ), যহহাক (রঃ) এবং সুদ্দী (রঃ) প্রমুখ গুরুজনদের উক্তি) তাদের সাথে গায়িকা মেয়েরাও ছিল এবং তারা গানবাজনাও করেছিল। অভিশপ্ত শয়তান তাদের পৃষ্টপোষকতা করেছিল। সে তাদেরকে মিষ্টি কথা দিয়ে ভুলাচ্ছিল এবং তাদের কার্যাবলী তাদের দৃষ্টিতে খুব চাকচিক্যময় ও শোভনীয় করে দেখাচ্ছিল। তাদের কানে কানে সে বলছিলোঃ “তোমাদেরকে কে পরাজিত করতে পারে? আমি তোমাদের সাহায্যকারী হিসেবে রয়েছি। তাদের অন্তর থেকে সে বানু বকরের মক্কার উপর আক্রমণ করার ভয় দূর করছিল এবং সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জুলুমের রূপ ধারণ করে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলছিলঃ “আমি তো ঐ এলাকার সরদার। বানু মুদলিজ গোত্রের লোকেরা সবাই আমার অনুগত। আমি তোমাদের সহায়তাকারী। সুতরাং তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো।” শয়তানের কাজই তো হলো এটা যে, মিথ্যা অঙ্গীকার সে করে থাকে। পূরণ হবে না এমন আশা সে প্রদান করে এবং মানুষকে সে প্রতারণার জালে আটকিয়ে দেয়। বদরের দিন সে স্বীয় পতাকা ও সেনাবাহিনী নিয়ে মুশরিকদের দলে যোগদান করেছিল এবং তাদের অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দিয়েছিল যে, কেউই তাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না। সে তাদেরকে আরো বলেছিলঃ “তোমাদের কোনই ভয় নেই, আমি তোমাদের সাহায্যার্থে সর্বদা তোমাদের সাথেই থাকবো। কিন্তু যখন উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এবং সেই পাপাচার শয়তান ফেরেশতাদেরকে মুসলিমদের সাহায্যার্থে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে দেখলো তখন সে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাতে শুরু করলো এবং বলতে লাগলোঃ “আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাও না।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বদরের দিন ইবলীস স্বীয় পতাকা উঁচু করে মুদলিজ গোত্রের একটি লোকের রূপ ধারণ করতঃ তার সেনাবাহিনীসহ উপস্থিত হয়। সে সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জুসুমের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করে এবং মুশরিকদের অন্তরে সাহস ও উৎসাহ উদ্দীপনা যোগাতে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন উভয় বাহিনী কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক মুষ্টি মাটি নিয়ে মুশরিকদের চেহারায় নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং পলায়নের হিড়িক পড়ে যায়। জিবরাঈল (আঃ) শয়তানের দিকে অগ্রসর হন। ঐ সময় সে একজন মুশরিকের হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল। জিবরাঈল (আঃ)-কে দেখা মাত্রই সে লোকটির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের সেনাবাহিনীসহ পালাতে শুরু করলো । ঐ লোকটি তখন তাকে বললোঃ “হে সুরাকা! তুমি তো বলেছিলে যে, আমাদের সাহায্যার্থে তুমি আমাদের সাথেই থাকবে, কিন্তু এখন এ করছে কি?” ঐ অভিশপ্ত যেহেতু ফেরেশতাদেরকে দেখতে পাচ্ছিল তাই সে বললোঃ “আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ না। আমি তো আল্লাহকে ভয় করছি। আল্লাহর শাস্তি খুবই কঠোর।” অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে। যে, শয়তানকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে দেখে হারিস ইবনে হিশাম তাকে ধরে ফেললো । সে তখন তার গালে এমন জোরে একটা চড় মেরে দিলো যার ফলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তখন অন্যান্যেরা তাকে বললোঃ “হে সুরাকা! তুমি এই অবস্থায় আমাদেররকে অপদস্থ করছে এবং আমাদেরকে ধোকা দিচ্ছ?” সে উত্তরে বললোঃ “হ্যা, হ্যাঁ, তোমাদের সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। আমি তাদেরকে দেখছি যাদেরকে তোমরা দেখতে পাচ্ছ না।”

ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ক্ষণিকের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক প্রকারের আত্মভোলা হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি সতর্ক হয়ে গিয়ে বলেনঃ “হে আমার সাহাবীর দল! তোমরা আনন্দিত হয়ে যাও যে, তোমাদের ডানদিকে রয়েছেন জিবরাঈল (আঃ) এবং বামদিকে রয়েছেন মীকাঈল (আঃ), আর এই যে ইস্রাফীল (আঃ)। এঁরা তিনজনই নিজ নিজ সেনাবাহিনীসহ বিদ্যমান রয়েছেন।” ইবলীস সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জুসুম মুদলিজীর আকৃতিতে মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করছিল। তাদের অন্তরে সে সাহস দিচ্ছিল এবং ভবিষ্যদ্বাণী করছিল- “তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো, আজ তোমাদেরকে কেউই পরাজিত করতে পারবে না।” কিন্তু ফেরেশতাদের সেনাবাহিনীকে দেখা মাত্রই সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং “তোমাদের সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই, আমি তাদেরকে দেখছি যাদেরকে তোমরা দেখতে পাচ্ছ না” একথা বলতে বলতে পালিয়ে যায়। হারিস ইবনে হিশাম তাকে সুরাকা ভেবেই তার হাত ধরে ফেললো। তখন শয়তান তার বক্ষে এতো জোরে ঘুষি মারে যে, সে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। অতঃপর শয়তান পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে এবং নিজের কাপড় উঁচু করে ধরে বলতে থাকেঃ “হে আল্লাহ! আমি আপনাকে আপনার ঐ ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যা আপনি আমার সাথে করেছিলেন। তিবরানীতে রিফাআহ ইবনে রাফি (রাঃ) হতেও এরই কাছাকাছি বর্ণিত আছে।

উরওয়া ইবনে যুবাইর (রাঃ) বলেন যে, যখন কুরায়েশরা মক্কা থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করে তখন তাদের বানু বকরের যুদ্ধের কথা স্মরণ হয়ে যায় যে, হয়তো তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে তারা মক্কার উপর আক্রমণ করে বসবে। কাজেই তারা তাদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকতে উদ্যত হয়েছিল । ঐ সময়েই অভিশপ্ত ইবলীস সুরাকার রূপ ধারণ করে তাদের কাছে আসে। ঐ সুরাকা ছিল বানু কিনানা গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোক। এই সুরাকার রূপ ধারণকারী শয়তান করায়েশদেরকে বলতে শুরু করলোঃ “আমার কওমের দায়িত আমি নিচ্ছি। তোমরা তাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকে এবং মুসলমানদের সাথে মুকাবিলার জন্যে পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যাও।” এ কথা বলে সেও তাদের সাথে চললো। প্রতিটি মনজিলেই কুরায়েশরা সুরাকারূপী শয়তানকে দেখতে পাচ্ছিল। তাদের সবারই মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, সুরাকা স্বয়ং তাদের সাথে থাকবে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তখন সেই বিতাড়িত শয়তান পলায়ন করলো। হারিস ইবনে হিশাম অথবা উমাইর ইবনে অহাব তাকে যেতে দেখে চেঁচিয়ে বললোঃ “হে সুরাকা! তুমি কোথায় পালিয়ে যাচ্ছ?” সুরাকারূপী শয়তান তাকে মৃত্যু ও জাহান্নামের মুখে ঠেলে দিয়ে পালিয়েই গেল। কেননা, সে আল্লাহর সৈনিক ফেরেশতাদেরকে মুসলমানদের সাহায্যার্থে আসতে দেখেছিল। পালাবার সময় সে স্পষ্টভাবে বলে গেলঃ “তোমাদের সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। আমি এমন কিছু দেখছি যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ না।” ঐ কথায় নিঃসন্দেহে সে সত্যবাদী ছিল। তারপর সে বললোঃ “আমি আল্লাহকে ভয় করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর।” সে জিবরাঈল (আঃ)-কে ফেরেশতাদের সাথে অবতীর্ণ হতে দেখে বুঝতেই পেরেছিল যে, তাদের সাথে মুকাবিলা করার শক্তি তার নিজেরও নেই এবং মুশরিকদেরও নেই। সে যে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলেছিল তাতে সে মিথ্যাবাদী ছিল। ওটা ছিল শুধু তার মুখের কথা। প্রকৃতপক্ষে তার মুকাবিলা করার শক্তিই ছিল না।

এটাই হচ্ছে আল্লাহর এই শত্রুর অভ্যাস যে, সে মানুষকে উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত করে এবং সত্যের মুকাবিলায় এনে দাঁড় করে দেয়। অতঃপর সে গা ঢাকা দেয়।

কুরআন কারীম ঘোষণা করছে- “শয়তান মানুষকে বলে, তুমি কুফরী কর, অতঃপর যখন সে কুফরী করে বসে তখন সে বলে, তোমার সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই, আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি।” অন্য জায়গায় রয়েছেঃ “যখন সমস্ত মুকদ্দমা মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে-আল্লাহ তোমাদের সাথে সত্য ওয়াদা করেছিলেন, আর আমিও কিছু ওয়াদা করেছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা খেলাফ করেছিলাম, আর তোমাদের উপর আমার কোন আধিপত্যও ছিল না, শুধু এইটুকু যে, আমি তোমাদেরকে ডেকেছিলাম, তখন তোমরা আমার কথা মেনে নিয়েছিলে। অতএব তোমরা আমার উপর (সমস্ত) দোষ চাপিয়ে দিয়ো না, বরং দোষ নিজেদের উপরই আরোপ কর; আমি না তোমাদের সাহায্যকারী হতে পারি; না তোমরা আমার সাহায্যকারী হতে পার; আমি নিজেও তোমাদের এ কাজে অসন্তুষ্ট যে, তোমরা ইতিপূর্বে আমাকে (আল্লাহর) অংশ সাব্যস্ত করতে; নিশ্চয়ই যালিমদের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।”

আবু উসাইদ মালিক ইবনে রাবীআ (রাঃ) তার চক্ষু নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর বলেনঃ “এখনও যদি আমি তোমাদের সাথে বদর প্রান্তরে থাকতাম এবং আমার চক্ষু ঠিক থাকতো তবে আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ঐ ঘাটির খবর দিতে পারতাম যেখান দিয়ে ফেরেশতাগণ বের হয়ে এসেছিলেন। ঐ ঘাঁটি অবশ্যই আমার চেনা আছে। তাঁদেরকে ইবলীস দেখেছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁরা যেন মুসলমানদের যুদ্ধক্ষেত্রে স্থির ও অটল রাখেন। তারা মুসলমানদের পরিচিত লোকদের রূপ ধারণ করে এসেছিলেন এবং তাদেরকে বলেছিলেনঃ “তোমরা আনন্দিত হও। এ কাফিররা কিছুই নয়। তোমাদের সাথে আল্লাহর সাহায্য রয়েছে। নির্ভীকভাবে সিংহের ন্যায় আক্রমণ চালাও।” এ দেখে ইবলীস পগার পার হয়ে গেল। এতক্ষণ সে সুরাকার রূপ ধরে কাফিরদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। আবু জেহেল এ অবস্থা দেখে স্বীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে চক্কর দিতে শুরু করলো এবং তাদেরকে বলতে থাকলোঃ “তোমরা হতোদ্যম হয়ো না। সুরাকা পালিয়ে গেছে বলে মন খারাপ করো না। সে তো মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নিকট থেকে কুপরামর্শ শিখে এসেছিল যে, সুযোগ বুঝে তোমাদের মন ভেঙ্গে দেবে। ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। লাত ও উযযার শপথ! আজ আমরা মুসলমানদেরকে এবং তাদের নবীকে গ্রেফতার করে ফেলবো। সুতরাং ভীরুতা প্রদর্শন করো না, বরং মনোবল বৃদ্ধি কর। কঠিন আক্রমণ চালাও। সাবধান! তাদেরকে হত্যা করো না, বরং জীবিত ধরে রাখো যেন তাদেরকে মন খুলে শাস্তি দেয়া যায়। এ লোকটাও (আবূ জেহেল) ছিল সে যুগের ফিরআউন। যাদুকরগণ ঈমান এনেছিল বলে সেও তাদেরকে বলেছিলঃ “এটা তো শুধু তোমাদের একটা চক্রান্ত ছিল যে, তোমরা আমাদেরকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।” সেও যাদুকরদেরকে বলেছিলঃ “এই মূসা (আঃ) তোমাদের ওস্তাদ।” অথচ ওটা ছিল তার একটা প্রতারণা মাত্র। এই উম্মতের ফিরআউন আবূ জেহেলও এ ধরনের কথাই বলেছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে কুরায়েয (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আরাফার দিন ইবলীস যত লাঞ্ছিত, অপদস্থ ও লজ্জিত হয়েছিল, আর কোন দিন এতটা হতে দেখা যায়নি। কেননা সে দেখছিল যে, আল্লাহ তা’আলার সাধারণ ক্ষমা ও সাধারণ রহমত বর্ষিত হচ্ছে। প্রত্যেকের গুনাহ প্রায়ই মাফ হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, তবে বদরের দিনে তার লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হওয়ার কথা জিজ্ঞেস করো না, যখন সে দেখলো যে, ফেরেশতাদের সেনাবাহিনী জিবরাঈল (আঃ)-এর নেতৃত্বে আসতে শুরু করেছেন সেইদিন সে সবচেয়ে বেশী লজ্জিত ও অপমানিত হয়েছিল।”

(আরবী) এ আয়াত সম্পর্কে আলী ইবনে আবি তালহা (রাঃ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, উভয় সেনাবাহিনী যখন কাতারবন্দী হয়ে মুখোমুখী দাঁড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে মুশরিকদের চক্ষে কম দেখান। তখন মুশরিকরা মুসলমানদের সম্পর্কে বিদ্রুপ করে বলেঃ “এদের দ্বীন এদেরকে প্রতারিত করেছে। তাদের একথা বলার কারণ ছিল এই যে, তারা মুসলমানদের সংখ্যা তাদের চোখে খুবই কম দেখছিল। তাই তারা ধারণা করছিল যে, নিঃসন্দেহে তারা মুসলমানদেরকে পরাজিত করবে। তারা পরস্পর বলাবলি করছিলঃ “দেখো, মুসলমানরা কত ধর্মের পাগল। মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোক এক হাজার সৈন্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছে। প্রথম আক্রমণেই তারা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে। আল্লাহ রাব্বল আলামীন বলেন যে, এরা হচ্ছে ভরসাকারী দল। তাদের ভরসা এমন সত্তার উপর রয়েছে যিনি বিজয়ের মালিক এবং হিকমতের মালিক। মুসলিমদের মধ্যে আল্লাহর দ্বীনের উপর দৃঢ়তা অনুভব করেই মুশরিকদের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল যে, তারা দ্বীনের পাগল । আল্লাহর শত্রু অভিশপ্ত আবু জেহেল পাহাড়ের উপর থেকে অবজ্ঞাভরে মুসলিমদের সংখ্যার স্বল্পতা ও অস্ত্র-শস্ত্রের নগণ্যতা লক্ষ্য করতঃ গাধার মত ফুলে উঠলো এবং বলতে লাগলঃ “আল্লাহর কসম! আজ থেকে আল্লাহর ইবাদতকারী হতে জমিনকে শূন্য দেখা যাবে। এখনই আমরা তাদের এক একজনকে দু’ টুকরো করে রেখে দিবো।” ইবনে জুরায়েজ (রঃ) বলেন যে, মুসলিমদের ধর্মের প্রতি বিদ্রুপকারী ছিল মক্কার মুনাফেকরা। আমীর (রঃ) বলেন যে, এরা ছিল কতকগুলো লোক যারা শুধু মুখে মুসলিম হয়েছিল। কিন্তু বদরের প্রান্তরে তারা মুশরিকদের সাথে যোগ দিয়েছিল। মুসলিমদের সংখ্যার স্বল্পতা ও তাদের দুর্বলতা দেখে বিস্মিত হয়েছিল এবং বলেছিলঃ “এ লোকগুলো ধর্মের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে।” মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা ছিল কুরায়েশদের একটি দল। তারা হচ্ছে কায়েস ইবনে অলীদ ইবনে মুগীরা, আবুল কায়েস ইবনে ফাকাহ্ ইবনে মুগীরা, হারিস ইবনে যামআ, আসওয়াদ ইবনে আবদিল মুত্তালিব, আলী ইবনে উমাইয়া ইবনে খাল্ফ এবং আস ইবনে মুনাব্বাহ ইবনে হাজ্জাজ। এ লোকগুলো কুরায়েশদের সাথে ছিল। কিন্তু তারা সন্দেহের মধ্যে পতিত হয়েছিল এবং তাদের সন্দেহ তাদেরকে আবদ্ধ রেখেছিল। এখানে মুসলিমদের অবস্থা দেখে তারা বলতে শুরু করেঃ “এ লোকগুলো তো শুধু ধর্মীয় পাগল! নতুবা এই মুষ্টিমেয় রসদ ও হাতিয়ার বিহীন লোক এত শান-শওকতপূর্ণ বিরাট সেনাদলের সাথে কিভাবে যুদ্ধ করতে পারে? হাসান (রঃ) বলেন যে, এই লোকগুলো বদরের যুদ্ধে আগমন করেনি। তাদের নাম মুনাফিক রাখা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, তারা মুখে ইসলামের স্বীকারোক্তি করেছিল এবং তারা মক্কাতে ছিল। মুশরিকদের সাথে তারা বদর অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিল। যখন তারা মুসলিমদের সংখ্যা খুবই কম দেখলো তখন বলতে লাগলো, এদের ধর্ম এদেরকে প্রতারিত করেছে। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেন যে, যারা এই মালিকুল মুলকের (আল্লাহর) উপর ভরসা করে তিনি তাদেরকে মর্যাদার অধিকারী বানিয়ে দেন। কেননা সম্মান ও মর্যাদা দানের মালিক একমাত্র তিনিই। বিজয় দান তাঁরই হাতে। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত এবং মহনি বাদশাহ। তিনি মহান বিজ্ঞানময়। তার সমস্ত কাজ হিকমতে পরিপূর্ণ। প্রত্যেক জিনিসকে তিনি যথাযোগ্য স্থানে রেখে থাকেন। যারা সাহায্য পাওয়ার যোগ্য তাদেরকেই তিনি সাহায্য করে থাকেন। আর যারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার যোগ্য তাদেরকে তিনি লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
* মক্কার মুশরিকরা যখন নিজেদের বাণিজ্য কাফেলার হিফাযত ও যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হল, তখন তারা বড় ফখর, গর্ব ও অহংকারের সাথে বের হল। মুসলিমদেরকে কাফেরদের এই কুঅভ্যাস থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
* মুশরিকরা যখন মক্কা থেকে রওনা দিল তখন তাদের দুশমন গোত্র বানী বাকার বিন কিনানার পক্ষ থেকে তাদের আশঙ্কা ছিল যে, তাদেরকে পিছন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুতরাং শয়তান বানী বাকার বিন কিনানার একজন সর্দার সুরাকা বিন মালেকের রূপ ধরে এল এবং সে তাদেরকে শুধু বিজয়ের সুসংবাদই দিল না; বরং তাদের সহযোগিতা করার পূর্ণ আস্থা দিল। কিন্তু যখন মুসলিমদের পক্ষে ফিরিশতা দ্বারা আল্লাহর মদদ তার পরিদৃষ্ট হল, তখন সে সকলকে ছেড়ে পিছন ফিরে পলায়ন করল।

* আল্লাহর ভয় তার অন্তরে আর কি সৃষ্টি হবে? তবে তার দৃঢ়-বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলিমদের জন্য আল্লাহর বিশেষ সাহায্য রয়েছে; মুশরিকরা তাদের সামনে টিঁকে থাকতে পারবে না।

* হতে পারে এটা শয়তানের কথার একাংশ। আর এটাও হতে পারে যে, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পৃথকভাবে নতুন বাক্য ছিল।

* ‘যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে’ থেকে উদ্দেশ্য হল সেই নও মুসলিমগণ যাঁরা প্রথম প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং মুসলিমদের সাফল্যের ব্যাপারে তাদের সন্দেহ ছিল। অথবা এ থেকে উদ্দেশ্য মুশরিকদল। আর এটাও হতে পারে যে, এ থেকে মদীনায় বসবাসকারী ইয়াহুদীদল উদ্দেশ্য।

* অর্থাৎ, এদের সংখ্যা তো দেখ! আর যুদ্ধসামগ্রীর যা অবস্থা তাও তো প্রকাশ। অথচ এরা মুকাবিলা করতে চলেছে মক্কার মুশরিকদের সাথে; যারা এদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশী এবং তাদের আছে নানান ধরনের যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ও উপকরণ। মনে হয় যে, এদের দ্বীন এদেরকে ধোঁকায় ফেলেছে। এই মোটা কথাও ওদের মগজে ধরে না?!

* আল্লাহ তাআলা বলেন, ওই দুনিয়াদারদের কাছে সেই ঈমানদারদের ঈমান, মনোবল ও অবিচলতার কি অনুমান হতে পারে, যাদের ভরসা এক আল্লাহর উপর, যিনি মহাপরাক্রমশালী। অর্থাৎ, তাঁর প্রতি ভরসাকারীকে তিনি অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেন না। আর তিনি প্রজ্ঞাময়ও; তাঁর প্রত্যেক কর্ম প্রজ্ঞা ও হিকমতে পরিপূর্ণ; যা পূর্ণরূপে অনুভব করতে মানুষের জ্ঞান অপারগ।

তাফসীরে‌ তাফহীমুল‌ কুরআন বলেছেন:-

এখানে কুরাইশ গোত্রভুক্ত কাফেরদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের সেনাবাহিনী মক্কা থেকে বের হয়েছিল অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে। বাদ্য-গীত পারদর্শীনী ক্রীতদাসী পরিবেষ্টিত হয়ে তারা চলছিল। পথের মাঝখানে বিভিন্ন জায়গায় থেমে তারা নাচ-গান, শরাব পান ও আনন্দ উল্লাসের মাহফিল জমিয়ে তুলেছিল। পথে যেসব গোত্র ও জনবসতির ওপর দিয়ে তারা যাচ্ছিল, তাদের ওপর নিজেদের শান-শওকত, সংখ্যাধিক্য ও শক্তির দাপট এবং যুদ্ধ সরঞ্জামের ভীতি ও প্রভাব বিস্তার করে চলছিল। তারা এমনভাবে বাহাদুরী দেখাচ্ছিল, যেন তাদের সামনে দাঁড়াবার মত কেউ নেই। এমনি একটা উৎকট অহংকারের ভাব তাদের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠছিল। এ ছিল তাদের নৈতিক অবস্থা। আর যে উদ্দেশ্যে তারা ঘর থেকে বের হয়েছিল, তা ছিল তাদের এ নৈতিক অবস্থার চাইতেও আরো বেশী নোংরা ও অপবিত্র এবং তা তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল অতিরিক্ত অভিশাপের বোঝা। তারা সত্য, সততা ও ইনসাফের ঝাণ্ডা যাতে বুলন্দ করার জন্য ধন ও প্রাণ উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসেনি। বরং এ ঝাণ্ডা বুলন্দ না হয় এবং যে একটি মাত্র দল সত্যের এ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য এগিয়ে এসেছে, তাকেও যাতে খতম করা যায় সেই উদ্দেশ্যেই তারা বের হয়েছিল। তারা চাইছিল, দুনিয়ায় এ ঝাণ্ডা বহনকারী আর কেউ থাকবে না। এ ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, তোমরা এমনটি হয়ে যেয়ো না। আল্লাহ‌ তোমাদের ঈমান ও সত্যপ্রিয়তার যে নিয়ামত দান করেছেন তার দাবী অনুযায়ী তোমাদের চরিত্র যেমন পাক-পবিত্র হতে হবে, তেমনি তোমাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্যও হতে হবে মহৎ। এ নির্দেশ শুধুমাত্র সেই যুগের জন্য নির্দিষ্ট ছিল না। আজকের জন্যও এবং চিরকালের জন্য এ নির্দেশ প্রযোজ্য। সেদিন কাফেরদের সেনাবাহিনীর যে অবস্থা ছিল আজো তার মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি। বেশ্যালয়, ব্যভিচারের আড্ডা ও মদের পিপা যেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মত তাদের সাথে জড়িয়ে আছে। গোপনে নয়, প্রকাশ্যে তারা অত্যন্ত নির্লজ্জতার সাথে মেয়ে ও মদের বেশী বেশী বরাদ্দ দাবী করে। তাদের সৈন্যরা নিজেদের জাতির কাছে যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নিজেদের সমাজের বেশী সংখ্যক যুবতী মেয়েদেরকে তাদের হাতে তুলে দেবার দাবী জানাতে লজ্জাবোধ করে না। এ অবস্থায় অন্য জাতিরা এদের থেকে কি আশা করতে পারে যে, এরা নিজেদের নৈতিক আবর্জনার ফাঁকে তাদেরকে ডুবিয়ে দেবার ব্যাপারে কোন প্রকার চেষ্টার ত্রুটি করবে না? আর এদের দম্ভ ও অহংকারের ব্যাপারে বলা যায়, এদের প্রত্যেকটি সৈনিক ও অফিসারের চাল-চলন ও কথাবার্তার ধরন থেকে তা একেবারে পরিষ্কার দেখা যেতে পারে। আর এদের প্রত্যেক জাতির নেতৃস্থানীয় পরিচালকবৃন্দের বক্তৃতাবলীতে لاغالب لكم اليوم (আজ তোমাদের ওপর বিজয়ী হতে পারে দুনিয়াতে এমন কেউ নেই) এবং من اشد منا قوة (কে আমাদের চেয়ে শক্তিশালী? ) ধরনের দম্ভোক্তিই শ্রুত হয়ে থাকে। এদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, এ নৈতিক পূতিগন্ধময় আবর্জনা থেকেও বেশী কুৎসিত ও নোংরা। এদের প্রত্যেকেই অত্যন্ত প্রতারণাপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করে দুনিয়াবাসীকে একথার নিশ্চয়তা দিয়ে যায় যে, মানবতার কল্যাণ ছাড়া তার সামনে আর কোন লক্ষ্য নেই। কিন্তু আসলে শুধুমাত্র মানবতার কল্যাণটাই তাদের লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়, বাকী সবকিছুই সেখানে আছে। এদের যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ‌ তাঁর এ পৃথিবীতে সমগ্র মানবজাতির জন্য যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার জাতি একাই হবে তার ওপর দখলদার এবং অন্যদের তার চাকর ও কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকতে হবে। কাজেই এখানে ঈমানদারদেরকে কুরআন এ স্থায়ী নির্দেশ দিয়েছে যে, এ ফাসেক ও ফাজেরদের আচার-আচরণ থেকেও দূরে থাকো। আবার যেসব অপবিত্র ও পূতিগন্ধময় উদ্দেশ্য নিয়ে এরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, সেই ধরনের উদ্দেশ্যে নিজেদের ধন-প্রাণ উৎসর্গ করতে উদ্যোগী হয়োনা।

* মদীনার মুনাফীক গোষ্ঠি এবং বৈষয়িক স্বার্থ পূজায় ও আল্লাহর প্রতি গাফিলতির রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামহীন মুষ্টিমেয় লোকের একটি দলকে কুরাইশদের মত বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে দেখে নিজেদের মধ্যে এ মর্মে বলাবলি করছিল যে, এরা আসলে নিজেদের ধর্মীয় আবেগে উন্মাদ হয়ে গেছে। এ যুদ্ধে এদের ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু এই নবী (সা.) এদের কানে এমন মন্ত্র ফুঁকে দিয়েছে, যার ফলে এরা বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং সামনে মৃত্যুগূহা দেখেও তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

Leave a Reply