أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
(Book# 114/٣٨٩)-৫৯৩
www.motaher21.net
সুরা: আত্ তাওবাহ
সুরা:০৯
০১-০২ নং আয়াত:-
بَرَآءَۃٌ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖۤ
আল্লাহ ও রসূলের পক্ষ হতে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হল।
Freedom from (all) obligations (is declared) from Allah and His Messenger..
بَرَآءَۃٌ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖۤ اِلَی الَّذِیۡنَ عٰہَدۡتُّمۡ مِّنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ ؕ﴿۱﴾
فَسِیۡحُوۡا فِی الۡاَرۡضِ اَرۡبَعَۃَ اَشۡہُرٍ وَّ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّکُمۡ غَیۡرُ مُعۡجِزِی اللّٰہِ ۙ وَ اَنَّ اللّٰہَ مُخۡزِی الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۲﴾
তোমরা যে অংশীবাদীদের সাথে সন্ধি স্থাপন করেছিলে, আল্লাহ ও রসূলের পক্ষ হতে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হল।
সুতরাং (হে অংশীবাদীরা!) তোমরা দেশে চার মাসকাল (নিরাপদে) চলাফেরা কর। আর জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না এবং আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(০৯-তওবা) : নামকরণ:
এ সূরাটি দুটি নামে পরিচিতঃ আত্ তাওবাহ ও আল বারাআতু। তাওবা নামকরণের কারণ, এ সূরার এক জায়গায় কতিপয় ঈমানদারের গোনাহ মাফ করার কথা বলা হয়েছে। আর এর শুরুতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করা হয়েছে বলে একে বারাআত (অর্থাৎ সম্পর্কচ্ছেদ) নামে অভিহিত করা হয়েছে।
(০৯-তওবা) : বিসমিল্লাহ না লেখার কারণ:
এ সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম লেখা হয় না। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু মতভেদ ঘটেছে। তবে এ প্রসংগে ইমাম রাযীর বক্তব্যই সঠিক। তিনি লিখেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এর শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখাননি, কাজেই সাহাবায়ে কেরামও লেখেননি এবং পরবর্তী লোকেরাও এ রীতির অনুসরণ অব্যাহত রেখেছেন। পবিত্র কুরআন যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হুবহু ও সামান্যতম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যেভাবে তিনি দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই তাকে সংরক্ষণ করার জন্য যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, এটি তার আর একটি প্রমাণ।
(০৯-তওবা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এ সূরাটি তিনটি ভাষণের সমষ্টি। প্রথম ভাষণটি সূরার প্রথম থেকে শুরু হয়ে পঞ্চম রুকূর শেষ অবধি চলেছে। এর নাযিলের সময় হচ্ছে ৯ হিজরীর যিলকাদ মাস বা তার কাছাকাছি সময়। নবী (স) সে বছর হযরত আবু বকরকে (রা.) আমীরুল হজ্ব নিযুক্ত করে মক্কায় রওয়ানা করে দিয়েছিলেন। এমন সময় এ ভাষণটি নাযিল হয়। তিনি সংগে সংগেই হযরত আলীকে (রা.) তার পিছে পিছে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে হজ্বের সময় সারা আরবের প্রতিনিধিত্বশীল সমাবেশে তা শুনানো হয় এবং সে অনুযায়ী যে কর্মপদ্ধতি হয়েছিল তা ঘোষনা করা যায়। দ্বিতীয় ভাষণটি ৬ রুকূর শুরু থেকে ৯ রুকূর শেষ পর্যন্ত চলেছে। এটি ৯ হিজরীর রজব মাসে বা তার কিছু আগে নাযিল হয়। সে সময় নবী (সা.) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এখানে মুমিনদেরকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আর যারা মুনাফিকী বা দুর্বল ঈমান অথবা কুড়েমি ও অলসতার কারণে আল্লাহর পথে ধন-প্রাণের ক্ষতি বরদাশত করার ব্যাপারে টালবাহানা করছিল তাদেরকে কঠোর ভাষায় তিরষ্কার করা হয়েছে। তৃতীয় ভাষণটি ১০ রুকু’ থেকে শুরু হয়ে সুরার শেষ পর্যন্ত চলেছে। তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর এ অংশটি নাযিল হয়। এর মধ্যে এমনও অনেকগুলো খণ্ডিত অংশ রয়েছে যেগুলো ঐ দিনগুলোতে বিভিন্ন পরিবেশে নাযিল হয় এবং পরে নবী (সা.) আল্লাহর ইঙ্গিতে সেগুলো সব একত্র করে একই ধারাবাহিক ভাষণের সাথে সংযুক্ত করে দেন। কিন্তু যেহেতু সেগুলো একই বিষয়বস্তু ও একই ঘটনাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট তাই ভাষণের ধারাবাহিকতা কোথাও ব্যাহত হতে দেখা যায় না। এখানে মুনাফিকদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। তাবুক যুদ্ধে যারা পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন তাদেরকে ভৎর্সনা ও তিরস্কার করা হয়েছে। আর যে সাচ্চা ঈমানদার লোকেরা নিজেদের ঈমানের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান ছিলেন ঠিকই কিন্তু আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন তিরস্কার করার সাথে সাথে তাদের ক্ষমার কথাও ঘোষনা করা হয়েছে। আয়াতগুলো যে পর্যায়ক্রমিক ধারায় নাযিল হয়েছে তার প্রোক্ষিতে প্রথম ভাষণটি সবশেষে বসানো উচিত ছিল। কিন্তু বিষয়বস্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে সেটিই ছিল সবার আগে। এ জন্য কিতাব আকারে সাজাবার ক্ষেত্রে নবী (সা.) তাকে প্রথমে রাখেন এবং অন্য ভাষণ দুটিকে তার পরে রাখেন।
(০৯-তওবা) : ঐতিহাসিক পটভূমি:
নাযিলের সময়-কাল নির্ধারিত হবার পর এ সূরার ঐতিহাসিক পটভূমির ওপর একটু দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এ সুরার বিষয়বস্তুর সাথে যে ঘটনা পরম্পরার সম্পর্ক রয়েছে, তার সূত্রপাত ঘটেছে হোদাইবিয়ার সন্ধি থেকে। হোদাবিয়া পর্যন্ত ছ বছরের অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফলে আরবের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ এলাকায় ইসলাম একটি সুসংঘটিত ও সংঘবদ্ধ সমাজের ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। হোদায়বিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর এ ধর্ম বা দ্বীন আরো বেশী নিরাপদ ও নির্ঝঞ্চাট পরিবেশে চারদিকে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পেয়ে যায়। ১ এরপর ঘটনার গতিধারা দু’টি বড় বড় খাতে প্রবাহিত হয়। আরো সামনে অগ্রসর হয়ে ঐ দু’টি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে একটির সম্পর্ক ছিল আরবের সাথে এবং অন্যটির রোম সাম্রাজ্যের সাথে।
১.বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সূরা মায়েদা ও সূরা ফাতাহ এর ভূমিকা। আরব বিজয় হোদায়বিয়ার সন্ধির পর আরবে ইসলামের প্রচার, প্রসারের জন্য এবং ইসলামী শক্তি সুসংহত করার জন্য যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তার ফলে মাত্র দুবছরের মধ্যেই ইসলামের প্রভাব বলয় এত বেড়ে যায় এবং তার শক্তি এতটা পরাক্রান্ত ও প্রতাপশালী হয়ে ওঠে যে, পুরাতন জাহেলিয়াত তার মোকাবিলায় অসহায় ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। অবশেষে কুরাইশদের অতি উৎসাহী লোকেরা নিজেদের পরাজয় আসন্ন দেখে আর সংযত থাকতে পারেনি। তারা হোদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে। এ সন্ধির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু এ চুক্তি ভংগের পর নবী (সা.) তাদেরকে আর গুছিয়ে নেবার কোন সুযোগ দেননি। তিনি ৮ হিজরীর রমযান মাসে আকম্মিকভাবে মক্কা আক্রমণ করে তা দখল করে নেন। ১ এরপর প্রাচীন জাহেলী শক্তি, হোনায়েনের ময়দানে তাদের শেষ মরণকামড় দিতে চেষ্টা করে। সেখানে হাওয়াযিন, সাকীফ, নদর, জুসাম, এবং অন্যান্য কতিপয় জাহেলিয়াতপন্থী গোত্র তাদের পূর্ণ শক্তির সমাবেশ ঘটায়। এভাবে তারা মক্কা বিজয়ের পর যে সংস্কারমূলক বিপ্লবটি পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল তার পথ রোধ করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা ও ব্যর্থ হয়। হোনায়েন যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের সাথে সাথেই আরবের ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা হয়ে যায়। আর এ ফায়সালা হচ্ছে, আরবকে এখন দারুল ইসলাম হিসেবেই টিকে থাকতে হবে। এ ঘটনার পর পুরো এক বছর যেতে না যেতেই আরবের বেশীর ভাগ এলাকার লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে। এ অবস্থায় জাহেলী ব্যবস্থার শুধুমাত্র কতিপয় বিচ্ছিন্ন লোক দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। উত্তরে রোম সাম্রাজ্যের সীমান্তে সে সময় যেসব ঘটনা ঘটে চলছিল তা ইসলামের এ সম্প্রসারণ ও বিজয়কে পূর্ণতায় পৌঁছুতে আরো বেশী করে সাহায্য করে। সেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দুঃসাহসিকতার সাথে ৩০ হাজারের বিরাট বাহিনী নিয়ে যান এবং রোমীয়রা যেভাবে তাঁর মুখোমুখি হবার ঝুঁকি না নিয়ে পিঠটান দিয়ে নিজেদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটায় তাতে সারা আরবে তাঁর ও তাঁর দ্বীনের অপ্রতিরোধ্য প্রতাপ ও অজেয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে তাবুক থেকে ফিরে আসার সাথে সাথেই তার কাছে একের পর এক প্রতিনিধি দল আসতে থাকে আরবের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং তাঁর বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকার করে।
২ এ অবস্থাটিকেই কুরআনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃإِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا “যখন আল্লাহর সাহায্য এসে গেলো ও বিজয় লাভ হলো এবং তুমি দেখলে লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে।”
১. সূরা আনফালের ৪৩ টীকা দেখুন।
২. মুহাদ্দিসগণ এ প্রসংগে যেসব গোত্র, সরদার, আমীর ও বাদশাহদের প্রতিনিধি দলের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের সংখ্যা ৭০ পর্যন্ত পৌঁছে। এরা আরবের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম সব এলাকা থেকেই এসেছিল।
তাবুক অভিযান : মক্কা বিজয়ের আগেই রোম সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হোদাইবিয়ার সন্ধির পর নবী (সা.) ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে আরবের বিভিন্ন অংশে যেসব প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি দল গিয়েছিল উত্তর দিকে সিরিয়া সীমান্তের লাগোয়া গোত্রগুলোর মধ্য। তাদের বেশীর ভাগ ছিল খৃষ্টান এবং রোম সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন। তারা “যাতুত তালাহ” (অথবা যাতু-আতলাহ) নামক স্থানে ১৫ জন মুসলমানকে হত্যা করে। কেবলমাত্র প্রতিনিধি দলের নেতা হযরত কাব ইবনে উমাইর গিফারী প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। একই সময়ে নবী (সা.) বুসরার গবর্ণর শুরাহবিল ইবনে আমরের নামেও দাওয়াত নামা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেও তাঁর দূত হারেস ইবনে উমাইরকে হত্যা করে। এ সরদারও ছিল খৃষ্টান। এবং সরাসরি রোমের কাইসারের হুকুমের আনুগত। এসব কারণে নবী (সা.) ৮ হিজরীর জমাদিউল উলা মাসে তিন হাজার মুজাহিদদের একটি সেনাবাহিনী সিরিয়া সীমান্তের দিকে পাঠান। ভবিষ্যতে এ এলাকাটি যাতে মুসলমানদের জন্য নিরাপদ হয়ে যায় এবং এখানকার লোকেরা মুসলমানদেরকে দুর্বল মনে করে তাদের ওপর জুলুম ও বাড়াবাড়ি করার সাহস না করে, এই ছিল তার উদ্দেশ্য। এ সেনাদলটি মা’আন নামক স্থানের কাছে পৌছার পর জানা যায় শুরাহবীল ইবনে আমর এক লাখ সেনার একটি বাহিনী নিয়ে মুসলমানদের মোকাবিলায় আসছে। ওদিকে রোমের কাইসার হিমস নামক স্থানে সশরীরে উপস্থিত। তিনি নিজের ভাই থিয়েডরের নেতৃত্বে আরো এক লাখের একটি সেনাবাহিনী রওয়ানা করে দেন। কিন্তু এসব আতংকজনক খবরাখবর পাওয়ার পরও তিন হাজারের এ প্রাণোৎসর্গী ছোট্ট মুজাহিদ বাহিনীটি অগ্রসর হতেই থাকে। অবশেষে তারা মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখের বিরাট বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ অসম সাহসিকতা দেখানোর ফলে মুসলিম মুজাহিদদের পিষ্ট হয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সারা আরব দেশ এবং সমগ্র মধ্য প্রাচ্য বিষ্ময়ে স্বম্ভিত হয়ে দেখলো যে, এক ও তেত্রিশের এ মোকাবিলায়ও কাফেররা মুসলমানদের ওপর বিজয়ী হতে পারলো না। এ জিনিসটিই সিরিয়া ও তার সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী আধা স্বাধীন আরব গোত্রগুলোকে এমনকি ইরাকের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসকারী পারস্য সম্রাটের প্রভাবাধিন নজদী গোত্রগুলোকেও ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করে। তাদের হাজার হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করে। বনী সুলাইম (আব্বাস ইবনে মিরদাস সুলামী ছিলেন তাদের সরদার) আশজা, গাতফান, যুবইয়ান ও ফাযারাহ গোত্রের লোকেরা এ সময়ই ইসলাম গ্রহণ করে। এ সময়ই রোম সাম্রাজ্যের আরবীয় সৈন্য দলের একজন সেনাপতি ফারওয়া ইবনে আমর আলজুযামী মুসলমান হন। তিনি নিজের ঈমানের এমন অকাট্য প্রমাণ পেশ করেন, যা দেখে আশেপাশের সব এলাকার লোকেরা বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে পড়ে। ফারওয়ার ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে কাইসার তাকে গ্রেফতার করিয়ে নিজের দরবারে আনেন। তাঁকে দু’টি জিনিসের মধ্যে যে কোন একটি নির্বাচন করার ইখতিয়ার দেন। তাকে বলেন ইসলাম ত্যাগ করো। তাহলে তোমাকে শুধু মুক্তিই দেয়া হবে না বরং আগের পদমর্যাদাও বহাল করে দেয়া হবে। অথবা মুসলমান থোকো। কিন্তু এর ফলে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তিনি ধীর স্থিরভাবে চিন্তা করে ইসালামকে নির্বাচিত করেন এবং সত্যের পথে প্রাণ বিসর্জন দেন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কাইসার তার সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে উদ্ভূত এক ভয়াবহ হুমকির স্বরূপ উপলব্ধি করেন, যা আরবের মাটিতে সৃষ্ট হয়ে তার সাম্রাজ্যের দিকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছিল।
পরের বছর কাইসার মুসলমানদের মুতা যুদ্ধের শাস্তি দেবার জন্য সিরিয়া সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে দেন। তার অধীনে গাসসানী ও অন্যন্য আরব সরদাররা সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। নবী (সা.) এ ব্যাপারে বেখবর ছিলেন না। একেবারেই নগণ্য ও তুচ্ছ যেসব ব্যাপার ইসলামী আন্দোলনের ওপর সামন্যমতও অনুকূল বা প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তার প্রত্যেকেটি সম্পর্কে তিনি সর্বক্ষণ সচেতন ও সতর্ক থাকতেন। এ প্রস্তুতিগুলোর অর্থ তিনি সংগে সংগেই বুঝে ফেলেন। কোন প্রকার ইতস্তত না করেই কাইসারের বিশাল বিপুল শক্তির সাথে তিনি সংঘর্ষে লিপ্ত হবার ফায়সালা করে ফেলেন। এ সময় সামান্যতম ও দুর্বলতা দেখানো হলে এতদিনকার সমস্ত মেহনত ও কাজ বরবাদ হয়ে যেতো। একদিকে হোনায়েনে আরবের যে ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষ জাহেলিয়াতের বুকে সর্বশেষ আঘাত হানা হয়েছিল তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো এবং অন্যদিকে মদীনার যে মুনাফিকরা আবু আমের রাহেবের মধ্যস্থতায় গাসসানের খ্রীস্টান বাদশাহ এবং স্বয়ং কাইসারের সাথে গোপন যোগসাজশে লিপ্ত হয়েছিল। উপরন্তু যারা নিজেদের দুস্কর্মের ওপর দ্বীনদারীর প্রলেপ লাগাবার জন্য মদীনার সংলগ্ন এলাকায় “মসজিদে দ্বিরার” (ইসলামী মিল্লাতকে ক্ষতিগ্রস্থ করার উদ্দেশ্যে তৈরী মসজিদ) নির্মাণ করেছিল, তারা পিঠে ছুরি বসিয়ে দিতো। সামনের দিক থেকে কাইসার আক্রমণ করতে আসছিল। ইরানীদের পরাজিত করার পর দূরের ও কাছের সব এলাকায় তার দোর্দণ্ড প্রতাপ ও দাপট ছড়িয়ে পড়েছিল। এ তিনটি ভয়ংকর বিপদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইসলামের অর্জিত বিজয় অকস্মাত পরাজয়ে রূপান্তিত হয়ে যেতে পারতো। তাই, যদিও দেশে দুর্ভিক্ষ চলছিল, আবহাওয়া ছিল প্রচণ্ড গরম, ফসল পাকার সময় কাছে এসে গিয়েছিল, সওয়ারী ও সাজ, সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল। অর্থের অভাব ছিল প্রকট এবং দুনিয়ার দুটি বৃহত্তম শক্তির একটির মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তবুও আল্লাহর নবী এটাকে সত্যের দাওয়াতের জন্য জীবন-মৃত্যুর ফায়সালা করার সময় মনে করে এ অবস্থায়ই যুদ্ধ প্রস্তুতির সাধারণ ঘোষণা জারি করে দেন। এর আগের সমস্ত যুদ্ধে নবী (সা.) এর নিয়ম ছিল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কাউকে বলতেন না কোনদিকে যাবেন এবং কার সাথে মোকাবিলা করতে হবে। বরং তিনি মদীনা থেকে বের হবার পরও অভীষ্ট মনযিলের দিকে যাবার সোজা পথ না ধরে তিনি অন্য বাঁকা পথ ধরতেন। কিন্তু এবার তিনি এ আবরণটুকু ও রাখলেন না। এবার পরিষ্কার বলে দিলেন যে, রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে এবং সিরিয়ার দিকে যেতে হবে।
এ সময়টি যে অত্যন্ত নাজুক ছিল তা আরবের সবাই অনুভব করছিল। প্রাচীন জাহেলিয়াতের প্রেমিকদের মধ্যে যারা তখনো বেঁচে ছিল তাদের জন্য এটি ছিল শেষ আশার আলো। রোম ও ইসলামের এ সংঘাতের ফলাফল কি দাঁড়ায় সে দিকেই তারা অধীর আগ্রহে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিল। কারণ তারা নিজেরাও জানতো, এরপর আর কোথাও কোন দিক থেকেই আশার সামান্যতম ঝলকও দেখা দেবার কোন সম্ভবনা নেই। মুনাফিকেরাও এরই পেছনে তাদের শেষ প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেছিল। তারা নিজেদের মসজিদে দ্বিরার বানিয়ে নিয়েছিল। এরপর অপেক্ষা করছিল সিরিয়ার যুদ্ধে ইসলামের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটা মাত্রই তারা দেশের ভেতরে গোমরাহী ও অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এখানেই শেষ নয়, বরং তারা তাবুকের এ অভিযানকে ব্যর্থ করার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের কৌশলও অবলম্বন করে। এদিকে নিষ্ঠাবান মুসলমানরাও পুরোপুরি অনুভব করতে পেরেছিলেন, যে আন্দোলনের জন্য বিগত ২২বছর ধরে তারা প্রাণপাত করে এসেছেন বর্তমানে তার ভাগ্যের চূড়ান্ত ফায়সালা হবার সময় এসে পড়েছে। এ সময় সাহস দেখাবার অর্থ দাঁড়ায়, সারা দুনিয়ার ওপর এ আন্দোলনের দরজা খুলে যাবে অন্যদিকে এ সময় দুবর্লতা দেখাবার অর্থ দাড়ায় খোদ আরব দেশেও একে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হবে। কাজেই এ অনুভূতি সহকারে সত্যের নিবেদিত প্রাণ সিপাহীরা চরম উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম যোগাড় করার ব্যাপারে প্রত্যেকেই নিজের সামর্থ্যের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে অংশগ্রহণ করেন। হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বিপুল অর্থ দান করেন। হযরত উমর (রা.) তার সারা জীবনের উপার্জনের অর্ধেক এনে রেখে দেন। হযরত আবু বকর (রা.) তার সঞ্চিত সম্পদের সবটাই নবী (সা.) এর সামনে পেশ করেন। গরীব সাহাবীরা মেহনত মজদুরী করে যা কামাই করতে পেরেছিলেন তার সবটুকু উৎসর্গ করেন। মেয়েরা নিজেদের গহনা খুলে নযরানা পেশ করেন। চারদিক থেকে দলে দলে আসতে থাকে প্রাণ উৎসর্গকারী স্বেচ্ছাসেবকদের বাহিনী। তারা আবেদন জানান, বাহন ও অস্ত্র শস্ত্রের ব্যবস্থা হয়ে গেলে আমরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যারা সওয়ারী পেতেন না তারা কাঁদতে থাকতেন। তারা এমনভাবে নিজেদের আন্তরিকতা মানসিক অস্থিরতা প্রকাশ করতে থাকতেন যার ফলে রাসূলে পাকের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতো, এ ঘটনাটি কার্যত মুমিন ও মুনাফিক চিহ্নিতকরার একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি এ সময় কোন ব্যক্তি পেছনে থেকে যাওয়ার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, ইসলামের তার সম্পর্কের দাবি সত্য কিনা সেটাই সন্দেহজনক হয়ে পড়তো। কাজেই তাবুকের পথে যাওয়ার সময় সফরের মধ্যে যেসব ব্যক্তি পেছনে থেকে যেতো সহাবায়ে কেরাম নবী (সা.) এর নিকট তাদের খবর পৌছিয়ে দিতেন। এর জবাবে তিনি সংগে সংগেই স্বতস্ফূর্তভাবে বলে ফেলতেনঃ دعوه فان يك فيه خير فسيلحقه الله لكم , وان يك غير ذلك فقد اراحكم الله منه- “যেতে দাও, যদি তার মধ্যে ভালো কিছু থেকে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাকে আবার তোমাদের সাথে মিলিয়ে দেবেন। আর যদি অন্য কোন ব্যাপার হয়ে থাকে, তাহলে শোকর করো যে, আল্লাহ তার ভণ্ডামীপূর্ণ সাহচর্য থেকে তোমাদের বাঁচিয়েছেন”।
৯ হিজরীর রজব মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৩০ হাজারের মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সিরিয়ার পথে রওয়ানা হন। তাঁর সাথে ছিল দশ হাজার সওয়ার। উটের সংখ্যা এত কম ছিল যে, এক একটি উটের পিঠে কয়েক জন পালাক্রমে সওয়ার হতেন। এর ওপর ছিল আবার গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা। পানির স্বল্পতা সৃষ্টি করেছিল আরো এক বাড়তি সমস্যা। কিন্তু এ নাজুক সময়ে মুসলমানরা যে সাচ্চা ও দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় দেন তার ফল তারা তাবুকে পৌঁছে পেয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তারা জানতে পারেন, কাইসার ও তার অধিনস্থ সম্মুখ যুদ্ধ অবতীর্ণ হবার পরিবর্তে নিজেদের সেনা বাহিনী সীমান্ত থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এখন এ সীমান্তে আর কোন দুশমন নেই। কাজেই এখানে যুদ্ধেরও প্রয়োজন নেই। সীরাত রচয়িতারা এ ঘটনাটিকে সাধারণত এমনভাবে লিখে গেছেন যাতে মনে হবে যেন সিরিয়া সীমান্তে রোমীয় সৈন্যদের সমাবেশ সম্পর্কে যে খবর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছে তা আদতে ভুলই ছিল। অথচ আসল ঘটনা এই যে, কাইসার সৈন্য সমাবেশ ঠিকই শুরু করেছিল। কিন্তু তার প্রস্তুতি শেষ হবার আগেই যখন রসূলুল্লাহ (সা.) মোকাবিলা করার জন্য পৌঁছে যান তখন সে সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন পথ দেখেনি। মুতার যুদ্ধে এক লাখের সাথে ৩ হাজারের মোকাবিলার যে দৃশ্য সে দেখেছিল তারপর খোদ নবী করীমের (সা.) নেতৃত্বে ৩০ হাজারের যে বাহিনী এগিয়ে আসছিল সেখানে লাখ দুলাখ সৈন্য মাঠে নামিয়ে তার সাথে মোকাবিলা করার হিম্মাত তার ছিল না।
কাইসারের এভাবে পিছু হটে যাওয়ার ফলে যে নৈতিক বিজয় লাভ হলো, এ পর্যায়ে নবী (সা.) তাকে যথেষ্ট মনে করেন। তিনি তাবুক থেকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে সিরিয়া সীমান্তে প্রবেশ করার পরিবর্তে এ বিজয় থেকে যত দুর সম্ভব রাজনৈতিক ও সামরিক ফায়দা হাসিল করাকেই অগ্রাধিকার দেন্ সে জন্যেই তিনি তাবুকে ২০ দিন অব্স্থান করে রোম সাম্রাজ্য ও দারুল ইসলামের মধ্যবর্তী এলাকায় যে বহু সংখ্যক ছোট ছোট রাজ্য এতদিন রোমানদের প্রভাবাধীনে ছিল। সামরিক চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে ইসলামী সাম্রাজ্যের অনুগত করদ রাজ্যে পরিণত করেন। এভাবে দুমাতুল জানদালের খৃষ্টান শাসক উকাইদির ইবনে আবদুল মালিক কিনদী, আইলার খৃষ্টান শাসক ইউহান্না ইবনে রুবাহ এবং অনুরূপ মাকনা, জারবা, ও আযরূহের খৃষ্টান শাসকরাও জিযিয়া দিয়ে মদীনার বশ্যতা স্বীকার করে। এর ফলে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা সরাসরি রোম সাম্রাজ্যের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। রোম সম্রাটরা যেসব আরব গোত্রকে এ পর্যন্ত আরবদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছিল এখন বেশীর ভাগই রোমানদের মোকাবিলায় মুসলমানদের সহযোগী হয়ে গেল। এভাবে রোম সাম্রাজ্যের সাথে একটি দীর্ঘ মেয়াদী সংঘর্ষে লিপ্ত হবার আগে ইসলাম সমগ্র আরবের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রন ও বাঁধন মজবুত করে নেবার পূর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। এটাই হয় এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় লাভ। এতদিন পর্যন্ত যারা প্রকাশ্যে মুশরিকদের দলভুক্ত থেকে অথবা মুসলমানদের দলে যোগদান করে পরদার অন্তরালে মুনাফিক হিসেবে অবস্থান করে প্রাচীন জাহেলিয়াতের পুনর্বহালের আশায় দিন গুণছিল তাবুকের এ বিনা যুদ্ধে বিজয় লাভের ঘটনা তাদের কোমর ভেংগে দেয়। এ সর্বশেষ ও চূড়ান্ত হতাশার ফলে তাদের অধিকাংশের জন্য ইসলামের কোলে আশ্রয় নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আর যদি বা তাদের নিজেদের ইসলামের নিয়ামতলাভের সুযোগ নাও থেকে থাকে, তবে কমপক্ষে তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য সম্পর্ণরূপে ইসলামের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। এরপর একটি নামমাত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তাদের শির্ক ও জাহেলী কার্যক্রমে অবিচল থাকে। কিন্তু তারা এত বেশী হীনবল হয়ে পড়ে যে, ইসলামের যে সংস্কারমূলক বিপ্লবের জন্য আল্লাহ তাঁর নবীকে পাঠিয়েছিলেন তার পূর্ণতা সাধনের পথে তারা সামান্যতমও বাধা সৃষ্টি করতে সমর্থ ছিল না।
(০৯-তওবা) :আলোচ্য বিষয় ও সমস্যাবলী:
এ পটভূমি সামনে রেখে আমরা সে সময় যেসব বড় বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং সূরা তাওবায় যেগুলো আলোচিত হয়েছে, সেগুলো সহজেই চিহ্নিত করতে পারি। সেগুলো হচ্ছে।
। ১। এখন যেহেতূ সমগ্র আরবের শাসন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে মুমিনেদের হাতে এসে গিয়েছিল এবং সমস্ত প্রতিবন্ধক শক্তি নির্জীব ও নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, তাই আরবদেশকে পূর্নাঙ্গ দারুল ইসলামে পরিণত করার জন্য যে নীতি অবলম্বন করা অপরিহার্য ছিল তা সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করতে আর বিলম্ব করা চলে না।তাই নিম্নোক্ত আকারে তা পেশ করা হয়ঃ
। (ক) আরব থেকে শির্ককে চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে হবে। প্রাচীন মুশরিকী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি খতম করে ফেলতে হবে। ইসলামের কেন্দ্র যেন চিরকালের জন্য নির্ভেজাল ইসলামী কেন্দ্রে পরিণত হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্য কোন অনৈসলামী উপাদান যেন সেখানকার ইসলামী মেজায ও প্রকৃতিতে অনুপ্রবেশ করতে এবং কোন বিপদের সময় আভ্যন্তরীন ফিতনার কারণ হতে না পারে। এ উদ্দেশ্যে মুশরিকদের সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিসমূহ বাতিল করার কথা ঘোষণা করা হয়।
। (খ, কাবা ঘরের ব্যবস্থাপনা মুমিনদের হাতে এসে যাবার পর, একান্তভাবে আল্লাহর বন্দেগী করার জন্য উৎসর্গীত সেই ঘরটিতে আবারো আগের মত মূর্তিপূজা হতে থাকবে এবং তার পরিচালনা ও পৃষ্ঠপোষতার দায়িত্ব এখনো মুশরিকদের হাতে বহাল থাকবে এটা কোনক্রমেই সংগত হতে পারে না। তাই হুকুম দেয়া হয়ঃ আগামীতে কাবা ঘরের পরিচালনা ও অভিভাবকত্বের দায়িত্বেও তাওহীদদের হাতেই ন্যস্ত থাকা চাই।আর এ সংগে বায়তুল্লাহর চতুসীমানর মধ্যে শির্ক ও জাহেলিয়াতের যাবতীয় রসম-রেওয়াজ বল প্রয়োগে বন্ধ করে দিতে হবে। বরং এখন থেকে মুশরিকরা আর এ ঘরের ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে পারবে না। তাওহীদদের মহান অগ্রনী পুরুষ ইবরাহীমের হাতে গড়া এ গৃহটি আর শির্ক দ্বারা কলুষিত হতে না পারে তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
। (গ, আরবের সাংস্কৃতিক জীবনে জাহেলী রসম-রেওয়াজের যেসব চিহ্ন এখনো অক্ষুন্ন ছিল নতুন ইসলামী যুগে সেগুলোর প্রচলন থাকা কোনক্রমেই সমিচীন ছিল না। তাই সেগুলো নিশ্চিহ্ন করার প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করা হয়েছে। নাসী (ইচ্ছাকৃতভাবে হারাম মাসকে হালাল ও হালাল মাসকে হারাম নির্দিষ্ট করে নেয়া, র নিয়মটা ছিল সবচেয়ে খারাপ প্রথা। তাই তার ওপরে সরাসরি আঘাত হানা হয়েছে। এ আঘাতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের অন্যান্য নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে মুসলমানদের করনীয় কী। তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
। ২।আরবের ইসলাম প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম পূর্ণতায় পৌঁছে যাবার পর সামনে যে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়টি ছিল সেটি হলো, আরবের বাইরে আল্লাহর সত্য দ্বীনের প্রভাব-বলয় বিস্তৃত করা। এ পথে রোম ও ইরানের রাজনৈতিক শক্তি ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। আরবের কার্যক্রম শেষ হবার পরই তার সাথে সংঘর্ষ বাধা ছিল অনিবার্য। তাছাড়া পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য অমুসলিম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাগুলোর সাথেও এমনি ধরনের সংঘাত ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হওয়া ছিল স্বাভাবিক। তাই মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়, আরবের বাইরে যারা সত্য দ্বীনের অনুসারী নয়, তারা ইসলামী কর্তৃত্বের প্রতি বশ্যত ও আনুগত্যের স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত শক্তি প্রয়োগ করে তাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম শাসন কর্তৃত্ব খতম করে দাও। অবশ্য আল্লাহর সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপরটি তাদের ইচ্ছাধীন। তারা চাইলে ইমান আনতে পারে, চাইলে নাও আনতে পারে। কিন্তু আল্লাহর যমীনে নিজেদের হুকুম জারি করার এবং মানব সমাজের কর্তৃত্ব ও পরিচালনা ব্যবস্থা নিজেদের হাতে রেখে মানুষের ওপর এবং তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের ওপর নিজেদের গোমরাহীসমূহ জোরপূর্বক চাপিলে দেবার কোন অধিকার তাদের নেই। বড় জোর তাদের কে একটুকু স্বাধীনতা দেয়া যেতে পারে যে, তারা নিজেরা চাইলে পথভ্রষ্ট হয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু সে জন্য শর্ত হচ্ছে, তাদের জিযিয়া আদায় করে ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের অধীন থাকতে হবে।
। ৩।মুনাফিক সংক্রন্ত বিষয়টি ছিল তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয়। সাময়িক বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে তাদের ব্যাপারে এ পর্যন্ত উপেক্ষাও এড়িয়ে যাবার নীতি অবলম্বন করা হচ্ছিল। এখন যেহেতু বাইরের বিপদের চাপ কম গিয়েছিল বরং একেবারে ছিলই না বললে চলে, তাই হুকুম দেয়া হয়, আগামীতে তাদের সাথে আর নরম ব্যবহার করা যাবে না। প্রকাশ্য সত্য অস্বীকারকারীদের সাথে যেমন কঠোর ব্যাবহার করা হয় তেমনি কঠোর ব্যবহার গোপন সত্য অস্বীকারকারীদের সাথেও করা হবে। এ নীতি অনুযায়ী নবী (সা.) তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি পূর্বে সুওয়াইলিমের গৃহে আগুন লাগান্ সেখানে মুনাফিকদের একটি দল মুসলমানদেরকে যুদ্ধে যোগদান করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে প্রচারাভিযান চালাবার জন্য জামায়েত হতো। আবার এ নীতি অনুযায়ী নবী (সা.) তাবুক থেকে ফিরে আসার পর সর্বপ্রথম মসজিদে দ্বিরার ভেংগে ফেলার ও জ্বালীয়ে দেবার হুকুম দেন।
। ৪।নিষ্ঠাবান মুমিনদের কতকের মধ্যে এখনো পর্যন্ত যে সামান্য কিছু সংকল্পের দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল তার চিকিৎসারও প্রয়োজন ছিল। কারণ ইসলাম এখন আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চলেছে। যে ক্ষেত্রে মুসলিম আরবেকে একাকী সারা অমুসলিম দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে সে ক্ষেত্রে ইসলামী সংগঠনের জন্য ঈমানের দুর্বলতার চাইতে বড় কোন আভ্যন্তরীণ বিপদ থাকতে পারে না। তাই তাবুক যুদ্ধের সময় যারা অলসতা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছিল অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাদের তিরস্কার ও নিন্দা করা হয়। যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদের ন্যায়সংগত ওযর ছাড়াই পিছনে থেকে যাওয়াটাকে একটা মুনাফেকসূলভ আচরণ এবং সাচ্চা ঈমানদার না হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ভবিষ্যতের জন্য দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দেয়াহয়, আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার সংগ্রাম এবং কুফর ও ইসলামের সংঘাতই হচ্ছে মুমিনদের ঈমানদের দাবি যাচাই আসল মানদণ্ড। এ সংঘর্ষে যে ব্যক্তি ইসলামের জন্য ধন-প্রাণ সময় ও শ্রম ব্যয় করতে ইতস্তত করবে তার ঈমান নির্ভরযোগ্য হবে না। অন্য কোন ধর্মীয় কাজের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রের কোন অভাব পূরণ করা যাবে না।
। এসব বিষয়ের প্রতি নজর রেখে সূরা তওবা অধ্যয়ন করলে এর যাবতীয় বিষয় সহজে অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
* এ সূরার ভূমিকায় আমি বলে এসেছি, ৫ রুকূ’র শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত এ ভাষণটি ৯ হিজরীতে এমন এক সময় নাযিল হয় যখন নবী (সা.) হযরত আবু বকরকে (রা.) হজ্জের জন্য রওয়ানা করে দিয়েছিলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর এটি নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম নবী (সা.) এর কাছে আবেদন করেনঃ এটি হযরত আবু বকর (রা.) এর কাছে পাঠিয়ে দিন, তিনি হজ্জের সময় লোকদের এটি শুনিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি বলেন, এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির ঘোষণা আমার পক্ষ থেকে আমারই ঘরের একজনের করা উচিত। কাজেই তিনি হযরত আলীকে (রা.) এ কাজে নিযুক্ত করেন। এ সঙ্গে তাঁকে নির্দেশ দেন, হাজীদের সাধারণ সামাবেশে আল্লাহর এ বাণী শুনিয়ে দেবার পর নিম্নলিখিত চারটি কথাও যেন ঘোষণা করে দেন। এক, দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এমন কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। দুই, এ বছরের পরে আর কোন মুশরিক হজ্জ করতে আসতে পারবে না। তিন, বাইতুল্লাহর চারদিকে উলঙ্গ অবস্থায় তাওয়াফ করা নিষিদ্ধ। চার, যাদের আল্লাহর রসূলের চুক্তি অক্ষুন্ন আছে অর্থাৎ যারা চুক্তি ভঙ্গ করেনি, চুক্তির সময়সীমা পর্যন্ত তা পূর্ণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানা থাকা দরকার, মক্কা বিজয়ের পর ইসলামী যুগে প্রথম হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় ৮ হিজরীতে প্রাচীন পদ্ধতিতে। ৯ হিজরীতে মুসলমানরা এ দ্বিতীয় হজ্জটি সম্পন্ন করে নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং অন্যদিকে মুশরিকরা করে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে। এরপর ১০ হিজরীতে তৃতীয় হজ্জ অনুষ্ঠিত হয় খালেস ইসলামী পদ্ধতিতে। এটিই বিখ্যাত বিদায় হজ্জ। নবী ﷺ প্রথম দুবছর হজ্জ করতে যাননি। তৃতীয় বছর শিরকের পুরোপুরি অবসান ঘটার পর তিনি হজ্জ আদায় করেন।
* সূরা আনফালের ৫৮ আয়াতে একথা আলোচনা করা হয়েছে যে, কোন জাতির পক্ষ থেকে যখন তোমাদের খেয়ানত করার তথা অঙ্গীকার ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করারআশঙ্কা দেখা দেয় তখন প্রকাশ্যে তার চুক্তি মুখের ওপর ছুঁড়ে দাও এবং তাকে এ মর্মে সতর্ক করে দাও যে, এখন তোমাদের সাথে আমাদের আর কোন চুক্তি নেই। এরূপ ঘোষণা ও বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে কোন চুক্তিবদ্ধ জাতির বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম শুরু করে দেয়া মূলত বিশ্বাসঘাতক তারই নামান্তর। এ নৈতিক বিধি অনুযায়ী চুক্তি বাতিল করার এ সাধারণ ঘোষণা এমনসব গোত্রের বিরুদ্ধে করা হয়েছে যারা অঙ্গীকার করা ও চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সমসময় ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাতে এবং সুযোগ পেলেই সকল অঙ্গীকার ও চুক্তি শিকেয় তুলে রেখে শত্রুতায় লিপ্ত হতো। সে সময় যেসব গোত্র শিরকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের মধ্য থেকে কিনানাহ ও বনী দ্বামরাহ এবং হয়তো আরো এক আধাটি গোত্র ছাড়া বাদবাকি সকল গোত্রের অবস্থা এ রকমই ছিল।
এ দায়িত্ব মুক্তি ও স্পর্কচ্ছেদ সংক্রান্ত ঘোষণার ফলে আরবে শিরক ও মুশরিকদের অস্তিত্বই যেন কার্যত আইন বিরোধী (Out Law) হয়ে গেলো। এখন আর তাদের জন্য সারাদেশে কোন আশ্রয়স্থল রইল না। কারণ দেশের বেশীরভাগ এলাকা ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের আওতাধীন হয়ে গিয়েছিল। এরা নিজেদের জায়গায় বসে অপেক্ষা করছিল, রোম ও পারস্যের পক্ষ থেকেই ইসলামী সালতানাত কখন বিপদের সম্মুখীন হবে অথবা নবী (সা.) কখন ইন্তেকাল করবেন। তখনই এরা অকস্মাৎ চুক্তি ভঙ্গ করে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেবে। কিন্তু আল্লাহ তার ও তার রসূল ﷺ তাদের প্রতীক্ষিত সময় আসার আগেই তাদের পরিকল্পনার ছক উল্টে দিলেন এবং তাদের থেকে দায়িত্ব মুক্তির কথা ঘোষণা করে তাদেরকে তিনটি পথের একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করলেন। এক, তাদের যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হতে হবে এবং ইসলামী শক্তির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। দুই, তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। তিন, তাদের ইসলাম গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের বৃহত্তর অংশ আগেই যে শাসন ব্যবস্থার আওতাধীন চলে এসেছে তারই আয়ত্বে নিজেদেরকে ও নিজেদের এলাকাকে সোপর্দ করে দিতে হবে। এ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রকৃত ও যথার্থ যৌক্তিকতা অনুধাবন করার জন্য আমাদেরকে পরবর্তীকালে উদ্ভূত ইসলাম বর্জন আন্দোলনের দিকে ফেরাতে হবে। আলোচ্য ঘটনার দেড় বছর পরে নবী (সা.) ইন্তেকালের পরই দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ অশুভ তৎপরতা ও গোলযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠার ফলে ইসলামের নব নির্মিত প্রাসাদটি আকস্মিকভাবে নড়ে ওঠে। ৯ হিজরীর এ সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণার মাধ্যমে যদি শিরকের সংগঠিত শক্তিকে খতম করে না দেয়া হতো এবং সারাদেশে ইতিমধ্যে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতা প্রধান্য বিস্তার না করতো, তাহলে হযরত আবু বকর (রা.) খিলাফত আমলের শুরুতেই মুরতাদ হওয়ার যে হিড়িক লেগে গিয়েছিল তার চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশী শক্তি নিয়ে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডব শুরু হয়ে যেতো। এ অবস্থায় ইসলামের ইতিহাসের চেহারাই হয়তো সম্পূর্ণ পাল্টে যেতো।
* এ ঘোষণাটি হয়েছিল ৯ হিজরীর যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে। নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য এ সময় থেকে ১০ হিজরী ১০ রবিউল সানী পর্যন্ত ৪ মাসের অবকাশ তাদেরকে দেয়া হয়। তারা যুদ্ধ করতে চাইলে যুদ্ধ করার জন্য তৈরী হোক। দেশ ত্যাগ করতে চাইলে এ সময়ের মধ্যে নিজেদের আশ্রয়স্থল খুঁজে নিক। আর যদি ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তাহলে স্থির মস্তিস্কে ভেবে-চিন্তে তা গ্রহণ করুক।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura At-Tawbah
Sura:09
Verses :- 01-02
بَرَآءَۃٌ مِّنَ اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖۤ
Freedom from (all) obligations (is declared) from Allah and His Messenger..
Why there is no Basmalah in the Beginning of This Surah
This honorable Surah was one of the last Surahs to be revealed to the Messenger of Allah.
Al-Bukhari recorded that Al-Bara’ said,
“The last Ayah to be revealed was,
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِى الْكَلَـلَةِ
(They ask you for a legal verdict. Say:”Allah directs (thus) about Al-Kalalah.” (4:176), while the last Surah to be revealed was Bara’ah.”
The Basmalah was not mentioned in the beginning of this Surah because the Companions did not write it in the complete copy of the Qur’an (Mushaf) they collected, following the Commander of the faithful, Uthman bin Affan, may Allah be pleased with him.
The first part of this honorable Surah was revealed to the Messenger of Allah when he returned from the battle of Tabuk, during the Hajj season, which the Prophet thought about attending. But he remembered that the idolators would still attend that Hajj, as was usual in past years, and that they perform Tawaf around the House while naked. He disliked to associate with them and sent Abu Bakr As-Siddiq, may Allah be pleased with him, to lead Hajj that year and show the people their rituals, commanding him to inform the idolators that they would not be allowed to participate in Hajj after that season. He commanded him to proclaim,
بَرَاءةٌ مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِه
(Freedom from (all) obligations (is declared) from Allah and His Messenger…), to the people.
When Abu Bakr had left, the Messenger sent Ali bin Abu Talib to be the one to deliver this news to the idolators on behalf of the Messenger, for he was the Messenger’s cousin. We will mention this story later.
Publicizing the Disavowal of the Idolators
Allah said,
بَرَاءةٌ مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ
Freedom from obligations from Allah and His Messenger,
is a declaration of freedom from all obligations from Allah and His Messenger,
إِلَى الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ
فَسِيحُواْ فِي الَارْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ
to those of the Mushrikin, with whom you made a treaty. So travel freely (Mushrikin) for four months (as you will) throughout the land,
This Ayah refers to idolators who had indefinite treaties and those, whose treaties with Muslims ended in less than four months. The terms of these treaties were restricted to four months only. As for those whose term of peace ended at a specific date later (than the four months), then their treaties would end when their terms ended, no matter how long afterwards, for Allah said,
فَأَتِمُّواْ إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَى مُدَّتِهِمْ
(So fulfill their treaty for them until the end of their term). (9:4)
So whoever had a covenant with Allah’s Messenger then it would last until its period expired, this was reported from Muhammad bin Ka`b Al-Qurazi and others.
We will also mention a Hadith on this matter. Abu Ma`shar Al-Madani said that Muhammad bin Ka`b Al-Qurazi and several others said,
“The Messenger of Allah sent Abu Bakr to lead the Hajj rituals on the ninth year (of Hijrah). He also sent Ali bin Abi Talib with thirty or forty Ayat from Bara’ah (At-Tawbah), and he recited them to the people, giving the idolators four months during which they freely move about in the land. He recited these Ayat on the day of Arafah (ninth of Dhul-Hijjah). The idolators were given twenty more days (till the end) of Dhul-Hijjah, Muharram, Safar, Rabi Al-Awwal and ten days from Rabi Ath-Thani.
He proclaimed to them in their camping areas, `No Mushrik will be allowed to perform Hajj after this year, nor a naked person to perform Tawaf around the House.”‘
So Allah said,
وَاعْلَمُواْ أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللّهِ وَأَنَّ اللّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ
but know that you cannot escape (from the punishment of) Allah; and Allah will disgrace the disbelievers
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
১-২ নং আয়াতের তাফসীর:
এই সম্মানিত সূরাটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর নাযিলকৃত সর্বশেষ সূরা । সহীহ বুখারীতে বারা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সর্বশেষ আয়াত হচ্ছে- (আরবী) (৪:১৭৬) এই আয়াতটি এবং সর্বশেষ সূরা হচ্ছে সূরায়ে বারাআত। (ইমাম বুখারী (রঃ) এটাকে বারা ইবনে আযিব (রাঃ) হতে তাখরীজ করেছেন) এই সূরার প্রথমে বিসমিল্লাহ লিখিত না থাকার কারণ এই যে, সাহাবীগণ আমীরুল মুমিনীন উসমান ইবনে আফফান (রাঃ)-কে অনুকরণ করে কুরআনে এই সূরার পূর্বে বিসমিল্লাহ লিখেননি। সুনানে তিরমিযীতে রয়েছে যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ) উসমান (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি (আরবী)-এর অন্তর্ভুক্ত সূরায়ে আনফালকে (আরবী)-এর অন্তর্ভুক্ত সূরায়ে বারাআতের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন এবং এ দু’টির মাঝে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখেননি, আর এটাকে সাতটি দীর্ঘ সূরার মধ্যে রেখেছেন, এর কারণ কি?” উসমান (রাঃ) উত্তরে বলেন, কোন কোন সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর একই সাথে কয়েকটি সূরা অবতীর্ণ হতো। যখন কোন আয়াত অবতীর্ণ হতো তখন তিনি লেখকদের কাউকে ডেকে বলতেনঃ “এই আয়াতটিকে অমুক সূরার মধ্যে রেখে দাও যার মধ্যে এর বর্ণনা রয়েছে।” মদীনায় সর্বপ্রথম সূরায়ে আনফাল অবতীর্ণ হয়েছিল এবং সর্বশেষে অবতীর্ণ হয়েছিল সূরায়ে বারাআত। বর্ণনায় এ দুটো সূরার মধ্যে মিল ছিল। তাই আমি ভয় পেলাম যে, না জানি এটা হয়তো সূরায়ে আনফালেরই অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইনতিকাল হয়ে গেল এবং এ সূরাটি সূরায়ে আনফালের অন্তর্ভুক্ত কি-না তা তিনি বলে গেলেন না। এ জন্যেই আমি দু’টি সূরাকে মিলিতভাবে লিখেছি এবং মধ্যখানে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” লিখিনি। আর এটাকে সাতটি দীর্ঘ সূরার মধ্যে রেখেছি। এই সূরার প্রথম অংশ ঐ সময় অবতীর্ণ হয় যখন নবী (সঃ) তাবূকের যুদ্ধ হতে ফিরে আসছিলেন। ওটা হজ্বের মওসুম ছিল। মুশরিকরা নিজেদের অভ্যাস মত হজ্ব করতে এসে উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহ শরীফের চারদিকে তাওয়াফ করতো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের সাথে মিলিত হতে অপছন্দ করে আবু বকর (রাঃ)-কে ঐ বছর হজ্বের ইমাম বানিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা করান, যেন তিনি মুসলিমদেরকে হজ্বের আহকাম শিক্ষা দেন এবং মুশরিকদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন যে, তারা যেন আগামী বছর হজ্ব করতে না আসে। আর জনসাধারণের মধ্যে তিনি যেন সূরা বারাআতেরও ঘোষণা শুনিয়ে দেন। তাঁর পিছনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আলী (রাঃ)-কেও পাঠিয়ে দেন যে, তার নিকটতম আত্মীয় হিসেবে তিনিও যেন তাঁর পয়গাম পৌঁছিয়ে দেন। এর বিস্তারিত বর্ণনা ইনশাআল্লাহ আসছে।
ঘোষণা হচ্ছে- “এটা হচ্ছে সম্পর্ক ছিন্নতা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর পক্ষ হতে। কেউ কেউ বলেন যে, এই ঘোষণা ঐ চুক্তি ও অঙ্গীকার সম্পর্কে, যার জন্যে কোন সময় নির্দিষ্ট ছিল না বা যাদের সাথে চার মাসের কম সময়ের জন্যে চুক্তি ছিল। কিন্তু যাদের সাথে চুক্তির মেয়াদ দীর্ঘ ছিল ওটা যথা নিয়মে বাকী থেকে যায়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা তাদের অঙ্গীকার বা চুক্তি তাদের মেয়াদ পর্যন্ত পূর্ণ কর।” (৯:৪) হাদীস শরীফেও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাদের সাথে যাদের সন্ধি বা চুক্তি রয়েছে, আমরা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ঐ চুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবো।” এই ব্যাপারে আরো উক্তি রয়েছে। কিন্তু এই উক্তিটিই সবচেয়ে বেশী উত্তম ও দৃঢ়। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যাদের সাথে চুক্তি হয়েছিল, আল্লাহ তাআলা তাদের জন্যে চার মাসের সীমা নির্ধারণ করে দেন। আর যাদের সাথে চুক্তি ছিল না তাদের জন্যে হারাম মাসগুলো অতিক্রান্ত হওয়াকে সীমা নির্ধারণ করেন। অর্থাৎ ১০ই যিলহজ্ব হতে মুহররম মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত পঞ্চাশ দিন। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তাদের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয় যে পর্যন্ত না তারা ইসলাম গ্রহণ করে। আর যাদের সাথে চুক্তি রয়েছে তারা ১০ই যিলহজ্ব ঘোষণার দিন থেকে নিয়ে ২০শে রবিউল আখির পর্যন্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। অতঃপর ইচ্ছা করলে মুকাবিলা করবে। এটা হচ্ছে নবম হিজরীর ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবূ বকর (রাঃ)-কে হজ্বের আমীর নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন এবং আলী (রাঃ)-কে কুরআনের এই সূরাটির ত্রিশটি অথবা চল্লিশটি আয়াতসহ পাঠিয়ে দেন যে, তিনি যেন চার মাসের মেয়াদের ঘোষণা করেন। তিনি তাদের তাঁবুতে, ঘরে এবং মনজিলে গিয়ে গিয়ে এ আয়াতগুলো তাদেরকে শুনিয়ে দেন। সাথে সাথে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ নির্দেশও শুনিয়ে দেন যে, এ বছরের পর কোন মুশরিক যেন হজ্ব করতে না আসে এবং কোন উলঙ্গ ব্যক্তি যেন বায়তুল্লাহ তাওয়াফ না করে। খুযাআ’ গোত্র, মুদলিজ কবিলা এবং অন্যান্য সকল গোত্রের জন্যেও এই ঘোষণাই বলবৎ ছিল। তাবুক থেকে প্রত্যাবর্তন করে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হজ্ব করার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে মুশরিকদের আগমন ও উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফকরণ তার নিকট অপছন্দনীয় ছিল। এই জন্যে তিনি হজ্ব করলেন না এবং ঐ বছর আবু বকর (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। তাঁরা যিল মাজাযের বাজারসমূহে প্রত্যেক অলিতে-গলিতে, প্রত্যেক তাঁবুতে এবং মাঠে ময়দানে ঘোষণা করে দেন যে, চার মাস পর্যন্ত মুশরিকদেরকে অবকাশ দেয়া হলো, এর পরেই মুসলিমদের তরবারী তাদের উপর আঘাত হানবে। ঐ চার মাস হচ্ছে যিলহজ্ব মাসের বিশ দিন, মুহররম, সফর ও রবিউল আওয়াল এই তিন মাস পুরো এবং রবিউল আখির মাসের ১০ দিন। যুহরী (রঃ) বলেন যে, শাওয়াল থেকে মুহররম মাস পর্যন্ত অবকাশ ছিল। কিন্তু এই উক্তিটি গারীব বা দুর্বল এবং এটা মনেও ধরে না যে, হুকুম পৌছার পূর্বেই মেয়াদের গণনা কিভাবে হতে পারে?
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] মক্কা বিজয়ের পর ৯ হিজরীতে রসূল (সাঃ) আবু বাকর, আলী এবং অন্যান্য সাহাবা (রাঃ)গণকে কুরআনের এই আয়াতসমূহ ও বিধান দিয়ে মক্কা পাঠালেন, যাতে তাঁরা তা প্রকাশ্যভাবে।
*. এই সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা সেই মুশরিকদের জন্য ছিল, যাদের সাথে স্থায়ী চুক্তি ছিল। অথবা চার মাস থেকে কম ছিল। অথবা চার মাস থেকে বেশী একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছিল। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে চুক্তি রক্ষার কোন আগ্রহ ছিল না। তাদেরকে চার মাস মক্কায় থাকার অনুমতি দেওয়া হল। এর মানে হল যে, সেই সময়ের মধ্যে যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে নেয়, তাহলে তাদের জন্য এখানে থাকার অনুমতি হবে। অন্যথা তাদের জন্য জরুরী হবে যে, তারা চার মাস পর আরব উপদ্বীপ থেকে বের হয়ে যাবে। অতঃপর যদি উভয় এখতিয়ারের মধ্যে কোন একটা গ্রহণ না করে, তাহলে তাদেরকে জঙ্গী কাফের বলে গণ্য করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের জন্য লড়াই জরুরী হবে; যাতে আরব দেশ কুফর ও শিরকমুক্ত হতে পারে।
[২] অর্থাৎ, এই অবকাশ এই জন্য দেওয়া হয়নি যে, এখন তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ সম্ভব নয়; বরং এতে তোমাদের কল্যাণই উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি এর মধ্যে তাওবাহ করে মুসলিম হতে চাইবে, সে মুসলিম হয়ে যাবে। নতুবা জেনে রাখ তোমাদের ব্যাপারে আল্লাহর যে সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছা রয়েছে তা তোমরা কোনক্রমেই ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অবধারিত লাঞ্ছনা ও অপমান থেকে পরিত্রাণ পেতে পারবে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
নামকরণ ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা:
মুফাসসিরগণ এ সূরাটির একাধিক নাম বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে দু’টি নাম প্রসিদ্ধ:
১. তাওবাহ: এ সূরাতে কয়েকজন সাহাবীর তাওবাহ কবূলের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, তাই একে তাওবাহ বলা হয়।
২. বারাআহ: একে বারাআহ বলা হয় এজন্য যে, এতে মুশরিকদের সাথে মুসলিমদের সাধারণভাবে বারাআহ বা সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে এবং সূরার প্রথম শব্দটিও বারাআহ।
এটা কুরআন মাজীদের একমাত্র সূরা যার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ নেই। এ ব্যাপারে ইমাম কুরতুবী (রাঃ) পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তন্মেধ্যে:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি উসমান (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী কারণে সূরা আনফালকে সূরা বারাআহর সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন? (অথচ সূরা আনফাল مثاني তথা একশত এর কম আয়াতবিশিষ্ট সূরা আর বারাআহ একশত এর বেশি আয়াতবিশিষ্ট সূরা) এবং উভয়ের মাঝে বিসমিল্লাহ লেখেননি, অনুরূপ এটাকে সাতটি দীর্ঘ সূরার মধ্যে শামিল করেছেন। উসমান (রাঃ) বলেন: কোন কোন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওপর অনেক আয়াতবিশিষ্ট কয়েকটি সূরা অবতীর্ণ হত। যখন আয়াত অবতীর্ণ হত তখন তিনি লেখকদের কাউকে ডেকে বলতেন: এ আয়াতটি উমুক সূরার মধ্যে রেখে দাও যার মধ্যে এরূপ এরূপ বর্ণনা রয়েছে। সূরা আনফাল মদীনায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর মধ্যে প্রথম দিকের অন্যতম একটি, আর সূরা বারাআহ সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। উভয় সূরার ঘটনা সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই আমি মনে করেছি সূরা বারাআহ আনফালের অন্তর্ভুক্ত। আর এ অবস্থাতেই নাবী (সাঃ) মারা গেলেন কিন্তু এ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করে যাননি। এ কারণে আমি দুটি সূরাকে মিলিয়ে দিয়েছি; মাঝে বিসমিল্লাহ লেখিনি। আর এটাকে সাতটি দীর্ঘ সূরার মধ্যে শামিল করে দিয়েছি। (তিরমিযী হা: ৩০৮৬, আবূ দাঊদ হা: ৭৮৬, হাকিম: ২/৩৩০, ইমাম হাকিম বলেন: সনদ সহীহ)
ইমাম ইবনু কাসীর (রাঃ) বলেন: এ সূরার প্রথম অংশ ঐ সময় অবতীর্ণ হয় যখন নাবী (সাঃ) তাবূকের যুদ্ধ হতে ফিরে আসছিলেন। তখন হাজ্জের মওসুম ছিল। মুশরিকরা নিজেদের অভ্যাস মত হাজ্জ করতে এসে উলঙ্গ অবস্থায় বায়তুল্লাহর চারদিকে তাওয়াফ করত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সাথে মিলিত হতে অপছন্দ করতেন, তাই আবূ বাকর (রাঃ)-কে ঐ বছর হাজ্জের ইমাম বানিয়ে মক্কা অভিমুখে প্রেরণ করেন। মানুষকে হাজ্জের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেয়ার এবং মুশরিকদের মাঝে এ ঘোষণা দেয়ার জন্য যে, এ বছরের পর থেকে কোন মুশরিক হাজ্জ করতে পারবে না। তখন তিনি জনগণের মাঝে সূরা বারাআহ তেলাওয়াত করে শুনালেন। (ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সাহাবী বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন:
أَخِرُ سُوْرَةٍ نَزَلَتْ بَرَاءَةٌ
সূরা বারাআহ সর্বশেষ অবতীর্ণ হওয়া সূরা। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৫৪) যখন সূরা তাওবাহ নাযিল হল তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে চারটি নির্দেশ দিয়ে মক্কায় প্রেরণ করলেন।
১. কেউ উলঙ্গ অবস্থায় কাবা তাওয়াফ করতে পারবে না।
২. এ বছরের পর কোন মুশরিক বাইতুল্লাহর নিকটে আসতে পারবে না।
৩. কোন ব্যক্তি ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাঝে যদি কোন অঙ্গীকার থাকে তাহলে তা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে।
৪. মু’মিন ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
১-২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে এটা সেই সকল মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা যাদের সাথে স্থায়ী অথবা চার মাসের কম অথবা চার মাসের বেশি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুক্তি ছিল। এখন মুশরিকদের থেকে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পূর্ণ মুক্ত। অতএব হে মুশরিকরা! তোমরা চার মাস (শাওয়াল, যুলকাদা, যুলহাজ্জ ও মুহাররাম) যেথায় ইচ্ছা ঘুরে বেড়াও তাতে মুসলিমদের থেকে পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। চার মাস পর কোন অঙ্গীকার থাকবে না, কোন প্রতিশ্র“তিও থাকবে না।
(يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ)
‘মহান হাজ্জের দিবসে’ মহান হাজ্জের দিন বলতে দশই যিলহাজ্জকে বুঝানো হয়েছে। এ দিনে মিনাতে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা শুনানো হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৫৫, সহীহ মুসলিম হা: ৯৮২, তিরমিযী হা: ৯৫৭)
দশই যিলহাজ্জকে বড় হাজ্জের দিন বলার কারণ হল, এ দিনে হাজ্জের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সম্পন্ন করা হয়। মানুষের মাঝে প্রচলন আছে যে, জুমুআর দিন আরাফা হলে ঐ হাজ্জকে বড় হাজ্জ বা হাজ্জে আকবার বলা হয়, এরূপ কথা ভিত্তিহীন। মূলত বড় হাজ্জ দ্বারা হাজ্জকে বুঝানো হয়েছে, যেহেতু উমরাকে ছোট হাজ্জ বলা হয়।
(إِلا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ)
‘তবে মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ’ অর্থাৎ পূর্বের বিধান থেকে ঐ সকল মুশরিকরা আলাদা যারা নির্দিষ্ট মেয়াদে চুক্তিবদ্ধ আর তোমাদের সাথে খিয়ানত করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে শত্রুদের সহযোগিতাও করেনি। তাহলে তাদের সাথে মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ কর।
(فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ)
‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে’এখানে হারাম মাস বলতে কোন্ মাসকে বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়।
আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: যে মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম। তাহল যুলক্বা‘দাহ, যুলহাজ্জ, মুহাররাম ও রজব। প্রবীণ মুফাসসিরদের মধ্যে ইমাম ইবনু কাসীর (রাঃ)ও এ মত পোষণ করেছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সাধারণভাবে অমুসলিমদের সাথে কোন মুসলিমের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে ইসলামের স্বার্থে মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে চুক্তি করা বৈধ।
২. নির্দিষ্ট মেয়াদে সম্পাদিত চুক্তিগুলো যথাযথভাবে পূর্ণ করা আবশ্যক।
৩. দশই যিলহাজ্জকে হাজ্জে আকবার বলা হয়।